স্ত্রীর অধিকারের গুরুত্ব
ইবাদত-বন্দেগী ও কৃচ্ছ্র সাধনা অনেক প্রশংসার কাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু তা করতে গিয়ে স্ত্রীর অধিকার হরণ করা, তার পাওনা যথারীতি ও পুরাপুরি আদায় না করা, তার সাথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন করা নিশ্চয়ই বড় গুনাহ। নবী করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************)
নিশ্চয়ই তোমার স্ত্রীর তোমার ওপর একটা অধিকার রয়েছে।
কেবল স্ত্রীর অধিকার স্বামীর ওপর, সে কথা নয়, স্বামীর অধিকার রয়েছে স্ত্রীর ওপর। আল্লামা বদরুদ্দীন এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************)
স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের ওপর।
স্বামীর উপর স্ত্রীর যা কিছু অধিকার, তার মধ্যে একটি হচ্ছে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন। আর সাধারণভাবে তার প্রাপ্য হচ্ছেঃ
(আরবী******************************************)
তাকে খাবার দেবে যখন যেমন তুমি নিজে খাবে এবং তার পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করে দেবে, যেমন মানের পোশাক তুমি নিজে গ্রহণ করবে।
এ হাদীসের তাৎপর্য মওলানা খলীলুর রহমান লিখেছেণ নিম্নরূপঃ
(আরবী************************************************************)
স্ত্রীর খোরাক ও পোশাক যোগাড় করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য, যখন সে নিজের জন্যে এগুলোর ব্যবস্থা করতে সমর্থ হবে।
আল্লামা আল-খাত্তাবী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
এ হাদীস স্ত্রীর খোরাক-পোশাকের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর ওপর ওয়াজিব করে দিচ্ছে। এ ব্যপারে কোনো সীমা নির্দিষ্ট নেই, প্রচলন মতোই তা করতে হবে, করতে হবে স্বামীর সামর্থ্যানুযায়ী। আর রাসূলে করীম (স) যখন একে ‘অধিকার’ বলেছেণ তখন তা স্বামীর অবশ্য আদায় করতে হবে –সে উপস্থিত থাক, কি অনুপস্থিত। সময়মতো তা পাওয়া না গেলে তা স্বামীর ওপর অবশ্য দেয় ঋণ হবে –যেমন অন্যান্য হক-অধিকারের ব্যাপারে হয়ে থাকে।
এতদ্ব্যতীত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্ত্রীর নিকট যাওয়াও স্ত্রীর একটি অধিকার স্বামীর ওপর এবং তা স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর প্রতি। স্বামী যদি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হয়, তবে তাতে স্ত্রীর মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যাওয়া স্বাভাবিক। কেননা তাতে প্রমাণ হয় যে, স্বামী স্ত্রীর মন জয় করার জন্যে বিশেষ যত্ন নিয়েছে এবং পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারেই সে স্ত্রীর নিকট হাজির হয়েছে। অপরিচ্ছন্ন ও মলিন দেহ ও পোশাক নিয়ে স্ত্রীর নিকট যাওয়া স্বামীর একেবারেই অনুচিত। স্ত্রীরও কর্তব্য স্বামীর ইচ্ছানুরূপ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও সেই অবস্থায়ই স্বামীর নিকট যাওয়া। এজন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, সাবান ও অন্যান্য জরুরী প্রসাধন দ্রব্য সংগ্রহ করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। হযরত ইবনে আব্বাস এ পর্যায়ে একটি নীতি হিসেবে বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
আমি স্ত্রীর জন্যে সাজসজ্জা করা খুবই পছন্দ করি, যেমন পছন্দ করি স্ত্রী আমার জন্যে সাজসজ্জা করুক।
স্ত্রীর বিপদে সহানুভূতি প্রদর্শন
স্ত্রীর বিপদে-আপদে, রোগে-শোকে তার প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি প্রদর্শন করা স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রী রোগাক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা স্বামীরই দায়িত্ব। বস্তুত স্ত্রী সবচেয়ে বেশী দুঃখ পায় তখন, যখন তার বিপদে-শোকে তার স্বামীকে সহানুভূতিপূর্ণ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত দেখতে পায় না অথবা স্ত্রীর যখন কোন বিপদ হয়, শোক হয় কিংবা রোগ হয়, তখন স্বামীর মন যদি তার জন্যে দ্রবীভূত না হয়, বরং তখন স্বামীর মন মৌমাছির মতো অন্য ফুলের সন্ধানে উড়ে বেড়ায়, তখন বাস্তবিকই স্ত্রীর দুঃখ ও মনোকষ্টের কোনো অবধি থাকে না। এজন্যে নবী করীম (স) স্ত্রীর প্রতি দয়াবান ও সহানুভূতিপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এর সাধারণ নিয়ম হিসেবে বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************)
যে লোক নিজে অপরের জন্যে দয়াপূর্ণ হয় না, সে কখনো অপরের দয়া-সহানুভূতি লাভ করতে পারে না।
স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের ক্ষেত্রে এ কথা অতীব বাস্তব। এজন্যে স্ত্রীদের মনের আবেগ উচ্ছ্বাসের প্রতি লক্ষ্য রাখঅ স্বামীর একান্তই কর্তব্য।
এ প্রসঙ্গে হযরত উমর ফারূকের একটি ফরমান স্মরণীয়। তিনি এক বিরহিণী নারীর আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখতে পেয়ে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। তখন তিনি তাঁর কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী*********************************)
মেয়েলোক স্বামী ছাড়া বেশির ভাগ কদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকতে পারে?
হযরত হাফসা বললেনঃ (আরবী************) –‘চার মাস’। তখন হযরত উমর বললেনঃ
(আরবী***********************************************************)
সৈন্যদের মধ্যে কাউকে আমি চার মাসের অধিক বাইরে আটকে রাখব না।
(আরবী**********************************)
তিনি খলীফাতুল মুসলিমীন হিসেবে সব সেনাধ্যক্ষকে লিখে পাঠালেনঃ
(আরবী**********************************)
এই (চার মাসের) অধিক কাল কোনো বিবাহিত ব্যক্তিই তার স্ত্রী-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন না থাকে।
এ ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, স্ত্রীর মনের কামনা-বাসনা ও আন্তরিক ভাবধারার প্রতি তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখা স্বামীর অবশ্য কর্তব্য। আর স্ত্রীদের পক্ষে স্বামীহারা হয়ে বেশি দিন ধৈর্য ধরে থাকা সম্ভব নয় –এ কথার তার কিছুতেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াত থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। বলা হয়েছেঃ
(আরবী******************************************************)
যেসব লোক তাদের স্ত্রীদের সম্পর্কে কসম খেয়ে বসে যে, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত ইত্যাদি করবে না, তাদের জন্যে মাত্র চার মাসের মেয়াদ অপেক্ষা করা হবে। এর মধ্যে তারা যদি ফিরে আসে, তবে আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা মার্জনাকারী ও অতিশয় দয়াবান। আর তারা যদি তালাক দেয়ারই সিদ্ধান্ত করে থাকে, তবে আল্লাহ সব শোনেন ও সব জানেন।
এ আয়াতে ‘ঈলা’ সম্পর্কে ফয়সালা দেয়া হয়েছে। ঈলা (আরবী********) শব্দের অর্থ হচ্ছে, (আরবী********) ‘কসম করে কোনো কাজ না করা –‘কোনো কাজ করা থেকৈ বিরত থাকা’ আর ইসলামী শরীয়তের ভাষায় এর অর্থ হচ্ছেঃ
(আরবী***********************************************)
কসম করে স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম না করা –স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম করা থেকে বিরত থাকা।
আয়াতে বলা হয়েছেঃ যারা স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম না করার কিরা করবে তাদের জন্যে চার মাসের অবসর। এ চার মাস অতিবাহিত হবার পরে হয় সে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করে তাকে ফিরিয়ে নেবে, আর না হয় তালাক দিয়ে তাকে চিরতরে বিদায় করে দেবে।
(আরবী**********************************************************)
আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
আল্লাহ তা’আলা স্ত্রীর ক্ষতি হয় এমন কাজ বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই এই মেয়াদের সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েচেন। জাহিলিয়াত যুগে লোকেরা এক বছর, দুই বছর কি ততোদিক কালের জন্য ‘ঈলা’ করত আর তাদের উদ্দেশ্য হতো স্ত্রীলোককে ক্ষতিগ্রস্ত করা। এসব ক্ষতি-লোকসানের পথ বন্ধ করার এবং স্ত্রীলোকদের প্রতি পুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াদের কথাগুলো বলে দিয়েছেন।
স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা প্রকাশ না করা
স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকার হচ্ছে এই যে, সে স্ত্রীর গোপন কথা অপরের নিকট প্রকাশ করে দেবে না। নবী করীম (স) তীব্র ভাষায় নিষেধ করেছেন এ ধরনের কোনো কথা প্রকাশ করতে। বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
যে স্বামী নিজ স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় ও স্ত্রী মিলিন হয় তার স্বামীর সাথে, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপন কথা প্রকাশ করে দেয় –প্রচার করে, সে স্বামী আল্লাহর নিকট মর্যাদার দিক দিয়ে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি।
অর্থাৎ স্বামী যাবতীয় গোপন বিষয়ে অবহিত হয়ে থাকে, তার সাথে যৌন মিলন সম্পন্ন করে, স্ত্রী নিজকে –নিজের পূর্ণ সত্তা –দেহ ও মনকে স্বামীর নিকট উন্মুক্ত করে দেয়। এমতাবস্থায় স্বামী যদি স্ত্রীর যাবতীয় গোপন বিষয় অবহিত হয়ে তা অপর লোকের নিকট প্রকাশ করে দেয়, তবে তার অপেক্ষা নিকৃষ্ট ব্যক্তি আর কেউ হতে পারে না। আর আল্লাহর দৃষ্টিতেও এ ব্যক্তির মর্যাদা নিকৃষ্টতম হতে বাধ্য। কেননা এর মতো হীন ও জঘন্য কাজ আর কিছু হতে পারে না। ইমাম নববীর মতে এ কাজ হচ্ছে হারাম।
তিনি উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে যৌন-সম্ভোগ সম্পর্কিত গোপন বিষয় ও ঘটনা প্রকাশ করা এ হাদীসে সম্পূর্ণরূপে হারাম করে দেয়া হয়েছে।
একদিন রাসূলে করীম (স) নামাযের পরে উপস্থিত সকল সাহাবীকে বসে থাকতে বললেন এবং প্রথমে পুরুষদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরবী************************************************************)
তোমাদের মধ্যে এমন পুরুষ কেউ আছে নাকি, যে তার স্ত্রীর নিকট আসে, ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, তারপর বের হয়ে এসে লোকদের সাথে কথা বলে ও বলে দেয়ঃ আমি আমার স্ত্রীর সাথে এই করেছি, এই করেছি? …..হাদীস বর্ণনাকারী বলেছেন –এ প্রশ্ন শুনে সব সাহাবীই চুপ থাকলেন।
তারপরে মেয়েদের প্রতি লক্ষ্য করে তাদের নিকট প্রশ্ন করলেনঃ
(আরবী*****************************************)
তোমাদের মধ্যে এম নকেউ আছে নাকি, যে স্বামী-স্ত্রীর মিলন রহস্যের কথা প্রকাশ করে ও অন্যদের বলে দেয়?
তখন এক যুবতীয় মেয়ে বলে উঠলঃ
(আরবী*******************************************)
আল্লাহর শপথ, এই পুরুষরাও যেমন সে কথা বলে দেয়, তেমিন এই মেয়েরাও তা প্রকাশ করে।
তখন নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
তোমরা কি জানো, এরূপ যে করে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে, সে যেন একটি শয়তান, সে তার সঙ্গী শয়তানের সাথে রাজপথের মাঝখানে সাক্ষাত করলো, অমনি সেখানে ধরেই তার দ্বারা নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করে নিল। আর চারদিকে তাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল।
এ পর্যায়ে দুটি হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
এ দুটি হাদীসই প্রমাণ করছে যে, স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গম কার্য প্রসঙ্গে যত কিছু এবং যা কিছু ঘটে থাকে, তার কোনো কিছু প্রকাশ করা –অন্যদের কাছে বলে দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার আদান-প্রদান নয়, হয় পারস্পরিক মনের গোপন কথা বলাবলি। একজন তো অকৃত্রিম আস্থা ও বিশ্বাস নিয়েই অপর জনকে তা বলেছে, এখন যদি কেউ অপর কারো কথা কিংবা যৌন- মিলন সংক্রান্ত কোনো রহস্য অন্য লোকদের কাছে বলে দেয়, তা হলে একদিকে যেমন বিশ্বাস ভঙ্গ হলো অপরদিকে লজ্জার কারণ ঘটল। এই কারণে ইসলামের এ কাজকে সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেয়া হয়েছে।
বস্তুত একদন যদি তাদের স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার কথা বাইরের কোনো লোক-নারী বা পুরুষকে –বলে দেয়, তাহলে শ্রোতার মনে সেই স্ত্রী বা পুরুষের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আর যদি কেউ যৌন সঙ্গম কার্যের বিবরণ অন্য লোকের সামনে প্রকাশ করে, তাহলে তার গোপনীয়তা বিলুপ্ত হয়, গুপ্ত ব্যাপারাদি উন্মুক্ত ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কোনো নেকবখত স্ত্রীর দ্বারাও যেমন এ কাজ হতে পারে না, তেমনি কোনো আল্লাহ ভীরু ব্যক্তির দ্বারাও এ কাজ সম্ভব নয়। বিশেষভাবে মেয়েরাই এ ব্যাপারে অগ্রসর হয়ে থাকে বলে কুরআনে তাদের গুণাবলীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
তারা অতিশয় বিনীতা, অনুগতা অদৃশ্য কাজের হেফাযতকারিণী –আল্লাহর হেফাযতের সাহায্যে।
স্ত্রীর খোরপোশ সরবরাহের দায়িত্ব স্বামীর
স্ত্রীর শোভনীয় মান অনুপাতে খোরপোশ নিয়মিত সরবরাহ করা স্বামীরই কর্তব্য, যেন সে নির্লিপ্তভাবে স্বামীর ঘর-সংসার পরিচালন ও সংরক্ষণ এবং সন্তান প্রসব ও লালন-পালনের কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করতে পারে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
যে লোককে অর্থ-সম্পদের সাচ্ছন্দ্য দান করা হয়েছে, তার কর্তব্য সেই হিসেবেই তার স্ত্রী-পরিজনের জন্যে ব্যয় করা। আর যার আয়-উৎপাদন স্বল্প পরিসর ও পরিমিত, তার সেভাবেই আল্লাহর দান থেকে খরচ করা কর্তব্য। আল্লাহ প্রত্যেকের ওপর তার সামর্থ্য অনুসারেই দায়িত্ব অর্পন করে থাকেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
এ আয়াতে আদেশ করা হয়েছে সচ্ছল অবস্তায় লোকদেরকে যে, তারা দুগ্ধদায়িনী স্ত্রীদের জন্যে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুপাতে বহন করবে। আর যাদের রিযিক নিম্নতম প্রয়োজন মতো কিংবা সংকীর্ণ সচ্ছল নয়, তারা আল্লাহর দেয়া রিযিক অনুযায়ীই খরচ করবে। তার বেশি করার কোনো দায়িত্ব তাদের নেই।
স্ত্রীদের জন্যে খরচ বহনের কোনো পরিমাণ শরীয়তে নির্দিষ্ট আছে কিনা –এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************)
স্ত্রীর ব্যয়ভারের কোনো পরিমাণ শরীয়তে নির্দিষ্ট নয়, বরং তা বিচার-বিবেচনার ওপরই নির্ভর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অবস্থা বিবেচনীয়। সচ্ছল অবস্থায় স্ত্রীর জন্যে সচ্ছল অবস্থায় স্বামী সচ্ছল লোকদের উপযোগী ব্যয় বহন করবে। অনুরূপভাবে অভাবগ্রস্ত স্ত্রীর জন্যে অভাবগ্রস্ত স্বামী ভরণ-পোষনের নিম্নতম দায়িত্ব পালন করবে।
উপরোক্ত আয়াতের শেষাংশ প্রমাণ করছে যে, সামর্থ্যের বেশি কিছু করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব নয়। ইমাম আবূ হানীফারও এই মত। আল্লামা ইবনুল হুম্নান লিখেছেনঃ স্বামী যদি গরীব হয়, আর স্ত্রী হয় সচ্ছল অবস্থায়, তাহলে স্বামী গরীব-লোকদের উপযোগী ভরণ-পোষণ দেয়ার জন্যে দায়িত্বশীল। কেননা স্ত্রী নিজে সচ্ছল অবস্থার হলেও সে যখন গরীব স্বামী গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে, তখন সে প্রকারান্তরে গরীবলোক-উপযোগী খোরপোশ গ্রহণেও রাজি হয়েছে বলতে হবে।
পক্ষান্তরে স্বামী যদি সচ্ছল অবস্থার হয়, আর যদি স্ত্রী হয় গরীব অবস্থার, তাহলে সে সচ্ছল লোক উপযোগী ব্যয়ভার লাভ করতে পারবে।
স্বামীর অবস্থা অনুযায়ী স্ত্রীকে খোরপোশ দেয়ার কথা কুরআন থেকে প্রমাণিত। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী –উৎবা কন্যা –রাসূলে করীম (স)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেনঃ
(আরবী********************************************)
হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্বামী আবূ সুফিয়ান একজন কৃপণ ব্যক্তি; সে আমার ও আমার সন্তানদের প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ দেয় না, তবে আমি তাকে না জানিয়ে প্রয়োজন মতো গ্রহণ করতে থাকি। এ কাজ জায়েয কিনা?
তখন নবী করীম (স) তাকে বললেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী তোমার ও তোমার সন্তানাদির প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ তুমি গ্রহণ করতে পারো।
এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, আবূ সুফিয়ান সচ্ছল অবস্থাসম্পন্ন ছিল, রাসূলে করীম (স) জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কেবলমাত্র কৃপণতার কারণে নিজ স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ দিত না। সেই কারণে রাসূলে করীম (স) তার স্ত্রীকে প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। (আরবী*********)
ইমাম শাফিয়ীর মতে এই পরিমাণ শরীয়ত কর্তৃক নির্দিষ্ট বলে এ ব্যাপারে বিচার-বিবেচনার কোনো অবকাশ নেই। আর এ ব্যাপারে স্বামীর অবস্থানুযায়ীই ভরণ-পোষনের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্ত্রীর যদি খাদেম-চাকরের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে স্বামীর সামর্থ্য থাকলে খাদেম-চাকর যোগাড় করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। এ ব্যাপারে ফিকাহবিদগণ সম্পূর্ণ একমত। ইমাম মুহাম্মাদ বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
একাধিক খাদেম-চাকরের খরচ বহন করা অসচ্ছল অবস্থার স্বামীর জন্যেও ওয়াজিব হবে।
একজন খাদেম-চাকরের প্রয়োজন হলে তাও সংগ্রহ করা ও খরচ বহন করা স্বামীর কর্তব্য কিনা –এ সম্পর্কে ফিকাহবিদগণ একমত নন। ইমাম মালিকের মতে দুই বা তিনজন খাদেমের প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করা স্বামীর কর্তব্য। আর ইমামা আবূ ইউসুফ বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
এমতাবস্থায় স্বামীর কর্তব্য হবে শুধু দুজন খাদেমের ব্যবস্থা করা ও খরচ বহন করা। তাদের একজন হসে ঘরের ভিতরকার জরুরী কাজ-কর্ম করার জন্যে। আর অপরজন হবে ঘরের বাইরে জরুরী কাজ সম্পন্ন করার জন্যে।
গরীব ও অসচ্ছল স্বামীদের সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতের পরই বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
আল্লাহ অসচ্ছলতা ও দারিদ্র্যের পক্ষে অবশ্যই সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য সৃষ্টি করে দেবেন।
এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটিও পাঠ আবশ্যক। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী************************************************)
সন্তানের পিতার কর্তব্য হচ্ছে প্রসূতির খাবার ও পরার প্রচলিত মানে ব্যবস্থা করা। কোনো ব্যক্তির ওপরই তার সামর্থ্যের অধিক বোঝা চাপানো যেতে পারে না।
এ আয়াতের ভিত্তিতে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
সন্তান ও স্ত্রীর ব্যয়ভার, খোরাক ও পোশাক সংগ্রহ ও ব্যবস্থা করা সন্তানের পিতার পক্ষে ওয়াজিব। আর তা করতে হবে সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী –যা লোকেরা সাধারণত করে থাকে। এ ব্যাপারে কোনো পিতাকেই তার শক্তি-সামর্থ্যের বাইরে –তার পক্ষে কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে –এমন মান বা পরিমাণ তার ওপর চাপানো যাবে না।
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও লালন-পালন করা স্ত্রীর কাজ; আর তার সন্তানের ভরণ-পোষণ ও যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব স্বামীর। এর ফলে স্ত্রীরা খোর-পোশের যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে গেল। এর প্রভাব তাদের মনে ও জীবনে সুদূরপ্রসারী হবে। রাসূলে করীম (স) স্বামীদের লক্ষ্য করে তাই এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
স্ত্রীদের খাবার ও পরার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তোমরা অবশ্যই তাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবে।
অর্থাৎ কেবলমাত্র মোটা ভাত ও মোটা কাপড়ের ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হরে চলবে না। এ ব্যাপারে তাদের প্রতি কঠোরতা অবলম্বনের বদলে সহানুভূতিমূলক নীতি গ্রহণ করবে।
আলোচনার সারকথা হচ্ছে এই যে, স্বামী-স্ত্রীতে অতি স্বাভাবিকভাবেই কর্মবণ্টন করে দেয়া হয়েছে। যে যৌন মিলনের সুখ ও মাধুর্য স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সমানভাবে ভোগ করে, তার সুদূরপ্রসারী পরিণতি কেবল স্ত্রীকেই ভোগ করতে হয় প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী। পুরুষকে তার কোনো ঝুঁকিই গ্রহণ করতে হয় না। এ হচ্ছে এক স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। কাজেই স্ত্রী প্রকৃতির এই দাবি পূরণে সতত প্রস্তুত থাকবে, আর স্বামী তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্যে দায়ী হবে। মূল ব্যাপারে সমান অংশীদারিত্বের এটা অতি স্বাভাবিক দাবি।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীর চলতি নিয়মে কেবল খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দেওয়াই দাম্পত্য জীবনে মাধুর্য সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে স্বামীর তওফীক অনুযায়ী তারও বেশি এবং অতিরিক্ত হাত খরচাও স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া স্বামীর কর্তব্য; যেন স্ত্রী নিজ ইচ্ছা, বাসনা-কামনা ও রুচি অনুযায়ী সময়ে-অসময়ে খরচ করতে পারে। এতে করে স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, আস্থা ও নির্ভরশীলতা অত্যন্ত দৃঢ় ও গভীর হবে। স্বামী সম্পর্কে তার মনে জাগবে না কোনো সংশয়, উদ্বেগ বা বীতরাগ। (আরবী**************)
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালনে অক্ষমই হয়ে পড়ে তাহলে তখন ইসলামী সরকার সে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবে। নবী করীম (স)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, সে তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করতে পারে না, এমতাবস্থায় কি করা যেতে পারে? তখন নবী করীম (স) বলেছিলেনঃ
(আরবী**********) –এ দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দিতে হবে।
দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক (রা) তাঁর খিলাফতকালে সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন প্রধানের প্রতি ফরমান পাঠিয়েছিলেন এই বলেঃ
(আরবী******************************************************)
হয় তারা তাদের স্ত্রীদের ভরণ-পোষনের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করবে, না হয় তাদের তালাক দিয়ে দেবে।
কিন্তু স্বামীর দৈন্য ও আর্থিক অনটনের সময় স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা কতখানি সমীচীন এবং রাসূলে করীম (স) ও উমর ফারূকের উক্ত কথারই বা তাৎপর্য কি, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি মত এই –হ্যাঁ, এরূপ অবস্থায় –যখন স্বামী স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ক্ষমতা রাখে না তখন –বিয়ে ভেঙ্গে উভয়কেই মুক্ত করে দেয়া সমীচীন। হযরত আলী, হযরত উমর ফারূক, হযরত আবূ হুরায়রা (রা) প্রমুখ সাহাবী, বহু সংখ্যক তাবেয়ী, ফিকাহবিদ এবং ইমাম মালিক, শাফিয়ী ও ইমাম আহমাদ প্রমুখ ফকীহর এই মত বলে জানা গেছে। দলীল হিসেবে তাঁরা যেমন পূর্বোক্ত কথা দুটির উল্লেখ করেছেন, তেমনি ইসলামের স্থায়ী ও সর্বজনস্বীকৃত (আরবী********) “না, কারো ক্ষতি করা হবে, না কাউকে অপর কারো ক্ষতি করতে দেয়া হবে” –এই মূলনীতিও পেশ করেছেন অর্থাৎ অসচ্ছল ও অভাব-অনটনের সময় স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে দৈন্য ও দুঃখ-দুর্ভোগ পোহাতে বাধ্য করা কোনো ইনসাফের কথা হতে পারে না। এ ছাড়া আরও একটি কথা রয়েছে, আর তা হচ্ছে এই যে, মূলত স্ত্রীর সাথে সহবাস ও যৌন সঙ্গম হচ্ছে স্ত্রীর যাবতীয় খরচ বহনের বিনিময়। কাজেই বিনিময়ের দুটি জিনিসের মধ্যে একটি অনুপস্থিতিতে অপরটির উপস্থিতি ধারণা করা যায় না। এরূপ অবস্থায় স্ত্রীর অবশ্য ইখতিয়ার থাকা উচিত –হয় সে অভাবগ্রস্ত স্বামীর সাথে নিজ ইচ্ছায় থাকবে, আর থাকতে না চাইলে বিবাহ-বিচ্ছেদ করে তার মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
এঁদের আরও দুটি দলীল রয়েছে। একটি এই যে, ক্রীতদাসকে খেতে-পরতে দিতে না পারলে রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিয়েছেন তাকে বিক্রয় করে দিতে। তাহলে স্ত্রীকে খেতে পরতে না দিতে পারলে তাকে তালাক দিয়ে মুক্ত করে দেয়া হবে না কেন? আর যদি স্বামী নপুংসক হয়ে যায়, তাহলে তাদেরও বিয়ে-বিচ্ছেদ করে স্ত্রীর মুক্তির পথ প্রশস্ত করাই ইসলামের আইন। খেতে পরতে দিতে না পারা স্বামীর নপুংসকতার শামিল, তখণও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের নীতিই স্বাভাবিক।
তাঁদের দ্বিতীয় দলিল হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত আয়াতাংশঃ
(আরবী*********************************************************)
হয় যথাযথ নিয়মে ও ভালোভাবে স্ত্রীকে রাখবে, নয় ভালোভাবে ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করে তাকে ছেড়ে দেবে।
এ আয়াতের ভিত্তিতে তাঁরা বলেন যে, স্ত্রীকে খাওয়া-পরা না দিয়ে রাখা নিশ্চয়ই মারুফ ভাবে রাখা নয়। বরং এরূপ অবস্থায় পড়ে থাকতে স্ত্রীকে বাধ্য করা হলে তদপেক্ষা অধিক কষ্টদান ও ক্ষতি সাধন আর কিছু হতে পারে না।
এ পর্যায়ে দ্বিতীয় মত হচ্ছে, স্বামীর অভাব-অনটনের সময় স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য করা কিংবা বিচার বিভাগের সাহায্যে উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো অত্যন্ত মর্মান্তিক কাজ সন্দেহ নেই। এ মতের অনুকূলে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী পেশ করা হয়। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
যার রিযিক পরিমিত হয়ে পড়েছে সে যেন আল্লাহর দেয়া সম্পদ থেকে ব্যয় করে। আল্লাহ একজনকে ততটাই দায়িত্ব দেন, যতটার সম্পদ তিনি তাকে দিয়েছেন।
এ আয়াত অনুযায়ী অভাবের সময় স্ত্রীর ভরণ-পোষণ সংগ্রহের ব্যাপারে স্বামীর আদৌ কোনো দায়িত্ব থাকে না। কাজেই কোনো সময় তা না দিতে পারলে সেজন্যে যে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে হবে কিংবা তাকে তালাক দিতে বাধ্য করা হবে –এমন কোনো কথাই হতে পারে না। হযরত আয়েশা ও হাফসা (রা) যখন রাসূলে করীম (স)-এর নিকট নিজেদের খরচের দাবি জানিয়েছিলেন, তখন হযরত আবূ বকর (আয়েশার পিতা) ও হযরত উমর (হাফসার পিতা) অত্যন্ত ক্রোধ এবং রাগ প্রকাশ করেছিলেন ও নিজ নিজ কন্যাকে রাসূলের সামনেই মারধেঅর করতে চেয়েছিলেন। অথচ দাবি অনুযায়ী খরচ দিতে না পারায় তাঁরা কেউই রাসূলের নিকট তালাকের দাবি করেন নি। (আরবী***************************)
এ প্রসঙ্গে শেষ কথা এই যে, পারিবারিক যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব ইসলামী শরীয়তে কেবল স্বামীর ওপরই অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে স্ত্রীকে এ অধিকার দেয়া হয়নি যে, সে স্বামীকে সর্বাবস্থায়ই খোরপোশের বিশেষ একটা নির্দিষ্ট মান রক্ষা করে চলতে বাধ্য করবে। পূর্বোক্ত আয়াতের ভিত্তিতে স্বামী তার সামর্থ্য ও আর্থিক ক্ষমতানুযায়ী যে কোনো একটি মান (Standard) রক্ষার জন্যে দায়ী মাত্র। কোনো বিশেষ মান রক্ষার জন্যে –তাও আবার সকল অবস্থায় –তাকে দায়ী করা হয়নি।
পারিবারিক জীবনের আর্থিক দায় সম্পর্কিত এ সম্যক আলোচনা সম্বন্ধে এ কথা সুস্পষ্ট ভাষায়ই বলা যায় যে, ইসলামের এ ব্যবস্থা স্বভাব ও প্রকৃতি-ব্যবস্থার স্থায়ী নিয়মের সাথে পুরোপুরি সমঞ্জস। তা সত্ত্বেও যে সব স্বামী স্ত্রীদের বাধ্য করে তাদের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থোপার্জনের দায়িত্বও পালন করতে কিংবা যারা স্ত্রীদেরকে সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও লালন-পালনের ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি দিয়ে পুরুষের মতোই অর্থোপার্জনের যন্ত্ররূপে খাটাতে ইচ্ছুক, তারা যে স্বভাব ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থার দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না।
নারী প্রকৃতির প্রতি রাখার নির্দেশ
এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (স)-এর একটি হাদীস উল্লেখ করা যাচ্ছে। এ হাদীসে তিনি স্ত্রীলোকদের প্রকৃতিগত এক মৌলিক দুর্বলতার প্রতি বিশেষ খেয়াল রেখে চলবার জন্যে স্বামীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
মেয়েলোক সাধারণত স্বামীদের অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকে এবং তাদের অনুগ্রহকে করে অস্বীকার। তুমি যদি জীবন ভরেও কোনো স্ত্রীর প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করো, আর কোনো এক সময় যদি সে তার মর্জী-মেজাজের বিপরীত কোনো ব্যবহার তোমার মাঝে দেখতে পায় তাহলে তখনি বলে ওঠেঃ
‘আমি তোমার কাছে কোনোদিনই সামান্য কল্যাণও দেখতে পাইনি’।
রাসূলের এ কথা থেকে একদিকে যেমন নারীদের এক মৌলিক প্রকৃতিগত দোষের কথা জানা গেল, তেমনি এ হাদীস স্বামীদের জন্যেও এক বিশেষ সাবধান বাণী। স্বামীরা যদি নারীদের এ প্রকৃতিগত দোষের কথা স্মরণ না রাখে, তাহলেই পারিবারিক জীবনে অতি তাড়াতাড়ি ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এজন্যে পুরুষদের অবিচল নিষ্ঠা ও অপরিসীম ধৈর্য ধারণের প্রয়োজন রয়েছে এবং এ ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করে পারিবারিক জীবনের মাধুর্য ও মিলমিশকে অক্ষুণ্ন রাখা পুরুষদেরই কর্তব্য।
এ পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাসূলে করীম (স)-এর সেই ফরমান, যা তিনি বিদায় হজ্জের বিরাট সমাবেশে মুসলিম জনতাকে লক্ষ্য করে এরশাদ করেছিলেন। আবূ দায়ূদের বর্ণনা মতে সে ফরমানের ভাষা নিম্নরূপঃ
(আরবী*********************************************************)
হে মুসলিম জনতা! স্ত্রীদের অধিকার সম্পর্কে তোমরা আল্লাহকে অবশ্যই ভয় করতে থাকবে। মনে রেখো, তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে পেয়েছ এবং আল্লাহর কালেমার সাহায্যে তাদের দেহ ভোগ করাকে নিজেদের জন্যে হালাল করে নিয়েছ। আর তাদের ওপর তোমাদের জন্যে এ অধিকার নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, সে কোনো অবাঞ্ছিত ব্যক্তির দ্বারা তোমাদের দুজনের মিলন-শয্যাকে মলিন ও দলিত কলংকিত করবে না।
এই শেষ বাক্যের অর্থ কেবল এতটুকুই নয় যে, স্ত্রীরা ভিন্ন পুরুষদের স্বামীর শয্যায় গ্রহণ করবে না বরং-
(আরবী******************************************************)
স্বামীর অনুতমি ব্যতিরেকে স্বামীর ঘরে অপর কাউকে প্রবেশ করতে পর্যন্ত দেবে না।
গুরুতর বিষয়ে স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ
পারিবারিক –এমন কি সামাজিক ও জাতীয় –রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুতর ব্যাপারসমূহ সম্পর্কে স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করা এবং তার নিকট সব অবস্থার বিবরণ দান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার মতামত গ্রহণ করার রেওয়াজ চালু করা দাম্পত্য জীবনের মাধুর্যের পক্ষে বিশেষ অনুকূল। পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ের যাবতীয় বিষয়ে ঘরোয়া পরামর্শ অনেক সময়ই সার্বিকভাবে কল্যাণকর হয়ে থাকে। এবং তাতে করে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ঐকান্তিক আস্থা-বিশ্বাস ও অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রমাণিত হয়। আর স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর মনে ভালোবাসা ও আন্তরিক আনুগত্যমূলক ভাবধারা গভীরতর হয়। শুধু তা-ই নয়, ঘরের মেয়েলোকদের নিকটও যে অনেক সময় ভালো ভালো বুদ্ধি পাওয়া যায়, পাওয়া যায় জটিল বিষয়াদির সুষ্ঠু সমাধানের শুভ পরামর্শ, তাও তার মাধ্যমে প্রতিভাত হয়ে পড়ে। ফলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মতের ভিত্তিতে গুরুতর কাজসমূহ সম্পন্ন করাও সম্ভভ হয় অতি সহজে এবং অনায়াসে। কুরআন মজীদে এ কারণেই স্ত্রীর সাথে সর্ব ব্যাপারেই পরামর্শ করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তার বড় প্রমাণ এই যে, সন্তানকে কতদিন দুধ পান করানো হবে তা স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শের ভিত্তিতে নির্ধারণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************************************)
স্বামী ও স্ত্রী যদি পরস্পর পরামর্শ ও সন্তোষের ভিত্তিতে সন্তানের দুধ ছাড়াতে ইচ্ছা করে, তবে তাতে কোনো দোষ হবে না তাদের।
আল্লামা আহমাদুল মুস্তফা আল-মারাগী এ আয়াতের ভিত্তিতে লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
কুরআন মজীদ সন্তান পালনের মতো অতি-সাধারণ ব্যাপারেও পরামর্শ প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং পিতামাতার একজনকে অপর জনের ওপর জোর-জবরদস্তি করার অনুমতি দেয়া হয়নি –এ কথা যদি তোমরা চিন্তা ও লক্ষ্য করো, তাহলে গুরুতর বিপজ্জনক ও বিরাট কল্যাণময় কাজ-কর্ম ও ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শের গুরুত্ব সহজেই বুঝতে পারবে।
রাসূলে করীম (স)-এর জীবনে এ পর্যায়ের বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সর্ব প্রথম অহী লাভ করার পর তাঁর হৃদয়ে যে ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি হয়েছিল, তার অপনোদনের জন্যে তিনি ঘরে গিয়ে স্বীয় প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)-এর নিকট সব অবস্থার বিবরণ দান করেন। বলেছিলেনঃ
(আরবী***************************************************)
আমি এই ব্যাপারে নিজের সম্পর্কে বড় ভীত হয়ে পড়েছি।
এ কথা শুনে সঙ্গিনী হযরত খাদীজা (রা) তাঁকে বলেছিলেনঃ
(আরবী*************************************************************)
আল্লাহ আপনাকে কখনই এবং কোনোদিই লজ্জিত করবেন না। কেননা আপনি তো ছেলায়ে (আত্মীয়তার সম্পর্ক)-র রেহমী রক্ষা করেন, অপরের বোঝা বহন করে থাকেন, কপর্দহীন গরীবদের জন্যে আপনি উপার্জন করেন, মেহমানদারী রক্ষা করেন, লোকদের বিপদে-আপদে তাদের সাহায্য করে থাকেন, এজন্যে আল্লাহ কখনই শয়তানদের আপনার ওপরে জয়ী বা প্রভাবশালী করে দেবেন না। কোনো অমূলক চিন্তা-ভাবনাও আপনার ওপর চাপিয়ে দেবেন না। আর এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ আপনাকে আপানার জাতির লোকজনের হেদায়েতের কার্যের জন্যেই বাছাই করে নিয়েছেন।
হযরত খাদীজার এ সান্ত্বনা বাণী রাসূলে করীম (স)-এর মনের ভার অনেকখানি লাঘব করে দেয়। আর এ ধরনের অবস্থায় প্রত্যেক স্বামীর জন্যে তার প্রিয়তমা ও সহানুভূতিসম্পন্না স্ত্রীর আন্তরিক সান্ত্বনাপূর্ণ কথাবার্তা অনেক কল্যাণ সাধন করে থাকে।
হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে যখন মক্কা গমন ও বায়তুল্লাহর তওয়াফ করা সম্ভব হলো না, তখন রাসূলের সঙ্গে অবস্থিত চৌদ্দশ সাহাবী নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ সময়ে রাসূল (স) তাঁদেরকে এখানেই কুরবানী করতে আদেশ করেন। কিন্তু সাহাবীদের মধ্যে তাঁর এ নির্দেশ পালনের কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। এ অবস্থা দেখে রাসূলে করীম (স) বিস্মিত ও অত্যন্ত মর্মাহত হন। তখন তিনি অন্দরমহলে প্রবেশ করে তাঁর সঙ্গে অবস্থানরতা তাঁর স্ত্রী হযরত উম্মে সালমা (রা)-এর কাছে সব কথা খুলে বললেন। তিনি সব কথা শুনে সাহাবাদের এ অবস্থার মনস্তাত্ত্বিক কারণ বিশ্লেষণ করেন এবং বলেনঃ
(আরবী*******************************************************)
হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নিজেই বের হয়ে পড়ুন এবং যে কাজ আপনি করতে চান তা নিজেই শুরু করে দিন। দেখবেন, আপনাকে সে কাজ করতে দেখে সাহাবিগণ নিজ থেকেই আপনার অনুসরণ করবেন এবং সে কাজ করতে লেগে যাবেন।
এহেন গুরুতর পরিস্থিতিতে বাস্তবিকই হযরত উম্মে সালমার পরামর্শ বিরাট ও অচিন্ত্যপূর্ব কাজ করেছিল। এমনিভাবে সব স্বামীই তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে এ ধরনের কল্যাণময় পরামর্শ লাভ করতে পারে তাদের সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে।
স্ত্রীর কর্তব্য ও অধিকার
স্ত্রীদের অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম পুরুষদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হয়েছে অর্থাৎ পুরুষদের যা যা কর্তব্য স্ত্রীদের প্রতি, তাই হচ্ছে স্ত্রীদের অধিকার পুরুষদের ওপর। এক্ষণে আলোচনা করা হবে –স্ত্রীলোকদের ওপর পুরুষদের অধিকার –অন্য কথায় পুরুষদের প্রতি স্ত্রীদের কর্তব্য। বস্তুত একজনের যা কর্তব্য অপরের প্রতি, তাই হচ্ছে অপরজনের অধিকার তার প্রতি। উভয়ের প্রতি উভয়ের কর্তব্য যা তাই হচ্ছে উভয়ের প্রতি উভয়ের অধিকার।
আইনের পূর্ণতার দৃষ্টিতে বিচার করলেও একথা অস্বীকার করা যায় না যে, একদেশদর্শী, একপেশে ও একতরফা আইন বা বিধান কখনো পূর্ণ আইন হতে পারে না, পারে না তা সমগ্র মানবতার প্রতি কল্যাণকর হতে। যে আইন কেবল একচেটিয়াভাবে পুরুষের অধিকার ও কর্তৃত্বের কথা বলে, স্ত্ররি অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে যা নির্বাক কিংবা এর বিপরীত –যে আইন কেবল স্ত্রীদের অধিকারের কথা বলে, পুরুষদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে কোনো নির্দেশ দেয় না, তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই কারণেই ইসলাম এ ধরনের একপেশে ও একদেশদর্শী বিধান নয়।
এতে সন্দেহ নেই যে, নারী জন্মগতভাবেই দুর্বল, স্বাভাবিক আবেগ উচ্ছ্বাসের দিক দিয়ে ভারসাম্যহীন, দৈহিক আকার-আঙ্গিকের দৃষ্টিতেও পুরুষদের তুলনায় ক্ষীণ ও নাজুক, কোমল ও বলহীন। এজন্যে নারীর প্রতি অধিকার অনুগ্রহপূর্ণ দৃষ্টিদান এবং অধিক প্রেম ভালোবাসা পোষণ অপরিহার্য। কিন্তু তাই বলে তাদের পক্ষে উপযুক্ত ও জরুরী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করা থেকে তাদের নিষ্কৃতি দেয়া যেতে পারে না। কেননা তাহলে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের জীবন –সমষ্টিগত জীবন –অত্যন্ত তিক্ত ও কষ্টপূর্ণ হতে বাধ্য।
স্ত্রী ঘরের রাণী
পুরুষ ও নারীর জ্ঞান-বুদ্ধি, কর্মক্ষমতা ও দৈহিক-আঙ্গিকের স্বাভাবিক পার্থক্যের কারণে পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কর্মবণ্টনের নীতি পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করা হয়েছে। পুরুষকে করা হয়েছে কামাই-রোজগার ও শ্রম-মেহনতের জন্যে দায়িত্বশীল আর স্ত্রীকে করা হয়েছে ঘরের রাণী। পুরুষের জন্যে কর্মক্ষেত্র করা হয়েছে বাইরের জগত আর নারীর জন্যে ঘর। পুরুষ বাইরের জগতে নিজের কর্মক্ষমতা প্রয়োগ করে যেমন করবে কামাই-রোজগার, তেমনি গড়বে সমাজ-রাষ্ট্র, শিল্প ও সভ্যতা। আর নারী ঘরে থেকৈ একদিকে করবে ঘরের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, অপরদিকে করবে গর্ভ ধারণ, সন্তান প্রসব, লালন ও ভবিষ্যতের উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তোলার কাজ। এজন্যে নারীর সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**************************************)
এবং নারী-স্ত্রী –তার স্বামীর ঘরের পরিচালিকা, রক্ষণাবেক্ষণকারিণী, কর্ত্রী।
এ হাদীসের (আরবী******) শব্দের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
(আরবী******) হচ্ছে হেফাযতকারী, রক্ষণাবেক্ষণকারী, আমানতদার, দায়িত্বের অধীন সব জিনিসের কল্যাণ সাধনের জন্যে একান্ত বাধ্য। যে ব্যক্তির দায়িত্বেই যে কোনো জিনিস দেয়া হবে, এমন প্রত্যেকেরই তেমন প্রত্যেকটি জিনিসে সুবিচার ও ইনসাফ করা এবং তার দ্বীনী ও দুনিয়াবী কল্যাণ সাধন করাই বিশেষ লক্ষ্য। এখন যার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সে যদি তা পুরোপুরি পালন কর, তবে সে পূর্ণ অংশই লাভ করল, অধিকারী হলো বিরাট পুরস্কার লাভের আর যদি তা না করে, তবে দায়িত্বের প্রত্যেকটি জিনিসই তার অধিকার দাবি করবে।
আর দীর্ঘ হাদীসের ওপরে উদ্ধৃত অংশের ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
আর ‘স্ত্রী স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীলা’ হওয়ার মানে, স্বামীর ঘরের সুন্দর ও পূর্ণ ব্যবস্থাপনা করা, স্বামীর কল্যান কামনা ও তাকে ভালো কাজের পরামর্শ বা উপদেশ দেয়া এবং স্বামীর ধনমাল ও তার নিজের ব্যাপারে পূর্ণ আমানতদারী ও বিশ্বাসপরায়ণতা রক্ষঅ করাই স্ত্রীর কর্তব্য।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের কথা নিম্নোক্ত হাদীসে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
তোমাদের জন্যে তোমাদের স্ত্রীদের ওপর নিশ্চয়ই অধিকার রয়েছে, আর তোমাদের স্ত্রীদের জন্যেও রয়েছে তোমাদের ওপর অধিকার। তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে এই যে, তারা তোমাদের শয্যায় এমন লোককে স্থান দেবে না যাকে তোমরা পছন্দ করো না। তোমাদের ঘরে এমন লোককেও প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না, যাদের তোমরা পছন্দ করো না বলে নিষেধ করো।
আর তোমাদের ওপর তাদের অধিকার হচ্ছে, তোমরা তাদের ভরণ-পোষণ খুবই উত্তমভাবে বহন করবে!
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যসম্পন্না এ দাম্পত্য জীবন যে কতদূর গুরুত্বপূর্ণ এবং এ জীবনে স্ত্রীর যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা ব্যাখ্যা করে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
দাম্পত্য জীবনের সম্পর্ক, সম্বন্ধ ও মিলনই হচ্ছে পারিবারিক জীবনের বৃহত্তম সম্পর্ক। এ সম্পর্কের ফায়দা সর্বাধিক, প্রয়োজন পূরণের দৃষ্টিতে তা অধিকতর স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেননা আরব অনারবের সকল পর্যায়ের লোকদের মধ্যে স্থায়ী নিয়ম হচ্ছে এই যে, স্ত্রী সকল কল্যাণময় কাজে-কর্মে স্বামীর সাহায্যকারী হবে, তার খানাপিনা প্রস্তুতকরণ ও কাপড়-চোপড় পরিস্কার ও পরিপাটি করে রাখার ব্যাপারে সে হবে স্বামীর ডান হাত, তার মাল-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তার সন্তানদের লালন-পালন করবে এবং তার অনুপস্থিতিতে সে তার ঘরের স্থলাভিষিক্ত ও দায়িত্বশীলা।
ঘরের অভ্যন্তরে ভাগের যাবতীয় ব্যাপারের জন্যে প্রথমত ও প্রধানত স্ত্রীই দায়ী। তারই কর্তৃত্বে যাবতীয় ব্যপার সম্পন্ন হবে। এখানে তাকে দেয়া হয়েছে এক প্রকারের স্বাধীনতা। স্বামীর ঘর কার্যত তার নিজের ঘর, স্বামীর জিনিসপত্র ও ধন-সম্পদ স্ত্রীর হেফাযতে থাকবে। সে হবে আমানতদার, অতন্দ্র প্রহরী। কিন্তু স্বামীর ঘরের কাজকর্ম কি স্ত্রীকে তার নিজের হাতে সম্পন্ন করতে হবে? এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজমের একটি উক্তি দেখতে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
স্বামীর খেদমত করা –কোনো প্রকারের কাজ করে দেয়া মূলত স্ত্রীর কর্তব্য নয়, না রান্না-বান্নার আয়োজন করার ব্যাপারে; না রান্না করার ব্যাপারে; না সূতা কাটা; কাপড় বোনার ব্যাপারে; না কোনো কাজে।
ফিকাহিবদগণ এর কারণস্বরূপ বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
কেননা বিয়ের আকদ হয়েছে স্ত্রীর সাথে যৌন ব্যবহারের সুখ ভোগ করার জন্যে। অতএব স্বামী তার কাছ থেকে অপর কোনো ফায়দা লাভ করার অধিকারী হতে পারে না।
অথচ আবূ সওর বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
সব ব্যাপারে স্বামীর খেদমত করাই স্ত্রীর কর্তব্য।
ইবনে হাজমের ‘মূলত কর্তব্য নয়’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা কোনো কাজ মূরত কর্তব্যভুক্ত না হলেও অনেক সময় তা না করে উপায় থাকে না। এজন্য আমরা রাসূল (স)-এর সময়কার ইসলামী সমাজে দেখতে পাই –স্ত্রীরা ঘরের যাবতীয় কাজ-কর্ম রীতিমত করে যাচ্ছে। নিজেদের হাতেই সব কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে, ঘরের কাজ-কর্ম করতে গিয়ে নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করছে, তবু সে কাজ ত্যাগ করেনি, কাজ করতে অস্বীকৃতিও জানায়নি। বলেনি –আমি কোনো কাজ করতে পারব না। রাসূল-তনয়া হযরত ফাতিমা (রা) ঘরের যাবতীয় কাজ করতেন, চাক্কি বা যাঁতা চালিয়ে গম পিষতেন, নিজ হাতে রুটি পাকাতেন। এ কাজে তাঁর খুবই কষ্ট হতো। এজন্যে একদিন তিনি তাঁর স্নেহময় পিতার কাছে অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। হযরত আসমা (রা) তাঁর স্বামীর সব রকমের খেদমত করতেন। তিনি নিজেই বলেছেনঃ
(আরবী********************************************)
আমি আমার স্বামী জুবাইরের সব রকমের খেদমত করতাম।
রাসূলে করীম (স)-এর যুগে ইসলামী সমাজের স্ত্রীরা স্বামীর খেদমত করতেন –এ কথা ঠিক। হযরত ফাতিমাও যখন নিজ হাতে যাঁতা চালিয়ে আটা তৈরী করতেন, আটা পিষে রুটি তৈয়ার করতেন ও আগুনের তাপ সহ্যকরে রুটি পাকাতেন, তখন অপর যে কোনো স্ত্রীর পক্ষে তা অকরণীয় হতে পারে না। বরং সবার জন্যেই তা অনুসরণীয়। নিজের ঘরের কাজ করা কোনো স্ত্রীর পক্ষেই অপমান কিংবা লজ্জার কারণ হতে পারে না। ইমামা মালিক এতোদূর বলেছেন যে, স্বামী বিশেষ ধনী লোক না হলে স্ত্রীর কর্তব্য তার ঘরের যাবতীয় কাজ যতদূর সম্ভব নিজের হাতে আঞ্জাম দেয়া –সে স্ত্রী যতবড় ধনী বা অভিজাত ঘরের কন্যাই হোক না কেন।
কুরআনের আয়াতঃ
(আরবী********************************************************)
স্ত্রীদের সেই সব অধিকারই রয়েছে স্বামীদের ওপর, যা স্বামীদের রয়েছে স্ত্রীদের ওপর।
প্রমাণ করে যে, স্বামী যেমন স্ত্রীর জন্যে প্রাণপাত করে, স্ত্রীরও কর্তব্য স্বামীর জন্যে কষ্ট স্বীকার করা। ইমাম ইবনে তাইমিয়াও এরূপে ফতোয়া দিয়েছেন। আবূ বকর ইবনে শায়বা ও আবূ ইসহাক জাওজেজানীর মতও তা-ই। হাদীসে আরো স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে এর স্বপক্ষে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************)
নবী করীম (স) তাঁর কন্যা ফাতিমার ওপর তাঁর ঘরের মধ্যকার যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং হযরত আলীর ওপর দিয়েছিলেন ঘরের বাইরের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব।
জিদ ও হঠকারিতা পরিহার
স্ত্রীলোকদের প্রায় সকলেরই একটি সাধারণ দোষ হচ্ছে জিদ ও হঠকারিতা। এ দোষ থেকে যথাসম্ভব তাদের মুক্ত থাকতে চেষ্টা করতে হবে। কেননা দেখা গেছে, কোনো সামান্য ব্যাপারেও তাদের মরজী ও মন-মেজাজের বিপরীত ঘটলেই তারা আগুনের মতো জ্বলে ওঠে। তখন তারা যে কোন বিপর্যয় ঘটাতে ত্রুটি করে না। আর এতে করে পারস্পরিক খারাপ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। স্বামীর মন তার দোষে তিক্ত বিরক্ত হয়ে যায় খুব সহজেই।
অবশ্য অপরিহার্য কোনো ব্যাপার হলে স্ত্রীর কর্তব্য অপরিসীম ধৈর্য সহকারে স্বামীকে বোঝানো, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে প্রেম-ভালোবাসার অমৃত ধারায় স্বামীর মনের সব কালিমা ধুয়েমুছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা। তার বদলে রাগ করে, মুখ ভার করে, তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-ঝাটি করে গোটা পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলা তার কখনও উচিত নয়। স্বামীকে অসন্তুষ্ট বা ক্রুব্ধ দেখতে পেলে যথাসম্ভব শান্ত ও নরম হয়ে যাওয়া স্ত্রীর কর্তব্য। আর নিজেদের দমেরন ঝাল মেটানো যদি অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাহলে তা অপর এক সময়ের জন্যে অপেক্ষায় রেখে দেবে, পরে এমন এক সময় এবং এমনভাবে তা করবে, যাতে করে পারস্পরিক সম্পর্ক কিছুমাত্র তিক্ত হয়ে উঠবে না।
স্বামীর বাড়াবাড়ি ও ক্রুব্ধ মেজাজ দেখতে পেলে স্ত্রীর খুব সতর্কতার সাথেই কাজ করা, কথা বলা উচিত। এ অবস্থায় স্ত্রীরও বাড়াবাড়ি করা কিংবা নিজের সম্ভ্রম-মর্যাদার অভিমানে হঠাৎ করে ফেটে পড়া কোনোমতেই বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। স্বামীর কাছে কিছুটা ছোট হয়েও যদি পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখা যায়, তবে স্ত্রীর তাই করা কর্তব্য। কেননা তাতেই তার ও গোটা পরিবারের কল্যাণ নিহিত। কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা এ পর্যায়েই এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর বদমেজাজী ও তার প্রতি প্রত্যাখ্যান উপেক্ষা-অবহেলা দেখতে পায় আর তার পরিণাম ভালো না হওয়ার আশংকা বোধ করে, তাহলে উভয়ের যে কোনো শর্তে সমঝোতা করে নেওয়ার কোনো দোষ নেই। বরং সব অবস্থায়ই সমঝোতা-সন্ধি-মীমাংসাই অত্যন্ত কল্যাণময়।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
আয়াতে সাধারন অর্থে কথাগুলো বলা হয়েছে। এভাবে বলার কারণে বোঝা যায় যে, যে সমঝোতার ফলেই উভয়ের মনের মিল হতে পারে, পারস্পরিক বিরোধ দূর হয়ে যায় তাই মোটামুটিভাবে অনেক উত্তম কাজ কিংবা তা অতীব উত্তম বিচ্ছেদ হওয়া থেকে, বেশি উত্তম ঝগটা-ফাসাদ থেকে।
সহাস্যবদনে স্বামীর অভ্যর্থনা
এ পরিপ্রেক্ষিতে একথাও উল্লেখযোগ্য যে, স্বামী যখনই বাহির থেকে ঘরে ফিরে আসে, তখন স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে হাসিমুখে ও সহাস্যবদনে তাকে অভ্যর্থনা করা –স্বাগতম জানানো। কারণ স্ত্রীর স্মিতহাস্যে বিরাট আকর্ষণ রয়েছে, তার দরুণ স্বামীর মনের জগতে এমন মধুভরা মলয়-হিল্লোল বয়ে যায় যে, তার হৃদয় জগতের সব গ্লানিমা-শ্রান্তি জনিত সব বিষাদ-ছায়া সহসাই দূরীভূত হয়ে যায়। স্বামী যত ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়েই ঘরে ফিরে আসুক না কেন এবং তার হৃদয় যত বড় দুঃখ, কষ্ট ও ব্যর্থতায়ই ভারাক্রান্ত হোক না কেন, স্ত্রীর মুখে অকৃত্রিম ভালোবাসাপূর্ণ হাসি দেখতে পেলে সে তার সব কিছুই নিমেষে ভুলে যেতে পারে।
কাজেই যে সব স্ত্রী স্বামীর সামনে গোমরা মুখ হয়ে থাকে, প্রাণখোলা কথা বলে না স্বামীর সাথে, স্বামীকে উদার হৃদয়ে ও সহাস্যবদনে বরণ করে নিতে জানে না বা করে না, তারা নিজেরাই নিজেদের ঘর ও পরিবারকে –নিজেদেরই একমাত্র আশ্রয় দাম্পত্য জীবনকে ইচ্ছে করেই জাহান্নামে পরিণত করে, বিষায়্তি করে তোলে গোটা পরিবেশকে। রাসূলে করীম (স) এ কারণেই ভালো স্ত্রীর অন্যতম একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
(আরবী*****************************************************)
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দৃষ্টি পড়লেই স্ত্রী তাকে সন্তুষ্ট করে দেয় (স্বামী স্ত্রীকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে)।
স্বামীর গুণের স্বীকৃতি
স্বামী স্ত্রীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, তার জন্যে সাধ্যানুসারে উপহার-উপঢৌকন নিয়ে আসে, তার সুখ-শান্তির জন্যে যতদূর সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরূপ অবস্থায় স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর এসব কাজের দরুণ আন্তরিক ও অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। অন্যথায় স্বামীর মনে হতাশা জাগ্রত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
আল্লাহ তা’আলা এমন স্ত্রীলোকের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করবেন না, যে তার স্বামীর ভালো ভালো কাজের শুকরিয়া জ্ঞাপন করে না।
এ শুকরিয়া যে সব সময় মুখে ও কতায় জ্ঞাপন করতে হবে, এমন কোনো জরুরী শর্ত নেই। শুকরিয়া জ্ঞাপনের নানা উপায় হতে পারে। কাজে-কর্মে, আলাপে-ব্যবহারে স্বামীকে বরণ করে নেয়ার ব্যাপারে স্ত্রীর মনের কৃতজ্ঞতা ও উৎফুল্লতা প্রকাশ পেলেও স্বামী বুঝতে পারে –অনুভব করতে পারে যে, তার ব্যবহারে তার স্ত্রী তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ এবং সে তার জন্যে যে ত্যাগ স্বীকার করছে, তা সে অন্তর দিয়ে স্বীকার করে।
বুখারী শরীফের একটি হাদীসে এগারো জন স্ত্রীলোকের এক বৈঠকের উল্লেখ রয়েছে। তাতে প্রত্রেক স্ত্রীই নিজ নিজ স্বামী সম্পর্কে বর্ণনা দানের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে এবং তার পরে প্রত্যেকেই তা পরস্পরের নিকট বর্ণনা করে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর খুবই প্রশংসা করে। এ প্রশংসা করা যে অন্যায় নয় বরং অনেক সময় প্রয়োজনীয় তা এ থেকে সহজেই বোঝা যায়। তাই এ সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বামীর সম্মুখে তার প্রশংসা করা –বিশেষত যখন জানা যাবে যে, তার দরুন তার মেজাজ বিগড়ে যাবে না –তার মন দুষ্ট হবে না –সঙ্গত কাজ।
যৌন মিলনের দাবি পূরণ
যৌন মিলনের দাবি এক স্বাভাবিক দাবি। এ ব্যাপরে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই সমান। কিন্তু এ ব্যাপারে নারী সব সময় Passive –নিশ্চেষ্ট, অনাগ্রহী ও অপ্রতিরোধীও। পুরুষই এক্ষেত্রে অগ্রসর, active অর্থাৎ সক্রিয় ভূমিকা করে থাকে। সেজন্যে যৌন মিলনের ব্যাপারে সাধারণত স্বামীর তরফ থেকেই আসে আমন্ত্রণ। তাই এ ব্যাপারে স্বামীর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা কখনই স্ত্রীর পক্ষে উচিত হতে পারে না। বরং প্রেম-ভালোবাসার দৃষ্টিতে স্বামীর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা কখনই স্ত্রীর পক্ষে উচিত হতে পারে না। বরং প্রেম-ভালোবাসার দৃষ্টিতে স্বামীর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা কখনই স্ত্রীর পক্ষে উচিত হতে পারে না। বরং প্রেম-ভালোবাসার দৃষ্টিতে স্বামীর যে কোনো সময়ের এ দাবিকে সানন্দ চিত্তে, সাগ্রহে ও সন্তুষ্টি সহকারে গ্রহণ করা –মেনে নেয়া স্ত্রীর কর্তব্য। এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর বাণী সুস্পষ্ট। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************))
স্বামী যখন নিজের যৌন প্রয়োজন পূরণের জন্যে স্ত্রীকে আহবান জানাবে, তখন সে চুলার কাছে রান্না-বান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলেও সে কাজে অমনি তার প্রস্তুত হওয়া উচিত।
অপর হাদীসে এর চেয়েও কড়া কথা উল্লেখিত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************)
স্বামী যখন তার স্ত্রীকে নিজের শয্যায় আহবান করে (যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে), তখন যদি সে সাড়া না দেয় –অস্বীকার করে, তাহলৈ ফেরেশতাগণ সকাল হওয়া পর্যন্ত তার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
‘হাদীসটি’ থেকে বাহ্যত মনে হয় যে, এ ঘটনা যখন রাত্রী বেলা হয়, তখনই ফেরেশতারা অস্বীকারকারী স্ত্রীর ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে; কিন্তু আসলে কেবল রাতের বেলার কথাই নয়, দিনের বেলাও এরূপ হলে ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষিত হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু যৌন মিলনের কাজ সাধারণত রাতের বেলাই সম্পন্ন হয়ে থাকে, এ জন্যে রাসূলে করীম (স) রাতের বেলার কথা বলেছেন। মূলত এ কথা রাত ও দিন –উভয় সময়ের জন্যেই প্রযোজ্য।
অপর এক হাদীসে এ কথাটি অধিকতর তীব্র ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। তা এইঃ
(আরবী**********************************************************)
যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, যে ব্যক্তিই তার স্ত্রীকে যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে তার শয্যায় ডাকবে, তখন যদি স্ত্রী তা অমান্য করে –যৌন মিলনে রাজি হয়ে তার কাছে না যায়, তবে আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট –ক্রুব্ধ থাকবেন যতক্ষণ না স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে।
অনুরূপ আর একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************)
স্ত্রী যদি তার স্বামীর শয্যা ত্যাগ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, তবে যতক্ষণে সে তার স্বামীর কাছে ফিরে না আসবে, ফেরেশতাগণ তার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকবে।
আর একটি হাদীস হচ্ছেঃ
(আরবী******************************************************************)
তিন ব্যক্তির নামায কবুল হয় না, আকাশের দিকে উত্থিত হয় তা তাদের কোনো নেক কাজও। তারা হচ্ছেঃ পলাতক ক্রীতদাস –যতক্ষণ না মনিবের নিকট ফিরে আসবে, নেশাখোর, মাতাল –যতক্ষণ না সে সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ হবে এবং সেই স্ত্রী, যার স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট –যতক্ষণ না স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে।
ইবনে জাওজীর ‘কিতাবুন নিসা’য় উদ্ধৃত অপর এক হাদীসে আরো বিস্তৃত কথা বলেছেন –হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ
(আরবী*********************************************************)
রাসূলে করীম (স) ‘মুসবিফা’ ও ‘মুগলিসা’র ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। ‘মুসবিফা বলতে বোঝায় সেই নারী, যাকে তার স্বামী যৌন মিলনে আহবান জানালে সে বলেঃ ‘এই শীগগিরই আসছি’। আর ‘মুগলিসা’ হচ্ছে সেই স্ত্রী, যাকে তার স্বামী যৌন মিলনে আহবান জানালেসে বলে ‘আমার হায়েয হয়েছে’, অথচ প্রকৃতপক্ষে সে ঋতু অবস্থায় নয়।
অবশ্য এ ব্যাপারে স্ত্রীর স্বাস্থ্য, মানসিক অবস্থা ও ভাবধারার প্রতি পুরাপুরি লক্ষ্য রাখতে হবে। স্বামী যদি নিতান্ত পশু হয়ে না থাকে, তার মধ্যে থেকে থাকে মনুষ্যত্বসুলভ কোমল গুণাবলী, তাহলে সে কিছুতেই স্ত্রীর মরজী-মনোভাবের বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তি করে যৌন মিলনের পাশবিক ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে যাবে না। সে অবশ্যই স্ত্রীর স্বাস্থ্যগত মানবিক সুবিধা-অসুবিধার, আনুকূল্য-প্রতিকূলতা সম্পর্কে খেয়াল রাখবে এবং খেয়াল রেখেই অগ্রসর হবে।
উপরে উদ্ধৃত হাদীসসমূহ সম্পর্কে নববী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
এ সব হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোনো প্রকার শরীয়তসম্মত ওযর বা কারণ ছাড়া স্বামীর শয্যায় স্থান গ্রহণ থেকে বিরত থাকা স্ত্রীর পক্ষে হারাম।
স্ত্রীর কোনো শরীয়তসম্মত ওযর থাকলে স্বামীকে অবশ্যই এ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ফিকাহবিদগণ এজন্যে বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
অধিক মাত্রায় যৌন সঙ্গম যদি স্ত্রীর পক্ষে ক্ষতিকর হয় তাহলে তার সামর্থ্যের বেশি যৌন সঙ্গম করা জায়েয নয়।
অবশ্য রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামীর এ ধরনের কামনা-বাসনা বা দাবি যথাযথভাবে পূরণের জন্যে সতত প্রস্তুত হয়ে থাকা। এ প্রস্তুত হয়ে থাকার গুরুত্ব নানা কারণে অনস্বীকার্য। এমনকি রাসূলে করীম (স)-এর ফরমান অনুযায়ী স্বামীর বিনানুমতিতে নফল রোযা রাখাও স্ত্রীর পক্ষে জায়েয নয়। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ছাড়া স্ত্রী নফল রোযা রাখবে না।
কেননা রোযা রাখলে স্ত্রী স্বামীর যৌন মিলনের দাবি পূরণে অসমর্থ হতে পারে, আর স্বামীর এ দাবিকে কোনো সাধারণ কারণে অপূর্ণ রাখা স্ত্রীর উচিত নয়।
ইসলামে এসব বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে কেবলমাত্র এজন্যে যে, সমাজের লোকদের পবিত্রতা, অকলংক চরিত্র ও দাম্পত্য জীবনের অপরিসীম তৃপ্তি ও সুখ-শান্তি, প্রেম-ভালোবাসা ও মাধুর্য রক্ষার জন্যে এ বিষয়গুলো অপরিহার্য।
আর এ কারণেই নবী করীম (স) ও সাহাবায়ে কিরাম-এর যুগে স্ত্রীগণ তাঁদের স্বামীদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। স্বামীদের একবিন্দু অসন্তুষ্টি বা মনোকষ্ট তাঁরা সইতে পারতেন না। এমন কি, কোনো স্বামীর প্রত্যাখ্যানও তার স্ত্রীর এ কর্মপদ্ধতি পরিত্যাগ করাতে পারত না। হাদীসে ও সাহাবীদের জীবন চরিতে এ পর্যায়ের ভূরি ভূরি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
আল্লাহর ইবাদত আদায়ে পারস্পরিক সহযোগিতা
আল্লাহর দ্বীন পালনের জন্যে স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে পরস্পরকে উৎসাহ দান। ইসলামের ফরয ওয়াজিব ইবাদত এবং শরীয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম পালনের জন্যে তো একজন অপরজনকে প্রস্তুত ও উদ্বুদ্ধ করবেই। এ হচ্ছে প্রত্যেকেরই দ্বীনী কর্তব্য। কিন্তু তা ছাড়াও সুন্নত এবং নফল ইবাদতের জন্যেও তা করা ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্য। এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর দু’-তিনটি বাণী এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ
তিনি এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
আল্লাহ যে পুরুষকে রহমত দান করবেন, সে রাতের বেলা জেগে ওঠে নামায পড়বে এবং তার স্ত্রীকেও সেজন্যে সজাগ করবে। স্ত্রী ঘুম ছেড়ে উঠতে অস্বীকার করলে তার মুখে পানি ছিঁটিয়ে দেবে।
অনুরূপভাবে আল্লাহ রহমত দান করবেন সেই স্ত্রীকে, যে রাতের বেলা জেগে উঠে নিজে নামায পড়বে এবং সে তার স্বামীকেও সেজন্যে জাগাবে; স্বামী উঠতে না চাইলে মুখে পানি ছিঁটিয়ে দেবে।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************************)
পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে রাতের বেলা জাগাবে এবং দুজনেই নামায পড়বে –আলাদা আলাদাভাবে এবং দুরাকাত নামায একত্রে পড়বে, আল্লাহ এ স্বামী-স্ত্রীকে আল্লাহর যিকরকারী পুরুষ-নারীদের মধ্যে গণ্য করবেন।
স্বামী পরিচর্যায় মহিলা সাহাবী
হযরত আয়েশা (রা)-এর সাথে নবী করীম (স)-এর ভালোবাসা ইতিহাসে দৃষ্টান্তমূলক। হযরত আয়েশা (রা) একদিন হাতে রৌপ্য নির্মিত দস্তানা পরেছিলেন। নবী করীম (স) এসে জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আয়েশা, তোমরা হাতে কি পরেছ? তিনি বললেনঃ আপনার সন্তুষ্টির জন্যে এ দস্তানা পরিধান করেছি। হযরত আয়েশা রাসূলের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তাঁর কাপড়-চোপড় তিনি নিজ হাতে ধুয়ে সাফ করে দিতেন, তাঁর পোশাকে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতেন, তাঁর মিসওয়াক শুকনো থাকলে তিনি তা চিবিয়ে মুখের লালায় ভিজিয়ে মসৃণ করে দিতেন এবং সেটাকে তিনি নিজের হেফাযতে রাখতেন। তিনি নিজ হাতে রাসূলের চুলে দাঁড়িতে চিরুণী করে দিতেন। বুখারী ও অন্যান্য হাদীসে তার অকাট্য প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।
হযরত খাওলা (রা) একদা হযরত আয়েশার খেদমতে হাযির হয়ে বললেনঃ আমি প্রতি রাতে সুসাজে সজ্জিতা হয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে স্বামীর জন্যে দুলহিন সেজে তার কাছে উপস্থিত হই, তারই পাশে গিয়ে শয়ন করি। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি –সে আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। হযরত আয়েশার জবানীতে রাসূলে করীম (স) এ কথা শুনে বললেনঃ তাকে বলো, সে যেন তার স্বামীর আনুগত্য ও মনতুষ্টি সাধনেই সতত ব্যস্ত থাকে।
এ ধরনের সমাজ-পরিবেশের ফলে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা গভীর ও অসীম হয়ে যায়। একজন অপরজনের জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এর সাথে তাঁর বেগমদের প্রেম-ভালোবাসা ছিল বর্ণনাতীত। হযরত খাদীজাতুল কুবরা রাসূলের জন্যে –জিন্দেগীর মিশনের জন্যে রাসূল হিসেবে তাঁর কঠিন দায়িত্ব পালনে তাঁর যাবতীয় ধন-সম্পদ নিঃশেষ খরচ করে দিয়েছিলেন। আর সেজন্যে তিনি কোনোদিন এতটুকু আফসোসও প্রকাশ করেন নি। বরং নবী করীম (ষ) যদি কখনও সে বিষয়ে কথা তুলতেন, তাহলে তিনি নিজেই রাসূলকে সান্ত্বনা দিতেন।
রাসূলে করীম (স)-এর মহিলা সাহাবিগণ প্রায় সকলেই এই একই ভাবধারায় মহিমান্বিত ছিলেন। হযরতের কন্যা জয়নব তাঁর স্বামীকে বন্দীশালা থেকে মুক্তিদানের জন্যে নিজের কণ্ঠের বহু মূল্যের হার ফিদিয়া-বিনিময় মূল্য হিসেবে দিয়েছিলেন ও তাকে মুক্ত করেছিলেন।
এসব ঘটনা হতে নিঃসন্দেহে বোঝা যায় যে, ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর জীবনকে এক উত্তম প্রেম-ভালেবাসার মাধুর্যপূর্ণ ভাবধারায় সঞ্জীবিত দেখতে চায়। কেননা প্রেম-ভালোবাসা, পারস্পরিক আদর-যত্ন ও সোহাগ না হলে দাম্পত্য জীবন আর বিয়ের বন্ধন যে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যায়, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
পারিবারিক জীবনের সংস্থা
উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে ইসলামের পারিবারিক সংস্থার কাঠামো ও ধরন-প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধাণা সহজেই করা যেতে পারে। নারীর স্বাভাবিক দুর্বলতা, নানাবিধ দৈহিক অসুবিধা এবং পুরুষের তুলনায় তার দৈহিক ও মানসিক অসম্পূর্ণতার কারনে ইসলাম স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক জীবনে পুরুষের প্রাধান্য ও নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর সমষ্টিগত জীবনের প্রধান কিংবা পারিবারিক জীবনের চেয়ারম্যান –পরিচালক ও নেতা হচ্ছে পুরুষ-স্ত্রী নয়। কেনান পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে যে কোনো প্রতিকূলতা, অসুবিধা, বিপদ-মুসিবদ আসতে পারে কিংবা সাধারণত এসেথাকে, তার মুকাবিলা করার এবং এ সমস্যার ও জটিলতার সমাধান করার উপযুক্ত ক্ষশতা ও যোগ্যতা পুরুষেরই রয়েছে। সাধারণত সে ক্ষমতা স্ত্রীলোকের হয় না। অন্তত পুরুষের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে স্ত্রীলোকদের সে ক্ষমতা স্ত্রীলোকের হয় না। অন্তত পুরুষের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে অনস্বীকার্য। ঠিক এ কারণেই পরিবার পুরুষের নেতৃত্বে চলবে। আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে একথাই বলেছেন নিম্নোক্ত আয়াতেঃ
(আরবী*******************************************************************)
স্বামীগণ হচ্ছে তাদের স্ত্রীদের পরিচালক, সংরক্ষক, শাসনকর্তা এ কারণে যে, আল্লাহ তা’আলা তাদের পরস্পরকে পরস্পরের ওপর অধিক মর্যাদাবান করেছেন এবং এজন্যে যে, পুরুষ তাদের ধনমাল খরচ করে।
কুরআনের শব্দ (আরবী**********) –এর মানে হচ্ছে (আরবী*********************) শাসক, সংরক্ষক, নেতা, কর্তা, যাবতীয় বিষয় ও ব্যাপারের সম্পাদনকারী ও পর্যবেক্ষক। ইবনুল আরাবী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
স্বামী ‘কাওয়াম’-এর অর্থ হচ্ছে স্বামী স্ত্রীর আমানতদার রক্ষণাবেক্ষণকারী, তার যাবতীয় কাজের দায়িত্বশীল, কর্তা এবং তার অবস্থার সংশোধনকারী ও কল্যাণ বিধানকারী।
ইবনুল আরাবী সূরা আল-বাকারার আয়াতাংশঃ (আরবী************) উল্লেখ করে লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
পুরুষের অধিক মর্যাদা হচ্ছে নেতৃত্বের অধিকারেরকারণে। স্ত্রীকে মহরানা দান, যাবতীয় ব্যয়ভার বহন, তার সাথে গভীর মিলমিশ সহকারে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা, তাকে সব অপকার থেকে রক্ষা, আল্লাহর আনুগত্যের জন্যে আদেশ করা এবং নামায-রোযা ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্যে তাগিদ করার কাজ স্বামীই করে থাকে –করা কর্তব্য। আর তার বিনিময়ে স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামীর ধনমালের হেফাযত করা, স্বামীর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা এবং আত্মসংরক্ষণমূলক যাবতীয় কাজে-কর্মে স্বামীর আদেশ পালন করে চলা –স্বামীর বিনানুতমিতে তার কোনোটাই ভঙ্গ না করা।
উপরোক্ত আয়াত সম্পর্কে ইবনুল আরাবীর মোটামুটি বক্তব্য হচ্ছে এইঃ
(আরবী************************************************************)
আয়াতের অর্থ হচ্ছেঃ আমি স্ত্রীর ওপর পুরুষের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব দিয়েছি তার ওপর তার স্বাভাবিক মর্যাদার কারণে। তিনটি বিষয়ে পুরুষ স্ত্রীর চেয়ে অধিক মর্যাদাবান। প্রথম, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনায় পূর্ণত্ব লাভ; দ্বিতীয়, দ্বীন পালন ও জিহাদের আদেশ পালনের পূর্ণতা এবং তৃতীয় সাধারণভাবে ভালো কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজের নিষেধ করা –(এসব পুরুষের দায়িত্ব এবং এ দায়িত্ব পুরামাত্রায় পুরুষের ওপরই বর্তে।)
সহজ কথায় বলা যায়, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচক্ষণা, কর্মশক্তি, দুর্ধর্ষতা, সাহসিকতা, বীরত্ব, তিতিক্ষা ও সহ্যশক্তি স্ত্রীলোকদের অপেক্ষা পুরুষদের বেশি। আর পারিবারিক জীবনে অর্থোপার্জন ও শ্রম পুরুষই করে থাকে। স্ত্রীকে মহরানা পুরুষই দেয়; স্ত্রীর ও সন্তান-সন্ততির খোরাক-পোশাক ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস পুরুষই সংগ্রহ করে থাকে। এজন্যে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দাম্পত্য জীবনের প্রধান কর্তা, পরিচালক ও চেয়ারম্যান পুরুষকেই বানানো হয়েছে! কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কারণ কি?
পরিবারে পুরুষের প্রাধান্য
কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই একথা অস্বীকার করতে পারে না যে, আল্লাহ প্রদত্ত বহু গুণ-বিশিষ্ট এবং স্বভাবজাত যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার কারণে স্ত্রীলোকদের তুলনায় পুরুষ অনেকখানি অগ্রসর! স্ত্রীলোক স্বাভাবিকভাবেই জীবনের কিছু সময় সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যেতে বাধ্য হয়। তখন সে অপরের সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। সন্তান গর্ভে থাকাকালে, সন্তান প্রসব, স্তনদান, শিশু পালন এবং নিয়মিত হায়েয-নেফাসের সময় স্ত্রীলোকদের অবস্থা কোনো বিশেষ দায়িত্ব পালনের অনুকূল নয়।
শাহ অলী উল্লাহ দেহলভী পুরুষের এ প্রাধান্য সম্পর্কে লিখেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
স্বামীকে তার স্ত্রীর ওপর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক হিসেবে নিযুক্ত করা একান্ত আবশ্যক। আর স্ত্রীর ওপর এ প্রাধান্য স্বভাবসম্মতও বটে। কেননা পুরুষ জ্ঞাত-বুদ্ধিতে অধিক পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় অধিক সুদক্ষ, সাহায্য-প্রতিরোধের কাজে প্রবল ও সুদৃঢ়। লজ্জা ও অপমানকর ব্যাপার থেকে রক্ষা করার অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন। পুরুষ স্ত্রীর খোরাক-পোশাক ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে বলেও স্ত্রীর ওপর পুরুষের এ নেতৃত্ব ও প্রাধান্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আল্লামা বায়জাবী উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ
পুরুষরা স্ত্রীদের দেখাশোনা ও পরিচর্যা এমনভাবে করে, ঠিক যেমনভাবে শাসকগণ করে থাকে (বা করা উচিত) দেশের জনসাধারণের। আল্লাহ তা’আলা স্ত্রীদের তুলনায় পুরুষদের দুটি কারণ শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। একটি কারণ আল্লাহর বিশেষ দান সম্পর্কীয়, আর অপরটি পুরুষদের নিজস্ব অর্জনের ব্যাপারে। আল্লাহর দান এই যে, আল্লাহ নানা দিক দিয়ে পুরুষদের বিশিষ্ট করেছেন। স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও গুরুতর কার্য সম্পাদন, বিপুল কর্মশক্তি প্রভৃতির দিক দিয়ে পুরুষগণ সাধারণতই প্রধান ও বিশিষ্ট। এজন্যেই নবুয়ত, সামাজিক নেতৃত্ব, শাসন ক্ষমতা, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্যে জিহাদ, বিচার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্ব কেবল পুরুষের ওপরই অর্পিত হয়েছে এবং সেই দায়িত্ব অধিক হওয়ার কারণে মীরাসে স্ত্রীলোকদের তুলনায় পুরুষদের অংশ বেশি দেয়া হয়েছে। আর পুরুষদের উপার্জিত কারণ হলোঃ আসলে বিয়ে থেকে শুরু করে মহরানা দান, ভরণ-পোষণ ও পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় দায়িত্ব পুরুষরাই পালন করে থাকে। (আরবী**************************)
আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যাচাই করলেও একতা প্রমাণিত হয় যে, পুরুষের মগজ স্ত্রীলোকের তুলনায় অনেক বড়। বুদ্ধি, জ্ঞান-প্রতিভা অপেক্ষাকৃত বেশি। বুদ্ধি-জ্ঞানে অধিক পরিপক্ক। সেই সঙ্গে পুরুষের দেহ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও হয় নারীর তুলনায় অনেক মজবুত। মিসরীয় চিন্তাবিদ আল্লামা ফরীদ আজদী লিখেছেনঃ
পুরুষের মগজ সাধারণত গড়ে সাড়ে ৪৯ আউন্স, আর স্ত্রীলোকের মগজের ওজর মাত্র ৪৪ আউন্স। দু’শ’ আটাত্তরজন পুরুষের মগজ ওজন করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় মগজের ওজন হচ্ছে ৬৫ আউন্স, আর সবচেয়ে ছোট মগজের ওজন ৩৪ আউন্স। পক্ষান্তরে ২৯১ জন স্ত্রীলোকের মগজ ওজন করার পর প্রমাণিত হলো যে, সবচেয়ে ভারী মগজের ওজন হচ্ছে ৫৪ আউন্স, আর সবচে হালকা মগজের ওজন হচ্ছে ৩১ আউন্স। ….. এ থেকে কি একথা প্রমাণিত হয় না যে, স্ত্রীলোকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও স্নায়ু পুরুষের তুলনায় অনেক গুণ দুর্বল? (আরবী******** ফরীদ অজদী) বৈজ্ঞানিক তদন্তে এও জানা গেছে যে, নারী-পুরুষের মগজের ওজনের এ পার্থক্য কেবল এক সমাজেই নয়, সব সমাজের –সকল স্তনের নারী-পুরষেরই এই একই অবস্থা। সভ্য-অসভ্য জাতির মধ্যেও এ ব্যাপারে কোনো পার্থক্য নেই। প্যারিসের মতো সুসভ্য নগরীতে যেমন নারী ও পুরুষের এ পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে, তেমনি দেখা যাবে আমেরিকার বর্বরতম জাতির মধ্যেও।
এ যুগের আরবী মনীষী আব্বাস মাহমুদ আল-আক্কাস লিখেছেনঃ
‘স্ত্রীর ওপর স্বামীর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব স্বাভাবিক মর্যাদা আধিক্যের কারণে এবং এ কারণে যে, স্ত্রীর যাবতীয় আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করার দায়িত্ব স্বামীর। আর এ কর্তব্য হচ্ছে কম মর্যাদাশালীর প্রতি অধিক মর্যাদাবান ব্যক্তির কর্তব্য। কেবল আর্থিক প্রয়োজন পূরণই এর একমাত্র ভিত্তি নয়। অন্যথা যে স্ত্রীর ধনশালী কিংবা যে স্বামী স্ত্রীর প্রয়োজন পূরণ করে না বরং স্ত্রীর মেহমান হয়ে তার সম্পদ ভোগ করে, সেখানে স্ত্রীরই উত্তম ও কর্তী –হওয়া উচিত স্বামীর কিন্তু ইসলামে তা কোনো দিন হতে পারে না। (আরবী****************)
মোটকথা, আধুনিক জ্ঞান-গবেষণা অনুযায়ীও স্ত্রীলোক অপেক্ষা পুরুষের মধ্যে কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা অধিক!
কুরআন মজীদে এ পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************)
এবং স্ত্রীদের ওপর পুরুষের এক ধরনের প্রাধান্য রয়েছে।
এ আয়াতেও পারিবারিক জীবনের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য পুরুষকেই দেয়া হয়েছে, নারীকে নয়। আর সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি ও বস্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এ কথার যথার্থতা স্বীকৃত।
পুরুষ সন্তানের পিতা, তারই সন্তান বলে পরিচিত হয়ে থাকে লোকসমাজ। ছোটরাও যেমন বড়রাও তেমনি। তাই পরিবারে পুরুষেরই কর্তৃত্ব হওয়া উচিত।
পরিবারের লোকজনের সকল প্রকার খরচপত্র পরিবেশনের জন্যে পুরুষ –পিতাই –দায়ী, তারই নিকট সব কিছু দাবি করা হয় এবং সেই বাধ্য হয় সব যোগাড় করে দিতে। খাবার, পোশাক, চিকিৎসা, বিয়ে ও শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হয়। এদের মধ্যে সন্তানরাও যেমন থাকে, স্ত্রীও। অতএব এ সকলের ওপর পুরুষের নেতৃত্বই স্বাভাবিক। আর তার নেতৃত্বে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কোনো আপত্তি বা সংশয় থাকতে পারে না।
মেয়েলোকের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার আজীবনের আশ্রয় পিতার ঘর হয়ে যায় পরের বাড়ি, আর জীবনে কোনোদিন যাকে দেখেনি –যার নাম কখনো শুনেনি, তেমন এক পুরুষ হয়ে যায় তার চির আপন এবং সে পিতার ঘর ত্যাগ করে তারই সাথে চলে যায় তারই বাড়িতে। এ-ই সাধারণ নিয়ম। অতএব বসতবাটির মালিক হচ্ছে পুরুষ, সে ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব যার, ঘরের ওপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বও তারই হওয়া উচিত। কিন্তু এ কর্তৃত্ব জোর-জবরদস্তির নয়, না-ইনসাফী, অসাম্য ও স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার জন্যে নয়; বরং এ হচ্ছে –“যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তাদেরই পরিচালনার কর্তৃত্ব” ধরনের। কেননা একজন লোক যাদের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে, তাদের ওপর সে লোকের যদি কর্তৃত্ব না থাকে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের, পথনির্দেশের, প্রতিরোধের, তাহলে সে তার দায়িত্ব পালন করতে কিছুতেই সমর্থ হতে পারে না। এ ধরনের কর্তৃত্ব যেমন পরিবারের অন্যান্য লোকের অধিকার হরণকারী হয় না, তেমনি তা হরণ করে না স্ত্রীর অধিকারও। অতএব এ ধরনের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব একটি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মাত্র, যা দায়িত্বাধীন লোকদের তুলনায় দায়িত্বশীরের জন্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছে। এতে করে না স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা স্বামীকে দেয়া হয়েছে, না তার ব্যক্তিত্ব বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
বস্তুত পারিবারিক ব্যবস্থাপনা-পরিচালনার কর্তৃত্ব স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে সুবিচার, সাম্য ও পরামর্শমূলক সূক্ষ্মতম ভিত্তিতে কায়েম হয়ে থাকে, তা স্বভাবতই স্বৈরনীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার পরিপন্থী হয়ে থাকে। বরং তাতে প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতের আযাদী, ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ লাভের সুযোগ সংরক্ষিত হয়, স্ত্রীর ধন-মালের ওপর কর্তৃত্ব তারই হবে, স্বামীর নয়। স্ত্রী যথা-ইচ্ছা ও যেমন ইচ্ছা তা ব্যয় ব্যবহার করতে পারে, সে বিষয়ে স্বামীর কিছুই বলবার ও করবার থাকতে পারে না। সে যদি তার ধনমাল সংক্রান্ত কোনো বিবাদে অপর কারো বিরুদ্ধে বিচার প্রার্থী হতে চায়, তবে সে অনায়াসেই তা করতে পারে। স্বামীর সে ব্যাপারে আপত্তি বা হস্তক্ষেপ করারও কোনো অধিকার নেই। ইসলাম এদিক দিয়ে মুসলিম নারীকে এমন এক মর্যাদা দিয়েছে, যা অত্যাধুনিকা ফরাসী নারীরাও আজ পর্যণ্ত লাভ করতে পারে নি। (আরবী***************************)
অধিকার সাম্য
স্বামী-স্ত্রীর মিলিত দাম্পত্য জীবনে পুরুষের প্রাধান্য স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও ইসলাম স্ত্রীকে পুরুষের দাসী-বাঁদী বানিয়ে দেয়নি। যদি কেউ তা মনে করে, তবে সে মারাত্মক ভুল করে। প্রশ্ন হচ্ছে স্বামী ও স্ত্রীর মিলিত পারিবারিক জীবনে পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে না কি? কোনো বিষয়ে যদি পারস্পরিক মতপার্থক্য কখনও ঘটে যায়, তখন সে বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা করার কার্যকরী পন্থা কি হতে পারে? ইসলাম বলেছে, তখন পুরুষের মতই প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার পাবে। তখন স্ত্রীর কর্তব্য হবে স্বামীর মতকেই মেনে নেয়া, স্বামীর কথা মতো কাজ করা। কেননা তাকে মনে করতে হবে যে, স্বামী –তার চাইতে বেশি জ্ঞান, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অধিকারী এবং এজন্যে পারিবারিক জীবন সংক্রান্ত ‘সভাপতিত্বের’ মর্যাদা স্বতঃই স্বামীরই প্রাপ্য।
এ সম্পর্কে ব্যাপক আদর্শ হচ্ছে এই যে, মুসলিম জীবনের সকল সামাজিক-সামগ্রিক ক্ষেত্রেই পারস্পরিক পরামর্শ ও যথাসম্ভব ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এ পরামর্শ নেয়া-দেয়া কেবল রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেই নয়, পারিবারিক জীবনের গণ্ডীতেও অপরিহার্য। আর তাতে পরামর্শ দেয়ার অধিকার রেছ স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই এবং এ পরামর্শের ব্যাপারেও যার মত অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বিবেচিত হবে, তারই মত মেনে নেয়া হলো পরামর্শ ভিত্তিক সংস্থার লক্ষ্য।
কুরআন মজীদে এ পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************)
স্ত্রীদের ওপর পুরুষদের যে রকম অধিকার রয়েছে, ঠিক অনুরূপ সমান অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর স্ত্রীলোকদের এবং তা সুস্পষ্ট প্রচলিত নিয়মানুযায়ী হবে।
আয়াতটি সংক্ষিপ্ত হলেও এতে পারিবারিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি ও নিয়ম উল্লিখিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে এই যে, সকল ব্যাপারে ও বিষয়ে নারী পুরুষের সমান মর্যাদাসম্পন্ন। সকল মানবীয় অধিকারে নারী পুরুষেরই সমান, প্রত্যেকের ওপর প্রত্যেকের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। তাই রাসূলে করীমও বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের হক –অধিকার –রয়েছে এবং তাদেরও অধিকার রয়েছে তোমাদের ওপর।
কেবল একটি মাত্র ব্যাপারে পুরুষ স্ত্রীর তুলনায় অধিক মর্যাদা পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী পুরুষের সমান নয়। আর তা হচ্ছে তাই যা বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************)
পুরুষরা নারীদের ওপর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সম্পন্না।
এই আয়াতাংশ এবং এই একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর সব ক্ষেত্রেই নৈতিকতা, ইবাদত, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভ, কর্ম ফল প্রাপ্তি, মানবিক অধিকার ও সাধারণ মান-মর্যাদা এসব ব্যাপারেই স্ত্রীলোক পুরুষের সমান। অপর কোনো ক্ষেত্রেই পুরুষকে স্ত্রীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ এবং স্ত্রীকে পুরুষ অপেক্ষা নিকৃষ্ট মনে করা যেতে পারে না। আর সত্যি কথা এই যে, দুনিয়ার ব্যবস্থাসমূহের মাঝে একমাত্র ইসলামই নারীকে এ মর্যাদা দিয়েছে।
পুরুষকে পারিবারিক সংস্থার ‘সভাপতি’ করে দেয়া সত্ত্বেও ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে সব ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শ করা ও পরামর্শের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কেননা এরূপ হলেই পারিবারিক জীবনে শান্তি, সন্তুষ্টি, মাধুর্য ও পরস্পরের প্রতি গভীর আস্থা ও নির্ভরতা বজায় থাকতে পারে। দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দুধ পান করাবার মেয়াদ হচ্ছে পূর্ণ দু’বছর। এর পূর্বে যদি দুধ ছাড়াতে হয় তবে স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক পরামর্শ করে তা করতে পারে। নিম্নোক্ত আয়াতে একথাই বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************)
স্বামী-স্ত্রী যদি সন্তুষ্ট ও পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে দুধ ছাড়াতে চায়, তবে তাদের কোনো গুনাহ হবে না।
আয়াতটিতে একদিকে যেমন স্বামী-স্ত্রী –পিতামাতা –উভয়েরই সন্তুষ্টি এবং পারস্পরিক পরামর্শের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তেমনি অপরদিকে বিশেষভাবে স্ত্রী-সন্তানের মা’র সন্তুষ্টি ও তার সাথে পরামর্শের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে। একে তো বাপ-মা দু’জনের একজনের ইচ্ছায় এ কাজ হতে পারে না বলা হয়ছে; দ্বিতীয়ত হতে পারে যে, মা’য়ের মত ছাড়াই বাবা নিজের ইচ্ছার জোরে শিশু সন্তানের দুধ দু’বছরের আগেই ছাড়িয়ে দিলো, আর তাতে মা ও চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুরও ক্ষতি হয়ে পড়ল। অতএব স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্তুষ্টি এবং সন্তানের পূর্বাপর অবস্থা সম্পর্কে পরামর্শ গ্রহণ অপরিহার্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সহজেই বুঝতে পারা যায়, দুগ্ধপোষ্য শিশুর দুধ ছাড়ানোর জন্যে যদি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও পরামর্শের এতদূর গুরুত্ব নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। আর বাস্তবিকই যদি স্বামী-স্ত্রীর যাবতীয় কাজ পারস্পরিক পরামর্শ ও একে অপরের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রেখে সম্পন্ন করে, তাহলে তাদের দাম্পত্য জীবন নিঃসন্দেহে বড়ই মধুর হবে, নির্ঝঞ্ঝাট হবে, হবে সুখ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ।
স্বামীর সন্তুষ্টি বিধান ও তার আনুগত্য
এ দৃষ্টিতে স্বামীর যেমন কর্তব্য স্ত্রীর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে চেষ্টা করা, তেমনি স্ত্রীরও তা-ই কর্তব্য। স্ত্রীর যাবতীয় কাজে-কর্মে লক্ষ্য থাকবে প্রথম আল্লাহর সন্তোষ লাভ এবং তারপরই দ্বিতীয়ত থাকবে স্বামীর সন্তোষ লাভ। আর এ স্বামীর সন্তোষ লাভের জন্য চেষ্টা করাও আল্লাহর সন্তোষেরই অধীন। কেননা আল্লাহই তার সন্তোষ লাভের জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন স্ত্রীদের। এ কারণে নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
যে মেয়েলোকই এমনভাবে মৃত্যুবরণ করবে যে, তার স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট, সে অবশ্যই বেহেশতবাসিনী হবে।
স্বামীর সন্তোষ বিধানের জন্যেই তার আনুগত্য করাও স্ত্রীর কর্তব্য। রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*********************************************************))
স্ত্রী যদি পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায রীতিমত পড়ে, যদি রমযানের একমাস ফরয রোযা রাখে, যদি তার যৌন অঙ্গের পবিত্রতা পূর্ণ মাত্রায় রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করে, তবে সে অবশ্যই বেহেশতের যে দুয়ার দিয়েই ইচ্ছে প্রবেশ করতে পারবে।
এ হাদীসে স্বামীর আনুগত্য করাকে নামায-রোযা ও সতীত্ব রক্ষা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে এবং একেও সেসব কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। অন্য কথায় হাদীসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, স্ত্রীর ওপর যেমন আল্লাহর হক রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বামীর অধিকার। স্ত্রীর যেমন কর্তব্য আল্লাহর হক আদায় করা, তেমনি কর্তব্য স্বামীর কতা শোনা এবং তার আনুগত্য করা, স্বামীর যাবতীয় অধিকার পূরণের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা। স্বামীর অধিকার আদায় না করে স্ত্রীর জৈবিক জীবন তেমনি সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না, যেমন আল্লাহর হক আদায় না করে সফল হতে পারে না তার নৈতিক ও পরকালীন জীবন। শুধু তাই নয়, স্বামীর হক আদায় না করলে আল্লাহর হকও আদায় করা যায় না। রাসূলে করীম (স) খুবই জোরালো ভাষায় বলেছেনঃ
(আরবী*************************************)))))
যাঁর মুষ্টিতে মুহাম্মদের প্রাণ-জীবন, তাঁর শপথ, স্ত্রী যতক্ষণ পর্যন্ত তার স্বামীর হক আদায় না করবে, ততক্ষণ সে তার আল্লাহর হকও আদায় করতে পারবে না। স্বামী যদি স্ত্রীকে পেতে চায় –যখন সে সওয়াব হয়ে যাচ্ছে –তবে তখনো সে স্বামীকে নিষেধ করতে পারবে না।
বস্তুত স্বামীর হক আদায় করার জন্যে দরকার তার আনুগত্য করা, তার কথা বা দাবি অনুযায়ী কাজ করা। এজন্যে সর্বোত্তম স্ত্রী কে এবং কি তার গুণ, এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
সে হচ্ছে সেই স্ত্রীলোক, যাকে স্বামী দেখে সন্তুষ্ট হবে, যে স্বামীর আনুগত্য করবে এবং তার নিজের স্বামীর ধনমালে স্বামীর মতের বিরোধিতা করবে না –এমন কাজ করবে না, যা সে পছন্দ করে না।
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর যেমন কর্তব্য, তেমনি অত্যন্ত বিরাট মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের ব্যাপারও বটে। নিম্নোক্ত হাদীসে এ মর্যাদা ও মাহাত্মের কথা সুস্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে।
(আরবী****************************************************************************)
মুসলিমদের জন্যে তাকওয়ার পর সবচেয়ে উত্তম জিনিস হচ্ছে নেককার চরিত্রবতী স্ত্রী –এমন স্ত্রী, যে স্বামীর আদেশ মেনে চলে, স্বামী তার প্রতি তাকালে সন্তুষ্ট হয়ে যায় এবং স্বামী কোনো বিষয়ে কসম দিলে সে তা পূরণ করবে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার নিজের ও স্বামীর ধনমালের ব্যাপারে স্বামীর কল্যাণকামী হবে।
অন্য কথায়, আল্লাহর ভয় ও তাকওয়ার পর সব মুসলিম পুরুষের জন্যেই সর্বোত্তম সৌভাগ্যের সম্পদ হচ্ছে সতী-সাধ্বী, সুদর্শনা ও অনুগতা স্ত্রী। প্রিয়তম স্বামীর সে একান্ত প্রিয়তমা, স্বামীর প্রতিটি কতায় সে উৎসর্গীকৃতা, সতীত্ব ও পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে সে অতন্দ্র সজাগ আর এ রকম স্ত্রী যেমন একজন স্বামীর পক্ষে গৌরব ও মাহাত্ম্যের ব্যাপার, তেমনি এ ধরনের স্ত্রীও অত্যন্ত ভাগ্যবতী।
স্বামীর আনুগত্য করার ওপর এই সব হাদীসেই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পারিবারিক জীবনে স্ত্রী যদি স্বামীর প্রাধান্য স্বীকার না করে, স্বামীকে মেনে না চলে, স্বামীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি উভয় সময়ই যদি স্ত্রী স্বামীর কল্যাণ বিধানে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে দাম্পত্য জীবন কখনই মধুর হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু স্বামীর এ আনুগত্যও অবাধ নয়, অসীম নয়, নয় নিঃশর্ত। ইসলামের আনুগত্যের ব্যাপারে সর্বত্র শরীয়ত সীমার উল্লেখ করা হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘সঙ্গত ও শরীয়তসম্মত কাজে স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর কর্তব্য’। অন্যত্র বলেছেনঃ ‘কোনো স্ত্রী ঈমানের স্বাদ ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে না, যতক্ষণ না সে তার স্বামীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করবে’। (আরবী********************)
এ দুটি হাদীসেই ‘সঙ্গত’ ও ‘শরীয়তসম্মত’ বা ‘ন্যায়সঙ্গত’ শর্তের উল্লেখ রয়েছে। কাজেই স্বামীর অন্যায় জিদ বা শরীয়ত-বিরোধী কাজের কোনো আদেশ বা আবদার পালন করতে স্ত্রী বাধ্য নয়। শুধু তা-ই নয়, স্বামী শরীয়ত-বিরোধী কোনো কাজের আদেশ করলে তা অমান্য করাই ঈমানদার স্ত্রীর কর্তব্য। বুখারী শরীফের এক অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছেঃ
(আরবী**********************************************)
গুনাহের কাজে স্ত্রী স্বামীর আদেশ মানবে না –এ সম্পর্কিত হাদীসের অধ্যায়।
আর তারপরই যে হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে, এক আনসারী মহিলা তার কন্যাকে বিয়ে দেয়। বিয়ের পর কন্যার মাথায় চুল পড়ে যেতে শুরু করে। তখন মহিলাটির জামাতা তাকে বলল –তার স্ত্রীর মাথায় পরচুলা লাগিয়ে দিতে। তখন মাহিলাটি রাসূলে করীমের দরবারে হাজির হয়ে বললঃ
(আরবী****************************************************************************)
আমার মেয়ের স্বামী আমাকে আদেশ করেছে যে, আমি যেন মেয়ের মাথায় পরচুলা জুড়ে দেই।
একথা শুনে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
(আরবী***************************************************************)
না, তা করবে না, কেনান যেসব মেয়েলোক পরচুলা লাগায় তাদের ওপর লানত করা হয়েছে।
অন্য কথায়, পরচুলা লাগানো যেহেতু হারাম, অতএব এ হারাম কাজের জন্যে স্বামীর নির্দেশ মানা যেতে পারে না। (আরবী***************)
নিজের ও স্বামীর ধন-সম্পদে স্ত্রীর অধিকার
স্বামীর ঘরে স্ত্রীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থায় সুস্পষ্টরূপে স্বীকৃত। স্ত্রীর যেমন অধিকার আছে সীমার মধ্যে থেকে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করার পরে যে কোনা কাজ করে অর্থোপার্জন করার, তেমনি অধিকার রয়েছে সেই উপার্জিত অর্থের মালিক হওয়ার এবং নিজের ইচ্ছানুক্রমে তা ব্যয় ও ব্যবহার করার। স্বামীর ধন-সম্পদেও তার ব্যয়-ব্যবহার ও দান প্রয়োগের অধিকার রয়েছে। সেই সঙ্গে সে মীরাস পেতে পারে পিতার, ভাইয়ের, পুত্র-কন্যার এবং স্বামীর।
স্বামীর ধন-সম্পদে স্ত্রীর অধিকার এতদূর রয়েছে যে, তার ব্যয়-ব্যবহার করার ব্যাপারে সে তার স্বামীর মর্জি বা অনুমতির মুখাপেক্ষী নয়। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************************)_)
স্ত্রী যদি স্বামীর খাদ্যদ্রব্য থেকে শরীয়ত-বিরোধী নয় –এমন কাজে এবং খারাপ নয় –এমনভাবে ব্যয় করে তবে তাতে তার সওয়াব হবে, কেননা সে ব্যয় করেছে; আর তার স্বামীর জন্যেও সওয়াব রয়েছে, কেননা সে তা উপার্জন করেছৈ।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***************************************************************************)
স্ত্রী যদি তার স্বামীর কামাই-রোজগার করা ধন-সম্পদ থেকে তার আদেশ ব্যতীতই কিছু ব্যয় করে, তবে তার স্বামী তার অর্ধেক সওয়াব পাবে।
হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর (রা) একদিন রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
হে রাসূল, স্বামী জুবাইর আমাকে সংসার খরচ বাবদ যা কিছু দেন, তা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। এখন তা থেকে যদি আমি দান-সাদকার কাজে কিছু ব্যয় করি, তবে কি আমার গুনাহ হবে?
তখন নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী****************************************)
যা পারো দান-সাদকা করো –করতে পারো; তবে নিজের তহবিলে নিয়ে জমা করে রেখো না, তাহলে মনে রেখো, আল্লাহও তোমার জন্যে শাস্তি জমা করে রাখবেন।
ইবনে আরাবী লিখেছেনঃ স্বামীর ঘরের মাল-সম্পদ থেকে দান-সাদকা করা স্ত্রীর পক্ষে জায়েয কিনা –এ সম্পর্কে প্রথম যুগের মনীষিগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়ছে। অনেকের মতে –সে দানের পরিমাণ অল্প, সামান্য ও হালকা হলে কোনো দোষ নেই, তা জায়েয। কেননা তাতে স্বামীর বিশেষ কোনো ক্ষতি-লোকসানের আশংকা নেই। কেউ বলেছেন, স্বামীর অনুমতি হলে তবে তা করা যেতে পারে; সেই অনুমতি সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট হলেও ক্ষতি নেই। ইমাম বুখারীরও এই মত। তবে কোনে প্রকার অন্যায় কাজে অর্থ ব্যয় কিংবা স্বামীর ধন-সম্পদ বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা সর্বসম্মতবাবে না জায়েয। অনেকের মতে স্বামীর ধন-সম্পদে যখন স্ত্রীর অধিকার স্বীকৃত এবং তা দেখাশোনা করার দায়িত্বও তারই ওপর রয়েছে, তখন তা দান-সদকা করাও স্ত্রীর পক্ষে অবশ্যই সঙ্গত হবে।
ইমাম শাওকানীর মতে এ সম্পর্কিত যাবতীয় হাদীস থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয়ঃ
(আরবী*************************************************************************)
স্বামীর ঘর থেকে তার অনুমতি ব্যতিরেকেই অর্থসম্পদ ব্যয় করা স্ত্রীর পক্ষে সম্পূর্ণ জায়েয।
তবে যেসব হাদীসে এ সম্পর্কে নিষেধ উল্লিখিত হয়েছে, নিষেধের মানে ‘হারাম’ নয়, বরং বড়জোর মাকরূহ। আর মকরূহ তানজীহ জায়েয হওয়ার পরিপন্থী নয়।
(আরবী************************************************************************)
অপর এক হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছ, মুজার কবীলার এক সম্মানিতা মহিলা রাসূলে করীম (স)-কে সম্বোধন করে বললেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
হে আল্লাহর নবী, আমরা হচ্ছি আমাদের পিতা, পুত্র ও স্বামীদের ওপর এক বোঝা স্বরূপ। এমতাবস্থায় তাদের ধনমাল থেকে ব্যয় করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কি?
জবাবে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
(আরবী*********************************************************)
যাবতীয় তাজা খাদ্য তোমরা খাবে, আর অপরকে হাদিয়া-তোহফা দেবে।
এ হাদীস থেকেও প্রমাণিত হয় যেঃ
(আরবী********************************************************************)
মেয়েদের জন্যে তাদের স্বামী, পিতা ও পুত্রের ধনমাল থেকে তাদের অনুমতি ছাড়াই পানাহার করা ও অপরকে হাদিয়া-তোহফা দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয।
তবে ইমাম শাওকানীর মতে মেয়েদের এ অধিকার কেবলমাত্র খাদ্য ও পানীয়ের দ্রব্যাদি সম্পর্কেই প্রযোজ্য ও স্বীকৃত। কাপড়-চোপড় ও টাকা-পয়সার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এ পর্যায়ে পরের উক্ত হাদীসটি উল্লেখযোগ্যঃ
(আরবী********************************************************************)
স্ত্রী স্বামীর আদেশ-অনুমতি ব্যতিরেকেই যা কিছু ব্যয় করে তার অর্ধেক সওয়াব সে স্বামীকে দেয়।
স্ত্রীর নিজস্ব ধনমাল ব্যয়-ব্যবহার ও দান-সদকা করার অধিকার আছে কিনা, থাকলে কতখানি, তা নিম্নের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************)
স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য লোককে দান-সাদকা করা বা উপহার-উপঢৌকন দেয়া জায়েয নয়।
অপর বর্ণনায় হাদীসটির ভাষা নিম্নরূপঃ
(আরবী*******************************************************************)
স্ত্রীর সমগ্র যৌন সত্তার মালিক যখন স্বামী, তখন তার অনুমতি ছাড়া তার নিজের ধনমাল ব্যয়-বণ্টন করা স্ত্রীর জন্যে জায়েয নয়।
এ হাদীস থেকে বাহ্যত প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী যদি পূর্ণ বয়স্কা ও বুদ্ধিমতিও হয়, তবু স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে তার নিজের ধনমাল থেকেও দান-সাদকা করা, উপহার-উপঢৌকন দেয়া তার পক্ষে জায়েয নয়। কিন্তু এ সম্পর্কিত চূড়ান্ত ফায়সালায় মনীষীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম লাইস বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
স্ত্রীর পক্ষে তা আদৌ জায়েয নয়, এক-তৃতীয়াংশের ওপরও নয়, তার কম পরিমাণের ওপর নয়। তবে অল্প-স্বল্প পরিমাণ ধর্তব্য নয়।
তাউস ও ইমাম মালিক বলেছেঃ
(আরবী**************************************************************)
স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী তার নিজের ধনমালের এক-তৃতীয়াংশ থেকে দান-সাদকা করতে পারে। তার বেশি পারে না।
আর অধিকাংশ ফিকাহবিদ ও মনীষীদের মত হচ্ছেঃ
(আরবী***********************************************)
স্ত্রী যদি বুদ্ধিহীনা ও বোকা না হয়, তাহলে স্বামীর কোনো প্রকার অনুমতি ব্যতিরেকেই তার (স্ত্রী) নিজের ধনমাল থেকে সে ব্যয়-ব্যবহার করতে পারে। আর সে যদি বুদ্ধিহীনা ও বোকা হয়, তবে তা জায়েয নয়।
এঁদের দলীল হচ্ছে প্রধানত এই যে, রাসূলে করীম (স)-এর আহবানক্রমে মহিলা-সাহাবিগণ নিজ নিজ অলংকার জিহাদের জন্যে দান করেছিলেন কিংবা যাকাত বাবদ দিয়ে দিয়েছিলেন এবং রাসূলে করীম (স) তা গ্রহণও করেছিলেন। এ থেকে স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে, স্বামীর অনুমতি –এমন কি তার উপস্থিতি ছাড়াই স্বামীর ধন-সম্পদ থেকে দান-সাদকা করা যখন স্ত্রীর পক্ষে জায়েয হলো তখনঃ
(আরবী****************************************************************)
স্ত্রীর নিজের ধনমাল থেকে দান-সদকা করা তো আরো বেশি করে জায়েয হবে।
ঈদের ময়দানে উপস্থিত মেয়েরা নবী করীম (স)-এর আহবানক্রমে নিজেদের অলংকারাদি যাকাত বাবদ কিংবা দ্বীনরে জিহাদের জন্যে দান করেছিল। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ
(আরবী*********************************************************************************)
নবী করীম (স) মেয়েদের কাছে উপস্থিত হয়ে তাদের নসীহত করলেন, তাদের লক্ষ্য করে ওয়াজ করলেন এবং সাদকা দিতে আদেশ করলেন। এ সময় বিলাল কাপড় পেতে ধরলেন এবং মেয়েরা আংটি, কানের বালা, ঝুমকা ইত্যাদি অলংকার সে কাপড়ের ওপর ফেলতে লাগল।
ইমাম নববী এ হাদীস সম্পর্কে লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
এ হাদীস প্রমাণ করছে যে, মেয়েরা তাদের নিজেদের ধন-সম্পদ থে স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকেই দান সাদকা করতে পারে –করা জায়েয এবং এ দান মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের মধ্য থেকে হওয়ার কোনো শর্ত নেই।
এ হাদীস থেকে একথাও স্পষ্ট বেঝা যাচ্ছে যে, নবী করীম (স) যখন মেয়েদের দান করতে বললেন এবং সে দান গ্রহণ করাও হচ্ছিল, তখন তিনি এ কথা জিজ্ঞেস করেন নি যে, তারা তাদের স্বামীদের কাছে অনুমতি পেয়ে দান করছে কিনা। বরং তারা যে তাদের স্বামীদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দান করছে না তা তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। দানকারিণী এ মহিলাদের স্বামীরা ময়দানে উপস্থিত ছিল বটে, কিন্তু তারা ছিল বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত। তাদের বেগমরা ঈদ-ময়দানের অপর একপাশে বসে কেবলমাত্র রাসূলে করীমের নির্দেশ মতো দান করছিলেন। ফলে তাদের স্বামীরা এ দানের খবর এবং তার পরিমাণ সম্পর্কে জানতেও পারেনি, আর এ দানে তাদের অনুমতি দেয়ারও কোনো অবকাশ ছিল না। কাজেই তাদের নীরব অনুমতিরও কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
দ্বিতীয়ত মেয়েরা যখন দান করছিল, তখন তাদের সমস্ত সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে দান করছে কিনা, তা জিজ্ঞেস করারও কোনো প্রয়োজন নবী করীম (স) বোধ করেন নি।