ইসলামে নারী ও পুরুষের আদর্শ
ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়কেই যেমন সৃষ্টিকুলের মধ্যে বিশেষ সম্মানিত মর্যাদায় ভূষিত করেছে তেমনি নারী ও পুরুষের মধ্যে বিশেষ কতগুলো গুণের বর্তমানতাও ইসলামের দৃষ্টিতে কাম্য। এ গুণগুলোই তাদের পূর্ণ আদর্শবাদী বানিয়ে দেয় এবং এ আদর্শবাদ চিরউজ্জ্বল ও বাস্তবায়িত রাখতে পারলেই ইসলামের দেয়া সে মর্যাদা নারী ও পুরুষ পূর্ণমাত্রায় রক্ষা করতে পারে। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের পারিবারিক জীবনের বিস্তারিত বিধান পেশ করার পূর্বে আমরা এখানে সে বিশেষ গুণাবলী সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করতে চাই। আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
আল্লহার অনুগত পুরুষ ও স্ত্রীলোক, ঈমানদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহর দিকে মনোযোগকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, সত্য ন্যায়বাদী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, সত্যের দৃঢ়তা প্রদর্শনকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহর নিকট বিনীত নম্র পুরুষ ও স্ত্রীলোক, দানশীল পুরুষ ও স্ত্রীলোক, রোযাদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক –আল্লাহ তা’আলা এদের জন্যে স্বীয় ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন। কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার স্ত্রীলোকের জন্যে –আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোনো বিষয়ে চূড়ান্তভাবে ফায়সালা করে দেন, তখন সেই ব্যাপারে তার বিপরীত কিছুর ইখতিয়ার ও স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করার কোনো অধিকার নেই। আর যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে, সে সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে লিপ্ত হয়।
এই দীর্ঘ আয়াত থেকে যে গুণাবলী প্রমাণিত হচ্ছে –সেসব গুণাবলী নর-নারীর মধ্যে বর্তমান থাকলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হতে পারে –তা এখানে খানিকটা ব্যাখ্যাসহ সংখ্যানুক্রমিক উল্লেখ করা যাচ্ছে, যেন পাঠকগণ সহজেই সে গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারেন।
১. মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম স্ত্রীলোক। ‘মুসলিম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পণকারী, আনুগত্য, বাধ্য। আর কুরআনী পরিভাষায় এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণকারী, আল্লাহর অনুগত ও বাধ্য। ব্যবহারিকভাবে আল্লাহর আইন পালনকারী।
২. মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন মঞিলা। ‘মু’মিন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ঈমানদার। ঈমান অর্থ কোনো অদৃশ্য সত্যে বিশ্বাস স্থাপন, আর কুরআনী পরিভাষায় কুরআনের উপস্তাপিত অদৃশ্য বিষয়সমূহকে সত্য বলে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে নেওয়াই হচ্ছে ঈমান। এই অনুযায়ী মু’মিন হচ্ছে সে পুরুষ ও স্ত্রী, যারা কুরআনের উপস্থাপিত অদৃশ্য বিষয়সমূহের প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসী। মুসলিম-এর পরে মু’মিন বলার তাৎপর্য এই যে, দুনিয়ার মানুষকে কেবল আল্লাহর বাহ্যিক আইন পালনকারী হলেই চলবে না, তাকে হতে হবে তাঁর প্রতি মন ও অন্তর দিয়ে ঐকান্তিক বিশ্বাসী।
৩. আল্লাহর দিকে মনোযোগকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক। এর অর্থ সেসব লোক, যারা সর্বপ্রকার মিথ্যাকে পরিহার করে আন্তরিক নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহর হুকুম পালন করে চলে। ফলে তাদের আমলে কোনো প্রকার রিয়াকারী বা দেখানোপনা থাকে না।
৫. সত্যের পথে দৃঢ়তা প্রদর্শনকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক। মূল শব্দ (আরবী*******) সবর। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিজেকে বেঁধে রাখা, ধৈর্য ধারণ করা। এখানে সেসব পুরুষ-স্ত্রীলোককে বোঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর দ্বীন পালন ও তাঁর বন্দেগী অবলম্বন করতে গিয়ে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট অকাতরে সহ্য করে, তার ওপর দৃঢ় হয়ে অচল অটল হয়ে থাকে। শত বাধা-প্রতিকূলতার সঙ্গে মুকাবিলা করেও দ্বীনের ওপর মজবুত থাকে এবং কোনোক্রমেই আদর্শ বিচ্যুত হয় না।
৬. আল্লাহর নিকট বিনীত নম্র পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা অন্তর, মন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব কিছু দিয়ে আল্লাহর বিনীত বন্দেগী করে। মূল শব্দটি হচ্ছে (আরবী**********) ‘খুশূয়ূন’, অর্থ প্রশান্তি, স্থিতি, প্রীতি, শ্রদ্ধা-ভক্তি, বিনয়, ভয়মিশ্রিত ভালোবাসা এবং আল্লাহর প্রতি আগ্রহ-উৎসাহ।
৭. দানশীল পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা গরীব-দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের প্রতি অন্তরে দয়া অনুভব করে উদ্ধৃত্ত মাল ও অর্থ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অভাবগ্রস্ত লোকদের দেয়।
৮. রোযাদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা আল্লাহর হুকুম-মুতাবিক রোযা রাখে, যে রোযার ফল হচ্ছে তাকওয়া পরহেযগারী লাভ এবং যার মাধ্যমে ক্ষুৎপিপাসার জ্বালা ও যন্ত্রণা অনুভব করা যায় প্রত্যক্ষভাবে ও তার জন্যে ধৈর্য ধারনের শক্তি অর্জন করতে পারেন।
৯. লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা নিজেদের লজ্জাস্থান অন্য লোকদের সামনে প্রকাশ করে না –তাতে লজ্জাবোধ করে এবং নিজেদের লিঙ্গস্থানকে হারামভাবে ও হারাম পথে ব্যবহার করেনা। ঢেকে রাখার যোগ্য দেহে –দেহের কোন অঙ্গকে ভিন-পুরুষ-স্ত্রীর সামনে উন্মুক্ত করে না।
১০. আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহকে কস্মিনকালেও এবং মুহুর্তের তরেও ভুলে যায় না, আর মুখ ও কলব ক্ষেত্রেই আল্লাহকে চিরস্মরণীয় রাখে।
এই দশটি মৌলিক গুণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হোক এবং এ গুণধারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হোক, কুরআনের এ ভাষণের মূল লক্ষ্য তাই। এ মৌলিক গুণাবলী নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই কাম্য। কেবল পুরুষদেরই নয়, নারীদেরও এই গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। আর তা হতে পারলেই এই পুরুষ ও নারী সমন্বয়ে গঠিত হবে আদর্ম সমাজ যা কুরআন গড়ে তুলতে চায়।
কুরআনের অপর একটি ছোট্ট আয়াতে বিশেষভাবে মুসলিম মহিলার গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*********************************)
অতএব যারা নেককার স্ত্রীলোক, তারা তাদের স্বামীদের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম পালনকারী এবং স্বামীদের অনুপস্থিতিতে গোপনীয় বা রক্ষণীয় বিষয়গুলোর হেফাযতকারী হয়ে থাকে; কেননা আল্লাহ নিজেই তার হেফাযত করেছেন। (যদি কেউ সে-সবের হেফাযত করতে চায়, তবে তার পক্ষে তা সম্ভব ও সহজ হবে)।
এ আয়াতের তাফসীরে লেখা হয়েছেঃ
(আরবী******************************************************)
অর্থাৎ নারীদের জন্যে কর্তব্য করে দেয়া হয়েছে যে, তারা তাদের স্বামীদের অধিকার রক্ষা করবে এর বিনিময়ে যে, আল্লাহ নিজেই তাদের অধিকার তাদের স্বামীদের ওপর সংস্থাপন ও তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এজন্যেই তিনি স্ত্রীদের প্রতি ন্যায়নীতি ও সুবিচার স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন পুরুষদেরকে। তাদেরকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে বলেছেন এবং আদেশ দিয়েছেন পুরুষদেরকে তাদের মোহরানা আদায় করতে।
ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ নারী
কুরআন মজীদে মহিলাদের দুটি আদর্শ নারীর চরিত্র পেশ করা হয়েছে এবং দুনিয়ার ঈমানদার নারীদেরকে তাদের আদর্শ চরিত্রের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
তার মধ্যে একটি আদর্শ হচ্ছে ফিরাঊনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম। ফিরাঊন ছিল আল্লাহ ও আল্লাহর দ্বীনের প্রকাশ্য দুশমন। কিন্তু তার স্ত্রী ছিলেন আল্লাহ ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি পূর্ণ ও মজবুত ঈমানদার। ফিরাঊনের ন্যায় প্রচণ্ড প্রতাপশালী সম্রাটের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এবং অত্যন্ত কুফরী পরিবেশে থেকেও তিনি আন্তরিক নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহকে ভয় করতেন, তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করে চলতেন। এত বড় সম্রাটের স্ত্রী হওয়াকে তিনি নিজের জন্যে সামান্য গৌরবের বিষয় বলেও মনে করতেন না। বরং রাতদিন আল্লাহর নিকট এই আল্লাহ-বিরোধী সম্রাটের আধিপত্য থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যে কাতর কণ্ঠে দো’আ করতে থাকতেন। ফিরাঊনের নাফরমানীর কারণে গোটা জাতির ওপর আল্লাহর যে গজব ও অভিশাপ বর্ষিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল, তা থেকেও তাঁর নিকট পানাহ চাইতেন। কুরআন মজীদে এই আল্লাহ বিশ্বাসী মহিলাকে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছেঃ
(আরবী**************************************)
আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার লোকদের জন্যে ফিরাঊনের স্ত্রীকে দৃষ্টান্তস্বরূপ পেশ করেছেন। সে (স্ত্রী) দো’আ করলঃ ‘হে আল্লাহ! আমার জন্যে তোমার নিকট জান্নাতে একখানি ঘর নির্মাণ করো এবং ফিরাঊন ও তার কার্যকলাপ থেকে আমাকে মুক্তি দাও, মুক্তি দাও জালিম লোকদের নির্যাতন থেকে’।
এ দৃষ্টান্ত সম্পর্কে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
মু’মিন লোকদের প্রকৃত অবস্থা কি হতে পারে তা দেখার ও তার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা ফিরাঊনের স্ত্রীকে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করেছেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর আনুগত্যে দৃঢ়তা দেখানো, দ্বীন ইসলামকে সর্বাবস্থায় আঁকড়ে ঘরে থাকার এবং কঠোর দুর্বিষহ অবস্থায়ও ধৈর্য ধারণ করার উৎসাহ দান করা হয়েছে এ উপমা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। পরন্তু দেখানো হয়েছে যে, কুফরী শক্তির যতই দাপট ও প্রতাপ হোক, তা ঈমানদার লোকদের একবিন্দু ক্ষতি করতে পারবে না, যেমন ফিরাঊনের মতো একজন বড় কাফেরের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সে তার স্ত্রীর একবিন্দু ক্ষতি করতে পারে নি, বরং তিনি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান সহকারেই নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে চলে যেতে পেরেছেন।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত হচ্ছে, হযরত মরিয়মের চরিত্র। তিনি ছিলেন পবিত্রতা, সতীত্ব এবং আল্লাহ-ভীরুতার জ্বলন্ত প্রতীক। আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
আল্লাহ তা’আলা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইমরান-কন্যা মরিয়মের কথা। সে তার সব শংকাপূর্ণ স্থান (যৌন অঙ্গ) সমূহের পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। তখন আমি (আল্লাহ) তার মধ্যে আমার থেকে রূহ ফুঁকে দিলাম এবং সে তার আল্লাহর সব কথা ও তাঁর কিতাবসমূহের সত্যতা মেনে নিয়েছে। বস্তুত সে ছিল তার আল্লাহর আদেশ পালনকারী বিনয়ী লোকদের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহর হুকুম পালন, বিনয় ও আল্লাহ-ভীরুতার বাস্তব প্রতীক হিসেবে ওপরের আয়াতদ্বয়ের যেমন দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে, অনুরূপভাবে উপদেশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে দুটি খারাপ চরিত্রের নারীর দৃষ্টান্তও উল্লেখ করা হয়েছে অপর আয়াতে। তাদের এক দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে হযরত নূহ ও হযরত লতু নবীর স্ত্রীদ্বয়ের উল্লেখ হয়েছে। দুজনের প্রতিই আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহ ছিল, দুজনকেই আল্লাহর বিধান মুতাবেক জীবন যাপন করতে এবং তাদের স্বামীদ্বয় যে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাতে যদি তারা তাঁদের সাহায্য ও সহযোগিতা করত –সব রকমের দুঃখ-কষ্টে তাঁদের অকৃত্রিম সহচারী ও সঙ্গিনী হত, তাহলে তাদের স্বামীদ্বয়ের মতো আল্লাহর নিকট তাদেরও মর্যাদা হতো। কিন্তু তারাতা করেনি। তারা বরং এ ব্যাপারে নিজ নিজ স্বামীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাদের কাজকে তারা অতি হীন ও নগণ্য মনে করেছে। তাদের দুশমনদের সাথে তারা গোপনে হাত মিলিয়েছে। ফলে নবীদ্বয়ের দুঃখ ও বেদনার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই কারণে জাতির ফাসিক-ফাজির লোকেরা আল্লাহর যে আযাবে নিমজ্জিত হয়েছে, তারাও সেই আযাবে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************)
আল্লাহ কাফেরদের অবস্থা বোঝাবার জন্যে নূহ ও লুতের স্ত্রীদ্বয়ের দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন। এই দুজন মেয়েলোক ছিল আমার দুই নেক বান্দার স্ত্রী। তারা দুজনই নিজ নিজ স্বামীর সাথে খেয়ানতের অপরাধ করেছে। কিন্তু নেক স্বামীদ্বয় তাদের জন্যে আল্লাহর আযাবের মুকাবিলায় কোনো উপকারে আসেনি। বরং তাদে দুজন (স্ত্রীদ্বয়)-কেও আদেশ করা হলোঃ তোমরা অন্যান্যদের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করো।
কুরআন মজীদে এ পর্যায়ে তৃতীয় যে দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো আবূ লাহাবের স্ত্রীর কথা। আবূ লাহাব ছিল ইসলাম-বিরোধী কুফরী আদর্শের একজন বড় নেতা। আর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের সে ছিল অতি বড় দুশমন। তার স্ত্রী ছিল বড় খবীস প্রকৃতির, হীন ও নিকৃষ্ট চরিত্রের এক দুর্দান্ত মেয়েলোক। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে রাসূলে করীম (স)-এর বিরোধিতা করত প্রাণপণে। তাদের এ বিরোধীতা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণের ওপর ভিত্তিশীল ছিল না, ছিল না কোনো নীতির ভিত্তিতে। বরং এ বিরোধিতা ছিল অনেকটা ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও আক্রোশ পর্যায়ে। অপরদিকে আবূ লাহাবের স্ত্রী ছিল অত্যন্ত আধুনিক। তার বিলাস-ব্যসনের জন্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে দেয়ার জন্যে সে স্বামীর ওপর প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করত। আবূ লাহাব নিতান্ত বোকার মতো স্ত্রীর যাবতীয় দাবি-দাওয়া পূরণের জন্যে ন্যায়-অন্যায় নির্বিচারে নানাবিধ উপায় অবলম্বন করত। এতবড় একজন সমাজপতি হওয়া সত্ত্বেও হাজীদের পরিচর্যার জন্যে সংগৃহিত অর্থ বিনষ্ট ও আত্মসাত করত। এমন কি, আল্লাহর ঘরে রক্ষিত স্বর্ণ চুরি করত বলে অনেকেই তার প্রতি সন্দেহ পোষণ করত। তার এসব অসদাচরণের একমাত্র কারণ ছিল তার প্রিয়তমা স্ত্রীর অবাঞ্ছিত বিলাস-ব্যসনের আবদার রক্ষা। এ ধরনের একটি নারী গোটা জাতির পক্ষেও বিপজ্জনক হতে পারে। এ কারণে কুরআন মজীদে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে এ নারীর উল্লেখ করা হয়েছে। আর তার দুষ্কৃতকারী স্বামীর মর্মান্তিক পরিণতির ব্যাপারে তাকেও সমানভাবে অংশীদার বানানো হয়েছে। কুরআনে তার নির্মম পরিণতির যে চিত্র অংকন করা হয়েছে, তা হচ্ছে এমন এক নারী, যে গলায় রশি ঝুলিয়ে বনে-জঙ্গলে কাষ্ঠ আহরণ করে বেড়াচ্ছে এবং সে ইন্ধন সংগ্রহ করে আগুনকে দ্বিগুণভাবে তেজস্বী করে জ্বালিয়েছে। এ আগুনেই জ্বলছে তার নিজের স্বামী। কেননা আবূ লাহাবের জাহান্নামে যাওয়ার যাবতীয় কারণ এ দুনিয়ায় সেই উদ্ভাবন করেছিল। কুরআনে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************)
আবূ লাহাব ধ্বংস হোক, -আর তার সব ক্ষমতা প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হলো সে নিজে ধ্বংস হলো। না তার ধন-সম্পদ তাকে রক্ষা করতে পারল, না তার হারাম-হালাল উপার্জন। সে শীঘ্রই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করবে। তার স্ত্রীও তারই সঙ্গে –যার কাজ ছিল কেবল ইন্ধন সংগ্রহ করা –তার গলদেশে ঝুলতে থাকবে মোটা পাকানো রশি।
অর্থাৎ ঘুষ খেয়ে পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে হরণ করে এবং খেয়ানত করে আব লাহাব যে সব মূল্যবান অলংকার বানিয়ে তার স্ত্রীকে দিত, কিয়ামতের দিন তা-ই তার গলায় বড় বড় রশি হয়ে ঝুলতে থাকবে। বস্তুত মরণকালেও যে পাকানো রশি দ্বারা জালানী কাঠ বেঁধে আনতো তার গলায় ঐ রশির ফাঁস লেগে তার মৃত্যু হয়েছিল।
কুরআন মজীদে উল্লিখিত বিভিন্ন নারীর এ দৃষ্টান্ত দুনিয়ার নারীকুলের জন্যে যেমন বিশেষ অনুসরণীয় ও উপদেশ গ্রহণের স্থল, তেমনি দুনিয়ার স্বামীকুলের জন্যেও এর মধ্যে রয়েছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, রয়েছে উপদেশ গ্রহণের উন্নত শিক্ষা। এ আলোচনার মাধ্যমে কুরআন নারীকুরের সামনে নৈতিকতার একটি মান –একটি নৈতিক লক্ষ্য সংস্থাপন করেছে। যে সব মহিলা দ্বীনদার, কিন্তু স্বামীরা ফাসেক-ফাজের –দ্বীন-ইসলামের বিরোধী কিংবা তার পক্ষে নয়, তাদের জন্যেও যেমন এখানে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে, তেমনি সব কাফের, চরিত্রহীন ও আল্লাহ-দ্রোহী নারীদের জন্যেও এতে রয়েছে নিজেদের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করে কল্যাণের পথ এ দুনিয়ায়ই গ্রহণ করার উপযুক্ত শিক্ষা, যাদের স্বামীরা বড় দ্বীনদার পরহেযগার। দুনিয়ার স্বামীকুল সম্পর্কেও এই একই কথা।
স্বামী যদি বেঈমান হয়, আর স্ত্রী হয় ঈমানদার, আল্লাহভীরু, তাহলে এ কারণেই স্বামীর পক্ষে পরকালীন মুক্তি লাভ সম্ভব হবে না। আর এরূপ অবস্থায়ও যে স্ত্রীলোকদের পক্ষে দ্বীন পালন করা উচিত, স্বামীর অন্যায় কাজের সমর্থন করতে গিয়ে নিজেদেরকেও জাহান্নামী করা স্ত্রীর পক্ষে উচিত কাজ নয়, আর তা যে সম্ভব, তার বাস্তব দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুরআনে উল্লিখিত ফিরাউনের স্ত্রী –আছিয়া।
পক্ষান্তরে বেঈমান স্ত্রীদের স্বামীরা যদি নবীও হয়, তবু কেবলমাত্র এই বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রেহাই দেবেন –এরূপ ধারণা বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়।