সপ্তদ্বশ অধ্যায়
অদ্ভূত ঘটনাবলীর মধ্যে আমার একটি ঘটনা সংঘটিত হয় ভাই মোস্তফা মু’মিন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। ইস্রাঈলের সাথে ক্যাম্পডেভিট চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর তিনি “আদ দাওয়া” সাময়িকীর বর্তমান অফিসে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। এই চুক্তি সম্পর্কে আলাপ হতে থাকে। তিনি বলতে লাগলেন ইখওয়ান লজ্জাবোধসহ শান্তিচুক্তির বিরোধিথা করেছে। একথায় আমি ঈষৎ হেসে ফেললাম। আমি বললাম, এই চুক্তির বিরুদ্ধাচরণ করা কি কোন অপমানজনক কাজ যে, তা করতে গিয়ে আমি লজ্জাবোধ করবো? বরং বাস্তবতা কি এই নয় যে, উপরোল্লিখিত ব্যক্তি আমাদের ভূমিকার সমালোচনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি লজ্জা বোধ করতে থাকেন।
আমার সমালোচনা পদ্ধতি
সত্য কথা হলো, আমি যখন কোন ব্যাপারে সমালোচনা করেছি তখন একটি ঢেকেই তা করেছি। কেননা একদিকে আমি কারো সম্মুখে এমন কোন বিষয় উপস্থাপন করা আদৌ পছন্দ করি না যা সে পছন্দ করে না। অপর দিকে আমিএমন দাবীও কখনো করি নাই যে, আমার মতামতই সঠিক ও নির্ভুল এবং তার বিপরীতে যত বক্তব্যই আসুক না কেন সবই বাতিল। আমি আমার মতের পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতাম ঠিকই কিন্তু কখনো কখনো আমি আমার নিজের মতেরও সমালোচনা করতে কসুর করি না। আমি এই বিসয়ে অত্যন্ত পরিতৃপ্ত যে আমার দৃষ্টিভংগী ঈমান আকীদার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বাকী থাকে এই বিষয়টি যে, আমি নিজেকে সর্বদা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করবো এরূপ মনোভাব আমার কখনো ছিল না। তবে আলআহ ও তাঁর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক হালাল ও হারাম ঘোষিত জিনিস সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। কারণ, আল্লাহ ও রাসূলের (স) ফায়সালা মুসলমানদের জ ন্য সনদ যা কখনো চ্যালেঞ্জ করা যায় না। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আমার কর্মনীতি হচ্ছে, আমার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেনি যে, আলোচনার টেবিলে আমাকেই বিজয় লাভ করতে হবে। আমার আচরণ ইমাম শাফেয়ী (র)-এর ন্যায়। অর্থাৎ তাঁর উক্তি অনুসারে আমিও চাই যে, যার সাথেই আমার আলোচনার সুযোগ হয় তার সামনেই যেন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। (এটা জ্ঞানের পরিচায়ক যে, সত্য যদি প্রতিপক্ষের কাছে থাকে তাহলে আপনি তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে সত্যের পতাকা সমুন্নত রাখার পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন। পক্ষান্তরে আপনিই যদি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকেন আর অপর পক্ষতা মেনে নিতে না চায় তাহলে তার ওপর তা চাপিয়ে দিতে পারেন না।)
দাওয়াতে হক ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে কথাবার্তা বলা ও আলাপ আলোচনা করার প্রতি আমার তেমন কোন আকর্ষণই নেই। আর এটাই ইখওয়ানের কর্মপদ্ধতি।
গন্তব্যে তারাই গিয়ে উপনীত হয়েছে যারা সফরে অংশগ্রহণ করেনি
ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও আবদুন নাসেরের মধ্যে যত মতানৈক্যই হয়েছে তা পারস্পরিক বুঝা পড়ার মাধ্যমে অবশ্যই দূর করা যেতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল এই যে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গৃহীত হতো এবং নেপথ্যে থেকে তার পরিচালনাকারী ছিল। বিপ্লবের পূর্বে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতগণকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে, কোন বিদেশী শক্তি অথবা মিসরে বসবাসরত বিদেশী কোন নাগরিক এই অভ্যুত্থানের লক্ষ্যবস্তু হবে না। আমরা আমেরিকা ও তার কূটনৈতিক মিশনের সদস্যদের খুব ভাল করেই জানি যে, তাদের উদ্দেশ্য কেমন হয়ে থাকে এবং কোন প্রকৃতির লোকদের সাথে তাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বিপ্লব সংঘটিত হলে জানা গেলো নাসেরের লক্ষ্য ছিল ইখওয়ানকে নির্মূল করা। সে এক এক করে সঙ্গী-সাথীদের থেকে নিজেকে মুক্ত করে এবং অবশেষে একনায়কসুলভ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করার আকাংখা তার অন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। সে ইখওয়ানকে তার পথের একমাত্র প্রতিবন্ধক মনে করতে থাকে। আপন বন্ধুদের মধ্যে সর্বপ্রথম সে ইউসুফ সাদিককে শিকার করে। অথচ বিপ্লবের রাতে ইউসুফ সাদিকই সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন।
অভ্যুত্থাতেনর রাতে জামাল আবদুন নাসের ও আবদুল হাকিম আমের উভয়েই বেসামরিক পোশাক পরিহিত ছিল। তারা কোন এক গোপন স্থানে ছিল যা কারো জানা ছিল না। সেই রাতে সাদাত এক সিনেমা হলে ফিল্ম দেখছিলেন। যেহেতু বিপ্লবের কথা অবশ্য তার জানা ছিল কিন্তু সফলতার ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এই জন্য সিনেমা হলেই কোন একজনের সাথে মিথ্যা ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করার জন্য চলে যান। যাতে বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত কার্যকলাপের সাথে তার কোন প্রকার সম্পর্ক না থাকার কথা তিনি সহজেই প্রমাণ করতে পারেন। তিনিও বেসামরিক-পোশাক পরিধান করেছিলেন।
নাসেরের সর্প স্বভাব ব্যক্তিত্ব
স্ত্রী সাপ যেভাবে তার বাচ্চাদেরকে এক এক করে খেয়ে ফেলে। কোন সৌভাগ্যবানই কেবল তার গ্রাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। অনুরূপ নাসের সাহেবও তার সংগী সাথীদেরকে এক এক করে গলধকরণ করে ফেলে। নাসেরের দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তু ছিল মুহাম্মাদ নাজীব। তারপরই একের পর এক খালেদ মুহীউদ্দীন, বাগদাদী, যাকারিয়া হাসান ইবরাহীম ও কামালুদ্দীন হোসাইন প্রমুখ সকলেই প্রতিশোধের শিকারে পরিণত হয়। তার বিষাক্ত ছোবল থেকে কেবলমাত্র সেই রক্ষা পেয়েছে যে তার পদতলে আত্মসমর্পণ করে তাকে এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করেছে যে, তার পূর্ণ আনুগত্য করতে ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে কখনো কসুর করবে না।
ইখওয়ানের ভূমিকা সম্পর্কে তো মোটামুটি সকলেরই জানা ছিল। তাদের ওপরও যুগের জঘন্যতম একনায়কের হাত তোলা বোধগম্য হয়। কিন্তু নাসেরের প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে আযহার শরীফের ন্যায় একটি অক্ষতিকর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও রক্ষা পায়নি। আল আযহারের শেখ জনাব আল খিদির হোসাইন দ্বীনের বুনিয়াদী শিক্ষা ও নির্দেশাবলীর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। নাসেরের জন্য তা ছিল অসহনীয়। সম্মানিত শেখের ওপরও তিনি চাপ প্রয়োগ করতে আরম্ভ করেন এবং আল আযহারের কর্তৃত্ব গ্রহণর কয়েক মাস পরই তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। তাঁর স্থলে নতুন শেখ নিযুক্ত হন স্থায়ী রোগ ব্যধি ও বার্ধক্য তাকে কোন কাজের উপযুক্ত রাখেনি। তিনি চিলেন নাসেরের গুণগ্রাহীদের অন্যতম। এই গুণাবলীর ভিত্তিতেই তাকে এই গুরু দায়িত্বের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
এই শেখ সাহেবকে আল্লাহ তায়ালা মাফ করুন। তিনি নাসের সম্পর্কে এমন উক্তিও করেছেন যে, এই নওজোয়ানকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইলহাম প্রদান করা হয়েছে। তিনি তার সকল দুশমনের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন।
নাসের ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতার পথ অবলম্বন করে এবং এতদূর গিয়ে উপনীত হয় যে, সাধারণ সভা সমাবেশে তাঁর মন্ত্রী প্রবরদেরকে মুজরিদান নামে সম্বোধন করতো। তাদের সাথে তার আচরণ ছিল এমন য, তারা যেন তার ব্যক্তিগত সেবাদাস। এরূপ আত্মগর্বী কর্মনীতি সাদাত ও তার আমলের শেষের দিকে অবলম্বন করেছিল। আমার কাছে তো এই বিষয়টি বিস্ময়করই মনে হতো যে, এই মন্ত্রীরা কেমন করে এই স্বৈরাচারের কর্তৃত্ব মেনে চলছিলো। বৃটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার শাসনকর্তারা তাদরে মন্ত্রীদেরকে সম্মানেসর সাথে সম্বোধন করেন। যেমন তারা কোন মন্ত্রীকে আহ্বান করতে গিয়ে মিষ্টার মুঁসিও কিংবা সিনেবার শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের শাসকগোষ্ঠীর এরূপ কর্মপদ্ধতির কোন সংগত কারণ হয়ত থেকে থাকবে? মনস্তত্ব বিশারদ ও সমাজ বিজ্ঞানীগণ কি এর কোন কারণ র্দিশ করতে পারবেন? আসল কথা হচ্ছে আমি নিজে এর কোন কারণ জানি না। অতএব এটাই উত্তম হবে যে, যা আমার জানা নেই তা আমাকে জেনে নিতে হবে। অন্যথায় আমার পক্ষ থেকে িএমন সব কথা প্রকাশ পাবে যার কারণে কিছু মানুষ নারাজ হয়ে পড়বে। বস্তুত মনস্তত্ববিদগণই মানসিক রোগীদের ব্যাপারে অধিকতর ওয়াকিফহাল।
গুজবে কান দেয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়
অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকদের দৃষ্টিভংগী ইখওয়ান সম্পর্কে মোটেই ভাল নয়। এর কারণ ইখওয়ান সম্পর্কে তাদের সামনে যেসব রিপোর্ট আসে তাতে তাদের সম্পর্কে ভয়ঙ্কর ধারণা দেয়া হয়। তাকে এমন সন্ত্রাসবাদী সংগঠণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। যার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে কোন প্রকার সন্ত্রাস ও শক্তি ব্যবহার করতে সদা প্রস্তুত। এর সমর্থনে যুক্তি হিসেবে তারা ইকাদের ঘটনা পেশ করে থাকে। এতে আমাদের কিছু সরলপ্রঅণ যুবক বল প্রয়োগের জবাবে বল প্রয়োগের নীতি অবলম্বন করে তাকে। এই কর্মপদ্ধতিতে ন্যায় ও সত্যের আন্দোলনের কোন লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে। এই দায়িত্বশীল ও কর্তাব্যক্তিগণকে আল্লাহ তায়ালা যদি কিছু বুদ্ধি-বিবেচনা ও কান্ডজ্ঞান দিয়ে থাকেন তাহলে তাদের একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিত যে, শোনা কথার ওপর আমল করার পরিবর্ত তারা সরাসরি ইখওয়ানের সাথে যোগাযোগ করে প্রকৃত সত্য জেনে নেয়ার উদ্যোগ কেন গ্রহণ করে না?
ইখওয়ানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ সঠিক তথ্য লাভ করতে পারেন এবং এতে নিশ্চিতভাবেই দেশ ও জাতির কল্যাণ আসতে পারে এবং বিদ্যমান বেদনাদায়ক পরিস্থিতির প্রতিকার হতে পারে। এরূপ মহতী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তারা উদ্যোগী হয় না। অথচ এতে তাদের কোন লোকসানের ভয় নেই। ইখওয়ানুল মুসলিমুন তো অন্তরের অন্তস্থল থেকেই এই প্রত্যাশা করে যে, মুসলিম শাসকগণ তাদের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যাক। এবং দ্বীনি পয়গাম মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার মহতী কাজে তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করুক। যাতে এই বুনিয়াদী ফরজ উত্তমরূপে আদায় হতে পারে। তারা যদি একান্তই সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করতে না পারে তাহলে অন্ততপক্ষে বাধার প্রাচীর দাঁড় করাতে যেন ব্রতী না হয়। আমাদেরকে আমাদের ব্যবস্থার ওপরই যেন ছেড়ে দেয়।
আমি বলছিনা যে, আমরা আজ থেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা করছি বরং এই দাওয়াতী তৎপরতার প্রথম দিন থেকে এটাই আমাদের ভূমিকা এবং ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের লিখিত ইসলামী সাহিত্যগুলো এই দাবীর সত্যতার প্রমাণ দিয়ে থাকে। ইমাম শহীদ আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে প্রত্যেকের নিকট দাওয়াত পৌঁছাতেন। কিন্তু যারা এই দাওয়াতের বিরোধিতা করে তাদের কারো ব্যাপারে তিনি কখনো ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স)-এর দাওয়াত নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ লোকেরা তো মহব্বতের পয়গামই বন্টন করে থাকে। যারা তাদের দিকে অগ্রসর হয়ে থাকে তারা তাদেরকে বুকে তুলে নেয়। আর যারা তাদের থেকে দূরে থাকে তাদের জন্য প্রাণ খুলে হিদায়াতের দোয়া করতে থাকে। এই বিশ্বস্ত অনুরাগীর দল কারো বিরুদ্ধে কখনো কোন ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করে না। এমনকি যারা তাদের সাথে কোন অশালীন ও অমার্জিত ব্যবহার করে কিংবা তাদের কষ্ট দেয় অথবা তাদেরকে হত্যা করেতারা তাদের সকলের কল্যাণের জন্যই দোয়া করতে থাকে। তারা ভাল করেই জানে যে, এসব দুঃখ মুসিবত তারা আল্লাহর পথেই বরণ করছে এবং এর বিনিময়ও তারা তার নিকট থেকে পেয়ে যাবে।
মাথা উলংগ অথচ পায়ে মাথার রাজমুকুট
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নওজোয়ানগণ সুয়েজের তীরে এবং অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসলামী জিহাদে অংশগ্রহণ করে এবং নিজেদের বুকের তপ্ত লহু ঢেলে ধরিত্রির তৃষ্ণা নিবারণ করে তাতে এ সত্য সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মুসলিমসমাজে আজও এমন লোক রয়েছে যারা তাদের মর্যাদার নিরাপত্তা বিধান করতে পারেন। ইসলামের শত্রুরা একথা বুঝতে পারে যে, যে জাতিকে তারা ভীরু কাপুরুষ বলে মনে করতো তাদের মধ্যে ত্যাগ স্বীকার করার মত প্রেরণাদীপ্ত লোক এখনো রয়েছে। ইখওয়ানের কোন কোন বন্ধুবান্ধব এরূপ প্রকাশ্য শক্তির মহড়া প্রদর্শন করা পছন্দ করেনি। তাদের ভূমিকা ছিল এই যে, এভাবে শক্তির প্রদর্শনী ছিল হিকমাত, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিপন্থী। কেননা এতে আন্দোলনের শত্রুগণ এখন থেকেই সতর্ক হয়ে উঠবে। মোটকথা তরংগের আঘাতে জর্জরিত ব্যক্তিও উপকূল থেকে দর্শনকারী লোক কখনো সমান হতে পারে না। এ সময় পরিস্থিতির দাবীই ছিল এই যে, ইখওয়ান নির্বিকার বসে থাকতে পারে না। এটা ছিল কাজের সময় কামান থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীর কখনো ফিরে আসে না। আমদের সেই সমস্ত ভক্ত অনুরক্ত যারা বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার শিকার ছিলেন তাদের আপত্তি ছিল শুধুমাত্র তত্বগত। আমি িএররূপ মন্তব্য করছি কয়েকটি কারণে:
১-মিসরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী সংগঠনের শরীর চর্চা টীম বর্তমান ছিল। স্কাউটিং ও অন্যান্য প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম আইনগতভাবে বৈধ ছিল। ইখওয়ানের জন্য আত্মিক ও দৈহিক প্রশিক্ষণের চিন্তা করা জরুরী ছিল। ইখওয়ান কোন গোপন সংগঠন ছিল না। এর সমস্ত কর্মতৎপরতা প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে হতো। ট্রেনিংক্যাম্প, ভ্রমণটীম বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচী সবকিছুই তখন আইনের দৃষ্টিতে অনুমোদিত ছিল। বিভিন্ন টীম তাদের মান উন্নত করার জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতামূলকভাবে অংশগ্রহণ করতো। অধিকন্তু এই সমস্ত কর্মসূচী গোপনে নয় বরং খোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হতো। পরবর্তী সময়ে সরকার যখন এসব কর্মসূচীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করে তখন তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আবার এই বিধিনিষেধও ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। ইখওয়ানের ভ্রমণটীমকে মিসরের ভেতরে ও বাইরে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো এবং দাওয়াত সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এসব টীম কার্যত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।
২-দাওয়াত ইলাল্লাহ বা আল্লাহর পথে আহবান এমন একটা কাজ যা প্রকাশ্যে ও খোলামেলাভাবে করা উচিত। যাতে সর্বসাধারণ তা জানার ও বুঝার সুযোগ লাভ করতে পারে এবং একে গ্রহণ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো ওকাজ ও যুলমাজান্না মেলায় গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা করতেন এখানে কি এমন কোন ব্যক্তি নেই যে আমার সাহায্যের জন্য দাঁড়াতে পারে যাতে আমি আল্লাহর পয়গাম মানুষের নিকট পৌঁছে দিতে পারি। অনন্তর দাওয়াতে হকের এই আহ্বান যে সমস্ত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং তাদের স্বীকৃতি লাভ করে এবং অধিকাংশ মুসলিম এদিকে ছুটে এস তখনো কি মানুষের নিকট আমরা বলবো: আমাদের দিকে আসবে না আমাদের কথায় কর্ণপাত করবে না কিংবা আমাদের থেকে দূরে থাকো। সত্যের পথে আহ্বানকারীদের জন্য এটা খুবই খুশীল কথা যে, মানুষ তাদের দাওয়াতে সাড়া দেবে। আমরা কখনো শক্তির মহড়া দেইনি এবং প্রদর্শনীও করিনি। আর কখনো গায়ের জোরে কাউকে অবদমিত করতেও চেষ্টা করিনি। কিন্তু দাওয়াতে হক যখন শিকড় মজবুতভাবে গেড়ে বসলো এবং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে ফলদায়ক হয়ে উঠলো তখন আপনা থেকেই তার শাক্তিমত্তা প্রকাশ পেতে থাকলো। এটা কোন প্রকার কৃত্রিমতা ছিল না বরং ছিল স্বাভাবিক প্রকাশ।
৩-ইহুদীরা ফিলিস্তিন ভূখন্ডে উড়ে এসে জুড়ে বসে এবং ইংরেজরা তাদেরকে মুসলিমদের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দেয়। মযলুম ফিলিস্তিনী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীরা অত্যন্ত জঘণ্য অপরাধ করে চলেছে। বিরাজমান এই বেদানাদায়ক পরিস্থিতির সামনে সমগ্র দুনিয়া মুসলিম সরকার ও জনগণ এমন বেপরোয়া ও উদাসীন কর্মনীতি গ্রহণ করেছে যে সে সম্পর্কে চিন্তা করলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। তবে হ্যাঁ, নিষ্ফল প্রতিবাদ এবং বৃথা শ্লোগানের তোড়জোড় প্রায়শঃই দেখা যায়। এসব বিক্ষোভ মিছিল দ্বারা ফিলিস্তিনবাসীরা কিছুই লাভ করেনি। অবশ্য তাতে তাদেরকে অত্যন্ত নির্মমবাবে হত্যা করার অবাধ সুযোগ ইহুদীরা লাভ করেছে ঠিকই। শরীয়ত ও নৈতিক দিক থেকে ইখওয়ানের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিকে ইহুদীদের নাপাক থাবা থেকে মুক্ত করা। মুসলিমগণ যখন সামষ্টিকভাবে এই ফরজে কেফায়া আদায় করতে অপারগ। তখন ইখওয়ানই সম্মুখে অগ্রসর হয়ে এই গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিতে ব্রতী হয়। এভাবে তারা গোটা উম্মাতের মাথার ওপর থেকে একটা গুনাহের বোঝা নামিয়ে দেয়। এর পুরস্কার ইখওয়ানগণ এভাবে লাভ করে যে নাকরাশী পাশা মরহুমের মন্ত্রী পরিষদ তাদেরকে জিহাদের ময়দান থেকে ডেকে পাঠিয়ে কারা অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়। নাকরাশী পাশার এই আচরণের ওপর আপনি কি মন্তব্য করবেন? তিনি কি ইহুদীদের এজেন্ট ছিলেন? নাকি তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুগভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন যে, এরা ফিলিস্তিনের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য ইহুদীদের সাথে কেন প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে?
৪-এই সময় অবশ্য কর্তব্য ছিল সমস্ত দুনিয়াবাসীকে একথা জানিয়ে দেয়া যে, যে ইসলামকে তারা মৃত মনে করে তা আসলে মৃত নয় বরং জীবিত। আর ইসলামের সন্তানগণ অপমান ও লাঞ্ছনা এবং তাদের রাসূল ও দ্বীনের অসম্মান কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ইসলামের স্বার্থে তারা তাদের জানমাল ও পরিবার পরিজন সবকিছুই কুরবানী করতে পারে।
৫-ঐ সময় ইহুদীদেরকে এই শিক্ষা দেয়া অত্যাবশ্যক ছিল যে, ফিলিস্তিনকে তারা যেন তাদের মুখের গ্রাস মনে না করে যা কোন প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়াই গলধ-করণ করা তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এটা তাদের গলায় কাঁটা হয়েও বিদ্ধ হতে পারে।
৬-ইসলামের অনুসারীরা সুদিন ও দুর্দিন সকল অবস্থায়ই দুশমনদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র হয়ে এসেছে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র হয়ে এসেছে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। মুসলিমদের এ সামর্থ আছে যে, তারা তাদের অন্তরে আকীদার প্রভাব প্রমাণ করবে। যেহেতু তারা বস্তুগতভাবে দুর্বল। ক্রুসেড যুদ্ধ এবং তাতারদের অভিযানের মুখে তারা সে ক্ষমতা দ্বারা ইংরেজদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে প্রদর্শন করেছে। মুসিলম উম্মাহ আজ অধোপতিত অবস্থায় কালাতিপাত করছে। তা সত্ত্বেও তাদের বীরত্বের ব্যাপারে আমরা কখনো নিরাশ নই।
৭-হোদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম যষন ওমরাহ পালনের জন্য মক্কায় আগমন করেন তখন তিনি সাহাবাদেরকে শক্তি মহড়া প্রদর্শন করার জন্য উৎসাহিত করেন।যদিও কিছু লোক অসুস্থ্যতার কারণে শারীরিকতভাবে দুর্বল ছিলেন। হাদীস বর্ণনাকারীগণ এই প্রসংগে যে সমস্ত বর্ণনা উপাস্থাপন করেছেন তার ভাষা ছিল নিম্নরূপ: “আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির প্রতি রহম করুন যিনি আজ তার শারীরিক শক্তি ইসলামের দুশমনদের সম্মুখে প্রদর্শন করে দেখাবে।”
৮-সিদ্ধান্তকর সময়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন এবং বীরত্ব প্রদর্শন খুবই জরুরী হয়ে থাকে। এই সময় আমাদের গৃহীত ভূমিকায় সরকারের একটা উত্তম আস্থা লাভ হয়েছিল যে, তারা ইহুদীদের মোকাবিলা করতে সক্ষম। নাকরাশীর দুর্ভাগ্যের প্রতি লক্ষ্য করুন যে, এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানোর পরিবর্ত সে উল্টো ইখওয়ানকেই তার লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করে। সে ইহুদীদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তী সময়ে সংঘটিত সমস্ত বিপর্যয় বিপত্তির মূলে নাকরাশী পাশার সেই ভুলই ছিল দায়ী। তার কাছে বাহুবল না থাকলেও অন্তত ইখওয়ানকে জিহাদের ময়দানে কাজ করে যাওয়ার সুযোগ দিতে পারতো। তারপর আপনারা দেখতে পেতেন যে, ইতিহাসের গতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে।