বত্রিশতম অধ্যায়
আশা আকাংখা ক্ষীণ কিন্তু উদ্দেশ্য মহান
অনেক দু’মুর্শিদে আ’ম ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ এবং সাইয়েদ হাসান আল হুদাইবি (র) মরহুমগণের ব্যক্তিত্বের মধ্যে তুলনা করে থাকেন। দু’ব্যক্তিত্বের মধ্যে কয়েকটি যুক্ত বৈশিষ্ট ছিল। আবার কতগুলো গুণাবলীতে একজন ছিলেন অপরজন অপেক্ষা ভিন্নতর ও ব্যতিক্রম। দু’ব্যক্তিত্বের দৃষ্টিভংগি প্রাথমিক শিক্ষা এবং বাস্তব কর্মজীবনের সূচনা লঘ্ন এবং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র ছিল বিশেষ ধরনের। কিছুলোক বড়ই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে থাকেন এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সূক্ষ্মতিসূক্ষ্মভাবে বিন্যস্ত করে থাকেন। কিছু কিছু লোক এসব বই পুস্তক পাঠ করে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন। পক্ষান্তরে অনেকে আবার এরূপ তুখোর সমালোচনা এ প্রক্রিয়া আদৌ পছন্দ করেন না। আমার দৃষ্টিতে সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনার এ প্রক্রিয়া আদৌ পছন্দ করেন না। আমার দৃষ্টিতে সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, পাঠকদের সম্মুখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বকে তার-রূপে উপস্থাপন করা উচিত। যাতে করে তারা এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, যে ব্যক্তির জীবনালেখ্য তারা পাঠ করছে সে যেন ব্যক্তিগতভাবে তাদের বহুল পরিচিত। তারা যেন চক্ষষভাবে তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হচ্ছে। যতদুর ইখওয়ানুল মুসলিমুনের যোগসূত্র রয়েছে তারা সকলেই তাদের মুর্শিদের হাতে আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থেই বাইয়াত করেছিলো। এ বাইয়াতের শর্ত পূরণ করাই হচ্ছে আসল কাজ। বাকী থেকে গুরুত্ব নেই। তারা শুধু জানে যে, যে ব্যক্তিত্বের হাতে হাত রেখে তারা বাইয়াতের শপথ গ্রহণ করেছে তিনি তার জীবনকে কেবলমাত্র আল্লাহর দ্বীনের জন্যই ওয়াক্ফ করে দিয়েছেন।
চিত্তাকর্ষক বাচনভংগী ও মনোসুগ্ধকর দৃষ্টি
আমি ইখওয়ানের একজন কর্মী হিসেবে দু’মুর্শিদে আ’ম-এর হাতেই বাইয়াত করেছিলাম। এ পর্যায়ে প্রসংগক্রমে প্রথম মুর্শিদ সম্পর্কে দ্বীতিয় মুর্শিদের মন্তব্য কিংবা বিবৃতি পেশ করার জন্য মুখ খুলতেন তখন জনগণের লোভাতুর দৃষ্টি তার চেহারার প্রতি পলকহীনভাবে পড়ে থাকতো এবং পত্যেক ব্যক্তি গভীন মনোযোগ সহকারে তার কথাবর্তা শুনতে থাকতো। তার মুখ থেকে শব্দমালা হিরা, মতি ও পান্নার ন্যায় ঝরে পড়তো এবং শ্রোতাদের হৃদয়ের গভীর গ্রথিত ও প্রোথিত হয়ে যেতো। বক্তৃতা চলাকালীন সময়ে উপস্থিত জনতা এমন নীরব নিথর হয়ে শুনতো যেন তাদের মাথার ওপর পাখী বসে রয়েছে। তাদের অন্তর বক্তার মুষ্টিতে আবদ্ধ। আবার যখন তার ভাষণ সমাপ্ত হয়ে যেতো তারপর গিয়ে লোকদের অন্তরাত্মা পুনরায় তাদের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসতো এবং তারা প্রশান্ত প্ররিতৃপ্ত অন্তকরণ নিয়ে ঘরে ফিরে যেতো। কিন্তু আমার অবস্থা হতো সর্বাপেক্ষা ব্যতিক্রমধর্মী। আমি তার বাগ্মিতাপূর্ণ আলোচনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আমার মনকে মহান বক্তার নিকট রেখে দিয়েই গৃহ অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যেতাম।”
আন্তর ও দৃষ্টির মুসলিম
ইমাম শহীদ যে দাওয়াতের সূচনা করে গেছেন তা আল্লাহর ফজল ও অনুগ্রহে উজ্জল সূর্যর দীপ্তির ন্যায় দীপ্তিমান হয়ে থাকবে। যার সম্মুখে তারকারাজির ঔজ্জ্বল্যও ম্লান হয়ে যায়। সুর্য যদিও দিনের বেলায় প্রখর আলোয় ভরপুর থাকে। কিন্তু রাতের আগমনের সাথে সাথে অস্তমিত হয়ে যায়। অপরদিকে এ দাওয়াত কখনো হারিয়ে যাওয়ার নয়। ইহার রৌশনী চিরন্তন এবং উহার দীপ্তি চির বসন্তে ভরা। যদি সময় পশ্চাৎগামী হয়ে পড়ে এবং সে সুদিন পুনরায় ফিরে আসে যেদিন শহীদ মুর্শিদের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিলো। আর আমাকে বলা হবে যে, আমি আমার জীবনের জন্য কোন পথ অবলম্বন করতে চাই? তাহলে আমি নিঃসংকোচে ও কোনরূপ ইতস্তত না করেই সে কর্মপন্থাই অবলম্বন করবো যার ওপর আমি আজীবন চলে আসছি। এটা হচ্ছে সে রাস্তা যার প্রতি আল্লাহ তায়ালা অন্যাকে হেদায়াত করেছেন এবং যার উপলক্ষ হয়েছিলেন ইমাম শহীদ নিজে। হেদায়াত প্রদানের ক্ষমতা অবশ্য আল্লাহ তায়ালার হাতেই নিবন্ধ কিন্তু আমার নিকট পর্যন্ত এ বাস্তবতা ইমাম শহীদের মাধ্যমেই পৌঁছেছিল।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত আমার সামনে সে সত্য উন্মোচিত করে দিয়েছিল যে সন্বন্ধে আমি ছিলাম একেবারেই না- ওয়াকিফ ও অনবাহিত। এমনিতেই তো পৃথিবীতে অগণিত মুসলিম বাস করেছে কিন্তু যাদের অন্তর ইসলাম ও মুসলিমদের মহব্বতে পরিপূর্ণ তাদের সংখ্যা খুব বেশী নয়। আমি নিজে আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করছি যে, এ আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে নিজে আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করছি যে, এ আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে আমি ঈমানের বিভিন্ন উপাদান ও উপকরণ সম্পর্কে সম্যকভাবে পরিজ্ঞাত হয়েছি। যদি কোন মুসলিম উত্তর মেরুতে ভুখা থাকে তাহলে তা শুনে আমি আমার হৃদয়ে ব্যথা অনুভব করে থাকি। পৃথিবীর যে কোন প্রন্তে কোন মজলুম মুসলিমের একবিন্দু রক্ত মাটিতে ঝরে পড়ে তাহলে আমার মনে হয় যেন আমার নিজের শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়ে যা্চ্ছে। কোন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার ওপর যদি কোন দুশমন হাত তোলে তখন আমার রাতের নিদ্রা হারাম হয়ে যায়। আমার মনে হয় যেন আমার বসত বাড়ীর ওপর শত্রু তার প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে।
এ আন্দোলন আমার মধ্যে এ অনুভূতিরও সঞ্চার করেছে যে, আমার পকেটে যা কিছু রয়েছে উহা আমার মালিকানাধীন নয় বরং এটা আমার নিকট আমানত রাখা হয়েছে মাত্র। ইমাম শহীদ দাওয়াতী কার্যক্রমের প্রারম্ভেই ইখওয়ানের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন যে, প্রত্যেকে নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সংগঠনকে আর্থিক সহযোগিতা দান করবে। ইহা কোন পূর্ব নির্ধারিত চাঁদ ছিল না। বরং প্রত্যেকের পরিপূর্ণ আযাদী ও ইখতিয়ার ছিল যে যতটুকু পারে আর্থিক কুরবানীর মহড়া প্রদর্শন করতে থাকবে। ইখওয়ান এ ময়দানে তাদের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কখনো কাপর্ণ্য করতো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজে নিজের ব্যাপারে কখানো এতটুকুন চিন্তাক্লিষ্ট ছিলাম না যতটুকু আমি আমার অন্যান্য মুসলিম ভাই বন্ধুদের চিন্তায় সর্বদা অস্থির থাকতাম। জীবনতো এরই নাম যে মানুষ অন্যদের জন্য ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করতে থাকবে। এক্ষেত্রে মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। একশ্রেণীর লোক তো কবির ভাষায় এমন কথাও বলে বেড়ায় যে, যদি তাদের বৃষ্টির নেয়ামত দ্বারা সিক্ত না করা হয় তথাপি তারা এ ব্যাপারে প্রশান্তিই থাকে যে কোথাও না কোথাও রহমতের বৃষ্টির ধারা জমিনকে সিক্ত করে থাকবে এবং তাদ্বারা মানবজাতি উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে। এরূপ নির্লিপ্ত ও সভ্রান্ত লোকের সংখ্যা খুব কমই তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগতপ্রাণ হয়ে পড়ি কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে যাই তবুও যেন মর্তের মাটিতে একফোটা বারিবিন্দুও নাজিল না হয় যাতে করে ছোট বড় সকলেই আমার মত অসহায়ভাবে পিপাসার হাতে মৃত্যুর শিকার হয়ে যায়।
বাঁচার জন্য খাওয়া নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচা
দু’দলের লোকই দুনিয়াতে পাওয়া যায় এবং আপনাপন ঋণাবদ্ধ জীবন প্রত্যেকেই অতিবাহিত করে নেয়। কিন্তু এতদুভয়ের মধ্যে আসমান জমিনের ফারাক রয়েছে। এক গ্রুপ এজন্য খেয়ে থাকে যে বেঁচে থাকতে হবে। অপরদিকে অপর গ্রুপ এজন্য জীবিত থাকে যেন খাওয়ার সুযোগ লাভ করতে পারে। অর্থাৎ “বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ করা” খাওয়ার সুযোগ লাভ করার জন্য বেঁচে থাকা” এর মূলনীতির ওপর উভয় সম্প্রদায়ই কর্মতৎপর। এক কুয়া পানিতে কানায় কানায় ভরে উঠে; পক্ষান্তরে অন্য কূপ সম্পূর্ণ শুষ্ক ও পনিশূন্য জমিনের এমন একটা টুকরা হয়ে থাক যে, এগুলোতে যদি পানি সিঞ্চন করা হয় তাহলে উভয়টিতেই জীবনের সঞ্চার হয়ে থাকে। কোন কোন ভূ-খন্ড পানিতে সিক্ত হওয়ার পর নিরেট পাথরের রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। না উহাতে বীজ অম্কুরিত হয় আর না চারা গজায়। এমনি করে জীবনের কয়েক রূপ পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে। যে ধ্বংসশীল ও অস্থায়ী জীবন গড়ার চিন্তায় অস্থির থাকে এবং অন্য কারো মংগল ও কল্যাণের ধারণা পর্যান্ত কখনো হৃদয় মনে স্থান দিতে না পারে তার ধ্বংসের ব্যাপারে আর কি সন্দেহ থাকতে পারে। সেতো ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।
মানবসমাজকে অন্ধকারের কুহেলিকা থেকে বের করে উজ্জল আলোয় নিয়ে আসা এবং নির্যাতন, নিষ্পেষণ এবং দাসত্ব ও গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন করে মানবতাকে আযাদী ও স্বাধীনতার নেয়ামত প্রদানকারী আল্লাহর বান্দাহগণের সংখ্যায় খুব কমই হয়ে থাকেন। এসব জীবন্ত মানুষগুলো সত্যের ওপর কায়েম থাকে। যদিও দুনিয়া তাদের শত বিরোধিতাই করুক না কেন। মানুষ কি সে ঐতিহাসিক কাহিনী সম্পর্কে অবহিত নয় যাতে একটা নওজোয়ান ছেলে তার জাতিকে জাগিয়ে তোলে এবং সমকালীন শাসকের অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তাদেরকে প্রতিবাদী ও ক্ষিপ্ত করে তোলা। জালিম বাদশাহ সে দুঃসাহসী ছেলেটিকে হত্যা করে তার ছোবল থেকে রক্ষা পেতে চাইলো কিন্তু যুবকের ওপর কোর অন্ত্রই কার্যকরী করা গেলো না। শেষ পর্যন্ত বাদশাহ সে ছেলেটিকে তার নিকট ডেকে পাঠায় এবং তাকে বলে, “তুমি আমার প্রজাসাধারণকে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উত্তেজিত করে দিয়েছো। আর আমি তোমাকে খতম করার জন্য যে কৌশলই পয়োগ করি তা-ই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তুমি কারো সম্মুখেই তোমার মস্তকাবনত করতে চাও না। এখন তুমিই আমাকে বলে দাও যে, আমি কি উপায়ে তোমার হাত থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি? প্রত্যৃত্তরে নওজোয়ান বলতে লাগলো,- “আপনি অকারণে শুধু শুধুই এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন- এটা তো খুবই সহজ কাজ।” বাদশাহ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তা কি রূপ সম্ভব?” ছেলেটি জবাবে বলতে শুরু করলো, “ঈদের দিন চাশতের সময় সমস্ত দেশবাসীক একটা খোলা ময়দানে সমবেত হওয়ার আদেশ জারী করে দিন এবং সমাগত আপামর জনতার সামনে আমাকে কোন উচূ জায়গায় দাঁড় করিয়ে তরিন্দাজকে হুকুম দিয়ে দিন যেন সে আমার বক্ষ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তীর ছোড়ার পুর্বে যেন সে বলে দেয়, এই ছেলের রবের নামে।”
বাদশাহ সে ছেলেটের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করেন। ছেলেটি তীরন্দাজের অব্যর্থ তীরের আঘাতে মাটিতে ঢলে পড়লো এবং শাহাদাতের মর্যাদালাভে ধন্য হয়ে গেলো। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনতার সকলেই একযোগে কালেমায়ে তাওহীদের ওপর ঈমান আনলো। ফলে অবোধ বাদশাহর জন্য অপমান, আফসোস ও শোচনীয় পরাজয় ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। এ নওজোয়ান যে সত্যবাদিতার জন্য তার জীবনের বাজী লাগাতে প্রস্তুত হয়ে গেলো সে দুনিয়া এবং আখেরাত দু’প্রতিযোগিতাতেই একযোগে জিতে গেলো। এ নওজোয়ানের ন্যায় ইখওয়ানের আন্দোলনের পতাকা ওপরে তুলে ধারণকারী নওজোয়ানগণও প্রবল আত্মত্যাগের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত। যত প্রতিবন্ধকতা এবং বাধার পাহাড়ই তাদের চলার পথে এনে দাঁড় করিয়ৈ দেয়া হউক না কেন তারা কিছুতেই পরাজয় মেনে নিতে আদৌ প্রস্তুত হবে না। যেদিন সমস্ত বাধা-বিপত্তি সরে যাবে তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে যাবে এবং সমগ্র দুনিয়াবাসী দেখতে পাবে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন কেব ছিলেন? এরা হচ্ছে ওসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদের জন্য আল্লাহর কিতাবে শাক্তি,কামিয়াবী ও বিজয়ের ওয়াদা রয়েছে।
আমাদের মত কেউই নয়
এটা কতই না আফসোস ও দুঃখজনক কথা যে, আমাদের দেশের সমস্ত সংবাদপত্র ও সাহিত্য সাময়িকী সকল ব্যাপারেই নেতিবাচক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভংগি পেশ করে থাকে। কিন্তু ইখওয়ান সম্পর্কে তাদের মনোভাব সম্পুর্ণ ব্যতিক্রম। ইখওয়ানের মধ্যে কোন ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় দিক তার দেখতে পায় না। তাদের নিকট ইখওয়ান আপাদমস্তক নিকৃষ্ট, ঘৃণীত অবাঞ্ছিত মাত্র।
ইখওয়ান আল্লাহর অনুগ্রহে সমস্ত দুনিয়া থেকে নির্লিপ্ত ও অমুখাপেক্ষী। এমনকি তারা কারো সমীপে কখনো এমন কোন আবেদনও জানায় না যে, তাদের প্রতি একটু পক্ষপাতিত্ব কার হোক। কিন্তু সাংবাদিকতার অন্যতম কর্তব্য হচ্ছে এই যে, সাংবাদিক সকল পক্ষপাতমুক্ত এবং ইনসাফপূর্ণ আচরণ অবলম্বন করবে। সত্য থেকে বিমুখ ও বিচ্যুত লোক যেসব গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকে সেগুলো সম্পর্কে ছোট বড় সকলেই অবগত হয়ে যায়। আমাদের সাথে ওসব লোকরে আচরণ খুবই দুঃখজনক তো বটেই কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। এরা হক থেকে বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
১৯৫২ সালের ২৩শে জুলাই বিপ্লবের সময় ইখওয়ানের কীর্তীকলা্প সম্পর্কে কে না জানে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে নাসের এবং অপরাপর আযাদ অফিসারগণের যোগাযোগের ব্যাপারে কোন সাংবাদিকই না-ওয়াফিক নন। আযাদ অফিসারগন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সহকারী মুর্শিদে আ’ম মেজর মাহমুদ লাবীবের শাগরেদ ছিলেন। এসব বাস্তবতা সম্বন্ধে তারা কিছুই না জানার ভান করছিল। এমনকি তারা ইখওয়ানকে বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের দুশমনরূপে চিহ্নিত করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সাংবাদপত্রগুলো নিমক হালালী করার প্রয়াস পেতো। এটা কি কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা নাকি ধীরস্থির মস্তিষ্কের পূর্ব পরিকল্পনা? মিসরে বিগত কয়েক শতাব্দি পূর্বে জনৈক ফেরাউন এরূপ আচরণরই করেছিল। আমীস সানী বা দ্বিতীয় আমীস যখন ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হন তখন তিনি তার পূর্ববর্তী সকল ফেরাউনের সমস্ত কীর্তিকলাপ ও নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে ফেলার নির্দেশ প্রদান করেন। যাতে করে ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায় তারই নামের অংশবিশেষে পরিণত হয়ে যায়। নব্য যুগের ফেরাউনও অনুরূপ আচরণেই পুনরাবৃত্তি ঘটানোর প্রয়াস পায়। দাওয়াতে ইসলামের বিরোধিতায় বিভিন্ন শাসনকর্তাগণ তাদের ব্যক্তিগত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একই কর্মনীতি অবলম্বন করে থাকে। বৃদ্ধিজীবি, বিশেষজ্ঞ, ওয়াকিফহাল মহলা এবং সংবাদপত্রসেবীদের নিকট প্রশ্ন রাখতে চাই, অন্ততপক্ষে সন্তব্য করুন-এ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ কি না?
সাইয়েদ কুতুব শহীদ
সাইয়েদ কুতুব শহীদ মিসরীয় ভূ-খন্ডের সে গৌরবোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব যিনি সর্বদা বেঁচে থাকবেন। সেইয়েদ কুতুবের ক্ষুরধার লিখনীর দ্বারা বহু গ্রন্থ প্রণীত ও সংকলিত হয়। এসব অমূল্য গ্রন্থের জ্ঞানগত মান খুবই উন্নত এবং লিখার গতি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ছিল। এমনিতেই তো তিনি সকল বিষয়ের ওপর কলম ধরেছিলেন এবং চমৎকার উপস্থাপনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তন্মোধ্যে তার বাক যুদ্ধ সম্বলিত তাফসীর “ফি জ্বিলালিল কুবআনিল ইজতিমাইয়া” এবং “মু্আলিমুন ফিত্ তরীক” বাস্তবিকই অতুলনীয় সৃষ্টি।{* “ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা” নামে এ বইটি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে।}
সাইয়েদ কুতুব শহীদের সংকলনসমূহ সকল জাহেলিয়াত ও জুলুমের বিরুদ্ধে যেহায়েত কার্যকরী ও বলিষ্ঠ আওয়াজ এবং সমগ্র মানবজাতির অধিকারের পতাকাবাহী। সাইয়েদ শহীদের দৃষ্টিকোণ ছিল এই যে, আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত হালাল হারামের ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক। সাইয়েদ শহীদ ইসলামের ওপর গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তার সাথে সাথে আধুনিক সভ্যতার ওপরও ছিল তাঁর প্রাগাঢ় পন্ডিত্য। তিনি উন্নত বিশ্বের বিরাজমান পরিস্থিতির চুলচোরা বিশ্লেষণ ও সার্বিক মূল্যায়ন করার প্রয়াস পান। তাদের সামাজিক স্বাধীনতার গভীর প্রবেশ করেন। অনন্তর উম্মতে মুসলিমাকে আজীবন এ সত্য বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, শরীয়াতে ইলাহিয়া প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই মানবতার সত্যিকার মুক্তি এবং দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি অর্জন করার করতে পারে আর না পকৃত মুক্তি লাভ করতে পারে।
“মুয়ালিমুন ফিত্ তরীক” ছিল তার এমন জ্বালাময়ী প্রন্থ যাকে উপলক্ষ বানিয়ে সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা-চেতনায় কোন নিত্য নতুন ও অদ্ভূদ অভিনব চিন্তাধারার সামাবেশ ঘটেনি। বরং তার সমৃদয় লিখনী সে বুনিয়াদী চিন্তা-ভবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে যার উল্লেখ আমরা ওপরে করে এসেছি। এ শহীদ কারাগারে বসেই লিখেছিলেন। জেলখানার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে যেরূপ দানবীয় ও নারকীয় হিংস্রতা ও বর্বরতার চরম পরাকাষ্ঠ প্রদর্শন করতো সরকারী গোমস্তাগণ সে ভয়াল দৃশ্য দেখে প্রত্যেক সভ্রান্ত ব্যক্তি মাত্রেরই হৃদয় আলোড়িত ও প্রকম্পিত না হয়ে পারে না। সাইয়েদ কুতুব ছিলেন তীক্ষ্ণ অনুভুতিপবণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি এসব দৃশ্য দেখে তার সে চিন্তা। চেতনাকে শরীয়াতে ইসলামীয়ার বাস্তবায়নকে মুসলিম জীবনের সর্বাধিক মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে নির্ধারণ করেছেন এবং অত্যান্ত বলিষ্ঠ ভংগিতে এ অমূল্য প্রন্থে তা উপস্থাপন করে দিয়েছেন। শরীয়াত বিরোধী সকল আইন- কানুনের সর্বদা প্রবল বিরোধী ছিলেন তিনি। কিন্তু এ বইতে তাঁর কলমের গতি ছিল উদীয়মান।
সাইয়েদ কুতুব শহীদের ওপর মিথ্যা অভিযোগসমূহ
সাইয়েদ কুতুবের ওপর এ দোষারোপ করা কয়েছিল যে, তিনি দেশের মানুষকে কাফের মনে করে থাকেন। এ অভিযোগ ছিল ডাহা মিথ্যার বেসাতি মাত্র। তিনি কখানো কোন মুসলিমকে কাফের বলে অভিমত ব্যক্ত করেননি। তার ভলভাবেই জানা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশ কিছু সংখ্যক হাদীসে ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার মন দিয়ে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু’- এর ওপর ঈমান আনবে সে কিছুতেই চিরদিন দোজখে থাকবে না। আমাদেরও দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, জাহান্নামের চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে কাফেরদেরই। কেননা তারা মহাপরাক্রমাশালী সর্বশক্তিমান আল্লাহ একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বের অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী। তিনি তার গতিশীল লিখনীতে জাহেলীয়াতের সামাজিক পাভিাষার বহুল ব্যবহার করেন। এ প্রচলন দ্বারা সমাজকে কাফের প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য তার কখনো ছিল না। বরং জালিম, তাগুত, অসভ্য ও সংশয়গ্রস্থদের স্বরূপ উদঘাটনই তার মূল লক্ষ্য।
আরবী ভাষায় সুস্পষ্ট বর্ণনাভংগী জানা আবশ্যক। কোন একটা শব্দের শাব্দিক অর্থ নিয়ে সারিষার পাহাড় রচনা করা ও তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে বসা বড়ই বেমানান এবং অবিবেচনা প্রসুত কর্মপদ্ধতি। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত কুরআন মজীদে কাফেরদের ব্যাপরে ইরশাদ করেছেন-(আরবী**************) “অর্থাৎ কাফেরদেরকে মর্মপীড়াদায়ক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।”-সূরা তাওবাঃ ৩
এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে দোজখের কঠিন এবং কঠোর আযাব থেকে ভয় দেখানো আর উহার তীব্রতা ও ভয়াবহতা প্রকাশ করা। কিন্তু এ লক্ষ্যার্জনের জন্যও বিশারত ব সুখবর শব্দই প্রয়োগ করা হয়েছে। যা সাধারণত সচ্ছল অবস্থ, প্রাচুর্য ও কল্যাণের জন্য ব্যাবহৃত হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা) তার বহু হাদীসে বর্ণনা করেছেন। যেখানে এসব শব্দ থেকেও ওলামায়ে উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশিষ্ট ব্যক্তিকে কাফের সাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয় বরং আলোচ্য আমলের অনিষ্ঠকারিতা বর্ণনা করে মানুষের উহা থেকে বিরত রাখাই মূল উদ্দেশ্য। যেসব লোক সাইয়েদ কুতুব শহীদকে জানে তারাই একথার সা্ক্ষ্য প্রদান করবে যে, তিনি ছিলেন উন্নত চরিত্র ও সম্ভ্রান্ত আচার ব্যাবহারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামী শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধকে তিনি সর্বদা সম্মুখে রাখতেন। কাউকে কাফেল বলে অভিযুক্ত করা ছিল তার স্বভাব প্রকৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তিনি ছিলেন তাঁর সমসাময়িক ইসলামের দায়ীগণের শীর্ষস্থানীয়। যে সমস্ত লোক তার লিখনী থেকে তাদের মর্জি বিরোধী উদ্ধৃতি উদ্ধার করে সেগুলোর মনগড়া অর্থ বর্ণনা করে তাদের জালিম রূপে অভিহিত হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ-সংশয়েল অবকাশ নেই। তার তেজদীপ্ত লিখনী যা যুব মানস ও বর্তমান প্রজন্মকে খুবই প্রভাবিত ও আলোড়িত করতে সক্ষম হচ্ছিলো এবং তার অকৃত্রিম ভালবাসা, অনুরাগ ও সম্মানবোধের প্রেরণা পাঠকদের মনে দানা বাঁধাছিল। আর এ জিনিসই তাগুতি শক্তিগলোর অন্তরে কন্টকের ন্যায় প্রবিষ্ট হচ্ছিলো। তাইতো তারা নিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে, এ মুজাহিদকে পথ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
সাইয়েদ কুতুব শহীদের ব্যক্তিত্ব ও সংকলন সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে হলে প্রচৃর সময়ের পয়োজন। এত স্বল্প সময়ে বিষয়বস্তুর হক আদায় করা যাবে না। “মুয়ালিমুন ফিত্ তারীক” বা “ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা” –এর বিষয়বস্তু যে কেন্দ্রেীয় প্রতিপাদ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে তার সারনির্যাস ওপরে কর্ণনা করা হয়েছে। আমি সুধী পাঠকগণের সম্মুখে আরও আরজ করবো যে, “মুয়ালিমুন ফিত্ তারীক” মুদ্রণ ও প্রকাশের পুর্বে উহার পান্ডলিপি দেখার সৌভাগ্য আমার লিমান তারাস্থ জেলখানার হাসপাতালে বসে হয়েছিল। অদ্যাবধি এ অমূল্য কিতাবখানি রাহে হকের মুসাফিরগণকে মনজিল ও অভিষ্ট লক্ষ্যপানে পথপ্রদর্শন করে চলেছে।
সাইয়েদ কুতুব সম্পর্কে আমি অতি সংক্ষেপে যা কিছু আরজ করলাম তাই যথেষ্ট। কেননা তিনি কোন পরিচিতির মুখাপেক্ষী নন। প্রসংগক্রমে আমি এখানে আরো একটি কথা যোগ করতে চাই। আমরা তখন জেলে আটক ছিলাম। ইত্যবসরে সাইয়েদ কুতুব শহীদেকে সরকার মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এ মুক্তি লাভের পর পুনরায় তাকে গ্রেফতার করে ফেলা হয়। এবারে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রেহিতার মোকাদ্দমা দায়ের করা হয় এবং তাকে ফাঁসির সাজার ডিক্রী শুনানো হয়। ছাড়া পাওয়ার পর সাইয়েদ কুতুব জেলখানায় আমাকে পয়গাম দিয়ে পাঠান যে, ইরাকী সরকার তাকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ অলম্কৃত করার জন্য আমান্ত্রণ জানিয়ে পাঠিয়েছেন। সাইয়েদ শহীদ আমার নিকট এ প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে পরামর্শ কামনা করেন। আমি তাকে এ মর্মে পরামর্শ প্রদান করলাম যে, এ আমন্ত্রণ আপনি স্বাদরে গ্রহন করুন এবং অবিলম্ব ইরাকের উদ্দেশ্যে মিসর ত্যাগ করুন। বিপ্লবীদের অসৎ উদ্দেশ্য আমি লক্ষ্য করছি ও দেখতে পাচ্ছি। এমনকি স্বয়ং সাইয়েদ শহীদের জীবনই আমি খুব বিপদাপন্ন বলে মনে করছিলাম। আমার এ পরামর্শ প্রদানের পরও সাইয়েদ কুতুব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে, স্বীয় মতামত এবং তার পান্ডিত্যপূর্ণ ধ্যান ধারণা প্রতিহত করার জন্য তাকে মিসরেই অবস্থান করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা যঙা কিছু নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা থেকে পালিয়ে বাঁচার কোন উপায় ছিল না। আর না কোন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ তা হটিয়ে দিতে সক্ষম। আবদুল ফাত্তাহ ইসমাঈল শহীদও আমাদের আন্দোলনের অপর এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যার দীপ্তি হথ হার পথিকদের পথ দেখাতে থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে আবদুল ফাত্তাহ শহীদের ব্যাপারে বেশী কিছু জানার সুযোগ পাইনি। কেননা যখন তাকে ফাঁসির শাস্তি প্রদান করা হয় তখন আমি দীর্ঘ দিন যাবত কারগারের সাজা ভোগ করছিলাম এবং আমাকে কাটাতে হয়েছিল বিভিন্ন জিন্দানখানার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে।
আবদুর রহমান সিন্ধী মরহুম আন্দোলনের গোড়ার দিকে ছিলেন সংগঠনের বড়ই অনুগত এবং ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের অনুসরণে ছিলেন সর্বপেক্ষা অগ্রগামী। ইখওয়ানের সামরিক বিভাগ (বিশেষ বিভাগ)- এর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল তার ওপর। কিন্তু দুর্ভগ্যক্রমে শয়তার তাঁর মনে কুমন্ত্রণা দিতে সক্ষম হয় যে ইখওয়ানের সদম্যগণ মুর্শিদে আ’ম অপেক্ষাও তার বেশী অনগত। ফলে তিনি মুর্শিদে আ’ম- এর মোকোবেলায় তার নিজের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে ও প্রকাশ করতে শুরু করলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে খুব বেশী অগ্রসর হতে পারলেন না। ইতিমধ্যেই মুর্শিদে আ’মকে শহীদ করে ফেলা হয়। অতপর যখন হাসান আল হুদাইবি মরহুমকে মুর্শিদে আ’ম হেসেবে মনোনীত করা হয় তখন আবদুর রহমান সিন্ধী মরহুম তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও নগ্নভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করে এসেছি। সাথে সাথে ইখওয়ান সিন্ধী মরহুম এবং তার পৃষ্ঠপোষকদেরকে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানিযে দেন যে, তারা তাদের মুর্শিদে আ’ম-এর মোকাবেলায় অপর কোন ব্যক্তিত্বকে কোন প্রকার গুরুত্বই প্রদান করে না। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইখওয়ান সদস্যগণও সিন্ধী সাহেববে বুঝিয়ে দেন যে, মুর্শিদে আ’ম-এর নিদের্শ ক্রমেই তারা তার আনুগত্য করে আসছে। এক্ষণে তার বিদ্রোহের পর তারা কিছুতেই তার অনুগত নয়। অনন্তর সিন্ধি সাহেব ইনতিকাল করেন। আল্লাহ তায়ালা তার ওপর রহমত নাজিল করুন। আমি কবরস্থ মৃত মানুষের লাশ কিছুতেই তুলে আনার পক্ষপাতি নই। আমি সমালোচনা করতে চাই না। অবশ্য সাংগঠনিক স্বার্থে এতটুকু বলতে হবে যে, আমানত রাখা বস্তু সতর্কতার সাথে হেফাজত করা কর্তব্য এবং পরিস্থিতি যে দিকেই মোড় নিক না কেন নিজের সংগঠনের খবরাদি সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। সিন্ধী সাহেবের ওপর নাসের এমন প্রভাব ফেলেন যে তিনি শুধু তার গুণগ্রাহী হয়েই ক্ষান্ত হননি বরং সংগঠনের আদিঅন্ত সব বৃত্তান্ত তার নিকট ফাঁস করে দেন। দুনিয়া থেকে চলে গেছেন তারা আর প্রতিরোধমূলক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। তাদের নিয়ে সমালোচনা মুখর হয়ে ওঠকে আমি শরাফত ও শালীনতা পরিপন্থি বলে মনে করি। উলামা ও বিশেষজ্ঞগণ, সমাজ বিজ্ঞান ও নৈতিক চরিত্রকে এভাবে বিন্নস্ত ও সংগঠিত করে গেছেন। গোপনীয়তা রক্ষা করার অংগীকার ভংগ করার ওপর সম্যকরূপে অবগত হয়ে এবং বিষয়ভিত্তিকভাবে কলম ধারণ করা উচিত।
আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ
আবদুল কাদের আওদাহ শহীদের স্মৃতিকথা আমার অন্তরে জাগরুক রয়েছে। তিনি ইখওয়ানের সহকারী মুর্শিদে আ’ম-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি পান্ডিত্য ও যোগ্যতার জীবন্ত আদর্শ এবং বিচারলয়ের স্বনামধন্য বিচারপতি ছিলেন। স্মৃতির বাতায়নে উকি দিয়ে দেখতে গিয়ে আমি সে ঘটনাকে আমার কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি যখন আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ আদালতের জজ ছিলেন্ তখন কোন কোন ইখওয়ান ভাইকে কোন মোকদ্দমায় তাঁর আদালতে পেশ করা হয়। ইখওয়ান ভ্রাতাগণের বিপক্ষে লড়েন বড়ই অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ কৌশুলিগণ। তারা আইনের খুবেই সূক্ষ্ম মারপ্যাচ উপস্থাপন করেন আদালতে। এদিকে আবদুল কাদের আওদাহ শুধু একজন জজ মাত্রই ছিলেন না যে, শুধু উকিলগণের যুক্তিপ্রমাণের ওপরই তাকে নির্ভর করতে হবে। বরং তিনি নিজেও আইন শাস্ত্রের ওপর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি রাখতেন। ফলে তিনি আসামী ও অভিযুক্তদের বেকুসুর খালাস করে দেন। এবং তার ফায়সালার পথার্থতার পক্ষে এমন সব দলিল পেশ করেন যেগুলোর ভিত্তিতে তিনি তাদের নির্দোষ হওয়ার নির্দেশ জারী করেন। দু’পক্ষের আইনজীবিগণ আওদাহ যুক্তি-প্রমাণ এবং সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম তত্ত্ব তথ্যের মোকাবেলায় তাদের আইন বিষয়ক ধারণাকে খুবই অপ্রতুল বলে স্বীকার করতে বাধ্য হন।
আদালত কিংবা বিচারালয়ের আসনে উপবিষ্ট হওয়া খুবই বিপদসংকুল গুরুদায়িত্ব। একজন বিচারক শুধু মামলার ফাইল পত্র, অভিযোগ খন্ডনের যুক্তি প্রমাণ, সাক্ষী সাবুদ এবং বর্ণনা বিবরণ পর্যন্তই তার নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে সকল মোকদ্দমায় ইনসাফ পর্যন্ত পৌছতে পারে না। তাকে তার সম্কটজনক দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য পর্যন্ত পরিমাণ পবেষণা, পর্যবেক্ষণ এবং বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা প্রয়োগ করতে হয়। আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ-এর দুর্লভ গ্রন্থ “ইসলামের ফৌজদারী আইন” গুণীজনদের ব্যাপক স্বীকৃতি ও প্রশংসা অর্জন করেছে। এ অমূল্য গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠা থেকেও এটা প্রতীয়মান হয় যে, এর লেখক কতটুকু বিচক্ষণতা ও দুরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। ইখওয়ানের মধ্যে নাসেরের সাথে প্রথমদিকে শহীদ আওদাহই সর্বাধিক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। নাসের যখন বাদশাহী নখর বিস্তার করতে শুরু করেন তখন আবার আওদাহ শহীদই তার বিরোধিতায় তৎক্ষণাৎ নিঃসংকোচে দাড়িয়ে যান। তার এই ঈমানদীপ্ত নির্ভীকতায় নাসের ভীত হয়ে পড়ে। এরপর সে তার কবল থেকে রেহাই লাভ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলে। তাকে স্বকপোলকল্পিত এক অভিযোগের সাথে জড়িত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়।
আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ নিজেই আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, একবার নাসেরের সাথে তার আলাপ হচ্ছিলো। এক পর্যায়ে নাসের বললো, “আমি আমার বিরোধীদরেকে দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা দিতে পারি, তারা সংখ্যায় যত বেশীই হউক না কেন।” জবাবে আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ বলতে লাগলেন, “ যেসব লোককে তুমি সমুচিত শিক্ষা দিতে চাও তারা তো কোনদিন শেষ হবে না। তাদের ওপর হাত উত্তোলনকারীরা যতই শক্তিশালী এবং সংখ্যায় যত অধিকই হউক না কেন। কোন অবস্থায়ই তারা পরাজয় মেনে নেবে না। একজন দ্বিখন্ডিত হয়ে ভুমিতে লুটিয়ে পড়লে আর একজন এগিয়ে এসে পতাকা সামলে নেবে।”
আবদুল কাদের আওদা যেভাবে নাসেরের চোখে চোখ রেখে একথাগুলো বলেছিলেন যার অবশ্যম্ভারী ফল এই দাঁড়িয়েছিলো যে, সে ভীরু ও কাপুরুষ শত্রু তার মত ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান প্রতিপক্ষকে ময়দান থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টাই করবে।
আবদুল কাদের আওদাহ ওকালতি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মস্তবড় শিক্ষিত লোক। কোন মোকদ্দমায় তদবীর করতে গিয়ে তিনি সাধারণ আইনজীবীদের ন্যায় আইনের মারপ্যাচ, বাকপটুতা ও অনলবর্ষী বক্তৃতার ওপর সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে খুব ওজস্বী দলিল-প্রমান, সূক্ষ্ম বিশ্লষণ এবং আইনগত জটিল দৃষ্টিভংগী পেশ করতেই ছিলেন অভ্যস্ত। ইখওয়ানের সাথে তাঁর ছিল প্রগাঢ় সম্পর্ক ও অকৃত্রিম মহব্বত ভালবাসা। তার বিরুদ্ধে যখন সামরিক আদালতে মামলা রুজু করা হয় তখন তিনি আদালতে এ সূক্ষ্ম পয়েন্ট উত্থাপন করেন যে, সামরিক অফিসারগণ যে মোকদ্দমা তৈরি করেছেন তার নিরিখে সেনাবাহিনীই শতধা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। শররী বৈষয়িক আইনের দৃষ্টিতে এ আদালতে এরূপ মোকদ্দমার শুনানী হওয়ার অধিকার নেই। তারপরও সামরিক আদালত তার দাবী গ্রহণ করতে রাজী হয়নি। তার দাবী ছিল এই যে, মামলা কোন নিরপেক্ষ আদালতে পেশ করা হোক। আবদুল কাদের আওদা শহীদ জেনারেল মুহাম্মাদ নাজীবের বড়ই বলিষ্ঠ পৃষ্টপোষক ছিলেন। ইহাও ছির অন্যতম কারণ যে জন্য নাসের তার প্রাণের দুশমন এবং রক্তপিপাসু হয়ে উঠেছিলো।
জনাব সালেহ আবু রাকীক
সম্মানিত দ্বীনি ভাই ও উস্তাদ সালেহ আবু রাকীক ছিলেন আরব লীগের উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত। তখন আরব লীগের সভাপতি ছিলেন আবদুর রহমান আযয়োম পাশা মরহুম। জনাব আবু রাকীকের সাথে ছিল তার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এমন কি তিনি তাকে তাঁর সন্তান তুল্য মনে করতেন। তার ওপর নাসের অভিযোগ আরোপ করেছিলেন যে, তিনি তার বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন। জেলখানার অভ্যান্তরে তার ওপর বড়ই অত্যাচার ও নির্যাতন চালনো হয়। তথাপি তাঁর ঈমানী বলিষ্ঠতায় কোন দুর্বলতা দেখা দেয়নি। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় তথাপি তিনি একনো পর্যন্ত ইখওয়ানের প্রথম সারিতে জিহাদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে শিফা দান করুন এবং দীর্ঘ জীবনে ধন্য করুন।
আমার এ স্মৃতির বর্ণনায় সমাপ্তি টেনে দেয়ার পূর্বেই আমি প্রাচ্য ও প্রতিচ্যে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম ভ্রাতাগণের সমীপে অত্যন্ত জোরদারভাবে আরজ করতে চাই যেন তারা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সাথেই তাদের সকল প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার যোগসূত্র স্থাপন করে নেয়। আমেরিকার শক্তি, রাশিয়ার প্রবল প্রতাপ এবং ইসরাঈলের হিংসাপরায়ণতাকে কোনক্রমেই তোয়াক্কা করা চলবে না। আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় গ্রন্থণকারী ব্যক্তি কখনো কাকেও ভয় করে চলে না। বস্তুত আল্লাহ তায়ালার পরাক্রম ও ক্ষমতার তুলনায় বাতিলের কিইবা গুরুত্ব যেতে পারে।
উম্মতের নামে পয়গাম
ইতিহাসের নিষ্ঠুর বাস্তবতা ও শিক্ষা রয়েছে আমাদের সম্মুখে। ইতিহাসের এক অমোঘ বিধান হচ্ছে এই যে, কোন জাতিরই শৌর্য-বীর্য এবং উন্নতি-অগ্রগতি চিরস্থায়ী হয়নি। আবার কোন জাতি সর্বদা অবনতি-অনগ্রসরতা, হীনতা ও নীচতার অসহায় শিকার হয়ে থাকেনি। উন্নতি-অবনতি, সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্না এবং আনন্দ বেদনা গাড়ীর চাকার ন্যায় আবর্তিত হতে থাকে। আমাদের ভাগ্যও নিঃসন্দেহে পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু সে জন্য একটা শর্ত রয়েছে এই যে, আল্লাহ তায়ালাকে আমাদের ভয় করতে হবে যেভাবে ভয় করা উচিত। সর্বাবস্থায় তারই ওপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। এবং স্বীয় সমস্ত কর্মতৎপরতায় ইহসানের রূহ সৃষ্টি করতে হবে। আর এই ইহসান ও আনুগত্য শুধুমাত্র সালাত, সাওম এবং সাদাকা-যাকাত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইহসান ও ইবাদাত পরিবেষ্টন করবে সকল কর্মকান্ডকে লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, চেষ্টা-উদ্যেগ ও ইসলামী রেঁনেসা তথা পুনর্জাগরণের পরাকাষ্ঠা মোদ্দাকথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে ইহসান ও আনুগত্যেরই পরিচয় দিতে হবে। ইসলামের ভুলে যাওয়া শিক্ষা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে পুনরায় মানুষের অন্তরে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠছি। এবং জীবনের সকল ময়দানে ইহা স্বীয় ভূমিকা আদায় করতে শুরু করে দিয়েছে। ইসলামের শক্তি ও দীপ্তি সকল দিক ও বিভাগে অনুভূত হয়ে চলেছে। আজিকার নওজোয়ানগণ তাদের অলস নিদ্রার মোহে থেকে জেগে উঠেছে। বিগত পাঁচ শতাব্দি থেকে যে অলসতা ও অনুভূতিহীনতা মুসলিম উম্মাহর ওপর জেকে বসেছিল আজ সে কালো পর্দা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এসবগুলোই শুভ লক্ষণ ও আশার আলামত। আল্লাহ তায়ালার কুদরাত ও ক্ষমতা আমাদের আশা-আকাংখা পরিপূর্ণ করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এবং আমাদের শপথকে বলিষ্ঠতা দান করার সকল উপায় উপকরণ তৈরী করে দিয়েছে। যাতে করে আমরা আমাদের সযত্ন প্রয়াস-প্রচেষ্টাকে লক্ষ্য পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হই।
আমরা কি প্রত্যহ এ বিষয়টি দেখতে পাই না যে, সহস্র মাইলের সফর এক কদম ও পদক্ষেপের সাহায্যেই শুরু হয়ে থাকে? আমরা তো আমাদের লক্ষ্যভিমুকে অগণিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফেলেছি। আমাদের যুব সমাজকে সুসংবাদ শুনিয়ে দাও যে, আল্লাহ তায়ালার ফজল ও করম এবং দায় ও অনুগ্রহে তারা একটা মহৎ উদ্দেশ্য হাসিল করা এবং তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বাস্তরে অনতিবিলম্বে দেখতে পাবে। নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা, সবর, ধৈর্য এবং সতর্কতা ও সাবধানতা এবং রাহে হকে সকল প্রকার বিপদ-মুসিবত, পরীক্ষা-প্রতিকূলতা বরণ করে নেয়ার প্রেরণাই কামিয়াবী ও সফল তার চাবিকাঠি। জেনে রাখুন যে, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের প্রদত্ত রিজিকই আমরা সকলে খাচ্ছি। এ জমিন যার প্রশস্ততা ও উদারতার সুযোগ নিয়েই আমরা দিব্যি চলাফেরা করছি। আমাদের রিজিকের দায়-দায়িত্ব যদি জামিনের ওপরই সমর্পিত থকতো তাহলে তো তার রিজিক কত আগেই নিঃশেষ হয়ে যেতো। আমরা তো সে মহান সত্ত্বা কর্তৃক প্রদত্ত রিজিকই খাচ্ছি যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। যার ভান্ডার কোন দিন শূন্য হওয়ার নয়। তারই হাতে রয়েছে আকাশ ও পাতালের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ। যদি জমিনের রিজিক যথেষ্ট না হয় তাহলে আসমানের মধ্যেও বান্দাহদের জন্য রিজিক এবং এমন জিনিস রয়েছে যেগুলোর যোগান দেয়ার ব্যাপারে তাদের সাথে ওয়াদা করা হয়েছে। হায় আফসোস! যদি আমরা আঁখি মেলে একটু তাকিয়ে দেখতাম এবং চিন্তা-ভাবনা করতাম।
মানুষের অসহায়ত্ব
প্রসংগত সর্বসাধারণের বোধগম্য একটা উদাহরণ আরজ করতে চাই। যদ্বারা আল্লাহ তায়ালার সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃর্ত্বের মালিক হওয়া এবং মানুষের অক্ষমতা ও অসহায়ত্বের স্বরূপ প্রতিপন্ন হয়ে উঠবে।………….. আমেরিকা মাহশূন্যে বহু নভোযান উৎক্ষেপণ করেছে। একের পর এক উৎক্ষিপ্ত এ কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে তার পরিভ্রমণ সমাপ্ত করে নিরাপদে আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। কেবলমাত্র ভু-উপগ্রহ নং-৯- এর বেলায়ই ব্যতিক্রম ঘটেছে যে, সার্বিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও ইহা মহাশূন্যে জ্বলে ভস্মিভুত হয়ে গেছে। এ দুর্ঘটনাকে মানবীয় জ্ঞান-দুদ্ধি এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উৎকর্ষ কেন প্রতিহত করতে পারেনি। আত্মরক্ষামূলক ও আপদকালীন যন্ত্রপাতি কোথায় হারিয়ে গেছে? মানুষের বুদ্ধিমত্তা বিচক্ষণতা এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কোনই মূল্য নেই। আল্লাহ তায়ালার কুদরাত ও ক্ষমতাই প্রকৃতপক্ষে সকল জিনিসের ওপর বিজয়ী হয়ে থাকে। বস্তুত এসব ঘটনা দুর্ঘটনা দ্বারা মানুষের শক্তি সামর্থ ও যোগ্যতার সীমাবদ্ধতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। অগ্নি বিচ্ছুরণকারী ফেটে পড়ে এবং কেয়ামতের ভয়াবহ দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। অথচ কোন মানুষেই সেই আগুন ও লাভার ওপর নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করতে পারে না। তুফানী অন্ধকার নেমে আসে তখন আরোহীদের নিয়ে গাড়ীগুলোকে এমনভাবে দূরে নিক্ষেপ করে যেমন কোন শিশু তার খেলনাগুলোকে ছুড়ে মারে। তাপমাত্রা নীচে নামতে নামতে হিমাম্কেরও নীচি চলে আসে। এমনি চারদিকে তুষার বৃষ্টিপাতের দৃশ্য নজরে পড়ে, রেলগাড়ী, মটরযান ও হাওয়াই জাহাজ তথা সব জিনিসই একপর্যায়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সৃষ্টিজগতে আল্লাহ তায়ালার অগণিত-অসংখ্য সৃষ্টি তারই নির্দেশ পালনে ও আপনাপন কর্তব্য সম্পাদনে সদা ব্যস্ত যেগুলোর সম্মুকে মানুষ অত্যন্ত অসহায় অনুন্যোপায় গয়ে পড়ে। এক্ষণে বলুন যে মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি তার আবিষ্কার উদ্ভাবন এবং বস্তুগত উন্নতি অগ্রগতি কেন এসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে তৎপর হয় না? হতে পারে না?
আমরা এসব বিষয়ের প্রতিই মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চাই। সাথে সাথে এগুলোর ওপর চিন্তা-গবেষণা করার আহবান জানাই। কিন্তু আমাদের সকলকেই এটা ভালভাবে জেনে নিতে হবে যে, সকল শক্তির ওপর রয়েছে একটা মহাশক্তি এবং সকল কর্তৃত্ব অপেক্ষা শেষ্ঠ কর্তৃত্বের অধিকারী এমন এক সত্ত্বা রয়েছেন তিনি এমন প্রবল পরাক্রমশালী যে, তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। কেউ তাকে প্রতিহত করতে পারে না। তার মর্জি ব্যতীত কারো কিছু করার ক্ষমাতা নেই। এ প্রচন্ড ও অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালারই হাতে নিবদ্ধ। আর তিনিই সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রকৃত বাদশাহ, সম্রাট, মালিক, মনিব এবং প্রভু ও প্রতিপালক।
আযাদী ও স্বাধীনতার ইসলামী তাৎপর্য
প্রাচ্য দেশসমূহে বিশেষ করে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের লোক তারা মুসলিম হোক কি অমুসলিম- অনগ্রসরতা ও পশ্চাৎপদতাপর গ্লানি থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারবে না। যতদিন পর্যন্ত না তার প্রকৃত স্বাধীনতার স্বর্গীয় নেয়ামত লাভ করতে পারছে। বলা হয়ে থাকে যে, পাশ্চাত্য দেশসমূহে পরিবেশ পরিস্থিতি অন্য রকম। ওসব পরিবেশ রিস্থিতি আমাদের এ অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রয়োগ করা আদৌ সম্ভব নয়। জনসাধারনের গণতান্ত্রিক সচেতনতার তুলনা করে যুক্তি পেশ করা হয়ে থাকে যে, সেখানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যামান রয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের পরিবেশ এ জন্য অনুকুল নয়। এসব খোঁড়া যুক্তির জবাব হচ্ছে এই যে, ওসব দেশেও এরূপ পিস্থিতি রাতারাতি সৃষ্টি হয়ে যায়নি। বরং ওসব জাতিকেও অনেক সমস্যা এবং প্রতিকূলতার সম্কটজনক ঘাটি অতিক্রম করে আর দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভুল-ভ্রান্তি করে করে এক পর্যয়ে এসে এ মর্যাদা ও সম্মান লাভ হয়েছে। আবার অনেক সময় এমন দলিলও পেশ করা হয় যে, কিছু লোক আযাদী ও স্বাধীনতার অপপ্রয়োগ করে থাকে এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রই কাজে লাগিয়ে থাকে। আমি বলতে চাই যে, যদিও স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ ধরনের ঘটাবলী পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে। তথাপি ইহার ক্ষতি বাদশাহী, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের লোকসানের তুলনায় মোটিই উল্লেখযোগ্য নয়। আমরা যখন স্বাধীনতার দাবী জানাই তখন উহা দ্বারা পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রক স্বাধীনতা বুঝায় না। পশ্চিমা দেশগুলোর স্বাধীনতার ধারণা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আমাদের আযাদীর সীমা চৌহদ্দী আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাহ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আল্লাহ-রসূলের হালাল-হারামের বিধানেও কোনরূপ পরিবর্তন সাধন করার কোন অনুমতি আমাদের আদৌ নেই। কিন্তু নির্ধারিত সীমানার মধ্যে কোন মানবসন্তানের আযাদীর ওপর কোনরূপ বিধি-নিষেধ আরোপ করা কারো নিকটই জায়েজ নেই। পশ্চিমের স্বাধীনতা বগ্লাগীন ও জন্তু-জানোয়ার সদৃশ্য স্বাধীনতা যে, তারা সর্বসাধারণের সম্মুখে যে কোন ধরনের অপরাধ, নির্লজ্জতা এবং জঘন্যতম আচরণ করে থাকে। এবং স্বাধীনতা বনাম স্বেচ্ছচারিতার নামে তারপরও তারা নিরাপত্তা লাভ করে থাকে। ইসলামরে স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও রূপরেখা এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এখানে নিষিদ্ধ সীমানালংঘন করা জঘন্যতম ও মারাত্মক অপরাধ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে । আমাদের শরীয়াত স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে আদালত ও ইনসাফ, মুসাওয়াত ও সাম্য, ইজ্জত ও শরাফত এবং সম্মান ও সভ্রমের নিরাপত্তা বিধান। আযাদীর এ ধারণার ব্যাপারে কারো কি কোন দ্বিমত থাকতে পারে? তারপরও এখন ইসলামের এ স্বাধীনতার দাবী ও আওয়াজ শুনে লাব্বায়েক বলার মত কেউ আছে কি?
স্মৃতিচারণ সম্পর্কিত প্রসংগ কথা
আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা যে, আমার এ স্মৃতিচারণে ইতি টেনে দেয়ার পূর্ব আরজ করেন দেবো আরও একটা কথা যে, আমি এখানে যত কথা বর্ণনা করেছে কোন কোন ইখওয়ান উহার কিছু কিছু অংশ পছন্দের দৃষ্টিতে নাও দেখতে পারে। এ প্রসংগের গোড়াতেই আমি আমার মধ্যে এ অনুভুতি জাগরুক দেখতে পাচ্ছিলাম যে, আমার স্মৃতিপটে মুদ্রিত রয়েছে বিগত আশি বছরেরও অধিক সময়-কালের স্মৃতিকথা মালা যা ইতিহারেস বক্ষে মুদ্রিত হয়েছিলো। এ জীকনকাল কতদীর্ঘ ও সমস্যা সংকুল। হিসেবে নিকেশ কত কঠিন হবে এবং জবাবদিহির মনজিল হবে কতইনা কঠোর। বিশেষত আমার ন্যায় একজন নিঃসম্বল ব্যক্তির কি অবস্থা হবে যে এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যার কোন উপযুক্ততা তার নেই এবং যে সম্পর্কে তার ধারণা কল্পানায়ও কখনো আসেনি যে, এ সম্মানজনক পদ তারই জন্য অপেক্ষা করছে। কেননা আমার রয়েছে জ্ঞানের স্বল্পতা বরং নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাকী থাকে আমার ঈমান- এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে কিরূপ আচরণ করবেন। সংকল্প ও সৎসাহস খুবই ক্ষীণ ও দুর্বল- যার মধ্যে স্বীয় গুরুদায়িত্ব সামাল দেয়ার কোন শক্তি ও ক্ষমতা নেই। আমি যখন এসব স্মৃতিকথাকে সংরক্ষণ করার সিদ্ধন্ত করি যে কোন প্রকার কমবেশী না করে আদ্যন্ত আমার সঠিক ও যথার্থ পরিচয় বিশেষ করে আমার ইখওয়ান সাথীদের সামনে এবং সাধারণভাবে অন্যান্য মানুষরে সম্মুখে পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততার সহিত পেশ করে দিতে হবে। আমি কোন ব্যাপারেই লেফাফা দুরস্তি ও অতিরঞ্জনের আশ্রয় গ্রহণ করিনি। আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে কোন জিনিসই গোপন নেই। তিনি আমার গোপনীয় ও প্রকাশ্য সবকিছু সম্পর্কেই উত্তম রূপে অবহিত রয়েছেন। তারপরও আমি আমাকে মানুষের নিকট থেকে কেন গোপন করতে চেষ্টা করবো যা না আমার নিজের জন্য আর না আমার অস্তিত্বের জন্য লাভ-লোকসানের অধিকারী।
আমার একান্ত প্রত্যাশা ছিল যে, মানুষ আমাকে আমার স্বকীয়রূপে দেখ নিতে পারে। যাতে করে তারা কোন প্রকার অযৌক্তিক আত্মতৃপ্তির শিকার না হয়, আর না কোনরূপ ভুল-ভ্রান্তিতে পতিত হয়। আমি আল্লাহ তায়ালার বান্দাদের মধ্যে একজন অধম বান্দামাত্র। আডিম এসব স্মৃতিকে রোমান্থন করতে গিয়ে এও সমীচীন মনে করি যে, সকল সমালোচক ও অপবাদদানকারীর সম্মুখেই দিগন্ত প্রসারিত উন্মুক্ত আকাশ ছেড়ে দিতে হবে যাতে করে আমার দ্বীন, আখলাক ও মান-সম্মানের ব্যাপারে যদি তাদের কোন বক্তব্য থাকে তাহলে দলিল প্রমাণ সহকারে তা পেশ করে দিতে পারে। আমি উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে এবং রুকু-সিজদায় আমার রাব্বুল উজ্জতের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই যে, তিনিই তার অপার অনুগ্রহ ও মেহেরবানীর বদৌলতে আমাকে সকল হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ থেকে মাহফুজ রেখেছেন। এতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই বরং এটা তার রহমাতেরই ফসল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, “হালালের সীমানা সুস্পষ্ট আবার হারামের চৌহদ্দীও দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট আর এতদুভয়ের মধ্যে কিছু বিষয় রয়েছে দ্ব্যর্থেবোধক।”
আমি সারাজীবন আমার নিজেকে হালাল কাজের মাঝেই ব্যাপৃত রেখেছি। আর আল্লাহ তায়ালা তার কুদরাতের সাহায্যে আমাকে হারাম থেকে রক্ষা করেছেন। বাকী থাকে সন্দেহজনক বিষয়সমূহ- এ ক্ষেত্রেও আল্লাহ তায়ালার রহমারেত প্রশাস্ততায় আমি খুবই আশাবাদী যে, তিনি তাঁর দুর্বল বান্দাকে পরিবেষ্টন করে নেবেন।
আমি তখনও ছাত্র ছিলাম। এরই মধ্যে আমাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। অতপর যখন আমি আইন কলেজে শিক্ষারত ছিলাম তখন বাড়ীতে ফিরে এসে বিষয়বস্তুর প্রস্তুতিতে বসে যেতাম এবং আমার চারদিকে আমার বাচ্চারা খেলাধুলা করতে থাকতো। আমার দাম্পত্য জীবন ছিল বড়ই আনন্দঘন ও মধুর এবং শাস্তিদায়ক। আমি স্বভাবগতভাবে অভদ্র, বদমেজাজ ও নিরস কাঠমোল্লা নই। বরং আমি শান্তশিষ্ট, রশিকতা প্রিয় ও সূক্ষ্ম তত্ব বিশ্লেষণে অভ্যস্ত।
কোন কোন নিষ্ঠুর প্রাণ ও অত্যাচারী লোক বলে থাকেন, “যেসব জিনিসকে আল্লাহ পর্দার আড়ালে রেখে দিয়েছেন সেগুলোকে পর্দার অন্তরালেই থাকতে দিন।” তাদের এ বক্তব্য একদিন থেকে তো সঠিক ও যথার্থ যে, যেসব কাজ আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করে থাকনে সেগুলোকে পর্দার অন্তরাল থেকে জনসমক্ষে টেনে নিয়ে আসা কিছুতেই দূরন্ত নহে। যতদূর পর্যন্ত আমার লেন-দেন রয়েছে আমি কখনো জেনে বুঝে আল্লাহর গযবকে স্বাগত জানাইনি।
আমি বাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদাম্ক অনুসরণ করে চলতে গিয়ে বর্বদা দু’পন্থার মধ্যে অপেক্ষাকৃত সহজ রাস্তাই অবলম্বন করে থাকি। যদি তা আল্লাহ তায়ালার নাফরমানীমুলক কাজ না হয়। এ কর্মপদ্ধতির ব্যাপারে কারো কোন প্রকার ক্রোধ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা উচিত নয়। কেননা ইহাই সুন্নত মোতাবেক কর্মনীত। আমি চাই যে, যে ব্যক্তি আমাকে জানে কিংবা যে আমার সম্পর্কে কিছু পড়াশুনা করেছে সেই আমার প্রকৃত ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে অবগত হয়ে যেতে পারবে। এতেই কল্যাণ ও মংগল নিহিত যে, মানুষ পরস্পরে একে অন্যকে সুস্পষ্টভাবে জেনে নেবে এবং কোন প্রকার অজ্ঞতা ও ভুল বুঝাবুঝি না থেকে যায়। যার ফলে একজন অপরজনের সাথে লেন-দেন করতে গিয়ে নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা ও সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রস্তুত থাকে।
এসব স্মৃতিচারণকারী শত সহস্র উকিলদের মধ্যে একজন উকীল মাত্র। যাকে কেবল ওসব লোকই জানার সুযোগ পেয়েছে। যাদের কোন না কোন কাজে তার সংস্পর্শে যেতে হয়েছে কিংবা যারা তার নিকট আত্মীয় স্বজন যারা একান্ত কাছে থেকে তাকে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু ইহার অপর একটি দিকও রয়েছে যার মাধ্যমে সাধারণভাবে সমগ্র দুনিয়া এবং বিশেষভাবে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সদস্যগণ তার সাথে সম্যকরূপে পরিচিত। ঘটনার আকস্মিকতাই বলতে হবে যে, ইখওয়ানের নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব সোপর্দ করা হয়েছিলো আমার ওপর। অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে যে, জায়িদ এমন সুযোগ সুবিধা লাভ করে থাকে যা থেকে বকর থেকে যায় সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। কোন কোন লোক আবার কিছু বলতে চায় অথচ উত্তম ধারণা এবং শিষ্টাচার শালীনতার কথা তাদের মুখ খোলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আমার ব্যাপারেও কোন সংগী সাথীর অন্তরে হয়ত কিছু থাকতে পারে। ইখওয়ান সম্পর্কে মানুষ যা কিছু জানে তার সাথে সাথে ইহাও জরুরী যে, এ শিক্ষাও তাদের জেনে রাখতে হবে যা আমি আমার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে উল্লেখ করে এসেছি। বস্তুত এটা আর কিছুই নয় যে, আমি শুধু কোন রং-তুলি ব্যবহার না করে এবং কোন প্রকার অতিরঞ্জনের আশ্রয় না নিয়ে একজন সাধারণ মানুষের ন্যায় নিজেই নিজেকে জনগণের সম্মুখে পেশ করে দিতে চেয়েছি। এখন যদি কোন শত্রু কিংবা বন্ধু এসব স্মৃতির ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে চায় সে কোন প্রকার ইতস্তত না করে সম্পূর্ণ নিঃসংকোচে তা প্রকাশ করে দিতে পারে।
ইখওয়ান তো কোন ফেরেশতা নয়। তাদের একটা মৌলিক ও অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা তাদের সৌন্দর্য ও গুণাবলীর সাথে সাথে তাদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধেও খুব ভালভাবেই অবগত রয়েছে। নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ হওয়া তো আম্বিয়অ ও রসূলগণের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এবং পরিপূর্ণতা ও স্বর্থকতা কেবলমাত্র রব্বুল আলামীদের জন্যই শোভা পায়। সাধারণ মানুষ ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে পারে না। আর না এমন দাবী করাও তাদের জন্য শোভনীয় হতে পারে। আমার কখনো এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের দাবী করি না না আমাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। আমরা বাহ্যিক এমন কোন চাকচিক্য ও জৌলুষ দেখানোর প্রয়াস পাইনি যা আমাদের অন্তরের অবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। কখনো যদি আমাদের দ্বারা কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে যায় তখন আমরা উহার সাফাই প্রকাশ করতে ও পর্বভরে সে গুনাহের ওপর অটল অবিচল হয়ে থাকার চেষ্টা করিনি কখনো। আমরা বরং আমাদের ভুল-ভ্রান্তি থেকে তাওবা করেও অনুতপ্ত হয়ে আল্লহর সমীপে নতজানু ও অবনত মস্তকে হয়ে পড়ি। আমাদের এ স্বরূপ ও প্রকৃতি জনসাধারণের জেনে রাখা উচিত যাতে করে তারা যদি আমাদের ওপর সম্তুষ্ট থাকে তাও যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে আর যদি অসন্তুষ্ট থাকে তবে উহাও উপযুক্ত দলিলের নিরিখে হয়।
আমার স্মৃতির পাতায় অংকিত এসব কথাবার্তা আমি পাঠকদের খেদমতে পেশ করে দিয়েছি। এতদ্ব্যতীত দেশের ভিতরে ও বাহিরে বহু পত্র-পত্রিকায় আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখা হয়ে থাকে। লখকদের মধ্যে যারা বিরুদ্ধাচারণকারী তারা প্রবল শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এমন সব কথাবার্তা লিখে দেয় যেগুলোর বাস্তবতার সাথে থাকে না কোন সম্পর্ক। পক্ষান্তরে যারা আমাকে পছন্দ করেন তারাও আবেগের আতিশেয্যে অতিশয়োক্তি করে ফেলেন এবং তাদের কলমে আমার চিত্র অংকিত হয়ে থাকে যার কোন যোগ্যতা ও উপযুক্ততা আদৌ আমার নেই। এসব স্মৃতিকথা দ্বারা আমার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণকারীদের জেনে নেয়া উচিত যে, আমি কামালিয়াতের স্তরে উন্নীত হতে পারিনি। সকল দোস্ত দুশমনকে আমার এমন দৃষ্টিভংগীতেই দেখা কর্তব্য যতটুকু যোগ্যতা আমার রয়েছে। যাতে করে কোন প্রতারক ও ধোঁকাবাজ আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে আমাকে ধোঁকা ও প্রতারণার অসহায় শিকারে পরিণত করতে না পারে।
হে মানবজাতি! আপনারা সর্বাস্তকনণে জেনে রাখুন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন কখনো কাকেও এমন করে আমন্ত্রণ জানায়নি যেন তারা তাদেরকে অন্যান্য মুসলিমদের ব্যতিক্রমধর্মী বৈশীষ্ট্যের অধিকারী বলে মনে করে। আমরা কখনো কাউকে এও বলিনি যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দিকে আসুন। বরং আমাদের দাওয়াত শুরু থেকে এ- ই ছিল এবং সর্বদা এ-ই থাকবে যে-
“হে জনতা! এগিয়ে আসুন এমন একটি বিষয়ের প্রতি যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে একই রকম। আর তা হচ্ছে এই যে, আমরা আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো আনুগত্য করবো না। তার সাথে কাউকেও শরীক করবো না এবং আমাদের মধ্য থেকে কেউ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অপর কাউকে নিজেদের রব বানিয়ে নেবো না।”
আমরা মানুষের সাথে এমন কথা তো কখনো বলি না যে, তোমরা আমাদের আনুগত্য করো। কেননা আমরা নাতো অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠতম আর না জ্ঞান ও পান্ডিত্যের দিক থেকে অগ্রগামী। আমাদের দাওয়াত হচ্ছে এই যে, কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রসূলুল্লাহর অনুসরণ করে চলো। আল্লাহ তায়ালার ইতিবাচক নির্দেশসমূহকে প্রশাস্ত মনে ও হৃষ্টচিত্তে কার্যকরী করে চলেঅ এবং নেতিবাচক আদেশসমূহ থেকে নানন্দচিত্তে বিরত থাকো ও আত্মরক্ষা করে চলার চেষ্টা করো। যদি তোমরা এ কাজ করতে সক্ষম হবে তখন ইখওয়ানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া কিংবা উহার বাইরে থাকা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। আজ যদি আমরা ইখওয়ানের নাম নিয়ে থাকি অথবা আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার কথা বলে থাকি তবুও এগুলো কখনো আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয় বরং আমদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের এটা একটা পন্থা মাত্র। কেননা একক সংগঠন ব্যতীত শক্তি অর্জিত হতে পারে না। আর শক্তি ছাড়া অভিষ্ঠ লক্ষ্য পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছা আদৌ সম্ভবপর নয়।
পরিশেষে আমি এ দোয়ার মাধ্যমে আমার বক্তব্যের সমাপ্তি টানতে চাই যে, “ওগো আমাদের রব! ভুল-ভ্রান্তির ফলে ও অজ্ঞতা বশত আমাদের পক্ষ থেকে যেসব দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায় তুমি আমাদেরকে তজ্জন্য পাকড়াও করো না। মালিক! তুমি আমাদের ওপর এমন বোঝা ও দায়িত্ব চাপিয়ে দিও না যা তুমি আমদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলে। পরওয়ারদিগার! যে দুর্বহ বোঝা বহন করার কোন শক্তি ও ক্ষমতা আমাদের নেই তা তুমি আমাদের ওপর বর্তিয়ে দিও না। আমাদের সাথে কোমল ও সহৃদয় আচরণ করো। আমাদেরকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করো। আমাদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহের বৃষ্টি বর্ষণ করো। তুমিই আমাদের একমাত্র মাওলা ও অভিভাবক। অতএব কাফেরদের মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করো।” আমীন-ইয়া রাব্বুল আলামীন।
সমাপ্ত