উপক্রমনিকা
বিংশ শতাব্দির দুটো বিরাট ইসলামী আন্দোলন
বিশ্ব মানবতার হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা অগণিত নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন, যারা প্রত্যেকে নিজ নিজ জাতি ও সমকালীন বিশ্বের লোকদের সামনে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে গেছেন। ঐসব নবী রাসূল প্রেরণের শেষ পর্যায়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। তিনি সমস্ত আদম সন্তানের জন্য এবং কিয়ামত পর্যান্ত সর্বকালের মানুষের জন্য হিদায়াতের পথের আহবায়ক এবং পথপ্রদর্শক। তাঁর পর আর কোন নবী রাসূলের আগমন ঘটবে না।
নবী আদমের হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব তথা মহাগ্রন্থ আল কুরআন এবং পবিত্র সুন্নাহ উম্মাতের নিকট সোপর্দ করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছিলেনঃ “যতদিন পর্যন্ত তোমরা এ দুটো মৌলিক উৎসের শিক্ষা মুজবুতভাবে অনুসরণ করে চলেবে ততদিন কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।”
তিনি আরো বর্ণনা করেছেন যে, আমার উম্মাতের উলামায়ে কেরাম বনী ইসরাঈলের আম্বিয়ায়ে এজামদের সমান।
অবশ্য এর অর্থ এটা নয় যে, আলেমদেরকে নুবায়াতের সমান মর্যাদা কিংবা নবীদের ন্যায় সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। বরং তার মর্মার্থ হচ্ছে এই যে, যেভাবে মহানবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ববর্তী সমস্ত নবী রাসূলকে উম্মাতের সংশোধন সংস্কারের জন্য প্রেরণ করা হতো, এখন থেকে সেই গুরু দায়িত্ব অর্পিত হলো ওলামায়ে ইসলামের উপর।
দ্বীনের সংস্কার সাধন ও পুনরুজ্জীবনের জন্য আল্লাহ তায়ালা এ উম্মাতের মধ্য থেকে সাহসী আলেমক ও সৎব্যক্তিগণকে তাওফীক দিয়ে আসছেন যাতে তারা দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ঠ ভ্রান্ত রীতিনীতি ও আচার আচরনের মূলোৎপাটন করে আল্লাহর বান্দাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর স্বচ্ছ ঝর্ণাধারার কাছে নিয়ে আসতে পারেন। দ্বীনের সংস্কার সাধন ও পুরর্জীবনের আন্দোলন সকল যুগে ও সকল দেশেই কার্যকর ছিলো। সংস্কারকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আল্লাহ তায়ালা অজ্ঞতা ও গোমরাহীর মোকাবেলায় প্রকৃত জ্ঞান এবং দ্বীন হানিফকে পরিশুদ্ধ করে দেন। তথাপি এ কাজ অত্যন্ত কঠিন এবং ধৈর্যের দাবিদার। এ কাজ কেবল সেইসব লোকের পক্ষে সম্ভব যারা সত্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য যাবতীয় প্রতিকুলতার সম্মুখীন হবার জন্য সর্বদা জিহাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত থাকে।
বিংশ শতব্দীর ইসলামী উম্মাহ পশ্চাৎপদতা অধঃপতনের গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে রাজনৈতিক গোলামীর সাথে সাথে চিন্তাগত স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। এরূপ পরিস্থিতিতে নীলনদ উপত্যকায় আল্লাহ তায়ালা তার এক সত্যপ্রিয় বান্দাকে বাতিলের মোকাবিলা করার জন্য দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। যিনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত গুণাবলীর অধিকারী। আল্লাহ তাকে সবরকমের গুণ দান করেছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি মুসলিম উম্মার করুণ অবস্থা আবলোকন করে চিন্তিত ছিলেন। তিনিই তার যৌবন কালে মাত্র একুশ বছর বয়সে উম্মাহকে সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯২৭ সালে ইসমাঈলিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তখন তার সাথে ছয় সাথী ছিলেন। এই বিশাল ব্যক্তিত্ব সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদ এখন আর কারো পরিচয় করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা থাকে না। তার পরিচালিত ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বিশ্ব ইসলামী আন্দোলন যার প্রভাব মুসলিম বিশ্ব এবং আরব জাহান ছাড়া অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোতেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অনুভূত করা হচ্ছে।
হাসানুল বান্না যে সময় মিসরে সংস্কার আন্দোলন জোরদার করছিলেন ঠিক সেই সময়েই পাক ভারতীয় উপমহাদেশে তারই সমসাময়িক অপর এক নওজোয়ান মর্দে মু’মীন সম্পূর্ণ একই আঙ্গিকে ও একই প্রেক্ষাপটে চিন্তা ভাবনা শুরু করেছিলেন। তিনি তার ইমান উদ্দীপক লেখনী দ্বারা প্রতিটি জাগ্রত বিবেক, সচেতন ও নিষ্ঠাবান মুসলিমের অন্তরে সমকালীন জাহেলীয়াত ও পরিবেশ পরিস্থিতি সংস্কারের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিলেন। এ যুবকের নাম ছিলো সাইয়েদ আবুল আ’লা মুওদূদী মারহুম। তিনি ছিলেন বর্তমান শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ভাষ্যকার ও মুখপাত্র। তিনি ইসলামী আন্দোলনের একটা মজবুত ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তার নাম প্রস্তাব করা হয় “জামায়াতে ইসলামী”। সত্যের এ কাফেলায় সর্বপ্রথম ১৯৪১ সালে। বর্তমানে এ সংগঠন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন এর ন্যায় বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী।
সৌভাগ্যবশত এ দুটি সংগঠনেরই প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খুবই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, অদম্য সাহসিকতা ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এবং এলেম ও আমলের গুণাবলীতে একজনের সাথে অন্যজনের রয়েছে পুরোপুরি সাদৃশ্য। উভয়ের যৌবন ছিলো নির্দোষ ও নিষ্কলুষ এবং চিন্তা-চেতনা ঊষা লঘ্ন থেকেই ছিলো কুরআন সুন্নাহর আলোকে আলোকিত। দুই ব্যক্তিত্বকেই অল্প বিস্তর প্রায় একই রকম পরিবেশ পরিস্থিতিতে উম্মাহর সংস্কারে কাজ দুটো পৃথক প্রক্রিয়ায় আঞ্জাম দিতে হয়। বিপদ-মসিবত, দুঃখ-দৈন্যের প্রকৃতিও ছিলো প্রায় একই ধরনের। উভয়েই জাতিরে সামনে যে শ্লোগান পেশ করেন তাও ছিলো হুবহু একই। সেই শ্লোগান ছিলো أُدْخُلُوا فِى السِّلْمِ كَافَّة “পূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো।”
আর এটা কোন বিস্ময়কর ব্যাপারও নয়। কেননা বীজ যে বৃক্ষের হবে তা থেকে সেই বৃক্ষই উৎপন্ন হবে। যদিও দুটো আলাদা ভূখন্ডে একই আবহাওয়ায় ঐ বীজ বপন করা হয়। দুজনেরই চিন্তা একই সূত্রে গাঁথা ছিলো। তাই রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসার পার্থক্য হওয়া সম্ভবই ছিল না।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধবাদীরা প্রত্যেকটি আন্দোলনের উপরই তাদের নিজ নিজ গোপন আস্তানা থেকে একই অস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ করে থাকে। অভিযোগ উত্থাপন এবং দোষারোপের ফিরিস্তি দেখলে এবং সেগুলোর ভাষা বিশ্লেষণ করলে বিস্ময়ের অবধি থাকে না। মনে হয় যেন এসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ একই কারখানায় তৈরী হয়ে আসছে। জামায়াতে ইসলামীর বিরোধীরা নির্বোধের মত অভিযোগ আরোপের সাথে সাথে অপেক্ষাকৃত একটি হালকা ভিত্তিহীন অপবাদও আরোপ করে থাকে যে এরা ইখওয়ানের সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় থাকে। মিসর ও অন্যান্য আরব দেশে যা কিছু লেখা হয় এরা অবিকল তাই নিজেদের দেশে ভাষান্তরিত করে থাকে। আমরা এখানে এসব অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করতে বা সেগুলোর পর্যালোচনায় যেতে চাই না। এ পর্যায়ে বরং সাইয়েদ কুতুব শহীদের দু শব্দের একটি সংক্ষিপ্ত জবাবই যথেষ্ট। প্রকাশ থাকে যে, ইখওয়ানের বিরোধীরা তাদের উপরও একই অভিযোগ আরোপ করতো যে, তারা জামায়াতে ইসলামীর চিন্তাধারারই ব্যপ্তি ও বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। সাইয়েদ কুতুব এর লেখনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করুন আবার সাইয়েদ মুওদূদীর লেখাও অধ্যায়ন করে দেখুন। মনে হবে যেন দুজন লেখকরই চিন্তাধারা একই উৎস থেকে উৎসারিত। বিশেষেতঃ “তাফহীমুল কুরআন” ও “ফি যিলালিল কুরআন”- এর মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য বিদ্যমান।
একবার সাইয়েদ কুতুব-এর সামনে জনৈক ব্যক্তি এ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, তার লেখনী সাইয়েদ মওদূদীর লেখনীর দ্বারা অনুপ্রাণিত। তিনি এর জাবাবে বলেছিলেনঃ আমাদের চিন্তাধারার উৎস এক ও অভিন্ন। মাত্র দুশব্দের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এ জবাব সৃদীর্ঘ রচনা বা প্রবন্ধ বরং বিশাল আয়তনের গ্রন্থ থেকে বেশী অর্থবোধক اِنَّ فِى ذَلِكَ لِعِبْرةً لاُّولِى الْالباب “নিশ্চয়ই এতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে এমন লোকদের জন্য যারা জ্ঞানবুদ্ধিকে কাজে লাগায়।”
সাইয়েদ মওদূদী ও সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদের পরস্পরের সাথে কখনো সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। তথাপি দুই মহান নেতার মধ্যে তাদের উভয়েরই বন্ধু কুয়েতের প্রখ্যাত ইসলামী নেতা শাইখ আবদুল আযীয আলী আল মাতলু এর মাধ্যমে পত্রের আদান প্রদান হতো। এতে ইখওয়ান ও জামায়াতের নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং নিয়মিত দেখা সাক্ষাত হতে থাকে। সাইয়েদ মওদূদী ও সাইয়েদ হাসানুল বান্না দুই সংগঠনের প্রত্যেকটিকে অপরটির অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং পরিপূরক মনে করতেন। তাদের মধ্যে এ অনুভূতি ছিল যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একই। কেবলমাত্র ভৈৗগোলিক অবস্থান এবং কর্মক্ষেত্র আলাদা। আমি নিঃসঙ্কোচেব বলতে পারি যে জামায়াতে ইসলামী ও ইখওয়ানের দুজন কর্মী দুনিয়ার যে কোন স্থানে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেলে তারা মনে করে যে তারা দুজন একই বংশোদ্ভুত। যদি পৃথিবীর কোন অংশে কোন ইখওয়ানী ভাইয়ের ওপর অত্যাচার হয় তাহলে জামায়াত ইসলামীর প্রত্যেক কর্মী তার অন্তরের অন্তস্থলে বেদনা অনুভব করে। অনুরূপভাবে জামায়াত বা এর কোন কর্মীর ওপর নির্যাতন চালানো হলে সমগ্র পৃথিবীর ইখওয়ানী ভাইয়েরা তড়পাতে থাকে। এমনটা হবেই বা না কেন? আমাদের মনযিলে মকসুদ ও জীবন লক্ষ্য যে এক ও অভিন্ন।
ব্যক্তিগতভাবে আমার বহুবার এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কোন অজ্ঞতা অপরিচিত পরিবেশের কোন এয়ার পোর্টে কিংবা প্লেনের মধ্যে অথবা অন্য কোন স্থানে হঠাৎ কোন ইখওয়ানী ভ্রাতার সাথে সাক্ষাত হয়ে গেলে কথার ফাঁকে যখনই আমাদের কারো জানার সুযোগ হয় যে অপরজন ইসলামী সংগঠনের সাথে জড়িত। অমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পরস্পর গলাগলি কোলাকুলি হয়ে যায়। বিদেশী ও অপরিচিতির লেশমাত্র তখন আর অবিশষ্ট থাকে না। মুহূর্তের মধ্যেই মনে হয় যেন আমরা বাল্যকাল থেকেই একত্রে বসবাস করে আসছি।
এটা ইসলামী আন্দোলনেরই কৃতিত্ব যে তার কর্মীদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস الْحُبُّ فِى للهِ وَالبُغضُ للهِ (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে সকল প্রকার ভালবাসা এবং বৈরিতা) এর জীবন্ত নমুনা বানিয়ে দিয়েছে।
দুটি সংগঠনেরই দাওয়াত ও কর্মনীতির প্রতি লক্ষ করুন এবং বুনিয়াদী সাহিত্য সম্ভার পড়ে দেখুন। দায়িত্বশীলগণের বক্তৃতা বিবৃতি চিন্তাবিদগণের চিন্তা-ভাবনা লেখক সাহিত্যিকগণের লেখনী সাংবাদিকগণের পর্যালোচনা মোদ্দা-কথা যে কোন অংগনের উপর দৃষ্টিপাত করে দেখলে আপনার কাছে প্রতীয়মান হবে যে উভয় ফুলের তোড়য় একই গাছের ফুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
এতোসব সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও আপনাপন পরিমন্ডলে এবং কর্মক্ষেত্রে দু’সংগঠনের অগ্রগতি এবং জিহাদের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। হাসানুর বান্না সাহিত্য সৃষ্টির তুলনায় মানুষের মন-মানসিকতা গঠনে ছিলেন বেশী তৎপর। পক্ষান্তরে সাইয়েদ মওদূদী যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী বাহিনী তৈরীর সাথে সাথে সাহিত্য রচনারও দিকে গুরুত্ব প্রদান করেন। হাসানুল বান্নাও ছিলেন সৃজনশীল লেখক ও সাহিত্যিক কিন্তু তার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ছিলো বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপরাদিকে সাইয়েদ মওদূদী খুব তেজস্বী বক্তা ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর ময়দানই ছিলো বেশী প্রশস্ত। বলিষ্ঠ ও গতিশীল লেখনীর এক এমন মহৎ গুণ তার মধ্যে ছিলো যা বদৌলতে তিনি তার সমকালীন সকলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তেমনিভাবে নীল নদের অববাহিকা চলতি শতাব্দীতে হাসানুল বান্না শহীদ অপেক্ষা আর কোন বড় বক্তা দেখতে পায়নি।
সাইয়েদ মওদূদী প্রত্যেক বিষয়ের ওপর কলম ধরেছেন। এমনকি সত্যকথা বলতে গেলে প্রত্যেক বিষয়ের হকও তিনি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। তাফহীমুল কুরআন নামক কিতাবুল্লাহর তাফসীর ব্যতিক্রমী ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। এ বিষয়ে বহু চিন্তাবিদ পুরোদস্তুর মূল্যায়ণ করে এবং প্রাচীন ও আধুনিক অসংখ্য তাফসীরের সাথে তুলনা করে প্রমান করেছেন যে, এটা এক অতুলনীয় ও ব্যতিক্রম ধর্মী সৃষ্টি। জন্মনিয়ন্ত্রণ, পর্দা ও সুদ এর মত সংবেদশীল বিষয়াবলীর ওপরও তিনি কলম ধরেছেন। বিশেষথ এমন যুগ সন্ধিক্ষনে পাশ্চাত্য দর্শনের সম্মুখে ইসলামের বড় বড় মাশায়েখগণ হতবাক ও বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কারণ প্রদর্শন না করেই সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে ইসলামের দৃষ্টিভংগী অত্যন্ত সাহসিকতা এবং প্রামাণ্য তথ্য প্রমাণসহ উপস্থাপন করেন। তার ক্ষুরধার লেখনীর সর্বাপেক্ষা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট ও পরিপূর্ণতা হচ্ছে এই যে, তিনি পশ্চিমা দার্শনিক পন্ডিতদেরকে তাদের নিজেদের লেখনী এবং বাস্তবতার নিরীখে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।এমনকি তাদের দুর্বিনীত মস্তক অবনত করতে বাধ্য করেছিলেন। তার রচিত গ্রন্থাবলীর বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা এখানে উদ্দেশ্য নয়। শুধু উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটা বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো। সারকথা এই যে তিনি একাই তার সংগঠনকে এত বিপুল পরিমাণে বিশ্বাস ও চিন্তার বিশুদ্ধিকরণ অস্ত্রযোগন দিয়ে গিয়েছেন যে, যদি কর্মীরা কাজ করতে ইচ্চা করে, তাহলে কোন ময়দানেই তাদের পরাজয়ের গ্লানিতে নিমজ্জিত হতে হবে না।
হাসানুল বান্না শহীদের যে সংক্ষিপ্ত অবকাশ নসীব হয়েছিলো, তাতেই তিনি ইসলামী আন্দোলনের চারা মানুষের মনের গভীরে প্রোথিত করে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত সাদাসিদে ভাষায় ও সহজবোধ্য বর্ণনা ভংগীতে স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রাম গঞ্জে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার পয়গাম ছড়িয়ে দেন। কৃষক মজুর জনতা তার পার্শ্বে এসে সমবেত হয়। সাহিত্য রচনা এবং প্রত্যেক বিষয়ের চিন্তা-চেতনাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে তার অনুসারীগণ অত্যন্ত চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি মন ও মস্তিষ্কের নিকট আবেদন রাখেন। কিন্তু তার আবেদন দেমাগের তুলনায় দিলের নিকটই ছিলো বেশী। একইভাবে সাইয়েদ মওদূদী মানুষের মন ও মস্তিষ্ক উভয়ের উপরই কারাঘাত করেছিলেন; তবে তার লক্ষ্য ও গুরুত্ব ছিলো দেমাগের উপরই সমাধিক।
জামায়াতে সাইয়েদ মগুদূদী পরও চিন্তাশীলগনের ঘাটতি দেখা দেয়নি। তথাপি সত্য কথা হলো এ পর্যায় জামায়াত অপেক্ষা ইখওয়ান অনেক অগ্রসর ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। জামায়াতের চিন্তাবিদগণের মধ্যে মিয়া তোয়ায়েল মুহাম্মদ, মাসউদ আলম নাদভী মারহুম, অধ্যাপক আবদুল হামিদ সিদ্দিকী মারহুম, অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ, চৌধুরী গোলাম মুহাম্মদ, মালেক গোলাম আলী, নাঈম সিদ্দিকী, জান মুহাম্মদ ভূট্টো, সাইয়েদ হামেদ আলী, সাইয়েদ আসআদ গিলানী, আবাদ শাহপুরী, মুহতারাম খলিল আহমদ হামিদী, খুররম জাহ মুরাদ, অধ্যাপক গোলাম আযম, মুহতারিমা মরিয়ম জামিলা, মুহাম্মদ সুলতান, মুহতারাম আবুল লাইছ, ডক্টর নাজাত উল্লাহ সিদ্দিকী, সদরুদ্দীন ইসলাহী, মুহাম্মদ ইউসূফ ইসলাহী, সাইয়েদ সরুজ কাদেরী, মুহতারাম আবদুল হাই, মারহুম আবদুর রহীম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কলম ধরেছিলেন এবং অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থাবলী দ্বারা সুধী পাঠক মন্ডলীকে ধন্য করেছেন এবং আজো করে চলেছেন। কিন্তু ইখওয়ান চিন্তাবিদগণের অবস্থান এক্ষেত্রে অনেক উর্ধে। হাসান আল হুদাইবি মারহুম, আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ, মুহাম্মদ আল গাযালী, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, মুহাম্মদ কুতুব, ইউসূফ আল কারযাভী, মুস্তাফা সিবায়ী মারহুম, মুস্তাফা যারকা, আল বাহী আল খলি, ফাতহী ইয়াকীন, সাঈদ হওয়া যায়নাব আল গাযালী, সাঈদ রামাদান, ইমাম আল খাত্তাব এর ন্যায় আরো অনেকে ছিলেন বা আছেন এরা এমন দূরদর্শী বিদগ্ধ সুপন্ডিত ব্যক্তিত্ব যে ইসলামকে জীবনের বিস্তীর্ণ অংগনে বলিষ্ঠ দলীল প্রমাণসহ উপস্থাপন করেছেন। তারা শুধুমাত্র তাদের অনন্য সাধারণ জ্ঞান প্রতিভা ও লেখনী শক্তির স্বীকৃতিই সমসাময়িক বিশ্ব থেকে আদায় করেনেনি। বরং জ্ঞানের প্রতিটি মানদন্ডে এবং সাহিত্যিক হিসেবেও তাদের মর্যাদা সর্বজন স্বীকৃত। কোন নিরপেক্ষ বিশ্লেষক ও সমালোচকই এ সত্য অস্বীকার করতে পারে না। তাদের লেখনীতে নতুনের ছাপ এবং শক্তি অনেক বেশী। প্রতিপক্ষকে লাজবাব করে দেবার মত তাদের যুক্তির বাস্তবতা। আপন দীপ্ততে ভাষ্বর যদি আমরা গভীর অন্তর্দৃর্ষি দ্বারা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ণ করি তাহলে সহজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে যে অনাগত কালের বংশধরদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তুত এ স্বর্ণমালার সম্পর্কের ধারাবাহিকতা ক্রমশ ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। পক্ষান্তরে ইখওয়ানের মধ্যে এর বাঁধন আগামী দিনগুলোতে আরো সুবিন্যস্ত হবে বলে মনে হয়।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইংরেজী মাসিক আরাবিয়া (ARABIA) পত্রিকার ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর সংখ্যার উপসম্পাদক প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জনাব ফাতহী উসমান “মুহতারাম মওদূদীর জীবনী ও কৃতিত্ব” শিরোনামে একটা প্রামাণ্য তথ্যবহুল ও মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটি যদিও মৌলিকভাবে সাইয়েদ মওদূদীর (র) জীবনী ও কর্মতৎপরতার ওপর লিখিত হয়েছিলো, তথাপি বিদগ্ধ লেখক সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদ এবং সাইয়েদ মওদূদী উভয়ের সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ হৃদয়গ্রাহী তুলনামূলক আলোচনা পেশ করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর মতে সাইয়েদ হাসানুল বান্না শুরুতেই দলীয় শৃংখলা বিধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণী বিশেষত গ্রামীণ জনপদকে আন্দোলন সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত করে তোলেন, অথচ তার সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে সাইয়েদ মওদূদী লেখনী ও সংবাদ পত্রের মাধ্যমে তার সংস্কার কাজের শুভ সুচনা করেন। দলীয় ভিত্তি রচনার পূর্বে আর আকৃতি প্রকৃতি কাল্পনিক স্বরূপ ও মনস্তাত্বিক রূপরেখা পূর্ণাঙ্গ এবং ভারসাম্যপূর্ণ দলিল প্রমাণ সহ সাধারণ মুসলমানদের সামনে উপস্থপন করেন। সাইয়েদ মওদূদী বিরচিত গন্থ “আল জিহাদু ফিল ইসলাম” গ্রন্থর নাম ও পর্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যা আল্লামা ইকবাল এবং মুহাম্মদ আলী জাওহার এর মত মহান নেতা ও পথনির্দেশকগণের ভূয়সী প্রশংসা ও অকুণ্ঠ স্বীকৃত আদায় করতে সক্ষম হয়। এ দু’পথপ্রদর্শকই নওজোয়ান মওদূদী অফুরন্ত সম্ভাবনা ও প্রতিভা লক্ষ্য করে তাকে নীরবে সুশৃংখলভাবে কাজ করে যাবার জন্য উৎসাহিত করেন, প্রাচ্যের কবি সম্রাটের ঐকান্তিক উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে সাইয়েদ মওদূদী সপরিবারে হিজরত করে পূর্ব পাঞ্জাব চলে আসেন এবং দারুল ইসলাম নামক আদর্শ পল্লীর ভিত্তি স্থাপন করেন…………..
ফাতহী উসমান একদিকে যেমন ছিলেন একজন প্রখ্যাত কলামিষ্ট, সমালোচক ও আলেমে দ্বীন। তেমনি অন্যদিকে ছিলেন ইখওয়ানের অন্যতম নিবেদিত প্রাণ সদস্য। উপরোল্লেখিত লেখায় আল্লামা মওদূদী সম্পর্কে তার মূল্যায়ণ ও পর্যালোচনায় একথাও উল্লেখ করেন যে, মারহুম উন্নত চিন্তার দিক থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী এবং এ কারণে ইখওয়ানের সমস্ত নেতা ও লেখকের উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। তিনি বলেনঃ
আল্লামা সাইয়েদ মওদূদী গ্রন্থাবলী যখন আরবী ভাষায় অনুদিত হয়ে ইখওয়ানী যুবক এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীলদের হাতে পৌছে, তখন তারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তারা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেন যে, তাঁর লেখায় অত্যন্ত গভীরতা, প্রভাব যুক্তির বলিষ্ঠতা রয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক তথা প্রতিটি দিক ও বিভাগে তার রচিত গ্রন্থারাজি এমন জনপ্রিয়তা লাভ করে যার তুলনা মেলে না……………..
জনাব ফাতহী উসমানের এ মূল্যায়ন যথার্থ যে আল্লামা মওদূদীর পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যাকর। বিদগ্ধ পন্ডিত সমাজ তাঁর লেখা পাঠ করে সম্বিত ফিরে পায়। তাঁর সাথে সাথে যদি সমকালীন ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে একমাত্র উস্তাদ মওদূদী ব্যতীত অবশিষ্ট সকল লেখকের (জামায়াত ও ইখওয়ানের লেখকবৃন্দসহ) মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। ইখওয়ানের অধিকাংশ লেখক যাদের নাম উপরে উল্লেখ করা হয়েছে এর চিন্তা এবং লেখায় নতুনত্ব ও মৌলিকত্ব রয়েছে। কিন্তু জামায়াতের লেখকগণের মধ্যে অধিকাংশের ইলমী কাজ উন্নত মান ও মূল্য এবং কল্যাণকারিতাসহ সুবিন্যস্ত তথ্যের মর্যাদা রাখে।
এ বিষয়ে অধিক লেখার অবকাশ নেই। অন্যথায় উদাহরণসহ বিভিন্ন লেখকের কাজের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ করা যেতে পারতো। আরব ও পশ্চিমা দেশগুলোতে মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য সমকালীন সময়ে বহু মূল্যবান, তথ্যবহুল প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে মুর্শিদে আম তার স্মৃতি চারণ গ্রন্থে এরূপ একটা প্রবন্ধের উল্লেখ করেছেন, আমার মনে হয় মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও এসব বিষয়ে থিসিস লেখার সুযোগ দেয়া উচিত। উপরোল্লেখিত বিষয়টি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং এর তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধের শিরোনাম হতে পারে।
ইখওয়ানের প্রথম মুর্শিদে আম মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করেন। কিন্তু শাহাদাতের পূর্বে তিনি সমাজ জীবনের প্রত্যেক স্তরে সংগঠন কায়েম করেছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের মধ্যে ইখওয়ানের কাজ শুরু থেকেই খুব শক্তিশালী ও সুশৃংখল ছিলো। গ্রামীণ চাষা-ভুষা ও কিষাণ-মজুর ছিলো এ সংগঠনের আগ্রণী বাহিনী। জামায়াত প্রথম থেকেই তার কর্মসূচীর মধ্যে এসব পেশাজীবি ও শ্রমজীবিশ্রেণীর মানুষদের সুশৃংখল করার বলিষ্ঠ সংকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কার্যক্ষেত্রে এ কাজ অনেক দেরীতে শুরু হয়। ফলে জামায়াত তেমন জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি, ইখওয়ান সংশ্লিষ্ট আংগনে যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিলো। কেবলমাত্র ছাত্ররাই এমন একটা শ্রেণী যাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী ছাত্র সংগঠন ‘জমিয়তে তালাবা’ প্রথম থেকেই তৎপর ছিলো। অন্যান্য শ্রেণীর মধ্যে হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচনে কখনো কখনো জামায়াত তার প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় লাভ করেছে। যেখানে গ্রাম, গ্রামান্তরে শতকরা আশিজন লোকের বাস- তারা আজও জামায়াতের দাওয়াত থেকে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বহুদূরে অবস্থান করছে।
সাংবাদিকতার ময়দানে অবশ্য দুটি সংগঠনই বেশ কিছু কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা নিজেই ছিলেন একজন উচ্চস্তরের এবং সর্বজন স্বীকৃত সাংবাদিক। তিনি ছাড়াও মালিক নাসরুল্লাহ খান আযীয মারহুম, মিসবাহুল ইসলাম ফারূকী মারহুম, মুহতারাম আবদুল হামিদ সিদ্দিকী, নাঈম সিদ্দিকী, মাহেরুল কাদেরী মারহুম, চৌধুরী গোলাম জিলানী, হাসের ফারূকী, মাহমুদ আহমাদ মাদনী, মুজাফফর বেগ অনেক নওজোয়ান সাংবাদিক সাংবাদিকতার জগতে তাদের আসন করে নিয়েছেন। ইখওয়ানও সাংবাদিকতার ময়দানে অনেক বিধিনিষেধ সত্ত্বেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
জনাব উমর তিলমিসানী, হুসাইন আশুর, জনাব সালেহ আল ইসমাদী মারহুম, ফাতহী উসমান, নিশাত আল মিসরী, মুহাম্মাদ সালাহ উদ্দীন (আল-মাদানী), ইসমাঈল শাত্তী, ডক্টর মুহাম্মদ মাওরিদ এবং আরো অগণিত ইখওয়ানী সাংবাদিক এ পেশায় তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতি আদায় করেছেন। অনেক বিধিনিষেধ আরোপ সত্ত্বেও বেশ কয়েকটা দুনিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। সাংবাদিকতার জগতে দুটি সংগঠনের লেখকগণই ধর্মনিরপেক্ষ, কমিউনিষ্ট, বেদ্বীন, সুযোগসন্ধানী সরকারের বেতনভোগী সাংবাদিকদের সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছেন।
উপরে জনাব ফাতহী উসমানের যে প্রবন্ধের উল্লেখ করা হয়েছে তাতে তিনি ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ ও সাইয়েদ মওদূদীর (র) ব্যক্তিত্বের তুলনামূলক আলোচনা করে বলেছেন যে, দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বি ব্যক্তিত্বের প্রত্যেকেই দ্বীনি এবং আধুনিক জ্ঞানে সুগভীর পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। দ্বীনের সামগ্রিক ধারণা তাদের চিন্তা-চেতনা এবং মতামতে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তারা উভয়েই ইসলামকে দ্বীন ও দুনিয়ার একমাত্র অনুসরণকারী আদর্শ বলে মনে করতেন। তাদের দৃষ্টিতে দ্বীন ও সরকার দুটি ভিন্ন জিনিস ছিল না। বরং একই যন্ত্রের দুটো অংশ মাত্র ছিলো। আলেম সমাজ ও রাজনীতিবিদ এই দুটি শ্রেণীর জন্যই এ ধারণা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই সরকার এবং মিসর ও মিহরাব উভয়স্থান থেকেই তাদের বিরোধিতা করা হয়েছে।
বস্তুত ফাতহী উসমান সাহেবের এই মূল্যায়ণ সম্পূর্ণ সঠিক ও যথার্থ। মিসরে যদিও আলেমদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা ততটা জোরদার হয়নি যতটা দেখা গিয়েছে এ উপমহাদেশে। তথাপি আলেমদের একটা ক্ষদ্র অংশ ইখওয়ানের বিরুদ্ধে ফতোয়া দান এবং তাদেরকে ‘বিভ্রান্ত সংগঠন’ বলে মন্তব্য করাকে তাদের জীবনের মিশন বানিয়ে নিয়েছিলো। এখন থাকে জামায়াতে ইসলামী ও এ উপমহাদেশের আলেমদের ব্যাপারে। এ ক্ষেত্রে এই বেদনাদায়ক বাস্তবতা কারো নিকটই অস্পষ্ট নয়। উরামা শ্রেণী প্রথম দিন থেকেই জামায়াত এবং জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে পুরোপুরি যদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বসেছিলো। সত্যনিষ্ঠ নগণ্য সংখ্যক আলেম ছাড়া সবাই তাদের সে অনমনীয় আচরনের ওপর এখনো অটল রয়েছে। সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর বিরোধিতা তো কিছুটা উপলব্ধি করা যায় কিন্তু দ্বীনি আলেমদের এ কর্মনীতি একাধারে দুঃখজনক এবং বিস্ময়কর!
ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি ভিন্ন নয়। এ কারণেই ইখওয়ান ও জামায়াত উভয় সংগঠনই যুগপৎ জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগের সংশোধন সংস্কারে সাথে সাথে রাজনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইখওয়ান কখনো রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণের অনুমতিই লাভ করেনি। জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিক ময়দানে বাহ্যতঃ তেমন উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। যদিওে সংগোপনে ও একান্তভাবে অর্থাৎ সাংগঠনিকভাবে প্রচুর সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ একমত যে, এসেম্বলী এবং কাউন্সিল নির্বাচনী আসনসমূহের অধিকাংশ ক্ষেত্রে জামায়াতের ব্যর্থতা সত্ত্বেও দেশের সাধারণ রাজনৈতিক ময়দানে শাসনতন্ত্র ও সংবিধান প্রণয়ন ও পরিবর্তনে অনৈসলামিক দৃষ্ঠিভংগীর মোকাবিলায় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও জনমত সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ প্রেমিক এবং ইসলামপ্রিয় শক্তির সাথে জামায়াতের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ দেদীপ্যমান। জামায়াতের সুসংগঠিত প্রচেষ্টা এবং এর কর্মীদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা বিরুদ্ধবাদীদের নিকট প্রশংসা কুড়িয়েছে। কোন ব্যতিক্রম ছাড়া দেশে আজ পর্যন্ত কোন আন্দোলনই জামায়াতের অংশগ্রহণ ছাড়া সফলতার মুখ দেখতে পায়নি।
প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর ফাঁসির পর বেগম নুসরাত ভুট্টো যখন তার প্রতিশোধমূলক রাজনীতিকে সফল করার লক্ষ্যে গণতন্ত্র “পুনর্বহাল আন্দোলন” নামে একটা আন্দোলন পরিচালনা করতে চাইলে দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ তাঁর পায়ের কাছে গিয়ে ধর্ণা দেন। আন্দোলন পরিচালনা সকল চেষ্টা যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছিলো তখন নুসরাত ভুট্টো সাহেবকে এরূপ মন্তব্য করতে হয়েছিলো যেঃ
“যতোদিন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী কোন আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ না করে, ততদিন তার সফলতা নিশ্চিত হতে পারে না।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটা জামায়াতের জন্য এমন একটা সার্টিফিকেট যা একজন প্রবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিতে হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মরহুম একবার বলেছিলেন যে, এদেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের একটা মূল্য আছে; কারো কম আবার কারো কিছু বেশী। সে মূল্য আদায় করে দিলেই আপনি তাকে পেয়ে যাবেন। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর লোকদের কোন মূল্য নেই। তাদেরকে না খরিদ করা যায় না দমন করা যায়। প্রায় একই রকম বিবৃতি আইয়ুব খান সাহেবেরই এক ঘনিষ্ঠ সাথী এ, কে, সুমার মরহুমও করাচীতে মৌলিক গণতন্ত্রের অধীন এম, এন, এ নির্বাচিত হবার পর দিয়েছিলেন।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে জামায়াত কখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে বিজয়ী হতে পারেনি। কিন্তু ভুট্টোর মত একনায়ক যিনি ক্ষমতার মসনদ মজবুত হওয়ার ব্যাপারে গর্বিত ছিলো শেষ পর্যন্ত ইছরায় অবস্থানরত দরবেশের নিকট গিয়ে হাজির হতে হয়েছিলো। এটা জামায়াতের শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির অনস্বিকার্য প্রমাণ। দেশে যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও স্বাধীন ন্যায়ানগ পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকতো, তাহলে জামায়াত দেশের রাজনীতিতে এসেম্বলীতেও এতদিনে একটা শক্তি-হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারতো। তাছাড়া পকিস্তান আরো একটা সমস্যার সম্মখীন আর তা হচ্ছে এখানকার নির্বাচন পদ্ধতি। যদি কখনো ভুলক্রমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছেও তাহলে কারচুটি ও অসৎ পন্থা ছাড়াও তা হয়ে থাকে। বৃটিশ পদ্ধতির নির্বাচন সে বিষয়ে স্বয়ং বৃটেনের রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জনমত বর্তমানে সন্তুষ্ট নয়। ভোটার সিন্ধুর ভালুকাময় প্রান্তরে, বেলুচিস্তানের কঙ্করময় উপত্যকায়, পাঞ্জাবের গ্রামে গঞ্জে এবং সীমান্তের বরফাবৃত পর্বত চূড়ায় অর্থাৎ দেশের সর্বত্রই জামায়াতের ভোটার রয়েছে। কিন্তু তারা আছে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যদি আনুমানিক প্রতিনিধিত্বের নীতি গ্রহণ করা হয় তাহলে সব ভোট জাতীয় বা প্রাদেশিক পর্যায় একত্র হয়ে নির্বাচনের ফলাফলকেই বদলে দিতে পারতো।
প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই জামায়াতকে ভয় পায়। এদেশের ক্ষমতার মসনদে কোন ধর্মহীন অথবা মদ্যপায়ী আরোহন করুক কিংবা বাহ্যত কোন দ্বীনদার নামাযী শাসনকর্তা জেকে বসুক সরকারের গোটা মেশিনারী জামায়াতের অগ্রগতিতে অন্তরায় সৃষ্টির জন্য সকল শক্তি নিয়োজিত করে। এটা কতই না বিস্ময়কর যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দেশের চারটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্রে আনুমানিক প্রতিনিধিত্বের দাবী পেশ করা হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ব্যতীত অন্যসব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের ঘোষণাপত্র থেকে দূরে সরে গিয়েছে। পিপলস পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, তাহরীকে ইস্তিকলাল ও জামায়াতে ইসলামী সকলেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবী করেছিলেন। যদিও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দ্বারা অন্যান্য পার্টি লাভবান হতে পারতো। কিন্তু বিদ্বেষের কারণে তারা সবারই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে অনীহা দেখা যায়।
রাজনৈতিক ময়দানে ইখওয়ান এখনো স্বাধীনভাবে অংশ গ্রহণের অনুমতি পায়নি। সিরিয়া, মিসর, জর্দান এবং সুদানে এ সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিস্তারিত বিশ্লেষণে না গিয়ে আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, ইখওয়ানকে যদি জামায়াতের ন্যায় নির্বাচনে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক দৃশ্যটাই বদলে যাবে। গত বছর মিসরে যে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির নির্বাচন হয়ে গেলো তার উল্লেখ করেছেন মুর্শিদে আম তিলমিসানী (র) তার স্মৃতিচারণ গ্রন্থে। এ নির্বাচনে ইখওয়ান ছাড়াও দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে অংশ গ্রহণের ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিলো। কোন বৈধ রাজনৈতিক দলের সাথে জোট গঠন ও ঐক্যফ্রন্ট করা ব্যতীত ইখওয়ানের কোন গত্যন্তর ছিলো না। অতএব সংগত কারণেই ইখওয়ান “হিজবুত আফদুল জাদীদ” এর সাথে মোর্চা গঠন করে। প্রায় সাড়ে চারশত আসনের মধ্যে “হিজবুল অফদ” ইখওয়ানকে শুধু আঠারটি আসনে তাদের প্রার্থী মনোনয়নের অনুমতি প্রদান করে। অথচ ইখওয়ানের দাবী ছিলো তাদেরকে অন্তত শাতধিক আসনে প্রার্থী মনোনয়নের অনুমতি দেয়া হোক। কিন্তু হিজবুল অফদ তাদের সিদ্ধান্তের উপর অটল থাকে। ফলে ইখওয়ান আঠারটি আসন ছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত আসনেই হিজবুল অফদ এর প্রার্থীকে নির্বাচনী যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে দেয়।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবার পর সকলেই হতবাক হয়ে যায় এবং চোখ কপালে তুলে নেয়। হিজবুল অফদ এবং ক্ষমতাসীনদল ছাড়া অন্যান্য পার্টি হিজবুত তাজাম্মু ও হিজবুল আহরার প্রভৃতির কেউ-ই একটা আসনও লাভ করতে পারেনি। হিজবুল অফদ সর্বমোট আটান্ন আসন পেয়ে যায়। তন্মধ্যে আট চল্লিশ আসনে জয়লাভ করে হিজবুল অফদ এর সদস্যরা। অবশিষ্ট দশ আসন লাভ করে ইখওয়ান। ইখওয়ান আঠারজনের মধ্যে দশজন প্রতিনিধির বিজয়লাভ বড় রকমের সফলতাই বটে। আরো উল্লেখ যে অন্য কয়েকটি আসনেও ইখওয়ানের প্রার্থীগণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিদের চেয়ে অধিক ভোট লাভ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতিই এমন ছিল যে, তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ, প্রত্যেক জেলাকে নির্বাচনী এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিলো এবং জেলার সীমানা সরকার তার মর্জিমত করে নিয়েছিলো। এখন মনে করুন একটা নির্বাচনী জেলায় চার কিংবা পাঁচটি রয়েছে। প্রত্যেক পার্টি তাদের চার অথবা পাঁচজন প্রার্থী মনোনয়ন দান করবে এবং প্রত্যেক প্রার্থী নিম্নোক্ত ছকে বর্ণিত জেলায় তার প্রতিদ্বন্দির মোকাবিলা করবে। কিন্তু ফলাফলের ঘোষণা দেয়ার কথা সামষ্টিক ভোটের আলোকে। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করুন। মনে করি ‘ক’ নামক জেলায় রয়েছে চারটি আসন আর এ আসনগুলোতে নিম্নোক্ত প্রতিনিধি ও দলসমূহ অংশ গ্রহণ করছে।
নির্বাচনী জিলা- ক
এলাকা নং- ১
ক্ষমতাশীন দলা অফদ পার্টি অন্যান্য পার্টি ১২ হাজার (অফদী) ২ হাজার ৯ হাজার এলাকা নং -৩ ক্ষমতাশীন দল অফদ পার্টি অন্যান্য দল ৯ হাজার (ইখওয়ানী) ৩ হাজার ১৪ হাজার |
এলাকা নং- ২
ক্ষমতাশীন অফদ পার্টি অন্যান্য দল দল ১৫ (অফদী) ২ হাজার ১১ হাজার এলাকা নং- ৪ ক্ষমতাশীন অফদ পার্টি অন্যান্য দল দল ২৬ হাজার (অফদী) ১ হাজার ১৩ হাজার |
উপরোক্ত নকশার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে অফদ পার্টি ’ক’ জেলার অধীনে চারটি আসনের প্রত্যেকটিতেই তার প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলো। তন্মধ্যে তিন অঞ্চলেই ছিলো অফদ পার্টির প্রার্থী এবং মাত্র একটা এলাকায় ছিলো (ক অঞ্চল-৩) ইখওয়ানের প্রার্থী। ইখওয়ানের মনোনীত প্রার্থীগণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিদের উপর সুস্পষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছিলো। কেননা ঐ অঞ্চলে সর্বমোট ছাব্বিশ হাজার ভোট পড়েছিলো। তন্মধ্যে ইখওয়ানের প্রার্থী লাভ করে চৌদ্দ হাজার ভোট, ক্ষমতাশীন দলের প্রার্থী পায় নয় হাজার ভোট আর অন্যান্য দলের প্রার্থীরা পায় মাত্র তিন হাজার ভোট। এরূপ একক ও নিরংকুশ বিজয় লাভ করা সত্ত্বেও ইখওয়ানের প্রতিনিধিকে বিজয়ী ঘোষণা করা যেতে পারে না। কেননা তার অপর তিন সাথী তাকে নিয়েই ভরাডুবির শিকার হয়েছে। তাই ভোট গণনা করার সময় চার অঞ্চলের সংগৃহিত ভোটই একত্রিত করা হয় এবং গড় গণনায় যে দলের প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে, তারাই সমস্ত আসনে জিতে যায়। তা ছাড়া যেদল বা জোট শতকরা আট ভাগেরও কম ভোট পায়। তাদের প্রাপ্ত ভোটেও এগিয়ে থাকা দলের অনুকূলে হিসেব করা হয়।
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী ‘ক’ জিলার ভোটার সংখ্যা ও আসনসমূহ চিহ্নিত করার জন্য চার অঞ্চলের ভোট এক পুলে নিয়ে একত্র করা হয়।
ক্ষমতাশীন দল অফদ পার্টি অন্যান্য দল
‘ক’ নির্বাচনী অঞ্চল ১২ হাজার ৯ হাজার ২ হাজার
‘খ’ ” ” ১৫ হাজার ১১ হাজার ২ হাজার
‘গ’ ” ” ৯ হাজার ১৪ হাজার ৩ হাজার
‘ঘ’ ” ” ১৬ হাজার ১৩ হাজার ১ হাজার
নির্বাচনী ফলাফল ৫২ হাজার ৪৭ হাজার ৮ হাজার
এভাবে চার আসনেই সরকারীদল বিজয়ী হয়ে যায়। এদিকে অফদ ও ইখওয়ান সম্মিলিতভাবে যে আটান্ন আসনে বিজয় লাভ করে, তা বিভিন্ন নির্বাচনী জেলায় সামষ্টিক বিজয়ের কারণে হয়। ইখওয়ানের মুর্শিদে আম মুহতারাম উমর তিলমিসানী (র) নির্বাচনোত্তরকালে এক সাক্ষাতকারে এ তথ্য প্রকাশ করেন যে, কিছু সংখ্যক ইখওয়ান অফদ পার্টির এলাকা থেকেও নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে পৌছে গেছে। তিনি অবশ্য তাদের সংখ্যা ও নাম বলতে অনীহা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, সরাসরি ইখওয়ানের পরিচয়ে ও তাদের ব্যানারে যেহেতু আমাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের অনুমোদন নেই, তাই আমরা অত্যন্ত সুকৌশলে প্রত্যেক প্লাটফরম ব্যবহার করে পার্লামেন্টে গিয়ে পৌছার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। মিসরীয় পার্লামেন্টে গমনকারী দশজন ইখওয়ানী সদস্যের প্রত্যেকে খুবই যোগ্যতাসম্পন্ন এবং স্বীয় দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে সম্পাদনে সদা প্রস্তুত। বিদায়ী পার্লামেন্টেও ইখওয়ানের কোন কোন সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো। তাদের মধ্যে শাইখ সালাহ আবু ইসমাঈলও ছিলেন। তিনি এবারও বিজয়ী দশজন সদস্যের অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। যারা অফদ পার্টির টিকেটে বিজয় লাভ করেছে। প্রচলিত নির্বাচনে পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন লাভের কোন সুযোগ নেই। শাইখ সালাহ আবু ইসমাঈলই অফদ পার্টিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন পার্লামেন্টে। যার ফল দাঁড়ায় এই যে, সরকার ইখওয়ান ব্যতীত অন্য সকল দলের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। যেসব পার্লামেন্ট সদস্য স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন, তাদেরকেও এখতিয়ার দেয়া হয় যে, তারা ইচ্ছা করলে কোন দলের পতাকা তলে সমবেত হতে পারেন। হিযবে আফদ এর প্রধান ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন গিয়ে শাইখ সালাহ আবু ইসমাঈলের নিকট আবেদন জানায় যে, তিনি যেন অফদ পার্টির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন যেহেতু ইখওয়ানের ওপর বরাবর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিলো সেহেতু পারস্পারিক পরামর্শক্রমে ইখওয়ানে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে শাইখ সালাহ অফদের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
শাইখ সালাহ ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী, সামাজিক, বন্ধুপ্রতীম, খুবই উন্নত চরিত্রের অধিকারী এবং অনুপম নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন। তার সুন্দর চেহারায় সর্বদা লেগে থাকতো মুচকী হাসির দৃপ্তি। সুদানে তার সাথে আমার সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিত্ব, যুক্তি-প্রমানসব স্বীয় বক্তব্য উপস্থাপন করা তার বৈশিষ্ট্য। কিছু দিন তিনি পার্লামেন্টে একাকী ছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই আরো আটজন সদস্য তার সাথে এসে মিলিত হয়। অফদ এর বর্তমান পার্লামেন্টারীদলের নেতা মমতাজ নাসার ছিলেন এ গ্রুপে এসে শামিল হওয়া সর্বাশেষ সদস্য।
শাইখ সালাহ আবু ইসমাঈল মূলত একজন আলেমে দ্বীন। কিন্তু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং বিশেষ করে পার্লামেন্টারী বিষয়েও তাঁর রয়েছে সুগভীর পান্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টিভংগী। বিগত পার্লামেন্টে তিনি যেরূপ বিচক্ষণতার সাথে কয়েকটা বিল উত্থাপন করেছিলেন এবং পার্লামেন্টে আলোচনা পর্যালোচনা চলাকালে অকট্য যুক্তি ও বাক চাতুর্য দ্বারা তার দৃষ্টিভংগী তুলে ধরেছেন এবং সেগুলো পাশ করিয়ে ছেড়েছেন তা পার্লামেন্টারী ইতিহাসে কোন একক ব্যক্তির মহাকৃতিত্ব হিসেবে উজ্জল ও ভাস্কর হয়ে থাকবে। এটা অবশ্য স্বতন্ত্র কথা যে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঐ সব আইনে সাক্ষরদানকারী ক্ষমতাসীনদের তাতে স্বাক্ষর দিয়ে ইতিহাসে নিজেদের সুখ্যাতি লিপিবদ্ধ করানোর তাওফীক ও সৌভাগ্য হয় না।
বর্তমানে পার্লামেন্টে এক ভাষণ দানকালে জনাব মুহাম্মদ আল মুরাগী (ইখওয়ানের প্রখ্যাত সদস্য) সরকারের নিকট দাবী জানান যে, ইখওয়ানকে আইনানুগভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ এবং পার্লামেন্টারী গ্রুপ গঠন করার অনুমতি দেয়া হোক। তিনি আরো বলেন, আমি প্রথমেও ইখওয়ানী এবং শেষেও ইখওয়ানী এবং সুকৃতির আদেশ ও দুষ্কৃতির প্রতিরোধ আমার জীবনের একমাত্র কর্তব্য। যা থেকে আমি কখনো কোন অবস্থায়ই উদাসীন থাকতে পারি না।
এ ঘটনার উল্লেখ করে কুয়েতের মাসিক ম্যাগাজিন ‘আল মুজতামা’ ১৯৮৫ ঈসায়ীর ৮ই জানুয়ারী সংখ্যায় যে জনাব আল মুরাগীর বক্তব্যের জবাবে পার্লামেন্ট বিষয়ক মন্ত্রী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে স্বীকার করেন যে, ইখওয়ান প্রকৃতপক্ষে দেশেপ্রেমিক ও ইসলামের পতাকাবাহী দল। জনসাধারণ এ দলকে খুবই ভালবাসা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। মন্ত্রী তাওফীক আবদুহু ইসমাঈলের এ সাহসিকতাপূর্ণ স্বীকৃতি সমগ্র মিসর এমনকি পুরো মুসলিম জাহানে অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে শ্রুত হয়। ইখওয়ানের মুর্শিদে আম জনাব ওমর তিলমিসানী এ বিষয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে বললেনঃ
সত্য সত্যই, কেউ তা স্বীকার করুক বা নাই করুক। তথাপি ইখওয়ানের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত এমন অকপটে ও দ্বিধাহীন চিত্তে কোন মন্ত্রী প্রকৃত সত্যকে স্বীকার করে নিলো। আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মনে করি যে, এটা একটা সঠিক পদক্ষেপ যার ফলাফল ইনশাআল্লাহ দেশ, জাতি এবং ইসলামের অনুসারীদের জন্য খুবই উপকারী ও আনন্দদায়ক হবে।
অতিসম্প্রতি উমর তিলমিসানী একটি সাক্ষাতকার আরবী প্রকাশিত দৈনিকগুলোতে হয়েছে। মিসরে ইখওয়ানের সমর্থকদের সংখ্যা কত এ বিষয়ের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি অকপটে তাৎক্ষনিক জবাব দেন যে, “শতকরা নববই ভাগ কিংবা তদপেক্ষা কিছু বেশী”। সংবাদপত্রের প্রতিনিধিগণ বিস্মিত হয়েও পুনরায় জিজ্ঞাস করে যে, “এর প্রমাণ কি”? তিনি জবাবে বলেনঃ আজই ইখওয়ানকে আইনগত অধিকার দিয়ে দেখো এবং দেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করো। তাহলে প্রমাণ পেয়ে যাবে। যদিও মুর্শিদে আম-এর এ অনুমান বাহ্যতঃ প্রত্যাশা বলেই মনে হয়। তথাপি এটা অনুস্বীকার্য যে সর্বাসাধাণের নিকট ইখওয়ান খুবই প্রিয় একটি সংগঠন।
৭১ পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্টের ইতিহাসে জামায়াত ইসলামীর সদস্য অতি নগণ্য সংখ্যায় জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদে তাদের তৎপরতা সর্বদা গৌরবোজ্জলও প্রমাণিত হয়েছে। ইউনাইটেড পাকিস্তানে মাওলানা আবদুস সোবহান, এ, কে, এম ইউসুফ এবং আব্বাস আলী খান এবং বিভাগোত্তর পাকিস্তানের অধ্যাপক গফুর আহমদ মাহমুদ আযম ফারূকী, ডাক্তার নাজির আহমদ শহীদ এবং সাহেব জাদা শফি উল্লাহ প্রমূখ যোগ্যতম পার্লামেন্টেরীয়ান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রশ্নোত্তর পর থেকে কিংবা বাজেট, পররাষ্ট্র বিষয় অথবা আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃংখলা বিধানের বিল পার্লামেন্টে আলোচনার বিষয় হিসেবে স্থান লাভ করুক- প্রত্যেক ক্ষেত্রে সকল পর্যায়েই হাতেগণা এই পার্লামেন্ট সদস্যগণ তাদের অস্তিত্ব ও অবস্থান কোন ক্ষেত্রেই- কম নয় বলে সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নিকট থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। জনগণের মধ্যে কবে নাগাদ উপলব্ধি জাগ্রত হবে যে, এসব লোকই তাদের অধিকারের বিশ্বস্ত সংরক্ষক যাদের কর্মজীবন নিষ্কলুস এবং যাদের যাবতীয় প্রয়াস-প্রচেষ্টা পংকিলতা ও আবিলতা মুক্ত। জামায়াতে ইসলামীরও দায়িত্ব রয়েছে যে, অফিসের সীমানার বাইরে গিয়ে এবং তাদের রিপোর্টের পর্দা ছিন্ন করে বাস্তব ময়দানের চাহিদা ও সময়ের দাবীর প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করবে। ইখওয়ান জনগণকে সচেতন করে ও জাগিয়ে তুলে নিজেদের সাথে একাত্ম করে নিয়েছে। জামায়াতকে এ ক্ষেত্রে এখনও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে।
অবশ্য ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামী উভয় সংগঠনই কঠোর পরীক্ষা ও প্রতিকুলতার বিভিন্ন মনজিল অতিক্রম করেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, দুনিয়াতে হকের বিজয়ের জন্য যখনই কোন ব্যক্তি বা দল সাহসিকতার সাথে মাথা উঁচু করেছে তখনই তাদেরকে এসব মনযিল অতিক্রম করতে হয়েছে। কুরআন মজীদে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার হাদীসেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমান ও ঈমানের পরীক্ষাকে পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন।
মুর্শিদে আম জনাব ওমর তিলমিসানীর এই স্মৃতি কথার স্থানে স্থানে এমন সব ঘটনা বর্ণনা আপনার দৃষ্টিগোচর হবে যা থেকে আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে বলিষ্ঠ ঈমান ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী ইখওয়ানী মুজাহিদগণ তাদের মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্দির স্বার্থে সকল প্রকার ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করার জন্য সদা প্রস্তুত হয়ে থাকতো। বাতিল তার সমস্ত শক্তি ও নষ্টামী সত্ত্বেও তাদের মজবুত অবস্থানে কোন প্রকার বিচ্যুতি সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রথম মুর্শিদে আমকে তাঁর পূর্ণ যৌবনে মাত্র তিতাল্লিশ বছর বয়সে যেরূপ নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয় সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার ওপর বেশ কয়েকটা বই লেখা হয়েছে। আবদুল কাদের আওদা শহীদ ও তার সংগীদেরকে ১৯৫৪ সালে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। এসব অমূল্য জীবনের অকাল পরিসমাপ্তি শুধুমাত্র নীল উপত্যকারই ক্ষতি হয়নি বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ অদ্যাবধি ও ক্ষতির জন্য তড়পাচ্ছে।
১৯৬৬ সালে পুনরায় সমকালীন ফেরাউন চলতি শতাব্দীর মহান ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ইসলামের কৃতি সন্তান সাইয়েদ কুতুব ও তার সাথীদেরকে ফাঁসি দেয়। এ ক্ষত কোন দিনও শুকাবে না কিংবা এ ব্যাপক ক্ষতির কোন ক্ষতিপূরণও কোন দিন হবে না। এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিলো সত্যের এ কাফেলাকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে দেয়া। কিন্তু এ অশুভ উদ্দেশ্য লাভে তাগুতী শক্তি কি আদৌ সফলকাম হয়েছে? কখখনো না!
জামায়াতে ইসলামীর উপরও বহু পরীক্ষা এসেছে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতাকে মৃত্যুদন্ড শুনানো হয়েছিল এবং তার ঘনিষ্ঠ সাথীদেরকে দীর্ঘ মেয়াধী কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এটা ১৯৫৩ সালের কথা, অর্থাৎ আওদা শহীদের শাহাদাতের এক বছর পূর্বে এবং ইমাম হাসানুল বান্না শাহাদাতের চার বছর পরে। ক্ষমা প্রার্থনার কথা উঠলে সাইয়েদ মওদূদী (র) এর মুখ থেকে সেই ঐতিহাসিক উক্তি উচ্চারিত হয় যা সোনালী হরফে লেখা হয়ে আছে এবং যার দীপ্তি কিয়ামত পর্যন্ত সত্যের পথের পথপ্রদর্শনের পথ দেখাতে থাকবে। তিনি বলেছিলেনঃ “শুনে রাখো—–মৃত্যু এবং জীবনের ফয়সালা এ জীমনের উপর হয় না। বরং আসমানে হয়ে থাকে। যদি আমার মৃত্যুর সময় হয়ে থাকে, তাহলে দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাকে বাঁচাতে পারবে না। আর যদি আমার জীবনের সময় এখনো বাকি থেকে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরাই উল্টো ফাঁসিতে ঝুলে যাবে। আমাকে মারতে পারবে না। এরপর থাকে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনের ব্যাপারটি। এরূপ দয়া ভিক্ষা কেবল একটি সত্তার কাছেই করা যেতে পারে যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। তোমাদের কাছে আমার জুতার কাঁটাও ক্ষমা চাইবে না………….।
এ উক্তির প্রতিধ্বনিতে বাতিলের প্রাসাদে ভূমিকম্পের কাঁপন ধরেছিলো এবং উক্তিকারী যে দৃঢ় বিশ্বাস থেকে একথা উচ্চরণ করেছিলেন সেই বিশ্বাসই ছিলো তাঁর কর্ম ও পুঁজি। জীবন অবশিষ্ট ছিল। তাই ফাঁসির কুঠরিতে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়া এবং ফাঁসির রজ্জু গলায় পরার সময় ক্ষণ নির্ধারিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সত্যের সৈনিক বেঁচে থাকলেন। মৃত্যু পরাভূত হয়েছিলো এবং জীবন আশাভরা দৃষ্টিতে মুচকি হেসে ভবিষ্যত পানে তাকাচ্ছিলো।
আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে জামায়াতে ইসলামীর বার্ষিক সম্মেলনে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী দ্বারা আক্রমণ করানো হয়। এবারেও লক্ষ্য ছিলো সেই মর্দে দরবেশ যিনি ইতিপূর্বে আল্লাহর হুকুমে মৃত্যুকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁকে লক্ষ্য করেই গুলী বর্ষিত হচ্ছিলো এবং তাঁকে বসে পড়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তাঁর কণ্ঠ আরেকবার গর্জে উঠলো এবং চির অমর হয়ে থাকলো। “যদি আমি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?” ১৯৫৩ সনের ঘটনা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখ থেকে শুনেছিলাম এবং বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম। কিন্তু এ ঘটনা হাজার হাজার মানুষের মতো লেখক স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলো এবং ঈমান দীপ্ত কথা নিজ কানে শুনেছিলো। আজও ঐ কথাটির মুধরতা এবং তার সাথে ঈমানী শক্তি ও উষ্ণতা আমি নিজ কানে শুনেছিলাম এবং হৃদয়ের গভীরে উপলব্ধি করেছিলাম।
আল্লাহ বখশ শহীদ জীবনের নজরানা পেশ করলেন। এই অমূল্য জীবন হক এর রাস্তায় কুরবানী করার পর আন্দোলনের নেতা উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন।
“আমি এ মোকদ্দামা এমন এক আদালতে দায়ের করেছি যেখানে হক ও ইনসাফের সাথে ফয়াসালা হয়ে থাকে।” কবির ভাষায়ঃ
এ শহীদানের রক্তপণ গীর্জাধিপতিদের নিকট চেতনা!
যে খুনের মর্যাদা ও মূল্য হারাম শরীফ থেকেও পবিত্র!!
সে আদালতে ফয়সালার দিন তো নির্ধারিত সময়েই আসবে কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক আল্লাহ এই নশ্বর পৃথিবীতেও শ্রেষ্ঠ ও ঘটনার নায়কদের ভয়বহ পরিণতির সম্মুখীন করেছিল তা সত্যিই শিক্ষণীয়।
কারা জীবনের দুঃখকষ্ট জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা এবং মজলিশে শূরার সকল সদস্যকে বার বার ভোগ করতে হয়েছে। তথাপি বাতিলের সম্মুখে তারা কখনো মাথানত করেনি বা নতজানু হয়নি। সন্ত্রাস ও ভয়-ভীতি দ্বারা সত্যানুরাগীদের হত্যোদম ও ভগ্নোৎসাহ করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রলোভনের ইন্দ্রজাল বিছিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু বাজপাখীকে কোন মূল্যেই ফাঁদে ফেলা যায়নি।
মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু কোন অস্ত্র দিয়েই বিশ্বস্তদের অবিশ্বাসী ও নীতিহীন লোকদের সম্মখে নত করানো যায়নি। ভুট্টো ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করার পর দেশ বাসী তার নিকট থেকে জঘন্য একনায়কত্ব ও স্বৈরাশাসন উপহার পেয়েছে। প্রথমে দেশকে টুকরো টুকরো করা হলো। তারপর দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীদের নাম ও নিশানা মুছে ফেলার ঘৃণ্যতম পরিকল্পিত চক্রান্ত করা হলো। মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদকে গ্রেফতার করার পর জিন্দানখানায় তার সাথে এমন দুর্ব্যবহার করা হয় যা সকল যুগের বর্বরতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। অথচ তিনি ছিলেন অত্যন্ত মার্জিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যার স্বভাবজাত সৌজন্য ও আভিজাত্য তার কট্টর বিরোধীরাও অকপটে স্বীকার করে থাকে। তাকে কারাগারের অন্ধকার প্রকেষ্ঠ গুণ্ডা বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে একান্ত নিষ্ঠুরভাবে চাবুক মারা হয়। তিনি দিনরাত তাদের অশ্রাব্য গালি গালাজের শিকার হতে থাকেন। তথাপি তাঁর অবিচল পায়ে না একটু কম্পন সৃষ্টি হয়েছে না তার আন্দোলনের সাথীদের উৎসাহ উদ্দীপনায় কোন প্রকার ভাটা পড়েছে।
ডাক্তার নাযীর আহমদ এবং অন্যান্য অগনিত অকুতোভয় নেতা ও নিবেদিত প্রাণ কর্মীদেরকে পিপলস পার্টির গুন্ডা এবং এফ, এইচ এফ এর হায়েনারা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেয়। তা সত্ত্বেও কাফেলার অগ্রগতি ব্যাহত হয়নি। এসব ঘটনাপ্রবাহ এখন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রতিটি ছাত্র এসব কাহিনী সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিফহাল রয়েছে।
জামায়াতের উপর যেসব কঠোর পরীক্ষা আপতিত হয়েছে তা ছিল জামায়াতের ধৈর্যের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য। কিন্তু ইখওয়ানের ওপর অত্যাচার উৎপীড়নের কোন তুলনাই মেলে না। বছরের পর বছর এ মহাপ্রাণ ব্যক্তিগণ যে পরিমাণ জুলুমেরন চাকায় পিষ্ট হয়েছেন কলম তা লিপিবদ্ধ করতে অক্ষম। তথাপি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পানে আগুয়ান এ কাফেলা আজও তার মনজিলে মাকসুদ অভিমুখে নিরন্তর ধাবমান রয়েছে। এটা তাদের বলিষ্ঠ ঈমান ও জিহাদী উদ্দীপনার অনস্বীকার্য প্রমাণ। বস্তুত বর্তমান শতাব্দীতে পরিচালিত দুনিয়ার কোন আন্দোলনের উপর এমন দুঃসহ বিপদ মুসিবত আসেনি যা এসেছে ইখওয়ানের ওপর। এ বিষয়ের বর্ণনা দিয়ে ইখওয়ানের নেতৃবৃন্দ প্রচুর লিখেছেন যা বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে সত্যানুসন্ধানীদের ঈমানের উৎকর্ষ সাধনে নিয়োজিত রয়েছে। মুর্শিদে আম-এর এ স্মৃতিচারণ গ্রন্থে উল্লেখিত কিছু সংখ্যক ঘটনা পড়লে শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায় এবঙ মনের মণিকোঠা থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে এরূপ দৃঢ়বিত্ত মহাপ্রাণ ব্যক্তিদের জন্য দোয়া বেরিয়ে আসে।
মুর্শিদে আম তিলমেসানী (আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবি করুন) তার এ গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলী ছাড়াও সম্প্রতি অপর এক সাক্ষাতকারে আরো কিছু হৃদয় বিদারক ও লোমহর্ষক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। “আল অতানুল আরাবী” পত্রিকায় প্রকাশিত এ সাক্ষাতকার থেকে একটা ঘটনা “আল মুজতামা” সাময়িকী তার ১৯৮৫ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশ করেছে। সাংবাদিক প্রতিনিধিবৃন্দ মিসরের নিবেদিত প্রাণ মুসলিম নওজোয়ানদের সম্পর্কে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে মুর্শিদে আম তার জবাবে বলেনঃ
তোমরা এ মানবতা বিধ্বংসী অত্যাচার-উৎপীড়নের প্রতি কেন শুধু অসহায়ের মত দৃষ্টিপাত করতে চাও, যা এ যুবকদের ওপর মিসরীয় কয়েদখানায় চলছে। মিসরের জেলখানায় বন্দী ইসলামী চিন্তাধারার অধিকারী যুবকদেরকে এমন পাশবিকতার লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে যা কল্পনাতীত। এরূপ অস্বাভাবিক ও অমানবিক আচরণের যথোপযুক্ত জবাব স্বরূপ যদি এ যুবকগণও রুঢ় আচরণ করতে উদ্যত হতো, তাহলে সে জন্য রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো এমন হৈচৈ আরম্ভ করে দিতো যা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের নিরাপদ রাখুন।
মিসরের জেলখানায় ১৯৫৪ এবং ১৯৬৫ সালে আমাদের সাথে নৃশংস আচরণ করা হয়েছে। তা অভিশপ্ত ইবলিশের চিন্তায়ও হয়তো কখনো স্থান পায়নি। আমি তোমাদেরকে কেবলমাত্র একটা কথাই বলে দিতে চাই যাতে তোমরা উপলব্ধি করতে পারো যে, এ পৃথিবীর বুকে ও যবনিকার অন্তরালে কত দুঃখজনক ঘটনা সংগঠিত হয়ে যাচ্ছে। “কারাগারের অভ্যন্তরে একবার আমার কুঠুরীর সম্মুখে আমারই এক সহোদরাকে এনে হাজির করা হয়। আমে কুঠুরীর ভেতর বন্দী ছিলাম এবং আমার পায়ে বেড়ি পরানো ছিল। জেল কর্মকর্তাদের সমাবেশের সামনে আমার ভগ্নিকে মাতৃগর্ভ থেকে ভুমিষ্ঠ শিশুর মত সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। এ দৃশ্যের অবতারণা করা হচ্ছিলো আমার কুঠুরীর ঠিক সামনে—–।”
পাকিস্তানে ইসলাম বিরোধী শক্তিসমূহ এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণের ধমকই দিয়ে আসছে কিংবা পত্র-পত্রিকায় ও মঞ্চে ময়দানে ইজ্জত ও সম্মানের অধিকারীনী দ্বীনি ভগ্নিগণের পবিত্র চরিত্রের ওপর অপবাদ ও কলঙ্ক লেপনের প্রচেষ্টয় নিয়োজিত রয়েছে। এমন কি মিসর ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব পৈচাশিক ও বর্বরোচিত আচরণ ইতিমধ্যেই করা হয়েছে।
ইখওয়ানের পরীক্ষা ছিল জামায়াতের তুলনায় অনেক বেশী কঠিন ও হৃদয় বিদারক। কিন্তু ইসলামের এসব কৃতি সন্তানের প্রশংসা করতে হয়। কারণ, তাদের সংকল্প ও বলিষ্ঠতায় কখনো কোন দুর্বলতা স্থান পায়নি। এমন লোকেরাই নবী রাসূলদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এবং এরাই উজ্জল দ্বীপশিখা। আমার অন্তর সর্বদা তাদের প্রতি ভক্তি ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে থাকে। কবি বলেছেনঃ
থেকে যাবে তুমিই পৃথিবীতে অনন্য ও অদ্বিতীয় হয়ে!
কারণ তোমার হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়েছে লা’শারীকা লাহ!!
জামায়তে ইসলামী ও ইখওয়ানের সংগঠন ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও অনুপম। দু’টি সংগঠনই তার কর্মীদেরকে এ শিক্ষা প্রদান করে থাকে যে সর্বপ্রথম নিজের ওপর কুরআন ও সুন্নাহকে কার্যকরী করবে এবং তারপর আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের চেষ্টা সাধনায় আত্মনিয়োগ করবে। ইসলামী আহকামের দৃষ্টিতে আমীরের আনুগত্য এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভালবাসা এ আন্দোলনের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য। যদিও এ সংগঠন থেকেও কোন কোন ব্যক্তি সয়ম বিশেষ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাদের বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, কেউ একবার বুঝে শুনে তাদের সাথে গিয়ে শামিল হলে তারপর সারা জীবন এর সাথে একাত্ম থেকেই জীবন অতিবাহিত করে দেয়।
আশ্চার্যজনক কিছু করা এসব আন্দোলনের নীতি নয়। নীতি নৈতিকতা ও আইন কানুনের চৌহর্দ্দিতে থেকে লক্ষ অর্জনে ব্রতী হওয়াই এ দু’টি আন্দোলনের মৌলিক গুণ। শৃংখলা ও নিয়ন্ত্রণ এবং দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি এমন সব বৈশিষ্ট্য যার মোকাবেলা অন্য কোন দল করতে পারে না। মুর্শিদে আম তার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এ সূক্ষ্ম তত্ত্বটি অত্যন্ত স্পস্টভাবে বর্ণনা করেছেন। জামায়াতের সাহিত্যও এ চিন্তাধারাকে তার কর্মী ও সদস্যদের মনে খুব বলিষ্ঠভাবে বদ্ধমূল করে দেয়।
নিয়মিত বৈঠক এবং প্রতিটা বিষয় সংগঠিত আন্দোলন ও চেষ্টা সাধনা এ আন্দোলনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। প্রতি মংগলবারে ইখওয়ানের দারসে কুরআনের আলোচনা এ স্মৃতিকথার মধ্যে বড়ই ঈমান প্রবৃদ্ধিকারী। জামায়াতেরও সাপ্তাহিক বৈঠক এবং দারসে কুরআন ও হাদীসের অনুষ্ঠান অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দর যাতে কখনো কোন অচলবস্থার সৃষ্টি হয় না।
সৌভাগ্য বশত ইখওয়ানের বর্তমান মুর্শিদে আম জনাব উমর তিলমিসানী এবং জামায়াতের বর্তমান আমীর জনাব মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ এর অনেক কথা ও কাজে পরিপূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে। উভয়েই পেশাগত দিক থেকে আইনজীবি। দু’জনই বাল্যকাল থেকেই দ্বীনের প্রতি অনুরাগী এবং সকল প্রকার অন্যায় অপকর্মের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী ছিলেন। উভয়েই অত্যন্ত সভ্রান্ত এবং উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এবং ত্যাগ, ক্ষমা ও মহত্বের মূর্ত প্রতীক। শুরুতে উভয়েই যখন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তখন পাশ্চাত্য পোশাক ও তাহযীব তামাদ্দুনে প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু আন্দোলনে শামিল হওয়ার পর সম্পূর্ণরূপে বদলে যান। উস্তাদ ওমর কিছু দিন ওকালতির পেশা অব্যাহত রাখেন কিন্তু মিয়া সাহেব জামায়াতে যোগদানের পর পরই এ পেশা ত্যাগ করেন। উস্তাদ ওমরকে বিচারকের পদ অলঙ্কৃত করার অনুরোধ আসে। কিন্তু উভয় নেতাই এ পদ গ্রহণে অস্বীকৃতী জ্ঞাপন করেন।
মুহতারাম ওমর তিলমিসানীও ছিলেন একটা কৃষক অথবা জমিদার পরিবারের সাথে সম্পর্কিত আর মিয়া সাহেবের আগমন অনুরূপ পারিবারিক পরিবেশ থেকেই। কোমল হৃদবৃত্তি ও উদার মানসিকতায় দুই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বই সিক্ত। কিন্তু আল্লাহর নির্ধারিত শরীয়াতের সীমানা মেনে চলা এবং দ্বীনের অনুসরণে তারা কখনো কোন প্রকার আপোষ করেননি। কিংবা নমনীয়তা দেখাননি। উভয়েই কারাগারের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন এবং অবিচলভাবে সর্বদা জীবনের লক্ষ অর্জনে অগ্রসর হয়েছেন।
জনাব উমর তিলমিসানী ইখওয়ানে যোগদানের কিছুদিন পর থেকেই দ্বিতীয় মুর্শিদে আম মুহতারাম হাসান আল হুদাইবি মারহুম এর প্রতি তার অত্যন্ত ভালবাসা ও ভক্তি গড়ে ওঠে। আবার তিনিও তাকে অকৃত্রিম স্নেহ ভালবাসা দানে ধন্য করতে থাকেন। একইভবে মিয়া সাহেবও জামায়াতে যোগদানের পর অল্প সময়ের ব্যবধানেই আন্দোরনের প্রতিষ্ঠাতার বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হন এবং আজীবন আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র)-এর সাথে থেকে প্রত্যেক বিষয়েই তাঁর হিদায়াত ও দিকনির্দেশনা লাভ করতে থাকেন। দুই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে নীরবচ্ছিন্ন বিশ্বস্ততা নির্ভরযোগ্যতা ও ভালবাসার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এর ঈমান প্রবৃদ্ধিকর দৃশ্য গ্রন্থকার বহুবার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। মিয়া সাহেব কখনো জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ৫/এ যিলদার পার্কে পৌঁছতেন কিংবা কোন সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মুর্শিদ মওদূদী (র) বড়ই দরদী মন ও হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার আবেগে তাকে বক্ষে জড়িয়ে ধরতেন। দর্শকমন্ডলী এ দৃশ্য অবলোকন ও প্রত্যক্ষ করে মিয়া সাহেবের সৌভাগ্যের ওপর ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেতো।
উস্তাদ ওমর তিলমিসানী সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদের সাথে তার স্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক সফরসমূহের বিবরণ তুলে ধরেছেন তার স্মৃতিচারণে। কয়েক জায়গায় মুর্শিদে আম-এর স্নেহ বাৎসল্য ও ভালবাসার জীবন্ত চিত্র অংকন করেছেন। এখানে উভয় সংগঠনের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে কিছু সংখ্যক মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের তুলনামূকল আলোচনায় জড়িয়ে পড়েছি। বস্তুত এ আন্দোলনের রূপায়ণে, সংগঠনে সম্প্রসারণে এবং ব্যাপ্তিত ও বিস্তৃতি প্রদানে তাঁদের ঘাম-রক্ত জারক রস হিসেবে কাজ করেছে।
এসকল আবেদন নিবেদনের পরিসমাপ্তি টানতে গিয়ে আমি আরজ করতে চাই যে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশ ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের শোকর আদায় করছি যে, তিনি আমাদের সকল অক্ষমতা ও দুর্বলতার উপর তার রহমতের পর্দা অবারিত করে দিয়েছেন। অন্যথায় আমরা কিছুতেই এমন যোগ্যতার অধিকারী ছিলাম না। এমন দুর্বহ বোঝা বইতে পারি যে আমাদের ইখওয়ানী ভাইগণ ইতিমধ্যেই বহন করেছেন এবং দৃঢ়পদে টিকে রয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা এবং শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের কয়েকজনের কথা বাদ দিয়ে আমরা সকলেই সামষ্টিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। তথাপি আল্লাপ তায়ালার অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে আমি জামায়াতের একজন অযোগ্য সদস্য ও সাধারণ কর্মীরূপে নিসঙ্কোচে বলতে পারি যে, আমাদের মুর্শিদ মওদূদী এবং তার নিকটতম সাথী সংগীগণ ধৈর্য ও স্থৈর্যের পাহাড় ছিলেন। কোন বাতিল শক্তিই তাদেরকে তাদের অনুসৃত নীতি থেকে চুল পরিমাণও হটাতে পারতো না। ইখওয়ান সম্পর্কে ইতিহাস এ সাক্ষ্য নীরব সাক্ষী প্রদান করে যেঃ
“এ ঘরের সবটুকুই উজ্জল আলোর দীপ্তিতে ভরপুর হয়ে রয়েছে।” এসব লোক সব পরীক্ষায়ই সাফল্য অর্জন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়াতে সুনাম সুখ্যাতি দান করেছেন এবং আখেরাতের অনন্ত জীবনেও আম্বিয়া, সিদ্দিকীন এবং গুহাদাগণের সারিতে অন্তর্ভুক্ত করে দিন। আমরা সাহসহীনেরাও তাদের প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদের মধ্যে শামিল। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেও তাদের সাথে পরিণতি দান করুন।
“আমি তো সালেহীনদের ভালবাসি যদিও আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকেও সালাহ এবং সফলতা প্রদান করেন।” আমি মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি তিনি যেন আমাদেরকে প্রতিটি পরীক্ষায় নিরাপদ রাখেন। আর যদি কখনো কোন পরীক্ষার সম্মুখীন হই, তাতে যেন তিনি স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহের সাহায্যে দৃঢ়তা দ্বারা আমাদেরকে ধন্য করেন।
জামায়াত ও ইখওয়ান মূলতঃ একই আত্মার দু’টো দেহবিশেষ। আমাদের কর্মক্ষেত্র আলাদা বটে কিন্তু আমাদের মানযিলে মাকসুদ প্রথম দিন থেকেই এক ও অভিন্ন। ইসলামকে সুমন্নত করে তুলে ধরা আমাদের মূল লক্ষ্য। আর আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। বাতিল সর্বদাই আমাদের ওপর রুষ্ট। ইসলামের কোন কোন পতাকাবাহীও আমাদের প্রতি যুদ্ধাংদেহী মনোভাব পোষণ করে থাকেন। আমার সকল বিষয়ে সঠিক ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার উপর সোপর্দ করে দিয়েছি। মুর্শিদে আম তার স্মৃতিকথায় বারবার এ সত্যেরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। আমরা সর্বদা আমাদের ঐ সকল ইসলাম প্রিয় ভাইদের সমীপে-যারা আমাদের উপর বিভিন্ন প্রকার অভিযোগ আরোপ করে নিজেদেরকে ইসলামের খাঁটি অনুসারী প্রমাণ করতে চান-সর্বদা এ আরজই করতে থাকবো। কবির ভাষায়ঃ
“জগতে তো কোন দেয়ালে গিয়ে আঘাত করিনি!
যাতে করে প্রমাণিত হতে পারে যে তুমি প্রস্তর খন্ড না কাঁচের টুকরো!!
আল্লাহ তাআয়া তোমার যুবকদের নিরাপদে রাখুন এবং তাদের আত্মঘাতি ও আত্মরক্ষামূলক দৃষ্টিভংগী দ্বারা ধন্য করুন!! আমীন!!!
এম, আমীর হোসাইন আল মাদানী
মদীনা মুনাওয়ারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
আল সুবাই হল, সউদী আরব।
১৭ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৫ সালে।