প্রথম অধ্যায়
আমার পরিচয়
আমি একজন মুসলমান এবং মিসরের নাগরিক জীবনের আশিটি বসন্ত অতিক্রম করতে যাচ্ছি। ১৯০৪ সালে ৪ঠা নভেম্বর কায়রোর গৌরিয়া অঞ্চলের খোশ কদম নামক পল্লীতে আমার জন্ম। এটা একটা প্রাচীন মহল্লা। প্রাচীনতার প্রতিটি সংজ্ঞাই এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পুরাতন ধাঁচের দালান কোঠা, রাস্তঘাট ও অলি গলিও চাপা ও অন্ধকার। কামরাগুলো খুবই প্রশস্ত ও খোলামেলা কিন্তু নীরব ও কোলাহল মুক্ত। গোসলখানায় ব্যবহার্য পানি বাইরে থেকেই গরম করে নিতে হতো। সেকালের ওয়াটার হিটারগুলো বর্তমান কালের বৈদ্যুতিক ওয়াটার হিটার সমূহের সাথে সাদৃশ্য পূর্ণ ছিল। হাম্মামের বাইরে ছোট একটা কামরা থাকতো যাতে গোসল সমাপনকারী ফ্লাটে যাওয়ার অব্যাহত পূর্বে সেখানে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারে। ঘরগুলোর প্রশস্ততার অনুমান এ থেকে করে নেয়া যেতে, পারে, একটা ফ্লাট কমপক্ষে আটশত বর্গমিটার আয়াতন সম্পন্ন হতো। গৃহের আঙিনা ও ছাদসহ প্রায় আটটি হাম্মাম ও টয়লেট থাকতো। কোন কোনটিতে মর্মর পাথরের টালি লাগিয়ে তার শোভা বর্ধন করা হতো আবার কোনগুলোতে সিমেন্টের সাধারণ তৈরী টালি লাগিয়ে নেয়া হতো।
শহর থেকে গ্রাম
এরূপ গৃহেই আমার জীবনের প্রথম তিন বছর অতিক্রান্ত হয়। তারপর আমাদের পরিবার অর্থাৎ আমার পিতা, পিতামহ এবং পরিবারের অন্যান্য সকল সদস্য এই বাড়ী পরিত্যাগ করে খামারে চলে যায়। শাবীনুল কানাতির কেন্দ্রের নাওয়া নামক গ্রামে ছিল এই খামারের অবস্থান। বর্তমান কালিউবিয়া প্রদেশের তৎকালীন নাম ছিল কমিশনারী। এই গ্রাম ছিল এরই অর্ন্তগত। কায়রো থেকে এই পল্লির দূরত্ব ছিল বাইশ কিলোমিটার। এই গ্রামেই ছিল রেলওয়ে ষ্টেশন, যেখানে গাড়ীগুলো এসে থামতো। তখনকার দিনে তৃতীয় শ্রেণী থেকে প্রথম শ্রেণী পযর্ন্ত সকল বগীতেই পরিষ্কার পরিচ্ছনতা ও আরাম আয়েশের বেশ ব্যবস্থা ছিল।
মাত্র চার বছর বয়স থেকেই আমি আমার পরিপার্শ্বিকতাকে গভীর উপলব্ধিসহ দেখতে শুরু করেছিলাম। যে ঘরে আমরা থাকতাম লোকজন সেটাকে ‘প্রাসাদ’ বলে অভিহিত করতো। আমার দাদা মরহুম এই মহলের দু’টি ফ্লাটে তার দুই স্ত্রীর সাথে বসবাস করতেন। আমার মরহুম পিতাও তার দুই স্ত্রীর সাথে অপর ফ্লাটে থাকতেন। আমার মাতা ও বিমাতার ফ্লাট ছিল সামনাসামনি। আমার চাচা তার একমাত্র স্ত্রীর সাথে একটা ফ্লাটে অবস্থান করতেন। তিনি তখনো পর্যন্ত আর্থিকভাবে স্বয়ম্ভব ছিলেন না।
জাঁকজকমকপুর্ণ অট্রালিকা
এই বিরাট মহলে ছিল মাত্র তিনজন চাকর ও চাকর ও চারজন চাকরানী। চাকরানী হাসিবা, বাবলা, সাঈদা ও বাখতিয়া এবং চাকর সারওয়ার, রায়হান ও তাহসীন।
তারা সকলেই ঘরের কাজকর্মে থাকতো সদা ব্যস্ত। মহলের মধ্যে মস্তবড় লংগরখানা ছিল। যেখানে বাবুর্চি ও খানসামারা খানা পাকানো ও খাওয়ানোর দায়িত্ব আঞ্জাম দিতো। মহলের মধ্যেই ঘোড়ার গাড়ী থাকতো যা চালাতো কোচম্যান, তাতে মাত্র একটা ঘোড়াই জুড়ে দেয়া হতো। মহলের পশ্চাৎদিক ঘেসে ছিল গবাদি পশুর আস্তাবল। যেখানে থাকতো বলদ, গাভী, মহিষ, উট, গাধা প্রভৃতি। একজন রাখাল ও তার একজন সহযোগী এসব গবাদি পশুর দেখাশুনা করতো।
মহলটি ছিল পাঁচ একরের সুসজ্জিত বাগান পরিবেষ্টিত। উহাতে ছিল মালটা, সিংতারা, আম, আঙ্গুর, বিভিন্ন প্রকার খেজুর, রাসবেরী, কলা, আপেল, নাশপাতি, লেবু, কমলালেবু, খুবানী, আলুচা মোদ্দাকথা তখনকার দিনের পরিচিত সব জাতের ফল। বাগানটি প্রায় সত্তর বছর ব্যাপী এই সকল ফলগাছ দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল।
অন্দর মহলে ছিল ফুলের টবের সমাহার। সেগুলোতে শোভা পেতো গোলাপ, সুসেন, একফুল ও দু’ফুল বিশিষ্ট চামেলি, লবঙ্গফুল, আতর প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার ফুল। একজন মলি এসব ফুলের বাগান দেখাশুনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।
পিতামহের জায়গীরসমুহ ও তার শাহী মেজাজ
দাদা মরহুমের জমিদারী ছিল তিন শত একর ভূ-সম্পত্তি ও কয়েকটি বাড়ী নিয়ে। তন্মধ্যে নাওয়া নামক গ্রামে ছিল একশ’ আশি একর এবং আল মুজাযির শারকিয়ায় ছিল একশ’ বিশ একর। কায়রোর বিভিন্ন মহল্লায় ছিল সাতটি বাড়ী।
দাদা মরহুমের নাম ছিল আবদুল কাদের পাশা আত তিলমেসানী। তার মেজাজ ছিল সম্পূর্ণ শাহী প্রকৃতির। তিনি মুখে যা উচ্চারণ করতেন তা পুরো হওয়া ছিল জরুরী। অন্যথা হলে ক্রোধে তিনি ফেটে পড়তেন। ফল দাঁড়াতো বেত্রাঘাত ও প্রচন্ড মারপিট।
সুলতান আবদুল হামীদ দাদা মরহুমকে পাশা উপাধিতে ভূষিত করেছেলেন। দাদা মরহুমের একটা বিশেষ অভ্যাস ছিল যে, হজ্জের পর ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভ্যবগ্রস্ত ও সহায় সম্বলহীন হাজীদেরকে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সফরের ব্যবস্থা করে দিতেন এবং যাবতীয় খরচ তিনি নিজে বহন করতেন। এতে কোনই সন্দেহ নেই যে, মরহুম ছিলেন খুবই দাতা ও দয়াদ্র হৃদয়। নাওয়া পল্লিতে প্রতি সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ শনিবারে বড় বাজার বসতো। সে দিন দাদা মরহুম বাজার থেকে গোশত ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে আনতেন এবং নৈশ ভোজে ফার্মের সমস্ত কিষাণ মজুরকে আমন্ত্রণ জানাতেন। তারা সবাই উদর পূর্তি করে খেতো। তিনি নিজেও গিয়ে ঐ সব কৃষকদের মাঝে বসে পড়তেন। তাদের সাথে খোশ গল্প জুড়ে দিতেন এবং সাথে সাথে খাদ্যও খেতে থাকতেন।
পূর্ব পুরুষের জন্মভূমি আলজিরিয়া
একথা বলতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমাদের পূর্ব পুরুষরা মুলতঃ আলজিরিয়ার তিলমেসান এলাকার অধিবাসী ছিলেন। এবং ঐ এলাকার নামানুসারে আজ পর্যন্ত আমাদের বংশ পরিচয় তিলমেসানী বলে পরিচিত। ফরাসীরা আলজিরিয়া অধিকার করলে একমাত্র তিলমেসানই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মোকাবিলা করে। সর্বশেষ তিলমেসানের পতট ঘটে। তিলমেসানের অধিবাসীগণ যে বীরত্ব ও সাহসের সাথে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তির মোকাবেলা করে আজও পর্যন্ত ফরাসীরা তা স্বীকার করে থাকে। প্যারিসের লুভার যাদুঘরে একটা বিশেষ উইং রয়েছে যাতে তিলমেসানের অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য স্বরণীয় দ্রব্য সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। এসব অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা ঐ সকল সিংহ হৃদয় মুসলমানগণ শেষ অবধি দুশমনদের মোকাবেলা করেছিল।
যে বছর তিলমেসান ফ্রান্সের অধিকারে চলে যায়। সেই বছরই অর্থা ১৮৩০ সালে আমার প্রপিতামহ স্বীয় পরিবার পরিজন সহ আলজিরিয়া থেকে হিজরত করে মিসরে এসে বসতি স্থাপন করেন এবং ব্যবসা বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি খাদ্য শস্য ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। মিসর, খার্তুম ও সিংগাপুরের মধ্যে তার কারবার পরিচালিত হতো। প্রপিতামহের ইনতিকালের পর যখন আমার পিতামহ কারবারের গুরুদায়িত্ব তার কাধে তুলে নেন তখন তিনি ব্যবসা ত্যাগ করে তার দু’টো জায়গীর এবং কায়রোর সাতটি বাড়র আমদানীর ওপর পরিতুষ্ট থাকেন। যার উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে।
মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের সাথে সম্পর্ক
দাদা মরহুম ছিলেন ইমাম মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব (র)-এর ভক্ত অনুসারীদের একজন। এই আন্দোলনের কয়েকখানা বই তিনি তাঁর নিজস্ব খরচে ছাপার ব্যবস্থা করে দেন। মুদ্রিত এসব গ্রন্থাবলীর মধ্যে কয়েকটি অদ্যাবধি সউদি আরবের লাইব্রেরীগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। দাদা নিজেও ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলেম, তিনি সর্বদা মাথায় পাগড়ী পরিধান করতেন। তার বন্ধু-বান্ধবাদের সকলেই আল-আজহারের বড় বড় আলেম ছিলেন। মরহুম শাইখ ইমামুস সাক্কা ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি এসব স্বনাম ধন্য ওলামায়ে কেরামদের প্রায়ই দাওয়াত করে নিয়ে আসতেন যাতে শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে এক আধদিনের জন্য সময় বের করে তাদেরকে তাঁর শান্তিময় কোলাহল মুক্ত ফার্মে সাদামাটা গ্রাম্য পরিবেশের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। যে রেলগাড়িতে এই আলেমগণের কায়রো থেকে মুযলিকান রেলওয়ে স্টেশনে এস পৌঁছার কথা থাকতো তা স্টেশনে এসে পৌঁছার পূর্বেই দাদা মরহুম সম্মানিত মেহমানগণকে স্বাগত জানানোর জন্য সেখানে উপস্থিত হতেন। দাদা ছিলেন সদা হাস্যোজ্জল এবং খোশ মেজাজের মানুষ। যখন সল বন্ধুই (উলামায়ে আয্হার) গাড়ী থেকে বাইরে তাশরীফ নিয়ে আতেন তখন দাদা মরহুম আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলে উঠতেন, “মাশাআল্লাহ তোমরা সকলেই দেখি তোমাদের পরিবার পরিজনের সকলকেই সাথে নিয়ে তাশরীফ এনেছো। এভাবে পরিজনদের সাথে আনতে কেউই কখনো অপারগতা প্রকাশ করতেন না” আবার কখনো বা অন্তত দু’একজন অক্ষমতা প্রকাশ করে বসতো। সাথে সাথে গোটা পরিবেশ যেন হাসি তামাশায় সুগন্ধি জাফরানের ক্ষেতে পরিণত হতো। এবং প্রত্যেকেই উল্লাসে ফেটে পড়তেন।
যখনতাঁদের সাথে নিয়ে গৃহ অভিমুখে রওয়ানা হতেন এবং চলার পথে খামারে কোন হাঁস, মুরগী অথবা মোরগ দৃষ্টি গোচর হলে চীৎকার কর বলে উঠতো: “আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করো। নিজেই নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।” স্বাগতম জানানোর পালা শেষ হলে ইল্মী আলোচনা শুরু হতো। দীর্গ সময় পর্যন্ত ভাবগম্বীর পরিবেশে আলোচনা অব্যাহত থাকতো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতামতের উপর অটল থাকতো এবং আপনাআপন অভিমতের স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতে থাকতো। কখনো কখনো জনসাধারণ এ দৃশ্য দেখে মনে করতো যে, এক্ষুণী বুঝি হাতাহাতি শুরু হয়ে যাবে। দুপুরের খানার সময় হওয়ামাত্র পরিবেশ আবার পরিচ্ছন্ন হয়ে যেতো। যুক্তি-প্রমাণের ছড়াছড়িতে ভাটা পড়তো এবং হালকা হাসি তামাশা ও চটুলতা পরিবেশ ফিরে আসতো। মনে হতো যেন এখানে কোন বিতর্কের মাহফিরই জমেনি। এসব মাহফিলে এ জাতীয় মজলিশের প্রভাবে দ্বীনি ইলমের প্রতি আমার অনুরাগ অনেক বেড়ে যায় এবং এমন সব বিষয়ে আবার জ্ঞান লাভ হয় যে সম্পর্কে আমার সমবয়সী বালকরা থাকতো সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এমন কি আমার বড় দু’সহোদরও এসব ইসলামী কথাবার্তার ব্যাপারে ছিল একেবারেই উদাসীন। অবশ্য এটা ছিল আমার কিশোর বয়সের কথা।
শিক্ষা জীবনের সূচনা
যখন আমি গ্রামের বিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু করি তখন ঐ বিদ্যালয়ে গ্রামেরই দু’জন আলেম মরহুম শাইখ আবদুল আযীয আল-কালমাভী এবঙ মরহুম শাইখ আহমদ আল-রিফায়ী-এর নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করি। বিদ্যালয়ের নাম ছিল “মাদ্রাসা সাইয়েদী আলী।”
আমি কুরআন মজীদ হেফয করার জন্য নিয়মিত পরিশ্রম করতে লাগলাম। জ্ঞানের জন্য জ্ঞানের প্রতি আমার ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল। বিশেষ করে দ্বীনি ইলমের প্রতি আমি গ্রামেই বেড়ে উঠেছি এবং গ্রামীন পরিবেশ ও কৃষক মজুরদের সাদামাঠা জীবনকে আমি অতিমাত্রায় ভালবাসতাম। একবার আমি নদীর পানিতে গোসলকরি এবং সে কারণে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। ফলে আমাকে খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তার নিদারুণ কষ্ট আজ পর্যন্তও আমি অনুভব করি। আমি নদীদে সাতার কাটতাম। যদিও বর্তমানে সাতহারে নিয়ম কানুন ও রহস্য ভুলে গিয়েছি। গম কাটার মওসুমে আমি ষাড়গুলোর পশ্চাতে আটি বাঁধা বোঝার ওপর বসে যেতাম। গমের স্তুপ এবং তীক্ষ্ম শীষের ওপরও কখনো কখনো শুয়ে পড়তাম। কখনো আবার ঘোড়ার নাংগা পিছে উঠে বসতাম এবং খামারের পার্শ্ববর্তী বালুকাময় জমিনের ওপর তার লাগাম ঢিলা করে দিয়ে খুব দৌড়াতাম।
কল্পনার জগতে বিচরণ
গ্রামের প্রতিটি জিনিসের সাথে ছিল আমার নিবিড় সম্পর্ক। গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি, সহজ-সরল জীবন ধারা, রাতের নিঃসংগ জীবনে আমি আপন মনে আমার কল্পনার সাগরে সাতার কেটে বেড়াতাম। এই পরিবেশের প্রতি কেন আমার এত গাড় অনুরাগ ছিল এবং এর শুরু ও শেষ কোথায় তা আমার জানা ছিল না। এর প্রতি আমার এত অকৃত্রিম প্রেম-ভালবাসা কেন ছিল? সেই অজনা জিনিস কি ছিল যার প্রেমের ডোরে আমি বাঁধা পড়েছিলাম। এমন স্বাধীন চিন্তাধারা যার কোন কূল কিনারা ছিল না- কেন ছিল? ছিলই বা কিভাবে? এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তরই আমার জানা ছিল না। তা সত্ত্বেও ঐ মুহূর্তগুলো খুবই আনন্দের অত্যন্ত উপভোগের। আমি কার প্রেমিক ছিলাম এবং কেন? তা আমি কখনো জানতে পারিনি। ;আমি কি কোন কল্পনা প্রবণ লোক ছিলাম? আমার মধ্যে কি কোন কুসংস্কার দানা বেঁধেছিলো? আমার মধ্যে কি কোন মানসিক ব্যাধি বাসা বেঁধেছিলো? প্রকৃতপক্ষে আমি কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারতাম না। সেই সময় আমার মনে হতো পর-পাখা ছাড়াই আমি মহাশূন্যের গভীরে উড়ে বেড়াতে পার। কোন লক্ষ্য স্থির না করেই আমি উড়ে বেড়াই এরূপ আকাংখাই দুর্দমনীয়ভাবে আমাকে তাড়া করে ফিরতো।
আমি উড্ডয়নের ঐকান্তিক আকাংখা পোষণ করতাম। আমার কল্পনার পাখা আমাকে উড়িয়ে কোথায় নিয়ে যাবে? আমার মনজিল কোথায়? ভূ-পৃষ্ঠ থেকে কতদূর উড়ে যাবো? আমার মনের কোণে এসব প্রশ্ন কখনো উঁকি মারতো না। আমার ছিল শুধু উড্ডয়নের প্রবল নেশা। এই উদগ্র কামনা ও দুর্নিবার আকাংখা স্বপনেও আমাকে উড্ডয়নের অনুশীলন করাতো। হয়তো বা এই শখ আজও আমার মনের মনিকোঠায় জাগরুক। এখন এটা আমার অত্যন্ত বিস্ময়কর সৌভাগ্য যে, আমার দাওয়াতী পরিভ্রমণ সুদূর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার শতশত ফ্লাইটে পরিব্যাপ্ত। অবিশ্রান্তভাবে আমি সুউচ্চ আকাশে এই দীর্গ সফল পরিক্রমমা সম্পন্ন করে চলছি। অনেক সময় এমনও হয় যে, একটা ফ্লাইট থেকে নেমেই অপর ফ্লাইট ধরতে হয় এবং এক বিমান থেকে অবতরণ করেই আরেকটি বিমানে আরোহণ করি। এই সফরসূচী থাকে ক্রমাগতভাবে; বয়সের আধিক্য এবং অসংখ্য রোগ ব্যাধি সত্ত্বেও। এই দুর্বল শরীরকে যুগের উত্থান পতন এবং ঝড়ো হাওয়ার প্রচণ্ড প্রতিকূলতা প্রবলভাবে তাড়া করেছে তথাপি সফর অব্রাহত রয়েছে আজও। আজও আমার ঐকান্তিক আকাংখা এই যে, আমি গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশে গিয়ে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো কাটিয়ে দেই। পল্লীল নিঝুম-নিস্তব্ধ রজনী, রাতভর আলোকিত হয়ে উঠা ও নিভে যাওয়া তারার খেলা, খুব ভোরে মোরগের ডাক, অতি প্রত্যুষে পাখির কল-কাকলী, সর্বপ্রথম একটা পাখির কেক আওয়াজ তারপর সেই সুমিষ্ট সুর শুনে অন্যদের জেগে উঠা। অতপর একযোগে আল্লাহর প্রশংসা গীতি, মহান সৃষ্টিকর্তার ইবাদাত ও স্তুতির এই ঈমান জাগানো দৃশ্য। পাখিদের তাওহীদী গান- সেই প্রকৃতি সৃষ্টিকর্তার তাওহীদ- যিনি সকাল বেলা তাদেরকে খালি পেটে বাসা থেকে বের করে দেন আর সন্ধ্যায় সকলেই ভরা পেটে ফিরে আসে। মানুষ যদি পাখিদের নিকট থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করতো তা হলে আমাদের এই দুনিয়া শান্তি ও নিরাপত্তার আবাসে পরিণত হতো। যেহেতু বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক জিনিসকে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে ও বিচক্ষণতা সাথে সৃষ্টি করেছেন। তাই পাখিদের সৃষ্টি নৈপুণ্য ও গঠন প্রকৃতিতেই আনুগত্য রয়েছে। মানুষকে তিনি চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। আমরা আমাদের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না যে, কেন তিনি এরূপ করেছেন? আর এখানেই তাঁর অসীম কুদরাত ও অপার হিকমতের সার্থক পরিচয়। এর পশ্চাতে লুক্কায়িত নিগূঢ় রহস্য তিনিই জানেন। আমরা মানুষ। আমাদের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতারকে বুঝে শুনে কাজে লাগাত হবে। যে আদেশ তিনি দিয়েছেন বিনা বাক্য ব্যয়ে ও সম্পূর্ণ শর্তহীনভাবেতা মেনে নিতে হবে। এবং যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আমি আবেগ অনুরাগে ভরা একজন সাধারণ মানুষ। শিল্পকলাকে ভালবাসি এবং মানব জীবনের বিভিন্ন দিকে ও বিভাগে পুরোপুরি উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অংশ গ্রহণ করে থাকি। আমি আমার সীমিত যোগ্যতা শক্তি ও সামর্থ বুদ্ধিমত্তা, বিবেক ও বিচক্ষণতা দ্বারা আমার রবের অতুলনীয় হিকমতের রহস্য যৎ সামান্য উপলব্ধি করার প্রয়াস পেয়েছি মাত্র।
সহজাত প্রবণতা
স্বভাব ও প্রকৃতিগতভাবে তর্ক-বিতর্ক ও বিবাদে বিসষ্বাদের প্রতি আমার কোন প্রবণতা ছিল না। আলোচনা পর্যালোচনা যখন বাকযুদ্ধ ও জিদের পর্যায়ে উপনীত হয় তখন আমি ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও তর্ক-বিতর্কের ময়দান থেকে আত্মরক্ষা করে সযত্নে কেটে পড়তাম। প্রত্যেক বিষয়েই আমি সৌন্দর্য প্রিয় বলে সকলের নিকট পরিচিত। মানুষের সৃষ্টি কৌশলই সৌন্দর্যের বিরাট নিদর্শন। পাখিদের আকৃতি ও প্রকৃতি এবং কারুকার্য খচিত পাখা ও পালক, হরিণের ক্ষিপ্রতা, তার পায়েল গোছার মাধুর্য ও কমনীয়তা, হাতীর বিশালায়তন শরীর এবং তার ধৈর্য, বাঘ ও নেকড়ের চোখের তীব্র চাহনী, পানির স্রোত ও তার কুলু কুলু ধ্বনি, পাতার মর্মর শব্দ, রেলগাড়ীর গতি এবং এই অনুভূতি যে রেল নয় বরং পৃথিবী তার পৃষ্ঠের সব কিছু নিয়ে তীব্র গতিতে পশ্চাৎ দিকে চুটে যাচ্ছে মনে হয় প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে যে নিজস্ব সৌন্দর্য বিরাজমান সেই শোভা ও সৌন্দর্যের প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ।
আমি পৃথিবীতে খুবই সাবধান ও সতর্ক জীবন যাপন করার প্রয়াস পেয়েছি। আপনারা আমাকে দেখতে পান যে, আমি সালাত ও সিয়ামের খুবই নিয়মাবর্তী। বাল্যকালেই কুরআনস মজীদ হিফয করার কাজ শুরু করেছিলাম। কিছু কিছু হাদীস ও দ্বীনি বই পুস্তক জীবনের প্রারম্ভিক স্তরেই পড়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু এসব সত্ত্বেও শৌর্য-বীর্য ও নির্ভীকতা এবং প্রেম-প্রীতি ও মহব্বত ভালবাসার কাহিনীর প্রতিও আমার আকর্ষণ ছিল প্রবল। তাই আমি প্রথম প্রথম যেসব বই পুস্তক পড়তাম তার মধ্যে আবু যায়েদ আল-হিলালী সালামাহ রচিত বইও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আনতারা বিন শাদ্দাত ও সাঈফ বিন যি নিরানের জীবন কাহিনীও আমি অদ্যয়ন করেছি। অতপর ইসকান্দার দিমাছ বিরচিত সমস্ত গল্প কথা ও কল্পকাহিনী আমি পড়ে শেষ করেছি। ইসকান্দার দিমাছ ও তার পুত্রের শৌর্য-বীর্ঘ ও বীরত্ব গাথা খোশ গল্প দ্বারা বেশ প্রভাবিতও হয়েছি। এসব কাহিনীর মধ্যে নায়কের বীরত্ব এবং তার প্রেমিকার নিরাপত্তা বিধান রক্ষা কল্পে বিস্ময়কর ঘটনা প্রবাহ অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী মনে হতো। ছুটিকালীন সময় আমার গোটা সময়েই এ ধরনের বই পুস্তক পড়ে কাটতো। আমি গভীর মনোনিবেশ সহকারে এসব বই পুস্তক পড়তাম আর মনে মনে ভাবতাম যে, অনুরূপ কোন ব্যক্তিত্ব অর্জনের জন্যই আত্মনিয়োগ করি কিন্তু তাতে আমি সফলকাম হতে পারিনি।
কাব্য ও কবিত্ব এবং সাহিত্য ও সংগীত
আমি নৈরাজ্যবাদী সাহিত্য সেবীদের সাহিত্যও পড়া শোনা করেছি। মানফালুতির প্রায় সব ক’টি গ্রন্থই আমি পড়েছি। কতিপয় বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক কাহিনী পাঠ করে আমি মর্মভেদী কান্নায় ভেংগে পড়েছি। সাহিত্যের প্রতি এত অনুরাগ ও আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও আমি নিজে কিন্তু সাহিত্যিক হতে পারিনি। বছরের পর বছর আমি বাঁশী বাজিয়েছি কিন্তু বংশীবাদক হতে পারিনি। কবিতা চর্চার শখও আমার মধ্যে দানা বেঁধেছে এবং এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট মাথাও ঘামিয়েছি। নিজে কবিতা লিখেছি এবং শীর্ষস্থানীয় কবিদের সামনে তা উপস্থাপন করেছি। তারা আমার কবিতা পড়ে সবসময় আমাকে এই মন্তব্যই শুনাতেন যে, আমি যা কিছু লিখছি তা ছন্দময় বাক্য বিশেষ অবশ্যই কিন্তু তাকে কবিতা বলে অপবাদ দেয়া যায় না। সর্বশেষ যে কবিতা আমি লিখেছিলাম তা ছিল নিম্নরূপ। আপনি নিজেও পড়ুন এবং আমার জন্য দুঃখ ও করুণা প্রকাশ করুন।
(আরবী**************)
“আমি নিবেদিত করে দিয়েছি ওহীর জ্ঞানের নিমিত্তে আমার কাব্য প্রতিভাকে।
যার জন্য ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে পাখির সকল কল কাকলি।”
এই কবিতা দেখে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন যে, তা কবিতা না কবিতার বিকৃতি। তাই আমি এখানেই ক্ষান্ত হলাম এবং কবিত্বকে চিরবিদায় জানালাম। শিল্পকলার যেসব বিষয়ে আমি প্রচেষ্টা চালিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি সেসব ক্ষেত্র থেকে আল্লাহ কেন আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন তা তিনিই ভাল জানেন। এটা ছিল তার সূক্ষ্ম কৌশল যে সেইসব ক্ষেত্রের কোনটাতেই আমি সফলতার মুখ দেখতে পারিনি। আমার এসব প্রচেষ্টা শিল্প কলার সাথে নিষ্ঠুর তামাশা বৈ আর কিছুই ছিল না।
দ্বীনি জ্ঞান চর্চার দিকে প্রত্যাবর্তন
আমি পুনরায় দ্বীনি ইলমের চর্চায় মনোনিবেশ করলাম। এবারে আমি তাফসীরে যামাখশারী, তাফসীরে ইবনে কাসীর ও তাফসীরে কুরতুবী পড়ে ফেলাম। তা ছাড়া সিরাতে ইবনে হিশাম এবং সীরাতের ওপর লিখিত অন্যান্য বইও অধ্যয়ন করলাম। উসুদুল গাবা, তাবাকাতে কুবরা, নাহজুল বালাগা, আল-আমলী আল-ইফদুল ফরীদ (ইবনে সাইয়েদিহি), বুখারী ও মুসলিম ইত্যাদি বহু বিশালায়তন গ্রন্থ পাঠের সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। তা সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই যে, আমি যা পড়েছি তা সাগরের এক বিন্দু পানির সমান যা মামুলী তৃষ্ণা নিবারণের জন্যেও যথেষ্ট নয়।
এসব চেষ্টা-সাধনা দ্বারা আমি এই একটা শিক্ষাই লাভ করেছি যে, আমি মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সুযোগ পেয়েছি। তাই আমি কখনো আমার কথা বা কলম দ্বারা কোন মানুষের মর্মে আঘাত করার চেষ্টা করিনি। এমনকি যেসব লোক আমার ওপর আক্রমণ করেছে এবং আমার সাথে মতবিরোধের কারণে আমার বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করেছে তাদের ওপর কখনো প্রতি আক্রমণের চিন্তা করিনি।
আল্লাহর সন্তুষ্টি
যেহেতু আমি আমার নিজের মতামত ও ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সেহেতু অন্যদের অভিমত ও ব্যক্তিত্বের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। আমি যা কিছু লিখি তা অত্যন্ত দায়িত্বানুভূতির সাথে এবং গভীর চিন্তা-ভাবনা করে লিখি। তাই স্বীয় সিদ্ধান্তের ওপর অটল ও অবিচল হয়ে থাকতে চাই। এজন্য অনেক সময় আমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয় এবং আজও পর্যন্ত সহ্য করে যাচ্ছি। আমি শৃংখল বন্দীত্ব এবং কষ্ট-মুসিবতের বহু মনজিলের মুখোমুশি হয়েছি। তবুও সত্য পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই আমার এই ভূীমকা। হককথা বলাই আমার আকীদা ও ঈমানের দাবী। আমার প্রতিটি ধমনি ও শিরা উপশিরায় রক্তের মতই তা প্রবাহমান। এমন এক পরিবারে আমি সর্বপ্রথম চোখ মেলেছি যেখানে পরিবারের প্রতিটি সদস্য ছিল নিয়মিত নামায-রোযার পাবন্দ; নারী, পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবাই ছিল দ্বীনের অনুসারী। আমার মনে পড়ে না আমি কখন (কত বছর বয়সে) থেকে সিয়ামের অনুশীলন করতে এবং কখন সালাত আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। যা হোক এতটুকু অবশ্যই স্মরণ করতে পারি যে, যখনই আমার মধ্যে অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে এবং বিচার-বিবেচনার উন্মেষ ঘটেছে তখন থেকেই আমি নিজেকে সালাত ও সওমে অভ্যস্ত দেখতে পেয়েছি। গোটা জীবনে আমার এমন কোন সময়ের কথা মনে পড়ে না যখন আমি ফরয পরিত্যাগ করেছি।
সিনেমা দেখা
আপনি বিস্মিত হবেন এই জেনি যে, যখন আমি কর্মজীবনে প্রবেশ করে ওকালতীর পেশা গ্রহণ করি তখন শুক্রবার দিন (সাপ্তাহিক ছুটি থাকতো) যোহরের পর আমি ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে চলে যেতাম কিন্তু সেখানেও সালাত আদায়ের ব্যাপারে কোন প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন করতাম না। বিরতির সময় সিনেমা ভবনেরই এক পার্শ্বে গিয়ে সালাতুল আসর ও মাগরিব আদায় করে নিতাম। সেই যুগে আমি দেখতাম কিছু লোক মজলিসে বসতো এবং ছবি দেখতে যাওয়ার সময় হলে উপস্থিত লোকদের বলতো যে, মেহেরবানী করে আপনার একটু বসুন। আমাকে অনুমতি দিন বাইরে একটি জরুরী কাজের জন্য আমাকে যেতে হচ্ছে। কিন্তু আমার অবস্থা ছিল এই যে, আমি অকপটে নিঃসংকোচে বন্ধুদের বলতাম যে, আমি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। অনেক সময় কোন কোন বন্ধু একথা শুনে বিস্মিত হতো এবং চোখ কপালে তুলে নিতো আবার কখনো কখনো বিরক্তি এবং উম্মাও প্রকাশ করতো (এই জন্য যে, আমি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি) কিন্তু আমি সর্বদা একই জবাব দিতাম “আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, আমি কোথায় যাচ্ছি?। তারপর আমি যদি আল্লাহকেই ভয় না করি তা হলে আবার মানুষকে ভয় করার কি অর্থ থাকতে পারে? বিশেষত আমারএ কাজ যখন হারাম নয় যদিও মাকরুতো অবশ্যই।”
আদলের দুলাল
আমার বাল্যকাল এমন শান্তিময় আনন্দঘন ও আরামদায়ক ছিল যে, আমি যা আবদার করতাম সহজেই তা পেতাম, আমার দাদার ছিলো সাতটি সন্তান। দু’টি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে। আমার মরহুম পিতা সতেরটি সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করেন। তন্মধ্যে আটজন ছিল পুত্র সন্তান এবং নয়জন কন্যা সন্তান। পিতা মরহুমের নিকট তার সমস্ত সন্তানের মধ্যে আমিই অধিকতর প্রিয় ছিলাম। কারণ আমি কখনো পরীক্ষায় ফেল করতাম না এবং প্রত্যেক বছর ভাল পজিশন নিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতাম। আমার বড় দুই ভাই পড়ালেখা চেড়ে কাজ-কারবারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত ব্যবসায়ে তাঁরা ভাল করতে পারেননি। কোন কোন শিক্ষককে আমার পড়ালেখার বিশেষ যত্ন নেয়ার জন্য গৃহশিক্ষক রূপে নিয়োগ করা হতো কিন্তু শিগ্গিরই একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, আমাকে বিশেষ কোচিং দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। যখন আমি মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে (নবম শ্রেণী হতে দশম শ্রেণীতে) উত্তীর্ণ হই তখন গ্রীস্মকালীণ ছুটিতে আমি আমার সিলেবাস ভুক্ত বই আদ্যপান্ত পড়ে ফেলি। তাই অবকাশ যাপনের পর শিক্ষকগণ ক্লাসে যখন পাঠ দিতেন তখন সেগুলো ভালভাবে বুঝে নেয়া ও মনে রাখা আমার জন্য কোন ব্যাপার-ই হতো না। ক্লাসে কখনও থার্ড পজিশন অপেক্ষা খারাপ রেজাল্ট করতাম না। তথাপি কোন দিন আমার ফাস্ট বয় হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আমাদেরকে ইংরেজী ভাষা পড়াতেন মিষ্টার জ্যাকশন নামক জনৈক শিক্ষক। তিন ক্লাসে যখনই ছাত্রদেরকে কোন শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করতেন তখন সাথে সাথে একথাও ব লে দিতেন যে, মুয়াররবা, বুশরা ও তিলমেসান ছাড়া আর কে এর অর্থ বলতে পারবে? তিনি জানতেন যে, আমরা তিনজন ছাত্র (আমি এবং উল্লেখিত দুই জন ছাত্র) পড়া পুরোপুরি তৈরী করেই ক্লাসে এসে থাকি।
জাতীয় মর্যাদাবোধ
আমার বয় যখন দশ বছর তখন আমি “আল-মুকতিম” পত্রিকা পড়া শুরু করি। প্রথম মহাযুদ্ধের সংবাদ আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পড়তাম। আমার মনের একান্ত আকাংখা ছিল এ যুদ্ধে ইংরেজ পরাজয় বরণ করুক যাতে আমার প্রিয় জন্মভূমি মিসর তাদের ছোবল মুক্ত হতে পারে এবং বৃটেনের এজেন্ট (ভাইসরয়)-এর অত্যাচার নির্যাতনের অবসান হয়। বৃটেনের প্রতিনিধিকে হিজহাইনেস বলা হতো, সে বড় অন্যায় ফরমান জারী করতো, সে প্রধান মন্ত্রীর নামে নির্দেশ জারী করতো এবং দেশের সমস্ত যুবককে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে “লাম বন্দী” নামক স্থানে পাঠিয়ে দিতো।
যুদ্ধের ঐ সময়টা ছিল বিশেষভাবে জুলুম ও নির্যাতনে ভরা। বৃটিশ রাজের নির্দেশে জোরপূর্বক জনসাধারণের নিকট থেকে উট ও গাধা ছিনিয়ে নেয়া হতো এবং রসদপত্র বহনের জন্য বৃটিশ সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়া হতো। অনুরূপভাবে ধান, যোয়অর ও অন্যান্য খাদ্যশস্য নামমাত্র মূল্যে জোর করে কিনে নেয়া হতো। কারো আর্তনাম ও আহাজারী শোনার কোন প্রশ্নই উঠতো না। এজন্য আমাদের প্রজন্ম ও আমাকে সমকালীন লোকদের ফিরিঙ্গী সাম্রাজ্যবাদের প্রতি প্রচণ্ড শত্রুতা ছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়অ মাত্রই মিসরীয়রা ১৯১৯ সালে বিপ্লব সংঘটিত করে বসে। তাতে বৃটিশ আধিপত্য খতম হয়নি বটে কিন্তু জাতি কিছু অধিকার আধাস্বায়ত্বশাসন এবং আভ্যন্তরীন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কিছু অধিকার লাভ করে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষের লাভা উদগীরণ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত জাতি ১৯৫৪ সালে ইংরেজদের দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
আমি মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশুনা শুরু করি মাদ্রাসা আল জমিয়তুল খাইবিয়াতুল ইসরামিয়াতে। কিছুদিন পর আর রাশাদ মাধ্যমিক স্কুলে চলে যাই এবং পরিশেষে ইলহামিয়া মাধ্যমিক স্কুল থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করি।
গ্রাম থেকে শহরে
দাদাজানের মৃত্যুর পর আমার পিতা তাঁর দুই স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের সাথে নিয়ে কায়রোস্থ খোশ কাদাম নামক মহল্লায় বাসস্থানে চলে আসেন। এ স্থানটির কথা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই বাসস্থানটি ছিল অনেক বিস্তৃত ও প্রশস্ত। এই বাড়ীর আয়তন ছিল আটশত বর্গমিটার। এ বাড়ীর সর্বাপেক্ষা অদ্ভূত ব্যাপার ছিল এই যে, এর কোন জানালাই বাইরের দিকে খোলা যেত না বরং সবগুলো জানালাই প্রশস্ত ও বিস্তৃত আঙ্গিনার দিকেই খুলতে হতো।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের সময় আমাকে একাধারে তিনটি স্কুল পরিবর্তন বিনা কারণে করতে হয়নি। জমিয়তুল খাইরিয়া স্কুলে যখন আমি প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন একদিন চিত্তবিনোদনের অবকাশে আমাদের ক্লাসে কিছু শোরগোল হলে স্কুলের একজন অফিসার আমার শ্রেণী কক্ষে আসেন। তিনি আমাদেরকে ভর্ৎসনা করেন এবং পূর্ণ নীরবতা অবলম্বনের নির্দেশ দেন। তিনি ডেস্কগুলোর মাঝে ইতস্তত পায়চারি করতে থাকেন। এই সময় তিনি মুহাম্মদ আলী নামক একজন ছাত্রকে নাড়াচড়া করতে দেখেন আর যায় কোথায়? তিনি সেই বেচারাকে তার কোটের কলার ধরে নিয়ে আসেন এবং তার পোশাকে কালী ঢেলে দেন। আমার নিকট এ দৃশ্য ছিল অত্যন্ত অশোভনীয়। আমি ঐ ছাত্রটির আর্থিক সংগতি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। এ জুলুম দেখে আমি নীরবে তা মেনে নিতে পারলাম না। আমার মর্যাদা বোধ আমাকে প্রতিবাদ মুখর হতে বাধ্য করলো। আমি চীৎকার করে সেই অফিসারকে লক্ষ্য করে বলে উঠলাম: “এটা কি ধরনের জুলুম ও বর্বরতা?” আমার কথা শুনে তিনি আমাকে তৎক্ষণাৎ ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আমি তার নির্দেশ পালনে অসম্মতি প্রকাশ করলাম। তিনি আমার কাছে আসলেন এবং আমার কাপড় টানতে শুরু করলাম। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে শক্তিশালী। কেননা আমি ছিলাম বাল্য বয়স্ক অথচ তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ যুবক। তিনি আমাকে ক্লাস রুম থেকে টেনে হেচড়ে বের করে আনলেন। দরজার বাইরে আমাকে রেখে আমার ডেস্কের পাশে গেলেন যেখানে আমার ব্যাগ ও বই পুস্তক পড়েছিল। তিনি আমার বই খাতাগুলো আমার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন। তিনি আমার বই খাতাগুলো আমর মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন। আমি ঐ বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে পাল্টা তার মুখের ওপর নিক্ষেপ করলাম। এক মিনিট অবধি উভয়ই একে অন্যের দিকে বইগুলো নিক্ষেপ করতে থাকলাম। অবশেষে অনন্যোপায় হয়ে তিনি আমাকে কঠোর হস্তে ধরে ফেললেন এবং টানতে টানতে সোজা হেড মাষ্টার সাহেবের নিকট নিয়ে হাজির করলেন। প্রধান শিক্ষকের নাম ছিল কিরারাহ আফেন্দী। তিনি আমাকে তার স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং পরদিন আমার অভিভাবককে সাথে নিয়ে যেতে বললেন। বাড়ীতে গিয়ে আমি আদ্যপান্ত সমস্ত ঘটনা আমার পিতার নিকট বর্ণনা করলাম এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, আর কোনদিন এ স্কুলে ফিরে যাব না। (মুহাম্মদ আলী সালেম পরে পুলিশ একাডেমীতে ভর্তি হয় এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়।) আমার পিতাও আমাকে বাধ্য করেননি। অগত্যা আমি প্রথম শিক্ষা বৎসরটি আর-রাশাদ মাধ্যমিক স্কুলে সমাপ্ত করি। এটা ছিল দারবুল জামহীর রোডে অবস্থিত একটা প্রাইভেট স্কুল। অন্যান্য বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত এই স্কুলেও ভাল পড়ালেখা হতো না। তখনকার দিনে প্রাইভেটট স্কুলগুলোর অবস্থা প্রায়শ এমনই হতো। দ্বিতীয বছরের প্রারম্ভেই আমি ইলহামিয়া স্কুলে গিয়ে ভর্তি হই। এই স্কুলটি ছির সরকারী মনজুরী প্রাপ্ত।
বি, এ, ডিগ্রী লাভ
এই স্কুল থেকে বছরের শেষে ভাল নম্বর পেয়ে আমি বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই এবং এই স্কুলেই ওপরের শ্রেণীতে ভর্তি হই। এখানে বি, এ, পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এখান থেকেই আমি ১৯২৪ সালে মানবিক বিভাগে বি, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এ বছর সারা দেশে বি, এ, পরীক্ষায় মাত্র সাতশত সত্তর জন (৭৭০) ছাত্র উত্তীর্ণ হয়। তন্মধ্যে আমি একাত্তর (৭১) নাম্বারে অর্থাৎ ক্রমানুসারে সত্তর জনের পরে সফলতা লাভ করি। আমি আটর্স বিভাগে এজন্য ভর্তি হয়েছিলাম যে, অংকশাস্ত্র ও হিসাব বিজ্ঞানে আমি ছিলাম বেশ দুর্বল। আজ পর্যন্তও আমি অংক অপেক্ষাকৃত কম বুঝি। কেউ হিসাব বিজ্ঞানে আমার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হউক এমন প্রত্যাশা আমি কখনো করতাম না।
অনুরূপভাবে আমি এমন ইচ্ছাও কখনো পোষণ করতাম না যে, আমার নিকট থেকে প্রত্যেক জিনিসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও চুলচেরা হিসেবে গ্রহণ করুক। আমি যা বলছি আল্লাহ তার সাক্ষী। কেউ আমাকে কোন দায়িত্ব অর্পণ করলে আর আমি তা গ্রহণ করলে আমার পূর্ণ শক্তি সামর্থ ও যোগ্যতা দিয়ে সেই গুরু দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার চেষ্টা করেছি এবঙ এজন্য নিরন্তর আল্লাহর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেছি। ফলাফল কি দাঁড়াবে সেই হিসেব বা সে জন্য কোন পরোয়া করতাম না। ফলাফল তো আল্লাহর হাতে এবং তারই ইখতিয়ারাধীন। আমার ওপর শুধু চেষ্টা করার দায়িত্বই অর্পণ করা হয়েছে। পুরোপুরি চেষ্টা করার পর এমন মানসিক প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি আমি লাভ করি যার কোন সীমা নেই। বান্দার প্রতি আল্লাহর অশেষ মহব্বত ও রহমত এইযে, তিনি অনুগ্রহ করে তাকে শুধু কাজ ও চেষ্টার দায়িত্ব দিয়েছেন। সফলতা এবং অনুকুল ফলাফলের দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়নি।
মুষ্টি যুদ্ধ
ইসলামিয়া স্কুলে অধ্যয়নরত থাকাকালে আমি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করি। এই পর্যায়ে আমি আমার বাহ্যিক জাঁকজমকের প্রতি গুরুত্ব দিতে শুরু করি। ইতিপূর্বে আমি শুধু জ্ঞান আহরণ ও অধ্যয়নের প্রতি যত্নবান ছিলাম। সুতরাং আমার জুতা সর্বদা চকচক করতো। প্যান্টের ভাঁজ কখনো নষ্ট হতে দিতাম না। সবসময় মনে হতো যেন এই মাত্র ইস্ত্রী করে আনা হয়েছে। দুপুরের পর আমি যখন স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে আসতাম তখন আমার নিজের কামরায় বসে জুতায় পালিশ লাগিয়ে খুব করে ব্রাশ করতাম। প্যান্টে কিঞ্চিৎ পানির ছিটা দিয়ে উত্তমরূপে ভাঁজ করে তারপর বিছানার দুই গদির মাঝখানে সাজিয়ে রেখে দিতাম। এভাবে তাতে কড়া ভাজ পড়ে যেতো। মাধ্যমিক স্কুলে আমি এমন কোন সমস্যা ও জটিলতার সম্মুখিন হইনি সাধারণত যুবকরা যেমনটি হয়ে থাকে। আমি সাধারণত ছেলেদের মত একজনের অপরজনের পশ্চাতে দৌড়ানো এবং সাধারণ বুট পরিধান করে খেলার কসরত করা থেকে সর্বদা দূরে থাকতাম। এই সময় আমি অবশ্য বক্সিং শিকার চেষ্টা করি কিন্তু আমার ক্রীড়া শিক্ষক একিদিন এমন বক্সিং (মুক্কা) মানে যে, আমি চির দিনের জন্য বক্সিং-এর অনুশীলন পরিত্যাগ করি। আমি স্কুল স্কাউটিং টিমেও অংশ গ্রহণ করি কিন্তু শীগ্রই তা থেকেও কেটে পড়ি। আমার সমস্ত শিক্ষা জীবনে আমিকোন ক্রীড়াতেই সরাসরি অংশ গ্রহণ করতে পারিনি। যদিও দেশী বিদেশী ক্রীড়া জগতের খবর ও রিপোর্টের প্রতি আমার ঝোঁক ছিল অত্যন্ত বেশী।
কঠোর তত্বাবধান
মাধ্যমিক শিক্ষার পুরোটা সময় আমি আমার মরহুম পিতার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে ছিলাম। এই তত্বাবধান ছিল বড় সূক্ষ্ম ও কঠোর। আমার শেষ পিরিয়ড কখন শেষ হতো এবং হিলমিয়া ও খোশ কাদামের মধ্যে দুরত্ব কতটুকু তা তিনি ভাল করেই জানতেন। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে কত সময় লাগতে পারে। এতসব চুলচেরা হিসেব নিকেশের দাবী ছিল এই যে, আমি যেন নির্দিষ্ট সময়ে ঘরের দরজায় পৌঁছে যাই। তিনি দরজার সিঁড়িতে বসে অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন এবং হস্তস্থিত ঘরির প্রতি তাকিয়ে থাকতেন। আমি দরজায় পৌঁছেই সালাম আরজ করতাম এবং পিতার হস্ত মুবারক চুম্বন করতাম। অতপর সিড়ি ভেংগে সোজা আমার পড়ার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করতাম।
যদি কখনো নির্ধারিত সময় থেকে আমার পাঁচ মিনিট বিলম্ব হয়ে যেতো তা হলে আমার রক্ষা ছিল না। দুর্ভাগ্যআমার ওপর আপতিত হতো—এমন সব তিরস্কার ও ভর্ৎসনা শুনতে হতো যা থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই। এই তিরস্কার ও ভর্ৎসনার সন্মখে আমি একেবারে বাকহীন হয়ে যেতাম। জাব দেয়ার জন্য মুখ খুলতে কিংবা আত্মপক্ষ পসমর্থন করতে একটি মাত্রই শব্দ মুখে উচ্চারণ করতে অথবা দুষ্কর্মে বিবরণ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সাহস হতো না। এতসব কড়াকড়ি সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে আমি ছিলাম বড় সৌভাগ্যের অধিকারী। সকারণ পিতা মরহুমের এরূপ কঠোরতার পশ্চাতে তার পিতৃসুলভ ও স্নেহ ও বাৎসল্য চাক্ষুষ দেখতে পেতাম। সেকালে কৌলিণ্যের দাবী ছিল এই যে, পিতা নিজে কখনো পুত্রকে বলবে না যে, বৎস! আমি তোমাকে ভালবাসি। পিতার স্থানে পিতা এবং পুত্রের জায়গায় পুত্র। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ মর্যাদা ও সম্মান আছে। পারস্পরিক স্নেহ ও ভালবাসার বন্ধন যত দৃঢ়ই হোক না কেন প্রত্যেকের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা জরুরী।
বিবাহ বন্ধন
মাধ্যমিক স্কুলে চতুর্থ বর্ষে থাকা কালেই আমার পিতা আমর বিবাহের চিন্তা ভাবনা করেন। তিনি আমার দ্বীনের বাকী অর্ধেকের হেফাজতের ব্যবস্থা করে দিতে চাচ্ছিলেন। অথচ আমার বড় আরো ভাই ছিল এবং তাদের তখনো বিয়ে হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা তখন আমার বিবাহের প্রস্তুতি চলছিল। প্রকৃত ব্যপার ছিল এই যে, মুহতারাম পিতা আমাকে কিছুটা বেশী ভালবাসতেন। আমার বিয়ের কাহিনীও বড় বিস্ময়কর।
আমি আমর পাঠ্য জীবনে যা কিছু পড়েছিলাম তাতে আমার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, আমার জীবন সংগিনী বাছাই করার নিরংকুশ অধিকার রয়েছে আমর এবং এতে কারো হস্তক্ষেপ না করা উচিত। কিন্তু এটা ছিল আমার মানসিক কল্পনা ও অনুমান মাত্র। বাস্তব অবস্থা ছিল এ থেকে ভিন্নতর। আর এটা সত্য যে, বাস্তব কুসংস্কার ও অলীক কল্পনা অপেক্ষা অনেক বেশী কার্যকর হয়ে থাকে।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে আসার পর আমার মাতা আমাকে বলতে লাগলেন “তোমার আব্বা আমাকে বলেছেন আমি যেন তোমাকে জানিয়ে রাখি আগামী কাল সালাতে মাগরিবের পর তোমাকে অমুখ শাইখের বাড়ীতে যেতে হবে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম “আম্মু, এর কোন কারণ কি আপনার জানা আছে?” জবাবে তিনি বললেন, “যে শাইখ সাহেবের বাড়ীতে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আগামী কাল সালাতে মাগরিবের পর তাঁর কন্যার সাথে তোমার বিয়ে হবে।”
সত্য বলতে কি আমার জন্য এটা ছিল আনন্দ দায়ক খবর। কেননা আমি জীবনেরবিশটি বসন্ত তখন পশ্চাতে ফেলে এসেছি। প্রকৃতিগতভাবে আমার বিয়ের প্রয়োজন ছিল। এখন হালাল পন্থায় জৈবিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে। এতো গেলো একদিক। কিন্তু অপর দিকে আমার ভিতরে পৌরুষ এবং জীবন সংগিনী নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমার স্বাধীনতার ধারণা আমাকে বিদ্রোহ করার জন্য উস্কানি দিতে শরু করে। তবে এই বিদ্রোহ ও তার প্রকাশ আমি কেবলমাত্র আমার মায়ের নিকটই করতে পারতাম। এ ব্যাপারে আব্বাজানের সামনে মুখ খোলার দুঃসাহস আমার ছিল না।
আমি অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সাথে আম্মাজানকে বললাম, “আমি কখনো সেখানে যাবো না এবং বিয়েও করবো না। আমি কেবল একশর্তে বিবাহ করতে রাজী আছি যদি স্ত্রী নির্বাচনের ইখতিয়ার আমর থাকে।” প্রতুত্তরে আম্মা বললেন, “তোমার সাথে এই বাজে আলোচনা ও বিতর্কে লিপ্ত হয়ে মাথা খারাপ করার কোন দরকার আমার নেই। তবে তোমার এরূপ ঔদ্ধত্য ও বিদ্রোহের কথা আমি তোমার পিতার নিকট পৌঁছে দিচ্ছি যাতে তিনি যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।”
আব্বা ঘরে ফিরে আসলে আম্মাজান তাঁকে আমার বক্তব্য জানালেন। তিনি অত্যন্ত শান্তভাবে বক্তব্য শুনলেন এবং আম্মাজানকে বললেন, ইনশাআল্লাহ সে নারাজ হবে না। সে পালিয়ে যাবে কোথায়? আমি তাকে এখন মানুষ বানিয়ে দিতে চাই। যাতে সে মানুষের সাথে উঠা বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমি তার বিয়ে পরিকল্পনা কর দেবো। আমি তার অভিভাবক। ইনশাআল্লাহ আজই বিয়ে সম্পন্ন হবে।
আদর্শ জীবন সংগিনী
মা আমাকে পিতার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। বাবার অনমনীয়তা দেখে আমি হঠকারিতা পরিত্যাগ করলাম। তা না করে আমার কোন গত্যন্তরও ছিল না। বস্তুত মুহতারাম পিতার অন্তরে আল্লাহ যে কথা জাগুরক করে দিয়েছিলেন তাতে বড়েই কল্যাণ নিহিত ছিল। আমার আব্বাজান আমার বিয়ের মাত্র ছয় মাস পর ইনতিকাল করেন। ১৯২৪ সালে জানুয়ারী মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। আল্লাহ তায়ালা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে আমার অর্ধেক দ্বীনের হিফাজতের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আমাকে সিরাতুল মুস্তাকিবের ওপর কায়েম থাকার তওফীক দিয়েছেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি আর কোন দিন কোন মহিলার প্রতি চোখ তুলে তাকাইনি এবং নিজের জীবন সংগিনী ছাড়া কখনো কোন রমণীর কল্পনাও আমার মনে জাগতে দেইনি। আমি আমার সারা জীবন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে এই নেক বখত মহিলার সাথে কাটিয়ে দেই। সুদীর্ঘ তিপান্ন বছর ব্যাপী চলে আসছে আমাদের এই আনন্দঘন দাম্পত্য জীবন। আমার এই অনুপমা স্ত্রী ১৩৯৯ হিজরী সালের রমজান মাস মোতাবেক ১৯৭৯ সালের আগস্ট মাসে আমাকে বিচ্ছেদ বেদনার সাগরে ডুবিয়ে পরপারে চলে গেছেন। তিনি একাধারে সাত বছর অবধি শয্যাশায়ী ছিলেন। কিন্তু তার ইবাদাতের ক্ষেত্রে কোন ভাটা পড়েনি। যেদিন তাঁর ইনতিকাল হয় সেদিন সেহরীর সময় আমরা উভয়েই রোযা রাখি এবং একত্রে সালাত আদায় করি। কিন্তু ইফতারীর সময় হওয়ার পূর্বেই তিনি তার মনজিলে গিয়ে পৌঁছেন। তাঁর কথা স্মরণ করে আজও আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। কেউ আমার সামনে তাঁর আলোচনা করলে আমার মন উৎফুল্লা হয় এবং চোখ দু’টি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
মরহুমা ছিলেন একজন আদর্শ স্ত্রী, বিয়ের পর যখন তিনি আমাদের এখানে আসলেন তখন থেকেই নিজ হাতে রান্না করতেন এবং ঘরের সমস্ত কাজকর্ম, কাপড় ধোয়া, গৃহের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাচ্চাদের দেখাশোনা ও লালন-পালন ইত্যাদি কাজে অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ব্যস্ত থাকতেন। বাড়ীতে পরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে কাজ করে আনন্দ পেতেন। আমার সমগ্র জীবনে কখনো তিনি এমন কথা বলেননি যে, “আপনি এই কাজ কেন করেছেন?” কিংবা অমুক কাজ কেন করেননি? তিনি জীবনে নিজের জন্য কখনো কোন জিনিসের বায়না ধরেননি। আমিও তাই তাঁর চাওয়ার পূর্বেই প্রতিটি আবশ্যকীয় জিনিসপত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে এনে দিয়েছি।
সতী সাধ্বী স্ত্রী ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন স্বামী
বিয়ের পর তিনি সত্যি সত্যিই একজন গৃহরাণী হয়ে পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকলেন। সুদীর্ঘ সতের বছর পর্যন্ত তো তিনি কখনো একাকী ঘর থেকে বাইরে পা রাখেননি। এই পুরো সময় কখনো তিনি কোন ট্রেন কিংবা বাসেও আরোহণ করেননি। যদি কখনো কোন বিবাহ শাদী অথবা কোন শোকানুষ্ঠানে তাঁকে তার আত্মীয় স্বজনদের পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়াতে হতো তখন আমি নিজে আমার গাড়ীতে করে নিয়ে যেতাম। আমি আমার গৃহিণীর ব্যাপারে অত্যন্ত মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ছিলাম। সূর্যালোকের ক্ষেত্রেও যেন আমার এই মর্যাদাবোধ ছিল সতকর্ক যেন তার কিরণচ্ছটা কোনভাবে আমার স্ত্রীর শরীর দেখে না ফেলতে পারে। অনুরূপভাবে বায়ুর প্রবাহ সম্পর্কেও আমার ছিল প্রবল বিতৃষ্ণা যাতে উহা তার ব্যবহৃত পোশাকের ওপর দিয়ে কখনো প্রবাহিত হয়ে না যায়। আমার এই সূতীক্ষ্ম মর্যাদাবোধের পুরোপুরি উপলব্ধি ছিল আমার স্ত্রীর। তাই তিনি কখনো এ কঠোরতার জন্য অসন্তোষ প্রকশ বা আপত্তি উত্থাপন করেননি। তার কারণ ছিল এই যে, এই সূক্ষ্ম মর্যাদাবোধে তিনিও সন্তুষ্ট চিত্তে আমার অংশীদার ছিলেন।
আল্লাহ তায়ালা এই মহিলার গর্ভে আমাকে বহু সন্তান দান করেছেন। তাদের মধ্যে থেকে এখন অবশ্য মাত্র দুই পুত্র ও দুই কন্যা জীবিত আছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্টি থাকেন। আল্লাহর শোকর আমর সমস্ত সন্তান সৎ শিষ্ট ও অনুগত।
আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে আমার সূক্ষ্ম মর্যাদাবোধের অনুভূতির একটা ঘটনা বর্ণনা করছি। ঘটনাটা এই মুহূর্তেই আমার মনে পড়লো। জামাল আবদুন নাসেরে জিন্দাখানায় আমাকে এক নাগাড়ে সতের বছর কাটাতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭১ সালের জুলাই পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময় মরহুমা একজন আদর্শ স্ত্রীর কৃতিত্ব অত্যন্ত ধৈর্য, দৃঢ়তা এবং সদাচরণের সাথে পেশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। জেলখানায় একাধারে দশ বছর ছিল আমার সশ্রম কারাদন্ড। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় আমার স্ত্রী একবারও আমার সাথে সাক্ষাত করতে আসেননি। কেননা এটা আমার মোটেও পসন্দনীয় ছিল না। যে জেলখানার লোকজন এবং আমার ইখওয়ানী ভাইয়েরা আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখতে পাক। ইখওয়ানী ভাইয়েরাও বার বার অনুরোধ করেন যে, এ আচরণ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার আচরণ এবং তিরস্কার যোগ্য। তাদের ঐকান্তিক অনুরোধ বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত আমি আমার স্ত্রীকে কারাগারে আমার সাথে দেখা করার অনুমতি দেই। তিনি আমার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য জেলখানায় আগমন করলে আমি ভাব গম্ভীর পরিবেশেসাতে স্বাগত জানাই। যেন আমরা একে অন্যের নিকট থেকে একদিন কিংবা এক দিনের অংশ বিশেষের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিলাম মাত্র। আমার দীর্ঘ কারাবাস ও গৃহ থেকে অনুপস্থিতির এই সময়কালে আল্লাহর এই বান্দী কখনো আমার কাছে কোন প্রকার অস্বস্তি প্রকাশ করেনি। কিংবা আমার আত্মীয় স্বজনের জন্য কোন সমস্যাও সৃষ্টি করেনি। যদিও আমার মা এবং ভাইবোনদের পক্ষ থেকে অনেক সময় তার সাথে রূঢ় আচরণও করা হয়েছে।
যুবক যুবতীদের প্রতি উপদেশ
আমি নওজোয়ান ছেলেমেদের উপদেশ দিতে চাই। এ উপদেশ আমার সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস। যুবক যুবতীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে তারা যেন তথাকথিত প্রেমকে তার ভিত্তি না বানায়, বিয়ের পূর্বে যা (পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণর ফলে) সৃষ্টি হয়। প্রেম ঘটিত বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সফল হয় না। যে ভাবাবেগ তাড়িত অবস্থাকে ভালবাসা ও প্রেম বলে আখ্যায়িত করা হয় তা একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, দুই তিন বছরের মধ্যেই তা নির্বাচিত হয় এবং আবেগের অপমৃত্যু ঘটে। ভালবাসা ঘৃণায় অথবা অন্তর নিস্পৃহতায় রূপান্তরিত হয়। বিশেষত যখন আগমন ঘটে নবজাতকের তখন এই আবেগ সম্পূর্ণ ঠান্ডা হয়ে যায়। ভাটা পড়ে আসে সেই অনুভূতিতে।
বিয়ের ব্যাপার আমার উপদেশ হচ্ছে, প্রথমে দেখতে হবে পিতামাতা এই বিয়েতে সম্মত কিনা তার পর দেখা আবশ্রক স্বামী স্ত্রীর সামঞ্জস্যতা ও সোমঝোতা। যদি এরূপ না করা হয় তাহলে সেই বিয়ে দ্বারা সেই উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না। যে জন্য বিয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক শুধু মাত্র সাময়িক ও আবেগ দাড়িত প্রেম প্রীতির ওপর স্থায়ী হতে পারে না। এর ভিত্তি হওয়া উচিত পবিত্রতা ও অকৃত্রিমতা। উভয়েই উভয়ের জন্য আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার অনুভূতি পোষণ করতে পারলে দাম্পত্য জীবনে জান্নাতী আবেশ ও সুষমা নেমে আসবে। ফলে বিয়ে স্থায়ী কল্যাণ ও সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
ধ্বংস নেমে আসুক এমন স্বামী স্ত্রীর ওপর যারা বিযের পর আপন সাথী ছাড়া অন্য কারো প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে কিংবা তার জন্য অন্তরে ভালবাসার লালন করতে শুরু করে।
আমার মনে পড়ে আমি ১৯৩৬ সালে দাস পাশা মার্কা ফিলিফস রেডিও গ্রাম ক্রয় করেছিলা। আমার মরহুমা স্ত্রী সুস্পষ্টভাবে আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে, রেডিওতে যখন তিনি রিয়াদুস সানবাতি মরহুমের গান শুনেন তখন এ গান ও তার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর তার খুব ভাল লাগে। আমি তাকে বললাম, “যখনই ঘোষকের মুখে রেডিওতে সানবাতির নাম শুনবে তখনই রেডিও বন্ধ করে দিবে।” মরহুমা কোন প্রকার ইতস্তত না করেই সাগ্রহে ও সানন্দে আমার এই নির্দেশ মেনে নেন। আমি যুবক যুবতীদের বলতে চাই যে, পিতামাতার স্ত্রী নির্বাচনে সন্তুষ্ট থাকবে। কিংবা নিজের পসন্দের মেয়ের ব্যাপারে মাতাপিতাকে সম্মত করতে চেষ্টা করো। পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির ফল অত্যন্ত দুঃখজনক পরিণাম এবং বর্ণনাতীত মুসিবত। আর তাদের সন্তুষ্টির ফল সীমাতিরিক্ত সৌভাগ্য ও সুখ-শান্তি লাভ।
আইনের পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা
১৯২৪ সাল ইউনিভার্সিটি ল’ কলেজে ভর্তি হওয়ার অব্যবহিত পরই আমার যৌবনের উন্মেষ ঘটে। আমি আইন মহাবিদ্যালয়ে এজন্য ভর্তি হয়েছিলাম যে, আইন ব্যবসায়ের প্রতি ছিল আমার প্রবল অনুরাগ। উকিলগণ যখন মজলিশে বসে কথাবার্তা বলতেন তখন আমার কাছে তাদেরকে খুবই সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় মনে হতো। মোকদ্দমাসমূহের শুনানী ও বিশ্লেষণে তাদের ধরণ ধারণ বিশেষত যখন জজ সাহেবগণ নীরবে বসে তাদের যুক্তিসমূহ শুনতে থাকেন তখন তাদের গুরু গম্ভীর মনে হতো। উকিলদের সম্পর্কে পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে আমি যেসব বিবরণ পড়তাম তাতে আমার এই ধারণা হয়েছিল যে, তারা মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষক। তারা দুর্বলদের সহযোগিতা প্রদান করে এবং তাদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে দেয়। সর্বোপরি যে কথাটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনার যোগ্য তা হচ্ছে তারা কারো কর্মচারী নয়। বরং তাদের পেশা স্বাধীনতা ও স্বয়ম্ভবতার গ্যারান্টি।
আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পর্যায়ে আমি কখনো কোন ক্লাসে অকৃতকার্য হইনি। কিন্তু আইন কলেজে এসে আমি একাধিকবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছি। অবশ্য আমার অকৃতকার্যতার কতগুলো কারণ ছিল:-
১।বিয়ে : আমি কলেজ জীবনে বিয়ে করি এবং পিতা হওয়ার গৌরব অর্জন করি। অতেএব স্ত্রী পরিজনের কারণে পড়াশুনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারিনি। এমনকি ক্লাসেও আমি নিয়মিতভাবে হাজির হতে পারতাম না।
২। জাতির আযাদী আন্দোলনে যোগদান: আমি অধিকাংশ সময়ই আন্দোলনের কাজে অংশ গ্রহণ করতাম এবং বহুবার সা’দ জগলুল পাশার নিকট বায়তুল উম্মাহ চলে যেতাম। তার কথা বার্তায় ছিল যাদু মন্ত্রের মত আকর্ষণ। সেখান ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতাম।
৩। পিতার ইনতিকাল ও গাড়ী ক্রয়: ইত্যবসরে আমার পিতা ইনতিকাল করেন। অমনি সেই নিয়ন্ত্রণ যা এত দিন তিনি কঠোরভাবে কার্যকরী করে আসচিলেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই পর্যায়েই আমি একটা (গাড়ী) রিন্যুকা পরুলিয়া নম্বর ২৭৫১ ক্রয় করি। এখন আমার আনন্দ স্ফূর্তির সুযোগ ও উপকরণ হস্তগত হয়ে যায় যা এতদিন মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। এই পর্যায়ে আমি মদ ও ব্যভিচার ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত অভ্যাস ও আচরণ রপ্ত করে ফেলি যা আমীর ওমরাহদের সন্তানদের বৈশিষ্ট্য। সিনেমা ও থিয়েটারে গমন করা নৃত্যু ও সংগীতের আসরে নর্তন কুর্দন করা আমর অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আল্লাহর মেহেরবানী যে, তিনি আমাকে মাদক দ্রব ও জ্বেনা থেকে নিরাপদ রেখেছেন।
আদর্শ শিক্ষক মন্ডলী
আইন কলেজে দেওয়ানী আইনের উস্তাদ ছিলেন ডক্টর আবদুর রাজ্জাক আল সানহুরী মরহুম। তিনি শুধু তার বিষয়েরই সুদক্ষ শিক্ষক ছিলেন না। বরং প্রকৃতপক্ষে তিনি নৈতিক গুণাবরী ও বৈষয়িক লেন-দেনের ক্ষেত্রেও খুবই উন্নত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি ছাত্রদের নিকট গ্রহণযোগ্রতা লাভ করতে পারেননি। তার আওয়াজ ছিল অত্যন্ত কর্কষ ও ক্ষীন এমন কি তাকে “ছাত্রদের জ্বীন” নামে অভিহিত করা হতো। তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ফরাসী ভাষাকে আরবী ভংগিতে বলতে শুরু করেন। যখন তিনি দেখেন যে, দেওয়ানী আইনের পত্রে কোন কোন চাত্র খুবই দুর্বল তখন তিনি আমাদের সকলকে ডেকে পাঠান এবং নির্ধারিত পিরিয়ড ছাড়া আরো অতিরিক্ত পিরিয়ড আমাদের দিয়ে দেন। এই সময় তিনি আইনের অধিকতর জটিল দিকগুলো বিশ্লেষণ করতেন যা নিয়মিত ক্লাসে আমরা শিখে নিতে পারতাম না। আর এই অতিরিক্ত সময় তিনি কোন প্রকার আর্থিক বিনিময় ব্যতীতই প্রদান করতেন। অথচ আধুনিক কালের কোন কোন ডক্টর এবং প্রফেসরের মত ডক্টর সানহুরী মরহুম ধন্য ব্যক্তি ছিলেন না। এসব ডক্টর তো তাদের গৃহে অনেক বেশী অর্থের মিনিময় ছাত্রদেরকে কোটেশন পড়াতেন। এমনকি এই অন্যায় অবৈধ কর্মতৎপরতার সমালোচনা করার মতও কোন লোক ছিল না। ছাত্রদের অন্তরে সেই শিক্ষকের প্রতি কি সম্মান বোধ জাগবে যার নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করার পর ছাত্রদেরকে তার বিল পরিশোধ করতে হয়। শিক্ষকগণ জ্ঞান শিক্ষা দিতে গিয়ে পয়সার জন্য হাত প্রসারিত করলে তা কি মানানসই হয়?
এই কর্মনীতি ছাত্রদের মনে এই বিশ্বাসই সৃষ্টি করে যে, এই পৃথিভীতে কোন জিনিসই এমনকি জ্ঞানও বস্তুগত বিনিময় ছাড়া লাভ করা যায় না। ফলে ছাত্ররাও শুধু জ্ঞান লাভের জন্য জ্ঞান চর্চার করতে পারে না। বরং তাদের নিকট এই জ্ঞান আর্থিক লাভের উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই তারা এই লক্ষ্য পানে পাগলপারা ও হন্যে হয়ে ছুটতে থাকে যাতে বেশী বেশী অর্থ উপার্জন সম্ভব। ধন-সম্পদ অর্জন করা তাদের এক নম্বর লক্ষ্যে পরিণত হয় এবং যাবতীয় নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়। উন্নত দেশসমূহে ছাত্ররা জ্ঞান অর্জন করে এজন্য যাতে বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম করতে এবং অর্জিত সেই শিক্ষার সাহায্যে কোন নতুন আবিষ্কার ও মতবাদ উপস্থাপন করতে এবং সৃষ্টি রাজ্যের রহস্য নিগুঢ় তত্ব মানুষের নিকট উদঘাতি করে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার এই উদ্দেশ্যই একেবারে বদলে গেছে। এ কারণেই সেসব জাতি দ্রুত উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিযে চলেছে। আর আমরা অনুন্নতই রয়ে গিয়েছি। তারা শক্তিশালী আমরা দুর্বল। আমরা মৌলিক শিক্ষার জন্য শিক্ষা লাভ করা সম্পূর্ণ ভুলে বসেছি। জ্ঞান লঅভের জন্য ত্যাগ ও পরিশ্রম এখন পুরোনো দিনের কাহিনী। আমরা প্রত্যেকেই নিজের জীবন যাত্রার মান অধিকতর উন্নত সমৃদ্ধ করার চিন্তায় বিভোর। অন্যসব মানুষ অনাহারে মৃত্যু বরণ করুক তাতে কিছু যায় আসে না। স্বার্থপরতারি এই জীবনধারাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।
আমি কয়েকবার বলেছি যে, এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে সরকার দ্বীনি সংগঠনগুলোকে এই কাজ আঞ্জাম দেয়অর জন্য নিয়োগ করুক। মুসলিম ও খৃস্টান নির্বিশেষে ধর্মীয সংগঠনগুলোই এই সমস্যার সমাধান একযোগে চেষ্টা করে বের করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ ক্লাসের ব্যবস্থা যথাক্রমে মসজিদ ও গীর্জায় করা যেতে পারে। মুসলিমদের নিকট মসজিদ এবং খৃস্টানদের গীর্জা পবিত্র স্থান। সুতরাং এই সকল স্থানে অনুষ্ঠিতব্য শিক্ষামুলক ক্লাস থেকে দুর্বল ছাত্রগণও অল্প বিস্তর উপকৃত হতে সক্ষম হবে।
মহিলাদের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভংগী
আমার দৃষ্টিতে মহিলাদের জন্য উপযুক্ত স্থান ঘর ও গৃহের চার দেয়াল পরিবেষ্টিত স্থান। এর বাইরে তাদের কোন অবস্থান আমি স্বীকার করতে পারি না। বর্তমান যুগের নওযোয়ান ছেলেমেদেয়দের মধে প্রচলিত আচার আচরণ আমি একেবারেই পসন্দ করি না। নারী ও পুরুষের কোন সহ অনুষ্ঠানে যদি কখনো আমার যোগদানের সুযোগ হয় বিশেষত যেখানে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা বেশী সেখানে লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে আসে। নির্লজ্জের মত বার বার চেয়ে দেখা তো দূরের কথা আমি কখনো কোন পরনারীর চেহারার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না। আমি মহিলাদের সমাবেশে বক্তব্য পেশ করা কিংবা মহিলাদের সাথে সরাসরি কথাবার্তা বলাও পসন্দ করি না। তথাকথিত সংস্কৃতিবান লোকেরা এই মানসিকতাকে দোষ ও দুর্বলতা বলে মনে করেন এবং কাপুরুষ বলে গালি দিয়ে থাকেন। এই লোকেরা যা ইচ্ছা তাই বলে বেড়া কিন্তু আধুনিকতাবাদ ও তার নারী পুরুষের স্বাধীনতার সাথে আমার কি সম্পর্ক? নারী পুরুষের মধ্যে সাম্যের মতবাদেরও আমার নিকট কোন গুরুত্ব নেই। আল্লাহ তায়লা পুরুষকে পুরুষ করে সৃষ্টি করেছেন এবং নারীকে নারী প্রকৃতি দ্বারা ধন্য করেছেন। মানুষ আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি কৌশল এবং তার নিগুঢ় তত্তব ও প্রকৃতি কিভাবে পরিবর্তন করতে পারে? আমাদের সরলমনা যুবক যুবতীদেরকে বাহ্যত সমৃদ্ধি ও আধুনিক ধ্যান-ধারণার আকর্ষনীয় দিকসমূহ দেখানো হয়ে থাকে। কিন্তু তারা তা বাস্তবের কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না। নারী-পুরুষের এই সাম্যের অর্থ কি? যে নারী নিজেকে পুরুষের সমান বলে মনে করে সে তার মর্যাদা হারাবার পূর্বেই নারীত্ব থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়।
যতদিন আমি একজন উকিল হিসেবে প্রাকটিস করেছি ততদিন আমি আমার ব্যক্তিগত সচিবকে বিশেষভাবে নির্দেশদিয়ে রেখেছিলাম যে, আমার চেম্বারে আমর নিকট যেন কখনো কোন মহিলা একাকী না আসে। যদি কখনো কোন মহিলাকে কোন কাজে আসতে হয় এবং তার সাথে কোন পুরুষ লোক না থাকে তা হলে সেক্রেটারী অবশ্যই তার সাথে যেন আমার অফিসে আসে।
আমাকে একবার আরব আমীরাতে মহিলাদের এক কনফারেন্সে যেতে হয়। সেখানে আমি কোন কোন মহিলার প্রশ্নে নির্ভিকতা ও নির্লজ্জতার বহর দেখে হতবাক হয়ে যাইা। আমি ইশারায় ইংগিতে জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাম। একবার আমি ইটালী গিয়েছিলাম। সেখানকার কুমু শহরের এক হোটেলে অবস্থান করছিলাম।আমার ক্ষৌরকার্য করানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই আমি হোটেলের সেলুনে বুকিং করিয়ে পাঠাই। যথা সময়ে আমি সেলুনে গিয়ে উপস্থিত হই এবং দেখতে পাই যে সেখানে ক্ষৌরকার্য সম্পাদনের জন্য মহিলারা কর্মরত। একজনও পুরুষ ছিল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম: “আমার ক্ষৌরকার্য কে করবে?” তখন তারা একটা মেয়ের দিকে ইংগিত করলো। তারপর আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম: “এখানে কোন পুরুষ ক্ষৌরকার নেই?” তারা বললো: “না”। একথা শুনে আমি: “বললাম তাহলে আমি ক্ষৌরকর্মই করবো না।” এই বলে আমি আমার রুমে ফিরে গেলাম। এই ঘটনা পুরো হোটেলে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হলো। উপস্থিত সকলেই এটাকে অদ্ভূত ঘটনা মনে করে প্রত্যেকের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করতে থাকে আর আমি সারারাত আল্লাহর শোকার আদায় করতে থাকি এই জন্য যে, তিনি আমাকে এমন এক দেশে জন্মলাভ করিয়েছেন যেখানে আর যাই হোক অন্তত হালাল হারামের পার্থক্য মানুষ এখনও করে থাকে।
ভুল বুঝাবুঝির অবসান
আমার মহিলাদের ভূমিকা হবে বিশ্বস্ত স্ত্রীরূপে পুরো ঘরকে আনন্দ মনজিল এবং জান্নাতসম বানিয়ে দেয়া। আমার স্ত্রী ছিলেন ঠিক এ ধরনের একজন মহিলা। সে আমার সন্তানদের গর্ভে ধারণ করে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাদেরকে উত্তম রূপে লালন পালন করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আমার ছেলেমেয়েরা যার সাথেই মিশুক না কেন সার সাথেই সম্মানজনক ব্যবহার করে এবং বিনিময়ে তারাও অনুরূপ সৌজন্যমূলক ও ভদ্রজনোচিত ব্যবহার লাভ করে থাকে। আমি এখানে একটা ভুল বুঝাবুঝিও চিন্তাজগত থেকে দূর করে দিতে চাই। আমার এসব কথাবার্তা থেকে কখনো যেন এরূপ ধারণা না করা হয় যে, নারী জাতির প্রতি আমার রয়েছে বিদ্বেষ ও ঘৃণা। কখ্খনো নয় আল্লাহ তায়ালা সাক্ষী এবং তিনি জানেন নারী জাতিকে আমি কত বেশী সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকি। আর আমার এই মনোভাব ও অনুভূতি প্রকৃতপক্ষে মহিলাদের প্রতি অনেক বেশী সম্মান বোধের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমি তাদেরকে অন্যদের অসৎ উদ্দেশ্যের শিকার ও কুদৃষ্টি থেকে পরিপূর্ণভাবে নিরাপদ দেখতে চাই। আমি নারী শিক্ষার বলিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক। আমি সর্বদাই এ বিষয়ে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছি যে, নারীদের শিক্ষা লাভের সুযোগ দিতে হবে। যাতে তারা তাদের নারীত্বের পূর্ণাংগ বিকাশ ঘটাতে পারে। এবং সতীত্ব ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান করতে পারে। আমি চাই নারীদের ব্যাপারে প্রচলিত সমস্ত সন্দেহ সংসয়ের অবসান হোক। ইসলামী বিধানের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নারীদের অধিকার ও কর্তব্য এবং শাস্তি ও পুরষ্কারের দিক দিয়ে পুরোপুরি পুরুষের সমকক্ষ বানিয়ে দিয়েছেন। নারীর কাম্য এ ছাড়া আর কি হতে পারে। মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ পরস্পর সমান। উভয়ের রয়েছে কর্মের আপন গন্ডি। তথাকথিত আধুনিকতা ও প্রগতিবাদীদের সাম্য এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতিষ্ঠিত সাম্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রাচীন প্রতিনিধিত্ব
ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত ছাত্র থাকা কালই রাজনৈতিক কার্যক্রমে খুব আন্তরিকতার সাথে অংশ গ্রহণ করতে থাকি। এই পর্যায়ে আমি অফদ পার্টির একজন ঐকান্তিক সমর্থক ছিলাম। আমি অধিকাংশ সময় ‘উম্মাহ হাউসে” যাতায়াত করতাম। আমার মনে আছে সা’দ জগলুল পাশা “কাশকুল” পত্রিকা নেয়ার জন্য কোন ছাত্রকে পাঠিয়ে দিতেন। পত্রিকাটি ছাপার সাথে সাথেই তিনি তা চেয়ে পাঠাতেন। এই পত্রিকায় মুদ্রিত কার্টুন সমূহ তিনি খুবই কৌতুহলের সাথে দেখতেন। এই পত্রিকাটি অফ্দ পার্টি এবং তার নেতৃত্বের কট্টর বিরোধী ছিল। এতে সা’দ জগলুল ও তার পার্টির ওপর অত্রন্ত সূক্ষ্ম ও নগ্নভাবে হামলা করা হতো। এবং ব্যঙ্গচিত্রও ছাপা হতো। কিন্তু তিনি কখনো এসব লেখা ও কার্টুন দেখে অসন্তোষ কিংবা উত্তেজনা প্রকাশ করতেন না।
আমি যদিও অফ্দ পার্টির লোক ছিলাম কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসমাঈল সিদকী পাশা মরহুম সম্পর্কে আমি বিশেষ মতামত পোষণ করতাম। অধিকাংশ লোকই আমার এই দৃষ্টিভংগির সাথে দ্বিমত পোষণ করতো। তবে একথা সত্য যে, সিদকী পাশা জনসাধারণের মধ্যে কখনো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। জনগণের ওপর দমননীতি ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এসব সত্ত্বেও আমি নিজের পার্টির এই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কিচু মহৎগুণের ভক্ত ছিলাম।
সিদকী পাশা মিসরীয় জাতি সম্পর্কে বলতেন যে, এরা প্রতিটি সরকারের অনুগত এবং উদীয়মান সূর্যের পূজারী। এই দৃষ্টিভংগী পোষণ করার ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং জনগণের সাথে তার আচরণ অত্যাচার ও উৎপীড়নের ওপর ছিল ভিত্তিশীল। তথাপি নিসন্দেহে তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার রাজনীতিবিদ। তিনি তার রাজনীতিকে দেশে বিরাজিত পরিস্থিতিরে মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন। তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল যদি (ইংরেজদের থেকে) পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক অধিকার লাভ করা সম্ভব না হয় তাহলে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকু ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। (পক্ষান্তরে অফ্দ পার্টির নেতা এবং জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা সা’দ জগলুল পাশা জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বলতেন বিদেশী আধিপত্যবাদের কবল থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করতে হবে নতুবা শুরু করতে হবে অসহযোগ আন্দোরন।) রাজনৈতিক ময়দানে সিদকী পাশার এই দৃষ্টিভংগী ভ্রান্ত ছিল না। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভের জন্যে লাগাতার সংগ্রাম অব্রাহত রেখে আংশিক অধিকার ও আযাদী আদায় করে নেয়াতে কোন ক্ষতি ছিল না।
ইনসাফের দাবী
সম্ভবত আজও মানুষের মনে আছে যে, সিদকী পাশা তার মন্ত্রীত্বের সময় আলেকজান্দ্রিয়াস্থ আল কুরনীশ রাজপথ নির্মাণের ঠিকাদারী দানতুমার কোম্পানীকে দিলে তখন চার দিক থেকে তার ওপর বিশ্বাস ভঙ্গের অপবাদ আরোপ করা হয়। পরবর্তীকালের ইতিহাস অবশ্য প্রমাণ করে যে, এ অভিযোগ ছিল মিথ্যা। এই কুর্ণিশ সড়ক অদ্যাবধি আলেকজান্দ্রিয়াতে বিদ্যমান। এবং এর পরিপাটি রূপ সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করছে। আলেকজান্দ্রিয়ার এই মহাসড়ক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাসমূহের অন্যতম। সড়কটির উপযোগিতা এখন আর কারো অজানা নয়। এই সড়ক আলেকজান্দ্রিয়ার জন্য অনেক কল্যাণ বয়ে এনেছে। যতদিন আলেকজান্দ্রিয়া থাকবে ততদিন এই সড়কও থাকবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, যেসব লোক এই সৌন্দর্যমন্ডিত ও লাভজনক উপঢৌকন আলেকজান্দ্রিয়াকে দিয়েছে আজ কেউ তুলেও তাদেরকে স্মরণ করে না।
সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য ছিল খুবই প্রবল। কিন্তু মতবিরোধকারীগণ ছিলেন কাজের মানুষ। জাতীয ইস্যুগুলোতে মতোভেদ যত তীব্রই হোক তারা পরস্পরে অত্যন্ত সৌহার্দ ও বন্ধু প্রতীম সম্পর্ক বজায় রাখতেন। একজন অন্যজনের কাছে আসা যাওয়াও করতেন। এবং সন্ধ্যায় একই আসরে সমবেত হয়ে সকলে গল্প গুজবে মেতে উঠতেন। আজকাল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির মধ্যে যেরূপ হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতামূলক মনোভাব বিদ্যমান এবং দলীয় হীনমন্যতা ও সংকীর্ণতা ব্যাপক তখনকার দিনে এর নাম নিশানাও ছিল না। রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিসমূহের মধ্যে যে ব্যাপক শত্রুতা ও দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী বিদ্যমান তৎকালে তার কোন নাম গন্ধও ছিল না। কোন ক্ষমতাসীন দলই নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত হয় না। বরং বিজয় লাভের জন্য সকল প্রকার বৈধ অবৈধ কূটকৌশল অবলম্বন করে। অথচ মিসরের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন নজীরও রয়েছে যে, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি হয়েছে। ইয়াহহিয়া পাশা ইব্রাহীমের মন্ত্রীত্বের আমলে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সর্বাপেক্ষা বেশী সম্ভাবনাময় দল পরাজয় বরং করে এবং অফ্দ পার্টি নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয় লাভ করে। এতসত্ত্বেও রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সম্প্রীতি সৌহার্দ থাকার কারণে কোন প্রকার রাজনৈতিক শত্রুতা কিংবা তিক্ততার সৃষ্টি হয়নি।
আমাদের মতে মিসরের কোন লোকই নির্বাচনের বিরোধিতা করে না। বিজয়ী ও বিজিত সকলেই নির্বাচনের পক্ষে।কিন্তু দুঃখজনক কথা হলো দলভিত্তিক বর্তমান রাজনীতিতে ক্ষমতার মসনদে প্রতিষ্ঠিত দল নির্বাচন নামক প্রহসন করা সত্ত্বেও কখনও ইনসাফপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে দেয় না। তাদেরকে তো যে কোন মূল্যে নির্বাচনে বিজয় লাভ করতেই হয়। যদিও জনগণ তাদের প্রতি সম্পূর্ণ অনাস্থাই প্রকাশ করুক না কেন, তাতে কিছুই যায় আসে না। বিশ্বসভায় আমরা কখনো প্রকৃত সম্মান অর্জন করতে পারবো না যা আমরা কামনা করে থাকি; যদি আমরা আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে আমূল পরিবর্তন সাধন না করি।
আইন ব্যবসা শুরু
শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করার পর আমি কর্ম জীবনের প্রারম্ভে উতবা খাজরা এলাকায় জনৈক উকিল সাহেবের দপ্তরে শিক্ষাণবিশী করি। উকিল সাহেবের নাম ছিল ইব্রাহীম বেগ জকি। তিনি প্রথমে জজ ছিলেন। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর তিনি প্রাকটিস শুরু করেছিলেন। আমি আজীবন মাযহাবের গোঁড়ামী ও পক্ষপাতিত্ব থেকে দূরে ছিলাম। এবঙ কখনো এরূপ চিন্তা করিনি যে, কাউকে মুসলিম হতে হলে তাকে অবশ্যই মাযহাবের পক্ষপাতিত্ব করতে হবে, যদি সে মাযহাব ভুলের ওপর থাকে তবুও। আবার কেউ খৃস্টান ধর্মের অনুসারী বলে তার বিরুদ্ধাচরণ করাও জরুরী যদিও সে ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। জানি না সাদাতের সময় কোন্ শয়তান মাযহাবের পক্ষপাতিত্বের এই ফিতনা ও বিপর্যয় কখনো স্থান পায়নি তা আল্লাহ ভাল করেই জানেন। এখানকার প্রত্যেক শহরেই মিসরীয়রা বাস করতো এবং অন্যদেরকে মিসরীয় বলে মনে করা হতো। দ্বীনের প্রত্যেক অনুসারী কোন প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়াই এবং কারো হস্তক্ষেপ ব্যতীতই নিজ নিজ পরিমন্ডলে পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে জীবন অতিবাহিত করছিলো।
শিক্ষাণবিশীর মেয়াদ শেষকরার পর শাবিনুল কানাতির অঞ্চলে আমি আমার নিজস্ব দপ্তর খুলে ব সলাম।সত্য কথা বলতে কি। আমি আমার পেশায় না ছিলা অপ্রতিদ্বন্দ্বিী আর না একেবারেই অখ্যাত ও অজ্ঞাত বরং এ দু’ প্রান্তিকের মাঝামাঝি ছিল আমার অবস্থান। কালুবিয়াস্থ কমিশনারীর প্রত্যেক আদালতে আমার হাতে কোন না কোন মোকদ্দমা অবশ্যই থাকতো। তাছাড়াও আল্লাহর মেহেরবানীতে সারা দেশ থেকে আমার নিকট মামলাসমূহ আসতিা। উত্তর দিকে দূরতম স্থান যেখানেই আমার মামলার তদবীর করার জন্য যেতে হয় উহার নাম ছিল তানতা। আবার দক্ষিণ দিকে সুদুর এলাকায় অবস্থিত আদালাত যেখানে মামলাসমূহ রুজু করা হতো তার নাম ছিল তাহতার আদালত, এভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমার যশ ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
সততা ও দ্বীনদারী
আমি আমার পেশা জীবনের প্রারম্ভেই আল্লাহর নামে শপথ করেছিলাম যে, মক্কেলদের কখনো প্রতারণার মধ্যে ফেলে রাখবো না। কোন বাদী কিংবা বিবাদী কোন দেওয়ানী মামলা নিয়ে আমার কাছে আসলে আমি তার কেসটি তার মুখেই বিস্তারিত শুনে নিতাম। প্রয়োজনীয় দস্তাবেজ যেমন কেসের তারিখ, প্রেক্ষাপট, সাক্ষী এবং আনুসংগিক অন্যান্য সকল ব্যাপারে পুরো তথ্য নিয়ে নিতে চেষ্টা করতাম। মোকদ্দমাত সত্য হলে তা তদবীর করতে সম্মত হতাম এবং সংগে সংগেই আদি অন্ত ও সাক্ষী ইত্যাদি দেখে যতি মনে হতো যে, এই মোকদ্দমায় জিতে যাবো তাহলে মক্কেলকে বলে দিতাম ঠিক আছে মামলা দায়ের করে দিচ্ছি। আর যদি কেসের প্রকৃতি দ্বারা উপলব্ধি করতে পারতাম যে, এ কেসে সফলতার কোন সম্ভাবনা নেই। তা হলে অকপটে মক্কেলকে বলে দিতাম, অনর্থক পয়সা খরচ করবেন না। বরং প্রতিপক্ষের সাথে আপোষ-মীমাংসা করে ফেলুন। কেস গ্রহণের অর্থ কখনো এই ছিল না যে, এরূপ কেসকে শতকরা একশত ভাগই সাফল্য লাভ করতো। বরং এ হতো আমার প্রাথমিক ধারণা ও অনুমান মাত্র। অনেক সময় এমনও হতো যে, যে মামলা আমি হাতে নিয়েছিলাম সে হেরে গেছে আর যার কেস আমি গ্রহণ করিনি সে জিতে গেছে। আমি মূলত আমার উপার্জন হালাল পন্থায় করতে চেয়েছি। এজন্যই মোকদ্দমাসমূহের সত্যতা ও যথার্থতা এমন কি জয়লাভের জন্য উপস্থাপিত ঘটনাপ্রবাহ এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়ণ করে নিতাম। আমার অনুমান ভুলও হতে পারতো কিন্তু আমাদের সর্বাত্মক প্রয়াস ও আগ্রহ উৎসাহ এই লক্ষ্যে পরিচালিত হতো যে, মোকদ্দমা দায়েরকারীকে তার তদবীরের খরচতো অন্তত বহন করতে হবে। বাকী ফলাফলের নিশ্চিত জ্ঞান তো তদবীরের খরচতো অন্তত বহন করতে হবে। বাকী ফলাফলের নিশ্চিত জ্ঞান তো আল্লাহ ব্যতীত আর কারো নিকট সুস্পষ্ট নয়। অবশ্য ফৌজদারী মামলায় আমি যখনই অনুমান করতে পেরেছি এবঙ যখনই কোন ফায়সালার বিরুদ্ধে আপিল দায়েল করেছি তখন সর্বপেক্ষত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তি হয় মুক্তি লাভ করেছে নয়তো অপরাধীর শাস্তি কিছুটা লাঘ করা হয়েছে। মোক্কদমার ফাইল ও রেকর্ডপত্র দেখে আমি সেসব বিষয় বুঝে ফেলতাম যার ভিত্তিতে আদালতে দলিল-প্রমাণ পেশ করা যেতে পারে। আল্লাহর মেহেরবানীতে তাতে সফলতা আসতো।
নির্বাচনে অংশ গ্রহণ
এমনিতে আমার পেশাগত জীবন অব্যাহত ছিল। আলহামদুলিল্লাহ এতে আমি বেশ সফলও হয়েছি। এই পর্যায়ে আমি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মনোনীত প্রার্থ হিসেবে বেশ কয়েকবার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করি কিন্তু একবারও সফলকাম হতে পারিনি। কারণ নির্বাচনের নিয়ম-নীতি এবং তাতে জয়লাভের জন্য প্রকাশ্য ও গোপনীয় কৌশল সম্পর্কে আমি একেবারেই অবহিত ছিলাম না। নির্বাচনে জেতার জন্য সাধারণত এমন সব তদবীর করা হয় যা নৈতিকতা বা শরীয়াত কোনটাই অনুমোদন করে না। যেমন মিথ্যা খবর ও প্রচার-প্রচাগান্ডা, ঘুষ-স্বেচ্ছাচারিতা ও ভয় ভীতি প্রদর্শন। এসব হাতিয়ার আমার ছিল না এবং যে দ্বীনের আমি অনুসরণ করি তার শিক্ষার মধ্যেও এগুলো ছিল না। এসব নোংরা কূটকৌশল থেকে সর্বদা আমি আমার দেহ ও আত্মাকে রক্ষা করে চলি। সাধারণ মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক খুবই ভাল। মজার ব্যাপার হলো এই যে, কালউবিয়া অঞ্চলে অফ্দ পার্টির লোকেরাও আমাকে তাদের দলের সদস্য বলে মনে করতো এমনকি হিযবুল আহরার এর দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণও আমার নাম তাদের দলের সদস্য তালিকায় লিখে নিতো। সকলের সাথেই বন্ধু প্রতীম সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। লজ্জা শরমের কারণে আমি নীরবে আমার কাজ করে যেতাম। যতদিন পর্যন্ত আমার নিকট ইসলামের সীমানা এবং হালাল হারামের চৌহদ্দি থেকে বাহির হয়ে যাওয়ার দাবী না করা হয় ততদিন তাদের সাথে আমি আমার সম্পর্ক খারাপ করতে পারি না। এ ছিল আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা। সৃষ্টিগতভাবেই আমার স্বভাব প্রকৃতি এরূপ ছিল।
আত্মপ্রচার বিমুখতা
কোন কোন সময় মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমার ছাত্রজীবনে যে সকল ছাত্র বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নির্বাচনে বিজয়ী হতো এবং যাদের নাম সমসাময়িক সংবাদপত্রে ছাপা হতো আমার নাম তাদের সাথে কেন দেখা যায় না।
এর জবাব হলো আমার স্বভাব-প্রকৃতি বড়ই বিস্ময়কর। খ্যাতি নামধাম এবং প্রচার প্রপাগান্ডার প্রতি আমার রয়েছে ঘৃণা। এখনো পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যেসব লোক আমাকে জানে তা একান্ত অনিচ্ছাকৃত ও আমার অপারগতারই ফল মাত্র। যদি আমার সাধ্যাতীত না হতো তা হলে আমি এমন সংগোপনে ও নীরবে থাকতাম যে, কেউ আমার নাম পরিচয় জানার সুযোগও পেতো না। পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। তাছাড়া দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে গিয়ে আমাকে এসব কিছুই মেনে নিতে হয়েছে। আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়ার জন্র ইখওয়ানের বাইয়াত বিশেষত নিয়তের বিশুদ্ধতার ওপর ভিত্তিশীল। ইখওয়ানের নেতৃত্বের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করা হয়েছে। ফলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সাহিত্য সাময়িকীতে আমার আলোচনা পকাশিত হতে থাকে। এতে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ব্যতীত সুনাম সুখ্যাতি সঅর্জনের উদ্দেশ্য আমার নেই। আল্লাহ তায়ালা তো অন্তর্যামী। তিনি মানুষের নিয়ম ও মনের অবস্থা খুব ভালভাবেই জানেন। হৃদয়ের গভীরে লুকায়িত গোপনীয় সবিষয়টাও তিনি ভালভাবে জানেন।
আপনি দেখছেন যে পারিবারিক পরিবেশে আমি জন্মগ্রহণ করেছি তা ছিল অনাবিল দ্বীনি পরিবেশ। আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছাও সর্বদা এই ছিল যে, নিষ্ফল ও অনর্থক কাজকর্ম থেকে আত্মরক্ষা করে চলি। আমার মরহুম পিতার কঠোর তত্বাবধান এবং স্বীয় সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য তার বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন এসব কিছুর সমন্বয়ে গঠিত একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রভাব আমার নীরব প্রকৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। তাছাড়া আমি সর্বদা গুণীজনদের মজলীশে গিয়ে বসা এবঙ তাদের সাথে চলাফেরা করারও প্রয়াস পেতে থাকি। তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকা ছিল আমার দ্বিতীয় চারিত্রক বৈশিষ্ট্য। কৃত্রিমতা আমি কখনো পসন্দ করি না। আমি অন্যদের আবেগ অনুভূতির প্রতি সর্বদা সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। এসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমার এই ব্যক্তিত্ব গঠন করেছে আজ যা আপনারা আমার মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন।
আমার মনের একটা দৃঢ় সংকল্প হচ্ছে, আমার কোন কথা ও আচরণ দ্বারা আমি কখনো কোন মানুষের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবো না। কেউ আমাকে কোন কষ্ট দিলে বা ক্ষতি করলেও না। ব্যক্তিগত জীবনে আদর্শগতভাবে আমি তার বিরোধী হলেও না। এ কারণে আজীবন কোন ব্যক্তিগত ব্যাপারে কখনো কোন লোকের সাথে আমার কোন প্রকার বিরোধ ও সংঘাত হয়নি। অবশ্য দাওয়াতে হকের আন্দোলনে কিছু লোক আমার সাথে সীমাহীন দুর্ব্যবহার করেছে। কিন্তু তাদের সেই অত্যাচার ও নির্যাতনের মোকাবেলায় আমি এই সান্ত্বনাই পেতে চেষ্টা করতাম যে, আমি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত তাদের জুলুম ও নিপীড়ন আমার ব্যক্তিগত কোন অশোভনীয় আচরণের ফল নয় বরং তাদের ইসলাম বিদ্বেষী মানষিকতা-ই এর মূল কারণ। আমি তাদের সকল অত্যাচার উৎপীড়ন অত্যন্ত ধৈর্য ও স্থৈর্যের সাতে ষহ্য করেছি এবং কোন প্রকার অভিযোগ ও অসন্তোষ প্রকাশ না করেই জালিমদের মোকদ্দমা মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে এসেছি। ইবরাহীম আবদুল হাদী মরহুম এবং জামাল আবদুল নাসের মরহুমের হাতে বর্ণনাতীত অত্যাচার সহ্য করেছি। তথাপি আমি কখনো তাদের সম্পর্কে আমার অন্তরে না কোন প্রতিহিংসা লালন করেছি, না কোন অশালীন বাক্য প্রয়োগ করেছি। তা করার প্রয়োজনই বা আমার কি। যখন পুরো বিষয়টা সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, মহাপরাক্রমশালী ও অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার মালিকের নিকট সোপর্দ করা আছে। তখন তাঁর ফায়সালার প্রতি কৃকজ্ঞ ও পরিতৃপ্ত থাকাই আমার কর্তব্য।