ত্রিশতম অধ্যায়
মন্ত্রীত্বের আকাঙ্খায়
জনাব শাইখ আল বাকুরী মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবির অনুমতি না নিয়েই মন্ত্রীত্ব কবুল করেছিলেন। মুর্শিদে আ’ম শাইখ আল বাকুরীকে জিজ্ঞেস করেন, “এখন ইখওয়ান সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভংগি ও মনোভাব কি”? তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, “আমি মাকতাবে ইরশাদে গিয়ে ইস্তফা দিয়ে দিচ্ছি।” পুনরায় পশ্ন করলেন “তারপর”? শাইখ বাকুরী জবাব দিলেন, “ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বুনিয়াদী রকুনিয়াতের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
শাইখ বাকরীর মন্ত্রীত্বের মোহ ও নেশা তাকে আন্দোলন থেকে পুরোপুরি সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছিলো। ইখওয়ান অস্থির হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে, তিনি কত নিকৃষ্টতম সওদা করে ফেলেছেন। কি খারাপ সিদ্ধান্তেই না উপনীত হয়েছেন। মুর্শিদে আ’ম ছিলেন খুবই বদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তিনি শাইখ আল বাকুরীর দফতরে তাশরীফ নিয়ে যান এবং মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য তাকে মোবারকবাদ জানান। এ সময় সন্ত্রণালয়ে মুর্শিদে আ’ম এবং শাইখ আল বাকুরীর সাক্ষাতের যুগ্ম ছবি সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল। শাইখ বাকুরীকে জনৈক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, মুর্শিদে আ’ম- এর ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? জবাবে তিনি আলোচ্য ছবিব প্রতি ইংগিত করে বলেন, “তোমরা দেখতে পাচ্ছো যে, আমি মর্শিদে আ’মের সম্মুখে এমনভাবে বসে রয়েছি যেমন করে কোন শাগরেদ তার উস্তাদের সামনে শালীনতা ও সৌজন্যবোধ সহকারে বসে থাকে।” আন্দোলন থেকে শাইখ বাকুরীর বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা তার কতিপয় গুণাবলী ও বৈশীষ্ট্যের স্বীকৃতি দেই। তিনি ছিলেন বড় উত্তম আচরণের অধিকারী ও সহৎ নৈতিক চরিত্রের গুণে বিভূষিত। আল্লাহ তায়ালা তাকে এবং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।
পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায়
জামাল আবদুল নাসের ইখওয়ানের বিরুদ্ধে যখন অভিযান শুরু করেন তখন মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাকেও বাদ দেয়া হবে না। তথাপি তিনি সত্য প্রকাশের দায়িত্ব অব্যাহতভাবে আদায় করতে থাকেন। ইখওয়ানের কত নিরপরাধ ও নির্দোষ সাথীদের সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কঠোর শাস্তির নির্দেশ শুনানো হয়। আমাদের এসব ভাই উচ্চ খান্দানের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। ডাক্তার হোসাইন কামালুদ্দিন, উস্তাদ মুনীর দাল্লা এবং ডাক্তার মুহাম্মাদ কামাল খলিফা তিন জনকেই ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডাদেশ শুনানো হয়। উস্তাদ মুনীর দাল্লা ছিলেন মিসরের বিখ্যাত ও স্বনামধন্য ধনী এবং প্রখ্যাত দাল্লা বংশের প্রদীপ্ত প্রদীপ ও গৌরবোজ্জল ব্যক্তিত্ব। মিসরবাসীর খেদমতে এ গোত্রের কৃতিত্বের পরিচয় নতুন করে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ডঃ হোসাইন কামাল উদ্দীন ছিলেন সে আমলে আইন কলেজের অধ্যক্ষ এবং সুপরিচিত আলেম আল্লামা শাইখ আহমদ ইবরাহীমের বংশধর। অনুরূপ ডাক্তার কামাল খলিফা ছিলেন সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী মুহাম্মাদ পাশা আল আসমাভী মরহুমের জামাতা।
মুর্শিদে আ’ম শাস্তির ফায়সালা শুনতে পান। তিনি নিজের বিচার বিভাগের সদস্য ছিলেন। এজন্য এসব ফায়সালা দেখে তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে ছিলো যে, সরকার ইখওয়ানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা রুজু করে সাজা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এতদসত্ত্বেও তিনি ইংরেজদের সাথে আবদুন নাসেরের মৈত্রী চুক্তির সমালোচনা করেন এবং তার সকল নেতিবাচক ও অনিষ্টকর দিকগুলো প্রমাণসহ এবং বিজ্ঞজনোচিতভাবে বিশ্লেষণ করেন।
তার মতে সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করতে গিয়ে যদি জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয় তাহলেও মু’মিন বান্দাকে সত্যের স্বার্থে তা কুরবান করা উচিত। তিনি একজন আই-নবিশেষজ্ঞ ম্যাজিষ্টেট, জজ এবং মুর্শিদ হিসেবে জীবন যাপন করেন। তার পুরো জীবনের রেকর্ড ছিল নিষ্কলুষ এবং উজ্জ্বল। সম্ভবত অভিকাংশ লোক এ সত্য সম্পর্কে অনবহিত যে, ইখওয়ানের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য আমরা তাকে বার বার বহু অনুরোধ উপরোধ করি। অথচ তিনি বরাবরই তার শারীরিক দুর্বলতা এবং এ গুরুদায়িত্বের বোঝা উপলব্ধি করে অক্ষমতা প্রকাশ করতে থাকেন। আমরা যখন বার বার অনুরোধ জানাই তখন তিনি এ পদ গ্রহণ করেন। একবার তিনি বোঝা কাঁধে তুলে নেয়ার পর তার হকও যথাযথ পালন করেছেন। আন্দোলনের স্বার্থে তিনি তার যথা সর্বস্ব কুরবানী করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ইখওয়ানের ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখার জন্য এবং দাওয়াতের হকের প্রদীপ সমুজ্জল রাখার লক্ষ্যে তিনি তার সর্বশেষ রক্তবিন্দুও এ পথেই ব্যয় করেছেন।
স্মরণীয় ছবি
একবার আমরা তাঁর সাথে হালওয়ান মুরুভূমি এবং হাওফ উপত্যকায় সফরে যাই। ভ্রমণ ব্যাপদেশে মরুভূমিতেই মধ্যহ্নভোজের সময় হয়ে যায়। আমরা এক জায়গায় থেমে নাময পড়লাম এবং খাবার গ্রহণ করলাম। পানাহার শেষে তিনি তার মূল্যবান স্যুট পরিহিত অবস্থায়ই বালির ওপর শুয়ে পড়লেন এবং কয়েক মিনিট আরাম করেলেন। আমি এ স্মরণীয় মুহূর্তে তাঁর ছবি তুলে নিলাম। ফিরে আসার পর আমি তাকে সেই ছবি দেখালাম এবং এ ছবি ছাপানোর অনুমতি চাইলাম। তিনি খুব কঠোরভাবে নিষেধ করলেন এবং বললেন, “ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কখনো এ ধরনের সস্তা খ্যাতি ও নাম-যাশের পশ্চাতে ধাবিত হওয়া উচিত নয়। আমাদের প্রতিটি কাজই শুধু মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয়ে থাকে। আর আমাদের রব আমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। তাই মানুষের কাছে প্রচার করে বেড়ানোর কোনই প্রয়োজন নেই। আমি এ ছবি নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছি। এমনকি ১৯৫৪ সালে আবদুন নাসেরের গোমস্তারাও আমার গৃহে অভিযান চালিয়ে সমস্ত রেকর্ডপত্র নিয়ে যায় যার মধ্যে এ ছবিটিও ছিল।
মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবি তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ কাল বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। সকল ব্যাপারেই তার দৃষ্টিভংগী আইনের চৌহদ্দীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। যে সংগঠনের পরিচালনার দায়িত্ব এমন নিয়মানুবর্তী ব্যক্তির ওপর থাকে তার কখনো কোন সন্ত্রাসী তৎপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণের সাযোগই থাকে না। আমাদের শত্রুরা আমাদের ওপর সর্বদা দোষারোপ করতেই অভ্যস্ত অথচ আমরা তার জবাবে নীরবতা অবলম্বন করাটাকেই অধিকতর সমীচীন বলে মনে করি।
বন্ধুদের সাঝে বিনম্র কিন্তু হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বে ইস্পাত কঠিন
দ্বিতীয় মুর্শিদে আ’ম ছিলেন বড় কোমল হৃদয়ের অধিকারী। আবার বাতিলের মোকাবিলায় ছিলেন অকুতোভয়। মিসরের কারাগারে আমি তাঁর সাথে একই সেলে বন্ধী ছিলাম। তৎকালীন কায়রোর গভর্ণর যার নাম এখন আর আমার মনে নেই একবার জেলখানা পরিদর্শনে আগমন করেন। গভর্ণরের আগে আগে সামরিক জোয়াণ চলছিলো। সে প্রতি সেলের সামনে গিয়ে সজোরে পা মাটির ওপর মারতো এবং ফৌজি কায়দায় নিদের্শ জারী করতো। সে আমাদের সেলের সম্মুখে পৌঁছলে জেলখানার নিয়মানুযায়ী আমি উঠি দাঁড়ালাম। মুর্শিদে আ’ম (র) অবিচলভাবে স্বস্থানে বসে রইলেন এমনকি বিন্দুমাত্র নড়াচড়াও করলেন না। ভাবখানা যেন কিছুই হয়নি। ফলে গভর্ণর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তিনি তাঁকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, “যদি তোমরা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে তাহলে আল্লাহ আমাদের মোকাবিলায় তোমাদের সাহায্য করতো।” তিনি সম্পূর্ণ অনমনীয়ভাবে স্বীয় আসনে উপবিষ্ট থেকে অত্যন্ত প্রশান্ত বদনে জবাব দিলেনঃ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিমদের সন্দেহের অবকাশ নেই। অথচ তাঁর সত্যের পথের দিশারী হওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আমাদের ও তোমাদের বর্তমান অবস্থাকে ভিত্তি করে হক ও বাতিলের ফায়সালা করা একেবারেই অর্থহীন।
গভর্ণর তার এ জবাব শুনে নীরবে চলে গেলেন। তার চলে যাওয়ার পর মুর্শিদে আ’ম আমাকে তিরস্কার করেন এবং বলেনঃ “তুমি দাঁড়িয়ে গেলে কেন? তোমার জানা থাকা উচিত যে, জালিমের জন্য তার মিথ্যার ঔদ্ধত্যের পরাজয় অপমানবোধের কার্যকর উপায়। অত্যাচারী যখন দেখতে পায় যে, জনগণ তার ভায়ে ভীত সন্ত্রস্ত এবং তার সামনে করজোড়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে তখন তার দুর্বিনীত প্রবৃত্তি আরো ঔদ্ধত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু যখনই সে উপলব্ধি করতে পারে যে, জনসাধারণ তাকে কোন গুরুত্বই দেয় না- তখন তার আমিত্বের তাজমহল ধড়াস করে সাটিতে পড়ে যায়। আর সে অংগারের ওপর গড়াগড়ি খেতে থাকে। তার এই কর্মনীতিতে হকপন্থীদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে।
ফেরাউনকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিলো, “কোন জিনিস তোমাকে ফেরাউনিয়াত পর্যন্ত এনে পৌঁছিয়েছে?” ফেরাউন জবাব দিয়েছিলো, “কেউ আমার কোন কথা অমান্য করতে পারতো না তাই আমি ফেরাউনে পরিণত হয়েছি।” জালিমের মধ্যে কোন উত্তম স্বভাব এবং নৈতিক গুণাবলী থাকে না। যে মানুষ তার সম্মান করবে সে তার বস্তুগত শক্তি এবং বাহ্যিক শান-শওকত দ্বারা মানুষের ওপর মিথ্যা প্রভাব সৃষ্টি করে। যখনই সে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় তখনই গাধার ন্যায় অপমাণিত ও বাইরের কোন বিষয়ের মুখাপেক্ষী হয় না। সে হাতিয়ার ছাড়াই নিজ ঈমানী শক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধের কারণে বলীয়ান হয়ে ওঠে। সে বড় থেকে বড় তাগুত এবং অত্যাচারী বাদশাহর সম্মুখেও কারেমায়ে হক বলতে সংম্কচ বোধ করে না। বস্তুত যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে তার সামনে কারো কোন গুরুত্বই নেই যাকে সমীহ করে চলা যেতে পারে।
জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্তমূলক ও শিক্ষাপ্রদ কাহিনী বর্ণনা করা হয়ে থাকে। তার ওপর কোন এক অত্যাচারী শাসক অত্যাচার চালা্য়। অনন্তর সে জালিম মজলুম ব্যক্তিকে বলে, “আমি এবার তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম- এখন তোমার যা ইচ্ছা আমার কাছে চাও।” নিগৃহীত ব্যক্তি স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠলো, “আমাকে অমর জীবন দান কর।” জালিম লোকটি বলে উঠলো, “এ তো আমার ক্ষমতা বহির্ভূত।” মজলুম বললো, “আচ্ছা এটা যদি তুমি করতে না পারো তাহলে আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দাও।” জালিম উত্তর দিলো, “একাজও তো কেবল আল্লাহ তায়ালার। তিনি ইচ্ছা করলে কাউকে জান্নাতে দাখিল করাতে পারেন।” অতপর মজলুম ব্যক্তি তৎক্ষাণাৎ বললো, “তোমার ইখতিয়ারে দুনিয়াও নেই আখেরাতও নেই। তাহলে তুমি কোন ভরসায় আমাকে উৎসাহিত করতে পারলে যে চাও কি তোমার পেতে ইচ্ছা করে।” ওগো জালিমদের ভয়ে অস্থির ব্যক্তিগণ! এটা কি নির্মম সত্য ও বাস্তবতা নয় যে, জালিম নিজেই কত দুর্বল, অক্ষম ও অসহায়। তারপরও আবার তাকে ভয় করে ও সমীহ করে চলার কি অর্থ থাকতে পারে।
সৎলোকদের সাহেচর্যর প্রভাব
হাসানুল বান্না এবং হাসান আল হুদাইবি যুগপৎভাবে কোন ব্যক্তির ওপর তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া আদৌ পছন্দ করতেন না। যেসব লোক সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো দুই মর্শিদের কেউই তাদের সম্পর্কে কখনো কোন কঠোর আচরণ ও নির্দয় ব্যবহারের নীতি অবলম্বন করেননি। উস্তাদ হাসানুল বান্না (র) একবার আল বুহাইরা প্রদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এক জায়গায় জনৈক প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি তার মেহমানদারী করেন্। মেজবান উতিপূর্বে কখনো মুর্শিদ আ’ম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানার সুযোগ পাননি। তিনি শুধু একজন সম্মানিত মেহমান মনে করেই তাঁর অবস্থান করার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন্ কিন্তু তিনি যখন তার কথাবর্তা শুনলেন কখন বলতে লাগলেন, “আপনি যা বর্ণনা করলেন তাতে আমি অত্যন্ত প্রভাবিত ও বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছি। অবশ্য আমি কিছু কিছু ভাল কাজও করে থাকি, যেমন মিছকিনদের পৃষ্ঠপোষকতা, গরীব ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য সহযোগিতা এবং সালাত ও সওমের নিয়মানুবর্তিতা। কিন্তু তার সাথে সাথে আমার মধ্যে একটা গুনাহের কুঅভ্যাসও আছে। আমার মনে হয় যেন আমি এ গুনাহের কাজ পরিত্যাগ করতে পরবো না।”
মুর্শিদে আ’ম জিজ্ঞেস করলেন, “এটা এমনি কি গুনাহ যা আপনি ছেড়ে দিতে পারবেন না?” আমীর ব্যক্তি জবাব দিলেন, “আমি মাঝে মধ্যে মদ্য পান করে থাকি। আর এ বদ অভ্যাসই আমার সংগঠনে যোগদান পথে অন্তরায় হয়ে আছে।” কোন মানুষ ধারণাও করতে পারে না যে, এই পরিস্থিতিতে ইমাম সে মদ্যপ ব্যক্তিকে কি জবাব দিয়েছিলেন। বাস্তবিকই তার উত্তর ছিল অনন্য ও অসাধারণ! কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই প্রতীয়মান হবে যে, এ জবাব ছিল একেবারেই সময়োপযোগী সমীচীন। ইমাম শহীদ বললেন, “আমাদের সাথে শামিল হয়ে যাও আমরা এ অবস্থায়ই তোমাকে বরণ করে নেবো।” সে ব্যক্তি বিস্মিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
ইমামের এ ইরশাদের অর্থ আবার এও নয় যে, তিনি মানুষের মদ্য পানাভ্যাসকে জায়েজ বলে মনে করতেন। কখ্খনো নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল তার দূরদর্শিতার পরিচায়ক। যদি সে ব্যক্তিকে ঐ অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া হতো তাহলে সে হয়তো আর কখনো শরাবখুরী ছেড়ে দিতে পারতো না। অপরদিকে যদি তাকে সাংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া যেতো এবং তাকে মুসলিমদের সাথে একই মোতির মালায় গ্রথিত করে দেয়া হতো তাহলে তাদের সাহচর্য্যর প্রভাবে তার মদ্যপান অভ্যাস পরিত্যাগের সম্ভাবনাই ছিল বেশী।
কার্যত ইখওয়ানের সাথে যোগদানের পর সে ব্যক্তির সান্নিধ্যের প্রবল প্রভাব পড়ে এবং সে উম্মুল খাবায়েস থেকে পরিপূর্ণ রূপে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন। গুনাহগারদের সংশোধনের পন্থা, পদ্ধতির মধ্যে এটাও একটা যে, তাদের ধিক্কার দেয়া ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার পরিবর্তে নিজের কাছে টেনে নিতে হবে। চলাতে হবে তাদের সংশোধনের সযত্ন প্রয়াস।
আমাদের আন্দোলনের জীবন অনুরূপ বেশ কিছু দৃষ্টান্ত আছে। আমি তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে যাচ্ছি না। এ উদাহরণ পেশ করার উদ্দেশ্য হলো সুধী পাঠকগণকে জানিয়ে দেয়া যায় যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন আত্মগর্ভ থেকে পুত-পবিত্র থাকতে রয়েছে তৎপর এবং লোকদের জন্য তাওবার দরজা তারা কখনো বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেনি। আমাদের পয়গম মানুষকে রহমাতে রব্বানীর জন্য আশাবাদী করা তাদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে দেয়া নয়। এই যাদের কর্মপদ্ধতি তারা কি কখনো সন্ত্রাস এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির পথ অবলম্ভন করতে পারে?
মরীদ থেকে মুর্শিদে আ’ম
উস্তাদ হাসানুল বান্না তাঁর সংগীদের ব্যক্তিগত বিষয়সমূহের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নিতেন এবং তাদের সাথে একান্ত সাক্ষাতের সময় ব্যক্তিগত বিষয়ও জানতে চেষ্টা করতেন। একবার তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি কি আদালতের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পাদনের প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ কর না?” প্রত্যুত্তরে আমি আরজ করলাম, আদালতের সদস্যদেরকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে থাকি এবং এ পদ আমার নিকট অত্যন্ত সম্মানজনক বলেই মনে হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বও মাননীয় জজ গও বিচারপতিগণকে বহু অন্যায় ও অবৈধ বিধি-নিষেধের শৃংখলা আবদ্ধ করে রাখা হয়। ফলে তাদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ অনেক সীসাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমি স্বভাবতই আমার নিজেকে এরূপ ধরাবাঁধা নিয়েমের বন্ধন থেকে মুক্ত রাখতে চাই যাতে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল (সা)- এর অনুমোদিত সীমানার মাঝে কোথাও আমার সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা এসে দাঁড়াতে না পারে। আমি চাই, আমার সময় কোন চাকুরীর শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে না পড়ুক। চাকুরীকে যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন সর্ববাস্থায়ই তা বাধ্যবাধকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন উকিল বা আইনজীবী হিসেবে আমার যে স্বধীনতা রয়েছে আমি তা জলাঞ্জলী দিতে পারি না। এখন আমি স্বাধীন, তাই যেভাবে ইচ্ছা আমার প্রোগ্রাম তৈরী করতে পারি।” তিনি আমার জবাব শুনে প্রশান্ত ও নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন এবং এ বিষয়ে আমাকে আর কখনো কোন প্রশ্ন করেননি।
আমি আমার দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা পোষণ করি। অনেক সময় আমি চিকিৎসা ব্যাপদেশে ইউরোপ ও আমেরিকা যাই। যদি সেখানে দীর্ঘদিন থাকতে হয় তাহলে দেশের কথা স্মরণ করে অস্থির হয়ে পড়ি। ফলে কতবার আমি ডাক্তারদের পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা অসম্পুর্ণ রেখে মিসরে এসে পড়েছি। প্রসংগক্রমে এখানে জনসাধারণের একটা আপত্তিরও জবাব দেয়া সংগত বলে মনে করছি। কেউ প্রশ্ন করে যে, এ বয়োবৃদ্ধ লোকটি না আছি কোন রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা না আছে বিষয় সম্পত্তি তারপরও কিভাবে প্রায় বিদেশ ভ্রমণের এবং চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করে থাকে? সত্য কথা হলো, আমার কাছে প্লেনের টিকেট ক্রয় করার মত টাকা পয়সাও থাকে না। কিন্তু সমগ্র দুনিয়ার কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা ইখওয়ান জোরজবরদস্তি করে আমাকে এসব দূর পাল্লার সফরের কষ্ট স্বীকার করতে বাধ্য করে। এবং আমার সফর চিকিৎসা ও থাকা খাওয়ার সমূদয় ব্যয় নিজেদের পকেট থেকেই বহন করে। দয়াময় আল্লাহ তায়ালা এসব ভ্রাতাগণকে উত্তম বিনিময় প্রদান করুন যারা শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিলাভের নিমিত্তেই আমাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকে এবং সর্বদা বিমানে আমার জন্য প্রথম শ্রেণীর টিকেটের ব্যবস্থা করে। আমি সেই সব ইখওয়ানের অনুরোধক্রমেই একদেশ থেকে অন্যদেশে গমন করে থাকি এবং সর্বত্রই আমার দ্বীনি ভাইগণ আমার সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসে। সর্বোপরি তারা আমাকে বিপুল পরিমাণ তোহফা ও উপটৌকন দ্বারাও ধন্য করে থাকেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এসব তোহফা আমার বন্ধু বান্ধব এবং সংগঠনের সাথী সংগীদের মাঝে বন্টন করে দেই। কিছু কিছু সংগী সাথী হাসি তামাশাচ্ছলে বলতে থাকে যে, পরবর্তী সফরের সুযোগ আবার কবে আসছে। বিমান বন্দরে যাতায়াতের পথে আমার সাথে যেসব আচরণ করা হয়ে থাকে তার উল্লেখ ইতিপূর্বে করে এসেছি। এসব দুঃখ কষ্টের মোকাবিলায় যখন ইখওয়ানের সাথে দেখা্ সাক্ষাত ও আলাপ আলোচনার সুযোগ লাভ করি তখন সবকিছুই তুচ্ছ বলে মনে হয়। আমি আল্লাহ তায়ালার সমীপে বিনম্র প্রার্থনা করছি যেন আমাদের এ পারস্পরিক ভালবাসা বিশেষভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের স্বার্থেই হয়। সম্ভবত এ বিবরণের দ্বারা সেসব লোক সান্ত্বনা খুঁজে পাবে যারা আমার বার বার বিদেশ ভ্রমণের কারণে চোখ কপালে তুলে থাকেন।
একটা তাজা উদ্যম একটা মহৎ ইচ্ছা
আমি যে দেশেই গিয়েছে সে দেশেই বিপুল সংখ্যক যুবককে আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে দেখেছি। এসব যুবককে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আন্তরিক প্রশান্তি লাভ করেছি এবং ইসলামী আন্দোলনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখে হৃদয়-মন ভরে উঠেছে। এর সাথে আল্লাহ তায়ালার প্রভূত সাহায্য সহযোগিতাও রয়েছে। কাজেই এর অকাল মৃত্যু হবে না। (ইনশাআল্লাহুল আযীয)
একবার আমি একটা মুসলিম রাষ্ট্রে সফরে গিয়েছিলাম। আমাদের সফরসঙ্গীগণ এক জায়গায় মস্তবড় এক হল রুমে লেকচারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। বক্তৃতার সময় হওয়ার সাথে সাথে মিলনায়তনে পর্যপ্ত প্রশস্ততা সত্ত্বেও স্থান সংকুলান না হওয়ার অভিযোগ করতে দেখা গেলো। সকল বিবেচনায়ই শ্রোতাদের মধ্যে যুবসমাজের সংখ্যাই ছিল অধিক। ব্যবস্থাপনার পক্ষ থেকে অবহিত করা হলো যে, এ হলের মধ্যেই অধিকাংশ সভা-সমাবেশ হয়ে থাকে। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক জনতার উপস্থিতি শুধু এবারই দৃষ্টিগোচর হলো। যখন ইসলামী আন্দোলনের কোন স্বনাম ধন্য ব্যক্তি ভষণ দিতে আসেন তখন এ পরিস্থিতি একথারই ইংগিত দেয় যে, ইখওয়ানের দাওয়াত এবং এর শান্তিপ্রিয় কর্মনীতি যুবসমাজকে আকৃষ্ট করতে ও তাদের মন জয় করতে সক্ষম হচ্ছে। তারা স্বভাবতই দেখতে পাচ্ছে যে, এসব বক্তৃতা বিবৃতিতে রোমাঞ্চকর ও চটকদার কোন কথা নেই। কিংবা কারো বিরুদ্ধে কাদা ছুঁড়াছুড়িও নেই। এসব বক্তা অলীক কাহিনী শুনান না বরং নিজেদের লক্ষ্যবস্তু ও নির্ধারিত বিষয়ের ওপর মার্জিত, গবেষণামূলক ও ইলমী যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে থাকেন।
আমার ঐকান্তিক বাসনা হচ্ছে, এ স্মৃতিকথা প্রকাশের সময় আন্দোলনের মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরবো। আমি যা কিছু উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছি তা কোন ব্যক্তিবিশেষের মনগড়া কথাবর্তা নয় বরং সেসব স্মৃতিকথা যা আমার জীবনোদ্দেশ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে ব্যক্তি শুধু ঘটনাপ্রবাহকে পাঠকদের সম্মুখে সাজিযে পেশ করতে চায় তার স্মৃতিচারণের ভাবভংগি আমার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হতে বাধ্য। আমার উদ্দেশ্য আন্দোলনের উপলক্ষ বানিয়ে সে আংগিকে আমার স্মৃতিমালা তুলে ধরা। এখানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ব্যক্তিত্বের পরিস্ফুটন নয় বরং জীবনোদ্দশ্যে পরিবেশনা। আমরা এ দাওয়াতের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল (সা) ও তাঁর দ্বীনের প্রতি সহব্বত পোষণ করতে শিখেছি। এ পথে আত্মত্যাগ করতে হবে এবং এরই স্বার্থে সকল প্রকার ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার কারার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তিই ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কামনা বাসনা সেই দ্বীনের অধীন না হয়। যা নিয়ে আমি আগমন করেছি।” আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, রিসালাতে মা’আব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আনীত পয়গাম কতইনা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। মানুষের অন্তরে যতদিন না প্রেম ভালবাসা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে তার দ্বারা কোন বড় কাজ সমাধা হতে পারে না। আমি খুবই আবেগ ও অনুরাগ প্রবণ মানুষ। আমার এই প্রেমপ্রীতি আল্লাহর দ্বীন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলনের সাথে একই সূত্রে গ্রথিত। আপনারা জানেন যে, একজন প্রেমিক কোন মাহফিলে হউক কিংবা কোন বিশেষ বিষয়ের ওপর ভাষণ দিতে থাকুক সকল অবস্থায়ই সে তার প্রেমিকার আলোচনা না করে থাকতে পারে না। অনুরূপ আমারও এ দুর্বলতা রয়েছে। আমি ও আমার মা’শুকার নাম উল্লেখ না করে কোন কথা বলাকেই সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ বলে মনে করতে পারি না।
যদি প্রেম-প্রীতির চূড়ান্ত স্তর পর্যন্ত ভালবাসার অনুপ্রেরণা এবং জীবনের ঝুঁকি নেয়ার মত শপথের বলিষ্ঠতা না থাকতো তাহলে আন্দোলনের স্বার্থে ইখওয়ান যে অতুলনীয় আত্মত্যাগের দৃস্টান্তস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে তা কখানো সম্ভব হতো না। গ্রেফতার ও বন্দী জীবনকে স্বাগত জানানো এবং ফাঁসির মঞ্চকে চুম্বুন করা এ প্রেমেরই চাক্ষুষ প্রমাণ যা আমাদের শিরা উপশিরায় সতত প্রবাহমান। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সম্বন্ধে বলেছেনঃ (আবরী ************) (আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন আর তারাও আল্লাহকে ভালবাসে) যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার প্রতি মহব্বত পোষণ করে সে কেবল আল্লাহর সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে। আর যে আল্লাহর সম্মা্ন সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয় তার সম্মুখে দুনিয়া এবং তার তাবৎ রূপ-সৌন্দর্য বস্তুগত উপায়-উপকরণ, বৈষয়িক শান-শওকত এবং অস্থায়ী মান-মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তির আর কোন প্রভাব ও গুরুত্ব অবিশিষ্ট থাকে না।
(আরবী************)
(শুধুমাত্র এতটুকু বলে দিন আল্লাহ অতপর তাদেরকে যুক্তিতর্কের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার জন্য ছেড়ে দিন।)
ইসলামী আন্দোলনের প্রসংগ উপেক্ষা করে আমি কিভাবে আমার স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করতে পারি? আন্দোলনের কথা যদি বাদ দিলে আর আমার নিজের আত্মজীবনী বলতে কিইবা অবশিষ্ট থাকে? কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, প্রেম কি? তদুত্তরে আমি বলবো, প্রেমই আমার জীবন এবং আমার পোশাক। আমি ভালভাবে জানি যে, আমাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা, মানুষের চক্রান্ত এবং রাজা বাদশাহদের রক্তচক্ষু থেকে একটা জিনিসই মুক্তি দিতে পারে, তাহচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসা। (আরবী ************) (তুমি কি মানুষকে ভয় করো? অথচ এ বিষয়ে আল্লাহই সর্বাধিক উপযুক্ত যে তাকেই ভয় করে চলবে।) হে মুসলিম জাতি! আল্লাহর দিকে ফিরে এসো তিনি তোমাদের হিফাজত করবেন তোমাদের শক্তিশালী করবেন। তোমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। তোমাদের সম্মুখে আগত সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে দেবেন এবং তোমাদের সকল সমস্যার সুষ্ঠ সমাধান করে দেবেন। তোমরা তার প্রতি মহব্বত পোষণ করে মনুষ্যত্বকে সমুন্নত করে তোল তবেই তিনি তার উলূহিয়াতের বরকত দ্বারা তোমাকে অধিকতর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করবেন।
তারা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল
ইখওয়ানের পূর্ববর্তী উভয় মূর্শিদে আ’মই আপনাপন সংগী সাথীদের প্রতি গভীর ভালবাসা পোষণ করতেন। সকল সুখে দুঃখে তারা তাদের সাথে শরীক হতেন। সুদিনে মোবারকবাদ জানাতেন উপহার উপঢৌকন পাঠাতেন এবং নিজেই এ উপলক্ষে তাদের বাড়ীতে তাশরীফ নিয়ে যেতেন। একান্তই যদি নিজে যেতে না পারতেন তাহলে কোন প্রতিনিধিকে পাঠিয়ে দিতেন। অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে ভাইয়ের দুঃখ বেদনার ভাগ নেয়ার জন্য তাদের পাশে গিয়ে হাজির হতেন। তাদের এ আচরণ আমীর-গরীব, বিত্তবান ও বিত্তহীন সকলের ক্ষেত্রেই সমান হতো। কারো ওপর কারো কোন পার্থক্য বা শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না। তারা তাদের নিত্য দিনের নির্ধারিত দায়িত্ব কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সাথে সাথে এসব কাজ-কর্মের প্রতিও খুবই গুরুত্ব দিতেন। এই দুই অনুপম ব্যক্তিত্বই নেতাদের জন্য উত্তম দৃষ্টান্তস্থাপন করে গেছেন।
ইখওয়ান তাদের উল্লেখিত দু’জন মুর্শিদের ব্যক্তিত্ব সন্বন্ধে ভালভাবেই অবগত আছে। দুই মহান নেতাই তাদের চারিত্রিক মাধর্য ও বাস্তব কর্ম-তৎপরতা দ্বারা সকল পরীক্ষায়ই কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হতে থাকেন। আমাদের যুবক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আমি এ দিশারী ও পথপ্রদর্শকদ্বয়কে নমুনা ও আদর্শ হিসেবে পেশ করছি। আল্লাহ তায়ালার শোকর যে, আন্দোলনের কর্মীগণ আজও এ ঐতিহ্যকে উত্তমরূপে অনুসরণ করে চলেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ফলাফল মূল্যায়ন করে দেখুন আপনার সম্মুখে এ বাস্তব সত্য উদঘাটিত হবে যে শীর্ষস্থান লাভকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের ওপর প্রকাশিত খবর পাঠ করে আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় হৃদয় মন ভরে ওঠে। সত্য সত্যই দ্বীনই হচ্ছে জীননের সকল ক্ষেত্রে কামিয়াবী এবং নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
পূর্ণাঙ্গ সৌন্দর্য থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রেম
ইমাম হাসানুল বান্না এ দাওয়াতের বুনিয়াদ মজবুতভাবে স্থাপন করে ছিলেন এবং এর কর্মপদ্ধতি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সাথে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছিলেন। এ রাস্তায় তিনি এমন জিহাদ করেন যতটুকু করলে জিহাদের হক আদায় হয়। এভাবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি শাহাদাতের অমীয় ধারা পান করে স্বীয় রবের নিকট পৌঁছে যান্। তার অবর্তমানে শাইখ হাসান আল হুদাইবী নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব বহন করেন। তখন তার বয়স ছিল ষাট বছরেরও অধিক।স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এটা ছিল তাঁর ঈমান এবং এ জীবনলক্ষের প্রতি প্রবল। অনুরাগেরই পরিচায়ক। যা তাকে এরূপ ভারী পাথর উত্তোলনের জন্য অনু্প্রাণীত করেছিল্। মিসরে অধিকাংশ বিচারপতিই অবসব গ্রহণের পর প্রাইভেট প্রাকটিসের পেশা অবলম্বন করে থাকেন্। এমনি করে তারা মজলুম ও অত্যাচারীতদের সাহায্য সহযোগিতা করেন এবং জনসাধারণকে তাদের অধিকার আদায় করে দিয়ে জীবিকা অর্জনের উপকরণ যোগাড় করেন। হাসান আল হুদাইবির সহকর্মীরা রিটায়্যারমেন্টে যাওয়ার পর প্রকটিস করতে শুরু করেন। অথচ তিনি নিজেকে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের জন্য কোন প্রকার বিনিময় ছাড়াই পেশ করেন। তিনি কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি শুধু তাই নয় বরং এ পথে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিপদ-মুসিবতকেও হাসি মুখে বরণ করে নেন। এটা মহান সত্তার প্রতি অকৃত্রিম প্রেম-ভালবাসারই প্রমান যিনি অনাদি অনন্ত এবং প্রকাশ্য ও গোপন সর্বাবস্থায়ই সমান ক্ষমতার অধিকারী। কত শিক্ষক, আইনজীবি ও বিচারপতিইতো এ ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। আজ পৃথিবী তাদের নামও জানে না ইতিহাসের পৃষ্ঠায়ও তাদের উল্লেখ নেই। কিন্তু একজন শিক্ষক হাসানুল বান্না এবং একজন আইনজীবি ও বিচারপতি হাসান আল হুদাইবির নাম আজও দীপ্তিতে ভাস্বর। বস্তুত পৃথিবীর সকল বস্তুই ধ্বংসশীল। কিন্তু একমাত্র সংগ্রাম-সাধনা এবং এর প্রতি আহবান করার চিত্রই স্থায়ী হয়ে থাকে। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে একত্রিত হওয়া তার দ্বীনকে মজবুতভাবে ধারণ করা। তার প্রতিরক্ষার জন্য বুক টান করে দাঁড়ানো এবং সুখে দুঃখে সকল অবস্থায়ই তার সাথে অটল অবিচল থাকাই চিরস্থায়ী আমল।
সকল জেলখানাতেই একজন করে দারোগা থাকে। যাকে সহযোগিতা করে থাকে নিরাপত্তা কর্মচারী ও সিপাহীরা। প্রত্যেক কয়েদখানায়েই একজন ডাক্তার থাকে যার তত্বাবধানে থাকে নার্স এবং অন্যান্য কর্মাচারী। রাজবন্দীদেরকে জেলখানাতে বিশেষভাবে নির্যাতন করা হয় এবং জেলখানার দারোগারা স্পেশাল ফরমান জারী করে থাকেনে যেন এই শ্রেণীর বন্দীদেরকে নির্যাতনের বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। তারপর আবার জারীকৃত এসব আদেশের বাস্তবায়ন রিপোর্টও গ্রহণ করা হয়। এ অত্যাচার-নির্যাতনের বিশেষ লক্ষ্য করুন যে, জেলখানার কোন সত্ত্বেও কয়েদীদের সাথে সৌহার্দাপূর্ণ ও সহৃদয় আচরণ করতো। তারা কেবল নিজের পক্ষ থেকে তাদেরকে আরাম পৌঁছানোর চেষ্টা করতো না বরং কয়েদীদের পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছে তাদের খবরাখবরও আদান প্রদান করতো। এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, নির্যাতনের মেয়াদ দীর্ঘাস্থয়ী হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তারপরও এসব ন্যায়পরায়ণ কর্মকর্তাদের আচরণ দেখে নিশ্চিতরূপে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন তখন জালিমদের প্রবল আকাংখা সত্ত্বেও তিনি মজুলমদের জন্য সবকিছু সহজ ও সুগম করে দেন।