মহিলাদের সামাজিক দায়িত্ব
পূর্ববর্তী আলোচনায় অকাট্য দলীল-প্রমাণাদির ভিত্তিতে একথা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মেয়েদের প্রকৃত স্থান এবং আসল কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তাদের ঘর। তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বও ঠিক তাই, যা তারা প্রধানত ঘরের চার-প্রাচীরের অভ্যন্তরে বসেই সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারে এবং যে কাজই মূলত ঘর কেন্দ্রিক; ঘরের নির্দিষ্ট পরিবেশের মধ্যেই যা সীমাবদ্ধ। ঠিক এ কারণেই মহিলাদের ওপর বাইরের সামাজিক ও সামগ্রিক পর্যায়ের কোনো কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি।
পুরুষ নারী উভয়ই মানুষ; কিন্তু শুধু মানুষ বললে এদের আসল পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। পুরুষরা শুধু মানুষই নয়, তারা ‘পুরুষ মানুষ’ তেমনি মেয়েরাও শুধু মানুষ নয়, তারা ‘মেয়ে মানুষ’। মানুষের এ শ্রেণীবিভাগ মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য ও কাজকে স্বভাবতই দু’পর্যায় ভাগ করে দেয়। একটি পর্যায়ের কাজ হচ্ছে ঘরে, পারিবারিক চতুঃসীমার মধ্যে, আর এক প্রকারের কাজ হচ্ছে বাইরের। এ উভয় প্রকারের কাজের স্বভাব ও ধরনের কোনো মিল নেই, সামঞ্জস্যও নেই। দুটো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের স্বতন্ত্র প্রকৃতির কাজ বিধায় এ দুক্ষেত্রের জন্যে এ দু’ধরনের মানুষের প্রয়োজন ছিল, যা পূরণ করা হয়েছে নরও নারী সৃষ্টি করে। পুরুষকে দেয়া হয়েছে বাইরের কাজ আর তা সম্পন্ন করার জন্যে যে যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা ও কাঠিন্য (hardship) অনমনীয়তা, কষ্ট-সহিষ্ণুতা, দুর্ধষর্তার প্রয়োজন, তা কেবল পুরুষদেরই আছে। আর মেয়েদের আছে স্বাভাবিক কোমলতা, মসৃণতা, অসীম ধৈর্যশক্তি, সহনশীলতা, অনুপম তিতিক্ষা। ঘরের অঙ্গনকে সাজিয়ে গুছিয়ে সমৃদ্ধশালী করে তোলা, মানব বংশের কুসম-কোমল কোরকদের গর্ভে ধারণ, প্রসবকরণ, স্তন দান ও লালন পালন করার জন্যে একান্তই অপরিহার্য। তাই এ কাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে মহিলাদের ওপর অর্পন করা হয়েছে। ফলৈ পুরুষেরা বাইরের কর্মক্ষেক্রের কর্তা আর মেয়েরা হচ্ছে ঘরের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় ব্যাপারের কর্ত্রী। এ দুটি কর্মক্ষেত্র মিলিয়েই যেমন হয় দুনিয়ার সম্পূর্ণ ও অখণ্ড জীবন, তেমনি পুরুষ আর নারীর সমন্বয়েই মানুষ, মানুষের সম্পূর্ণতা।
ঠিক এজন্যেই ইসলামী শরীয়ত মেয়েদের ওপর ঠিক সে ধরনের কাজেরই দায়িত্ব দিয়েছে, যা তাদের ছাড়া আর কারোর করার সাধ্য নেই। সে কাজ যেন তারা অখণ্ড নির্লিপ্ততা ও নিষ্ঠাপূর্ণ মনোযোগ সহকারে সম্পন্ন করতে পারে, ইসলাম সে ধরনেরই পরিবার ও সমাজ কাঠামো পেশ করেছে, আইন বিধান দিয়েছে এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে বলেছে।
এ উদ্দেশ্যেই ইসলামের মৌলিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অনেক বাধ্যবাধকতা থেকে নারী সমাজকে এক প্রকার মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে জামা’আতে শরীক হয়ে পড়া এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কিন্তু নারীদের তা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে। তার মানে এ নয় যে, জামা’আতে নামায পড়ার ফযিলত ও অতিরিক্ত সওয়াব থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। বরং ঘরের নিভৃত কোণে বসে একান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে নামাজ পড়লেই তাদের সে ফযিলত লাভ হতে পারে বলে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে। (আরবী*********************)
অনুরূপ কারণে জুম’আর নামাযও মেয়েদের ওপর ফরয করা হয়নি। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
জুম’আর নামায জামা’আতের সাথে পড়া সব মুসলমানদের ওপরই ধার্য অধিকার –ফরয। তবে চার শ্রেণীর লোকদের তা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছেঃ ক্রীতদাস, মেয়েলোক, বালক ও রোগী।
আল্লামা খাত্তাবী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
মেয়েলোকদের ওপর জুম’আর নামায ফরয নয়, এ সম্পর্কে সব মাযহাবের ফিকাহবিদরাই সম্পূর্ণ একমত।
জানাযার নামাযে শরীক হওয়া এবং জানাযার সাথে কবরস্থানে গমন করা থেকেও মহিলাদের বিরত থাকতে বলা হয়েছে। যদিও জানাযা অনুসরণ করা মেয়েদের জন্যে হারাম নয়, মাকরূহ তানজীহী মাত্র। কাযী ইয়ায বলেছেনঃ বেশির ভাগ আলেমই মেয়েদের জানাযায় যেতে নিষেধ করেছেন। তবে মদীনার আলেমগণ অনুমতি দিয়েছেন এবং ইমাম মালিকও মনে করেন যে, অনুমতি আছে বটে, তবে যুবতী মেয়েদের জন্যে নৈতিক বিপদের আশংকায় তা অনুচিত। (আরবী**************)
হজ্জ ফরয হলেও একাকিনী হজ্জে গমন করতে মেয়েদের জন্যে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। এ থেকে ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা মেলে। মূলতগতভাবে মেয়েদের ওপর বাইরের কোনো কাজেরই দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়নি। কিন্তু তাই বলে তারা যদি নিজেদের পর্দা রক্ষা করে পারিবারিক স্বাভাবিক দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালন করার পরও সামাজিক কাজ করতে সমর্থ হয় তবে তাও নিষেধ নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে পূর্ণ ভারসাম্য Balance রক্ষা করাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত কঠিন কাজ। নারীদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ঘরে। তাই বলে ঘরের চার প্রাচীরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকবে, অবরুদ্ধ জীবন যাপন করবে, ইসলাম তা চায় না। নারদের ওপর প্রাথমিক ও স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের পর বাইরের সামাকি কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে, তাহলে ইসলাম তাতে বাধ সাধবে না। এভাবে উভয় দিকের সঙ্গে পূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই ইসলামের লক্ষ্য।
কিন্তু বর্তমানে সে ভারসাম্য ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। এ যাবত যারা কেবল ঘরের মধ্যে রয়েছে, তারা ঘরের বাইরে বের হওয়া এবং সামাজিক দায়িত্বে শরীক হওয়াকে সম্পূর্ণ হারাম বলে ধরে নিয়েছে। এক্ষণে যেসব মেয়েলোক ঘরের বাইরে আসতে শুরু করেছে, তারা পারিবারিক জীবনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলতে আরম্ভ করেছে। এক কালে মেয়েরা যেমন ছিল নিতান্ত পুরবাসিনী, একান্তই স্বামী অনুগতা, ঘর-গৃহস্থালী করা আর সন্তান গর্ভে ধারণ ও লালন-পালনই ছিল তাদের একমাত্র কাজ। বর্তমানে তেমনি ঘর ছেড়ে দিচ্ছে, স্বামী-আনুগত্য পরিহার করছে। ঘর-গৃহস্থালী করাকে দাসীবৃত্তি –অতএব পরিত্যাজ্য বলে মনে করছে। আর সন্তান গর্ভে ধারণের সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আজ গর্ভ নিরোধের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বদ্ধপরিকর হচ্ছে। পূর্ব অবস্থয় যেমন ইসলামী আদর্শের পূর্ণ স্ফূরণ হচ্ছিল না, তেমনি বর্তমান অবস্থায়ও কিছুমাত্র ইসলামী আদর্শানুরূপ নয়। দুটো অবস্থাই ভারসাম্য রহিত।
আজকের নারী ছাত্র-শিক্ষয়িত্রী, ডাক্তার-নার্স, ব্যবসায়ী-সেলসম্যান, নর্তকী-গায়িকা, রেডিও আটিষ্ট, ঘোষণাকারিণী, সমাজনেত্রী, রাজনীতি পার্টি কর্মী, সমাজ সেবিকা, উড়োজাহাজের হোস্টেস, বিদেশে রাষ্ট্রদূত, অফিসের ক্লার্ক আর কারখানার মজুর-শ্রমিক প্রভৃতি সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ও সর্বকাজেই অগ্রসর। কিন্তু এদিকে ঝুঁকে পড়ে তারা তাদের আসল কর্মক্ষেত্র থেকে একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে। বিশেষ কোনো পুরুষের স্ত্রী হয়ে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নতুন করে এক ভারসাম্যহীন জীবনধারার সূচনা হয়ে সামগ্রিক ক্ষেত্রে এনে দিচ্ছে এক সর্বাত্মক বিপর্যয়। ইউরোপের মহিরা সমাজ সর্বাগ্রে এদিকে পদক্ষেপ করেছে। এসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা একদিকে খুইয়েছে তাদের পারিবারিক জীবন কেন্দ্রের স্থিতি, আর অপর দিকে সর্বক্ষেত্রে ভিন পুরুষদের সাথে অবাধ মেলামেশা করে তারা হারিয়েছে তাদের নৈতিকতার অমূল্য সম্পদ। শুধু তাই নয়, তাদের নারীত্ব –মূলত সকল কোমলতা, মাধুর্য, শ্লীলতা-শালীনতা ও পবিত্রতা –খতম হয়ে গেছে, আর তারই ফলে গোটা মানব বংশকে তারা ঢেলে দিয়েছে এক মহাসংকটের মুখে।
প্রশ্ন হচ্ছে –নারীদেরও এসব ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া কি নিতান্তই অপরিহার্য ছিল? এমন অবস্থা কি নিশ্চয়ই দুনিয়ার কোনো দেশে কোনো সমাজেই দেখা দেয়নি যে, কর্মক্ষম পুরুসের অভাব পড়ে গেছে কিংবা কর্মক্ষম সব পুরুষের কর্মে নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে বিধায় নারীদেরও এ পথে টেনে আনতে হয়েছে। কিন্তু আসল ব্যাপার তা নয়। যেখানে যত নারীকেই বিভিন্ন সামাজিক কর্মে নিযুক্ত করা হয়েছে, সেখানেই দেখা গেছে যে, যে কোনো পুরুষকে এ কাজে নিয়োগ করা যেত অতি সহজে এবং শোভনীয়ও তাই ছিল। সামাজিক ক্ষেত্রের এমন কোনো কাজটির নাম করা যেতে পারে, যা যে কোনো পুরুষের দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে না? এতদসত্ত্বেও এসব ক্ষেত্রে নিয়োগ করে একদিকে যেমন র্কক্ষম পুরুষ শক্তির অপচয়ের কারণ ঘটানো হয়েছে, তেমনি অপরদিকে নারীদেরকে পুরুষদের কাছাকাছি ও পাশাপাশি থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত ধরে কাজ করতে বাধ্য করে উভয়ের নৈতিক শ্লীলতা বোধটুকুকেও চিরতরে খতম করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।
নারী-পুরুষের এরূপ অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দেয়ার পর নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করে নিজস্ব পারিবারিক জীবনের স্থিতি রক্ষা করে চলা কারো পক্ষেই সম্ভব হতে পারে না। না ইউরোপ-আমেরিকায় তা সম্ভব হয়েছে, না সম্ভব হচ্ছে বর্তমান এশিয়া ও আফ্রিকায়। এ ধরনের সমাজে কেবল নৈতিক বিপর্যয়ই পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠেনি, সুষ্ঠুভাবে গঠিত এবং সম্প্রীতি ও বাৎসল্যপূর্ণ পারিবারিক জীবনও ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। দুজন রেডিও আর্টিষ্ট, একজন চার সন্তানের পিতা আর একজন তিন সন্তানের জননী। রেডিও স্টেশনের পরিবেশে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্ত্রী-স্বামী ও নিষ্পাপ শিশু-সন্তানের কথা ভুলে গিয়ে নতুনভাবে মধুযামিনী যাপনে উদ্যোগী হতে দেখা গেছে। একই অফিসের দুই ক্লার্ক –নারী ও পুরুষ, পরস্পরের কাছে মজে গিয়ে নিজ নিজ পারিবারিক পবিত্র জীবনের কতা বিস্মৃত হয়েছে। এসব কাহিনীর সংখ্যা এত বেশি, যা নির্ধারণ করে সংকলিত করা সম্ভব নয়। তাই সুষ্ঠু ও নির্দোষ-নির্ভেজাল ও নির্লিপ্ত পারিবারিক জীবনের পক্ষে নারীদের ঘরের বাইরে সামাজিক কাজে-কর্মে যোগদান ও সেখানে ভিন পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগ যে অত্যন্ত মারাত্মক, তা আজনের সমাজতত্ত্ববিদ কোনো লোকই অস্বীকার করতে পারে না।
নারীরা কি শুধু সন্তান প্রজননের যন্ত্র বিশেষ, তাদের মধ্যে কি মনুষ্যত্ব নেই? …..তা যদি হবে, তাহলে তারা কেন কেবলমাত্র স্ত্রী হয়ে ঘরের কোণে বন্দী হয়ে থাকবে –অত্যাধুনিকা নারীদের সামনে এ প্রশ্ন অত্যন্ত জোরালো হয়ে দেখা দিয়েছে এবং এ প্রশ্ন করে নারী সমাজকে ঘায়েল করা আজ খুবই সহজ। নারীরা নিছক সন্তান প্রজননের যন্ত্র বিশেষ নয়, নয় তারা মানুষ ছাড়া আর কিছু –এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু এ ব্যাপারে ভাবাবেগ চালিত হওয়া বড়ই মারাত্মক। নারীরা কেবলমাত্র সন্তান প্রজননের যন্ত্র নয়, তারা আরো কিছু, সেই সঙ্গে সন্তান প্রজননের যন্ত্র যে কেবল সন্তান গর্ভে ধারণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে মানব বংশই যে লোপ পেয়ে যাবে। স্বভাবের তাগিদে সন্তান গর্ভে ধারণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে মানব বংশই যে লোপ পেয়ে যাবে। স্বভাবের তাগিদে যৌন মিলনে প্রস্তুত হওয়া যেমন সত্য, তেমনি সত্য যৌন মিলনের পরিণামে নারীদের গর্ভে সন্তানের সঞ্চার হওয়া। প্রথম ব্যাপারটিকে যদি অস্বীকার করা না যায় বা না হয়, তাহলে তার পরিণামকে অস্বীকার করা কি শুধু নারীত্বেরই নয়, মনুষ্যত্বেরও বিরোধিতা হবে না? হবে না কি তাদের অপমান? তাহলে ভাবাবেগ চালিত হয়ে এমন সব কাজে ও এমন সব ক্ষেত্রে নারীদের ঝাঁপিয়ে পড়া বা টেনে নেয়া –যেতে প্রলোভিত করা কি কখনো সমীচীন হতে পারে, যার দরুন যৌন মিলনের নিশ্চয়তা ও পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে, দেখা দিতে পারে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা এবং যার দরুন সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও পালনের সুষ্ঠুতা হবে ব্যাহত, বিঘ্নিত?
অতএব নারীকে তার আসল স্থানে প্রতিষ্ঠিত রাখার এবং যারা সেখান থেকে নির্মূল হয়েছে তাদের সেখানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাই হচ্ছে নারী কল্যাণের সর্বোত্তম ব্যবস্থা। তাই ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে “হে নারীরা! তোমরা তোমাদের ঘরকেই আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করো, তাকে কেন্দ্র করে জীবন গঠন করো, আর যত কাজই করো না কেন, তা তাকে বিঘ্নিত করে নয়, তাকে সঠিকভাবে রক্ষা করেই করবে।
অর্থোপার্জনে নারী
বর্তমান যুগ অর্থনৈতিক যুগ, অর্থের প্রয়োজন আজ যেন পূর্বাপেক্ষা অনেক গুণ বেশি বেড়ে গেছে। অর্থ ছাড়া এ যুগের জীবন ধারণ তো দূরের কথা, শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণও যেন সম্ভব নয় –এমনি এক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে জীবন ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে। তাই পরিবারের একজন লোকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকা, এক ব্যক্তির উপার্জনে গোটা পরিবারের সব রকমের প্রয়োজন পূরণ করা আজ যেন সুদূরপরাহত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের লোকদের মনোভাব এমনি। তারা মনে করে, জীবন বড় কঠিন, সংকটময়, সমস্যা সংকুল। তাই একজন পুরুষের উপার্জনের ওপর নির্ভর না করে ঘরের মেয়েদের-স্ত্রীদেরও উচিত অর্থোপার্জনের জন্যে বাইরে বেরিয়ে পড়া। এতে করে একদিকে পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে স্বামীর সাথে সহযোগিতা করা হবে, জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। অন্যথায় বেচারা স্বামীর একার পক্ষে সংসার তরণীকে সুষ্ঠুরূপে চালিয়ে নেয়া এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বেলাভূমে পৌঁছিয়ে দেয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না। আর অন্যদিকে নারীরাও কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের কর্মক্ষমতার স্ফূরণ ও বিকাশ সাধনের সুযোগ পাবে।
এ হচ্ছে আধুনিক সমাজের মনস্তত্ত্ব। এর আবেদন যে খুবই তীব্র আকর্ষণীয় ও অপ্রত্যাখ্যানীয়, তাতে সন্দেহ নেই। এরই ফলে আজ দেখা যাচ্ছে, দলে দলে মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। অফিসে, ব্যবসা কেন্দ্রে, হাসপাতালে, উড়োজাহাজে, রেডিও, টিভি স্টেশনে –সর্বত্রই আজ নারীদের প্রচণ্ড ভীড়।
এ সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন অত্যন্ত মৌলিক, একটি পারিবারিক-সামাজিক ও নৈতিক আর দ্বিতীয়টি নিতান্তই অর্থনৈতিক।
নারী সমাজ আজ যে ঘর ছেড়ে অর্থোপার্জন কেন্দ্রসমূহে ভীড় জমাচ্ছে, তার বাস্তব ফলটা যে কী হচ্ছে তা আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। পরিবারের মেয়েরা নিজেদের শিশু সন্তানকে ঘরে রেখে দিয়ে কিংবা ধাত্রী বা চাকর-চাকরাণীর হাতে সঁপে দিয়ে অফিসে, বিপণীতে উপস্থিত হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে –দিন রাতের প্রায় সময়ই –শিশু সন্তানরা মায়ের স্নেহমায়া থেকে বঞ্চিত থাকবে বাধ্য হচ্ছে আর তারা প্রকৃতপক্ষে লালিত-পালিত হচ্ছে ধাত্রীর হাতে, চাকর-চাকরাণীর হাতে। ধাত্রী আর চাকর-চাকরাণীরা যে সন্তানের মা নয়, মায়ের কর্তব্য সঠিকবাবে পালন করাও তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয় –এ কতা যুক্তি দিয়ে বোঝাবার প্রয়োজন করে না অথচ ছোট ছোট মানব শিশুদের পক্ষে মানুষ হিসেবে লালিত-পালিত হওয়ার জন্যে সবচাইতে বেশি প্রয়োজনীয় হচ্ছে মায়ের স্নেহ-দরদ ও বাৎসল্যপূর্ণ ক্রোড়।
অপরদিকে স্বামীও উপার্জনের জন্যে বের হয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে স্ত্রীও। স্বামী এক অফিসে, স্ত্রী অপর অফিসে, স্বামী এক কারখানায়, স্ত্রী অপর কারখানায়। স্বামী এক দোকানে, স্ত্রী অপর এক দোকানে। স্বামী এক জায়গায় ভিন মেয়েদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে কাজ করছে আর স্ত্রী অপর এক স্থানে ভিন পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রুজি-রোজগারে ব্যস্ত হয়ে আছে। জীবনে একটি বৃহত্তম ক্ষেত্রে স্বামী আর স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের বন্ধনে ফাঁটল ধরা –ছেদ আসা যে অতি স্বাভাবিক তা বলে বোঝাবার অপেক্ষা রাখে না। এতে করে না স্বামীত্ব রক্ষা পায়, না থাকে স্ত্রীর সতীত্ব। উভয়ই অর্থনৈতিক প্রয়োজনের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল এবং প্রত্যেকেরই মনস্তত্ব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবধারায় চালিত ও প্রতিফলিত হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। অতঃপর বাকি থাকে শুধু যৌন মিলনের প্রয়োজন পূরণ করার কাজটুকু। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভের পর এ সাধারণ কাজে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হওয়া –বিশেষত বাইরে যখন সুযোগ-সুবিধার কোনো অবধি নেই –তখন একান্তই অবাস্তব ব্যাপার। বস্তুত এরূপ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আকর্ষণ ক্ষীণ হয়ে আসতে বাধ্য। অতঃপর এমন অবস্থা দেখা দেবে, যখন পরিচয়ের ক্ষেত্রে তারা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী হলেও কার্যত তারা এক ঘরে রাত্রি যাপনকারী দুই নারী পুরুষ মাত্র। আর শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তাদের ক্ষেত্রে বিচিত্র কিছু নয়। পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি, নির্লিপ্ততা, গভীর প্রেম-ভালোবাসা শূন্য হয়ে এরা বাস্তব ক্ষেত্রে অর্থোপার্জনে যন্ত্র বিশেষে পরিণত হয়ে পড়ে। এ ধরনের জীবন যাপনের এ এক অতি স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়।
একথা সুস্পষ্ট যে, যৌন মিলনের স্বাদ যদিও নারী পুরুষ উভয়েই ভোগ করে, কিন্তু তার বাস্তব পরিণাম ভোগ করতে হয় কেবলমাত্র স্ত্রীকেই। স্ত্রীর গর্ভেই সন্তান সঞ্চারিত হয়। দশ মাস দশ দিন পর্যন্ত বহু কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ সহকারে সন্তান গর্ভে ধারণ করে তাকেই চলতে হয়, সন্তান প্রসব এবং তজ্জতিন কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ তাকেই পোহাতে হয়। আর এ সন্তানের জন্যে স্রষ্টার তৈরী খাদ্য সন্তান জন্মের সময় থেকে কেবলমাত্র তারই স্তনে এসে হয় পুঞ্জীভূত। কিন্তু পুরুষ এসব কিছু থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। জনেন্দ্রিয়ে শুক্রকীট প্রবিষ্ট করানোর পর মানব সৃষ্টির ব্যাপারে পুরুষকে আর কোনো দায়িত্বই পালন করতে হয় না। এ এক স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যাপার, যৌন মিলনকারী কোনো নারীই এ থেকে রেহাই পেতে পারে না।–[বর্তমানে গর্ভ ধারনের এ ঝামেলা থেকে তাদের মুক্ত রাখার জন্যেই আবিস্কৃত ও উৎপাদিত হয়েছে জন্মনিরোধের যাবতীয় আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম। তার সফল ব্যবহার যেসব নারী সক্ষম হয়, কেবল তারাই গর্ভ ধারণ থেকে নিষ্কৃত পেয়ে যায়] এখন এহেন নারীকে যদি পরিবারের জন্যে উপার্জনের কাজেও নেমে যেতে হয়, তাহলে তাকে কতখানি কষ্টদায়ক, কত মর্মান্তিক এবং নারী সমাজের প্রতি কত সাংঘাতিক জুলুম, তা পুরুষরা না বুঝলেও অন্তত নারী সমাজের তা উপলব্ধি করা উচিত।
পারিবারিক জীবনের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ দুটো। একটি হচ্ছে পরিবারের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ আর অপরটি হচ্ছে মানব বংশের ভবিষ্যৎ রক্ষা। দ্বিতীয় কাজটি যে প্রধানত নারীকেই করতে হয় এবং সে ব্যাপারে পুরুষের করণীয় খুবই সামান্য আর তাতেও কষ্ট কিছুই নেই, আছে আনন্দ-সুখ ও স্ফুর্তি, এ তো সুস্পষ্ট কথা। তা হলে যে নারীকে মানব বংশের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্যে এতো দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে, তাকেই কেন আবার অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব বহন করতে হবে? এটা কোন ধরনের ইনসাফ! দুটো কাজের একটি কাজ যে স্বাভাবিক নিয়মে একজনের ওপর বর্তিয়েছে, ঠিক সেই স্বাভাবিক নিয়মেই কি অপর কাজটি অপর জনের ওপর বর্তাবে না? নারীরাই বা এ দুধরনের কাজের বোঝা নিজেদের স্কন্ধে টেনে নিতে ও বয়ে বেড়াতে রাজি হচ্ছে কেন?
ইসলাম এ না-ইনসাফী করতে রাজি নয়। তাই ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থায় গোটা পরিবারের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব একমাত্র পুরষের। দুটি কাজ দু’জনের মধ্যে যে স্বাভাবিক নিয়মে বণ্টিত হয়ে আছে ইসলাম সে স্বাভাবিক বণ্টনকেই মেনে নিয়েছে। শুধু মেনে নেয়নি, সে বণ্টনকে স্বাভাবিক বণ্টন হিসাবে স্বীকার করে নেয়ায়ই বিশ্বমানবতার চিরকল্যাণ নিহিত বলে ঘোষণাও করেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী মহাসম্মানিত মানুষ, তাদরে নারীত্ব হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে সম্মানার্হ। আল্লাহ তা’আলা তাদের এ সম্মান ও মর্যাদা নিহিত রেখেছেন তাদের কাছে অর্পিত বিশেষ আমানতকে সঠিকভাবে রক্ষার কাজে। এতেই তাদের কল্যাণ, গোটা মানবতার কল্যাণ ও সৌভাগ্য। নারীর কাছে অর্পিত এ আমানত সে রক্ষা করতে পারে কোনো পুরুষের স্ত্রী হয়ে, গৃহকর্ত্রী হয়ে, মা হয়ে। এ ক্ষেত্রেই তার প্রকৃত ও স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব। নারীকে যদি পরিবারের সুরক্ষিত ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়, যদি দেয়া যায় তার সব অধিকার, সঠিক মর্যাদা যথাযথভাবে ও পরিপূর্ণ মাত্রায়, তবেই নারীর জীবন সুখ-সম্ভারে সমৃদ্ধ হতে পারে। নারী যদি সফল স্ত্রী হতে পারে, তবেই সে হতে পারে মানব সমাজের সর্বাধিক মূল্যবান ও সম্মানীয় সম্পদ। তখন তার দরুন একটা ঘর ও সংসারই শুধু প্রতিষ্ঠিত ও ফুলে ফলে সুশোভিত হবে না, গোটা মানব সমাজও হবে যারপরনাইভাবে উপকৃত।
অনুরূপভাবে নারী যদি মা হতে পারে, তবে তার স্থান হবে সমাজ-মানবের শীর্ষস্থানে। তখন তার খেদমত করা, তার কথা মান্য করার ওপরই নির্ভরশীল হবে ছেলে সন্তানদের জান্নাত লাভ। ‘মায়ের পায়ের তলায়ই রয়েছে সন্তানের বেহেশত’।
নারীকে এ সম্মান ও সৌভাগ্যের পবিত্র পরিবেশ থেকে টেনে বের করলে তার মারাত্মক অকল্যাণই সাধিত হবে, কোনো কল্যাণই তার হবে না তাতে।
তবে একথাও নয় যে, নারী অর্থোপার্জনের কোনো কাজই করতে পারবে না। পারবে, কিন্তু স্ত্রী হিসেবে তার সব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার পর; তাকে উপেক্ষা করে, পরিহার করে নয়।
ঘরের মধ্যে থেকেও মেয়েরা অর্থোপার্জনের অনেক কাজ করতে পারে এবং তা করে স্বামীর দুর্বহ বোঝাকে পারে অনেকখানি হালকা বা লাঘব করতে। কিন্তু এটা তার দায়িত্ব নয়, এ হবে তার স্বামী-প্রীতির অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
কিন্তু আবার স্মরণ করতে হবে যে, সফল স্ত্রী হওয়াই নারী জীবনের আসল সাফল্য। সে যদি ঘরে থেকে ঘরের ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুরূপে চালাতে পারে, সন্তান লালন-পালন, সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষাদান, সামান্য ও সাধারণ রোগের চিকিৎসার প্রয়োজনও পূরণ করতে পারে, তবে স্বামী-প্রীতি আর স্বামীর সাথে সহযোগিতা এর চাইতে বড় কিছু হতে পারে না। স্বামী যদি স্ত্রীর দিক দিয়ে পূর্ণ পরিতৃপ্ত হতে পারে, ঘরের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় কাজ-কর্ম সম্পর্কে হতে পারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত, তাহলে সে বুকভরা উদ্দীপনা আর আনন্দ সহকারে দ্বিগুণ কাজ করতে পারবে। স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতা এর চাইতে বড় আর কি হতে পারে।
নারী স্ত্রী হয়ে কেবল সন্তান উৎপাদনের নির্জিব কারখানাই হয় না, সে হয় সব প্রেম-ভালোবাসা ও স্নেহ মমতার প্রধান উৎস, স্বামী ও পুত্র কন্যা সমৃদ্ধ একটি পরিবারের কেন্দ্রস্থল। বাইরের ধন-ঐশ্বর্যের ঝংকার অতিশয় সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের চাকচিক্য আর হাস্য-লাস্যের চমক-ঠমক, গৃহাভ্যন্তরস্থ এ নিবিড় সুখ ও শান্তির তুলনায় একেবারেই তুচ্ছ, অতিশয় হীন ও নগণ্য। এ দুয়ের মাঝে কোনো তুলনাই হতে পারে না।
আজকের দিনে যেসব নারী গৃহকেন্দ্র থেকে নির্মূল হয়ে বাইরে বের হয়ে পড়েছে, আর ছিন্ন পত্রের মতো বায়ূর দোলায় এদিক থেকে সেদিকে উড়ে চলেছে, আর যার কাছে হচ্ছে ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা –তারা কি পেয়েছে কোথাও নারীত্বের অতুলনীয় সম্মান? পেয়েছে কি মনের সুখ ও শান্তি? যে টুপি অল্প মূল্যের হয়েও মাথায় চড়ে শোভাবর্ধন করতে পারে, তা যদি স্থানচ্যুত হয়ে যায়, তবে ধূলায় লুণ্ঠিত ও পদদলিত হওয়া ছাড়া তার কি গতি হতে পারে?
বস্তুত বিশ্বমানবতার বৃহত্তম কল্যাণ ও খেদমতের কাজ নারী নিজ গৃহাভ্যন্তরে থেকেই সম্পন্ন করতে পারে। স্বামীর সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম সাথী হওয়া, স্বামীর হতাশাগ্রস্থ হৃদয়কে আশা আকাংক্ষায় ভরে দেয়া এবং ভবিষ্যৎ মানব সমাজকে সুষ্ঠুরূপে গড়ে তোলার কাজ একজন নারীর পক্ষে এ ঘরের মধ্যে অবস্থান করেই সম্ভব। আর প্রকৃত বিচারে এই হচ্ছে নারীর সবচাইতে বড় কাজ। এতে না আছে কোনো অসম্মান, না আছে লজ্জা ও লাঞ্ছনার কোনো ব্যাপার। আর সত্যি কথা এই যে, বিশ্বমানবতার এতদাপেক্ষা বড় কোনো খেদমতের কথা চিন্তাই করা যায় না। এ কালের যেসব নারী এ কাজ করতে রাজি নয় আর যে সব পুরুষ নারীদের এ কাজ থেকে ছাড়িয়ে অফিসে কারখানায় আর হোটেল-রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায়, তাদের চিন্তা করা উচিত, তাদের মায়েরাও যদি এ কাজ করতে রাজি না হতো, তাহলে এ নারী ও পুরুষদের দুনিয়ায় আসা ও বেঁচে থাকাই হতো সম্পূর্ণ অসম্ভব।
তাই ইসলাম নারীদের ওপর অর্থোপার্জনের দায়িত্ব দেয়নি, দেয়নি পরিবার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের কর্তব্য। তা সত্ত্বেও যে নারী গৃহকেন্দ্র অস্বীকার করে বাইরে বের হয়ে আসে, মনে করতে হবে তার শুধু রুচিই বিকৃত হয়নি, সুস্থ মানসিকতা থেকেও সে বঞ্চিতা।
সামাজিক ও জাতীয় কাজে-কর্মে নারী-বিনিয়োগের ব্যাপারটি কম রহস্যজনক নয়। এ ধরনের কোনো কাজে নারী-বিনিয়োগের প্রশ্ন আসতে পারে তখন, যখন সমাজের পুরুষ শক্তিকে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। তার পূর্বে পুরুষ-শক্তিকে বেকার করে রেখে নারী নিয়োগ করা হলে, না বেকার সমস্যা সমাধান হতে পারে, না পারে নতুন দাম্পত্য জীবনের সূচনা, নতুন ঘর-সংসার ও পরিবারের ভিত্তি স্থাপিত করতে। কেননা সাধারণত কোনো সভ্য সমাজেই নারীর রোজগার করে পুরুষদের খাওয়ায় না, পুরুষরাই বরং নারীদের ওপর ঘর-সংসারের কাজ-কর্ম ও লালন-পালনের ভার দিয়ে তাদের যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। বিশেষত পুরুষরা যদি বাইরের সমাজের কাজ না করবে, জরুরী-রোজগারের কাজে না লাগবে, তাহলে তারা করবেটা কি! স্ত্রীর রোজগারে যেসব পুরুষ বসে খায়, তারা নিষ্কর্মা থেকে কর্মশক্তির অপচয় করে। এভাবে নারীর পরিবর্তে পুরুষকে নিয়োগ করা হলে একদিকে যেমন জাতির বৃহত্তর কর্মশক্তির সঠিক প্রয়োগ হবে, বেকার সমস্যার সমাধান হবে, তেমনি হবে নতুন দম্পতি ও নতুন ঘর-সংসার-পরিবার প্রতিষ্ঠা। এক-একজন পুরুষের উপার্জনে খেয়ে পরে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারবে বহু নর, নারী, শিশু। এতে করে পুরুষদের কর্মশক্তির যেমন হবে সুষ্ঠু প্রয়োগ, তেমনি নারীরাও পাবে তাদের স্বভাব-প্রকৃতি ও রুচি-মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ। এভঅবেই নারী আর পুরুষরা বাস্তবভাবে হতে পারে সমাক শংকটের সমান ভারপ্রাপ্ত চাকা। যে সমাজে এরূপ ভারসাম্য স্থাপিত হয়, সে সমাজ শকট (গাড়ি) যে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে ও দ্রুতগতিতে মঞ্জিলে মকসুদ পানে ধাবিত হতে পারে, পারে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির উচ্চমত প্রকোষ্ঠে আরোহণ করতে, তা কোনো সমাজ অর্থনীতিবিদই অস্বীকার করতে পারেনা।
তাই এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে যে, সামাজিক ও জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে নারীদের ভীড় জমানো কোনো কল্যাণই বহন করে আনতে পারে না –না সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিতে, না নিতান্ত অর্থনৈতিক বিচারে।
এ নীতিগত আলোচনার প্রেক্ষিতে আধুনিক ইউরোপের এক বাস্তব দৃষ্টান্ত পেশ করা কম রুচিকর হবেনা।
এক বিশেষ রিপোর্ট থেকে জানা গেছে যে, লণ্ডন শহরে ৭৫৭৩টি পানশালা রয়েছে। আর সেখানে কেবল মদ্যপায়ী পুরুষরাই ভীড় জমায় না, বিলাস-স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া বহু নারীও সেখানে পদধুলি দিতে কসুর করে না। লন্ডনে নারী মদ্যপায়িনীর সংখ্যা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বর্তমানে তাদের জন্যে বিশেষ পানশালা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। কিন্তু নারীদের জন্যে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত এ পানশালা সমূহে কেবলমাত্র সাদাসিধে গৃহকর্ত্রীরাই এসে থাকে। বিলাসী যুবতী ও চটকদার সিক মেয়েরা কিন্তু সাধারণ পানশালাতেই উপস্থিত হয়। নারীদের মদ্যপান স্পৃহার এ তীব্রতা প্রথমে গুরুতর বলে মনে করা হয়নি। বরং মনে করা হয়েছে, তাদের এ কাজ থেকে বিরত রাখতে চাইরে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে। কিন্তু মদাসক্ত ও অভ্যস্ত মদ্যপায়িনী নারীদের স্বামীর এখন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। তারা তাদের স্ত্রীদের এ মদাসক্তির ফলে তাদের দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন ধ্বংশোন্মখ হতে দেখতে পাচ্ছে। তারা অনুভব করছে –পুরুষদের তুলনায় নারীরা অধিক আবেগপ্রবণ ও অটল স্বভাবের হয়ে থাকে। ফলে তারা খুব সহজেই অভ্যস্ত মদ্যপায়িনীতে পরিণত হচ্ছে। আর তাদের স্বাস্থ্য বিনষ্ট হচ্ছে, পারিবারিক বাজেট শূন্য হয়ে যাচ্ছে এবং সর্বোপরি ঘর-সংসারের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে।
এ মদ্যপায়ী নারীদের অধিকাংশই হচ্ছে তারা, যারা শহরের বিভিন্ন অফিসে নানা কাজে নিযুক্ত রয়েছে। তাদের অফিস গমনের ফলে অফিসের নির্দিষ্ট সময় তাদের ঘর-সংসার তাদের প্রত্যক্ষ দেখাশোনা, পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। অফিসের সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে তারা পানশালায় গমন করে। আর রাতের বেশির ভাগ সময়ই তারা অতিবাহিত করে মদের নেশায় মত্ত হয়ে। ফলে না থাকে তাদের স্বামীদের প্রতি কোনো আগ্রহ আকর্ষণ ও কৌতুহল, না শিশু সন্তানদের জন্য কোনো মায়া-মমতা তাদের মনে।
এসব স্ত্রী স্বামীরই নিজেদের সন্ধ্যাকালীন ও নৈশ একাকীত্ব ও নিঃসংগতাকে ভরে তোলে, সরল ও রঙীন করে তোলে নৈশ ক্লাবে গমন করে। ফলে এদের সন্তানদের মনে মা-বাবা ও নৈতিক মূল্যমানের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাভক্তি থাকতে পারে না। বর্তমান ইউরোপের নতুন বংশধররা যে সামাজিক পারিবারিক বন্ধনের বিদ্রোহী হয়ে উঠছে, শত্রু হয়ে উঠছে নৈতিকতা শালীনতা পবিত্রতার, আসলে তারা পূর্বোক্ত ধরনের মদ্যপায়ী মা-বাবার ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেছে। বর্তমান ইউরোপ এ ধরনের নৈতিকতার সব বাঁধন বিধ্বংসী ময়লার স্রোতে রসাতলে ভেসে যাচ্ছে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় সম্পদ শক্তি এটম বোমা ও হাইড্রোজেন বোমাও এ স্রোতকে রুখতে পারে না, ঠেকাতে পারে না ইউরোপ-আমেরিকার নিশ্চিত ধ্বংসকে। (দৈনিক কুহিস্তান, লাহোর, দৈনিক দাওয়াত, দিল্লী-১৩-৪-৬৫ইং)
রাজনীতি ও নারী সমাজ
রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারসমূহ মানব সমাজের জন্যে সাধারণভাবেই অত্যন্ত জরুরী এবং অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামের প্রাথমিক যুগে পুরুষদের সমান মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও নারী সমাজ প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অংশ গ্রহণ করেছে বলে কোনো প্রমাণ নেই। রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকালের পরে পরে সাকীফার বনী সায়েদার অনুষ্ঠিত খলীফা নির্বাগচনী সভায় মহিলারা যোগদান করেছে বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়নি। খুলাফায়ে রাশেদুনও নির্বাচনী সভায় মহিলারা যোগদান করেছে বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়নি। খুলাফায়ে রাশেদুনের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারাদি মীমাংসার্থে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভাসমূহেও নারী সমাজের সক্রিয়ভাবে যোগদানের কোনো উল্লেখ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দেকতে পাওয়া যায় নি। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জটিলতার বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে –এমন কথাও কেউ বলতে পারবে না।
অথচ ইতিহাসে –কেবল ইতিহাসে কেন, কুরআন মজীদেও –এ কথার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় যে, নবী করীম (স) পুরুষদের ন্যায় স্ত্রীলোকদের নিকট থেকেও ঈমান ও ইসলামী আদর্শানুযায়ী জীবন যাপনের ‘বায়’আত’ –ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি –গ্রহণ করেছেন। মক্কা বিজয়ের দিন এরূপ এক ‘বায়’আত’ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ ‘বায়’আতে’ নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই অংশ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসব কথাকে যারা ‘মেয়েরাও রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেছে’ বলে প্রমাণ হিসাবে পেশ করতে চান, তারা মরুভূমির বুকের ওপর নৌকা চালাতে চান, বলা যেতে পারে।
ইতিহাসে এ কথার উল্লেখ অবশ্যই পাওয়া যায় যে, রাসূলের জামানায় পুরুষদের মতোই কিছু সংখ্যক মহিলা সাহাবীও রাসূলে করীম (স)-এর অনুমতিক্রমেই যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে তাঁরা যোদ্ধাদের পানি পান করানোর কাজ করেছেন, নানা খেদমত করেছেন। নিহত ও আহতদের বহন করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তারা তাদের সেবা-শুশ্রুষা করেছেন। রুবাই বিনত মুয়াকেয (রা) বলেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
আমরা মেয়েরা রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে যুদ্ধে গমন করেছি। আমরা সেখানে লোকদের পানি পান করানো, খেদমত ও সেবা-শুশ্রূষা ও নিহত-আহতদের মদীনায় নিয়ে আসার কাজ করতাম।
হযরত উম্মে আতীয়াতা আনসারী বলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
আমি রাসূলে করীম (স)-এর সাথে একে একে সাতটি যুদ্ধে যোগদান করেছি। আমি পুরুষদের পিছনে তাদের জন্তুযানে বসে থাকতাম, তাদের জন্যে খাবার তৈরী করতাম, আহতদের ঔষধ খাওয়াতাম ও রোগাক্রান্তদের সেবা-শুশ্রূষা করতাম।
হুনাইনের যুদ্ধে হযরত উম্মে সুলাইম খঞ্জর নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। হযরত আনাস (রা) বলেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
উম্মে সুলাইম হুনাইন যুদ্ধের দিন খঞ্জর হস্তে ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কে প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ
(আরবী**********************************************************************)
রাসূলে করীম (স) কি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে গমন করতেন?
জবাবে তিনি জানিয়েছিলেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন। মেয়েরা সেখানে আহতদের ঔষধ দেয়ার কাজ করত।
অনেক সময় যুদ্ধের ময়দানের একদিকে তাঁবু ফেলা হতো এবং তাতে মেয়েরা অবস্থান করত। কেউ অসুস্থ বা আহত হলে তাকে সেখানে স্থানান্তরিত করার জন্যে রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিতেন।
ঐতিহাসিক এবং প্রামাণ্য হাদীসের কিতাবে এ সব ঘটনার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু তা থেকে একথা প্রমাণিত হয় না যে, ইসলামী সমাজে মহিলাদের পক্ষে প্রকাশ্য রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে যোগদান করা শরীয়তসম্মত। এ থেকে যা কিছু প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে কেবলমাত্র জরুরী পরিস্থিতিতে –যুদ্ধ জিহাদে সাধারণ ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর, গোটা সমাজ ও জাতি যখন জীবন মরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে, তখন পুরুষদের সঙ্গে মেয়েদেরও কর্তব তার মুকাবিলা করার জন্যে বের হয়ে পড়া। আর ঠিক এরূপ পরিস্থিতিতে এহেন কঠিন সংকটপূর্ণ সময়ে –তা যখনই যেখানে এবং ইতিহাসের যে কোনো স্তরেই হোক না কেন –নারীদের কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া অপরিহার্য এবং ইসলামী শরীয়তেও তা জায়েয, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এ হচ্ছে নিতান্তই জরুরী পরিস্থিতির (Emergency time) ব্যাপার এবং জরুরী পরিস্থিতি হচ্ছে বিশেষ extraordinary situation) আর বিশেষ পরিস্থিতি যেমস সাধারণ পরিস্থিত নয়, তেমনি বিশেষ পরিস্থিতি যা কিছু সঙ্গত, যা করতে মানুষ বাধ্য হয়, না করে উপায় থাকে না, তা সাধারণ পরিস্থিতিতে করা কিংবা তা করার জন্যে আবদার করা কিছুতেই সঙ্গত হতে পারে না, যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।
উপরোক্ত ঐতিহাসিক দলীল থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে মুসলিম মহিলারা যোগদান করেছেন, যুদ্ধের ময়দানে তারা আলাদাভাবে পুরুষদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেছেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তারা পুরুষদের সঙ্গে দুধে-কলায় মিশে একাকার হওয়ার মতো অবস্থায় পড়েনি, পড়তে রাজি হন নি। তাঁরা রোগী ও আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেণ, ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়েছেন, ব্যান্ডেজ বেঁধেছেন আর এসবই তারা করেছেন যুদ্ধের সময়, যুদ্ধের ময়দানে, নিতান্ত জরুরী পরিস্থিতিতে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সকল কালের মুসলিম মহিলাদের পক্ষে যে বিশেষ ধরনের কাজ করা সঙ্গত, আজও এ নিয়মে কোনোরূপ রদবদল করার প্রয়োজন নেই, কোনো দিনই সে প্রয়োজন দেখা দেবে না, কেউ সে কাজ করতে নিষেধও করবে না। কিন্তু এ সময়ের দোহাই দিয়ে সাধারণভাবে মেয়েদেরকে রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রীয় তথা সামাজিক জটিল ব্যাপারাদিতে টেনে আনতে চেষ্টা করলে তা যেমন অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, তেমনি তার পরিণামও কখনো শুভ হতে পারে না।
আমরা এও জানি, ইসলামের প্রথম পর্যায়ে মেয়েরাও পুরুষদের ন্যায় বিরাট কুরবানী দিয়েছেন। দৈহিক, মানসিক ও আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যার কোনো তুলনা হয় না। তাঁরা মেয়ে মহলে ইসলাম প্রচারের কাজও করেছেন, এখনো করবেন –করতে কোনোই বাধা নেই; বরং এজন্যে দেয়া নির্দেশ চিরদিনই বহাল থাকবে। কিন্তু তাইবলে তাদের প্রকাশ্য রাজনীতির ময়দানে টেনে আনা, রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্ম তৎপরতায় শরীক করা কিছুতেই সমীচীন হতে পারে না। কেননা তা করতে গেলে তাদের দ্বারা পারিবারিক জীবনের গুরুদায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না। আর মেয়েদের বৃহত্তম দায়িত্ব হচ্ছে পারিবারিক দায়িত্ব পালন। যে কাজে তা যথাযথভাবে পালন করা নিশ্চিতভাবে বিঘ্নিত হবে, তা করতে যাওয়া নারী জাতির নারীত্বেরই চরম অবমাননা, সন্দেহ নেই।
রাসূলের যামানায় মেয়েরাও ঈদের জামা’আতে শরীক হয়েছে, রাসূলে করীমের ওয়ায-নসীহত শোনবার জন্যে উপস্থিত হয়েছে, -এখনো এ কাজ হতে পারে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেই মেয়েরা যেমন পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রয়েছে, তেমনি পর্দা ব্যাহত হতে পারে –এমনভাবে আজো করা চলবে না।
যুদ্ধের ময়দানে মেয়েরা গিয়েছে, নার্সিং, সেবা-শুশ্রূষার কাজ করেছে, ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধেছে, কিন্তু প্রত্যেক মেয়েই করেছে তার নিজস্ব মুহাররম পুরুষের। আর ভিন পুরুষের মধ্যেও তা করে থাকলে তাতে তার পর্দার হুকুম অমান্য হতে দেয়নি। আল্লামা নববী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
মেয়েদের এ ঔষধ খাওয়ানো বা লাগানোর কাজ হতো তাদের মুহাররম পুরুষদের জন্যে –তাদের স্বামীদের জন্যে। এদের ছাড়া আর কারো জন্যে তা করা হলে তা স্পর্শকে এড়েয় চলা হয়েছে। আর স্পর্শ করতে হলেও নিতান্ত প্রয়োজনীয় স্থানে করা হয়েছে।
একথাও ইতিহাস প্রসিদ্ধ যে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) ‘জামাল’ যুদ্ধে এক পক্ষের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এ সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, তিনি তা করেছেন উষ্টের পৃষ্টে ‘হাওদাজের’ মধ্যে বসে পর্দার অন্তরালে থেকে। প্রকাশ্যভাবে পুরুষদের সামনে তিনি বের হন নি, তাদের সঙ্গে তিনি খোলামেলাভাবে মিলিতও হন নি।
দ্বিতীয়ত তিনি যা কিছু করেছিলেন, পরবর্তী জীবনে তিনি নিজেই সে সম্পর্কে গভীরভাবে অনুতাপ করেছেন। কেননা প্রথম নারী আর দ্বিতীয়ত রাসূলের বেগম হিসেবে তাঁর ঘর ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে বের হয়ে পড়া সঙ্গত ছিল না। এজন্যে তিনি আল্লাহর কাছে দোষ স্কীকার করে তওবাও করেছেন।
কাজেই তাঁর এ কাজকে একটি প্রমাণ বা দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে না এবং এর ভিত্তিতে বলা যেতে পারে না যে, মেয়েরাও রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ঝামেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কেননা এ হচ্ছে একটি দুর্ঘটনা, একটি ভুল –ভুলবশত করা একটি কাজ। আর তা থেকে কখনো সাধারন নীতি প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে না।
ইসলাম ও মুসলিম জাতির ইতিহাসে এমন সব অধ্যায়ও অতিবাহিত হয়েছে, যখন মেয়েলোক কোনো রাষ্ট্রের কর্ত্রী হয়ে বসেছেন। এঁদের অনেকে আবার তাদের স্বামীদের ওপর প্রভাব ব্সিতার করে রাজ্য শাসনের কর্তৃত্ব দখল করেছে। শিজরাতুল-দূর ও হারুন-অর রশীদের স্ত্রী জুবায়দার নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে।
কিন্তু এসবও নিতান্তই আকস্মিক ও অসাধারণ ব্যাপার, সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিশেষ। তাদের এ কাজ ইসলামী শরীয়তের দলীল হতে পারে না। কেননা প্রথমত স্বামীর ওপর প্রভাবের ফলেই তা হওয়া সম্ভব হয়েছিল, সরাসরি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের ফলে নয়। অথচ আজকের দিনের রাজীনতে তারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করছে। দ্বিতীয়ত কোনো মুসলিমের শরীয়ত বিরোধী কাজের অনুসরণ করতে মুসলমানরা বাধ্য নন।
এ আলোচনার ফলে এ কথাই প্রমাণিত হলো যে, মুসলিম মহিলাদের রাজনীতিতে কার্যত অংশ গ্রহণ সঙ্গত নয়, সমীচীন নয়। নয় বলেই অতীত ইতিহাসে মেয়েদেরকে রাজনীতির ঝামেলা-জটিলতা পড়তে দেখা যায়নি। কিন্তু কেন? ইসলাম নারীদের মর্যাদা উন্নত করেছে, পুরুষদের দাসত্ববৃত্তি থেকে তাদের চিরদিনের তরে মুক্তি দিয়েছে। তা সত্ত্বেও এরূপ হওয়ার কারণ কি?
ইসলাম মহিলাদের হারানো সব অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে, উপযুক্ত মানবীয় মর্যাদা দিয়ে তাদের সুপ্রতিষ্টিত করেছে সমাজের ওপর, পুরুষের সমান মৌলিক অধিকার দিয়েছে –এ সবই সত্য; কিন্তু এতদসত্ত্বেও ইসলামী রাজনীতির ঝামেলা-সংকুল জটিলতা থেকে মহিলাদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখাতেই নিজেদের, জাতির এবং গোটা মানব সমাজের কল্যাণ মনে করেছে। এ কারণেই তাদের ওপর অর্থোপার্জনের দায়িত্ব চাপানো হয়নি, বরং তা পিতা, ভাই, স্বামী, পুত্র ও নিকটাত্মীয় মুরব্বী গার্জিয়ানের উপর অর্পন করা হয়েছে। যদিও ক্রয়-বিক্রয় ও কামাই-রোজগার করার যোগ্যতা সম্পূর্ণভাবে তাদের রয়েছে এবং কাজ হিসেবে এগুলো কোনো অন্যায় বা নাজায়েয কিছু নয়, তবুও মেয়েদেরকে এসব ব্যাপারের দায়িত্ব দিয়ে পারিবারিক জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা, পবিত্র-সমৃদ্ধি বিনষ্ট করতে ইসলাম রাজি নয়। নারী পিতা ও ভাইয়ের আশ্রয়ে লালিতা-পালিতা হবে এবং স্বামীর ঘর করার জন্যে তৈরী হবে দেহ ও মনে। বিয়ের পর সে হবে স্বামীর ঘরের রাণী, কর্ত্রী, সন্তানের স্নেহের পাত্রী, আদরের ধন। আর স্বামীর ঘরের সে দয়ার পাত্রী নয় কারো। সে পালন করবে তার নিজের দায়িত্ব আর স্বামী পালন করবে তার নিজের দায়িত্ব। সে আদায় করবে স্বামীর অধিকার। ফলে তা মনিবী আর দাসত্বের ব্যাপার হয় না, হয় দুই সমান সত্তার পারস্পরিক অধিকার আদায়ের অংশীদারিত্ব। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তিও এখানেই নিহিত। ঘর ত্যাগ করে বাইরে বের হয়ে অপর কারো কাছে চাকরি-বাকরি করে নির্দিষ্ট পরিমাণে কিছু টাকা মাসান্তর নিজ হাতে পাওয়াই নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি সাধিত হতে পারে না। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি বলতে যাঁরা এটাকে মনে করেন তাঁরা নারী হলে কঠিনভাবে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত এবং পুরুষ হলে তারা মস্তবড় প্রতারক।
ইসলাম নারীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার হরণ করেনি। তা না করেই তার মর্যাদাকে উন্নত করেছে, তার সামাজিক মান-সম্ভ্রমকে রক্সা করেছে। কিন্তু পুরুষরা যেসব কাজ করে ও যেখানে যেখানে করে সেখানে সেখানে ও সে সব কাজে যোগ দিয়ে নারীকে ঘরবাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য করেনি। রাজনৈতিক অধিকার দেয়া হয়েছে, কিন্তু সে অধিকার আদায় ও ভোগ করতে গিয়ে পারিবারিক দায়িত্বে অবহেলা জানাবার অধিকার দেয়া হয়নি। তাদের রাজনীতির নেত্রী, রাষ্ট্রের কর্ত্রী আর রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার পরিবর্তে কন্যা, বোন, স্ত্রী ও মা হওয়াই যে তাদের জীবনের কল্যাণ ও সার্থকতা নিহিত –একথা উপলব্ধি করার জন্যে ইসলাম তাদের প্রতি তাগিত জানিয়েছেন। আর তাই হচ্ছে চিরদিতের তরে বিশ্ব মুসলিম মহিলাদের অনুসরণীয় আদর্শ। তা সত্ত্বেও তারা মাতৃভূমির রাজনীতি –রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে অনবহিত ও উদাসীন হয়ে থাকবে, সে ব্যঅপারে তাদের কোনো সচেতনতাও থাকবে না, এমন কথা কিন্তু ইসলাম বলেনি। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মত জানাবার সাধারণ সুযোগকালে তাকেও স্বীয় মত জানাতে হবে। তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
ভোটদানের অধিকার
দেশের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান ও আইন পরিষদসমূহের সদস্য কিংবা দেশের সর্বোচ্চ শাসনকর্তা নির্বাচনের ব্যাপারে নারীদেরও ভোটদানের অধিকার রয়েছে। এ অধিকার দান ইসলামের বিপরীত কিছু নয়। কেননা নির্বাচন শরীয়তের দৃষ্টিতে উকীল নির্ধারনের (আরবী********) মতোই। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা উচ্চতর স্তরে আইন প্রণয়ন করে ও জনগণের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এ কোনো নিষিদ্ধ কাজ নয় যে, সে একজনকে উকিল নিযুক্ত করবে, সে গিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে নারীর মতামত, ইচ্ছা-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়োজন ব্যাখ্যা করবে এবং তার অধিকার রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
এ ব্যাপারে একটি মাত্র বিষয়ই দূষণীয় আর তা হচ্ছে ভোটদানরে সময় ভিন পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষান ও মেলা-মেশার আশংকা এবং তার ফলে পর্দা নষ্ট হওয়া। কিন্তু এ অশংকা যদি না থাকে, যদি তাদের ভোটকেন্দ্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কায়েম করা হয় এবং সেখানে পর্দার যাবতীয় নিয়ম-বিদান রক্ষা করার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে পর্দা সহকারে ভোটকেন্দ্রে গমন ও নিজ ইচ্ছামতো যে কোনো প্রার্থীকে ভোট দান করায় কোনো দোষ থাকতে পারে না।
জন-প্রতিনিধি হওয়ার অধিকার
পর্দা রক্ষা করে ভোট দান করা যদি নারীদের পক্ষে দূষণীয় এবং আপত্তিকর কিছু না হয়, তাহলে সে নারীর পক্ষে বিভিন্ন পরিষদে ও নির্বাচনী সংস্থার প্রতিনিধি হওয়া কি দূষণীয় হবে?
এ প্রশ্নের জবাব দানের পূর্বে প্রতিনিধিত্ব ও জাতীয় নেতৃত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করে নেয়া আবশ্যক।
মনে রাখা দরকার, প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্বের দুটো প্রধান দায়িত্ব রয়েছে। একটি হচ্ছে আইন প্রণয়ন, জাতীয় শাসন-বিচার ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্যে জরুরী নিয়ম-নীতি রচনা। আর দ্বিতীয় হচ্ছে পর্যবেক্ষণ, প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কার্যকলাপ, ক্ষমতা প্রয়োগ ও জনসাধারণের সাথে তার আচার-ব্যবহার প্রভৃতি জটিল বিষয়ের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করা।
প্রথম পর্যায়ের দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও বিদ্যা অপরিহার্য। একদিকে যেমন ব্যক্তিগতভাবে জাতির প্রত্যেকটি ব্যক্তির এবং অপরদিকে সমষ্টিগতভাবে গোটা জাতির সমস্যা, জটিলতা ও প্রয়োজনাবলী সম্পর্কে সূক্ষ্ম, নির্ভূল ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান আবশ্যক। আর একজন নারীর পক্ষে এ জ্ঞান অর্জন নিষিদ্ধ যেমন নয়, তেমনি কঠিন বা অসম্ভবও কিছু নয়। উপরন্তু ইসলাম নির্বিশেষে সকলকে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের অধিকারই দেয় না, তা ফরয বলেও ঘোষণা করেছে। অতএব বলা যায়, নারীর পক্ষে আইন-প্রণেতা –আইন পরিষদের সদস্যা হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয়। ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু সংখ্যক নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁরা কুরআন, হাদীস ফিকাহ ও ইসলামী সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেছেন।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ, এ কাজের সারকথা হচ্ছে “আমর বিল মারুফ ও নিহি আনিল মুনকার” –ভালো ও ন্যায়সঙ্গত কাজের আদেশ দান এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে নিষেধকর। আর ইসলামে এ ব্যাপারে নারী ও পুরুষ উভয়ই সমান। আল্লাহ তা’আলা নিজেই এ সম্পর্কে বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
মু’মিন পুরুষ স্ত্রী পরস্পরের সাহায্যকারী, পৃষ্ঠপোষক; সকলে মা’রুফ কাজের আদেশ করে ও অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে নিষেধ করে।
এ আয়াতে মু’মিন পুরুষ ও স্ত্রীদের সমান পর্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সকলের জন্যে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কাজের রূপ ও প্রকৃতি একই নির্ধারণ করা হয়েছে। পুরুষ ও নারীকে পরস্পরের বন্ধু, সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এ সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দ্বীন পালন, দ্বীন প্রচার ও দ্বীনের বিপরীত কার্যাদির প্রতিরোধের ব্যাপারে অবশ্য প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা পুরুষ ও নারীর স্থায়ী পরিচয় এবং গুণ। এ আয়াত অনুযায়ী কাজ করা পুরুষ স্ত্রী সকলেই কর্তব্য। অতএব ইসলামে এমন কোনো সুস্পষ্ট দলীল নেই, যার ভিত্তিতে মেয়েদের ‘প্রতিনিধি’ (Representative) হওয়ার অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত রাখা যেতে পারে, সে প্রতিনিধি কাজ আইন প্রণয়ন ও শাসন কার্য পরিচালন, পর্যবেক্ষণ –যাই হোক না কেন, তাদের এ কাজের যোগ্যতা নেই, তা বলারও কোনো ভিত্তি নেই।
কিন্তু বিয়ষটিকে অপর এক দৃষ্টিতে বিচার করে দেখা যায় যে, নারীর এ ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রয়োগ করার পথেই ইসলামের প্রাথমিক নিয়ম-কানুন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যোগ্যতা না থাকার কারণে এ বাধ্য নয়, বাধা হচ্ছে সামাজিক ও সামগ্রিক কল্যাণের দৃষ্টি।
নারীর স্বভাবিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হলে তাকে অন্যসব দিকের ছোট বড় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে থাকতে হবে এবং তার সে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কোনো প্রকার অসুবিধার সৃষ্টি করা কিছুতেই উচিত হবে না।
‘প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা নারীর আছে’ –স্বীকার করলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এ কাজ করতে গিয়ে তার অপরাপর স্বাভাবিক দায়িত্বসমূহ পালন করা তার পক্ষে সম্ভব কি? তাকে পারিবারিক জীবন যাপন, গর্ভ ধারণ, সন্তান প্রসব, সন্তান পালন ও ভবিষ্যৎ সমাজের মানুষ তৈরীর কাজ সঠিকভাবে করতে হলে তাকে কিছুতেই প্রতিনিধিত্বের ঝামেলায় নিক্ষেপ করা যেতে পারে না। আর যদি কেউ সেখানে নিক্ষিপ্ত হয়, তবে তার পক্ষে সেই একই সময় উপরোক্ত স্বাভাবিক দায়িত্বসমূহ পালন করা সম্ভব নয়।
নারীকে এ কাজে টেনে আনলেও এ দায়িত্ব সঠিকরূপে পালন করতে হলে তাকে অবশ্যই ভিন পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা করতে হবে, নিরিবিলি ও একাকীত্বে সম্পূর্ণ গায়র-মুহাররম পুরুষদের সাথে একত্রিত হতে হবে। আর এ দুটো কাজই ইসলামে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ। এমন কি মুখমণ্ডল ও হাত-পা ভিন পুরুষের সামনে উন্মুক্ত করা –যা না হলে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব কিছুতেই পালন হতে পারে না –একান্তই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে। শুথু তা নয়, তাকে একাকী ভিন পুরুষদের সাথে –নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভিন্ন ও দূরবর্তী শহরেও গমন করতে হবে। কিন্তু ইসলামে তাও কিছুমাত্র জায়েয নয়।
এ চারটি ব্যাপারে ইসলামী সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত ও একান্তই মৌলিক এবং এ কারণে নারীর পক্ষে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন –হারাম না হলেও –কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। কোনো মুসলিম নারীই এসব মৌলিক নিষেধকে অস্বীকার করে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হবার সাহস করতে পারে না। অতএব বলা যায়, জাতীয় প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা নারীর রয়েছে বটে; কিন্তু একদিকে নারীর স্বাভাবিক দুর্বলতা, অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা এবং অপরদিকে প্রতিনিধিত্বের স্বরূপ প্রকৃতির দৃষ্টিতে নারীকে এ কাজ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং স্বতন্ত্র করে রাখায়ই জাতীয় ও ধর্মীয় কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
আরো গভীরভাবে নারীর প্রতিনিধি হওয়ার পরিণাম চিন্তা ও বিবেচনা করলে দেকা যাবে, এর ক্ষতি ব্যাপক এবং অত্যন্ত ভয়াবহ।
নারী যদি প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করতে চায়, তাহলে প্রথমত তাকে তার ঘর-বাড়ি, শিশু-সন্তান ছেড়ে বাইরে যেতে হবে। এর ফলে অবহেলিত ঘর-বাড়ি ও সন্তান স্বামীর সঙ্গে অন্তর মনের দূরত্ব এক স্থায়ী ভাঙ্গনের সৃষ্টি করতে পারে। এতদ্ব্যতীত স্বামীর সাথে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে পারস্পরিক কঠিন মনোমালিন্য অবশ্যম্ভাবী। আমেরিকার এক নির্বাচনে কোনো এক স্ত্রী তার স্বামীকে হত্যা করে শুধু এ কারণে যে, স্ত্রী স্বামীর বিপরীত এক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে দলের প্রার্থী হয়েছিল এবং এজন্যে উভয়ের মধ্যে বিরাট ঝগড়া ও বিবাদের সৃষ্টি হয়। বস্তুত নারীকে স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক তৎপরতায় যোগদান করতে দিলে পারিবারিক জীবনে যে ভাঙন ও বিপর্যয় দেকা দেবেই, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।
নারীর পক্ষে এ কাজ আরো অবাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে তখন, যখন নারী হয় যুবতী ও সুন্দরী। নারীর রূপ-সৌন্দর্যকে নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রে জয়লাভের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বিশেষত সেই যুবতী সুন্দরী নারী নিজেই যদি নির্বাচনে প্রার্থী হয়, তাহলে তার গুণাগুণ বিচার না করে কেবল এ রূপের জন্যে মুগ্ধ একদল যুবক কর্মী তার চারপাশে একত্রিত হয়ে যাবে, মধুর চাকার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে থাকে মৌ-পোকার দল। আর এর পরিণাম নৈতিক-রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই যে কত মারাত্মক হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
জনগণের প্রতিনিধিত্ব নারীর পক্ষে যারা সহজ কাজ বলে ধারণা করে, তারা প্রতিনিধিত্বের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে কিছুমাত্র সচেতন নয় বলে ধরা যেতে পারে। প্রতিনিধিদের একদিকে যেমন পদের দায়িত্ব পালন করতে হয় অপর দিকে তার চাইতেও বেশি নির্বাচকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা এবং তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ ও তাদের মন সন্তুষ্টি সাধনের প্রতি পুরাপুরি লক্ষ্য আরোপ করতে হয় অন্যথায় এ দুটো দিকই সমানভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হবে এবং এ প্রতিনিধিত্ব হবে শুধু নামে মাত্র, কার্যথ তা কিছুই হবে না। কিন্তু চিন্তার বিষয় এটা যে, নারীর পক্ষে কি এ দুটো দিকেরই দায়িত্ব সমান গুরুত্ব সহকারে একই সঙ্গে প্রতিপালিত হওয়া বাস্তবিকই সম্ভব; পার্লামেন্টের পরিসদের বৈঠক সমূহে কেবল উপস্থিত থাকাই কি তার পরবর্তী সাফল্যের জন্যে যথেষ্ট?
এতদ্ব্যতীত সবচেয় কঠিন প্রশ্ন, এহেন প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সম্পন্ন নারীর পক্ষে কি কারো সফল স্ত্রী হওয়া এবং সন্তানের মা হওয়া সম্ভব? অন্য কথায়, সেই নারী যদি কারো স্ত্রী এবং সন্তানের মা হয়, তাহলে একদিকে ঘরের ভিতরকার বিবিধ দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার দায়িত্বও পূর্ণমাত্রায় পালন করতে হবে; কিন্তু তা কি বাস্তবিকই সম্ভব হতে পারে? আর তা যদি সম্ভবই না হয়, -আর কেবল বলতে পারে যে, তা সম্ভব? –তাহলে জনপ্রতিনিধিত্বশীল নারীকে কি স্ত্রী ও মা হওয়ার দায়িত্ব বা অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে? বঞ্চিত রাখা হলে তা কি তার স্বভাব-প্রকৃতির দাবির বিপরীত পদক্ষেপ হবে না? আর ঘরের এসব দায়িত্ব পালন সহকারেও যদি দশদিন এবং বছর-দুবছরে অন্তত একবার করে দশ বারো মাসের জন্যে মুলতবী রাখা হবে? কেননা নারীর জন্যে –বিশেষ করে বিবাহিতা নারীর পক্ষে এ তো একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। এ সময় গুলো নারীর পক্ষে বড়ই সংকটের সময়। এ সময় নারীর মেজাজ প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবেই বিগড়ে যায়। প্রায় সব কাজ থেকেই তার মন মেজাজ থাকে বিরূপ, কিছুই তার ভালো লাগে না এ সময়ে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে বাইরে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনের জন্যে বছরে কতটুকু নিরংকুশ অবসর নির্লিপ্ততার সময় পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
এতসব ঝামেলা অনিবার্য হওয়া সত্ত্বেও নারীকে রাজনীতির এ চক্রজালে জড়িয়ে দেয়ায় জাতির ও সমাজের যে কি শুভ ফল লাভ হতে পারে, তা বোঝা কঠিন। তারা কি এক্ষেত্রে এতই দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছে যে, সেই কাজ তাদের বাদ দিয়ে কেবল পুরুষদের দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়? –কী এমন সে কাজ যা পুরুষরা করতে সক্ষম নয়? ….কে এর জবাব দেবে?
কেউ কেউ বলেন, এতে করে নারীর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, নারী মানুষ হওয়ার –সমাজের, দেশের পুরুষদের সমপর্যায়ের সদস্য বা নাগরিক হওয়ার বোধ লাভ করতে পারে।
আমরা প্রশ্ন করব, নারীদের যদি প্রতিনিধিত্বের ময়দানে, রাজনীতির মঞ্চে অবতরণ থেকে বঞ্চিতই করে দেয়া হয়, তাহলে তাতে কি একথাই প্রমাণিত হবে যে, নারীর না আছে কোনো সম্মান, না মনুষত্ববোধ? প্রত্যেক জাতির পুরুষদের মধ্যেই কি একটি বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ এমন থাকে না, যাদের সরাসরি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ কেউই মেনে নিতে রাজি নয়? …যেমন দায়িত্বপূর্ণ সরকারী কর্মচারী এবং সৈন্যবাহিনী? তাহলে তাদের সম্পর্কে কি ধরে নিতে হবে যে, তাদের কোনো সম্মান নেই আর নেই তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ।
বস্তুত প্রত্যেক সমাজে ও প্রত্যেক জাতিরই অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুতা বিধান ও যাবতীয় কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করানোর জন্যে কর্মবণ্টন নীতি অবশ্যই কার্যকর করতে নয়। এ নীতি অনুযায়ী কোনো মানব সমষ্টিকে (Group of people) কোনো বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিলে এবং এ দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে –এমন সব কাজ থেকে তাদের দূরে রাখা হলে তাতে তাদের না মানসম্মান নষ্ট হতে পারে, না তাদের মনুষ্যত্ব লোপ পেতে পারে আর না তাদের কোন হক (Right) নষ্ট বা হরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা যেতে পারে। ঠিক এ দৃষ্টিতেই নারী সমাজকে যদি তাদের বৃহত্তর ও স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে স্বামী ও সন্তানের অধিকার রক্ষার কারণে বাইরের সব রকমের দায়িথ্ব পালন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় এবং রাখা হয় সমাজ, জাতি ও বৃহত্তর মানবতার কল্যাণের দৃষ্টিতে, তবে তাকে কি কোনো দিক দিয়েই অন্যায় বা জুলুম বলে অভিহিত করা যেতে পারে? সৈনিকদের যেমন রাজনীতির ঝামেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, কঠোর দৃঢ়তা সহকারে। সৈনিকদের রাজনীতি করতে না দেয়ায় যেমন কোনো লোকসান নেই? ঠিক তেমনিভাবে নারীদেরও যদি দূরে রাখা হয়, তবে তাতে কি জাতীয় কল্যাণের কোনো লোকসান হতে পারে।
এ পর্যায়ে যে শেষ কথাটি বলতে চাই, তা হলো এই যে, নারীদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে যে উৎসাহ আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে, তার কারণ ইউরোপের অন্ধ অনুকরণ গ্রহণের ব্যাপারে যে উৎসাহ আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে, তার কারণ ইউরোপের অন্ধ অনুকরণ, পাশ্চাত্য চিন্তাধারার মানসিক গোলামী এবং বিবেচনাহীন অযৌক্তিক আবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইউরোপে তো রেনেসাঁর প্রায় একশ বছর পর নারীরা রাজনৈতিক অধিকার লাভ করেছে। জিজ্ঞেস করতে পারি কি, ইউরোপীয় সমাজে এ অভিজ্ঞতার কি ফল পাওয়া গেছে?
ইউরোপীয় সমাজ এ ব্যাপারে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা লাভের এ সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে, নারীদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণের কোনো ফায়দা নেই, বরং পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিতে এর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহই হয়েছে ইউরোপে। সেখানে এরফলে ঘর ভেঙ্গেছে, পরিবার ভেঙ্গেছে, পথে-ঘাটে সন্তান জন্মানোর কলংকের সৃষ্টি হয়েছে, আর রাজনীতিক নারীকে নিয়ে পুরুষদের মধ্যে টানাটানি হিড়িক পড়েছে। এক্ষেত্রে বৃটেনে ক্রীষ্টান কীলারের ব্যাপারটি অতি সাম্প্রতিক ঘটনা, যেখানে নারীর সরাসরি রাজনীতির হওয়ার ব্যাপারে নেই, কেবলমাত্র এক রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তির সাথে অবৈধ যোগাযোগের পরিণামই বৃটিশ সরকারের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলে পর ফ্রান্সের নেতৃবন্দ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেনঃ রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারিণী ও প্রভাব-শালিনা মেয়েরাই আমাদের পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা একথা জোরের সঙ্গেই বলব, আমাদের সমাজে নারীদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে টেনে আনার ফলও অনুরূপ মারাত্মক হবে, এতে এক বিন্দু সন্দেহের অবকাশ নেই। জাতীয় বা জেলা পরিষদসমূহে নারীদের সদস্যপদের কার্যত কোনো সুফল হতে পারে না বলে তা যত তাড়াতাড়ি বন্ধ করা হবে, ততই মঙ্গল।
নারীর প্রতিনিধিত্বের সঠিক পন্থা
কিন্তু তাই বলে নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব নারী করবে –এ অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করার কথা আমি বলতে চাইনি। বরং তাদের এ অধিকার সুষ্ঠুরূপে কার্যকর হতে পারে তখন, যখন নারীদেরকে নারীদেরই প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেয়া হয়। আর তা হতে পারে এভাবে যে, নারী সমাজের ভোটে কিছু সংখ্যক নারীকে নির্বাচিত করে তাদের সমন্বয়ে একটি মহিলা বোর্ড গঠন করা হয় এবং তাদের দায়িত্ব এই দেয়া হয় যে, তারা সাধারণভাবে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এবং বিশেষভাবে নারীদের সাধারণ ও নিত্য নৈমিত্তিক সমস্যা ও শিশু পালন, শিশু শিক্ষা –তথা সমাজের ভবিষ্যৎ বংশধরনের গঠন-উন্নয়ন সম্পর্কে সুপারিশ তৈরী করে জাতীয় পরিষদের সামনে তদনুযায়ী আইন রচনার উদ্দেশ্যে পেশ করবে। আমি বিম্বাস করি, জাতীয় পরিষদের সদস্য করে দেশের সাধারণ কাজ-কর্মে নারীদের যদি নিয়োগ করা হয়, তাহলে তাদের প্রতিনিধিত্বের শুভ ফল ও বিশেষ কল্যাণ লাভ করা সম্ভব হতে পারে এবং এ প্রতিনিধিত্বকারী মহিলাগণ নিজেদের পারিবারিক দায়িত্ব পালন থেকেও বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হবেন না।
ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের কাজের ভিত্তি পাওয়া যায়। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা)-এর ফুফাত বোন ছিলেন হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রা)। তিনি যেমন ছিলেন বিদূষী, বুদ্ধিমতী, তেমনি ছিলেন পুরামাত্রায় দ্বীনদার। তিনি একদিন রাসূলে করীম (স)-এর দরবারে এসে হাযির হয়ে আরয করলেনঃ
(আরবী*************************************************************)
আমি আমার পশ্চাতে অবস্থিত মুসলিম নারী সমাজের প্রতিনিধি, তারা সকলেই আমার কথায় একমত এবং আমি তাদের মতই আপনার কাছে প্রকাশ করছি। কথা এই যে, আল্লাহ তা’আলা আপনাকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রতি। আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আপনাকে অনুসরণ করে চলছি। কিন্তু আমরা –নারীরা –পর্দানশীল ও ঘরের অভ্যন্তরে বসে থাকি, পুরুষদের লালসার কেন্দ্রস্থল আমরা এবং তাদের সন্তানদের বোঝা বহন করি মাত্র। জুম’আ ও জানাযার নামায এবং জিহাদে শরীক হওয়ার একচ্ছত্র অধিকার পেয়ে পুরুষরা আমাদের ছাড়িয়ে গেছে অথবা তারা জিহাদের জন্যে ঘরের বাইরে চলে যায়, তখন আমরাই তাদের ঘর-বাড়ি দেখাশোনা করি এবং তাদের সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব বহন করি। এমতাবস্থায় সওয়াব পাওয়ার দিক দিয়েও কি আমরা তাদের সঙ্গে ভাগীদার হতে পারব হে রাসূল? ….রাসূলে করীম (স) একথা শুনে উপস্থিত সাহাবীদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমরা অপর কোনো নারীকে কি এর অপেক্ষা অধিক সুন্দর করে দ্বীন-ইসলামের বিধান সম্পর্কে সওয়াল করতে পেরেছে বলে জানো? তাঁরা সকলেই বললেনঃ না, আল্লাহর শপথ হে রাসূল! অতঃপর রাসূলে করীম (স) হযরত আসমা (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেনঃ হে আসমা, তুমি আমায় সাহায্য ও সহযোগিতা করো। যে সব নারী তোমাদের প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠিয়েছেন তাদেরকে আমার তরফ হতে একথা পৌঁছিয়ে দাও যে, ভালোভাবে ঘর-সংসারের কাজ করা, স্বামীদের সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করা এবং তাদের সাথে মিলমিশ রক্ষা করনার্থে তাদের কথা মেনে চলা –পুরুষদের যেসব কাজের উল্লেখ তুমি করেছ তার সমান মর্যাদাসম্পন্ন।
হযরত আসমা রাসূলে করীমের কথা শুনে অত্যন্ত সন্তুষ্ঠি সহকারে আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর করতে করতে উঠে চলে গেলেন।
ইসলামী ইতিহাসের এ বিশেষ কথা শুনে অত্যন্ত সন্তুষ্ঠি সহকারে আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর করতে করতে উঠে চলে গেলেন।
ইসলামী ইতিহাসের এ বিশেষ ঘটনা থেকে প্রথমত এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, সমাজের নারীদের অভাব-অভিযোগ, দাবি-দাওয়া ও মনের কথাবার্তা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের কাছে সুষ্ঠুরূপে পৌঁছাবার ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক এবং এ ব্যবস্থা হতে পারে তখন, যদি নারী সমাজেরই প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কোনো কোনো মহিলা বোর্ড গঠন করা হয় এবং তাদের এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। এতদাপেক্ষা অপর কোনো ব্যবস্থা –জাতীয় পার্লামেন্ট পুরুষদের পাশাপাশি সকল বিষয়ে মাথা গলাবার সুযোগ বা দায়িত্ব দিয়ে তাদের আসল দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতার দৃষ্টি করা কিছুতেই কল্যাণকর হতে পারে না।