ত্রয়োদশ অধ্যায়
জামাল আবদুন নাসের বহুরূপী মানুষ। বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। আমাদেরকে যখন কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়েছিল তখন জামাল আবদুন নাসের প্রস্তাব পেশ করেছিলো যে, জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়দি এবং জটিলতা ও সমস্যা সমূহের সমাধানের জন্য একটা কমিটি গঠন করা হোক। এই কমিটিতে ইখওয়ান ও সামরিক কাউন্সিলের সদস্যগণ অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। ইখওয়ান এবং কাউন্সিলের মধ্যে যদি কোন ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয় তাহলে এ কমিটি তা নিরসন করার দায়িত্বও পালন করবে। পরিতাপের বিষয় হলো ঠিক এই প্রস্তাবই আমাদের দু’জন সদস্য মুনীরউদ্দৌলা ও সালাহ শাদী ইতিপূর্বে পেশ করেছিলেন। তাতে নাসেরের প্রতিক্রিয়া ছিল এই যে; বিপ্লবী কাউন্সিলের ওপর আমরা কোন উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান চাই না। আমরাই সরকার। সরকারের ওপর কোন প্রতিষ্ঠানের আবশ্যকতা নেই।
এ ব্যাপারে তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এ প্রতিষ্ঠান সরকারের কর্মকাণ্ডে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। আমরা এই সমঝোতা কমিটি থেকে শুধু পারস্পরিক বুঝা পড়ার কাজ পেতে চাই। আমাদের কদাচ এরূপ কোন উদ্দেশ্য নেই যে, সরকার কোন আইন বা সিদ্ধান্ত ঘোষণার পূর্বেই আমাদের অনুমোদন নিতে বাধ্য থাকবেন। নাসের সে সময় বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। এখন সে নিজেই প্রস্তাব পেশ করছে। যদিও এবারে সে কেবল প্রস্তাব পেশ করার কষ্টই স্বীকার করেছেন। অগ্রসর হয়ে আর কিছুই করেনি।
আমাদের ওপর দোষারোপের পালা আসলে হুঙ্কার ছেড়ে অত্যন্ত জোরেশোরে তীব্র প্রতিবাদী ভাষায় বলা হলো এই ইখওয়ানীরা নিজেদেরকে সরকারের উর্ধে মনে করে। তারা চায় তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়া ছাড়া যেন কোন আইন কার্যকরী না করা হয়। ইখওয়ানীরা চায়, তাদের অনুমতি ছাড়াও যেন কোন একটা পাতাও না নড়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের সাথে তার আচরণ তো সর্বদা এমনই হয়েছে যে, প্রয়োজনের সময় আমাদের সহযোগিতা কামনা করেছে আর বিপদ কেটে গেলে বা মতলব হাসিল হয়ে গেরে তখন অভিযোগের পুরস্কার আর দোষারোপ তোহফা হিসেবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
বিপ্লবের রোয়েদাদ
বিপ্লবের পূর্বের বর্ণনাও শুনে রাখুন। বিপ্লবের ফায়সালা হয় ইখওয়ানের পরামর্শক্রমে ও সার্বিক সহযোগিতায় কিন্তু বলা হয়, যেহেতু ইখওয়ান বিশ্ব শক্তিসমূহের দৃষ্টিতে একটা শক্তিশালী সংগঠন। বিশেষত ফিলিস্তিন যুদ্ধে ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো তাদের আত্মনিবেদনের দৃশ্য দেখেছে। সেজন্য প্রকাশ্যে এগিয়ে আসা তাদের জন্য উচিত নয়। কর্মসূচী অনুযায়ী পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপদান করবে সেনাবাহিনী। আর ইখওয়ান পর্দার অন্তরালে থেকে সহযোগিতা করবে। তিনি বলেনঃ এসব ইখওয়ানী যুবক যারা মুহাম্মাদ (সা)-এর আনীত পয়গামের বিশ্বস্ত সংরক্ষক ও পতাকাবাহী। বিশ্বক্তিগুলো তাদের দেখে খুবই আতঙ্কিত এবং ভীত সন্ত্রস্ত। তারা সম্মুখে অগ্রসর হলে ইসলামের সমস্ত দুশমন উঠে দাঁড়াবে। ফলে বিপ্লব সফলতা লাভ করতে পারবে না। আমরা বললামঃ ঠিক আছে, আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল করাই মূল লক্ষ্য। সুনাম সুখ্যাতির কোন আকাংখা আমাদের নেই।
পাশ্চাত্য দূতাবাসসমূহ ও ইখওয়ান
মিসরে নাকরাশী পাশার মন্ত্রীত্বের আমলে পাশ্চাত্য দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতগণ এক জায়গায় সমবেত হন এবং প্রধান মন্ত্রীকে এক কড়া নোট প্রেরণ করেন। সেই নোটে যেমনি ছিল পীড়াপীড়ি তেমনি ছিল হুমকি যেন ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ মসয়ই আযাদ অফিসার বিপ্লবের জন্য একপায়ে দাঁড়িয়েছিল। নাকরাশী পাশা ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। কঠিন পর্যায়সমূহ ও ত্যাগ স্বীকারের মত ক্ষেত্রসমূহের দাবী পূরণের জন্য ইখওয়ানের ওপরে ভরসা করে বসেছিলো। এই বিধি-নিষেধ আরোপের ফলে সেনাবাহিনী বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই তথাকথিত নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনকে কি কখনো নিঃশেষ করতে পারে?
নাকরাশী পাশার পক্ষ থেকে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তা ছিল প্রথম নিষেধাজ্ঞা। তারপর আমাদের ইতিহাস নিষেধাজ্ঞার ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়েছে। কথায় বলে এক পন্থা দুই কাজ, কিন্তু মিসর ও ইসলামের দুশসনরা এক পন্থা ও তিন কাজের প্রদর্শনী করে দেখিয়েছিলো। তারা ইখওয়ানের ওপর আঘাত করেন যা ছিল প্রকৃতপক্ষে মিসরের শাসকগোষ্ঠীর ওপর আঘাত এবং সর্বোপরি সমগ্র মিসরীয় জাতির ওপর আঘাত। আমাদের শত্রুরা জানে যে, মিসর আরব বিশ্ব ও ইসলামী দুনিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারে। অতএব তারা মিসরকে কখনো ইসলামী রূপ গ্রহণের অনুমতি দেয় না। এভাবে তারা এক তীরে তিন তিনটি শিকার করে চলেছে।
হতে পারে তোমরা যা অপছন্দ করো
তাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর
আমি এখানে এ সত্যটি তুলে ধরাও জরুরী মনে করি যে, নাসেরের নির্যাতন ও দমননীতি ইখওয়ানের পয়গাম মিসরের বাইরে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সন্ত্রাসী পরিস্থিতির কারণে বহু ইখওয়ান দেশ থেকে হিজরত করে চলে যায়। যেহেতু নাসের নিজেও সর্বদা ইখওয়ানের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। তাই ইখওয়ানের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ব্যাপারে কখনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়নি। সে মনে করতো যে, এরা মিসর থেকে চলে গেলে সে হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারে। দেশের বাইরে গমনকারী এসব লোকেরা আন্দোলনের পয়গাম তাদের সংগে নিয়ে যায়। তারা যেখানেই গিয়েছে সেখানেই ইখওয়ানের দাওয়াত প্রসার লাভ করেছে। এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যে, সুদূর ইউরোপ, প্রাচ্য ও প্রতিচ্যে ইখওয়ানের প্রচেষ্টায় ইসলামের আলো ও জাগরণ ছড়িয়ে পড়া যেন ইতিহাসেরই পুনরাবুত্তি। ফাতেহ মুহাম্মদের হাতে কনষ্টান্টিনোপল বিজয় হয়। তখন ঈসায়ী আলেমগণ সেখান থেকে হিজরত করে। ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই মহাদেশ তারা খৃস্টবাদের প্রসার ঘটান। এখন মিসরেও নাসের সত্য পন্থীদের ওপর জুলুম নির্যাতনের অস্ত্র প্রয়োগ করলো। তাই ইসলাম প্রিয় জনতা ইসলামের শাশ্বত বাণী বক্ষে ধারণ করে আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সাথে ইসলামী আন্দোলনও এসব দেশে প্রসার লাভ করতে থাকে।
জুলুমের রাতের অবসান
আমার স্মৃতি পটে সেই দৃশ্য জীবন্ত হয়ে রয়েছে যখন যখন ১৯৭১ সালে আমাকে কারাগারে থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এটা ছিল ৩০শে জুন ১৯৭১ সালের কথা। ইখওয়ানী ভাইয়েরা মাগরিবের নামায সবে মাত্র শেষ করেছেন। আমি তখনও নামায পড়ছিলাম। এরই মধ্যে আমি ইখওয়ানী ভাইদেরকে উচ্চৈস্বরে পরস্পরের সাথে কথাবার্তা বলতে শুনলাম। তাদের আলোচনায় তারা বার বার আমার নাম উল্লেখ করছিলো। আমি সেদিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ করলাম না। সালাতুল এশার পর জনৈক অফিসার আমার নিকট আগমন করে বলতে লাগলেন আপনি, উস্তাদ মামুন আল হুদাইবি এবং আপনার অন্যান্য সংগী-সাথীদের মুক্তিদানের নির্দেশ এসেছে। আপনাদের মালপত্র গুছিয়ে নিন এবং বেরিয়ে পড়ুন। আমি তাকে বললাম এটা কি সম্ভব নয় যে আমি এই রাতটি এখানেই অতিবাহিত করি এবং আগামীকাল সকালে চলে যাই। কেননা আমি এত দীর্ঘ সময় কারাগারে অবস্থান করছি যে, কায়রোর রাস্তাঘাট পর্যন্ত ভুলে গেছি। এত বছরের দীর্ঘ সময়ে না জানি কায়রোতে কত পরিবর্তন এসেছে। রাতের বেলায় আমি আমার সবতবাড়ী কিভাবে খুঁজে বের করব?
আমার কথা শুনে কর্মকর্তাটি চোখ কপালে তুলে বলতে লাগলোঃ এটা আপনি কি বলছেন? আপনি কি বন্দী জীবন থেকে মুক্তি লাভ করে উন্মুক্ত আকাশের নীচে বেরিয়ে যেতে চান না?
আমি বললামঃ “জেল থেকে ছাড়া পেতে চাই, কিন্তু আজ রাত এখানেই কাটিয়ে আগামী কাল প্রত্যুষে বেরিয়ে যাওয়া উত্তম বলে মনে করি।”
জেল অফিসার বিস্মিতও হলেন আবার পীড়াপীড়িও করছিলেন যেন আমি শীগ্রই জেলখানার বাইরে চলে যাই। তিনি বললেনঃ যখন আপনার মুক্তির ফরমান আমার হাতে এসে পৌঁছে তখনই আপনার নাম কারাগারের হাজিরা পৃষ্ঠা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এখন আপনি আমাদের হিসেবের অন্তর্ভূক্ত নন। যদি আল্লাহ না করুন আজ রাতে জেলের ভেতর আপনার কিছু হয়ে যায় তাহলে সে দায়িত্ব বহন করবে কে? আমাদের জন্য তা বড়ই বিপদের কারণ হবে। আমাদের আতিথেয়তা এ পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে। আপনি কারা ফটকের বাইরে সানন্দে রাত্রি যাপন করতে পারেন। কিন্তু এ চার দেয়ালের ভেতর এখন আর আপনার অবস্থান সম্ভব নয়।
একদিন কিংবা একদিনের কিছু অংশ
অগত্যা আমি অফিসার মহোদয়কে অনুরোধ করলাম- অবস্থা যদি এই-ই হয় তাহলে আমার জন্য একটা ট্যাক্সি ডেকে দিন।
তিনি একখানা ট্যাক্সি নিয়ে আসলেন। ট্যাক্সিওয়ালা আমাকে আমার বাসগৃহে নিয়ে গেল। এটা কত বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আমি আমার বাড়ীর চার দেয়ালের মধ্যে আমার পরিবার পরিজনের মাঝে সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে গিয়ে হাজির হলাম।
আপনি বিস্ময়ে হতবাক হবেন যে, আমি বাড়ীতে কিংবা আমার মন-মগজে কোন বড় পরিবর্তন অনুভব করলাম না। মনে হচ্ছিলো যেন আমি গতকালই আমার বাড়ী থেকে গিয়েছিলাম আর আজ পুনরায় ফিরে এসেছি। অথচ ইতিমধ্যে প্রায় আঠারটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। আরো জেনে নিন যে, আমি স্বভাবগতভাবে আমার পরিবার পরিজন ও প্রিয়জনদের খুব বেশী ভালবেসে থাকি। তারপরও কি রহস্যজনক ব্যাপার যে, এ সুদীর্ঘকাল একদিনের বেশী মনে হয়নি। আমি নিজে এ রহস্যের কিছু জানি না। আমার মনে হয় মানুষের শিক্ষার জন্য আল্লাহ তায়ালার অগণিত নিদর্শন সৃষ্টিজগতে বিদ্যমান। এটাও তারই একটা নিদর্শন।
এই উচ্চ মর্যাদা যিনি লাভ করেছেন
আমার নিজের অবস্থার প্রতি লক্ষ করুন। আমি স্বাধীনতার প্রেমিক। অথচ আমি এ সুদীর্ঘ সময় জেলখানায় অতিবাহিত করলাম। কিন্তু সেজন্য অন্তরে কোন দুঃখ কিংবা মনের ওপর কোন বোঝা অনুভব করিনি। আমার চিন্তা-চেতনার প্রতি লক্ষ্য করলে আমার ধৈর্য ও পরিতৃপ্তি এই অবস্থা দেখে আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন। আমি যখন পাখীদের ইচ্ছামত আকাশে উড়ে বেড়াতে দেখি তখন তাদের এই অবাধ স্বধীনতা দেখে আকাংকা জাগে- আমার বড় ঈর্ষা হয়। মাছের কথা চিন্তা করি চিরে ওপরে ভেসে ওঠে। তখন তার সৌভাগ্য দেখে হতবাক হয়ে যাই। অথচ আমার নিজের অবস্থা এই যে, সুদীর্ঘ সময় কারাপ্রকোষ্ঠেই কেটে গেল। না ছিল মুখখোলার অনুমতি, না নাড়াচাড়ার স্বাধীনতা। তার পরও আন্তরিক প্রশান্তি! এটা আল্লাহর দ্বীনের কারণেই সম্ভব হয়েছে।
স্বাধীনতা অমূল্য সম্পদ
একথা সত্য যে, ছোট ছোট প্রাণী ও পাখীরা বড় বড় প্রাণী ও পাখীদের শিকারে পরিণত হয়। ছোট ছোট মাছগুলোকে বড় মাছেরা খেয়ে ফেলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যতদিন তাদের দেহে প্রাণ থাকে ততদিন তারা স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে পারে এবং এ মহানেয়ামত পেয়ে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত থাকে। তারা স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে, মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে, সুমিষ্ট স্বরে গান গাইতে, গভীর পানিতে ডুব দিতে ও সাঁতার কাটতে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা ও এখতিয়ারকে কাজে লাগাতে পারে। এ ক্ষেত্রে কারো বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের কোন সুযোগ থাকে না। এসব প্রাণী, পাখী ও মৎস্যের জন্য আল্লাহর এত বড় নিয়ামত যে, তার কোন বিকল্প নেই। মানুষ সৃষ্টির সেরা কিন্তু আফসোস! সে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে না-ওয়াকিফ এবং তার নেয়ামত থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। মানুষ যদি আইনের সীমানার মধ্যে থেকেই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারতো এবং আইনের বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকে পাকড়াও করা হতো তাহলে মানবতা কতইনা সৌভাগ্যবান ও সমৃদ্ধ হয়ে যেতো। অথচ এখানে অবস্থা এই যে, ক্ষমতাধররা কেবলমাত্র এমন কথাই বলার অনুমতি দান করেন যা তাদের তোষামোদ এবং প্রশংসার জন্য উচ্চারিত হয়। আবার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা তার নিকট ততক্ষণই গ্রহণযোগ্য যতক্ষণ তা থাকে তার মর্জির অধীন।
মানব জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে এই স্বাধীনতা। এজন্য সে কখনো স্বৈরাচার ও একনায়কত্বকে পছন্দ করে না। আমার সুদীর্ঘ কারা জীবনে যে জিনিসটি আমাকে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে তা ছিল আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত তাকদীরের ওপর অবিচল আস্থা এবং অগাধ বিশ্বাস। আমার বলিষ্ঠ ঈমান ছিল যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমার প্রিয় জীবনের একটা অংশ জেলখানায় কাটানোর ফায়সালা করেছেন। তাই আমি তার সন্তুষ্টির ওপর রাজী থাকলাম। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থলে এবং আবেগ-অনুভুতিরসূক্ষ্ম তন্ত্রীতে পর্যন্ত আপাদমন্তক আত্মসমর্পিত ও সন্তুষ্ট থাকি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই দোয়ার অর্থও আমার সম্মুখে সুস্পষ্ট-যাতে তিনি রাব্বুল ইজ্জাতের সমীপে আরজ করেছিলেনঃ
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট তোমার ফায়সালা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার জন্য দোয়া করছি না। বরং আমি তোমার নিকট আবেদন করছি তোমার গৃহীত সিদ্ধান্ত সর্বান্তকরণে মেনে নেয়ার জন্য আমাকে মানসিক প্রশান্তি প্রদান কর। আর তা আমার জন্য সহজসাধ্য করে দাও।
আর এটা যখন আল্লাহ তায়ালার ফায়সালা এবং তারই নির্ধারিত তাকদীর যাতে চুল পরিমাণ পরিবর্তন সাধনের ক্ষকমতা কারো নেই। তখন অস্থিরতা ও অধৈর্য হওয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? আমার জেলে যাওয়া এবং একটা মেয়াদকাল সেখানে অতিবাহিত করা ছিল আল্লাহ তায়ালারই ফায়সালা। এতে আল্লাহর ইহসান ও করুণা ছিল এই যে, আমি কোন অন্যায় কাজের জন্য কিংবা কোন অপরাধের শাস্তি স্বরূপ জেলে যাইনি। আমি একটি মহৎ উদ্দেশ্য ও পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের জন্য শৃংখলাবদ্ধ হয়েছিলাম। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর পথে আহবান। এজন্য আমি পুরোপুরি আত্মসমর্পণ ও সন্তুষ্টিসহ সকল প্রকার প্রতিকূলতা এবং কষ্ট সহ্য করার জন্য তৈরী ছিলাম এবং এখনও আছি।
প্রবৃত্তির আকাংকা ও তার পূজা
হাসান আল হুদাইবি যখন ইখওয়ানের মুর্শিদে আ’ম নির্বাচিত হন তখন একই সাথে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্যগণের নির্বাচনও সম্পন্ন হয়। তাঁর (মুর্শিদে আ’ম-এর) প্রত্যাশা ছিল নবনির্বাচিত সদস্যগণ উচ্চ শিক্ষিত সাথীদের মধ্য থেকেই যেন নির্বাচিত হয়। কোন কোন ইখওয়ান তাঁর এ মতের সাথে একমত হতে পারেননি। যা হোক নির্বাচন পর্ব সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু কিছু সংখ্যক সদদ্যের দৃষ্টিভংগী ও আচার আচরণে এরূপ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল যে, মুর্শিদে আ’ম হয় নির্বাচন কমিশনই বাতিল করে দেবেন নয়তো সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করবেন। তবে তিনি এখনো এ সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেননি। ইত্যবসরে আবদুর রহমান সিদ্ধী যার সম্বন্ধে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে এবং যিনি সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদের আমলে বিদ্রোহাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন-এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার অপেক্ষায় ছিলেন। ইমাম শহীদের সময় পরিস্থিতি ভিন্ন রকম ছিল। কিন্তু এখন জামাল আবদুন নাসের আবদুর রহমান সিদ্ধীর মনোভাবের ফলশ্রুতিতে পিঠে হাত বুলাচ্ছিলেন।
উস্তাদ আল বান্না শহীদের জীবদ্দশায় তিনি বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করার সার্বিক অপপ্রয়াস চালিয়ে দেখেছিলেন যে, ইখওয়ানের মিজাজ ও প্রশিক্ষণের শিক্ষা দীক্ষার প্রভাবে তাদেরকে মুর্শিদে আ’মের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো ও উত্তেজিত করা সম্ভব নয়। অথচ সেই তিনিই এখন পুনরায় অনুভব করেন যে, পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাই এখন তার দূরভিসন্ধি কাজে লাগতে পারে। একদিকে নাসেরের সামগ্রিক পৃষ্ঠপোষকতা অপরদিকে কোন কোন ইখওয়ানের মানসিক অস্থিতিশীলতা সিন্ধী সাহেবকে আবার ভাগ্য পরীক্ষায় ব্রতী হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলে। হাসান আল হুদাইবি ছিলেন অত্যন্ত ধীর স্থির, অনমনীয় এবং প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তি। তিনি কারো কাছে নতি স্বীকার করার লোক ছিরেন না। আবদুর রহমান সিদ্ধী ও তার সাথীরা সেনাবাহিনীর জওয়ানদের সহযোগিতায় একদিন রাতে মুর্শিদে আ’মের বাসগৃহের ওপর আক্রমণ করে বসে। টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং জোরপূর্বক মুর্শিদে আ’মকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে যায়। বাড়ী থেকে কিছু দূর এক জায়গায় নিয়ে তাঁকে ইখওয়ানের নেতৃত্ব থেকে ইস্তফা দিতে বলে। এসব নির্বোধদের জানা ছিল না যে, হাসান আল হুদাইবি কারো চাপের মুখে কাবু হওয়ার লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন এমন অনমনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে, তার ঘাড়ের ওপর তলোয়ার ধরা হলেও তিনি ইস্তফা দিতেন না।
মুর্শিদে আ’ম–এর আহবান ও আমার উপস্থিতি
হাসান আল হুদাইবির নিকট থেকে ইস্তফা ও পদত্যাগপত্র নিতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে সেখানেই রেখে এসব ব্যক্তি কেন্দ্রীয় অফিসে এসে তা দখল করে। আমি যেখানে ভাড়ায় থাকতাম সে বাসার অপর অংশে বাড়ীর মালিক বাস করতেন। সেখানে টেলিফোন ছিল। সন্ধ্যায় কে বা কারা আমাকে ফোন করলো। অন্য প্রান্ত থেকে ভাই ফরিদ আবদুল খালেক কথা বলছিলেন। তিনি বললেনঃ আমি মুর্শিদে আ’মের বাড়ীতে আছি আপনি এখনই এখানে চলে আসুন। আপনাকে নিয়ে আসার জন্য একটা মোটর সাইকেল পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাড়ীওয়ালাকে আল্লাহ তায়ালা উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন। তিনি বললেনঃ আমি আপনাকে এভাবে যেতে দেব না। ফোনকারী কে আর এ মোটর সাইকেল আরোহীর পরিচয় এবং তার মতলব কি তা তো জানা নেই? মোটর সাইকেলওয়ালা আগে আগে যাবে আর আপনি আমার সাথে গাড়ীতে বসুন। আমি আপনাকে মুর্শিদে আ’মের বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে আসবো। এতএব সেই সদয় বন্ধুর গাড়ীতে করেই আমি মুর্শিদে আ’মের বাসভবনে গিয়ে উপনীত হলাম।
মুর্শিদে আ’মের বাড়ীতে তখন কয়েকজন ইখওয়ান বসে ছিলেন। আমি তাদেরকে অস্থির দেখে জিজ্ঞেস করলাম খবর ভাল তো? তারা আমার কাছে সব ঘটনা বর্ণনা করলো। ভাই হারুন মুজাদ্দেদীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার নিজের প্রাইভেট কার ছিল। আমাকে কেন্দ্রীয় অফিসে পৌছে দেয়ার জন্য আমি তাকে অনুরোধ করলাম। আমরা যখন কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে দেখতে পেলাম দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তালাগুলোতে শিকল লাগানো দেখতে পেলাম। এবং ভিতর থেকে এক ভাই “সিদ্ধী সাহেবের সাথী” দেখা শোনার দায়িত্ব পালন করছে। আমার বন্ধু ও সহকর্মী ভাই সালেহ আসমাভীও (নায়েবে মুর্শিদে আ’ম) দফতরে উপস্থিত ছিলেন। প্রহরী আমাকে দেখে বললোঃ আমি আসমাভী সাহেবের অনুমতি নিয়ে তার পর দরজা খুলে দিচ্ছি।
আমি বললাম মা’শায়াল্লাহ, বেশ। এখনই কি সেই সময় এসে গেছে যে, আমি অনুমতি ব্যতীত এই দফতরে প্রবেশ করতে পারবো না। তারপর সে ভিতরে চলে যায় এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দরজা খুলে দেয়। আমি সোজা ভেতরে প্রবেশ করি। মিলনায়তনে আমি প্রায় চল্লিশ জন সরকারী বিভাগের লোককে দেখতে পাই। আমি হল থেকে বেরিয়ে মুর্শিদে আ’মের দফতরে যাই। সেখানে ভাই সালেহ আসমাভী মরহুম বসে ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ আলহাজ্জ সালেহ, এত উৎসব আয়োজন কিসের? তিনি হেসে বললেন, মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জলসা।
আবদুর রহমান সিন্ধী এই চল্লিশ ব্যক্তির সাহায্যে দফতর দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। টেলিফোনে আমি তার সাথে যোগাযোগ করি। উস্তাদ আহমদ বিন আবদুল আযীয টেলিফোন ধরেন অনেক দীর্ঘ ও জটিল আলোচনা হয়। গোটা রাতই এই বিতর্কের মধ্যে কেটে যায়, আমি আবদুর রহমান সিন্ধীকে আচ্ছা রকম জব্দ করে বলি যে, তিনি এটা কেমন আচরণ করলেন। আন্দোলনের মধ্যে সমস্ত সমস্যার সমাধান যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে সমাধান করা হয়ে থাকে। পুলিশ ফোর্সের সাহায্যে নয়। মোদ্দাকথা একদিকে ফজরের আযানের সময় হয়ে যায়, অপর দিকে আবদুর রহমান সিন্ধী সশস্ত্র ব্যক্তিদেরকে দফতর থেকে সরিয়ে নিতে সম্মত হয়।
মুসিবত কেটে গেল
অপরদিকে ইখওয়ানও এক জায়গায় সারারাত পরামর্শ করতে থাকে। পরিশেষে তারা এ সেদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ঢিলের জওয়াব পাটকেল দিয়েই দেয়া হবে। তারা সবাই সুলতান হাসান মসজিদে সমবেত ছিলেন। তারা ফায়সালা করেন যে, কেন্দ্রীয় দফতরে গিয়ে অবরোধকারীদেরকে বহিষ্কার করতে হবে। তবে আল্লাহ তায়ালার শোকর যে, সংঘর্ষের পর্যায়ে যেতে হয়নি। এ লোকদের সেখানে গিয়ে পৌঁছার আগেই সরকারী লোকজন দফতর ছেড়ে চলে যায়। সমস্যাটি ভালোয় ভালোয় সমাধান হয়ে যাওয়ায় আমি আল্লাহর শোকর আদায় করলাম।
পরদিন ইখওয়ান কেন্দ্রীয় দফতরে মুর্শিদে আ’মের সম্মানে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে। উক্ত সমাবেশে হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করে। সবার কাছে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইখওয়ানের ওপর কারো নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। মুর্শিদে আ’ম তো ইখওয়ানের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচিত হয়ে থাকে। যার প্রতি থাকে ইখওয়ানের ঐকান্তিক ভালবাসা এবং যার নির্দেশে তারা জীবন বাজি রেখে সম্মুখে অগ্রসর হতে সদা প্রস্তুত।
সিন্ধী সাহেবের পুরস্কর ও পরিণতি
সেদিন থেকেই ইখওয়ানের সাথে আবদুর রহমান সিন্ধীর সকল সম্পর্কের পরিমাপ্তি ঘটে। তারপর সে আর কখনো অগ্রসর হতে পারেনি। তার পরিণতি এবং পরিণামও শিক্ষণীয়। শুধু মাত্র স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য উল্লেখ করছি। জামাল আবদুন নাসের সিন্ধী সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তার কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ তাকে শেল কোম্পানীর উচ্চ পদে নিয়োগ করা হয় এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় বড় জাকজমক পূর্ণ বাংলো প্রদান করা হয়। মহোদয় কিছুদিন বেশ আড়ম্বরপূর্ণ ও বিলাসী জীবন যাপন করেন। কিন্তু কতদিন!
নাসেরের মেজাজ ছির অস্থির প্রকৃতির। ১৯৬৯ সালে আবদুর রহমান সিন্ধীকে গ্রেফতার করা হয়। তার এত সেবা ও আনুগত্য সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনীত হয় যে, ইখওয়ানের সাথে তার গোপন যোগসাজশ রয়েছে। তার সংগী-সাথী যারা ইখওয়ানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল যেমন আবদুল আযীয কামিল প্রমুখও বাদ পড়েনি। আবদুর রহমান সিন্ধীকে এমনভাবে ধোলাই করা হয় যে, জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মারের চোটে বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই অসুস্থই প্রাণঘাতি প্রমাণিত হয় এবং সে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যায়। আল্লাহ তায়ালা মরহুমকে ক্ষমা করে দিন এবং তার সমস্ত অপরাধ তারঁ রহমত দ্বারা ঢেকে দিন।
আবদুর রহমান সিন্ধী ইখওয়ানের সমস্ত তথ্য নাসেরকে পৌঁছানের দায়িত্ব পালন করতেন। এ কারণেই তিনি নাসেরের একান্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু নাসেরের পৃষ্ঠপোষকতা ইখওয়ানের ওপর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে তার জন্য সহায়ক হয়নি। তিনি একটা অত্যন্ত মামুলী ধরনের তুফান সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু তা সোডার বোতলের উথলিয়ে ওঠার চেয়ে বেশী কিছু ছিল না। এই ফিতনার খুবই সাধারণ আঁচড় তিনি রেখে যেতে সক্ষম হন। অনতিবিলম্বেই যার প্রতিকার হয়ে যায়। ইখওয়ানের বিরুদ্ধে তার এই গোয়েন্দাগিরী দুনিয়াতেও মরহুমের তেমন কোন কল্যাণ সাধন করতে পারেনি। আবার আখেরাতে তা বড় রকমের কোন পুরস্কার লাভের কারণ হবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলেরই ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে দিন।