পরিবার ও বর্তমান সভ্যতা
বর্তমান পাশ্চাত্য প্রভাবিত সমাজ ও সভ্যতায় নারী ও পুরুষ সম্পর্ক মানবীয় নয়, নিতান্ত পাশবিক। পাশবিক উত্তেজনা ও যৌন-লালসার পরিতৃপ্তিই হচ্ছে তথায় সাধারণ নারী-পুরুষের সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি। এর ফলে বর্তমান সমাজ ও সভ্যতা বিপর্যয় ও ব্যর্থতার সম্মুখীন। অথচ নারী-পুরুষের মিলন ও একাত্মতাকে সভ্যতার অগ্রগতির কারণ ও বাহনরূপে গণ্য করা হয়েছে চিরকাল। সেজন্যই দেখতে পাই, নারী-পুরুষের মিলনে জীবনে যে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ হওয়া বাঞ্ছনীয় বর্তমান মানুষ তা থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত। বর্তমান সভ্যতা পরিবারকে চূর্ণ করে, পরিবারের গুরুত্ব হ্রাস করে দিয়ে তার স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে রাষ্ট্রকে। অথচ পরিবার হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। দ্বিতল বা চারতল প্রাসাদ গড়ে তোলা, -তা নির্মাণ না করেই উপরের তলা নির্মাণের চেষ্টা পাগলামী ছাড়া আর কিছুই নয়। ঠিক তেমনি বর্তমান সভ্যতা সভ্যতার প্রথম স্তর অর্থাৎ পরিবারকে প্রায় অস্বীকার করেই, তার গুরুত্ব হ্রাস করেই গড়ে উঠতে চাচ্ছে। কিন্তু হাওয়ার ওপর যেমন প্রাসাদ গড়া যায় না, তেমনি পরিবারকে ভিত্তি না করে –ভিত্তি হিসেবে পরিবারকে গড়ে না তুলে –সত্যিকারভাবে স্থায়ী কোনো সভ্যতা কিংবা মজবুত কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। সুস্থ চিন্তার অধিকারী প্রত্যেকটি মানুষের নিকট একথা অত্যন্ত প্রকট।
বর্তমানে ব্যক্তির কাছেও পরিবারের গুরুত্ব যেন অনেকখানিই কমে গেছে। পরিবারের প্রতি কোনো আকর্ষণই সে বোধ করে না। স্বামী স্ত্রীর, স্ত্রী স্বামীর, পুত্র পিতার, পিতা পুত্রের, ভাই ভাইয়ের, ভাই বোনের, বোন ভাইয়ের প্রতি কোনো দরদ অনুভব করছে না। কেউ কারোর ধার ধারে না, পরোয়া করে না। অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ফলে সমাজ জীবনের যে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা শুধু সভ্যতাকেই ধ্বংস করছে না, মনুষ্যত্ব ও মানবতাকেও দিচ্ছে প্রচণ্ড আঘাত।
পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক সরোকিন বর্তশান দুনিয়ায় পরিবারের গুরুত্ব কম হওয়ার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে বলেছেনঃ
আমরা বর্তমানে খাবার খাই হোটেল রোঁস্তোরায়, আমাদের রুটি বেকারী-কনফেকশনারী থেকে তৈরী হয়ে আসে আর আমাদের কাপড় ধোয়া হয় লণ্ড্রীতে। পূর্বে মানুষ আনন্দলাভ ও চিত্ত বিনোদনের উদ্দেশ্যে ফিরে যেত পরিবারের নিভৃত আশ্রয়ে; কিন্তু বর্তমানে মানুষ তার জন্যে চলে যায় সিনেমা-থিয়েটার, নাচের আসর ও ক্লাব ঘরের গীতমুখর পরিবেষ্টনীতে। পূর্বে পরিবার ছিল আমাদের আগ্রহ ঔৎসুক্য ও আনন্দ-উৎফুল্লতার কেন্দ্রস্থল, পারিবারিক জীবনেই আমরা সন্ধান করতাম শান্তি, স্বস্তি, তৃপ্তি ও আনন্দের নির্মলতা; কিন্তু এখন পরিবারের লোকজন হয়ে গেছে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত। কিছু লোক একত্রে বাস করলেও তার মূল উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয়ে গেছে, হারিয়ে ফেলেছে সকল প্রীতি, মাধুর্য, অকৃত্রিমতা, আন্তরিকতা ও পবিত্রতা। দিনের বেশির ভাগ সময়ই মানুষ জীবিকার চিন্তায় অতিবাহিত করে, রাত্রিবেলা অন্তত পরিবারের সব লোক একত্রিত হতো। কিন্তু এখন তারা রাত্রি যাপন করে বিচ্ছিন্নভাবে, যার যেখানে ইচ্ছে –সেখানে। এখন আমাদের ঘর আমাদের আরাম বিশ্রামের স্থান নয়, ঘরে রাত্রিদিন অতিবাহিত করার তো এ যুগে কোনো কথাই উঠতে পারে না। একটি গোটা রাত্রি এখন লোকেরা নিজেদের ঘরে যাপন করবে, তা কেউই পছন্দ করে না।
সরোকিনের একথা কেবল পুরুষ ও যুবকদের সম্পর্কেই সত্য নয়, অবিবাহিতা যুবতী ও বিবাহিতা বয়স্কা নারীরাও এক্ষেত্রে কিছুমাত্র কম যায় না।
পরিবার-বিরোধী যুক্তিধারা
যারা পরিবার ও পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব অস্বীকার করে, তারা কিছু কিছু যুক্তিও তার অনুকূলে পেশ করে থাকে। সে যুক্তিগুলো নিম্নরূপঃ
১. মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাই সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই তার স্বাভাবিক দাবি –স্বভাবের প্রবণতা। পরিবারের সুদৃঢ়-সুরক্ষিত পরিবেষ্টনীতে বন্দী করে তার এ আযাদীর অধিকার হরণ করা জুলুম বৈ কিছুই নয়।
২. পরিবার মানুষের স্বভাবের দাবি নয়। পারিবারিক জীবনে স্ত্রীকে পুরুষের অধীন হয়ে প্রায় ক্রীতদাসী হয়ে থাকতে হয়, অথচ স্বাধীনভাবে থাকা তার মানবিক অধিকার। পারিবারিক জীবনে তা নির্মমভাবে হরণ করা হয়। একমাত্র পুরুষই সেখানে উপার্জন করে, স্ত্রীকে তার জীবন-জীবিকার জন্যে পুরুষের মুখাপেক্ষী –তথা গলগ্রহ হয়ে থাকতে হয়।
৩. আগের কালে রাষ্ট্র বর্তমানের ন্যায় সর্বাত্মক ও ব্যাপক ভিত্তিক ছিল না। তখন মানুষের পরিবারের মুখাপেক্ষী ছিল, মানুষের জন্যে তা ছিল প্রয়োজনীয়। এখন রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা থেকেই তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। কাজেই আগের কাছে পরিবারের প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে তা ফুরিয়ে গেছে।
৪. পূর্বে সম্মিলিত পারিবারিক জীবন (Joint family life) থাকার কারণে পিতা-মাতার আত্মীয়-স্বজনের গুরুত্ব অসাধারণ, কিন্তু এখন সে অবস্থা বদলে গেছে। এখন শিশু পালনের জন্যে নার্সারী হোম ও কিন্ডারগার্টেন এবং কর্মক্ষেত্র হচ্ছে কারখারা ও অফিস। কাজেই আজ পারিবারিক সম্বন্ধ অপ্রয়োজনীয়। এবং
৫. বর্তমানে রাষ্ট্র শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্যে যেরূপ সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমর্থ হচ্ছে, পিতা-মাতার পক্ষে তা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই আজ পরিবার ভেঙ্গে গেলে রাষ্ট্র থেকেই সব প্রয়োজন অনায়াসেই পূরণ করা যেতে পারে। এতে মানুষের কোনোরূপ অনিষ্ট হওয়ার আশংকা থাকতে পারে না।
পরিবারের গুরুত্ব অস্বীকার করতে গিয়ে মোটামুটি এই কথাগুলোই বলা হয়ে থাকে। আমাদের পরবর্তী আলোচনা এসব কথারই বিস্তারিত জবাব সম্বলিত। তাতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে যে, এ সব কথা একবারেই মূল্যহীন ও অন্তঃসারশূন্য।