পঞ্চম অধ্যায়
পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় ও পুনর্গঠন
পারিবারিক জীবনে ভাঙ্গন ও বিপর্যয় অত্যন্ত মর্মান্তিক ব্যাপার। ‘তালাক’ হচ্ছে এ বিপর্যয়ের চূড়ান্ত পরিণতি।
তালাক
ইসলামে তালাকের সুযোগ বিধিবদ্ধ করা হয়েছে পারিবারিক জীবনের চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে স্বামী ও স্ত্রী –উভয়কে বাঁচাবার জন্যে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে ভাঙ্গন দেখা দেয়, পরস্পরে মিলেমিশে ঠিক স্বামী-স্ত্রী হিসেবে শান্তিপূর্ণ ও মাধুর্যমণ্ডিত জীবন যাপন যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, পারস্পরিক সম্পর্ক যখন হয়ে পড়ে তিক্ত, বিষাক্ত। এক জনের মন যখন অপর জন থেকে এমনবাবে বিমুখ হয়ে যায় যে, তাদের শুভ মিলনের আর কোনো আশায় থাকে না, ঠিক তখনই এ চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ। এ হচ্ছে নিরুপায়ের উপায়। বাঁধন যখন টুটে যাবেই, পরস্পরকে বেঁধে রাখার শেষ চেষ্টাও যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত, তখন বিয়ের রশিটুকু আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন করে না দিলে উভয়ের জীবন দুর্বিষহ –প্রাণ ওষ্ঠাগত, তখন সে রশিকে কেটে দিয়ে পরস্পরের অস্তিত্বকে রক্ষা করার এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য।
কুরআন মজীদে একদিকে যেমন স্বামীতে-স্ত্রীতে মিলমিশ রক্ষা করে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে, তেমনি অপরদিকে উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর কার্যকর নিয়ম-কানুন পেশ করা হয়েছে। ইসলামের এ ব্যবস্থা কিছুমাত্র নিরর্থক নয়। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার জুলুম, অবিচার, নির্যাতন ও সীমালংঘনের অনুমতি দেয়া হয়নি, কোনো কারণ ও কল্যাণ-উদ্দেশ্য ব্যতীতই স্ত্রীকে তালাক দেয়া কিংবা স্বামীর কাছ থেকে তালাক গ্রহণের কাজেও কিছুমাত্র পছন্দ করা হয়নি। কি স্ত্রী আর কি স্বামী –কি মেয়েলোক আর কি পুরুষ লোক, কাউকেই বিনা কারণে ও বিনা অপরাধে কোনো প্রকার কষ্ট দেয়াই ইসলাদের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট হারাম।
তা সত্ত্বেও তালাক দেয়ার ব্যবস্থা ইসলামে কেন রাখা হয়েছে? …..রাখা হয়েছে সকল প্রকার সীমালংঘনকারী কাজ থেকে ব্যক্তি ও সমাজকে রক্ষা করা এবং সকল অবস্থায় ভারসাম্যপূর্ণ ও মাধ্যম অবলম্বন করার সুযোগ দানের উদ্দেশ্যে। কেননা তালাক বা বিচ্ছেদের ব্যবস্থা না থাকলে যে কোনো অবস্থায়ই হোক না কেন, বিবাহ সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষ বাধ্য হয়। অথচ এমন অবস্তা দেখা দেয়া অসম্ভব নয় যে, স্বামী-স্ত্রীর একজন চরিত্রহীন হবে কিংবা উভয়ের প্রকৃতি এমন অনমনীয় হয়ে পড়বে যে, কারো পক্ষেই অপরকে বরদাশত করা আদৌ সম্ভব হচ্ছে না। পরস্পরের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, চাল-চলন, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য পরস্পর বিরোধী –শুধু বিরোধীই নয় –সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে, যার ফলে উভয়ের সাথে প্রতি মুহুর্ত কেবল ঝগড়া-বিবাদ তর্ক-বিতর্ক আর গালাগাল দেয়ার অবস্থারও উদ্ভব হয়ে পড়েছে। আর দুজনের কেউই না পারে শরীয়তের সীমা রক্ষা করে চলতে এবং না পারে পরস্পরের হক-হকুক যথাযথভাবে আদায় করতে। এরূপ অবস্থায় উভয়ের চূড়ান্ত বিচ্ছেদই উভয়ের নিকট কাম্য হয়ে থাকে। আইনসম্মতভাবে এ বিচ্ছেদের ব্যবস্থা না তাকলে উভয়েরই জীবন বরাবদ হয়ে যেতে বাধ্য।
কিন্তু তাই বলে তালাক দেয়ার ব্যাপারেও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ইসলাম বরদাশত করেনি। তালাক দেয়ার সঠিক পন্থা স্পষ্টভাবে বেঁধে দিয়েছে। এমনিতে তো বিয়ে সম্পর্কে সবদিক দিয়ে সুরক্ষিত করে দিয়েছে। কোনো প্রকার সাময়িক বা আকস্মিক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া যাতে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তার প্রতিও পূর্ণমাত্রায় লক্ষ্য রাখা হয়েছে। সাধারণত আকস্মিকভাবে স্বামী ক্রোধান্ধ ও উত্তেজিত হয়ে স্ত্রীকে তালাক দিতে উদ্যত হয় বা তালাক দিয়ে ফেলে। পরে যখন সে ক্রোধ প্রশমিত হয়, উত্তেজনার বিষবাষ্প উবে যায়, যখন ঘাটে পানি আসে, সুস্থভাবে বিচার বিবেচনা করে দেখতে পারে, এ কাজ আদৌ করবে কি না। ঠাণ্ডা মন-মগজে এসব চিন্তা করার শক্তি তখন ফিরে আসে। তখন উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে কৃত কাজ সম্পর্কে তার মনে জাগে অনুতাপ। …কি করে ফেললাম ভেবে অনেক মানুষই তখন দিশেহারা –পাগল হয়ে যায়।
মানুষের প্রকৃতি-নিহিত এ দুর্বলতাকে লক্ষ্য করেই ইসলাম তালাক দানের একটা অতীব ভারসাম্যপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে।
প্রাচীন সমাজে তালাক
প্রাচীন জাতি ও সভ্যতার কোথাও কোথাও তালাকের ব্যবস্থা ছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে তার অস্তিত্ব ছিল না বলেই মনে হয়। হিন্দু শাস্ত্রে বিয়ে এক চিরস্থায়ী বন্ধন বিশেষ এবং জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তাকে স্থায়ী রাখাই কর্তব্য। এজন্যে তাকে তালাকের কোনো পথ উন্মুক্ত রাখা হয়নি। হিব্রু ভাষাভাষী জাতিগুলোর মধ্যে তালাকের ব্যবস্থা ছিল। স্বামী সাধারণ ও সামান্য কারণেই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিত। অনুরূপভাবে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় স্ত্রীরও অধিকার ছিল তালাক গ্রহণের। অবশ্য প্রাচীন রোমান সমাজে বিয়ে যেমন ছিল একটি সাধারণ পারিবারিক ব্যাপার, তেমনি তালাক দানের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী ছিল। আর সেজন্যে কোনো বিচারক বা আদালনের নিকট হাজির হওয়ারও কোনো প্রয়োজনই হতো না।
খ্রিষ্টান সমাজে তালাক
প্রথম দিকে খ্রিষ্টান সমাজের ওপর রোমান আইনের প্রভাব পড়েছিল বটে, কিন্তু খ্রিষ্টবাদ যখন ইউরোপে ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে দাঁড়াল এবং বৈরাগ্যবাদী মতবাদ দানা বেঁধে উঠল, তখন বিয়েকে এমন এক ধর্মীয় কাজ বলে ঘোষণা করা হলো যা জীবনের শেষ নিঃশাস ত্যাগ করা পর্যন্ত শেষ হতে পারে না। এরূপ বাধ্যবাধকতার ফলে ইউরোপীয় সমাজ সাংঘাতিক রকমের অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এ সমাজে তালাককে একটি মহা গুনাহের কাজ বলে গণ্য করা হতো, বিবাহ বিচ্ছেদকারীদের পথে ছিল নানা প্রকারের দুর্লংঘ্য প্রতিবন্ধকাত। উত্তরকালে গির্জার আইন যখন বলবৎ হলো, তখন বিয়ে ও তালাক –উভয়ের ওপর কঠিন প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে দেয়া হয়। বস্তুত গির্জার এসব আইন ছিল মানব স্বভাব ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরোধী। দৈনন্দিন জীবন তদনুযায়ী যাপন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। ফলে গির্জার বিরুদ্দে জনমনে বিদ্রোহের বাষ্প পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে। ষষ্ঠদশ শতকে তা প্রচণ্ড আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি করে। এ কারণে পনের শত বচর পর্যন্ত খ্রিষ্টান সমাজ গির্জার অত্যাচারী নির্যাতন, নির্মম অমানুষিক আইন-শাসনের অধীনে থেকে নিষ্পেষিত হতে বাধ্য হয়েছে।
গির্জা-বিরোধী আন্দোলন সাফল্যমণ্ডিত হলে পরে প্রোটেস্ট্যাণ্ট ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন বিয়ে তালাকের ব্যাপারে অনেকখানি উদার নীতি অবলম্বিত হতে শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত এ দুটো ব্যাপারকেই ধর্মীয় সীমার বাইরে ফেলে দেয়া হয়। আসল ব্যাপার এই যে, প্রোটেষ্ট্যান্ট পাদ্রীদের কাছে এসব সমস্যার কোনো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সমাধান ছিল না, ছিল না এ বিষয়ে তাদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা। ফলে ‘তালাক’কে গ্রহণ করা হলো, কিন্তু তালাক দেয়ার ক্ষমতা একান্তভাবে স্বামীর কুক্ষিগত করে দেয়া হলো। আর তালাক লাভের ন্যে একমাত্র উপায় হলো পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ উত্থাপন। সহজেই বোঝা যায়, এরূপ উপায়ে তালাক লাভের পর দু’জনের পক্ষে আর কোনো দিনই মিলিত হওয়ার আর কোনো সুযোগই থাকতে পারে না।
ইংলণ্ডে তালাক
ইংরণ্ডে ‘পিউরিটান’দের প্রতিপত্তি শুরু হলে তারা বিয়ে-শাদীর ব্যাপারটির দিকে বিশেষ নযর দেয়। প্রথমত বিয়েকে তারা ধর্মীয় সীমার বাইরে নিক্ষেপ করল। বিয়ের জন্যে ছেলের বয়স ১৬ আর মেয়ের বয়স ১৪ নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো। বিয়ে-অনুষ্ঠানের জন্যে পাদ্রীর বদলে রেজিষ্ট্রিকারী নিযুক্ত করা হলো। কিন্তু এ ব্যবস্থা বেশি দিন চলতে পারল না। পরে তা বাতিল করে প্রাচীন গির্জা-আইন পুনরায় চালু করা হলো।
এ সময়ে প্রখ্যাত ইংরেজ কবি মিল্টন তালাকের সমর্থনে এক পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশ করেন। তাতে স্বামী ও স্ত্রী –উভয়কেই তালাক দানের ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়, যদিও গির্জা আইন তার তীব্র প্রতিবাদ করে।
ষষ্ঠদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত পূর্ণ আড়াই শত বছর কাল যাবত ইংলণ্ডে গির্জা-আইনের প্রবল প্রতিপত্তি থাকে, যার প্রচণডতা ও অপরিবর্তনীয়তা সাধারণ মানুষকে রীতিমত ক্ষেপিয়ে তোলে। ১৮৭৫ সালে তালাক সম্পপের্ক একটি আইন জারি করা হয়, যা পরে পার্লমেণ্ট কর্তৃকও গৃহীন হয়। এ আইনে স্ত্রীর ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে তাকে তালাক দেয়ার ক্ষমতা কেবলমাত্র স্বামীকেই দেয়া হয়। কিন্তু পুরুষের জ্বেনা-ব্যভিচারকে কোনো দোষের কাজ বলে আদপেই ধরা হয় না। দ্বিতীয়ত স্ত্রী যদি তালাক গ্রহণ করতে ইচ্ছা করে, তাহলে তাকে স্বামীর ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার এবং সে সঙ্গে তার ওপর তার অমানুষিক অত্যাচার ও জুলুমের প্রমাণও অকাট্যভাবে পেশ করার শর্ত আরো করা হলো। অবশ্য ১৯২৩ সালের এক আইনে ব্যভিচারের অভিযোগে তালাক গ্রহণের সুযোগ স্বামী-স্ত্রী –উভয়কেই দেয়া হয়। ১৯৩৭ সালে তালাক আইনে আরো অনেক সংশোধন সংযোজন করা হয়। এতে করে ব্যভিচার ছাড়াও একাধিক্রমে তিন বছরকাল স্ত্রীকে নিঃসম্পর্ক করে ফেলে রাখা, নির্মমতা, অভ্যাসগত মদ্যপান, অচিকিৎসা, পাগলামী ও দূরারোগ্য যৌন ব্যধির কারণে তালাক লওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তার সাথে শর্ত আরোপ করা হয় যে, বিয়ে হওয়ার পর তিন বছরের মধ্যে তালাকের আবেদন পেশ করা যাবে না। যদিও এ আইন বলবত থাকা সত্ত্বেও ইংলণ্ডে আজও ব্যভিচারই হচ্ছে তালাক গ্রহণের সবচেয়ে বড় ও কার্যকর কারণ ও উপায়। জনৈক ইংরেজ সমাজবিজ্ঞানী লিখেছেনঃ
ব্যভিচার ও নির্মম ব্যবহার প্রমাণ করতে পারলেই তবে আজকের ইংরেজ স্ত্রী স্বামীর কবল থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারে। স্বামী তো কেবল স্ত্রীর ব্যভিচার লিপ্ততার অভিযোগ এনেই তালাক পেতে পারে; কিন্তু স্ত্রীকে সেজন্যে স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের সঙ্গে সঙ্গে তার নির্মম ব্যবহারের অভিযোগও আনতে হবে –এই হচ্ছে ইংরেজদের ইনসাফ। বস্তুত আইনের এ স্বৈরাচার বেশিদিন বরদাশত করা যেতে পারে না। অদূর ভবিষ্যতে স্বামী ও স্ত্রী –উভয়ই তালাক গ্রহণের সমান অধিকার লাভ করবেই। (আরবী**************************)
তালাক ব্যবস্থার আবশ্যকতা
ইউরোপীয় সামজবিজ্ঞানীরা একতা অকপটে স্বীকার করেছেন যে, যেসব দেশ ও সমাজে তালাকের ব্যবস্থা, তালাক দেয়া-নেয়ার সুবিধে আছে, সেখানে কার্যত তালাক খুব কমই সংঘটিত হয়ে থাকে। রোমানদের সম্পর্কে কথিত আছে যে, তাদের মধ্যে তালাক দেয়া-নেয়া খুবই সহজ ছিল। তথাপি কয়েক শত বছরের মধ্যে তালাকের ঘটনা দু’একটা ছাড়া বেশি ঘটেনি। পরন্তু তালাক দেয়া-নেয়া যেখানে সহজতর, সেখানে অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের ঘটনা যে আপেক্ষাকৃতভাবে অনেক কম সংঘটিত হয়ে থাকে, বিশেষজ্ঞদের কাছে তাও স্বীকৃত সত্য। অপর এক মনীষীর মতে –যেসব সমাজে পতনের গতি তীব্র ও ক্রমবৃদ্ধিশীল, সেখানে তালাকের ঘটনা ঘটে এত যে, তার কোনো হিসাব-নিকাশ করা সম্ভব হয় না। ১৯১৪ সনে ইংলণ্ডে ৮৫৬টি তালাক সংঘটিত হয়, ১৯২১ সনে সেখানে ৩৫২২টি আর ১৯২৮ সনে ৪০০০ এবং ১৯৪৬ সনে ৩৫৮৭৪টি।
আমেরিকায় তালাক
বর্তমান সভ্য (?) দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকাই হচ্ছে এমন এক দেশ, যেখানে তালাক অনুষ্ঠান অস্বাভাবিক রকমের সহজ। তার প্রকৃত কারণ এই যে, এদেশের প্রাথমিক উপনিবেশ স্থাপনকারীরা ছিল ধর্মদ্রোহী, যারা গির্জার জুলুম নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ত্যাগ করে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। এদের উপর গির্জার জুলুম নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ত্যাগ করে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। এদের উপর পিউরিটানদের প্রভাব ছিল বেশি, পিউরিটানরা যে বিয়ে-শাদীর ব্যাপরটিকেই ধর্মীয় সীমানার বাইরে নিক্ষেপ করে রেখেছিল, তা পূর্বেই বলেছি। ফলে এদের কাছে তা ছিল নিতান্ত একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তালাকের ক্ষেত্রে তারা এতদূর বাড়াবাড়ি করে যে, তা নিতান্ত হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমন সব কারণেও সেখানে তালাক লাভ করা যায়, যা শুনলে হাসি সংবরণ করা সম্ভব হয় না। স্ত্রী স্বামীর কোটের বোতাম লাগায়নি, স্বামী তার পায়ের নখ কাটেনি বা ঘুমোলে একজনের নাসিকা এমনভাবে গর্জন করে যে, তাতে অপর জনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে যায়, এসব এবং এমনি ধরনের অসংখ্য নিতান্ত হাস্য উদ্রেককারী বিষয়ও সেখানে তালাক গ্রহণের বিরাট কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত সেখানে বিয়ে আর দাম্পত্য জীবন সকল গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য হারিয়ে ফেলেছে। সেখানে বিয়েই করা হয় এজন্যে যে, তার পরই তাতে তালাক অনুষ্ঠিত হবে। তালাকের আধিক্য সম্পর্কে বলা হয়ঃ প্রতি তিনটি বিয়ের একিট পরিণতি অনিবার্যরূপে তালাক।
নারী-পুরুষের সার্বিক সমতা এবং জীবিকার্জনের ক্ষেত্রে নারীদেরও পূর্ণ মাত্রায় অংশ গ্রহণের সুযোগ থাকায় স্বামীর কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য সেখানে খতম হয়ে গেছে বলে তালাক আধিক্যের কারণ দর্শানো হয়ে থাকে। কেননা যেখানে নারী ও পুরুষের পূর্ণ সমাজ মর্যাদায় পরস্পরের সাথে মিলিত হয় যৌন ব্যাপারেও এ সমতা সেখানে কাম্য। প্রাচীনকালে যেহেতু নারী পুরুষের অধিনে থাকত, সেজন্যে তার মুখে স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অবস্থায়ই কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হতো না।
কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। যৌন পরিতৃপ্তি নারীর এক বিশেষ অধিকার বলে বিবেচিত হচ্ছে। যেখানে তার অভাব, পারস্পরিক তিক্ততা সেখানে অনিবার্য। তার শেষ পরিণতি হয় তালাক। আর কিনসের রিপোর্ট অনুযায়ী সমাজ পরিবেশ অস্বাভাবিক উত্তেজনাময় হওয়ার কারণে সেখানকার অধিকাংশ পুরুষ দ্রুত বীর্য স্খলনের রোগে আক্রান্ত। এ কারণেই সেখানে তালাকের এত মাত্রাধিক্য।
ইসলাম ও তালাক
তালাক (আরবী******) শব্দের আভিধানিক অর্থঃ (আরবী************)
বন্ধন খুলে দেয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় ‘তালাক’ মানে (আরবী***************) বিয়ের বন্ধন খুলে দেয়া।
ইমামুল হারামাইন বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
এ শব্দটি ইসলাম-পূর্ব জাহিলী যুগে ব্যবহৃত পরিভাষা। ইসলামও এক্ষেত্রে এ শব্দটিই ব্যবহার করেছে।
এ যুগের মিসরীয় পণ্ডিত আল-খাওলী বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
স্বামী তার স্ত্রীর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়া।
অথবা
(আরবী************************************************************************)
আল্লাহর বিধান অনুযায়ী একত্রিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক-রশি ছিন্ন করা।
ফিকাহ শাস্ত্রের দৃষ্টিতে তালাক মানে-
(আরবী***********************************************************************)
বিয়ের বাধনকে তুলে ফেলা আর বাধন তুলে ফেলার মানে বিয়ের বাধ্যবাধকতা খতম করে দেয়া।
ইসলামে তালাকের উদ্দেশ্য হচ্ছে –স্বামী স্ত্ররি পারস্পরিক সম্পর্ক যখন এতদূর খারাপ হয়ে যাবে যে, তারা পরস্পর মিলেমিশে ও ঐক্য সৌহার্দ্য সহকারে জীবন যাপন করার কোনো সম্ভবানাই দেখতে পায় না, এমনকি এরূপ অবস্থার সংশোধন বা পরিবর্তনের শেষ আশাও বিলীন হয়ে গেছে। -যার ফলে বিয়ের উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যা, তখন উভয়ের ভবিষ্যৎ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ও তিক্ততা-বিরক্তির বিষাক্ত পরিণতি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে উভয়ের মধ্যে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া।
কিন্তু তাই বলে ইসলামে তালাক বা বিচ্ছেদ কোনো পছন্দনীয় কাজ নয়। এ কাজকে কোনো দিক দিয়ে কিছুমাত্র উৎসাহিত করা হয়নি। বরং এ হচ্ছে নিরুপায়ের উপায়, অগতির গতি। দাম্পত্য জীবনে মিলমিশ রক্ষার সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়ে যাবে, তখন এ ব্যবস্থার সাহায্যে উভয়ের স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগত সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখা। -আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে উদ্দার করাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য।
‘তালাক’ যে ইসলামে কোনো পছন্দনীয় কাজ নয়, একথা হাদীসের স্পষ্ট ঘোষণা থেকেই প্রমাণিত।
রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
আল্লাহর কাছে সব হালাল কাজের মধ্যে সর্বাধিক গৃণার্হ ও ক্রোধ উদ্রেককারী কাজ হচ্ছে তালাক।
এই হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা খাত্তাবী লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
তালাক ঘৃণ্য হওয়ার অর্থ আসলে সেই মূল কারণটির ঘৃণ্য হওয়া, যার দরুন একজন তালাক দিতে বাধ্য হয়। আর তা হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক খারাপ হওয়া –মিলমিশের অভাব হওয়া। মূল তালাক কাজটিই ঘৃণ্য নয়। কেননা এ কাজটিকে আল্লাহ তা’আলা মুবাহ করে দিয়েছেন। আর রাসূল (স) তাঁর কোনো কোনো স্ত্রীকে ‘রাজয়ী’ তালাক দিয়ে পুনরায় গ্রহণ করেছেন বলে প্রমাণিত।
আর ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল কাহলানী ছানআনী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************************)
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, হালালের মধ্যেও কতক কাজ এমন রয়েছে, যা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত ঘৃণ্য। আর এসব হালাল কাজের মধ্যে ‘তালাক’ হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণ্য।
ফিকাহবিদদের মতেও তালাক মূলত নিষিদ্ধ। তবে তালাক না দিয়ে যদি কোনো উপায়ই না থাকে, তাহলে তা অবশ্যই জায়েয হবে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষের ভাব যদি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, একত্র জীবন সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়ে, একত্র জীবনে আল্লাহর নিয়ম-বিধান রক্ষা করা সম্ভবপর না হয়, তাহলে তখন এ তালাকের আশ্রয় নিতে হবে। (আরবী*****************************************)
ফিকাহবিদদের মতে তালাক-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা অন্যায়, জুলুম ও নিদারুণ কষ্ট, জ্বালাতন ও উৎপীড়ন থেকে নিষ্কৃতি লাভের পন্থা। ফিকাহর ভাষায় বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************************************)
তালাকের সৌন্দর্য হলো কষ্টকর অশান্তি থেকে অব্যাহতি লাভ।
বস্তুত আল্লাহ তা’আলা তালাককে শরীয়তসম্মত করেছেন। কেননা পারিবারিক জীবনে এর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তবে বিনা প্রয়োজনে –স্ত্রীর কোনো গুরুতর দোষ-ত্রুটি ব্যতীতই –তালাক দেয়া একান্তই এবং মারাত্মক অপরাধ। এ সম্পর্কে ইসলামের মনীষীগণ সম্পূর্ণ একমত। ইমাম আবূ হানীফার ফিকাহর আলোচনায় এ বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষিত সাধারণ নীতি হলোঃ (আরবী*******************) ‘না নিজে ক্ষতি স্বীকার করবে, না অন্যকে ক্ষতিগ্রহস্ত করবে’। অথচ অকারণ তালাকের দরুন স্ত্রীকে অপূরনীয় ক্ষতি ও অপমান-লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হয়। প্রখ্যাত ফিকাহবিদ ইবনে আবেদীন বলেছেনঃ তালাক মূলত নিষিদ্ধ, মানে হারাম; কিন্তু দাম্পত্য জীবনে সম্পর্ক যখন এতদূর বিষজর্জর হয়ে পড়ে যে, তা থেকে নিষ্কৃতি লাভ অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তখন তা অবশ্যই জায়েয হবে। পক্ষান্তরে বিনা কারণেই যদি তালাক দেয়া হয়; স্ত্রীকে তার পরিবার-পরিজনকে, সন্তান-সন্ততি ও পিতামাতা, ভাই-বোনদেরকে কঠিন কষ্টদান করা ও বিপদে ফেলাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এ তালাক একেবারেই জায়েয নয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলা কেবলমাত্র তখনই সঙ্গত হতে পারে, যখন তাদের উভয়ের স্বভাব-প্রকৃতিতে এতদূর পার্থক্যের সৃষ্টি হবে, আর পরস্পরের মধ্যে এতদূর শত্রুতা বেড়ে যাবে যে, তারা মিলিত থেকে আল্লাহর বিধানকে পালন ও রক্ষা করতে পারেই না। এরূপ অবস্থার সৃষ্টি না হলে তালাক তার মূল অবস্থায়ই থাকবে –মানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারামই বিবেচিত হবে। এজন্য আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************************)
স্ত্রীরা যদি স্বামীদের কথামতো কাজ করতে শুরু করে, তাহলে তখন আর তাদের ওপর কোনো জুলুমের বাহানা তালাম করো না –তালাক দিও না।
বাস্তবিকই, কোনো প্রকৃত কারণ না থাকা সত্ত্বেও যারা স্ত্রীকে তালাক দেয়, তারা মহা অপরাধী, সন্দেহ নেই। এদের সম্পর্কেই রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************************)
তোমাদের এক-একজনের অবস্থা কি হয়েছে? তারা কি আল্লাহর বিধান নিয়ে তামাসা খেলছে? একবার বলে তালাক দিয়েছি, আবার বলে পুনরায় গ্রহণ করেছি।
বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
তারা কি আল্লাহর কিতাব নিয়ে তামাসা খেলছে, অথচ আমি তাদের সামনেই রয়েছি।
রাসূলে করীমের ওপরে উল্লিখিত বাণীসমূহ থেকে একথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ‘তালাক’ কোনো সাধারণ জিনিস নয়, মুখে এল আর তালাকের শব্দ উচ্চারণ করে ফেললাম, তা এরূপ সহজ ও হালকা জিনিস নয় আদৌ। বরং এ হচ্ছে অতি সাংঘাতিক কাজ। মানুষের জীবন, মান-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কাজ হচ্ছে এটা, ইসলামে তার অবকাশ রাখা হয়েছে নিষ্কৃতির সর্বশেষ উপায় হিসেবে মাত্র।হযরত মুয়ায থেকে বর্ণিত হাদীসের ভাষা থেকেও একথারই সমর্থন পাওয়া যায়। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************)
আল্লাহ তা’আলা তালাক অপেক্ষা অধিকতর ঘৃণার্হ জিনিস আর একটিও সৃষ্টি করেন নি।
হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত রাসূলের নিম্নোক্ত বাণী থেকেও তালাকের ভয়াবহতা ও ভয়ংকরতা স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। বাণীটি নিম্নরূপঃ
(আরবী***********************************************************************)
তোমরা বিয়ে করো, কিন্তু তালাক দিয় না, কেননা তালাক দিলে তার দরুন আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।
সমাজে এমন লোকের অভাব নেই, যারা মৌমাছির মতো ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ানোর অভ্যাসের দাস। এদের কাছে না বিয়ের কোনো মূল্য আছে, না আছে নারীর জীবন, মান-সম্ভ্রমের এক কড়া-ক্রান্তি দাম। এরা বিয়েকে দুটি দেহের একই শয্যায় একত্রিত হওয়ার মাধ্যম মনে করে এবং একটি দেহের স্বাদ আকণ্ঠ পান করার পর নতুন এক দেহের সন্ধানে বেরিয়ে পড়াই তাদের সাধারণ অভ্যাস।
এদের সম্পর্কেই রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
তোমরা বিয়ে করো; কিন্তু তালাক দিও না। কেননা আল্লাহ তা’আলা সেসব স্ত্রী-পুরুষকে (ভালোবাসেন না) পছন্দ করেন না, যারা নিত্য নতুন বিয়ে করে স্বাদ গ্রহণ করতে অভ্যস্ত।
পারিবারিক স্থিতির ইসলামী সংরক্ষণ
ইসলামে তালাকের ব্যবস্থা আছে বলে পাশ্চাত্য সমাজ ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। তারা বলেছে, তালাক ব্যবস্থা থাকায় মনে হচ্ছে, ইসলামে নারীর কোনো সম্মান নেই, আর বিয়েরও নেই কোনো গুরুত্ব –স্থায়িত্ব।
কিন্তু তালাকের ব্যবস্থাপনায় ইসলাম একক নয়। ইহুদী শরীয়তেও তালাকের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাচীন সমাজসমূহেও এর প্রচলন ছিল। স্বয়ং খ্রিষ্টানদের মধ্যেও তালাকের ব্যবস্থা –তা অত্যন্ত লজ্জাকরভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অথচ ইসলাম এমন এক পারিবারিক ব্যবস্থা উপস্থাপিত করেছে, যা স্বামী ও স্ত্রী –উভয়েরই ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও মর্যাদার পূর্ণ নিয়ামক এবং তা পরিবারকে এমনি সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলে, যার ফলে মানবীয় সমাজ হয় অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। নিতান্ত প্রয়োজনের কারণেই তালাকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু তবুও এ ব্যবস্থাকে কেউ খেলনার ছলে গ্রহণ করে নারীকে অযথা কষ্ট দেবে আর পরিবারের পবিত্রতা বিনষ্ট করবে, তার কোনো সুযোগই রাখা হয়নি।
ইসলাম প্রথমত বিয়ে ও দাম্পত্য জীবনকে চিরদিদের তরে স্থায়ী করে তুলতে চায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই বসবাস করবে –এই তার নির্দেশ। এ কারণে ইসলামে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে বিয়েকে জায়েয বলে গ্রহণ করা হয়নি।–[কেবলমাত্র শিয়া ফিকাহতে বিয়েকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ এক সাময়িক নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে বিয়ে। আর দ্বিতীয় চিরস্থায়ী বিয়ে। কিন্তু সুন্নী ফিকাহতে এই বিভক্তি গ্রাহ্য হয়নি। (আরবী***********************)] এরূপ শর্তে কোনো বিয়ে যদি সম্পন্ন হয়ওতবে সে বিয়ে চিরদিনের জন্যে হয়ে যাবে, আর মেয়েদের সে শর্ত বাতিল হয়ে যাবে।
বিরোধ মীমাংসার পন্থা
ইসলাম সর্বপ্রথম দাম্পত্য জীবনের সম্ভাব্য সকল প্রকার বিরোধ ও মনোমালিন্য শান্তিপূর্ণভাবে বিদূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নিম্নলিখিত উপায়ে বিরোধসমূহের মীমাংসা করা সম্ভবঃ
(আরবী**********************************************************************************)
১. স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই উভয়ের অধিকার ও উভয়ের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধসম্পন্ন হতে নির্দেশ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীমের এ মহামূল্য বাণীটি বারে বারে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছেঃ
হুশিয়ার, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
(আরবী*******************************************************************************)
পুরুষ দায়ী তার পরিবারবর্গের জন্যে। আর সেজন্যে সে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হবে।
(আরবী*************************************************************************)
স্ত্রী দায়ী তার স্বামীর ঘরবাড়ি ও যাবতীয় আসবাবপত্রের জন্যে এবং সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
বস্তুত এ দায়িত্ববোধ উভয়েরমধ্যে পূর্ণমাত্রায় জাগ্রত থাকলে পারিবারিক জীবনে কখনো ভাঙ্গন বা বিপর্যয় আসতে পারবে না, কখনো তালাকের প্রয়োজন দেখা দেবে না।
২. দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীতে যখনই কোনো প্রকার বিবাদ-বিরাগ বা মনোমালিন্য দেখা দিবে, তখনই তাদের উভয়ের জন্যে এ নসীহত রয়েছে যে, প্রত্যেকেই যেন অপরের ব্যাপারে নিজের মধ্যে সহ্য শক্তির সংবৃদ্ধি রক্ষা করে, অপরের কোনো কিছু অপছন্দনীয় হলে বা ঘৃণার্হ হলেও সে যেন দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য রক্ষার উদ্দেশ্যে তা অকপটে বরদাশত করতে চেষ্টা করে। কেননা এ কথা সর্বজনবিদিত যে, পুরুষ ও স্ত্রী –স্বভাব-প্রকৃতি, মন-মেজাজ ও আলাপ ব্যবহার ইত্যাদির দিক দিয়ে পুরামাত্রায় সমান হতে পারে না। কাজেই অপরের অসহনীয় ব্যাপার সহ্য করে নেয়ার জন্যে নিজের মধ্যে যোগ্যতা অর্জন করা কর্তব্য।
৩. দাম্পত্য জীবন সংরক্ষণের এ ব্যবস্থা যদি ব্যর্থ হয়ে যায়, বিরোধ বিরাগ ও মনোমালিন্যের মাত্রা যদি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতেই থাকে, তাহলে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত মীমাংসার জন্যে উভয়ের নিকটাত্মীদের সাগ্রহে এগিয়ে আসা কর্তব্য। স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন এবং স্বামীর পক্ষথেকে একজন পরস্পরের মধ্যে মিলমিশ বিধানের জন্যে ঐকান্তিক নিষ্ঠাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে চেষ্টা চালাবে। এ যেন পরিবারিক বিরোধ মীমাংসার আদালত এবং এ আদালতের বিচারপতি হচ্ছে এ দু’জন। তারা উভয়ের মনোমালিন্যের বিষয় ও তার মূলীভূত কারণ সতর্কতার সঙ্গে অনুসন্ধান করবে। আর তার সংশোধন করে স্থায়ী মিলমিশ ও প্রেম ভালোবাসা পুনর্বহালের জন্যে চেষ্টা করবে। বস্তু স্বামী-স্ত্রী যদি বাস্তবিকই মিলেমিশে একত্র জীবন যাপনে ইচ্ছুক এবং সচেষ্ট হয় তাহলে সাময়িক ছোটকাট বিবাদ নিজেরাই মীমাংসা করে নিতে পারে। আর বড় কোনো ব্যাপার হলেও তা এ পারিবারিক সালিসী আদালত দ্বারা মীমাংসা করিয়ে নেয়া খুবই সহজ। কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াতে এ ব্যবস্থারই নির্দেশ করা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************************************)
যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকোনো বিরোধ মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছে বলে ভয় করো, তাহলে তোমরা স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। তারা দু’জন যদি বাস্তবিকই অবস্থার সংশোধন করতে চায়, তাহলে আল্লাহ তাদের সে জন্যে তওফীক দান করবেন।
‘যদি তোমরা ….. ভয় করো’ বলে আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে দেশের শাসক ও বিচারকদের, সমাজের মাতবর-সরদারদের কিংবা স্বামী-স্ত্রীর নিকটাত্মীয় ও মুরব্বীদের। (আরবী**********) বলা হয়েছেঃ তোমাদের মনে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে যদি কোনো প্রকারের সন্দেহের উদ্রেক হয় –সম্পর্ক মধুর নেই বলে ধারণা জন্মে, তাহলে তখন প্রকৃত ব্যাপার তদন্ত করা এবং অবস্থার সংশোধনের জন্যে চেষ্টিত হওয়া অবশ্য কর্তব্য। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে দাম্পত্য জীবনে ভাঙ্গন আসতে পারে এবং তা কিছুতেই কারো কাম্য হতে পারে না –ইসলামও তা পছন্দ করে না আর এ চেষ্টার পদ্ধতি হিসেবে বলা হযেছে, স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা এমন দু’জন ব্যক্তিকে মাধ্যম ও সালিস হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে, যারা কোনো কথা বলে উভয়কে মানাতে পারবে। এ দুজনকে এদের নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকেই হতে হবে।
(আরবী********************************************************************************)
কেননা নিকটাত্মীরাই প্রকৃত অবস্থার গভীরতর রূপের সন্ধান পেতে পারে। সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারে এবং তারা অবশ্যই উভয়ের মধ্যে মিলমিশ করার জন্যে সর্বাধিক আগ্রহী হয়ে থাকে।
বাইরের লোক এ মীমাংসা কাজে নিয়োগ না করে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই আপন জন নিয়োগের নির্দেশ দেয়ার কারণ যে কি, তা আল্লামা আবূ বকর আল-জাসসাস-এর নিম্নোক্ত কথা থেকে জানা যায়। তিনি এ কারণ দর্শাতে গিয়ে লিখেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
বাইরের অনাত্মীয় লোক বিচারে বসলে তাদের কোনো এ পক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়ার ধারণা হতে পারে; কিন্তু উভয়েরই আপন আত্মীয় যদি এ মীমাংসার ভার গ্রহণ করে এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ পক্ষের কথা বলে, তাহলে এ ধরনের কোনো ধারণার অবকাশ থাকে না –এজন্যেই আত্মীয় ও আপন লোককে এ বিরোধ মীমাংসার ভার দিতে বলা হয়েছে।
হযরত আলীর খেদমতে এক দম্পতি বহু সংখ্যক লোক সমভিব্যবহারে উপস্থিত হলে তিনি ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করলেন। তাঁরা বললেনঃ এই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছেঃ তার মীমাংসা চাই। তখন হযরত আলী (রা) বললেনঃ উভয়ের আপন আত্মীয় থেকে এক-একজনকে এ বিরোধ মীমাংসায় নিযুক্ত করে দাও। যখন দু’জন লোককে নিযুক্ত করা হলো, তখন হযরত আলী (রা) বললেনঃ তোমাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা কতখানি তা জানো? তার পরে তিনি নিজেই বলে দিলেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
তোমাদের দায়িত্ব হলো, তারা দু’জনে মিলেমিশে একত্রে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে চাইলে তার ব্যবস্থা করে দেবে। আর যদি মনে করো যে, তারা উভয়েই বিচ্ছিন্ন হতে চায়, তাহলে পরস্পরকে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মিতভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।
বিচারকদ্বয় সব কথা শুনে, সব অবস্থা জেনে বুঝে একটি ফয়সালা দেবে ও উভয়কে তা মানবার জন্যে বলবে। কিন্তু যদি তারা উভয় বা একজন তা মানতে রাজি না হয়, তাহলে তাকে ফয়সালা মেনে নেয়ার জন্যে নির্দেশ দিতে হবে। কেননা আয়াতে ব্যবহৃত শব্দনিচয়ের দৃষ্টিতে বলা যায়, এ দু’জন প্রথমত এক এক পক্ষ থে উকীল আর উকীলের কাজ হলো বলা। কিন্তু সে বলায় দি বিরোধের চূড়ান্ত অবসান না হয়, তাহলে তারা দু’জনে বিচারকর্তার মর্যাদা নিয়ে রায় মেনে নেয়ার জন্যে নির্দেশ দেবে। এ নির্দেশ মেনে নিতে উভয়েই বাধ্য। কেননা কুরআন মজীদে তাদের বলা হয়েছে ‘হাকিম’ অর্থাৎ হুকুমদাতা, বিচারক, ফয়সালাকারী। ফিকাহর কিতাবে এ সম্পর্কিত মতভেদ ও প্রত্যেক কথার দলীলের উল্লেখ রয়েছে।
এ ধরনের যাবতীয় চেষ্টা চালানোর পরও যদি মিলেমিশে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকবার কোনো উপায় না বেরোয়, বরং উভয় পক্ষই চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্যে অনমনীয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ইষলাম তাদের দাম্পত্য জীবনের চূঢ়ান্ত অবসান ঘটাবার –তালাক দেয়ার –অবকাশ দিয়েছে।
ইসলামের এ তালাক দানের একটা নিয়মও বেঁধে দেয়া হয়েছে এবং তা হচ্ছে এই যে, স্বামী-স্ত্রীর ‘তুহর’ (হায়েয না থাকা) অবস্তায় একবার এক তালাক দেবে। এ তালাক লাভের পর স্ত্রী স্বামীর ঘরেই ‘ইদ্দত’ পালন করবে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে না –এরূপ তালাক দান ও ইদ্দত পালনের নিয়ম করার কারণ হলো –এতে করে উভয়েরই স্নায়ু মণ্ডলির সুষ্ঠু এবং তাদের অধিক সুবিবেচক হয়ে ওঠার সুযোগ হবে। চূড়ান্ত বিচ্ছেদের যে কি মারাত্মক পরিণাম তা তারা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারবে। স্পষ্ট বুঝতে সক্ষম হবে যে, তালাকের পর তাদের সন্তান-সন্ততির ও ঘর-সংসারের কি মর্মান্তি দুর্দশা হতে পারে। ফলে তারা উভয়েই অথবা যে পক্ষ তালাকের জন্যে অধিক পীড়াপীড়ি করেছে –ঝগড়া-বিবাদ ও বিরোধ-মনোমালিন্য সম্পূর্ণ পরিহার করে আবার নতুনভাবে মিলিত জীবন যাপন করতে রাজি হতে পারে। এ সাময়িক বিচ্ছেদ তাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার তীব্র আকর্ষণও জাগিয়ে দিতে পারে।
যদি তাই হয়, তাহলে এক-এক তালাককে ‘তালাকে রিজয়ী’ বা ‘ফিরিয়ে পাওয়ার অবকাশ পূর্ণ তালাক’ বলা হবে। তিন মাস ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বেই উভয়ের পুনর্মিলন সাধন করতে হবে। এতে নতুন করে বিয়ে পড়াতে হবে না (যদিও ইমাম শাফেয়ীর মতে মুখে অন্তন ফিরিয়ে নেয়ার কথা উচ্চারণ করতে হবে)।
৫. কিন্তু যদি এভাবে তালাক দেয়ার পর তিন মাসের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে গ্রহণ করা না হয়, তাহলে এ তালাক বায়েন তালাক হয়ে যাবে। তখন যদি ফিরিয়ে নিতে হয়, তাহলে পুনরায় বিয়ে পড়াতে হবে ও নতুন করে দেন-মোহর ধার্য করতে হবে। এমতাবস্থায় স্ত্রী স্বাধীন –সে ইচ্ছা করলে প্রথম স্বামীকে পুনরায় গ্রহণ করতেও পারে, আর ইচ্ছা না হলে সে অপর কোনো ব্যক্তিকে স্বামীত্বে বরণ করে নিতেও পারে। প্রথম স্বামী ও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে কোনোরূপ জবরদস্তি বা চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না এবং তার অপর স্বামী গ্রহণের পথে বাধ সাধতেও পারবে না।
৬. এক তালাকের পর ইদ্দতের মধ্যেই স্ত্রীকে যদি ফিরিয়ে নেয়া হয়, আর স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জীবন যাপন শুরু করার পর আবার যদি বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে প্রথমবার ন্যায় আবার পারিবারিক আদলতের সাহায্যে মীমাংসার জন্যে চেষ্টা করতে হবে। এবারও যদি মীমাংসা না হয় তাহলে স্বামী তখন আর এক তালাক প্রয়োগ করবে। তখনও প্রথম তালাকের নিয়ম অনুযায়ীই কাজ হবে।
৭. দ্বিতীয়বার তালাক দেয়ার পর যদি স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় আর তারপর বিরোধ দেখা দেয়, তখনো প্রথম দুবারের ন্যায় মীমাংসার চেষ্টা করতে হবে। আর তা কার্যখর না হলে স্বামী তৃতীয়বার তালাক প্রয়োগ করতে পারে। আর এই হচ্ছে তার তালাক দানের ব্যাপারে চূড়ান্ত ও সর্বশেষ ক্ষমতা। অতঃপর স্ত্রী তার জন্যে হারাম এবং সেও তার স্ত্রীর জন্যে চিরদিনের জন্যে হারাম হয়ে যাবে।
কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************************************)
তালাক দুবার দেয়া যায়, তার পরে ভালোভাবে স্ত্রীকে গ্রহণ করা হবে, না হয় ভালোভাবে সকল কল্যাণ সহকারে তাকে বিদায় দেয়া হবে।
এ ‘বিদায় করে দেয়া হবে’ থেকেই তৃতীয় তালাক বোঝা গেল। তা মুখে স্পষ্ট উচ্চারনের দ্বারাই হোক, কি এমনি রেখে দিয়ে এক ‘তুহর’ কাল অতিবাহিত করিয়েই দেয়া হোক –উভয়ের পরিণতি একই।
নবী করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ আয়াতে তো মাত্র দুবার তালাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাহলে তৃতীয় তালাক কোথায় গেল? তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
(আরবী*******************************************)
‘কিংবা ভালোভাবে বিদায় করে দেয়া হবে’ বাক্যে-ই তৃতীয় তালাকের কথা নিহিত রয়েছে। -আবূ দাউদ।
তালাক ব্যবস্থা
এই তৃতীয় তালাক –তাই যেভাবেই দেয়া হোক –এরপর স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে ও স্ত্রী হিসেবে তাকে নিয়ে বসবাস করতে পারবে না।
এ আয়াত স্পষ্ট ভাষায় বলে দিচ্ছে যে, এক বা দুই তালাক দেয়ার পর স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করা হোক, আর তাকে চিরদিনের তরে বিদায় দেয়া হোক –উভয় অবস্থায়ই স্ত্রীর প্রতি ভালো ব্যবহার করতে হবে, তার মান-মর্যাদা ও ইযযত-আবরুর এক বিন্দু ব্যাঘ্যাত করা চলবে না। ফিরিয়ে নিলেও যাতে করে তার স্ত্রীত্বের মর্যাদা ও সম্ভ্রম কিছুমাত্র ব্যাহত হতে না পারে, আর চূড়ান্তভাবে তালাক দিয়ে পরিত্যাগ করা হলেও যাতে তার মান-সম্মান ও নৈতিকতার ওপর কোনো কলঙ্ক আরোপ করা না হয়, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বামীর এ অধিকার নেই যে, এক বা দুই তালাক দেয়ার পর তাকে পুনরায় গ্রহণ করে তাকে লাঞ্চিতা ও অপমানিতা করবে, তেমনি চিরদিনের তরে বিদায় করতে হলেও তার কুৎসা প্রচার করে তার গোপন কথা জনসমাজে বা আদালনের বিচারকমণ্ডলী ও সমবেত জনতার সামনে প্রকাশ করে দিয়ে –অতীত দাম্পত্য জীবনের সব ময়লা আবর্জনা হাটে ঘাটে ধৌত করবে, ভবিষ্যতে অপর কোনো পুরুষ তাকে আগ্রহ ও ভক্তি সহকারে স্ত্রীত্বে বরণ করবে –তার পথ বন্ধ করে দেবে না, এ অধিকার স্বামীকে আদৌ দেয়া যায় না, ইসলামে তা দেয়া হয়নি। অতএব যে ব্যবস্থাধীন তালাক কেবল আদালতেই কার্যকর হতে পারে, আর স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর বা স্বামীর পক্ষে স্ত্রীর নৈতিক চরিত্রহীনতা ও দাম্পত্য জীবনে অসততার প্রমাণ না দিয়ে তালাক নেয়া বা দেয়া যায় না এবং চিরমুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষেল বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় ব্যভিচারের অভিযোগ আনতে হয়, তা কোনোক্রমেই মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষের নীতি হতে পারে না। ইসলাম তালাকের এই পদ্ধতি গ্রহণ করেনি। কুরআন তো এ আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেঃ রাখো তো ভালোভাবে রাখো, না রাখো তো তার কল্যাণ ও মঙ্গলকে অক্ষুণ্ন রেখেই এবং সে কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যেই চির বিদায় করে দাও, যেন সে অন্যত্র তার জুড়ি গ্রহণ করে সুষ্ঠু দাম্পত্য জীবন যাপন করতে পারে এবং তুমিও পারো নতুন স্ত্রী গ্রহণ করে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন অতিবাহিত করার ব্যবস্থা করতে।
এ পর্যায়েই আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
স্বামী ও স্ত্রী যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়ই, তাহলে আল্লাহ তাঁর ঐশ্বর্য ও স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে তাদের দুজনকেই নিশ্চিত ও স্বচ্ছন্দ করে দেবেন। আর আল্লাহ তা’আলা বাস্তবিকই বিশালতা দানকারী সুবিজ্ঞ বিজ্ঞানী।
তার মানে, স্বামী-স্ত্রী যদি পারস্পরিক সম্পর্ককে সুষ্ঠু, নির্দোষ ও মাধুর্যপূর্ণ করে নিতে না পারে এবং শেষ পর্যন্ত যদি তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটেই যায়, তাহলে আল্লাহ তাদের পরস্পরকে পরস্পর থেকে মুখাপেক্ষীহীন করে দেবেন। একজন অপরজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও তারা সুখে ও শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। স্বামী অপর এক স্ত্রী গ্রহণ করে এবং স্ত্রী অপর এক স্বামী গ্রহণ করে সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করবে।
এ আয়াতে স্বামী-স্ত্রীর তালাক গ্রহণর পরবর্তী মর্মান্তিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়কেই সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে, যেন তারা শরীয়ত অনুযায়ী পারস্পরিক বিচ্ছেদ ঘটিয়ে কোনোরূপ মর্মজ্বালায় নিমজ্জিত না হয়ে বরং তালাক পরবর্তী বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি হয়ে যেন তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। অতীতের কোনো স্মৃতিই যেন তাদের মনকে পীড়িত না করে। নতুন করে যেন তারা বিবাহিত হয়ে সুখময় জীবনের সন্ধান করে। পুরুষ যেন আবার বিয়ে করে গ্রহণ করে অপর এক মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে। মেয়ে লোকটিও যেন নতুন স্বামী গ্রহণ করে এবং এ নতুন সংসারে যেন তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িথ্ব যথাযথরূপে পালন করে। সেক্ষেত্রে যেন উদ্যোগ, আগ্রহ ও আন্তরিকতার কোনো অভাব দেখা না দেয়। এ আয়াতের মূল বক্তব্য এই।
বস্তুত ইসলামে তালাকের ব্যবস্থা করা হয়েছে জীবন নাট্যের চূড়ান্ত অবসান ঘটাবার জন্যে নয়, বরং নতুন করে এক উদ্যমপূর্ণ জীবন শুরু করাবার উদ্দেশ্যে। এ ভাঙ্গন ভাঙ্গনের জন্যে নয়, নতুন করে গড়বার জন্যে। তাই এ ভাঙ্গন কিছুমাত্র দূষণীয় নয়, নয় নিন্দনীয়, অবশ্য যদি তা গ্রহণ করা হয় সর্বশেষ ও চরম উপায় হিসেবে।
উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, তালাক ব্যবস্থা যদিও পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের পক্ষে এক অবাঞ্ছনীয় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে সন্তান-সন্ততির পক্ষে তা মর্মান্তিক অবস্থার সৃষ্টি করে। কিন্তু পারিবারিক জীবনের আর এক বৃহত্তর দুর্দশা থেকে নারী-পুরুষ ও সন্তান-সন্ততিকে রক্ষা করার কল্যাণময় উদ্দেশ্যেই ইসলামে এর অবকাশ রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইসলামে তালাক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এক চরম অবস্থার প্রতিকারের বিশেষ পন্থা হিসেবে, নিরুপায়ের উপায় হিসেবে। যখন আর কোনো উপায়ই নেই, শান্তিতে বসবাস যখন সম্ভবই হচ্ছে না ঠিক সে অবস্থায় প্রয়োগের জন্যেই এ ব্যবস্থা।
তিন তালাকের পরিণতি
এক, দুই ও তিন তালাক হয়ে যাওয়ার পর স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের জন্যে চিরতরে হারাম হয়ে যায়। অতঃপর এতদুভয়ের পুনরায় স্বামী স্ত্রী হিসেবে মিলিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ সময় অবস্থা দাঁড়ায় এরূপ যে, স্বামী সেই স্ত্রীর নয় এবং স্ত্রী সেই স্বামীর স্ত্রী নয়। যারা ছিল পরস্পরের জন্যে সম্পূর্ণ হালাল, তালাক সংঘটিত হওয়ার পর তারাই পরস্পরের জন্যে হারাম হয়ে গেছে। এ হারাম হওয়ার কথা কুরআন মজীদের সূরা আল-বাকারার ২৩০ আয়াতের প্রথমাংশ থেকেই প্রমাণিত হয়। তা হলঃ
(আরবী************************************************************************)
স্বামী যদি স্ত্রীকে তৃতীয় তালাকও দিয়ে দেয়, তাহলে অতঃপর সেই স্তী তার জন্যে হালাল হবে না।
তৃতীয়বার তালাক দানে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ ঘটে যায় এবং তারা পরস্পরের জন্যে হারাম হয়ে যায়। এরূপ ঘটানোর মূলে একটি বিশেষ মানসিক কারণ নিহিত হয়েছে। কেননা এ তৃতীয়বারের তালাকেও যদি তালাক সংঘটিত না হতো, যদি একজন অন্য জনের হারাম হয়ে না যেত, তাহলে দুনিয়ার স্বামীরা স্ত্রীদের বৈবাহিক জীবন নিয়ে মারাত্মক ছিনিমিনি খেলবার সুযোগ পেত। স্ত্রীকে স্ত্রী হিসেবে তার পাওনা অধিকার দিত না অথচ সে তার কাছ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারলে অন্যত্র বিবাহিত হয়ে সুখী দাম্পত্য জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করতে পারত। সে কারণে ইসলামী শরীয়তে এ মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যথায় অবস্থা দাঁড়াত এই যে, একবার একজনের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে জীবনে কোনো দিনই তার বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হতো না। ফলে পূর্ণ স্ত্রীত্বের অধিকারও যেমন তার কাছে পেত না, তেমনি তার কাছ থেকে চলে গিয়ে অপর একজনকে স্বামীত্বে বরণ করে নিয়ে সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করাও সম্ভব হতো না।
ইসলামের ব্যবস্থা হচ্ছে, তিনবার তালাক হওয়ার পর এ স্বামী স্ত্রী পরস্পরের জন্যে চিরদিতের তরে হারাম হয়ে গেল। কিন্তু এতদুভয়ের যদি আবার স্বামী স্ত্রী হিসেবে একত্রিত হতে হয়, তাহলে স্ত্রী লোকটির অপর একজন স্বামী গ্রহণ করতে হবে এবং স্বাভাবিক নিয়মে তার কাছে থেকে মুক্তি পেতে হবে, অন্যথায় তা কখনো হালাল হবে না।
তৃতীয়বারের তালাক সংঘটিত হওয়ার পর স্বামী স্ত্রীর পুনর্মিলনের জন্যে কুরআন মজীদে যে অপর এক ব্যক্তির সাথে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপন ওতার কাছ শেতে তালাক লাভের শর্ত করা হয়েছে, তার মধ্যেও এমন মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে, যা প্রত্যেক স্বামীকে চূড়ান্তভাবে তালাক দানের উদ্যম থেকে বিরত রাখে। কেননা অপর কোনো স্বামী কর্তৃক ব্যবহৃত হয়ে এলে তাকে প্রথম স্বামীর পক্ষে পুনরায় স্ত্রী হিসেবে খুশী মনে গ্রহণ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে সব স্বামীই নিজ স্ত্রীকে তিন তালাক দিতে খুম কমই রাজি হবে।
তালাক সম্পর্কিত এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে পারিবারিক জীবন অত্যন্ত মহান ও সম্মানার্হ। জীবনে যাতে করে কোনো প্রকার বিপর্যয় দেখা দিতে না পারে, তার জন্যে সম্ভাব্য সবরকমের ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে। অতএব বলা যায়, ইসলামের তালাক ব্যবস্থা পারিবারিক জীবনের রক্ষাকবচ।
তালাক দানের ক্ষমতা কার
উপরের আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলামে তালাক দেয়ার কাজ কেবল স্বামীর, এ ক্ষমতাও একান্তভাবে স্বামীকেই দেয়া হয়েছে। স্বামী যদ্দিন ইচ্ছা একজন স্ত্রীকে স্ত্রী হিসেবে রাখতে পারে। আর যখন ইচ্ছা –কারণ কিছু থাক বা নাই থাক –স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বিদায়করে দিতে পারে। এ ইখতিয়ারও স্বামীরই রয়েছে। কিন্তু ইসলামের এরূপ বিধান কেন? স্ত্রীকে এ ব্যাপারে কোনা ইখতিয়ার দেয়া হয়নি কেন? এতে করে স্ত্রী দাম্পত্য জীবনকে স্বামীর দয়া-অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীলা করে দেয়া হয়নি –আর এটাই কি ইনসাফ? বিষয়টি বিশদ আলোচনা সাপেক্ষ। তালাক দানের ক্ষমতা কাকে দেয়া যেতে পারে তা সাধারণ বুদ্ধিতে আমরা নিম্নোক্ত পাঁচটি সম্ভাবনাকে সম্মুখে রেখে বিবেচনা করতে পারিঃ
১. তালাক দানের ক্ষমতা কেবলমাত্র স্ত্রীকে দেয়া;
২. তালাক দানের কাজটি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে সম্পন্ন হওয়ার ব্যবস্থা করা;
৩. তালাক দানের ক্ষমতা প্রয়োগ কেবলমাত্র বিশেষ সরকারী বিভাগ কর্তৃক সম্পন্ন হওয়ার ব্যবস্থাকরা;
৪. তালাক দানের ক্ষমতা কেবলমাত্র স্বামীর হাতে ন্যস্ত করা;
৫. তালাক দানের ক্ষমতা যদিও দূড়ান্তভাবে স্বামীকে দেয়া হবে কিন্তু সে সঙ্গে স্ত্রীকেও ক্ষেত্র ও অবস্থান বিশেষ তালাক গ্রহণের সুযোগ দেয়া।
এ পাঁচটি ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা বিস্তরিত আলোচনা করে দেখতে চাইঃ
১. কেবলমাত্র স্ত্রীকে তালাক দানের ক্ষমতা দেয়ার উপায় নেই। কেননা এতে করে স্বামীকে কঠিন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করে দেয়া হবে। আর পারিবারিক জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ও ভঙ্গুরতা প্রবল হয়ে দেখা দেবে। তালাকে আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতি সাধন হয় কেবল স্বামীর –স্ত্রীর নয় বরং স্ত্রী তো নিত্য নতুন স্বামী গ্রহণের সুযোগ পেলে প্রতিবারে নতুন করে দেন-মোহর পেয়ে আর্থিক দিক দিয়ে বড়ই লাভবান হতে পারবে। নিত্য নতুন সাজসজ্জা, নিত্য নতুন ঘরবাড়ি ও নিত্য নতুন পুরুষের ক্রোড় লাভের সুযোগ পাবে। ক্ষতির দিকটি সম্পূর্ণই পড়বে স্বামী বেচারার ভাগ্যে। কেননা দেন-মোহর ও যাবতীয় খরচ তাকেই বহন করতে হয়। কাজেই তালাক দানের ক্ষমতা কেবল স্ত্রীর হাতে থাকলে স্বামীর অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে তা প্রয়োগ করে নতুন স্বামী গ্রহণ করার জন্যে চলে যেতে পারবে। আর তখন এ ক্ষমতার অপপ্রয়োগের আশংকাও খুব তীব্র হয়ে দেখা দেবে। স্ত্রীলোকের মন-মেজাজ দ্রুত পরিবর্তনশীল, স্পর্শকাতর, ক্রোধান্ধ। পরিণাম সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তায় অক্ষম। স্বামী তার সাথে সামান্য ব্যাপার নিয়ে একটু মতভেদ করলেই স্ত্রী অতিষ্ট হয়ে তালাক দিয়ে ফেলবে এবং নতুন স্বামীর সন্ধানে বের হয়ে পড়বে।
২. স্বামী স্ত্রী উভয়ের সম্মতিক্রমে তালাক দেয়ার ব্যবস্থা করা হলে তালাক দানের ব্যাপারটি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে; যদিও ইসলাম পারস্পরিক বোঝাপড়া করাকে নিষেদ করেনি। কিন্তু তাই বলে বোজাপড়া ও স্ত্রীর সম্মতি ব্যতিরেকে তালাক দিলে তালাক সিদ্ধ হবে না, এমন শর্ত ইসলামে করা হয়নি। কেননা এরূপ শর্ত করা হলে স্ত্রী স্বামীর সাথে ইচ্ছাপূর্ভক অমানুষিক ও অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেও তালাকের পরিণাম থেকে রেহাই পেয়ে যেতে পারে। এরূপ অবস্থায় বহু সংখ্যক স্বামীরই দাম্পত্য জীবন মারাত্মকরূপে বিষাক্ত ও দুঃসহ হয়ে পড়ত। তাছাড়া স্ত্রী তো ঘরবাড়ির ব্যয়ভার বহন করে না, স্বামীকেও কোনো অর্থ দিয়ে সাহায্য করে না, করতে বাদ্য নয়, এজন্যে তার কোনো দায়িত্ব নেই। এমতাবস্থায় সে কেন তালাকে সম্মতি দেবে? আর তখন স্বামীকেই বা কি করে এমন স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে বলা যায়, যে তাকে ভালোবাসে না? শুধু তাই নয় –ঘৃণা করে, আদৌ সহ্য করতে পারে না অথচ তালাক নিতেও সম্মত নয়?
৩. সরকারী ব্যবস্থাপনায় তালাক ঘটানো সম্পূর্ণ ইউরোপীয় রীতি। এর ক্ষীত ও কদর্যতা এখন দুনিয়ার মানুষের সামনে প্রকট হয়ে পড়েছে। কেননা তা করা হলে উভয়কেই দাম্পত্য জীবনের কলুষতাকে হাটের মাঝখানে তুলে ধরতে হবে, প্রত্যেককেই অপর পক্ষের নৈতিক দোষ, কলংক ও দুর্বলতা প্রমাণিত করতে হবে বিচারকদের সামনে। আর একাজে যে সামাজিক নৈতিকতা ও সংহতি-স্থিতির পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক, তা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না।
৪. তালাকদানের ক্ষমতা কেবল স্বামীর হাতে ন্যস্ত করা হলে সেটা হবে সত্যই এক স্বভাবসম্মত ব্যবস্থা। কেননা পারিবারিক জীবনের সব রকমের দায়দায়িত্ব প্রধানক তাকেই বহন করতে হয়। আর্থিক প্রয়োজন তাকেই পূরণ করতে হয়। সে ইচ্ছা করে বারে বার নতুন বিয়ে করে দেন-মোহর দেয়ার, বিয়ে-উৎসবের খরচ বহন করার ঝুঁকি গ্রহণ করতে সহজে রাজি হতে পারে না। সে একবারের বিয়েকে স্থায়ী করে রাখার জন্যে চেষ্টিত হবে প্রাণপণে। আরসে তালাক দিতে রাজি হলেও তাহবে ঠিক তখন, যখন স্ত্রীর সাথে একত্রে ঘর করার আর কোনো উপায়ই অবশিষ্ট নেই।
অপরদিকে, পুরুষরা সাধারণত্যশক্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে। পারিবারিক জীবন যত ঝড়-ঝাপটাই আসুক, যতই কষ্ট হোক, যতই জটিলতা দেখা দিক, বাইরের কিংবা ভিতরে, সবই সে অকাতরে সইতে পারে। সয়ে থাকে। তার পক্ষে তালাকের জন্যে তৈরী হওয়া কেবল তখনই সম্ভব, যখন দাম্পত্য জীবন সব রকমের সুখ-শান্তি ও সৌবাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত তালাক দেয়ার ও নতুন করে বিয়ে করে ঘরে আনার পরিণাম, দাম্পত্য সুখ ও আর্থিক ব্যয় বহনের দিক দিয়েও সে সব সময়ই সজাগ থাকে। কাজেই তার পক্ষে যখন-তখন তালাক দানের ক্ষমতা প্রয়োগ হওয়া সহজ মনে করা যেতে পারে না, অন্তত যদ্দিন একত্রে মিলেমিশে ও সুখে থাকার শেষ আশাটুকু নিভে না যাবে।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, স্বামী সব সময় এ চরম অবস্থায় পড়েই তালাক দানের ক্ষমতা প্রয়োগ করে না, বরং প্রায়ই দেখা যায়, স্ত্রীর সঙ্গে সামান্য ঝগড়াঝাটি ও কলহের দরুন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়, একান্তই অকারণে স্ত্রীকে শুধু কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে তালাক দেয় অথবা এও দেখা যায় যে, নিত্য নতুন বধুয়ার মধু লুণ্ঠনের সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে স্বামী তার এক স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছে, ফলে এ স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিপীড়িত ও অপদস্ত হচ্ছে। এর প্রতিবধান কি করা যেতে পারে?
এর জবাবে বলা যায়, দুনিয়ার যে কোনো ব্যবস্থাই খারাপভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর ক্ষমতাবান ব্যক্তি যদি চরিত্রহীন ও দায়িত্বজ্ঞানশূন্য হয়, তাহলে তার পক্ষে সবক্ষেত্রে সীমা লংঘন করে যাওয়া একটা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ অবস্তা এই যে, স্বামী স্ত্রীর তুলনায় অধিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হয়ে থাকে, ঘর-সংসার ও সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাকেই বেশি করে ভাবতে হয় –অন্তত স্ত্রীর তুলনায়। তাই এ সাধারণ অবস্থাকে সামনে রেখেই বিধান হিসেবে তালাক দানের ক্ষমতা মূলত স্বামীর হাতেই অর্পন করা হয়েছে। বস্তুত নিয়ম কখনো ব্যর্থ যায় না। প্রত্যেক সাধারণ নিয়মকে যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্যে অনুরূপ ব্যক্তি-চরিত্র ও সমাজ পরিবেশ গড়ে তুলতে হয়। আর এজন্যে দীর্ঘ সময় চেষ্টা-সাধনা ও যত্নের প্রয়োজন। তালাক দানের সুযোগ ও স্বামীর ক্ষমতা একটা সাধারণ নিয়ম; কিন্তু স্বামীর চরিত্রহীনতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কারের দরুন কিছু লোক যদি এ সুযোগের অপব্যবহার করে, তাতে আসল মূলনীতির কোনো দোষ নেই। আর প্রত্যেক সাধারণ নীতির প্রয়োগে কারো না কারো কিছু-না-কিছু অসুবিধা কিংবা ক্ষতি সাধিত হয়েই থাকে। এটাও বিচিত্র কিছু নয়। কাজেই বৃহত্তর কল্যাণের দৃষ্টিতেই সাধারণ নীতির যথার্থতা বিচার করতে হবে। উপরোক্ত ক্ষতি ও অকল্যাণের দিকটির সংশোধন করা গলে পুরুষকে তালাক দানের ক্ষমতা দেয়াই যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হবে। এ কারণেই ইসলামে তালাক দেয়ার ক্ষমতা স্বামীকে দেয়া হয়েছে।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************************)
সে যার হাতে বিয়ের মূল গ্রন্থি নিবদ্ধ রয়েছে।
তাফসীরে মাযহারী এর অর্থ লিখেছেঃ
(আরবী*******************************************************************)
স্বামীই হচ্ছে বিয়ের বন্ধন ও সে বন্ধন খোলার কর্তৃত্বের অধিকারী।
তাবারানী ও বায়জাবীতেও এ অর্থই বর্ণিত হয়েছে। সায়ীদ ইবনে সুমাইয়্যিব, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, শা’বী, শুরাইহ, মুজাহিদ ও আবূ হানীফা প্রমুখ এ মত প্রকাশ করেছেন। (আরবী**********************)
আল্লামা আ-লুসী এ ব্যাখ্যা সম্পর্কে লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
আয়াতের এ ব্যাখ্যা রাসূল থেকে বর্ণিত, বর্ণিত হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে রাসূলে করীম (স)-এরই কাছ থেকে তাঁরই কথা হিসেবে আর সাহাবীদের এক জামা’আতও এ মতই পোষণ করতেন।
এ পর্যায়ে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে –এক ব্যক্তি নবী করীম (স)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আরয করলেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
হে রাসূল! আমার মালিক ও মনিব তার দাসীকে আমার কাছে বিয়ে দিয়েছিল। এখন সে আমার ও আমার স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়। এ কথা শুনে নবী করীম (স) মুসলিম জনগণকে একত্রিক করলেন এবং মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। বললেনঃ তোমাদের কি হয়েছে। তোমাদের এক-একজন তার দাসের কাছে তার দাসীকে বিয়ে দেয়। আর তার পরে তাদের দুজনের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়। জেনে রাখ, তালাক দেয়ার ইখতিয়ার তার, যে বিয়ে করেছে।
বস্তুত কুরআন ও হাদীসের এসব দলীল এবং মনীষীদের ব্যাখ্যা ও সমর্থন এ পর্যায়ের অকাট্য দলীল। এ দলীলসমূহ অতীব স্পষ্ট। এর অন্য কোনোরূপ ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। এসব মিলে এক সঙ্গে একথা প্রমাণ করে যে, তালাক দেয়ার ক্ষমতা ও অধিকার কেবলমাত্র স্বামীর। এমন কি রাসূলের পক্ষেও স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার ছিল না। অতএব দুণিয়ার কোনো দেশের কোনো সরকার বা সরকারী পদাধিকারী কোনো ব্যক্তির, আদালতের কোনো বিচারপতির কিংবা ইউনিয়ন কাউন্সিলের কোনো চেয়ারম্যানের –নিজ ইচ্ছেমতো তালাক দেয়ার কোনো অধিকার থাকতে পারে না। অবশ্য যদি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কই খারপা হয়ে যায়, কেউ যদি কারো অধিকার আদায় না করে, তাহলে সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারার কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার।
তালাক দানের কয়েকটি পন্থা
স্বামী-স্ত্রীর বিয়ে-সূত্রের অধিকারী। এ সূত্র ছিন্ন করার কিংবা রাখার ব্যাপারে তার অধিকারই স্বীকৃত। এ অধিকার অনুযায়ী বিয়ে সূত্রকে ছিন্ন করে দেয়ার নামই হলো শরীয়তের পরিভাষায় তালাক। এ তালাক কয়েক প্রকারে হতে পারে, তালাক দেয়ার পরও নতুন বিয়ে-অনুষ্ঠান ব্যতিরেকেই যদি স্ত্রীকে ফিরিয়ে রাখার অধিকার থাকে তবে তা হবে রিজয়ী তালাক। আর যদি সে অধিকার না থাকে, তবে তাকে বলা হবে বায়েন তালাক।
রিজবী তালাক-এর সংজ্ঞান হচ্ছেঃ
(আরবী******************************************************************************)
রিজয়ী তালাক হচ্ছে সে তালাক, যার পরও স্বামী তার তালাক দেয়া স্ত্রীকে নতুন আকদ অনুষ্ঠান না করেই ইদ্দতকালের মধ্যেই –রাজি হোক আর নাই হোক –ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার পায়।
আর ‘বায়েন তালাক’ দু’প্রকারের হতে পারে। একটি ছোট বায়েন আর অপরটি বড় বায়েন। ‘ছোট’ বায়েন তালাক হচ্ছেঃ
(আরবী**********************************************************************)
সে তালাক, যার পর স্বামী তালাক দেয়া স্ত্রীকে নতুন বিয়ে অনুষ্ঠান না করে ফিরিয়ে নিতে পারে না। তার মানে এ তালাকের পর স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করতে হলে নতুন করে বিয়ের আকদ হতে হবে।
আর বড় বায়েন তালাক হচ্ছেঃ
(আরবী**********************************************************************************)
সে তালাক, যার পর স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে না। পারে কেবল একটি অবস্থায়। আর তা হচ্ছে এই যে, স্ত্রীলোকটি অপর এক স্বামী গ্রহণ করবে সহীহ পন্থায় এবং সে তার সাথে প্রকৃতভাবেই সহবাস ও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে। এরপর তাদের মাঝে বিচ্ছেদ হবে কিংবা সেই দ্বিতীয় স্বামী তাকে রেখে মরে যাবে ও তার পরে এ মৃত্যুর ইদ্দত পালিত হবে।
বিভিন্ন প্রকারের তালাক কেন
তালাক ব্যবস্থার এরূপ বিভিন্ন পন্থায় অবকাশ রাখার মূলে ইষলামী শরীয়তের এক বিশেষ কল্যাণময় উদ্দেশ্যে নিহিত রয়েছে। তা হচ্ছে, শরীয়তের বিধানদাতার একমত্রা কামনা হলো পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের অক্ষুণ্নতা ও স্থায়িত্ব বিধান অর্থাৎ স্বাশী যদি কোনো জটিল মুহুর্তে বা বিশেষ কারণে তালাক দিতে বাধ্য হয়, তাহলে সে যেন ঠিক সেই পন্থায়ই তালাক দেয়, যে পন্থায় তালাক দিলে পরে তার স্ত্রীকে পুনর্বহাল করার শরীয়তসম্মত ও সম্মানজনক উপায় বর্তমান থাকে। হয় এমন অবস্থা হবে যে, ইদ্দতের মধ্যেই তাকে অবাধে ও নির্ঝঞ্ঝাটে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে আর তার তা যদি নাও হয় তবুও অন্তত পক্ষে যেন এরূপ হয় যে, নতুন করে বিয়ের অনুষ্ঠান করে ফিরিয়ে নিতে পারবে; কেননা এ দু’ধরনের তালাকে স্ত্রী সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে যায় না। রাগের বশবর্তী হয়ে কিংবা স্ত্রীকে শাসন করার উদ্দেশ্যে কোনো স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দিতেই চায় তাহলে সে যেন এ পর্যায়ের কোনো তালাক দেয়। তাহলে এর পর তাকে আফসোসও করতে হবে না, আর চরমভাবে লজ্জিত ও লাঞ্ছিতও হতে হবে না।
কিন্তু যদি রাগের বশবর্তী হয়ে অথবা পরিণাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে একসঙ্গে তিন তালাকই দিয়ে দেয়, তাহলে এর পর যে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, যে দুঃখ ও দুরবস্থার সম্মুখীন হতে হয় স্ত্রীকে, স্বামীকে, সন্তান-সন্ততিকে, গোটা পরিবারকে, তা ভাষায় বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। এর পর যে দুঃখ ও অনুতাপ জাগে স্বামীর অন্তরে, তার প্রতিকারের কোনো উপায়ই থাকে না তার হাতে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, তিন তালাক দেয়ার পরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা বসবাস করতে থাকে। আর এ হচ্ছে সুস্পষ্টরূপে জ্বেনার অবস্থা।, নিঃসন্দেহে তা হারাম। তাই কোনো লোকেরই একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া উচিত নয়। এর পরিণাম তালাকদাতা স্বামীকেই ভোগ করতে হয়। আর সে পরিণাম অত্যন্ত দুঃখময়, নিতান্ত অবাঞ্ছনীয় এবং অত্যন্ত মর্মান্তিক। এ থেকে বাঁচার জন্যে প্রস্তুত থাকা উচিত সব মানুষেরই।
তালাক দেয়ার পরও স্ত্রীকে ফিরিয়ে রাখার মাত্র দুটো উপায় উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তার কারণ এই যে, এ দুটো উপায়ই চূড়ান্ত বিপর্যয়ের হাত থেকে গোটা পরিবারকে রক্সা করার জন্যে যথেষ্ট। আর তিন তালাক দেয়ার পরও স্ত্রীকে ফিরিয়ে রাখতে না পারা এবং ফিরিয়ে রাখার সুযোগ না থাকাও অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা। এ হলো সীমালংঘনকারীর জন্যে শরীয়তের তরফ থেকে একটি শাস্তি। যে লোক এ কাজ করবে, তার শান্তিও তাকে ভোগ করতে হবে। তাতে করে প্রমাণিত হয় যে, স্বামী এ স্ত্রীকে নিয়ে ঘর না করারই সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে। অতএব সে পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে ধরে নিতে হবে। কেননা যদি কেউ বাস্তবিকই নিষ্কৃতি পেতে চায়, তাহলে নিষ্কৃতি লাভের সুযোগ তাকে দেয়াই সমীচীন। তাই শরীয়তের এ ব্যবস্তা এ দৃষ্টিতে সত্যিই কল্যাণময়।
‘হিলা বিয়ে’ জায়েয নয়
পূর্বোক্ত আলোচনায় একথা বলা হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে কিংবা সুন্নতী নিয়মে তিন তালাক দিলে সে স্ত্রীকে ফিরিয়ে রাখার কোনো উপায় থাকে না। সে তার জন্যে হারাম হয়ে যায়, হারাম হয়ে যায় –বলতে হবে –চিরতরে, তবে শরীয়াত একটি মাত্র উপায়ই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তা হলোঃ
(আরবী*********************************************************************************)
‘সে স্ত্রীলোকটি অপর স্বামী বিয়ে করবে’। তারপর সে দ্বিতীয় স্বামী যদি তালাক দেয় তারপরে যদি তারা পুনর্মিলিত হতে চায় এবং আল্লাহর বিধান কায়েম রাখতে পারবে বলে যদি মনে করে, তাহলে তাদের দু’জনের পুনরায় বিবাহিত হতে কোনো দোষ নেই।
আল্লামা আ-লুসী আয়াতটুকুর তাফসীর করেছেন এ ভাষায়ঃ
(আরবী**************************************************************************************)
অর্থাৎ সে স্ত্রীলোকটিকে অপর এক স্বামীর সাথে বিবাহিত হতে হবে এবং তার সাথে সহবাস করবে। এ দৃষ্টিতে শুধু বিয়ের আকদ হওয়াই এ আয়াতের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট হবে না।
তিনি আরও লিখেছেনঃ এ আয়াত থেকে একসঙ্গে দুটো কথা জানা গেল। একটি এই যে, অপর এক পুরুষের সাথে বিয়ের ‘আকদ হতে হবে –তা বোঝা গেল (আরবী**********) শব্দ থেকে। আর দ্বিতীয় এই যে, সে পুরুষের তাথে তার যৌন সঙ্গম অনুষ্ঠিত হতে হবে। এ কথা জানা গেল (আরবী************) শব্দ থেকে।
আর (আরবী**************) শব্দ থেকে যদি শুধু (আরবী*************) ‘বিয়ের আকদ’ই অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে বলতে হবে যে, কুরআনের আয়াত থেকে যদিও শুদু বিয়ের আকদই বোঝায়, কিন্তু এর পরে হাদীস থেকেও বোঝায় যে, শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয়, স্বামী-স্ত্রীর মধুমিলনও অপরিহার্য। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাফায়া নামক এক ব্যক্তির প্রাক্তন স্ত্রী এসে রাসূলে করীমের খেদমতে আরয করলঃ আমি বর্তমানে আবদুর রহমান ইবনে জুবাইর-এর স্ত্রী; কিন্তু তার পুরুষত্ব নেই। এজন্যে আমি আমার প্রথম স্বামীর সাথে আবার বিবাহিতা হতে চাই। তখন নভী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
না, তা পারবে না যতক্ষণ তুমি তোমার বর্তমান স্বামীর মধু পনা করবে এবং সে পান করবে তোমার মধু।
ইকরামা তবেয়ী বলেছেনঃ এ আয়াতটি আয়েশা নাম্নী এক মেয়েলোক সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। তাকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তার বর্তমান স্বামীর সাথে যদি তার যৌন সঙ্গম সম্পাদিত হয়ে থাকে এবং অতঃপর সে যদি তাকে তালাক দেয় তাহলে সে প্রাক্তন স্বামীর সাথে নতুন করে বিবাহিতা হতে পারবে। এ হাদীসের বর্ণনা উল্লেখ করে আল্লামা আ-লূসী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
এ হাদীস প্রমাণ করে যে, দ্বিতীয় বিবাহকারী ব্যক্তিকে অবশ্য যথাযথভাবে স্বামী হতে হবে।
অর্থাৎ শুধু বিয়ের আকদ হলেই চলবে না, যৌন সঙ্গমও হতে হবে। আর শুধু আকদ ও যৌন সঙ্গম হলেই চলবে না, দ্বিতীয় বিবাহকারীকে পুরাপুরিভাবে স্বামী হতে হবে। তার মানে, তার সাথে এ স্ত্রীলোকটির স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস করতে হবে। অস্থায়ী বা এক রাত্রির স্বামী-স্ত্রী নয়, সাধারণ ও স্বাভাবিক নিয়মে যেরূপ স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করা হয়, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে তেমনি হতে হবে। তার পরে যদি সে তালাক দেয়, তবেই তার পক্ষে প্রথম স্বামীর নিকট যাওয়ার ও বিবাহিতা হওয়ার সুযোগ হবে।
কিন্তু বর্তমান কালে যেমন সাধারণ রীতি হিসেবে দেখা যায়, কেউ তার স্ত্রীকে রাগের বশবর্তী হয়ে একসঙ্গেই তিন তালাক দিয়ে দিলো, পরে অনুতাপ জাগল, ঘর-সংসারের বিধ্বস্ত রূপ দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল, তখন কোনো বন্ধু-বান্ধব, খালাত ভাই, মামাত ভাইকে ডেকে আকদ করিয়ে এক রাত একত্রে থাকতে দিলো। পরের দিন সকাল বেলায় তার কাছে থেকে তালাক নিয়ে পরে সে নিজেই আবার তাকে বিয়ে করল। এ রীতি কুরআনের পূর্বোক্ত আয়াত থেকে প্রমাণিত নয়, প্রমাণিত নয় কোনো হাদীস থেকে। এ হচ্ছে সম্পূর্ণ মনগড়া, নিজেদের প্রয়োজনে আবিস্কৃত ও উদ্ভাবিত এক জঘন্য পন্থা। পরিভাষায় এরূপ বিয়েকে বলা হয় ‘হিলার বিয়ে’ বা (আরবী****************)। এ বিয়ের উদ্দেশ্য শুধু অপর একজনের জন্যে স্ত্রী লোকটিকে হালাল করে দেয়ার বাহানা করা। তার মানে এই যে, দ্বিতীয়বারে যে লোক বিয়ে করে তার মনে এ ভাব জাগ্রত থাকে যে, সে এ স্ত্রী-লোকটিকে দাম্পত্য জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে বিয়ে করছে না। সে শুধু এক রাতের স্বামী। রাত শেষ হওয়ার পরই সে তাকে তালাক দিয়ে দেবে, যেন অপর একজন তাকে স্থায়ীভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করার জন্যে বিয়ে করতে পারে। ঠিক স্ত্রীলোকটির মনেও এ অবস্থা –এ কথাই জাগ্রত থাকে। আর প্রথম স্বামী –যার জন্যে এত কিচু করা হচ্ছে –সেও জানে যে ও মেয়ে-লোকটি আসলে তারই স্ত্রী, মাত্র এক রাতের জন্যে তাকে অপর এক পুরুসের স্ত্রী হিসেবে তার অঙ্কশায়িনী হবার জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। …..বস্তুত এ চিন্তা ও এরূপ কথা যে কত লজ্জাকর, কত জঘন্য, বীভৎস, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এরূপ কাজ কুরআন হাদীস সমর্থিত হতে পারে না, হতে পারে না ইসলামের উপস্থাপিত বিধান। অথচ তাই আজ নিত্য অনুষ্ঠিত হচ্ছে সমাজের যত্রতত্র, শরীয়তসম্মত (?) বিধান রূপে।
হাদীসের পরিভাষায় এরূপ বিয়ে যে করে, তাকে বলা হয় (আরবী**********) –যে অপরের জন্যে হালাল করে দেয়ার জন্যে বিয়ে করে হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************************************************)
যে লোক এভাবে হালালকারী হয় এবং যার জন্যে সে হালালকারী হয় –এ উভয়ের ওপরই নবী করীম (স) লা’নত করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
নবী করীম (স)-কে হালালকারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেনঃ না, এরূপ বিয়ে করা যাবে না। বিয়ে হবে শুধু তা-ই, যা অনুষ্ঠিত হবে পারস্পরিক আগ্রহে, যাতে কোনোরূপ ধোঁকাবাজি থাকবে না, যা করলে আল্লাহর কিতাবের সাথে করা হবে না কোনোরূপ ঠাট্ট-বিদ্রূপপূর্ণ আচরণ। আর তার পরে পরস্পরের মধু মিলন হতে হবে।
ইবনে শায়বা ও আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
আমার কাছে এরূপ হালালকারী ও যার জন্যে হালাল করা হয় তাকে পেশ করা হলেই আমি তাদের দুজনকেই ‘রজম’ বা সঙ্গেসার করব।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরকে দুজনকে শাস্তি দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ (আরবী****************) ‘কেননা এরা দুজনই জ্বেনাকার’ অর্থাৎ যে হালাল করে সেও জ্বেনা করে; আর যে এরূপ তাকে বিয়ে করে, সেও সাথে জ্বেনাই করে। এজন্যে যে, এ উপায়ের জন্যে মেয়েলোকটি হালাল হয়ে যায়নি।
আর এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরভী*************************************************************************)
আমি একটি মেয়েলোককে বিয়ে করেছি এ উদ্দেশ্যে যে, আমি তাকে তার স্বামীর জন্যে হালাল করে দেব, সে আমাকে কিছুই আদেশ করেনি এবং কিছুই জানা যায়নি। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
আর এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
আমি একটি মেয়েলোককে বিয়ে করেছি এ উদ্দেশ্যে যে, আমি তাকে তার স্বামীর জন্যে হালাল করে দেব, সে আমাকে কিছুই আদেশ করেনি এবং কিছুই জানা যায় নি। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
তখন জবাবে হযরত ইবনে উমর (রা) বললেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
না, এরূপ বিয়ে জায়েয নয়। বিয়ে শুধু তাই হবে, যা হবে ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে। তোমার পছন্দ হলে তাকে রেখে দেবে আর পছন্দ না হলে তাকে আলাদা করে দেবে –যদিও এরূপ বিয়েকে আমরা রাসূলে করীম (স)-এর যমানায় সুস্পষ্ট জ্বেনার মধ্যেই গণ্য করতাম।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
তোমাদেরকে ধার করা খাসির বিষয়ে বলব? সাহাবাগণ বললেনঃ হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ। তখন তিনি বললেনঃ সে হলো হালালকারী। আর হালালকারী ও যার জন্যে হালাল করা হয় –এ দুজনের ওপরই আল্লাহ তা’আলা অভিশাপ বর্ষণ করেছেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, এক ব্যক্তি স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে। অতঃপর সে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েছে। তার সম্পর্কে আপনি কি বলেন? জবাবে তিনি বললেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
সেই ব্যক্তি তো আল্লাহর নাফরমানী করেছে, এজন্যে তিনি তাকে লজ্জিত করেছেন। সে শয়তানের আনুগত্য করেছে, ফলে তার জন্যে মুক্তির কোনো পথ রাখা হয়নি।
ইমাম মালিম, আহমদ, সওরী এবং আরো অনেক ফিকহবিদের মতে ‘হালাল’ করার শর্তে কোনো বিয়ে শুদ্ধ হবে না। পূর্বোদ্ধৃত দলীলসমূহের ভিত্তিতেই তাঁরা এ মত কায়েম করেছেন। তবে হানাফী মাযহাবের লোকদের মতে এরূপ বিয়ে মাকরূহ। কিন্তু প্রথমোক্তদের মত যে এ ব্যাপারে খুবই শক্তিশালী এবং অকাট্য দলীলভিত্তিক তাতে সন্দেহ নেই। যে ‘তাহলীল’ বিয়ে এবং ‘হালালকারী’ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) লা’নত ঘোষণা করেছেন, তাকে শুদু মাকরূহ বলে ছেড়ে দেয়া কিছুতেই সমীচীন হতে পারে না। বস্তুত এ ‘তাহলীল’ বিয়ের সুযোগ নিয়ে সমাজে যে অশ্লীলতার বন্যা প্রবাহিত হয়েছে, তাতে গোটা সমাজটাই পংকিল হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এতে করে তিন তালাকের পর স্ত্রীর হারাম হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিন তালাকের পর এত সহজ স্ত্রী লাভের সুযোগ থাকলে কেউ তিন তালাক দিতে একবিন্দু পরোয়া করবে না। তাই তো দেখা যায়, সমাজের লোকেরা তালাক দিতে গেলেই একসঙ্গে তিন তালাক দিয়ে ফেলে। এর পরে যে স্ত্রীকে চিরদিনের তরে হারাতে হবে এমন কোনো আশংকা বোধও তাদের মনে জাগে না। অথচ শরীয়তের এরূপ ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল এই যে, লোকেরা যেন তিন তালাক না দেয়। যদি দেয়ই, তাহলে যেন বুঝে-শুনেই দেয় এবং দিয়ে যেন তাকে আবার ফিরিয়ে পাওয়ার কোনো আশা না করে। কুরআন এবং হাদীস থেকে একথা স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে। অতএব এর ব্যতিক্রম না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
খুলা তালাক
আর এক প্রকারের তালাক আছে, যাকে বলা হয় খুলা তালাক। ‘খুলা তালাক’ মানে, স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকতে রাজি নয়, সেজন্যে সে তালাক নিতে চায়; কিন্তু স্বামী তালাক দিতে ইচ্ছুক নয়। এরূপ অবস্থায় স্ত্রী কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে স্বামীকে তালাক দিতে রাজি করে নেয়। ইসলামে একে বলা হয় ‘খুলা তালাক’ এবং শরীয়তে এরূপ তালাকের অবকাশ রয়েছে। কেননা স্ত্রী যদি কোনোমতেই স্বামীর সাথে থাকতে প্রস্তুত না হয় আর স্বামীও তাকে তালাক দিতে প্রস্তুত নয় –এরূপ অবস্থা একজন নারীর পক্ষে অত্যন্ত মর্মান্তিক। তাই সুযোগ রাখা হয়েছে, স্ত্রী যদি স্বামীকে টাকা-পয়সা দিয়ে তালাক দিতে বাধ্য করতে পারে এবং সে তালাক দিয়ে দেয়, তবে স্ত্রীর মুক্তিলাভের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটিকে সামনে রাখতে হবে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
স্ত্রীকে বিদায় করে দেয়ার সময় তোমাদের দেয়া জিনিপত্র থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্যে জায়েয নয়। অবশ্য এ অবস্থা স্বতন্ত্র যে, দম্পতি যদি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করতে না পারার আশংকা বোধ করে। এরূপ অবস্থায় যদি তারা দুজন আল্লাহর নির্ধারিত বিধান পালন করতে পারবে না বলে ভয় করে, তাহলে তাদের দুজনের মাঝে এ সমঝোতা হওয়ায় কোনো দোষ নই যে, স্ত্রী স্বামীকে কিছু দিয়ে তালাক গ্রহণ করবে ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
এ আয়াত থেকে খুলা তালাকের সুযোগ প্রমাণিত হয় এবং এও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী যদি টাকা-পয়সার বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে তালাক গ্রহণ কর এবং স্বামী সে অর্থ গ্রহণ করে তবে তাতে কোনো দোষ হবে না। ইকরামা তাবেয়ীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ
(আরবী*************************) –‘খুলা তালাকের’ কোনো ভিত্তি আছে কি?
তিনি বললেন, হযরত ইবনে আব্বাস (লা) বলতেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
ইসলামী সামজে প্রথম ‘খুলা’ তালাক অনুষ্ঠিত হয়েছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই’র বোন সাবিত ইবনে কায়েসের স্ত্রীর ব্যাপারে।
হযরত উমর (রা) একজনকে বলেছিলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
তোমার স্ত্রীর একটি কানের বালার বিনিময়ে হলেও তাকে খুলা করে দাও (অর্থাৎ তালাক দিয়ে দাও)।
মনে রাখতে হবে, খুলা তালাকের অবকাশ ইসলামে আছে একথা ঠিক। আর এর সুযোগ রাখা হয়েছে এমন সব স্ত্রীর মুক্তিলাভৈর উপায় ও পন্থা হিসেবে, যখন স্বামীর সাথৈ একত্রে থাকার কোনো উপায়ই থাকে না তখনকার মর্মান্তির অবস্থার প্রয়োগ করার জন্যে। কিন্তু ইসলামে একে কিছুমাত্র উৎসাহিত করা হয়নি। শুধু এতটুকুই নয়, সত্যি কথা এই যে, ইসলামে তালাক দানের মতোই স্ত্রীর পক্ষে খুলা তালাক গ্রহণকেও অত্যন্ত খারাপ মনে করা হয়েছে। এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর বাণী হলোঃ
(আরবী****************************************************************************************)
যে মেয়েলোক তার স্বামীর কাছে তালাক চাইবে কোনো দুঃসহ কারণ ছাড়াই, তার জন্যে জান্নাতের সুগন্ধি হারাম হয়ে যাবে।
নবী করীম (স) আরও বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
‘খুলা’ গ্রহণকারী স্ত্রীলোকেরাই হচ্ছে মুনাফিক স্ত্রীলোক।
অতএব এ কাজ কোনো নারীরই করা উচিত নয়। নারী ও পুরুষ –স্ত্রী ও স্বামী সকলেরই কর্তব্য ইসলামী সমাজের পরিবার-দুর্গকে সুরক্ষিত করে রাখা এবং এ দুর্গকে কোনোরূপে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপর্যয়ের সম্মুখীন না করা।
এক সঙ্গে তিন তালাক
এখানে আরও একটি জটিল প্রশ্ন থেকে যায়। তালাক দেয়ার কোনো কোনো রীতি ও পদ্ধীততে স্ত্রীকে যথেষ্ট কষ্ট ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তাতে না স্ত্রীর প্রতি সুবিচার হয়, না এ ক্ষতি ও কষ্ট থেকে স্ত্রীকে রক্ষা করার কোনো উপায় আছে। আর তা হচ্ছে এক সঙ্গে এক বৈঠকে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার রীতি এবং ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তালাক দেয়া। এর ফলে স্ত্রীকে তো বটেই –স্বামীকেও –আর সত্যি কথা এই যে, কোটা সংসারটিকেই চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে যেতে হয়। স্বামীর নিকট থেকে নিষ্কৃতি লাভের কোনো উপায় স্ত্রীর হাতে না থাকার কারণে স্ত্রীকে অনেক ক্ষেত্রে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হয়।
এর জবাবে বলা যায়, তালাক দানের যে ক্রমিক নিয়ম রয়েছে, তা-ই হচ্ছে তালাক দেয়ার সঠিক ও শরীয়তসম্মত পদ্ধতি। পূর্বের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, তালাক প্রয়োগের একটা সুস্পষ্ট স্তর রয়েছে। প্রথমে এক তালাক দেবে। তারপর হয় তাকে ফিরিয়ে নেবে, না হয় দ্বিতীয় তুহর-এ আর এক তালাক দেবে। দ্বিতীয়বারের পর হয় তাকে ফিরিয়ে নেবে, না হয় তৃতীয় তালাক প্রয়োগ করবে। এ তৃতীয়বার তালাক প্রয়োগের পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার উপস্থিত কোনো সুযোগ নেই। কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত তালাক দানের এই হচ্ছে পদ্ধতি। একসঙ্গে একই বৈঠকে –একই সময়, একই শব্দে তিন তালাক দেয়ার রীতি কুরআন প্রদত্ত পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সূরা আল-বাকারার নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে এ পদ্ধতিরই উল্লেখ হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************************)
তালাক দেয়ার পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগপূর্ণ তালাক হচ্ছে মাত্র দুবার। তারপর হয় তাকে সঠিকভাবে রেখে দেবে, না হয় সম্পূর্ণরূপে তাকে ছেড়ে দেবে।
তাফসীরের গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসীর লেখা হয়েছে এরূপঃ
(আরবী**************************************************************************************)
যতবার তালাক দিলে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে, তা হলো একবার ও দুইবার মাত্র।
সূরা (আরবী*******) এও এ কথাই বলা হয়েছে। এতে করে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, তালাক দেয়ার কাজটি হঠাৎ করে ফেলার মতো কোনো কাজ নয়। বরং তা খুবই ধীরে সুস্থে, চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনা করে –এক এক পা করে অগ্রসর হয়ে করার কাজ। ‘রিজয়ী’ তালাকের পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার এ সুযোগ রাখাটাও অত্যন্ত মানবিক ব্যবস্থা। একবার কি দুবার তালাক দেয়ার পর স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মনেই নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রত্যকষভাবে বিবেচনা করার ফলে নতুন চিন্তা জেগে উঠতে পারে এবং চূড়ান্ত বিচ্ছেদের পরিবর্তে স্থায়ী মিলন কামনায় উভয়ের মন উদ্ধুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এত সব সুযোগ থাকার পরও যদি কেউ তা গ্রহণ করতে রাজি না হয়; বরং চূড়ান্ত বিচ্ছেদ সাধনেরই স্থির সংকল্প হয়, তাহলে তাকে রক্ষা করার কেউ থাকতে পারে না। কেউ যদি একসঙ্গেই তিনটি তালাক দানের ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তাহলে কুরআনের ঘোষণানুযায়ী সে নিজের ওপর নিজে জুলুম করে। একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া যতেই অবাঞ্ছনীয় হোক না কেন, তা যে কার্যকর হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে সে কুরআনের পদ্ধতি অনুসরণ করেনি বলে কঠিন গুনাহের অপরাধে অপরাধী হবে, তাও নিশ্চিত।
এক সঙ্গে তিন তালাক সম্পর্কে বিভিন্ন মত
একসঙ্গে বা এক শব্দের তিনটি তালাক দিয়ে দিলে তাতে তিনটি তালাকই হয়ে যাবে, না তা এক তালাক গণ্য হবে, এ সম্পর্কে ফিকাহবিদদের মধ্যে খানিকটা মতভেদ রয়েছে। এখানে তার বিস্তারির বিবরণ পেশ করা যাচ্ছে।
তাঊস, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, হাজ্জাজ ইবনে আরতাত, নখয়ী ও ইবনে মুকাতিল এবং জাহিরী মাযহাবের মনীষীগণের মতে একসঙ্গে তিন তালাক দিলে তাতে এক তালাক গণ্য হবে। তাঁদের দলীল হিসেবে তাঊস বর্ণিথ একটি হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে; আবা-সাহবা হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-কে বললেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
নবী করীম (স) ও হযরত আবূ বকরের খিলাফত আমল পর্যন্ত একসঙ্গে দেয়া তিন তালাক এক তালাক গণ্য হতো এবং উমরের সময়ে থেকে তা তিন তালাক গণ্য হতে শুরু হয়েছে, তা কি আপনি জানেন?
জবাবে হযরত ইবনে আব্বাস বললেনঃ হ্যাঁ।
অথচ ইমাম আওজায়ী, নখয়ী, সওরী, ইমাম মালিক ও তাঁর সঙ্গী ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম মালিক ও তাঁর ছাত্রগণ, ইমাম শাফিয়ী ও তাঁর ছাত্রবৃন্দ, ইমামা আহমদ ও তাঁর সঙ্গী-সাথী, ইসহাক ইবনে রাওয়ায়, আবূ সওর ও আবূ দাউদ প্রমুখ বিপুল সংখ্যক তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী ফিকাহবিদগণ একবাক্যে এ মত প্রকাশ করেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
যে লোক একসঙ্গে তিন তালাক দেব, তার দেয়া তিনটি তালাক কার্যকর হবে, তবে সে অবশ্যই গুনাহগার হবে। সে সঙ্গে তাঁরা আরো বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
উপরোক্ত সর্বসম্মত মতের বিপরীত যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁরা সংখ্যায় খুবই কম এবং তাঁরা সুন্নতপন্থীদের বিরোধী মতাবলম্বী। এ বিপরীত মত কেবল বিদআতপন্থীরাই আঁকড়ে ধরেছে। আর তাঁরা সংখ্যায় কম বলে নগণ্য ও অনুল্লেখযোগ্য। কেননা তাঁরা এমন জামা’আতের বিপরীত মত পোষণ করেছে, যাঁদের সম্পর্কে এমন ধারণা কিছুতেই করা যেতে পারে না যে, তাঁরা কুরআন-হাদীসের কিছুমাত্র রদবদল করেছেন।
এই বিপরীত মতের সমর্থনে –একসঙ্গে তিন তালাক দিলে তাতে এক তালাক হওয়া মতের অনুকূলে –হযরত ইবনে আব্বাস সমর্থিত যে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, তার জবাবে ইমাম তাহাভী বলেছেনঃ
(আরবী************************************************)
একসঙ্গে তিন তালাক দিলে তাতে এক তালাক হওয়ার মতটি বাতিল হয়ে গেছে।
এ মনটি বাতিল হয়ে যাওয়া সম্পর্কিত ঘটনার বিবরণ এই যে, হযরত উমরের খলীফা থাকাকালে একদিন উপস্থিত লোকদের সম্বোধন করে তিনি বললেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
সমবেত জনগণ, তালাকের ক্ষেত্রে তোমাদেরকে একটা বড় সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এখন যে লোক তালাকের ব্যাপারে আল্লাহর দেয়া এ সুযোগ গ্রহণে তাড়াহুড়া করল; আমরা তাকে তার ফল গ্রহণে বাধ করে দিলাম (একসঙ্গে তিন তালাক হওয়ার ফয়সালা দিলাম)।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী এ বিবরণ দেয়ার পর লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
এ কথা শুনে তখনকার উপস্থিত লোকদের একজনও তাঁর কোনো প্রতিবাদ করলেন না, কেউ তাঁর এ কথায় বাঁধা দিলেননা। ফলে তৎপূর্ব ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়া ও তিন তালাক কার্যকর হওয়ার রায় বলবৎ হওয়া সম্পর্কে এই হলো সবচেয়ে বড় দলীল।
আইনী অতঃপর বলেনঃ
(আরবী*****************************************************************************)
হযরত উমর যখন সাহাবীদের সম্বোধন করে এ সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিলেন, তখন তার কোনো প্রতিবাদ হয়নি বরে এ মতটির ব্যাপারে তাঁদের সম্পূর্ণ ঐকমত্য ইজমা –স্থাপিত হলো।
আর ইজমা সম্পর্কে তিনি বলেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
ইজমা নিঃসন্দেহে দৃঢ় প্রত্যয়পূর্ণ জ্ঞান দান করে, ঐকান্তিক বিশ্বাস সহকারে তা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, যেমন কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট অকাট্য ঘোষণাকে নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা হয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) তাঁর স্ত্রীকে এক তালাক দিয়ে রাসূলে করীমের নিকট এ খবর বললেন। তিনি এ খবর শুনে বললেনঃ ‘তোমার স্ত্রীকে তুমি ফিরিয়ে গ্রহণ করো’। তিনি বললেনঃ
(আরবী*********************************************************)
হে রাসূল, আমি যদি আমার স্ত্রীকে (এক তালাক না দিয়ে) একসঙ্গে তিন তালাক দিতাম, তাহলেও কি আমি তাকে পুনরায় স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে পারতাম?
তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
(আরবী********************************************************************)
না, ফিরিয়ে নিতে পারবে না। কেননা তিন তালাক দিলে তোমার স্ত্রী তোমার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আর এভাবে তিন তালাক দেয়া তোমার অবশ্যই গুনাহ।
এ থেকৈ প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইবনে উমর তাঁর স্ত্রীকে তিন তালাক দেন নি, দিয়েছিলেন এক তালাক। তাই তাঁর দেয়া তিন তালাককে এক তালাক বানাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।