পঁচিশতম অধ্যায়
সাদাতের হত্যা এবং ইখওয়ান
জনসাধারণ জানতে চায় সাদাতের হত্যাকান্ডে ইখওয়ান সমর্থিত দ্বীনি ব্যক্তির সংগঠনকেই এ হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী বলে মনে করে থাকে। আপনি যাদি পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেন তাহলে এ উক্তি ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং আদালতের ফায়সালা ছাড়াই রায় প্রদান করার নামান্তর প্রতীয়মান হবে।
আমি মনে করি শোনা কথা বলে বেড়ানো এবং মনগড়া গুজব প্রচারের পরিবর্তে এ ব্যাপারে ইখওয়ানের ভূমিকা তাদের মুখ থেকেই শোনা উচিত। ইনসাফের দাবী হচ্ছে এই যে, আমাদের থেকে এ পরিস্থিতি এবং এ হত্যাকান্ডের ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা কি তা জেনে নেয়া। আমি সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে বর্ণিত স্বল্প পরিসরে কয়েকটি লাইনে এ ব্যাপারে ইখওয়ানের ভূমিকা তুলে ধরছিঃ
১- এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত পরই গণপ্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জনব মুহাম্মাদ হোসনী মোবারক সুস্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেন যে, ঘটনার সাথে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কোন সম্পর্ক নেই। দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তির সুস্পষ্ট ঘোষণার পর সকল প্রকার গুজব বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। রাষ্ট্রপতি নিশ্চিতভাবেই সম্পুর্ণ তথ্যানুসন্ধান এবং আভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাসমূহের রিপোর্ট পর্যালোচনা করার পরই এরূপ মন্তব্য করেছেন।
২- সাবেক স্বরা্ষ্ট্র মন্ত্রী হাসান আবু পাশাও সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, সন্ত্রাসীচক্র ইখওয়ানের কোন সহযোগিতা অবশ্যই পায়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃংখলারন নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্বে থাকেন। তার নিকটই থাকে সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য। তারপরও একথা কিভাবে বলা যেতে পারে যে, সাদাতের হত্যাকারীর ইখওয়ানের সাহায্য লাভ করেছিলো।
৩- সাদাত শুধু ইখওয়ানদেরই বন্দী করেছিল না। বরং ওয়াভদ পার্টি, হিয্বে আমলা, তাজাম্মু পার্টি এমন কি সাদাতের সমালোচনাকারী মসজিদের খতিবগণকেও কারগারে বন্দী করা হয়েছিলো। ফলে সাদাতর বিরুদ্ধে এ সমস্ত দলের সদস্যগণ ক্রোধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলো্ তারপরও এ দুর্ঘটনার দায় দায়িত্বের বোঝা একা ইখওয়ানের ওপর কেন চাপানো হচ্ছে? মসজিদের একজন খতিব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সাদাতের এরূপ খেদোক্তি প্রকাশ করা যে, সে এখন জেলখানায় কুকুরের ন্যায় পড়ে আছে। এদিক থেকে সাদাত তখন সমগ্র পৃথিবীর মুসলমানদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলেন।
৪-আমাদের বিশেষ ব্যবস্থা যার নামে আমাদের ওপর এ অভিযোগ চাপানো হচ্ছে তা বিগত ত্রিশ বছর থেকে বাতিল হয়ে রয়েছে। জামাল আবদুন নাসের সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর সংগঠনের সমস্ত সদস্য বিশেষত বিশেষ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত ইখওয়ানদেরকে বর্ণনাতীত অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়। বিশেষ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ দায়িত্বশীলদেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর হাঠাৎ এই ব্যবস্থার সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ কিভাবে আত্মপ্রকাশ করে বসে? কবে এবং কোথায় তারা পরিকল্পনা করেছে আর কথিত সে ষড়যন্ত্রকে বাস্তবে রূপদানের উদ্যোগও গ্রগণ করে ফেলে?
৫- একথাও বেশ শোনা যায় যে, গুলি সম্মুখের পরিবর্তে পাশ্চাত দিক থেকে চালানো হয়েছিলো। পোষ্টমর্টেমেও প্রমাণিত হয় যে, গুলি লেগেছিলো পেছন থেকে। আমি এটা তো বলছি না যে, এসব জনশ্রুতি পুরোটাই সত্য হবে। কিন্তু তারপরও এটা জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রসংগত এ প্রবাদবাক্যও স্মরণ রাখা উচিত যে, আগুনের অস্তিত্ব ব্যতীত ধোঁয়া নির্গত হয় না।
বিশ্লেষণ ও গুজব
কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি তো এমন উক্তিও করেছেন যে, সাদাতকে তার উপদেষ্টা এবং অকল্যাণকামীগণই হত্যা করেছেন। আমার ধারণা আমি ইতিপূর্বে সাদাতের ব্যাপারে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দৃষ্টিভংগী বর্ণনা করেছি। তিনি আমাদেরকে জেল থেকে মুক্তি প্রদান করেছিলেন এবং চলাফেরার ও দ্বীনি মাহফিল অনুষ্ঠানের জন্য বেশ কিছুটা স্বধীনতা দিয়েছিলেন। এটা ছিল একটা ইতিবাচক পরিবর্তন্ যার ফলে ইখওয়ান কিছুটা আনন্দ প্রকাশ এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।
কোন কোন পর্যালোচকের বিশ্লেষণ এও যে, সাদাত গোড়ার দিকে ইখওয়ানের সাথে এ সদাচরণ শুধুমাত্র মার্কসাবাদী তরঙ্গতে প্রতিহত করার এবং কমিউনিষ্টদের উৎখাত করার জন্যই করেছিলেন। এভাবে তিনি জনসাধারণের সমর্থন লাভ করতে চাচ্ছিলেন। তা না হলে তার নিয়ত কিন্তু ভাল ছির না। তারা তাদের মন্তব্যের স্বপক্ষে এ যুক্তি পেশ করে থাকেন যে, সাদাত যদি সত্যিই সরল মনে করতেন তাহলে ইখওয়ানের ওপর থেকে আইনগত বিধি- বিষেধ প্রত্যাহার করে নিতেন এবং তাদের কেন্দ্রীয় অফিস ও বাজেয়াপ্তকৃত সহায় সম্পত্তি ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু তিনি এগুলোর মধ্যে কোন একটা কাজও করেননি। বরং প্রায়শই ধর্ম ব্যবসার কথা বলে কঠোর সমালোচনা করতেন এবং তার কথায় ইংগীত থাকতো ইখওয়ানের প্রতিই। আইনগতভবে ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ করে রাখার জন্য এবং তাদের তাওয়াতী কার্যক্রমের পথ বন্ধ করার লক্ষ্যে তিনি রাজনৈতিক দল বিষয়ক আইনকে বিস্তারিতভাবে দাফাবন্দী করেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহকে অৎপরতার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হলেও ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়।
আমার এসব গুজবে কান দেই না। কেননা আমার মানষের বুক চিরে তাদের অন্তরের খবর তো আর জানতে পারি না। এ ব্যাপারটি পুরোপুরি আল্লাহ তায়ালার ইখতিয়ারে। সাদাত তাঁর শাসনামলের শেষের দিকে ইখওয়ানের ওপর খুব দুর্ঘটনার পূর্বে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ দারুল ইখওয়ানে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চালায়। সেদিন থেকেই আমাদের সম্মুখে এ সত্য উদ্ভাসিত হয়ে পড়েছিল যে, সাদাত সাহেবের দৃষ্টিভংগী পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও আমরা যতদূর সম্ভব ভাল ধারণা নিয়েই কাজ করে যেতে চাই। আমাদের সামনে কুরআন মজীদের এ আয়াত সর্বদাই দিকনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে থাকেঃ (………….) আমাদের এ কর্মনীতি কেবলমাত্র সাদাতের বেলাতেই নয় বরং আমাদের কোন কোন সম্মানিত বন্ধু যারা এক সময় ইখওয়ানেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এমন কি ইখওয়ানের বিরুদ্ধে জামাল আবদুন নাসেরের সহযোগিতা করেছেন তাদের বেলায়ও। এরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো আর সে ওদের পিঠ চাপড়িয়ে বাহবা দিয়েছেন। আমরা তাদের সম্পর্কেও কখনো কোন খারাপ শব্দ মুখ থেকে উচ্চারণ করি না। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদেরকেও। তারা ভাল করেই জানতো এবং আমাদেরও জানা আছে যে, নাসেরের যেসব গুণাবলীর উল্লেখ করা হতো এবং আমাদের ওপর যে কাদা ছোঁড়া হতো তাতে সত্যের লেশ মাত্র ছিল না।
আমার পথ ধনীর পথ নয় দারিদ্রের
আমার মনে হয় আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করে এসেছি যে, ১৯৭৯ সালে ইসমা- ঈলীয়াতে “আল ফিকরুল ইসলামী” বিষয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে সাদাতের সাথে আামার সাক্ষাত হয়। তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী জনাব মনসূর হাসানের ঐকান্তিক আগ্রগ ছিল যেন এ সেমিনারে সমস্ত দ্বীনি জামায়াত অংশগ্রহণ করে। তিনি এ ব্যাপারে সাদাতের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেন যাতে আমাকেরও আমন্ত্রণ জানানো যায়। মন্ত্রী মহোদয় একান্তভাবে কামনা করছিলেন যেন ইখওয়ান ও সাদাতের মধ্যেকার ভুল বুঝাবুঝি দর করে ঘনিষ্ঠতা ও সখ্যতা সৃষ্টি করে দেয়া যায়। তাঁর কি জানা ছিল যে, সাদাত সাহের আমার সাথে মিলিত হয়ে কি খেল খেলবেন? এ সাক্ষাতকারের ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আমার এমন কোন আগ্রহই ছিল না যে, রাষ্ট্রপতির সাথে আমর সাক্ষাত হোক আর সেজন্য কোন তদবিরও আমি করিনি। আমি শুধুমাত্র আমার রবের সন্তুষ্টি লাভের অভিলাষী। যদি তিনি আমার প্রতি রাজী থাকেন তাহলে দুনিয়ার যে কোন ব[ থেকে বড় জিনিসও আমার নিকট কোন গুরুত্বই বহন করে না।
এ ব্যাপারে আমি আমার রচিত গ্রন্থ “আইয়াম মা’আস্সাদাত” এ উক্ত সাক্ষাতের বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছি। ২৬ শে রমযানের রাতে যখন সংস্কৃতি ও তথ্য বিষয়ক মন্ত্রী সাইয়েদ মনসুর হাসান আমার সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানান যে, আমি যেন তার দফতরে তার সাথে সক্ষাত করি। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য যখন গমন করি তখন ভ্রাতৃপ্রতীম আলহাজ্জ আহমদ হাসনাইন (আদ দাওয়া সাময়িকীর সার্কুলেশন ম্যানেজার) ছিলেন আমার সাথে। মন্ত্রী মহোদয়ের সংগে এ সাক্ষাতকার রাত সোয়া নয়টায় গুরু হয়ে সাড়ে এগারাটায় শেষ হয়। তিনি আমাকে সেমিনারে যোগদান করার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে থাকেন এবং আমি অসম্মতি জ্ঞাপন করতে থাকি। কেননা আমি সাতাদের অহংকার এবং জনগণের মোকাবিলায় মিথ্যা ঔদ্ধত্য সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। সাদাত জনসাধারণের সাথে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের আচরণ করেতেন। আমার কাছে এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ছিল যে, কোন ব্যক্তি আমার ওপর তার প্রভাব বিস্তার করবেন, তার মর্যাদা ও অবস্থান যত উঁচুই হোক না কেন! আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাব্বুল আলামীন ছাড়া আর কারো সামনে হস্ত প্রসারিত করতে চাই না। কিংবা মহাসম্মানিত আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অপর কারো নিকট মস্তকাবনত করতে চাই না। যে মহান সত্তার সমস্ত সৃষ্টিজগতের নিরংকুশ কর্তৃত্ব তাঁকে ব্যতীত আর কাউকে আমি ভয় করি না। সৃষ্টি-কুলের কেউই কারো কোন ক্ষতি করতে পারে না। যদিও সে নিজে নিজেকে অনেক শক্তিধর ও ক্ষমতার অধিকারী মনে করে এবং মানুষও তার শক্তিকে ভয় করে থাকে।
মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আলোচনা দীর্ঘস্থয়ী হয়। আমার ক্রমাগত অস্বীকৃতির পরও তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ জানাতে থাকেন। তখন অগত্যা রক্ষা পাওয়ার জন্য আমি তাঁকে বললাম। ঠিক আছে আমি আপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করছি। কিন্তু আমি সেমিনারে অংশগ্রহণ করবো না। উজির মহোদয় বললেন, ঠিক আছে আমি এতই সন্তুষ্ট যে, আপনি দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, দাওয়াত কবুল করার পর আমি অবশ্যই আমার অংগীকার পালন করবো। অতএব এতটুকু কথার পর আমি সেখান থেকে চলে আসি।
সাদাতের বক্তৃতা
আমার কল্পনারও অতীত ছিল যে, সাদাত আমার সাথে সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লামের পরিপন্থী কোন অপ্রিয় অযৌক্তিক ভংগীতে কথা বলবেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এর অত্যন্ত সুস্পষ্ট নির্দেশ হচ্ছে, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে হবে। আমি ছিলাম সাদাতের পিতা কিংবা তদপেক্ষাও বয়সে প্রবীণ। সাদাতের মাথায় তখন ক্ষমতার ভূত সওয়ার হয়েছিল। সে মনে করছিল যে, সে যাচ্ছেতাই বলে বেড়াবে কেউ তার কথার প্রতিবাদ করার মত নেই। কিন্তু আমি ফলাফল ও পরিণতির ব্যাপারে একবারেই বেপরোয়া। তাঁর অভদ্র ও অশালীন কথাবার্তা শুনে নীরবে বসে থাকতে পারি না। যা কিছু ঘটে গেলো তা সে কস্মিন কালেও কল্পনা করেনি। কিংবা তার তল্পীবাহী সহযোগীরা কোনদিন ভাবতেও পারেনি। ২৮শে রমযান রাতে আমি কায়রো থেকে ভ্রাতৃপ্রতীম আলহাজ্জ মোস্তাফা মাশহুর এবং ডাক্তার আবদুল আযীম আল মাতআনী সমভিব্যাহারে ইসমাঈলিয়ার দিকে রওয়ানা হই। সম্মেলন স্থলে গিয়ে আমি পশ্চাৎদিকের সারিতে বসে পড়ি। কয়েক মুহূর্ত পর প্রটোকল অফিসার আমার নিকট আগমন করেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রথম সারিতে গিয়ে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান। আমি মনে করলাম হয়তো সে আমার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং পারস্পরিক বুঝাপড়ার সুবিধার্থে আমাকে সম্মুখের সারিতে নিয়ে বসাতে চাচ্ছে। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে সামনের সারিত চলে যাই। পরক্ষণে আমি বুঝতে পারি যে, এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। আমাকে সামনে নিয়ে বসানো কোন আন্তরিকতার ভিত্তিতে ছিল না। যে আসনে আামকে বসানো হয় সেখান থেকে মঞ্চের দিকে যদি কোন সরল রেখা টানা হতো তাহলে তা সোজা সেই আসন পর্যন্ত চলে যেতো যার ওপর সাদাত সমাসীন ছিল। সম্ভবত আমাকে এজন্য সাদাতের নিকটতম আসনে বসানো হয়েছিলো যেন তার অভিযোগ ও দোষারোপের লক্ষ্য বস্তু বানানোর জন্য আমাকে খুঁজে বের করতে কোন বেগ পেতে না হয়। মুহতারাম রাষ্ট্রপতি ভাষণ দিতে শুরু করলেন। তাঁর রক্তব্যের মূল বিষয় ছিল আমার ওপর অবান্তর অভিযোগের বৃষ্টি বর্ষণ করা। মহাত্মন আমার দক্ষিণ ও বাম এবং সম্মুখ ও পশ্চাত সব দিক থেকে তীর বর্ষণ করতে লাগলেন।
আমার ও ইখওয়ানের ওপর অগণিত আক্রমণ করা হলো। ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড, বিদেশীদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা, ছত্রদের হাংগামা সৃষ্টিতে উস্কানি দান এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য আমাদেরকেই দায়ী করা হয়। পরিবেশ ছিল অতিরঞ্জন ও উচ্ছাসপূর্ণ। ইসমাঈলিয়ার সবুজ শ্যামল গাছপালার ডালে ডালে সবুজের মনোলোভা সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ছিলো। ঘনছায়া ও পাখীর কলকাকলী অদ্ভূত পরিবশে সৃষ্টি করে রেখেছিল। এই নীরবতা ভংগকারী পরিবেশে সাদাত সাহেব পংখীরাজ ঘোড়ার সওয়ার হয়ে বাগ্মিতা এবং কবিতা ও কাব্যের হক আদায় করছিলেন।
ধৈর্যর শেষ সীমা
গালমন্দ ও অশালীন কথাবার্তা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলতে থাকে। ফলে ধৈর্যর পাত্র কানায় কানায় ভরে ওঠে। আরও সহ্য করার যখন কোন অবকাশ রইলো না এবং ইখওয়ানের আন্দোলনের সাথে আমার আবেগপূর্ণ সম্পর্ক আবেগাপ্লু হয়ে উঠলো তখন আমি সুবক্তার বক্তব্যে বাধা দিয়ে বললাম বক্তৃতার এই ধারা তার প্রত্যুত্তর দাবী করে। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাকে বললেন, ঠিক আছে, আমি যখন আমার কথা শেষ করবো তখন তোমাদের যা কিছু বলার ইচ্ছা বলবে………মহোদয় পুনরায় তার অবান্তর ও অপ্রাসংগিক কথাবর্তায় অতিশায়োক্তির রং মিশ্রণ করতে লাগলেন।
সাদাত সাহেবের বর্ণানাভংগীতে উপস্থিত সকলেই অস্বস্তি বোধ। করছিলেন। তিনি গালমন্দ উচ্চারণ ও দোষারোপ করার পর কথার সমাপ্তি টানছিলেন এই বলে যে, ওমর এটা কি ঠিক নয়? সমস্ত জাতি এমন কি তার কিছু কিছু সংগী সাথীও এই বাচনভংগী অপছন্দ করে। তিনি শুধু আমার নাম নিয়ে আমাকে সন্বোধন করছিলেন যা সকল প্রকার শিষ্টাচার ও শালীনতার পরিপন্থী। তিনি না আমার বার্ধক্যের প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন করেছেন না রমযানুল মোবারকের পবিত্র মাসের কোন তোয়াক্কা করছিলেন। ইউনিভারসিটি আমাকে আইনশাস্ত্রে যে ডিগ্রী দিয়েছিলো না তার প্রতি কোন বিবেচনা করা হয়, না তাঁর নিজের মর্যাদার প্রতি কোন গুরুত্ব প্রদান করে। সাদাতের নিকট তখন শিষ্টাচারের মানদন্ড এবং শালীনতার সীমা এটা বৈ আর কিছুই ছিল না যে, যা কিছু তার মনে আসে তাই সে বলে যাবে। তাঁর দৃষ্টিতে তিনি হয়তো আমাকে অত্যন্ত হীন ও নীচ দেখানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বকেই আহত করে দুর্নাম কুড়ানোর ক্ষেত্রই প্রশস্ত করছিলেন। তার বক্তৃতা দানের সময় সে এতবেশী উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল যে, শদ্বমালাও তাঁর সামনে সারিবদ্ধভাবে প্রতীক্ষমান। আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করছিলেন এবং আমাকেও। তাঁর সাহায্য এই অর্থে যে, সে যা কিছু বলতে চাচ্ছিলো তা বলার ইখতিয়ার তাকে প্রদান করা হয়েছেলো। আর আমার স্বধীনতা এই অর্থে যে, আমি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে সকল প্রকার গালিগালাজ শুনে যাচ্ছিলাম। এই ধৈর্য ও স্থৈর্যর মধ্যে আল্লাহ তায়ালার প্রত্যক্ষ সাহায্য শামিল ছিল। তাঁরই সমীপে উপযুক্ত বিনিময়ের প্রত্যাশাই আমি করছি।
কাঁপছে পাহাড় কাঁপছে তৃণভূমি ও নদীনালা
রাষ্ট্রপতির ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই আমি আমার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমার সম্মুখে না ছিল কোন লাউড স্পীকার আর না তখনো পর্য়ন্ত আমার মনে জবাবের কোন চিত্র অংকত হয়েছিলো। কিন্তু অতিশয় পবিত্র ও মহান আল্লাহ নিজেই আহলে ঈমানদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মাহফিলের ব্যবস্থাপকগণ সাথে সাথে লাউড স্পীকার আমার সামনে এনে হাজির করলো। সম্ববত তারা মনে করেছিলো যে রাষ্ট্রপতির এরূপ নির্লজ্জ ও সাঁড়াসি আক্রমণের পর আমি ক্ষমা ভিক্ষা ও অনুতাপ প্রকাশ করবো এবং একজন অনুগত তল্পীবাহকের ন্যায় সাফাই পেশ করতে লেগে যাবো। আর তাতে সদর সাহেবের অন্তর প্রশান্ত হয়ে যাবে এবং ক্রোধের পরিমাণ কমে আসবে। জনসাধারণও এরূপ ধারণা পোষণ করতে সক্ষম হবে যে, প্রেসিডেন্ট আসর মাত করে ফেলেছেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল কিছুটা ভিন্ন রকম। তাদের কোন প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি।
আমার ও ইখওয়ানের ওপর যে অপবাদ আরোপ করা হয়েছেলো এক এক করে আমি তার সবগুলোরই দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিলাম এবং আরোপিত সব অভিযোগ সম্পর্কে বলিষ্ঠ যুক্তি- প্রমাণ দ্বারা প্রমাণ করে দিলাম যে, এগুলো ডাহা মিথ্যার বেসাতি। পুরো সম্মেলন কক্ষে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিলো। আমি এই বলে আমার বক্তৃতার সমাপ্তি টেনেছিলাম যদি আপনি ছাড়া অন্য কেউ এসব অবাস্তব ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করতো তাহলে আমি আপনার কাছে নালিশ করতাম। কিন্তু আফসোস এ আপনি নিজেই হে মুহাম্মাদ! হে আনোয়ার! হে সাদাত! এসব অপবাদ আরোপ করেছেন। তাই আমি আহকামুল হাকেমীন ও আ’দালুল আদেলীন আল্লাহর পবিত্র সত্তার সমীপেই আমার মোকদ্দমা দায়ের করছি। হায়রে মানুষটি! তমি আমাকে বড়ই কষ্ট দিয়েছো। আমি তোমার মুখ থেকে যা কিছু শুনলাম তা আমাকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত শয্যাশায়ী করে রাখবে।
ঔদ্ধত্যের মোহাবিষ্ট দুর্বিনীত মস্তক অবনত হলো
আল্লাহ সাক্ষী রয়েছেন যে, সে দৃশ্য ছিল দর্শনীয়। সাদাতের ঠোঁট কাঁপছিলো এবং চেহারা বিবর্ণ হয়ে উঠছিলো। সে বললোঃ উস্তাদ ওমর আমি কখনো আপনার ব্যক্তিগত দোষত্রুটি কিংবা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের অনিষ্টকারিতা বর্ণনা করর ইচ্ছা করিনি। তাছাড়া আমার অন্তরে আপনার কিংবা সংগঠনের বিরুদ্ধে কোন বিদ্বেষও নেই। অতএব আপনি আপনার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিন।
এই সর্বপ্রথম সাদাত সাহেব আমাকে উস্তাদ বলে বন্বোধন করলেনঃ “আমি আমার অভিযোগ সেখানে পেশ করেছি যেখান থেকে তা প্রত্যাহার করে নেয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”
সম্মেলন শেষ হওয়ার পরপরই সাদাত উজীরে আওক্বাফ ডঃ আবদুল মোনায়েম আন নাসের এবং সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রী মিষ্টার মনসুর হাসানকে আমার নিকট পাঠিয়ে দেন। উভয় মন্ত্রীই তখনো যেসব লোক সেখানে কথাবার্তা বলছিলো তাদের উপস্থিতিতেই আমাকে বললেন, “মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনার সম্পর্কে কোন প্রকার খারাপ ধারণা তার অন্তরে পোষণ করেন না। আপনাকে কষ্ট দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। শীঘ্রই রাষ্ট্রপতি আপনার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হবেন।”
১৯৮১ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তারিখের ভাষণে রাষ্ট্রপতি এই ধারণা দেন যে, আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি কখনো সাক্ষাতকারের অভিলাষী ছিলাম না। এমন কোন প্রয়োজনও আমি বুঝতে পরিনি। কোন কোন লোক কেন এত নির্ভীক এবং গুনাহের ব্যাপারে এমন বেপরোয়া হয়ে যায় যে, জীবন্ত সত্যাকে ধামাচাপা দিতে গিয়েও তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে না।
আবারো জুলুমের ঝঞ্ঝা
১৯৮১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মংগলবার সকাল বেলায় সমস্ত মিসরে এক ভূতুড়ে নীরবতা নেমে আসে। যেন বিজলীর কোন ঝলক মিসরবাসীর জীবনের গতি রুদ্ধ করে দিয়েছে। অকস্মাৎ সমস্ত নীরবতা ভংগ করে সরকার জনসাধারণকে ব্যাপকভবে ধর পাকড় করতে শুরু করে। বর্তমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে এরূপ নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় যে, এখন আর কোন অত্যাচার উৎপীড়ন করা হবে না। অথচ বিগত শাসনামলে এটা খুবই মামুলী ব্যাপারে পরিণত হয়েছেলো। আপনি এমন জাতির ব্যাপারে কি ধারণা পোষণ করবেন যারা সন্ধ্যার সময় পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপদ অবস্থায় শয্যা গ্রহণ করে, তারপর মধ্যরাতে হঠাৎ পুলিশ কোন প্রকার অনুমতি ব্যতীতই তাদের গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তন্ন তন্ন করে ঘরের সমস্ত জিনিস তল্লাসী করে। বিস্মিত হতভম্ব নগরবাসীরা এই অবাঞ্ছিত ও অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করছিলো যে, তাদের সকলকেই হয়তো হাতকড়া পরিয়ে দলে দলে কারগারে নিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হবে? যে রাতের কথা আমি উল্লেখ করছি সেই রাতে প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর জেলখানার দরওয়াজায় পুলিশের এক একটা গাড়ী এস দাঁড়াতো এবং তা থেকে নিরীহ ও নিরপারাধ লোকদের নামিয়ে জেলখানার অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। অনেকের মাথায় ছিল টুপি পাগড়ী ও হ্যাট। অধিকাংশকে নাংগা মাথায়ই তাদের শয্যা থেকে পাকড়াও করে নিয়ে এসছিলো। কারো কারো পায়ে ছিল জুতা। কেই কেই আবার হওয়াই চপ্পল পরিধান কের ছিলো। পত্যেকে ছিল বিস্ময় বিমূঢ় এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত কি ঘটতে যাচ্ছে।
মিসরের ওপর কি মুসিবত নাযিল হয়েছিল, আর দেশ মাতৃকার এই সন্তানদের বর্তমানে দেশের অব্যাহত শান্তি ও নিরাপত্তা কি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল? বিভিন্ন ধরনের চিন্তা-ভাবনার অধিকারী লোকদেরকে ভেঁড়া-বকরীর মত জেলখানার কাল কুঠরীসমূহের মধ্যে বন্ধী করা হয়েছিলো। এই কয়েদীদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও সাংগঠনিক ধারণার সমন্বয় ঘটেছিল এক জায়পায়। আর তা ছিল এই যে, তারা সকলেই কার্টর, মেনাহিম বেগিন এবং হেনরি কিসিঞ্জরের ন্যায় ইসলামের কট্রর দুশমনদের পদতলে মস্তকাবনত করতে অস্বীকার করেছিলো। ক্ষমতাসীন সরকারের এই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সম্মুখে নতি স্বীকার করার পলিসি সমগ্র জাতি প্রত্যাখ্যান করেছিলো। আর এটাই ছিল একমাত্র অনুভূতি য সকল গ্রেফতারকৃতদের পরস্পরকে একই লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করেছিলো।
তুররা জেলখানার মধ্যে আামকে সাত রং সেলে ভাই ইবরাহীম সারফ এবং আরো কতিপয় ব্যক্তির সাথে বন্ধী করে রাখা হলো। তাদের কারো কারো নামই এখন আর আমার মনে নেই। কিন্তু উস্তাদ আল ক্বাজী মরহুম, ডক্টর ইসমাত সাইফুদ্দৌলা, জনাব আবুল ফজল আর জিযাভার ছেলের এবং উস্তাদ কামাল আহমদ প্রমুখের নাম আমার মনে আছে। প্রত্যেকের মুখেই ছিলো একই আলোচনা যে, এই অজ্ঞতা ও অবিবেচনা প্রসুত মহাড়া। আল্লাহ তায়ালা যিনি সকল অপরাধ ক্ষমাকারী তিনিই মিসরবাসীদেরকে হযরত আইয়ূব (আ)- এর মত ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। ফলে তারা সকল মুসিবতকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে পেরেছিলেন।
জিন্দানাখানার পুরনো মেহমান
ইখওয়ানুল মুসলিমুন সম্পর্কে আমি বাড়িয়ে বলছি না, আত্মপ্রশংসাও আমাদের নীতি নয়। আমাদের জন্য এ ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল না। ইখওয়ানের ইতিহাস এমন ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। বার বার তাদের বাড়ীতে পুলিশ মধ্যরাতে হানা দিয়েছে এবং তাদেরকে গ্রেফতার করে জিন্দানখানার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দিয়েছে। জেল কর্মকর্তা এবং কারারক্ষীদের কাছেও এসব মেহমান অপরিচিত নয়। তারা বরং খুব ভালভাবেই তাদেরকে জানে। রাতের বেলায় কুরআন তিলাওয়াত এবং নামাযের মাধ্যমে এই লোকেরা দীর্ঘ সময় ধরে জেলখানার কুঠরীগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে। কতবার যে জেল কর্মকর্তাগণ গালির বৃষ্টি এবং মারপিটের তুফান দ্বারা এই লোকগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। অতচ এই মেহমানগণ তাদের মেজবানদের এতসব মেহেরবানী সত্ত্বেও সর্বদা হাসিমুখে এসব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায় অতিক্রম করতে থাকে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের জন্য এই সমস্ত ধর পাকড় ও গ্রেফতার কোন প্রকার বিম্ময়ের উদ্রেক কারার কারণ ছির না্ তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ইস্রাঈলের ব্যাপারে তাদের ভূমিকা ও মনোভাবের কারণে দীর্ঘকাল কিংবা স্বল্পকাল সরকারী মেহমানখানায় অতিবাহিত করতেই হবে। এই পথে ভোগ করা সকল বিপদ মুসিবত আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। এটা কোন ছোটখাটো কিংবা হীন সওদা নয়। বাকী লোকদের গ্রেফতারী সম্ভবত এই জন্য ছিল যে, এই পদক্ষেপ যেন নিরংকুশভাবে ইখওয়ান নিধন হিসেবে চিহ্নিত না হয়। অথবা ভয়- ভীতির সাহায্যে নাসেরী শাসনামলের ন্যায় সকলের মুখে তালা লাগিয়ে দেয়ার ফায়সালাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
যে ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, অত্যাচার নির্যাতন দ্বারা ইখওয়ানকে সত্যের পথে কুরবানী দেয়া থেকে বিরত রাখা যেতে পারে তিনি নিজেই নিজেকে প্রতারিত করছেন এবং বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এই গ্রেফতারির বিস্তারিত বিবরণ যে ব্যক্তিই দেখতে পারে সে-ই এ সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে পারবে না যে, তাদের পশ্চাতে ইস্রাঈলের নির্দেশ ছিল সক্রিয়। কতবার তারা নীরবে এমন কিছু বলে দেয় যা মুখে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এই বিষয়ে আমাদের শাসনকর্তাদের নীরবতা খুবই অর্থবহ। যিনি সবজান্তা ও প্রকৃত জ্ঞানী তিনি সম্যকরূপে পরিজ্ঞাত আছেন যে পর্দার অন্তরালে কিছু রহস্য অবশ্যই আছে।
এবারের গ্রেফতারির পূর্বের আমলে সাধারণ কয়েদীদেরকে ইখওয়ানীদের সাথে মিলিত হতে দেয়া হচ্ছিলো না। কারারক্ষীগণ সাথীদের সাথে মাঝে মধ্যে যেসব কথাবর্তা বলতো তা একথার ইংগীত বহন করতো যে, ইখওয়ান সমস্ত অনিষ্টের জন্য দায়ী এবং সন্ত্রসী। ইখওয়ানের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত বেশী বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ছিলেন তারা এসব কথা নীরবে হজম করতেন এবং কোন প্রকার পত্যুত্তর করতেন না। তাদের দৃষ্টিতে “অজ্ঞ মূর্খদের জবাবে নীরবতা অবলম্বন করাই শ্রেয়”- মূলনীতি এমন পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম কর্মপন্থার মর্যাদা রাখছিল। কিছু কিছু আবেগপ্রবণ ইখওয়ান অবশ্য এসব কথাবার্তা শুনে নিশ্চুপ থাকতে পরতো না এবং এসব মিথ্যা অভিযোগের যথোপযুক্ত জবাব দিতো।
এসো সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত গ্রেফতারের ঘটনার পর বিভিন্ন দলের সাথে সম্পর্কিত লোকদেরকে পরস্পরের মিলিয়ে জেলখানায় রখা হয়। ওয়াফদী নাসেরী, ইখওয়ানী এবং তাজাম্মুয়ী সবই ছিল একাকার হয়ে। অবশ্য তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ইজ্জত ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতো। যখন কোন কয়েদীর বাড়ী থেকে খানা আসতো তখন তারা সকলেই তা মিলে মিশে ভাগ করে খেতো। আমার মনে পড়ছে আমারন বার্ধক্য অবস্থায় কারণে ইখওয়ান ছাড়াও অন্যান্য সকল দলের সদস্যগণই আমাকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন এবং আমার আরাম আয়েশের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাখতেন। হিযবে তাজ্জাম্মু দলের কোন কোন সাথী তো তাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্যে আমার সকল মনোবাঞ্চ পূর্ণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতো। আমার বাড়ী থেকে যদি কোন জিনিস আনানোর প্রয়োজন হতো অথবা কোন পয়গাম পাঠাতে হতো তাহলে এই বন্ধুগণ একন্ত সহৃদয়তার সাথে এই খেদমত আঞ্জাম দিতেন। মিসরীয় কবি শাওকী (র) কতই না চমৎকার উক্তি করেছিলেন যে, দুঃখ সহমর্মিতার অন্তরসমূহকে নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ করে দেয়। হয়ত আমাদের ব্যাপারটাও এমটি একটা কিছু ছিল। বুলবুলদের দুশ্চিন্তা ছিল ফুলের জন্য, আর কবরি ছিল ব্যাথায় ভরা দরদী অন্তর। কিন্তু বিপদ মুসিবতের অংশীদারীত্ব দু’শ্রেণীকেই একই কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো।
প্রত্যেক পক্ষেরই নিজ নিজ মতামত ছিল যা অন্যের পুরো শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আলাপ আলোচনা থেকে যথা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করা হতো। অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সহযোগিতা এবং কল্যাণকামিতার অনুভুতিও অনুপ্রেরণাই ছিল এই সময় বেশী কার্যকরী ও সময়ের দাবী। ব্যায়ম, পরিশ্রম, সাহিত্য, সংগীত, রাজনীতি এবং বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ, মোদ্দাকথা সকল বিষয়েই আলাপ আলোচনা হতো কিন্তু কোন ব্যাপারেই কোন বড় ধরনের মতানৈক্য দেখা দিতো না। এই সমস্ত ব্যাপারেও যদি কোন ভুল বুঝাবুঝি দেখা দিতো তাহলে তা আপোষ, আদব ও শিষ্টাচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। ইত্যবসরে বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় পরস্পরের বিরুদ্ধে যে কাদা ছোড়াছুড়ি করা হতো তার কোন নাম নিশানাও এখন আর পরিদৃষ্ট হতো না। আফসোস! সেই সখ্যত ও হৃদ্যতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য জেলখানার চার দেয়ালের বাইরে এসে কেন স্থায়ীভাবে ধরে রাখা গেলো না।
নিজের কয়েদী বন্ধুদের সম্পর্কে আমার অন্তরে অকৃত্রিম মর্যাদা ও ভালবাসা সদা জাগরুক রয়েছে। ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন, ডাক্তার ইসলাঈল সাবরী আবদুল্লাহ, ডাক্তার ফুয়অদ নুছহী প্রমুখ কারাবন্ধুদের ব্যাপারে আমি আপনাদেরকে আর কি বলবো। এতটুকু বুঝে নিন যে, এটা ছিল এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। সেই দিনগুলো মনে পড়ে যখন আমার একত্রে জেলখানায় ছিলাম এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্যকরূপে অবগত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলাম। আমার যদিও পূর্ব থেকেই একে ভালভাবেই জানতাম কিন্তু কারজীবনের এই অনুপম সম্পর্ক ও একান্ত সান্নিধ্য প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের উত্তম ও মহত দিকগুলো এমনভাবে প্রকটিত করে তোলে যা এত ভালভাবে আগে আর কখনো জানার সুযোগ হয়নি।
ওপরে আমি যেসব ব্যক্তির উল্লেখ করলাম তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা সুষ্ঠু জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক প্রদান করেছেন। তাদের মনমানসিকতা ছিল স্বদেশ প্রেমে উদ্দীপ্ত। আমার আন্তরিক অভিব্যক্তি হচ্ছে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যেন মাঝে মধ্যে এসব লোকদের সাথে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে মিলিত হওয়ার ও পারস্পরিক মতামত বিনিময়ের ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন। তাহলে দেশ ও জাতি সমবাবে উপকৃত হতে পারবে। এতে রাষ্ট্রপ্রধানও এমন মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবেন যা্ থেকে বঞ্চিত ছিলেন তার অগ্রগামী। কিন্তু এজন্য তাকে উদার দৃষ্টিভয়গী নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থনীয় ব্যক্তিদের প্রতি সহযোগিতা হস্ত প্রসারিত করা উচিত।
সাদাত ও তার ইস্রাঈলী বন্ধু
যে ধরপাকড় ও গ্রেফতারির উল্লেখ আমি এই মাত্র করে এসেছি তার নির্দেশ দিয়েছিলেন সাদাত সাহেব নিজেই। এতদসেত্ত্বেও তাঁর একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে গিল, ইনসাফের দাবী হচ্ছে আমি যেন সেই ঘটনা বর্ণনা করি। আল কানাতিরুল খাইরিয়াস্থ রেষ্ট হাউসে ১৯৭৯ সনের ডিসেম্বর মাসে সাদাত সাহেবের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। সাদাত সাহেব সালাম ও কুশলাদি বিনিসয়ের পর অকপটে আমাকে বলতে লাগলেন যে, “ইসরাঈলী শাসকগণ ‘আদ দাওয়া’ সাময়িকীর ব্যাপারে খুবই আপত্তি উত্থাপন করছেন। ইখওয়ানের একাদিক্রমে আক্রমণের কারণে ইসলাইল সরকার বার বার আমাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে। রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের সম্মুখে টেবিলের ওপর ‘আদ দাওয়া’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা রাখা ছিল। আমি আরজ করলাম “শান্তি চুক্তি সম্পর্কে আমাদের মনোভাব ও ভুমিকা সম্পূর্ণ দ্বীনি দৃষ্টিভংগীর ভিত্তিতেই ব্যক্ত করা হয়েছে। ইস্রাঈল সম্পর্কে আমরা যা কিছু লিখছি তা আমাদের দেশের ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ে নয় বরং আমাদের আকীদা ও দ্বীনের সমস্যা জড়িত। আমার দ্বীনের দাবী হচ্ছে আমি এই নিরিখে আমার লেখনি অব্যাহত রাখি যাতে ভ্রান্ত ধারণা কল্পনার কোলে মেঘের অবসান ঘটে এবং প্রকৃত সত্যের আলো সমুদ্ভাসিত হয়ে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। যদি এই ব্যাপারে অবশ্যই। এই সত্তদা এতই সহার্ঘ যে আমি তা কল্পনাও করতে পারি না …………..।”
আমি পুরোপুরি ইনসাফ ও ন্যায়ত একথা সুধী পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপন করতে চাই যে, রাষ্ট্রপতি মহোদয় আমার একথাগুলো গভীর মনোনিবেশ সহকারে শুনলেন। তারপর তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবে বললেনঃ “আমি আপনার বক্তব্যেব সাথে সম্পূর্ণ একমত। এই দৃষ্টিভংগীতে আপনি আপনার লেখনী অব্যাহত রাখুন। সাদাত আমার সাথে যে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেছেন তা বর্ণনার পাশাপাশি তার চরিত্রের ভাল দিকগুলোও পাঠকদের সামনে তুলে ধরা অবশ্য কর্তব্য বলে আমি মনে করি। আল্লাহ তায়ালা আমার ওপরও রহমত করুন আর ক্ষমা করে দিন সাদাতকেও।