পরিবার ও বিশ্বপ্রকৃতি
একজন পুরুষ ও একজন নারী বিবাহিত হয়ে যখন একসঙ্গে জীবন যাপন করতে শুরু করে, তখনি একটি পরিবারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এখানে পুরুষ হয় স্বামী আর নারী হয় স্ত্রী। এ দুয়ের সম্মিলিত ভালোবাসাপূর্ণ যৌন জীবনকেই বলা হয় দাম্পত্য জীবন।
নারী-পুরুষের এ দাম্পত্য জীবনের উদগাতা হলো বিয়ে। এর প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য, নির্দিষ্টভাবে স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তির অবাধ ও নিঃশংক চরিতার্থতা। স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরকি নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ঐকান্তিকতা দাম্পত্য জীবনের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। মনের মিল ও পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি এ বন্ধনকে দুশ্ছেদ্য করে তোলে। এর দ্বিতীয় মহান উদ্দেশ্য হচ্ছে বংশের ধারা অব্যাহত রাখা –উত্তরাধিকারী উৎপাদন। পূর্ব পুরুষের মৃত্যু ও উত্তর পুরুষের মধ্যবর্তীকালে নিজেকে জীবন্ত করে রাখার স্বাভাবিক প্রবণতা মানুষকে এজন্যে সর্বতোভাবে উদ্যোগী ও তৎপর বানিয়ে দেয়। তখন এ হয় এক চিরন্তন সত্য, এক চিরস্থায়ী বংশ-প্রতিষ্ঠান।
বিয়ে ও দাম্পত্য জীবন বিশ্বপ্রকৃতির এক স্বভাবসম্মত বিধান। এ এক চিরন্তন ও শাশ্বত ব্যবস্থা, যা কার্যকর হয়ে রয়েছে বিশ্ব প্রকৃতির পরতে পরতে, প্রত্যেকটি জীব ও বস্তুর মধ্যে! আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে ইরশাদ করেছেনঃ
(আরবী****************************************)
প্রত্যেকটি জিনিসকেই আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি।
বস্তুত সৃষ্ট জীব, জন্তু ও বস্তুনিচয় জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করার তাৎপর্যই এই যে, সৃষ্টির মূল রহস্য দুটো জিনিসের পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকাতেই নিহিত রয়েছে। যখনই এভাবে দুটো জিনিসের মিলন সাধিত হবে, তখনই তা থেকে তৃতীয় এক জিনিসের উদ্ভব হতে পারে। সৃষ্টিলোকের কোনো একটি জিনিসও এ নিয়মের বাইরে নয়, একটি ব্যতিক্রমও কোথাও দেখা যেতে পারে না। তাই কুরআন মজীদে দাবি করে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************)
মহান পবিত্র সেই আল্লাহ, যিনি সৃষ্টিলোকের সমস্ত জোড়া সৃষ্টি করেছেন –উদ্ভিদ ও মানবজাতির মধ্য থেকে এবং এমন সব সৃষ্টি থেকে, যার সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না।
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, ‘বিয়ে’ ও ‘সম্মিলিত জীবন যাপন’ এবং তার ফলে তৃতীয় ফসল উৎপাদন করার ব্যবস্থা কেবল মানুষ, জীব-জন্তু ও উদ্ভিদ গাছপালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এ হচ্ছে গোটা বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্নিহিত এক সূক্ষ্ম ও ব্যাপক ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক জগতের কোনো একটি জিনিসও এ থেকে মুক্ত নয়। গোটা প্রাকৃতিক ব্যবস্থাই এমনিভাবে রচিত যে, এখানে যত্রতত্র যেমন রয়েছে পুরুষ তেমনি রয়েছে স্ত্রী এবং এ দুয়ের মাঝে রয়েছে এক দুর্লংঘ্য ও অনমনীয় আকর্ষণ, যা পরস্পরকে নিজের দিকে প্রতিনিয়ত তীব্রভাবে টানছে। প্রত্যেকটি মানুষ –স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যেও রয়েছে অনুরূপ তীব্র আকর্ষণ এবং এ আকর্ষণই স্ত্রী ও পুরুষকে বাধ্য করে পরস্পরের সাথে মিলিত হতে –সম্মিলিত ও যৌথ জীবন যাপন করতে। মানুষের অন্তর –অভ্যন্তরে যে স্বাভাবিক ব্যাকুলতা, আকুলতা ও সংবেদনশীলতা রয়েছে বিপরীত লিঙ্গের সাথে একান্তভাবে মিলিত হওয়ার জন্যে, তারই পরিতৃপ্তি ও প্রশমন সম্ভবপর হয় এই মধু মিলনের মাধ্যমে। ফলে উভয়ের অন্তরে পরম প্রশান্তি ও গভীর স্বস্তির উদ্রেক হয় অতি স্বাভাবিকভাবে।
মানুষের অন্তর্লোকে যে প্রেম ভালোবাসা প্রীতি ও দয়া-অনুগ্রহ, স্নেহ-বাৎসল্য ও সংবেদনশীলতা স্বাভাবিকভাবেই বিরাজমান, তার কার্যকারিতা ও বাস্তব রূপায়ণ এই বৈবাহিক মিলনের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। এজন্যে হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************)
আল্লাহ বলেছেনঃ আমিই আল্লাহ, আমারই নাম রহমান, অতীব দয়াময়, করুণা নিধান, আমিই ‘রেহেম’ (রক্ত সম্পর্কমূলক আত্মীয়তা) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নিজের নামের মূল শব্দ দিয়েই তার নামকরণ করেছি।
অন্য কথায়, প্রেম-প্রীতি, দয়া-সংবেদনশীলতা ও স্নেহ-বাৎসল্য মানব-প্রকৃতির নিহিত এক চিরন্তন সত্য। আর এ সত্যের মুকুর পুষ্পাকৃতি লাভ করতে পারে না এবং এ পুষ্প উন্মুক্ত উদ্ভাসিত হতে পারে না মানব-মানবীর মিলন ব্যতিরেকে। এ মিলনই সম্ভব হতে পারে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমে।
পরিবারের ইতিবৃত্ত
বস্তুত বিয়ে নারী ও পুরুষের মাঝে এমন এক একত্ব ও একাত্মতা স্থাপন করে, যা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থিত হয়ে থাকে। এ ঐক্য (Unification) ও একাত্মতার ভিত্তি হচ্ছে নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক। বিয়ের মাধ্যমেই নারী পুরুষের মাঝে এ একত্ব ও একাত্মতা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। তখন নারী-পুরুষের মাঝে কেবল দৈহিক মিলনই অনুষ্ঠিত হয় না, মন ও প্রাণেরও গভীর সূক্ষ্ম মিলনসূত্র গ্রথিত হয়। মন, প্রাণ ও দেহ –এ তিনের মিলন ও একাত্মতা ব্যতীত ‘বিবাহ’ কিংবা পারিবারিক জীবন কল্পনাতীত। আর দৈহিক মিলন ব্যতীত মন ও প্রানের একাত্মতা সৃষ্টি হতে পারে না, পারে না তা পূর্ণত্ব লাভ করতে। অন্য কথায় দৈহিক মিলন অর্থ যৌন জীবনের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব। নারী ও পুরুষের যৌন-জীবন নির্ভুল রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী কায়েম না হলে কিংবা এ ব্যাপারে পারস্পরিক যৌন ক্ষুধা ও পিপাসা অতৃপ্ত থেকে গেলে না দৈহিক মিলন সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে, না মানসিক ও আত্মিক মিলন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে।
আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান –যার উৎপত্তি হয়েছে নাস্তিকতাবাদী ইউরোপীয় সমাজে –বিয়ের ও পারিবারিক জীবনের এক অদ্ভূত ইতিহাস উপস্থাপিত করেছে। এ ইতিহাস অনুযায়ী অতি প্রাচীনকালে মানব সমাজে বিয়ের আদৌ কোনো প্রচলন ছিল না। মানুষ নিতান্ত পশুর স্তরে ছিল এবং পশুদের ন্যায় জীবন যাপন করত। তখনকার মানুষের একমাত্র লক্ষ্য ছিল খাদ্য সংগ্রহ ও যৌন প্রবৃত্তির পরিতৃপ্তি লাভ। যৌন মিলন ছিল নিতান্ত পশুদের ন্যায়। তখনকার সমাজে বিষয়-সম্পত্তির ওপর ছিল না ব্যক্তিগত স্বত্ত্বাধিকার, ছিল না কোনো বিশেষ নারী বিশেষ কোনো পুরুষের স্ত্রী বলে নির্দিষ্ট। ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির জন্যে তাদের সম্মুখে ছিল খাদ্য পরিপূর্ণ বিশাল ক্ষেত্র, তেমনি যৌন প্রবৃত্তির নিবৃত্তির জন্যে ছিল নির্বিশেষে গোটা নারী সমাজ। উত্তরকালে মানুষ যখন ধীরে ধীরে সভ্যতা ও সামাজিকতার দিকে অগ্রসর হলো, বিস্তীর্ণ ও ব্যাপক হতে থাকল তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনাশক্তি; তখন নারী পুরুষের মাঝে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনের এবং বিশেষ পুরুষের জন্যে বিশেষ নারীকে নির্দিষ্ট করার প্রম্ন দেখা দিল। সন্তান প্রসব, লালন-পালনের ও সংরক্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই নারীদের ওপর বর্তে সেজন্যে সেই প্রাথমিক যুগে নারীর গুরুত্ব অনুভূত এবং সমাজ ক্ষেত্রে এক বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃত হলো। সেকালে সন্তান পিতার পরিবর্তে মা’র নামে পরিচিত হতো। কিন্তু এ রীতি অধিক দিন চলতে পারেনি। নারীদের সম্পর্কে পুরুষদের মনোভাব ক্রমে ক্রমে বদলে গেল। নারীদের স্বাভাবিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পুরুষরা তাদের স্থাবর সম্পত্তির ন্যায় দখল করে বসল এবং দখলকৃত বিত্ত-সম্পত্তির উপযোগী আইন-কানুন নারীদের ওপরও চালু করল। কিন্তু সমাজ যখন ক্রমবিবর্তনের ধারায় আরো কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে গেল, তখন পরিবার ও গোত্রের ভিত্তি স্থাপিত হলো। রাষ্ট্র ও সরকার সংস্থা গড়ে উঠল। আইন ও নিয়ম-নীতি রচিত হলো। তখন বিয়ের জন্যে নারীদের তার পিতা-মাতার অনুমতিক্রমে কিংবা নগদ মূল্যের বিনিময়ে লাভ করার রীতি শুরু হল। যদিও মূল্যদানের সে আদিম রীতি আজকের সভ্য সমাজেও কোনো না কোনো রূপ নিয়ে চালু হয়ে আছে। বস্তুত পাশ্চাত্য সমাজতত্ত্বে মানুষকে পশুরই অধঃস্তন মনে করে নেয়া হয়েছে, তাই মানব জীবন ও সমাজের এই পাশবিক সূচনার ইতিহাসও সম্পূর্ণ মনগড়াভাবে রচনা করে নিতে হয়েছে! কিন্তু তাই মানুষের প্রকৃত ইতিহাস হবে –এমন কথা সত্য নয়।
একজন স্ত্রী স্বামীর প্রতি চরম মাত্রার অভিমানে বিক্ষুব্ধ নিজ স্বামী ও সন্তানদের পরিত্যাগ করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েও তার সেই স্বামী সন্তান ও সংসারের একান্ত নিজস্ব পরিমণ্ডলের মায়ায় সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা এবং পুনরায় স্বামী সন্তান নিয়ে স্ত্রীত্ব ও মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার –এবং অনুরূপ কারণে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে পুনরায় গৃহে ফিরিয়ে আনার নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনাবলী অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রকৃতিগতভাবে পারিবারিক জীবন যাপনে একান্তভাবে আগ্রহী। বাইরের অন্যান্য ব্যস্ততার আকর্ষণ যত তীব্র ও দুর্দমনীয় হোক, স্ত্র বা স্বামীর সন্তান ও সংসারের বিনিময়ে তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হওয়া কোনো সুস্থ প্রকৃতির নারী বা পুরুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, চিন্তনীয়ও নয়।
কিন্তু কুরআন মজীদে মানব-সৃষ্টি ও সমাজ-সভ্যতার ইতিহাস যেমন সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে পেশ করা হয়েছে, বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের সূচনা সম্পর্কেও তার উপস্থাপিত ইতিহাস চলেছে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারায়। আধুনিক ইতিহাস যাকে সূচনা ও আদিম বলে ধরে নিয়েছে এবং যা কিছু ভালো ও কল্যাণময়, তাকে ক্রমবিবর্তনের ফলে রূপে তুলে ধরেছে, ইসলামের পারিবারিক ইতিহাস যেহেতু তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, এজন্যে সে সূচনা ও আদিকে পরবর্তী কালের কোনো মনুষ্যত্ববোধহীন এক স্তরের ব্যাপার বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তা-ই যে একমাত্র সূচনা ও আদি, তা স্বীকার করে নেয়া সম্ভব নয়।
কুরআন অনুযায়ী প্রথম মানব যেমন আদম তেমনি মানব জাতির প্রথম পরিবার গড়ে উঠেছিল আদম ও হাওয়াকে কেন্দ্র করে। উত্তরকালে তাদের সন্তানদের মধ্যে ও এ পরিবারিক জীবন পূর্ণ মাত্রায় ও পূর্ণ মর্যাদা সহকারেই প্রচলিত ছিল। এই প্রথম পরিবারের সদস্যদ্বয় –স্বামী ও স্ত্রীকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ তা’আলা বলেছিলেনঃ
(আরবী**********************************************)
হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে একত্রে বসবাস গ্রহণ করো এবং যেখান থেকে মন চায় তোমরা দুজনে অবাধে পানাহার করো।
বস্তুত মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম পরিবার যেমন সর্বতোভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবার ছিল, তেমনি তাতে ছিল পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপকরণ এবং তার ফরে সেখানে বিরাজিত ছিল পরিপূর্ণ তৃপ্তি, শান্তি, স্বস্তি ও আনন্দ। এ সূচনাকালের পরও দীর্ঘকাল ধরে এ পারিবারিক জীবন-পদ্ধতি ও ধারা মানব সমাজে অব্যাহত থাকে। অবশ্য ক্রমবিবর্তনের কোনো স্তরে মানব-সমাজের কোনো শাখায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি, তেমন কথা বলা যায় না। বরং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কোনো স্তরে মানব জাতির কোনো কোনো শাখায় পতনযুগের অমানিশা ঘনীভূত হয়ে এসেছে এবং সেখানকার মানুষ নানাদিক দিয়ে নিতান্ত পশুর ন্যায় জীবন যাপন করতে শুরু করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ পর্যায়ে এসেতারা ভুলেছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানবীয় কর্তব্য। নবীগণের উপস্থাপিত জীবন-আদর্শকে অস্বীকার করে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে ধাবিত হয়েছে এবং একান্তভাবে নফসের দাস ও জৈব লালসার গোলাম হয়ে জীবন যাপন করেছে। তখন সব রকমের ন্যায়নীতি ও মানবিক আদর্শকে যেমন পরিহার করা হয়েছে, তেমনি পরিত্যাগ করেছে পারিবারিক জীবনের বন্ধনকেও। এই সময় কেবলমাত্র যৌন লালসার পরিতৃপ্তিই নারী-পুরুষের সম্পর্কের একমাত্র বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ অবস্থা ছিল সাময়িক। বর্তমান সময়েও এরূপ অবস্থা কোথাও-না-কোথাও বিরাজিত দেখতে পাওয়া যায়। তাই মানব সমাজের সমগ্র ইতিহাস যে তা নয় যেমন ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা পেশ করেছেন, তা বলাই বাহুল্য। বর্ণিত অবস্থাকে বড় জোর সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমই বলা যেতে পারে। অথচ এই ব্যতিক্রমের কাহিনীকেই ইউরোপীয় ইতিহাসে গোটা মানব সমাজের ইতিহাস নয়, তা হলো ইতিহাসের বিকৃতি, মানবতার বিজয় দৃপ্ত অগ্রগতির নিরবচ্ছিন্ন ধারবাহিকতায় নগণ্য ব্যতিক্রম মাত্র।
বস্তুত ইসলামী সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিবার এবং পারিবারিক জীবন হচ্ছে সমাজ জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর। এখানেই সর্বপ্রথম ব্যষ্টি ও সমষ্টির সম্মিলন ঘটে এবং এখানেই হয় অবচেতনভাবে মানুষের সামাজিক জীবন যাপনের হাতেখড়ি। ইসলামের শারীর-বিজ্ঞানে ব্যক্তি দেহে ‘কলব’ (আরবী**********) এর যে গুরুত্ব, ইসলামী সমাজ জীবনে ঠিক সেই গুরুত্ব পরিবারের, পারিবারিক জীবনের। তাই কলব সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর বাণীঃ
(আরবী**********************************************************)
দেহের মধ্যে এমন একটি মাংসপিণ্ড রয়েছে, তা যখন সুস্থ ও রোগমুক্ত হবে, সমস্ত দেহ সংস্থাও হবে সুস্থ ও রোগশূন্য। আর তা যখন রোগাক্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, তখন সমগ্র দেহ জগত চরমভাবে রোগাক্রান্ত ও বিষ-জর্জরিত। তোমরা জেনে রাখ যে, তাই হলো কলব বা হৃদপিণ্ড।
পরিবার সম্পর্কেও একথা পুরোপুরি সত্য। তাই সমাজ জীবনে, সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগকে সুস্থ করে তোলা যাদের লক্ষ্য, পারিবারিক জীবনকে সুস্থ ও সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ে তোলা তাদের নিকট সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। অন্যথায় সমাজ সংস্কার ও আদর্শিক জাতি গঠনের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হতে পারে না। সুস্বাস্থ্য ও আয়ুর দৃষ্টিতেও বিবাহিত ও পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব সর্বজনস্বীকৃত। ১৯৫৯ সনের ৬ই জুনের পত্রিকায় জাতিসংঘের একটি বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিলঃ বিবাহিত নারী পুরুষ অবিবাহিতদের তুলনায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেঁচে থাক না কেন।
নদীর যে কেন্দ্রস্থল থেকে বহু শাখা-প্রশাখা নানাদিকে প্রবাহিত, সেই সঙ্গম-স্থলের পানি যদি কর্দমাক্ত হয়, যদি হয় বিষাক্ত ও পংকিল, তাহলে সে পানি প্রবাহিত হবে যত উপনদী, ছোট নদী ও খাল-বিলে তা সবই সে পানির সংস্পর্শে তিক্ত ও বিষাক্ত হবে অনিবার্যভাবে। অতএব পারিবারিক জীবন যদি আদর্শভিত্তিক, পবিত্র ও মাধুর্যপূর্ণ না হয়, তাহলে সমগ্র জীবন –জীবনের সমগ্র দিক ও বিভাগও বিপর্যস্ত, বিষাক্ত ও অশান্তিপূর্ণ হবে, এটাই স্বাভাবিক এবং এর সত্যতার কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না।
দুনিয়ার ইতিহাসে বিভিন্ন সমাজ ও জাতির ধ্বংস ও বিপর্যয় সংঘটিত হওয়ার যেসব কাহিনী লিখিত রয়েছে, তার যে-কোনটিরই বিশ্লেষণ ও তত্ত্বানুসন্ধান করে দেখলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে যে, পরিবার ও পারিবারিক জীবনের বিপর্যয়-ই হচ্ছে তার মূলীভূত কারণ। মুসলিম জাতি সংগঠনকালীন ইতিহাস প্রমাণ করে যে, সুস্থ ও সুন্দর পরিবার গড়ে তোলার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল এবং উত্তরকালে মুসলিম জাতির যে অভ্যুদয় ঘটে তার মূলেও ছিল পারিবারিক দৃঢ় ভিত্তি ও পারিবারিক জীবনের সুস্থতা, পবিত্রতা। মুসলিম জাতির বর্তমান দুর্বলতা ও অধোগতির মূল কারণও যে এই পরিবার ও পারিবারিক জীবনই হলো ইসলামী সমাজের রক্ষাদুর্গ। এ দুর্গের অক্ষুণ্ন ও সুরক্ষিত থাকার ওপরই একান্তভাবে নির্ভর করে ইসলামী সমাজ ও জাতীয় জীবনের পবিত্রতা, সুস্থতা এবং বলিষ্ঠতা ও স্থিতি। মুসলিম জাতির এ দুর্গ এখনো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় নি, যদিও ঘুণে ধরে একে অন্তঃসারশূন্য করে দিয়েছে অনেকখানি। উপরন্তু পাশ্চাত্যের নাস্তিকতাবাদ, নগ্ন ও নীতিহীন সভ্যতার ঝঞ্ঝা বায়ু এর উপর প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে প্রচণ্ডভাবে। আল্লাহ না করুন, এ দুর্গও যদি চূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে মুসলিম জাতির সামষ্টিক অবলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী সন্দেহ নেই। এ প্রেক্ষিতে এ পর্যায়ের আলোচনা, গবেষণা ও বিচার বিশ্লেষণ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য।