পঞ্চদশ অধ্যায়
মাহফিল পন্ড
আমার স্মৃতিকথার আলোচনা প্রসংগে সাদাতের সেই প্রস্তাবের উল্লেখ ইতিপূর্বে করা হয়েছে যে সম্পর্কে তিনি “পাবলিক প্রোসিকিউটিঙ এজেন্সির” ভিত্তি রাচনা করেছিলেন। পুলিশ বিভাগ তো বিভিন্নভাবে পৃথিবীর সকল দেশেই পাওয়া যায়। তথাপি সাদাত সাহেবের প্রতিষ্ঠিত এই বিভাগটি ছিল সর্বাপেক্ষা ভিন্ন। অন্য কোন দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যার তুলনা খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি অপ্রাণ চেষ্টা করি কিন্তু কোথাও পাইনি। এই সংস্থার লোকজন কোন ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধানের জন্র আমার সহযোগিতা কামনা করে। প্রথম বৈঠক কোন প্রকার বিরতি ছাড়া একটানা ছয় ঘন্টা স্থায়ী হয়। তারপরও আরো পাঁচবার আমাকে উপস্থিত হওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। কোন অধিবেশনেরই সময়কাল দু’ঘন্টার কম ছিল না। এত দীর্ঘ ও প্রাণান্তকর অনুসন্ধানের পর ফলাফল দাঁড়ায় সম্পূর্ণ শূন্য। পর্বতের মুষিক প্রসব প্রবাদের নির্মম বাস্তব রূপ।
নিকটতম গুপ্তচর বৃত্তি
এই অনুসন্ধান কার্য চলাকালীন সময়ে আমি জানতে পাই যে, এই সংস্থার কর্মকর্তাগণ আমার প্রতিটি গতিবিধি সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত থাকতো। তারা ছায়ার ন্যঅয় আমার পশ্চাদানুসরণ করতো। আমার প্রতিটি শ্বাস গুণে গুণে হিসেব ক ষতো। সাদাতের শাসনামলের শেষের দিকে তিনি িএমনভাবে গুপ্তচর বৃত্তিতে তৎপর হয়ে উঠেন যে, আমি যখন যেখানেই মুখ খুলেছি তারা “কিরামান কাতিবিনের” মত তার সম্পূর্ণ রেকর্ড সংরক্ষণ করেছে। আমি কায়রোর বার এসোসিয়েশনে “ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা” শীর্ষক বিষয়ের ওপর বক্তব্য পেশ করি। যার প্রতিটি শব্দ এই বেচারাদের লিপিবদ্ধ করতে হয়। অনন্তর প্রতিটি শব্দের বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা হয় যে, আমি কোথাও এমন কোন কথা বলেছি কি না যার পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এটা ছিল এমন এক প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি নাগরিকের পিছনে সি আই ডি লাগিয়ে রাখা হতো। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেন কারো ব্যক্তিগত জীবন বলতে কোন কিছুই ছিল না। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল এই যে, এতদসত্ত্বেও কোন কোন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবি সাদাতের আমলের প্রশংসায় মুখর।
কোন সরকারেরই এ ধরনের কর্মপন্থা শাসক ও শাসিতের কারো জন্যেই কল্যাণকর হতে পারে না। এতে বরং উভয় পক্ষের মধ্যেই সংশয়-সন্দেহ, ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং অবিশ্বাস ও অনাস্থাই সৃষ্টি হয়ে থাকে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সত্য কথাই বলেছেন: শাসক যখন প্রজা সাধারণের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে তাদের পেছনে লেগে যায় তখন সে তাদেরকে খারাপ করে ছাড়ে।
প্রতিটি লোকের পশ্চাতে গোয়েন্দা নিয়োগকারী শাসক নিশ্চিত এই অনুভূতি রাখে যে, জনসাধারণ তার ওপর সন্তুষ্ট নয়। এমনকি তার অনুসৃত পলিসিও গণস্বীকৃতি লাভ করেনি। অন্যথায় প্রত্যেক ব্যক্তির পেছনে সি আই ডি নিযুক্ত করার প্রয়োজন কি?
আমি কতবার বলে এসেছি যে, আমার এই স্মৃতি রোমন্থন করার উদ্দেশ্য কোন প্রকার গর্ব বা অহংকার প্রকাশ করা আদৌ নয়। মিসর ও মিসরের বাহির েথেকে অসংখ্য লোক আমার সাথে সাক্ষাত করার জন্য আমার বাড়ীতে এসে থাকেন। অথচ আমার বাসগৃহের পরিবেশ খুবই অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে ধরনের। আমার ঘরের সাজ-সরঞ্জামের প্রায় সবই ১৯২৬ সালের। চেয়ার, সোফা এবং অন্যান্য আসবাবপত্র পুরনো হওয়ার কারনে সেগুলো আসল রং রূপ ও চেহারা হারিয়ে বসেছে। আমার কোন কোন বন্ধু বান্ধবের এ দৃশ্য আদৌ পছন্দ নয়। মিসরের বাহির থেকে আগত আমার কোন হিতাকাংখী প্রস্তাব করেছেন যে, আমার জন্য কোন বিলাস বহুল ও নামীদামী মহল্লায় বাড়ী ক্রয় করে তা উত্তমরূপে অত্যাধুনিক আরাম আয়েশের উপায় উপকরণ দ্বারা সজ্জিত করে দেবে। আমি তাদের এই প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি শানশওকাত ও ভোগ বিলাসিতা আদৌ কামনা করি না। যে বাড়ীতে এবং যে অবস্থায় আছি তাতেই আমার মন ও মস্তিষ্ক খুব পরিতৃপ্ত আছে। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করছি যে, তিনি আমাকে এভাবে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। আমার মনের গভীর কন্দরে কখনো এমন মনোভাব দেখা দেয়নি যে, বর্তমান বাসস্থান ও সাজ-সরঞ্জাম পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। আমি আল্লাহ তায়ালার নিকট তার শোকর আদায় করছি এবং তার রহমত ও আশ্রয়ের প্রত্যাশা করছি। আর তা আমি সর্বদা লাভও করেছি। একজন মু’মীন বান্দাহ যখনই আত্মতৃপ্তি ও মানসিক প্রশান্তি নিয়ে দুনিয়ার সুখ সম্ভোগ ও আরাম-আয়েশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সর্বদা তখনই তার সন্তুষ্টি অর্জন এবং তারই নৈকট্য লাভের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে যায় তখনই তার প্রকৃত সাফল্য অর্জনের সকল উপায় উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে তার হস্তগত হয়ে যায়।
হে আল্লা! আমাকে এমন অবস্থায় সন্তুষ্ট রাখো- যাতে তোমার সন্তোষ লাভ করতে পারি এবং এই ক্ষণস্থায়ী জগতের বিত্ত-বৈভবের কঠোর পরীক্ষায় তুমি আমাকে ফেলো না।
যেমন রাজা তেমন প্রজা
আমার মতে মুসলিম উম্মাহ আজ যেসব বিপদ ও কঠোর পরীক্ষায় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তার কারণ অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থানের দুষ্প্রাপ্যতা নয়। বরং প্রকৃত সমস্যা সেসব অদৃশ্য হাতের সৃষ্ট যারা এসব মৌলিক প্রয়োজনের কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি মুসলিম জাহানের প্রতিটি দেশে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব আমানতদার ও বিশ্বস্ত লোকদের হাতে এসে যায় তাহলে ইসলামী দুনিয়া বিশ্বের সব জাতির মোকাবিলায় সর্বাপেক্ষা অধিক মজবুত ও আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত হতে পারবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের সাথেই বলতে হচ্ছে যে, মুসলিম বিশ্বের এরূপ অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনাই সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়েছে এবং একান্ত ব্যতিক্রম ছাড়া সর্বত্র উল্টো হাওয়াই প্রবাহিত হচ্ছে। সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর লোকজন উচ্চশ্রেণীর লোকতের প্রতি চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে এবং যদি দেখতে পায় যে, তারা অধপতনের গভীর পংকে নিমজ্জিত হচ্ছে তাহলে এরাও একই অপরাধে অপরাধী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। এভাবে এই অকল্যাণের চক্র গোটা জাতির দেহে রক্তের ন্যায় প্রবাহিত হতে থাকে। “যেমন রাজা তেমন প্রজা” প্রবাদ বাক্যের সত্যতার ন্যায় সমাজের নীচুস্তরের লোকেরা উঁচুস্তরের লোকদের অনুসরণ করে থাকে। যেহেতু ওপরের তলার লোকদের মধ্যে ও ব্যাধী সংক্রামক রোগের মত বিস্তার লাভ করে আছে। দেশ ও জাতির মংগল ও কল্যাণ কামনার তুলনায় ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুযোগ সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয। তাই প্রত্যেকেই আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে।
চেষ্টা দ্বারাই অভ্যাস গড়ে ওঠে
আমি যখন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম তখন দেখতে পেলাম মসজিগুলোর অবস্থা খুবই রুণ। যে মসজিদেই আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সেখানেই বয়োবৃদ্ধ, গরীব ও কাংগাল মানুষ দেখতে পেয়েছি। সচ্ছল ও যুব সমাজের কোন সম্পর্ক মসজিদের সাথে নেই বললেই চলে। নিত্য দিনের লেন-দেনে ও সভ্যতা সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মানুষ ইসলামী কাজ-কর্ম করতে কোন প্রকার লজ্জা অনুভব করতো না। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াতের সূচনা হলে কিছু দিনের মধ্যেই এর সুফল প্রকাশ পেতে শুরু করে এবং রিস্থিতিতে সুস্পষ্ট পরিবর্তন আসতে থাকে। মসজিদে মসজিদে যুবকশ্রেণীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যার আগমন শুরু হয়। উঠতি বয়সের এসব মুসলিম তরুণ ইবাদাতে নিষ্ঠা ও ইসলামী জ্ঞান চ র্চায় প্রবল ঈমানী প্রবণতা প্রদর্শনী করতে থাকে। সর্বত্র বিরাজমান পরিস্থিতিতে গণমূলক ও সম্ভাবনাময় আমূল পরিবর্তন প্রতিভাত হতে লাগলো। অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে, সাধারণ রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দও দ্বীনি শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার ধারাবাহিক আলোচনা করতে থাকে। এটা ছির একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন। ইখওয়ান তো আল্লার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাজের সূচনা করেছিল। কিন্তু কতিপয় রাজনৈতিক দল ইসলামের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ এবং আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন দেখে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যেই ইসলামের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেযাতে তারাও কিছুতেই ইখওয়ান থেকে পিছিয়ে না পড়ে। যা হোক ভাল কাজের প্রতিযোগিতা করাও উত্তম অবশ্য তজ্জন্য শর্ত হলো নিয়ত সৎ হতে হবে।
আমাদের দুরদৃষ্টিকে ব্যাপকতা দাও
এই দাওয়াতের ফল এই যে, এখন প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের ঘোষণাপত্রের শিরোনামে এ বিষয়টি লিপিবদ্ধ করে দেয় যে, বিজয় লাভ করল তারা দেশে ইসলামী শরীয়াত চালু করবে। এটা দাওয়াতে ইসলামীর সফলতার চাক্ষুষ প্রমাণ ইসলামের শত্রুরা এই দ্বীনের বিরুদ্ধে যত চক্রান্ত ও কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল; এক্ষণে তা প্রায় সবটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। খৃস্টান মিশনারীদের সম্মুখে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে। দাওয়াতের এসব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুরো একে নির্মূল করার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সকল দেশেই মিশনারীদের গৃহীত কর্মনীতি হচ্ছে, তারা হাসপাতাল, স্কুল ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজকে তাদের বাণী প্রচারের উপলক্ষ বানিয়ে থঅকে। জনগণের সেবায় ছ্দ্মাবরণে মূলত ক্রমে আন্দোলন তার পাঞ্জা শ্ত করে গেড়ে দেয়। এ ব্যাপারে আমি কখনো উদাসীন ছিলাম না। আমার মনে পড়ে শাবীনুল কানাতিরে হারমূল হাসপাতালে সর্বদা রোগীদের ভিড় লেগেই থাকে। আমি জানতে পেরেছি যে, চিকিৎসা ও ঔষধ পথ্যের সাথে সাথে খৃস্টবাদের দাওয়াত দেয়া হয়ে থাকে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন এই প্রতিষ্ঠানের মুখোশ উন্মোচন করে এর আসল চেহারা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়। তারপর আর যায় কোথায়? হাসপাতাল রোগী শূন্য হয়ে পড়ে এবং সেখানে পেঁচকের দল বাসা বাঁধে। ইখওয়ান গ্রামীন কৃষকদল, পেশাজীবি, শ্রমজীবি এবং সাধারণ বস্তিবাসীদের অবহিত করে যে, মানবীয় সহানুভূতির পর্দার অন্তরারেল হাসপাতালের আমলা ও কর্মচারীরা তাদের দ্বীন ও ঈমানের ওপর কুঠারাঘাত করছে। ফলে এই হাসপাতাল অন্যভাবে বলতে গেলে খৃষ্টবাদ প্রচারের কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়।
ত্রুটিমুক্তি ব্যবস্থা
আমার মনে পড়েছে যে, যখন কোন লোক ইখওয়ানের রাজনৈদিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক দর্শনের উল্লেখ করতো তখন আমার মনে এই “দর্শন” শব্দটি বেশষ খটকা সৃষ্টি করতো। কোন কোন দর্শনশাস্ত্রবিদের মতে “দর্শনের” সংজ্ঞা হচ্ছে, “মানুষের অনুসন্ধান ও ভুল-ভ্রান্তির সমষ্টি, হোঁচট খাওয়া তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং ভবিষ্যতে হোচঁট খাওয়া থেকে আত্মরক্ষা করা” –ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি দর্শনের সংজ্ঞা এই হয় তাহলেতো ইসলামী আকীদা বিশ্বাস এই দর্শন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও অমুখাপেক্ষী। কেননা এখানে হোঁচট খাওয়া এবং ভুলভ্রান্তির পর সংশোধনের না কল্পনা করা যায় আর না তার অবকাশ আছে। এটা আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত জীবন বিধান যা সূর্যের চেয়েও দীপ্তিময়। আমাদের আল্লাহ এক আমাদের শরীয়ত এক আমাদের রাসূল এক আমাদের দ্বীনের সকল বিষয় সুস্পষ্ট, সর্বজনবোধ্য ও কার্যকরী করার যোগ্য। একজন শিক্ষিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এতে কোন দার্শনিক তত্ব কিংবা তর্কশাস্ত্রের মারপেচের আদৌ কোন আবশ্যকতা নেই।
আমাদের কোন কোন স্বনাম ধন্য ইমা ও আলেম দর্শনের ময়দানে যে সমস্ত তাত্বিক আলোচনা পেশ করেছেন তা কেবলমাত্র গ্রীক এবং অন্যান্য বিজাতীয় দেশ থেকে আনীত যুক্তিবিদ্যার প্রভাব এবং ইসলামের ওপর আরোপিত ভিত্তিহীন অবান্তর আপত্তি ও সমালোচনার যথাযথ প্রতিবাদ জ্ঞানের নিমিত্তেই ছিল। উদাহরণ স্বরূপ ইমাম গায্যালী ও ইবন রুশদ প্রমুখ মনীষীদের গবেষণামূলক গ্রন্থ লক্ষণীয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম জনসমাজের ওপর থেকে অবাঞ্ছিত দর্শনশাস্ত্রের প্রভাব জনিত ভীতি বিদূরিত করা এবং সক্রেটিস, হিপক্রাটিস ও প্লেটো প্রমুখ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকগনের ভ্রান্ত মতবাদের প্রত্যাখ্রান ছাড়া আর কিছু নয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রাচীন ও আধুনিক এসব দার্শনিক মুসলমানদের অন্তরে সন্দেহ এবং সংশয় সৃষ্টি করার জন্য সযত্ন প্রয়াস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ওয়াহদাত অযুদ বিষয়ে কালামশাস্ত্র এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ের মাথা ঘামানো নিরেট পণ্ডশ্রম মাত্র। এভাবে সময়ের অপচয় ও মস্তিষ্কের ক্ষয় ছাড়া আর কোন লাভ হয় না।
আমি আমার সারা জীবন প্রত্যাশার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অতিবাহিত করে দিয়েছি। আমি সর্বদা প্রতিটি জিনিসের উজ্জল দিক দেখে থাকি। হতাশা ও নৈরাশ্য কখনো আমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না। তার কারণ শুধু একটাই আর তা হচ্ছে এই আকীদা বিশ্বাস যে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ব্যতীত কোন ঘটনা এই পৃথিবীতে সংগঠিত হতে পারে না। আল্লাহর ইচ্ছঅকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। তার ইচ্ছা অবশ্যম্ভাবীরূপে কার্যকরী হয়ে থাকে। এ থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। আল্লাহ অত্যন্ত দাতা ও দয়ালু। আমাদের কর্তব্র হচ্ছে যেসব বিষয়ে আমাদের মন সন্তুষ্ট হয় না সেগুলোর ব্যাপারে নিম্নে বর্ণিত মূলনীতির আলেঅকে আমাদের কর্মনীতি স্থির কতে হবে:
১-আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত কি নিরংকুশ বিচারক নন? নিশ্চিত তিনি মহাবিচারক। তাহলে যা কিছু ঘটেছে তাতেও নিশ্চযই কোন নিগঢ় রহস্য লুকায়িত রয়েছে।
২-আল্লাহ কি পরম দয়ালূ নন? অবশ্যই। তবে আর ঐ সমস্ত বিপর্যয় যা বাহ্যত মূসিবতরূপে পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কোন নিগূঢ় জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল এবং তাতে আল্লাহর রহমত নিহিত। যদিও আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান তার গভীরে পৌঁতে অপারগ।
৩. আল্লাহ তায়ালা কি সুবিচারক নন? নিশ্চয়ই তাহলে তাঁর এমন কোন ফায়সালা হতে পারে না যার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে।
এরূপ চিন্তাধারা গ্রহণ করলে হতাশা উদাসীনতা, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা কিছুতেই আমাদের অন্তরে শিকর গজাতে পারে না। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি সর্বদা হাসি মুখ থাকতেন। মানুষকে হতাশা থেকে দূরে রাখার জন্য সুসংবাদ শুনাতেন এবং আল্লাহ তায়ালার ফায়সারার ওপর সন্তুষ্ট থাকতেন। তার পবিত্র চেহারায় অসন্তোষের লক্ষণ ললাটে ভাঁজ শুধু মাত্র এমন অবস্থায় পরিদৃষ্ট হতো যখন আল্লাহ তায়ালা নিষিদ্ধ কার্যাবলীর কোথাও কোন বিরুদ্ধাচরণ হতো। এতদ্ব্যতীত তিনি সর্বদা আনন্দিত থাকতেন।
ইখওয়ানের সমস্ত সাথী জেলখানার দুঃখ জীবনেও সর্বদা হাসিখুশী ও অত্যন্ত আশাবাদী থাকতেন। কারারক্ষীগণ কখনো কখনো আমাদের জিজ্ঞেস করতো তোমরা কি আল হুদাইবির সাথে রয়েছো নাকি আবদুন নাসেরের সাথে? আমাদের মধ্যে কোন এক ভাই জবাব দিতেন- “আমি তো রয়েছি আল্লাহর সাথে।” একথা শ্রবণে সরকারী কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ কারতো।
সিরাজের দাওয়াত
আমরা যখন কেন্দ্রীয় অফিসে একাধারে কয়েক ঘন্টার অধিবেশনে মিলিত হতাম তখন সেখানে যা কিছু পাওয়া যেতো সম্মিলিতভাবে খেয়ে নিতাম। আন্দোলনের প্রাথমিক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমাদের এক ভাই আলীর অভ্যাস হচ্ছে, তিনি সম্মেলন চলাকালীন সময়ে লুবনের তরকারী রুটি ও ভূনা কলিজা নিয়ে এসে উপস্থিত সকলের খেদমতে হাজির করতেন। বেশীর ভাগ সময়ই তিনি তার ব্যক্তিগত খরচে এই সব খাদ্য সামগ্রী এনে ইখওয়ানদের খাওয়াতেন। দামের কথা জিজ্ঞেস করা হলে পাশ কাটিয়ে যেতেন। আল্রাহ তায়ালা তাকে বেশী করে পুরস্কৃত করুন। তাকে তার এই খেদমতের সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন। তাকে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ প্রদান করুন এবং নেক আমলের তাওফীক প্রদান করুন। আমাদের পারস্পরিক আচরণ সকল প্রকার লৌকিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ইখওয়ানের মধ্য থেকে কোন ভাই যদি কখনো দাওয়াত খেতে আমন্ত্রণ জানায় তখন কম বেশী কিছুটা ধমধাম পড়ে যায়। সারীদ ও গোশত দ্বারা সকলকে আপ্যায়ন করা হয়। কোন কোন ভাই যাকে আল্লাহ তায়ালা পর্যাপ্ত ধন-সম্পদ দান করেছেন তিনি মেহমানদারীর সময় রকমারী সুস্বাধু ও ঘৃতপক্ক খাদ্য হাজির করতেন। এ ব্যাপারে নিয়ম ছিল, সংগীদের মেহমানদারী করার জন্য কোন প্রকার কার্পণ্য করা হতো না। আর কোন রকম বাহুল্য ব্যয়ও পছন্দ করা হতো না। প্রত্যেক ভাই তার দ্বীনি ভাইদেরকে তার সামর্থানুযায়ী সম্মান করতে তৎপর থাকতো। কেননা রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅমের একটি বাণীর মর্মার্থ এই যে, “তোমাদের মধ্যে যেই আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে তার উচিত মেহমানদের সম্মান করা।”
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল
আমার জীবনের প্রথম দিকে আমার আগ্রহ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ওয়াফদ পার্টির প্রতি। কিন্তু সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল বন্ধু প্রতীম। এই কারণে অনেক মজার কাহিনীও সংঘটিত হয়েছে। যেমন দু’টো পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দল একই সময় আমাকে তাদের দলের সদস্য রূপে মনে করেছে। মরহুম আহমদ হামজা পাশা ক্ষমতাসীন ওয়াফদ পার্টির অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। তার সাথে ছিল আমার ঐকান্তিক সম্পর্ক। আল কালয়ুবিয়া প্রদেমের প্রাদেশিক সংগঠনে তিনি আমার নাম ওয়াফদ পার্টির কমিটির অন্তর্ভুক্ত করিয়েছিলেন। একই সময় শাবিবুল কানাতির অঞ্চল থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য জনাব মুহাম্মাদ আল ফাকী বেগ মরহুম আমার নাম তার পার্টির মধ্যে শামিল করেছিলেন। আমাকে কখনো না ওয়াফদ পার্টির কোন সদস্য কিছু জিজ্ঞেস করেছে না দাস্তুরীগণ। আমিও এতে কোন রকম অসুবিধা মনে করতাম না। কেননা ইখওয়ানের মধ্যে আমাদের মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জনাব মোহাম্মদ আবদুর রহমান নাসির মরহুম হিজাবে দাস্তুর-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। এমনকি তিনি এই দলের পক্ষ থেকে নাবহা এলাকার পার্লামেন্টের সদস্যও ছিলেন। ইমাম হাসানুল বান্না শহীত তাঁর হিজবে দাস্তুর-এর সদস্য পদের ব্যাপারে কখনো কোন আপত্তি উত্থাপন করেননি।
এই সময় ইখওয়ান সদস্যগণ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য হতে পারতেন, যদি তাদের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইখওয়ানের আন্দোলনের পয়গাম সর্বস্তরের জনগণের নিকট পৌঁছানো হতো এবং অন্য সকল বিষয়ই তার কাছে গৌণ বলে বিবেচিত হতো। ইখওয়ানের বেশ কিছু সদস্য ওয়াফদী, দস্তুরী, সা’দী (সা’দ জগলুল পাশার নামানুসারে), মাহাযী, কিংবা হিজুল ওয়াতানী দলের সদস্য ছিলেন। তারা যেখানেই থাকুক না কেন সেই প্লাটফর্ম থেকেই দাওয়াতে হকের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে থাকতেন সদা তৎপর। আর তাদের মূল বিশ্বস্ততা ছিল আল্লাহ ও রাসূলের সাথে।
আমি কখনো কোন দলের সদস্য পদ ও দাওয়াতে হকের মধ্যে সংঘাতের কোন লক্ষণ দেখতে পাইনি। ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য কোন দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ধারণাও আমার ছিল না। অবশ্য আমি শেক্সপিয়ারের কায়জারের কাহিনীর ঐ অংশ সর্বদা পছন্দ করতাম যে কোন অবহেলিত গ্রামের নেতৃস্থানীয় পদ লাভ রোম নগরে দ্বিতীয় পজিশন অপেক্ষা শ্রেয়। এ বাক্যাংশে আমার এজন্য ভাল লাগতো না যে, আমি নাম ও যশের প্রত্যাশী। বরং এর লেশমাত্রও আমি অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে থাকি। আমি কোন দিনই কোন পদলোভী ছিলাম না। এজন্য কোন প্রকার চেষ্টা তদবীরও করিনি। মাকতাবে ইরশাদের সদস্য পদ থেকে আমি সর্বদা পাশ কাটিয়ে চলতাম। কিন্তু ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ আমাকে এর কর্মকর্তা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর যখন ইমাম আল হুদাইবি মুর্শিদে আ’মের দায়িত্বে অভিষিক্ত হন তখন প্রতিষ্ঠা মজলিশের সদস্যগণ আমাকে এই পদে সামাল দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। মিসর কিংবা মিসরের বাহরে যখনই আমাদেরকে কোন কক্ষে বসতে হতো তখন সর্বদা আমার প্রচেষ্টা থাকতো দরজার পাশে বসার যাতে কেউ আমাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এরূপ অনুরোধ করার সুযোগ না পায় যে, আমার পাশে বসুন!
আমি কি আর আমার ক্ষমতাই বা কি?
আমি আমার ও পূর্ববর্তী দু’দু’জন মুর্শিদে আ’মের মাঝে আসমান জমিনের ফারাক মনে করি। সত্য করে জেনে রাখুন এটা বিনয় নয় বরং সত্য। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকেই এরূপ ধারণা পোষণ করি আর এটাই বাস্তব। আমার ওপর এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে এবং ইখওয়ান আমাকে তাদের জ্যেষ্ঠ েভ্রাতা মনে করে থাকে। অথচ আমি নিজেকে এই কঠিন দায়িত্ব পালনের যোগ্য বলে আদৌ মনে করি না। নিজের মর্যাদা যোগ্যতা ও অবস্থান সম্পর্কে আমার ভালভাবেই জানা আছে। আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যক্তির ওপরই রহমত নাযিল করেন যিনি তার সম্মান ও আত্মমপরিচয় সম্পর্কে সচেতন থাকেন।
আমার স্মৃতিকথার মধ্যে সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক ও মূল্যবান জিনিস হচ্ছে, আমি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াতের সাহায্যে আমার নিজেকে জানার সুযোগ পেয়েছি এবং এই জীবনে এমন ব্যক্তিত্ব লাভ করেছি যার অস্তিত্ব ও অবস্থান রয়েছে। এই দাওয়াতের বদৌলতে আমি সাক্ষ্য করেছি যে, আমি খাদ্য গ্রহণ করে থঅকি জীবন ধারণ ও দ্বীনি দায়িত্ব পালন করার জন্য কেবলমাত্র খাওয়ার জন্যই আমি বেঁচে থাকি না।
জীবনটা ধরে রাখতে হলে খেতে হয়; খাওয়ার জন্যই বেঁচে না থাকার নিষ্টুর বাস্তবতা আমার সম্মুখে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পয়গামই তুলে ধরেছে। যদি আমার যৌবন ফিরে আসে যার জন্য আমার কোন আকাংখা নেই বরং আমার ব্যক্তিত্বের মধ্যেই আমার বার্ধক্যের বিরাট অংশ রয়েছে। এর বদলে আমি পুনরায় যৌবন লাভ করে এই মহাসম্পদ ছাড়া করতে চাই না। যা জীবনভর আমি জমা করছি —। তা হলে আমি সেই নবযৌবনে কি গতিধারা অবলম্বন করবো? আমাকে যদি এই যৌবন দেখিয়ে বলা হয় যে, তুমি তোমার নিজের জন্য রাস্তা বেছে নাও। তাহলে আমি নির্দ্বিধায় সেই পথই অবলম্বন করবো যে পথে আমি আমার বিগত জীবন অতিবাহিত করেছি। আল্লাহ তায়ালার সাথে এ অপেক্ষা বেশী নৈকট্য আর কি হতে পার যে, জীবন তারই পথে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রম হয়েছে। আমার ন্যায় দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তির পক্ষে অতসব মুষ্কিল ও কঠিন চড়াই উৎরাই অতিক্রম করা কি করে সম্ভব ছিল যদি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ও তার পক্ষ থেকে অবিচল থাকার তাওফীক আমাকে পরিবেষ্টন না করে নিতো এই চড়াই উৎরাই ও উত্থান পতন-যাতে আমার জীবন কেটে গেলো –তার স্মৃতি রোমন্থন করতে আমার খুবই ভাল লাগে। এটাই আমার মূলধন এবং এটাই আমার সম্বল ও পাথেয়। এটাই দুনিয়াতে সম্মান এবং আখেরাতে মংগল ও কল্যাণ। আমি আমার জীবন নিয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত।
বদদোয়া ও তার লক্ষ্য
একবার আমি মিসরের পাহাড়ী অঞ্চলে এক জেলখানায় বন্দী ছিলাম। জেলের কর্মকর্তাদের একজন আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠায় এবং জামাল আবদুন নাসেরের গুণাবলী ও গৌরবজনক কীর্তিগাতা বর্ণনা করতে থাকে। সাথে সাথে ইখওয়ানের সংগঠন মুর্শিদে আ’মের বিরুদ্ধে বিষোধগার করতে থাকে ও তার সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে। এমন সব মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে যা মিসরে নিত্যদিনকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এবং যার কোন অস্তিত্ব এই ইখওয়ান বিদ্বেষীদের মনমানস ও কথাবার্তা েএবং আচার আচরণ ব্যতীত আর কোথাও ছিল না। সে অন্যুন আধা ঘন্টা পর্যন্ত ভাষণ দিতে থাকে। আমি পিন পতন নীরবতার সাথে ও নিবিষ্ট মনে তার বক্তৃতা শুনতে থাকি। সে মনে করে যে, তার বক্তব্যেল যাদু আমর ওপর ক্রিয়া করেছে। তারপর সে বলতে লাগলো, “এখন তোমার মতামত কি? তুমি কি আবদুন নাসেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত?”
আমি জবাব দিলাম তুমি তোমার মনোভাব ও দৃষ্টিভংগী বর্ণনা করতে নিসন্দেহে কোন কসুর করনি। কিন্তু আমি আমার বিবেককে প্রশ্ন করছি সুদীর্ঘ এতগুলো বছর অত্যাচারের ষ্টিম রোলারে পিষ্ট হওয়ার পর এখন আমি জালিমের পৃষ্ঠপোষকতা করতে আরম্ভ করবো যার অত্যাচারের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়ে এসেছি আমি নিজেও? এত বছর ধরে আমি কি একেবারে জ্ঞানহীন ও গন্ডমূর্খ ছিলাম যে, এখন স্বীকৃতি প্রদান করবো নাসের হকের ওপর আছে। আর আমি আছি বাতিলের ওপর? যদি বাস্তবিকই আমার অবস্থা এমন হয়ে থাকে তাহলে তো আমি এর চেয়েও অধিক কঠোর শাস্তি এবং দীর্ঘ কারা জীবনের উপযুক্ত। অতএব আমার পক্ষ থেকে অপারগতা প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমি আপনার দাবী মেনে নিতে পারছি না।
এই কর্মকর্তা আমাকে পুনরায় আমার কুঠরিতে নিয়ে যায় তখন তার মুখ থেকে অভিশাপের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছিল। সে কোন রকম বিরতি ছাড়াই বলে যাচ্ছিলো আল্লাহ তোমার বংশ পরিবারকে ধ্বংস কর দিন, আল্লাহ তোমার সর্বনাশ করুন…..। আমি সেই মুহূর্তেই উপলব্ধি করলাম যে, তার বদদোয়া আমর ওপর পতিত হওয়ার পরিবর্তে শূন্যে ঘুর পাক খাচ্ছে এবং কয়েক পলক আবর্তিত হওয়ার পর যোগ্য লোক্ষ্যের ওপর গিয়েই আঘাত হানল। এর লক্ষ্যবস্তু আমি নই বরং কারাগারের এই কর্মকর্তা। আর সুধি পাঠক! আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন যে, প্রকৃত অবস্থা তাই পরিদৃষ্ট হলো। সে ব্যক্তি ক্যানসারের শিকার হয়ে মারা যায়। আল্লাহ তাকে তার রহমতের ছায়া তলে স্থান করে দিন এবং আমার ও তার ক্ষমার বিষয়টি বিবেচনা করুন।
জিহাদে অংশগ্রহণের দাবী
১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল নিয়ে যুদ্ধের সময় আমি আল ওয়াহাত জেলখানায় বন্দী ছিলাম। আমরা জেলখানার দারোগার নিকট দরখাস্ত করলাম যেন আমাদেরকে জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্যে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের প্রতিটি বৃদ্ধ ও যুবক দেশ মাতৃকার রক্ষার প্রেরণায় ছিল উজ্জীবিত। জেলখানার দারোগা এই আবেগ দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং সে বিলক্ষণ বুঝতে পারে যে, এই লোকগুলো যারা শুধুমাত্র এই অপরাধের কারণে কারাগারের শাস্তি বোগ করে যাচ্ছে যে, তারা আল্লাহ তায়ালাকে তাদের রব বলে মনে করে- দেশের জন্য কত পবিত্র আবেগ পোষণ করে। তাই সে আমাদের দাবী সরকারের নিকট প্রেরণ করে দেয়, কিন্তু সেখান থেকে জবাব আসলো, না, এই “অপরাধী”দেরকে কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতেই থাকতে দাও। অনুমান করুন, ক্ষমতাশীনদের চিন্তার ধরন কত ভ্রান্ত ও জুলুমমূলক। নাসের ও তার তল্পীবাহকদের অবস্থা ছিল এই যে, তারা ইখওয়ানদের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি কথারই প্রবল বিরোধিতা করতো। এমন কি ইখওয়ান যদি বলতো, “সালমুল্লাহ” (তোমাদের উপর আল্লাহর প্রশান্তি নেমে আসুক) তখন তারা প্রত্যুত্তরে বলতো “গাজাবুল্লাহ” (তোমাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক)।
ইখওয়ানের নামে ব্যাংগ–বিদ্রূপ
মিসরের জাতীয় ইতিহাসে ইখওয়ানের কীর্তিমালা সর্বজন বিদিত। বিশেষত ইখওয়ান ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ দশ বছরে যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেছে তারই আলোকে মিসরের পুরো ইতিহাস এবং এই সমসয়ে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনা ইখওয়াকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। এতদসত্ত্বেও এই অত্যাচার উৎপীড়নের স্বরূপ দেখুন, যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া এই সময়ে প্রকাশিত কোন গ্রন্থই ইখওয়ানের কোন আলোচনা স্থান পায়নি। একেই বলা হয়ে থাকে “ক্ষমতাধরদের ইতিহাস রচনা।”
ফিরিঙ্গি সভ্যতার দাস
বৃটেনের বিদেশ মন্ত্রী মিষ্টার ইভেন্স আরব লীগ প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা বিনা কারণে ছিল না। তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছিল। পাশ্চাত্য শক্তিগুলো উপলব্ধি করেছিলো যে, ইখওয়ান বিশ্বব্যাপী একটি ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য অপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অতএব তারা ইসলামের পরিবর্তে আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি সংস্থা গড়ে তোলার জন্য তাদের ভক্ত-অনুরক্ত ও দোষরদের উৎসাহিত করে। আমি অত্যন্ত অকপটে বলতে পারি যে, ফিলিস্তিন সমস্যাকে উপলক্ষ বানিয়ে আরব লীগের কাঠামো গড়ে উঠে এবং এই কারণেই তা হিমাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। আরবলীগের দ্বারা ফিলিস্তিন যুদ্ধের অসীম ক্ষতি তো সাধিত হয়েছে। লাভ হয়নি মোটেও। এটা ছিল গোটা মুসলিম উম্মাহর সমস্যা। আর নেতৃবৃন্দ নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির জাতিগত গোঁড়ামি ও নির্বুদ্ধিতার কারণে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। আরবলীগ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান িএবং অন্যান্য অনারব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এই জিহাদ তেকে বাইরে রাখে। আমাদের শত্রুরা এটাই একান্তভাবে কামনা করছিলো।
আমি প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নববী ইসমাঈলের সাথে আলোচনা করেছিলাম যে, আমাদেরকে মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত সংগঠন কায়েম করা উচিত। আমার এই আলোচনার পর “মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত লীগ” সম্পর্কে আলোচনা শোনা যেতে থাকে। এমনকি তা প্রতিষ্ঠার ঘোষণারও দেয়া হয়্ কিন্তু যেহেতু এর ভিত্তি মজবুত ছিল না। ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং ব্যক্তি বিশেষের সুনাম সুখ্যাতি, লাভ করাই ছিল এর পশ্চাতে সক্রিয়। ফলে এই মহতী উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখার সুযোগ পায়নি। যে কাজের পশ্চাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উদ্দেশ্য থাকে না। তা কখনো ফলপ্রসূ হয় না। ফিলিস্তিনে ইখওয়ানের মুজাহিগণের কৃতিত্ব সোনালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রাখার মত। এই জিহাদের পর আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, প্রতিটি আরব রাষ্ট্রে সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপক প্রতিযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই বিপ্লব ছিল ধীর স্থির মস্তিষ্ক প্রসূত পরিকল্পনার ফল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সামরিক সরকারের সাহায্যে এই গজিয়ে ওঠা ইসলামী শক্তি “আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন”কে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে দেয়া। পরবর্তী কালে সংঘটিত ঘটনাবলী আমার এই মতামতের সত্যতা ও যথার্থতার প্রমাণ করেছে। কেউ তা মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে পারবে না। কেননা ইতিহাস তার ফায়সালা দিয়ে দিয়েছে। ইসলামী জাগরণ এবং সঠিক ইসলামী বিপ্লবের পথ রোধ করে এই জালিমগণ তাদের প্রভুদের খুশী করেছে। ফলে এই সংস্কার কাজ বহু বছর পিছিয়ে পড়েছে। একে একদিন অবশ্যই সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করতে হবে। কিন্তু সেই সুদিন আসবে কবে তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউই জানে না।