একাদশ অধ্যায়
সাদাতের শাসনকালের শেষের দিকে আযাদ অফিসার ইখওয়ানের কিছু সংখ্যক বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ করে এরূপ আকাংখা প্রকাশ করে যে, এমন একটা রাজনৈতিক দল গঠন করা হোক যাতে দু’দলের (অর্থাৎ আযাদ অফিসার ও ইখওয়ান)-এর লোকজন যুগপৎ অংশ গ্রহণ করতে পারে। যেসব লোক এ প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তারা আজও জীবিত আছেন এবং তাদের প্রত্যেকের নাম আমাদের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। আমি কোন প্রকার নামধাম ও খ্যাতির লোভে এ ঘটনা লিখছি না বরং শুধুমাত্র স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই লিখার প্রয়াস পাচ্ছি। কারণ স্মৃতিচারণ দ্বারা মু’মীনদের উপকারই হয়ে থাকে। ইখওয়ানী বন্ধুগণ আলোচনার সময় ‘আযাদ অফিসার’ প্রতিনিধিদের জানিয়ে দিলেন যে, এ ভানুমতির খেলা কেবল মাত্র সবার হাসির কারণ হবে। সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী বিষয় বা বস্তুর সমন্বয় একেবারেই অসম্ভব। জামাল আবদুন নাসেরের আমলে আযাদ অফিসার-এর হাতে ইখওয়ানের ওপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছিলো কালের আবর্তন এখনো তা মুছে দিতে পারেনি।
জনৈক অফিসার- যিনি আজও জীবিত আছেন- বলেছিলেন, আবদুন নাসেরের সময় ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে তা যর্থাথই ছিল। কিন্তু তারপর যা কিছু সংগঠিত হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ ভুল ও অন্যায়। যদি তিনি এতটুকু কথাও বলতেন যে, নাসেরের আমলে সংগঠিত অত্যাচারের জন্য আমরা লজ্জিত এবং পুরো এই শাসন কালটাই ছিল জুলুম-নিপীড়নে ভরপুর। তথাপি প্রস্তাবিত দল গঠন সম্ভব ছিল না। আর যদি এমন একটা দল গঠন করা হয়েও যেতো তাহলেও জনসাধারণের তার প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ থাকতো না। যাই হোক উপরোক্ত জবাব লাভের পর একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পুরোনো অভ্যাস যেতে সময় লাগে। ইখওয়ানের ওপর পরিচালিত জুলুম-নির্যাতনকে যারা যথার্থ বলে মনে করেন তারা কোন্ মুখে তাদের কাছে সহযোগিতা কামনা করতে পারেন? আর ইখওয়ইবা কোন্ যুক্তিতে কিসের ভিত্তিতে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে পারে। অতএব এ আলোচনা থেকে আমরা নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেই।
শহীদ আবদুল কাদের আওদার জনপ্রিয়তা
মিসরে আযাদ অফিসার যখন শাহ ফারুককে ক্ষমতা চ্যুত করে সামরিক শাসন জারী করেন তখন সংস্করের ঘোষণাসমূহ বিবেচনা করে আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাই। নতুন বিপ্লবী সরকার এবং তার কর্তা ব্যক্তিদের সাথে শহীদ আবদুল কাদের আওদার অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। আযাদ অফিসার ও ইখওয়ানের মাঝে প্রথমেই এ মর্মে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, দেশে সত্যিকার ইসলামী আইন জারী করা হবে। যখন আযাদ অফিসার নানা প্রকার টাল বাহানা করে ইসলামী অনুশাসন চালুর ব্যবস্থাকে বিলম্বিত করতে শুরু করলো তখন জনসাধারণ তাদের নিয়াত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতে লাগলো। অতএব ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সেই ঐতিহাসিক বিক্ষোভ শুরু হয়। যা সরকারকে প্রকম্পিত করে তোলে। আবেদীন প্রাসাদের সম্মুখের বিশাল ময়দান বিক্ষোভকারীদের দ্বারা ভর্তি হয়ে যায়। চারদিকে শুধু মানুষের মাথা আর মাথাই দেখা যাচ্ছিলো। এর ঠিক পূর্বেই হাসান আল হুদাইবি ও ইখওয়ানের অন্যান্য প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। উপস্থিত সকলের মুখেই ছিল ইসলামী বিধান চালু কর এবং হাসান আল হুদাইবি ও তার অন্যান্য সংগীদের মুক্তির স্বতঃস্ফূত দাবীও গগণ বিদারী শ্লোগান মুহূর্মুহ উচ্চারিত হচ্ছিলো। শ্লোগানের আওয়াজে পরিবেশ ধ্বনিত – প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছিলো।
এ সমাবেশকে পন্ড করার সকল সরকারী ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রজাতন্ত্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুহাম্মদ নাজীর শহীদ আবদুল কাদের আওদাকে ডেকে পাঠান এবং তার কাছে জনসভা ছত্রভংগ করে দেয়ার কাজে সরকারকে সহযোগিতা প্রদানের আবেদন জানান। শহীদ আবদুল কাদের আওদা জেনারেল নাজীরের সাথে প্রেসিডেন্ট ভবনের ব্যালকুনিতে দাঁড়ালেন এবং জনতাকে উদ্দেশ করে বললেনঃ “আপনারা আপনাদের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করেছেন এবং নিজেদের দাবীদাওয়াও পেশ করেছেন। এখন আপনারা নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে যান।”
একথা বলার কয়েক মিনিটের মধ্যে আবেদীন ময়দান এমনভাবে জনমানবশূন্য হয়ে গেল যে, সেখানে যেন কোন মানুষের অস্তিত্বই ছিল না। অতপর আবদুন নাসের বুঝতে পারলেন যে, আবদুল কাদের আওদার জনপ্রিয়তা তার সরকারের জন্য যে কোন মুহূর্তে বিপদের কারণ হতে পারে।
জেল-জুলুম ও বন্ধিত্ব
এর একদিন বা দুইদিন পরই আবদুল কাদের আওদা শহীদকে গ্রেফতার করে। একটি কাঠপুতুল আদালতে পেশ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করেছেন। ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সকল সদস্যের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করা হলো। মুর্শিদে আম জনাব হাসান আল হুদাইবি, আবদুল কাদের আওদা শহীদ এবং উস্তাদ মুহাম্মদ ফারাগলী প্রমুখকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। ডাক্তার খামীস মরহুম, উস্তাদ সালেহ্ আবু রাকীক, উস্তাদ আবদুল আযীয আতিয়া ও উস্তাদ মুহাম্মদ হামেদ আবু নসরকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হলো এবং শেখ আহমদ শারীত ও এই বইয়ের লেখক ওমর তিলমেসানীকে পনের বছর করে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
শেখ আবদুল মুয়েজ আবদুস সাত্তার, শেখ মুহাম্মদ বাহী আল খাওলী এবং উস্তাদ আবদুর রাহমান আল বান্নাকে মুক্তি দেয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবিকেও মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। অথচ তাঁর অন্যসব সংগীদেরকে নির্দয়ভাবে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়।
আমাদের প্রত্যেককে পৃথক পৃথক জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। তারপর আমাদেরকে বার বার এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর করার কাজ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। শাস্তির পরোয়াণা জারী করার পর আমাকে মিসর নামক কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অতপর এক এক করে বানী সাভীফ, আল ওয়াহাত, আল মাহারীক, আসইউত, কানা এবং সর্বশেষ লীমান তাররা জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। লীমান তাররা নামক স্থানের কারাগারেই আমার সুদীর্ঘ পনের বছরের শাস্তির মেয়াদ পূর্ণ হয় এবং এরপর সেই জেলের ফার্মেই অতিরিক্ত আরো দু’বছরের জন্য আমাকে নজর বন্দী করে রাখা হয়।
এ দু’বছর ও অতীতের গর্ভে বিলীন হলে আমার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়- স্বজন আমাকে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেল ফটকে এসে হাজির হয়। কয়েদের মেয়াদকাল পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আমি জানতাম যে আমার মুক্তির সময় আরো পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
নাসেরের দয়াদ্রচিত্ততা ও ইনসাফ
আমি আমার প্রিয়জনদেরকে বাড়ীতে ফিরে যেতে বললাম। আপনারা তাদের দুঃখ, মনোকষ্ট ও অনুতাপ অনুমান করতে পারেন। তাদের ধারণা ছিল যে, রামাদান মাসের সেদিনের ইফতার আমি তাদের সাথে বাড়ীতে গিয়ে করবো। কিন্তু তাদের সম্মুখে আবদুন নাসেরের ন্যায় নিষ্ঠতা ইনসাফ দয়াদ্রচিত্ততা এবং বিশ্বস্ততার স্বরূপ উদঘাটিত হয়ে পড়ে তখন যখন আমাকে আরো কিছু কালের জন্য জিন্দানখানার মধ্যেই রাখার ফরমান জারী করা হয়।
আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকগণের মধ্য থেকে জনৈক বুজর্গ তাঁর এক নিবন্ধে জামাল আবদুন নাসেরের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ইনসাফ কোমলতা ও হৃদ্যতার যথোপযুক্ত বিবরণ তুলে ধরেন। আল্লাহ তায়ালা আমাকেও মাফ করুন। আর উক্ত শেখ সাহেবকেও ক্ষমা করুন। তিনি তার কলমের ভাষায় যা কিছু লিপিবদ্ধ করেছিলেন তা তার জন্য আদৌ মানানসই ও শোভনীয় ছিল না। আমর ধারণা তিনি এসব কথা কোন প্রকার বিনিময় ছাড়াই শুধুমাত্র চাটুকারিতা ও মোসাহেবীর ভংগীতেই লিখেছিলেন। কবির ভাষায়ঃ
“প্রত্যেক কাজের জন্যই যথোপযুক্ত লোক যথাসেময়ে পাওয়া যায়।”
আদালতের আচরণ
যে আদালতের কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেটি ছিল সামরিক আদালত। একে আদালত নমে অভিহিত করা ন্যায় ও ইনসাফের উপহাস ও বিদ্রূপ করারই নামান্তর। এই তথাকথিত আদালতের কাজ তো শুধু পূর্বে গৃহিত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা মাত্র। আর মামলার শুনানি তো নিছক অভিনয় ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। এই ট্রাইবুনাল ছিল তিনজন সামরিক অফিসারের সমন্বয়ে গঠিত। যার প্রধান ছিলেন জামাল সালেম এবং সদস্য ছিলেন যথাক্রমে হোসাইন শাফেয়ী ও আনোয়ার সাদাত। ট্রাইবুনালে কোন বক্তব্য শোনা হয়নি কিংবা কোন প্রকার যুক্তিতর্কও হয়নি। উপহাস-বিদ্রূপ এবং হেয় ও অবজ্ঞা করাই ছিল এ ট্রাইবুনালের বৈশিষ্ট্য।
যিনি হন্তা তিনিই সাক্ষী ও বিচারক
ডাক্তার খামীস হামীদাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে, তিনি সূরা ফাতেহা জানেন কি না? যদি জানেন তাহলে তিনি যেন তা মুখস্ত পড়ে শুনান। সত্যি করে বলুন তো একথা শুনলে মানুষ হাসবে না কাঁদবে? আপনি কি কখনো এমন আদালত দেখেছেন, না শুনেছেন? দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে অপরাধের স্বীকৃতি আদায়ের পর যখন কোন একজন মজলুম আদালতে বললো যে, তার নিকট থেকে জোর পূর্বক এই স্বীকৃতি আদায় করা হয়েছে তখন আদালত প্রধান তার নেকড়ে সুলভ তদন্ত অফিসারকে বলে দেন যে, “আদালত মুলতবী, ওকে নিয়ে যাও এবং তার জবানবন্দি শুধরিয়ে পুনরায় হাজির করো——।”
অত্যাচার-উৎপীড়নের এমন চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হতো যে, নির্যাতিত ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার যখন আদালতের কাঠগড়ায় এনে হাজির করা হতো তখন তাকে বাধ্য হয়েই তদন্তকারী অফিসারগণের লিখিত প্রতিবেদনকেই তার নিজের মতামত বলে স্বীকৃতি দিতে হতো। সেই হতভাগা তো আর জানতো না যে, ইনসাফ লাভের জন্য তাকে আদারতে নয় বরং কসাইখানায় নিয়ে আসা হয়েছে। আদালতে তদন্তকারী অফিসারদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা হলে মাজলুমের আহবানে সাড়া দেয়া হতো এভাবে যে, সেই হায়েনাদের সামনেই তাকে ছেড়ে দেয়া হতো। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক সবকিছুই স্বীকার করতে হতো যা তারা করেছে বলে তাদের সঙ্গী ফেরেশতারাও জানে না। জামাল সালেমের বিদ্যার বহর ছিল এই যে, কখনো সূরা আলে ইমরান থেকে কোন আয়াতের ব্যপারে জিজ্ঞেস করতেন কিন্তু “আলে ইমরান”কে তিনি “আল ইমরান” (আরবি*********) পড়তেন। তার মতে ইমরানের সাথে যুক্ত আলিফ লাম ছিল নির্দিষ্ট বাচক।
অত্যাচারীরা সাবধান!
আমাদের কেস শুনে তার ফায়সালা করার দায়িত্ব ছিল তাদেরই। কিন্তু তারা নিজেরাই ছিল লুটেরা দস্যু। এই অর্থহীন নাটকের সময় জামাল সালেম একবার আমাকেও তার উপহাসের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করে। আমি কোন ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে সে বললোঃ “হাঁ মিষ্টর উমর বল”। আমি ভাবলাম যে তার কাজই হলো জনসমক্ষে অপমাণিত করা এবং প্রত্যেক ব্যাপারেই তার আরেকটি অভ্যাস হচ্ছে, যে বিষয়ের প্রতি সে ইংগীত করতে চায় ঠিক তার বিপরীত শব্দ প্রয়োগ করে। উদাহরণ স্বরূপ সে কালকে সাদা এবং হলুদকে লাল বলতো। অতএব আমি নীরবতা অবলম্বন করাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলাম। এ জালেমদের নিকট জিজ্ঞেস করার বা প্রত্যাশা করার কিই বা থাকতে পারে। আল্লাহ তায়ালাই আমাদের সকল দরখাস্ত শ্রবণ এবং আমাদের আকাংখা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট। এই জালেমরা ভেবেছিল যে, তাদের দুরভিসন্ধি ও কূটকৌশল সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা একেবারেই উদাসীন। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা দেরীতে আসতে পারে ব্যর্থ হতে পারে না।
মন্ত্রীত্বের প্রলোভন
এ বিপ্লবই আমাদের বিরুদ্ধে তার পুরো শক্তি কাজে লাগিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রথম দিকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়েছিল আমরা এসব লোককে সহায়তা করেছিলাম। কারণ তাদের মৌখিক দাবী ছির ইসলামের অনুশাসন চালু করবে। স্বয়ং মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবিও এ বিপ্লবের ফলে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছিলেন। এবং অনেক আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন। তারই অনুমোদনক্রমে ইখওয়ান জামাল আবদুন নাসেরের সাথেও যোগযোগ স্থাপন করে। জামাল আবদুন নাসের মুর্শিদে আ’ম-এর নিকট আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি যেন ইখওয়ানের মধ্য থেকে কয়েকজন লোকের নাম মন্ত্রীত্বের জন্য পেশ করেন। তিনি আবদুল কাদের আওদাহ শহীদের নাম প্রস্তাব করেন। তারপর বলা হলো যে, আওদাহ সাহেবের স্বভাব প্রকৃতিই এমন যে, সামরিক সরকারের সাথে তার বনিবনা হবে না। অবশেষে তিনি মুনীর দাল্লা সাহেবের প্রস্তাব করলে নাসের বলেন যে, না, তিনি এখনো মন্ত্রীত্বের গুরু দায়িত্ব সামাল দেয়ার যোগ্যতা রাখেন না। পরিশেষে উস্তাদ সালেহ আল আশমাভী মরহুম-এর নাম বলা হলে তিনি সে ক্ষেত্রে আপত্তি করে বলেন যে, তিনি খুবই অল্প বয়স্ক মানুষ। অতপর তিনি এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেন এবং বলেন যে, আমি তোমাকেই এখতিয়ার দিচ্ছি তুমি যাকে ইচ্ছা বেছে নিতে পারো।
শাইখ আল বাকুরী
সামরিক বাহিনী উস্তাদ বাকুরীকে পছন্দ করলো। বাকুরী সাহেবও মুর্শিদে আ’ম বা কর্মপরিষদের পরামর্শ ব্যতীতই মন্ত্রীত্বের টোপ গিলে ফেললেন। অথচ এটা ছিল তার বড় রকমের ভুল সিদ্ধান্ত। ইখওয়ানেরও বড় রকমের ক্ষতি হলো। মন্ত্রীত্বের প্রতি অনুরাগী ব্যক্তিকে সেজন্য কম মাশুল দিতে হয়নি। সামরিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির পর সামরিক টোপ বাকুরী সাহেব সম্পর্কে সরকারী মহল থেকেও এমন সব অশালীন কথাবার্তা বলা হলো যা ছিল খুবই পীড়াদায়ক। এ সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে মিসর এমনকি মিসরের বাইরের লোকও সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। এতদসত্ত্বেও বাকুরী সাহেব শাসকদের সাথে বিশ্বস্ততার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকেন। নাসেরের উচ্ছসিত প্রশংসায় তিনি তাঁর লিখনী পরিচালনা করেন। এমনকি এক নিবন্ধে তাকে “সকল কল্যাণ ও মংগলের উৎস এবং দয়া ও অনুগ্রহের সাগন” পর্যন্ত লিখে ফেলেন। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার লব্ধ শিক্ষা ও দ্বীনি দূরদৃষ্টির কারণে তার মধ্যে কমপক্ষে এতটুকু বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা অবশ্যই রয়েছে যে, কল্যাণ ও মংগলের এবং দয়া ও অনুগ্রহের উৎস কে হতে পারে? এসব গুণ কি সৃষ্টিকর্তার দান না কোন সৃষ্টির দান? আমি কি বলবো? উস্তাদ বাকুরীর সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতি জড়িত। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এবং আমাদের সকলকেই ক্ষমা করুন।
রাজনৈতিক পরিশুদ্ধি
নাসের তাঁর রাজনীতির সূচনা করেন বিস্ময়কর চালের মাধ্যমে। তিনি প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দাবী করেন যে, তারা যেন তাদের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেন। তারপর তিনি হাতির ন্যায় নৌকাকে দোলানোর কাজ অব্যাহত রাখেন। তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল বিভিন্ন দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। রাজনৈতিক দলগুলো নাসেরের শুদ্ধি অভিযানের ষড়যন্ত্র বুঝতে বিরাট ভুল করে বসে। তাঁর কথা অনুসারে শুদ্ধি অভিযানের কাজ শুরু করে নীতিগতভাবে তারা স্বীকার করে নিয়েছিল যে, তাদের দলের অভ্যন্তরে খারাপ লোকের সমাবেশ রয়েছে। যাদের বহিষ্কার অত্যন্ত জরুরী। এরূপ ধারণা স্বয়ং পার্টির জন্যও সস্তবড় দুর্ণামের শামিল। আমাদের কোন কোন সাথীও শুদ্ধি অভিযানের এ মহতি উদ্যোগকে খুবই ভাল লক্ষণ বলে অভিনন্দন জানালেন। তারা মনে করেছিলেন যে, এ কাজ শরীয়াতের আইন চালু করার প্রথম পদক্ষেপ বিশেষ। কিন্তু মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবির মু’মীনসুলভ দূরদর্শিতা, মেধা ও প্রজ্ঞা এবং ব্যুৎপত্তির প্রতি লক্ষ্য করুন তিনি ইখওয়ানকে লক্ষ্য করে বললেন, এতে খুশীর কোন কারণ নেই। আজ হোক, আর কাল হোক আমাদের ওপরও হস্তক্ষেপ করা হবে।
তাঁর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি যা দেখেছিলো পরবর্তীতে তার সবটাই হুবহু সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিলো।
সেই ওয়াদা করেছে যা পূর্ণতা লাভ
নাসেরের শঠতার প্রতি লক্ষ্য করুন। তিনি সমস্ত দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন কিন্তু ইখওয়ানকে তার আপন গতিতে চলতে দিলেন। প্রত্যেকেই এ ভূমিকার কারণে বিস্মিত হলেন। রাজনৈতিক দলসমূহ এ পরিস্থিতির কারণে ইখওয়ান সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করতে থাকেন যা তারা কখনো ভুলেনি। অন্যসব দলের কিসসা খতম করার পর নাসের এখন শুধুমাত্র ইখওয়ানের সাথে মোকাবিলা করার স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইখওয়ানীরাও এরূপ ধারণা পোষণ করছিলেন যে, শরীয়াতের বিধি-বিধান চালুর স্বার্থে সরকার যদি ইখওয়ানের সংগঠনকে নির্মূল করে দেশবাসীর সার্বিক সহযোগিতা লাভ করার ইচ্ছা করে থাকেন তাহলে তাতে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু নাসের অদ্ভূত ধরনের মুখোশ পরিধান করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ইখওয়ানকে একখানা পত্র লিখেন। ঐ পত্রে তিনি তাদেরকে সুখবর শুনিয়েছিলেন যে, তাদের ওপর কোন প্রকার বিধি-নিষেধ নেই। তারা নির্বিঘ্নে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখতে পারে। এ চিঠি হাতে হাতে প্রেরণ করা হয়েছিল। আমি কেন্দ্রীয় অফিসে উপস্থিত ছিলাম। অতএব আমিই এ চিঠি গ্রহণ করলাম। আমি তৎক্ষণাৎ নায়েবে মুর্শিদে আ’ম ডাক্তার খামীছ হামীদাকে এ চিঠি সম্পর্কে অবহিত করি। তিনি বললেন যে, আমি যেন চিঠিখানা সর্তকতার সাথে নিজের কাছেই রেখে দেই। আমার বাড়ীতে এ চিঠি আমার ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে ছিল। এ চিঠি প্রাপ্তির কয়েকদিন পরই আমাদের ব্যাপকভাবে ধরপারড় শুরু হয়ে যায়। আমার খানা তল্লাশি করা হয় আমার সমস্ত কাগজপত্র, বই-পুস্তক ও ফাইল ইত্যাদি সব কিছুই জব্দ করে নেয়া হয়।
উম্মে কুলসুমের গান ও আমরা
ইখওয়ানের কিছু সংখ্যক সাথী প্রখ্যাত গায়িকা উম্মে কুলসুমের গান অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনতো। আমি নিজেও ছিলাম উম্মে কুলসুমের গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তার গাওয়া নাতিয়ার কবিতার সাথে যেন আমার রয়েছে প্রেমের সর্ম্পক যা কবিকুল শিরমণি শওকী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উচ্ছসিত প্রসংসায় লিখেছিলেন। উম্মে কুলসুম তার বেদনাভরা সুমধুর কণ্ঠে তা গেয়েছিলেন।
আলওয়াহাত জেলখানায় উম্মে কুলসুমের গানের একটি ঘটনার সাথে আমার মজার স্মৃতি জড়িত আছে। তখন আমি আলওয়াহাত জেলখানায় বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলাম। আমরা জেলের ভিতরেই ছিলাম। রেডিওতে উম্মে কুলসুম তার অতুলনীয় সুরেলা কণ্ঠে ঝংকার তুলে গাচ্ছিলো। আমরা কয়েক জন বন্ধু তা শুনছিলাম। আমাদের বন্ধু উস্তাদ আবদুল আযীয আতিয়া মরহুম সকল প্রকার গানকেই মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। তিনি আমাদেরকে এজন্য তিরস্কার করতেন। সেদিন উম্মে কুলসুম যে গান গেয়েছিলেন তার একটি কলি হচ্ছেঃ
(আরবি***************)
তোমাকে দেখার পূর্বের জীবন প্রকৃতপক্ষে কোন কাজেই আসেনি। বরং তা ছিল সময়ের অপচয় মাত্র।”
আমি ওস্তাদ আবদুল আযীয মরহুমকে বললামঃ ভাই দেখলেন কি মজার গান গাইলো। আপনি তো শুনেননি। অতপর আমি উপরোক্ত কলিটি তাকে শুনালাম। মরহুম আমাকে উপহাস করে বললেনঃ তুমি এতে কি মজা পাও?
আমি বললামঃ এর অর্থ হচ্ছে, প্রিয় জীবনের সেই অংশ যা ইখওয়ানের আন্দোলনে অংশ গ্রহণের পূর্বে অতিবাহিত হয়ে গেছে। তা আমার জীবনের কোন অংশ নয় বরং তা ছিল বৃথা কাল ক্ষেপনেরই নামান্তর। ভাই আবদুল আযীয, এ অর্থ কতই না হৃদয়গ্রাহী!
আবদুল আযীয মরহুম সজোরে চীৎকার করে বলে উঠলেন ভাই ওমর! হে ভাই ওমর!! আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে বলো তো গায়িকাও কি এ গানের এ অর্থ গ্রহণ করছিলো। যা আপনি গ্রহণ করছেন?
আমি জবাবে আরজ করলামঃ তার উদ্দেশ্য দিয়ে আমার কি প্রয়োজন! তিনি তার অর্থ যা ইচ্ছা তাই গ্রহণ করুন। কণ্ঠ শিল্পিরা গেয়ে থাকেন। কবি ও লেখকরা লিখে থাকেন এবং শ্রোতারা এসব কথা থেকে নিজেদের মনের মত অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। এ জন্যই তো তারা সাগ্রহে শুনে থাকেন।
শিল্প ও শিল্পী
সত্য কথা বলতে কি উম্মে কুলসুম মরহুমা তার শিল্পকর্মে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু আফসোস যে তিনি অত্যাচার ও অত্যাচারীদের কাফেলায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। শিল্পী যদি তার শিল্পকর্মের প্রতি আন্তরিক হন তাহলে কোন অত্যাচারের সাথে তার একাত্ত হওয়া আদৌ উচিত নয়। শিল্প হচ্ছে, সূক্ষ্ম কলা এবং অতি সূক্ষ্ম অনুভূতির নাম। শিল্পী মহৎ চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। তাকে কোমল হৃদয়, দয়া, উপলদ্ধি ও সহানুভূতি-সহমর্মিতার চরম পরাকাষ্ঠ্য প্রদর্শন করা উচিত। নিষ্ঠুরতা ও নির্দয়তার মূর্দয়তার মূর্তপ্রতিক হওয়া তার জন্য আদৌ শোভনীয় নয়।
সিনেমা ও ড্রামার মূল উদ্দেশ্য প্রশিক্ষণ ও মহৎ চরিত্রের শিক্ষা দেয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। কিন্তু হায়। এগুলো এখন সম্পূর্ণরূপে শয়তানের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ফ্রান্সের সাহিত্যিক যেমন ভিক্টর হুগো প্রমুখের ফ্রান্সে বিপ্লব সংগঠিত করা এবং সকল প্রকার জুলুম নিপীড়ন থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান ছিল। আমাদের দেশে সাহিত্যিকও তাদের সাহিত্য কর্ম শিল্পী এবং তাদের শিল্পকর্ম, বিনোদনের উপকরণ ও তার উপস্থাপনা সবকিছুই উন্নত নৈতিক চরিত্রকে ভিত্তিমূলক থেকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুব সমাজকে তাদের দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ করা এবং উশৃংখলতা ও লাম্পট্যের শিক্ষা দেয়াই তাদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এসব শিল্পী ধন-দৌলতের পিয়াসী হয়ে এমন কিছু করে যাচ্ছেন যা সুষ্ঠু রুচিবোধ সম্পন্ন কোন মানুষ কখনো মেনে নিতে পারে না। অপমাণিত হয়ে এবং স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে খাবার গ্রাস লাভ করার চেয়ে সসম্মানে ক্ষুৎপিপাসায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সহস্র গুণে উত্তম। স্বাধীনতার জন্য যত ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করতে হোক না কেন সবই অকপটে গ্রহণযোগ্য। আমাদের দেশের কর্তা ব্যক্তিরা আজও সেই ধ্বংসাত্মক পথেই চলছে যে পথে ছোট বড় সবার জন্য করুণ মৃত্যু অপেক্ষা করছে।
নীল উপত্যকার আধুনিক ফেরাউন
পাঠকগণকে কখনো ভুলে গেলে চলবে না যে, আবদুন নাসেরের শাসনামলের অনন্য বৈশিষ্ট্যই ছিল অত্যাচার-উৎপীড়ন ও মানুষের মৌলিক অধিকার পদদলিত করা। কোন পর্যায়েয় মানুষই তার এ অমানবিক আচরণ থেকে নিরাপদ ছিল না।
আপনারা শুনে বিস্মিত হবেন যে, জাতীয় পরিষদের স্পীকার ডক্টর সানহুরীও প্রতিশোধের টার্গেটে পরিণত হন। নাসের তার পেছনে তার গার্ড বাহিনীকে লেলিয়ে দেন পরিষদ ভবনের মধ্যেই তাদের হাতে বেচারা স্পীকার নির্মমভাবে প্রহৃত হন। তার অপরাধ ছিল এই যে, তিনি মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ব্যাপারে নাসের সাহেবের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। আইনজীবি সমিতি (Bar Asso-ciation)-এর ওপরও নাসের তার নিজের লোকদের নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। তারা তোতাপাখীর মত শেখানো শ্লোগান দিতো এবং আইনজীবিগণের মুখের ওপর ঘুষি পাকিয়ে মূর্খতার মূর্তপ্রতীক এসব শ্লোগান তুলতো- নির্বোধ আইনজীবিগণ মুর্দাবাদ!
আল্লাহ মাফ করুন! লক্ষ্য করুন! আইন বিশারদগণ মূর্খ বলে আখ্যায়িত হলো এবং এ জালেমশাহীর গোমস্তাগণ জ্ঞানী পন্ডিতরূপে স্বীকৃতি পেল।
জামাল আবদুন নাসের কেবল এসব অপকর্মের নির্দেশ জারী করেই ক্ষান্ত থাকতো না। বরং খুবই উৎসাহের সাথে এর টেপ শুনতো এবং ফিল্ম দেখতো এবং অহংকারে মাথা ঝাকুনি দিতো। কুব্বা প্রাসাদের স্বাগতিক হলে নাসের এ সকল টেপ ও ভিডিও ক্যাসেট ফিল্ম সাদরে গ্রহণ করতো। এই ছিল তার প্রিয় মেহমান, অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ মহলেই প্রেসিডেন্টের দপ্তর ও কর্মস্থল ছিল। এই বিলাস বহুল প্রাসাদে তিনি ভোগ বিলাসে মত্ত থাকতেন। অথচ ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে তিনিই অপব্যয়, বিলাসিতা ও জাঁকজমকপূর্ণ শাহী মহল বালাখানা এবং বড় বড় বাংলো নির্মাণের তীব্র সমালোচনায় মুখর থাকতেন।
খর্বকায় নেতা ও মিসরের ইতিহাস
নাসেরের স্থালাভিষিক্ত সাদাতও তার পদষ্ক অনুসরণ করে চলতে শুরু করে। এমন কি ভোগ বিলাসিতায় তার চেয়েও আরো দু’কদম অগ্রসর হয়ে যায়। তিনি ময়ূরের ন্যায় সাজগোজ করে অত্যন্ত অহংকার ও গর্ব প্রকাশ করতেন। ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিদিন একখানা প্লেনে ভর্তি ফুলের তোড়া তার জন্য আনা হতো। নাসের ও সাদাত উভয়ের শাসনামরেই একটা দৃশ্য ছিল খুবই সুস্পষ্ট। তাহলো, মিসরের ইতিহাসের গৌরবোজ্জল ব্যক্তিত্বদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব রকম প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো। যেন ইতিপূর্বে মিসরের ইতিহাস বলতে কিছুই ছিল না। এসব ক্ষণজন্মা নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন হওয়ার সাথে সাথে ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। মনে হয় যেন ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে মিসর অস্তিত্ব লাভ করেছে। মিসরের জন্য এথেকে বড় লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে যে, তার সমস্ত ইতিহাস ঐতিহ্যকেই অস্বিকার করা হবে? অথচ পবিত্র কুরআন মজীদে আল্লাহ তায়ালা বার বার এ ভূ-খন্ডের উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা শুধু এ ইংগীত দেয় যে, উক্ত দু’মহাপ্রাণ ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ছিল একান্তই দুর্বল আর মন-মস্তিষ্ক অত্যন্ত স্থুল চিন্তায় ভরা। তারা তাদের অকিঞ্চিৎকার অবস্থা সম্বেন্ধে খুব ভালভাবেই অবগত ছিল। তাই এসব মহারথীরা ইতিহাস খ্যাত মহাপ্রাণ ব্যক্তিদের আলোচনা পর্যন্ত মানুষের সামনে আসতে দেয়ার পক্ষপাতি না। যদি মিসরের ইতিহাস সৃষ্টিকারী অন্যান্য নেতাদের সম্পর্কে যুব সমাজ অবহিত হতে পারতো এবং তারা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেতো তাহলে এসব স্বকল্পিত মোড়লগণ ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তো।
হোসনী মোবারকের অপুর্ণাঙ্গ সংস্কার
আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল এই যে, এসব গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল শ্রেণীর নেতাদের হাটে হাঁড়ি ভেঙে যুব সমাজকে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করবেন। অতএব তিনি মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ হোসনী মোবারককে তাওফিক দিলেন যে, তিনি তার পূর্ববর্তীদের পদাষ্ক অনুসরণ করার পরিবর্তে যুক্তিসঙ্গত ও যথার্থ পথ অবলম্বন করবেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সস্তা খ্যাতি ও মিথ্যা প্রপাগান্ডার পূর্বতন পদ্ধতি অবলম্বন করেননি যা ছিল তার পূর্ববর্তী দু’জনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। হোসনী মোবারককে আল্লাহ তায়ালা উত্তম পুরষ্কার প্রদান করুন। তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে সিলেবাস পাঠ্যক্রম, শিক্ষা-দীক্ষা ও পড়ালেখার অন্যান্য সকল দিক ও বিভাগে সাহিত্যিক ও পন্ডিতগণকে অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন যেন তারা মিসরের ইতিহাসকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যুবকশ্রেণী ও ছাত্রসমাজের সামনে তুলে ধরেন। এ পর্যায়ে আমরা যেমন তাঁর গৃহীত এ পদক্ষেপকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই তেমনি আমাদের অভিযোগও ইতিহাসের নিকট সোপর্দ করে দিতে চাই যে, অদ্যাবধি ইখওয়ানের দায়িত্বশীল ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণকে বিশেষত আমাদের দু’দুজন মুরশিদে আ’ম- যথাক্রমে সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদ এবং সাইয়েদ হাসান আল হোদাইবি মরহুমের ইতিহাসকে গোপন করে রাখা হচ্ছে। পাঠক্রম থেকেও তাদেরকে দূরে রাখা হয়েছে। অথচ মিসরের ইতিহাসের রেকর্ড ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হতে পারে না যতক্ষণ উক্ত দু’মহতী ব্যক্তিত্বের উল্লেখ না করা হবে। এরা দু’জন আধুনিক মিসরের ইতিহাসের দু’টি উজ্জল চাঁদ। তাদেরকে যারা পর্দার অন্তরালে রাখতে চায় তাদের জেনে রাখা উচিত যে, তাদের কৃতিত্ব এমন জীবন্ত ও ধরাপৃষ্ঠে এমন দীপ্তিমান রাজপথের নির্দেশিকা যে তা গোপন করে রাখা সম্ভব নয়।
ইসলামী দুনিয়ার পথিকৃত
আমরা পড়েছি যে, বানাফশা (এক প্রকার বেগুনি) ফুল সচরাচর ঘাস ও লতাগুল্মের ভেতর পরিদৃষ্ট হয় না কিন্তু তার সুগন্ধি দূর থেকেই হৃদয় মন ভরে দেয়। ঠিক এ অবস্থাই ছিল আমাদের দু’জন মুর্শিদে আ’মের। আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত রহমত ও সন্তুষ্টি বর্ষিত হউক তাদের ওপর। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীদের অবস্থাও বড় অদ্ভূত। তাঁরা এই দু’ মহান ব্যক্তিত্বের কথা ছাত্রদের কানে পৌছতে দেয়াকেই বিপজ্জনক মনে করে থাকেন। তাঁদের দু’জন ছাড়া অন্য সকল ব্যক্তিত্বের ওপর থেকে ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। অথচ উক্ত দু’মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের মর্যাদা সম্পর্কে এ থেকেই ধারণা লাভ করা যেতে পারে যে, তাদের প্রভাব শুধুমাত্র মিসরের মাটি ও ইতিহাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কারণ, তাঁরা সমগ্র ইসলামী দুনিয়াকেই তাঁদের মহত চিন্তাধারার আলোকে আলোকিত করে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও নিকটবর্তী অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদ দিন। দূরপ্রাচ্য অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিফাইন পর্যন্ত তাদের চিন্তার দীপ্তিতে ঝলমল করছে। হাসানুল বান্নার কৃতিত্ব হলো তিনি বিশ্বব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণ ও রেঁনেসার পথ সুগম করেছেন। আর হাসান আল হুদাইবি ছিলেন তার নিজের উক্তির মূর্ত প্রতীক। তিনি বলেছিলেনঃ
“কুরআনের রাজত্ব নিজেদের অন্তরে কায়েম করে নাও-
ভূ-পৃষ্ঠে তা আপনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।”
(আরবি****************) –সাজসরঞ্জাম কম থাক
আর বেশী থাক বেরিয়ে পড়ো
উস্তাদ আল হুদাইবি (র) ইখওয়ানের দায়িত্ব ভার গ্রহণের পর হাসানুল বান্না (র)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতে থাকেন। তিনি একাধারে গ্রাম, মহল্লা এবং শহরে নিয়মিত দাওয়াতী সফরে যেতেন। শারীরিক দুর্বলতা এবং কার্ধক্য সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্মতৎপর, প্রাণ চঞ্চল ও উৎসাহী নেতা। তিনি ইসলামী দাওয়াত ব্যাপ দেশে সুদূর সিরিয়া ও লেবাননও সফর করেন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় মিসরের জনগণ তাকে উঞ্চ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এ জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিলো যে, মুর্শিদে আ’ম কতটা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। সাধারণ জনসমাবেশ ও সভা সমিতিতে মুর্শিদে আ’মকে বড়ই ভাবগম্ভীর এবং মর্যাদাবান বলে মনে হতো। আবার যখন ইখওয়ানের বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হতেন তখন মনে হতো তিনি অত্যন্ত কোমল প্রাণ সাথীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা পোষণকারী এবং হাসিখুশী ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
আল্লাহ জুলুমকেই জুলুমের
প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেন
আমার মনে আছে সি, আই, ডি, প্রধান মিষ্টার হাসান তালাত একবার আমাদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে আগমন করেছিলেন। সেখানে তিনি মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে কিছু সময় কথাবার্তা বলেন। যেসব মন্তব্য তিনি সাক্ষাতের পর করেছিলেন আমার স্মৃতিপটে তা আজও সুরক্ষিত আছে। তিনি বলেছিলেন আমি আমার চাহিদা মাফিক প্রত্যেক দলের ভেতর বিশেষ ব্যক্তিদের পেয়েছি। যারা আমাকে সংশ্লিষ্ট দলের অভ্যন্তরীন খবরাদি সরবরাহ করে থাক। কিন্তু ইখওয়ানের মধ্যে তেমন একটি লোকও আমি খুঁজে পেলাম না।
হাসান তালাত নামক এই ব্যক্তি ছিলো বড়ই অত্যাচারী ও পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী। আল্লাহ তায়ালা তাঁর মেজাজ ও স্বভাব-প্রকৃতি ভারসাম্য পূর্ণ করে দেয়ার জন্য অপর এক হিংস্র স্বভাব অফিসারকে তার ওপর চাপিয়ে দেন। এ বিভাগেরই জনৈক কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অর্থাৎ তার নিজের দপ্তরেই সিঁড়ির উপর তাকে পাকড়াও করেন এবং খুব উত্তম মাধ্যম দ্বারা ধন্য করেন। এসব অভিনয়ের প্রেক্ষাপট ছিল এই যে, হাসান তালাতের নিকট কিছু সংখ্যক গোপন টেপ ছিল। যাতে কতিপয় নামীদামী ব্যক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন সংরক্ষিত ছিল। অপর একজন অফিসার তার নিকট হতে এ টেপ নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তিনি তা মোটেও দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। অবশেষে এ টেপের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায়। তা জালিয়ে ফেলেছিলেন। আমার মনে হয়, উক্ত টেপ আজও কারো না কারো কাছে বর্তমান থেকে থাকবে এবং প্রয়োজনে সময় মত সে তা ব্যবহার করবে। আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন। ঐ সব টেপের মধ্যে এমন কি আছে যা দিয়ে কারো ক্ষতি সাধন করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
জেলখানায় বন্দী জীবন যাপনের সময় ইখওয়ানীরা যেসব দোয়া করতেন তার একটি হচ্ছেঃ (আরবি**************)
“হে আল্লাহ! যালেমদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দাও। আর তাদের মধ্য থেকে আমাদেরকে তুমি নিরাপদে রক্ষা করো।”
উস্তাদ হাসান আল হুদাইবি (র)-এ দোয়া শুনে মিষ্টি হেসে বলতেনঃ
(আরবি***************) “আল্লাহ তো তাই করে থাকেন। তিনি এক জালেমকে দিয়ে আরেক জালেমকে হত্যাও করিয়ে থাকেন। কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।”
উপরোক্ত ঘটনাতো একটা উদাহরণ। অথচ এরূপ হাজারটা দৃষ্টান্ত আমাদের দৃষ্টির সামনে দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গেছে।
ইখওয়ানীরা যখন জেলখানায় ছিলেন তখন জামাল আবদুন নাসের এবং তার অর্থে কেনা সংবাদপত্র ইখওয়ান ও মুর্শিদে আ’ম-এর ওপর সকল রকম অপবাদ আরোপ করতে থাকে। কারাবন্দীগণ না পারছিলো আত্মপক্ষ সমর্থন করতে না পারছিলো অন্যে তাদের পক্ষে মুখ খুলতে। অথচ আত্মপক্ষ সমর্থন করা মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত আমরা এমন গুরুত্বপূর্ণ অধিকার থেকেও ছিলাম পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত। যাহোক এসব লোকের নির্লজ্জতা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনিত হয় তখন মুর্শিদে আ’ম “আলমিসরী” পত্রিকায় একটি পত্র লিখেন। এ পত্রিকা তখনো পর্যন্ত নিসিদ্ধ ঘোষিত হয়নি। তিনি উক্ত চিঠিতে বিপ্লবের নেতৃবৃন্দকে “মোবাহেলার” জন্য আহবান জানালেন। “মোবাহেলা” শব্দটি শুনে এসব মহারথিরা হতবাক হয়ে যান। কারণ, তারা এ শব্দটির অর্থ সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণভাবে নাওয়াকিফ। তাদের এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে উস্তাদ আল বাকুরী তাদেরকে উদ্ধার করেন এবং “মোবাহেলা” শব্দের ব্যাখ্যা তাদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেনঃ “মোবাহেলা” দ্বারা না লড়াই বুঝায় না বাক যুদ্ধ। এটা দু’টা প্রতিদ্বন্দ্বী অথবা পরস্পর বিরোধী ব্যক্তি কিংবা দলের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার নিকট এই মর্মে দোয়া করা যে, উভয়ের মধ্যে যে মিথ্যাবাদী আল্লাহ তায়ালা যেন তার লানত নাযিল করেন।
যদি সত্যবাদী হও তাহলে আস
জেলখানার ভিতর থেকে কোন কয়েদীর পত্র বাইরে যাওয়া এমনিতেই ছিল বড় রকমের অপরাধ। তার ওপর আলোচ্য চিঠিখানা নাসের ও তার সমস্ত সাঙ্গপাঙ্গোদের হাটে হাড়ি ভেঙে দেয়। জনসমক্ষে তার মুখোশ পুরোপুরিভাবে খুলে যায়। এখন বেচারা সম্পূর্ণ কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে না সামনে অগ্রসর হতে পারছিলো না পেছনে সরে আসতে পারছিলো। হাসান আল হুদাইবির মোকাবিলায় মোবাহেলায় অংশ গ্রহণ করার হিম্মত তাঁর কোথায়? কোন মায়ের সন্তানের এমন বুকের পাটা ছিল যে, সে ময়দানে অবতীর্ণ হতে পারে? জেলখানার দারোগার ওপর কঠোরতা নেমে এলো। হতভাগার ওপর শাস্তির নির্দেশ জারী করা হলো এই মর্মে যে, কারাভ্যন্তর থেকে এ পত্র বাইরে আসলো কি করে? আমরা জেলখানার আঙ্গিনায় একটা গাছের ছায়ায় বসেছিলাম। ইত্যবসরে দারোগা সাহেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ মেজাজে আমার কাছে আসলেন। আমাদেরকে সেলের মধ্যে আটকে রাখার জন্য রাগান্বিত মেজাজে হুকুম জারী করলেন। এমনকি কোন প্রকার পায়চারি করার জন্য বাইরে আসতে দেয়া হবে না। এসব বিপ্লবীরা আমাদের মোকাবিলায় সকল হাতিয়ারই পরীক্ষা করেছে। কিন্ত এই নিরস্ত্রদের মোকাবিলায় অসহায় বোধ করছেন।
মর্দে মু’মিন
উস্তাদ আল হুদাইবি এমন মহৎ নৈতিক ও মানবিক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন যে, কোন লোক সম্পর্কেই অন্তরে কোন হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। ইবরাহীম আবদুল হাদীর নির্যাতন-নিপীড়নের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। উস্তাদ আল হুদাইবি একবার তার সাথে সাক্ষাত করার জন্য চলে যান। শরীয়াতের দৃষ্টিতে সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তিনি প্রতিশ্রুতি পুরো করার ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই নিয়মানুবর্তী। ইখওয়ানের সমাবেশেও দেখা যেতো তিনি সর্বদা সকলের আগে এসে পৌছতেন। আবার যাওয়ার সময় যেতেন সবার শেষে।
তাঁর অভ্যাস ছিল যে, তিনি তার দ্বীনি মর্যাদাকে কখনো দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিল করার উপায় বানাতেন না। এটা ইখওয়ানের প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিরাট অনুগ্রহ যে, কোন বিরাট ব্যক্তিত্বও এমন কোন প্রমাণ পেশ করতে পারবেন না যে, তিনি ইখওয়ানের কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে কোন টাকা পয়সা প্রদান করেছেন। যখন যে পরিবেশ পরিস্থিতিই বিদ্যমান থাকুক না কেন? আমরা কখনো আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারো অনুগ্রহের দ্বারাস্থ হইনি। কোন প্রমাণ ব্যতীত দোষারোপকারীদের বিচারের দায়-দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার ওপর। তিনিই তিদের সাথে বুঝাপড়া করবেন। তারা আল্লাহর ভয় না করে দ্বিধাহীনভাবে বলে বেড়ায় যে, ইখওয়ান দ্বীনকে তাদের ব্যবসায়ের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। মনে রেখো, যেসব শরীফরা মিথ্যা ও অপবাদ আরোপ করে একদিন তাদের মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যাবে।
জামাল আবদুন নাসেরের বিদ্বেষ
মুনীর দাল্লা মরহুমের সাথে এক সাক্ষাতের সময় জামাল আবদুন নাসের বলেছিলেন-আমি এমন একটা বৈদ্যুতিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাই যে, যখনই বোতাম টিপবো তখনই সমগ্র জাতি বিদ্যুৎ প্রবাহের ন্যায় উঠে দাঁড়াবে এবং যখন আরেকটি বোতাম টিপবো তখন ততটা দ্রুত গতিতেই সমস্ত দেশবাসী বসে পড়বে।
জবাবে মুনীর দাল্লা মরহুম বলেছিলেনঃ “কি চমৎকার জামাল”? আপনি চাচ্ছেন সমস্ত জাতিকে পুতুলের মত নাচাতে এবং কেউ যেন আপনার নির্দেশ অমান্য না করে। আপনার এরূপ মহৎ ইচ্ছার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এমনটা করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।
নাসের তাৎক্ষণিকভাবে নীরবতা অবলম্বন করলেও মুনীর মরহুমের এমন নির্ভীক জবাব কিছুতেই ভুলে যেতে পারেননি। তিনি তার অন্তরে প্রতি হিংসার দাবানল প্রজ্জলিত করতে লাগলেন। ইখওয়ানের ওপর যখন বর্বরোচিতভাবে হামলা করা হয় তখন মুনীর দাল্লার ওপর সর্বাপেক্ষা বেশী নির্যাতন চালানো হয়। মুনীর দাল্লা নাসের সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা শুধু ইখওয়ানের মতামতই ছিল না। বরং নাসেরের স্থালাভিষিক্ত সাদাত ও তাঁর রচিত “আপন অস্তিত্বের সন্ধানে” গ্রন্থে যা লিখেছেন তার মমার্থও ছিল এই যে, নাসের নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর আর কারো কোন উচ্চবাচ্য শুনতে প্রস্তুত ছিল না। তার নিকট সত্য ছিল কেবল তাই যা তার মনে উদয় হতো। তা ছাড়া অন্য কোথাও সত্যের লেশমাত্র ছিল না।
এ ছিল একনায়কতন্ত্রের ব্যাধি যা এই ব্যক্তিটিকে ইখওয়ান এবং মুর্শিদে আ’ম- এর প্রতিও জুলুমের হাত প্রসারিত করতে অনুপ্রাণীত করেছিল। মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবি সঠিক অর্থে ছিলেন ইসলামী নেতা। তিনি ছিলেন ফিকাহ্ বিশারদ এবং আইনবিদও। তাঁর খুব ভালভাবেই জানা ছিল যে, একজন মুসলিম শাসনকর্তার ওপর প্রজাদের কি কি অধিকার রয়েছে। আর প্রজাসাধারণেরই বা কি কি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে শাসনকর্তার ওপরে। তাঁর দৃষ্টি যেমন ছিল ঐশী আইনের ওপর তেমনিভাবে ছিল মানবরচিত আইনের ওপরও। নাসের এজন্য ভীত ছিল যে, তিনি তার একনায়কতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন। মুর্শিদে আ’ম-এর অভ্যাস ছিল, তিনি নসীহত করার হক অবশ্যই আদায় করতেন। নাসেরের একটা অভিযোগ ছিল এই যে, সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের ওপর অবশ্য তাঁর মতামত চাপিয়ে দেয়ার জন্য কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতেন না সত্য কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের বহু পূর্বেই সমূদয় তথ্য গোপন সূত্রে মুর্শিদে আ’ম অবগত হয়ে যেতেন, যা ছিল ডাহা মিথ্যা।
নাসের শাইখ আল বাকুরীকে ওয়াকফ বিষয়ক মন্ত্রী বানিয়েছিল। অথচ ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মুর্শিদে আ’ম তার নাম উল্লেখ করেননি। শাইখ আল বাকুরী মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। অথচ মুর্শিদে আ’ম-এর নিকট থেকে না কোন অনুমতি নিয়েছিলেন না তার সাথে কোন পরামর্শ করেছিলেন। বাইয়াতের অর্থ হচ্ছে নিজের পছন্দ হোক বা না হোক সকল অবস্থায়ই মুর্শিদে আ’ম-এর আনুগত্য বাধ্যতামূলক। এরূপ আচরণ করার পরও মুর্শিদে আম কোন প্রকার অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। কিংবা শাইখ আল বাকুরীর নিকট থেকে কোন রূপ ব্যাখ্যাও দাবী করেননি। এসব লোক তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শাইখ আল বাকুরীকে বলি দিয়েছিল এবং অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে এই অভিযোগ দাঁড় করিয়েছিল যে, তিনি মুর্শিদে আ’ম ও ইখওয়ানের চর। মূলকথা হচ্ছে, নাসের মনে মনে ইখওয়ান ও তার মুর্শিদে আ’মের ব্যাপারে খুবই ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। তার জানা ছিল যে, ইখওয়ানের উপস্থিতিতে তার পুতুল নাচ সফলতা লাভ করতে পারে না।
নাসেরের এজেন্টরা সম্পূর্ণ নির্দোষ লোকদের ওপর যেভাবে অন্যায় অভিযোগের বৃষ্টি বর্ষণ করেন তা ছিল নজির বিহীন। নাসেরের নির্যাতনের অসহায় শিকার হন এমন সব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ফেরেশতাগণও যাদের নিষ্কলুষ চরিত্রের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবেন। এ ব্যক্তি ছিল এমন পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী যে, তার পাশবিকতার জন্য সে কোনদিন অনুতপ্ত হয়নি। তার অন্তর কখনো প্রকম্পিত হয় না এবং চক্ষু কখনো অশ্রুসিক্ত হয় না। মূলত সে মানুষ ছিল না। ছিল পাথর বরং তা থেকেও বেশী অনুভূতিহীন।
কৃষি সংস্কার না কৃষি বিপর্যয়
আবদুন নাসের তার তথাকথিত ভূমি সংস্কারের ঘোষণা করেন। তিনি আবাদী জমির পরিমাণ ধার্য করেন একশ একর। হাসান আল হুদাইবির অভিমত ছিল, এ সীমা পাঁচশ’ একর হওয়া আবশ্যক। তিনি নাসেরের বেঁধে দেয়া সীমার বিরোধিতা করেননি। কিন্তু তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন। মিসরের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির সাথে পরিচিত ব্যক্তি মাত্রই এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করবেন যে, উৎপাদনের দৃষ্টিভংগীর দিক থেকে হাসান আল হুদাইবির অভিমতই ছিল বাস্তবসম্মত ও কল্যাণকর। পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ একথার অনস্বীকার্যতা প্রমাণ করেছে। যে মুর্শিদে আ’মের রায়ের প্রতি তোয়াক্কা না করে বিপ্লবী সরকার কৃষি ব্যবস্থারই সর্বনাশ সাধন করেছে। সকল ক্ষেত্রেই লাভের পরিবর্তে দেখা দিয়েছে লোকসান। সাথে সাথে এ বাস্তবতাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইসলাম মানুষের জন্মগত মালিকান অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এবং বিশেষ পরিবেশ পরিস্থিতি ও একান্ত জরুরী অবস্থা ব্যতীত কারো ধন-সম্পদ তার সন্তুষ্টি ও যথাযোগ্য বিনিময় ছাড়া হস্তগত করার অনুমতি প্রদান করে না। মুসলিম জনসমাজের একান্ত কল্যাণ ও প্রয়োজনের খাতিরে যদি কারো মালিকানাধীন সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতেই হয় তবে তার যথাযোগ্য বিনিময় প্রদান করতে হয়।
অবশেষে নাসের চাষাবাদযোগ্য জমির মালিকানার পরিমাণ নির্ধারণ করলেন সোয়া দুইশ’ একর। কিন্তু তার এ ঘোষণার প্রতিও তিনি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করলেন না। কিছুদিন পরই পুনরায় নতুন ফরমান জারী করলেন যে, সংশোধিত মালিকানার পরিমাণ স্থির করা হয়েছে পঞ্চাশ একর। তিনি আরো ঘোষণা করলেন যে, হুকুম দখল কৃত জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদেয় মূল্য প্রাক্তন মারিকদের প্রদান করা হবে। তিনি তার এ অংগীকার রক্ষা করা থেকে পিছিয়ে যান। এমনকি কাউকে এক কানা কড়িও মূল্য প্রদান করা হয়নি। নাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে, যেসব লোকের জমি হুকুম দখল করা হয়েছে তাদেরকে প্রতি মাসে মিসরীয় পাঁচ পডিও করে প্রদান করা হবে যাতে পর্যায়ক্রমে তাদের মূল্য আদায় হয়ে যায়। এ ভাগ্য বিড়ম্বিত হতবাগার দল এ নগণ্য পরিমাণ অর্থ প্রাপ্তির আশায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অফিসে ধর্ণা দিতে থাকে। কিন্তু অর্ধচন্দ্র ব্যতীত তাদের ভাগ্যে কোন দিন কিছুই জোটেনি। এ থেকেই আপনি সরকারের গৃহীত জনকল্যাণমূলক সংস্কার কার্যাবলীর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন।
যে ভূমি থেকে কৃষক তার খাদ্য পায় না
ইতিহাস তার রায় দিয়েছে আর আমিও আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে সম্পূর্ণ স্থিরচিত্তে এ ঘোষণা দিচ্ছি যে, নাসেরের ভূমি সংস্কার প্রকৃত প্রস্তাবে ছিল ভূমি বিপর্যয়েরই নামান্তর। আমি নিজে ভূমি সংস্কারের বিরোধী নই। তথাপি ভূমির বিপর্যয়েরই নামান্তর। আমি নিজে ভূমি সংস্কারের বিরোধী নই। তথাপি ভূমির বিপর্যয়কে তো মেনে নিতে পারি না। আমি কৃষকদের সাথে মিশে তাদের জীবনধারাকে অত্যন্তা নিকটে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি-আমি তাদের মাঝেই জন্ম লাভ করেছি। তাদের অভাব অভিযোগ ও সমস্যাবলী আমার ভালভাবেই জানা আছে। আমি বক্তিগতভাবে কখনো এটা সমর্থন করতে পারি না যে, একজন জায়গীরদার (জোতদার ও জমিদার) হাজার হাজার একর জমির মালিকানা কুক্ষিগত করে বসে থাকবে অথচ সে হাত পা পর্যন্ত নাড়াতে চেষ্টা করবে না। কিন্তু বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে থাকবে। অথচ তার খামারে কর্মরত মজুররা ভূখা-নাঙ্গা থাকবে এবং ক্ষুধা ও তৃঞ্চার অসহায় শিকার হয়ে থাকবে। তারা সারা দিন অমানুষিক পরিশ্রম করেও রাতে অসাগারে অর্ধাহারে তাদের ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন দেহ বিছানায় এলিয়ে দেয়। তাদের মাথা গোঁজার একটু ঠাঁইও নেই। একই স্থানে তারা ও তাদের গরু বাছুরগুলো রাত কাটায়। শীতকালে প্রচন্ড হিমেল হাওয়া তাদের শরীরের ওপর দিয়েই বয়ে যায় অথচ তাদের গায়ে কোন গরম কাপড় থেকে না। এ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। এর সমাধান অত্যাবশ্যক আর এ জন্য আমাদের শরীয়াতই আমাদেরকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা বাতলে দিয়েছে। শরীয়াতকে বাদ দিয়ে আপনারা যতই বিদেশী মতবাদ; আমদানী করে অবস্থা সংস্কারের চেষ্টা করবেন তাতে কখনো সুফল পাবেন না। শরীয়াতের বিরোধিতা করে আপনারা সমস্যায় আরো ঘৃতাহুতি দিতে থাকবেন। কিন্তু সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন পথ খুঁজে পাবেন না।
প্রাচীন যে সমস্ত নিয়ম-নীতি দীর্ঘ দিন থেকে মিসরে প্রচলিত রযেছে তার সংস্কার প্রয়োজন। জোতদার ভূস্বামীদের আচরণ কৃষকদের সাথে অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং জুলুমমূলক। চাষীদের বেগার খাটানো হতো কিন্তু তাদেরকে কোন পারিশ্রমিক দেয়া হতো না। নাসের যদি সংস্কারের সঠিক পন্থা অবলম্বন করতো তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। ভূমির মালিকদেরকে কৃষকদের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কারবার করার নির্দেশ কার্যকরী করা যেতো। যেমন ভূমি মালিকের এবং শ্রম কৃষকের উৎপাদিত পসলে উভয়ের অংশ সমান। এতে উৎপাদনের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পেতো তেমনি চাষীদের অবস্থারও উন্নতি হতো। জমি ইজারা দেয়ার ব্যাপারে কোন কোন ফকীহগণের মাতানৈক্য রয়েছে বটে, তবে ভাগ চাষের বিষয়টি সর্বসম্মতিক্রমে স্থিরিকৃত হয়ে গেছে। কৃষকদের নিকট সরকারী খাস জমিও সহজ কিস্তিতে বন্টন করা যেতে পারতো। সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পর কৃষকদের মালিকানায় চলে যেতো। যদি এ কর্মপন্থা অবলম্বন করা হতো তাহলে ভূমিহীন কৃষক গ্রাম ছেড়ে শহরে পালিয়ে আসতো না। অথচ এখন তাদের জমি ছেড়ে চলে আসার ফলে একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদনের ওপর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব পড়ে অপর দিকে শহুরে পরিবেশে আশ্রয়হীন ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষের আর্থ সামাজিক সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে।
অনুরূপভাবে কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি, গরু-মহিষ ও হাঁস-মুরগী চাষ ইত্যাদিও যদি মালিক ও কৃষকের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ শ্রম ও আনুপাতিক অংশ অনুযায়ী উৎপাদনে অংশীদার হতো। তাহলে খাদ্য শস্য, দুধ, ঘি, গোশত ও ডিম তথা প্রয়োজনীয় সব উপকরণই সস্তায় পাওয়া যেতো এবং চাষীদের অবস্থার উন্নতি হতো। যখন একজন শ্রমজীবিকে কারবারে অংশীদার করা হয় তখন তার জন্য কাজ করা ও উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আগ্রহ ও আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়। তার আত্মসম্মান বোধও ক্ষুন্ন হয় না এবং তাকে অনাহারেও থাকতে হয় না।
নাসের সাহেব আবাদযোগ্য জমি সরকারীভাবে হুকুম দখল করে চাষী ও কৃষককূলের যেমন কোন কল্যাণ সাধন করেননি তেমনি সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতির কোন কল্যাণও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
সরকারী আমলা ও কর্তাব্যক্তিদের উৎপাদনের প্রতি কোন আন্তরিকতা থাকাতো দূরের কথা অসহায় ও অনন্যেপায় চাষী যারা ইতিপূর্বে জমিদারদের গোলাম ছিল এখন নব্য প্রভুদের দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র হয়ে পড়েছে। মিসর মূলত কৃষি প্রধান দেশ। অথচ সেখানে খাদ্য দ্রব্য ও গবাদি পশুর মূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে। যথাযথ পরিকল্পনা এবং ন্যায়নুগ ব্যবস্থা চালু করা হলে মুরগীর ডিমের দাম দশ কিরশের বেশী এবং গরু মহিষের দাম কখনো মিসরীয় এক হাজার পাউন্ডের অধিক হতো না। কিন্তু এখন দ্রব্য মূল্যের যে অবস্থা তা কোন মিসরবাসীরই অজানা নয়।
নাসের বড় অহংকারের সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি গরীবদের ভাগ্য হরিবর্তন করে দেবেন। হাঁ, অবশ্য তিনি তাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। তাদের অবস্থা আগে খারাপ ছিল এখন শোচনীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। জনসাধারণ যারা আগে কোন ঈদ বা উৎসব উপলক্ষে মাঝে মধ্যে অপেক্ষাকৃত উন্নত খাবার খেতো এখন তা থেকেও বঞ্চিত। ডিম, বকরীর গোশত, মুরগীর ইত্যাদি এখন মিসরের ধনিক শ্রেণী ছাড়া আর কারো ভাগ্যে জুটে না। নাসেরের সমাজতন্ত্র ও কৃষি সংস্কারের এই হলো পরিণতি।