পর্দার ব্যবস্থা
ঠিক এ কারণে ইসলামে পর্দার ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। ইসলামে পর্দা ব্যবস্থা পরিবারের পবিত্রতা ও স্থায়িত্ব বিধানের জন্যে একান্তই অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, পর্দা ব্যবস্থা বাস্তবায়িত না হলে পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা ও শান্তিপূর্ণ স্থিতি ধারণাতীত।
ইসলামের এই পর্দা ব্যবস্থার দুটি পর্যায় রয়েছে। একটি হচ্ছে ঘরের আর অপরটি বাইরের। ঘরের অভ্যন্তরে থাকাকালীন পর্দা ব্যবস্থা পালন করা যেমন মুসলিম নারীর পক্ষে কর্তব্য তেমনি ঘরের বাইরের ক্ষেত্রে। এ উভয় ক্ষেত্রের জন্যে যে পর্দা ব্যবস্থা, তাই হচ্ছে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ পর্দা ব্যবস্থা। এখানে পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হচ্ছে।
প্রথম পর্যায়
পর্দা ব্যবস্থার প্রথম পর্যায় হচ্ছে ঘরোয়া জীবনে, ঘরের অভ্যন্তরে পালন ও অনুসরণের নিয়ম-বিধান। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রকৃত কর্মকেন্দ্র হচ্ছে তার ঘর। ঘরকেই আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করা বরং স্থায়ীভাবে ঘরের অভ্যন্তরে অবস্থান করাই হচ্ছে মুসলিম নারীর কর্তব্য। কুরআন মজীদে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে দুনিয়ার মুসলিম নারী সমাজকে –বলা হয়েছেঃ
(আরবী*********************************************************************************)
এবং তোমা তোমাদের ঘরের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে বসবাস করো এবং পূর্বকালীন জাহিলিয়াতের মতো নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য ও যৌনদীপ্ত দেহাঙ্গ দেখিয়ে বেড়িও না।
আয়াতটির দুটো অংশ। প্রথম অংশ পর্দা ব্যবস্থার প্রথম পর্যায় সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় অংশ তার দ্বিতীয় পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট।
আয়াতটির প্রথমাংশে বলা হয়েছে যে, নারীর আসল স্থান হচ্ছে ঘর; অতএব ঘরে অবস্থান করাই তার কর্তব্য। আয়াদের শব্দ প্রয়োগ পদ্ধতি প্রমান করছে যে, প্রত্যেক নারীর জন্যে একখানা ঘর থাকা উচিত। এমন একখানা ঘর থাকা উচিত, যেখানে তার বসবাসের স্থান নির্দিষ্ট ও সর্বজন পরিচিত। দ্বিতীয়ত, তার এ ঘরই হবে তার অবস্থানের জায়গা ও কর্মকেন্দ্র। নারী-জীবনের যা কিছু করণীয়, তা প্রধানত এ ঘরকে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন হবে এবং যে সব কাজ সে নিজের ঘরে বসে সম্পন্ন করতে পারে, তাই হচ্ছে তার পক্ষে শোভনীয় কর্মসূচী। অন্য কথায়, প্রধানত তার বসবাসের ঘরকে কেন্দ্র করেই রচিত হবে তার জন্যে কর্মসূচী।
আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতাংশের তাফসীরে লিখেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
তোমাদের ঘরকে তোমরা আঁকড়ে থাকো এবং বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে কখনো বের হবে না।
আল্লামা আবূ বাকর আল-জাসসাস এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
এ আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ করছে যে, মেয়েরা ঘরকে আঁকড়ে থাকার জন্যে নির্দিষ্ট এবং বাইরে বের হওয়া থেকে নিষেধকৃত।
আল্লামা ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
ঘরেই বসবাস করো, বাইরে দৌড়াদৌড়ি করো না এবং ঘর ছেড়ে দিয়ে বাইরে চলে যেও না।
আল্লামা শওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
এ আয়াতাংশের অর্থ হচ্ছে, এতে মেয়েদেরকে তাদের নিজেদের ঘরে ধীরস্থীরভাবে বসবাসের আদেশ করা হয়েছে।
আল্লামা আলুসী এ আয়াতাংশের তরজমা লিখেছেন এ ভাষায়ঃ
(আরবী*******************************************************************************)
তোমরা তোমাদের মন তথা নিজেদের সত্তাকে ঘরের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত করে রাখ।
আল্লামা আলুসী আয়াতাংশের বহু প্রকারের পাঠ-পদ্ধতির উল্লেখ করার পর এর সামগ্রিক তাৎপর্য লিখেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
(আরবী***************************************************************************************)
সকল প্রকার পাঠ-রীতিতেই এর মানে হচ্ছে এই যে, আয়াতে মেয়েদেরকে ঘরকে আঁকড়ে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর সব মেয়েদের প্রতিই এ হচ্ছে ইসলামের দাবি।
এক হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত ঘোষণা উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
তাদের ঘরই তাদের জন্যে সুখ-শান্তি ও সার্বিক কল্যাণের আকর।
হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, কিছু সংখ্যক মহিলা রাসূলে করীম (স)-এর খেদমতে হাজির হয়ে নিবেদন করলেনঃ
(আরবী************************************************************************)
হে রাসূল, পুরুষরা তো আল্লাহর প্রদত্ত বিশিষ্টতা ও আল্লাহর পথে জিহাদ প্রভৃতি দ্বারা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর হয়ে গেছে। আমরা কি এমন কোনো কাজ করতে পারি, যা করে আমরা আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের মর্যাদা লাভ করব? এ প্রশ্নের জবাবে নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
যে মেয়েলোক তার ঘরে অবস্থান করল, সে ঠিক আল্লাহর পথে জিহাদকারীর কাজ সম্পন্ন করতে পারল।
রাসূলের কথা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের জন্যে আল্লাহর দেয়া বিশিষ্টতা মেয়েরা লাভ করতে পারে না কোনোক্রমেই। কেননা তা জন্মগত ব্যাপার। পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে বলেই তার এ বিশিষ্টতা। আর মেয়েরা তা পেতে পারে না এজন্যে যে, মেয়ে হয়েই তাদের জন্ম। আর পুরুষও আল্লাহরই তো সৃষ্টি। তবে নৈতিক মান মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য নেই, মেয়েরাও তা লাভ করতে পারে পুরুষদের মতোই –যদিও ঠিক একই কাজ দ্বারা নয়। কাজের স্বরূপ, ধরন, ক্ষেত্র বিভিন্ন হলেও কাজের ফল হিসেবে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করার ব্যাপারে মেয়ে-পুরুষ সমান।
রাসূলের কথা থেকে এ কথাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মেয়েদের প্রকৃত কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তাদের ঘর আর পুরুষদের কর্মক্ষেত্র বাইরে। জিহাদের সওয়াব পাবার জন্যে পুরুষদের তো যুদ্ধের ময়দাতে যেতে হবে, দ্বীনের শত্রুদের সাথে কার্যত মুকাবিলা করতে হবে, জীবন-প্রাণ কঠিন বিপদের সম্মুখে ঠেলে দিতে হবে, ঘর-বাড়ি থেকে বহুদূরে চলে যেতে হবে। কিন্তু মেয়েদের জিহাদ তার ঘরকে কেন্দ্র কেই সম্পন্ন হবে এবং ঘরের দায়িত্ব পালন করলেই পুরুষদের জিহাদের সমান মর্যাদা ও সওয়াব লাভ করতে পারবে। জিহাদ স্ত্রী-পুরুষ উভয়কেই করতে হবে। কিন্তু পুরুষদের করতে হবে তা বাইরের ক্ষেত্রে, যুদ্ধের ময়দানে। কেননা তা করার যোগ্যতা ক্ষমতা তাদেরই দেয়া হয়েছে। আর মেয়েদের তা করতে হবে ঘরে বসে। কেননা ঘর কেন্দ্রিক জিহাদ করার যোগ্যতাই মেয়েদের দেয়া হয়েছে, বাইরের জিহাদের নয়।
প্রসঙ্গত ‘মেয়েদের নিজেদের ঘর’ কথাটির বিশ্লেষণ হওয়া আবশ্যক। কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘরকে ‘স্ত্রীদের ঘর’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে (আরবী****************) –‘তোমাদের নিজেদের ঘরে’। হাদীসেও তাই বলা হয়েছে। তার মানে স্ত্রীদের নিজস্ব ঘর থাকা আবশ্যক –যেমন পূর্বে বলেছি –এবং এ গরই হবে তার কর্মকেন্দ্র, জীবন-কেন্দ্র। এ জন্যেই নবী করীম (স) তাঁর এক-একজন বেগমের জন্যে এক-একটি হুজরা –ছোট কক্ষ –নির্মাণ করে দিয়েছিলেন এবং যে বেগম যে হুজরায় বসবাস করতেন, তিনিই ছিলেন তার মালিক-ব্যবস্থাপনা-পরিচালনার কর্ত্রী। নবী করীম (স)-এর উপস্থিতিতেও তিনি তাতে মালিকানা কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতেন।–[আহলি সুন্নাহ আল-জামায়াত-এর মতে এ মালিকানা এমন ছিল না, যার ওপর মিরাসের আইন কার্যকর হতে পারত এবং রাসূলের পরও তার মালিক হয়ে থাকতে পারতেন।]
এরই ভিত্তিতে ফিকাহবিদগণ বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
যে লোক তার স্ত্রীর বসবাসের জন্যে কোনো ঘর নির্মাণ করবে এবং তার পরিচালন অধিকার তারই হস্তে অর্পন করবে, সে যেন তার স্ত্রীকে একখানি ঘর সম্পূর্ণ হেবা করে দিলো। তারই কাছে তা হস্তান্তর করে দিলো। ফলে সেই ঘরের মালিকানা স্ত্রীর হয়ে যাবে।
উপরোক্ত আয়াতে এ ঘরকেই আশ্রয় হিসেবে আঁকড়ে ধরে থাকবার জন্যে সমস্ত মুসলিম মহিলাকে আদেশ করা হয়েছে। এমন কি জামা’আতে নামায পড়া ওয়াজিব করা হয়েছে কেবলমাত্র পুরুষদের জন্যে, মহিলাদের পক্ষে সে নামাযের জামা’আতের উদ্দেশ্যেও ঘর থেকে বের হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
মেয়েদের ঘরের কোণই হচ্ছে তাদের জন্যে উত্তম মসজিদ।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
মেয়েরা তাদের ঘরে নামাযের জন্যে এমন একটি স্থান নির্দিষ্ট করে নেবে, যেখানে তাকে কেউ দেখতেও পাবে না, আর তার কোনো শব্দও কেউ শুনতে পাবে না।
উম্মে হুমাইদ নামে পরিচিতা এক মহিলা রাসূলে করীমের খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলঃ
(আরবী********************************************************************************)
হে রাসূল, আমি আপনার সাথে জামা’আতে মসজিদে নামায পড়তে ভালবাসি।
তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
হ্যাঁ আমি জানতে পারলান তুমি আমার সাথে জামা’আতে নামায পড়া খুব পছন্দ করো। কিন্তু মনে রেখ, তোমার শয়নকক্ষে বসে নামায পড়া তোমার জন্য বৈঠকখানায় নামায পড়া অপেক্ষা ভালো, বৈঠকখানায় নামায পড়া ঘরের আঙ্গিনায় নামায পড়া অপেক্ষা ভালো, ঘরের আঙ্গিনায় নামায পড়া ঘরের কাছাকাছি মহল্লার মসজিদে নামায পড়া অপেক্ষা ভালো আর তোমার মহল্লার মসজিদে নামায পড়া আমার এই মসজিদে এসে নামায পড়া অপেক্ষা ভালো।
হাদীস বর্ণনাকারী বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
অতঃপর সেই মেয়েলোকটির আদেশে তার ঘরের দূরতম ও অন্ধকারতম কোণে নামাযের জায়গা বানিয়ে দেয়া হয় এবং সে মৃত্যু পর্যন্ত এখানেই নামায পড়েছিল।
আল্লামা আহমাদুল বান্না এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, সকল ব্যাপার এমন কি নামাযে ও আল্লাহর সব বন্দেগীর কাজে পূর্ণ মাত্রায় পর্দা গ্রহণ মেয়েদের জন্যে আবশ্যক। আর ঘরের সবচেয়ে গোপন কোণে নামায পড়ায় অধিকতর ও পূর্ণতর সওয়াব বলে নবী করীম (স) মেয়ে লোকটিকে তার ঘরের অধিক গোপন ও লোকদৃষ্টি থেকে দূরবর্তী জায়গায় নামায পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন।
হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ রাসূলে করীম (স) মেয়েলোকদেরকে মসজিদে যেতে চাইলে নিষেধ করতে মানা করেছেন একথা ঠিক; কিন্তু
(আরবী********************************************************************************)
তিনি যদি আজকের দিনের মেয়েদের অবস্থা দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই মেয়েদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণী বর্ণনা করেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
মেয়েরা তার ঘরে বসে আল্লাহর যে ইবাদত সম্পন্ন করে, সে রকম ইবাদত আর হয় না।
তিনি আরো বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
আল্লাহর কাছে মেয়েলোকের সেই নামায সবচেয়ে বেশি প্রিয় ও পছন্দনীয়, যা সে তার ঘরের অন্ধকারতম কোনে পড়েছে।
ঠিক এ দৃষ্টিতেই রাসূলে করীম (স) মেয়েদেরকে জানাযার সঙ্গে কবরস্থানে যেতে নিষেধ করেছেন। হযরত উম্মে আতীয়াতা (রা) বলেনঃ
(আরবী************************************************************************)
জানাযা অনুসরণ করতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, যদিও রাসূলে করীম (স) এ ব্যাপারে আমাদের প্রতি কঠোরতা প্রয়োগ করেন নি।
অপর এক হাদীসে হযরত উম্মে আতীয়াতার কথাটি নিম্নরূপঃ
(আরবী*******************************************************)
রাসূলে করীম (স) আমাদেরকে জানাযায় বের হতে নিষেধ করেছেন।
হযরত উম্মে আতীয়াতার প্রথমোক্ত কথা থেকে মনে হয়, রাসূলে করীম (স) মেয়েদেরকে জানাযায় বের হতে ও কবরস্থান পর্যন্ত গমন করতে নিষেধ করেছেণ বটে; যদিও সে নিষেধ হারাম পর্যায়ে নহে। কেননা এ ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি দেখান নি, খুব তাগিদ করে নিষেধ করেন নি। শুধু অপছন্দ করেছেন।
ইমাম কুরতুবী বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************************)
উম্মে আতীয়াতার হাদীস থেকে বাহ্যত মনে হয় যে, এ নিষেধ নৈতিক শিক্ষাদানমূলক –সব ইসলামবিদই এ মত গ্রহণ করেছেন।
সওরী বলেছেনঃ
(আরবী***************************) –মেয়েদের জানাযায় গমন করা বিদআত।
ইমাম আবূ হানীফা (রহ) বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
এ কাজ মেয়েদের শোভা পায় না।
ইমাম শাফেয়ী এ কাজকে মাকরূহ মনে করেছেন হারাম নয়। (ঐ)
মনে রাখা আবশ্যক, জামা’আতের সাথে নামায পড়তে মসজিদে যাওয়া এবং জানাযার সাথে কবরস্থানে গমন করতে নিষেধ করা হয়েছে রাসূলে করীম ও সাহাবীদের ইসলামী সমাজের সোনালী যুগে। কিন্তু চিন্তা করার বিষয় –সেকালেও যদি এ দুটো কাজে মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, অপছন্দ করা হয়ে থাকে, তাহলে এ যুগে কি তা সমর্থনযোগ্য হতে পারে কোনক্রমে? উপরন্তু ঠিক যে যে কারণে এ নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছিল, সে কারণ কি সে যুগের তুলনায় এ যুগে অধিকতর তীব্র আকার ধারণ করে নি?
ঘরের অভ্যন্তরে পর্দা
ঘরের অভ্যন্তরেও নারী-পুরুষের জন্যে পর্দার ব্যবস্থা রয়েছে। এ পর্যায়ে নারী-পুরুষের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের একটি সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************************)
বাবা, চাচা-মামা, নিজ সন্তান, সহোদর ভাই, ভাই-পো, বোন-পো, মুসলিম মহিলা ও দাসদাসীদের সাথে দেখা দেয়ার কোনো দোষ নেই।
এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা আলুসী লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************************)
এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা আলুসী লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
এ আয়াতে যাদের থেকে পর্দা করা ওয়াজিব নয়, তাদের কথা বলা হয়েছে।
লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
বাহ্যত এর অর্থ হচ্ছে এদের পর্দা না করলে কোনো দোষ নেই।
মুজাহিদ বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
এর অর্থ এই যে, আয়াতে উদ্ধৃত ব্যক্তিদের সামনে মুখাবরণ উন্মুক্ত করলে ও সৌন্দর্যের অলংকারাদি জাহির করলে কোনো দোষ হবে না।
সূরা আন-নূর-এ একথাই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতেঃ
(আরবী**************************************************************)
এবং মেয়েলোকেরা –তাদের স্বামী, পিতা, স্বামীর পিতা, গর্ভজাত ছেলে-সন্তান, স্বামীর পুত্র, সহোদর ভাই, ভাই-পো, বোন-পো, বোন-পো, মেলা-মেশার মেয়েলোক, দাস, মেয়েদের প্রতি কোনো প্রয়োজন রাখে না। এমন সব পুরুষ এবং যেসব ছেলেপেলে এখনও মেয়েদের লজ্জাস্থান সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ও সচেতন হয়নি –এদের ছাড়া আর কারো সামনে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না।
আয়াদের প্রত্যেকটি শব্দই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ।
মেয়েরা তাদের নিজ নিজ স্বামীকে দেখা দিতে পারবে, নিজের রূপ-সৌন্দর্য দেখাতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, স্বামীর পক্ষে তার সমগ্র দেহকে –দেহের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা সম্পূর্ণ জায়েয। নারী রূপ-সৌন্দর্য যৌবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ও চরম লক্ষ্যই তাই। তারী তার স্বামীকে তা দেখাতে –দেখতে দিতে বাধ্য। দেখতে দিতে না চাইলে স্বামী বল প্রয়োগ করার অধিকার রাখে। যদিও স্ত্রীর যৌন অঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত কারো মতে অশোভন, কারো মতে মাকরূহ আর কারো মতে হারাম।
২. কেবল বাবাকেই নয়, বাবার বাবা, তার বাবার ভাই, মায়ের ভাই ইত্যাদিকেও দেখা দেয়া জায়েয। কেবল নিজের বাবা-দাদাই নয়, মায়ের বাবাকেও দেখা দিতে পারে। দুধ বাবাকেও দেখা দেয়া জায়েয। হযরত আয়েশার দুধবাপ ছিল আবূ কুয়াইস। সে হযরত আয়েশার ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইরে তিনি বললেনঃ
(আরবী**************************************************************)
তাঁর সাথে দেখা দেয়ার ব্যাপারে রাসূলের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার আগে আমি তাঁকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেব না।
পরে রাসূরে করীম (স)-কে তাঁর কথা বলা হলে তিনি বলেনঃ
(আরবী************************************)
হ্যাঁ, তাকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দাও, কেননা সে তো তোমার চাচা হয়। (বুখারী)
৩. স্বামীর পিতা –শ্বশুরকেও দেখা দেয়া জায়েয।
৪. নিজ গর্ভজাত ছেলে-সন্তান, তাদের ছেলে-সন্তান।
৫. আপন সহোদর ভাই, পিতার দিকে বৈমাত্রেয় ভাই, মায়ের দিকে বৈপিত্রেয় ভাই এবং দুধ-ভাইও তার মধ্যে শামিল।
৬. এসব ভাইয়ের ছেলে-সন্তান, তাদের সন্তান।
৭. বোনের ছেলে-সন্তান, তাদের সন্তান।
৮. সাধারণ মেলামেশার মেয়েলোক, যাদের সঙ্গে দিনরাত দেখা-সাক্ষাত হয়েই থাকে কিংবা যাদেরকে ঘরের ভিতরে কাজ-কর্ম করানোর উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করা হয়েছে। কাফির ও ফাসিক মেয়েদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করা মুসলিম মহিলাদের জন্যে জায়েয নয়। কেননা তাতে করে পর্দার মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে যিম্মী ও গায়র যিম্মীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যিম্মী মেয়েলোক মুসলিম মহিলাকে দেখতে পারে কিনা, এ সম্পর্কে দুটি মত রয়েছে। ইমাম গাযালীর মতে, অন্য মুসলিম মহিলার মতো যিম্মী মেয়েলোকও দেখতে পারে। আর ইমাম বগবীর মতে এ দেখা জায়েয নয়। ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
খেদমত করার সময় মুসলিম মহিলাদের দেহের যে অংশ সাধারণত প্রকাশ হয়ে পড়ে তা দেখা যিম্মী মেয়েলোকের পক্ষে হারাম, এ হচ্ছে অধিক সত্য ও সহীহ মত। তবে যিম্মী মেয়েলোকেরা নিজের মুনিব মহিলাকে দেখতে পারে। সহীহ হাদীসে উম্মুল মু’মিনীনের কাছে যিম্মী মেয়েলোকের অনুপ্রবেশের যে কথা উল্লিখিত যিম্মী মেয়েলোকেরা নিজের মুনিব মহিলাকে দেখতে পারে। সহীহ হাদীসে উম্মুল মু’মিনীনের কাছে যিম্মী মেয়েলোকের অনুপ্রবেশের যে কথা উল্লিখিত হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, খেদমতের জন্যে যে অংশ প্রকাশ হয়ে পড়ে তা দেখা জায়েয।
ইমাম রাযী ও ইবনুল আরাবীর মতে যিম্মী মেয়েলোকও মুসলিম মহিলার মতোই। কুরআনের (আরবী*********) বলে সব মেয়েলোকই বোঝানো হয়েছে। কেননা মুসলিম মহিলাদের পক্ষে যিম্মী মেয়েলোকদের দেখা না দিয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
আমার বিবেনায় বিশুদ্ধ মত হচ্ছে এই যে, সব মেয়েলোকদের সাথেই মুসলিম মেয়েরা দেখা-সাক্ষাত করতে পারে।
৯. দাস-দাসীদের সাথে দেখা-সাক্ষাত জায়েয, তারা কাফির হলেও নিষেধ নেই। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফেয়ীর একটি কথা এই যে, মেয়ে-মালিকের দৃষ্টি ক্রীতদাস ভিন পুরুষদের মতই। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব প্রথমে বলেছিলেনঃ (আরবী*********************) মেয়ে-মালিকের পক্ষে দেখা দেয়ার ব্যাপার ক্রীতদাসীদের মতোই। কিন্তু পরে তিনি তাঁর এ মত প্রত্যাহার করেছেন এবং বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
সূরা নূর-এর আয়াত থেকে তোমাদের ভুল ধারণা হওয়া উচিত নয়, কেননা তা হচ্ছে ক্রীতদাসীদের সম্পর্কে, ক্রীতদাসদের সম্পর্কে নয়।
আর এর কারণস্বরূপ তিনি বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
ক্রীতদাসেরা তো বলদের ন্যায়। মেয়ে-মালিকের তারা স্বামীও নয়, মুহাররমও নয় অথচ যৌন উত্তেজনার উদ্রেক হওয়া খুবই স্বাভাবিক, আর মোটামুটিভবে এ নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ে তো হতেই পারে।
এতদসত্ত্বেও কুরআনে ব্যবহৃত শব্দ স্পষ্টভাবে পুরুষ স্ত্রী –অন্য কথায় দাস-দাসী –উভয়ের সাথেই সমানভাবে দেখা-সাক্ষঅতের অনুমতি প্রমাণ করে। এ পর্যায়ে হযরত আনাস বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ্য। একদা রাসূলে করীম (স) একটি ক্রীতদাসসহ হযরত ফাতিমার ঘরে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখতে পেলেনঃ ফাতিমা এমন একখানি কাপড় পড়ে আছে, যা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা খুলে যায় আর পা ঢাকা হলে মাথা অনাবৃত হয়ে পড়ে। তখন নবী করীম (স) হযরত ফাতিমাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ
(আরবী*************************************************************************))
তোমার কোনো অসুবিধে নেই। এ দাসটি হচ্ছে তোমার বাবা তুল্য এবং তোমার গোলাম।
এ থেকে মেয়ে-মালিকের পক্ষে তার ক্রীতদাসকে দেখা দেয়ায় কোনো দোষ নেই বলেই স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে।
১০. মেয়েদের প্রতি যেসব পুরুষ কোনো প্রয়োজন রাখে না –এমন সব অধীনস্থ লোকের দেখা দেয়াও জায়েয। এরা হচ্ছে সে সব লোক, যারা ঘরের বাড়তি খাবার খেতে আসে, কেননা তারা নিজেরা উপার্জন করতে অক্ষম। এরা মেয়েদের দিকে কোনো যৌন প্রয়োজন বোধ করে না, বরং কাজকর্ম করে দেয়, কথাবার্তা শোনে। এরা হচ্ছে বিগত যৌবন বৃদ্ধ, আধাবৃদ্ধ লোক।
মুজাহিদ বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
মেয়েদের প্রতি প্রয়োজন রাখে না –এমন পুরুষ হচ্ছে তারা, যারা মেয়েদের ব্যাপারই বুঝে না, জানে না এমন সোজা-সোজা ও সাদাসিধে লোক।
১১. সেসব ছেলেপেলে, যারা এখনো মেয়েলোকদের যৌনত্বের কোনো বোধ লাভ করেনি, যাদের মধ্যে যৌন বোধ এখনো জাগ্রত হয়নি, যে সব কিশোরের মনে নারীদের প্রতি এখনো কোনো কৌতুহল ও ঔৎসুক্য জাগেনি, তারাও এর মধ্যে শামিল।
এসব পুরুষ লোকের সঙ্গে পর্দানশীল মেয়েরাও অবাধে দেখা সাক্ষাত করতে পারে, এদের সামনে সাজ-সজ্জা ও প্রসাধন করেও আসতে পারে। শরীয়তে তার পূর্ণ ও স্পষ্ট অনুমতি রয়েছে। কেননা পর্দানশীল মেয়েদেরও এ ধরনের পুরুষদের সাথে দিন-রাত দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন হয়ে থাকে। আর দ্বিতীয়ত এ ধরনের পুরুষদের কাছ থেকে মেয়েদের কোনো নৈতিক বিপর্যয় –কোনো অঘটন ঘটার আশংকা নেই বললেও চলে। আর আশংকা না থাকারও কারণ এই যে, এরা হচ্ছে নিতান্ত আপন লোক। আত্মীয়তা, নৈকট্য, রক্ত সম্পর্ক ইত্যাদি বিপর্যয়ের পথের প্রধানতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এদের জণ্যে সাধারণত খোলা থাকে মেয়েদের যেসব দেহাঙ্গ, তা দেখায় কোনো দোষ নেই, আর তা হচ্ছে মুখমণ্ডল, মাথা, পা-হাটু, দুই হাত। কিন্তু এদের জন্যেও বুক, পিঠ ও পেট এবং নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত এলাকার কিছু অংশ দেখা আদৌ জায়েয নয়। কেননা এসব অঙ্গ সাধারণত উন্মুক্ত থাকে না, বস্ত্রাবৃত থাকাই স্বাভাবিক এবং এসব অঙ্গই প্রধানত যৌন আবেদনকারী।
এ ব্যবস্থা দ্বারা মেয়েদের জন্যে একটি পরিবেষ্টনী নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো। সেখানে তারা স্বাধীনভাবে ও দ্বিধা-সংকোচহীন হয়ে বিচরণ করতে পারে। বাস্তব জীবনের প্রয়োজনের তাগিত যেসব পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাত একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাতের পথে ইসলামী শরীয়তে কোনোই বাধা আরোপ করা হয়নি বরং অবাধ অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বাইরের পুরুষদের সাথে দেখা-সাক্ষাত আদৌ জায়েয নয়; সাধারণত চার কোনো প্রয়োজনও দেখা দেয় না। আর অপ্রয়োজনীয় দেখা-সাক্ষাত নারী-পুরষের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এজন্যে তা বর্জন করা প্রত্যেক ঈমানদার মহিলার কাছেই তার ঈমান ও ইসলামী বিধানের ঐকান্তিক দাবি।
মেয়ে-পুরুষদের এ পর্দা রক্ষার্থেই সাধারণ পুরুষদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন আগাম জানান না দিয়ে অপর কারো ঘরে প্রবেশ না করে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী******************************************************************************)
হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের ঘর ছাড়া অপর লোকের ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের আগমন সম্পপের্ক পরিচিতি করিয়ে নেবে এবং ঘরের লোকদের প্রতি সালাম পাঠাবে। এ নীতি অবলম্বন করা তোমাদের জন্যে কল্যাণবহ, সম্ভবত তোমরা এ উপদেশ গ্রহণ করবে ও এ অনুযায়ী কাজ করবে।
এ আয়াত নাযিল হওয়ার উপলক্ষ এই ছিল যে, একজন মহিলা সাহাবী রাসূলে করীম (স)-এর দরবারে হাজির হয়ে বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি আমার ঘরে এমন অবস্থায় থাকি যে, তখন আমাকে সেই অবস্থায় কেউ দেখতে পায় তা আমি মোটেই পছন্দ করিনে –সে আমার ছেলে-সন্তানই হোক কিংবা পিতা, অথচ এ অবস্তায়ও তারা আমার ঘরে প্রবেশ করে। এখন আমি কি করব? এরপরই এ আয়াতটি নাযিল হয়। বস্তুত আয়াতটিতে মুসলিম নারী-পুরুষের পরস্পরের ঘরে প্রবেশ করার প্রসঙ্গে এক স্থায়ী নিয়ম পেশ করা হয়েছে। মেয়েরা নিজেদের ঘরে সাধারণত খোলামেলা অবস্থায়ই থাকে। ঘরে প্রবেশ করার তো কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।। কেননা বিনানুমতিতে ও আগাম জানান না দিয়ে কেউ যদি কারো ঘরে প্রবেশ করে তবে ঘরের মেয়েদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখা, তাদের দেহের যৌন অঙ্গের ওপর নজর পড়ে যাওয়া খুবই সম্ভব। তাদের অঙ্গে চোখাচোখি হতে পারে। তাদের রূপ-যৌবন দেখে পুরুষ দর্শকের মনে যৌন লালসার আগুন জ্বলে ওঠতে পারে। আর তারই পরিণামে এ মেয়ে-পুরুষের মাঝে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে গোটা পরিবারকে তছনছ করে দিতে পারে। মেয়েদের যৌন অঙ্গ ঘরের আপন লোকদের দৃষ্টি থেকে এবং তাদের রূপ-যৌবন ভিন পুরুষের নজর থেকে বাঁবাচার উদ্দেশ্যেই এ ব্যবস্থা পেশ করা হয়েছে।
জাহিলিয়াতের যুগে এমন হতো যে, কারো ঘরের দুয়ারে গিয়ে আওয়াজ দিয়েই টপ করে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করত, মেয়েদেরকে সামলে নেবারও সময় দেয়া হতো না। ফলে কখনো ঘরের মেয়ে পুরুষকে একই শয্যায় কাপড় মুড়ি দেয়া অবস্থায় দেখতে পেত, মেয়েদেরকে দেখত অসংবৃত বস্ত্রে। এজন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ
(আরবী********************************************************************************)
তোমাদেরকে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে। আর যদি তোমাদেরকে ফিরে যেতে বলা হয়, তাহলে অবশ্যই ফিরে যাবে। এ হচ্ছে তোমাদের জন্যে অধিক পবিত্রতর নীতি। তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ণ মাত্রায় অবহিত রয়েছেন।
হযরত আনাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
হে প্রিয় পুত্র, তুমি যখন তোমার ঘরের লোকদের সামনে যেতে চাইবে, তখন বাইরে থেকে সালাম করো। এ সালাম করা তোমার ও তোমার ঘরের লোকদের পক্ষে বড়ই বরকতের কারণ হবে।
কারো ঘরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে সালাম দেবে, না প্রথমে ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইবে, এ নিয়ে দু’রকমের মত পাওয়া যায়। কুরআনে প্রথমে অনুমতি চাওয়ার নির্দেশ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন যে, প্রথমে অনুমতি চাইবে, পরে সালাম দেবে। কিন্তু একথা ভিত্তিহীন। কুরআনে প্রথমে অনুমতি চাওয়ার কথা বলা হয়েছে বলেই যে প্রথমে তাই করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কুরআনে তো কি কি করতে হবে তা এক সঙ্গে বলে দেয়া হয়েছে। এখানে পূর্বাপরের বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। বিশেষত বিশুদ্ধ হাদীসে প্রথমে সালাম করার ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
কালদা ইবনে হাম্বল (রা) বলেনঃ আমি রাসূলের ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলাম, কিন্তু প্রথমে সালাম করিনি বলে অনুমতিও পাইনি। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী*******************************************************)
ফিরে যাও, তারপর এসে প্রথমে বলো আসসালামু আলাইকুম, তার পরে প্রবেশের অনুমতি চাও।
হযরত জাবের বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
যে লোক প্রথমে সালাম করেনি, তাকে ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিও না।
হযরত জাবের বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী***********************) –কথা বলার পূর্বে সালাম দাও।
হযরত আবূ মূসা আশ’আরী ও হুযায়ফা (রা) বলেছেনঃ
(আরবী***************************************)
মুহাররম মেয়েলোকদের কাছে যেতে হলেও প্রথমে অনুমতি চাইতে হবে।
এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরবী*******************) –আমার মায়ের ঘরে যেতে হলেও কি আমি অনুমতি চাইব?
রাসূলে করীম (স) বললেনঃ অবশ্যই। সে লোকটি বললঃ আমি তো তার সঙ্গে একই ঘরে থাকি –তবুও? রাসূল (স) বললেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই অনুমতি চাইবে। সেই ব্যক্তি বললঃ আমি তো তার খাদেম। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
(আরবী*******************************************************)
অবশ্যই পূর্বাহ্নে অনুমতি চাইবে, তুমি কি তোমারমাকে ন্যাংটা অবস্থায় দেখতে চাও –তা-ই অপছন্দ করো?
তার মানে, অনুমতি না নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলে মাটে ন্যাংটা অবস্থায় দেখতে পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে সালাম করতে হবে এবং পরে প্রবেশের অনুমতি চাইতে হবে। অনুমতি না পেলে ফিরে যেতে হবে। এ ফিরে যাওয়া অধিক ভালো, সম্মানজনক প্রবেশের জন্যেকাতর অনুনয়-বিনয় করার হীনতা থেকে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হাদীসের ইলম লাভের জন্যে কোনো কোনো আনসারীর ঘরের দ্বারদেশে গিয়ে বসে থাকতেন, ঘরের মালিক বের হয়ে না আসা পর্যন্ত তিনি প্রবেশের অনুমতি চাইতেন না। এ ছিল উস্তাদের প্রতি ছাত্রের বিশেষ আদব, শালীনতা।
কারো বাড়ির সামনে গিয়ে প্রবেশ-অনুমতির জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে দরজার ঠিক সোজাসুজি দাঁড়ানোও সমীচীন নয়। দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে নজর করতেও চেষ্টা করবে না। নবী করীম (স) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছেঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুসর বলেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
নবী করীম (স) যখন কারো বাড়ি বা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেন, তখন অবশ্যই দরজার দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেন না। বরং দরজার ডান কিংবা বাম পাশে সরে দাঁড়াতেন এবং সালাম করতেন।
এক ব্যক্তি রাসূলে করীমের বিশেষ কক্ষপথে মাথা উঁচু করে তাকালে রাসূলে করীম (স) তখন ভিতরে ছিলেন এবং তাঁর হাতে লৌহ নির্মিত চাকুর মতো একটি জিনিস ছিল। তখন তিনি বললেনঃ
(আরবী******************************************************)
এ ব্যক্তি বাইরে থেকে উঁকি মেরে আমাকে দেখবে তা আগে জানতে পারলে আমি আমার হাতের এ জিনিসটি দ্বারা তার চোখ ফুটিয়ে দিতাম। এ কথা তো বোঝা উচিত যে, এ চোখের দৃষ্টি বাঁচানো আর তা থেকে বাঁচবার উদ্দেশ্যেই পূর্বাহ্নে অনুমতি চাওয়ার রীতি করে দেয়া হয়েছে।
এ সমএর্ক হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে স্পষ্ট, আরো কঠোর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
কেউ যদি তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে তাকায় আর তুমি যদি পাথর মেরে তার চোখ ফুটিয়ে দাও, তাহলে তাতে তোমার কোনো দোষ হবে না।
অনুমতি না পাওয়া গেলে কিংবা ঘরে কোনো পুরুষ লোক উপস্থিত নেইবলে যদি ঘর থেকে চলে যেতে বলা হয় তাহলে অনুমতি প্রার্থনাকারীকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। তার সেখানে আরো দাঁড়ানো এবং কাতর কণ্ঠে অনুমতি চাইতে থাকা সম্পূর্ণ গর্হিত কাজ।
তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরও যদি অনুমতি পাওয়া না যায়, তাহলেই এরূপ করতে হবে। হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী একবার হযরত উমর ফারূকের দাওয়াত পেয়ে তাঁর ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হলেন এবং তিনবার সালাম করার পরও কোনো জবাব না পাওয়ার কারণে তিনি ফিরে চলে গেলেন। পরে সাক্ষাত হলে হযরত উমর ফারূক বললেনঃ
(আরবী****************) –তোমাকে দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও তুমি আমার ঘরে আসলে না কেন?
তিনি বললেনঃ
(আরবী******************************************************)
আমি তো এসেছিলাম, আপনার দরজায় দাঁড়িয়ে তিনবার সালামও করেছিলাম। কিন্তু কারো কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে আমি ফিরে চলে এসেছি। কেননা নবী করীম (স) আমাকে বলেছেন, তোমাদের কেউ কারো ঘরে যাওয়ার জন্যে তিনবার অনুমতি চেয়েও না পেলে সে যেন ফিরে যায়। (বুখারী, মুসলিম)
ইমাম হাসান বসরী বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
তিনবার সালাম করার মধ্যে প্রথমবার হলো তার আগমন সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া। দ্বিতীয়বার সালাম প্রবেশ অনুমতি লাভের জন্যে এবং তৃতীয়বার হচ্ছে ফিরে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা।
কেননা তৃতীয়বার সালাম দেয়ার পরও ঘরের ভেতর থেকে কারো জবাব না আসা সত্যই প্রমাণ করে যে,ঘরে কেউ নেই, অন্তত ঘরে এমন কোনো পুরুষ নেই, যে তার সালামের জবাব দিতে পারে।
আর যদি কেউ ধৈর্য ধরে ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়েই থাকতে চায়, তবে তারও অনুমতি আছে, কিন্তু শর্ত এই যে, দুয়ারে দাঁড়িয়েই অবিশ্রান্তভাবে ডাকা-ডাকি ও চিল্লচিল্লি করতে থাকতে পারবে না। একথাই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতাংশেঃ
(আরবী*****************************************************************)
তারা যদি ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষায় থাকত যতক্ষণ না তুমি ঘর থেকে বের হচ্ছ, তাহলে তাদের জন্যে খুবই কল্যাণকর হতো।
আয়াতটি যদিও বিশেষভাবে রাসূলে করীম (স)-এর প্রসঙ্গে; কিন্তু এর আবেদন ও প্রয়োজন সাধারণ। কোনো কোনো কিতাবে এরূপ উল্লেখ পাওয়া যায় যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা) –যিনি ইসলামের বিষয়ে মস্তবড় মনীষী ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন –হযরত উবাই ইবনে কা’আবের বাড়িতে কুরআন শেখার উদ্দেশ্যে যাতায়াত করতেন। তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতেন, কাউকে ডাক দিতেন না, দরজায় ধাক্কা দিয়েও ঘরের লোকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন না। যতক্ষণ না হযরত উবাই নিজ ইচ্ছেমতো ঘর থেকে বের হতেন, ততক্ষণ এমনিই দাঁড়িয়ে থাকতেন। (আরবী******************************)
পুরুষ উপস্থিত নেই –এমন ঘরের মেয়েদের কাছ থেকে যদি কোনো সাধারণ দরকারী জিনিস পেতে হয়; কিংবা একান্তই জরুরী কোনো কথা, কোনো সংবাদ জানতে হয়, তাহলে পর্দার আড়ালে বাইরে দাঁড়িয়েই তাঁদের নিকট চাইবে। বস্তুত এ নীতি তোমাদের ও তাদের দিলের পবিত্রতা রক্ষার পক্ষে অধিকতর উপযোগী, অনুকূল।
আয়াতটি যদিও স্পষ্ট রাসূলে করীমের বেগমদের সম্পর্কে অবতীর্ণ এবং এ নির্দেশও বিশেষভাবে রাসূলের বেগমদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু এ আয়াতেরও একটি সাধারণ আবেদন রয়েছে এবং এ নির্দেশও সাধারণ মুসলিম সমাজের মহিলাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযোজ্য হবে। কেননা, তাদের কাছ থেকে কিছু পেতে হলেও তো সে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়েই চাইতে হবে এবং বিনানুমতিতে তাদের ঘরেও প্রবেশ করা যাবে না।
উপরের উদ্ধৃত নির্দেশসমূহ পুরুষদের লক্ষ্য করেই বর্ণিত হয়েছে; কিন্তু তাই বলে মেয়েরা তার বাইরে নয়, তাদের পক্ষে এর কোনোটিই নয় লংঘনীয়। মেয়েদের লক্ষ্য করে আরো অতিরিক্ত নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন মেয়েরা তা পালন করে নিজদেদের পরপুরুষের দৃষ্টি ও আকর্ষণের পংকিলতা থেকে পূর্ণমাত্রায় রক্ষা করতে পারে।
মেয়েদের পক্ষে যদি বাইরের পুরুষদের সাথে কথা বলা একান্তই জরুরী হয়ে পড়ে এবং তা না বলে কোনো উপায়ই না থাকে, তাহলে কথা বলতে হবে বৈ কি; কিন্তু সেজন্যেও কিছুটা স্পষ্ট নিয়ম-নীতি রয়েছে, যা লংঘন করা কোনো ঈমানদার মহিলার পক্ষেই জায়েয নয়।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************************************)
তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহ ভীরু হয়ে থাক, তাহলে কস্মিনকালেও নিম্নস্বরে কথা বলবে না। কেননা সেরূপ কথা বললে রোগগ্রস্ত মনের লোক লোভী ও লালসা-কাতর হয়ে পড়বে। আর তোমরা প্রচলিত ভালো কথাই বলবেঃ
‘নিম্নস্বরে কথা বলবে না’ মানেঃ
(আরবী************************************************************)
তোমাদের কথাকে বিনয় নম্রতাপূর্ণ ও নারীসুলভ কোমল ও নরম করে বলবে না, যেমন করে সংশয়পূর্ণ মানসিকতা সম্পন্ন ও চরিত্রহীনা মেয়েলোকেরা বলে থাকে।
কেননা এ ধরনের কথা শুনলে লালসাকাতর ব্যক্তিরা খুবই আশাবাদী হয়ে পড়ে। তাদের মনে মনে এ লোভ জাগে যে, হয়ত এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে। কেবল মেয়েদেরই নয়, পুরুষদেরও অনুরূপ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নিহায়া কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************************)
নবী করীম (স) পুরুষকে তার নিজের স্ত্রী ছাড়া ভিন মেয়েলোকের খুব নরম সুরে ও লালসা পিচ্ছিল কণ্ঠস্বরে কথা বলতে নিষেধ করেছেন, যে কথা শুনে সেই মেয়েলোকের মনে কোনো লালসা জাগতে পারে।
‘মানসিক রোগাক্রান্ত লোকেরা লালসাকাতর হতে পারে’ –একথা বলার বিশেষ কারণ হচ্ছে এই যে, ভিন মেয়েলোকের কাছ থেকে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভবনার আশা করা কেবল এ ধরনের লোকদের পক্ষেই সম্ভব। ঈমানদার লোক কখনো এরূপ হয় না।
(আরবী***********************************************************************)
কেননা কামিল ঈমানদার ব্যক্তির দিল ঈমানের প্রভাবে শান্ত-তৃপ্ত-সমাহিত। সে সব সময় আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণাবলী দেখতে পায় –মনে রাখে। ফলে সে আল্লাহর হারাম করা কোনো কিছু পেতে লোভ করেনা। কিন্তু যার ঈমান দুর্বল, যার দিলে মুনাফিকী রয়েছে, সে-ই কেবল হারাম জিনিসের প্রতি লোভাতুর হয়ে থাকে।
কিন্তু যে মেয়েলোকের সাথে কথা বলা হচ্ছে, সে যদি স্পষ্ট ভাষায় ও অকাট্য শব্দে ও স্বরে কাটাকাটিভাবে জরুরী কথা কয়টি বলে দেয়, তাহলে এ মানসিক রোগাক্রান্ত লোকেরা লোভাতুর হবে না, তারা নিরাশ হয়েই চলে যেতে বাধ্য হবে। আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
লোকদের সাথে কথা বলার সময় কণ্ঠস্বর মিহি করে বলো না। যেমন সন্দেহপূর্ণ চরিত্রের মেয়েরা করে থাকে। কেননা এ ধরনের কথা বলাই অনেক সময় বিরাট নৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে।
শয়তান প্রকৃতির ও চরিত্রহীন লোকেরা নারী শিকারে বের হয়ে সাধারণত সেসব জায়গায়ই ঢু মারে, যেখান থেকে কিছুটা সুযোগ লাভের সম্ভাবনা মনে হয়। আর এ উদ্দেশ্যে স্বামী কিংবা বাড়ির পুরুষদের অনুপস্থিতি তারা মহা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। নারী শিকারীর এ ধরনের মৃগয়া কেবল সেখানেই সার্থক হয়ে থাকে, যেখানে নারী নিজে দুর্বলমনা, প্রতিরোধহীন, যে শিকার হবার জন্যে –পর পুরুষের হাতে ধরা দেবার জন্যে কায়মনে প্রস্তুত হয়েই থাকে। নারীদেরকে সাবধান ও সতর্ক করে তোলবার জন্যেই আল্লাহর এ নির্দেশবাণী অবতীর্ণ হয়েছে। অপরদিকে সাধারণভাবে সব পুরুষকেই রাসূলে করীম (স) স্বামী বা বাড়ির পুরুষের অনুপস্থিতিতে ঘরের মেয়েদের সাথে কথা বলতেই নিষেধ করেছেন। হযরত আমর ইবনুল আস (রা) বর্ণনা করেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
নবী করীম (স) মেয়েলোকদের সাথে তাদের স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন।
মেয়েরা যদি ভিন পুরুষের সাথে কতা বলতে বাধ্যই হয়, না বলে যদি কোনো উপায়ই না থাকে, তাহলে কুরআনের নির্দেশ হচ্ছেঃ
(আরবী************************) –খুব ভাল ও প্রচলিত ধরনের কথা বলবে।
এ আয়াতাংশের তাফসীরে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
তারা বলবে সাধারণভাবে লোকদের কাছে পরিচিত ও প্রচলিত কথা, যার মধ্যে সন্দেহ-সংশয়ের লেশমাত্র থাকবে না এবং যা হবে শরীয়তের রীতিনীতি অনুযায়ী, যে কথা শুনে শ্রোতা অপছন্দও কিচু করবে না এবং পাপী ও চরিত্রহীন লোকেরা অবৈধ সম্পর্কের লোভে লালায়িতও হবে না।
সে সঙ্গে একথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, মেয়েদের সাধারণ কথাবার্তা খুবই নিম্নস্বরে হওয়া বাঞ্চনীয়। উচ্চৈস্বরে বা তীব্র কণ্ঠে কথা বলা মেয়েদের শোভা পায় না। দ্বিতীয়ত উচ্চৈস্বরে কথা বললে দূরের লোকের পর্যন্ত তার কথা শুনতে পাবে। পূর্বোক্ত আয়াতেরই ব্যাখ্যায় আল্লামা আবূ বকর আল-জাসসাস লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, মেয়েদের কন্ঠস্বর উচ্চ হবে না, অন্য লোকরা তাদের কণ্ঠস্বর শুতনে পাবে না –এই হচ্ছে মেয়েদের জন্যে অতি উত্তম নীতি।
বস্তুত একথা ভুল যেতে পারে না যে, মেয়েদের শরীরের ন্যায় তাদের কণ্ঠস্বরও পর্দায় রাখতে হবে। দেহকে যেমন ভিন পুরুষের সামনে অনাবৃত করা যায় না, কণ্ঠস্বরকেও তেমনি ভিন পুরুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করানো যায় না। ইমাম ইবনুল হাম্মাম বলেছেনঃ
(আরবী****************) –নিশ্চয়ই মেয়েলোকের সুরেলা কন্ঠস্বর ভিন পুরুষ থেকে লুকোবার জিনিস। ঠিক এজন্যেই নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
নামাযে ইমামের ভুল হলে সেই জামা’আতে শরীক পুরুষেরা তাকবীর বলবে আর মেয়েরা হাত মেরে শব্দ করবে।
এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, মেয়েদের কণ্ঠস্বর অবশ্য গোপনীয়, ভিন পুরুষ থেকে তা অবশ্যই লুকোতে হবে। (আবরী************)
এরই ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, মেয়েরা নামাযে যদি উচ্চৈস্বরে কুরআন পাঠ করে তবে তাতে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। (আরবী********************)
শুধু কণ্ঠস্বরই নয়, মেয়েদের অলংকারাদির ঝংকারও ভিন পুরুষদের কর্ণকুহর থেকে গোপন করতে হবে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************)
এবং তারা যেন নিজেদের পা মাঠির ওপর শক্ত করে না ফেলে, কেননা তাতে করে তাদের গোপনীয় অলংকারাদির ঝংকার শুনিয়ে দেয়া হবে।
আর জাহিলিয়াতের যুগে মেয়েরা পায়ে পাথরকুচি ভরে মল পরত আর তারা যখন চলাফেরা করত, তখন শক্ত করে মাটিতে পা ফেলত। এতে পা ঝংকার দিয়ে উঠত। এ আয়াতে তা করতে নিষেধ করা হয়েছে।
ইমাম বায়যাবী লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
অলংকারাদি জাহির করার ব্যাপারে একটা পূর্ণমাত্রার নিষেধ এবং মেয়েদের কণ্ঠস্বর উচ্চ করা যে নিষেধ, তাও এ থেকে প্রমাণিত।
কেননা অলংকারের ঝংকার শুনতে পেলেও ভিন পুরুসের মনে অতি সহজেই যৌন আকর্ষণ জেগে ওঠে। তাই নিখুঁত পর্দা রক্ষার জন্যে অলংকারের ঝংকারও পরপুরুষ থেকে লুকোতে হবে। আল্লামা যামাখশারী এ আয়াতের ভিত্তিতে লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
মেয়েদেরকে যখন অলংকারের শব্দ জাহির করতে নিষেধ করা হয়েছে, তখন জানা গেল যে, অলংকার ব্যবহারের অঙ্গসমূহ গোপন করা আরো বেশি করে নিষিদ্ধ হবে।
ভিন স্ত্রী-পুরুষের গোপন সাক্ষাতকার
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মেয়ে পুরুষের অবাধ দেখা-সাক্ষাতের জন্যে একটা পরিসর রয়েছে এবং সে পরিসরের বাইরে মেয়ে পুরুষের দেখা-সাক্ষাত করা, কথাবার্তা বলা ও গোপন অভিসারে মিলিত হওয়া সম্পূর্ণ হারাম। যে আয়াতে ঘরের মেয়েলোকদের কাছে কোনো জরুরী জিনিস চাইতে হলে পর্দার আড়ালে থেকে বাইরে বসে চাইতে হবে বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে আয়াতেরই ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
এ আয়াত প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তির জন্যে একটি নীতি শিক্ষা দেয় এবং গায়র-মুহাররম মেয়েলোকদের সাথে গোপনে মিলিত হওয়া ও পর্দার অন্তরাল ছাড়াই পরস্পরে কথাবার্তা বলা সম্পর্কে স্পষ্ট ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।
নবী করীম (স)-ও একথাই বলেছেন নিম্নোদ্ধৃত হাদীসেঃ
(আরবী*****************************************************************))
যে সব মহিলার স্বামী বা নিকটাত্মীয় পুরুষ অনুপস্থিত, তাদের কাছে যেও না। কেননা তোমাদের প্রত্যেকের দেহের প্রতিটি ধমনীতে শয়তানের প্রভাব রক্তের মতো প্রবাহিত হয়।
অন্যত্র আরো কঠোর ভাষায় বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার কোনো ব্যক্তিই যেন এমন মেয়েলোকের সাথে গোপনে মিলিত না হয়, যার সাথে তার আপন মুহাররম কোনো পুরুষ নেই। কেননা গোপনে মিলিত এমন দুজন স্ত্রী পুরুষের সাথে শয়তান তৃতীয় হিসেবে উপস্থিত থাকে। ঠিক এ কারণেই সতীসাধ্বী স্ত্রী হওয়ার জন্য অপরিহার্য গুণ হিসেবে নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
স্বামীর ঘরে তার অনুমতি ছাড়া কোনো লোককেই প্রবেশ করতে দেবে না।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী এ হাদীসের অর্থ লিখেছেন এ ভাষায়ঃ
(আরবী******************************************************************)
অর্থাৎ স্ত্রী তার স্বামীর ঘরে স্বামীর পছন্দ নয় –এমন পুরুষ বা স্ত্রীলোককে প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না। কেননা এতে করে খারাপ খারাপ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে এবং তার ফলে স্বামীর মনে আত্মমর্যাদাবোধ তীব্র হয়ে উঠে দাম্পত্য সম্পর্ককেই ছিন্ন করে দিতে পারে।
স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগ তার স্ত্রীর কাছে কোনো গায়র-মুহাররম পুরুষের উপস্থিতি এবং তার ঘরে প্রবেশ করা ইসলামী শরীয়তে বড়ই গুনাহের কাজ, নিষিদ্ধ এবং অভিশপ্ত। হাদীসে এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) একদা বাইরে থেকে এসে তাঁর ঘরে তাঁর স্ত্রীর কাছে বনু হাশিম বংশের কিছু লোককে উপস্থিত দেখতে পান। তিনি গিয়ে নবী করীম (স)-এর কাছে বিষয়টি বিবৃত করেন এবং বলেন যে, ঘটনা এই; কিন্তু ভালো ছাড়া খারাপ কিছু দেখতে পাইনি; তখন নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী*****************************) –খারাবী থেকে আল্লাহ তাঁকে মুক্ত করেছেন।
অতঃপর তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন এবং ঘোষণা করলেনঃ
(আরবী************************************************************)
আজকের দিনের পর কোনো পুরুষই অপর কোনো ঘরের স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে কখনো প্রবেশ করবে না, যদি না তার সাথে আরো একজন বা দুইজন পুরুষ থাকে।
হযরত ফাতিমা (রা) –এর ঘরে প্রবেশ করার জন্যে হযরত আমর ইবনে আ’স (রা) একদিন বাইরে থেকে অনুমতি চাইলেন। তাঁকে অনুমতি দেয়া হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ওখানে আলী উপস্থিত আছে কি? বলা হলঃ ‘না, তিনি নেই”। একতা শুনে হযরত আমর ফিরে চলে গেলেন। পরে আবার এসে অনুমতি চাইলে হযরত আলী উপস্থিত কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বলা হলো –তিনি ঘরে উপস্থিত রয়েছে। অতঃপর হযরত আমর প্রবেশ করলেন। হযরত আলী জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরবী*********************************************************************************)
আমাকে এখানে অনুপস্থিত পেয়ে তুমি ঘরে প্রবেশ করলে না কেন –কে নিষেধ করেছিল?
তখন হযরত আমর বললেনঃ
(আরবী************************************************************************)
যে মেয়েলোকের স্বামী উপস্থিত নেই, তার ঘরে প্রবেশ করতে রাসূলে করীম (স) আমাদরে নিষেধ করেছেন।
এ পর্যায়ে অধিকতর কঠোর বাণী ঘোষিত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীসে। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
যে পুরুষ লোক স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোনো মেয়েলোকের শয্যায় বসবে, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার উপর (তার শাস্তির জন্যে) একটি বিষধর অজগর নিযুক্ত করে দিবেন।
আল্লামা আহমাদুল বান্না এসব হাদীসের ভিত্তিতে লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
এ পর্যায়ের সমস্ত হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর কাছে কোনো একজন পুরুষের প্রবেশ করা এবং ভিন-গায়র মুহাররম মেয়েলোকের সাথে গোপনে মিলিত হওয়া সম্পূর্ণ হারাম এবং এ সম্পর্কে সকল ইসলামবিদ সম্পূর্ণ একমত।
ইমাম নববী লিখেছেনঃ দুইজন-তিনজন পুরুষের প্রবেশ জায়েয প্রমাণিত হয় যে, হাদীস থেকে তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। এজন্যে একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতিতে কোনো দুষ্কৃতির কল্পনা করা যায় না। অন্যথায়, তা সত্ত্বেও যদি দুষ্কার্য হওয়ার সম্ভাবনা দেকা দেয় তাও হারাম। (আরবী************)
স্বামীর উপস্থিতিতেও যেমন এ কাজ করা যেতে পারে না, তেমনি তার অনুপস্থিতিতেও করা যেতে পারে না। বরং স্বামীর অনুপস্থিতিতে এ কাজ এক ভয়ানক অপরাধে পরিণত হয়ে যায়।
বস্তুত স্বামীর নিকটাত্মীয় বন্ধুদের সাথে স্ত্রীর এবং স্ত্রীর নিকটাত্মীয় বান্ধবীদের সাথে স্বামীর –মুহাররম নয় এমন সব মেয়ে পুরুষের –গোপন সাক্ষাতকার বড়ই বিপদজনক হয়ে থাকে। উপরোক্ত হাদীসে মেয়েদেরকে যেমন সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলবার জন্যে, তেমনি নিম্নোদ্ধৃত হাদীসে সাবধান করে দেয়া হয়েছে পুরুষদের।
রাসূলে করীম (স) কড়া ভাষায় বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************)
তোমরা পুরুষেরা গায়র-মুহাররম মেয়েলোকের কাছে যাওয়া-আসা থেকে দূরে থাকো –সাবধান থাক।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
এ হাদীস থেকে যে দুটি কথা প্রমাণিত হয়, তার একটি হচ্ছে, ভিন মেয়েলোকদের সাথে পুরুষের নিরিবিলিতে গোপনবাবে মিলিত হওয়া নিষেধ; আর দ্বিতীয়তটি হচ্ছে স্বামী বা ঘরের পুরুষ উপস্থিত নেই এমন মেয়েলোকের ঘরে প্রর্বেশ করা নিষেধ।
রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশের ফলে এ দুটো কাজই হারাম। এ পর্যায়ে দেবর-ভাসুর সম্পর্কে পুরুষদের সাথে মেয়েদের একাকীত্বের সাক্ষাত সর্বাধিক বিপদজনক এবং এ ব্যাপারে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করার জন্যে স্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে।
রাসূলে করীম (স)-এর উপরোক্ত কতা শুনে একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরবী***********************************************************)
হে রাসূল, দেবর-ভাসুর প্রভৃতি স্বামীর নিকটাত্মীয় পুরুষদের সম্পর্কে আপনি কি নির্দেশ দিচ্ছেন?
জবাবে তিনি বলেনঃ
(আরবী**********) –স্বামীর এসব নিকটাত্মীয়রাই হচ্ছে মৃত্যুদূত।
(আরবী*******) শব্দের অর্থ কি? –এ সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের বিভিন্ন কথা উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী বলেছেনঃ
(আরবী*************) –‘হামো’ মানে স্বামীর ভাই –স্বামীর ছোট হোক কি বড়।
ইমাম লাইস বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************)
‘হামো’ হচ্ছে স্বামীর ভাই, আর তারই মতো স্বামীর অপরাপর নিকটবর্তী লোকের যেমন চাচাত, মামাত, ফুফাত ভাই ইত্যাদি।
ইমাম নববীর মতে ‘হামো’ মানে হচ্ছেঃ
(আরবী*****************************************************************************)
স্বামীর নিকটবর্তী লোক –আত্মীয়, স্বামীর বাপ ও পুত্র সন্তান –এর মধ্যে শামিল নয়। কেননা তারা তো স্ত্রীর জন্যে মুহাররম। এদের সঙ্গে একাকীত্বে একত্রিত হওয়া শরীয়তে জায়েয। কাজেই এদেরকে মৃত্যুদূত বলে অভিহিত করা যায় না।
বরং এর সঠিক অর্থে বোঝা যায়ঃ
স্বামীর ভাই, স্বামীর ভাইপো, স্বামীর চাচা, চাচাত ভাই, ভাগ্নে এবং এদেরই মতো অন্যসব পুরুষ যাদের সাথে এ মেয়েলোকের বিয়ে হতে পারে, যদি না সে বিবাহিতা হয়। ৱ
কিন্তু নবী করীম (স) এদেরকে মৃত্যু বা মৃত্যুদূত বলে কেন অভিহিত করেছেন? এর কারণস্বরূপ বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************)
সাধারণ প্রচলিত নিয়ম ও লোকদের অভ্যাসই হচ্ছে এই যে, এসব নিকটাত্মীয়ের ব্যাপারে উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়। (এবং এদের পারস্পরিক মেলা-মেমায় কোনো দোস মনে করা হয় না) ফল তাই ভাইর বউর সাথে একাকীত্বে মিলিত হয় এ কারণেই এদেরকে মৃত্যু সমতূল্য বলা হয়েছে। আল্লামা কাযী ইয়ায বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
স্বামীর এসব নিকটাত্মীয়ের সাথে স্ত্রীর (কিংবা স্ত্রীর এসব নিকটাত্মীয়ের সাথে স্বামীর) গোপন মেলামেশা নৈতিক ধ্বংস টেনে আনে।
ইমাম কুরতুবী বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************)
এ ধরনের লোকদের সাথে গোপন মিলন নৈতিক ও ধর্মের মৃত্যু ঘটায় কিংবা স্বামীর আত্মসম্মানবোধ তীব্র হওয়ার পরিণামে তাকে তালাক দেয় বলে তার দাম্পত্য জীবনের মৃত্যু ঘটে। কিংবা এদের কারোর সাথে যদি জ্বেনায় লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে সঙ্গেসার কারার দণ্ড দেয়া হয়, ফল তার জৈবিক মৃত্যুও ঘটে।
স্বামী বা স্ত্রীর নিকটাত্মীয়-আত্মীয়দের ব্যাপারে শরীয়তে যখন কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তখন স্বামীর পুরষ বন্ধুদের সাথে স্ত্রীর এবং স্ত্রীর বান্ধবীদের সাথে স্বামীর অবাধ মেলামেশা, বাড়িতে-পার্কে, হোটেল-রেস্তোরায় আর পথে-ঘাটে কি অফিসে-ক্লাবে গোপন অভিসার কিভাবে বিধিসম্মত হতে পারে! অথচ তাই চলছে বর্তমান সামজের সর্বস্তরে। এখনকার সমাজে শালার বউ আর বউর বোন অর্ধেক বধু। স্ত্রীর বান্ধবী আর স্বামীর বন্ধুরাই হচ্ছে নিঃসঙ্গের সঙ্গী –আসর বিনোদনের সামগ্রী, আনন্দের ফল্গুধার। ভাবীর বোন আর বোনোর ননদও এ ব্যাপারে কম যায় না। বন্ধু বাড়ীতে বন্ধুর স্ত্রীর আদর-আপ্যায়ন ও খাবার টেবিলে পরিবেশন না করলে বন্ধুত্বই অর্থহীন। শ্বশুর বাড়িতে শালার বউ আদর-যত্ন না করলে শ্বশুর বাড়িতে আর মধুর হাঁড়ির সন্ধান পাওয়া যায় না। বোনের সহপাঠিনী আর সহপাঠির বোনের তো নিত্য সহচরী, গোপন অভিসারের মধু-মল্লিকা। কিন্তু এর পরিণামটা কি হচ্ছে? নৈতিক পবিত্রতা বিলীন হচ্ছে। বিয়ের আগেই কার্যের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হচ্ছে; আর যুবক-যুবতীরা হারাচ্ছে তাদের মহামূল্য কুমারিত্ব।
নর-নারীর অবাধ মেলামেশার এ মারাত্মক পরিণতি অনিবার্য বলেই আল্লাহ তা’আলা তা চিরতরে হারাম করে দিয়েছেন। অন্যথায় এর মূলে নারী-পুরুষের প্রতি কোনো খারাপ ধারণার স্থান নেই। মানব চরিত্র ও মানুষের স্বভাবই এমন যে, তার জন্যে এরূপ নিয়ম বিধান না থাকলে জীবনই দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। শুষ্ক খড় কুটোর স্তুপের কাছাকাছি আগুন নিয়ে খেলা করতে দিয়ে যে কোনো মুহুর্তে সে আগুন লেগে সব জ্বলে ভস্ম হয়ে যেতে পারে, তাতে আর সন্দেহ কি।
ইসলামে যেহেতু মানুষের নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা এবং পারিবারিক স্থায়িত্বই হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান ও সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং যে কোনো মূল্যে তা রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এ জন্যেই ইসলাম এমন কিছুই বরদাশত করতে রাজি নয়, যার ফলে এক্ষেত্রে ভাঙন ও বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************************)
তোমরা গায়র-মুহাররম মেয়েলোকদের সাথে গোপনে ও একাকীত্বে মিলিত হবে না। আল্লাহর শপথ, যেখানেই একজন পুরুষভিন মেয়েলোকের সাথে গোপনে মিলিত হবে, সেখানেই তাদের দুজনার মধ্যে শয়তান অবশ্যই প্রবেশ করবে ও প্রভাব বিস্তার করবে।
ব্যাপাটিকে আমরা এভাবেও বুঝতে পারি যে, ইলেকট্রিক লাইনের দুটো করে তার থাকে, একটি ‘পজিটিভ’ আর অপরটি ‘নেগেটিভ’। এ দুটোই অপরিহার্য, একটি ছাড়া অপরটি অর্থহীন। কিন্তু এ দুটো থেকেসত্যিকার আলো জ্বলা বা পাখা চলার কাজ পাওয়া যেতে পারে তখন, যখন উভয় তারকে বিশেষ এক ব্যবস্থাধীন পরস্পরের সাথে যুক্ত করা হয়। কিন্তু দুটো পাশাপাশি চলতে গিয়ে চলাবস্থাতে যদি পারস্পরিক ব্যবচ্ছেদ ছিণ্ন করে দিয়ে মিলিত হয়ে পড়ে তাহলে তাতে আলো জ্বলবে না, পাখা চলবে না, বরং এমন আগুন জ্বলে উঠবে, তার ফলে গোটা ঘর-সংসার জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
নারী-পুরুষও নেগেটিভ-পজিটিভ দুই বিপরীতমুখী, বিপরীত গুণ-সম্পন্ন শক্তি। এ দুয়োর সমন্বয়ে যদি মানবতার কল্যাণ লাভ করতে হয় তাহলে অবশ্যই এক নির্দিষ্ট নিয়মে উভয়ের মিলন সম্পন্ন করতে হবে। ঘাটে-পথে, হাটে-মাঠে, পার্কে-ক্লাবে আর হোটেল-রেস্তোরায় যদি এদের অবাধ মেলামেশাকে সম্ভব করে দেয়া হয় তাহলে নৈতিকতা ও মনুষ্যত্যের অপমৃত্যু অনিবার্য। দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতা আর পারিবারিক সুস্থতা ও শান্তি-তৃপ্তি নিঃশেষে ফুরিয়ে যাবে, তাতে আর কোনোই সন্দেহ নেই। বর্তমানে ইউরোপ আমেরিকার সমাজে এ কথাই অকাট্য হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। বস্তুত যে সমাজে একটি কুমারী মেয়েও সন্ধান করে পাওয়া যায় না সে সমাজ যে মানুষের সমাজ নয়, নিতান্ত পশুর –পশুর চাইতেও নিকৃষ্টতম জীবনের সমষ্টি, তাতে একবিন্দু সন্দেহ থাকতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা সত্যিই বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
মানুষকে অতীব উত্তম মানদণ্ডে সৃষ্টি করেছি বটে; কিন্তু অতঃপর তাদের অমানবিক কার্যখলাপের দরুনই তাদের নামিয়ে দিয়েছি চরমতম নিম্ন পংকে।
ঘরের অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা সংরক্ষণ
একটি ঘরকেই কেন্দ্র করে সুষ্ঠু দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসা, পরস্পরের সহানুভূতি, সংবেদন ও প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে গড়ে ওঠে এক নতুন সংসার। ইসলাম এ ঘর ও সংসারের সম্ভ্রম, মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষার্থে বিবিধ ব্যবস্থা পেশ করেছে। এ উদ্দেশ্যে কতগুলো জরুরী নিয়ম বিধান –যা যথাযথভাবে পালন করলে পারিবারিক জীবনে মাধুর্যময় ও নিশ্চয়তা ভিত্তির আস্থঅ ও বিশ্বাসপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং স্বাম স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি –সকলেই সেখানে নিরবিচ্ছিন্ন আশার ও শান্তি-সুখ লাভ করতে পারে। প্রত্যেকেই পূর্ণ আযাদী, সম্ভ্রম ও পূর্ণ সংরক্ষণের মধ্যে কালাতিপাত করতে পারে।
ঘরের পরিবেশকে পবিত্রময় করে গড়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথম কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটির দিকে লক্ষ্য দেয়া উচিত। আল্লাহ তা’আলা নবীর বেগমদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
এবং তোমরা স্মরণ করো –স্বরণে রাখো তোমাদের ঘরে আল্লাহর যেসব আয়াত ও হিকমতের কথা তিলাওয়াত করা হয়, তা। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা’আলা সূক্ষ্মদর্শী, অনুগ্রহসম্পন্ন ও সর্ববিসয়ে অবহিত।
রাসূলের বেগমদের লক্ষ্য করে বলা এ কথা সাধারণভাবে সব মেয়ের প্রতিই প্রযোজ্য, একথা বলাই বাহুল্য। অতএব এ নির্দেশ পালিত হওয়া উচিত সব পালিত হওয়া উচিত সব মুসলিম ঘরে ও সংসারে।
‘আল্লাহর আয়াত ও হিকমত’ বলতে বোঝানো হয়েছে কুরআন মজীদ এবং রাসূলের সুন্নাত। কেননা এ দুয়ের মধ্যেই রয়েছে জীবন ও সৌভাগ্য, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শের পূর্ণ শিক্ষা। আর যা তিলাওয়াত করা হয়, মানে –এ দুটো জিনিসের শিক্ষা, প্রচার এবং আলোচনা-পর্যালোচনা হওয়া ইচত প্রত্যেকটি মুসলিমের ঘরে –ঘরের স্ত্রী পুত্র পরিজন সকলের সামনে এবং সে তিলাওয়াত জীবনে একবার কি বছরে বা নামকাওয়াস্তে হলে চলবে না। হর-হামেশা পারিবারিক কার্যসূচীর অপরিহার্য অংশ হিসেবে তা রীতিমতই হওয়া কর্তব্য। বিশেষ করে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কিত আদেশ-নিষেধ, উপদেশ-নসীহত ও বিধি-বিধান এবং রীতিনীতি তো অবশ্যই আলোচিত হতে হবে। অন্যথায় পারিবারিক জীবন আল্লাহর অনাযিল ও অফুরন্ত রহমত লাভ করতে ব্যর্থ হবে।
কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের আদেশ-উপদেশসমূহ এভাবে আলোচনা পর্যালোচনা করতে নির্দেশ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেমন তদনুযায়ী পারিবারিক জীবন চালিত হয়, পরিবারের প্রত্যেকটি নর-নারী বাস্তবভাবে পালন করে চলে আল্লাহ ও রাসূলের দেয়া বিধিব্যবস্থা। আর এ কাজ তখনি সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, যখন কুরআন ও হাদীসের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হয় পরিবারের লোকজনকে। আর কেবল শিক্ষা দিয়েই যেন ক্ষান্ত করা না হয়, বরং নিত্যনৈমিত্তিক কার্যসূচী হিসেবে তা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়।
বস্তুত ‘স্মরণ করো’ মানেই হচ্ছে আমল করো। আর আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী যে ঘরে ও পরিবারে সঠিকভাবে আমল করা হবে, তা যে বাস্তবিকই পবিত্র, নিষ্কলঙ্ক ও নির্ভেজাল প্রেম-ভালোবাসায় পূর্ণ হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না।
প্রত্যেকটি পরিবারেরই এমন এক নির্ভরযোগ্য নিজস্ব পরিমণ্ডল প্রয়োজন, যার মধ্যে কেউ অধিকার প্রবেশ করতে পারবে না। যেখানে পরিবার, পরিবারের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই নিজস্বতায় পরিপূর্ণ, পরিতৃপ্ত, সেকানে যেমন প্রত্যেকটি ব্যক্তিই পূর্ণ স্বাধীনতা ও মানসম্ভ্রমসহ দিনাতিপাত করতে পারবে, তেমনি পারবে সকলের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও নির্ভরতায় এক অখণ্ড পরিবার সংস্থা গড়ে তুলতে। এজন্যে বাইরের লোকদের যেমন বিনানুমতিতে কারো ঘরে প্রবেশ করার অধিকার দেয়া হয়নি, তেমনি একই ঘরের লোকদেরও বিশেষ কয়েকটি সময়ে একে অপরের নিজস্ব কক্ষে বিনানুমতিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমাদের ক্রীতদাস-দাসী এবং অপূর্ণ বয়স্ক ছেলেপেলেরা যেন তিনবার তোমাদের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করে তোমাদের ঘরে প্রবেশ করার জন্যে, ফযরের নামাযের পূর্বে দ্বিপ্রহরে যখন তোমরা জামা-কাপড় খুলে ফেল এবং এশার নামাযের পর। এই তিনটি সময় হচ্ছে তোমাদের জন্যে অবশ্য গোপনীয়। এ ছাড়া অন্যান্য সময় তোমাদের কাছে বিনানুমতিতে আসা-যাওয়ায় তোমাদের কোনো দোষ হবে না –তাদেরও হবে না। তোমাদের পরস্পরের কাছে তো বারবার আসা-যাওয়া করতেই হয়।
আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
এ আয়াত কয়টি হচ্ছে কাছাকাছির ও একই বাড়িতে অবস্তানরত আপন লোকদের পরস্পরের কাছে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করা সম্পর্কে।
এ আয়াত একথাও প্রমাণ করে যে, ঘরের কাজকর্ম করার জন্যে দাস-দাসী যেমন নিয়োগ করা যেতে পারে তেমনি চাকর-চাকরাণীও নিয়োক করা যায়। তবে চাকরদের অবশ্য অল্প বয়স্ক –অত্যন্ত অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা বিগত যৌবনা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এ আয়াত তিনটি সময়কে প্রত্যেকের জন্যে একান্ত নিজস্ব করে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
প্রথম হচ্ছে ফযরের নামাযের পূর্ব সময়। কেননা এ সময়টিতে মানুষ সাধারণত নিজেদের শয্যায় ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে। কে কি অবস্থায় ঘুমিয়ে রয়েছে, পূর্ণ শরীর ঢেকে রয়েছে, না উলঙ্গ অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে আছে তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। তাছাড়া একাকী এক বিছানায় শুয়ে আছে, না স্বামী-স্ত্রীতে মিলে একান্ত নিবিড় হয়ে রয়েছে, তারও কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকবার কথা নয়। কাজেই আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ হচ্ছে –এ সময় অপর কোনো লোক –সে যতই কাছের হোক না কেন; এমনকি দাস-দাসী আর অল্প বয়স্ক চাকর চাকরাণীই হোক না কেন –অনুমতি না নিয়ে ঘরে প্রবেশ করবে না। কেননা বিনানুমতিতে প্রবেশ করলে কোনো অবাঞ্চিত দৃশ্য তাদের চোখে পড়া এবং তা সকলের পক্ষে লজ্জার বা অপমানের কাণ হওয়া বিচিত্র নয়।
দ্বিতীয় হচ্ছে দ্বিপ্রহরে। যখন লোকেরা –মেয়েরা পুরুষরা –কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে পারে, স্বামীতে স্ত্রীতে মিলে একান্তে শয্যাশায়ী হতে পারে। আর সে অবস্থায় অপর কারো সামনে যেতে বা কারো চোখে পড়তে কেউই রাজি হতে পারে না। আর তৃতীয় হচ্ছে এশার নামাযের পর। কেননা এ সময় লোকেরা সারা দিনের যাবতীয় কাজকর্ম চুকিয়ে দিয়ে শয্যার ক্রোড়ে একান্তভাবে ঢলে পড়ার জন্যে প্রস্তুত হয়। কে কিভাবে শুতে যায়, একাকী এক শয্যায় শয়ন করে কি স্ত্রীকে কাছে ডেকে নেয়, তা অপর কারো জানা থাকার কথা নয়। কাজেই এ সময়ও প্রত্যেক ব্যক্তির থাকা উচিত পূর্ণ স্বাধীনতা, একান্ত নিশ্চিন্ততা ও সুগভীর নিবিড়তা। বিনানুমতিতে কারো প্রবেশ তাতে অবশ্যই ব্যাঘাত জন্মাবে। এসব কারণে আল্লাহ তা’আলা এ তিনটি সময়কে বলেছেন (আরবী*********) আর ইমাম রাগিবের ভাষায় তার মানে হচ্ছেঃ
(আরবী******************************************************************)
মানুষের লজ্জা-শরম। এ শব্দটি রূপক। এর আসল অর্থ হচ্ছে শরম লজ্জা। কেননা এ এমন ব্যাপার যা প্রকাশিত হলে লজ্জা ও অপমান দেখা দিতে পারে।
বস্তুত কুরআন নির্দেশিত এ তিনটি সময়ও এমনি, যখন আকস্মিকভাবে অপর কারো নজরে পড়লে লজ্জা বা দুর্নামের কারণ ঘটতে পারে। এ তিনটি সময় ছাড়া অন্যান্য এমন, যখন কারো পক্ষেই অসতর্ক ও অসংবৃত্ত হওয়ার সাধারণত সম্ভাবনা থাকে না, সে কারণে অন্যান্য সময়ে সাধারণত ঘরে লোকদের পরস্পরের কাছে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে অনেক কাজই সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। কেননা তারা তো (আরবী********) –তোমাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করে, কাজ করবে এজন্যেই নিয়োজিত হয়েছে। আর চাকর-বাকরদের ব্যাপারে অনেক কিছুই এমন নয়, যা বাহ্যত আপত্তিকর হলেও সেখানে আপত্তি করা চলে না। ঠিক এ কারণেই রাসূলে করীম (স) বিড়াল-বিড়ালী সম্পর্কে বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
বিড়াল-বিড়ালী নাপাক নয়, কেননা ওরা তো তোমাদের চারপাশে সব সময় ঘোরাফেরা করতেই থাকে।
এ আয়াতটি সম্পর্কে মনে রাখা দরকার যে, তা পূর্ণ মর্যাদা সহকারে বহাল এবং তার কার্যকরতা শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, লোকেরা এ আয়াত অনুযায়ী আমল করে খুবই কম। এ আয়াতটি সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা হচ্ছেন সর্বাধিক পরিমাণে গোপনতা বিধানকারী। কাজেই তিনি গোপনতা অবলম্বনকে খুবই ভালোবাসেন, পছন্দ করেন।
ইমাম সুদ্দী বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
সাহাবীদের অনেকেই এই এই সময়ে নিজেদের স্ত্রীদের সাথে যৌন মিলনে প্রবৃত্ত হওয়া পছন্দ করতেন, যেন তারপর গোসল করে তাঁরা নামাযের জন্যে চলে যেতে পারেন। এ কারণে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের এ নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন চাকর-গোলামদের এই সময়ে বিনানুমতিতে তাঁদের ঘরে প্রবেশ করতে না দেন।
নির্দিষ্ট তিনটি সময় ছাড়াও একই ঘরের নিকটাত্মীয়দের পরস্পরের শয়নকক্ষে প্রবেশ করার জন্যে অনুমতি গ্রহণ প্রয়োজন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ
(আরবী*************************************************************)
তোমাদের মা’দের কক্ষে প্রবেশ করার জন্যে পূর্বাহ্নে অনুমতি গ্রহণ তোমাদের কর্তব্য।
তাঊস তাবেয়ী বলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
কোনো মুহাররম মেয়েলোকের লজ্জাস্তান দেখা অপেক্ষা অধিক ঘৃণার ব্যাপার আমার কাছে আর কিছু নেই।
আতা ইবনে আবূ রিবাহ হযরত আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
আমার কয়েকটি ইয়াতিম বোন রয়েছে, যারা আমার কোলে লালিতা-পালিতা, আমার সাথে একই ঘরে বসবাস করে, তাদের সামনে যেতেও কি আমি পূর্বাহ্নে অনুমতি গ্রহণ করব?
হযরত ইবনে আব্বাস বললেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই অনুমতি নেবে। পরে বললেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
তুমি কি তাদরে ন্যাংটা ও উলঙ্গ দেখা পছন্দ করো?
আতা বললেনঃ না, কখনই নয়। তিনি বললেনঃ “তা হলে অবশ্যই অনুমতি গ্রহণ করবে”।
নিজ স্ত্রীর ঘরে প্রবেশের পূর্বে তার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করতে হবে কিনা –এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে আতা বলেনঃ ‘না’। কিন্তু আল্লামা কাসীর লিখেছেনঃ তার মানে স্ত্রীর ঘরে প্রবেশের পূর্বে তার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ ‘ওয়াজিব’ নয়; অন্যথায়ঃ
(আরবী***************************************************************)
ঘরে প্রবেশের পূর্বে স্ত্রীকে জানিয়ে দেয়া ভালো যে, সে তার ঘরে প্রবেশ করছে। তার সামনে হঠাৎ করে উপস্থিত হওয়া উচিত নয়। কেননা সে হয়ত এমন অবস্থায় রয়েছে, যে অবস্থায় স্বামী তাকে দেখতে পাক –তা সে আদৌ পছন্দ করে না।
আপন মা, বোন ও স্ত্রীর ঘরে প্রবেশের পূর্বে যখন অনুমতি গ্রহণ এবং প্রবেশ সম্পর্কে আগাম জানান দেয়া সম্পর্কে এত তাগিদ, তখন ভিন ও গায়র-মুহাররম মেয়েদের –তারা যত নিকটাত্মীয়া হোক না কেন –নিকট বিনানুমতিতে প্রবেশ করাকে ইসলাম কি বরদাশত করতে পারে?
এ অনুমতি নিয়ে কারো ঘরে প্রবেশ করা সম্পর্কিত নির্দেশের ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে আল্লামা যামাখশারী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
এর কারণ এই যে, অনুমতি লওয়া কেবল এ জন্যেই বিধিবদ্ধ করা হয়নি যে, কোনো সহসা অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তি কোনো গোপনীয় জিনিস দেখে ফেলতে পারে এবং হালাল নয় এমন জিনিসের ওপর তার নজর পড়ে যেতে পারে। বরং এ জন্যেই তা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, যেন বাইরে থেকে আসা কোনো ব্যক্তি ঘরের এমন সব অবস্থাও জানতে না পারে, যা মানুষ সাধারণত অপরের কাছ থেকে গোপনই রাখতে চায় এবং অপর লোক যাতে তা জানতে না পারে, তার জন্যে চেষ্টা করে। এরূপ অবস্থায় বিনানুমতিতে প্রবেশ করলে অপর লোকের কর্তৃত্বের এলাকার ওপর অনধিকার চর্চা হয়। অতএব কারো ঘরে প্রবেশ তার অনুমতি ছাড়া হওয়া উচিত নয়।
অন্যথায় তার মনে ক্রোধ প্রবল হয়ে ওঠার ও অন্যের প্রাধান্য অস্বীকার করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠবার আশংকা রয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়
পর্দার দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে ঘরের বাইরে বেরুলে বয়স্ক নারী পুরুষকে যে পর্দা ব্যবস্থা পালন করে চলতে হবে, তা-ই। এ পর্যায়ে আমাদের আলোচনার প্রথম ভিত্তি হচ্ছে প্রথম পর্যায়ে উদ্ধৃত আয়াতের দ্বিতীয় অংশ। পূর্ব আয়াতটি আবার পাঠ করতে হচ্ছে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************************************)
এবং তোমরা তোমাদের ঘরের অভ্যন্তরে মজবুত হয়ে স্থিতি গ্রহণ করো –স্থায়ীভাবে বসবাস করো এবং তোমরা প্রথম কালের জাহিলিয়াতের নারীদের মতো নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য ও যৌবনদীপ্ত দেহাঙ্গ দেখিয়ে বেড়িও না।
আয়াতের প্রথম অংশে মেয়েলোকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন নিজেদের ঘরেই স্থায়ীবাবে দৃঢ়তা সহকারে বসবাস করে। আর দ্বিতীয়াংশে বলা হয়েছে, ঘরের বাইরে গিয়ে জাহিলী যুগের নারীদের মতো লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ভিন পুরুষদের সামনে হেসে গলে ঢলে পড়ো না, নিজেদের রূপ সৌন্দর্য ও যৌবনদীপ্ত দেহের কান্তি দেখিয়ে বেড়িও না, আয়াতের প্রথমাংশ ঘর সম্পর্কে আর দ্বিতীয়াংশ ঘরের বাইরের সাথে সংশ্লিষ্ট।
আয়াতে ঘরে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়নি, নিষেধ করা হয়েছে জাহিলী যুগের নারীদের মতো নির্লজ্জভাবে চলাফেরা করতে।
এ আয়াতে মুসলিম নারীদের যে ঘর থেকে বের হতে চূড়ান্তভাবে নিষেধ করা হয়নি, তার প্রথম প্রমাণ এই যে, এই আয়াত নাযিল হওয়ার পরও মুসলিম মহিলারা ঘরের বাইরে গিয়েছেন। মসজিদে নামায পড়তে হজ্জ করার জন্যে বায়তুল্লাহ তওয়াফ করতে পিতামাতা-নিকটাত্মীয়দের সাথে দেখা করতে এবং আরো অনেক অনেক কাজে। এ আয়াতে যদি ঘরের বাইরে যেতে নিষেদই করা হতো তাহলে নিশ্চয়ই রাসূলে করীম (স) এসব কিছুতেই বরদাশ করতেন না। কিন্তু রাসূলের জীবদ্দশায়, সাহাবীদের যুগে এ কাজ যখন অবাধে সম্পন্ন হয়েছে, তখন সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, এ আয়াতে মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে যেতে সম্পূর্ণরূপে ও অকাট্যভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়নি। নিষেধ করা হয়েছে অন্য কিছু, যা শরীয়তে প্রকৃতই নিষিদ্ধ।
বরং দেখা যাচ্ছে যে, কুরআনের উপরোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী করীম (স) মুসলিম মহিলাদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
তোমাদেরকে তোমাদের প্রয়োজনের দরুন ঘরের বাইরে যেতে অনুমতি দেয়া হয়েছে।
অপর এক হাদীসে কথাটি আরো অকাট্যঃ
(আরবী*****************************************************************)
মেয়েরা ঘর থেকে বাইরে বের হবার কোনো অধিকারই রাখে না, তবে যদি কেউ খুব বেশি নিরুপায় হয়ে যায় বরং তার চাকরও না থাকে তবে সে প্রয়োজনীয় কাজের জন্যে বের হতে পারবে।
আল্লামা আলূসী এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
ঘরে অবস্থান করার নির্দেশ ও বাইরে যাওয়ার নিষেধ অকাট্য ও শর্তহীন নয়। তা যদি হতো তাহলে নবী করীম (স) এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মহিলাদের নিশ্চয়ই হজ্জ, উমরা ইত্যাদির জন্যে কখনো ঘরের বাইরে যেতে দিতেন না, যুদ্ধে জিহাদে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন না এবং বাপ-মার সাথে সাক্ষাতের জন্যে, রোগীকে দেখার জন্যে এবং নিকটাত্মীয়দের শোকে শরীক হওয়ার জন্যে কখনো বাইরে যেতে তাদের অনুমতি দিতেন না।
তাহলে এ আয়াতের সঠিক অর্থ কি হবে? আল্লামা আলূসীর ভাষায় বলা যায়ঃ
(আরবী**************************************************************)
মেয়েদেরকে ঘরে অবস্থান করতে নির্দেশ করা হয়েছে, কেননা এরই দ্বারা তাদের মর্যাদা ও বিশিষ্টতা সাধারণত মেয়েদের ওপর প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এর সঠিক অর্থ এই যে, তারা বেশির ভাগ সময় ও সাধারণত নিজেদের ঘরেই অবস্থান করবে এবং তারা খুব বেশি বাইরে গমনকারিণী, খুব বেশি লোকজনের ভীড়ে প্রবেশকারিণী এবং ঘাটে-পথে, হাটে-বাজারে, দোকানে-বিপনীতে ও লোকদের ঘরে ঘরে যাতায়াতকারিণী হবে না।
সানাউল্লাহ পনিপত্তী লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
আয়াতে ঘর থেকে বের হতে একেবারে নিষেধ করে দেয়া হয়নি –যদিও নামায, হজ্জ কিংবা অপর কোনো মানবীয় জরুরী কাজে হোক না কেন।
আয়াতে বলা হয়েছে ‘তাবাররুজ’ করো না। এ ‘তাবাররুজ’ শব্দ ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। আল্লামা জামালুদ্দীন আল-কাসেমী লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
‘তাবাররুজ’ মানে –হাস্যলাস্য ও লীলায়িত ভঙ্গীতে চলা, রূপ-সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করা, ভিন পুরুষের মনে যৌন স্পৃহা জাগিয়ে তোলা, খুব পাতলা ফিনফিনে কাপড় পরা –যা মেয়েদের শরীর আবৃত করে না, গলদেশ, কণ্ঠহার ও কানের দুল-বালার চাকচিক্য জাহির করা এবং এ ধরনেরই অন্যান্য কাজ। আয়াতে এসবকেই নিষেধ করা হয়েছে, কেননা এরই ফলে আসে নৈতিক বিপর্যয় আর মহাগুনাহের দিকে পদক্ষেপ।
মুবরাদ বলেনঃ
(আরবী*******************************************************)
মেয়েলোকের যে রূপ-সৌন্দর্য ঢেকে রাখা কর্তব্য, তাকে জাহির করাই হচ্ছে ‘তাবাররুজ’।
লাইস বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
কোনো মেয়েলোক যখন তার মুখ ও দেহের সৌন্দর্য প্রকাশ করে আর সেই সঙ্গে তার ডাগর চোখের সৌন্দর্যভরা দৃষ্টিও পড়ে, তখন বলা হয় মেয়েলোকটি ‘তাবাররুজ’ করেছে।
আবূ উবায়দা বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
মেয়েরা যখন তাদের দেহের এমন সৌন্দর্য লোকদের সামনে প্রকাশ করে, যা পুরুষদের যৌন স্পৃহা উত্তেজিত করে তুলে, তখন তারা ‘তাবাররুজ’ করে।
মুবরাদ আরো বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
জাহিলিয়াতের যুগে মেয়েরা স্বামী ও প্রণয়ী যুগপতভাবে গ্রহণ করত। স্বামীর জন্যে তার দেহের নিম্নার্ধ নির্দিষ্ট রাখত, আর ঊর্ধ্বাংশ ছেড়ে দিত পুরুষ বন্ধু ও প্রণয়ীর ব্যবহারে। তারা স্পর্শ, চুম্বন ও লেহন দিয়ে তাকে ভোগ করত।
আল্লামা শাওকানীও এ কথাই লিখেছেনঃ
জাহিলিয়াতের যুগে মেয়েরা তাদের দেহের অশ্লীল অঙ্গসমূহ উন্মুক্ত ও অনাবৃত করে চলত। এমনকি এক-একজন মেয়েলোক তার স্বামী ও প্রণয়ীকে নিয়ে একসঙ্গে বসত। প্রণয়ী তার বস্ত্রের উপরিভাগ নিয়ে সুখ ভোগ করত আর স্বামী পরিতৃপ্ত হত তার দেহের বস্ত্রাবৃত নিম্নভাগ ব্যবহার করে। আবার কখনো সখনো একজন অপর জনের কাছ থেকে তার জন্যে নির্দিষ্ট অংশ অদল-বদল করে নিতেও চাইত।
এ সব উদ্ধৃতি থেকে জাহিলিয়াতের নারী চরিত্র ও তদানীন্তন সমাজের বাস্তব ও প্রকৃত চিত্র উদঘাটিত ও উদভাসিত হয়ে উঠেছে। মেয়েরা ঘর থেকে বেরুতে পারে, আয়াতে তা নিষেধ করা হয়নি, নিষেধ করা হয়েছে বাইরে গিয়ে এসব কাজ করতে, যা উপরের উদ্ধৃতিসমূহ থেকে প্রতিভাত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ-ই হচ্ছে জাহিলিয়াত –জাহিলিয়াতের ‘তাবাররুজ’ –যার সাথে এ যুগের সভ্যতা-সংস্কৃতিসম্পন্ন নারী সমাজের পূর্ণ মিল ও সাদৃশ্য স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে হাটে-বাজারে, দোকানে-বিপণীতে, পথে-পার্কে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় ও ক্লাবে-মিটিং-এ। আর কুরআন মজীদে উপরোক্ত আয়াতাংশে এ সব কাজকেই নিষেধ করা হয়েছে, চিরতরে হারাম করে দেয়া হয়েছে।
ঘরের বাইরে পর্দা
উপরে আমরা এ কথা প্রমাণিত করেছি যে, মেয়েদের যে একান্তভাবে ঘরের অভ্যন্তরেই বসে থাকতে হবে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা, সারা মাস বছর, সমগ্র জীবন, আর ঘর থেকে তারা আদৌ বাইরে বেরুতেই পারবে না, নিতান্ত প্রয়োজনেও নয়, এমন কথা কুরআন মজীদে বলা হয়নি, রাসূলে করীম (স) বলেন নি। সাহাবী, তাবেয়ীন ও পরবর্তীকালের মুজতাহিদীন –কেউই সে মত প্রকাশ করেননি। তাঁরা সকলেই কুরআন থেকে একথাই বুঝেছেন যে, মেয়েদের ঘর থেকে বাইরে যেতে নিষেধ নেই। তবে নিষেধ হচ্ছে বাইরে গিয়ে তাদের পর্দা নষ্ট করা, রূপ-সৌন্দর্য প্রদর্শন এবং পুরুষদের মনে নিদ্রাতুর যৌন পশুকে প্রচণ্ড হুংকারে ক্ষিপ্ত করে দেয়া। এ না করলে তাদের বাইরে যেতে –প্রয়োজন মতো ঘর থেকে বের হতে, এমনকি দোকানে-বাজারে যেতে, রাস্তাঘাটে চলতে কোনোই দোষ নেই। তবে শর্ত এই যে, তা অবশ্যই বিনা কারণে আর বিনা প্রয়োজনে হবেনা; শুধু ঘুরেফিরে হাওয়া খেয়ে গাল-গল্প বেড়ানোর উদ্দেশ্যে হবে না।
প্রয়োজনে আর জরুরী কাজে ঘর থেকে বেরুতে হলে মেয়েদের সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে তার সর্বাঙ্গ পূর্ণ মাত্রায় আবৃত করা। কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াতে ঘরের বাইরে মেয়েদের অবশ্য পালনীয় হিসেবে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************************)
হে নবী, তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুসলিম মেয়েলোকদের বলো, তারা যেন সকলেই ঘরের বাইরে বের হওয়াকালে তাদের মাথার ওপর তাদের চাদর ঝুলিয়ে দেয়। এভাবে বের হলে তাদরে চিনে নেয়া খুব সহজ হবে। ফলে তাদের কেউ জ্বালাতন করবে না। আল্লাহ প্রকৃতই বড় ক্ষমাশীল, দয়াবান।
আয়াতে উদ্ধৃত শব্দ (আরবী*******) বহু বচন। এক বচনে (আরবী*****) ‘জিলবাব’ বলা হয়ঃ
(আরবী***********************************************)
যে কাপড় দিয়ে সমস্ত শরীর ঢাকা হয়।
আল্লামা রাগিব ইসফাহানী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************)
জিলবাব হচ্ছে কোর্তা ও ওড়না –যা দিয়ে শরীর ও মাথা আবৃত করা হয়।
ইবনে মাসউদ, উবাদাহ, কাতাদাহ, হাসান বসরী, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, ইবরাহীম নখয়ী, আতা প্রমুখ বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
ওড়নার উপরে যে চাদর পরা হয়, তাই ‘জিলবাব’।
হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
যে কাপড় উপর থেকে নিচের দিকে পরে সমস্ত আবৃত করা হয়, তাই জিলবাব।
ইবনে জুবাইর বলেছেনঃ (আরবী*******) ‘বোরকা’, কেউ বলেছেনঃ (আরবী******) চাদর, যা সমস্ত দেহ পেচিয়ে পরা হয়।
আল্লামা যামাখশারী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
‘জিলবাব’ হচ্ছে একটি প্রশস্ত কাপড় –তা উড়না-দোপাট্টা থেকেও প্রশস্ত অথচ চাদরের তুলনায় ছোট। মেয়েরা তা মাথার উপর দিয়ে পরে, আর তা ঝুলিয়ে দেয়, তার দ্বারা বক্ষদেশ আবৃত রাখে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
জিলবাব হচ্ছে এমন চাদর, যা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ঢেকে দেয়।
মুফাসসিরদের মতেঃ
(আরবী******************************************************************************)
মেয়েরা পরিধেয় কাপড়ের উপরে যা পরে তাই জিলবাব। এক কথায় এ কালের ‘বোরকা’।
হযরত ইবনে আব্বাস এ আয়াত সম্পর্কে বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
আল্লাহ তা’আলা মু’মিন মেয়েলোকদের নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যখন তাদের ঘর থেকে বের হবে, তখন তাদের মাথার উপর দিয়ে চাদর দ্বারা মুখমণ্ডলকে ঢেকে নেবে এবং একটি মাত্র চোখ খোলা রাখবে –এ অত্যন্ত জরুরী।
অপর এক বর্ণণা মতে ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদ বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************)
স্বাধীনা –ক্রীতদাসী নয় –এমন মেয়েলোক যখন ঘর থেকে বাইরে যাবে, তখন তাদের মুখমণ্ডল ও মাথা আবৃত করে নেবে।
আল্লামা আবূ বকর আল-জাসসাস আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
এ আয়াত বলে দিচ্ছে যে, যুবতী মেয়েদেরকে ভিন পুরুষ থেকে নিজেদের মুখমণ্ডলকে ঢেকে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস ও আবূ উবায়দা বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
মু’মিন মেয়েদের আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন তাদের মুখমণ্ডল ও মাথা পূর্ণ মাত্রায় ঢেকে রাখে, তবে একটি মাত্র চোখ খোলা রাখতে পারে। এ থেকে জানা যাবে যে, তারা স্বাধীন মহিলা-ক্রীতদাসী নয়।
ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
মেয়েরা তাদের মুখমণ্ডলকে এমনভাবে ঢাকবে যে, বাম চক্ষু ছাড়া তাদের শরীরের অপর কোনো অংশ দেখা যাবে না।
অন্য আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************************************************)
এবং মেয়েরা তাদের অলংকার ভিন পুরুষের সামনে প্রকাশ করবে না, তবে যা আপনা থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তা প্রকাশ হতে দিতে নিষেধ নেই এবং তাদের বক্ষদেশের উপর উড়না-দোপাট্টা ফেলে রাখবে।
এ আয়াতের তরজমা ইমাম ইবনে কাসীর লিখেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
(আরবী********************************************************************)
অর্থাৎ মেয়েরা তাদের অলংকারাদি ভিন পুরুষদের সামনে প্রকাশ করবে না, তবে যা লুকানো সম্ভব হবে না তার কথা ভিন্ন।
জীনাত কি, কাকে বলে? ইমাম কুরতুবী ও আললামা ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ
জীনাত দুরকমের। একটি হচ্ছে সৃষ্টিগত আর অপরটি উপার্জনগত। সৃষ্টিগত সৌন্দর্য বলতে বোঝায় মুখমণ্ডল চেহারা (Anearance)। কেননা তাই হচ্ছে সমস্ত রূপ ও সৃষ্টিগত সৌন্দর্যের মূল উৎস কেন্দ্র। নারী জীবনের মাহাত্ম, মাধুর্য এখানেই নিহিত। আর দ্বিতীয় হচ্ছে উপার্জিত সৌন্দর্য।
(আরবী**********************************************************************)
যা মেয়েরা তাদের সৃষ্টিগত রূপ-সৌন্দর্যকে অধিকতর সুন্দর করে তোলবার জন্যে কৃত্রিমভাবে গ্রহণ করে, যেমন কাপড়, অলংকারাদি, সুরমা মাখা চোখ, রং, খেজাব, মেহেন্দি।
এ দু’রকমের জিনাতকেই বাইরের লোক –ভিন পুরুষদের সামনে প্রকাশ করতে আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। অতঃপর বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************) ‘তবে যা’ আপনা থেকে প্রকাশিত হয়। ইমাম ইবনে কাসীরের তরজমা অনুযায়ী ‘যা লুকানো সম্ভব হয় না’ –যা জাহির হতে না দিয়ে পারা যায় না, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কি?
ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ প্রথমে যা প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং পরে যা প্রকাশ হতে না দিয়ে পারা যায় না বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এ দুটো এক জিনিস নয়। দুটো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জিনিস হতে হবে, তাহলে পরবর্তী জীনাত কি, যা জাহির না করে পারা যায় না, যা গোপন রাখা সম্ভব হয় না। এ সম্পর্কে তিনটি মত রয়েছে।
এক –তা হচ্ছে কাপড়। কেননা মেয়েরা বোরকা পরেও বাইরে বের হলে অন্তত তার বোরকার বাইরের দিকটি লোকদের সামনে প্রকাশমান হবেই; তা তো আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
দুই –সুরমা ও অঙ্গুরীয়। এ হচ্ছে ইবনে আনাসের মত।
তিন –মুখমণ্ডল ও দুই হস্ত।
ইবনুল আরাবী বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মত আসলে একই। কেননা সুরমা মুখের দিকে ব্যবহার হয়, আর অঙ্গুরীয় ব্যবহার করা হয় হাতের দিকে –আঙ্গুলে।
যাঁদের মতে মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় প্রকাশ নিষেধের আওতার মধ্যে গণ্য নয়, বরং এ দুটো ভিন পুরুষের সামনে প্রকাশ করা যায় বলে মনে করেন, তাঁরাও সুরমা মাখা চোখ মুখ আর অঙ্গুরীয় পরা হাত ভিন পুরুষের সামনে জাহির করা জায়েয মনে করেন না। যে মুখে ও হাতে তা না থাকবে, তাই শুধু বের করা চলবে। যদি সুরমা ও অঙ্গুরীয় ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা অবশ্যই ভিন পুরুষের দৃষ্টি থেকে লুকোতে হবে। তখন তা প্রথম পর্যায়ের অলংকারের মধ্যে গণ্য হবে, তা লুকানো ওয়াজিব।
আর ভেতর দিকের জীনাত হচ্ছে কানবালা, কণ্ঠহার, বাজুবন্দ আর পায়ের মল ইত্যাদি। ইমাম মালিকের মতে মুখ চুলের রং বাইরের দিকে ‘জীনাত’ নয়, হাতের চুড়ি-বালা ইত্যাদি সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা) বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
তা বাহ্যিক জীনাতের মধ্যে গণ্য, কেননা তা দুই হাতে পড়া হয়।
আর মুজাহিদ বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
তা লুকিয়ে রাখার মতো ভেতর দিকের জীনাত। কেননা, তা কব্জাদ্বয়ের বাইরের জীনাত।
আর রং যদি পায়ে লাগানো হয়, তবে তা অবশ্যই গোপনীয় জীনাতের মধ্যে গণ্য হবে। অতএব রং –আলতা পরা পা ভিন পুরুষকে দেখানো যাবে না।
মনে রাখা আবশ্যক যে, এখানে এসব জীনাত ভিন পুরুষদের সামনে প্রকাশ করতে নিষেধ করার মানে কেবল জীনাত না দেখানোই নয়, বরং এ সব জীনাত যেসব অঙ্গে –দেহের যে সব জায়গায় –পরা হয়, তাও ভিন পুরষের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লামা কাসেমী লিখেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
আয়াতে কেবল জীনাতের (অলংকার) উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন অঙ্গে তা পরা হয় তার উল্লেখ করা হয়নি, গোপনীয়তা ও সংরক্ষণের অধিক প্রয়োজনীয়তা বোঝাবার জন্যে মাত্র। কেননা এ অলংকারগুলো দেহের এমন সব অঙ্গে পরা হয়, যার দিকে কেবল মুহাররম পুরুষ ছাড়া আর কারো তাকানো হালাল নয়।
তার মানে এই যে, এসব অলংকারের দিকেই যখন ভিন পুরুষের নজর পড়া –নজর পড়তে দেয়া নিষেধ, তখন তা যেসব অঙ্গে পরা হয়েছে, তার দিকে তাকানো বা তাকানোর সুযোগ দেয়া আরো বেশি নিষিদ্ধ হবে।
আল্লামা সানাউল্লাহ পানিপত্তী লিখেছেনঃ
(আরবী****************************************************************);
কোন স্বাধীন –ক্রীতদাসী নয় –এমন মহিলার পক্ষে নিজ স্বামী ও মুহাররম পুরুষ ছাড়া অন্য কারো সামনে তার মুখমণ্ডল প্রকাশ করা আদৌ জায়েয নয়। কেননা নারীর সাধারণ ও আসল সৌন্দর্যই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে তার মুখমণ্ডলে। এ কারণে একজন নারীর দেহ অপেক্ষা মুখমণ্ডল দেখায় নৈতিক বিপদ ঘটার সর্বাধিক আশংকা বিদ্যমান।
নবী করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণী থেকেও তাই প্রমাণিত হয়। বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
নারীর আপাদমস্তক –পূর্ণাবয়বই হচ্ছে গোপন করার জিনিস। এ কারনে সে যখন ঘরের বাইরে যায়, তখন শয়তান তার সঙ্গী হয়ে পিছু লয়।
এ হাদীসের ভিত্তিতে পানিপত্তী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
এ হাদীস থেকে প্রমাণ করছে যে, নারীর সমগ্র শরীরই হচ্ছে গোপন রাখার বস্তু। তবে নিতান্ত প্রয়োজনের সময় তা প্রযোজ্য নয়। এ ব্যাপারে সকল ইসলামবিদ সম্পূর্ণ একমত।
সে প্রয়োজন কি হতে পারে, যখন নারীর কোনো না কোনো সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়। এ সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা যেতে পারে। যেমন কোনো যুবতী নারীর এমন কোনো পুরুষ নেই, যে তার হাট-বাজারের প্রয়োজন পূরণ করে দিতে পারে, জরুরী জিনিস ঘরে এনে দিতে পারে। তখন সে বোরকা পরে শুধু পথ দেখার কাজ চলে চোখের জায়গায় এমন ফাঁক রেখে ঘরের বাইরে যাবে এবং প্রয়োজনীয় জায়গায় গিয়ে দরকারী জিনিসপত্র খরিদ করে ফিরে আসবে। যদি তার বোরকা না থাকে, না থাকে তা যোগার করার সামর্থ্য, তাহলে সে যে কোনো একখানা কাপড় দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পূর্ণাবয়ব আবৃত করে নিয়ে বের হবে।
এছাড়া দুটো ক্ষেত্র আছে, যখন ভিন পুরুষের সামনে মুখমণ্ডল কিংবা দেহের কোনো না কোনো অঙ্গ প্রকাশ করতে হয়, যেমন ডাক্তার-চিকিৎসকের সামনে অথবা আদালতে উপস্থিত হয়ে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো বিষয়ে জবানবন্দী বা সাক্ষ্য দেয়ার সময়ে। তখন মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করাসর্ববাদী সম্মতভাবে জায়েয।
তাহলে আল্লাহর বাণী –‘তবে যা আপনা থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে’ কথাটির দুটো অর্থ দাঁড়াল। একটি এই যে, নারীর দেহের পূর্ণাবয়ব পর্দা, অতএব তা ভালো করে আবৃত করেইঘরের বাইরে বের হবে। তখন সে বোরকা বা যে চাদর –কাপড় দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা হলো, তার বাইরের দিক ভিন পুরুষ দেখলে কোনো দোষ হবে না। কেননা তা লুকানো তো আর সম্ভব নয়। এখন তা দেখেও যদি কোনো পুরুষ কাবু হয়ে পড়ে, তবে তাকে ‘পুরুষ’ মনে করাই বাতুলতা। অন্তত তাতে নারীর কোনো ক্ষতি নেই,তার কোনো গুনাহ হবে না।
আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, দেহের যে অঙ্গ প্রকাশ না করে পারা যায় না, যা লুকিয়ে রাখার উপায় নেই –বিশেষ প্রয়োজনের দৃষ্টিতে, যেমন ডাক্তারের কাছে দেহের বিশেষ কোনো রোগাক্রান্ত অঙ্গ প্রকাশ করা, ইনজেকশন দেয়া, অপারেশন করা কিংবা রোগ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে তা দেখানো কোনোদোষ নেই, সে নির্দিষ্ট স্থান এবং নির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণের সীমা পর্যন্ত –তার বাইরে নয়। অথবা যেমন সাক্ষ্য দেয়া বা জবানবন্দী শোনানোর জন্যে বিচারকের কাছে মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ দুটো কথাই আল্লাহর বাণী (আরবী****) ‘তবে যা জাহির হয়ে পড়া’র মধ্যে শামিল এবং তা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ জায়েয। আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
মেয়েলোক কোন সৌন্দর্যই প্রকাশ করবে না। তার সৌন্দর্যের সব জিনিসই আবৃত করে রাখবে। প্রয়োজনের কারণে যা প্রকাশ না করে পারা যায় না, তা-ই বাদ পড়বে।
বলা বাহুল্য, এসব আলোচনাই স্বাধীনা রমনী সম্পর্কে, ক্রীতদাসীদের সম্পর্কে নয় এবং নয় বৃদ্ধা, বিগতা যৌবনা নারীদের সম্পর্কে। কুরআন মজীদেই বলা হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************************)
যেসব মেয়েলোক ঋতুশ্রাব ও সন্তান প্রসব থেকে চূড়ান্ত অবসর গ্রহণ করেছে, যারা বিয়ের বা স্বামী সহবাসের কোনো আশা পোষণ করে না, তাদের দেহাবরণ পরিত্যাগ করলে তাতে কোনো গুনাহ হবে না। তবে সে অবস্থায়ও তাদের সৌন্দর্য আর অলংকার প্রদর্শন করে বেড়ানো চলবে না। আর তারা যদি তা থেকেও পবিত্রতা অবলম্বন করে ও তা পরিহার না করে, তবে তা তাদের পক্ষে কল্যাণকর, মঙ্গলজনক। আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন।
আল্লামা আলূসীর মতে এরা হচ্ছে (আরবী******) বৃদ্ধা। আর বৃদ্ধাদের অধিক উপবেশনকারী বলাহয়েছে এ কারণে যেঃ
(আরবী*************************************************************)
কেননা তারা বার্ধক্যের কারণে বেশি সময় বসেই কাটায়।
রবী’আ বলেছেনঃ
(আবরী****************************************)
যে সব বৃদ্ধা, যাদের দেখলে পুরুষেরা ঘৃণা বোধ করে, তাদের জন্যে এ হুকুম। যাদের রূপ-সৌন্দর্য অধিক বয়স্কা হওয়া সত্ত্বেও অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের জন্যে এ আয়াত প্রযোজ্য।
আল্লামা পানিপত্তী লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
বৃদ্ধাদের বাইরের আচ্ছাদন পরিহার করার ব্যাপারে পুরুষদের সৌন্দর্য দেখাবার ইচ্ছা না হওয়াকে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা থেকে বোঝা গেল যে, যে বৃদ্ধা সৌন্দর্য প্রদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করে, তার পক্ষে বাইরের আচ্ছঅদন পরিহার করা হারাম।
পর্দার নির্দেশ নাযিল হওয়ার উপলক্ষ হিসেবে মুজাহিদ সূত্রে নিম্নোক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ একবার নবী করীম (স) খাবার খাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে শরীক ছিল কিছু সংখ্যক সাহাবী। হযরত আয়েশা (রা)-ও তাঁদের সঙ্গে খাবার খাচ্ছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তির হাত হযরত আয়েশার হাতে লেগে যায় এবং নবী করীম (স)-এর কাছে ব্যাপারটি খুবই খারাপ বিবেচিত হয়। এর পরই পর্দার আয়াত নাযিল হয়। (আরবী**********************************)
পর্দার এ নির্দেশ মেয়েলোক ও পুরুষ লোকের মাঝখানে এক স্থায়ী অন্তরাল দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ অন্তরাল ভাঙ্গতে পারা যায় প্রথমে মুহাররম সম্পর্কের দরুন আর দ্বিতীয় বিয়ের সম্বন্ধের দ্বারা। অন্যথায় এ অন্তরাল অন্য কোনভাবে ভঙ্গ করা শুধু ইসলামী শরীয়তের বিধানই নয়, মানব-মানবীর স্বভাব-প্রকৃতির ওপরও একান্তই অন্যায়-অনাচার বটে। ঘরের বাইরে পূর্ণাবয়ব আচ্ছাদিত করে বের হওয়ার সংক্রান্ত উক্ত আয়াত ও আহকাম নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল –আরবের অবাধ নীতিতে চলতে অভ্যস্ত মেয়েরা ঘর থেকে বের হতে গিয়ে তাদের মাথার উপর কালো চাদর ফেলে তা দিয়ে সমস্ত মাথা, মুখমণ্ডল ও সমগ্র শরীর পূর্ণমাত্রায় আবৃত করে নিতে শুরু করে দিয়েছে। নারী সমাজে এক আদর্শিক বিপ্লবের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল। উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ আর রূপ-যৌবন প্রকাশকারী পোশাক সাধারণভাবে বর্জিত হলো, কোনো মেয়েই তা পরে ঘরের বাইরে যেতে রাজি হচ্ছিল না। উচ্ছৃঙ্খলতা ও নির্লজ্জলতা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হলো। এ আয়াত অনুযায়ী সে কালে মেয়েদের আদত ছিল একটা বড় আকারের চাদর দিয়ে মাথা, মুখমণ্ডল ও সমস্ত দেহাবয়ব আবৃত করা। বলা যায়, এ চাদরই ক্রমবিবর্তনের ধারায় বর্তমান সভ্যতায় এসে বোরকা’র রূপ পরিগ্রহ করেছে। অতএব একালে কুরআনের এ নির্দেশ পালনের জন্যে মুসলিম মেয়েদেরকে বোরকা পরেই ঘর থেকে বের হতে হবে। অনাগত ভবিষ্যতে ক্রমবিবর্তনের পরবর্তী কোন স্তরে পৌঁছে বোরকা যদি এমন কোনো রূপান্তর গ্রহণ করে যা দিয়ে আরো উন্নত ও সুন্দরভাবে মাথা, মুখমণ্ডল ও সমগ্র দেহ আচ্ছাদিত করা যেতে পারে তবে তাইহ বে সে সমাজের জিলবাব এবং তা পরেই কুরআনের এ আয়াত অনুযায়ী মেয়েদেরকে প্রয়োজনে বাইরে যেতে হবে। এক কথায়, বিগতা যৌবনা নয় –এমন সব মুসলিম মেয়েকেই সব সমাজে, সব দেশে, সব রকমের আবহাওয়ায় এবং ইতিহাসের সব পর্যায় ও স্তরেই মাথা, মুখমণ্ডল ও সমগ্র দেহাবয়ব আবৃত করা না হলে মুসলিম মহিলা বলে অভিহিত হওয়ার কোনো অধিকারই তার থাকবে না এ আয়াত অনুযায়ী।
বস্তুত যেসব মেয়ে বোরকা পরে সমস্ত শরীর, মুখ ও মাথা আবৃত করে ঘর থেকে বের হয়, তাদের দেখলে বুঝতে পারা যায় যে, এরা পর্দানশীল মহিলা। দুষ্ট চরিত্রের বখাটে চরিত্রের লোকেরা তাদেরকে চরিত্রবতী ও সতীত্বসম্পন্না মেয়ে মনে করে তাদের সম্পর্কে নৈরাশ্য পোষণ করতে বাধ্য হয়। ফলে কেউ তাদের পছু নেবে না, তাদের আকৃষ্ট করার জন্যে কিংবা নিজেদেরকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলবার জন্যে চেষ্টাও করবে না।
আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী***********************************) –অংশে একথাই বলে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু যারা উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে বোরকা ছাড়াই নিজেদের মাথা, গলা, বুক ও বাহুযুগল উন্মুক্ত রেখেই রাস্তা-ঘাটে, দোকানে, পার্কে- হোটেল-রেস্তোরাঁয় চলাফেরা করে, তাদের সম্পর্কে দুষ্ট লোকদের মনে এর বিপরীত ধারণা জাগ্রত হবে। তারা এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে আলাপ পরিচয় করবে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করবে, নিজেদেরকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলবে এবং তাদের সাথে অবাধ ও অবৈধ প্রণয় চর্চা করতে চেষ্টা করবে নিরতিশয় আগ্রহ সহকারে। কেননা তাদের উক্তরূপ অবস্থায় রাস্তায় বের হওয়ার মানেই হচ্ছে তারা অপর যে কোনো পুরুষের কাছে ধরা দিতে কিছুমাত্র অরাজি নয়। অন্তত কেউ যদি তাদের পেতে চায়, তবে তারা কিছুমাত্র আপত্তি জানাবে না। বরং স্পষ্ট মনে হয়, তারা তাদের রূপ-যৌবনের মধুকেন্দ্রের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দুনিয়ার সব মধু মস্ফিকাকে। উলঙ্গভাবে চলাফেরাকারী মেয়েদের শতকরা আশিভাগের অবস্থাই যে এমনি, তা আজকের কোনো সমাজচরিত্রবিদই অস্বীকার করতে পারবে না। সমাজবিদ আবূ হায়ান একথাই বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
কেননা পূর্ণমাত্রায় পর্দা ও শালীনতা রক্ষাকারী মেয়েলোক দেখলে তার দিকে কেউই অগ্রসর হতে সাহস পাবে না। কিন্তু উলঙ্গভাবে চলা-চলকারী মেয়েদের কথা আলাদা। কেননা তাদের প্রতি তো লোকেরা বড়ই আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, হাজার দু’হাজার, কি ছ’হাজার বছর আগেকার জাহিলিয়াতে এবং এ যুগের অত্যাধুনিক (Ultra modern) জাহিলিয়াতে একাকার হয়ে একই খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। এ দুয়ের মাঝে মৌলিক কোনোই পার্থক্য নেই, না স্বভাব-প্রকৃতি, না বাহ্যিক প্রকাশে, অনুষ্ঠানে। আসল কথাও তাই। জাহিলিয়াতের সে যুগে আর এ যুগে যেমন কোনোই তারতম্য নেই, ইসলামেও নেই তেমনি পার্থক্য সেকালে ও একালে। অন্য কথায় ইসলামও পুরাতন, যত পুরাতন মানবতা। আধুনিক জাহিলিয়াতও তেমনি পুরাতন, যত পুরাতন শয়তানের ইবলিশী ভূমিকা। কাজেই যারা উলঙ্গভাবে যত্রতত্র চলাফেরা –অবাধ মেলা-মেশা ও যুব সম্মেলন করে ছেলে-মেয়েদের ফষ্টি-নষ্টির অবাধ সুযোগ করে দেয়া অত্যাধুনিক সভ্যতার অবদান বলে মনে করে, আর মনে মনে গৌরব বোধ করেঃ আমরা আর সেকেলে নই, মধ্যুগের ঘুণেধরা সংস্কৃতি (?) মেনে আমরা চলছি না, আমরা একান্তই আধুনিক-আধুনিকা –তারা যে কতখানি বোকা, নির্বোধ ও স্থূল জ্ঞানসম্পন্ন ও সূক্ষ্ম জ্ঞান বঞ্চিত তা জাহিলিয়াতের ইতিহাসই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। তারা অজ্ঞানতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে মোটেই বুঝতে পারছে না যে, তারা যা কিছু করছে, তার কোনোটাই নতুন নয়, নয় আনকোরা এবং এসব করে তারা মোটেই আধুনিক হওয়ার প্রমাণ দিতে পারছে না,বরং তারাও যে পুরাতন –অতি পুরাতন –ঘুণে ধরা সংস্কৃতিরই অন্ধ অনুসারী, এতটুকু বুঝবার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে পাশ্চাত্য নগ্নতার প্রতি আকর্ষণ ও ইষলামের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষ পোষনের কারণেই মাত্র –এতে কোনো সন্দেহ নেই।
নামাযের জন্যে মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া
পূর্বেই আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মেয়েদের আসল স্থানই হচ্ছে তার ঘর। এমন কি নামাযের জন্যে তাদের বাইরে যাওয়াও দরকারী নয়, পছন্দনীয় নয়। তবে ঘরের মধ্যে অবরোধবাসীনী হয়ে থাকাও ইসলামের কোনো বিধান নয়। প্রয়োজন হলে, নিরুপায় হলে তারা অবশ্য ঘরের বাইরে যেতে পারে, কিন্তু যেতে হবে পূর্ণাবয়ব আবৃত করে, পুরামাত্রায় পর্দা রক্ষা করে। এখন প্রশ্ন এই, নামাযও তেমন কোনো প্রয়োজন কিনা, যার জন্যে ঘর থেকে মসজিদে কিংবা ময়দানে যাওয়া যেতে পারে। এ সম্পর্কে সম্যক আলোচনা আমরা এখানে পেশ করতে চাই।
মেয়েদের মসজিদে যাওয়া সম্পর্কে তিন ধরনের হাদীস একই সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে। এক ধরনের হাদীসে মেয়েদের মসজিদে যেতে নিষেধ না করতে আদেশ করা হয়েছে। তার মানে সে হাদীসসমূহ মসজিদে মেয়েদের যাওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট অনুমতি রয়েছে। যেমন নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
তোমরা আল্লাহর বাঁদীদের আল্লাহর মসজিদে যেতে নিষেধ করো না।
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ আল্লাহর বাঁদীদেরকে মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে নিষেধ করো না।
হযরত ইবনে উমর থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************)
কোনো ব্যক্তিই যেন তার পরিবার-পরিজনকে মসজিদে যেতে কখনোই নিষেধ না করে।
তখন আবদুল্লাহ ইবনে উমরের বিলাল নামক এক পুত্র বলে উঠলঃ আমরা তো নিষেধ করবই। তখন ইবনে উমর বললেনঃ
আমি তো তোমাকে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস শোনাচ্ছি, আর তার মুকাবিলায় তুমি এ ধলনের কথাবার্তা বলছ?
(আরবী*************************************************************)
হাদীস বর্ণনাকারী বলেন যে, এ ঘটনার পর হযরত ইবনে উমর তাঁর এ পুত্রের সাথে মৃত্যু পর্যন্ত আর কথা বলেন নি।
এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
মেয়েরা মসজিদে যাওয়ার জন্যে তোমাদের কাছে অনুমতি চাইলে তোমরা তাদেরকে মসজিদে যাওয়ার অধিকার ভোগ তেকে নিষেধ করো না।
হাদীসের ভাষা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মেয়েদের মসজিদে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর সে যাওয়ার অধিকার তারা ভোগ ও ব্যবহার করতে চাইলে তা থেকে তাদের বঞ্চিত রাখার অধিকার কারোরই নেই।
বুখারী উদ্ধৃত এক হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, বিশেষ করে রাতের বেলা যদি মেয়েরা মসজিদে যেতে চায়, তাহরে তাদের নিষেধ করা নিষেধ।
নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
তোমাদের মেয়েরা যতি রাতের বেলা মসজিদে যাওয়ার জন্যে তোমাদের কাছে অনুমতি চায়, তবে অনুমতি দাও।
অনুমতি চাইলে অনুমতি দিতে নবী করীম (স) নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলে করীম (স)-এর এ নির্দেশ কি অবশ্য পালনীয় –অথবা পালনীয় নয়? দ্বিতীয়ত প্রথম দিকে উল্লিখিত হাদীসসমূহে রাতের বেলার কোনো উল্লেখ নেই, কিন্তু বুখারী উদ্ধৃত এ হাদীসে রাতের বেলার শর্ত রয়েছে। তার মানে, রাতের বেলা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তখন মেয়েদেরকে বিশেষভাবে এ অনুমতি দিতে স্বামী বা ঘরের মুরব্বী অবশ্যই বাধা হবে।
দ্বিতীয় ধরনের হাদীস থেকে জানা যায় যে, সুগন্ধি ব্যবহার করে মেয়েদের মসজিদে যেতে স্পষ্ট নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************)
কোনো মেয়েলোক সুগন্ধি ব্যবহার করে মসজিদে গেলে আল্লাহ তার নামায কবুল করবেন না, যতক্ষণ সে ফরয গোসলের মতো গোসল করে সেই সুগন্ধি দূর করে নামাযে না দাঁড়াবে অর্থাৎ সুগন্ধি লাগিয়ে মসজিদে গেলেও নামায পড়লে সেই নামায আল্লাহর দরবারে কখনো কবুল হবে না।
এক হাদীসে মহিলাদের লক্ষ্য করে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************)
তোমাদের কেউ যখন এশার নামাযের জন্যে ঘর থেকে বের হবে, তখন সুগন্ধি স্পর্শ পর্যন্ত করবে না।
আর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************************)
আকর্ষণীয় সুগন্ধি না দিয়ে যেন মেয়েরা ঘরের বাইরে যায়।
আর তৃতীয় ধরনের হাদীসে মেয়েদের নামাযের জন্যে মসজিদ অপেক্ষা তাদের ঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন কুঠরীই অধিক ভালো বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যার দুটি হাদীস উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
এ সব ধরনের হাদীস সামনে রেখে মেয়েদের নামাযের জন্যে মসজিদে গমন সম্পর্কে শরীয়তের লক্ষ্য জানবার জন্যে মুহাদ্দিস ও ইসলামী মনীষীবৃন্দ চেষ্টা-গবেষণা চালিয়েছেন। তাঁদের গবেষণার সারাংশ এখানে উদ্ধৃত করা যাচ্ছে।
প্রখ্যাত ‘হিদায়া’ গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
(আরবী******************************************************)
নামাযের বিভিন্ন জামা’আতে মেয়েলোকদের শরীক হওয়া ‘মাকরূহ’।
কোন মেয়ের শরীক হওয়া মাকরূহ? এ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকারগণ বলেছেন, যুবতী মেয়েদের পক্ষে শরীক হওয়া মাকরূহ। আর ‘নামাযের জামা’আত’ বলতে জুম’আ, ঈদ, সূর্যগ্রহণ, ইস্তিসকা, পানির জন্য প্রার্থনা প্রভৃতি নামাযে যেসব প্রকাশ্য জামা’আত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, তা সবই এর মধ্যে শামিল। ইমাম শাফেয়ীর মত হচ্ছেঃ
(আরবী******************************************************)
নামাযের জন্যে মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়া মুবাহ।
হানাফী মাযহাবের মনীষীদের দৃষ্টিতে তা জায়েয নয়। তার কারণ দর্শাতে গিয়ে তাঁরা বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
কেননা মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়াই হচ্ছে নৈতিক বিপদের কারণ, আর তাই হচ্ছে হারাম কাজের নিমিত্ত। আর যাই হারাম কাজ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়, তাই হারাম।
এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বলা যায়, যারা এ কাজকে মাকরূহ বলেছেন, সে মাকরূহ মানেই হচ্ছে হারাম –বিশেষ করে বর্তমান যুগ-সমাজে। কেননা এ সমাজে বিপদের কারণ সর্বত্র ও সর্বাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা এও বলেছেন যেঃ
(আরবী**********************************************************************)
বৃদ্ধা মেয়েলোকদের পক্ষে ফজর, মাগরিব ও এশার জামা’আতে শরীক হওয়ার জন্যে বাইরে যাওয়ার কোনো দোষ নেই। কেননা তাদের ব্যাপারে পূর্ণ নৈতিক নিরাপত্তা বিদ্যমান। আর এ মত হচ্ছে কেবল ইমাম আবূ হানীফার।
কিন্তু ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মদের মতে বৃদ্ধা মেয়েরা তো সব রকমের নামাযের জামা’আতেই শরীক হতে পারে। কেননা তাদের প্রতি পুরুষ লোকদের আগ্রহ-কৌতুহল কম হওয়ার কারণে কোন বিপদের আশংকা থাকবার কথা নয়।
‘মেয়েরা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তোমরা তাদের অনুমতি দাও’ –রাসূলে করীম (স)-এর বাণীর ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
এ হাদীস প্রমাণ করে যে, মেয়েদের অনুমতি দেয়াই বাঞ্ছনীয়, যে কাজে তার ফায়দা, তা থেকে তাকে নিষেধ করা যায় না। এ কথা তখনকার জন্যে, যখন বাইরে গেলে মেয়েদের ওপর কোনো বিপদ ঘটার কিংবা মেয়েদের নিয়ে অপর কোনো বিপদ সংঘটিত হওয়ার কোনোই আশংকা বা ভয়=ভীতি থাকবে না।
এ কথারই প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে হযরত আয়েশা (রা)-এর নিম্নোদ্ধৃত বাণী। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
এ মেয়েরা কি নতুন চাল-চলন গ্রহণ করেছে, তা যদি রাসূলে করীম (স) দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি এদেরকে মসজিদে যেতে অবশ্যই নিষেধ করতেন, যেমন নিষেধ করা হয়েছিল বনী ইসরাইলের মেয়েদের।
ইমাম মালিক (রহ) বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
মসজিদে যাওয়ার অনুমতি সংক্রান্ত এ হাদীসের মতো অন্যান্য হাদীসে কেবলমাত্র বৃদ্ধাদের সম্পর্কেই প্রযোজ্য।
কিন্তু ইমাম নববী বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************)
মেয়েদের জন্যে –সে বৃদ্ধাই হোক না কেন –নিজেদের ঘরের তুলনায় আর কোনো জায়গা কল্যাণকর হতে পারে না -নেই।
তিনি প্রথম প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন হযরত ইবনে মাসঊদের নিম্নোদ্ধৃত কথা। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
মেয়েদের আপাদমস্তকই পর্দার জিনিস। তাদের ঘরের গোপন কোঠায় থাকাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের পক্ষে অধিক উপযোগী। কেননা তারা যখন ঘর থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাদের পিছু নেয়।
একটি মেয়েলোক হযরত ইবনে মাসউদের কাছে জুম’আর দিন মসজিদে যাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে বললেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
তোমার বড় ঘরের অভ্যন্তরীণ কোঠায় তোমার নামায পড়া তোমার প্রশস্ত ঘরে নামায পড়া অপেক্ষা উত্তম। তোমার প্রশস্ত ঘরে নামায পড়া তোমার বাড়ির এলাকার মহল্লার মসজিদে নামায পড়া অপেক্ষা তোমার জন্যে উত্তম।
আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেছেনঃ
আজকের যুগে মেয়েদের ঈদের নামাযের জন্যে বের হয়ে যাওয়া আমি পছন্দ করিনে। যদি কোনো স্ত্রীলোক বের হতেই জিদ ধরে তবে তার স্বামীর উচিত তাকে অনুমতি দেয়া এই শর্তে যে, সে তার পুরানো পোশাক পরে যাবে এবং অলংকারাদি পরে যাবে না। আর সেভাবে বের হতে রাজি না হলে সুসাজে সজ্জিতা হয়ে যেতে স্বামী নিষেধ করতে পারে। (আরবী*******************************)
আল্লামা শাওকানী এ পর্যায়ের যাবতীয় হাদীস একসঙ্গে সামনে রেখে আলোচন্য বিষয়টি সম্পর্কে লিখেছেনঃ
এ হাদীসসমূহ একসঙ্গে প্রমাণ করে যে, দুই ঈদের নামাযে মেয়েদের ময়দানে বের হয়ে যাওয়া শরীয়তসম্মত কাজ, এতে কুমারী বা অকুমারী, যুবতী আর বৃদ্ধা মেয়েদের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই –যদি না সে ইদ্দত পালতে রত কিংবা তার বের হয়ে আসার কোনো বিপদ বা তার নিজের কোনো ওযর-অসুবিধা থাকে। (আরবী*************)
অতঃপর তিনি মুসলিম মনীষীদের এ পর্যায়ে দেয়া মত উল্লেখ করেছেন। তার একটি মত হচ্ছে এই যে, মেয়েদের বের হওয়ার জন্যে অনুমতি চাইলে পর অনুমতি দেয়া সম্পর্কে রাসূলের নির্দেশ পালন মুস্তাহাব। আর এ মুস্তাহাব বৃদ্ধ-যুবতী সব মেয়ের পক্ষেই। হাম্বলী মাযহাবের আবূ হামেদ, শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম জুরজানীও এ মত প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় মত হচ্ছে –যুবতী ও বৃদ্ধাদের মধ্যে অবশ্য পার্থক্য করতে হবে। তৃতীয় মত হচ্ছে, মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া জায়েয, মুস্তাহাব নয় –ইবনে কুদামাহ উদ্ধৃত কথার বাহ্যিক অর্থ এই। চতুর্থ, মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া মাকরূহ। এ কথাটি ইমাম আবূ ইউসুফের এবং তা ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন সওরী ও ইবনুল মুবারক থেকে। ইবনে শায়বা নখয়ীর মত উদ্ধৃত করে বলেছেন, যুবতী মেয়েদের ঈদের নামাযে যাওয়া মাকরূহ।
পঞ্চম মতঃ
(আরবী***********************************************************)
ঈদের নামাযের জন্যে বাইরে যাওয়া মেয়েদের বিশেষ অধিকার রয়েছে।
কাযী ইয়ায হযরত আবূ বকর, হযরত আলী ও হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে এ মত বর্ণনা করেছেন। ইবনে শায়বা হযরত আবূ বকর ও হযরত আলী (রা)-এর নিম্নোদ্ধৃত কথাটির উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
দুই ঈদের নামাযের জন্যে প্রত্যেক সক্ষম মেয়েলোকেরই যাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং এটা ন্যায্যা অধিকার।
আল্লামা শাওকানী বলেন, যাঁরা এ কাজকে মাকরূহ বা হারাম বলেন, তাঁদের কথা মেনে নিলে সহীস হাদীসকে অযৌক্তিক মত দ্বারা বাতিল করে দেয়া হয়। কেননা সহীহ হাদীসে মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অনুমতি চাইলে স্বামী বা গার্জিয়ান অনুমতি দিতে বাধ্য এবং সেজন্যে রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ রয়েছে। আর যারা যুবতী ও বৃদ্ধা মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এবং বৃদ্ধাদের জন্যে বাইরে যাওয়া জায়েয –যুবতীদের পক্ষে জায়েয নয় বলে রায় দিয়েছেন, তাঁরাও সর্ববাদীসম্মত সহীহ হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন অথচ তা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। (আরবী*****************)
ইমাম তিরমিযী উম্মে আতীয়াতা বর্ণিত হাদীসটি উদ্ধৃত করে লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
উম্মে আতীয়াতা বর্ণিত হাদীসটি অতি উত্তম এবং সহীহ সনদে বর্ণিত।
তারপর লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************)
মনীষীদের একদল এ হাদীস অনুযায়ী মত দিয়েছেন এবং মেয়েদেরকে দুই ঈদের নামাযের জন্যে ময়দানে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আর কেউ কেউ তা অপছন্দ করেছেন।
পূর্বে উদ্ধৃত হাদীসসমূহের দৃষ্টিতে হযরত আয়েশার আশংকাবোধকে কোনো গুরুত্ব দেয়া যায় না, অন্তত কেবলমাত্র ঈদের নামাযের জন্যে বের হওয়ার ব্যাপারে। কেননাঃ
(আরবী***************************************************************)
হযরত আয়েশা এ কথাটি বলেছিলেন নিজস্ব ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে। এ কারণেই তাঁর কথার ধরন এমনি হয়েছে যে, রাসূল যদি এ অবস্থা দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি নিষেধ করতেন। আর তাঁর নিজস্ব ধারণা-অনুমান শরীয়তের কোনো প্রমাণ হতে পারে না।
আল্লামা আহমাদুল বান্না ‘মুসনাদে আহমাদ’-এ উদ্ধৃত এ সম্পর্কিত যাবতীয় হাদীস সামনে রেখে বলেছেনঃ
এসব হাদীসই নামাযের জন্যে মসজিদে গমন মেয়েদের জন্যে জায়েয বলে প্রমাণ করে। তবে তা শর্তহীন নয়। দ্বিতীয়, এতে নিষেধও রয়েছে –যদি মেয়েরা তীব্র সংক্রামক সুগন্ধি ব্যবহার করে নামাযের জন্যে যার (তবে তা জায়েয হবে না)। তৃতীয়, যদি কোনো মেয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে কোনো না কোনো প্রয়োজনে মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয়, তবে তাও সে করতে পারে। আর চতুর্থ এই যে, মেয়েরা নামাযের জামা’আতে সকলের পিছনের কাতারে দাঁড়াবে এবং পুরুষদের বের হওয়ার বহু পূর্বেই তারা মসজিদ থেকে বের হয়ে চলে যাবে। (আরবী******************)
বস্তুত সমাজ-চরিত্র ও সমাজ-পরিবেশ যতই খারাপ হোক না কেন, এ সব শর্তের ভিত্তিতে মেয়েদের মসজিদে যাওয়া ও ঈদের নামাযের জামা’আতে শরীক হওয়া কোনোক্রমেই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হতে পারে না।
কার কারণ এই যে, বহু সংখ্যক সহীহ হাদীসে ঈদের জামা’আতে সব শ্রেণীর মহিলার উপস্থিতি হওয়া সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর স্পষ্ট নির্দেশ উল্লিখিত হয়েছে। এখঅনে ‘মুসনাদে আহমাদ’ থেকে এ পর্যায়ের কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাচ্ছেঃ
(আরবী************************************************************************)
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেনঃ নবী করীম (স) দুই ঈদের জামা’আতে নিজে বের হয়ে যেতেন এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকেও বের করে নিতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ
(আরবী*************************************************************)
নবী করীম (স) তাঁর মেয়েদের ও স্ত্রীদের দুই ঈদের নামাযের জন্যে বের হয়ে যেতে হুকুম দিতেন।
উমরা বিনতে রওয়া আল-আনসারী নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
প্রত্যেক কোমরবন্ধ পরিহিতা মেয়েলোকেরই ঈদের ময়দানে বের হয়ে যাওয়া ওয়াজিব।
হযরত উম্মে আতীয়াতা বলেনঃ
(আরবী********************************************************************)
রাসূলে করীম (স) আমাদেরকে সব যুবতী মেয়ে পর্দানশীল ও হায়েয-সম্পন্ন মেয়েকেই ঈদের ময়দানে বের করে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ মেয়েরা কি ঈদের জামা’আতে শরীক হওয়ার জন্যে ঘর থেকে বের হবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই। তার নিজের কাপড় না থাকলে তার কোনো সখীর কাপড় পরে বের হবে।
এ সব হাদীস সনদের দিক দিয়ে যেমন নিঃসন্দেহ, কথার দিক দিয়েও তেমনি অকাট্য, সুস্পষ্ট। এসব হাদীস যে কোনো ঈমানদার ব্যক্তির মন কাঁপিয়ে না দিয়ে পারে না। বর্তমানে মুসলিম সমাজে এসব হাদীস সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। অতএব শরীয়তের নিয়ম-নীতি পালনের মধ্যে দিয়ে ঈদের ময়দানে এক পাশে মেয়েদের জন্যে যদি পূর্ণ পর্দার ব্যবস্থা করা হয় তবে তাতে সমাজের মেয়েরা কেন শরীক হবে না বা হতে পারবে না এবং শরীক হলে তা দোষের হবে কেন –তা সত্যিই বোঝা যাচ্ছে না।
শুধু ঈদের নামাযই নয়, পর্দা রক্ষা করে মুসলিম মহিলারা সব রকমের জাতীয় কল্যাণমূলক অনুষ্ঠানে ও সভা-সম্মেলনে দাওয়াতেও শরীক হতে পারে। এ পর্যায়ে বুখারী শরীফে উদ্ধৃত একটি দীর্ঘ হাদীসের একাংশ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
যুবতী পুরাবাসিনী ও ঋতুবতী মেয়েলোক ঈদের নামাযের জন্যে অবশ্যই ঘরের বাইরে যাবে। তবে ঋতুবতী মেয়েরা নামাযে শরীক হবে না। তারা অবশ্যই উপস্থিত হবে সব রকমের জাতীয় কল্যাণমূলক কাজে ও অনুষ্ঠানে, মুসলমানদের সামগ্রিক দো’আ প্রার্থনার অনুষ্ঠানে, দাওয়াত ও যিয়াফতে।
এ হাদীসের ভিত্তিতে নববী লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
সব কল্যাণকর কাজে ও সমাবেশে, মুসলমানদের সামষ্টিক দো’আ প্রার্থনা মজলিসে দ্বীনী ইলম চর্চা ও ইসলামী বিষয়ে আলোচনা সভায় মেয়েদের শরীক হওয়া যে খুবই ভালো ও পছন্দনীয় কাজ, তা এ হাদীস থেকেই প্রমাণিত হয়।
(আরবী*************************************************************)
আমাদের এমন মেয়ে, যার মুখ ঢাকা চাদর বা বোরকা নেই, সে কি করবে?
জবাবে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
এরূপ অবস্থায় তার কোনো বোন তার নিজের বোরকা তাকে পরিয়ে দেবে।
একথা থেকে দুটি কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি এই যে, এ ধরনের অনুষ্ঠানাদিতে সব মেয়েলোকেরই –এমন কি যারা সাধারণত ঘর থেকে বেরই হয় না, যারা পুরাবাসিনী, তাদেরও হাজির হওয়া উচিত। আর দ্বিতীয় এই যে, মেয়েরা ঘর থেকে বের হলেই তাকে মুখাবয়ব অবশ্যই ভালোভাবে ঢেকে নিতে হবে। মুখ খোলা রেখে, বুক পিঠ না ঢেকে ঘর থেকে বের হতে পারবেনা। এভাবে ঢাকবার কাপড় –বোরকা –কোনো মেয়ের যদি নাও থাকে, তাহলে অন্য মেয়েলোকের কাছ থেকে তা ধার করে নেবে। আর এক্ষেত্রে যারই বোরকা আছে –সে সময় তার প্রয়োজন না থাকলে প্রয়োজনশীল অপর বোনকে তা অবশ্যই ধার দেবে। কোনো মেয়েলোকই যাতে করে খোলা মুখে ও খোলা বুক-পিঠ নিয়ে বাইরে বের না হয়, তার জন্যেই এ ব্যবস্থা।
রাসূলে করীম (স)-এর যুগে মেয়েরা ঈদের নামাযে রীতিমত শরীক হতেন এবং তিনি মেয়েদেরকে স্বতন্ত্রভাবে একত্র করে ওয়াজ-নসীহত করতেন। হাদীসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************))))))
আমি রাসূলে করীম (স) সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি খোতবা দেয়ার আগেই নামায পড়ে নিতেন। এমনি একদিন তিনি নামায পড়ালেন, পড়ে খোতবা দিলেন। পরে তিনি লক্ষ্য করলেন যে, নামাযের জন্যে সমবেত মহিলাদের তিনি স্বীয় ভাষণ শোনাতে পারেননি। তাই তিনি পরে তাদের কাছে উপস্থিত হলেন এবং তাদের নসীহত করলেন –দ্বীন ইসলামের জন্যে দান করতে ও রীতিমত যাকাত আদায় করতে নির্দেশ দিলেন।
এ হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছেঃ
(আরবী************************************************************************************)
মেয়েরা যখন পুরুষদের সাথে নামায কিংবা অন্য কোনো সমাবেশে উপস্থিত হতো, তখন তারা পুরুষদের থেকে খানিকটা দূরে স্বতন্ত্র স্থানে আসন গ্রহণ করত। আর তা করত কোনো নৈতিক বিপদ, চোখাচোখি কিংবা খারাপ চিন্তা উদ্ভব হওয়ার ভয় থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে।
মেয়েদের হজ্জ যাত্রা ও বিদেশ সফর
মেয়েদের পর্দার ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে উপরে যে আলোচনা পেশ করা হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কোনো গায়র-মুহাররম পুরুষের সাথে নিবিড় একাকীত্বে মিলিত হওয়া কোনো মেয়েলোকের পক্ষেই জায়েয নয়। এ পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠে –কোন মেয়েলোকের ওপর যদি হজ্জ ফরয হয়, আর তার স্বামী বা এমন কোনো মুহাররম পুরুষও না থাকে যে তাকে সঙ্গে করে হজ্জ সফরে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে তখন সে কি করবে?
আল্লামা আহমাদুল বান্নার বিশ্লেষণ এই যে, এ সম্পর্কে যত হাদীসই পাওয়া যায়, তা সবই একসঙ্গে প্রমাণ করে যে, মুহাররম সাথী ছাড়া মেয়েলোকের বিদেশ সফর আদৌ জায়েয নয়। তা হজ্জের সফরেই হোক আর অন্য কিছুর।
ইবনে দকীকুল রীদ বলেছেনঃ বিষয়টিকে দুটো পরস্পর বিরোধী সাধারণ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। একদিকে আল্লাহ বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)))))))
আল্লাহরই জন্যে আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা এমন প্রত্যেক ব্যক্তির ওপরই কর্তব্য, যার সে পর্যন্ত পৌঁছবার সামর্থ্য রয়েছে।
এ সাধারণ নির্দেশ পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে সামর্থ্যবতী মেয়েলোকদের ওপরও প্রযোজ্য। যে মেয়েলোকের মক্কা গমনের সামর্থ্য রয়েছে, তাকেই হজ্জ করতে হবে –ফরয।
অপরদিকে নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
মেয়েলোক আদৌ বিদেশ সফর করবে না –তবে কোনো মুহাররম পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে করতে পারে।
এ কথাটি সব রকমের সফর প্রসঙ্গেই প্রযোজ্য, অতএব কোনো মেয়েলোকই মুহাররম পুরুষ সাথী ছাড়া আদৌ কোনো সফর করবে না, তা হজ্জের সফরই হোক না কেন।
এক্ষণে এ দুটি সাধারণ নীতির একটিকে অপরটির ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সেই অগ্রাধিকার দানের কারণ বাইরে থেকে নিতে হবে।
ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ এ পর্যায়ের হাদীসসমূহ কুরআনের উক্ত আয়াতের সাথে মোটেই সাংঘর্ষিক নয়। কেননা আয়াতে হজ্জ ফরয হওয়ার জন্যে যে সামর্থ্যের শর্ত আরোপ করা হয়েছে মেয়েদের ক্ষেত্রে একজন মুহাররম সাথী লাভ সেই শর্তেরই অন্তর্ভুক্ত। অতএব যার মুহাররম সাথী জুটছে না, হজ্জ ফরয হওয়ার শর্তও সেখানে পুরামাত্রায় পূরণ হচ্ছে না। কাজেই আয়াত ও হাদীসের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই।
এ কারণেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
মুহাররম পুরুষ সাথী না পেলে মেয়েলোকের ওপর হজ্জই ওয়াজিব হয় না।
ইমাম মালিক অবশ্য ফরয সফর আদায় করার ব্যাপারে মুহাররম সাথী পাওয়াকে শর্ত হিসাবে গণ্য করতে রাজি নন। ইমাম শাফেয়ী ফরয হজ্জের সফরকে সাধারণ প্রয়োজনের সফর থেকে আলাদা করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন। এর জবাবে বলা হয়েছে যে, সাধারণ প্রয়োজনের সফর সম্পর্কেই এ সর্ববাদীসম্মত মত যে, তা মুহাররম সাথী ছাড়া করা জায়েয নয়। অতএব ইখতিয়ারী ও ইচ্ছাকৃত সফরককে এর সমতুল্য মনে করা যেতে পারে না।
দারেকুতনী বর্ণিত এ পর্যায়ের একটি হাদীসের বিশেষ অংশ হচ্ছেঃ
(আরবী***********************************************************)
স্বামীর সঙ্গে ছাড়া কোনো মেয়েলোকই কখখনোই হজ্জ পালন করতে পারে না।
আবূ আমামা রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণী বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
এবং মেয়েলোক স্বামীকে সঙ্গী না বানিয়ে একাকী তিন দিনের দূরত্বের পথে সফর করবে না এবং হজ্জ করতেও যাবে না।
এসব হাদীস সামনে রাখলে হজ্জের সফরকে অন্যান্য সাধারণ সফর থেকে আলাদা করে বিবেচনা করা চলে না।
ইমাম আবূ হানীফা, নখয়ী ও ইসহাক ইবনে রাওয়া প্রশ্ন তুলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************)
মেয়েদের হজ্জ সফর প্রসঙ্গে মুহাররম সাথী হওয়া কি হজ্জ ফরয হওয়ার জন্যে শর্ত, না হজ্জ আদায় করার জন্যে? (আর এ দুটির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান।)
কেউ কেউ বলেছেনঃ মুহাররম সাথী হওয়ার শর্ত কেবল যুবতী মেয়েদের জন্যে, বৃদ্ধাদের জন্যে তা শর্ত নয়। কেননা বৃদ্ধাদের প্রতি কারোরই কোনো আগ্রহ হওয়ার কথা নয়।
রাসূলে করীম (স) এক ব্যক্তিকে বললেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
তুমি ফিরে যাও এবং তোমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হজ্জ করতে চলে যাও।
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থের ভিত্তিতে কেউ কেউ মনে করেন যে, স্ত্রীর ওপর হজ্জ ফরয হলে এবং তার সঙ্গে যাওয়ার জন্যে অপর কোনো মুহাররম পুরুষ যদি না পাওয়া যায়, তাহলে স্বামীকেই তার সঙ্গে যেতে হবে –যাওয়া স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইমাম শাফেয়ীরও এই মত। আর স্বামী ছাড়া অপর কোনো মুহাররম পুরুষের সাথে স্ত্রী যদি হজ্জে গমন করতে চায়, তাহলে তাকে যেতে না দেয়া স্বামীর অধিকার নেই। (আরবী************)
উপরের আলোচনার ভিত্তিতে অতি সহজেই চিন্তা করা যায় যে, হজ্জের মতো একটি ফরয আদায়ের সফর সম্পর্কে যখন এতদূর কড়াকড়ি ইসলামে রয়েছে, তখন প্রমাদ সফর, শিক্ষা সফর, সাংস্কৃতিক দৌত্যের সফর ইত্যাদি সম্পর্কে ইসলামের বিধান কি হতে পারে। ছাত্রী, শিল্পী, শিক্ষয়িত্রী কিংবা রাষ্ট্রদূত –যিনিই হোন না কেন, কারো পক্ষেই স্বামী কিংবা কোনো মুহাররম পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বিদেশ সফর আদৌ জায়েয নয় –হতে পারে না, সে সফর উচ্চশিক্ষার জন্যে হোক, উচ্চতর ট্রেনিং-এর জন্যে হোক, সাংস্কৃতিক চুক্তির ভিত্তিতে হোক আর রাষ্ট্রীয় দৌত্যের জন্যে হোক, তার মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যায় না এবং কোনো সফরই জায়েয নয়, একথা বলাই বাহুল্য।
মেয়েদের পোশাক প্রসাধন
মেয়েদের ঘরের বাইরে যেতে শরীয়তে নিষেধ করা হনি, অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে সে অনুমতি দুটো শর্তের অধীনঃ
প্রথম শর্ত, বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়ানো চলবে না। প্রয়োজন –নিতান্ত অপরিহার্য প্রয়োজন থাকলেই সেই প্রয়োজন পরিমাণ সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারে।
আর দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, নিজের মুখ-মাথা-বুক-পিঠ এবং সমগ্র শরীর ভালোভাবে আবৃত আচ্ছাদিত করে তবে বের হওয়া চলবে। মুখ-বুক উন্মুক্ত রেখে, গায়ের বর্ণ ও যৌবনোজ্জ্বল দেহাবয়ব প্রকাশ করে ঘর থেকে বের হওয়া মেয়েদের জন্যে সুস্পষ্ট হারাম। রাসূলে করীম (স) এ পর্যায়ে বড় কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন এবং এভাবে চলার মারাত্মক পরিণামের কথাও উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেনঃ
(আরবী********************************************************************)
সেসব নারী যারা পোশাক পরিধান করেও ন্যাংটা, যারা নিজেদের কুকর্মকে অন্য লোকের কাছে জানান দিয়ে চলে, যারা বুক-স্কন্ধ বাঁকা করে একদিকে ঝুঁকিয়ে চলে, যাদের মাথা ষাঁড়ের চুটের মত ডান বামে ঢুলে ঢুলে পড়ে, তারা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং বেহেশতের সুগন্ধিও লাভ করতে পারবে না, যদিও তার সুগন্ধি বহুদূর থেকে পাওয়া যাবে।
‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’-এ স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************************************)
বেহেশতের সুগন্ধি পাঁচশ বছর দূরত্ব থেকেও পাওয়া যাবে।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা নববী লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
মানে তারা আল্লাহর আনুগত্যের সীমা লংঘন করেছে, যা যা রক্ষা করা ও হেফাযত করা দরকার, তার হেফাযত করেছে, নিজেদের পঙ্কিল ঘৃণার্হ কাজের জানান দেয় অপর লোকদের বুক টান করে পথে-ঘাটে বীরদর্পে চলাফেরা করে, কাঁধ বাঁকা করে হাঁটে আর অসৎ মেয়েদের মতো লোকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে পথ অতিক্রম করে। এসব মেয়েলোক কখনো জান্নাতবাসী হতে পারবে না।
আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
এ ধরনের কাপড় যে মহিলা পরবে ও যে এভাবে চলাফেরা করবে, সে জাহান্নামী হবে এবং সে জান্নাতের সুগন্ধি পাবেনা –যদিও তা পাঁচশ বছর পথের দূরত্ব থেকে পাওয়া যাবে –এ বড় কঠিন ও কঠোর শাস্তির খবর। এ জিনিস প্রমাণ করে যে, হাদীসে যা করতে নিষেধ করা হয়েছে, তা করা সম্পূর্ণ হারাম।
বর্তমান সময়ে মেয়েরা যেমন মাথার ওপর সবগুলো চুল চাপিয়ে বেঁধে রাখে, যা দেখলে মনে হয় (পুরষদের ন্যায়) মাথায় যেন পাগড়ি বাঁধা হয়েছে, এরূপ চুল বেঁধে রাজপথে ও বাজারে মার্কেটে চলাফেরা করা এ হাদীসে স্পষ্ট নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের চুল-বাঁধা মাথাকে ষাঁড়ের পিঠে অবস্থিত চুটের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
কাপড় পরেও ন্যাংটা থাকার অর্থে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************************************)
মেয়েরা দেহের কতকাংশ আবৃত রাখে আর কতকাংশ রাখে খোলা, উন্মুক্ত, অনাবৃত। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য ভিন পুরুষদের সামনে প্রকাশ করা অথবা অত্যন্ত পাতলা কাপড় করে, যার ফলে দেহের কান্তি বাইরে ফুটে বের হয়ে পড়ে।
এসব মেয়েলোকদের কাপড় পরেও ‘ন্যাংটা’ বলে অভিহিত করা যেমন যথার্থ, তেমনি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লামা ইবনে আবদুল বার ও শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
কাপড় পরেও ন্যাংটা থেকে যায় যেসব মেয়েলোক, যারা খুব পাতলা মিহিন কিংবা জালের ন্যায় কাপড় পরে, যার নীচের সব কিছু স্পষ্টভাবে দ্রষ্টার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অতএব এরা কাপড় পরিহিত হয় নামে মাত্র –বাহ্যত, কিন্তু আসলে এরা ন্যাংটা-উলঙ্গ।
হযরত উসামা ইবনে যায়দ বলেনঃ রাসূলে করীম () আমাকে খুব পাতলা মিহিন এক কিবতী চাদর পরিয়ে দিলেন। আমি তা আমার স্ত্রীকে পরিয়ে দিলাম। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ কি হলো কিবতী চাদরটি তুমি পরলে না? আমি বললাম, আমি তা আমার স্ত্রীকে পরিয়ে দিয়েছি। তখন তিনি বললেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
তোমার স্ত্রীকে বলো, সে যেন সেই কাপড়ের নিচে আর একটি কাপড় পরে। কেননা আমার ভয় হচ্ছে কেবল সেই একটি কাপড় পরলেই তার দেহাবয়ব প্রকাশ হয়ে পড়বে।
এত দ্দেশের মেয়েরা মাড়ির নিচে যেমন ছাড়া পরিধান করে, এখানে ঠিক তা পরবার জন্যেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আল্লামা আহমাদুল বান্না এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
অর্থাৎ মেয়েদের কাপড় যদি মোটা, অমসৃণ ও আঁটসেঁটে হয়, তাহলে দেহাবয়ব তার পূর্ণ আকার-আকৃতিসহ স্পষ্ট দেখা যাবে। আর যদি খুব পাতলা হয়, তাহলে চামড়ার কান্তি বাইরে প্রস্ফুট হয়ে পড়বে। এ কারণে দুরকমেরই কাপড় ব্যবহার করা মেয়েদের জন্যে জায়েয নয়। রাসূলের উপরোক্ত বাণীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, মেয়েদের এমন কাপড় পড়তে বলা, যা বাহ্যত কেবল কাপড়ই দেখা যাবে, তা প্রশস্ত ও ঢিলে-ঢালা হবে, মোটাহবে এবং এসব কারণে নারীদেহের কোনো অংশ প্রকাশ করবে না, যাতে চামড়ার কান্তি বাইরে থেকে দেখা যাবে।
আধুনিকা মেয়েদের টাইট পোশাক এবং গলা, পিঠ ও পেট ন্যাংটা করে অজন্তা ফ্যাশনে পরা পোশাক এজন্যেই জায়েয নয়। আবদুর রহমানের কন্যা হাফসা হযরত আয়েমার খেদমতে হাজির হয়। সে তখন খুবই পাতলা কাপড় পরিধান করেছিল। তা দেখে হযরত আয়েশা (রা) তার সে পাতলা কাপড় ছিঁড়ে ফেলে দেন এবং একখানা মোটা গাঢ় কাপড় পড়িয়ে দেন। (আরবী********************)
যে সব পুরুষ তাদের ঘরের মেয়েদেরকে খুব পাতলা কাপড় পরতে দেয়, এমন কাপড় পরতে দেয় যা পরার পরেও দেহের কান্তি বাইরে ফুটে বের হয় কিংবা দেহের বিশেষ অঙ্গ অনাবৃতই থেকে যায়, হাদীসে সেসব পুরুষের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে (আরবী***********) তারা পুরুষের মতো আর তার মানেঃ
(আরবী*************************************************************************)
তারা বাহ্যত পুরুষ হলেও প্রকৃত পক্ষে তারা না নয়। কেননা যথার্থ পুরুষ মানুষ কখনো তাদের স্ত্রী-কন্যা-বোন-নিকটাত্মীয়া প্রভৃতি মেয়েদের এমন কাপড় কখনই পরতে দিতে পারে না, যা তাদের দেহকে ভালোভাবে আবৃত করে না।
বর্তমানে যাদের মেয়েরা টাইট পোশাক পরে, শাড়ি ও ব্লাউজ এমনভাবে পরে যে, বুক-পিঠ-পেট সবই থাকে উন্মুক্ত কিংবা এমন শাড়ি পরে যা দেহের সমস্ত উচ্চ-নীচ সব অঙ্গের আকার-আকৃতি দর্শকের সামনে উদঘাটিত করে তোলে এবং পুরুষের লালসা-পংকিল দৃষ্টিতে করে আকৃষ্ট, তারা যে কি ধরনের পুরুষ তা সহজেই বোঝা যায়। বস্তুত এসব পুরুষের মধ্যে পৌরুষ বা মনুষ্যত্ব নামের কোনো ‘বস্তু’ থাকলে তারা তা কিছুতেই বরদাশত করত না।
বর্তমানে কিছু কিছু মেয়েলোককে অবিকল পুরুষের পোশাকও পরতে দেখা যায়। কিন্তু ইসলামের এ যে কত বড় নিষিদ্ধ কাজ, তা নিম্নোদ্ধৃত হাদীস থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
যে মেয়েলোক পুরুষের বেশ ধারণ করবে আর যে সব পুরুষ মেয়েলোকের বেশ ধারণ করবে –তারা কেউই আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।
এ প্রসঙ্গেই রাসূল সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************************************)
যে পুরুষ মেয়েদের পোশাক পরিধান করে, আর যে মেয়েলোক পরে পুরুষের পোশাক, রাসূলে করীম (স) তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************************)
যে পুরুষ মেয়েদের পোশাক পরিধান করে, আর যে মেয়েলোক পরে পুরুষের পোশাক, রাসূলে করীম (স) তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************************************)
নবী করীম (স) অভিশাপ বর্ষন করেছেন সেসব পুরুষের ওপর, যারা মেয়েলী পোশাক পরে এবং সেসব মেয়েলোকের ওপর, যারা পুরুষের পোশাক পরিধান করে।
আল্লামা শাওকানী এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
এ পর্যায়ের যাবতীয় হাদীস প্রমাণ করে যে, পুরুষদের মেয়েলী বেশ ধারণ এবং মেয়েদের পুরুষালী বেশ ধারণ করা সম্পূর্ণ হারাম। কেননাএ কাজে অভিশাপ বর্ষণ করা হয়েছে, আর হারাম কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার অভিশাপ বর্ষণ করা হয় না –সকল বিশেষজ্ঞের এই হচ্ছে সুসংহত অভিমত।
হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মেয়ে আর পুরুষ আল্লাহর দুই স্বতন্ত্র সৃষ্টি। কাজেই প্রত্যেকের জন্যে শোভনীয় বিশেষ পোশাকই তাদের পরিধান করা উচিত, তার ব্যতিক্রম করা হলে আল্লাহর মর্জির বিপরীত কাজ করা হবে। আর তাতেই নেমে আসে আল্লাহর অভিশাপ।
পোশাক সম্পর্কে একটি মূল কথা অবশ্যই সকলকে স্মরণে রাখতে হবে। সে মূল কথাটি বলা হয়েছে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
হে আদম সন্তান, নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের জন্যে এমন পোশাক নাযিল করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থানকে আবৃত করে এবং ভূষণও। আর তাকওয়ার পোশাক, সে তো অতি উত্তম-কল্যাণকর। এ হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি। সম্ভবত লোকের এ থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে।
প্রথমত আয়াতে গোটা মানব জাতিকে –সমস্ত আদম সন্তানদের সম্বোধন করে কথা বলা হয়েছে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই এর মধ্যে শামিল অর্থাৎ পরবর্তী কথা সমস্ত মানুষের পক্ষেই অবশ্য পালনীয়।
দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, আল্লাহ পোশাক ও ভূষণ নাযিল করেছেন। পোশাক এমন, যা মানুষের স্ত্রী-পুরুষ –সকলের লজ্জাস্থানসমূহকে পূর্ণ মাত্রায় আবৃত করে, তার কোনো অংশই অনাবৃত-উলঙ্গ থাকে না। আল্লাহ শুধু পোশাকই নাযিল করেন নি সেই সঙ্গে ভূষণ –শোষাও মানুষের জন্যে নাযিল করেছেন। অন্য কথায়, একটা পোশাক পরাই আল্লাহর দৃষ্টিতে যথেষ্ট নয়, যবুথবুভাবে দেহাবয়ব আবৃক করলেই চলবে না, সেই সঙ্গে তাকে ভূষণ –শোভা বৃদ্ধিকারকও হতে হবে।
আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
রীশ অর্থ এখানে সৌন্দর্য্যের পোশাক, সৌন্দর্যমণ্ডিত ও শোভা বৃদ্ধিকারী পোশাক।
‘আল কামুস’-এ ‘রীশ’ শব্দের অর্থ লিখেছেন। (আরবী********) ‘গৌরবজনক পোশাক’।
তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়ঃ
(আরবী*******************************************************************)
আমরা নাযিল করেছি লজ্জাস্থান আবৃতকারী পোশাক এবং গৌরবমণ্ডিত পোশাক, যা পরে তোমরা শোভামণ্ডিত হবে।
আল্লামা বায়যাবীও লিখেছেনঃ (আরবী**********) রীশ মান সৌন্দর্য, শোভা।
তৃতীয় বলা হয়েছে, তাকওয়া-আল্লাহভীরুতামূলক পোশাকই উত্তম অর্থাৎ পোশাককে প্রথমত লজ্জাস্থান আবরণকারী, লজ্জা নিবারণকারী হতে হবে, দ্বিতীয়ত কেবল লজ্জা নিবারণই আল্লাহর ইচ্ছা নয়, বরং পোশাক হতে হবে শোভা বৃদ্ধিকারী। তৃতীয়, শোভাবর্ধক পোশাক যাই পরা হোক না কেন তার তাকওয়ামূলক, আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে পোশাক হতে হবে। তাকওয়া-বিরোধী শোভামণ্ডিত পোশাক আল্লাহর পছন্দ নয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই আরব কবি বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
ব্যক্তি যখন তাকওয়ামূলক পোশাকই পরল না, তখন সে পোশাক পরেও উলঙ্গে পরিণত হয়ে যায়।
আয়াতের শুরুতে বনী আদম –আদম সন্তানদের সম্বোধন করা হয়েছে, যা স্পস্ট ইঙ্গিত করে বাবা আদম ও মা হাওয়া বিবস্ত্র হয়ে পড়ার ঘটনার দিকে। আর পরবর্তী আয়াতেই কথাটিকে আরো স্পষ্ট করে তোলার জন্যে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
হে আদম সন্তান, শয়তান যেন তোমাদের বিপদে ফেলে দিতে না পারে, যেমন করে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে বিপদে ফেলেছিল। তখন সে দুজনার পোশাক টেনে ফেলে দিয়েছিল, যেন দুজনেরই লজ্জাস্থান প্রকাশিত ও দৃষ্টিগোচর হয়ে পড়ে।
শয়নাত আদম জাতিকে সর্বপ্রথম যে বিপদে ফেলেছিল, তা হলো আদম-হাওয়া –দুজনারই কাপড় খুলে পড়ে যাওয়া, উলঙ্গ হয়ে পড়া। অতএব তোমরা তাঁদেরই সন্তান বিধায় তোমাদের প্রতিও শয়তান দুশমনি দেখাবে তোমাদেরকে উলঙ্গ করে দিয়ে। অতএব তোমরা সাবধান।
এ আয়াত মানব জাতির জন্যে বড়ই সাবধান বানী, নগ্নতা, অর্ধোলঙ্গ ও কাপড় পরেও না পারার মতোই দেহের সর্বাঙ্গ দেখতে পারা শয়তানেরই প্ররোচনা। অতএব নগ্নতা আর কাপড় পরে থাকা থেকে তোমাদের সাবধান থাকতে হবে। কেননা উলঙ্গ-অর্ধোলঙ্গ হওয়ার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে গুনাহ, আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া। বস্তুত লজ্জা-শরম মানুষের প্রকৃতিগত বলেই আদম-হাওয়া সঙ্গে সঙ্গেই গাছের পাতা দিয়ে দেহাবয়ব আবৃত করতে শুরু করেন। বনী আদমেরও বর্তব্য হচ্ছে নগ্নতা ও অর্ধ নগ্নতা পরিহার করে তাকওয়ামূলক পোশাক পরিধান করা।
মেয়েদের সুগন্ধি ব্যবহার সম্পর্কেও আমরা এ পর্যায়ে বিশ্লেষণ করে দেখব। বিশেষ করে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা মেয়েদের পক্ষে জায়েয নয়। এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর বড় কঠোর বাণী উচ্চারিত ও হাদীসের কিতাবসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে। একটি হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর কথা নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
যে মেয়েলোক সুগন্ধি (আতর-গোলাপ-সেন্ট ইত্যাদি) লাগিয়ে ঘরের বাইরে লোকদের কাছে যাবে এ উদ্দেশ্যে, যেন তারা সুগন্ধি শুঁকতে পারে, তবে সে ব্যভিচারী গণ্য হবে।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
এ হাদীসে সে মেয়েলোক সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর ভাষা প্রয়োগ ও তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে, যে বাইরে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে সুগন্ধি ব্যবহার করা, তাকে ব্যভিচারিণীও বলা হয়েছে। তার কারণ সুগন্ধির তীব্র ক্রিয়া দ্বারা সে পুরুষদের মনে যৌন উত্তেজনা জাগিয়ে তোলে এবং তার দিকে তাকাবার জন্যে দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। আর এ হচ্ছে কার্যত ব্যভিচারের পূর্বাভাষ।
এক হাদীসে দৃঢ় ভাষায় বলা হয়েছে, সুগন্ধি লাগিয়ে মসজিদে গিয়ে নামায পড়লে সে নামাযও আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। নামায এবং মসজিদের জন্যে সুগন্ধি লাগানোর ব্যাপারে যখন কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তখন বাইরের হাটে-বাজারে, ক্লাবে, রেস্তোরাঁয়, মিটিং-এ পার্টিতে গমনের জন্যে সুগন্ধি ব্যবহার করা যে কতখানি অপরাধ, তা সহজেই অনুমেয়।
এ প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস হচ্ছে এই –নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
তোমরা আল্লাহর বাঁদীদের আল্লাহর মসজিদে যেতে নিষেধ করো না। তবে তারা খুব সাদাসিধেভাবেই ঘরের বাইরে যাবে।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে আবদুল বার লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
মেয়েদের বাইরে যেতে নিষেধ করতে বারণ করা এবং তাদে সুগন্ধি মেখে বের হতে নিষেধ করার কারণ হলো, তাদের সুগন্ধির মাদকতায় পুরুষ লোকদের মন উতলা হয়ে উঠতে পারে।
বলা বাহুল্য, সুগন্ধি বলতে সব রকমের সুগন্ধিই বোঝায়। চোখ ঝলসানো ও চাকচিক্যপূর্ণ পোশাকও এ পর্যায়ে পড়ে।
এ কারণে নবী করীম (স) সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
সাবধান, পুরুষদের সুগন্ধ হচ্ছে এমন জিনিস, যাতে গন্ধ আছে (রং নেই), আর মেয়েদের সুগন্ধ হচ্ছে যাতে রং আছে, গন্ধ নেই।
তার মানে, চারদিকে আলোড়িত করে তোলা সুগন্ধি ব্যবহার করে ঘরের বাইরে যাতায়াত করা মেয়েদের জন্যে জায়েয নয়, এ কারণেই মেয়েদের পক্ষে মেহেন্দি, আলতা, সুরমা ইত্যাদি ধরনের ভালো সৌখিন, রূপচর্চা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির দ্রব্যাদি ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া অন্য কোনো তীব্র সুগন্ধিযুক্ত জিনিস ব্যবহার করা জায়েয নয়।
এ জন্যে রাসূলে করীম (স) মেয়েদেরকে ‘খেজাব’ ব্যবহার করতে বলতেন। তিনি এক মহিলাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ
(আরবী********************************************************************)
খেজাব লাগাও, তোমরা খেজাব লাগাও না বলে তোমাদেরহাত পুরুষদের হাতের মতোই বর্ণহীন হয়ে থাকে।
হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে –এ মেয়েলোকটি অতঃপর কখনোই হয়ত খেজাব লাগান পরিত্যাগ করেনি।
এমনি অপর একটি মেয়েলোক পর্দার আড়ালে থেকে হাত বাড়িয়ে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট একখানি চিঠি পেশ করে। নবী করীম (স) সে চিঠি না ধরে বলে উঠলেনঃ
(আরবী******************************************************)
বুঝতে পারলাম না, এ কি কোনো পুরুষের হাত, না কোনো মেয়েলোকের হাত?
মেয়েলোকটি পর্দার আড়াল থেকেই বলে উঠলঃ মেয়েলোকের হাত। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী***********************************************))
তুমি যদি মেয়েলোকই হতে, তাহলে তোমার হাতের নখগুলোতে অবশ্যই হেনার রঙ লাগাতে।
‘তুমি যদি মেয়েলোকই হতে’ মানে তুমি মেয়েলোক হয়ে দি মেয়েদের ভূষণ ও সাজসজ্জাকে যথারীতি পালন করে চলতে অর্থাৎ ‘নখ পালিশ’ লানাগো মেয়েদের ভূষণ ও প্রসাধনের মধ্যে গণ্য।
এ থেকে জানা যায় যে, মেয়েদের হাতে-পায়ে মেহেন্দি ও নখে হেনার (মেহেন্দি) রং লাগানো উচিত। বর্তমানে আলতা, নখ-পালিশ ও লিপিস্টিক ব্যবহারেও কোনো দোষ নেই।
বস্তুত মেয়েদের রূপ চর্চা –ইসলামে কিছুমাত্র নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে যে রূপচর্চা বাইরের লোকদের দেখাবার, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ও তাদের মনে যৌন উত্তেজনা জাগিয়ে দিয়ে তাদেরকে উন্মাদ করে তোলার উদ্দেশ্য হওয়া একেবারেই উচিত নয়। এ যদি কেউ করে তবে তার এ কাজ নিজের দেহ মনকে পর-পুরুষের কাছে সঁপে দেয়ারই শামিল হবে।
আর তাই হচ্ছে জ্বেনা। তা সবই হওয়া উচিত তার স্বামীর জন্যে, কেবলমাত্র যার পক্ষে তাকে দেখা, তার রূপ ও যৌবন উপভোগ করা ইসলামে হালাল। স্বামীর জন্যে রূপচর্চা করার ব্যাপারে কেবল চাকচিক্যপূর্ণ রঙ ব্যবহারই জায়েয নয়, তারও অধিক ঘরের মধ্যে থেকে তীব্র মন মাতানো সুগন্ধি ব্যবহার করাও জায়েয। এজন্যে উল্লিখিত আলোচনার পর আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
মেয়েলোক যখন স্বামীর কাছে থাকবে তখন যে কোনো জিনিস দিয়ে নিজ-ইচ্ছে ও মনোবাঞ্ছনা মতো প্রসাধন করতে পারে।
মেয়েদের পর্দা সহকারে জরুরী কাজ বাইরে বের হওয়য়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বাইরের পথে চলাচলের একটা নিয়মও তাদের জন্যে বের করে দেয়া হয়েছে। ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের কখনো পথের মাঝখান দিয়ে ভিন পুরুষদের সাথে ঘষাঘষি করে, ভীড় ঠেলে ধাক্কা খেয়ে চলা উচিত নয়। নবী করীম (স) একটা মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে লোকদের পথ চলা লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, পথে পুরুষ ও মহিলারা পরস্পরের গা ঘেষে পাশাপাশি চলছে। তখন তিনি মেয়েদের লক্ষ্য করে বললেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
তোমরা একটু দেরী করো, একটু পিছিয়ে পড়। কেননা পথের মাঝখান দিয়ে চলা তোমাদের উচিত নয়; বরং তোমাদের উচিত পথের একপাশ দিয়ে চলা।
হাদীসে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশের পরে মহিলারা ঠিক পথের কিনারা দিয়ে প্রাচীরের পাশ ঘেষে চলতে আরম্ভ করে। ফলে এ অবস্থাও দেখা যায় যে, মেয়েদের কাপড় পথের কিনারায় প্রাচীরের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।
(আরবী*******************************************************************************)
নবী করীম (স)-এর স্থায়ী রীতি ছিল, তিনি জামা’আতের নামায সম্পূর্ণ করে পুরুষ নামাযীদের নিয়ে এতটুকু সময় দেরী করে মসজিদ থেকে বের হতেন, যার মধ্যে মেয়েরা মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারত। অপর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মসজিদে নববীতে মহিলা নামাযীদের প্রবেশ ও নিষ্কমণের জন্যে একটি আলাদা দরজা করে দেয়া হয়েছিল। (আবূ দাউদ)
বস্তুত মেয়েদের বাইরে পথ চলার ব্যাপারটি মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা শত বোরকা পরে, শরীর-মুখ-মাথা পূর্ণমাত্রায় ঢেকেও যদি তারা ঘরের বাইরে যায়, আর যদি পথিমধ্যেই নানা পুরুষের দ্বারা দলিত মথিত ও মর্দিত হয়, তাহলে সে বোরকা আর দেহাবয়ব আচ্ছাদনের এক কানা-কড়িও মূল্য থাকে না। বিশেষত বর্তমান সময়ের মেয়েদের রাজপথে চলাচলের ধরণ দেখলে রাসূলে করীম (স)-এর এ নির্দেশের গুরুত্ব খুবই তীব্রভাবে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।