বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিবার
পূর্বের আলোনা থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, পরিবার হচ্ছে একিট ছোট্ট সমাজ-সংস্থা (Small Community)। কেননা বৃহত্তম সমাজ-সংস্থার পৌরহিত্যে সাধারণ জীবনের সাথে মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করে দেয় এই পরিবার। এর ফলেই সাধারণ ঐতিহ্য ও সাধারণ ভাবধারাকে বৃহত্তর সমাজে উপস্থাপিত করার সুযোগ হয়ে থাকে।
সেই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, পরিবার হচ্ছে একটি যৌন সংস্থা (association of sex), সন্তান প্রজননের একটি স্থায়ী কারখানা। আর তা সংস্থাপিত রয়েছে বিয়ে সম্বন্ধের (Contract of marriage) ওপর। তার অর্থ, পরিবার একই সঙ্গে একটি সম্প্রদায় (Community) এবং একটি মহাসম্মিলন (association)। অন্তত এ দুয়ের মাঝখানে পরিবার হচ্ছে একটি অপরিহার্য সোপান (Bridge)।
পরিবার –স্থায়ী সংস্থা
পরিবার কি কোনো কৃত্রিম ও ইচ্ছানুক্রমে উদ্ভাবিত প্রতিষ্ঠান? তার কি অক্ষয় ও স্থায়ী হয়ে থাকা উচিত? তার কি একটি বিশ্বজনীন, সর্বদেশের ও সর্বকালের প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত নয়? বস্তুত মানব ইতিহাসের অতিপ্রাচীন কালেও এ পরিবারের অস্তিত্ব দেখা গেছে এবং মানুষ যদ্দিন এ ধরিত্রীর বুকে থাকবে, তদ্দিন পরিবার অবশ্যই টিকে থাকবে। কালের কুটিল গতি তাকে কিছুতেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে পারবে না। প্লেটো থেকে এইচ.জি. ওয়েলস পর্যন্ত দার্শনিকদের প্রস্তাব অনুযায়ী সন্তান-সন্ততিকে বাপ-মা’র সংস্পর্শে ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা যেতে পারে বটে, কিন্তু এ পদ্ধতিতে সত্যিকার মানুষ তৈরীর জন্যে কোনো সফল প্রচেষ্টা আজো কার্যকর হতে দেখা যায়নি। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, পরিবার হচ্ছে এক স্থায়ী ও অক্ষয় মানবীয় সংস্থা (Human institution) এবং এর এই স্থিতিস্থাপকতার কারণ মানব প্রকৃতির গভীর সত্তায় নিহিত। অন্য কথায় পরিবার স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যবর্তী কোনো ক্ষণস্থায়ী যোগাযোগের ব্যাপারে আদৌ নয়।
প্লেটোর অভিমত
দার্শনিক প্লেটো পরিবারকে একটি স্বাভাবিক (natural institution) বলে স্বীকার করে নিতে পারেন নি। তাঁর মতে পরিবারই হচ্ছে সমাজ জীবনের সব অনৈক্যের (Discord) মূলীভূত কারণ। কেননা এই পরিবারই মানুষকে শিক্ষা দেয়ঃ আমি ও তুমি, আমার ও তোমার। অতএব, তাঁর মতে পরিবার প্রথার উচ্ছেদই বাঞ্ছনীয়। তখন সব নারী-পুরুষ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাধীন ব্যারাকে বসবাস করবে এবং রাষ্ট্রকর্তাদের পর্যবেক্ষণাধীন শ্রেষ্ঠ নর শ্রেষ্ঠ নারীকে গ্রহণ করবে তাদের যৌন-লালসা নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে। তাদের এই যৌন মিলনের ফলে যখন কোনো নারীর সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তখন-তখনই সে সন্তানকে সরকারী নার্স অন্যত্র তুলে নিয়ে যাবে, যেন সে সন্তান তার পিতামাতাকে জানতে না পারে এবং পিতামাতাও যেন চিনতে না পারে তাদের ঔরসজাত –গর্ভজাত সন্তানকে। এরূপ কার্যক্রমের সর্বশেষ ফল দাঁড়াবে এই –এক দিনে প্রসূত সকল সন্তানকে সব বাবা-মায়ের নিজের সম্মিলিত সন্তান বলে মনে করতে থাকবে। আর কোনো পিতামাতা কোনো সন্তানকেই নিজের সন্তান বলে দাবি করার এবং অন্যদের থেকে পৃথক করে দেখবার সুযোগ পাবে না। এর ফলে রাষ্ট্র সর্ব দিক থেকেই সুরক্ষিত থাকতে পারবে। অন্যথায়, প্রত্যেকটি পরিবারের প্রয়োজন নির্বাহের জন্যে আলাদা আলাদা সম্পত্তি সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেবে এবং রাষ্ট্রের সমগ্র এলাকা ‘আমার’ ও ‘তোমার’ মধ্যে বণ্টিত ও খণ্ডিত হয়ে পড়বে। কিন্তু প্রস্তাবিত পন্থায় পরিবারও যেমন নির্ভুল হবে, তেমনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বিলুপ্ত হবে। আর এর দরুন সমাজের সব বিভেদ ও অনৈক্য বিদূরিত হবে এবং সব অসামঞ্জস্যও বিলীন হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এর দরুন গোটা রাষ্ট্রই পরিণত হবে একটি মাত্র পরিবারে, আর সে পরিবারের সদস্যরূপে গণ্য হবে দেশের সমস্ত মানুষ।
এ্যারিস্টটলের অভিমত
কিন্তু এ্যারিস্টটল প্লেটোর সাথে এ ব্যাপারে মোটেই একমত নন। তাঁর মতে পরিবার একটি অতি স্বাভাবিক মানবীয় সংস্থা। কেননা এর মূল নিহিত রয়েছে মানুষের নৈত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনের গভীর তলে। কোনো মানুষই ব্যক্তিগতভাবে তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনাবলী পরিপূরণের জন্যে তার প্রয়োজন একজন সহকারীর, সাহায্যকারীর, সহকর্মীর। আর স্ত্রী-ই যে হতে পারে তার সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রকার সহকারী, সাহায্যকারী, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। এ কারণে নারী পুরুষ পরস্পরের যোগাযোগে আসে কেবল পছন্দের মাধ্যমেই নয়, নিজস্ব অভ্যন্তরীণ আবেগের তাড়নায়ও। অতএব গার্হস্থ্য সমাজ –অন্য কথায় পরিবার হচ্ছে প্রথম স্বাভাবিক সমাজ, জনসম্মিলন। কেননা এই সম্মিলন স্ত্রী-পুরুষের অন্তঃস্থিত স্বাভাবিক তৃপ্তির অনুভূতির ফলশ্রুতি।
দ্বিতীয়ত, কেবল সন্তান লাভের কামনায়ই নারী-পুরুষ পরস্পরের সংস্পর্শে আসে না, গার্হস্থ্য জীবনের প্রথম প্রয়োজন –খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়ের দাবি পূরণের জণ্যেও তাদের এই সম্মিলন কাম্য। কাজেই দৈনন্দিন আর্থিক প্রয়োজন পূরণের তাড়নাও গড়ে তোল পরিবার, পারিবারিক জীবন। আর উভয়ের থাকে এই পারিবারিক জীবনে।
তৃতীয়ত, মানুষ স্বভাবের দিক দিয়েই সামাজিক জীব এবং নর ও নারী নিজ নিজ প্রজাতির গুণের কারণে একত্রিত ও সম্মিলিত জীবন যাপনে বাধ্য। এ কারণেই তাদের মিলন অস্থায়ীও যেমন নয়, তেমনি নিছক কার্যকারণ ঘটিতও নয়; বরং এ হচ্ছে একান্তই স্থায়ী ও স্বাভাবিক ব্যবস্থা। এজন্যে পরিবারকে বলা যায়ঃ
A Moral Friendship rejoicing in each other’s goodness. পরস্পরের কল্যাণ কামনাপূর্ণ নৈতিক বন্ধুত্ব।
বস্তুত স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা সৃষ্টি করে এক সুখ ও পরিতৃপ্তি সমাজের প্রথম ধাপ। আর সন্তান লাভ হচ্ছে এ সুখী সমাজের চতুর্থ স্তর। এ কথা প্রমাণ করে যে, পরিবার কেবল যৌন ও পাশবিক জৈবিক জীবন রক্ষার জন্যেই প্রয়োজনীয় নয়, স্বভাবতই এর লক্ষ্য হচ্ছে এক উন্নত নৈতিক পবিত্র ও নির্দোষ জীবন যাপন।
এ সব বাস্তব (Natural) কারণ ছাড়াও –এ্যারিস্টটল বলেনঃ প্রকৃত প্রেম ভালোবাসা ও প্রীতি-প্রণয় অল্প সংখ্যক মানুষের খুবই ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ পরিবেষ্টনীর মধ্যেই উৎকৃষ্ট ও বিকশিত হতে পারে। পরিবেশের লোকসংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে, ভালোবাসার মাত্রাও ঠিক সেই অনুপাতে হ্রাস (decreases) প্রাপ্ত হবে। এ কারণেই বলা যায়, পরিবারের একটি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে ভালোবাসা বেশ দানা বেঁধে, ফুলে ফলে সুশোভিত ও শাখায়-প্রশাখায় বিকশিত হয়ে উঠতে পারে। আর তারই ফলে সাধারণ স্বার্থের ব্যাপারে তা-ই হতে পারে একটি বৃহত্তম ও শক্তিসম্পন্ন মানসিকতা (Strong sentiment)। এখানে প্রেম-ভালোবাসার এ জন্মভূমিকেই যদি –প্লেটোর মত অনুযায়ী –বিনষ্ট করে দেয়া হয়, তাহলে গোটা সমাজ সংস্থাই বিশ্লিষ্ট ও শিথিল হয়ে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত সাধারণ জীবনের অনুকূলে কোনো জোরালো মানসিকতা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন কি, মানসিকতার যে পবিত্র সুকুমার ও সুন্দরতম অনুভূতি তাও নিঃশেষে মিলিয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে শেষ কথা এই যে, পরিবার ভেঙ্গে দিলে মানব-সন্তান তার নৈতিক উর্দ্বতন হারিয়ে ফেলবে। কেননা তারা পিতামাতার স্বাভাবিক স্নেহ-বাৎসল্য থেকে হবে বঞ্চিত। একজন নার্স বা ধাত্রী কি কোনো দিক দিয়েই মা’র স্থলাভিষিক্ত হতে পারে, -যে মা দশমাস কাল যাবত স্বীয় গর্ভে বত্রিশ নাদী দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছে তার সন্তানকে! আর বড় কষ্ট ও মর্মান্তিক বেদনা-যন্ত্রণা ভোগ করে তাকে প্রসব করেছে? –এসব কারণে মা সন্তানের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই যতখানি দরদ ও রক্তের টান অনুভব করবে, ধাত্রী বা নার্স কি তার এক লক্ষ ভাগের একভাগও অনুভব করতে পারে? –অথচ মানব শিশুর মানুষ হয়ে গড়ে উঠবার জন্যে তা একান্তই অপরিহার্য।
তাছাড়া প্রত্যেকটি মানুষই স্বাভাবিকভাবে নিজস্ব সম্পত্তি গড়ে তুলতে চেষ্টিত হয়ে থাকে। এ তার নিজেরই স্বার্থ, নিজেরই উৎসাহ-উদ্দীপনা। তা যদি সাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়, তাহলে তার প্রতি সাধারণের অযত্ন ও অনাসক্তি হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। শিশু সন্তানদের ব্যাপারেও একথা অনস্বীকার্য। তাই বলতে হচ্ছে, প্লেটোর কল্পিত সমাজে শিশু-সন্তান যখন কারো নিজস্ব হবে না, হবে সকলের সর্বসাধারণের সমান আপন(?) তখন প্রকৃতপক্ষে সে শিশু কারোরই নিজের হবে না। তাদের প্রতি সকলের ও সর্বসাধারণের অবজ্ঞা ও অবহেলা হওয়াই স্বাভাবিক। এভাবে একটি মহামূল্যে সেবা ও দানের কাজ তার সব মূল্য ও মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে। সকলেরই ‘আপন’ বানাবার চেষ্টা কারোই ‘আপন’ বানাবে না, মনস্তত্ত্বের এ সত্য কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও পৌরবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও বলা যায়, একটি সুষ্ঠু পরিবার সুস্থ নাগরিক জীবন গড়ে তোলার জন্যে অপরিহার্য। বরং বলা যায়, সুষ্ঠু নাগরিক জীবনের জন্যে পরিবারই হচ্ছে প্রথম স্বাভাবিক জীবকেন্দ্র। এর ফলে যদিও একজন নাগরিক পরিবারকেন্দ্রিক এবং সাধারণ সমাজ বিমুখ হয়ে পড়তে পারে; কিন্তু তবুও তার ক্ষতির পরিমাণ পরিবার ধ্বংস করার অনিবার্য পরিণতির তুলনায় নিশ্চয়ই অনেক কম। সত্য বলতে কি মায়ের বাৎসল্যপূর্ণ চুম্বন এবং পিতার স্নেহপূর্ণ সেবাযত্নের পবিত্র পরিবেশেই জন্ম নিতে পারে মানুষের ভবিষ্যৎ সমাজ। নাগরিকত্বের প্রথম শিক্ষা মায়ের ক্রোড়ে আর বাবার স্নেহছায়াতেই হওয়া সম্ভব। যে দেশে পরিবার নেই কিংবা নেই পারিবারিক শৃঙ্খলা পবিত্রতা সেখানকার বংশধর বা ভবিষ্যত সমাজ যে কতখানি উচ্ছৃঙ্খল ও চরিত্রহীন –অতএব দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে গড়ে উঠেছে, বর্তমান ইউরোপ-আমেরিকা তথা চীন ও রাশিয়া তার সুস্পষ্ট নিদর্শন। এ দৃষ্টান্ত দেখার পরও যারা পরিবারকে অস্বীকার করার দুঃসাহস করে, তাদেরকে মানবতার শত্রু বলাই শ্রেয়।