একাধিক স্ত্রী গ্রহণ
ইসলামের দৃষ্টিতে পারিবারিক জীবনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নরনারীর নৈতিক পবিত্রতা ও সতীত্ব সংরক্ষণ। আর এজন্যে যেমন বিয়ে করার আদেশ করা হয়েছে, তেমনি পুরুষদের জন্যে এ অনুমতিও দেয়া হয়েছে যে, বিশেষ কোনো কারণে যদি এক সাথে একের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে তাহলে সে তা করতে পারে। তবে তার শেষ সীমা হচ্ছে চারজন পর্যন্ত। এক সঙ্গে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ করা একজন পুরুষের পক্ষে জায়েয –বিধিসঙ্গত। এক সময়ে চারজনের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে যে আয়াতটি রয়েছে তা হচ্ছে এইঃ
(আরবী*******************************************************************)
তবে তোমরা বিয়ে করো যা-ই তোমাদের জন্যে ভালো হয় –দুইজন, তিনজন, চারজন।
(আরবী******) অক্ষরের কারণে আয়াতের দুটো অর্থ হতে পারে। প্রথমত মেয়েলোকদের মধ্য থেকে দুই, তিন, চার য বা যত সংখ্যাই তোমরা জন্যে ভালো হয়, তত সংখ্যক মেয়েই তুমি বিয়ে করো। আর দ্বিথীয় অর্থ হচ্ছেঃ মেয়েলোকদের মধ্য থেকে যে যে মেয়ে তোমার জন্যে ভালো বোধ হয় তাকে তাকে বিয়ে করো, তারা দু’জন হোক, তিন জন হোক, আর চার জনই হোক না কেন। এজন্যে তাফসীরকারগণ এ আয়াতের অর্থ লিখেছেন এ ভাষায়ঃ
(আরবী****************************************************************)
অর্থাৎ রূপ-সৌন্দর্য কিংবা জ্ঞান-বুদ্ধি অথবা কল্যাণকারিতার দৃষ্টিতে যে যে মেয়ে তোমাদের নিজেদের পক্ষে ভালো বোধ হবে তাদের বিয়ে করো।
ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, চারজনের অধিক স্ত্রী এক সময়ে ও এক সঙ্গে গ্রহণ করা হারাম। তাঁরা বরেছেন যে, এ আয়াতে সমগ্র মুসলিম উম্মাকে সম্বোধন করে কথা বলা হয়েছে। অতএব প্রত্যেক বিবাহকারী এ সংখ্যাগুলোর মধ্যে যে কোনো সংখ্যক স্ত্রী ইচ্ছা করবে গ্রহণ করতে পারবে।
এক সঙ্গে চারজন পর্যণ্ত স্ত্রী গ্রহণের এ অনুমতি আয়াতটির পূর্বাপর অনুসারে যদিও ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে করে তাদের ‘আদল’ করতে না পারার ভয়ে শর্তাধীন, তবুও সমগ্র মুসলিম মনীষীদের মতে এক সময়ে চারজন পর্যন্ত বিয়ে করার এ অনুমতি তার জন্যেও যে তা ভয় করে না; -ইয়াতীম বিয়ে করে তাদের প্রতি আদল করতে না পারার ভয় যাদের নেই, তারাও একঙ্গে চারজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে।
আয়াতের (আরবী*******) ‘বিয়ে করো’ শব্দের কারণে যদিও বাহ্যত আদেশ বোঝায়, কিন্তু আসলে এর উদ্দেশ্য চারজন পর্যন্ত বিয়ে করার অনুমতি দান; সে জন্যে আদেশ দেয়া নয় এবং তা করা ওয়াজিব কিংবা ফরযও নয়; বরং তা অনুমতি মাত্র। অতএব তা জায়েয বা মুবাহ বৈ আর কিছু নয়। বিভিন্ন যুগের তাফসীরকার ও মুজতাহিদগণ এ মতই প্রকাশ করেছেন এবং এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত মনীষীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত দেখা দেয়নি।
কিন্তু রাফেজী ও খাওয়ারিজদের মত স্বতন্ত্র। রাফেজীরা কুরআনের এ আয়াতের ভিত্তিতেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, একসঙ্গে নয়জন পর্যন্ত স্ত্রী রাখা যেতে পারে –জায়েয নয়। নখয়ী ইবনে আবূ লায়লা –এই দুই তাবেয়ী ফকীহরও এইমত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের দলীল হচ্ছে, আয়াদের (আরবী******) (এবং) অক্ষরটি। তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে, এই তিনটি সংখ্যার কোনো একক সংখ্যা জায়েয নয়, বরং এর যোগফল অর্থাৎ দুই, তিন ও চার –মোট নয় জন একত্রে বিয়ে করা জায়েয। তাদের মতে আয়াতটির মানে হবে এরূপঃ
(আরবী*****************************************************************))
অতএব, বিয়ে করো দুই এবং তিন এবং চার। আর এর যোগফল হচ্ছে নয়।
খারেজীরা আবার এ আয়াত থেকেই প্রমাণ করতে চেয়েছে যে, মাত্র নয় জন নয়, নয় –এর দ্বিগুণ অর্থাৎ আঠার জন স্ত্রী একসঙ্গে রাখা জায়েয। তাদের মতে আয়াতে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি সংখ্যা দু’ দু’বার করে যোগ করতে হবে, তবেই হবে বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্যের সংখ্যা –অর্থাৎ আঠার।
কিন্তু এ দুটো মতই সম্পূর্ণ ভুল ও বাতিল এবং বিভ্রন্তিকর। কেননা তাদের একথা কুরআনের বর্ণনাভঙ্গী ও উদ্দেশ্যের সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যহীন, কোনো মিল নেই। আল্লাহ যদি এক সঙ্গে নয় জন স্ত্রী গ্রহণ জায়েয করে দিতে চাইতেন, তাহলে নিশ্চয়ই এরূপ ভাষায় বলতেন না –বলতেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
তোমরা বিয়ে করো দুইজন এবং তিনজন এবং চারজন মেয়ে লোক।
কিন্তু আল্লাহ তা’আলা এ ভাষায় কথাটি বলেন নি। এখানে কথাটি বলায় যে ভঙ্গী অবলম্বিত হয়েছে তদৃষ্টে এর তরজমা করতে হলে তার ভাষা হবে এমনিঃ
(আরবী********************************************************************)
তোমাদের জন্যে চারজন পর্যন্ত বিয়ে করা সঙ্গত। আর তাদের মধ্যে আদল করতে না পারলে তবে তিনজন, যদি তাদের মধ্যেও আদল করতে না পার তবে দুজন। আর তাদের মধ্যেও যদি আদল রক্ষা করতে না পার তবে মাত্র একজন।
আয়াতের কথার ধরন হচ্ছে এই। অক্ষমের জন্যে তার সামর্থের সর্বোচ্চ সংখ্যা হচ্ছে একজন অথচ হালালের সর্বোচ্চ সংখ্যা হচ্ছে চারজন। কুরআনে এই হচ্ছে সর্বশেষ সংখ্যা। আল্লাহ যদি নয় জন কিম্বা আঠারজন পর্যন্তই হালাল করতে চাইতেন, তাহলে বলতেনঃ
(আরবী******************************************************************)
তোমরা নয়জন বিয়ে করো অথবা আঠারজন বিয়ে করো আর যদি আদল করতে না পারো, তাহলে একজন মাত্র।
আমাদের নিজস্ব কথার ধরন থেকেও এর প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারি; আমি যদি বহু সংখ্যক লোকের সামনে কিছু পয়সা রেখে দিয়ে বলিঃ “তোমরা দুই-দুই, তিন-তিন, চার-চার পয়সা করে নাও” তবে তার অর্থ কখনো এ হবে না যে, এক-একজন নয় পয়সা করে নেবে।
এজন্যে আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতের নাম লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
অর্থাৎ তোমরা বিয়ে করো মেয়েদের মধ্যে যাকে চাও। তোমাদের কেউ চাইলে দুজন, কেউ চাইলে তিনজন এবং কেউ চাইলে চারজন পর্যন্ত।
এতদ্ব্যতীত এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, কুরআন –কুরআনের এ আয়াতও –রাসূলে করীমের প্রতি নাযিল হয়েছিল এবং তিনি নিজে এ আয়াতের ব্যাখ্যা দান করেছেন। এ আয়াত কায়স ইবনুল হারেস প্রসঙ্গে নাযিল হওয়ার পর রাসূলে করীম (স) তাকে ডেকে বললেনঃ
(আরবী**************************************************************)
চারজনকে তালাক দাও, আর বাকী চারজনকে রাখো।
সে গিয়ে তার নিঃসন্তান স্ত্রীকে এক এক করে বললোঃ
(আরবী**************************************************************)
হে অমুক! তুমি চলে যাও।
অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, গায়লান ইবন সাকাফী যখন ইসলাম কবুল করে তখন তার দশজন স্ত্রী বর্তমান ছিল এবং তারা সকলেই তার সঙ্গে ইসলাম কবুল করে। তখন নবী করীম (স) তাঁকে বললেনঃ
(আরবী*************************************************************)
এদের মদ্যে মাত্র চারজন বাছাই করে রাখো।
নওফল ইবনে মুয়াবিয়া ফায়লামী বলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
আমি যখন ইসলাম কবুল করি, তখন আমার পাঁচজন স্ত্রী ছিল। রাসূলে করীম (স) তখন আমাকে আদেশ করলেনঃ মাত্র চারজন রাখো, বাকিদের ত্যাগ করো। ওরওয়া ইবনে মাসউদ বলেনঃ আমি যখন ইসলাম কবুল করি তখন আমার দশজন স্ত্রী ছিল। রাসূলে করীম (স) আমাকে বললেনঃ
(আরবী**********************************************************)
এদের মধ্য থেকে মাত্র চারজনকে বাছাই করে রাখো আর বাকি সবাইকে ছেড়ে দাও।
কায়স ইবনুল হারেস সম্পর্কিত হাদীসের সনদ সম্বন্ধে মুহাদ্দিসগণ আপত্তি তুলেছেন। ইমাম শাওকানী লিখেছেন যে, এ হাদীসের সনদে মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবি লায়লা নামের একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন, আর হাদীস শাস্ত্রের সব ইমামই তাঁকে ‘যয়ীফ বর্ণনাকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বাগভী বলেছেণ, কায়স ইবনুল হারিস কিংবা হারিস ইবনে কায়স থেকে এতদ্ব্যতীত অপর কোনো হাদীস বর্ণিত হয়েছে বলে আমি জানি না।
আর আবূ আমর আন-নমীরী বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************)
তাঁর বর্ণিত এই একটি মাত্র হাদীস ছাড়া অন্য কোনো হাদীসই নেই। কিন্তু এ হাদীসটিও তিনি খুব বিশুদ্ধাবে বর্ণনা করতে পারেন নি।
আর গায়লান সাকাফী সম্পর্কত হাদীসটি সম্বন্ধেও অনুরূপ আপত্তি তোলা হয়েছে।
হাদীসদ্বয়ের সনদ সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের এ আপত্তি যদ্ৱও অকাট্য এবং তা এক-এটি সনদ সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে সত্য, কিন্তু কেবল সেই একটি সূত্র থেকেই মূল হাদীস কয়টি বর্ণিত হয়নি, তা আরো কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। অতএব হাদীসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সুস্পষ্ট ও অনস্বীকার্য এবং তা হচ্ছে এই যে, কুরআনের এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূলে করীম (স) তা থেকে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী এক সঙ্গে ও এক ময়ে রাখা জায়েয –তার অধিক নয় –এ কথাই বুঝতে পেরেছেন এবং তিনি ঠিক সেই অনুযায়ী চারজনের অধিক স্ত্রী না রাখার নির্দেশও কার্যকরভাবে জারি করেছেণ। আল্লামা শাওকানী লিখেছেন, ‘কুরআনের উপরোক্ত আয়াত দ্বারা চারজনের অধিক স্ত্রী একসঙ্গে গ্রহণ জায়েয নয় বলে অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যায় না, তবে হাদীসের ভিত্তিতে তা অবশ্যই প্রমাণিত হয়। বিশেষত সমগ্র মুসরিম সমাজই যখন এ সম্পর্কে একমত’।
শুধু তাই নয়, রাসূলে করীম (স)-এর সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দুনিয়ার সব মুসলিমের সর্বসম্মত মত হচ্ছে একসঙ্গে সর্বাধিক ও অনুর্ধ্ব মাত্র চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখা জায়েয, তার অধিক নয়।
এ পর্যায়ে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************************)
এক সঙ্গে চারজনের অধিক স্ত্রী রাখা যদি জায়েয হতো তাহলে রাসূলে করীম (স০ তাকে (গায়লানকে) তার দশজন স্ত্রী রাখবারই অনুমতি দিতেন –বিশেষত তারা যখন ইসলাম কবুল করেছিল। কিন্তু কার্যত যখন দেখছি, তিনি মাত্র চারজন রাখার অনুমতি দিচ্ছেন এবং অবশিষ্টদের বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন তা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, কোনোক্রমেই এক সঙ্গে চারজনের অধিক স্ত্রী রাখা জায়েয নয়। আর স্থায়ীকালের জন্যে যখন এ অবস্থা, তখন নতুন করে গ্রহণের ব্যাপারে তো এরূপ নির্দেশ হবে অবশ্যম্ভাবীরূপে।
ইমাম ইবনে রুশদ লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
সমগ্র মুসলিম একসঙ্গে চারজন স্ত্রী গ্রহণ জায়েয হওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত।
……এবং চারজনের অধিক স্ত্রী গ্রহণ অধিকাংশ মুসলিমের মতে –চারজনের বর্তমানে পঞ্চমা গ্রহণ জায়েয নয়।
মওলানা সানাউল্লাহ পানীপতি লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
সমস্ত ইমাম ও সমগ্র মুসলিমের মতে চারজনের অধিক বিয়ে করা জায়েয নয়।
তবে রাসূলে করীম (স) যে এক সঙ্গে নয়জন কিংবা ততোধিক স্ত্রী রেখেছিলেন তার কারণ, আল্লাহর বিশেষ অনুমতিক্রমে কেবল মাত্র তাঁরই জন্যে তা সম্পূর্ণ জায়েয নয়। তিনি ছাড়া মুসলিমদের মধ্যে অপর কারো জন্যেই তা জায়েয নয়। ইবনুল হাজার আসকালানী লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
চারজনের অধিক স্ত্রী একসঙ্গে ও এক সময়ে রাখা বিশেষভাবে কেবলমাত্র রাসূলে করীম (স)-এর জন্যেই জায়েয ছিল –এ সম্পর্কে সব মনীষীই সম্পূর্ণ একমত।
ইমাম শাফেয়ী (রহ) লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাত –যা আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিষ্ঠিত –প্রমাণ করেছে যে, রাসূলে করীম (স) ব্যতীত অপর কারো জন্যেই একসঙ্গে ও এক সময়ে চারজনের অধিক স্ত্রী রাখা জায়েয নয়।
আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
রাসূলের এই নয়, এগারো, পনের জন স্ত্রী এক সঙ্গে রাখা তার জন্যে বিশেষ অনুমোদিত ব্যাপার, মুসলিম উম্মতের মধ্যে এ জিনিস অপর কারো জায়েয নয়।
মোটকথা, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ বর্তমান সভ্যতায় যতই দূষণীয় ও কলংকের কাজ হোক না কেন, আল্লাহ ও রাসূলের দৃষ্টিতে এ কাজ যে একেবারে ঘৃণার্হ ও নিষিদ্ধ ছিল না, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। বিশেষত যে সব পুরুষ একজন মাত্র স্ত্রী দ্বারা নিজের চরিত্রকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ রাখতে পারে না, যৌন শক্তির প্রাবল্য পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হতে ও অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করতে যাদের বাধ্য করে, তার পক্ষে একাধিক স্ত্রী –দুজন থেকে প্রয়োজনানুপাতে চারজন পর্যন্ত –গ্রহণ করা যে কর্তব্য তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না। এ ধরনের ব্যক্তিদের পক্ষে এ কেবল অনুমতিই নয়, এ হচ্ছে তাদের প্রতি সুস্পষ্ট আদেশ। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে চরিত্রের পবিত্রতা হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চরিত্রই যদি রক্ষা না পেল, তাহলে দুনিয়ায় মানুষের স্থান একান্তভাবে পশুদের স্তরে। আর চরিত্রকে রক্ষা করার জন্যেই এ কাজ যদি অপরিহার্যই হয়, তাহলে তা অবশ্যই করতে হবে।
ইসলামের একাধিক স্ত্রী গ্রহনের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ মানবিক ও নৈতিক ব্যবস্থা মাত্র। ইসলাম ঠিক যে কারণে বিয়ে করার অনুমতি বা নির্দেশ দিয়েছে, ঠিক সেই একই কারণে একাধিক (চারজন পর্যন্ত) স্ত্রী গ্রহণেরও অনুমতি দিয়েছে। এ অনুমতি যদি ইসলামে না থাকত, তাহলে বিয়ে করার অনুমতি বা আদেশ দেয়া একেবারেই অর্থহীন –উদ্দেশ্যহীন হয়ে যেত। অবশ্য কুরআনের যে আয়াতে একাধিক বিয়ের এ অনুমতির উল্লেখ হয়েছে তাতেই এ পর্যায়ে একটি গুরুতর শর্তেরও উল্লেখ করা হয়েছে আর তা হচ্ছে (আরবী******) সুবিচার, সমান মানে ও সমান প্রয়োজনে সকলের অধিকার আদায় করা।
সমতা বিধানের শর্ত
কেউ যদি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে –কারো যদি স্ত্রী থাকে দুই, তিন কিংবা চারজন, তবে স্ত্রীদের যা কিছু অধিকার এবং যা কিছু তাদের জন্যে করা স্বামীর কর্তব্য, স্বামী তার সব কিছুই পূর্ণ সুবিচার, ন্যায়পরতা, নিরপেক্ষতা ও পূর্ণ সমতা সহকারে যথারীতি আদায় করবে। পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান-বাসসামগ্রী, খাদ্য, সঙ্গদান, মিল-মিশ, হাসি-খুশীর ব্যবহার, কথা-বার্তা বলা ইত্যাদি সব বিষয়ে ওসকল ক্ষেত্রেই সমতা রক্ষা করে –সকল স্ত্রীর অধকার আদায় করা স্বামীর কর্তব্য। এ সম্পর্কে প্রথমত একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি যে আয়াতে দেয়া হয়েছে, তাকেই সামনে রাখতে হবে। আয়াতটি পূর্ণ আকারে নিম্নরূপঃ
(আরবী*********************************************************************************)
তোমুরা যদি ইয়াতীম মেয়েদের সম্পর্কে ভয় করো যে, তাদের বিয়ে করে ইনসাফ রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে তোমরা মেয়ে লোকদের মধ্যে দুই, তিন, চার –তোমাদের যা ভালো লাগে তাই বিয়ে করো। আর তাদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না বলে যদি ভয় করো তোমরা, তাহলে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করবে অথবা তোমাদের দাসীদের ব্যবহার করবে।
যেন কোনো একজনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে অন্যদের প্রতি জুলুম না করো, এ ব্যবস্থা তার অধিক অনুকূল নিকটবর্তী।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আয়াতে পর পর দুটি বিষয়ে “তোমরা যদি ভয় করো” বলা হয়েছে। প্রথম ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে। তাদের প্রতি ইনসাফ করতে না পারা সম্পর্কে; আর দ্বিতীয় হচ্ছে এক সঙ্গে দুই, তিন বা চার জন স্ত্রী গ্রহণ করে তাদের প্রতি সুবিচার করতে না পারা সম্পর্কে।
জাহিলিয়াতের জামানায় নিজেদের কাছে পালিতা ইয়াতীম মেয়েদের ধনমাল কিংবা রূপ-লাবণ্য-সৌন্দর্যের কারণে বিয়ে করে লোকেরা তাদের প্রতি মোটেই ইনসাফ করত না, ভালো ব্যবহার করত না, স্ত্রীদের অধিকার দিত না। এজন্যে আল্লাহ তা’আলা বলে দিলেনঃ ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে করে তাদের প্রতি তোমরা না-ইনসাফী করবে, এর চেয়ে বরং অন্যান্য মেয়েদের বিয়ে করো। তাহলে তাদেরকে স্ত্রীর অধিকার ও মর্যাদা-দান তোমাদের পক্ষে অসুবিধাজনক হবে না। এগুলো ইসলামের এক মূল্যবান সমাজ সংশোধনী নির্দেশ।
দ্বিতীয়ত একাধিক স্ত্রী একসঙ্গে যদি কেউ গ্রহণ করে, তাহলে সকলের প্রতি সুবিচার ও ইনসাফ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদি কেউ সুবিচার ও ইনসাফ রক্ষা করতে পারবে না বলে ভয় করে, তবে তাকে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করবার অনুমতিবা নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আয়াতে উল্লিখিত (আরবী*********) শব্দের তাৎপর্য অনুধাবনীয়। আল্লামা রাগেম ইসফাহানী লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
‘আদল’ –সুবিচার-ইনসাফ –মানে সমতা, সাম্য রক্ষা এবং ‘আদল’ মানে সমানভাবে ও হারে বা পরিমাণে অংশ ভাগ করে দেয়া। “আর তোমরা যদি ভয় পাও যে, স্ত্রীদের মধ্যে ‘আদল’ করতে পারবে না” এর মানে-
(আরবী****************************************************************************************)
সেই আদল ও ইনসাফ যা স্ত্রীদের মধ্যে রাত বণ্টন ও যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের ব্যাপারে স্বামীকে করতে হয়।
আল্লামা ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
এর অর্থ হচ্ছে স্ত্রীদের মাঝে রাত ভাগ করে দেয়া এবং বিয়েজনিত অধিকারসমূহ আদায় করার ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষা করা, সমভাবে প্রত্যেকের প্রাপ্য তাকেই আদায় করা। আর এ হচ্ছে ফরয।
বস্তুত একাধিক স্ত্রীর স্বামীর পক্ষে বণ্টন ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্ত্রীদের মধ্যে পূর্ণ ইনসাফ ও সমতা সহকারে পরিবেশন একান্তই কর্তব্য। আর যদি সে তা রক্ষা করতে পারবে না বলে আশংকা বোধ করেত তাহলে একজন স্ত্রীই গ্রহণ করা তার কর্তব্য। আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতের তরজমা করেছেন এ ভাষায়ঃ
(আরবী******************************************************************************)
তোমরা কয়েকজন স্ত্রীর মধ্যে ‘আদল’ রক্ষা করতে পারবে না বলে যদি ভয় করো, তাহলে একজন স্ত্রী গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হওয়া উচিত।
এই হচ্ছে কুরআন মজীদের ঘোষণা।
সুবিচার ও সমতা রক্ষার প্রকৃত তাৎপর্য
সুবিচার বণ্টনের পর্যায়ে একথা মনে রাখা আবশ্যক যে, সংখ্যা ও পরিমাণ ইত্যাদির দিক দিয়ে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করার কথা এখানে বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে প্রত্যেক স্ত্রীর অধিকার সাম্য ও প্রয়োজনানুপাতে দরকারী জিনিস পরিবেশনের কথা। কেননা একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের সকলের প্রয়োজন, রুচি ও পছন্দ যে একই ধরনের ও একই মানের হবে এমন কোনো কথা নেই। কেউ হয়ত রুটিখোর, তার প্রয়োজন আটা বা রুটির। আর কেউ ভাতখোর, তার প্রয়োজন চাল বা ভাতের। কেউ হয়ত বেশ মোটা-সোটা, তার জামা ব্লাউজ ও পরিধেয় বস্ত্রের জন্যে বেশ কাপড় দরকার, আর কেউ হালকা-পাতলা, শীর্ণ, তার জন্যে প্রয়োজনীয় কাপড়ের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। কেউ বেশি বয়সের মেয়েলোক, স্বামীসঙ্গ লাভের প্রয়োজন তার খুব বেশি নয়, খুব ঘন ঘনও প্রয়োজন দেখা দেয় না; আর কেউ হয়ত যুবতী, স্বাস্থ্যবতী, তার পক্ষে অধিক মাত্রায় স্বামীসঙ্গ লাভের দরকার। আবার কেউ যুবতী হয়েও রুগ্ন, তার যৌন মিলন অপেক্ষা সেবা শুশ্রুষা ও পরিচর্যার প্রয়োজন বেশি। কাজেই ‘আদল’ (আরবী******) সুবিচার ও সমতার অর্থ পরিমাণ বা মাত্রা-সাম্য নয়, বরং তার মানে হচ্ছে সকলের প্রতি সমান খেয়াল রাখা, যত্ন নেয়া এবং প্রত্যেকের দাবি যথাযথভাবে পূরণ করা। একাধিক স্ত্রী গ্রহণের শর্ত এতটুকু মাত্র, এর বেশি নয়। এ শর্ত পূরণ করতে পারবে না বলে যদি কেউ ভয় পায় এবং আত্মবিশ্লেষণ করে যদি বুঝতে পারে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে ‘আদল’ ইনসাফের এ শর্তটুকু পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না, তাহলে তার উচিত আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হওয়া। এ কথাই তিনি বলেছেন আয়াতটির নিম্নোক্ত অংশেঃ
(আরবী**************************************************************************)
তোমরা ইনসাফ-সমতা রক্ষা করতে পারবে না বলে যদি ভয় করো তবে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করবে …..বস্তুত জুলুম ও অবিচারের কাজ থেকে বেঁচে থাকার জন্যে এ হচ্ছে একাধিক কার্যকর ও অনুকূল ব্যবস্থা।
ইমাম শাফেয়ীর মতে আয়াতের এ অংশ আরো একটি শর্ত পেশ করছে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে। আর তা হচ্ছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য। তিনি আল্লাহর বাণী (আরবী**************) এর তরজমা করেছেন এ ভাষায়ঃ
(আরবী*********************************************************************)
তোমার সন্তান বেশি না হওয়ার পক্ষে এই একজন স্ত্রী গ্রহণই অধিক নিকটবর্তী ব্যবস্থা।
ইমাম বায়হাকী এ আয়াতের তাফসীর ইমামা শাফেয়ীর উপরোক্ত মত অনুযায়ী নিজ ভাষায় লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
একাধিক স্ত্রী গ্রহণেল অনুমতি থাকা সত্ত্বেও একজন মাত্র গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হলে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করতে হয় এমন লোক বেশি হবে না।
এ তাফসীরকে ভিত্তি করে ড. মুস্তফা সাবায়ী লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
এ আয়াতটি প্রকারান্তরে ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্যের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে তুলে ধরে। যদিও এ শর্তটি পালনীয় কিন্তু এর ওপর আইন প্রয়োগ করা যায় না।
এ কারণে মুসলিম মনীষীগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত হয়েছেন যে, রাসূলে করীম (স)-এর ব্যাখ্যা ও বাস্তব ব্যবস্থার দৃষ্টিতে ‘আদল’ বলতে বোঝায়ঃ
(আরবী*************************************************************************)
একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে যে আদল-এর শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা হচ্ছে বাসস্থান, পোশাক, খাদ্য, পানীয়, রাত যাপন এবং দাম্পত্য জীবনের এমন সব ব্যাপার, যাতে আদল-ইনসাফ রক্ষা করা যায় –এ সব বিষয়ের বাস্তব ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা।
প্রশ্ন হতে পারে, স্ত্রী কি কেবল এ সব বৈষয়িক জিনিস পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে? এ ছাড়া প্রেম-ভালোবাসাও তো প্রয়োজন রয়েছে এবং তাও তাদের পেতে হবে স্বামীর কাছ থেকেই। কাজেই সে দিদে দিয়েও সমতা রক্ষা করা কি একাধিক স্ত্রীর বেলায় স্বামীর কর্তব্য নয়?
এর জবাব হচ্ছে এই যে, হ্যাঁ, এসব জৈবিক প্রয়োজন ছাড়াও প্রেম-ভালোবাসা প্রভৃতি আধ্যাত্মিক ও মানবিক প্রয়োজনও স্ত্রীদের রয়েছে এবং তাও স্বামীর কাছ থেকেই তাদের পেতে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। আর এ ব্যাপারে যতদূর সম্ভব সমতা রক্ষা করা স্বামীর কর্তব্য। অন্তত সে জন্যেই তাকে প্রাণ-পণে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, প্রেম-ভালোবাসা, মনের ঝোঁক, টান, অধিক পছন্দ ইত্যাদি মনের গভীর সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে মানুষের নিজের ইচ্ছে ও চেষ্টা-যত্নের অবকাশ খুবই সামান্য। মানুষ হাজার চেষ্টা করেও অনেক সময় সফল হতে পারে না। একেবারে সূক্ষ্ম তুলাদণ্ডে ওজন করে সমান মাত্রায় ভালেবাসা সকল স্ত্রীর প্রতি পোষণ করা মানুষের সাধ্যাতীত। ঠিক এ সমস্যাই বাস্তবভাবে দেখা দিয়েছিল যখন একাধিক স্ত্রী গ্রহণের এ অনুমতি প্রথম নাযিল হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে তাদের মধ্যে প্রথম প্রকারের প্রয়োজন পূরণের দিক দিয়ে পূর্ণ সমতা রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। এ চেষ্টায় তাঁরা সফলতাও লাভ করেছিলেন। কিন্তু প্রেম ভালোবাসা, ভালো লাগা, পছন্দ হওয়া, মন-মেজাজের মিল ইত্যাদি দিক দিয়েও পূর্ণ সমতা রক্ষা করতে তাঁরা অসমর্থ হলেন। হাজারো চেষ্টা করেওতাঁরা সব স্ত্রীকে সমান মাত্রায় ভালোবাসতে সমর্থ হলেন না। তখন তাঁরা মনের দিক দিয়ে খুব বেশি কাতর হয়ে পড়লেন, আল্লাহর কাছে এজন্যে কি জবাব দেবেন, এ চিন্তায় তাঁরা অস্থির হয়ে পড়লেন। তখন আল্লাহর তরফ থেকে এ বাস্তব সমস্যার সমাধান হিসেবে নাযিল হলো এ প্রসঙ্গের দ্বিতীয় আয়াতঃ
(আরবী**********************************************************************)
এবং তোমরা একাধিক স্ত্রী মাঝে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না –যত কামনা ও ইচ্ছাই তোমরা পোষণ কর না কেন। এমতাবস্থায় (এতটুকুই যথেষ্ট) তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে কোনো একজনের প্রতি এমনভাবে পূর্ণমাত্রায় ঝুঁকে পড়বে না যে, অপর স্ত্রীকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেবে। তোমরা যদি কল্যাণপূর্ণ নীতি অবলম্বন করো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল সীমাহীন দয়াবান।
হযরত ইবনে আব্বাস, উবায়দা সালমানী, মুজাহিদ, হাসনুল বসরী, জহাক ও ইবনে মুজাহিম প্রমুখ মনীষী এ আয়াতের তাফসীর করেছেন নিম্নোদ্ধৃত ভাষায়ঃ
(আরবী****************************************************************)
অর্থাৎ হে লোকেরা, তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে সবদিক দিয়ে ও সর্বতোভাবে সমতা রক্ষা ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। কেননা এ সমতা রক্ষা ও সাম্য এক এক রাতের বাহ্য বণ্টনের ক্ষেত্রে যদিও কার্যকর হয় তবুও প্রেম-ভালোবাসা, যৌন স্পৃহা ও আকর্ষণ এবং যৌন মিলনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য অবশ্যম্ভাবী।
প্রখ্যাত তাফসীরবিদ ইবনে শিরীন তাবি’ঈ এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
মানুষের সাধ্যায়াত্ত যা নয় তা হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা, যৌন মিলন স্পৃহা ও আন্তরিক বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সাম্য রক্ষা।কেননা এ সব জিনিসের ওপর কর্তৃত্ব কারোরই খাটে না। যেহেতু মানুষের দিল আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মধ্যে অবস্থিত, তিনি যেদিকে চান, তা ফিরিয়ে দেন। যৌন মলনও এমনি ব্যাপার। কেননা তা কারোর প্রতি আগ্রহনের বিষয়, কারোর প্রতি নয়। আর এ অবস্থা যখন কারোর ইচ্ছাক্রমে হয় না, তখন এ জন্যে কাউকেই দায়ী করা চলে না। আর তা যখন কারোর সাধ্যায়াত্তও নয়, তখন এ ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষার দায়িত্ব কাউকেই দেয়া যায় না।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর ভাষায় এ আয়াতের তাফসীর হচ্ছেঃ
(আরবী**************************************************************************)
হে পুরুষগণ, তোমরা তোমাদের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে তাদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা পোষনের ব্যাপারে সমতা রক্ষা করতে সমর্থ হবে না। ফলে তাদের মধ্যে এ দিক দিয়ে ‘আদল’ করা তোমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না। কেননা তোমরা এ জিনিসের মালিকও নও, যদিও তোমরা তাদের মধ্যে এ বিষয়ে সমতা রক্ষা করতে ইচ্ছুক ও আগ্রহান্বিত হবে।
প্রেম-ভালোবাসা ও যৌন সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে যে আদল ও সমতা রক্ষা করা আদৌ সম্ভব নয়, তার বাস্তব কারণ রয়েছে। একজনের কয়েকজন স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে কেউ অধিক সুন্দরী হবে, কেউ হবে কুশ্রী। কেউ যুবতী, কেউ অধিক বয়স্কা –প্রায় বৃদ্ধা। কেউ স্বাস্থ্যবতী, কেউ রুগ্না, কেউ মিষ্টভাষী খেঅশ মেজাজী, স্বামীগতা প্রাণ; কেউ ঝগড়াটে, খিটখিটে মেজাজের ও কটুভাষী। এভাবে আরো অনেক রকমের পার্থক্য হতে পারে স্ত্রীদের পরস্পরের মধ্যে, যার দরুন এক স্ত্রীর প্রতি স্বামীর স্বাভাবিকভাবেই অধিক আকর্ষণ হয়ে যেতে পরে, আর কারোর প্রতি আগ্রহের মাত্রা কম হতে পারে। কারোর জন্যে হয়ত দরদে-ভালোবাসার প্রাণ ছিঁড়ে যাবে আর কারোর দিকে তেমন টান অনুভূত হবে না। এ অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এজন্যে কোনো স্বামীকে বাস্তবিকই দোষ দেয়া যায় না। কেননা প্রকৃত পক্ষে এর উপর কারোরই কোনো হাত নেই। মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক ও ইচ্ছে ক্ষমতা কোনো কিছুই এখানে পুরোপুরি কাজ করতে পারে না। এজন্যে সব ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষা করা যে মানুষের সাধ্যাতীত, সাধ্যায়ত্ত নয়, তা-ই বলা হয়েছে আল্লাহ তা’আলার উপরোক্ত ঘোষণায়।
আর আল্লাহর এ ঘোষণা যে কতখানি সত্য, তা রাসূলে করীমের অবস্থা দেখলেই বুঝতে পারা যায়। তিনি আর যা-ই হোন, একজন মানুষ ছিলেন। আর মানুষের মানবিক ও স্বভাবগত দুর্বলতা থেকেও তিনি মুক্ত ছিলেন। এ কারণে তিনি তাঁর কয়জন স্ত্রীর মধ্যে হযরত আয়েশা (রা)-কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন অথচ তিনি আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক জৈবিক যাবতীয় বিষয়ে পূর্ণ সমতা রক্ষা করে চলতেন। আর মনের টান, অধিক আকর্ষণ ও প্রেম-ভালোবাসা তাঁর কাজ ইখতিয়ারের জিনিস ছিল না বলে সেক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। এ কারণে তিনি আল্লাহর নিকট দো’আ করেছিলেন নিম্নরূপ ভাষায়ঃ
(আরবী**********************************************************)
হে আল্লাহ, আমার সাধ্যানুযায়ী স্ত্রীদের মধ্যে অধিকার বণ্টন করেছিলাম; কিন্তু যা আমার সাধ্যায়ত্ত নয়, বরং যা তোমার কর্তৃত্বাধীন; সে বিষয়ে অমান্য হয়ে গেলে তুমি নিশ্চয়ই সেজন্যে আমাকে পাকড়াও করবে না।
এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল-কাহলানী লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
রাসূল সম্পর্কিত এ বর্ণনা প্রমাণ করছে যে, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা এবং মনের ঝোঁক টান-আকর্ষণ মানুষের সাধ্যায়ত্ত ব্যাপার নয়; বরং তা হচ্ছে একান্তভাবে আল্লাহর কর্তৃত্বের বিষয়, মানুষের হাতে তার কিছু নেই।
একাধিক স্ত্রীর মধ্যে জৈবিক বিষয়ে পূর্ণ সমতা রক্ষা করার নির্দেশ দেয়ার পর প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা মানুষের সাধ্যাতীত বলে সেক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা বান্দার ওপর আরোপ করা হয়নি। এজন্যে ইসলামী শরীয়ত তা কারোর নিকট দাবিও করে না। ইসলামী শরীয়তের দাবি হচ্ছে এই যে, এরূপ অবস্থা সত্ত্বেও যখন তুমি একজনকে তালাক দিচ্ছ না বরং যে কারণেই হোক তাকে স্ত্রী হিসেবেই রেখে দিচ্ছ, তখন তার সাথে ঠিক স্ত্রীর মতোই ব্যবহার করতে হবে, তাকে বিধবা বা স্বামীহীনা করে রেখে দিও না। আয়াতের শেষাংশে তাই বলা হয়েছেঃ
(আরবী***************************************************************************)
অতএব তোমরা সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না, যার দরুন কোনো স্ত্রীকে তোমরা ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেবে।
এ আয়াতের তাফসীর করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
(আরবী*************************************************************************)
তোমরা একজনের প্রতি যখন একটু ঝুঁকে পড়বেই, তখন সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না –চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেও না, তাহলে অপরকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেবে, মানে সে এমন অবস্থায় ঝুলে থাকবে যে, সে না হবে স্বামীওয়ালী আর না পরিত্যক্তা, তালাক প্রাপ্তা।
আর কুরআনের এ সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ সম্পর্কে ইবনুল মুনযির বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে প্রেমপ্রীতি ভালোবাসার দিক দিয়ে সমতা রক্ষা করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব নয়।
কিন্তু অন্যান্য যাবতীয় দিক দিয়ে সমতা রক্ষা করা ফরয। একাধিক স্ত্রী গ্রহণ কেবল তখনি বিধিসঙ্গত হতে পারে, যদি অন্তত এক্ষেত্রে স্ত্রীদের মধ্যে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ রক্ষা করা হয়। আর এ দিকদিয়ে সমতা রক্ষা করার তাগিদ করে নবী করীম (স) কঠোর ভাষায় বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
যে লোকের দুজন স্ত্রী থাকবে একজনকে বাদ দিয়ে অপরজনকে নিয়ে মশগুল হয়ে থাকবে, কিয়ামতের দিন তার এক পাশের গাল কাটা ও ছিন্ন অবস্থায় ঝুলতে থাকবে।
অপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*********************************************************************************)
যার দুজন স্ত্রী আছে, সে যদি একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে আর অপরজনকে বাদ দিয়ে চলে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার এক পাশ ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে।
এসব হাদীসের ভিত্তিতে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************************)
এসব হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, দুজন স্ত্রীর মধ্যে একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়া আর অপরজনকে বাদ দিয়ে চলা –বিশেষত দিন বণ্টন, খাদ্য-পানীয় ও পোশাক পরিবেশনের ক্ষেত্রে –সম্পূর্ণ হারাম। কেননা এসব বিষয়ে সমতা রক্ষা স্বামীর ক্ষমতায় রয়েছে। যদিও প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা –যাতে স্বামীর কোনো হাত নেই, তাতে সমতা রক্ষা করা স্বামীর প্রতি ওয়াজিব বা ফরয নয়।
ভুল ধারণা অপনোদন
উপরোক্ত আয়াতকে কেউ কেউ একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রতিবন্ধক হিসেবে পেশ করতে চেষ্টা করে থাকেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, প্রথম আয়াতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে সমতা রক্ষার শর্তে। আর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, সমতা রক্ষা করতে চাইলেও তা করা মানুষের সাধ্যাতীত। অতএব একাধিক স্ত্রী গ্রহণ জায়েয নয়, আল্লাহর পছন্দও নয়। তাঁদের মতে আল্লাহ তাআলা একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি এক হাতে যেমন দিয়েছেন, অপর হাতে তেমনি তা ফিরিয়েও নিয়েছেন। ফলে এজন্য আর কোনো অনুমতি বাকি রইল না।
এ সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, যাঁরা এ ধরনের কথা বলেন, তাঁরা কুরআন-হাদীস তথা ইসলামী শরীয়তকে ভালো করে না বুঝেই বলেন অথবা বলা যেতে পারে তাঁরা নিজেদের মনগড়া কথাকেই কুরআনের দোহাই দিয়ে চালিয়ে দিতে চান। কেননা পূর্বোর বিস্তারিত আলোচনা থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে আদল –সুবিচার –ও সমতা যেসব বিষয়ে রক্ষা করার জন্য শরীয়ত দাবি করে –নির্দেশ দেয়, তা মানুষের সাধ্যায়ত্ত বিষয়। আর যে ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা মানুসের সাধ্যাতীত, সে ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত মানের সমতা রক্ষার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, শরীয়ত তার দাবিও করে না। প্রথম প্রকারের ‘আদল’ হচ্ছে বৈষয়িক বিষয়, স্ত্রী সহবাস, খাদ্য-পানীয়-পোশাক পরিবেশন ইত্যাদির ক্ষেত্রে। এ হচ্ছে বস্তু বিষয়ে আদল (সুবিচার) আর দ্বিতীয় হচ্ছে আধ্যাত্মিক …..প্রেমপ্রীতি ভালোবাসার ক্ষেত্রের আদল। প্রথম আয়াতে প্রথম পর্যায়ের আদল রক্ষার শর্ত করা হয়েছে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের জন্যে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের আদল করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বলে তার কম-সে-কম মাত্রার নির্দেশ করা হয়েছে। অতএব আয়াতদ্বয়ে কোনো প্রকার বৈপরীত্য নেই। বরং এ দুটোর আয়াত থেকেই মানুষের পক্ষে করণীয় আদল এবং একটা সুস্পষ্ট ও বাস্তব রূপ ফুটে ওঠে যার অনুসরণ করতে হবে একাধিক স্ত্রীর স্বামীকে। এ নির্দেশ চিরন্তনের জন্যে। আর এ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন না করলে রীতিমত গুনাহগার হতে হবে।
দ্বিতীয় আয়াতে সেই আদল-এর কথা বলা হয়েছে, যা মানুষের সাদ্যায়ত্ত নয়। আর আল্লাহ যখন মানব-প্রকৃতি ও মানুষের প্রকৃতিগত ত্রুটি-দুর্বলতা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল, তখন তিনি এ ‘আদল’ মানুষ করতে পারে না বলে যথার্থই ঘোষণা করলেন। এ অবস্তায় মানুসের দ্বারা যা এবং যতটুকু সম্ভব তারই নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেনঃ “একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের একজনের প্রতি তো ঝুঁকে পড়বেই –এ স্বাভাকি, তবে এমনভাবে কখনো ঝুঁকে পড়বে না, যার ফলে অপর স্ত্রী ঝুলন্ত অবস্থায় না বিবাহিতা না পরিত্যাক্তা –হয়ে থাকতে বাধ্য হয়”। তার অর্থঃ কোনো এক স্ত্রীর দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ার অনুমতি আল্লাহ তা’আলা নিজেই দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এ খানিকটা ঝুঁকে পড়া যে অবশ্যম্ভাবী, তাও বলে দিচ্ছেন। অতএব কারো প্রতি খানিকটা ঝুঁকে পড়লে তা দোষের হবে না, মানুষকে সেজন্যে দোষী বা দায়ীও করা হবে না। আয়াতের শেষ অংশে সেই কথাই বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
যদি তোমরা ভুল-ত্রুটির সংশোধন করতে থাক –ভুলের মধ্যে ডুবে দিশেহারা হয়ে পড় না, আর সব ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে থাক, তাহলে আল্লাহ মাফও করবেন, রহমত করবেন।
আয়াতের এ অংশে স্বামীকে স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহার ও তাদের অধিকারসমূহ সঠিকরূপে আদায় করার জন্যে নতুন করে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ যদি স্বামী করতে থাকে, তাহলে এক স্ত্রীর প্রতি খানিকটা ঝুঁকে পড়ার দরুন অপর স্ত্রীর প্রতি যা কিছু অবহেলা-উপেক্ষা এর মধ্যে হয়ে গেছে তা দূর হয়ে যাবে এবং আল্লাহও ক্ষমা করবেন। আর যেহেতু সে ভবিষ্যতে আল্লাহকে ভয় করে স্ত্রীদের অধিকার সমানভাবে আদায় করতে থাকবে বলে এবং কখনো ইচ্ছে করে কোনো বিষয়ে তাদের মধ্যে তারতম্য –পার্থক্য করবে না বলে সংকল্প গ্রহণ করেছে, এজন্যে আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করবেন, ভবিষ্যতে যাতে করে সকলের অধিকার ঠিক ঠিকভাবে আদায় করতে পারে, সেজন্যে তওফীকও দান করবেন। তার মনে স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহারের দায়িত্বের অনুভূতিও জাগিয়ে দেবেন।
সেসব লোক যা ধারণা করেছে, তাই যদি আল্লাহর ইচ্ছে হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে যেঃ (আরবী****) এ আয়াতের সত্যিই কোনো অর্থ হয় না, বরং এ কথাটি বলারও কোনো প্রয়োজন ছিল না। সোজা করে বললেই পারতেনঃ তোমরা ‘আদল’ করতে পারবে না বলে একাধিক বিয়েও করো না। তা না বলে এক অসম্ভব শর্তের সাথে যুক্ত করে একাধিক বিয়ের অনুমতি দেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? আল্লাহ তো সর্বোচ্চ, একজন সাধারণ বুদ্ধিমান লোকও যে এ ধরনের কথা বলতে পারে, তা সত্যিই ধারণা করা যায় না।
সর্বোপরি, রাসূলে করীম (স)-ই হচ্ছেন কুরআনের ধারক, কুরআনের ব্যাখ্যাকারী। মুখের কথা দ্বারাও এবং বাস্তব কাজের ভিতর দিয়েও। আর তিনি নিশ্চয়ই কোনো হারাম কাজ করেন নি বা করতে পারেন না। আর কোনো হারাম কাজকে তিনি চুপচাপ বরদাশত করবেন, তাও তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। বহু সংখ্যক স্ত্রীর স্বামী ইসলাম কবুল করলে তিনি তাদের মধ্য থেকে চারজনকে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরকম ঘটনা একটা দুটো নয়। তার সংখ্যা অনেক এবং তার প্রত্যেকটি ঘটনারই নিভর্রযোগ্য সনদসূত্রে প্রমাণিত। একাধিখ স্ত্রী গ্রহণ যদি হারামই হতো, তাহলে রাসূলে করীম (স) তাদেরকে একজন মাত্র রাখারই নির্দেশ দিতেন, চারজন রাখার নয়। তা ছাড়া তিনি নিজেও একসঙ্গে একাধিক স্ত্রীর স্বামী ছিলেন –যদিও তাঁর জন্যে আল্লাহর মর্জি অনুযায়ীই চারজনের কোনো সীমা নির্দিষ্ট ছিল না। উপরন্তু একথাও ধারণা করা যেতে পারে যে, রাসূলে করীম (স) নিজে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ী পর্যায়ের বড় বড় মনীষী –যাঁরা সকলেই একবাক্যে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ জায়েয বলে ঘোষনা করেন –এ আয়াতদ্বয়ের সঠিক তাৎপর্য বুঝতে পারেন নি, বুঝতে পেরেছেন –আজকালকার এ বুদ্ধিমানেরা! এ ধরনের কথা আধুনিক বুদ্ধিবাদী নির্বোধেরাই বলতে পারে।
আমার মনে হয়, একাধিক স্ত্রী গ্রহণকে যারা কুরআনের ভিত্তিতেই হারাম বলে প্রমাণ করতে চান, তাঁরা দু’শ্রেণীর লোক। এক শ্রেণীর অত্যন্ত সাদাসিধে, ইসলামের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। তাঁরা যখন দেখলেন ইসলামের ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তখন তাঁরা ইসলামের মান রক্ষার উদ্দেশ্যেই বলতে শুরু করলেন, ‘না ইসলামে আসলে একজন স্ত্রী রাখাই নির্দেশ, একাধিক স্ত্রী রাখার নয়’। তাঁদের সম্পর্কে বলা যায়, এঁরা হচ্ছেন ঈমানদার নির্বোধ লোক। অন্যের কারণে নিজের ঘরে আগুন লাগাবার কাজ করেন তাঁরা। তাঁদেরকে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু তাঁদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা জাগে না। তাঁরা বুঝেন না যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহনই ইসলামের ওপর পাশ্চাত্য সমাজের হামলার একমাত্র কারণ নয়। তার কারণ অনেক গভীর এবং যারা এ হামলা চালাচ্ছে, তারা নিজেরাই ‘বহু বিবাহে’ নয়, বহু স্ত্রী সঙ্গমে বিশ্বাসী এবং বাস্তবেও অভ্যস্ত।
আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক তারা, যাদের নিয়তই খারাপ। তারা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল ব্যবস্তায় এমন এক নতুন জিনিসের আমদানি করতে চায়, যার সাথে ইসলামের কোনো মিল, কোনো সামঞ্জস্য নেই। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবে তারা সে ‘সত্য’কে মনের মাঝে বদ্ধমূল করে নিয়েছে তাকেই তারা ইষলামের নামে চালিয়ে দিয়ে দুনিয়াকে ধোঁকা দিতে চায়। তাদের নিজেদের পছন্দকে ‘আল্লাহর পছন্দ’ বলে লোকদের সামনে তুলে ধরতে চায়। এ হচ্ছে দস্তুরমতো বিশ্বাসঘাতকতা, এ হচ্ছে ইসলাম বিকৃতকরণ; এ এক অমার্জনীয় অপরাধ।
ইতিহাসে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ
আসলে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দানে ইসলামই অপরাধী (?) নয়; না প্রথম অপরাধী, একমাত্র অপরাধী। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ধর্ম ও সভ্যতার অবদান সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ। এ পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য এইঃ
১. ইসলামই সর্বপ্রথম একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দান করেনি। প্রাচীন প্রায় সবগুলো জাতি ও সব্যতায় এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। অ্যাসিরীয়, চীনা, ভারতীয়, বেবিলনীয়, অসুরীয় ও মিসরীয় সভ্যতার বহু স্ত্রী গ্রহণ ছিল একটি সাধারণ রেওয়াজ। এদের অধিকাংশের মধ্যে আবার স্ত্রীদের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল না। চীনের ‘লীকী’ ধর্ম একসঙ্গে ত্রিশজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহনের অনুমতি দিয়েছিল একজন পুরুষকে। আর চীনের বড় বড় বাবু লোকদের তো তিন হাজার পর্যন্ত স্ত্রী ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
২. ইয়াহুদী ধর্মশাস্ত্রে সীমা-সংখ্যাহীন স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি রয়েছে। তওরাত কিতাবে উল্লিখিত নবীগণের প্রত্যেরেই বহুসংখ্যক স্ত্রী ছিল। তাতেই বলা হয়েছে, হযরত সুলায়মানের সাতশতজন ছিল স্বাধীনা স্ত্রী, আর তিনশ ছিল দাসী।
৩. খ্রিষ্ট ধর্মশাস্ত্রে বহু স্ত্রী গ্রহণের কোনো নিষেধবাণীর উল্লেখ নেই। শুধু উপদেশ ছলে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ প্রত্যেক পুরুষের জন্যই তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। এতে করে বড়জোর একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণের দিকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে বলা যেতে পারে। ইসলামও তাই বলে। তাহলে এজন্যে ইসলামের দোষ দেখাবার যুক্তি থাকতে পারে না।
ইনজিল কিতাবে বহু-বিয়ে নিষেধ করে কোনো স্তোত্র বলা হয়নি। বরং পলিশ-এর কোনো কোনো পুস্তিকায় এমন ধরনের কথা রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সঙ্গত। তাতে এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ ‘আর্চবিশপকে অবশ্যই এক স্ত্রীর স্বামী হতে হবে’। তাহলে অন্যদের জন্য একাধিক স্ত্রীর স্বামী হতে কোনো বাধা নেই বলে মনে করা যেতে পারে। আর ইতিহাস প্রমাণ করছে যে, প্রাচীনকালের অনেক খ্রিষ্টানই এমন ছিল, যারা একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছিল একই সময়ে। বহু গির্জার পাদ্রীর বহু সংখ্যক স্ত্রী ছিল। আর বিশেষ বিশেষ অবস্থায় বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ সঙ্গত বলে খ্রিষ্ট যুগের বহু পণ্ডিত ফতোয়াও দিয়েছেন।
পারিবারিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞW ester Mark বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
গির্জার অনুমতিক্রমে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ সপ্তদশ শতক পর্যন্ত চলেছে। আর অনেক অবস্থায় গির্জা ও রাষ্ট্রের হিসাবের বাইরে তার সংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে যেত।
তাঁর গ্রন্থে আরো বলা হয়েছেঃ
আয়ার্ল্যাণ্ড সম্রাটের দু’জন ছিল স্ত্রী আর দু’জন ছিল দাসী।
শার্লিম্যানেরও দুইজন স্ত্রী ছিল, ছিল বহু সংখ্যক দাসী। তাঁর রচিত আইন থেকে প্রকাশ পায় যে, তাঁর যুগের লোকদে মধ্যে বহু বিবাহ কিছুমাত্র অপরিচিত ব্যাপার ছিল না।
মার্টিন লুথারও বহু বিবাহের যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারেন নি। কেননা তাঁর মতে তালাক অপেক্ষা একাধিক স্ত্রী রাখাই উত্তম। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভিষ্টা ফিলিয়ার-[১৬১৮ সন জার্মানীর বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য ও নওয়াব সামন্তদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং মধ্য ইউরোপের লোকদের ক্রমাগতভাবে ত্রিশ বছর পর্যন্ত এক আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত করে রাখে। ১৬৪৮ সনে এ যুদ্ধ খুব কষ্টের সঙ্গে বন্ধ করানো হয় এবং পরস্পরে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ফলে এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাই ‘ভিষ্টা ফিলিয়া সন্ধি’ নামে অভিহিত।] প্রখ্যাত সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষীরত হওয়ার পর এক প্রস্তাবের মাধ্যমে একজন পুরুষের জন্যে দুজন করে স্ত্রী গ্রহণ জায়েয করে দেয়া হয়। খ্রিষ্টানদের কোনো কোনো শাখায় লোকেরা বরং মনে করে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ একান্তই কর্তব্য। ১৫৩১ সনের এক ঘোষণায় সুস্পষ্ট করে বলা হয় যে, সত্যিকার খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীকে অবশ্যই বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ করতে হবে। প্রট্যাস্টান্ট (খ্রিষ্টানদের এক শাখা)-দের ধারনা ছিল, বহু স্ত্রী গ্রহণ এক পবিত্র আল্লাহরই ব্যবস্থা।
৪. আফ্রিকার কালো আদমীদের মধ্যে যারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করত, গির্জা তাদের জন্য বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণের অবাধ অনুমতি দিয়েছিল। কেননা প্রথম দিক দিয়ে আফ্রিকায় যখন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারিত হচ্ছির ও কালো আদমীরা দলে দলে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছিল, তখন গির্জা কর্তৃপক্ষ চিন্তা করল যে, আফ্রিকার অধিবাসী বহু স্ত্রী গ্রহণের অন্ধভাবে আগ্রহী, তাদের যদি তা করতে নিষেধ করা হয় তাহলে তারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হবে না –খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে তা হবে বাঁধাস্বরূপ। কাজেই বহু স্ত্রী গ্রহণ করা তাদের জন্যে নিষিদ্ধ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
৫. পাশ্চাত্য খ্রিষ্টান সমাজে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার দরুন –বিশেষত দুই বিশ্বযুদ্ধের পরে –এক জটিল সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, যার কোনো সমাধানই আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। আর একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি ভিন্ন এ সমস্যার কোনো বাস্তব সমাধানই হতে পারে না। ১৯৪৮ সনে আলমানিয়ার মিউনিখে এক বিশ্ব যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আরব দেশেরও অনেক যুবক তাতে যোগদান করে। এ সম্মেলনের এক বিশেষ অধিবেশনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে আলমানিয়া পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকমে বৃদ্ধিজনিত সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। তার নানাবিধ সমাধান চিন্তা করা হয়। এখানে আরব যুবকদের পক্ষ থেকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব একটি বাস্তব সমাধান হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়। প্রথমে এ প্রস্তাব গৃহীত হলেও পরে সম্মেলনে নানা মতভেদ দেখা দেয়। পরে এ ব্যাপারে সকলেই একমত হয় যে, এ ব্যবস্থা ছাড়া সমস্যার বাস্তব ও কার্যকর আর কোনো সমাধানই নেই –হতেপারে না। পরের বছর আলমানিয়া শাসনতন্ত্রে বহু স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি সংক্রান্ত ধারা সংযোজনের প্রস্তাব ওঠে। (আরবী*************************************)
এরপর আলমানিয়া থেকে এক প্রতিনিধি দল মিসরের জামে আজহারে আগমন করে ইসলামের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিধান সম্পর্কে সরাকরি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে। হিটলারও চেয়েছিলেন তাঁর দেশে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি আইন চালু করতে; কিন্তু মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে তা আর হয়ে ওঠে না।
বহু খ্রিষ্টান মনীষী একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুকূলে অনেক কথা বলেছেন। প্রখ্যাত আলমানিয়া দার্শনিক শোপেন আওয়ার লিখেছেনঃ
পুরুষ ও স্ত্রী সমান মর্যাদার হওয়ার কারণে ইউরোপে বিবাহ সংক্রান্ত আইন অত্যন্ত খারাপ। অথচ আমাদের দায়িত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে। কাজেই যতদিন পর্যন্ত মেয়েদেরকে পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হবে, তদ্দিন তাদরেকে পুরুষদের মতো বুদ্ধিও দিয়ে দেয়া উচিত।
আমরা যখন মূল বিষয়ে চিন্তা করি, তখন এমন কোনো কারণ খুঁজে পাইনে, যার দরুন পুরুষকে এক স্ত্রীর বর্তমানে দ্বিতীয়াকে গ্রহণ করতে বাধা দেয়া যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। বিশেষত কারো স্ত্রী যখন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে কিংবা বন্ধ্যা হয় অথবা কয়েক বছরের দাম্পত্য জীবনের পরই বৃদ্ধা হয়ে যায়, তখন সেই পুরুষকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে কি করে বাধা দেয়া যেতে পারে। ‘মোরমোন’ খ্রিষ্টানরা এই এক স্ত্রী গ্রহণের রীতি বাতিল না করে কোনো কল্যাণই লাভ করতে পারে না।
বস্তুত একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে ইসলামের অনুমতিকে আধুনিক পাশ্চাত্যপন্থীরা যতোই ঘৃণার চোখে দেখুন না কেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এর ফলে জাতীয় নৈতিক চরিত্র অনেক উন্নতি লাভ করে, পারিবারিক সম্পর্ক গ্রন্থি সুদৃঢ় হয় এবং নারীকে এক উচ্চ মর্যাদা দান করা সম্ভব এর সাহায্যে, যা ইউরোপীয় সমাজে দেখা যায় না।
উপরের আলোচনা হতে এ কথা সপ্রমাণিত হয়েছে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ মানব সমাজে বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে এসেছে; কম-বেশি ইতিহাসের সকল যুগে, সভ্যতার সকল স্তরে এর প্রচলন রয়েছে। সুসভ্য-অসভ্য, বর্বর ও উন্নত সংস্কৃতিসম্পন্ন সকল জাতিই এ বিষয়ে অভ্যস্ত ছিল। পাক-ভারতের প্রাচীন ইতিহাসেও দেখা যায়, রাজা-মহারাজা ও সম্রাট-বাদশাহদের ছাড়াও অলী-দরবেশ ও মুণি-ঋষিরা পর্যন্ত একাধিক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত। রামচন্দ্রের পিতা মহারাজা দশরথের তিনজন স্ত্রী ছিল –পিটরানী, কৌশল্যা ও রানী সুমিত্রা। শ্রীকৃষ্ণকে অবতার বা স্বয়ং ভগবান বলে ধারণা করা হয়, তারও ছিল অসংখ্য স্ত্রী। লাল লজপত রায় কৃষ্ণ চরিত্রে তাঁর আঠারজন স্ত্রী ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। রাজা পাণ্ডোরও ছিল দু’জন স্ত্রী –কুন্তি আর মাভরী।
ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরাও একাধিক স্ত্রীর স্বামী ছিলেন। নবী-পয়গাম্বরদের তো প্রায় সকলেরই ছিল বহু সংখ্যক স্ত্রী। আর তাঁরপর হযরত হাসান ইবনে আলী, হুসাইন ইবনে আলী, হযরত আবূ সুফিয়ান ইবনে হারিস, সায়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, হযরত হামযা, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত বিলাল ইবনে রিবাহ, জায়দ ইবনে হারিস, আবূ হুযায়ফা, উসামা ইবনে জায়দ (রা) প্রমুখ বড় বড় সাহাবীও একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন।
একাধিক স্ত্রী আর বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণের এ ইতিহাস প্রমাণ করে যে, এ ব্যাপারটি মোটেই সামান্য নয়, প্রকৃতপক্ষে এ এক অনন্য সাধারণ ব্যাপার। সাময়িক উত্তেজনার কিংবা কেবলমাত্র যৌন লালসার যথেচ্ছ চরিতার্থতার উদ্দেশ্যেই ইতিহাসের এ মহামনীষীবৃন্দ এদিকে অগ্রসর হন নি। আসলে মানব প্রকৃতির অন্তস্থলে এর কারণ নিহিত রয়েছে এবং সে কারণ থাকবে, তার প্রভাব বিস্তা করতে থাকবে, যদ্দিন মানুষ থাকবে এ ভূ-পৃষ্ঠে। এর প্রতি একটা ঘৃণার আর ঘৃণা প্রকাশক দুটো কথা, দুটো আইনের ধারার আঘাতেই তা কখনও মিটে যাবে না; বন্ধ হবে না এর সম্ভাবনার দুয়ার।
মানব প্রকৃতি ও একাধিক স্ত্রী গ্রহণ
এ পর্যায়ে মূল বিষয়ের যথার্থতা বোঝাবার জন্যে আমাদের অবশ্যই মানব প্রকৃতির অধ্যয়ন করতে হবে। দেখতে হবে মানব প্রকৃতি কি এক বিয়ের পক্ষে, না তার কোথাও একাধিক বিয়ের সামান্য দাবিও নিহিত রয়েছে?
প্রকৃতি –তা মানুষেরই হোক আর জন্তু-জানোয়ারের হোক সবই একাধিক বিয়ের কামনা-আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর। আমাদের কাছাকাছি যেসব গরু-মহিষ-ছাগলের পাল রয়েছে তার দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাব, বহু সংখ্যক গাভী, মহিষ, আর ছাগীর জন্যে দু একটি করে ষাঁড়, মহিষ আর পাঁঠা থাকে। আর স্ত্রী জাতীয় জন্তুগুলো তাদেরই কাছ থেকে গর্ভ ধারণ করে। যে মোরগের ধ্বনি ঘরে-দালানে মুখরিত হয়ে ওঠে, তাও বহু সংখ্যক মুরগীর মধ্যে একটি দুটি হয়ে থাকে মাত্র। আর এ মোরগ একটি ঘরে যতগুলো মুরগী নিয়ে বসবাস করে, সেখানে অপর কোন মোরগকে বরদাশত করতে কখনও রাজি হয় না। অন্তত সেখানকার মুরগীগুলোর প্রতি অপর মোরগকে কোনো প্রেম প্রকাশ করতে দিতে রাজি হয় না। জঙ্গলের অধিবাসী জন্তুদের জীবন পর্যবেক্ষণ করলেও দেখা যাবে, তাদের কোনো কোনোটি এক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত থাকলেও বহু স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত জন্তুর সংখ্যা অনেক বেশী।
মানব প্রকৃতিটা নিয়েই বিচার করে দেখুন, আপানর মন সাক্ষ্য দেবে যে, মানব প্রকৃতিতে বহু স্ত্রী গ্রহণের প্রতি প্রবণতা অনেক বেশি এবং তীব্র। এক স্ত্রী গ্রহণের পরও কি কোনো যুবক এমন পাওয়া যাবে যে, অপর কোনো সুন্দরী যুবতী নারীকে দেখে আকৃষ্ট হয় না? তার মধ্যে যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়না? সে যুবতী কনাকে পাবার জন্যে প্রেম ভালোবাসার বন্যা তার হৃদয়-মনে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে না? সে যদি নৈতিকতা ও সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে কার্যত কিছু না করে, তবুও এক স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও অপর নারীর প্রতি তার মনে যে আকর্ষণ জাগ্রত হয় তা কে অস্বীকার করতে পারে? আমরা রাত দিন দেখতে পাচ্ছি –রাস্তাঘটাতে কোনো সুন্দরী-রূপসী যুবতী যখন জাঁকজমক আর চাকচিক্যপূর্ণ পোশাক পরে বের হয়, তখন চারদিকে থেকে পুরুষরা এমনভাবে হা করে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে যে, মনে হয়, আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েলোক তারা পায়নি, আজই প্রথম দেখছে এবং দেখে শুধু পুলকিতই হচ্ছে না, উদভ্রান্তও হচ্ছে। এ পুরুষদের মধ্যে কেবল অবিবাহিত তরুণরাই থাকে না, বিবাহিত, পূর্ণ বয়স্ক এমনকি ছেলেমেয়ে বাপদের সংখ্যাও এতে কম থাকে না। এদের মধ্যে এমন লোকও থাকে ,যারা একসঙ্গে একাধিক বিয়ে করাকে অকাট্য যুক্তির ভিত্তিতে সঙ্গত কাজ বলে মেনে নিতে রাজি হবে না; কিন্তু বাহ্যিক ভয়-ভীতিহীন পরিবেশে তারা পরস্ত্রী ভোগ করার সুযোগ পেলে নিজ স্ত্রীকে বঞ্চিত করেও তা করতে একটুও দ্বিধাবোধ করবে না। এ থেকে কি একথাই প্রমাণিত হয় না যে, মানব প্রকৃতি এক স্ত্রী দিয়ে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হয়ে থাকতে কিছুতেই রাজি নয়? বাহ্যত এক স্ত্রী গ্রহণ করে কার্যত বহু স্ত্রী ভোগ করার ঘটনা এক স্ত্রীতে বিশ্বাসী সমাজে কিছুমাত্র বিরল নয়। বস্তুতই যদি মানব প্রকৃতি এক স্ত্রীতে তৃপ্ত সন্তুষ্ট হতো, তাহলে বিবাহিত পুরুষ নিশ্চয়ই অপর স্ত্রী দেখে কিছুমাত্র লালসা বোধ করত না। নিজের মধ্যে এবং নিজের স্ত্রী ছাড়া অপর নারীর প্রতি ভুলক্রমেও কখনও তাকাত না। কিন্তু তা আদৌ সত্য নয়।
প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রকৃতি ও অধিকাংশ পুরুষের দেহের ঐকান্তিক দাবি হচ্ছে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, একজন মাত্র স্ত্রী দিয়ে অতৃপ্ত। এজন্যে মানুষের ইতিহাসে এমন কোনো পর্যায় আসেনি, যখন একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ চালু হতে দেখা যায়নি। বহু স্ত্রী প্রবণতা অপূর্ণ ও অতৃপ্ত থাকার কারণেই আমরা দেখতে পাই –এক স্ত্রী গ্রহণ আইন যেসব দেশে জোর করে চালু করা হয়েছে, সেখানে বহু স্ত্রী ভোগের রেওয়াজ অপরাপর দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তবে পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, কোথাও একাধিক স্ত্রী গ্রহণ আইনসম্মত আর কোথাও বে-আইনীভাবে আইনকে ফাঁকি দিয়ে অবৈধ উপায়ে বহু স্ত্রী ভোগের মাধ্যমে লালসার বন্যা প্রবাহিত করা হয়। এই কারণেই নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অপর নারী-বন্ধু গ্রহণ করা হয়। নারী-পুরুষের মিলিত খেল-তামাসা, ক্লাব, নাচ, থিয়েটার, আসর বৈঠক ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে সর্বত্র। এ সবই হচ্ছে এক স্ত্রী গ্রহনের ছত্রছায়ায় বহু স্ত্রীর রূপ ও যৌবন ভোগ করার অতি আধুনিক ব্যবস্থা। হাটে-বাজারে ও শহরে-বন্দরে এই যে, বেশ্যালয়গুলো দাঁড়িয়ে আছে, চালু রয়েছে, এর মূলেই সেই বহু স্ত্রী সম্ভোগ লিপ্সার পরিতৃপ্তিই চরম উদ্দেশ্য হয়ে রয়েছে। এজন্যেই আজ প্রাইভেট সেক্রেটারী, টাইপিস্ট-কাম-স্ট্যানোগ্রাফার, পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট, অফিস-ক্লার্ক, এয়ার হোস্টেস, গেস্ট রিসিভার, টেলিফোন অপারেটর, রেডিও এ্যানাউন্সার, রেডিও ও সিনেমা আর্টিস্ট –প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুন্দরী যুবতী নারীদের নিয়োগ করতে দেখা যায়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার প্রচলন ও শিক্ষয়িত্রী নিয়োগও এজন্যেই হয়ে থাকে। এভাবে বর্তমানে পুরুষের বহু স্ত্রী ভোগের এ প্রকৃতিগত প্রবণতার তাণ্ডব নৃত্য দেখা যায় আধুনিক সভ্যতার সর্বত্র।
বস্তুত মানুষের জীবন ও মনস্তত্ব অত্যন্ত জটিল, সমস্যাসংকুল, অত্যন্ত ঠুনকো। একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা পুরুষের মনের দিক দিয়ে দেখা যেতে পারে, দেখা দিতে পারে দেহের ও পৌরুষের দিক দিয়ে। দেখা দিতে পারে নিতান্ত পারিবারিক ও বৈষয়িক কারণে। যার প্রথম স্ত্রী পছন্দনীয় নয় বলে সে তাকে একনিষ্ঠভাবে ভালোবাসতে পারে নি কিংবা যাকে দিয়ে তা মন পূর্ণ মাত্রায় পরিতৃপ্ত নয়, দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ তার মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন, ভালোবাসার প্রয়োজন। যার প্রথম স্ত্রী রুগ্না, স্বামীর দৈহিক দাবি পরিপূরণে অক্ষম দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ তার দৈহিক ও জৈবিক প্রয়োজন –যৌন প্রয়োজন। যার প্রথম স্ত্রী তাকে কোনো উত্তরাধিকারী উপহার দিতে পারেনি, বন্ধ্যা, সন্তান প্রসবে অক্ষম কিংবা যার সন্তান হয়ে মারা গিয়েছে, দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ তার পারিবারিক প্রয়োজন। কোনো শ্রমজীবী মনে করতে পারে যে, তার আর একজন স্ত্রী হলে শ্রমের কাজে তাকে সাহায্য করতে পারবে, এমতাবস্থায় দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ তার অর্থনৈতিক প্রয়োজন। এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরো অনেক প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, যার দরুন একজন ব্যক্তি এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে আরো স্ত্রী গ্রহণে বাধ্য হতে পারে। যদি তা না করে কিংবা আইন করে এ পথে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়, তাহলে হয় তাকে অবৈধ পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে, রীতিমত ব্যভিচারে লিপ্ত হতে হবে নতুবা পারিবারিক জীবনের মাধুর্য থেকে চিরবঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে অথবা বংশের প্রদীপ এখানেই শেষ হয়ে যাবে। এক সঙ্গে দুই, তিন বা চার জন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। কিন্তু এ যে কত মর্মান্তিক, কত হৃদয়বিদারক, তা প্রকাশ করা যায় না। এর ফলে কত নারী আর কত পুরুষের জীবন যে বিপর্যস্ত হয়ে যায়, চুরমার হয়ে যায় কত দম্পতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, তার কোনো হিসেব-নিকেশ করা সম্ভব নয়।
একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সামাজিক গুরুত্ব
এমন বহু সামাজিক প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে, যার দরুন এক –একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আর তা না করলে সমাজ মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হয়ে যায়। দুটো পরিস্থিতি সামনে রেখে এ সামাজিক প্রয়োজনের যথার্থতা বিচার করা যেতে পারেঃ
১.কোনো কারণে সমাজে যদি নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অধিক হয়ে যায় –যেমন উত্তর ইউরোপে বর্তমানে রয়েছে। ফিনল্যাণ্ডের জনৈক চিকিৎসক বলেছেন, সেখানে প্রত্যেক চারটি সন্তানের মধ্যে একটি হয় পুরুষ আর বাকী হয় মেয়ে।
এরূপ অবস্থায় একাধিক স্ত্রী গ্রহণ এক নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য হয়ে পড়ে। কেননা এক স্ত্রী গ্রহণের রীতিতে সেখানে বহু মেয়েলোক থেকে যাবে, যাদের কোনো দিন বিয়ে হবে না, যারা স্বামীর মুখ দেখতে পাবে না কখনো, তখন তারা তাদের যৌন প্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্যে পথে-ঘাটে মৌমাছির সন্ধান করে বেড়াবে। তাদের স্বামী হবে না কেউ, হবে না কোনো ঘর, আশ্রয়স্থল, হবে না কোনো বৈধ সন্তান। আর সে কারণে সামাজিক জীবনে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠা হবে না। আগাছা-পরগাছার মতো লাঞ্ছিত জীবন যাপনে বাধ্য হবে। চিন্তা করা যেতে পারে, তাদের এ রকমের উপেক্ষিত জীবনের অপেক্ষা একজন নির্দিষ্ট স্বামীর অধীন অপর নারীর সাথে একত্রে ও সমান মর্যাদার জীবন যাপন কি অধিকতর কল্যাণকর নয়?
বিংশ শতকের শুরু থেকেই ইউরোপীয় সমাজ-দার্শনিকগণ একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করণের কুফল প্রত্যক্ষ করতে পাচ্ছেন। তাঁরা দেখছেন, সমাজে হু হু করে যৌন উচ্ছৃংখলতার মাত্রা কিভাবে বেড়ে যাচ্ছে, কিভাবে অবৈধ সন্তানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেনঃ একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ করে না দিলে এ সমস্যার কোনো সমাধানই সম্ভব নয়।
‘লণ্ডন ট্রিবিউট’ পত্রিকার ১৯০১ সালে ২০শে নভেম্বরের সংখ্যায় এক ইউরোপীয় মহিলার নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলো প্রকাশিত হয়েছেঃ
আমাদের অনেক মেয়েই অবিবাহিত থেকে যাচ্ছে, ফলে বিপদ কঠিনতর হয়ে আসছে। আমি নারী, আমি যখন এ বিবাহাতিরিক্ত মেয়েদের দিকে তাকাই, তখন তাদের মমতায় আমার দিল দুঃখ-ব্যথায় ভরে যায়। আর আমার সাথে সব মানুষ একত্রিত হয়ে দুঃখ করলেও কোনো ফায়দা হবার নয়, যদি না এ দুরবস্থার কোনো প্রতিবিধান কার্যত করা হয়।
মনীষী টমাস এ মহারোগের ঔষধ বুঝতে পেরেছেন এবং পূর্ণ নিরাময় হওয়ার ‘ঔষধ’ও ঠিক করে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক পুরুষের জন্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অবাধ অনুমতি দিতে হবে। এর ফলেই এ বিপদ কেটে যাবে এবং আমাদের মেয়েরা ঘর পাবে, স্বামী পাবে। এতে করে বোঝা গেল যে, বহু নারী সমস্যার একমাত্র কারণ হচ্ছে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করতে পুরুষদের বাধ্য করা। এ বাধ্যবাধকতায়ই আমাদের বহু মেয়ে বৈধব্যের জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। যদ্দিন না প্রত্যেক পুরুষকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অধিকার দেয়া হবে, এ সমস্যার কোনো সমাধান হওয়াই সম্ভব হবে না। (আরবী*****************)
বর্তমান ইউরোপীয় সমাজে এমন অনেক বিবাহিত পুরুষও রয়েছে যাদের বহু সংখ্যক অবৈধ সন্তান রয়েছে, আর তারা ঘাটে-পথে তাড়া খাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। যদি একাধিক স্ত্রী বৈধভাবে গ্রহণের অনুমতি থাকত, তাহলে এ অবৈধ সন্তান আর তাদের মায়ের বর্তমান লাঞ্ছিত অবস্থার নিশ্চয়ই পড়তে হতো না। তাদের ও তাদের সন্তানদের ইযযত রক্ষা পেত। বস্তুত একাধিক বিয়ের অনুমতি প্রত্যেক নারীকে বৈধভাবে স্বামীর ঘরের গৃহিণী ও সন্তানের মা হওয়ার সুযোগ দান করে। দুনিয়ায় এমন নারী কে আছে যে তা পছন্দ করে না, কামনা করে না। আর এমন বুদ্ধিমান কে আছে, যে এ ব্যবস্থার সৌন্দর্য ও কল্যাণকারিতাকে অস্বীকার করতে পারে।
বর্তমানে আমেরিকায় যে লক্ষ লক্ষ সন্তান এক জটিল সামাজিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, তা থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, পুরুষেরা নিজের এক স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না, আর শত সহস্র নারী বৈধ উপায়ে পাচ্ছে না যৌন মিলন লাভের সুযোগ। এরূপ অবস্থার প্রতিকারের একমাত্র উপায় হচ্ছে –একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিধান।
২. সর্বধ্বংসী যুদ্ধের ফলে কোনো দেশে যদি পুরুষ সংখ্যা কম হয়ে যায় আর মেয়েরা থেকে যায় অনেক বেশি, তখনো যদি সমাজের পুরুষদের পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি না থাকে, তাহলে বেশির ভাগ মেয়ের জীবনে কখনো স্বামী জুটবে না। ইউরোপ বিগত দুটো বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ যুবক হারিয়েছে, এ কারণে যুবতী মেয়েদের মধ্যে খুব কমই বিবাহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ফলে এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে যে, হয় বিবাহিত পুরুষেরা আরো এক-দুই-তিন করে স্ত্রী গ্রহণ করবে, তবে অবশিষ্ট অবিবাহিতা মেয়েদের কোনো গতি হবে, নয় সে বিবাহিত যুবকরা নিজেদের স্ত্রীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এ স্বামীহীনা মেয়েদের যৌন পরিতৃপ্তি দানের জন্যে প্রস্তুত হবে।
এ কারণেই ইউরোপের কোনো কোনো দেশে যেমন –আলমানিয়া –এমন সব নারী সমিতি গঠিত হয়েছে, যাদের দাবি হচ্ছে, হয় একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অবাধ অনুমতির ব্যবস্থা, নয় প্রত্যেক পুরুষ তার স্ত্রী ছাড়া আরো একজন মেয়ের যাবতীয় দায়িত্ব বহনের জন্যে রাজি হবে –এমন আইন চালু করতে হবে।
বস্তুত যুদ্ধ-সংগ্রামের অনিবার্য ফল হচ্ছে দেশের পুরুষ সংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস পেয়ে যাওয়া। আর এরূপ অবস্থায় একমাত্র সুষ্ঠু ও শালীনতাপূর্ণ উপায় হচ্ছে প্রত্যেক পুরুষকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দান। তাই দার্শনিক স্পেন্সার একাধিক স্ত্রী গ্রহণ রীতি বিরোধী হয়েও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, যুদ্ধে পুরুষ খতম হলে পরে সেখানে বহু স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দান একান্তই অপরিহার্য। তিনি তাঁর Principle of Sociology গ্রন্থে লিখেছেনঃ
কোনো জাতির অবস্থা যদি এমন হয় যে, তার পুরুষেরা যুদ্ধে গিয়ে খতম হয়ে যায়, আর অবশিষ্ট যুবকেরা একজন করে স্ত্রী গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকে। ফলে বিপুল সংখ্যক নারীই থেকে যায় অবিবাহিতা, তাহলে সে জাতির সন্তান জন্মের হার অবশ্যই হ্রাস প্রাপ্ত হবে, তাদের সংখ্যা মৃত্যুসংখ্যার সমান হবে না কখনো। দুটো জাতি যদি পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যারা সর্বদিক দিয়ে সমান শক্তিমান, আর তাদের একটি যদি এমন হয় যে, সন্তান জন্মানোর ব্যাপারে সে জাতির সব মেয়েকেই ব্যবহার করা না হয়, আর অপর জাতি তার অপর জাতিতার সব সংখ্যক নারীকে এ কাজে লাগায়, তাহলে প্রথম জাতিটি তার শত্রু পক্ষকে কখনো পরাজিত করতে পারবে না। তার ফল এই হবে যে, এক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত জাতি সেসব জাতির সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে, যারা বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণে পক্ষপাতী। (আরবী***************************************)
এ প্রসঙ্গে আমি বলব, মধ্যমান জাতিগুলো এক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত হয়, তাহলে তার মধ্যে সে জাতি অতি সহজেই ধ্বংস হবে, সে জাতি বিলাস বাহুল্যে নিমজ্জিত হবে। কেননা বিলাসী জাতির মেয়েরা সাধারণত কম সন্তান প্রসব করে থাকে। জন্মহার তার অনেক কমে যাবে। এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফ্রান্স। আর মুকাবিলায় কম বিলাসী জাতি জয়লাভ করবে, কেননা কম বিলাসী জাতির মেয়রা সাধারণভাবে অধিক সন্তান প্রসব করে থাকে –যেমন রাশিয়া। এ কারণে বিলাসী জাতির পক্ষেও কর্তব্য হচ্ছে নিজেদের মধ্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রীতির ব্যাপক প্রচলন করা, তাহলে তাদের জনসংখ্যার ক্ষতি পূরণ হতে পারবে।
একটি হাস্যকর প্রশ্ন
পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের এ যুক্তিপূর্ণ অনুমতি বা আবশ্যকতার ওপর অত্যাধুনিক মেয়েরা একটি প্রশ্ন তুলে থাকে। তারা বলে যে, পুরুষরা যদি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে, তাহলে মেয়েরা কেন একাধিক স্বামী গ্রহণ করতে পারবে না?
প্রশ্নটি যে কতখানি হাস্যকর, তা সহজেই বোঝা যায়। নারী-পুরুষের সাম্য সম্পর্কে আধুনিক কালের মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণার কারণেই এ ধরনের নির্লজ্জ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে থাকে। অথচ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায় যে, নারী পুরুষের এ পর্যায়ের সমতা স্বভাব ও জন্মগত কারণেই অসম্ভব। মেয়েরা স্বভাবতই এক সময় গর্ভধারণ করে আর বছরে মাত্র একবারই তার গর্ভে সন্তানের সঞ্চার হয়। বহু সংখ্যক পুরুষ কর্তৃক ব্যবহৃত হলেও তার গর্ভে সন্তান হবে একজন মাত্র পুরুষ থেকেই। কিন্তু পুরুষদের অবস্থা এরূপ নয়। একজন পুরুষ এক সঙ্গে বহু সংখ্যক স্ত্রীলোককে গর্ভবতী করে দিতে পারে এবং একই সময় বহু সংখ্যক স্ত্রী থেকে বহু সংখ্যক সন্তান জন্মলাভ করাতেও পারে।
এমতাবস্থায় একজন মেয়েলোকের যদি একই সময় একাধিক স্বামী থাকে এবং একই সময়ে সকলের দ্বারা ব্যবহৃত হয় এবং তার গর্ভে সন্তান আসে, তাহলে সেই সন্তান যে কোন পুরুষের, তা নির্ণয় করা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। কিন্তু একজন পুরুষ যদি একই সময়ে একাধিক স্ত্রীর স্বামী হয়,তাহলে সেই স্ত্রীদের গর্ভের সন্তান যে সেই একমাত্র পুরুষের ঔরসজাত, তা ঠিক করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না।
দ্বিতীয়ত পারিবারিক জীবনে পুরুষেরই কর্তৃত্ব বিশ্বের সব সমাজ ধর্মেই স্বীকৃত। এখন একজন স্ত্রীলোকের যদি একাধিক স্বামী হয়, তবে সে পরিবারে কোনো পুরুষের কর্তৃত্ব চলবে? আর স্ত্রীই বা কার কর্তৃত্ব মেনে চলবে পারিবারিক কাজ কারবারে? এক সঙ্গে সব কয়জন স্বামীর কর্তৃত্ব মেনে চলা নিশ্চয়ই একজন স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা সব পুরুষের মতি-গতি, রুচি-বাসনা সমান নয়, পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণও নয় –বিশেষত দাম্পত্য বিষয়ে। স্ত্রী যদি স্বামীদের একজনের কর্তৃত্ব মেনে চলে তাহেল অপর স্বামীদের পক্ষে তা হবে সহ্যাতীত। অতএব একজন নারীর পক্ষে একাধিক স্বামী গ্রহণ অপেক্ষা একজন পুরুষের পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ অধিকতর সহজসাদ্য, নিরাপত্তাপূর্ণ, স্বাস্থ্যকর ও নির্বিঘ্ন। এ সম্পর্কে যত চিন্তাই করা হবে, অত্যাধুনিকদের উপরোক্ত প্রশ্নের অন্তঃসারশূন্যতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। এজন্যেই ডঃ মার্সিয়ার (marcier) বলেছেনঃ
The man is in this respect, as in many other respects, essentially different from woman, has been well noted by students of Biology:
Woman is by Nature a monogamist, man has in him the element of a polygamist
(Conduct and its Discorders Biologically Considered. Pp. 292-293)
এ পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষের জন্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ইসলাম প্রদত্ত অনুমতির যথার্থতা ও কার্যকরতা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ইসলাম মানব জীবনের জন্যে আল্লাহর দেয়া পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানুষের সার্বিক জীবনের প্রয়োজন ও জীবনের যাবতীয় সমস্যাকে সামনে রেখেই সর্বাঙ্গ সুন্দর ও নির্ভুল বিধান রচনা করেছেন মানব স্রষ্টা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। মানুষের প্রয়োজন ও সমস্যা সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কারোই সার্বিক জ্ঞান নেই –থাকা সম্ভব নয় বলে তাঁর দেয়া বিধানের সৌন্দর্য মানুষের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। তিনি নারীকে নয়, পুরুষদেরকে এক সময় একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দিয়ে যে বিশ্বমানবতার প্রতি বিরাট কল্যাণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তা বাস্তবিকই অনুধাবনীয়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইসলামের দুশমনগণ একাধিক স্ত্রী গ্রহণের এ অনুমতিকে একটি ত্রুটি-একটি দোষের ব্যাপার বলে প্রচারণা চালাচ্ছে, ইসলামের ওপর নিরন্তর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যে পাশ্চাত্য দেশে নারীর সতীত্ব ও মান-মর্যাদার এক কানা কড়িও দাম নেই, বরং যা পথে-ঘাটে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, নাচের আসরে, থিয়েটার হলে ও নাইট ক্লাবে দিনরাত লুণ্ঠিত হচ্ছে, নগদ কড়ির বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে, সে পাশ্চাত্য দেশে –পাশ্চাত্য সভ্যতার ধ্বজাধারীরাই ইসলাম সম্পর্কে ব্যঙ্গ্যোক্তি নিতান্ত পুরাতন ব্যাপার হয়ে গেছে। এতে না আছে কোনো নতুনত্ব আর না আছে কোনো বৈচিত্র। কেননা ইসলামকে এজন্যে যতই দোষ দেয়া হোক না কেন, তারা নিজেরা নিজেদের দেশের ও সমাজের নানা অবস্থার কারণে আজ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি একটি স্বাভাবিক ও মানব সমস্যার সমাধানকারী ব্যবস্থাও বটে। ইউরোপীয় সমাজের বহু চিন্তাবিদ মনীষী এর স্বপক্ষে সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করছেন না।
এক বিয়ের ধারক (monogamist) ইউরোপীয় সমাজের নৈতিক ভাঙ্গন ও পারিবারিক বিপর্যয় দেখে মনীষীরা চিৎকার করে উঠেছেন। তাঁদের মতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ কোনো দোষের কাজ তো নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে তা অপরিহার্য, নিতান্ত প্রয়োজনীয়। নিম্নে কয়েকজন মনীষীর এ সম্পর্কিত উক্তির উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছেঃ
১. লণ্ডনের মিস মেরী স্মীথ নামের এক স্কুল শিক্ষায়িত্রী লিখেছেনঃ
এক স্ত্রী গ্রহণের (monogamy) যে নিয়ম ও আইন বৃটেনে প্রচলিত, তা সবই নিতান্ত ভুল। পুরুষদের জন্যে দ্বিতীয়দায় পরিগ্রহের অনুমতি থাকা একান্তই বাঞ্ছনীয়।
লিখেছেনঃ
এ দেশে (বৃটেনে) নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্যে প্রত্যেক নারী স্বামী লাভ করতে পারছে না।
তারপর লিখেছেনঃ
এক স্ত্রী গ্রহণের নিয়ম ব্যর্থ হয়েছে। আর এ নিয়ম বিজ্ঞানসম্মতও নয়।
২. অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আল্লামা শেয়খ আবদুল আজীজ শ্বাদীস মিছরী তাঁর ‘স্বাভাবিক ধর্ম’ নামক গ্রন্থের এক স্থানে লিখেছেনঃ
লণ্ডনের এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত হলো। ইসলামের নানা দিক নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ হলো। বহু বিবাহ সম্পর্কে কথা উঠতেই তিনি বললেনঃ হায়! আমিও যদি মুসলিম হতাম, তাহলে আর একজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারতাম। কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেনঃ আমার স্ত্রী পাগল হয়ে গেছে, তারপরও কত বছর অতিবাহিত হলো। ফলে আমাকে বান্ধবী আর প্রণয়িনী গ্রহণ করতে হয়েছে। কেননা আইনসম্মতভাবে আমি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের সমাজেও দ্বিতীয় স্ত্রী বৈধ হলে তার থেকে আমার বৈধ সন্তানের জন্ম হতো; সে হতো আমার বক্ষের পুতুলি, আমার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী আর আমি পেতাম সঙ্গিনী, লাভ করতে পারতাম গভীর শান্তি ও অপরিসীম তৃপ্তি।
তিনি আরো লিখেছেনঃ
ইংলণ্ডে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সতেরো শতক থেকেই বহু বিবাহ প্রথার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয়। ১৬৫৮ সনে এক ব্যক্তি ব্যভিচার ও নবজাতক অবৈধ সন্তানের মৃত্যু বন্ধ করার জন্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের স্বপক্ষে এক পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তার এক শতাব্দী পর ইংলণ্ডের জনৈক আদর্শ চরিত্রবান পাদ্রী এ প্রস্তাব সমর্থন করে আর একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রখ্যাত যৌনতত্ত্ববিদ জেমস হুলটন যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ও ব্যভিচার প্রতিরোধের জন্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুকূলে মত প্রকাশ করেন।
৩. প্রখ্যাত চিন্তাবিদ শোপেন আওয়ার তাঁর এ সম্পর্কিত চিন্তাধারা প্রকাশ করেছেন এভাবেঃ
এক স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল লোক কোথায়, আমি তাদের দেখতে চাই। আসলে আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তিরই বহু সংখ্যক স্ত্রী প্রয়োজন। এজন্যে পুরুষের স্ত্রী গ্রহণের কোনো সংখ্যা নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়।
৪. প্রসিদ্ধ যৌনতত্ত্ববিদ কিলবন তাঁর Human Love নামক গ্রন্থ লিখেছেনঃ
ইংলণ্ডে যদিও কার্যত বহু স্ত্রী গ্রহণের রীতি চালু রয়েছে, কিন্তু সমাজ ও আইন তা এখন পর্যন্ত সমর্থন করেনি। যদিও সে সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি দেখা যায়। যেসব লোক একজন স্ত্রী গ্রহণ করে দুই বা তিনজন রক্ষিতা ও বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, সমাজ তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে একবারে নীরব। কিন্তু পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি থাকা উচিত বলে কেউ যদি কোনো প্রস্তাব পেশ করে তাহলে সমাজ অমনি তার বিরুদ্ধে চীৎকার করে ওঠে।
৫. আমেরিকার একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি বা প্রচলন না থাকার ফল কত মর্মান্তিক হয়েছে তা ওয়াশিংটনস্থ ‘ইয়ং ওমেন ক্রীশ্চান এসোসিয়েশন’-এর চেয়ারম্যান মিসেস ডাসেল কানফিংক প্রদত্ত এক ভাষণ থেকে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। তিনি বুকিং কমিটির সামনে বিবৃতি দান প্রসঙ্গে বলেছিলেনঃ
আমেরিকার চৌদ্দ বছরের ঊর্ধ্ববয়স্কা যুবতী মেয়ের সংখ্যা এক কোটি বিশ লাখ। আর এরা সবাই অবিবাহিতা। তার তুলনায় অবিবাহিত ছেলেদের সংখ্যা মাত্র নব্বই লাখ। এ হিসেব অনুযায়ী ত্রিশ লাখ যুবতী মেয়ের পক্ষে স্বামী লাভ কা কঠিন কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা মহাযুদ্ধ পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের সংখ্যাগত ভারসাম্য অনেকাংশে নষ্ট করে দিয়েছে।
-(লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘জমজম’ পত্রিকা-১৫.৮.১৯৪৫)
৬. কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবেশে ‘বহু বিবাহ ও তালাক’ পর্যায়ে ভাষণ দান প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গ্রন্থকার রবার্ট রীমার বলেছেনঃ
তালাকের ক্রমবর্ধমান ঘটনাবলীকে প্রতিরোধ করা এবং শিশু ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে আমেরিকার লোকদেরকে এক সময়ে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া আবশ্যক। এর ফলে সেয়ানা বয়সের পুরুষ নারী, বিধবা ও রক্ষিতাদের বহু উপকার সাধিত হবে। (দৈনিক জং, করাচী-২২.১২.’৬৪)
৭. চেকোশ্লাভিয়া সম্পর্কে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে যে, ততায় অবিবাহিতা নারীর সংখ্যা অবিবাহিতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, সে দেশে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নারীর সংখ্যা বিবাহেচ্ছু পুরুষ অপেক্ষা তিন লাখ ত্রিশ হাজার অধিক।
(দৈনিক ‘দাওয়াত’, দিল্লী-১৫.১২.’৬৪)
৮. প্রখ্যাত নারী চিকিৎসক ডা. এনি ব্যাসেন্ত (Annie Besent) বলেছেনঃ
There is pertended monogamy in the west, but there is really polygamy without responsibility; the mistress is cast off when the man is weary of her, and sinks gradually to be the “Woman of the street”, for the first lover has no responsibility for her future and she is a hundred times worse off than the sheltered wife and mother in the polygamous home. When we see thousands of miserable women who crowd the streets of Western towns during the night we must surely feel that it does not lie within Wertern mouth to reproach Islam for polygamy. It is berrer for woman, happier for woman more respectable for woman, to live in polygamy, united to one man only, with the legitimate child in her arms, and surrounded with respect, than to be seduced, cast out in the streets –perhaps with an illegitimate child outside the pale of low –unsheltered and uncared for to become the victim of any passer-by, night after night, rendered incapable of motherhood despised by all.
(Morning News-27.12.63)
(The light of Islam Polygamy and Law)
By Khurshid Ahmad
একাধিক স্ত্রী গ্রহণের খারাপ দিক
এতক্ষণে আমরা স্ত্রী গ্রহণের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং এ ব্যবস্থা চালুন না থাকার কারণে দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে কি পরিণতি ঘটেছে আর সে সব কি সামাজিক ও নৈতিক সমস্যার সম্মুখীন, তাও আমরা দেখেছি এবং তারও পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের আবশ্যকতা প্রমাণ করেছি। কিন্তু এ প্রসঙ্গে ইনসাফের তাগিদ হচ্ছে –এর খারাপ দিকটি সম্পর্কেও দুটো কথা বলে দেয়া। কেননা এরও যে একটা খারাপ দিক রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
ক. এ পর্যায়ে সবচেয়ে খারাপ দিক যেটা মারাত্মক হয়ে ওঠে পারিবারিক জীবনে, তা হচ্ছে স্ত্রীদের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, মন-কষাকষি ও ঝগড়া-বিবাদ। এ যে অনিবার্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এর ফলে যে পারিবারিক জীবন তিক্ত বিষ জর্জরিত হয়ে ওঠে তাও অনস্বীকার্য। এ রকম অবস্থায় স্বামী বেচারার দিন-রাত বচ্চিশ ঘন্টা চলে যায় স্ত্রীদের মধ্যে ঝগড়া মেটাবার কাজে। এতেও তার জীবন জাহান্নামে পরিণত হয়। এমন সময়ও আসে, যখন সে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করার জন্যে নিজেকে রীতিমত অপরাধী মনে করতে শুরু করে।
দ্বিতীয়ত, স্বামী যেহেতু স্বাভাবিক কারণেই একজন স্ত্রীর প্রতি বেশি টান ও বেশি ভালোবাসা পোষণ করে, ফলে স্ত্রীদের মধ্যে জ্বলে ওঠে হিংসার আগুন, যা দমন করতে পারে কেবল স্বামীর বুদ্ধিমত্তা আর এ আগুন থেকে বাঁচতে পারলে কেবল সে, যে নারীর আদর্শ চরিত্রকে অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করতে পেরেছে।
খ. হিংসার আগুন স্ত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা স্ত্রীদের সন্তানদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। তারাও বিভিন্ন মায়ের সন্তান হওয়ার কারণে পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে। ভ্রাতৃত্ব পারস্পরিক পরিণত হয়ে যায়। ফলে গোটা পরিবারই হিংসা-বিদ্বেষের আগুনে জ্বলতে থাকে। এরূপ অবস্থায় বিশেষ করে পিতার পক্ষে –একাধিক স্ত্রীদের স্বামীর পক্ষে –হয়ে পড়ে অত্যন্ত মারাত্মক। পরিবারের স্থিতি বিনষ্ট হয়, শান্তি ও সৌভাগ্য থেকে হয় বঞ্চিত।
গ. ভালোবাসার দিক দিয়ে স্ত্রীদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।যে স্ত্রী নিজকে স্বামীর ভালোবাসা বঞ্চিতা বলে মনে করে, সতীনদের প্রতি তার স্বামীর মনের ঝোঁক-আকর্ষণ ও টান লক্ষ্য করে, তখন সে স্বাভাবিকভাবেই মনে করে যে, তারও একদিন ছিল, যখন সে স্বামীর হৃদয়ভরা ভালোবাসা লাভ করেছিল। তখন তার মনে জাগে হতাশা। স্বামীর ভালোবাসায় পরবর্তী শরীককে তখন সে নিজের শত্রু বলে মনে করতে শুরু করে। আর তখন তার মনে যে ব্যর্থতার বেদনা জাগ্রত হয়, তা অনেক সময় তার নিজের জীবনকেও নষ্ট করে দিতে পারে, সে সতীনকে অপসারিত করার উপায় উদ্ভাবনের তৎপরতাও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।
ঘ. অনেকের মতে একাধিক স্ত্রীসম্পন্ন পরিবারের ছেলে মেয়েরা উচ্ছৃঙ্খল ও বিদ্রোহী হয়ে পড়ে। ঘরে যখন দেখতে পায় মায়েদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি দিন-রাত লেগেই আছে আর তার সামনে বাবা নিতান্ত অষহায় হয়ে হয় চুপচাপ নির্বাক থাকে, না হয় স্ত্রীদের ওপর চালায় অত্যাচার, নিষ্টেষণ, নির্যাতন, তখন পরিবারের শৃঙ্খলা ও শাসন-বাঁধন শিথিল হয়ে পড়ে। ছেলেমেয়েরা ঘরে শান্তি-সম্প্রীতির লেশমাত্র না পেলে ঘরের বাইরে এসে পড়ে আর শান্তির সন্ধানে যত্রতত্র ঘুরে মরে।
একাধিক স্ত্রী গ্রহণের পরিণামে উপরোক্ত অবস্থা দেখা দেয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। আর পারিবারিক জীবনে এ যেন একটি অকল্যাণের দিক, তাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানব সমাজের জন্যে এমন কোনো ব্যবস্থা রয়েছে, যা বাস্তবে জমিনে রূপায়িত হলে তাতে কোনো দোষ –কোনো ক্রটিই দেখা দেবে না? মানুষ যা কল্পনা করে, আশা করে, বাস্তবে তার কয়টি সম্ভব হয়ে ওঠে? ইসলামের একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সম্পর্কিত অনুমতি বা অবকাশেও যে বাস্তব ক্ষেত্রে এমনি ধরনের কিছু দোষ-ত্রুটি দেখা দেবে কিংবা বলা যায়, এ অনুমতির সুযোগে কিছু লোক যে দুষণীয় কাজ করবে, তা আর বিচিত্র কি। তবে ইসলামের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতিই একমাত্র জিনিস নয়, সে সঙ্গে রয়েছে প্রকৃত দ্বীনদারী ও পবিত্র চরিত্র গ্রহণের আদর্শ –আদেশ, উপদেশ ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। তা যদি পুরাপুরি অবলম্বিত হয়, তাহলে উপরোক্ত ধরনের অনেক খারাবী থেকেই পরিবারকে রক্ষা করা যেতে পারে, একথা জোরের সাথেই বলা যায়।
একথা মনে রাখতে হবে যে, ইসলামে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের কোনো নির্দেশ দেয়া হয় নি, তা ফরযও করে দেয়া হয়নি মুসলিম পুরুষদের ওপর। বরং তা হচ্ছে প্রয়োজনের সময়কালীন এক ব্যবস্থা মাত্র, তা হচ্ছে নিরুপায়ের উপায়, অগতির গতি। বস্তুত এক সঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রয়োজন যে দেখা দিতে পারে, অনেক সময় তা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা পূর্বে আমরা দেখেছি। এখন কথা হলো, নিরুপায় হয়ে পড়লে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ স্ত্রী গ্রহণ করা যাবে কিনা! আর নিতান্ত প্রয়োজনে পড়ে গৃহীত এ ব্যবস্থায় যদি কিছু কষ্টের কারণ দেখা দেয় তাহলেও তা অবলীলাক্রমে বরদাশত করা হবে কিনা! একটি বৃহত্তর খারাবী থেকে বাঁচবার জন্যে ক্ষুদ্রতর খারাবীকে বরদাশত করা মানব জীবনের স্থায়ী রীতি, যা আমরা দিনরাত সমাজে দেখতে পাই। কিন্তু ক্ষুদ্রতর খারাবী দেখিয়ে একথা বলা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না যে, এ গোটা ব্যবস্থাই ঠিক নয়। কাজেই ব্যাপারটি সম্পর্কে উদার ও ব্যাপকতর দৃষ্টিতেই বিচার করতে হবে ও চূড়ান্ত রায় দিতে হবে।
পরন্তু সতীনের কারণে কোনো স্ত্রীর মনোকষ্ট হওয়া কেবলমাত্র একাধিক স্ত্রী গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্ত্রী যদি দেখতে পায় তার বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তার স্বামী অপর নারীর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, তখনো কি তার মনে হতাশা জাগবে না? দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতার আঘাত কি তার কলিজাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে না? …..তাহলে তার স্বামীকে অবৈধ পন্থায় কিংবা গোপনে চুরি করে অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে দেয়ার চাইতে বৈধভাবে তাকে বিয়ে করে ঘরে আনতে দেয়া কি অধিকতর পবিত্র ব্যবস্থা নয়? ……যে লোক একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করেও তার একমাত্র স্ত্রীকে ভালোবাসেন না, সেই স্ত্রীর মানসিক অবস্তা কি এবং সেজন্যে দায়ী কে?
আর এ ধরনের পরিবারের সন্তানদের উচ্ছৃঙ্খল হওয়া সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, এর জন্যে একাধিক স্ত্রী বর্তমান থাকাই দায়ী নয়। এক স্ত্রীর সন্তানদেরও অবস্থা এমনি হতে পারে, হয়ে থাকে। আরব জাহানে ‘রীফ’ গোত্রের লোকেরা সাধারণভাবেই একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অধিক সন্তান লাভ, যেন কৃষিকাজে তারা তাদের সাহায্য করতে পারে, তারা খুবই সচ্ছল অবস্থার লোক। কিন্তু ‘রীফ’ সন্তানদের মধ্যে পারিবারিক বিদ্রোহের নামচিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায় না। বরং তা দেখা যায় বড় বড় শহরে নগরে, বিশেষত গরীব পর্যায়ের পরিবারের সন্তানদের মধ্যে খুব বেশির ভাগ। বর্তমানে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে পারিবারিক বিদ্রোহের ভাব প্রবল হতে দেখা যাচ্ছে তার কারণ নিশ্চয়ই একাধিক স্ত্রী গ্রহণ নয়, বরং তার কারণ নিহিত রয়েছে শিক্ষা বিষয়ক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে।
পূর্বের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলামে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যবস্থা একটি নৈতিক ও মানবিক ব্যবস্থা। নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা রক্সা এবং মানবতার স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এ ব্যবস্থা বিশ্বস্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে। নৈতিক ব্যবস্থা এজন্যে যে, একজন পুরুষ নিজ ইচ্ছামতো যে কোনো মেয়েলোককে যে কোনো সময়ে নিজের অঙ্গশায়িনী করে নিতে পারে না, পারে না বিয়ের বাইরে যাকে তাকে দিয়ে তার যৌন লালসা চরিতার্থ করে নিতে। আর তার স্ত্রীর বর্তমানে তিনজনের অধিক স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌন মিলন সম্প্ন করতে পারে না।
তাছাড়া কারো সঙ্গে গোপনে, অবৈধভাবে কেনো মেয়েলোকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারা যায় না। বরং রীতিমত বিয়ে সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক, যার পিছনে ছেলে ও মেয়ের অলী-গার্জিয়ান তথা সমাজের লোকদের থাকবে পূর্ণ সমর্থন, যার দরুন নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা বিনষ্ট হওয়ার কোনো কারণ ঘটবে না সেখানে।
আর সে ব্যবস্থা মানবিক এজন্যে যে, একজন স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যে পুরুষ অপর স্ত্রীর প্রয়োজন তীব্রভাবে বোধ করে, সে বাধ্য হয় বিয়ে ছাড়াই অবৈধভঅবে বান্ধবী আর প্রণয়ী যোগাড় করতে। সে তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক রাখবে, তাদের মধু লুটবে অথচ সে তাদের স্বামী হবে না, গ্রহণ করবে না কোনো সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব কিংবা সে বাধ্য হবে হাটে-বাজারে, শহরে-নগরে, কোঠাবাড়িতে অবস্থিত দেহপসারিণীদের দ্বারে দ্বারে লজ্জাস্করভাবে ঘুরে বেড়াতে। এতে করে তার মনুষ্যত্ব বিনষ্ট হয়ে যাবে, লাঞ্ছিত হবে, কলংকিত হবে তার ভিতরকার মানুষ।
উপরন্তু সে দেহপসারিণী কিংবা বান্ধবী-প্রণয়িনীদের জন্যে যৌন মিলনের বিনিময়ে যে বিপুল অর্থ-সম্পদ ব্যয় করবে, তাতে তার অর্থনৈতিক ধ্বংস টেনে আনবে, অথচ তা দ্বারা মানুষের সামাজিক কোনো কল্যাণই সাধিত হবে না। এ যৌন মিলনের পরিণামে গড়ে উঠবে না নতুন কোনো মানব-সমাজ।
একাধিক স্ত্রী গ্রহণের আইনসম্মত অবকাশ থাকলে এসব ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি কখনো দেখা দিতে পারে না। এ কারণে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ইসলামী বিধানযে কত নির্ভুল, কত স্বভাবসম্মত ও যুক্তিপূর্ণ ব্যবস্থা, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
কিন্তু পাশ্চাত্য সমাজে যেখানে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, সেকানে কার্যত বহু স্ত্রী ভোগরে বীভৎস নৃত্য সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। সেজন্যে আইনে কোনো বাধা নেই, বরং আইনের অধীন-আইনের চোখের সামনেই অনুষ্ঠিত হয় এ জঘন্য কাজ।
-যদিও সেসব স্ত্রীলোককে বিয়ে করতে রীতিমত স্ত্রীত্বের মর্যাদায় গ্রহণ করা হয় না, তারা হয় বান্ধবী আর প্রণয়িনী মাত্র।
সে সমাজের পুরুষরাও চারজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে না, সেখানে যৌন সম্পর্ক চলে যথেষ্ট বাধা-বন্ধনহীন এবং সীমা-সংখ্যাহীন।
এরূপ অবাধ যৌন চর্চায় না গড়ে ওঠে গোপনে, সমাজ সমর্থনের বাইরে। এর ধ্বংসকারিতা আজকে পাশ্চাত্য সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে।
এক কথায় বলা যায়, ইউরোপেও বহু স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ কার্যথ চালু রয়েছে। যদিও তা অবৈধভাবে। আর ইসলামেও একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ সমর্থিত, কিন্তু আইনের সামায্যে এবং চার সংখ্যার সীমার মধ্যে। এ দুয়ের মধ্যে কোনটি যে ভালো ব্যবস্থা, তা যেনো কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি সহজেই নির্ণয় করতে পারে।
বস্তুত এ পর্যায়ে ইউরোপীয় সমাজ আর ইসলামী সমাজে যে পার্থক্য দেখা যায়, তা এক স্ত্রী গ্রহণ আর বহু স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে নয়, আসল পার্থক্য হচ্ছে সীমিত সংখ্যার বৈধ স্ত্রী গ্রহণ আর সীমা-সংখ্যাহীন স্ত্রী ভোগের দায়িত্বহীন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। একটি করে মানুষকে শালিনতাপূর্ণ, দায়িত্বশীল আর অপরটি করে দেয় যেন লালসার দাস, দায়িত্বহীন, উচ্ছৃঙ্খল।
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) কর্তৃক ইসলামের প্রতিষ্ঠা লাভেল পূর্বে আরব সমাজেও সীমা-সংখ্যাহীন বহু স্ত্রী ভোগ করার নানাবিধ উপায় কার্যকর ছিল। ইসলাম এ স্বাভাকি প্রবণতার সংশোধন করেছে। সীমা-সংখ্যাহীন স্ত্রী ভোগ করার পথ বন্ধ করে চারজন পর্যন্ত সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। দ্বিতীয়, বিয়ের বাইরে নারী-পুরষের যৌন সম্পর্ককে চিরতরে হারাম করে দিয়েছে এবং তৃতীয়, স্ত্রীদের মধ্যে আদল ও ইনসাফ কায়েম করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। একাধিক স্ত্রী গ্রহণের জন্যে একে জরুরী শর্তরূপে নির্ধারিত করে দিয়েছে। আর চতুর্থ, এ ব্যাপারে স্বামীদেরম নে আল্লাহর আযাবের ভয় জাগিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ যে কত বড় সংশোধণী কাজ তা সেই সমাজের অবস্থাকে সামনে রেখে চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে। রাসূলে করীমের এ সংশোধনী কাজ বাস্তবায়িত হওয়ার পর সমাজের মূল গ্রন্থিতে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর এবং তা পারিবারিক ইতিহাসে চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
রাসূলে করীমের গঠিত সমাজে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ ছিল, কিন্তু সেখানে তার খারাপ দিক কখনো প্রবল হয়ে উঠতে পারে নি। কোনো নারীর কিংবা স্বামীর জীবন সেখানে তিক্ত-বিষাক্তও হয়ে ওঠেনি, স্ত্রীদের পরস্পরের মধ্যে হিংসা দ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠেনি আর তাদের সন্তানরাও হয়নি পরস্পরের শত্রু। ইসলাম যুগের প্রেম-ভালোবাসা, সম্প্রীতি-সদ্ভাবের পূত ভাবধারায় পরিপূর্ণ ছিল, ছিল অকৃত্রিম স্বামী-ভক্তি, ঐকান্তিক নিষ্ঠা। সেখানে এক স্ত্রীসম্পন্ন পরিবার আর একাধিক স্ত্রী সম্পন্ন পরিবারের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না।
আর এ কারণেই ইসলামী সমাজে নারীর সংখ্যাধিক্য কখনো সমস্যা হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেনি। ইহজগতের পর থেকেই ইসলামী যুদ্ধ-জিহাদের সূচনা হয়, তারপরে প্রায় দু’শতাব্দীকাল পর্যন্ত তা চলতে থাকে। এসব যুদ্ধ-জিহাদে হাজার হাজার পুরুষ শহীদ হয়েছে, হাজার হাজার নারী হয়েছে বিধবা, স্বামীহারা কিংবা অবিবাহিত যুবকদের শহীদ হওয়ায় অবিবাহিতা যুবতীদের সংখ্যা পেয়েছে বৃদ্ধি। কিন্তু কোনো দিন যুদ্ধ করতে সমর্থ যুবকশক্তির অভাবও দেখা দেয়নি, তেমনি অভাব ঘটেনি মেয়েদের জন্যে স্বামীর। অথচ আধুনিক ইউরোপ মাত্র দুটো মহাযুদ্ধের ফলেই পুরুষদের সংখ্যাল্পতা ও নারীর সংখ্যাধিক্যের বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অভাব পড়েছে যুদ্ধযোগ্য যুবশক্তি।
এসব দৃষ্টিতে বিচার করলেও একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ইসলামী ব্যবস্থার সৌন্দর্য ও যথার্থতা সহজেই অনুধাবন করা যায়।