ষষ্ঠদশ অধ্যায়
হাতের কঙ্কন দেখতে আর্শির কি প্রয়োজন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন ইখওয়ানের দাওয়াতের যথার্থ অবদান। নাকরাশী পাশার আমলে কুবরী আব্বাসের ঘটনাবলী এবং ছাত্রসমাজের ত্যাগ ও কুরবানী সবই ইখওয়ানের দাওয়াতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। ইখওয়ানের দাওয়াতের ইতিবাচক ফলাফল অগণিত। কিন্তু আমাদের দেশের লেখকগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত এবং একেবারেই চক্ষু বন্ধ করে রয়েছে। বস্তুত ভাবলে আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না, তারা কোথাও আমাদের আলোচনা করেলেও সে আলোচনায় তাদের প্রবৃত্তি, স্বার্থ ও আকাংখার রং ভাল করেই চড়িয়ে দেয়। এসব তথাকথিত সাহিত্যিক গ্রন্থকার এবং ঐতিহাসিকগণ ইখওয়ানের ইতিহাস বিকৃত করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তারা জানে না যে, এতে তারা সফলকাম হতে পারবেন। তারা পরস্পরের সাহায্যাকারী ও পৃষ্ঠপোষক হলেও এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ঘৃণিত কাজের উদ্যোগ নিলেও। এই ব্যর্থ উদ্যোগের পশ্চাতে ইসরাঈলের নাপাক হাত ক্রীয়াশীল রয়েছে। অবশ্য কোন কোন সরল প্রাণ লেখক বিষযটি সম্পর্কে একেবারেই অনবহিত। আবার অনেক জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবি জেনে বুঝেই এ খেদমতে আত্মনিয়োগ করেছে।
ইখওয়ানের বিরুদ্ধে এসব চক্রান্ত এবং তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য মুছে ফেলার সর্বাত্মক দুরভিসন্ধি সত্ত্বেও এই দাওয়াত মর্তের মাটিতে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে শিকড় গজিয়ে ফেলেছৈ। তার শাকা প্রশাখা ও পত্র পল্লব নিঃসীম আকাশের দিগন্তে আন্দোলিত হচ্ছে। তার সঞ্জীবনী ফল সত্যান্বেষীদেরকে সকল ঋতুতেই সরবরাহ করা হচ্ছে। এই বরকত ও কল্যাণময় বৃক্ষ শরৎ, গ্রীষ্ম এবং বসন্ত ও হেমন্তের মুখাপেক্ষী নয়। তা চির যৌবনা। এই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় বৃক্ষের নীচে বাতিলের মরীচিকায় উল্লসিত িএবং জুলুমের ঝলকানীতে দিশেহারা উদ্ভ্রান্ত প্রতিটি যুবক শীলতার পরশ পেয়ে যায়। কোন সংগছন বা দল কোনও উপলক্ষে যদি কোন সভা সমাবেশ করতে চায় এবং জনসধারণকে আমন্ত্রণ জানায় তখন দেখা যায় যে, নগণ্য সংখ্যক লোক সমবেত হয়। পক্ষান্তরে ইখওয়ানের কোন প্রোগ্রাম যদি করতে হয় এবং সরকার যদি তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে তাহলে হাজার হাজার জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবেতাতে অংশগ্রহণ করে। ইখওয়ানের প্রতি সর্বসাধারণের এই আগ্রহ ও ভালবাসা শুধু এই কারণে যে, তাদের দৃষ্টিতে এই দাওয়াতের মধ্যে সার্বিক কল্যাণ ও মংগল নিহিত। আমরা কোন প্রকার লোভ ও প্রলোভন ছাড়াই জনগণকে শুধুমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আহ্বান জানাই। এ কাজটাই ইসলামের দুশমনদের চক্ষুশূল এবং অন্তর্জালারও কারণ। তারা অত্যাচার উৎপীড়ন, সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হকের এই আওয়াজকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু জ্বীন ও ইনসান সকলের সম্মিলিত ও যুগপৎ প্রচেষ্টায়ও এ প্রদীপ নির্বাপিত হবার নয়। আল্লাহ তায়ালার অংগীগার রয়েছে যে, তিনি নিজেই তার দ্বীনের হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। আর তিনি কখনো তার ওয়াদা পরিপন্থী কোন কাজ করেন না।
রেকর্ড সংশোধনের জন্যে
এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, অনেক সম্মানিত ব্যক্তিও ইতিহাসের চোখের সামনে সংঘটিত স্বীকৃত ঘটনাবলীকে বিকৃত করে উপস্থাপন করতে কোন প্রকার লজ্জাবোধ করে না। উদাহরণ স্বরূপ শহীদ ইমাম যখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তখন নাহাস পাশা তাঁকে ডেকে পাঠান এবং নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলেন। কেননা মরহুমের ওপর বৃটেনের চাপ ছিল যে, হাসানুল বান্নাকে যে কোনভাবেই হোক নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করতে হবে। ইমাম তো কারো চাপের মুখে নতি স্বীকার করার মত লোক ছিলেন না। এটা সবারই জানা কথা। এমনকি স্বয়ং নাহাস পাশা মরহুমও এ বিষয়ে ছিলেন সম্যক পরিজ্ঞাত। তিনি ইমাম শহীদের নিকট আবেদন জানান যে, আপনি নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবেন না। বিনিময়ে আপনার সংগঠনকে দাওয়াতী কাজ করার জন্য কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে। তিনি ওয়াদা করেন যে, কেন্দ্রীয অফিস, গণমিলনায়তন এবং সর্বত্র গণকেন্দ্র খোলার শুধু অনুমতিই দেয়া হবে না বরং সহযোগিতাও প্রদান করা হবে। এই সাক্ষাতকারের সময় অন্য যেসব লোক উপস্থিত ছিলেন এবং যারা পরবর্তী সময় নাহাস পাশার মৃত্যু ও ইমাম শহীদের শাহাদাতের পর সংবাদপত্রে তাদের সাক্ষাতকার ছাপেন তারা সকল ঘটনাপ্রবাহকে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে পেশ করেন। তারা নাহাস পাশার এই অনুরোধ ও আবেদনকে নিদেনকে ধমকের রংগে রাঙ্গিয়ে তোলেন এবং তার মুখে ইমামকে বলিয়ে দেন যে, তিনি যেন ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা ছেড়ে দেন। অথচ তাদের উত্তমরূপেই জানা রয়েছে যে, এই বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে আলোচনায় স্থান পেয়েছিল। কিন্তু তারপরও নিজেদের আমলনামায় এরূপ “নেকী” লিপিবদ্ধ করানো তারা জরুরী মনে করেছেন যে, হাসানুল বান্নার মত একজন প্রবিত যশা অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কীর্তিকলাপকে অপকীর্তির রূপ দান করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ইমাম কারো লোব দেখানো (উৎসাহ প্রদান) ও ভীতি প্রদর্শনকে কোন আমলই দিতেন না। তাঁকে যখন অবহিত করা হয় যে, তাঁর নির্বাচনে দাঁড়ানোর ফলে দেশের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে। তখন তিনি তাঁর প্রার্থী পদ প্রত্যাহার করে নেন। ইতিপূর্বেও এই ঘটনা বর্ণনা করেছি।
“এই আন্দোলন আল্লাহর দ্বীন ও রিাসালাত মুহাম্মাদীয় পয়গামকে সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর অনুকূরে রয়েছে আল্লাহ তায়ালার সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা যা অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবে অব্যাহত। একে নির্মূলকারীগণ হারিয়ে ফেলবে তাদের অস্তিত্ব এই মর্তের মাটিতে। নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র এর আদৌ কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বৈরিতা ও বিরোধিতা এর অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। ইখওয়ানের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ক্ষিপ্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। ইখওয়ানের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ক্ষিপ্ত করতে প্রয়াসী ব্যক্তিরা তো শুরু থেকেই আমাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও সোচ্চার রয়েছে। আমরা তাদের সামাল দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার ওপর সমর্পণ করেছি। আমরা সেই সুদিনের প্রতীক্ষায় আছি যখন আমাদের শাসকদের চোখ খুলে যাবে এবং তারা হেদায়াত লাভ করবে যে, তারা আল্লাহর শরীয়ত কার্যকরী করবে। আমরা এ উদ্দেশ্যেই প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছি। তথাপি মানুষের হৃদয় মনে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রয়েছে আল্লাহরই হাতে। তিনি যেভাবে ইচ্ছা মানুষের মন-মানসিকতাকে পরিবর্তন করে দিতে পারেন। জনৈক সৎব্যক্তির এই উক্তি কতই না যথার্থ যে, “মানুষের অন্তরে পরিবর্তন আনতে মাত্র এক মুহূর্ত সময়ের প্রয়োজন।”
শাহ ফারুকের শাসনকালের প্রাথমিক অধ্যায়
আমার খুব ভালভাবে মনে আছে যে, শাহ ফারুক তার যুবরাজ থাকাকালে শান্তিপ্রিয়তা ও নেক চালচলনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন জনসাধারণের ভবিষ্যত আশা ভরসার স্থল। এই জন্যই তিনি ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হলে সারা দেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উৎসব উদযাপন করা হয়। জনগণ ধারণা করেছিলেন যে, এখন থেকে মিসরের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়েল সূচনা হবে এবং ইসলামী আইন ও ইসলামী মূল্যবোধ সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবে। ইখওয়ানও অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ফারুককে স্বাগত জানায়। কারণ তার কাছ থেকে কল্যাণধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। ইখওয়ানীগণ ফারুকের মনে একথাও বদ্ধমূল করে দিতে চাচ্ছিলো যে, তার আগমনে দেশময় যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে তার ইসলাম প্রীতিরই ফল মাত্র। যদি তিনি সঠিক অর্থে ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন তাহলে তিনি দেশবাসীর চোখের মণিতে পরিণত হবেন।
ফারুকের শাসনামলের গোড়ার দিকে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ ইউসুফ ইরশাদ ইমাম শহীদের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হওয়ার জন্য আগমন করেন। এটা একথারই স্বাক্ষর বহন করেছিলো যে, মিসরের ভবিষ্যতে ইসলামের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে চলেছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী অদৃশ্য হস্ত এই সময়ও সুগভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে ওঠে। তারা ফারুকের মনে ইখওয়ান সম্পর্কে প্রভূত সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করেন যা পর্যায়ক্রমে ভয়ভীতি ও আতঙ্কের রূপ পরিগ্রহ করে। এমনকি বাদশাহ ইখওয়ানকে তার এক নম্বর শত্রু মনে করতে থাকে। তিনি ইখওয়ান বিরোধীদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে থাকেনএবং মুর্শিদে আ’ম ও ইখওয়ানকে উৎখাত করার সকল চক্রান্ত শুরু হয়ে যায়। শীগ্রই এই গোপন হস্তের ইংগিত ফারুককে একটা নতুন জ ীবনধারায় অভ্যস্ত করে তোলে যা ছিল তার যুবরাজ থাকাকালীন রাজকীয় জীবনধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মিসরীয় জনগণ এখন তার প্রতি ভালবাসার পরিবর্তে ঘৃণা প্রকাশ করতে থাকে। ফারুককে বলা হয় যে, হাসানুল বান্না যেখানেই যায় মানুষ তার চারিপাশে পতংগের ন্যায় সমবেত হয়ে থাকে। তিনি কথা বলতে আরম্ভ করলে তারা তার কথাবার্তা এমন মনোযোগ দিয়ে শুনে যেন তাদের মাথার ওপর পাখী বসে রয়েছে। এ ব্যক্তি বড়ই ভয়ংকর ও বিপজ্জনক।…
ইখওয়ানের আদর্শপ্রীতি
আমার মনে আছে ইসরাঈল সাদফীও ইমামের সাথে সাক্ষাত করতে আসতেন। তার এসব সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা তার জামাতা ইবরাহীম পাশা করে দিতেন। এটা ছিল সেই সময়ের কথা যখন ইসমাঈল মিষ্টার বেগিনের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যা সফলতার মুখ দেখতে পায়নি।
নাকরাশী পাশা জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য গেলে ইখওয়ান তাকে সমর্থন করেন এবং ওয়াফদ পার্টির মন্ত্রীবর্গ কেন্দ্রীয় গণমিলনায়তনে উপস্থিত হন এবং সকলেই ইখওয়ানের প্রশংসায় বক্তব্য পেশ করেন। আহমদ হামযা, ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন, সবরী আবু ইলম ও সোলায়মান গানাম সকলের সমবেত হওয়া বিশেষভাবে মনে পড়ে। অনুরূপভাবে ফারুকের শাসনামলের প্রথম দিকে প্রাথমিক কবি যার নাম এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না। জনসমাবেশে আসেন এবং ভাষণও প্রদান করেন। অনন্তর ইখওয়ানের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা করা হয় যে, এই সংগঠন দেশ প্রেমিক নয়। এটা অমুকের এজেন্ট অমুকের দোশর ও দালাল। আফসোস! আমরা কি এমন সব লোকের এজেন্ট ছিলাম যারা এই আমলে আমাদের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। কিছুটা হলেও তো জ্ঞানবুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করা উচিত। প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা দেখে প্রতিটি ব্যক্তি তাদেরকে নিজেদের সাথে একাত্ম করতে চাচ্ছিলো। কিন্তু ইখওয়ান ছিল একটি আদর্শবাদী দল। তারা তাদের অনুসৃত পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য কখনো প্রস্তুত ছিল না। ফল এই দাঁঢ়ালো যে, ঐসব ব্যক্তি ও দল তাদের পারস্পরিক মতবিরোধ সত্ত্বেও একটি বিষয়ে ঐক্যমত্য পোষণ করে যে, ইখওয়ানের বিরোধিতা করতে হবে। অতএব আমাদের প্রতি সকলেই ঢিল ছুঁড়তে থাকে, যে প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত গতিতে চলছে।