তেইশতম অধ্যায়
আমার স্মৃতিপটে ১৯৫৪ সালের ঘটনাবলী ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বছর জানুয়ারী মাসে সুদানে প্রথম পার্লামেন্টের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। এ অধিবেশনে সদস্য অধিকাংশই মিসরের সাথে একীভূত হয়ে যাওয়ার দাবী করে….. আজ আবার লক্ষ্য করে দেখুন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। দু’টি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের মধ্যে পুনরায় একীভূত হওয়ার আলোচন চলছে। ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে যত চেষ্টা হয়েছে তার সবই কোন না কোন কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আমি আল্লাহ তায়ালার সমীপে আকুলভাবে দোয়া করছি যেন এবারের আলাপ আলোচনা ফলপ্রসু হয় এবং দু’টি দেশ একই ঐক্যসূত্রে নিজেদেরকে গ্রথিত করার ব্যাপারে সফলতার মুখ দেখতে পায়।
সুদান আশার আলোকচ্ছট!
সুদানে ইসলামী শরীয়াতের বাস্তবায়নে ও কার্যকরী করার কারণে ইনশাআল্লাহ সুদূর প্রসারী ফলাফল দেখা দেবে। মিসরের শাসনতন্ত্র এবং সংবিধানও এ ব্যাপারে ইসলামকেই সকল আইনের মৌলিক উৎস হিসেবে ঘোষণা করে। আল্লাহর হুকুমে কার্যক্ষেত্রেও যেন এদিকেই অগ্রসর হয়। আইন প্রণয়নের মৌলিক নীতিমালার ক্ষেত্রে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর একীভূত হয়ে যাওয়ার জন্য মজবুত ভিত্তি রচিত হয়ে যাবে। ইতিপূর্বেও আমি উল্লেখ করেছি যে, প্রেসিডেন্ট নিমেরী ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে ইখওয়ানুস শাইয়াতীন নামে অভিহিত করে আমাকে যারপরনেই গোলাক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছেলেন। তথাপি আমরা নিমেরী সাহেবের সাথে কোনরূপ আশোভন ও অশালীন আচরণ করিনি। বরং আমরা সর্বদা তার হিতাকাংখী ও কল্যাণকামী এবং এই মহতী কার্য তার সহযোগিই রয়েছি। সুদানী আইন পরিষদের সাময়িকীতে আমি যে প্রবন্ধ লিখেছিলাম তাতে ইসলামী আইনকে কার্যকরী করার মহতী উদ্যেগকে বড় সম্মনের দৃষ্টিতে দেখেছিলাম এবং এই পদক্ষেপকে পুরোপুরি সমর্থন করেছিলাম। আমরা মন্দের প্রতিদানে মন্দ করি না। আমাদের দোয়া এই যে, সুদানে ইসলাম বাস্তবায়নের প্রয়াস-প্রচেষ্টা সাফল্য মন্ডিত হোক। যাতে সমগ্র দুনিয়ার জন্য এই শাসন ব্যবস্থাকে নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
কামাল আতাতুর্কের ধর্মহীন গণতান্ত্র
১৯৫৪ সালের জানুয়ারী মাসের কথা। এ সময় মিসরে তুর্কী রাষ্ট্রদূত তুগায়ীকে দেশ ত্যাগ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিক নিয়ম-কানুনের পরিপন্থী কিছু কথাবার্তা বলেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে আমার মনে পড়লো যে, মিসরের এক রাষ্ট্রদূতের সাথেও তুরষ্কে এক আশ্চর্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এটা ছিল মিসরের বাদশাহ প্রথম ফুয়াদের আমলের কথা। সেই সময় কামাল আতাতুর্ক ইসলামের খেলাফত ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে তুরষ্কে ধর্মহীন গণতন্ত্রের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তুর্কী টুপি অথবা পাগড়ী পরিধান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ত্ৎপরিবর্তে ইউরোপীয় হ্যাট ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়। মিসরের রাষ্ট্রদূত আবদুল মালেক হামযা বেগ কোন সরকারী কার্য ব্যাপদেশে রাষ্ট্রপতি ভবনে গমন করেছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল তারবুশ (টুপি)। মোস্তফা কামাল (চরম ঔদ্ধত্বের সাথে) রাষ্ট্রদূতের মাথা থেকে টুপিটি নিয়ে মাটির ওপর ছুঁড়ে মারেন। এ অবাঞ্ছিত ঘটনা সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্যে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়নি।
বিপ্লবী কাউন্সিল কর্তৃক ইখওয়ানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ
১৯৫৪ সলের জানুয়ারী মাসেই বিপ্লবী কাউন্সিল ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে বেআইনী ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবি, ডাক্তার খামীস, হাসান আসমাভী, জনাব মুনীর দাল্লাহ, ভাই সালেহ আবু রাকীক, ফরিদ আবদুল খালেক, জেনারেল সালাহ শাদী ও জনাব ফারগলি প্রমুখকে গ্রেফতার করে জিন্দানখানার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দু’মাস পর মার্চ মাসে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। এ সম্পর্কে পূর্বেই উল্লেখ কার হয়েছে। এই ইখওয়ানী নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার সময় আবদুল কাদের আওদা শহীদ আবদুন নাসেরের সাথে তার বসভবনে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতের পর তিনি আমাদেরকে বললেন যে, অতি শীগ্রই সকল সমস্যা ও সংকটের অবসান হয়ে যাবে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিগণ আমেরিয়া কারাগারে ছিলেন। আওদা শহীদ সেখানে গিয়ে তাদের সহিত দেখা করেন এবং তাঁর সাক্ষাতের ব্যাপারে তাদের সবইকে অবহিত করেন।
মিসর ও সিরিয়ার ঐক্য
আমার আজও মনে আছে যে, ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যখন সিরিয়াতে মারাত্মক গোলযোগ দেখা দেয়। তখন জামল আবদুন নাসের ও জামাল সালেম সিরিয়া গমন করেন যেন বিবাদমান দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দেয়া যায়। আমার মনে হয় নাসের সিরিয়ায় বিরাজমান পরিস্থিতি দেখে মিসর ও সিরিয়ার মধ্যে ঐক্য ঘটানোর ব্যাপারে মত স্থির করেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, সিরিয়া অর্থনৈতিক-ভাবে দারিদ্রের শিকার হয়ে পড়েছে, এ থেকে মুক্তি লাভের জন্য সিরিয়ার নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণ মিসরের সাথে ঐক্যের ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। নাসের তার সাম্রজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইতিমধ্যে মনে মনে চিত্র অংকন করে ফেলেছিলেন। তার সেই নকশা মোতাবেক ইরাক থেকে সুদূর মরক্কো পর্যন্ত পুরো এলাকার ওপর আধিপত্য বিস্তার করাই ছিল উদ্দেশ্য। অনেক সময় প্রতিকূল আবহাওয়ার নিষ্ঠুর আঘাত জাহাজকে মঞ্জিলে মকসুদ পর্যন্ত পৌছতে দেয় না। নাসরের স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ দেখতে সক্ষম হয়নি। বস্তুত মানুষ চিন্তা করে এক আর তাকদীর ঘটিয়ে ফেলে অন্য। যে কাজের ভিত্তি মহৎ উদ্দেশ্যের ওপর রাখা হয় না তার ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না।
জেনারেল নাজীবের সাময়িক পদত্যাগ
১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আরো একটি ঘটনা সংঘটিত হয়্ সেটা ছিল জেনারেল মুহাম্মাদ নাজীবের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তাফা প্রদান। পদত্যাগ করার দু’দিন পরই জেনারেল নাজীব পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। সবাই এই ভেবে বিম্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়ে যে, দেশের অধীনে এসব বিষয়ে বিম্ময় বোধ করার কোন কারণ নেই। ক্ষমতার মসনদের প্রতি যখন সেনাবাহিনীর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তখন সব কিছুই উলট পালট হয়ে যায়। সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে সীমান্ত রক্ষা করা, রাষ্ট্র পরিচালনা নয়। সরকার পরিচালনা করা একটা গুরুত্বপূর্ণ ও নাজুক দায়িত্ব। এই গুরু দায়িত্বে অভিষিক্ত হতে পারে সেসব লোক যাদেরকে এই মহতী উদ্দেশ্যের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা করা রাজনীতিবিদদের কাজ; কিন্তু ক্ষমতার লিপসা ও গদির মোহ সমস্ত নিয়ম-শৃংখলা উলটে পালটে দেয়।
ওয়াফদ পার্টির শসনকাল
এখনে আমি একথাটাও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা জরুরী বলে মনে করি যে, ওয়াফদ পার্টির মন্ত্রীত্বের আমলে জনসাধারণের শাস্তি ও নিরাপত্তা লাভ করেছিল; অন্যান্য দলের মন্ত্রীদের সময় যা ছিল না। ওয়াফদদের মন্ত্রীত্বের আমলেও কখনো কখনো ওয়াফদদের কোন কোন নেতা তাদের নির্বুদ্ধিতার দ্বারা পরিবেশ কলুষিত করে ফেলতো। কিন্তু সার্বিকভাবে এই আমল অন্যদের আমলের চেয়ে অনেক উত্তম ছিল। আমার মনে আছে নাহাস পাশার মন্ত্রীত্বের আমলে পুলিশ শাবীনুল কানাতিরে অবস্থিত আমার বাড়ী ও অফিস তল্লাসী করে। তাদের সন্দেহ ছিল যে, মুকাররম আবীদ পাশার নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রন্থের কপি আামার কাছে আছে। লেখক এই বইটি নাহাস পাশা এবং তার ওয়াফদ পার্টির বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। সরকার এ পুস্তক নিষিদ্ধ করে দেন এবং তার সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করেন। আমার সম্পর্কে কেউ সরকারকে এই মর্মে মিথ্যা খবর দেয় যে, উক্ত গ্রন্থের কপি আমার নিকট আছে। পুলিশ বাসগৃহ ও দফতরের সবকিছু তন্নতন্ন করে খোঁজ করেও বইটির কোন কপি বের করতে পারেনি। এই দলটির চেহারায় এ ধরনের কলম্ক রেখা রয়েছে। যদিও তুলানামূলকভাবে তাদের রেকর্ড কিছুটা ভাল।
গোপন অধিবেশন
একদিকে যেমন ওয়াফদ পার্টির এই গ্রন্থকে বেআইনি করা এবং মানুষের ঘর বাড়ীতে আকম্মাত তল্লাশী চালানো ছিল অপছন্দনীয় কাজ অপরদিকে তেমনি আমার মতে মোকাররম আবীদ পাশার এই বই লেখাও সঠিক পদক্ষেপ ছিল না। আবীদ পাশা ছিলেন ওয়াফদ পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই পার্টির সাথে ছিলেন বেশ কয়েকটি বছর। এমনকি মন্ত্রীত্বের পদ পর্যন্ত অলম্কৃত করেন। অতপর তিনি ওয়াফদ পার্টি থেকে আলাদা হয়ে হিযবুল কুতলা বা কুতলা পার্টির গোড়া পত্তন করেন এবং ওয়াফদদের বিরুদ্ধে বই লিখেন। বিশ্বস্ততা ও দ্বীনদারীর পরিপন্থি যে কোন ব্যক্তি কোন দলে থাকবেন এবং সেই পার্টি থেকে মন্ত্রীত্বের পদও অলম্কৃত করবে কিন্তু পরে পার্টির আভ্যন্তরীণ গোপনীয়তা ফাঁস করে দেবেন এরূপ আচরণে গোপনীয়তা ও দায়িত্বশীলতা আহত হয়ে থাকে-প্রত্যেক পার্টির সদস্যেরই এটি মেনে চলা দরকার, যদি এর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা না হয় তাহলে কেউই কারো তোয়াক্কা করবে না এবং সামাজিক জীবন বিশৃংখলার শিকার হয়ে পড়বে।
আমি ওপরে আমার যে মতামত উল্লেখ করেছি তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু সংখ্যক হাদীস এবং কর্মনীতি থেকে গৃহীত। হযরত রাসূল (সা) থেকে একটি রেওয়াত বর্ণিত হয়েছে যে, “এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-এর নিকট এসে আরজ করলেন। ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আমি ছিলাম মুনাফিকদের অন্তর্গত বরং তাদের সরদার মুনাফিকদের মজলিশে কি কি কথাবার্তা হয়ে থাকে আমি খুব ভাল করে জানি। আমি কি আপনাকে তার বিস্তারিত বিবরণ দেবো? প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) একটা উন্নত নৈতিক শিক্ষা প্রদান করলেন। তিনি বললেন, “এমনটি কখনো করো না……..যিনি মোনাফিকী পরিত্যাগ করে তোমার মত নিষ্ঠাবান মুসলিম হয়ে যায় এবং আমাদের নিকট চলে আসে আমরা তাকে খোলা মনে গ্রহণ করে এবং তার জন্য আল্লাহর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করি। পক্ষান্তরে যে মোনাফিকীর ওপর অবিচল থাকে আমরা তার পশ্চাতে লেগে থাকি না। তার সাথে বুঝাপড়া করার জন্য আল্লাহ তায়ালাই তার জন্য যথেষ্ট। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এই হাদীস সর্ব যুগে দুনিয়াবাসীকে মজলিশের শিষ্ঠাচার সম্পর্কিত সোনালী নীতি শিক্ষা দিতে থাকবে। এই হাদীসের আলোকে মানুষের গোপনীয়তা নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকতে পারে। এই হাদীসের মমার্থ হচ্ছে, কারো গোপন কথা প্রকাশ করে দেয়া সমীচীন নয়। ইসলামী দাওয়াতের শিক্ষাসমূহের মধ্যে এটা একটা মৌলিক শিক্ষার মর্যাদ রাখে। ইখওয়ানুল মুসলিমুন এই শিক্ষাকেই মানুষের মধ্যে প্রচার করে থাকে। নিজেরাও এর ওপর আমল করে থাকে এবং এর আলোকে জীবন যাপন করেন।
ভ্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মপন্থা ও তার ফলাফল
ইসমাঈল সিদকীর মন্ত্রীত্বের আমলে মিসরে অদ্ভুত আর্থিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। ১৯৩১ সালে এক মণ তুলা মিসরীয় দেড় পাউন্ড বিক্রি হতে থাকে। রসূন পেয়াজের স্তুপ রাস্তা ও সড়কের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। কারণ কোন পাইকারী কিংবা খুচরা খরিদ্দার পাওয়া যাচ্ছিলো না। এতকিছু সেই সময় খাদ্য ও বস্ত্রের কোন অভাব সৃষ্টি হয়নি যেমনটি আজকের দিনে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। একথা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সারা দুনিয়াতেই বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে সাথে এ সত্য অস্বীকার করা যায় না যে, ব্যক্তির আয় দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির সাথে পাল্লা দিতে পারছে না। বিভিন্ন সরকার অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য স্বাভাবিক ও জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য বিশাল অংকের অর্থ ভর্তুকি হিসেবে খরচ করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণের দুঃখ দুর্দশা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রতিদিনই তারা বিভিন্ন আর্থিক দায়-দায়িত্বের নীচে পিষ্ট হয়ে চলেছে।
অর্থনীতি বিশারদ এবং লেখকগণ একাধিকবার একথা প্রকাশ করেছেন যে, দ্রব্য মূল্য হ্রাস করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত সাহায্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌছাচ্ছে না। ধনী ও প্রাচুর্য্যর অধিকারীর তাদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য এই সাহায্যও গ্রাস করে ফেলছে। এই ব্যবস্থা ভ্রান্ত পদ্ধতি ও ভুল মূলনীতির ওপর স্থাপন করা হয়েছে এবং পুনঃ পুনঃ অভিযোগ ও দাবী দাওয়া পেশ সত্ত্বেও পরিস্থিতি পরিবর্তনের ন্যূনতম আশাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গরীব শ্রেণীর সমস্যার সামাধান করার জন্য বাস্তবসম্মত যেসব প্রস্তাব পেশ করা হয়ে থাকে- তার প্রতি কেউ কর্ণপাত করে না। বুঝা যায় না, তারা বধির হয়ে গিয়েছে নাকি এর প্রতিকারের কোন চিন্তাই তারা করতে পারে না। অথবা কোন অদৃশ্য শক্তির ভয় তাদের সিদ্ধান্তের পথে অন্তরায় হয়ে আছে? এই ব্যাপারে আমিও কিছু প্রস্তাব পেশ করতাম। কিন্তু পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী আমার নীরবতা অবলম্বন করাটাই অধিকতর সমীচীন। মহীষের সম্মুখে ব্যান্ড বাজিয়ে কি লাভ? আমার পূর্বেও কিছু সংখ্যক লোক অনেক কিছু বলেছে এবং এখন নিরাশ হয়ে নীরব ভাষায় বলছেনঃ “অন্ধদের সামনে কেঁদেকেটে নিজের চোখ খোয়ানো বৃথা চেষ্টা ছাড়া লাভ কি?”
দাসদেরকে দাসত্বে সম্মত করা
১৯৫৪ সালের ২৫শে সার্চ বিপ্লবী কাউন্সিল আযাদী পন্থীদের বহাল করতঃ কয়েদীদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আযাদ অফিসার এবং মুহাম্মাদ নাজীবের মধ্যে আপোষ চুক্তির পর এই ফায়সালা জারি করা হয়। কিন্তু এটা প্রকৃত আযাদীর দিকে কোন পদক্ষেপ ছিল না। বরং এটা ছিল জনসাধারণের চোখে ধূলা নিক্ষেপের অপচেষ্টা মাত্র। পরবর্তীকালের ঘটন প্রবাহ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এই পদক্ষেপ ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে নস্যাতের সূচনা মাত্র। সে যাই হোক এই ফায়সালার পর আমাকে সামরিক কয়েদখানা থেকে সন্ধা পাঁচ ঘটিকার সময় ছেড়ে দেয়া হয়।
১৯৫৪ সালের ১৮ই এপ্রিল তারিখে জামাল আবদুন নাসের তার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। এই মন্ত্রীসভায় কার্যকালে বরং প্রকৃত প্রস্তাবে জামাল আবদুন নাসেরের গোটা শাসনকাল মিসরের ইতিহাসে জঘন্য প্রকৃতির নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়। নাসেরের স্তবকরা যদি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শত্রুতায় অন্ধ না হয়ে যেতো এবং ইনসাফ ও সুবিচারের সীমা পরিপূর্ণরূপে অতিক্রম না করতো তাহলে নাসেরের গুণাবলীর সাথে তার দোষ-ত্রুটিরও উল্লেখ করতো। তার “গুণাবলীর” কয়েকগুণ অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করা হতো। প্রকৃতপক্ষে তার দোষ-ত্রুটি ছিল গুণাবলী অপেক্ষা বহুগুণে বেশী। নাসেরের হাতে নিরপরাধ মানুষের যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তাকে এই তোশামোদকারীর শুধু সংস্কার বলেই দায়িত্ব শেষ করে থাকেন। এটা ইতিহাসের সাথে সরাসরি জুলুম এবং জাতির সাথে নির্মম তামাশা মাত্র।
কালের আয়নায় মিসর ও মিসরের বাইরের অবস্থা
ইন্দোচীনের যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার জন্য ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার নৌবহুর দূরপ্রাচ্যে এসে পৌঁছে। সংবাদপত্রে খবর বের হয় যে, লাল চীনের সেনাবাহিনী ইন্দোচীনের যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছে। যার ফলে ফ্রান্স আমেরিকার নিকট সামরিক সাহায্য চেয়েছে। অনুরূপভাবে সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হয় যে, ইরাক মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপের জন্য আমেরিকার কাছে আবেদন জানিয়েছে। ফ্রান্স ইন্দোচীনকে স্বাধীনতা দানে সম্মত হয়েছে এবং শীগ্রই দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। এই সময়েই ইস্রঈল সরকার তার আশেপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোর ওপর আক্রমণ করতে শুরু করে। ঐসব আরবদের শাসকগণ তাদের চিরাচরিত অভ্যাস মোতাবেক শত্রুর বাড়াবাড়ির জবাবে কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে প্রতিবাদমূলক বিবৃতি ও তর্জন গর্জন করে ইস্রঈলকে ভীতি প্রদর্শনের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।
১৯৫৪ সালের মে মাসে উস্তাদ আহমদ আবুল ফাতাহকে দশ বছর ও উস্তাদ আহমদ হোসাইন মরহুমকে পাঁচ বছর কারাদন্ডের ফরমান শুনিয়ে উভয়ের মৃত্যুদন্ড মওকুফ কার হয়। “আল মিসরী” পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল এবং এর প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই মাসেই নিরাপত্তা পরিষদ এবং এর প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই মাসেই নিরাপত্তা পরিষদ আরবদের বিরুদ্ধে ইস্রাঈলের সাহায্য করার প্রস্তাব পাশ করে। এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিন সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে ইস্রঈলের যে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় তার প্রত্যুত্তরে আরব শাসকরা শুধু শ্লোগান ও জ্বালাময়ী বক্তৃতার সাহায্যে নিজেদের ভূমিকার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এরূপ শ্লোগান দ্বারা না কোন সমস্যার সমাধান হয়েছে আর না ভবিষ্যতে হওয়া সম্ভব। ফিলিস্তিন সমস্যার ব্যাপারে এই লোকগুলো কখনো কোন সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেনি। তা না হলে এই অঞ্চলের জনগণ অধিকৃত ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য লক্ষ লক্ষ গর্দানের নজরানা পেশ করতে সদা প্রস্তুত।
মুর্শিদে আ’মের সিরিয়া ও লেবানন সফর
১৯৫৪ সালেই মুহতারাম মুর্শিদে আ’ম জনাব হাসান আল হুদাইবি লেবানন ও সিরিয়া সফর করেন। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল সেখানে ইখওয়ানদের অবস্থান ও সার্বিক অবস্থা জেনে নেয়া। তৎকালে আবদুন নাসেরের সরকার ও ইংরেজদের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। মুর্শিদে আ’ম উক্ত চুক্তির ব্যাপারে কতিপয় প্রশ্নের জবাবে সুস্পষ্টভাবে তাঁর মতামত ও দৃষ্টিভংগী প্রকাশ করেন। তাঁর এই মত জামাল আবদুন নাসেরের নিকট অত্যন্ত অপছন্দনীয় হয়। পরবর্তী কালে সংঘটিত ঘটনাবলীতে নাসেরের সেই অসন্তোষের বিশেষ প্রভাব ছিল।
এসব কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত
যদি আমার স্মৃতি আমাকে প্রতারিত না করে থাকে- তাহলে আমার মনে হয় যে, ১৯৩১ সালের জানুয়ারী মাসে তৎকালীন উজীরে আওকাফ হিলমী ঈসা পাশা নাহাস পাশাকে একটি পত্র লিখেন। ঐ পত্রে হিলমী ঈসা পাশার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় যে, তিনি যে মসজিদে জুমার নামায পড়তে যান সেখানে রাজনৈতিক শ্লোগান দেয়া হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তখন নাহাস পাশাকে সরকার থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আমি মনে মনে চিন্তা করলাম যে, এসব লোক মূলত একই মতের লোক। নাহাস পাশা তার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা কালে অন্যদের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিহিংসামূলক নির্দেশ জারী করেছিলেন সেসব ফরমানই এখন তার বিরুদ্ধে কার্যকরী হচ্ছিলো। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত মসজিদসমূহের খতিবদের উদ্দেশ্যে প্রায়ই নির্দেশ জারী করা হতো যেন তারা রাজনৈতিক সমস্যাবলী নিয়ে কোন আলোচনা না করেন। আমি মনে করি, খতিবগণ যদি রাজনৈতিক সমস্যাবলী বিশ্লেষণ করে জনসাধারণের কর্তব্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন তাহলে তাতে কি ক্ষতি হবে? মসজিদ কি এমন স্থান নয় যেখানে মুসলমানদেরকে তাদের জীবন সমস্যার সাথে পরিচিত করে তার সমাধান অবহিত করে দেয়া যেতে পারে? রাজনৈতিক কার্যকলাপ কি মানুষের জীবনের অংশ নয়? এমন খতিবদের সম্পর্কে জনসাধারণের অন্তরে কতটুকু সম্মন বোধ থাকবে যাদের ব্যাপারে তাদের মনে এরূপ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, তারা তাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিষয়ে মুখ খুলতে পারে না। নৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান এমন সব বিভাগ যে সম্পর্কে খতিবগণকে জনসাধারণের সম্মুখে ইসলামী দৃষ্টিভংগী বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা উচিত। কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্কন্ধের ওপর এমন সব দুর্বহ বোঝা তুলে নিচ্ছেন যার পরিণতি কালই তাদের নিয়ে ডুববে। তাদের এই বাড়াবাড়ির কারণে একদিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা এরূপ আচরণ করেছিলে কেন? অপরাধী ব্যক্তি তার ডানে-বামে তাকিয়ে দেখবে কিন্তু তার কোন সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক সে খুঁজে পাবে না। বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং মস্তক অবনত হয়ে পড়বে। আমি আল্লাহ তায়ালাকে সাক্ষী রেখে বলছি, যদি আমাদের প্রত্যেকে মানুষের পরিবর্তে সকল ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে চলে তাহলে যাবতীয় অন্যায় আপনা থেকেই নির্মুল হয়ে যাবে এবং আমরা বিশ্বভ্রাতৃত্বের দৃষ্টিতে অত্যন্ত সম্মানজনক আসনের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবো। আমাদের বিপদ হচ্ছে এই যে, আমরা এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার তালাশে একেবারে অন্ধ হয়ে পড়েছি অথচ চিরস্থায়ী জীবনের জন্য আমরা কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করছি না। জবাবদিহি করার দিন নিশ্চিত আসবে সেদিন কোন বিষয়েই আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কারো কোন কর্তৃত্ব চলবে না।
আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তোমরা শুধু তাই লাভ করতে পারো
১৯৫৪ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে আবদুন নাসের ও ইংরেজদের মধ্যে চলে যাওয়ার প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির ব্যাপারে ইখওয়ান তাদের লিখিত অভিমত প্রধান মন্ত্রীর সমীপে পেশ করেছিলো। ঐ বছরই আগষ্ট মাসে উস্তাদ আল হুদাইবির বাড়ীর নিকটবর্তী মসজিদুর রওদায় ইখওয়ানের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘাত ভবিষ্যত ঘটনাবলীর সূচনা এবং ইখওয়ানকে ভীত সন্ত্রস্ত করার সর্তক সংকেতের নামান্তর। এই সময় কেন্দ্রীয় অফিসে ইখওয়ানদের খুব কমই দেখা যেতো। তথাপি ডাক্তার খামীস মরহুম নিয়মিত কেন্দ্রীয় অফিসে উপস্থিত থাকতেন। আর আমি অধিকাংশ সময় তাঁর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য সেখানে গিয়ে হাজির হতাম। অনুরূপ আমি আলহাজ্জ মাহাম্মাদ জাওদা রাইস মার্চেন্টের দোকনে খানুল খালিলীতেও বেশীর ভাগ সময়ে চলে যেতাম। যেখানে আযাদ অফিসার এর লোকদের সাথে আমার দেখা সাক্ষাত হতো। এসব দেখা সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে যাচ্ছিলো তার প্রতিকার হতে পারে। সেই দিনগুলো ছিলো বড় বিপজ্জনক এবং মওসুমের দিক থেকেও ছিল ভীষণ গরম। আমি তখনই অনুমান করেছিলাম যে, জামাল আবদুন নাসেরের পক্ষ থেকে ইখওয়ানের ওপর মুসিবত অত্যাসন্ন। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নির্ধারিত হয়ে গেছে তা থেকে পালিয়ে বাঁচার কো উপায় নেই। ইখওয়ানের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত কিছু কিছু লোকের জন্য শাহাদাত প্রতিক্ষার প্রহর গুণছিল। একথা বলার সুযোগ নেই যে, ইখওয়ান নেতৃত্ব তাদের স্বাভাবসূলভ সরলতার কারণে প্রতারিত হয়েছিল। সত্য কথা হলো, আল্লাহর ফায়সালা ও নিয়তির সম্মুখে কোন বুদ্ধিমাত্তা কাজে আসে না।
ইখওয়ানের নেতারা তো সাধারণ মানুষ। তাকদীরের সামনে নবী রাসূলগণও অসহায় হয়ে পড়েন। একবার মদীনা মনোয়ারাতে কতিপয় বদ্দু (গ্রামীণ অশিক্ষিত আরব) নবী (সা)- এর খেদমতে এসে হাজির হয়। তারা ছির পীড়িত। কিছুদিন অবস্থানের পর সুস্থ হয়ে ওঠে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিদায়ের অনুমতি প্রার্থনা করে। সাথে সাথে আরো আবেদন জানায় যে, তাদের সাথে কিছু সংখ্যক ক্বারী ও হাফেজে কুরআনও প্রেরণ করা হোক। যারা তাদের গোত্রের লোকজনকে কুরআন ও ইসলাম শিক্ষা দিবে। নবী (সা) কয়েকজন সাহাবীকে তাদের সংগে পাঠিয়ে দিলেন। মদীনা থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর বদ্দুরা বিশ্বাসঘাতকতা করে। ক্বারীগণকে শহীদ করে ফেলে এবং বকরীর রাখালদেরকে মেরে বকরীর পালগুলোকে হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। রাসূলূল্লাহ (সা) এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে খুবই মর্মাহত হন। রাসূলুল্লাহ (সা)- এর ওপর তো ওহী অবতীর্ণ হতো এবং আল্লাহ যখনই চাইতেন বিভিন্ন ব্যাপারে তাঁর নবী (সা)-কে দিকটির্দেশনা দিতেন। এখন এ ব্যাপারে কোন মুসলিম একথা বলতে পারে না যে, রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতারিত হয়ে ছিলেন। এটা ছিল আল্লাহ তায়ালার ফায়সালা। যা্ পূর্বেই নির্ধারিত হয়েছিল্। যদি ১৯৫৪ সালের দিনগুলো আবার ফিরে আসে তাহলে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে পুনরায় আবার তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। কেননা তাকদীরকে বদলানো যায় না এবং আল্লাহর ফায়সালা থেকে পালিয়ে বাঁচাও সম্ভব না। এজন্য যে-ই এই বিতর্কে লিপ্ত হয়ে বলে যে, যদি বিচক্ষণতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো তাহলে এমনটি ঘটতো না। আর যদি সর্তকতা অবলম্বন করা হতো তাহলে ধোঁকার ফাঁদে পড়তে হতো না। সে মূলত আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর ও ফায়সালা সম্পর্কেই অনবহিত। আল্লাহ তায়ালার প্রতিটা কাজেই হিকমত লুকায়িত থাকে। যা কেবল সেই হাকীম এবং খাবীরই পরিজ্ঞাত। তিনি ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে তা জানা কিছুতেই সম্ভব নয়। মানুষকে তার সকল চেষ্টা-তদবীর এবং চিন্তা-ভাবনা পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা উচিত। সাথে সাথে তার জেনে রাখা উচিত যে, ফলাফল সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ তায়ালার ইখতিয়ারাধীন। কোন মানুষ জানে না যে, আগামীকাল তার সাথে কি আচরণ করা হবে।
সর্বাবস্থায় অস্থিরতা জাঁহাপনা!
আমি স্মৃতির প্রদীপ জ্বালিয়ে তার আলোতে অসংখ্য যুবক ছেলেমেয়েকে দেখতে পাই। তারা ইখওয়ানুল মুসলিমুনে শামিল হয়েছেল কিন্তু পরক্ষণে এর কোন দুর্বলতার কারণে নয় বরং নিজেদেরই অপারগতার কারণে সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এরপরও তাদের অন্তরের অন্তস্থলে এবং অনুভূতির পরতে পরতে সর্বদা কল্যাণ ও মংগলের অনুভূতি কার্যকর রয়েছে। একবার যদি কেউ সংগঠনের রংয়ে নিজেকে রাঙিয়ে নেয় তাহলে তা একবারে মুছে ফেলা খুবই কষ্টসাধ্য। এসব যুবক যুবতীরা সংগঠন থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হৃদয় মনে সংগঠনের প্রতি গভীর ভালবাসা পোষণ করে এবং যে সংগঠনের স্নেহ ছায়ায় এক সময় তারা প্রশিক্ষণাধীন ছিল তার দিকে পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য তাদের চিত্ত অস্থির থাকে। কালের আবর্তন এবং ঘটনা প্রবাহ এই সুন্দর স্মৃতিগুলোকে নিষ্প্রভ করে ফেলতে পারে না। যে ব্যক্তিই কোন সময় ইখওয়ানের অন্তর্ভক্ত হয়েছে অনন্তর বিপদ মুসিবত সহ্য করতে না পারার কারণে ইখওয়ানের থেকে বেরিয়ে গিয়েছে তারপরও তার আচার আচরণ এবং জীবনের দিবা-রাত্রিগুলোর ওপর দাওয়াতের গভীর ছাপ সব সময়ই বিদ্যমান রয়েছে।
নিজের অক্ষমতার কারণে ইখওয়ানকে ছেড়ে যাওয়া সাথীরা অন্যদের দৃষ্টিতে সর্বদাই ইখওয়ানী বলেই পরিগণিত হতে থাকে। তাদের কেউ যদি শপথ করেও বিশ্বাস করাতে চায় যে, ইখওয়ানের সাথে তার সম্পর্কের লেশমাত্রও নেই তবুও মানুষ তা বিশ্বাস করে না। জামাল আবদুন নাসেরের আমলে বহুবার এমন হয়েছে যে, ইখওয়ানের প্রাক্তন সাথীদেরকেও গ্রোফতার করা হয়েছে। এমনকি যেসব লোক তার পক্ষে শ্লোগান দিয়ে থাকে এবং তারই প্রশংসায় গীতি ও কীর্তিগাঁথা শত মুখে গেয়ে বেড়ায় তাদের ব্যাপারেও কোন পার্থক্য করা হয় না।
মিষ্টার গান্ধীর উদ্ধৃতি ও উদাহরণ
১৯৩১ সালের জানুয়ারী মাসে হিন্দু নেতা মিষ্টার গান্ধীকে ইংরেজরা মুক্তি দেয়। গান্ধীর মুক্তি পাওয়ার ফলে স্বাধীনতাকামীদের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। উত্তম দৃষ্টান্ত যার পক্ষ থেকেই পেশ করা হোক কিংবা কোন দ্বীন অথবা মিল্লাতের বিশেষজ্ঞ প্রশংসনীয় কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক তাহলে তার প্রশংসা বর্ণনা করতে কার্পণ্য প্রদর্শন করা অনুচিত। আমি গান্ধীর দৃষ্টান্ত পেশ করছি। এর লক্ষ্য এই বিষয়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, নিজেদের অধিকার আদায়ের পথে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার ও মুষড়ে পড়া আদৌ উচিত নয়। আত্মসম্মান নিয়ে যে ব্যক্তি প্রাণপণ সংগ্রাম করে যেতে থাকবে সে অবশ্য তার অভিষ্ট লক্ষ অর্জনে সক্ষম হবে। এই দুর্বল, ক্ষীণকায় ও অর্ধউলংগ গান্ধী তার লক্ষ্য অর্জনে অধ্যবসায় ছিল আপোষহীন। সে তার আমলের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী জাতি ইংরেজকে বলে দিয়েছিল যে, আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাও। উপনিবেশবাদী ইংরেজকে সরকার তাকে কারাবন্দী করে এবং কষ্ট দিতে থাকে। সে ছিল দুর্বল এবং বৃদ্ধ। তা সত্ত্বেও সে শক্তিধর উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে এবং তার উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়। উত্তম শিক্ষা যেখান থেকেই পাওয়া যাক না কেন তা গ্রহণ করা উচিত। গান্ধী অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যদি তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এমন পাগল পারা হতে পারে তাহলে ইসলামের অনুসারীদের তাদের মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আরো অধিকতর উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করা আবশ্যক।
মূর্তির প্রেম থেকে হাত গুটিয়ে নাও এবং আপন খুদীতে নিমগ্ন হয়ে যাও
আমার মনে পড়ে একদিন আমার বড় ভাই আসিউতের কারাগারে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। কথাবার্তার মাঝে তিনি আমার মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেন এবং উপদেশের ভংগীতে বলেন আমি যেন সরকারের সহযোগিতা করি যাতে জেলখানার মুসিবত থেকে নাজাত মিলে যায়। আমি তাঁর এই অনুভূতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং তার নিকট আবেদন জানাই যেন এ বিষয়ে কোন কথাই তিনি আলোচনায় টেনে না আনেন। অন্যথায় আমি আগামীতে আর কখনো তার সাথে সাক্ষাতই করবো না। ভাইসাহের আমার কথা হৃদয়গম করতে সক্ষম হন এবং এই প্রসংগে আর কোন কথাই বলেননি।
কারো এরূপ মনোভাব পোষণ করা উচিত নয় যে, জেলখানা একটা আরামদায়ক জায়গা কিংবা নিজ বাসস্থানের তুলনায় অগ্রাধিকার যোগ্য। কিন্তু আমার আকীদা-বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে বাড়ীতে অবস্থান করা এবং অপমানিত ও লাঞ্ছনাকারী শক্তির সম্মুখে মাথানত করা কারাগারের কঠোরতার তুলনায় সহস্রগুণে বেশী কষ্টদায়ক। জেলখানার শত কষ্ট সহ্য করতে গিয়ে মানুষের মন একথার ওপর অবশ্যই সান্ত্বনা লাভ করে যে, সে অন্তত শত্রুর সম্মুখে মাথানত করেনি। সে তাকে ভয় করেনি বা তার সামনে সন্ত্রস্তুও হয়ে পড়েনি। স্বীয় অক্ষমতা এবং জালিমের শক্তি ও দাপট সত্ত্বেও সে জালিমের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দিয়েছে। আমি অবশ্য প্রখ্যাত আরবী কবি আনতারার কথার প্রতিধ্বনী করছি না যেখানে এই স্বনামধন্য ও জগৎ বরেণ্য কবি এই উক্তি করেছিলেন যে, ইজ্জত ও সম্মানের সাথে জাহান্নাম চলে যাওয়াও উত্তম বৈকি! কেননা আমরা সকলেই জাহান্নামকে ভয় করে থাকি এবং তা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকি। যা হোক আমি আনতারার মনোভাবের এই দিকটি সমর্থন করছি যে, মানুষ তার আত্মমর্যদা ও আত্মসম্মান রক্ষা করার জন্য যে পরীক্ষা নিরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে থাকে-তা তার জন্য কঠিন এবং কঠোর হওয়া সত্ত্বেও সহজ ও সুগম হয়ে যায়।
সরকারের অন্ধ আনুগত্য ও গোলামীর এই পংকিল পরিবেশে আল্লাহ তাঁর পুত-পবিত্র বান্দাদের কাউকেও যদি হেফাজত করেন তাহলে সেটাই চরম সৌভাগ্য।
দুনিয়ার এই ধন-সম্পদ এই আত্মীয় পরিজনের সম্পর্ক
ইখওয়ানুল মুসলিমুনে শামিল হওয়ার প্রারম্ভিক পর্যায়ে যখন আমি সংগঠনের কাজকর্মে কার্যত অংশগ্রহণ করতে শুরু করি তখন আমাকে সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে মাঝে মধ্যে পাঠানো হতো। একবার মানুফিয়া জিলার ছোট্র শহর দামাহওয়াজে দু’টি পরিবারের মধ্যে কোন বিষয়ে ঝগড়া হয়েছিলো। তাদের একটি পরিবারের সম্পর্ক ছিল ইখওয়ানের সাথে। আমি অপর এক ভাই ইজ্জত আবুল মুয়াতির সংগে উক্ত পরিবারের মাঝে আপোষ মীমাংসা করিয়ে দিতে যাই। দু’পক্ষই ঝগড়ার বিশদ বিবরণ এবং তাতে নিজ নিজ ভূমিকার কথা বর্ণনা করলো। যা শুনে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, ইখওয়ানী পরিবারটি ছিল সম্পূর্ণ হকের ওপর, আমি গ্রামবাসীদের সামনে একটা উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করতে চাইলাম। মুর্শিদে আ’ম হাসানুল বান্না শহীদের পক্ষ থেকে ইখওয়ানীদের প্রতি এরূপ নির্দেশনাই ছিল। অতএব সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও আমি ইখওয়ানী পরিবারের কাছে আবেদন জানাই যেন তারা তাদের অধিকার ছেড়ে চলে আসে এবং তাদের বড়রা অন্য পরিবারের কাছে তাদের বাড়ীতে চলে যায়। আর এভবে মানুষের সামনে কুরআন মজীদের আয়াত অনুযায়ী যেন দৃঢ় সংকল্পের নমূনা পেশ করা যায়।
“আর অবশ্য যারা ধৈর্যধারণের নীতি অবলম্বর করলো এবং ক্ষমার আদর্শ স্থাপনের জন্য এগিয়ে এলো নিসন্দেহে তা খুব কঠিন কাজের অন্তর্গত।
এই ঘটনা লক্ষ্য করে গ্রামবাসীগণ অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং তারা জানতে পারে যে, ইসলাম সমস্যার সমাধান কিভাবে করে। এবং ইখওয়ানরা কিরূপ এই মূলনীতির ওপর তৎপর রয়েছে।
ঐ মাসেই আমি কালিয়ুবিয়া নামক শহরে যাই। সেখনে ওয়াফদ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক আলে আলম পাশার বাড়ীতে অনুষ্ঠিত হয়। আমিও ঐ বৈঠকে অংশগ্রহণ করি। একই মাসে মুকাররম আবীদ বার এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই আমলে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কোন রুকনের জন্য কোন রাজনৈতিক দলের মেম্বার হওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
হাসানের উৎসাহ এবং সৌন্দর্য থেকে বঞ্চনা
তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ক্ষমতাশীল দলগুলো শতকার নিরানব্বই ভাগ কিংবা তার চেয়েও বেশী ভোট লাভ করে। এই দৃশ্য দেখে আমার কতগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা মনে পড়ে। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হিটলার শতকরা নিরানব্বই ভাগ ভোট লাভ করেছিলো। কিছু লোক মিসরীয়দের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে থকে যে, তারা ক্ষমতসীনদের ধৃষ্ঠতামূলক আচরণ ও অপতৎপরতার মোকাবিলায় তৎপর হয় না কেন? মিসরীয়দের অপমান ও লাঞ্ছনায় সন্তুষ্ট থাকা জাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এসব লোক জার্মান, ইতা-লিয়ান, স্পেনিশ এবং পর্তুগীজদেরও ভুলে যায় যারা বর্তমানে ইউরোপের জবিন্ত জাতি হিসেবে পরিগণিত কিন্তু নিকট অতীতে তারাও এরূপ অপমান ও লাঞ্ছনার জীবনই অতিবাহিত করেছে। জার্মানীতে হিটলার নিকৃষ্টতম একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল। ইটালী, স্পেন ও পর্তুগালে যথাক্রমে মুসোলিনী, ফ্রা্ম্ক ও সালাজার প্রমুখ আজীবন স্বৈরতান্ত্রিক থাবা বসিয়ে রাখে। এই পুরো সময়ে এই জাতিগুলোর মধ্যে থেকে কোন একটি জাতিও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কেননা অত্যাচার নির্যাতন, গুলি, লাঠি, জেল ও জুলুম ইত্যাদি নিপীড়নমুলক ব্যবস্থা তাদেরকে অসহায় করে রেখেছিল। মিসরীয় জাতি অপমান ও লাঞ্ছনার ওপর কখনো সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। এই জাতি আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এবং স্বাধীনতা প্রিয় জাতি। কিন্তু ক্ষমতাসীন শাসকচক্র কখনো এই জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ দেয়নি। যদি শুধু পাঁচ বছর কালই জাতিকে প্রকৃত আযাদী প্রদান করা হয়। এবং জনসাধারণ মানবীয় সম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে অবগত হতে পারে তাহলে আর করো কোন মায়ের দেশ মাতৃকার ভাগ্য বিড়ম্বিত অধিবাসীরা যেন প্রকৃত আযাদী লাভ করে। প্রতৃক স্বাধীনতা লাভের একটাই মাত্র উপায় রয়েছে। আর তা হচ্ছে ইসলামী শরীয়াতের পূর্ণঙ্গ বাস্তবায়ন।