বিয়েতে কুফু’র প্রশ্ন
বিয়েতে কুফু’র কোনো গুরুত্ব আছে কি? এ সম্পর্কে ইসলামের জবাব সুস্পষ্ট ও যুক্তিভিত্তিক।
‘কুফু’ মানে (আরবী**************) ‘সমতা ও সাদৃশ্য’। অন্য কথায়, বর ও কনের ‘সমান-সমান হওয়া’, একের সাথে অপরজনের সামঞ্জস্য হওয়া। বিয়ের উদ্দেশ্যে যখন স্বামী-স্ত্রীর মনের প্রশান্তি লাভ, উভয়ের মিলমিশ লাভের পথে বাধা বা অসুবিধা সৃষ্টির সামান্যতম কারণও না ঘটতে পারে, তার ব্যবস্থা করা একান্তই কর্তব্য।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************)
সেই সমান আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘পানি’ থেকে, তার পরে তাকে পরিণত করেছেন বংশ ও শ্বশুর-জামাতার সম্পর্কে। আর তোমার আল্লাহ বড়ই শক্তিমান।
ইমাম বুখারী ‘বুখারী শরীফ’-এ এ আয়াতটিকে ‘কুফু’ অধ্যায়ের সূচনায় উল্লেখ করেছেন। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তার কারণ উল্লেখ করে বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
এ আয়াতটিকে এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা জানিয়ে দেয়া যে, বংশ ও শ্বশুর-জামাতার সম্পর্ক এমন জিনিস, যার সাথে কুফু’র ব্যাপারটি সম্পর্কিত।
এ আয়াতে মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগ হচ্ছে বংশ রক্ষার বাহন –মানে পুরুষ ছেলে, বংশ তাদের দ্বারাই রক্ষা পায়, ‘অমুকের ছেলে অমুক’ বলে পরিচয় দেয়া হয়। আর দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষার বাহন –মানে কন্যা সন্তানকে অপর ঘরের ছেরের নিকট বিয়ে দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। আর এ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে যাতে করে ভবিষ্যত বংশ রক্ষার ব্যবস্তা হয় সেই দৃষ্টিতে কুফু’ রক্ষা করা একটা বিশেষ জরুরী বিষয়।
কুফু’র মানে যদিও (আরবী************) –সমান-সদৃশ, তবু বিয়ের ব্যাপারে কোন কোন দিক দিয়ে এর বিচার করা আবশ্যক, তা বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ।
এ পর্যায়ে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************)
‘কুফু’ –যা ইসলামের বিশেষজ্ঞদের নিকট সর্বসম্মত ও গৃহীত –তা গণ্য হবে দ্বীন পালনের ব্যাপারে। কাজেই মুসলিম মেয়েকে কাফিরের নিকট বিয়ে দেয়া যেতে পারে না।
আল্লামা মুহাম্মাদ ইসমাইল সায়য়ানী লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
কু’ফুর হিসেব হবে দ্বীনদারীর দৃষ্টিতে। আর এ হিসেবেই কোনো মুসলিম মেয়েকে কোনো কাফির পুরুসের নিকট বিয়ে দেয়া যেতে পারে না –ইজমা’র সিদ্ধান্ত এই।
কুরআন মজীদের সুস্পষ্ট ঘোষণায় এ ইজমা’র ভিত্তি উদ্ধৃত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী******************************************)
ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারী কিংবা মুশরিক নারীকে বিয়ে করবে, পক্ষান্তরে ব্যভিচারী নারীকে অনুরূপ ব্যভিচারী কিংবা মুশরিক পুরুষ ছাড়া আর কেউ বিয়ে করবে না। মু’মিনদের জন্যে তা হারাম করে দেয়া হয়েছে।
কুরআন এর পূর্ববর্তী আয়াতে জ্বেনাকারীদের জন্যে কঠোর শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ আয়াতে জ্বেনাকারী পুরুষ স্ত্রীর সঙ্গে কোনরূপ বিষয়ে সম্পর্ক স্থাপন করাকে ঈমানদার স্ত্রী পুরুষের জন্যে হারাম করে দেয়া হয়েছে। আল্লামা আল-কাসেমী লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
এ আয়াত থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে, ব্যভিচারী মোটামুটি ঈমানদার নয়, যদিও তাকে মুশরিক বলা যায় না।
আর আয়াতটির শেষ শব্দ থেকে জানা যায় ঈমানই ব্যভিচারী পুরুষ স্ত্রীকে বিয়ে করতে ঈমানদার লোকদের বাধা দেয় –নিষেধ করে। যে তা করবে সে হয় মুশরিক হবে, নয় ব্যভিচারী। সে ধরনের ঈমানদার সে নয় অবশ্যই, যে ধরনের ঈমান এ ধরনের বিয়েকে নিষেধ করে, ঘৃণা জাগায়। কেননা জ্বেনা-ব্যভিচার বংশ নষ্ট করে আর জ্বেনাকারীর সাথে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপনে পাপিষ্ঠের সঙ্গে স্থায়ীভাবে একত্র বাস –সহবাস করা অপরিহার্য হয়। অথচ আল্লাহ এ ধরনের সম্পর্ক-সংস্পর্শকে চিরদিনের তরে নিষেধ করে দিয়েছেন।
অন্য কথায়, ব্যভিচারী পুরুষ ঈমানদার মেয়ের জন্যে এবং ব্যভিচারী নারী ঈমানদার পুরুষের জন্যে কুফু নয়। কেননা স্বভাব-চরিত্র ও বাস্তব কাজের দিক দিয়ে এ দুশ্রেণীর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, এ দুয়ের মধ্যে মনের মিল, চরিত্র ও স্বভাবের ঐক্য হওয়া, হৃদয়ের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়া, নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা এবং প্রাণের শান্তি ও স্বস্তি লাভ –যা বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্য –কখনো সম্ভব হবে না। তাই কুরআন মজীদের অপর এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************)
মু’মিন কি কোনোক্রমেই ফাসিকদের সমান হতে পারে? না, এরা সমান নয়।
মানে, মু’মিন ও ফাসিক এক নয়, নেই এদের মধ্যে কোনো রকমের সমতা ও সাদৃশ্য। অতএব মু’মিন স্ত্রী বা পুরুষ কখনোই ফাসিক বা কাফির স্ত্রী বা পুরুষের জন্য কুফু নয়।
কুরআনের উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ের সমর্থনে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণী উল্লেখযোগ্য। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী****************************************)
দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যভিচারী তারই মতো দণ্ডপ্রাপ্তা ব্যভিচারীনি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না।
উম্মে মাহজুল নাম্মী কোনো ব্যভিচারিণীকে বিয়ে করার অনুমতি প্রার্থনা করা হলে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
(আরবী****************************************************)
ব্যভিচারিনীকে ব্যভিচারী বা মুশরিক ছাড়া অন্য কেউ বিয়ে করবে না।
বলা বাহুল্য, হাদীসদ্বয়ের সনদ সহীহ এবং বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। তাবারানী ও মজমাওয যওয়ায়িদ গ্রন্থেও এ হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। (আরবী*********)
সূরা আন-নূর-এর নিম্নোক্ত আয়াতটিও এই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচ্য। বলা হয়েছেঃ
(আরবী***************************************************)
দুশ্চরিত্রশীলা মেয়েলোক দুশ্চরিত্র পুরুসের জন্য, দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা মেয়েদের জন্যে আর সচ্চরিত্রবতী মেয়েলোক সচ্চরিত্রবান পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্রবান পুরুষ সচ্চরিত্রা মেয়েদের জন্য।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
চরিত্রহীনা মেয়ে চরিত্রহীন পুরুষদের জন্যে, তাই চরিত্রহীনা মেয়েলোক চরিত্রবান পুরুষদের জন্যে বিবাহযোগ্য হতে পারে না। কেননা তা কুরআনে বর্ণিত চূড়ান্ত কথার খেলাফ। অনুরূপভাবে সচ্চরিত্রবান পুরুষ সচ্চরিত্রবতী মেয়েদের জন্যে। অতএব কোনো চরিত্রবান পুরুষই কোনো চরিত্রহীনা মেয়ের জন্যে বিয়ের যোগ্য হতে পারে না। কেননা তাও কুরআনের বিশেষ ঘোষণার পরিপন্থী। (আরবী****************************)
অন্য কথায় নেককার পুরুষ নেকাকর স্ত্রীলোকই গ্রহণ করবে, বদকার ও চরিত্রহীনা নারী নয়। কেননা তা তার জন্যে কুফু নয়। এমনিভাবে কোনো নেককার চরিত্রবতী মেয়েকে বদকার চরিত্রহীন পুরুষের নিকট বিয়ে দেয়া যেতে পারে না। কেননা তা তার জন্যে কুফু নয়। সারকথা এই যে, বিয়ের ব্যাপারে স্ত্রী পুরুষের মধ্যে কুফুর বিচার অবশ্যই করতে হবে। আর সে কুফু হবে নৈতিক চরিত্র ও দ্বীনদারীর দিক দিয়ে।
তাই নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
তোমরা যখন বিয়ের জন্যে এমন ছেলে বা মেয়ে পেয়ে যাবে যার দ্বীনদারী চরিত্র ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে তোমরা পছন্দ করবে, তো তখনই তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করো।
ইমাম শাওকানী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
এ হাদীস প্রমাণ করে যে, দ্বীনদারী ও চরিত্রের দিক দিয়ে কুফু আছে কিনা বিয়ের সময়ে তা অবশ্য লক্ষ্য করতে হবে।
ইমাম মালিক (রহ) সম্পর্কে ইমাম শাওকানীই লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************)
ইমামা মলিক দৃঢ়তা সহকারে বলেছেন, কেবলমাত্র দ্বীনদারীর দিক দিয়েই কুফু বিচার করতে হবে –অন্য কোনো দিক দিয়ে নয়।
আল্লামা খাত্তাবী সুনানে আবূ দাঊদ-এর ব্যাখ্যায় ইমাম মালিকের নিম্নোক্ত কতাটি উদ্ধৃত করেছেনঃ
(আরবী***********************************************)
কুফু কেবলমাত্র দ্বীনদারীর দিক দিয়েই লক্ষণীয় ও বিবেচ্য। আর ইসলামী জনতার সকলেই পরস্পরের জন্যে কুফু।
এ ছাড়া ধন-সম্পদ ও বংশমর্যাদা ইত্যাদির দিক দিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে কুফুর কোনো প্রশ্নই নেই। কেবলমাত্র ইমাম শাফিঈ (রহ) ধন-সম্পত্তির দৃষ্টিতেও কুফু’র গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এ কথা প্রমাণ করতে পারেনি যে, ধনী ও গরীবের সন্তানের মধ্যে পারস্পরিক বিয়ে হলে দাম্পত্য জীবনে তাদের প্রেম ও ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে না। তবে এক তরফের ধন-ঐশ্বর্য ও বিত্ত-সম্পদের প্রাচুর্য অনকে সময় দাম্পত্য জীবনে তিক্কতারও সৃষ্টি করতে পারে, তা অস্বীকার করা যায় না।
ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফিঈ একটি হাদীসের ভিত্তিতে বংশীয় কুফু’র গুরুত্বও স্বীকার করেছেন। হাদীসটি হচ্ছে এই –নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
আরবের লোকেরা পরস্পরের জন্যে কুফু। আর ক্রীতদাসেরাও পরস্পরের কুফু।
কিন্তু এ হাদীসের সনদ ও তার শুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগনের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। কেননা এর সনদে একজন বর্ণনাকারী এমন রয়েছে, যার নাম উল্লেখ করা হয়নি। ইমাম ইবনে আবূ হাতিম তাকে অপরিচিত লোক বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি তাঁর পিতাকে এ হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ
(আরবী**************************)
এ হাদীসটি মিথ্যা, এর কোনো ভিত্তি নেই।
অপর এক জায়গায় বলেছেন, এ হাদীসটি বাতিল। ইমাম দারে কুতনী বলেছেনঃ (আরবী***************) ‘হাদীসটি সহীহ নয়’। ইবনে আবদুর বাররয় বলেছেনঃ (আরবী**********) ‘এ হাদীসটি গ্রহণ অযোগ্য, এটি কারো নিজস্ব রচিত’। (আরবী************) আল্লামা শাওকানী এ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেনঃ (আরবী*******************) এ হাদীসের সনদ দুর্বল’। (আরবী***************)
হাদীসটিকে যদি সহীহ বলে ধরা যায়, তবে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আরবের সাধারণ অধিবাসী যদিও পরস্পরের জন্যে কুফু, কিন্তু ক্রীতদাস তাদের জন্যে কুফু নয়। কিন্তু এ কতা কুরআন ও অন্যান্য সহীহ হাদীসের সম্পূর্ণ খেলাফ। কুরআনের ঘোষণা (আরবী********************) ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী –আল্লাহ ভীরু ব্যক্তি আল্লাহর নিকট তোমাদের সকলের অপেক্ষা অধিকতর সম্মানিত’। এতে যেমন বংশের দিক দিয়ে মানুষের পার্থক্য স্বীকৃত হয়নি, তেমনি পার্থক্যের একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে পেশ করা হয়েছে তাকওয়া –আল্লাহ-ভীরুতা, দ্বীনদারী ও পরহেযগারীকে। আর হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস (আরবী****************) –“সমস্ত মানুষই আদমের সন্তান”। এ মানুষে মানুষে বংশের দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য স্বীকার করা হয়নি। দ্বিতীয় হাদীসঃ
(আরবী***********************************************)
মানুষ চিরুনীর দাঁতের মতোই সমান, কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, তবে পার্থক্য হতে পারে কেবলমাত্র তাকওয়ার কারণে। (ঐ)
ওপরের আলোচনা থেকে কুফুর ব্যাপারে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং জানা গেছে যে, মানুষে মানুষে তাকওয়া পরহেযগারী এবং দ্বীনদারী ও নৈতিক চরিত্র ছাড়া অপর কোনো দিক দিয়েই পার্থক্য করা উচিত নয়, কুফুর বিচারও কেবলমাত্র এই দিক দিয়েই করা যেতে পারে।
এ হলো ইসলামের আদর্শিক দৃষ্টিকোণ। কিন্তু এই আদর্শিক দৃষ্টিকোণের বাইরে বাস্তব সুবিধে-অসুবিধের বিচার ও বিয়ের ব্যাপারে অগ্রাহ্য বা উপেক্ষিত হওয়া উচিত নয়। কেননা বিয়ে বাস্তবভাবে দাম্পত্য জীবন যাপনের বাহন। এজন্যে স্বামী ও স্ত্রীর বাঝে যথাসম্ভব সার্বিক ঐক্য ও সমতা না হলে বাস্তব জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে ইসলামে বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গিও যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারে গণ্য ও গ্রাহ্য। ইসলামের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ মনীষীও এর অনুকূলে মত জানিয়েছেন।
ইমাম খাত্তাবী তাই লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
বহু সংখ্যক মনীষীর মতে চারটি কুফুর বিচার গণ্য হবেঃ দ্বীনদারী, আযাদী, বংশ ও শিল্প-জীবিকা। তাদের অনেকে আবার দোষত্রুটিমুক্ত ও আর্থিক সচ্ছলতার দিক দিয়েও কুফুর বিচার গণ্য করেছেন। ফলে কুফু বিচারের জন্যে মোট দাঁড়াল ছয়টি গুণ।
হানাফী মাযহাবে কুফুর বিচারে বংশমর্যাদা ও আর্থিক অবস্থাও বিশেষভাবে গণ্য। এর কারণ এই যে, বংশমর্যাদার দিক দিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে পার্থক্য হলে যদিও একজন অপরজনকে ন্যায়ত ঘৃণা করতে পারে না, কিন্তু একজন অপর জনকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে অসমর্থ হতে পারে তা অস্বীকার করা যায় না। অনুরূপভাবে একজন যদি হয় ধনীর দুলাল আর একজন গরীবের সন্তান তাহলেও –যদিও সেখানে ঘৃণার কোনো কারণ থাকে না, কিন্তু একজন যে অপরজনের নিকট যথেষ্ট আদরনীয় না-ও হতে পারে, তা-ই বা কি করে অস্বীকার করা যেতে পারে? এ সব বাস্তব কারণে দ্বীনদারী ও নৈতিক চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে বংশমর্যাদা, জীবিকার উপায় ও আর্থিক অবস্থার বিচার হওয়াও অন্যায় কিছু নয়।
কনের জরুরী গুণাবলী
কনে বাছাই করার সময় ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ একটি গুণের যাচাই করে দেখা আবশ্যক। সে গুণটি হচ্ছে কনের দ্বীনদার ও ধার্মিক হওয়া। এ সম্পর্কে নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
চারটি গুণের কারণে একটি মেয়েকে বিয়ে করার কথা বিবেচনা করা হয়ঃ তার ধন-মাল, তার বংশ গৌরব –সামাজিক মান-মর্যাদা, তার রূপ ও সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারী। কিন্তু তোমরা দ্বীনদার মেয়েকেই গ্রহণ করো।
যে সব কারণে একজন পুরুষ একটি মেয়েকে স্ত্রীরূপে বরণ করার জন্যে উৎসাহিত ও আগ্রহান্বিত হতে পারে তা হচ্ছে এ চারটি। এ গুণ চতুষ্টয়ের মধ্যে সর্বশেষে উল্লেখ করা হয়েছে দ্বীনদারী ও আদর্শবাদিতার গুণ। হাদীসেও উল্লিখিত চারটি গুণ স্বতন্ত্র গুরুত্বের অধিকারী। এর প্রতিটি গুণই এমন যে, এর যে কোনো একটির জন্যে একটি মেয়েকে বিয়ে করা যেতে পারে, যদিও এ গুণ চতুষ্টয়ের মধ্যে মেয়ের দ্বীনদার তথা ধার্মিকতা ও চরিত্রবতী হওয়ার গুণটিই ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বাগ্রগণ্য ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
নবী করীম (স)-এর আলোচ্য নির্দেশের সারকথা হলোঃ
(আরবী*****************************************************************)
দ্বীনদারীর গুণসম্পন্না কনে পাওয়া গেলে তাকেই যেন স্ত্রীরূপে বরণ করা হয়, তাকে বাদ দিয়ে অপর কোনো গণসম্পন্না মহিলাকে বিয়ে করতে আগ্রহী হওয়া উচিত নয়।
দ্বীনদার ও ধার্মিক কনেকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা উচিত –অন্য কথায় বিয়ের জন্যে চেষ্টা চালানো পর্যায়ে কনের খোঁজ-খবর লওয়ার সময় –রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ হলো, কেবল দ্বীনদার কনেই তালাশ করবে। বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে কনে সম্পর্কে প্রথম জানবার বিষয় হলো কনের দ্বীনদারীর ব্যাপার। অন্যান্য গুণ কি আছে তার খোঁজ পরে নিলেও চলবে অর্থাৎ কনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচেছ তার দ্বীনদার হওয়া। ধনী, সদ্বংশজাত ও সুন্দরী রূপসী হওয়াও কনের বিশেষ গুণ বটে; এবং এর যে-কোন একটি গুণ থাকলেই একজন মেয়েকে স্ত্রীরূপে বরণ করে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এসব গুণ মুখ্য ও প্রধান নয় –গৌণ। রাসূল (স)-এর নির্দেশ অনুযায়ী কেবল ধন-সম্পত্তি, বংশ-মর্যাদা ও রূপ-সৌন্দর্যের কারণেই একটি মেয়েকে বিয়ে করা উচিত নয়। সবচাইতে বেশি মূল্যবান ও অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য গুণ হচ্ছে কনের দ্বীনদারী।
চারটি গুণের মধ্যে দ্বীনদারী হওয়ার গুণটি কেবল যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা-ই নয়, এ গুণ যার নেই তার মধ্যে অন্যান্য গুণ যতই থাক না কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে সে অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য কনে নয়। রাসূল (স)-এর হাদীস অনুযায়ী তো দ্বীনদারীর গুণ-বঞ্চিতা নারীকে বিয়েই করা উচিত নয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেনঃ
(আরবী***************************************************)
তোমরা নারীর কেবল বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্য দেখেই বিয়ে করো না। কেননা তাদের এ রূপ সৌন্দর্য তাদের নষ্ট ও বিপথগামী করে দিতে পারে। তাদের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য দেখেও বিয়ে করবে না। কেননা ধন-সম্পদ তাদের বিদ্রোহী ও দুর্বিনীত বানিয়ে দিতে পারে। বরং বিয়ে করো নারীর দ্বীনদারীর গুণ দেখে। মনে রাখবে, কৃষ্ণকায়া দাসীও যদি দ্বীনদার হয় তবু অন্যদের তুলনায় উত্তম।
এ হাদীসটির ভাষা অপর এক বর্ণনায় এরূপ উদ্ধৃত হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************************)
তোমরা স্ত্রীদের কেবল তাদের রূপ-সৌন্দর্য দেখেই বিয়ে করো না –কেননা এ রূপ-সৌন্দর্যই অনেক সময় তাদরে ধ্বংসের কারণ হতে পারে। তাদের ধন-মালের লোভে পড়েও বিয়ে করবে না –কেননা এ ধন-মাল তাদের বিদ্রোহী ও অনমনীয় বানাতে পারে। বরং তাদের দ্বীনদারীর গুণ দেখেই তবে বিয়ে করবে। বস্তুত একজন দ্বীনদার কৃষ্ণাঙ্গ দাসীও কিন্তু অনেক ভালো।
রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল (আরবী*************) ‘বিয়ের জন্য কোন ধরনের মেয়ে উত্তম?’ জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ
(আরবী*******************************************************)
যে মেয়েলোককে দেখলে বা তার প্রতি তাকালে স্বামীর মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়, তাকে যে কাজের আদেশ করা হবে তা সে যথাযথ পালন করবে এবং তার নিজের ও স্বামীর ধন-মালের ব্যাপারে স্বামীর মত ও পছন্দ-অপছন্দের বিপরীত কোনো কাজই করবে না।
অপর এক হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে –সাহাবায়ে কিরাম একদিন বললেনঃ
(আরবী****************************************************)
সর্বোত্তম মাল-সম্পদ কি, তা যদি আমরা জানতে পারতাম, তাহলে তা আমরা অবশ্যই অর্জন করতে চেষ্টা করতাম। একথা শুনে নবী করীম (স) বললেনঃ সর্বোত্তম সম্পদ হচ্ছে আল্লাহর যিকর-এ মশগুল মুখ ও জিহবা, আল্লাহর শোকর আদায়কারী দিল এবং সেই মু’মিন স্ত্রীও সর্বোত্তম সম্পদ, যে স্বামীর দ্বীন-ইমানের পক্ষে সাহায্যকারী হবে।
এ সব হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়ঃ
(আরবী*************************************************************)
সর্ব পর্যায়ে দ্বীনদার লোকদের সাহচর্য অতি উত্তম। কেননা দ্বীনদার লোকদের সঙ্গী-সাথীগণ তাদের চরিত্র, উত্তম গুণাবলী ও ধরন-ধারণ, রীতিনীতি থেকে অনেক কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বিশষ করে স্ত্রী তো দ্বীনদার হওয়া একান্তই অপরিহার্য এবং এদিক দিয়ে যে ভালো সেই উত্তম। কেননা সে-ই তার শায়িনী, সে-ই তার সন্তানের জননী, গর্ভধারিনী, সে-ই তার ধন-মাল, ঘর-বাড়ি ও তার (স্ত্রীর) নিজের রক্ষণাবেক্ষণের একমাত্র দায়িত্বশীল ও আমানতদার।
বস্তুত রূপ-সৌন্দর্য ও ধন-মাল যেমন স্থায়ী নয়, তেমনি দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্ব দানে তার ক্রিয়া গভীর ও সুদূরপ্রসারীও নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে এ রূপ-সৌন্দর্য ও ধন-মাল পারিবারিক জীবনে অনেক তিক্ততা ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি করে থাকে –করতে পারে। সুন্দরী-রূপসী নারীদের মধ্যে –বিশেষত যাদের রূপ-সৌন্দর্য ছাড়া অন্য কোন মহৎ গুণ নেই –অহমিকা ও আত্মম্ভরিতা প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। আর তার ফলে হয়ত তারা স্বামীর কাছে নতি স্বীকার করতে বা তার প্রতি নমনীয় হতে কখনও প্রস্তুত হয় না। উপরন্তু তাদের রূপের আগুনে আত্মহুতি দেয়ার জন্যে অসংখ্য কীট-পতঙ্গ চারদিকে ভীড় জমাতে পারে আর তারা পারে ওদের আত্মহুতি দেয়ার জন্যে অনেক অবাধ সুযোগ করে দিতে। তখন এ রূপ ও সৌন্দর্যই হয় তার ধ্বংসের কারণ। ধন-মালের প্রাচুর্যও তেমনি নারী জীবনের ধ্বংস টেনে আনতে পারে। যে নারী নিজে বা তার পিতা বিপুল ধন-সম্পত্তির মালিক তার মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা অহংকার ও বড়ত্বের ভাব (Superiority Complex) থেকে থাকে। তার বিয়ে যদি হয় এমন পুরুষের সাথে, যার আর্থিক মান তার সমান নয় বরং তার অপেক্ষা কম কিংবা সে যদি গরীব হয়, তাহলে এ দুজনের দাম্পত্য জীবন সুখের হতে পারে না বললেও অত্যুক্তি হবে না। কেননা ধনী কন্যা বা ধনশালী স্ত্রী সব সময়ই তার গরীব স্বামীকে হেয়, হীন ও নীচ মনে করতে থাকবে। তার ফলে স্বামী নিজেকে তার স্ত্রীর নিকট ক্ষুদ্র, অপমানিত ও লাঞ্ছিত মনে করবে। আর এ কারণেই এ ধরনের স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন না হবে স্থায়ী, না হবে সুখের ও মাধুর্যময়।
কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতও হাদীসের ঘোষিত নীতিরই সমর্থক। সূরা আন-নূর এ বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************)
এবং বিয়ে দাও তোমাদের জুড়িহীন ছেলেমেয়েকে, আর তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা নেককার –যোগ্য, তাদের।
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************)
তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহ-ভীরু ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানার্হ।
এরশাদ হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************)
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের ইলম দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের সম্মান ও মর্যাদা অধিক উচ্চ ও উন্নত করে দেবেন।
এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************)
দুনিয়ার সব জিনিসই ভোগ ও ব্যবহারের সামগ্রী। আর সবচেয়ে উত্তম ও উৎকৃষ্ট সামগ্রী হচ্ছে নেক চরিত্রের স্ত্রী।
কেননা নেক চরিত্রের স্ত্রী স্বামীকে সব পাপের কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং দুনিয়া ও দ্বীনের কাজে তাকে পূর্ণ সাহায্য ও তার সাথে আন্তরিক সহযোগিতা করে থাকে। এ হাদীসের অর্থ হচ্ছেঃ
(আরবী*************************************************)
স্ত্রী যদি নেক চরিত্রের না হয়, তাহলে সে হবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও বেশি খারাপ সামগ্রী।
আর নেক চরিত্রের স্ত্রী বলতে বোঝায়ঃ
(আরবী************************************************)
নেককার, পরহেযগার, আল্লাহ-ভীরু ও পবিত্র চরিত্রের স্ত্রী –যে তার স্বামীর জন্যে সর্বাবস্থায় কল্যাণকামী, তার ঘরের রানী এবং তার আদেশানুগামী, তাকেই নেক চরিত্রের স্ত্রী মনে করতে হবে।
উপরোদ্ধৃত আয়াত ও হাদীস থেকে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা এই যে, ইসলামের দৃষ্টিতে তাকওয়া, পরহেযগারী, দ্বীনদারী ও উন্নত মর্যাদার চরিত্রই হচ্ছে মানুষের বিশিষ্টতা লাভের শ্রেষ্ঠ গুণ। এতদ্ব্যতীত অন্য কোনো গুণই এমন নয়, যার দরুন কোনো লোক অপরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হতে পারে। একথা যেমন নারীদের ব্যাপারে সত্য, তেমনি পুরুষদের ক্ষেত্রেও তা অনুরূপ গুরুত্ব সহকারে প্রযোজ্য। তাই দ্বীনদার ও চরিত্রবতী মেয়েই বিয়ের জন্য সর্বাগ্রগণ্যা, বিশেষত মুসলিম পরিবারে তা-ই হওয়া উচিত। দ্বীনদার চরিত্রবতী কনে বাছাই ও বিয়ে করার জন্যে ইসলামে যেমন বলা হয়েছে বরকে –বিবাহেচ্ছুক পুরুষকে, তেমনি বলা হয়েছে কনেকেও। এ সম্পর্কে ‘রদ্দুল মুহতার’ গ্রন্থে ফিকাহবিদদের সর্বসম্মত মতের উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ
(আরবী******************************************************)
নারী স্বামী গ্রহণ করবে তার উত্তম দ্বীনদারী ও উদার চরিত্রের জন্যে, সেই গুণ দেখে এবং সে কখনো ফাসিক ও ধর্মহীন ব্যক্তিকে বিয়ে করবে না।
দারিদ্র্য বিয়ের ব্যাপারে বাধা নয়
ওপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলাম নির্বিশেষে সকল স্ত্রী-পুরুষকেই বিধিসঙ্গত নিয়মে ও শরীয়তসম্মত পন্থায় বিয়ে করার জন্যে উৎসাহ দিয়েছে। আর যৌন উত্তেনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে তখন বিয়ে করা ফরযের পর্যায়ে পৌঁছে যায় বলে ঘোষণা দিয়েছে।
কিন্তু অনেক সময় যুবক-যুবতীগণ কেবলমাত্র দারিদ্র্য কিংবা অর্থাভাবের কারণে বিয়ে করতে প্রস্তুত হতে চায় না। তারা মনে করে, বিয়ে করলে আর্থিক দায়িত্ব বেড়ে যাবে, সেই অনুপাতেই রোজগার না হলে সে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথবা বিয়ে করলে যে আর্থিক দায়িত্ব বাড়বে, তদ্দরুন জীবন মান নিচু হয়ে যাবে।
এসব কারণে তারা বিয়েকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেই চেষ্টা করে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এ মনোভাব –চিন্তার এই ধারা ও প্রকৃতি –আদৌ সমর্থণযোগ্য নয়। একে তো মানুষের রুজি-রোজগারের পরিমাণ কোনো স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় জিনিস নয়। যে আল্লাহ আজ একজনকে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন, সে আল্লাহই আগামীকাল তাকে একশত বা এক হাজার টাকা দিতে পারেন। তাই অর্থাভাব যেন কখনোই বিয়ের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে, সেজন্যে আল্লাহ তা’আলা নিজেই ঘোষণা করেছেনঃ
(আরবী***********************************************)
যদি তারা গরীব দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে তাদের ধনী করে দেবেন। বস্তুতই আল্লাহ প্রশস্ততাসম্পন্ন সর্বজ্ঞ।
ছেলে বা মেয়ে কিংবা তাদের অলী-গার্জিয়ানদের উভয়ের কিংবা কোনো এক পক্ষের দারিদ্র্য বিয়ের পথে বাধা হওয়ার আশংকা দূর করার জন্যে কুরআনের এ আয়াত স্পষ্ট ঘোষণা। এর অর্থঃ
(আরবী******************************************************)
বিয়ের প্রস্তাব আসা ছেলে বা মেয়ের পারস্পরিক বিয়ের পথ দারিদ্র্য যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কেননা আল্লাহর মেহেরবানীতে রয়েছে অর্থবিমুখতা। এজন্যে যে, আল্লাহ সকাল-সন্ধ্যা যাকে চান অভাবিতপূর্ব উপায়ে রিযিক দান করেন। কিংবা এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ওয়াদা করেছেন (দারিদ্রকে) ধনী করে দেয়ার। অবশ্য তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন –আল্লাহ ইচ্ছার শর্তাধীন।
‘আল্লাহর ইচ্ছাধীন’ বলার কারণ এই যে, বিয়ে করলেই স্বামী-স্ত্রী ধনী হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। কাজেই আল্লাহ কোথাও ওয়াদা খেলাফী করেছেন –একথা বলা যাবে না। কেননা কত স্বামী বা স্ত্রীই তো দুনিয়ায় এমন রয়েছে, যারা দরিদ্র, বিয়ে করা সত্ত্বেও তাদের দারিদ্র্য দূর হয়ে যায় নি।
তাহলে এ আয়াতের ঘোষণার অর্থ কি? –কি এর প্রকৃত তাৎপর্য। বিয়ের সাথে আর্থিক সঙ্গতির সম্পর্ক কি? এর জবাবে বলা যায়, মানুষ সাধারণত কারণকেই বড় করে দেখে, কারণ বুঝেই নিশ্চিন্ত হয়। তারই ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সে কারণের মূলে যে ব্যাপারটি রয়েছে, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফিল হয়ে যায়। মানুষ মনে করে নিয়েছে যে, অধিক সন্তান হওয়াই বুঝি দারিদ্র্যের কারণ। আর কম সন্তান হলেই ধনের পরিমাণ বেড়ে যাবে। মানুষের এ অমূলক ধারণা বিদূরণের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তা’আলা উপরিউক্ত ঘোষণা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, বিয়ে করলেই মানুষ আর্থিক দায়িত্ব-ভারে পর্যুদস্ত হবে –এমন কোনো কথা নেই; বরং এর উল্টোটারই সম্ভাবনা বেশি। আর তা হচ্ছে, অধিক সন্তান হলে অনেক সময় আল্লাহ তা’আলা তার ধন-মাল বাড়িয়ে দেন। এও দেখা গেছে যে, সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে রোজগার বেশি হয়েছে, দারিদ্র্য দূরীভূত হয়ে গেছে! আসলে এ ব্যাপারটি আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। বিশেষত আল্লাহ তা’আলা নিজেই যখন বলে দিয়েছেন যে, বিয়ে করলেই দরিদ্র হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই, তখন বুদ্ধিমান ও জাগ্রতমনা নারী-পুরুষ বিয়েকে আদৌ ভয় করবে না, করা উচিত নয়। তাহলে আয়াতের সহজ অর্থ দাঁড়ালোঃ
(আরবী*********************************************************)
আল্লাহর অনুগ্রহে বিয়ে ধন-মালের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা) বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
তোমরা বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহর আদেশ পালনে তাঁর আনুগত্য করো। তা হলে ধনসম্পত্তি দানের যে ওয়াদা আল্লাহ তা’আলা করেছেন তা তোমাদের জন্যে পূরণ করবেন।
হযতর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************)
বিয়ে করে তোমরা ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করো।
এই পর্যায়ে স্মরণ করা যেতে পারে, একজন সাহাবী ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র, মোহরানা স্বরূপ দেবার মতো টাকা-পয়সা তো দূরের কথা –কোনো জিনিসই তাঁর কাছে ছিল না। একটি লোহার অঙ্গুরীয় দেবার মতো সামর্থ্যও তাঁর ছিল না। ছিল ছুধু তাঁর নিজের পরিধেয় একখানি বস্ত্র। তাকেও রাসূলে করীম (স) ‘মোহরানা’ স্বরূপ ধরে নিতে রাজি হলেন না। তা সত্ত্বেও সেই সাহাবীর বিয়ে সেই স্ত্রীলোকটির সাথেই করে দিলেন। আর ‘মোহরানা’র ব্যবস্থা করে দিলেন এভাবে যে, সাহাবী যতখানি কুরআন মজীদ শিখেছিলেন, তা-ই তাঁর স্ত্রীকে শিক্ষা দিবেন। আল্লামা ইবনে কাসীর এই ঘটনার উল্লেখ করে তার পরে লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
আল্লাহ তা’আলার অপরিসীম দয়া-অনুগ্রহ সর্বজনবিদিত, তিনি তাঁকে এত পরিমাণ রিযিক দান করলেন যে, তার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্যে যথেষ্ট হয়ে গেল।
অতএব কোনো মুসলিম যুবকেরই আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন অবিবাহিত কুমার জীবন যাপনে প্রস্তুত হওয়া উচিত নয়। বরং আল্লাহর রিযিকদাতা হওয়া –আল্লাহর অফুরন্ত দয়া-অনুগ্রহ ও দানের ওপর অবিচল বিশ্বাস রাখা উচিত। কেননা সকল প্রাণীরই রিযিকের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা নিজের ওপরে গ্রহণ করে নিয়েছেন। বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
যমীনের উপর বিচরণশীল সব প্রাণীরই রিযিকের ভার একান্তভাবে আল্লাহর উপর।
আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন বিয়ের দায়িত্ব গ্রহণে ভীত লোকদের উৎসাহ বর্ধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
আল্লাহ তাকে রিযিক দান করবেন এমন সব উপায়ে, যা সে ধারণা পর্যন্ত করতে পারে নি। আর বস্তুতই যে লোক আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ করবে, সেই লোকের জন্যেই আল্লাহই যথেষ্ট হবেন।
উপস্থিত আর্থিক অনটন ও অসচ্ছলতা দর্শনে কোনো যুবক বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত করতে পারে, তেমনি কোনো গরীব যুবকের তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে মেয়ে পক্ষ তা শুধু এ কারণেই প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অথবা মেয়ে পক্ষ গরীব বলে তার মেয়েকে বিয়ে করতে নারাযও হতে পারে। এসব দিকে লক্ষ্য রেখে আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
তোমরা যদি দারিদ্যের ভয় করো, তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ অবশ্যই তাঁর অনুগ্রতে তোমাদের ধনী করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই জ্ঞানী ও সুবিবেচক।
এ আয়াতের আর এক তরজমা হলোঃ ‘তোমরা যদি বিয়ের পরে অধিক সন্তানের বোঝা চেপে বসবে বলে ভয় করো, তাহলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে তোমাদের নিশ্চিন্ত করে দেবেন। আল্লাহ সবই জানেন, তিনি সুবিবেচক।
এ আয়াতের আর এক তরজমা হলোঃ ‘তোমরা যদি বিয়ের পরে অধিক সন্তানের বোঝা চেপে বসবে বলে ভয় করো, তাহলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে তোমাদের নিশ্চিন্ত করে দেবেন। আল্লাহ সবই জানেন, তিনি সুবিবেচক।
বস্তুত কোনো গরীব লোক যদি বিয়ে করে, তবে কামাই-রোজগারে তার বিপুল উৎসাহ ও উদ্যম সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আর এ ব্যাপারে তার স্ত্রী তার ওপর বোঝা না হয়ে বরং হবে দরদী সাহায্যকারিণী। আর সন্তান হলে তারাও তার অর্থোপার্জনের কাজে সাহায্যকারী হতে পারে। অনেক সময় স্ত্রীর ধনী নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য লাভও হতে পারে। সদিচ্ছার ওপর ফলাফল নির্ভর করে। আল্লাহ তা’আলার কথার প্রতি যার বিশ্বাস, আস্থা ও সদিচ্ছার অভাব থাকে, সে ছাড়া অপর কেউ দুর্ভোগে পড়তে পারে না। দৃঢ় বিশ্বাসই তাক সফলতার পথে আল্লাহর সাহায্য লাভের উপযুক্ত করে দেবে।