তৃতীয় অধ্যায়
পরিবার সংরক্ষণ
পূর্ববর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করেছি –ইসলামের পরিবার গঠন সম্পর্কে। দ্বিতীয় পর্বে আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে পরিবার সংরক্ষণ। বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার গঠন যত না গুরুত্বপূর্ণ, পরিবার সংরক্ষণ তার চাইতে শতগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার পবিত্রতা, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং স্থায়িত্ব রক্ষার জন্যে পরিবারের লোকদের ব্যক্তিগতভাবে কতক নিয়ম-নীতি পালন করে চলতে হবে। আর কতগুলো নিয়ম-কানুন পালন করতে হবে সমষ্টিগতভাবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ের অবশ্য পালনীয় নিয়ম-নীতি প্রথম পেশ করা হচ্ছে।
স্বামী-স্ত্রীর লজ্জাশীলতা।
পরিবারিক জীবনের পবিত্রতা ও সুস্থতা রক্ষার জন্যে ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বপ্রথম পালনীয় নিয়ম হচ্ছে প্রত্যেকের সহজতা লজ্জা-শরমকে যথাযথভাবে জাগ্রত রাখা।
স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই পবিত্র লজ্জা-শরমের ভূষণে ভূষিত হওয়া আবশ্যক। কেননা স্বামী-স্ত্রীর সম্মিলিত জীবনধারার গতি অব্যাহত রাখা –উভয়কে উভয়ের জন্যে সুরক্ষিত ও পবিত্র রাখবার জন্যে এ জিনিস একান্তই অপরিহার্য। স্বামীর যদি লজ্জা-শরম থাকে, তবে তার নৈতিক চরিত্রের দুর্গ-প্রাকার চিরদিন দুর্ভেদ্যই থাকতে পারে, কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না ভেদ করে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে কলুষ ঢুকিয়ে দেয়া, ভাঙ্গন ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি করা। স্ত্রীর বেলায়ও একথাই সত্য।
পারিবারিক জীবনের বন্ধনকে অটুট রাখার জন্যে এ লজ্জা-শরম বস্তুতই মহামূল্য সম্পদ। এসম্পদ যথাযথভাবে বর্তমান থাকলে উভয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ স্থায়ীভাবে বর্তমান থাকবে। স্বামী-স্ত্রীর অতলান্ত প্রেম-মাধুর্যে দেখা দেবে না কোনো ছিদ্র-ফাটল। একজন অপরজনের প্রতি বিরাগভাজন হবে না কখনো। এ কারণেই ইসলামে লজ্জা-শরমের গুরুত্ব অপরিসীম। নবী করীম (ষ) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************************)
নিশ্চিতই সত্য, লজ্জা-শরম ঈমানেরই বিষয়।
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিজে লজ্জা-শরম এমন একটি বিশেষ গুণ, যা মানুষকে সকল প্রকার গর্হিত ও মানবতা-বিরোধী কাজ পরিহার করতে এবং তা থেকে পুরো মাত্রায় বিরত থাকতে উদ্ধুদ্ধ করে। এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)))
লজ্জা-শরম বিপুল কল্যাণই নিয়ে আসে, তা থেকে কোনো অকল্যাণের আশংকা নেই।
মানুষের কাজে-কর্মে, চলায়-বলায়, জীবনের সব স্তরে ও সব ব্যাপারেই এ হচ্ছে এক অতি প্রয়োজনীয় গুণ। এ গুণই হচ্ছে মানুষে ও পশুতে পার্থক্যের ভিত্তি। এ গুণ না থাকলে মানুষে পশুতে কোন পার্থক্য থাকে না, কার্যত মানুষ পশুর স্তরে নেমে আসে। পশুর মতই নির্লজ্জ হয়ে কাজ করতে শুরু করে। রাসূলে করীম (স) এ লজ্জাহীনতার মারাত্মক পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
লজ্জাই যদি তোমার না থাকল, তাহলে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার।
অপর এক হাদীসে এ কথাটির গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************************************)))
লজ্জা-শরম নিতান্তই ঈমানের ব্যাপার। আর ঈমান বেহেশতে যাওয়ার চাবিকাঠি। পক্ষান্তরে লজ্জাহীনতা হচ্ছে জুলুম, আর জুলুমের কারণেই একজনকে দোযখে যেতে হয়।
মোটকথা, পারিবারিক জীবনে এ অত্যন্ত জরুরী গুণ। এ গুণ না থাকলে এ ছিদ্রপথ দিয়ে চরিত্র-বিরোধী বহু রকমের অসচ্চরিত্রতা ও বদ-অভ্যাস প্রবেশ করে দাম্পত্য জীবনের কিশতীর যে কোন সময়ে ভরাডুবি ঘটিয়ে দিতে পারে সংসারের মহাসমুদ্রে।
দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ
স্বাভাবিক লজ্জা-শরমের অনিবার্য ফল হচ্ছে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ। চোখের দৃষ্টি এমন একটি হাতিয়ার, যার দ্বারা যেমন ভালকাজও করা যায়, তেমনি নিজের মধ্যে জমানো যায় পাপের পুঞ্জীভূথ বিষবাষ্প। দৃষ্টি হচ্ছে এমন একটি তীক্ষ্ণ-শানিত তীর যা নারী বা পুরুষের অন্তর ভেদ করতে পারে। প্রেম-ভালবাসা তো এক অদৃশ্য জিনিস, যা কখনো চোখে ধরা পড়ে না, বরং চোখের দৃষ্টিতে ভর করে অপররের মর্মে গিয়ে পৌঁছায়। বস্তুত দৃষ্টি হচ্ছে লালসার বহ্নির দখিন হাওয়া। মানুষের মনে দৃষ্টি যেমন লালসাগ্নি উৎক্ষিপ্ত করে, তেমনি তার ইন্ধন যোগায়। দৃষ্টি বিনিময় এক অলিখিত লিপিকার আদান-প্রদান, যাতে লোকদের অগোচরেই অনেক প্রতিশ্রুতি –অনেক মর্মকথা পরস্পরের মনের পৃষ্ঠায় জ্বলন্ত আখরে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।
ইসলামের লক্ষ্য যেহেতু মানব জীবনের সার্বিক পবিত্র ও সর্বাঙ্গীন উন্নত চরিত্র, সেজন্যে দৃষ্টির এ ছিদ্রপথকেও সে বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে, দৃষ্টিকে সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্যে দিয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশ। কুরআন মজীদ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেঃ
(আরবী******************************************************************)
মু’মিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করে রাখে এবং লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করে, এ নীতি তাদের জন্যে অতিশয় পবিত্রতাময়। আর তারা যা কিছু করে, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ মাত্রায় অবহিত।
কেবল পুরুষদেরকেই নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম মহিলাদের সম্পর্কেও বলা হয়েছেঃ
(আরবী*******************************************************************)
মু’মিন মহিলাদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করে।
দুটি আয়াতে একই কথা বলা হয়েছে –দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ এবং লজ্জাস্থানের পবিত্রতা সংরক্ষণ, কিন্তু এ একই কথা পুরুষদের জন্যে আলাদাভাবে এবং মহিলাদের জন্যে তার পরে স্বতন্ত্র একটি আয়াতে বলা হয়েছে। এর মানেই হচ্ছে এই যে, এ কাজটি স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই সমানভাবে জরুরী। এ আয়াতদ্বয়ে যেমন রয়েছে আল্লাহর নৈতিক উপদেশ, তেমনি রয়েছে ভীতি প্রদর্শন। উপদেশ হচ্ছে এই যে, ঈমানদার পুরুষই হোক কিংবা স্ত্রীই, তাদের কর্তব্যই হচ্ছে আল্লাহর হুকুম পালন করা এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা। কাজেই আল্লাহর বিধান মুতাবিক যার প্রতি চোখ তুলে তাকানো নিষিদ্ধ, তার প্রতি যেন কখনো তাকাবার সাহস না করে। আর দ্বিতীয় কথা, দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ ও লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা ওতপ্রোতবাবে জড়িত। দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ হলে অবশ্যই লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা পাবে কিন্তু দৃষ্টিই যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে পরপুরুষ কিংবা পরস্ত্রী দর্শনের ফল হৃদয় মনের গভীর প্রশস্তি বিঘ্নিত ও চূর্ণ হবে, অন্তরে লালসার উত্তাল উন্মাদনার সৃষ্টি হয়ে লজ্জাস্থানের পবিত্রতাকে পর্যন্ত ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। কাজেই যেখানে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত নয়, দেখাশোনার ব্যাপারে যেখানে পর, আপন মুহাররম-গায়র মুহাররমের তারতম্য নেই, বাছ-বিচার নেই, সেখানে লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষিত হচ্ছে তা কিছুতেই বলা যায় না। ঠিক এজন্যই ইসলামের দৃষ্টিকে –পরিভাষায় যাকে (আরবী*************) ‘প্রেমের পয়গাম বাহক’ বলা হয়েছে, -নিয়ন্ত্রিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উপদেশের ছলে বলা হয়েছেঃ (আরবী*******************) এ-নীতি তাদের জন্যে খুবই পবিত্রতা বিধায়ক অর্থাৎ দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত রাখলে চরিত্রকে পবিত্র রাখা সম্ভব হবে। আর শেষ ভাগে ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছেঃ
মু’মিন হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রী-পুরুষ যদি এ হুকুম মেনে চলায় রাজি না হয়, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিশ্চয়ই এর শাস্তি প্রদান করবেন। তিনি তাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে পুরোমাত্রায় অবহিত রয়েছেন।
এ ভীতি যে কেবল পরকালের জন্যেই, এমন কথা নয়। এ দুনিয়ায়ও দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ ও পবিত্রতা রক্ষা না করা হলে তার অত্যন্ত খারাপ পরিণতি দেখা দিতে পারে। আর তা হচ্ছে স্বামীর দিল অন্য মেয়েলোকের দিকে আকৃষ্ট হওয়া এবং স্ত্রীর মন সমর্পিত হওয়া অন্য কোনো পুরুষের কাছে। আর এরই পরিণতি হচ্ছে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে আশু বিপর্যয় ও ভাঙ্গন। দৃষ্টিশক্তির বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাও মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
তিনি দৃষ্টিসমূহের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যক্রম সম্পর্কে এবং তারই কারণে মনের পর্দায় যে কামনা-বাসনা গোপনে ও অজ্ঞাতসারে জাগ্রত হয় তা ভালোভাবেই জানেন।
এ আয়াত খণ্ডের ব্যাখ্যায় ইমাম বায়যাহবী লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
বিশ্বাসঘাতক দৃষ্টি –গায়র-মুহাররম মেয়েলোকের প্রতি বারবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করার মতোই, তার প্রতি চুরি করে তাকানো বা চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করা অথবা দৃষ্টির কোনো বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণ।
দৃষ্টি বিনিময়ের এ বিপর্যয় সম্পর্কে ইমাম গাযালী লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
অতঃপর তোমার কর্তব্য হচ্ছে দুটি নিয়ন্ত্রণ করা, গায়র-মুহাররমকে দেখা থেকে চোখকে বাঁচানো –আল্লাহ তোমাকে ও আমাদের এ তওফীক দান করুন –কেননা এ হচ্ছে সকল বিপদ-বিপর্যয়ের মূলীভূত কারণ।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
চোখ নিয়ন্ত্রণ ও নীচু করে রাখায় চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায়।
দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণের জন্যে আলাদা আলাদাভাবে পুরুষ ও স্ত্রী উভয়কেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার কারণ এই যে, যৌন উত্তেজনার ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই স্ত্রী ও পুরুষের প্রায় একই অবস্থা। বরং স্ত্রীলোকের দৃষ্টি পুরুষদের মনে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করে থাকে। প্রেমের আবেগ-উচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের প্রতিকৃতি অত্যন্ত নাজুক ও ঠুনকো। কারো সাথে চোখ বিনিময় হলে স্ত্রীলোক সর্বাগ্রে কাতর এবং কাবু হয়ে পড়ে, যদিও তাদের মুখ ফোটে না। এ তার স্বাভাবিক দুর্বলতা –বৈশিষ্ট্যও বলা যেতে পারে একে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এর শত শত প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। এ কারণে স্ত্রীলোকদের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এমন হওয়া কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয় যে, কোনো সুশ্রী স্বাস্থ্যবান ও সুদর্শন যুবকের প্রতি কোনো মেয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল, আর অমনি তার সর্বাঙ্গে প্রেমের বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল, সৃষ্টি হলো প্রলয়ঙ্কর ঝড়। ফলে তার বহিরাঙ্গ কলঙ্কমুক্ত থাকতে পারলেও তার অন্তর্লোক পঙ্কিল হয়ে গেল। স্বামীর হৃদয় থেকে তার মন পাকা ফলের বৃস্তচ্যুতির মতো একেবারেই ছিন্ন হয়ে গলে, তার প্রতি তার মন হলো বিমুখ, বিদ্রোহী। পরিণামে দাম্পত্য জীবনে ফাটল দেখা দিলো, আর পারিবারিক জীবন হলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন।
কখনো এমনও হতে পারে যে, স্ত্রীলোক হয়ত বা আত্মরক্সা করতে পারল, কিন্তু তার অসতর্কতার কারণে কোনো পুরুষের মনে প্রেমের আবেগ ও উচ্ছ্বাস উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। তখন সে পুরুষ হয়ে যায় অনমনীয় ক্ষমাহীন। সে নারীকে বশ করবার জন্যে যত উপায় সম্ভব বা অবলম্বন করতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। শেষ পর্যন্ত তার শিকারের জাল হতে নিজেকে রক্ষা করা সেই নারীর পক্ষে হয়ত সম্ভবই হয় না। এর ফলেও পারিবারিক জীবনে ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
দৃষ্টির এ অশুভ পরিণামের দিকে লক্ষ্য করেই কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াত নাযিল করা হয়েছে, আর এরই ব্যাখ্যা করে রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেন অসংখ্য অমৃত বাণী। এখানে কয়েকটি জরুরী হাদীসের উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ
একটি হাদীসের একাংশঃ
(আরবী*********************************************************************) ]
চক্ষুদ্বয়ের জ্বেনা হচ্ছে পরস্ত্রী দর্শন। কর্ণদ্বয়ের জ্বেনা হচ্ছে পরস্ত্রীর রসাল কথা লালসা উৎকষ্ঠিত কর্ণে শ্রবণ করা। রসনার জ্বেনা হচ্ছে পরস্ত্রীর সাথে রসল কণ্ঠে কথা বলা, হস্তের জ্বেনা হচ্ছে পরস্ত্রীকে স্পর্শ করা –হাত দিয়ে ধরা এবং পায়ের জ্বেনা হচ্ছে যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে পরস্ত্রীর কাছে গমন। প্রথমে মন লালসাক্ত হয়, কামনাতুর হয়, যৌন অঙ্গ তা চরিতার্থ করে কিংবা ব্যর্থ করে দিয়ে তার প্রতিবাদ করে। (মুসলিম)
আল্লামা খাত্তাবী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
দেখা ও কথা বলাকে জ্বেনা বলার কারণ এই যে, দুটো হচ্ছে প্রকৃত জ্বেনার ভূমিকা –জ্বেনার মূল কাজের পূর্ববর্তী স্তর। কেননা দৃষ্টি হচ্ছে মনের গোপন জগতের উদ্বোধক আর জিহবা হচ্ছে বাণী বাহক, যৌন অঙ্গ হচ্ছে বাস্তবায়নের হাতিয়ার –সত্য প্রমাণকারী।
হাফেজ আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেনঃ
দৃষ্টিই হয় যৌন লালসা উদ্বোধক, পয়গাম বাহক। কাজেই এ দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌন অঙ্গেরই সংরক্ষণ। যে ব্যক্তি দৃষ্টিকে অবাধ, উন্মুক্ত ও সর্বগামী করে সে নিজেকে নৈতিক পতন ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। মানুষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে যত বিপদ ও পদঙ্খলনেই নিপতিত হয়, দৃষ্টিই হচ্ছে তার সব কিছুর মূল কারণ। কেননা দৃষ্টি প্রথমত আকর্ষণ জাগায়, আকর্ষণ মানুষকে চিন্তা-বিভ্রমে নিমজ্জিত করে আর এ চিন্তাই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে লালসার উত্তেজনা। এ যৌন উত্তেজনা ইচ্ছাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে আর ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়ে দৃঢ় সংকল্পে পরিণত হয়। এ দৃঢ় সংকল্প অধিকতর শক্তি অর্জন করে, বাস্তবে ঘটনা সংঘটিত করে। বাস্তবে যখন কোনো বাধাই থাকে না, তখন এ বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন না হয়ে কারো কোনো উপায় থাকে না। (আরবী**********************************)
অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি চালনার কুফল সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি ইবলিসের বিষাক্ত বাণ বিশেষ।
আল্লামা ইবনে কাসীর এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
দৃষ্টি হচ্ছে এমন একটি তীর, যা মানুষের হৃদয়ে বিষের উদ্রেক করে।
দৃষ্টি চালনা সম্পর্কে রাসূলের নির্দেশ
রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************)
তোমাদের দৃষ্টিকে নীচু করো, নিয়ন্ত্রিত করো এবং তোমাদের লজ্জাস্থানের সংরক্সণ করো।
এ দুটো যেমন আলাদা আলাদা নির্দেশ, তেমনি প্রথমটির অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে শেষেরটি অর্থাৎ দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত হলেই লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ সম্ভব। অন্যথায় তাকে চরম নৈতিক অধঃপতনে নিমজ্জিত হতে হবে নিঃসন্দেহে।
নবী করীম (স) হযরত আলী (রা)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
হে আলী, একবার কোনো পরস্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি পড়লে পুনরায় তার প্রতি চোখ তুলে তাকাবে না। কেননা তোমার জন্যে প্রথম দৃষ্টিই ক্ষমার যোগ্য, দ্বিতীয়বার দেখা নয়।
এর কারণ সুস্পষ্ট। আকস্মিকভাবে কারো প্রতি চোখ পড়ে যাওয়া আর ইচ্ছাক্রমে কারো প্রতি তাকানো সমান কথা নয়। প্রথমবার যে চোখ কারো ওপর পড়ে গেছে, তার মূলে ব্যক্তির ইচ্ছার বিশেষ কোনো যোগ থাকে না; কিন্তু পুনর্বার তাকে দেখা ইচ্ছাক্রমেই হওয়া সম্ভব। এ জন্যেই প্রথমবারের দেখার কোনো দোষ হবে না; কিন্তু দ্বিতীয়বার তার দিকে চোখ তুলে তাকানো ক্ষমার অযোগ্য।
বিশেষত এজন্যে যে, দ্বিতীয়বারের দৃষ্টির পেছনে মনের কলুষতা ও লালসা পংকিল উত্তেজনা থাকাই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের দৃষ্টি দিয়েই পরস্ত্রীকে দেখা স্পষ্ট হারাম।
তার মানে কখনো এ নয় যে, পরস্ত্রীকে একবার বুঝি দেখা জায়েয এবং এখানে তার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। আসলে পরস্ত্রীকে দেখা আদপেই জায়েয নয়। এজন্যেই কুরআন ও হাদীসে দৃষ্টি নত করে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ ‘পরস্ত্রীর প্রতি আকস্মিক দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে আপনার কি হুকুম’? তিনি বললেনঃ
(আরবী************) –তোমার দৃষ্টি সরিয়ে নাও।
অপর এক বর্ণনায় কথাটি এরূপঃ
(আরবী************************************) –তোমরা চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নাও।
দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া কয়েকভাবে হতে পারে। আসলে কথা হচ্ছে পরস্ত্রীকে দেখার পংকিলতা থেকে নিজেকে পবিত্র রাখা। আকস্মিকভাবে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি কারো প্রতি দৃষ্টি পড়ে যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নীচু করা, অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ঈমানদার ব্যক্তির কাজ।
(আরবী****************************************) –মেয়েলোকদের জন্যে ভালো কি?
প্রশ্ন শুনে সকলেই চুপ মেরে থাকলেন, কেউ কোনো জবাব দিতে পারলেন না। হযরত আলী এখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বাড়ি এসে ফাতিমা (রা) কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেনঃ
(আরবী*******************************************************)
ভিন পুরুষরা তাদের দেখবে না। (এটাই তাদের জন্যে ভালো ও কল্যাণকর)।
অপর বর্ণনায় ফাতিমা (রা) বলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
বস্তুত ইসলামী সমাজ জীবনের পবিত্রতা রক্ষার্থে পুরুষদের পক্ষে যেমন ভিন মেয়েলোক দেখা হারাম, তেমনি হারাম মেয়েদের পক্ষেও ভিন পুরুষদের দেখা। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে যেমন পাশাপাশি দুটো আয়াতে রয়েছে –পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে –তেমনি হাদীসেও এ দুটো নিষেধবাণী একই সঙ্গে ও পাশাপাশি উদ্ধৃত রয়েছে। হযরত উম্মে সালমা বর্ণিত এক হাদীসের ভিত্তিতে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
পুরুষদের দেকা মেয়েদের জন্য হারাম, ঠিক যেমন হারাম পুরুষদের জন্য মেয়েদের দেখা।
এর কারণস্বরূপ তিনি লিখেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
কেননা মেয়েলোক মানব জাতির অন্তর্ভূক্ত একটা প্রজাতি। এজন্য পুরুষের মতোই মেয়েদের জন্য তারই মতো অপর প্রজাতি পুরুষদের দেখা হারাম করা হয়েছে। এ কথার যথার্থতা বোঝা যায় এ দিক দিয়েও যে, গায়র-মুহাররমের প্রতি তাকানো হারাম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে যৌন বিপর্যয়ের ভয়। আর মেয়েদের ব্যাপারে এ ভয় অনেক বেশি। কেননা যৌন উত্তেজনা যেমন মেয়েদের বেশি, সে পরিমাণে বুদ্ধিমত্তা তাদের কম। আর পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের কারণেই অধিক যৌন বিপর্যয় ঘটে থাকে।
নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে এ কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মকতুম (রা) রাসূল করীম (স)-এর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তখন রাসূলের কাছে বসে ছিলেন হযরত মায়মুনা ও উম্মে সালমা –দুই উম্মুল মু’মিনীন। রাসূলে করীম (স) ইবনে উম্মে মকতুমকে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার পূর্বে দুই উম্মুল মু’মিনীনকে বললেনঃ (আরবী**************) অর্থাৎ তোমরা দুজন ইবনে উম্মে মকতুমের কারণে পর্দার আড়ালে চলে যাও।
তাঁরা দুজন বললেনঃ
(আরবী*********************************************)
হে রাসূল, ইবনে মকতুম কি অন্ধ নয়? ….তাহলে তো সে আমাদের দেখতেও পাবে না আর চিনতেও পারবে না, তাহলে পর্দার আড়ালে যাওয়ার কি প্রয়োজন?
তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ
(আরবী*******************************************)
সে অন্ধ, কিন্তু তোমরা দুজনও কি অন্ধ নাকি? সে তোমাদের দেখতে না পেলেও তোমরা কি তাকে দেখতে পাবে না?
তার মানে একজন পুরুষের পক্ষে ভিন মেয়েলোকদের দেখা যে কারণে নিষিদ্ধ, মেয়েলোকদের পক্ষেও ভিন পুরুষদের দেখায় ঠিক সে কারণই বর্তমান। অতএব তাও সমানভাবে নিষিদ্ধ।
বস্তুত আল্লাহর বান্দা হিসেবে সঠিক জীবন যাপন করার জন্য দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষ জরুরী। যার দৃষ্টি সুনিয়ন্ত্রিত নয় –ইতস্তত নারীর রূপ ও সৌন্দর্য দর্শনে যার চোখ অভ্যস্ত, আসক্ত, তার পক্ষে আল্লাহর বন্দেগী করা সম্ভব হয় না। নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
যে মুসলিম ব্যক্তি প্রথমবারে নারীর সৌন্দর্য দর্শন করে ও সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, আল্লাহ তার জন্যে তারই ইবাদত-বন্দেগীর কাজে বিশেষ মাধুর্য সৃষ্টি করে দেবেন।
তাহলে যাদের দৃষ্টি নারী সৌন্দর্য দেখতে নিমগ্ন থাকে, তাদের পক্ষে ইবাদতে মাধুর্য লাভ সম্ভব হবে না। হাফেয ইবনে কাসীর একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। নবী করীম (স) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন সমস্ত চোখ ক্রন্দনরত থাকবে; কিন্তু কিছু চোখ হবে সন্তুষ্ট; আনন্দোজ্জ্বল। আর তা হচ্ছে সে চোখ, যা আল্লাহর হারাম করে দেয়া জিনিসগুলো দেখা হতে দুনিয়ায় বিরত থাকবে, যা আল্লাহর পথে অতন্দ্র থাকার কষ্ট ভোগ করবে এবং যা আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বর্ষণ করবে। (আরবী*************************)
মোটকথা, গায়র মুহাররম স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক দৃষ্টি বিনিময় কিংবা একজনের অপরজনকে দেখা, লালসার দৃষ্টি নিক্ষেপ ইসলামে নিষিদ্ধ। এতে করে পারিবারিক জীবনে শুধু যে পংকিলতার বিষবাষ্প জমে উঠে তাই নয়, তাতে আসতে পারে এক প্রলয়ংকর ভাঙন ও বিপর্যয়। মনে করা যেতে পারে, একজন পুরুষের দৃষ্টিতে কোনো পরস্ত্রী অতিশয় সুন্দরী ও লাস্যময়ী হয়ে দেখা দিল। পুরুষ তার প্রতি দৃষ্টি পথে ঢেলে দিল প্রাণ মাতানো মন ভুলানো প্রেম ও ভালবাসা। স্ত্রীলোকটি তাতে আত্মহারা হয়ে গেল, সেও ঠিক দৃষ্টির মাধ্যমেই আত্মসমর্পণ করল এই পর-পুরুষের কাছে। এখন ভাবুন, এর পরিণাম কি? এর ফলে পুরুষ কি তার ঘরের স্ত্রীর প্রতি বিরাগভাজন হবে না? হবে নাকি এই স্ত্রী লোকটি নিজের স্বামীর প্রতি অনাসক্ত, আনুগত্যহীনা। আর তাই যদি হয়, তাহলে উভয়ের পারিবারিক জীবনের গ্রন্থি প্রথমে কলংকিত ও বিষ-জর্জর এবং পরে সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হতে বাধ্য। এর পরিণামই তো আমরা সমাজে দিনরাতই দেখতে পাচ্ছি।