সপ্তম অধ্যায়
দাওয়াতী সফরে যাওয়ার জন্য টীম গঠন ইখওয়ানের আবিষ্কার ছিল না। বরং এটা সারাদেশে ইতিপূর্বেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী স্কুলে, কলেজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং ক্লাবে এমনকি অভিনেতা, ভাঁড় ও বিদুষকগণের ইউনিয়নেও এই প্রচলন ছিল। এরূপ ভ্রাম্যমান টীমের ব্যাপারে আমি কখনো কারো বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপিত করিনি। কিন্তু যখন ইখওয়ানের পুন্যাত্মা এবং পবিত্র ব্যক্তিত্বগণকে দাওয়াতী অভিযানে প্রেরণ করা আরম্ভ হলো তখন সবখান থেকে আপত্তি ও সমালোচনার তীর বর্ষিত হতে লাগলো। উদাহরণ স্বরূপ ইখওয়ানের স্কাউটিং টীমের কথা উল্লেখযোগ্র। এমন টীমের প্রচলন রয়েছে সমগ্র পৃথিবীতে। কিন্তু কেউই আপত্তি তোলে না। সেখানে শুধু ইখওয়ানের বেলায় সবার মাথা ব্যাথা। কবির ভাষায় বলা হয়:
আমরা একটু আহ বললেই তাতে বদনাম;
কিন্তু যারা তারা হত্যাযজ্ঞ চালালেও কেউ তা মুখেও আনে না।
পারবর্তী আলোচনায় আমরা দেখতে পাবো, ইখওয়ান কখনো শক্তি প্রয়োগ করে কোন পরিবর্তন কিংবা বিপ্লব সাধনের চিন্তা করেনি। কেননা ইখওয়ান মূলত সালাফী জামায়াত। আর সালাফীরা উচ্চ শ্রেণী এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অপপ্রচার সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের পক্ষপাতি নয়। ক্ষমতাসীনরা ফাসেক এবং জালেম হলেও ইখওয়ানদের দাওয়াত সম্প্রসারণের উপায় উপকরণ প্রসংগ যখন আলোচনায় আসবে তখন এ ব্যাপারে বিষদ আলোচনা করা হবে। ইমাম শহীদের দাওয়াত দান প্রক্রিয়া ও কর্মপদ্ধতি থেকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
ইখওয়ানের প্রশিক্ষণ শিবিরসমূহ
কোন বহিরাগত যদি কখনো ইখওয়ানের কোন ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে তাহলে ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারীদের শৃংখলা ও নিয়মানুবর্তিতা, পোগ্রামসমূহে অংশগ্রহণ এবং তাদের আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখে হতবাক হয়ে যাবেন। শিক্ষা শিবিরে অংশগ্রহণকারীদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, সালাতুল ফজরের পূর্বেই শয্যা ত্যাগ করা যাতে তাহাজ্জুদের সৌভাগ্রও লাভ করতে পারে। তারপর মুয়াযযিনের আযান ধ্বনিত হলে সবাই জামায়াতের সাথে ফজরের নামায আদায় করে। অতপর ব্যায়ামের কর্মসূচী শুরু হয়ে যায়। যা সুস্থ সবল দেহের নিশ্চয়তা বিধান করে এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির ফায়সালাসমূহ বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম করে তুলে। ব্যায়াম থেকে অবসর হয়ে নাস্তা গ্রহণ করা হয়ে থাকে এবং সকাল বেলার জরুরী ঘোষণা দেয়া হয় যাতে অংশগ্রহণকারীগণ কর্মসূচী সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকতে পারেন। সারা দিনের পোগ্রামে খাদ্র তৈরী, ব্যায়ামানুশীলন, সালাত এবং বক্তৃতা ও দারস অন্তর্ভুক্ত থাকে। এভাবে সালাতে এশা পর্যন্ত এসব কর্মকান্ড চলে তারপর অবসর হয়ে অংশগ্রহণকারীগণ গিয়ে নিজ নিজ বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। প্রশিক্ষণের এই দিনগুলো নিসন্দেহে প্রশিক্ষণার্থী জীবনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের কারণ হয়। এতে আরাম ও বিশ্রাম এবং বিনোদনের কাজও হয়ে যায়। এবং সাথ সাথে যুবকেরা তাদের দেশের হিফাজতের জন্য শারীরিক ও মানসিক দিক থেকেও উপযুক্ত হয়ে যায়। তারা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং তাদের ওপর তাদের নিজেদের, পরিবারের, সমাজের ও বৃহত্তর ইসরামী উম্মাহর কি কি অধিকার রয়েছে তা জানতে পারে। এসব ব্যাপারে অনুভূতি তখনই চাংগা হয়ে ওঠে যখন মানুষ সর্বপ্রথম আকাশ ও পৃথিবীর রবের ইবাদাত ও আনুগত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে।
এ দিনগুলো বাস্তব প্রশিক্ষণ তথা হাতে কলমে শিক্ষা লাভ এবং ইসরামী জ্ঞানকে মনোজগতে প্রবিষ্ট করার ও হৃদয়ের গভীরে বদ্ধমূল করে নেয়ার উপযুক্ত সময়। এই দিবসগুলোতে আত্মার উৎকর্ষ সাধন ও উন্নতি বিধান, ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের সুষ্ঠু সংরক্ষণ, প্রকৃত সম্মানের অনুভূতি লাভ এবং সকল প্রকার অপমানের গতিরোধ কর মোক্ষম সুযোগ পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
(আরবী****************)
(প্রকৃত সম্মান আল্লাহ তায়ালার, তাঁর রাসূলের এবং ঈমানদারদের।)
ঈমানদারদের ইজ্জত ও সম্মানের ব্যাপারে তো ফয়সালা কৃত। যে এটা আল্লাহ তায়ালার কিতাবে কারীমে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। েএই মর্যাদা লাভের জন্য যেসব পন্থা-পদ্ধতি ও মাধ্যম নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে এই প্রশিক্ষণমূলক ও দাওয়াতী পোগ্রামে বের হওয়া তারই অংশবিশেষ।
কুরআন এবং তলোয়অর
ইসলাম বৈরাগীগণের অনাগ্রহ ও অনীহা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে উপনিত হয়েছিলো। তারা ইমাম শহীদের মতামত নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকে এই বলে যে, তিনি কুরআন ও তলোয়ারকে যথাক্রমে একত্রে সন্নিবেশীত করে দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য হলো, ইখওয়ান যখন বিশ্বাস করে যে, দ্বীন বলতে যুক্তি, প্রমাণ ও স্বাধীনতাকে বুঝায় তখন তলোয়ারের সাথে কুরআনের সম্পর্ক সৃষ্টি করার অর্থ কি? এই কুধারণা পোষণ কিংবা নির্বুদ্ধিতার অভিযোগ উত্থাপন এমন কোন ব্যক্তির জন্য শোভা পায় না, যার মধ্যে ন্যূনতম বিবেক-বুদ্ধি ও সুস্থ চিন্তাধারা রয়েছে। সমগ্র দুনিয়ার পর্যালোচনা করুন। মহাদেশগুলোর প্রতি লক্ষ করুন। এটা কি সত্য নয় যে, সকল দিক থেকেই শান্তি ও নিরাপত্তার বড় বড় দাবী করা হচ্ছে, বড় বড় সম্মেলন, প্রচার মাধ্যম এবং লেখকদের সবাই শান্তি জপ করছে।
শান্তির শ্লোগান ও যুদ্ধের প্রস্তুতি
আপনারা কি ইসরাঈল রাষ্ট্রের অবস্থান দেখছেন না? এ রাষ্ট্রটি তার সীমানার মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে জীবন যাপনের অধিকার কান্নাজড়িত কণ্ঠে দাবী করছে। এমন কোন দিন কি অতিবাহিত হয় যেদিন আমরা বিশ্বশান্তির ব্যাপারে সংবাদ ও গল্প প্রবন্ধ না পড়ে থাকি? দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা এবং সেজন্য আগ্রহ ও সদিচ্ছা সম্পর্কে শুনে শুনে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। এমন কি “বিশ্বশান্তি” কথাটিই এখন অন্তসারশূন্য মনে হচ্ছে। প্রত্যেক দেশের নেতৃত্বের অভিলাষীরা দ্বিধীহীন চিত্তে এর জপ করে থাকে।
এতদসত্ত্বেও দুনিয়ায় কি ঘটেছে? সমগ্র পৃথিবী ধ্বংসাত্মক ও মানবজাতিকে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নির্মূলকারী অস্ত্রশস্ত্র উদ্ভাবন এবং লাভ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। ধ্বংসের উপকরণ তৈরীর জন্য অজস্র টাকা পানির মত খরচ করা হচ্ছে। তথাপি প্রত্যেক জাতির শ্লোগান এটা কি যে, তারা শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সম্প্রীতি ও সৌহার্দের পতাকাবাহী। কেন এত প্রয়াস প্রচেষ্টা? এসব কি এই কাল্পনিক আযাদী ও ঐ শান্তির প্রতিরোধের জন্য নয় যার গীত গাওয়া হয়ে থাকে? গোলাপ ফুল কাঁটার মুখাপেক্ষী হয় এ জন্য যে, তা তার নিরাপত্তা বিধান করে। ইসলাম শান্তির দ্বীন এবং শান্তির দিকে দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি অবশ্যই দলিল-প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল।
(আরবী***********) (তুমি তোমার রবের দিকে মানুষকে হিকমত ও উত্তম নসিহতের সাহায্যে দাওয়াত দিতে থাকো এবং লোকদের সাথে এমনভাবে বিতর্ক কর যা সর্বোৎকৃষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী হয়।)
রাসূলুল্লাহ (স)-এর আদর্শে উৎসর্গিত আমার পিতা–মাতা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াতী কাজের সূচনা লগ্নে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। যদিও মুশরিকগণ ঈমানদারদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের নীতি অবলম্বন করেছিলো। এমনকি তাদের হত্যা করতেও ইতস্তত করছিলো না। সেই যুগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার নির্যাতিত সাথীদের পাশ দিয়ে কোথাও যেতেন তখন বলতেন, “হে ইয়াসীরের পরিবারের লোকজন! সবরের রজ্জু অত্যন্ত কঠোরভাবে ধারণ কর। আমার এমন ক্ষমতা নেই যে, আমি এই অত্যাচার প্রতিহত করতে পারি। নিসন্দেহে তোমাদের এই পরীক্ষার বিনিময়ে তোমাদেরকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।” আবার যখন তায়েফের বাজারগুলোতে সাকীফ গোত্রের লোকেরা তাঁর প্রতি পাথর বর্ষণ করেছিলো রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো তাঁর আপাদমস্তক তখন তিনি তার কোন পরোয়া করেননি। বরং তাঁর ঐকান্তিক কামনা ছিল তিনি যেন তাঁর রবের অসন্তোষের শিকার হয়ে না পড়েন। সকল অত্যাচার নির্যাতনে তিনি সবর অবলম্বন করেছিলেন। এমন কি শেষ পর্যন্ত তিনি হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সেই শহরের অধিবাস গ্রহণ করলেন। যার মাটির জ ন্য এই সৌভাগ্র লিপিবদ্ধ ছিল যে, তার পবিত্র দেহ বক্ষে ধারণ করবে। এখানেই শেষ নয়, যে ঘর বাড়ী ছেড়ে দিয়েছেন আর দুশমনদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। বরং শত্রুগণ এখানেও তাকে নিশ্চিন্তে বসার সুযোগ দেয়নি। এখানেও তারা তাকে হুমকি দিতে থাকে এবং তাঁকে ও তাঁর দাওয়াতকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য সদা তৎপর হয়। তার হিজরতের স্থানেও তারা আক্রমণ করে বসে এবং তখন দ্বীন এবং দ্বীনের ওপর ঈমান আনয়নকারীদের নিরাপত্তার জন্য অস্রহাতে আত্মরক্ষামূলক অভিযানে অগ্রসর হওয়া ব্যতীত অন্য কোন উপায় তাকে না। ইমাম শহীদের সম্মুখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উত্তম আদর্শ ছিল। এই আদর্শের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, সত্যকে তার অস্তিতত্ব রক্ষার জন্য অবশ্যই শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ রয়েছে (আরবী*****) “তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করো—”।
এ ক্ষেত্রে আপনাদের এই বিষয়টি ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, এই প্রস্তুতি হকের দুশমনদের সন্ত্রস্ত করা এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করার জন্য মাত্র। এর উদ্দেশ্য কখনো এটা নয় যে, আমা তাদের ওপর আক্রমণ করে বসবো। কিংবা অভিযান পরিচালনা করবো। এই প্রস্তুতির উদ্দেশ্র এও নয় যে এর সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করা কিংবা লোকদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করা হবে।
তরবারী ধারণকারী বাহু
এটা লক্ষ্য করুন যে, আমাদের সরকার ইসরাঈলের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছে এবং এই চুক্তি এখনও বলবৎ আছে। তারপরও আমাদের দেশের কি এমন প্রয়োজন যে সেনাবাহিনীকে ক্রমাগত সশস্র, সুসজ্জিত ও শক্তিশালী করে যাচ্ছে। এই সামরিক প্রস্তুতি কি কোন মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নেয়া হচ্ছে? কখ্খনো নয়। তা কিভাবে হতে পারে? যে বিপুল অর্থ আমাদের সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত করার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে তাকি বাহুল্য ব্যয় কিংবা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক? না সহস্রবার নয়। বরং প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে প্রতিটি দেশের অধিবাসীদের এই অধিকার রয়েছে যে, যদি তারা জীবিত থাকতে চায় তাহলে শক্তি সঞ্চয় করবে যাতে বিরোধী জাতিসমূহ ভীত সন্ত্রস্ত থাকে এবং তার প্রতি হাত বাড়াতে কিংবা স্বাধীনতা সার্বোভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস না করে। ইমামও এসব কাজই করেছেন। মিসরের ওপর অন্যদের দুঃসাহস না করে। ইমামও এসব কাজই করেছেন। মিসরের ওপর অন্যদের আধিপত্য ছিল এবং পার্শ্ববর্তী ফিলিস্তিনকে ইহুদীরা পদদলিত করছিলো। তাই তিনি ভাবলেন মুসরিমদের এই বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন যে দুর্বল বেইজ্জত ও পরাজিত ইসরাম প্রত্যেক নেকড়ের মুখের গ্রাসে পরিণত হয়েছে এবং প্রত্যেক কোণ থেকে শত্রুরা এর ওপর হামলা করছে। ইসলামের কি এতই অসহায় অবস্থা যে আত্মরক্ষা পর্যন্ত করতে পারে না? যেদিন ইমাম শহীদ কুরআন মজীদকে দুইখানা তলোয়অরের মাঝে রেখে ইখওয়ানের পার্থক্য সূচক নিশান তৈরী করেন সেদিন তিনি উম্মাতের মুসলিমার সামনে এই সত্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন যে এই পার্থক্র সূচক পতাকা যা দেখে ইসলামের শত্রুতা অসন্তুষ্ট- আজও আমাদেরকে আমাদের গৌরবোজ্জল সোনালী অতীতের সাথে যুক্ত করে দিতে পারে।
ইহুদীরা গোলান মালভূমির উপর জরবদস্তিমূলক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। তারা গোটা লেবাননে রক্তপাত করে চলেছে। পশ্চিম তীর ও গাজা অঞ্চলকে ইহুদীবাদের রঙ্গে রাঙিয়ে তোলা হচ্ছে। মসজিদসমূহের অমর্যাদা করা হচ্ছে এবং মসজিদগুলোর স্থলে ইহুদী ইবাদাতখানা নির্মাণের ষড়যন্ত্র পাকা পোখত করা হয়েছে। সিনাই মরুভূমি সম্পর্কে ছেলে ভুলানো বুঝ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা আমাদের দখলে আসেনি। আর আমাদের শত্রুরা সেখানে সশস্ত্র একজন মিসরীয়কেও মেনে নেয়নি।
আমাদের শত্রুদের যেহেতু এটা স্থায়ী সংকল্প ও পরিকল্পনা তাই তাদের পরাভূত করাও শক্তি প্রয়োগ দ্বারাই সম্ভব। এ কারণেই ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ দু’খানা তীক্ষ্মধার তলোয়ারের মাঝে কুরআন মজীদ রেখে উম্মাহকে এই চেতনা প্রদান করেন যে, ঈমান-আকীদার হিফাজতের জন্য জিহাদ অত্যাবশ্যক। এই প্রতীকের সাহায্যে তিনি এই অনুভূতিই জাগ্রত করেছেন যে, মুসলমানদের পৃথিবীর সকল মুসলিম অঞ্চলের স্বাধীনতার সংকল্প করতে হবে। যা এখনো অন্যদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ। এই প্রতীকের সাহায্য মিল্লাতে ইসলামীয়া, সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সকল প্রকার গোরামীর জোয়াল ছুড়ে ফেলার শক্তি অর্জন করতে পারে। মুসলিমগণ যদি এ বিষয়টি হৃদয়ংগম করতে পারে তাহলে আল্লাহ তায়ালার বাণীর সত্য ও বাস্তবতার জীবন্ত নমুনা হয়ে দেখা দেবে।
(আরবী**************) (আর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো এমনভাবে যাতে জিহাদের হক আদায় হয়ে যায়)
আমাদের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য তারা সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করছে এবং প্রকাশ্য ও গোপনীয় যাবতীয় ক্ষমতা ইচ্ছামত আমাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছে তবুও আমাদেরকে আল্লাহর শরীয়ত বাস্তবায়ন করা থেকে কোন কিছুই বিরত রাখতে পারবে না। আমাদের সযত্ন প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে এবং তা উত্তোরোত্তর আরো বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ।
পরাজয় আমাদের ভাগ্যলিপি নয়
আমরা দা’য়ী ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর পথের আহবায়ক। আর একজন দা’য়ী কখনো পরায় বরণ করে না। শত্রুর নির্যাতন ও চক্রান্ত তাকে পরাভূত করতে পারে না। তবে দা’য়ী যদি আল্লাহ তায়ালার সত্য ওয়াদার প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে থাকে কিংবা সেই অংগীকার ভংগ করার মানসিকতা পোষণ করতে থাকে যে, তিনি আল্লাহর দ্বীনের পতাকা উচ্চে তুলে ধরার লক্ষ্যে বাইয়াতের মাধ্যমে করেছেন তা হলে তার পরাজয় নিশ্চিত। কারণ বাইয়াতের এই ওয়াদা একটা স্থায়ী প্রতিজ্ঞা। মাঝে মধ্যে তার নবায়ন হয় মাত্র। এই চুক্তির উদ্দেশ্য কারো ওপর কোন জুলুম করা নয়। কিংবা তা শুধু তার সংগঠনেরই সুনাম সুখ্যাতির মাধ্যমও নয়। বিরুদ্ধবাদীগণ এরূপ ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করতে থাকে। প্রত্যেক ইখওয়ানী ভাই তার ভাই (মুর্শিদে আ’ম)এর হাতে এই বিষয়ের বাইয়াত করে থাকে যে, সে আল্লাহর পথে তার আনুগত্য করে চলবে। এই অংগীকার পূরণ করার জন্য কোন ক্ষমতাধর তাকে ধমক দিতে পারে না। আবার কোন অত্যাচারীও তাকে হতোদ্যম ও ভগ্নোৎসাহ করতে পারে না। এর কারণ শুধু এই যে, আমরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথেই অংগীকারাবদ্ধ হয়েছি। তাই পার্থিব শক্তিসমূহ যদি তাদের পুরো শক্তি প্রয়োগ করে আমাদরে পথে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে সফল হয়েও যায় তবে এই কামিয়াবী হবে খুবই সীমিত ও অস্থায়ী। নিরংকুশ ক্ষমতার মালিক এবং প্রকৃত শাসকদের সম্মুখে কার ক্ষমতা খাটতে পারে? তাঁর ইচ্ছাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। তিনি যা চান তাই হতে বাধ্য। তার দরকার প্রতিটি বিষয়কে অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণের সাথে বিন্যস্ত করা হয়ে থাকে।
কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদ অব্যাহত থাকবে
দ্বীন জিহাদের দাবী করে। তাই আমাদের ইমাম কুরআন মজীদকে দু’খানা তলোয়ারের মাঝে সাজিয়ে আমাদের প্রতীক বানিয়েছেন। যতদিন পৃথিবীতে একজন ইখওয়ানীও জীবিত থাকবে ততদিন এই প্রতীক বিদ্যমান থাকবে। ইখওয়ানের এই ঈমান রয়েছে যে, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের হিফাজত করতে হবে এবং এই আকীদার ওপর আক্রমণকারীদের মোকাবিলা করতে হবে। শক্তির এই প্রদর্শনী শুধু আত্মরক্ষার খাতিরে কারো ওপর জুলুম ও অত্যাচারের উদ্দেশ্রে নয়। এটা কত অদ্ভূত ব্যাপার যে, সারা দুনিয়াকে আত্মরক্ষার অধিকার দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর কোন ব্যক্তি তার অস্তিত্ব, তার দেশও তার ঈমান-আকীদার হিফাজতের ঘোষণা দিলেই তা হয়ে যায় মারাত্মক অপরাধ এবং তাকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করা হয়।
মনে হয় যেন শক্তি প্রয়োগ প্রত্যেক দ্বীন ও মানুষের জন্য বৈধ কিন্তু ইখওয়ানের জন্য নিষিদ্ধ। এখন দেখুন ইখওয়ানের নেতৃত্ব তার সংগঠনের ছাত্রদেরকে ইউনিভারসিটি ও কলেজসমূহে বিরোধী ছাত্রদেরকে মারপিট করার জন্য কখনো উৎসাহিত করেনি। অথচ অন্যদিকে সা’দাত ও তাঁর উত্তরসূরী শাসকগণ খোলাখুলিভাবে নির্দেশ দিতো যে, ইখওয়ানের সমর্থক ছাত্রদেরকে যে কোন উপায়েই হোক মারপিট করতে হবে। এতদসত্ত্বেও সরকারের তল্পীবাহী ও পেটুয়া ছাত্ররা কখনো ইখওয়ানী ছাত্রদের ওপর হাত তুলতে সাহস করেনি। এর কারণ এই যে, সরকার সমর্থক ছাত্রদের ইখওয়ানের শক্তি সম্পর্কেও ধারণা আছে এবং তারা এও জানে যে তাদের নিজেদের অবস্থা কি? এরূপ আচরণ যদি তারা কখনো করেও বসে তাহলে তাদের খুব ভালভাবেই জানা আছে যে, তার পরিণাম কি দাঁড়াবে। (ইখওয়ানী ছাত্ররা চুড়ি পরিধান করে বসে নেই।)
ভিত্তিহনি অভিযোগ
ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের একটা ঘোষণা খুবই বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। তিনি বলেছিলেন: “যেসব রাষ্ট্রপ্রধান, দল ও সংগঠন আমাদের আন্দোলনের বিরোধী আমাদের সংগ্রাম তাদরে সবার বিরুদ্ধে। আমাদের এই যুদ্ধ এমন যাতে কোন সন্ধি বা কোন যুব্ধবন্দী নেই। যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আমাদের জাতির ব্যাপারে চূড়ন্ত ফায়সালা করে দেন।”
উক্তিটি এবং এরূপ আরো অসংখ্য উক্তি হিসেব নিকেভ না করে এবং প্রসংগ প্রেক্ষিত থেকে আলাদা করে আমাদের বিরুদ্ধবাদীগণ জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। ইমামের কোন ভাষণ আলোচনা কিংবা লেখা বিকৃত করে তার মধ্যে নিজের স্বার্থের কথা বের করে নেয়া তাদের অর্জিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর উদাহরণ হলো, কোন ব্যক্তির কুরআন মজীদ থেকে সালাত পরিত্যাগ করার দলিল প্রমাণ খুঁজে বের করার মত। আয়াতের পূর্বর প্রসংগ বাদ দিয়ে শুধু—–
(আরবী**************)
(হে ঈমানদারগণ! তোমরা সালাতের ধারে কাছেও যেও না।) এবং তারপর সাদাকাল্লাহুল আজিম বলে।
আমরা জানি যে কুরআন মজীদে কোন প্রকার স্থবিরোধিতা পাওয়া যায় না। বরং কোন কোন আয়াত অপর আয়াতের বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট করে তুলে। অতএব কোন ব্যক্তি কোরআনের অংশবিশেষকে সমগ্র কিতাবে মুবীন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা থেকে ফলাফল গ্রহণ করতে চেষ্টা করে তাহলে তা হবে তার অজ্ঞতার প্রমাণ। এরূপ কর্মপদ্ধতি দ্বীনের জন্য বড়ই ক্ষতিকর।
ইভওয়ানের দাওয়াতের মূল উৎস হচ্ছে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এগুলোকে উপস্থাপন করার জন্য ইখওয়ান সহজ ও সুবোধ প্রক্রিয়া সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষা এবং সুস্পষ্ট ব্যক্তি প্রমাণের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। অতএব বিবেক –বুদিত্ধ-সম্পন্ন কোন ব্যক্তি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না যে, এ সংগঠন এবং কর্মীরা সন্ত্রাস ওশক্তি প্রয়োগের পথ অবলম্বন করবে। মূলত বিশুদ্ধ ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞানের নীতিমালা সম্পর্কে অবগত লোকদের জানা আছে যে, লিখনী ও বক্তৃতায় সাদৃশ্য ও সমার্থবোধক শব্দাবীল, রূপক অর্থের ব্যবহার এবং উপমিতির প্রয়োগ হয়ে থাকে। কিন্তু শাব্দিক অর্থ কখনো এর মুল উদ্দেশ্র থাকে না। সুতরাং যখন আমরা বলি যে, কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধীদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম তখন তার অর্থ এটা করা হয় না যে, আমরা তাদেরকে উদ্যত তলোয়ারের নীচে ফেলে দিতে যাচ্ছি। বরং সোজা কথায় তার অর্থ দাঁড়ায় আমরা আমাদের ভাষা আমাদের লিখনী এবং আমাদের চেষ্টা-সাধনা দ্বারা সর্বদা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। আর এটা একটা যুদ্ধই। কেননা লড়াই কেবলমাত্র ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার দ্বারাই হয় না। বরং তার অসংখ্য পন্থা ও পদ্ধতি রয়েছে। যদি উপরোক্ত বাক্য দ্বারা অস্ত্রের লাড়াই বুঝে নেয়া হয় তাহলে জেনে রাখুন যে, আমাদের কাছে প্রথমত গোলাবারুদ, জাহাজ এবং অন্যান্য যুদ্ধোপকরণ নেই যে, তার সাহায্যে আমরা পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর মোকাবিলায় লড়তে পারি। আর যদি এসব সাজ-সরঞ্চাম আমাদের কাছে থেকেও থাকে তবুও আমরা সেগুলো কোন মুসলিমের দিকে তাক করবো না, তারা আমাদের বিরোধী হলেও। আমরা তা শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করবো। যদি আপনি কোন পাহাড়ী আরবের কথাবার্তা শুনেন তা হলে হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে, সাধারণত ঝ গড়া বিবাদের ক্ষেত্রেও তারা বলে যে, “কাতালানি কাতালতুহু” যার আক্ষরিক অর্থ সে আমাকে হত্যা করেছে আমিও তাকে হত্যঅ করেছি। কিন্তু তার এই কথার এরূপ অর্থ কখনো উদ্দেশ্য নয় বরং এর মর্মার্থ হবে কেবল এই যে, সে আমাকে মেরেছে আমিও তাকে প্রহার করেছি।
যদি কোন লোক বলে যে, “আমিআমার প্রতিপক্ষকে বোবা বানিয়ে ছাড়বো।” তাহলে আপনি কি তার অর্থ গ্রহণ করবেন এই যে, সে তার জিহবা কেটে দেবে যাতে সে বাকশক্তিহীন হয়ে যায়। এই অর্থ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
আমরা যখন আমাদেরদাওয়াতের উল্লেখ করি এবং আমাদের দুশশনদের মোকাবিলা করার জন্য শপথ গ্রহণ করি এবং তখন তার অর্থ এই যে, আমরা এই পুতঃপবিত্র পয়গামের প্রচর ও প্রসার ঘটানোর ইচ্ছা পোষণ করছি এবং বীরত্বপূর্ণ শব্দাবলী ব্যবহার করে ইসলামের প্রতি আমাদের বিশ্বস্ততার প্রকাশ করছি। শব্দের গোলকধাঁধা সৃষ্টিকরী ও অপব্যাখ্যাকারীদের কথা ছেড়ে দিন। এ ব্যাপারে আপনি আমাদের সাথে একমত হবেন যে, মানুষ অনেক সময় “ঠিক আছে” কথাটা মুখে উচ্চারণ করে। শব্দ একই হলেও তা বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব অর্থ সুনির্দিষ্ট করার জন্য দেখতে হবে। বক্তা কোন্ পরিবেশ পরিস্থিতিতে ও প্রেক্ষাপটে শব্দটি প্রয়োগ করেছেন এবং তা বলার ভংগি কি ছিল। এই শব্দ দ্বারা আপনি কাউকে হেয় এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন। কারো সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করতে পারেন। আবার হুমকি প্রদানের ভাবও প্রকাশ করতে পারেন।
ইখওয়ানের দাওয়াতী শরীয়াতের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন
ইমাম হাসানুল বান্না শহদি জীবনের সকল ক্ষেত্রে শরীয়াতের ইলাহিয়ার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের দাওয়াত নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হন। এই শরীয়াতের শিক্ষামালা থেকে তিনি বিন্দুমাত্র সরে যাওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। শরীয়াত ডিকটেটরশীপকে আদৌ সমর্থন করে না। বরং তার বিরুদ্ধে লড়াই করার উদাত্ত আহবান জানায়। ইসলামে জোরজবরদস্তি ও বল প্রয়োগের কোন স্থান নেই। আল্লাহ তায়ালা দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন। “যার ইচ্ছা ইমান কবুল করুক আবার কেউ চাইলে কুফুরীর পথে চলতে থাকুক।” (প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করবে) আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলে মাকবুল (স)-কেও নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আপনি কি মানুষকে ঈমান গ্রহণ করতে বাধ্য করবনে? এমন সুস্পষ্ট হিদায়াতের পরও কি হকের পথের কোন আহবানকারী এক নায়কত্বের স্বপ্ন দেখতে পারে? হাসানুল বান্না ইসালামী ডিকটেটরশীল প্রতিষ্ঠার অভিলাষী ছিলেন এই জঘন্য অভিযোগের কি কোন মূল্য আছে? কোন সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মুমিন কি দুষ্কর্মশীল জালিমদের একনায়কত্ব ও স্বৈরচারকে নেককার ও পবিত্র ঈমানদারদের শূরার সাথে একাকার করতে পারে? আমাদের কাছে আছে ইসলামের শূরায়ী ব্যবস্থা একনায়কত্ব যার ধারে কাছেও ভিড়তে পারে না।
এরূপ অসুস্থ মন-মানসিকতার কোন চিকিৎসা সম্ভবই নয় যা দিনের দিবালোকের ন্যায় সত্যকে অস্বীকার করে। ইসলাম বিরোধী শক্তি মিথ্যাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রপাগান্ডা থেকে কখনো ফিরে আসার নয়। তারা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের অত্যন্ত কুৎসিত চিত্র অংকন করে থাকে। কেননা এই আন্দোলনই তাদের জন্য পেরেশানী ও অশান্তির কারণ। এই আন্দোলন তাদের আরামে ঘুম হারাম করে দিয়েছে এবং তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। যতদূর পর্যন্ত আমাদের কাজ-কারবার ও কর্মতৎপরতা রয়েছে- সর্বত্রই আমরা আমাদের অবস্থান পুরোপুরি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি। তদুপরি আমরা কখনো এমন দাবীও করি না যে, ইসলামী দাওয়াতের ওপর আমাদের ঠিকাদারী রয়েছে বরং আমরা অসংখ্য ইসলামীসংগঠনের মধ্যেকার একটা মাত্র। এই ময়দানে আমরা ছাড়াও বহু ইসলামী জামায়াত কর্মতৎপর রয়েছে। অবশ্য যে বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করে আমরা আমাদরে মানসিক সান্ত্বনা খুঁজে পাই। তা হচ্ছে এই, আমরা ইসলামের শত্রুদের চোখের কাঁটা হয়ে বিদ্ধ হচ্ছি। আর এটাই প্রমাণ করে যে, আমরা আল-হামদুলিল্লাহ রাহে হকের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছি। বিশ্বব্যাপী ক্রুসেডবাদী, সমাজতন্ত্রী ও ইহুদীবাদী শক্তিসমূহ আমাদের সাথে যে পরিমাণ বৈরিতা পোষণ করে তার কোন তুলনা মেলে না।
আমরা নির্দ্বিধায় ঘোষণা করছি যে, আমাদের আহ্বান ইসলামের সঠিক শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান। দুনিয়ার যে কেউ িএই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সচেষ্ট হোক আমরা তার নগণ্য সিপাহী এবং এই উত্তম কাজে যে কোন ব্যক্তির সাথে পুরোপুরি সহযোগিতা করার জন্য সদাপ্রস্তুত রয়েছি। আমরা এরূপ প্রত্যাশা কখনো করিনি যে, নেতৃত্ব কর্তৃত্বের দায়িত্ব আমাদেরকে দিতে হবে। বিগত পার্লামেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে তখন প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজ নিজ নির্বাচনী মেনিফেষ্টোতে সর্বপ্রথম এই অংগীকার ব্যকরে করে যে, তারা দেশে ইসলামী শরীয়াতের বাস্তাবায়ন চায়। সত্য বলতে কি এই গঠনমূলক পরিবর্তন দেখে আমাদের অন্তর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে যায়। এখন নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। তাই এখন বাস্তবে প্রমাণিত হবে যে, কারা ইসরামী অভিব্যক্তির ব্যাপারে নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক ছিল আর কারা ইসলামকে শুধু নির্বাচনী শ্লোগান রূপে ব্যবহার করছিলো। জনসাধারণ শীগ্রই এটা জেনে ফেলবে যে, ইসলামের ব্যাপারে একান্ত নিবেদিত প্রাণ ও বিশ্বস্ত কারা আর কারা ইসলামকে ভোট লাভের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। যদি প্রকৃতই এসব রাজনৈতিক দলের অবস্থা এই হয় তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে তাদের পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকী প্রতিদিন ইখওয়ানের প্রতি কেন কাদা নিক্ষেপ করে?
এই ভদ্রলোকদের সম্পর্কে অনেক কিছুই প্রকাশ করা যায় কিন্তু ইখওয়অনের কর্মনীতি এ নয় যে, এরূপ নিরর্থক কথাবার্তা এবং বেহুদা অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তারা তাদের মূল্যবান সময় অপচয় করবে। তদুপরি আমরা চাইনা যে, আমাদের মুখের ভাষা কিংবা কলম দ্বারা কখনো এমন কোন কথা প্রকাশিত হোক যা প্রতিশোধ গ্রহণের পর্যায়ে পড়ে এবং এভাবেকারো অন্তরে আঘাত লাগুক। আমরা আত্মরক্ষা করতে গিয়েও কখনো নৈতিকতা বিবর্জিত এবং অশালীণ কোন কথা মুখে উচ্চরণ করি না।
আমাদের আকাংখা এই যে, আদম সন্তানের মধ্যে আমরা উত্তম চরিত্র ও শ্রেষ্ঠ কর্মের আদর্শ উপস্থাপন করবো। আদম আলাইহিস সালামের দু’সন্তানের আলোচনা করা হয়েছে কুরআন মজীদে।তাদের একজন অপরজনকে হত্যা করার হুমকি দেয়। প্রত্যুত্তরে সে বলে, “যদি তুমি আমাকে হত্যা করার জন্য হাত বাড়াও আমি কিন্তু তোমাকে হত্যা করার মত কোন কাজ করবো না।” এটাই আমাদের কর্মনীতি। আমরা কারো সাথে অসদাচরণ করি না। আমাদের হাতের ও মুখের অত্যাচার থেকে সকল আদম সন্তান সম্পূর্ণ নিরাপদ। অবশ্য কোন জালিম যখন প্রতি অকারণে তার জুলূমের হাত প্রসারিত করতে উদ্যত হয় সেক্ষেত্রে আসমানী ও পার্থিক তথা আল্লাহ প্রদত্ত ও মানব রচিত সকল আইনের দৃষ্টিতেই আমাদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। তথঅপি আমরা সাধারণ মানুষের ন্যায় কখনো প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তা করি না। প্রতিশোধ গ্রহণেচ্ছুদের অবস্থা দাঁড়ায় এই যে, তারা সীমালংঘন করে বসে। গমের সাথে কীট পতংগকেও পিষে ফেলে। কিন্তু আমরা এরূপ নই। আমাদের অবস্থা হচ্ছে, ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের ভাষায় (আরবী********) অর্থাৎ আমরা জালেমদের বিরুদ্ধে কাদেরে মতলকের কুদরতে কামেলার তীর ও শেষ রাতের বিনম্র দোয়ার দ্বারা সাহায্য প্রার্থনা করি।
আর আমাদের এই হাতিয়ার কোন তেজ বীর্যহীন ভোঁতা অস্ত্র নয় বরং এর কার্যকারিতা প্রমাণিত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা বুঝে উঠতে পারে না। আল্লাহ প্রেরিত কিতাবের ওপর ঈমান আনয়নকারী লোক তারাই যাদের সম্মুখে কোন আয়াত পেশ করা হলে তারা একান্ত বিনয়াবনত হয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং সৃষ্টিকর্তার মহত্ব ও অসীম ক্ষমতার তাসবীহ জপ করতে থাকে। অতপর তাঁর মোকাবিলায় কখনো তারা অন্যায ও অহংকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় না।
আমি এতক্ষণ যা বললাম তার কিছু প্রমাণও পেশ করছি। ইখওয়ানের “আন নাজির” সাময়িকী মে ১৯৩৮ সালে প্রথম বারের মত প্রকাশিত হলে তাতে এই মর্মে দু’টো সুস্পষ্ট বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয় যে, ইখওয়ান রাজনৈতিক ময়দানে হাজির হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষের নিকট এই বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, আমরা অন্যান্য দলের মোকাবিলা করবো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায়। কোন প্রকা সন্ত্রাসমূলক কিংবা অপরাধী কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হবো না। আমাদের এই রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেশের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং আমরা এই তৎপরতাকে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। আমাদের প্রোগ্রাম ছিল অনেকটা বিশ্ব ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলার। এখন কোন নির্বোধ কেবল এটা মনে করতে পারে যে, আমরা প্রচার প্রপাগান্ডা এবং দাওয়াত ও তাবলীগের পরিবর্তে পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে কামান ও গোলা-বারুদ নিয়ে লড়াই বাধাতে যাচ্ছি। “আন নাজির” –এর প্রতিটি পৃষ্ঠা সাক্ষী যে, আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের ম ত আমাদের হাতিয়ার অশালীন বক্তব্য ও রক্ত চক্ষু নয় বরং হিকমতের ও কৌশল, উত্তম নসিহত, নম্রতা-ভদ্রতা, সবর ও ধৈর্য।
কোন বিবেকবান ও বুদ্ধিমানব্যক্তির বন্য এটা শোভনীয় যে, তিনি ইখওয়ান সম্পর্কে ধারণা পোষণ করবে যে আমরা ইসলামের সঘন্যতম দুশমন রাশিয়অ ও আমেরিকার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছি। লড়াইয়ের জন্য আমাদের কাছে বস্তুগত সরঞ্জাম কোথায়? মানুষের হয়েছে কি? তারা কি ধরনের ধারণা পোষণ করে এবং কি ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকৃত কথা হচ্ছে তাদের বিবেকের অপমৃত্যু ঘটেনি। কিন্তু বিদ্বেষ তাদেরকে অন্ধ করে দিয়েছে। এই বিদ্বেষ ও পক্ষপাতিত্ব তাদেরকে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ দেয় না। বরং তাদেরকে নিশ্চিত ধ্বংসের গভীর পঙ্কে নিক্ষেপ করে। যেখানে তাদের কখনো শান্তি ও স্বস্তি নসীব হবে না। আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের কাছে অন্য কোন প্রকার ছাড় প্রত্যাশা করি না। আমরা শুধু তাদের নিকট ইনসাফ ও সুবিচার প্রত্যাশা করি অবশ্য যদি ইনসাফ ও সুবিচার শব্তের অস্তিত্ব তাদের অভিাধানে থেকে থাকে।
আইন আমাদের ও আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে ফয়সালা করে সত্য কিন্তু ইনসাফের দাবী পূরণ করতে পারে না। যদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায় এবং সরকারী কোন চাপ ব্যতীত ইনসাফ এবং ন্যায়বিচারের নীতি গ্রহণ করা হয়। সাথে সাথে অত্যাচার নির্যাতন ও জুলুম নিপীড়নের কুটকৌশল প্রয়োগ না করে প্রকৃত সত্য উদ্ধারের জন্য বস্তুনিষ্ঠ উপায়ে অনুসন্ধান চালানো হয় এবং অতপর রায় ঘোষণা করা যায় তাহলে সমালোচকদের অধিকার থাকবে যা ইচ্ছা তা বলে বেড়ানোর অবশ্য তাদের দাবীর স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য দলীল থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কোথায় ইনসাফপূর্ণ ফায়সালা করা হয়েছে? অতএব আমাদরে বিরুদ্ধাচরণের দিশেহারা লোকদের কাল্পনিক অভিযোগ, মনগড়া কাহিনী এবং ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডা চালানোর স্বাধীনতা রয়েছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমাদের মালিকের ফায়সালা হচ্ছে তিনি ফিতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের কথা ও কাজের কখনো সফলতা দান করেন না। তাদের চারদিকে আল্লাহ তায়ালাই আমাদের সকল কর্মসম্পাদনকারী এবং তিনিই সাহায্যকারী। তাঁর সাহায্য সহযোগিতার পর আর কারো প্রয়োজনও আমাদের নেই।
সুধী পাঠকমন্ডলী। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে ইনশাআল্লাহ দেখতে পাবেন, ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ গণতন্ত্রের ওপর আস্থাশীল ছিলেন কি না। অনুরূপ এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করার জন্য ইমাম কি কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর নিকট ক্ষমতার দন্ড লাভ করা নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য কখনো ছিল না। তিনি সংস্কার ও সংশোদনের মহৎ উদ্দেশ্যে ক্ষশতা ও কর্তৃত্ব গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলেন।
আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, দুনিয়ার যে কোন ব্যক্তি এবং দলই শরীয়াতে ইসলামী প্রবর্তনের জন্য প্রাণচঞ্চল ও কর্মতৎপর হয় আমরা তার অনুপম পৃষ্ঠ পোষক ও সাহায্যকারী। সেজন্য বুদ্ধি, জ্ঞান এবং উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রয়োজন। পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বেই তা ঠিক আছে কি না দেখতে হবে। কেননা তড়িঘড়ি এবং আবেগের কারণে অনেক সময় সিদ্ধান্ত ভুল হয়ে যায়। যার ফলে শরীয়াতের প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি কাজই বুঝে শুনে করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আমরা ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের নিকট থেকে শিখেছি যে, দাওয়াত ও ইরশাদের কাজে এই আধুনিক যুগের দাবীকে বিবেচনা রাখতে হবে। বর্তমান সময়ে ঐ সকল কর্মপদ্ধতি ও উপকরণ যা বিগত দিনে কার্যকরী ও সুফলদায়ক ছিল- অকেজো হয়ে পড়েছে। তাই হকের আহবানকারীর কর্তব্য হলো তাঁকে বর্তমান সময়ের সকল উপায় উপকরণকে কাজে লাগাতে হবে। নাটক, সিনেমা, এবং টেলিভিশন আমাদের যুগের অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার। শয়তান এগুলোকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। অথচ এসব হাতিয়ারকে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের যুগ নতুন নতুন মতবাদ ও চিন্তাধারার যুগ। জনসংযোগ ও প্রচার প্রপাগান্ডায় এসব মতবাদ ও দর্শনের ব্যপ্তি ও বিস্তৃতি ঘটানোর ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসু ভূমিকা পালন করে। এই ময়দানে ইসলামের দায়ীগণকে দক্ষতা ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে। ইসলামী দাওাত জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সর্বত্র পরিব্যপ্ত। মানুষের নিকট আমাদের এই দাবী যে তারা যেন আল্লাহর কিতাবকে বুঝতে সচেষ্ট হন যাতে বিস্তারিতভভাবে ইসলামকে জানতে পারেন।
ইমাম হাসানুল বান্না এবং তাঁর পূর্ববর্তী দায়ীগণ আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়েছেন যে, দ্বীন ইসলামের মূল উৎস হচ্ছে কুরআন মজীদ। সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (স) কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। নবী করীম (স)-এর জীবন চরিত ও সুলাহায়ে উম্মাতের চরিত্র সুকৃতির আনুগত্য ও দুষ্কৃতির প্রতিরোধের বাস্তব উদাহরণ পেশ করে। অতএব এই মূলনীতির আলোকে বিশ্বব্যাপী দাওয়াতী অভিযানসমূহের মধ্যে থেকে যারা আমাদের ভূমিকার সাথে ঐকমত্য পোষণ করবে আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাবো আর যা এই নীতিমালার পরিপন্থী হবে তা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।