বিয়ে এবং তার গুরুত্ব
ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে বিয়েই হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায়, একমাত্র বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা। বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো ভাবে –অন্য পথে –নারী-পুরুষের মিলন ও সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিয়ে হচ্ছে পুরুষ ও নারীর মাঝে সামাজিক পরিবেশে ও সমর্থনে শরীয়ত মুতাবেক অনুষ্ঠিত এমন এক সম্পর্ক স্থাপন, যার ফলে দুজনের একত্র বসবাস ও পরস্পরে যৌন সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণরূপে বৈধ হয়ে যায়। যার দরুন পরস্পরের ওপর অধিকার আরোপিত হয় এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্য পালনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
(আরবী*******************************************************)
বস্তুত এ বিয়েই হচ্ছে ইসলামী সমাজে পরিবার গঠনের প্রথম প্রস্তর। একজন পুরুষ ও এক বা একাধিক স্ত্রী যখন বিধিসম্মতভাবে বিবাহিত হয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস ও স্থায়ী যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত করে, তখনই একটি পরিবারের ভিত্তি স্থাপিত হয় –হয় পারিবারিক জীবন যাপনের শুভ সূচনা।
কুরআন মজীদে এই বিয়ে ও স্ত্রী গ্রহণের ব্যবস্থাকে নবী ও রাসূলগণের প্রতি আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ দান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ‘আর-রায়াদ’-এ বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************)
হে নবী! তোমার পূর্বেও আমি অনেক নবী-রাসূল পাঠিয়েছি এবং তাদের জন্যে স্ত্রী ও সন্তানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
সূরা আন নূর এ বয়স্ক ছেলেমেয়ে ও দাস-দাসীদের বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্যে আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
(আরবী***********************************************)
এবং বিয়ে দাও তোমাদের এমন সব ছেলে-মেয়েদের, যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই, বিয়ে দাও তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা বিয়ের যোগ্য হয়েছে।
প্রথমোক্ত আয়াতে নবী ও রাসূলগণের জন্যে স্ত্রী গ্রহণ ও সন্তান লাভের সুযোগ করে দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তার মানে, বিয়ে করা ও সন্তান-সন্ততি লাভ করা নবী-রাসূলগণের পক্ষে কোনো অস্বাভাবিক বা অবাঞ্ছনীয় কাজ নয়। কেননা তাঁরাও মানুষ আর মানুষ হওয়ার কারণেই তাঁদের স্ত্রী গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে এবং বিয়ে করলে বা স্ত্রী গ্রহণ করা হলে তাদের সন্তান-সন্ততিও হতে পারে। আবার জাহিলিয়াতের সময়কার লোকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, আল্লাহর নবী বা রাসূল হলে তাঁর আর বিয়ে-শাদী ও সন্তান হওয়া প্রভৃতি ধরনের কোনো বৈষয়িক বা জৈবিক কাজ করা অবাঞ্ছনীয় এবং অন্যায়। এ কারণে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে তারা উপযুক্ত বা সঠিক নবী বলে মানত না। এরই প্রতিবাদ করে আল্লাহ তা’আলা প্রথমোক্ত আয়াতে বলেছেনঃ বিয়ে করা, স্ত্রী গ্রহণ করা, আর সন্তান-সন্ততি হওয়া হযরত মুহাম্মদের বেলায় নতুন কোনো ব্যাপার নয়। তাঁর পূর্বেও বহু নবী ও রাসূল দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের প্রায় সকলেই বিবাহিত ছিলেন, তাঁদের স্ত্রী ছিল আর ছিল সন্তান-সন্ততি –যেমন হযরত মুহাম্মাদের রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিয়ে করা, স্ত্রী গ্রহণ করা ও সন্তান লাভ হওয়ার ব্যবস্থা করা –আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ অনুগ্রহ। আল্লাহ তাঁর নবী ও রাসূলগণের প্রতি এ নেয়ামত দিয়েছিলেন বিপুলভাবে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-ও আল্লাহর এ বিশেষ নেয়ামতের দান থেকে বঞ্চিত থেকে যান নি।
নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
চারটি কাজ নবীগণের সুন্নাতের মধ্যে গণ্য; তা হচ্ছেঃ সুগন্ধি ব্যবহার করা, বিয়ে করা, মিসওয়াক করা এবং খাতনা করানো।
উপরে উদ্ধৃত দ্বিতীয় আয়াতটিতে বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্যে ছেলেমেয়ের অভিভাবক মুরুব্বীদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ আয়াতের আরবী তরজমা আল্লামা জামালুদ্দীন আল-কাশেমীর ভাষায় এরূপঃ
(আরবী****************************************************************************)
তোমাদের স্বাধীন ছেলেমেয়েদের মধ্যে যার যার স্বামী বা স্ত্রী নেই, তাদেরকে বিয়ে দাও। আর তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যেও যাদের বিয়ের যোগ্যতা রয়েছে, তাদেরও বিয়ে দাও।
‘যার স্বামী বা স্তী নেই’ মানে যাকে আদৌ বিয়ে দেয়া হয়নি –যারা কুমার বা কুমারী, তাদের সকলেরই বিয়ের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার মানে, একবারও যাদের বিয়ে হয়নি তাদের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা তো করতেই হবে; তেমনি যাদের একবার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু তালাক কিংবা মৃত্যু যে-কোন কারণে এখন জুড়িহারা তাদেরও বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একবার বিয়ে হলে পরে কোনো কারণে স্বামীহারা বা স্ত্রীহারা হলে পুনরায় তার বিয়ের ব্যবস্থা না করা কিংবা বিয়ে করতে রাজি না হওয়া আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী। আমাদের সমাজে এরূপ প্রায়ই দেখা যায় যে, কোনো মেয়ে হয়ত একবার স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছে অথবা স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা হয়ে গিয়েছে, অনুরূপভাবে কোনো ছেলের স্ত্রী মরে গেছে কিংবা তালাক দিতে বাধ্য হয়েছে, এরূপ অবস্থায় তারা পূনর্বিবাহে প্রস্তুত হয় না। সমাজের শালীনতা ও পবিত্রতা এবং মানুষের জৈব প্রবণতা ও ভাবধারার দৃষ্টিতে এরূপ কাজ কল্যাণকর হতে পারে না।
মোটকথা, বিয়ের যোগ্য হয়েও কেউ যাতে অবিবাহিত ও অকৃতদায় হয়ে থাকতে না পারে, তার ব্যবস্থা করাই ইসলামের লক্ষ্য। কেননা অকৃতদার জীবন কখনই পবিত্র ও পরিতৃপ্ত জীবন হতে পারে না। অবশ্য যে লোক বিয়ে করতে সমর্থ নয়, তার কথা স্বতন্ত্র।
একবার কিছু সংখ্যক সাহাবী সারা রাতদিন ধরে ইবাদত করার, সারা রাত জেগে থেকে নামায পড়ার, সারা বছর ধরে রোযা রাখার এবং বিয়ে না করার সংকল্প গ্রহণ করেন। নবী করীম (স) এসব কথা শুনতে পেয়ে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং রাগত স্বরে বলেনঃ
(আরবী**************************************************************)
তোমরাই কি এ ধরনের কথাবার্তা বলনি? আল্লাহর শপথ, একি সত্যি নয় যে, আমিই তোমাদের তুলনায় আল্লাহকে বেশি ভয় করি, আমিই তোমাদের চেয়ে বেশি আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকি? …..কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি রোযা থাকি, রোযা ভঙ্গও করি, নামায পড়ি, শুয়ে নিদ্রাও যাই এবং রমণীদের পানিও গ্রহণ করি। এই হচ্ছে আমার নীতি-আদর্শ; অতএব যে লোক আমার এই নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়। (বুখারী, মুসলিম)
এ হাদসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ে করা নবীর সুন্নাত বিশেষ। মনীষী মহলাব বলেছেনঃ বিয়ে ইসলামের অন্যতম রীতি ও বিধান। আর ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোনো অবকাশ নেই। যে লোক রাসূলের সুন্নাতের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাসের কারণে বিয়ে পরিত্যাগ করবে, সে অবশ্যই ভৎসনার যোগ্য বিদয়াতী। তবে যদি কেউ এজন্যেবিয়ে না করে যে, তাহলে তার নিরিবিলি জীবন ইবাদতে কাটিয়ে দেয়া সহজ হবে, তবে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। ইমাম দায়ূদ জাহেরী এবং তার অনুসারীদের মতে বিয়ে করা ওয়াজিব।
রাসূলের বাণী ‘সে আমার উম্মতের মধ্যেই গণ্য নয়’-এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে এই যে, যে লোক রাসূলের আদর্শের অনুসরণ না করবে, সে ইসলামেরসহজ ঋজু ও একনিষ্ঠ পথের পথিক হতে পারে না, বরং রাসূলের আদর্শ অনুসরণ না করবে, সে ইসলামে সহজ ঋজু ও একনিষ্ঠ পথের পথিক হতে পারে না, বরং রাসূলের আদর্শের সত্যিকার অনুসারী হবে সে ব্যক্তিঃ
(আরবী***************************************************)
যে লোক নির্দিষ্টভাবে ইফতার করবে (রোযা ভঙ্গ করবে) রোযা পালনের সামর্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে, নিদ্রা যাবে রাতে ইবাদতের জন্যে দাঁড়াবার শক্তি লাভের উদ্দেশ্যে এবং বিয়ে করবে দৃষ্টি ও যৌন-অঙ্গকে কলুষমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে।
প্রসঙ্গত বলা যায়, যদি কেউ রাসূলের এ আদর্শের বিরোধিতা করে এই ভেবে যে, রাসূলের আদর্শ অপেক্ষা অন্য আদর্শ উত্তম ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য, তাহলে রাসূলের এ বাক্যাংশের অর্থ হবেঃ
(আরবী**********************************************************_
সে আমার মিল্লাত ও জাতির মধ্যে গণ্য নয়।
অন্য কথায় সে পূর্ণ অর্থে মুসলিম নয়। কেননা এরূপ ধারণা পোষণ করা সুস্পষ্ট কুফরী।
হযরত আনাস (রা) বলেনঃ
(আরবী*****************************************************)
নবী করীম (স) আমাদেরকে বিয়ে করতে আদেশ করতেন, আর অবিবাহি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করা থেকে খুব কঠোর ভাষায় নিষেধ করতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) নবী করীমের নিম্নোক্ত বাণী বর্ণনা করেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
কুমারিত্ব ও অবিবাহিত নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের কোনো নিয়ম ইসলামে নেই।
নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
যে লোক য়ে করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়।
‘ইবনে মাজাহ’ কিতাবে হযরত আয়েশা (রা) থেকে রাসূলেরর নিম্নোক্ত বাণী বর্ণিত হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************************)
রাসূলে করীম (স) বলেছেন, বিয়ে করা আমার আদর্শ ও স্থায়ী নীতি, যে লোক আমার এ সুন্নাত অনুযায়ী আমল করবে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।
বস্তুত বিয়ে স্বভাবের দাবি, মানব প্রকৃতির নিহিত প্রবণতার স্বাভাবিক প্রকাশ, মানব সমাজের দৃষ্টিতেও অত্যন্ত জরুরী। এজন্যে রাসূলে করীম (স) সমাজের যুবক-যুবতীদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিয়ে করা কর্তব্য। কেননা বিয়ে দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণকারী, যৌন অঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন রোযা রাখে, যেহেতু রোযা হবে তার ঢাল স্বরূপ।
ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব যে কতখানি, তা উপরিউক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মে ও সমাজে বিয়ের তেমন কোনো গুরুত্ব স্বীকার করা হয়নি। বর্তমানে প্রাচীন কালের মানব সমাজের যে ইতিহাস প্রচলিত রয়েছে –আমার মতে তার প্রায় সম্পূর্ণটাই কল্পিত। তাতে ধারণা দেয়া হয়েছে যে, আদিম সমাজে বিয়ের প্রচলন ছিল না, বিয়ে হচ্ছে পরবর্তীকালের বিকাশমান সভ্যতার অবদান। খ্রিষ্টধর্মে বিয়েকে একভাবে নিষেধই করে দেয়া হয়েছিল। ক্রীনথিওনের নামে লিখিত চিঠিতে উল্লিখিত রয়েছেঃ
আমি অবিবাহিত ও বিধবাদের সম্বন্ধে মনে রি যে, তাদের এরকমই থাকা উচিত। কিন্তু যদি সংযম রক্ষা করতে না পারে, তবেই বিয়ে করবে।
উক্ত চিঠির অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
তোমার স্ত্রী না থাকলে তুমি স্ত্রীর সন্ধান করো না। আর যদি বিয়ে করই তবু তাতে গুনাহ নেই।
মার্টিন লূথার সর্বপ্রথম বিয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁর দৃষ্টিতে বিয়ে হচ্ছে সম্পূর্ণ দুনিয়াদারীর কাজ। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের নেতৃস্থানীয় লোকেরাও একে ধর্ম সম্পর্কহীন একটি কাজ মনে করতেন। বিয়ের স্বপক্ষে তারা কোন স্পষ্ট রায় দেন নি। কিন্তু বিয়ে করা যে মানুষের –স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েরই –স্বভাবের এক প্রচণ্ড ও অনমনীয় দাবি, তা দুনিয়ার সব বিজ্ঞানীই স্বীকার করেছেন। গ্রীক-বিজ্ঞানী জালিনুস বলেছেনঃ
প্রজনন ক্ষমতার ওপর আগুন ও বায়ুর প্রভাব রয়েছে, তার স্বভাব উষ্ণ ও সিক্ত। এর অধিকাংই যদি অবরুদ্ধ হয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত অবরুদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে নানা ধরনের মারাত্মক রোগ জান্মিতে পারে। কখনো মনে ভীতি ও সন্ত্রাসের ভাব সৃষ্টি হয়, কখনো হয় পাগলামীর রোগ। আবার মৃগী রোগও হতে পারে। তবে প্রজনন ক্ষমতার সুস্থ বহিষ্কৃতি ভালো স্বাস্থ্যের কারণ নয়। বহু প্রকারের রোগ থেকেও সে সুরক্ষিত থাকতে পারে।
প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদ আল্লামা নফীসী বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
শুক্র প্রবল হয়ে পড়লে অনেক সময় তা অত্যন্ত বিষাক্ত প্রকৃতি ধারণ করে বসে। দিল ও মগজের দিকে তা এক প্রকার অত্যন্ত খারাপ বিষাক্ত বাষ্প উত্থিত করে দেয়, যার ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়া বা মৃগী রোগ প্রভৃতি ধরনের ব্যাধির সৃষ্টি হয়।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ দিহলভী বিয়ে না করার অনিষ্টাকারিতা সম্পর্কে লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
জেনে রাখো, শুক্রের প্রজনন ক্ষমতা যখন দেহে খুব বেশী হয়ে যায়, তখন তা বের হতে না পারলে মগজে তার বাষ্প উত্থিত হয়।
কিন্তু বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা বিয়ের গুরুত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে। পারিবারিক জীবনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। পাশ্চাত্য মনীষীদের বিচারে ইউরোপীয় সমাজে বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের ব্যর্থতার কতগুলো কারণ রয়েছে। কারণগুলোকে নিম্নোক্তভাবে আট-নয়টি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারেঃ
১. বিয়ে এবং পারিবারিক জীবন সম্পর্কে খ্রিষ্টধর্মের অননুকূল দৃষ্টিভঙ্গি;
২. আধুনিক সভ্যতার চোখ জলসানো চাকচিক্য ও ব্যাপক কৃত্রিমতা;
৩. শিল্প বিপ্লবোত্তর নারী স্বাধীনতার আন্দোলন;
৪. নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে ভুল ধারণা;
৫. নারী-পুরুষের সাম্য ও সমানাধিকারের অবৈজ্ঞানিক দাবি;
৬. স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ববোধ না থাকা;
৭. পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ভাবধারা এবং নৈতিকতা ও মানবিকতা ও মানবিকতার পতন;
৮. পারিবারিক জীবনে সুষ্ঠুতা, সুস্থতা ও সফলতা লাভের জন্যে অপরিহার্য নিয়ম বিধানের অভাব; এবং
৯. সাধারণভাবে জনগণের ধর্মবিমুখতা, ধর্মহীনতা ও ধর্মদ্রোহিতা।
পরিবার ও পারিবারিক জীবনে আধুনিক ইউরোপে যে ব্যর্থতা এসেছে, তার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের আলোচনার দৃষ্টিতেই এখানে উল্লেখ করা হলো। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের বিধান এই গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে। তার ফলে উভয় সমাজ ব্যবস্থা ও আদর্শের মৌলিক পার্থক্য যেমন সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে, তেমনি বিশ্বমানবতার পক্ষে কোন ব্যবস্থাটি কল্যাণময় –মানবোপযোগী, তাও প্রতিভাত হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে ও পরিবার সম্পূর্ণরূপে একটি দেওয়ানী চুক্তির ফল। নারীর নিজেকে বিয়ের জন্যে উপস্থিত করা এবং পুরুষের তা গ্রহণ করা –এই ‘ঈজাব’ ও ‘কবুল’ দ্বারাই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এরই ফলে স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কতগুলো অধিকার নির্দিষ্ট হয়। দু’হাজার বছরের ধারাবাহিক ও ক্রমাগত চেষ্টা সাধনা সত্ত্বেও ইউরোপীয় সমাজ বিয়ে ও পরিবারকে অতখানি স্থান ও মর্যাদা দিতে পারেনি, যতখানি চৌদ্দশ বছর আগে ইসলাম দিয়েছে।
বিয়ের উদ্দেশ্য
বিয়ে এবং বিবাহিত জীবন যাপনের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। দুনিয়ার কোনো কাজই সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া সম্পাদিত হয় নি। কুরআন মজীদে বিয়ের উদ্দেশ্যের কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। কুরআনের এতদসম্পর্কিত আয়াতসমূহকে সামনে রেখে চিন্তা করলে পরিস্কার মনে হয়, কুরআনের দৃষ্টিতে বিয়ের উদ্দেশ্য নানাবিধ। এর একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাশী নৈতিক চরিত্র, পবিত্র পরিচ্ছন্ন ও কলুষমুক্ত রাখতে পারা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে মনের গভীর প্রশান্তি ও স্থিতি লাভ এবং তৃতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে পারিবারিক জীবন যাপন করে সন্তান জন্মদান, সন্তান লালন-পালন ও ভবিষ্যত সমাজের মানুষ গড়ে তোলা। নিম্নোক্ত কুরআন ভিত্তিক আলোচনা থেকে এসব উদ্দেশ্যের কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
সূরা আন-নিসা’র এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************************)
এই মুহাররম মেয়েলোক ছাড়া অন্য সব মেয়েলোক বিয়ে করা তোমাদের জন্যে জায়েয –হালাল করে দেয়া হয়েছে এই উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তোমাদের ধন-মালের বিনিময়ে তাদের লাভ করতে চাইবে নিজেদের চরিত্র দুর্জয় দুর্গের মতো সুরক্ষিত রেখে এবং বন্ধনহীন অবাধ যৌন চর্চা করা থেকে বিরত থেকে।
এ আয়াত থেকে প্রথম জানা গেল যে, নির্দিষ্ট কতকজন মেয়েলোক বিয়ে করা ও তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হারাম। সেই হারাম বা মুহাররম মেয়েলোক কয়জন ছাড়া আর সব মেয়েলোকই বিয়ে করা পুরুষের জন্যে হালাল। দ্বিতীয়ত এসব হালাল মেয়েলোক তোমরা গ্রহণ করবে ‘মোহরানা’ স্বরূপ দেয়া অর্থের বিনিময়ে বিয়ে করে। তৃতীয়ত মোহরানা ভিত্তিক বিয়ে ছাড়া অন্য কোনোভাবে এই হালাল মেয়েদের সাথেও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারা যায় না এবং পঞ্চমত এভাবে বিয়ে করে নৈতিক চরিত্রের এক দুর্জয় দুর্গ –পরিবার-রচনা করা যায় এবং অবাধ যৌন চর্চার মতো চরিত্রহীনতার কাজ থেকে নিজকে বাঁচানো যায়। আর বিয়ের উদ্দেশ্যও এই যে, তার সাহায্যে স্বামী-স্ত্রীর নৈতিক চরিত্রের দুর্গকে দুর্জয় করতে হবে এবং অবাধ যৌন চর্চা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে।
সূরা আন-নিসা’র অপর এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************)
তোমরা মেয়েদের অভিভাবক মুরুব্বীদের অনুমতিক্রমে তাদের বিয়ে করো, অবশ্য অবশ্যই তাদের দেন-মোহর দাও, যেন তারা তোমাদের বিয়ের দুর্গে সুরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে এবং অবাধ যৌন চর্চায় লিপ্ত হয়ে না পড়ে। আর গোপন বন্ধুত্বের যৌন উচ্ছৃংখলতায় নিপতিত না হয়।
এ আয়াত যদিও ক্রীতদাসদাসীদেরকে বিয়ে দেয়া সম্পর্কে, কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে এ আয়াত থেকে বিয়ের উদ্দেশ্য জানা যায়। আর তা হচ্ছে, বিয়ে করে পরিবার-দুর্গ রচনা করা, জ্বেনা-ব্যভিচার বন্ধ করা, গোপন বন্ধুত্ব করে যৌন স্বাদ আস্বাদন করার সমস্ত পথ বন্ধ করা। আর এসব কেবল বিয়ে করে পারিবারিক জীবন যাপনের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। পূর্বোক্ত আয়াতে পুরুষদের নৈতিক পবিত্রতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে আর এ আয়াতে সাধারণভাবে সকল শ্রেণীর মেয়েদের নৈতিক চরিত্র রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে এবং দুটো আয়াতেই পরিবারের দুর্জয় দুর্গ রচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইমাম রাগেব লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
বিয়েকে দুর্গ বলা হয়েছে, কেননা তা স্বামী-স্ত্রীকে সকল প্রকার লজ্জাজনক কুশ্রী কাজ থেকে দুর্গবাসীদের মতোই বাঁচিয়ে রাখে।
নারী-পুরুষ কেবলমাত্র বিয়ের মাধ্যমেই পরস্পর মিলিত হবে। তাহলেই উভয়ের চরিত্র ও সতীত্ব পূর্ণ মাত্রায় রক্ষা পাবে। এ দুটো আয়াতেই বিয়েকে (আরবী******) ‘দুর্গ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। দুর্গ যেমন মানুষের আশ্রয়স্থল, শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা, বিয়ের ফলে রচিত পরিবারও তেমনি স্বামী-স্ত্রীর নৈতিক চরিত্রের পক্ষে একমাত্র রক্ষাকবচ। মানুষ বিবাহিত হলেই তার চরিত্র ও সতীত্ব রক্ষা পেতে পারে –অবশ্য যদি সে পরিবার সুরক্ষিত দুর্গের মতোই দুর্ভেদ্য ও রুদ্ধদ্বার হয়। মোটকথা, নৈতিক চরিত্র সংরক্ষণ ও পবিত্রতা –সতীত্বের হেফাযত হচ্ছে বিয়ের অন্যতম মহান উদ্দেশ্য।
নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*****************************************************)
যে লোক কিয়ামতের দিন পাক-পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন চরিত্র নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবার বাসনা রাখে, তার কর্তব্য হচ্ছে (স্বাধীন মহিলা) বিয়ে করা।
অর্থাৎ বিয়ে হচ্ছে চরিত্রকে পবিত্র রাখার একমাত্র উপায়। বিয়ে না করলে চরিত্র নষ্ট হওয়ার আশংকা প্রবল হয়ে থাকে। মানুষ আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমা লংঘন করে পাপের পংকিল আবর্তে পড়ে যেতে পারে যেকোনো দুর্বল মুহুর্তে।
বাস্তবিকই যে লোক তার নৈতিক চরিত্রকে পবিত্র রাখতে ইচ্ছুক, বিয়ে করা ছাড়া তার কোনোই উপায় নেই। কেননা এই উদ্দেশ্যে বিয়ে করলে সে এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহায্য লাভ করতে পারবে। নিম্নোক্ত হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত হয়। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
তিন ব্যক্তির সাহায্য করা আল্লাহর কর্তব্য হয়ে পড়ে। তারা হলোঃ
১. যে দাস নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে চায় (আজকাল বলা যায়, কোনো ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তার ঋণ আদায় করতে দৃঢ়সংকল্প);
২. যেলোক বিয়ে করে নিজের নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করতে চায়; আর
৩. যে লোক আল্লাহর পথে জিহাদে আত্মসমর্পিত।
বস্তুত নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করা কিছুমাত্র সহজসাধ্য কাজ নয়। বরং এ হচ্ছে অত্যন্ত কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেননা এজন্যে প্রকৃতি নিহিত দুষ্প্রবৃত্তিকে –যৌন লালসা শক্তিকে –দমন করতে হবে। আর এ যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সে লোক পাশবিকতার নিম্নতম পঙ্কে নেমে যাবে। কাজেই যদি কেউ এ থেকে বাঁচতে চায়, আর এ বাঁচার উদ্দেশ্যেই যদি বিয়ে করে –স্ত্রী গ্রহণ করে, তবে আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা সে অবশ্যই লাভ করবে। আর আল্লাহর এই সাহায্যেই সে লোক বিয়ের মাধ্যমে স্বীয় নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করতে সফলকাম হবে।
কেবলমাত্র বিয়ের মাধ্যমেই যে সতীত্ব ও নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করা যেতে পারে, কুরআন মজীদে তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************************)
স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোশাক স্বরূপ, আর তোমরা হচ্ছ তাদের জন্যে পোশাকবৎ।
অর্থাৎ পোশাক যেম করে মানবদেহকে আবৃত করে দেয়, তার নগ্নতা ও কুশ্রীতা প্রকাশ হতে দেয় না এবং সব রকমের ক্ষতি-অপকারিতা থেকে বাঁচায়, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্যে ঠিক তেমনি। কুরআন মজীদেই পোশাকের প্রকৃতি বলে দেয়া হয়েছে এ ভাষায়ঃ
(আরবী********************************************************)
নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের জন্যে পোশাক নাযিল করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থানকে ঢেকে রাখে।
পূর্বোক্ত আয়াতে স্বামীকে স্ত্রীর জন্যে পোশাক বলা হয়েছে। কেননা তারা দুজনই দুজনের সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি ঢাকবার ও যৌন-উত্তেজনার পরিতৃপ্তি সাধনের বাহন। ইমাম রাগেব লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
পোশাক বলতে স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে (আর স্বামীর পক্ষে স্ত্রীকে) মনে করা হয়েছে। কেননা এ স্বামী ও স্ত্রী একদিকে নিজে নিজের জন্যে পোশাকবৎ আবার প্রত্যেকে অপরের জন্যেও তাই। এরা কেউই কারো দোষ জাহির হতে দেয় না –যেমন করে পোশাক লজ্জাস্থানকে প্রকাশ হতে দেয় না।
বিয়ের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী-পুরুষের হৃদয়াভ্যন্তরস্থ স্বাভাবিক প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসারদাবি পূরণ এবং যৌন উত্তেজনার পরিতৃপ্তি ও স্তিতি বিধান। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************************)
এবং আল্লাহর একটি বড় নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে জুড়ি গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যেন তোমরা সে জুড়ির কাছ থেকে পরম পরিতৃপ্তি লাভ করতে পার। আর তোমাদের মধ্যে তিনি প্রেম-ভালোবাসা ও দরদ-মায়া ও প্রীতি-প্রণয় সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
‘তোমাদেরই মধ্য থেকে’ অর্থঃ
(আরবী**********************************************)
তোমাদেরই স্বজাতির মধ্য থেকে; অপর জাতির লোককে নয়।
অর্থাৎ মানব-মানবীরজুড়ি মানব-মানবীকে বানাবার নিয়ম করে দেয়া হয়েছে। নিম্নস্তরের বা উচ্চস্তরের অপর কোনো জাতির মধ্য থেকে জুড়ি গ্রহণের নিয়ম করা হয়নি।
এ আয়াতে জুড়ি গ্রহণের বা বিয়ে করার উদ্দেশ্যস্বরূপ বলা হয়েছেঃ যেন তোমরা সে জুড়ির কাছ থেকে পরম পরিতৃপ্তি ও গভীর শান্তি-স্বস্তি লাভ করতে পার। তার মানে, স্বামী-স্ত্রীর মনের গভীল পরিতৃপ্তি –শান্তি স্বস্তি লাভ হচ্ছে বিয়ের উদ্দেশ্য। আর এ বিয়ের মাধ্যমেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্ব-ভালোবাসা জন্ম নিতে পেরেছে। আয়াতের শেষাংশের ব্যাখ্যা করে ইমাম আলূসী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
অর্থাৎ তোমাদের জন্যে আল্লাহ তা’আলা শরীয়তের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা –বিয়ের মাধ্যমে তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্ব-প্রেম-প্রণয় এবং মায়া-মমতা দরদ-সহানুভূতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন, অথচ পূর্বে তোমাদের মাঝে না ছিল তেমন কোন পরিচয়, না নিকটাত্মীয় বা রক্ত-সম্পর্কের কারণে মনের কোনোরূপ সুদৃঢ় সম্পর্ক।
হযরত হাওয়া ও হযরত আদমের প্রথম সাক্ষাত হয়, তখন হযরত আদম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী*****) ‘তুমি কে?’ তিনি বললেনঃ
(আরবী**********************************************************)
আমি হাওয়া, আমাকে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন এ উদ্দেশ্যে যে, তুমি আমার নিকট পরিতৃপ্তি ও শান্তি লাভ করবে। আর আমি পরিতৃপ্তি ও শান্তি লাভ করব তোমার কাছ থেকে।
অতএব এ থেকে আল্লাহর বিরাট সৃষ্টি ক্ষমতা ও অপরিসীম দয়া-অনুগ্রহের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। সূরা আল আ’রাফ-এর নিম্নোক্ত আয়াতেও এ কথাই বলা হয়েছে গোটা মানব জাতি সম্পর্কেঃ
(আরবী*******************************************************************)
সেই আল্লাহই তোমাদেকে সৃষ্টি করেছেন একটিমাত্র মানবাত্মা থেকে এবং তার থেকেই বানিয়েছেন তার জুড়ি, যেন সে তার কাছে পরম সান্ত্বনা ও তৃপ্তি লাভ করতে পারে।
এখানে পরম শান্তি ও তৃপ্তি বলতে মনের শান্তি ও যৌন উত্তেজনার পরিতৃপ্তি ও চরিতার্থতা বোঝানো হয়েছে। বস্তুত মনের মিল, জুড়ির প্রতি মনের দুর্নিবার আকর্ষণ এবং যৌন তৃপ্তি হচ্ছে সমগ্র জীবন ও মনের প্রকৃত সুখ ও প্রশান্তি লাভের মূল কারণ। তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মানে চরম অতৃপ্তি ও অশান্তির ভিতরে জীবন কাটিয়ে দেয়া। মনের প্রশান্তি ও যৌন তৃপ্তি যে বাস্তবিকই আল্লাহর এক বিশেষ দান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এজন্যে ঈমানদার স্ত্রী-পুরুষের কর্তব্য হচ্ছে এ প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তিকে আল্লাহর সন্তোষ এবং তাঁরই দেয়া বিধান অনুসারে লাভ করতে চেষ্টা করা। এ আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা মানব জাতির সৃষ্টি ও প্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, এই দুনিয়ায় মানুষের সৃষ্টি ও অস্তিত্ব যেমন এক স্বাভাবিক ব্যাপার, জুড়ি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও তেমনি এক প্রকৃতিগত সত্য, এ সত্যকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না। এজন্যে প্রথম মানুষ সৃষ্টি করার পরই তার থেকে তার জুড়ি বানিয়েছেন। এ জুড়ি যদি বানানো না হতো, তাহলে প্রথম মানুষের জীবন অতৃপ্তি আর একাকীত্বের অশান্তিতে দুঃসহ হয়ে উঠত। আদিম মানুষের জীবনে জুড়ি গ্রহনের এ আবশ্যকতা আজও ফুরিয়ে যায় নি। প্রথম মানুষ যুগলের ন্যায় আজিকার মানব-দম্পতিও স্বাভাবিকভাবে পরস্পরের মুখাপেক্ষী। আজিকার স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছ থেকে লাভ করে মনের প্রশান্তি ও যৌন তৃপ্তি, পায় কর্মের প্রেরণা। একজনের মনের অস্থিরতা ও উদ্বেগ ভারাক্রান্ততা অপরজনের নির্মল প্রেম-ভালবাসার বন্যাস্রোতে নিঃশেষ ধুয়ে মুছে যায়। একজনের নিজস্ব বিপদ-দুঃখও অন্যজনের নিকট নিজেরই দুঃখ ও বিপদরূপে গণ্য ও গৃহীত হয়। একজনের যৌন লালসা-কামনা উত্তেজনা অপরজনের সাহায্যে পায় পরম তৃপ্তি, চরিতার্থতা ও স্থিতি।
এসব কথা থেকে প্রমাণিত হলো যে, মানুষের –সে স্ত্রী হোক কি পুরুষ –যৌন উত্তেজনা পরিতৃপ্তি লাভ এবং তার উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতিবিধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে জুড়ি গ্রহণ বা বিয়ে ও বিবাহিত জীবন। যৌন উত্তেজনা মানুষকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট করে। এই সময় পুরুষ নারীর দিকে এবং নারী পুরুসের দিকে স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকে পড়ে। তখন একজন অপরজনের নিকট স্বীয় স্বাভাবিক শক্তি ও বৈশিষ্ট্যের দরুন মনোবাঞ্ছা পূরনের নিয়ামত হয়ে থাকে। এজন্যে রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিয়েছেন যে, এরূপ অবস্থায় পুরুষ যেন স্বীয় (বিবাহিতা) স্ত্রীর কাছে চলে যায়।
তিনি বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
কোনো নারী যখন তোমাদের কারো মনে লালসা জাগিয়ে দেয়, তখন সে যেন তার নিজের স্ত্রীর কাছে চলে যায় এবং তার সাথে মিলিত হয়ে স্বীয় উত্তেজনার উপশম করে নেয়। এর ফলে সে তার মনের আবেগের সান্ত্বনা লাভ করতে পারবে এবং মনের সব অস্থিরতা ও উদ্বেগ মিলিয়ে যাবে।
ইমাম নববী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************)
যে লোক কোনো মেয়েলোক দেখবে এবং তার ফলে তার যৌন প্রবৃত্তি উত্তেজিত হয়ে উঠবে, সে যেন তার স্ত্রীর কাছে আসে এবং তার সঙ্গে মিলিত হয়। এর ফলে তার যৌন উত্তেজনা সান্ত্বনা পাবে, মনে পরম প্রশান্তি লাভ হবে, মন-অন্তর তার বাঞ্ছা ও কামনা লাভ করে এককেন্দ্রীভূত হতে পারবে।
বিয়ে এবং বিবাহিত জীবনের তৃতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তান লাভ।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************)
এখন সময় উপস্থিত, স্ত্রীদের সাথে তোমরা এখন সহবাস করতে পার –তাই তোমরা করো এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা কিছু নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তাই তোমরা সন্ধান করো, তাই লাভ করতে চাও।
এখানে যে (আরবী*****) ‘মুবাশিরাত’-এর অনুমতি দেয়া হয়েছে, তার মানে হচ্ছে (আরবী************************) একজনের শরীরের চামড়ার সাথে অপরজনের দেহের চামড়াকে লাগিয়ে দেয়া, মিশিয়ে দেয়া। আর এর লক্ষ্যগত অর্থ হচ্ছেঃ (আরবী***************) স্ত্রী সহবাস –সঙ্গম, যার জন্যে স্বামীর দেহের চামড়াকে স্ত্রীর দেহের চামড়ার সাথে মিলিয়ে-মিশিয়ে দিতে হয়’। আর ‘আল্লাহ যা তোমাদের জন্যে নির্ধারণ করেছেন’ বলে দুটি কথা বরতে চাওয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে রমযান মাসের রাত্রি বেলায় স্ত্রী-সহবাসের অনুমতি দান। কেননা এ আয়াত সেই প্রসঙ্গেই অবতীর্ণ হয়েছে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে সন্তান লাভ। কেননা স্ত্রী-সহবাবের মূল লক্ষ্য হলো সন্তান তোমার জন্যে নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে, স্ত্রী-সহবাসের মূলে নিছক যৌন উত্তেজনার পরিতৃপ্তি আর লালসার চরিতার্থ তাই কখনো স্ত্রী সহবাসের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। এজন্যে যে ধরনের যৌন-উত্তেজনা পরিতৃপ্তির ফলে সন্তান লাভ হয় না যেমন পুংমৈথুন বা হস্তমৈথুন –তাকে শরীয়তে হারাম করে দেয়া হয়েছে। আর যে ধরনের স্ত্রী-সহবাসের ফলে সন্তান লাভ সম্ভব হয় না কিংবা সন্তান হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কিংবা স্ত্রী-সহবাস হওয়া সত্ত্বেও সন্না হতে পারে না, শরীয়তে তাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এজন্যেই সূরা বাকারার নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***************************************************************)
তোমাদের স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের ক্ষেতস্বরূপ, অতএব তোমরা তোমাদের ক্ষেতে গমন করো –যেভাবে তোমরা চাও –পছন্দ করো।
এ আয়াতে স্ত্রীদেরকে কৃষির ক্ষেত বলা হয়েছে। অতএব স্বামীরা হচ্ছে এ ক্ষেতের চাষী। চাষী যেমন কৃষিক্ষেতে শ্রম করে ও বীজ বপন করে ফসলের আশায়, তেমনি স্বামীদেরও কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রী-সহবাস করে এমনভাবে বীজ বপন করা, যাতে সন্তানের ফসল ফলতে পারে –সন্তান লাভ সম্ভব হতে পারে।
কুরআনের এ দৃষ্টান্তমূলক কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং প্রণিধানযোগ্য। চাষী বিনা উদ্দেশ্যে কখনো কষ্ট স্বীকার করে ও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জমি চাষ করে না, কেবলমাত্র মনের খোশ খেয়ালের বশবর্তী হয়ে কেউ এ কাজে উদ্যোগী হয় না। এ কাজ করে একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে আর তা হচ্ছে ফসল লাভ। কুরআনের ভাষায় স্বামীরাও এমনি উদ্দেশ্যপূর্ণ চাষী –সন্তান ফসলের চাষাবাদকারী। স্ত্রীদের যৌন অঙ্গ হচ্ছে তার কাছে চাসের জমিস্বরূপ আর স্ত্রীর যৌন অঙ্গে শুক্র প্রবেশ করানো হচ্ছে চাষীর জমিতে শস্য বীজ বপন করার মতো। চাষী যেমন এই সমস্ত কাজ ফসলের আমায় করে, স্বামীদেরও উচিত সন্তান লাভের আশায় স্ত্রী-সঙ্গম করা। কেবল যৌন স্পৃহা পরিতৃপ্তির উদ্দেশ্যে এ কাজ হওয়া উচিত নয়। বরং এই সন্তান-ফসল লাভের উদ্দেশ্যেই বিয়ে করতে হবে। স্ত্রী গ্রহণ ও তার সাথে সঙ্গম করতে হবে। অতএব বিয়র একটি চরমতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তান লাভ। এ কথাই আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে আয়াতের পরবর্তী অংশেঃ
(আরবী*****************************************)
এবং তোমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্যে কাজ করো।
অর্থাৎ এ স্ত্রী-সহবাস দ্বারা সন্তান লাভ করার আশা মনে মনে পোষণ করতে থাকো।
এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, স্ত্রীলোক কেবলমাত্র যৌন লালসা পরিতৃপ্তির মাধ্যম বা উপায় নয়, স্ত্রী গ্রহণ ও তার সাথে মিলে পারিবারিক জীবন যাপনের এক মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। আর সে উদ্দেশ্যর মধ্যে সন্তান লাভ –ভবিষ্যৎ মানব বংশকে রক্ষা করা –হচ্ছে অন্যতম। মানব সমাজের কুরআন ভিত্তিক ইতিহাস থেকেই জানা যায়, স্ত্রীলোক গ্রহণ করে বিবাহিত ও পারিবারিক জীবন যাপন করার ফলেই দুনিয়ায় মানব জাতির এই বিপুল বিস্তার সম্ভব হয়েছে। এ কারণেই স্বাভাবিকভাবে রমনীর মনে সন্তান লাভের দুর্বার আকাঙ্খা বিদ্যমান থাকে। এমন কি আজকাল বন্ধ্যা নারীরাও টেষ্ট টিউবের সাহায্যে সন্তান লাভের চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ব্রিস্টলের লেসলী ব্রাউন নামের জনৈক বন্ধ্যা রমণী টেষ্ট টিউবের সাহায্যে দুই বার গর্ভবতী হয়ে দুটি সন্তানের জননী হয়েছে। আর মানব বংশের এই ধারা বৃদ্ধির স্থায়িত্বের জন্যেই বিয়ে করাকে অপরিহার্য কাজ বলে ঘোষিত হয়েছে। বিয়ে ব্যতীত নারী পুরুষের যৌন মিলন নিষিদ্ধ –হারাম করে দেয়া হয়েছে। কেননা তা মানুসের নৈতিক চরিত্রের পক্ষে যেমন মারাত্মক, তেমনি তার ফলে মান বংশের পবিত্রতা রক্ষা ও সুষ্ঠুভাবে ভবিষ্যত সমাজ গঠন বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। ইউরোপে মেয়েদের ‘বয় ফ্রেণ্ড’ ‘ছেলে বন্ধু’ ও ছেলের ‘গার্ল ফ্রেণ্ড’ ‘মেয়ে বান্ধবী’ গ্রহনের এবং রক্ষিতা রাখার অবাধ সুযোগ দিয়ে যেমন সুস্পষ্ট ব্যভিচারের পথ খুলে দেয়া হয়েছে, তেমনি তা ভবিষ্যত বংশের পবিত্রতাকেও বিনষ্ট করে ফেলেছে। এর ফলে সাময়িকভাবে যৌন পরিতৃপ্তি লাভ হতে পারে বটে, কিন্তু একজন নারীর পক্ষে একজন পুরুষের স্থায়ী জীবন সঙ্গীনি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ সম্ভব হয় না, বংশের ধারাও সুষ্ঠুভাবে রক্ষা পেতে পারে না। এর ফলে তাই ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব এত বেশি। ইসলামের বিয়ে হচ্ছে নারী-পুরুসের এক স্থায়ী বন্ধন। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী পুরুষের মিলন এমন কোনো ক্রীড়া নয়, যা দু’দিন খেলা হলো, তারপর যে যার পথে চম্পট দিয়ে চলে গেল। এ জন্যে কুরআনে বিবাহিতা স্ত্রীদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************)
এবং বিবাহিতা স্ত্রীলোকেরা তাদের স্বামীদের নিকট থেকে শক্ত ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে।
ইসলামে বিয়ে এমনি দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই বাস্তব অনুষ্ঠান। এ প্রতিশ্রুতি সহজে ভঙ্গ করা যেতে পারে না।
বিয়ের তাগিদ
ওপরের আলোচনা থেকে একদিকে যেমন বিয়ের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, অপর দিকে ঠিক তেমনি বিয়ের আবশ্যকতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিকোণ উজ্জ্বল ও প্রতিভাত হয়েছে। বস্তুত বিয়ে করা ইসলামে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিয়ের তাগিদও করা হয়েছে কুরআন ও হাদীসে।
বিয়ের তাগিদ সম্পর্কে কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াত আমরা আবার পড়তে পারি। তাতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************)
এবং বিয়ে দাও তোমাদের মধ্যের জুড়িহীন (স্বামী বা স্ত্রীহীন) ছেলে-মেয়েদের আর তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা বিয়ের যোগ্য তাদের।
আয়াতে উদ্ধৃত (আরবী*******) শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************************)
‘আয়ামা’ বলতে বোঝায় এসব মেয়েলোক, যাদের স্বামী নেই এবং সেসব পুরুষকে যাদের স্ত্রী নেই, একবার বিয়ে হওয়ার পর বিচ্ছেদ হওয়ার কারণে এরূপ হোক কিংবা আদৌ বিয়েই না হওয়ার ফলে।
সংশ্লিষ্ট আয়াতাংশের অর্থ করা হয়েছে এ ভাষায়ঃ
(আরবী*****************************************************)
হে মু’মিন লোকেরা! তোমাদের পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের মধ্যে যাদের স্বামী নেই, তাদের বিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা বিয়ের যোগ্য তাদেরও।
ইমাম ইবনে কাসীর এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
এ আয়াতে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়ার আদেশ করা হয়েছে। ইসলামের মনীষীদের মতে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা ওয়াজিব।
এ শ্রেণীর মনীষীরা উপরিউক্ত আয়াতের পরে নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটিও একটি দলীল হিসেবে উল্লেখ করেন। হাদীসটি পূর্বেও উল্লিখিত হয়েছে। রাসূলে করীম (স) যুবক বয়সের লোকদের সম্বোধন করে এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
হে যুবক-যুবতীগণ! তোমাদের মধ্যে যারাই বিয়ের সামর্থ্যবান হবে, তাদেরই বিয়ে করা উচিত। কেননা বিয়ে তাদের চোখ বিনত রাখবে, তাদের যৌন অঙ্গ পবিত্র ও সুরক্ষিত রাখবে। আর যাদের সে সামর্থ্য নেই, তাদের রোযা রাখা কর্তব্য। তাহলে এই রোযা তাদের যৌন উত্তেজনা দমন করবে।
হাদীসে ‘যুবক-যুবতী’ কাদের বোঝানো হয়েছে, তার জবাবে ইমাম নববী লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
আমাদের লোকদের মতে যুবক-যুবতী বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে, যারা বালেগ –পূর্ণ বয়স্ক হয়েছে এবং ত্রিশ বছর বয়স পার হয়ে যায় নি –তাদের।
আর এই যুবক-যুবতীদের বিয়ের জন্যে রাসূলে করীম (স) তাগিদ করলেন কেন, তার কারণ সম্পর্কে বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
হাদীসে কেবলমাত্র যুবক-যুবতীদের বিয়ে করতে বলার কারণ এই যে, বুড়োদের অপেক্ষা এই বয়সের লোকদের মধ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা ও দাবি অনেক বেশি বর্তমান দেখা যায়।
আর
(আরবী************************************************)
যুবক-যুবতীর বিয়ে যৌন সম্ভোগের পক্ষে খুবই স্বাদপূর্ণ হয়, মুখের গন্ধ খুবই মিষ্টিহয়, দাম্পত্য জীবন যাপন সুখকর হয়, পারস্পরিক কথাবার্তা খুব আনন্দদায়ক হয়, দেখতে খুবই সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়, স্পর্শ খুব আরামদায়ক হয় এবং স্বামী বা স্ত্রী তার জুড়ির চরিত্রে এমন কতগুলো গুণ সৃষ্টি করতে পারে, যা খুবই পছন্দনীয় হয় আর এ বয়সের দাম্পত্য ব্যাপারে প্রায়শই গোপন রাখা ভালো রাগে।
যুবক বয়স যেহেতু যৌন সম্ভোগের জন্যে মানুষকে উন্মুখ করে দেয়, এ কারণে তার দৃষ্টি যে কোন মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে এবং সে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতায় পড়ে যেতে পারে। এজন্যে রাসূলে করীম (স) এ বয়সের ছেলেমেয়েকে বিয়ে করতে তাগিদ করেছেন এবং বলেছেনঃ বিয়ে করলে আর চোখ যৌন সুখের সন্ধানে যত্রতত্র ঘুড়ে বেড়াবে না এবং বাহ্যত তার কোন ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকবে না। এ কারণে রাসূলে করীম (স) যদিও কথা শুরু করেছেন যুবক মাত্রকেই সম্বোধন করে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ের এ তাগিদকে নির্দিষ্ট করেছেন কেবল এমন সব যুবক-যুবতীদের জন্যে, যাদের বিয়ের সামর্থ্য রয়েছে। বিয়ের সামর্থ্য মানে রাতিক্রিয়া, যৌন, সম্ভোগ স্ত্রী সঙ্গম। আর যারা যুবক বয়সেও নানা কারণে তার সামর্থ্য রাখে না, যারা রাতিক্রিয়া ও স্ত্রী সঙ্গমেও অক্ষম, তাদেরকে রাসূল (স) বলেছেন রোযা রাখতে। যেনঃ
(আরবী**********************************************)
তার যৌন উত্তেজনা দমিত হয়, দমিত হয় তার বীর্যশক্তির দাপট।
(আরবী**************************************************)
রোযা রাখলে পানাহার কম হয়। আর পানাহারের মাত্রা কম হলে যৌন প্রবৃত্তি দমিত হয়।
উপরিউক্ত হাদীসে যদিও বাহ্যত কোনো যৌন সঙ্গম কার্যে অক্ষম লোকদেরকে রোযা রাখতে বলা হয়েছে; কিন্তু আসল কথা কেবল তাদের সম্পর্কেই নয়; বরং তাদের সম্পর্কেও যারা বিয়ের ব্যায় বহনের সঙ্গতি রাখে না, এ শ্রেণীর লোককেও রোযা রাখতে বলা হয়েছে। এ কথার সমর্থনে অপর দুটো বর্ণনায় উল্লেখ করা যায়।
একটি ইসমাঈলীয় বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************)
তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করতে সমর্থ, তাদের বিয়ে করা উচিত।
আর অপরটিতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************)
যে-ই বিয়ের ব্যয়ভার বহনে সামর্থ্যবান, সে যেন অবশ্যই বিয়ে করে।
ফল কথা, বিয়ে করার ব্যয়ভার বহন এবং যৌন সঙ্গম কার্যে সক্ষম যুবক-যুবতীর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই বিয়ে করা উচিত।
এই প্রসঙ্গে মনীষীগণ নিম্নোক্ত হাদীসটিকেও উল্লেখ করে থাকেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************)
তোমরা সব অধিক সন্তানবতী মেয়েলোকদের বিয়ে করো এবং বংশ বাড়াও; কেননা কিয়ামতের নি আমি তোমাদের সংখ্যা বিপুলতা নিয়ে অপর নবীর উম্মত সংখ্যার মুবাকিলায় গৌরব করব।