চব্বিশতম অধ্যায়
ইখওয়ানের সামরিক সংগঠন
ইখওয়ানের সামরিক সংগঠনের সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো সম্পর্কিত ছিলাম না। এই সংগঠন সম্পর্কে খুব বেশী অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আমি এই সংগঠনের ব্যাপারেও এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। আমার এই নিবেদন হবে সম্পর্ণ বাস্তবসম্মত এবং সত্য নির্ভর যাতে কোন প্রকার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ কিংবা এই সংস্থার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন প্রভাব নেই।
এ বিষয়ে আমি অনুতপ্ত যে, আমি এ সংগঠনের নিয়মিত রুকন কখনো ছিলাম না। অথচ এই ব্যবস্থা স্বীয় উদ্দেশ্যপূর্ণ, বিশ্বস্ততা, সমস্যার মোকাবিলায় বীরত্ব, নিজের সকল মুল্যবান বস্তু আল্লাহর পথে কুরবা্ন করে দেয়া এবং সর্বব্যপী ও পূর্ণঙ্গ দ্বীনি অনুভূতির সমর্থক। যদি শহীদ ইমাম এই সংগঠন কায়েম করার প্রতি দৃষ্টি না দিতেন তাহলে দাওয়াতের হক আদায় করার ক্ষেত্র অপারগ থেকে যেতেন। ইখওয়ানের জন্য এই ব্যবস্থা খুবই জরুরী এবং মৌলিক গুরুত্বের দাবীদার। কেননাঃ
১- প্রিয় দেশ মিসরের ওপর ইংরেজরা্ আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল এবং তার সমস্ত কাজ কারবার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃটিশ রাজ নিযু্ক্ত ভাইসরয়ের মর্জি মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছিলো।
২- ফিলিস্তিন ভূখন্ডের ওপর ইহুদীদের দখলদারী কায়েম হয়ে গিয়েছিল। ইহুদীরা দেশের সন্তানদেকে হত্যা করে এবং পবিত্র স্থানসমূহের অসম্মান করে। তা সত্ত্বেও বিশ্বশক্তিসমূহ আরবদের বিরুদ্ধে ইহুদীদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে।
৩- বিদেশী ব্যাংকগুলো আমাদের রক্ত শোষণ করছিলো এবং আমরা যেন তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিলাম।
৪- সকল প্রকার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো। চিন্তা-ভাবনা, সাহিত্য-সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য সংকলন ও রচনার কোন স্বধীনতাই ছিল না।
ইসলামে দেশপ্রেম, আত্মমর্যদা ও শৌর্য-বীর্য সবকিছুরই দাবী ছিল এই যে, এই ধ্বংসাত্মক ব্যধি থেকে মুক্তিলাভ করে নিজেদের আযাদী বহাল করতে হবে। যে ব্যক্তি এই পরিস্থিতিতেও স্বাধীনতার চিন্তা করে না এবং তা লাভ করার জন্য সক্রিয়ভাবে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে না সে তার আকীদা-বিশ্বাস, আত্মসম্মাম, দেশ ও পৌরুষ থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায় এবং পাপী ও অপরাধী বলে পরিগণিত হয়ে থাকে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের জন্য এমন অপমান ও অসম্মানজনক অবস্থার ওপর সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব ছিল না। দ্বীন, মাতৃভূমি এবং ইজ্জত আবরুর হিফাজতের জন্য এ ছিল অতীব জরুরী যে দেশ মাতৃকার সন্তানগণ সামরিকভাবে নিজেদেরকে তৈরী করতে ব্রতী হবে। এটাই ছিল সর্বপথম ও সর্বশেষ কারণ যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম মুর্শিদে আ’ম এই ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন। আমার দুর্ভাগ্য যে, এই সংগঠনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার সম্মান আমি লাভ করতে পারিনি।
দেশ ও জাতির হিফাজতে সেনাবহিনীর সাথে সহযোগিতা
বলা হয়ে থাকে যে, উপরোল্লিখিত কর্তব্য সম্পাদন করার দায়িত্ব দেশের সেনাবাহিনীর এটা ঠিক। এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগি নেই। তথাপি যে সংস্থার উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে তার উদ্দেশ্যও নিজ দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা নয় বরং প্রয়োজনের সময় তাদের হাতকে শক্ত করা এবং তাদেরকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য এগিয়ে যাওয়া। এই সংগঠনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যুবকগণ দেশ মাতৃকার সুসন্তান এবং দেশ প্রেমিক নাগরিক তাদের সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় এবং অকারণে স্পর্শকাতরতা প্রকাশ করা দুর্বোধ্য। কয়েকটা ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর একটা বিশেষ অংশ সা’ইকা নামে পরিচিত। তার দায়িত্ব সন্বন্ধেও শুনে রাখুন এটি নাগরিকদেরকে ভীতি প্রদর্শন, হুমকি দেয়া, সর্তক এবং শাস্তি দেয়ার জন্য গঠন করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যোগ্যতর ছাত্রদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে রেখেছে। অতএব বিভিন্ন সংগঠনকে আকীদা-বিশ্বাস এবং দেশ ও জাতির হিফাজতের জন্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত যুবকদের সংগঠিত করার অনুমতি দিতে বাধা কোথায়? দলীয় রাজনীতি ও কোন্দল নয় বরং শুধু দেশ ও আকীদা-বিশ্বাসের হিফাজতই এসব সংগঠনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সা’ইকার ন্যায় সেনা ইউনিট বৈধ এবং তাদেরকে দেশ ও জাতির সেবক মনে করা হয় কিন্তু ইখওয়ানের জন্য যুবকদের প্রশিক্ষণদানের অনুমতি নেই।
আমি জানি আমার একথায় অনেক লোকই খুশী হবে না বরং ক্রোধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করবে। ইসলামী সংগঠনসমূহের সমালোচনাকারী কোন ব্যক্তিবিশেষ বা কতিপয় ব্যক্তির ভ্রান্ত তৎপরতাকে ভিত্তি করে এই ধারণাকেই ধ্বংসাত্মক মনে করা হয়। আমি না সেসব লোককে সমর্থন করি যারা এই সংগঠনের অপব্যবহার করে। আর না তাদের সমালোচনা ও বিরোধিতার কোন গুরুত্ব দিয়ে থাকি যারা খোঁড়া অজুহাতে একটা গঠনমূলক কর্মসূচীর ওপর কুঠারাঘাত করে। আমি অবশ্য আমার এই মনোভাব দ্বারা কাউকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করছি না। আমার উদ্দেশ্য স্বীয় দ্বীন ও দেশের কল্যাণ সাধন করা। যদি আমার মতামত সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত তাওফিকের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে। আর যদি সঠিক না হয়ে থাকে তবে তাকে আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা মনে করতে হবে। মানবীয় জ্ঞান বুদ্ধি সীমাবদ্ধ ও অপূর্ণাঙ্গ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি কথা যথার্থ সত্য এবং তিনিই সঠিক পথের দিকে মানুষকে পরিচালনা করতে পারেন।
হাসান আল হুদাইবির বির্দেশনা বনাম সামরিক সংগঠন
দ্বিতীয় মুর্শিদ আ’ম জনাব হাসান আল হুদাইবি (র) ইউসুফ তালাত শহীদকে যখন বিশেষ সংস্থার প্রধান নিযুক্ত করেন তখন সুস্পষ্টভাব ইরশাদ করেছিলেন যে, এটা কোন গোপন সংগঠন নয়। কিংবা এর তৎপরতাও পোগন নয়। এর উদ্দেশ্য সরকারের ক্ষমতার মসনদ উল্টে দেয় নয়। বরং এর সাহায্যে যুবকদেরকে উন্নত চারিত্রিক গুণ সম্পন্ন করে গড়ে তোলা এবং কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত করে দেয়া। যারা মনে করে যে, দুই এক হাজার যুবকের সাহায্যে লক্ষ লক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য পৃলিশ গার্ড ও সিকিউরিটি বিভাগের কর্মচারীদের পরাজিত করা যেতে পারে তারা পাগলের স্বর্গে বাস করে। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট, যার গুরুত্ব ও উপকারিতা বলার অগেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমাদের কাছে এমন লোকদের চিকিৎসার কি ব্যবস্থা থাকতে পারে যারা উজ্জ্বল দিবালোককে অস্বীকার করতে কোন প্রকার ইতস্তত বোধ করে না।
বিষনাশক বিষে রূপান্তরিত হলো
১৯৫২ সালে জুলাই মাসের পট পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল-প্রিয় দেশ থেকে অন্যায়ের কুৎসিত কলম্ক দূর করা এবং কল্যাণ ও মংগলের বিস্তৃতি ঘটানো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত এই উদ্দেশ্য পূরো হতে পারেনি। বরং উল্টো ভাল এবং মন্দের মানদন্ডই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বিপ্লবী কাউন্সিল ও তার মন্ত্রীর তাদের নিজেদের মনমত সমস্ত কাজকর্ম করে যেতে লাগলো। প্রতিদিন এ মর্মে লজ্জাজনক খবরাদি প্রকাশ হতে লাগলো যে, অমুক চিত্রাভিনেত্রী অমুক মন্ত্রীর প্রেমিকা। এ ধরনের একটি ঘটনা এতটা ছড়িয়ে পড়ে যে, তার দুর্গন্ধ গোটা পরিবেশকেই কলুষিত করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত বিদেশী প্রেমিকাকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আবদুন মাসেরের মৃত্যুর পর সেই কুখ্যাত চরিত্রহীনা নারী মিসরে ফিরে আসে। এয়ারপোর্টে তাকে যে উষ্ণ সম্মানজনক অভ্যর্থনা জানানো হয় তা সর্বস্তরের মানুষের জন্য ছিল বিস্ময়কর। উক্ত নারী সম্পর্কে জানা যায় যে, তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। তাই সে তার মেজবান দেশে নিজের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ইচ্ছায় অবস্থান করতে থাকেন। উল্লেখিত মহিলা সম্পর্কে শুনা যায় যে, তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। তাই হৃত সাস্থ্য পূনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে মনস্থ করেছেন। না আছে করো লাজ লজ্জার বালাই আর না তার অনুভূতি। চিত্র তারকা যার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি আমারেদকে দেশ প্রেম, প্রতিশ্রুতি পালন এবং উন্নত ও মহৎ চরিত্রের বাস্তব প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, অথচ বাস্তবে তিনি নিজেই এসব উন্নত নৈতিক গুণাবলী শিষ্টাচার ও শালীনতাবোধ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত এবং পুণ্যশীলতা, পবিত্রতা ও লজ্জার লেশমাত্র তার মধ্যে নেই।
যেসব আকাশ কুসুম কল্পনা ও রংগীন স্বপ্নের দাবীতে বিপ্লব সংঘটিত হয় তার নাকের ডগায় তিনি সকল অন্যায় অশ্লীলতার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ওপরে বর্ণিত নর্লজ্জতা থেকেও অগ্রসর হয়ে এই অপরাধ ব্যাপকভবে ছড়িয়ে পড়ে যে, শক্তিধর ও ক্ষমতাশালী লোকেরা কোন নারীকে দেখেও তার রূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে বেচারা স্বমীকে শক্তির বলে বাধ্য করতো তার স্ত্রীকে তালাক দিতো, যাতে সে তাকে তার শয্যা সংগিনী রূপে রবল করতে পারে। বেচারী তালাক প্রাপ্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে নিয়ে বিবাহের অভিনয় করা হয়। এর চেয়েও অধিক নিষ্ঠুরতা প্রদার্শন করা হতো রূপালী পর্দার সুন্দরীদেরকে সরকারী তত্ববধানে প্রশ্রয় দিয়ে। ক্ষমতাসীনরা তাদের নিয়ে মহাশূন্যে উড়ে বেড়াতে থাকে এবং উদ্দেশ্য হাসিলের পর তাদেরকে এসব উচ্চস্থান থেকে এমনভাবে নীচে ছুঁড়ে মারে যে, তাদের ঘাড় ভেংগে চুরমার হয়ে যায় এবং শরীরের সবগুলো সুন্দর অংগ- প্রত্যাংগ যার সাহায্যে হাজার হাজার মানুষকে বিপথগামী করা হয়েছে মাটিতে এমন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে যে, তা শিক্ষণীয় নিদর্শনে পরিণত হয়ে যায়। আলেকজান্ডার ও চেঙ্গিজের হাতে পৃথিবীতে শত শতবার সম্মানিত মানুষের ইজ্জত- আবরু ভুলুন্ঠিত হয়েছে।
তোমাদের কিন্তু লজ্জা নেই
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এসব সুন্দরী শিল্পি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায় এবং সর্বত্র্ তাদের উষ্ণ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়ে থাকে। বিয়ে ছাড়াই যা হয়ে থাকে সেটা আল্লাহই ভাল জানেন কিন্তু প্রতি কয়েক মাস পর পর প্রত্যেক মক্ষীরাণী কোন নতুন স্বামীর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে আমার বোধগম্য নয়। কোন পুরুষের মধ্যে যদিও বিন্দুমাত্র মর্যাদাবোধ এবং পৌরুষ থেকে থাকে, সে কি করে এমন রমণীকে বিয়ে করতে প্রস্তুত হতে পারে যে প্রতিটি আসরের প্রদীপ এবং প্রত্যেকের শয্যা সংগিনী হওয়ার জন্য থাকে সদা প্রস্তুত। হে আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার অন্যায় অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করো এবং ক্ষমা করে দাও। নিসন্দেহে তুমি অতীব ক্ষমাশীল।
নাসেরের ব্যক্তিত্বঃ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক
কেউ কেউ আমার কাছে দাবী করে যে, আমি যেন নাসেরের শাসনব্যবস্থা ও তার ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরি এবং তার নেতিবাচক দিকগুলো থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখি। অথচ আমি নাসেরের ব্যক্তিত্বের ওপর কখনো কোন আক্রমণ করিনি। কিংবা তা করার অভ্যাসও আমার নেই। তথাপি নাসের দেশ ও জতির ব্যাপারে যেসব বাড়াবাড়ি করেছে তাথেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা ইতিহাসের সাথে গাদ্দারী এবং সত্য ও সততার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গেরই নামান্তর। আমি কোন মানুষেরই মহৎ গুণাবলীর স্বীকৃতি প্রদান করতে কার্পণ্য করি না। নাসেরের ব্যাপারে তার ঘনিষ্ট কিছু বেসামরিক সংগী-সাথীদের নিকট আমি শুনতে পেয়েছি যে, সে মদ পান করতো না। অনুরূপ আরও জনশ্রুতি রয়েছে যে, সে নারীদের পশ্চতে ছুটে বেড়াতো না। সুদানে সামরিক দায়িত্ব পালন করার সময় তার ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল যে, সে অধিকাংশ সময়ই একাকী ও নিঃসংগ অবস্থায় অতিবাহিত করতো। নিজের ফৌজী সাথীদের সম্পূর্ণ বিপরীত খেলাধুলা, আনন্দ-উল্লাস ও ক্লাবগুলোতে রাত্রিযাপন করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকতো।
তাঁর জীবনের এই ব্যতিক্রমী দিকগুলো নিসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু তার রাজনৈতিক নেতিবাচক দিকসমূহ এবং অসৎ বৈশিষ্ট্যে কলম্কিত ও কলুষিত। আভ্যন্তরীণ জুলুম-অত্যাচার ছাড়াও সকল মুসলিম রাষ্ট্রের শত্রুতা কুড়ানো কেমন বুদ্ধিমাত্তার পরিচয়ক? নাসেরের স্তবক লেখকদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা ছোট বড় সবাইকে গালী দেয়া এবং প্রত্যেকের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা কি তাদের নিকট ইতিবাচক কৃতিত্বের পরিচয়ক? মিসরে মার্কসবাদের প্রবর্তন কোন মহৎকাজ নয়। নাসেরের মৃত্যুর পর মার্কসবাদের প্রতি যে ঘৃণা প্রকাশ করা হচ্ছে তা থেকেও অনুমান করা যায় যে, নাসেরের কর্মকান্ডের সাত্যিকার মূল্য কতটুক।
অর্থনৈতিক ব্যাপরে নাসেরের উত্তরাধিকা্রী আনোয়ার সাদাতের সন্তব্য উদ্ধৃত করাই উত্তম বলে মনে করি। সাদাত ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দ্ব্যর্থহীনভবে বলেছিলেন যে, তিনি নাসেরের নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে অর্থনীতি লাভ করেছেন তা শুধু শূন্যই নয় বরং শূন্যেরও অনেক নীচে। উস্তাদ মুস্তফা আমীন (প্রখ্যাত মিসরীয় সাংবাদিক ও সাহিত্যিক)- এর এই উক্তি এখন প্রত্যেক মিসরবাসীর মুখে মুখে যে, নাসের প্রতি দু’টি কারখানার মাঝে তৃতীয় কারখানা স্থাপন করে যার ফলে পুরাতন কারখানা ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এবং নতুন কারখানাও কোন ইতিবাচক কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারেনি।
বলা হয়ে থাকে যে, নাসের অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে উপনিবেশবাদী শক্তিসমূহের মোকাবিলা করেছেন। সত্যিকারভাবে আমাকে বলা হোক যে, উপনিবেশবাদী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে মিসরের কোন ব্যক্তি সংগ্রামরত ছিল না? উপনিবেশবাদের কবল থেকে মুক্তি লাভ করার পর নাসের জুলুম-নির্যাতন শুরু করলে তার অত্যাচার ও নির্যাতনের সামনে উপনিবেশবাদী যুগের জুলুম-নির্যাতন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আমি দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সাথেই বলতে চাই যে, যদি কোন মিসরীয় আামকে নাসেরের শাসনামলের একটিও ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখিয়ে দিতে পারে-যার ফলে দেশবাসীর সৌভাগ্য ও কল্যাণ করতে সক্ষম হয়েছে তাহলে আমি কোন প্রকার দ্বিধা না করে তা প্রকাশের জন্য পুরোপুরি চেষ্টা করবো।
সাদাত নাসেরের স্থলাভিষিক্ত
সাদাতের শাসনকাল যতদূর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত তার সূচনা খুবই ভাল ছিল। যদিও সে রাজনৈতিক নজরবন্দী ও কয়েদীগণকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি প্রদান করেনি। তথাপি মাত্র দু’বছরের মধ্যে যে, এই বিলম্বর কারণও ছিল মূলত নিরাপত্তা বিভাগীয় আমলা এবং পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের টালবাহানা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গুপ্ত ব্রাঞ্চের অফিস শান্তি-শৃঙ্খলা কায়েম রাখার ব্যা্পারে যদি প্ররিশ্রম ও আন্তরিকতার পরিচল দেতো তাহলে শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থারও উন্নতি হতো এবং জনগণকে অকারণে সমস্যর সম্মখীনও হতে হতো না। তাদের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে সরকার ও জনগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করা যাতে সকল ব্যাপারেই উত্তমরূপে আনজাম পেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এসব লোক এর সম্পূর্ণ বিপরীত সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে ব্যবধান ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতেই সদা সচেষ্ট থাকে।
সাদাতের দৃষ্টান্তমূলক পরিণাম
ধারণা করা হয়ে থাকে যে, প্রথমদিকে সাদাতের আশংকা ছিল তার শাসন স্থায়ী হবে না। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে যে, কোন শক্ত চ্যালেঞ্জ ছাড়াই সে তার ক্ষমতার মসনদকে মজবুত করে নিয়েছে। তখন তার দেমাগও খারপ হয়ে যায়। এক্ষণে সে তার প্রতিপক্ষের সকলকে একই লাঠি দ্বারা হাঁকিয়ে পুনরায় সেই জঘন্য কারাগারে প্রেরণ করে যেখান থেকে স্বীয় শাসনামলের গোড়ার দিকে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এসব জেলখানার অবস্থা ছিল বর্ণনাতীত যেখানে বন্দীদের মৌলিক মানবিক অধিকারের পতি কোন ভ্রুক্ষেপই করা হতো না। সাদাতর শাসনামলের পরিসমাপ্তি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও দৃষ্টান্তমূলক। নিজের ক্ষমতার নেশায় বিভোর হয়ে সে প্রেসিডেন্টের জন্য নির্মিত মঞ্চে সালামী গ্রহণের জন্য দাঁড়িয়েছিল। ইতিপূর্বে সে তার সমস্ত বিরোধী পক্ষকে শৃংখলিত করে ফেলে। আল্লাহ তায়ালা এমনভবে দুর্বিনীত গর্দানকে অবনত করে দিলেন যে, মঞ্চ রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। চারদিকে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায় এবং সাদাত সাহেব এখানেই সবকিছু ছেড়ে পরপারের পথে পাড়ি জমান।
সেনাবাহিনীর কাজ সীমান্ত রক্ষা রাজনীতি নয়
১৯৬৭ সালের অপমানজনক পরাজয় অনুশোচনাযোগ্য ছিল অবশ্যই কিন্তু অপ্রত্যাশিত ছিল না কিছুতেই। ১৯৫২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন কিছু। কিন্তু সেনাবাহিনী সংস্কারের পরিবর্তে ক্ষমতার নেশায় বিভোর হয়ে পৃথক সামরিক সরকার চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখন থেকেই আমাদের মনে আশংকা দানা বেঁধেছিল যে, মিসরের ওপর দিয়ে একর পর এক বিপদের ঝঞ্ঝা প্রবাহিত হবে। কারণ সরকারের কাজকর্ম এবং সামরিক দায়দায়িত্ব দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কর্মক্ষেত্র। যখন কোন দেশের ওপর সেনাবহিনী আধিপত্য বিস্তার করে তখনই একদিকে তারা তাদের পেশাগত যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত হয় এবং অপরদিকে সমস্ত সরকারী প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস সাধিত হয়। সামরিক বাহিনীতে নির্দেশ প্রদান এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে তার আনুগত্য করার নীতি কার্যকর। পক্ষান্তারে সরকারের কর্মকান্ড আলাপ আলোচনা, যুক্তি তর্ক, সলা পরামর্শ এবং পরিষ্ঠতা ও লঘিষ্ঠতার মূলনীতির ওপর ভিত্তিশীল। মহাবিজয়ের নামে অভিহীত ১৯৫৬ সালের লড়েইয়ের রহস্য উদঘাটিত হয়্ ১৯৬৭ সালে। যাকে পরাজয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রকৃতহক্ষে এটা শুধু পরাজয়ই ছিল না বরং জীবনব্যাপী লাঞ্ছনা- সর্বকালের নিদারুণ অপমানের নামান্তর।
বস্তুত তোমরা খুব কমই শিক্ষা গ্রহণ করে থাকো
আমাদের ধারণা ছিল এই দৃষ্টান্তমূলক পরাজয়ের পর হয়তো আবদুন নাসেরের চোখ খুলবে এবং সে তার পরামর্শ ও মন্ত্রণাদাতাদের পরিবর্তন ও বিরাজমান পরিস্থিতির আশু সামাধানের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু সে বরং আরো এক প্রহসনমূলক নাটকের অভিনয় করে। সে প্রদর্শনীমূলকভাবে ঘোষণা করে বসে। যার ফলে তার চাটুকার ও তল্পীবাহকরা তাকে তোষামোদ করতে শুরু করে যে, দেশ ও জাতির স্বার্থ যেস যেন তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। নাসের নিজে হয়তো ধারণার করতে পারেনি যে, এরূপ শিক্ষনীয় পরাজয়ের সম্মখীন তাকে হতে হবে। কিুন্তু আমাদের জন্য এই পরাজয় কোন বিম্ময়ের ব্যাপার ছিল না। আল্লাহর কিতাব, ইসলামী শরীয়াত এবং স্বয়ং মানবজাতির ইতিহাস এই বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করে যে, যখনই কোন ব্যক্তির একনায়কত্ব কোন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ধ্বংস ও বিপর্যয় এবং বিপদ মুসিবত ব্যতীত আর কিছুই দাঁড়ায় না। হিটলার, মুসোলিনী, সালাজার এবং ফ্রাম্কো প্রমুখ ব্যক্তিগণ নিজ নিজ জাতির জন্য তাই করেছিলেন। মিসরে আবদুন নাসের যার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন। পূর্ব থেকেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যাতে এ পরাজয় আরো বলিষ্ঠ হয়ে যায় যে, দৃষ্টান্তমূলক পরিণাম সমাগত।
একমুষ্টি মাটি কিন্তু জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত বিস্তৃত
মিসরের রাষ্ট্রীয় আইন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সংগঠনকে স্বীকার করে না। আমরা মানব রচিত আইনকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি না। কিন্তু আইনকে নিজের হাতেও তুলে নেই না। আমরা সর্বদা এ আইন বাতিল করার দাবী করে আসছি। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সংগঠন যা তাদের মুর্শিদে আ’মকে নির্বাচিত করে থাকে তা আইনগ ভবে নিষিদ্ধ। তথাপি মুর্শিদে আ’মকে বাছাই করা হয় এবং সরকারও তা মেনে নেয়। আমি ইতিপূর্বেও আরজ করে এসেছি যে, ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা কমিটিতে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, কোন কারণে যদি মুর্শিদে আ’ম নিখোঁজ হয়ে যান এবং তার সহকারীও বর্তমান না থাকেন, কিংবা তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন, তাহলে কর্মপরিষদের সদস্যগণের মধ্যে বয়সের দিক থেকে সর্বাপেক্ষা প্রবীণ সদস্য মর্শিদে আ’ম – এর দায়িত্ব পালন করবেন। উস্তাদ আল হাসান আল হুদাইবি মৃত্যুবরণ করেন এবং তার সহকারী ডঃ খামীস হামীদও ইনতিকাল করেন। তখন ঘটনাক্রমে কর্মপরিষদের সদস্যগণের মধ্যে আমিই ছিলাম বয়োজেষ্ঠ। অতএব এ শুরু দায়িত্ব সমর্পণ করা হয় আমার ওপর। অথচ আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমি আদৌ- এর উপযুক্ত নই। কোথায় হাসানুল বান্না, হাসান আল হুদা- ইবি আর কোথায় সম্পূর্ণ দুর্বল ও অযোগ্য আমি! ইখওয়ানী ভ্রাতাগণ তাদের ভাল মন্দ সকল ব্যাপারেই আমার পরামর্শ গ্রহণ জরুরী মনে করতেন এবং ইখওয়ানের মুর্শিদে আ’ম হিসেবে সরকারও আমার সাথে আলাপ আলোচনা করেন। আমাকে যখন মর্শিদে আ’ম বলে সন্বোধন করা হয় তখন আমি কোন প্রকার উল্লাস বোধ করি না। আবার তা অস্বীকারও করি না। তথাপি এদিক থেকে এটা একটা সম্মানের বিষয় যে, আমাকে মর্শিদে আ’ম বলে প্রকারান্তরে ইখওয়ানের অস্তিত্বই মেনে নেয়া হচ্ছে। এটা একটা সান্ত্বনার বিষয়।
সাদাত আমাকে ১৯৭৯ সালে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠালে মর্শিদে আ’ম হিসেবেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ব্যক্তিগতভবে কোন রাষ্ট্রপাধান কিংবা সরকারী দায়িত্বপূর্ণ কোন লোকের সাথে মিলিত হওয়ার কোন অভিলাষ আমার ছিল না। আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, আমি সুনাম সুখ্যাতি এবং প্রচারণা ইত্যাদিকে খুবই অপছন্দ করে থকি। সাদাত কানাতিরুল খাইরিয়াতে আমার সাথে সাক্ষাত করেন এবং আমার সম্মুখেই তাঁর সচিবকে নির্দেশ দেন যেন এ সাক্ষাতের বিস্তারিত বিবরণ ও ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশের ব্যবস্থা করে। আমি রাষ্ট্রপতির নিকট আবেদন জানাই যাতে এ সাক্ষাতের পাবলিসিটির কোন ব্যবস্থা কিছুতেই করা না হয়। আমার অনুরোধের ফলে সাদাত তার সেক্রেটারীকে পুনরায় আদেশ করেন যেন খবর প্রকাশ করা না হয়্ কিন্তু পরক্ষণেই রাষ্ট্রপতি বিস্ময় বিস্ফরিত নেত্রে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। তিনি তো দেখে এসেছেন মানুষ রাষ্ট্রপরিত সাথে সাক্ষাত এবং তার পাবলিসিটির জন্য অত্যন্ত আগ্রহী অথচ আমিই ছিলাম একমাত্র ব্যক্তি যে স্বয়ং এ পাবলিসিটি বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করলাম। আমি শাসকদের নৈকট্য ও সানিধ্য এড়িয়ে চলি। কারণ আমার মতে এতই নিহিত রয়েছে কল্যাণ। কদাচিৎ তাদের সমীপে গেলেও তা শুধু দ্বীনি উদ্দেশ্যেই যাই ব্যক্তিগত সুনাম সুখ্যাতির জন্য নয়।
“মুর্শিদে আ’ম উপাধিটি খুবই মর্যাদা ও সম্মানজনক। বড় বড় মহাপ্রাণ ব্যক্তিরাও এই গুরু দায়েত্বের বোঝা সামাল দিতে ইতস্তত করে থাকে। আমি কোনদিন এর প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাই ছিল এরূপ যে, এ কঠিন দায়িত্বভার আমার ক্ষীণকায় স্কান্ধের ওপরই সমর্পণ করবেন। বস্তুত আল্লাহ যে ফায়সালা করেন তা অটল অবিচলই হয়ে থাকে। কে এমন দাবী করতে পারে যে, সে তার সকল কর্মকান্ডেই স্বাধীন ও খোদ মোখতার।
সুয়েজখাল জাতীয় করণ
আমার মনে পড়ে ১৯৩৬ সলের মার্চ মাসে অর্থমন্ত্রী সুয়েজখাল কোম্পানীর ডাইরেক্টরের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। তিনি মিসর সরকারের মুনাফার অংশ বৃদ্ধি করা এবং কোম্পানীতে মিসর সরকারের প্রতিনিধি সংখ্যা বাড়ানোর দাবী করেন। এটা একথারই ইংগিত দেয় যে, মিসরের সকল সরকারই সুয়েজখালের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল এবং দেশের স্বার্থের হিফাজতের জন্য সবসময়ই সচেষ্ট ছিল। চুক্তি অনুসারে ১৯৬৯ সন পর্যন্ত কোম্পানীকে খাল লিজ দেয়া হয়েছেল। এই মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর গোটা কোম্পানী কোন প্রকার বিনিময় ব্যতীতই সমুদয় সাজ সরঞ্জামসহ মিসর সরকারের মালিকানায় চলে আসবে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ চুক্তি ছিল লাভ জনক। নাসের সাহেবের মাথায় হিরো হওয়ার ভূত নগ্নভাবে সওয়ার হয়েছিল। সে লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই সুয়েজখাল জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কোটি কোটি পাউন্ড বিনিময় আদায় করে এবং এর ভিত্তিতে নিজের মিথ্যা মূর্তি মানুষের মন ও মগজে বদ্ধমূল করতে চেষ্টা করে। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেংগে চুরমার হয়ে যায় এবং নাসের সাহেবের আমিত্ব প্রশান্তি লাভ করে। তারপর আরো একটি শখ তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত বোকামি করে বসে। অগণিত নিষ্পাপ যুবক এবং উদ্দেশ্যহীন লড়াইয়ের অসহায় শিকার হয় এবং অস্ত্রশাস্ত্রের মজুদও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। অথিকাংশ জাতীয় বীর যাদের মূর্তি তৈরী করে পূজা কর হয় এভাবেই তাদের জাতিকে ব্যক্তি স্বার্থের জন্য ধ্বংসের অতল গহবরে ঠেলে দিয়ে থাকে। দূরের বাদ্য আনন্দদায়ক হওয়ারই নামান্তরের ন্যায় যখন এসব লোককে খুব নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায় তখন তাদেরকে খড়কুটা অপেক্ষা বেশী কিছু বলে মনে হয় না।
১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে কায়রো এবং বাগদাদের মধ্যে সরাসরি টেলিফোন ব্যবস্থার উদ্বেধন হয়। ফলে আলী সাহেব ও হোসাইন আল হাশেমী কায়রো এবং বাগদাদ থেকে যথাক্রমে একে অন্যের সাথে কথাবার্তা বলেন। আমার এই স্মৃতি কথাগুলো সেই নোট থেকে গৃহীত যা আবদুন নাসেরের সেনাবাহিনী আমার বাসগৃহ থেকে সমস্ত কাগজগত্র, বই- পুস্তক এবং ফাইল-নথি নিয়ে যাওয়া সত্বেও থেকে গিয়েছিল।
১৯৫৪ সনের এপ্রিল মাসে আমেরিকার গৌরব ও কৃতি বৈমানিক লিন্ড বার্গের পুত্রের হত্যাকারীকে ফাঁসি দেয়া হয়। অপরাধী অত্যন্ত নির্মমভাবে এই ছোট্র শিশুটিকে হত্যা করেছিল। ঘটনাটি ছিল অ্ত্যন্ত ভয়ংকর ও পাশবিক। কিন্তু আমাদের দেশের মত এ ঘটনাকে বাহানা বানিয়ে না কোন সংগঠনকে বলির পাঠা বানানো হয়েছে না জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। লিন্ড বার্গ ছিলেন এমন এক বৈমানিক যিনি সর্বপ্রথম ১৯২৭ সালে একটি ক্ষুদ্র বিমানে নিউইয়র্ক থেকে প্যারিস পর্যন্ত একটানা সফর করেছিলেন। {১. চার্লস লিন্ড যিনি বিমান যোগে উত্তমাশা অন্তরীপের ওপর দিয়ে উড্ডয়ন করতঃ নিউইয়র্ক থেকে প্যারিস পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেন। তার নাম ছিল স্পিরিট আপ সেন্ট লুই। ইহা ছিল মহাশূন্যে উড্ডয়নের ইতিহাসের এক স্বরণীয় ঘটনা এবং মহাশূন্যচারীদের এক দুঃসাহসিক অভিযান। এই উড্ডয়নের পর লিন্ড বার্গের খ্যাতি সার বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের মধ্যেও অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে তাকে দেখা হতে থাকে। অতপর তিনি রাজনীতিতেও জড়িত হয়ে পড়েন এবং আমেরিকার স্বনামধন্য রাজনীতিবিদরূপে পরিগণিত হতে থাকেন। তারই ছোট্র বাচ্চাকে হত্যা করা হয়েছিল।}
হোসনী মোবারকের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভংগী
অনেকেই আমার নিকট জিজ্ঞেস করেন যে, মুহাম্মাদ হোসনী মোবারকের সরকারের মম্পর্কে আমাদের ভুমিকা কি? আমার জবাব হলো, তিনি কাতিপয় ভাল পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তার শাসনামলের সূচনা করেছিলেন। যেমন তিনি রাজবন্দীদের মুক্তি দিয়েছিলেন এবং সংবাদপত্র ও পত্র-পত্রিকাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তারর আরব রাষ্ট্রসমূহের শাসকদের বিরুদ্ধে লিখনী পরিচালনা করা থেকে বিরত থাকেন। আমার আকাংখা আমাদের সংবাদপত্রসমূহ এরূপ নির্দেশনা ছাড়াই যেন নিজেরাই যুক্তিসংগত কর্মপন্থা অবলম্বন করেন।
রাষ্ট্রপতি বিরোধীদলের সংবাদপত্র ও সাময়িকীকে সমালোচনার অধিকার দিয়ে একটা উত্তম ঐতিহ্য স্থাপন করেছেন। মাঝে মধ্যে রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারেও নিশ্চিয়তা প্রদান করতেন যে, তিনি মৌলিক মানবাধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল এবং তিনি তার এ ভূমিকার ওপর অবিচল থাকনেব। এসব কথা আনন্দদায়ক। রাষ্ট্রপতিরও আমাদের ওপর এ অধিকার রয়েছে যে, আমরা তার এসব মহৎ গুণাবলীর স্বীকৃতি প্রদান করব। এবার আসুন অপর দিকে তাকাই। আমাদেরও তার ওপর এমন কিছু অধিকার আছে যা সংকল্প সংশোধন দাবী করে আমরা সেগুলো চিহ্নিত করে তাকে জানাবো। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপ্রধানের ওপরই বর্তায়। কিন্তু যা হচ্ছে তা খুব একটা প্রশংসার যোগ্য নয়। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এমন কোন সপ্তাহ অতিবাহিত হয় না যখন বেশ কিছু সংখ্যক ইখওয়ানকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গ্রেফতার করা হয় না্ পাকড়াও করার পর তাদের সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ ও রূঢ় ব্যবহার করা হয়। কয়েক ঘন্টা, দিন অথবা সপ্তাহের পর তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাদের বলাও হয় না যে কেন এবং কি অপরাধে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ছেড়েই বা দেয়া হচ্ছে কেন। কোন ইখওয়ানীকে যখন আদালতে উপস্থিত কর হয় তখন আদালত সংগে সংগে তাকে মুক্তিদানের নির্দেশ জারী করে কেননা আনীত অভিযোগের কোন যৌক্তিকতা ও ভিত্তি পাওয়া যায় না।
এগুলো এমন সব জুলুম-নির্যাতন যা এই প্রতিশ্রুতির সাথে খাপ খায় না। যাতে আযাদী ও নাগরিকদের হিফাজতের গালভরা বুলি আওড়ানো হয়ে থাকে। এ নাজুক বিষয়ে বিরোধী দলের পত্র-পত্রিকায় বার বার মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু সবই বৃথা।
আমাদের এ অভিযোগ যথার্থ ও বাস্ত যা প্রকাশ করার অধিকার আমাদের রয়েছে। কিন্তু আমরা বার বার বলেছি যে, আমরাপ বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার পক্ষপাতি নই। আমরা যথার্থ সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। এটা খুবই দুর্বল পদক্ষেপ মাত্র। যার পরে আছে নীরবতা ও মৃত্যু। আমাদের বিরোধিতা করার কোন শখ ও আবেগ নেই। কিন্তু ভুল ভ্রান্তি দেখিয়ে দেয়া দ্বীনি দায়িত্ব ও জাতীয় কর্তব্য। এ কর্তব্য সম্পাদনে আমরা জঘণ্যতম স্বৈরাচারী আমলেও নির্বিকার ও উদাসীন থাকিনি।