দ্বাদশ অধ্যায়
ইখওয়ান যখনই কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে তা খুব ভালভাবে অগ্র পশ্চাৎ ভেবে চিন্তে ও যাচাই-বাছই করেই গ্রহণ করে থাকে। ১৯৫৪ সালে বৃটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্তির জন্য মিসর ও বৃটিশ সরকারের মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয় তার ওপরও ইখওয়ান তার সুচিন্তিত দৃষ্টিভংগী জামাল অবদুন নাসেরের গোচরীভূত করেছিলো। পরে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে। তন্মধ্যে একটা অভিযোগ ছিল এই যে, আমরা বৃটিশ শাসনের গ্রাস থেকে মুক্তি আন্দোলনের বিরোধিতা করেছি। অতএব আমরা বিদেশীদের এজেন্ট, দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক।
প্রকৃত অবস্থার স্বরূপ উদঘাটন
আসুন এখন আমরা এ অপ্রকাশিত রহস্যের পর্দা উন্মোচিত করে তার অন্তরালে একটু তাকিয়ে দেখি। কারা আসলে দেশের বন্ধু আর কারা দেশের শত্রু। দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে বৃটেনকে অধিকার প্রদান করা হয়েছিল যে, মিসর ভূ-খণ্ডে তারা তাদের সামরিক ঘাঁটি বহাল রাখতে পারবে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মিত্রদেশগুলোর সহায়তার জন্য এসব সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা ছিল এই যে, যে যুদ্ধে আমাদের কোন স্বার্থ থাকবে না এমন কোন যুদ্ধেই যেন আমাদের দেশের মাটি থেকে একটা বিদেশী শক্তিকে তৎপরতা চালানোর অনুমতি দেয়া না হয়। চুক্তির অন্যান্য শর্তের কথা বাদ দিলেও এই একটা ধারাই ছিল এমন যার বর্তমানে সংশ্লিষ্ট চুক্তি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেয়া যায় না। এ ঘটনার পর প্রায় ত্রিশ বছর অতিতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে কিন্তু তার খুঁটিনাটি আজও আমার মনে আছে। কেননা আমি ছিলাম সেসব ইখওয়ানের একজন যারা তা বাতিল করার জন্য যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছিলেন।
উস্তাদ সালেহ আবু রাকীক সরকারের এ ভিত্তিহীন অভিযোগের- যে আমরা বৃটিশের হাত থেকে মুক্তির বিরোধিতা করেছিলাম-জবাবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, “এসব লোকের ওপর হামলা করা হয়েছিল। কারণ, তারা বিপ্লবের বিরোধিতা করেছিল এবং এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। বৃটিশ দূতাবাসে গিয়ে বৃটিশ কর্মকর্তাদের সাথে গোপনে মিটিং করেছিল এবং বৃটেনের নিকট আবেদন জানিয়েছিল যে, তারা যেন মিসর ত্যাগের চিন্তা মন-জগত থেকে একেবারেই ঝেড়ে ফেলেন, কেননা জাতি বিপ্লবী সরকারের পক্ষে নেই——-!”
বৃটিশ দূতাবাসের সাথে আলোচনা
এ সাক্ষাতকারের বিষদ বিবরণও শুনুন। মিসর সরকার এবং বৃটিশ শাসকদের মাঝে এ মর্মে পর্যাপ্ত আলাপ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু কোন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছা তখনও সম্ভব হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব জেনারেল মুহাম্মদ সালেম আমাদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করেন এবং আমাদেরকে অবহিত করেন যে, বৃটিশ রাষ্ট্রদূত আমাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হতে চান। আমি মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবির খেদমতে এ পয়গাম পেশ করলাম। তিনি বললেনঃ
“বৃটেন কূটনৈতিকভাবে আমাদের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে। অতএব সাক্ষাত করায় কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু নাসের এবং তার সংগীদেরকে এ বিষয় অবহিত করতে হবে। যদি তারা সম্মতি প্রকাশ করে তাহলে সাক্ষাত করা যেতে পারে। অন্যথায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে হবে।”
মুর্শিদে আ’ম নাসেরের সাথে দেখা করার জন্য সময় প্রার্থনা করেন। তৎকালে নাসেরও মুর্শিদে আ’ম পরস্পর টেলিফোনে প্রত্যহ কথাবার্তা বলতেন এবং কুশলাদি বিনিময় করতেন। জামাল আবদুল নাসের যদিও বিপ্লবের হোতা ও নায়ক ছিলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। তিনি তখন পর্যন্তও সাদাসিধে আচরণের অভিনয় করছিলেন। সে সময় কোন মানুষ কল্পনাও করতে পারতো না যে, এ ব্যক্তিটিই বিলাসিতার এমন চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কার্যত তিনি তা করে দেখিয়েছেন। মোদ্দাকথা হলো, আল রাওদা মহয়ার পর কার্যত তিনি তা করে দেখিয়েছেন। মোদ্দাকথা হলো, আল রাওদা মহলাস্থ মুর্শিদে আ’মের বাসগৃহে পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক জামাল আবদুন নাসের, আবদুল হাকীম আমের, সালাহ সালেম, এবং কামালুদ্দীন হোসাইন প্রমুখ যথা সময় এসে পৌঁছেন। মুর্শিদে আ’ম দূতাবাসের বিষয়টি তাদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। তারা সর্বসম্মতিক্রমে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। মুর্শিদে আ’ম তাদেরকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তিনি তাদেরকে জানাতে থাকবেন।
ইখওয়ানের পক্ষ থেকে আমি এবং উস্তাদ মুনীর দাল্লা বৃটিশ কূটনৈতিক মিশনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপদেষ্টা মিষ্টার ইভান্সের সাথে আল মায়াদী মহল্লায় অবস্থিত ডাক্তার মুহাম্মাদ সালেমের বাসভবনে মিলিত হই। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর আমরা উপদেষ্টাকে দু’টো কথা মেনে নেয়ার ব্যাপারে সম্মত করতে সক্ষম হই। যা ইতিপূর্বে সরকারী প্রতিনিধিগণ পারেননি। সরকারী প্রতিনিধিগণের মাথায় একটা ভূতই জেঁকে বসেছিল যে, বৃটিশ চলে যেতে সম্মত হোক। তজ্জন্য তারা কি কি শর্ত আরোপ করছে সে ব্যাপারে তাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। পক্ষান্তরে আমরা চাচ্ছিলাম যে, বৃটিশরা সরে যেতে রাজি হলে পুরোপুরিই সরে যেতে হবে। কোন প্রকার বিধি-নিষেধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া চলবে না। আমি আদ্যোপান্ত পুরো ঘটনা মুর্শিদে আ’ম-এর সম্মুখে তুলে ধরি এবং তার সংগীদেরও অবহিত করি।
দুশ্চরিত্রদের বাহানার অন্ত থাকে না
নাসের ও তার সাথীর পুনরায় আবার মুর্শিদে আ’মের খেদমতে এসে উপস্থিত হলেন। তিনিও তাদের সামনে আলোচনরার বিষয় বিষদভাবে তুলে ধরেন। তারা সবাই এ প্রতিবেদন শুনে যারপর নেই সন্তোষ প্রকাশ এবং উচ্ছসিত প্রসংসা করেন। এমনিতেই আমাদের মধ্যে যেসব সাক্ষাত হতো তার খুঁটিনাটি সকল দিক সম্পর্কেই এ লোকদের ওয়াকিফহাল করা হতো। কিন্তু আপনারা জানেন যে, দুশ্চরিত্রদের বাহানার অন্ত থাকে না। আমাদের ওপর নির্যাতনের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে এ বিষয়টিই “গোপন ষড়যন্ত্র” এবং বিপ্লবের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা বলে রটানো হলো।
আমাদের আলোচনার প্রায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়েছিলো, ইত্যবসরেই বিপ্লবী সরকার পট পরিবর্তন করে। প্রথম দিকে ইংরেজরা ধারণা করেছিলো যে, আমরা এবং তার (নাসের) যে দুই শরীর এক প্রাণ বিশেষ অর্থাৎ অবিচ্ছেদ্য ও অভিন্ন। তার ভাবছিল যে, গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ। তাই আলোচনা চালাকালে তাদের আচরণ ছিল সমঝোতামূলক এবং ভূমিকা বেশ নমনীয়। জামাল আবদুন নাসের আকস্মিকভাবে খোলস বদলালে ইংরেজরা সর্তক হয়ে যায়। জামাল আবদুল নাসের প্রকাশ্য দিবালোকে হাওয়ামেদীয়া সফরের সময় জনসমক্ষে ইখওয়ানকে আক্রমণ করে কথা বলেন। আল বুহাইরায় পৌছে আরও একটু অগ্রসর হন এবং জনসভায় মানুষের সামনে আমাদের ভাই ওয়াহীদ রামাদানের তীব্র সমালোচনা করেন এবং সেই সময় তাঁর হাতে যে, কলম ছিল তাই তার মুখের উপর ছুড়ে মারেন। ইংরেজরা এই পরিবর্তনে অত্যন্ত সজাগ হয়ে যায় এবং মিষ্টার ইভান্স আমাকে বলেন যে, এখন তো সুস্পষ্ট বিভেদ প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
আমি প্রত্যুত্তরে বললাম-এতো খুবই মামুলি ব্যাপার। এতে আমাদের ও সরকারের মধ্যে কোন মতানৈক সৃষ্টি হবে না। মিসরীয় জনগণ সরকারের সাথেই রয়েছে———।
জামাল আবদুন নাসেরও তার সাংগপাংগরে যখনই উপলব্ধি করলো যে, ফল পেকে তৈরী হয়ে গেছে তখনই তারা ইখওয়ানকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। যাতে সমস্ত সফলতা এবং তার সুফল নিজেরাই কুড়িয়ে নিতে পারে। এ কাজের জন্য তারা ওপরে বর্ণিত নাসেরের আক্রমণ ছাড়াও আরো একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ঘটনাক্রমে ইখওয়ান সমর্থিত ছাত্ররা কায়রো ইউনিভারসিটিতে নওয়াব সাফাভী (ইরানের ফিদায়ানে ইসলামের প্রধান)-এর স্মরণে একটা অনুষ্ঠানের ঘোষনা দিয়ে রেখেছিল। সরকার জীপ যোগে একদল লোক প্রেরণ করে। জীপের ওপর লাউড স্পীকার লাগানো ছিল। জীপে সামরিক বাহিনীর কিছু লোক এবং কিছু সংখ্যক বিপ্লবী যুবক ছিল। সমাবেশ স্থলে পৌঁছে তারা শ্লোগান দিতে শুরু করে এবং গন্ডগোল আরম্ভ করে। ইখওয়ানী ছাত্রগণ প্রথমে তাদেরকে বুঝিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে। তারা তা মানতে অস্বীকার করলে তারা তাদের আচ্ছমত শায়েস্তা করে। মার খেয়ে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং যাওয়ার সময় নিজেরাই গাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করে। আমরা এ পরিস্থিতি সম্পর্কে ছিলাম সম্পূর্ণ না-ওয়াকিফ। হঠাৎ জামাল আবদুন নাসেরের সেনাবাহিনী আমাদের বাড়ী ঘেরাও করে। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে তল্লাশির অজুহাতে সবকিছু তছনছ করে ফেলে। পরিবারের সব লোকের সাথে অত্যন্ত অপমানজনক আচরণ করে। এ অশালীনতাপূর্ণ আচরণ ছিল এমন যে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। ইখওয়ানের সমস্ত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হাতকড়া লাগিয়ে সামরিক কারাগারে এবং আমেরিয়ার জেলখানায় বন্দী করা হয়।
বিশৃংখল রাজ্য অযোগ্য রাজা
এবার দেখুন এসব লোকদের সততা ও বিশ্বস্ততা! দু’দিন পর্যন্ত আমাদেরকে জেলখানায় এমনভাবে বন্দী করে রাখা হলো যে, বাইরের সাথে আমাদের কোন সম্পর্কই থাকলো না। যমকালো কুঠুরী থেকে তৃতীয় দিবসে আমাদের বের করে একগাদা সংবাদপত্র আমাদের সম্মুখে রাখা হলো। সংবাদ পত্রসমূহে লাল ব্যানার হেডে খবর মুদ্রিত হয়েছে যে, সরকার মস্তবড় এক ষড়যন্ত উদঘাটন করেছেন। কতিপয় ব্যানার হেডের ভাষা আজও আমার মনে আছেঃ
“ইখওয়ান বৃটিশ সরকারের সাথে আঁতাত করে বিপ্লব সংগঠিত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এটেছিলো-গাদ্দারদের হাড়ি চৌরাস্তার মাঝে ভেঙ্গেছে।”
“ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা।”
“বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।”
“জনসাধারণের ভেবে দেখার সময়।”
“জামাল আবদুন নাসেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী কাউন্সিলের জরুরী অধিবেশন।”
এটাই ছিল সেই ষড়যন্ত্র যা ক্ষমতাশীন শাসকগোষ্ঠী আমাদের বিরুদ্ধে সাজিয়েছিলো। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে চক্রান্ত ও গাদ্দারীর অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করা হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার সামনে মানুষের কূটকৌশল চলতে পারে না। সবই জানতে পেরেছে, ষড়যন্ত্রের জাল কারা বিস্তার করেছিল আর কারা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ।
সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছে
আমাদের সকলকে কারাগারে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরই হাঙ্গামা শুরু হয়। এই হাঙ্গামাই ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে বিপ্লবী সরকারে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে। তারপর বিপ্লবী কাউন্সিলের মধ্যেই কিছু টানা-পোড়ন এবং ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়। জেলখানায় অন্তরীণ থাকার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ সমস্ত গোলমাল ও বিশৃংখলা থেকে নিরাপদে রাখেন। হঠাৎ আমরা জানতে পারলাম যে, জামাল আবদুন নাসের জেলখানায় আমাদের কাছে এক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেছেন। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন মুহাম্মদ আহমাদ, মুহাম্মদ ফুয়াদ জামাল (সমাজ কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী), মহীউদ্দীন আবুল ইজ্জ (কায়রোর স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান) প্রমুখ ব্যক্তিগণ। তারা মুর্শিদে আ’মের সাথে তার কারাগারের সেলের মধ্যেই সাক্ষাত করেন। আমরাও মুর্শিদে আ’মের সাথে ছিলাম। তারা মুর্শিদে আ’মকে নাসেরের সালাম ও শুভেচ্ছা পৌছে দেন এবং বলেনঃ নাসের সাহেব বলেছেন যে, এখন একথা প্রামাণিত হয়ে গেছে যে, আপনারা প্রকৃত অর্থেই দেশ প্রেমিক। আপনারা জেল থেকে বের হয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে সরকারের সাথে সার্বিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করুন।
মু’মিনের দূরদৃষ্টি ও শয়তানী চক্রান্ত
কারাগারের এই সংকীর্ণ খুপরির মধ্যে এ ঐতিহাসিক সাক্ষাত চলাবস্থায় মুর্শিদে আ’মের অনুমতিকক্রমে উস্তাদ সালেহ আবু রাকীক বললেনঃ “তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে এমন ডাহা মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেছো যে, মিসরীয় কোন ভদ্রলোক এর চেয়ে ভয়ানক অপবাদের কল্পনাও করতে পারে না। তোমরা আবার তা ফলাও করে প্রচার করেছো। অথচ জামাল আবদুন নাসের খুব ভাল করেই জানে, প্রকৃত ঘটনা কি। আমরা কেবল এমন অবস্থায় জেল থেকে বের হতে পারি যখন জামাল আবদুন নাসের নিজে এ অপবাদ খন্ডন করবে। আমরা এমন পরিস্থিতিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি না। যেখানে আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করতে লজ্জাবোধ করি না। যতদিন এ সমস্যার সমাধান না হচ্ছে ততদিন আমরা এখানে অবস্থান করাটাই উত্তম মনে করি।”
সাইয়েদ মুহাম্মদ আহমদ (যিনি এখনো বেঁচে আছেন) নাসেরের নিকট চলে গেলেন এবং সমাধান নিয়ে পুনরায় ফিরে আসলেন। তিনি বললেনঃ মুর্শিদে আ’ম এবং তার সাথে নেতৃস্থানীয় ছয়জন ইখওয়ানী (যাদের মধ্যে আমি নিজেও ছিলাম) কারাগার থেকে বের হবেন এবং মুর্শিদে আ’মের বাসভবনে চলে যাবেন। নাসের নিজে সেখানে উপস্থিত হবেন। এই উপস্থিতির খবর পত্র-পত্রিকায়ও ছাপা হবে। এবং রেডিওতে প্রচার করা হবে। (নাসের মুর্শিদে আ’ম-এর বাসগৃহে তাঁর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য আসেন এবং তা প্রচারও করা হয়।)
আমরা কারাগার থেকে বেরিয়ে এলাম এবং সরকার ইখওয়ানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমরা আবারও নাসেরের মনোভাব পরিবর্তনের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। তিনি মিছিল করাতে শুরু করেছেন। আইনবিদদের বিরুদ্ধে মুর্দাবাদ শ্লোগান। আইনজীবিদের এসেম্বলীর স্পীকার ডঃ সানহুরী পাশা মরহুমকে অপমান ও মারপিট ইত্যাদি (ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে)। আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পারি যে, “আল মিসরী” পত্রিকার ওপর সরকার হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে। এটা ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিনিধিত্বকারী একটি সাময়িকী। নাসের সবসময় এই পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন।
নাসেরের সাথে সাক্ষাত
এ পরিস্থিতিতে মুর্শিদে আ’ম আমাকে নাসেরের সাথে সাক্ষাত করার জন্য তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দেন। বারিউল কুব্বা নামক সামরিক সদর দপ্তরে আমি নাসেরের সংগে দেখা করি। আমি তাঁকে বললাম যে, আমাকে মুর্শিদে আ’ম আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, তুমি ক্রমাগত বিক্ষোভ মিছিল করিয়ে যাচ্ছো তা অনতিবিলম্বে বন্ধ করাও এবং “আল মিসরী” সাময়িকীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক তৎপরতার চিন্তা পরিত্যাগ কর। এসব তৎপরতা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক।
নাসের আমার কথা শুনে বললো, আমি বিক্ষোভ মিছিল বন্ধ করিয়েছি এবং “আল মিসরী” সাময়িকীর বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা গৃহীত হবে না। আমাদের বিরোধী সকল শক্তি এখন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। কেবল একটি ফ্রন্ট থেকেই এখনো পর্যন্ত আমাদের মোকাবিলা করা হচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইখওয়ানী ছাত্র সংগঠন। তারা আমাদের নির্দেশনার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করছে না। তারা যেন বিদ্রোহের পতাকা উডডীন করে রেখেছে। আপনাদের স্বাধীনভাবে বিচরণে তো কোন রকম অসুবিধা নেই। এখন আমরা সেই ছাত্রদের ধোলাই করার জন্য যে কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করি না কেন তাতে আপনারা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। অন্যদের ব্যাপারে আপনাদের নাক গলানোর প্রয়োজন কি?
আমি নাসেরকে জানিয়ে দিলাম, জনাব সাইয়েদ জামাল। এটা আপনি কি বলছেন? আমাদের কি আমাদের সন্তানদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্যাপারে কোন ভাবনা-চিন্ত থাকা উচিত নয়? আপনি কি আপনার এ বিবৃতি সাংবাদিক সম্মেলনে দিতে যাচ্ছেন?
তিনি তৎক্ষণাৎ বললেনঃ না’
যা হোক, আমি তার সংকল্প অনুমান করতে পারলাম। আর সে-ও আমাদের ভূমিকা ও দৃষ্টিভংগী স্পষ্ট বুঝতে পারলো।
নাজিবের বিরুদ্ধে নাসেরের ষড়যন্ত্র
সে দিনগুলো বড়ই সংকটময়। প্রতিমুর্হূতে পরিবর্তনের খবর আসছিল। আমরা জানতে পারলাম যে, নাসের এবং জেনারেল মুহাম্মাদ নাজীবের মাঝে টানা পোড়ন শুরু হয়েছে। মুর্শিদে আ’ম এ সুযোগে নিজে নিজেই নাসেরকে বোঝানোর জন্য তার নিকট গমন করেন। সে তখনো পর্যন্ত নাসিয়াল বাকরী নামক স্থানে একটা সাধারণ বাড়ীতে বাস করতো। মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে ছিলেন ডাক্তার মোহাম্মদ কামাল খলিফা, উস্তদ মুহাম্মদ নাসর ও জনাব সালেহ আবু রাকীক প্রমুখ। মুর্শিদে আ’ম কোন রকম ইতস্তত না করেই খোলাখুলিভাবে নাসেরকে বলতে লাগলেন যে, এরূপ মতবিরোধের ফলে খুবই ক্ষতি হবে। তিনি তাকে আহবান জানান যে, এসব অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য অতিদ্রুত দূর করে পারস্পরিক বুঝাপড়া করার ক্ষেত্র তৈরীর চেষ্টা করুন। তার জানা ছিল যে, নাসের সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাই তিনি তাকে নসীহত করলেন যেন আরো দু’তিন দিন বিষয়টির ওপর চিন্ত-ভাবনা করা হয় এবং তড়িঘড়ি করে কোন চূড়ান্ত ব্যবস্থা না নেয়া হয়। এতে ক্রোধ প্রশমিত হয়ে যেতে পারে। মুর্শিদে আ’ম-এর বক্তব্য শুনে নাসের বললেনঃ সেনাবাহিনী কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়েছে তারা একটা কিছু করতে চাচ্ছে। (অর্থাৎ নাজীবকে বরখাস্ত করার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছে।)
এ সময়েই প্রায় আটশত সশস্ত্র সৈন্যের বিক্ষোভ মিছিল সেখানে গিয়ে পৌছে। তারা বিরাজমান পরিস্থিতির বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছিলো। নাসের আরো বলেন যে, তিনি তিন দিনের জন্য বিষয়টি বিলম্বিত করবেন। তাছাড়া তিনি সাথী নাজীবের সাথে সাক্ষাত করতেও যাচ্ছেন।
গৃহযুদ্ধের আশংকা
মুর্শিদে আ’ম হক নসীহত করেই চলেছিলেন। তিনি নাসেরকে বুঝানো ছাড়াও নাজীবের নিকট তাঁর প্রতিনিধি মুহাম্মদ ফারগলী ও সাঈদ রামাদানকে প্রেরণ করেন এবং একই নসীহত তাকেও করতে বলেন। পরিস্থিতি খুবই সংকটময় হয়ে পড়েছিল। মুহাম্মদ নাজীবের সমর্থক অশ্বরোহী সৈন্যদের মধ্যে ছিল বেশী। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলোঃ যে সমস্ত অফিসার নাজীবের পক্ষে বিক্ষোভের জন্য বেরিয়েছিল নাসের তাদেরকে চক্রান্ত করে বন্দী করে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দেন। এভাবে নাজীবের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। পক্ষান্তরে নাসের অব্যাহতভাবে তার শক্তির প্রদর্শনী করতে থাকে। আমরা ভাবছিলাম যে, যদি সামন্যতম কোন ভুলও হয়ে যায় তাহলে তা গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নেবে। আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে টেষ্টা করছিলাম এ বিপদ থেকে যেন প্রাণ প্রিয় দেশ মাতৃকা রক্ষা পায়। দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই আমরা বার বার আমাদের জীবনকে বিপন্ন করে সকল অত্যাচার-উৎপীড়ন অকাতরে বরণ করে নিয়েছি। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে দেশ প্রেমিকিই না হতাম তাহলে নিজেদের চামড়া বাঁচাবার জন্য সর্বদাই গৃহযুদ্ধের পথ বেছে নিতে পারতাম।