প্রথম অধ্যায়
পরিবার
পরিবার রাষ্ট্রের প্রথম স্তর, সামগ্রিক জীবনের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর (First Foundation Stone)। পরিবারেরই বিকশিত রূপ রাষ্ট্র। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, মাতা-পিতা, ভাই-বোন প্রভৃতি একান্নভুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পরিবার। বৃহদায়তন পরিবার কিংবা বহু সংখ্যক পরিবারের সমন্বিত রূপ হচ্ছে সমাজ। আর বিশেষ পদ্ধতিতে গঠিক সমাজেরই অপর নাম রাষ্ট্র। একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রের মূলে নিহিত রয়েছে সুসংগঠিত সমাজ রাষ্ট্র, সমাজ। ও পরিবারের ওতপ্রোত এবং পারস্পরিকভাবে গভীর সম্পর্কযুক্ত। এর কোন একটিকে বাদ দিয়ে অপর কোনো একটির কল্পনাও অসম্ভব।
পরিবার সমাজেরই ভিত্তি। রাষ্ট্র সুসংবদ্ধ সমাজের ফলশ্রুতি। পরিবার থেকেই শুরু হয় মানুষের সামাজিক জীবন। সামাজিক জীবনের সুষ্ঠুতা নির্ভর করে পারিবারিক জীবনের সুষ্ঠুতার ওপর। আবার সুষ্ঠু পারিবারিক জীবন একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রের প্রতীক। পরিবারকে বাদ দিয়ে যেমন সমাজের কল্পনা করা যায় না, তেমনি সমাজ ছাড়া রাষ্ট্রও অচিন্তনীয়। তিন তলাবিশিষ্ট প্রাসাদের তৃতীয় তলা নির্মাণের কাজ প্রথম ও দ্বিতীয় তলা নির্মাণের পরই সম্ভব, তার পূর্বে নয়।
একটি প্রাসাদের দৃঢ়তা ও স্থায়ীত্ব তার ভিত্তির দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের উপর নির্ভরশীল। তাই সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তি এই পরিবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার ও সমাজের সুসংবদ্ধ দৃঢ়তার উপর রাষ্ট্রের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব তেমনি নির্ভরশীল।
পরিবারের অপরিহার্যতা
মানুষ সামাজিক জীব। পরিবারের মধ্যেই হয় মানুষের এ সামাজিক জীবনের সূচনা। মানুষ সকল যুগে ও সকল কালেই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক জীবন যাপন করেছে। প্রাচীনতমকাল থেকেই পরিবার সামাজিক জীবনের প্রথম ক্ষেত্র বা প্রথম স্তর হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সোজা কথায় বলা যায়, বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের যে গুরুত্ব, প্রাচীনতম কালে –মানুষের প্রথম পৃথিবী পরিক্রমা যখন শুরু হয়েছিল, মানবতার সেই আদিম শৈশবকালে পরিবার ছিল সেই গুরুত্বের অধিকারী। বংশ ও পরিবার সংরক্ষণ এবং তার সাহায্য-সহায়তার লক্ষ্যে দুনিয়ার বড় বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে। উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনও চিরকাল সুনাম-সুখ্যাতি ও গৌরবের বিষয়রূপে গণ্য হয়ে এসেছে। আর নীচ বংশে ও নিকৃষ্ট পরিবারে জন্মগ্রহণ বা আত্মীয়তা লাভ মানুষের হীনতা ও কলংকের চিহ্নরূপে গণ্য হয়েছে চিরকাল। যে ব্যক্তি নিজ পরিবারের হেফাযত, উন্নতি বিধান ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে, সে চিরকালই বংশের গৌরব, -Hero রূপে সম্মান ও শ্রদ্ধা লাভ করতে সমর্থ হয়েছে পরিবারস্থ প্রত্যেকটি মানুষের নিকট।
পরিবারের ভিত্তি
প্রাচীকাল থেকেই পরিবার দু’টি ভিত্তির উপর স্থাপিত হয়ে এসেছে। একটি হচ্ছে মানুষের প্রকৃতি-নিহিত স্বভাবজাত প্রবণতা। এই প্রবণতার কারণেই মানুষ চিরকাল পরিবার গঠন করতে ও পারিবারিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে এবং পরিবারহীন জীবনে মানুষ অনুভব করেছে বিরাট শূন্যতা ও জীবনের চরম অসম্পূর্ণতা। পরিবারহীন মানুষ নোঙরহীন নৌকা বা বৃন্তচ্যুত পত্রের মতোই স্থিতিহীন।
আর দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে সমসাময়িককালের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় পরিবার ছিল বিশাল বিস্তৃত ক্ষেত্র। সমাজ ও জাতি গঠনের জন্যে তা-ই ছিল একমাত্র উপায়। এ কারণে প্রাচীনকালের গোত্র ছিল অধিকতর প্রশস্ত; এতদূর প্রশস্ত যে, নামমাত্র রক্তের সম্পর্কেও বহু এক-একটি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে পারত। এমন কি বাইরে থেকে যে লোকটিকে পরিবারের মধ্যে শামিল করে নেয়া হতো, তাকেও সকলেই উক্ত পরিবারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে নিত। পরিবারের নিজস্ব একান্ত আপন লোকদের জান-মাল ও ইযযতের যেমন রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো, সেই বাইরে থেকে আসা লোকটিরও হেফাযত করা হতো অনুরূপ গুরুত্ব সহকারে। ইসলাম পূর্ব আরব সমাজে ‘মুতাবান্না’ –পালিত পুত্র গ্রহণের রীতি ছিল, একথা সর্বজনবিদিত। ইউরোপে এই সেদিন পর্যন্তও পালিত পুত্রকে আইন সম্মতভাবেই বংশোদ্ভূত সন্তানের সমপর্যায়ভুক্ত মনে করা হতো। রোমান সভ্যতার ইতিহাস এর চেয়েও অগ্রসর। সেখানে জন্তু-জানোয়ারকে পর্যন্ত পরিবারের অংশ বলে মনে করা হতো; মর্যাদা তার যত কমই হোক না কেন। এ থেকে এ সত্য জানতে পারা যায় যে, প্রাচীনকালে অর্থনৈতিক প্রয়োজনেও পরিবারের পরিধি অধিকতর প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছিল।
সেকালে জীবন-জীবিকার বেশির ভাগই নির্ভরশীল ছিল চতুষ্পদ জন্তু ও কৃষি উৎপাদনের ওপর। এজন্যে প্রত্যেকটি পরিবারই এক বিশেষ ভূখণ্ডের ওপর প্রাচীন নির্মাণ করে নিজেদের এলাকা নির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত করে রাখত। সে সীমার মধ্যে অপর কোনো পরিবারের লোক বা জন্তু-জানোয়ার পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারত না। এর ফলে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব-কলহের সৃষ্টি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর তাদের বিশেষ কোনো স্থানে একত্রিত ও সম্মিলিত হওয়ার মতো কেন্দ্র বলতে কিছুই ছিল না। তাদের মধ্যে ঐক্যের কোনো সূত্র বর্তমান থাকলেও উপায়-উপাদানের অভাব ও গোত্রীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি এদিকে অগ্রসর হওয়ার পথে কঠিন বাঁধা হয়ে দাঁড়াত। এমনকি এক ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে যে-সব গোত্র বাস করত এবং যাদের মধ্যে জীবনের মূল্যমান ছিল এক ও অভিন্ন, তারাও পরস্পরের শত্রু এবং যুধ্যমান ও দ্বন্দ্ব-সংগ্রামশীল হয়ে থাকত। প্রতিটি গোত্র অপর গোত্রকে চরম শত্রুতার দৃষ্টিতে দেখত, পরস্পরের ক্ষতি সাধনের জন্যে সম্ভাব্য সকল প্রকার চেষ্টাই তারা চালাত। মানবতার এই প্রাথমিক স্তরে নিজেও নিজ পরিবার-গোত্রের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কোনো বিষয় ও সমস্যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করাও সম্ভব হত না কারো পক্ষে। আর চিন্তা ও কর্মের শত-সহস্র যোজন পার হয়ে আসার পর আজ মানুষও পারছে না আন্তর্জাতিক ও বিশাল মানবতার দৃষ্টিতে চিন্তা করার অভ্যাস করতে।
মানুষের নিকট নিজের জান ও মাল চিরকালই অত্যন্ত প্রিয় সম্পদ। এসবের জন্যেই মানুষ চেষ্টা ও শ্রম করত; সকল প্রকার বিপদ ও ঝুঁকির মুকাবিলা করত এবং তার সংরক্ষণের জন্যে সম্ভাব্য সকল রক্ষা-ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হতো। তাদের প্রিয় জান-প্রাণ সুরক্ষিত রাখার সব উপায় ও পথ অবলম্বন করা হতো। আর এবাবেই তাদের ধন-সম্পদ ও জীবন-জীবিকার দ্রব্য সামগ্রী সংরক্ষিত হতো।
মানুষ যখন দেখতে পায় যে, তার জান মালে সংরক্ষণ তার পরিবার ও পারিবারিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিপদ-মুসিবতে ভারাক্রান্ত সমগ্র পরিবেশের মধ্যেতার পরিবারই হচ্ছে তার একমাত্র আশ্রয় –এ পরিবারই তাকে সর্বতোভাবে সংরক্ষণ করছে, শত্রুদের মুকাবিলায় সব সময়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, তার দুঃখ-দরদ ও বিপদ-মুসিবতের বেলায় তার সাথে সমানভাবে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তখন তার পক্ষে পরিবারের সাথে পূর্ণমাত্রায় জড়িত ও একাত্ম হয়ে থাকাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এক আরব কবি এ কারণেই বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
বিপদ-মুসিবতে তার ভাই যখন ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসে, আওয়াজ তোলে, তখন সে তার এ কাজের কোনো যুক্তি খুঁজে বেড়ায় না।
তখন শুধু বলেঃ
(আরবী****************************************************************)
আমি নিকটাত্মীয়তার হক আদায় করেছি, তোমার ভাগ্যের শপথ, যখন কোনো বিপদের ব্যাপার ঘটবে, তখন আমি অবশ্যই উপস্থিত থাকব।
(আরবী*********************************************************)
কোনো কঠিন বিপদকালে আমাকে ডাকা হলে আমি তোমার মর্যাদা রক্ষাকারীদের মধ্যে থাকব, শত্রু তোমার ওপর হামলা করলে আমি তোমার পক্ষে প্রতিরোধ করব।
গোত্র ও পরিবারের এক-একটি ব্যক্তি যখন তার এতখানি সাহায্যকারী ও সংরক্ষক হয়, তখন সে নিজেও পরিবার ও পরিবারের প্রত্যেকের জন্য নিজের সব কিছু কুরবান করতে প্রস্তুত না হয়ে কিছুতেই পারে না। তার বিপদের সময় নিজের জীবন ও প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে অবশ্যই প্রস্তুত হবে। আর এ ভাবধারা থেকেই গোত্র ও পারিবারিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভাবধারা উৎসারিত হয়; আপন ও পরের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়; তখন নিজ পরিবারের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সুখ্যাতি প্রচার করা হয়; এ হচ্ছে মনের স্বাভাবিক ভাবধারার মূর্ত প্রকাশ। তাদের কীর্তিকলাপ নিয়ে গৌরব করা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করাক নিজের সৌভাগ্যের বিষয় বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানকালের রাজনৈতিক ও দলীয় নেতার প্রতি যেরূপ আনুগত্য ও ভক্তি-শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি ঘটে, তারই তাগিদে তাদের কীর্তিগাঁথাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তাদের ভুল-ভ্রান্তিকে ভালো অর্থে গ্রহণ করে তাকে সুন্দর ব্যাখ্যার চাকচিক্যময় বেড়াজালে লুকিয়ে রাখার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করা হয়; সেকালে বংশীয় নেতা ও গোত্রপতিদের সম্পর্কেও গ্রহণ করা হতো অনুরূপ ভূমিকা। কেননা তাদের স্বপ্ন-সাধের বাস্তব প্রতিফলন তারা তাদের মধ্যেই দেখতে পেত। তাদের সাথে বন্ধন স্থাপন করেই তারা নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়িত করে তুলত।
এক কথায় বলা যায়, প্রাচীনকালে পরিবার ছিল এ কালের এক-একটি রাজনৈতিক দলের মতোই। এজন্যে সেকালের রাষ্ট্রনীতির বিস্তারিত রূপ আমরা দেখতে পাই সেকালের এক-একটি পরিবার-সংস্থার মধ্যে। সেকালের পরিবার অপর কোনো উচ্চতর উদ্দেশ্য পালনের বাহন ছিল না; বরং পরিবারই ছিল সেখানে মুখ্যতম প্রতিষ্ঠান। মানুষের পরস্পরের মধ্যে সেখানে সম্পর্ক স্থাপিত হতো ‘রেহেম’ ও রক্ত ন্যায়ের ভিত্তি ছিল বংশীয় সম্পর্ক, সেখানে বংশ ও পরিবারের গুরুত্ব যে কত দূর বেশী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা চলে। এরূপ অবস্থায় মানুষ নিজেকে রক্ষা করার জন্যে আলোচ, পানি ও হাওয়ার মতো পরিবার ও পারিবারিক জীবনের সাথে জড়িত হয়ে থাকতে বাধ্য হবে –এটাই স্বাভাবিক। অন্যথায় সে হয় নিজেকে আপন লোকেরই জুলুম-নির্যাতনের তলে নিষ্পিষ্ট করবে অথবা অপর লোকদের দ্বারা হবে সে নির্যাতিত, নিগৃহীত এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে চিরবঞ্চিত।
কিন্তু সভ্যতার যখন ক্রমবিকাশ সংঘটিত হলো, জীবন-জীবিকা ও জীবনযাত্রা নির্বানের জন্য অপরিহার্য অন্যান্যা উপায়-উপাদান ও দ্রব্য-সামগ্রী যখন মানুষ করায়ত্ত করতে সমর্থ হলো তখন বিভিন্ন পরিবার ও গোত্রের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা স্থাপনের নানা পথ ও উপায় উদ্ভাবিত হলো। বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের মধ্যে বংশ ও রক্তের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের একই কেন্দ্রে মিলিত ও একত্রিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হলো। এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে একতা ও ঐক্য বিধানের জন্যে কেবল আত্মীয় ও রক্ত সম্পর্কই একমাত্র ভিত্তি হয়ে থাকল না, স্বাভাবিক ও জৈবিক উপায় উপাদানের ঐক্য, ভৌগোলিক সীমা, ভাষা ও বর্ণের অভিন্নতা প্রভৃতি তার স্থান দখল করে বসল। ফলে পরিবার ও গোত্র সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণা তলিয়ে যেতে লাগল, আর তার স্থানে জাতীয়তার বীজ বপিত ও অংকুরিত হয়ে ক্রমশ তা বর্ধিত হতে থাকল। পরিবার ও পারিবারিক ব্যবস্থা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। জাতি ও স্বদেশের প্রতি মানুষের লক্ষ্য আরোপিত হলো। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এবং ঘৃণা শত্রুতার মানদণ্ডও তখন পুরাপুরিভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেল।
এ কারণে পরিবার আজকের দুনিয়ার সমাজ-বিজ্ঞানীদের নিকট অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, পরিবারের বাস্তবিকই কোনো গুরুত্ব আছে কি? আর গুরুত্ব থাকলেও তা কতখানি?
মূলত এ প্রশ্ন অত্যন্ত গভীর সমাজতত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত। এর জবাব না পাওয়া গেলে সমাজের অন্যান্য সমস্যারও কোনো সমাধান লাভ করা সম্ভব হতে পারে না। কাজেই বিষয়টিকে নিম্নোক্তভাবে কয়েকটি দিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখতে হবেঃ
১. সমাজের সাফল্য ও উন্নতি লাভের জন্যপরিবার কি সত্যিই জরুরী?
২. পুরুষ ও নারীর মাঝে সম্পর্কের সাধারণ রূপ কি এবং উভয়ের কর্মক্ষেত্রের সীমা কতদূর প্রসারিত?
৩. পরিবারের ক্ষেত্রই বা কতখানি প্রশস্ত?
৪. পরিবারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি?
সমাজ পরিসরে পরিবারের গুরুত্ব
পরিবার গঠন ও রূপায়ণ এবং তার সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ ইত্যাদি সম্পর্কে কথা বলার আগে একটি মৌলিক প্রশ্নের মীমাংসা করে নিতে হবে; আর তা হচ্ছে সমাজ ও সামাজিক জীভনের সাফল্যের জন্যে পরিবার কি সত্যই অপরিহার্য? সুষ্ঠু রীতি-নীতির ভিত্তিতে পরিবার গঠন না করে সামগ্রিক কল্যাণের পথে অগ্রসর হওয়া কি সমাজের পক্ষে –সমাজের ব্যক্তিদের পক্ষে সম্ভব? পারিবারিক জীবন ও পারিবারিক জীবনের সমস্যা কি আমাদের জীবনে এতই গভীর ও জটিল যে, তাকে উপেক্ষা করলে জীবন মহাশূন্যতায় ভরে যাবে? ….কিংবা এ বিষয়গুলো তেমন গুরুতর কিছু নয়; এবং সহজেই তাকে উপেক্ষা করা চলে? পরিবার ভেঙ্গে দেয়ার পর রাষ্ট্র ও সরকার কি সুষ্ঠু সামাজিক জীবন গঠনের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারবে?
যেহেতু সমাজের উন্নতি কিংবা পতনের ব্যাপারে পরিবার ও পারিবারিক জীবন যদি সত্যিই কোনো অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ে মাথা ঘামানো অর্থহীন। আর যদি সমাজের সাফল্য ও সামাজিক জীবনের কল্যাণ লাভের ওপর নির্ভরশীলই হয়ে থাকে, তাহলে তাকে উপেক্ষা ও অবহেলা করা গোটা সমাজের পক্ষেই মারাত্মক। কাজেই প্রশ্নটির জবাব নির্ধারনের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী –স্বামী ও স্ত্রী –সঠিক মর্যাদা ও স্থান নির্ধারন-ও এ প্রশ্নের জবাবের ওপরই নির্ভরশীল।
মানব জীবনের লক্ষ্য
শান্তি, সুখ, তৃপ্তি, নিশ্চিন্ততা ও নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ লাভই হচ্ছে মানব-জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, মানব মনের ঐকান্তিক কামনা ও বাসনা। এদিক দেয় সব মানুষই সমান। উচ্চ-নীচ, ছোট-বড়, গরীব-ধনী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রামবাসী-শহরবাসী এবং পুরুষ ও নারীর মধ্যে এদিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। সিংহাসনারূঢ় বাদশাহ আর ছিন্নবস্ত্র পরিহিত দীনাতিদীন কুলি-মজুর সমানভাবে দিন-রাত্রি এ উদ্দেশ্যেই কর্ম নিরত হয়ে রয়েছে। কর্মপ্রেরণার এ হচ্ছে উৎসমূল। এ জিনিস যদি কেউ সত্যিই লাভ করতে পারে তাহলে মনে করতে হবে, সে জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ লাভ করেছে। তার জীবন সত্যিকারভাবে সাফল্য ও চরম কল্যাণ লাভে ধন্য হয়েছে।
নারী ও পুরুষ
সমাজের নারী এ সম্পদ লাভ করতে পারে একমাত্র পুরুষের নিকট থেকে, আর পুরুষ তা পেতে পারে কেবল মাত্র নারীর নিকট থেকে। দুই ব্যক্তির পারস্পরিক বন্ধুত্ব-ভালোবাসা, দুই সঙ্গীর সাহচর্য, দুই পথিকের মতৈক্য, দুই জাতির মৈত্রীবন্ধন, ব্যক্তির মনে তার মতবাদ-বিশ্বাসের প্রতি প্রেম, পেশা ও শিল্পের প্রতি মনোযোগিতা প্রভৃতি –যে সব জিনিস জীবন সংগঠনের জন্যে অত্যন্ত জরুরী এর কোনটিই মানুষকে সে শান্তি, সুখ ও নিবিড়তা-নিরবচ্ছিন্নতা দান করতে পারে না, যা লাভ করে নারী পুরুষের কাছ থেকে এবং পুরুষ নারীর নিকট থেকে। এজন্যই আমরা দেখতে পাই যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে অতি স্বাভাবিকভাবেই পারস্পরিক অতীব গভীর আকর্ষণ বিদ্যমান। এ আকর্ষণ চুম্বকের চাইতেও তীব্র। স্বতঃস্ফুর্তভাবেই একজন অপরজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রত্যেকেই নিজের সে হারানো সম্পদ অপর প্রতিক্ষায় উন্মুখ হয়ে কাটিয়েছে যুগের পর যুগ। প্রত্যেক নারীর মধ্যে পুরুষের জন্যে অপরিসীম ভালোবাসা ও আবেগ উদ্বেলিত প্রেম-প্রীতির অফুরন্ত ভাণ্ডার সিঞ্চিত হয়ে আছে। তেমনি আছে প্রত্যেক পুরুষের মধ্যে স্ত্রীর জন্য। এ এমন এক মহামূল্য নেয়ামত, যার তুলনা এই বিশ্ব প্রকৃতির বুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সুখ-দুঃখের সাথী
এ দুনিয়া এক বিরাট-বিশাল কর্মক্ষেত্র। এখানে বসবাসের জন্যে গতি, কর্মোদ্যম ও তৎপরতা-একাগ্রতা একান্তই প্রয়োজনীয়। এ ক্ষেত্রে মানুষ কখনো আনন্দ লাভ করে, কখনো হয় দুঃখ-ব্যথা-বেদনার সম্মুখীন। আর মানুষ যেহেতু অতি সূক্ষ্ম ও অনুভূতিসম্পন্ন সেজন্যে আনন্দ কিংবা দুঃখ তাকে তীব্রভাবে প্রভাবান্বিত করে। ফলে তার প্রয়োজন হচ্ছে সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম সঙ্গী ও সাথীর, যেন তার আনন্দে সে-ও সমান আনন্দ লাভ করে আর তার দুঃখ-বিপদেও যেন সে হয় সমান অংশীদার। নারী কিংবা পুরুষ উভয়ই এ দিক দিয়ে সমান অভাবী। প্রত্যেকেরই সঙ্গী ও সাথীর প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে নারীই হতে পারে পুরুষের সত্যিকার দরদী বন্ধু ও খাঁটি জীবন-সঙ্গিনী। আর পুরুষ হতে পারে নারীর প্রকৃত সহযাত্রী, একান্ত নির্ভরযোগ্য ও পরম সান্ত্বনা বিধায়ক আশ্রয়।
স্থায়ী সম্পর্ক
মানুষের জীবনে সুখ ও দুঃখের এ আবর্তন সব সময়ই ঘটতে পারে –ঘটে থাকে। ফলে তার প্রয়োজন এমন সঙ্গী ও সাথীর, যে সব সময়ই –জীবনের সকল ক্ষেত্রে, সকল সময় ও সব রকমের অবস্থায়ই তার সহচর হয়ে থাকবে ছায়ার মতো এবং অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে করবে সব দায়িত্ব পালন। মানুষের জীবনব্যাপী সংগ্রাম অভিযানের ক্ষেত্রে এ এক স্থায়ী, মৌলিক ও অপরিহার্য প্রয়োজন।
এ প্রয়োজন পূরণের জন্যেই নারী ও পুরুষের মাঝে স্থায়ী বন্ধন সংস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরফলে নারী ও পুরুষ উভয়ই জীবনের তরে পরস্পরের সাথে যুক্ত হতে পারে, যুক্ত হয়ে থাকে। আজীবন এ বন্ধনের সুযোগেই নারী ও পুরুষের জীবন সার্থক হতে পারে এবং তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য হতে পারে কার্যকর। বিয়ের বন্ধনই হচ্ছে এক অকাট্য দৃঢ় সূত্র। এ বন্ধন ব্যতীত আর কোনো প্রকার সংযোগে এ উদ্দেশ্য লাভ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু যে সম্পর্কের পিছনে শুধু ক্ষণস্থায়ী হৃদয়াবেগই হয় একমাত্র ভিত্তি, যার পশ্চাতে কোনো নৈতিক, সামাজিক –তথা আইনানুগ শক্তির অস্তিত্ব থাকে না, তা অনিশ্চিত, ক্ষণ-ভঙ্গুর। যে কোন মুহুর্তে তা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। নিছক আবেগ-উচ্ছ্বাস, পানি-স্রোতের ওপরে পুঞ্জিভূত ফেনারাশি মাত্র, দমকা হাওয়ার মসৃণ চাপেও তা নিমেষে চূর্ণ হতে পারে, উড়ে যেতে পারে, মহাশূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে প্রণয়-প্রেমের এ বন্ধুত্ব। কেননা নিছক আবেগ উচ্ছাসের বশে সাময়িক উত্তেজনা চরিতার্থ করার জন্যে কোনো নারী কিংবা পুরুষকে চিরদিতের তরে গলগ্রহ করে রাখা মানব স্বভাবের পরিপন্থী।
তামাদ্দুনিক প্রয়োজনে নারী-পুরুষের স্থায়ী সম্পর্ক
আরো এক দৃষ্টিতে বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রেম-ভালোবাসা এবং ঘৃণা-উপেক্ষার দুই বিপরীত ভাবধারা বিদ্যমান। মানুষ কাউকে ভালোবাসে সাদরে বুকে জড়িয়ে ধরে; আবার কাউকে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করে দূরে ঠেলে দেয়। কারো জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত হয়, আবার কারো নাম পর্যন্ত শুনতে রাজি হয় না। মানুষের এ স্বভাব এবং এ স্বাভাবিক ভাবধারার ফলেই মানুষের সমাজ ও সভ্যতা গড়ে ওঠে, ক্রমবিকাশ লাভ করে। মানব প্রকৃতির মধ্যে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা থেকে মানুষের প্রকৃতি নিহিত এ ভাবধারা আলোড়িত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
নারী ও পুরুষ উভয়ের এ স্ববাবসম্মত ভাবধারার সংযোগ কেন্দ্র হয়ে থাকে। একজন অপরজনকে ভালোবাসে, আর একজনের মনে অপরজনের কারণে অন্য কারো বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক হয়। পুরুষ নারীকে নিয়ে ঘর বাঁধে আর নারী হয় পুরুষের গড়া এ ঘরের কর্ত্রী। উভয়ই উভয়ের কাছ থেকে লাভ করে পারস্পরিক নির্ভরতা, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিকট থেকে পায় কর্মের প্রেরণা এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজে অগ্রসর হয়ে যায় উদ্যমপূর্ণ গতিতে। নারী ও পুরুষের এ সংযোগ ব্যতীত মানবতার অগ্রগতি আদৌ সম্ভব নয়।