দ্বিতীয় অধ্যায়
পরিবার গঠন
ইসলামে পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব
ইসলামে পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব যে কতোখানি, তা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল্লা তা’আলা মানুষের জন্যে যে পূর্ণাঙ্গ জীবনের বিধান নাযিল করেছেন, তাতে নানাভাবে ও নানা প্রসঙ্গে এ গুরুত্বের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।
কুরআনে পরিবারকে দুর্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং পারিবারিক জীবন যাপনকারী নারী-পুরষ ও ছেলে-মেয়েকে বলা হয়েছে ‘দুর্গ প্রাকারের অভ্যন্তরে সুরক্ষিত (আরবী************) লোকগণ’। দুর্গ যেমন শত্রুর পক্ষে দুর্ভেদ্য, তার ভিতরে জীবনযাত্রা যে রকম নিরাপদ, ভয়-ভাবনাহীন, সর্বপ্রকারের আশংকামুক্ত; পরিবারের নারী-পুরুষ ও ছেলেমেয়ে নৈতিকতা বিরোধী পরিবেশ ও অসৎ-অশ্লীল জীবনের হাতছানি বা আক্রমণ থেকে তেমনিই সর্বতোভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারে। বস্তুত পরিবারস্থ ছেলেমেয়ের পক্ষে পিতামাতা, ভাই বোনের তীব্র শাসন ও নিকটাত্মীয়দের সজাগ দৃষ্টির সামনে পথভ্রষ্ট হওয়া বা নৈতিকতা বিরোধী কোনো কাজ করা খুব সহজ হতে পারে না।
আল্লামা রাগেব ইসফাহানী কুরআনে উদ্ধৃত (আরবী***********) শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
কারো সম্পর্কে (আরবী*******) বলা হয় তখন (আরবী************) ‘যখন সে দুর্গকে বসবাসের স্থানরূপে গ্রহণ করে’। (আরবী***********)
আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী**************************************)
দুর্গবাসী হওয়ার আসল মানে হচ্ছে প্রতিরোধ শক্তিসম্পন্ন হওয়া।
যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************)
যেমন তোমাদেরকে তোমাদের ভয়-ভীতি থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।
এ কারণেই ঘোড়াকে বলা হয় (আরবী******)
(আরবী****************************************************)
কেননা সে তার মনিবকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে।
আর এই দৃষ্টিতেই (আরবী***********) বলা হয়ঃ
(আরবী*****************************************************)
পবিত্র চরিত্রসম্পন্না নারীকে, কেননা সে নিজকে সর্বতোভাবে রক্ষা করে রাখে।
এখান থেকেই বলা হয়ঃ
(আরবী*******************************************************)
আল্লাহর অসন্তোষজনক কাজ থেকে নিজকে বিরত রাকাকে বলা হয় ‘ইহসান’।
কুরআনে বিবাহিতা মহিলাকে এ কারণেই বলা হয়েছে (আরবী*****) অর্থাৎ পরিবারের দুর্গস্থিত সুরক্ষিত মহিলাগণ। শাওকানী বলেছেনঃ (আরবী**************************) এখানে ‘মুহসানাত’ মানে বিবাহিতাগণ। স্বামীসম্পন্না মেয়েলোক; এমন মেয়েলোক, যাদের স্বামী রয়েছে। এজন্যে যেঃ
(আরবী******************************************************)
তারা তাদের যৌন অঙ্গকে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষদের থেকে সুরক্ষিত করে রেখেছে।
আল্লামা আলূসী লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
মুহসানাত মানে স্বামীসম্পন্না মেয়েলোক, বিয়ে কিংবা স্বামী অথবা অলী –অভিভাবক তাদের গুনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে।
পারিবারিক জীবনের এই দুর্গপ্রাকার রক্ষা করা ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্যে সর্বপ্রথম অপরিহার্য কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করা আবশ্যকঃ
(আরবী************************************************************************)
তোমার আল্লাহ চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করে দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই দাসত্ব করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তাদের একজন কিংবা দুজনই যদি তোমার নিকট বৃদ্ধাবস্থায় জীবিত থাকে, তবে তাদের জন্যে কোনো কষ্টদায়ক ও দুঃখজনক কথা বলো না, তাদের ভৎসনা করবে না এবং তাদের জন্যে সম্মাজনক কথাই বলবে। তোমার দুই বাহু তাদের খেদমতে অপরিসীম বিনয় ও দয়া-মায়া সহকারে বিছিয়ে দাও এবং তাদের জন্যে সব সময় এই বলে দো’আ করতে থাকোঃ হে আল্লাহ পরোয়ারদেগার! তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করো, যেমন করে তাঁরা আমাকে লালন-পালন করেছেন আমার ছোট্ট শিশু অবস্থায়। তোমাদের আল্লাহ ভালোভাবেই জ্ঞাত আছেন তোমাদের মনের অবস্থা সম্পর্কে। তোমরা যদি বাস্তবিকই নেককার হতে চাও, তাহলে আল্লাহ তওবাকারী ও আশ্রয় ভিক্ষাকারীদের জন্যে সব সময়ই ক্ষমাশীল রয়েছেন।
এ আয়াতের শুরুতেই আল্লাহর একত্বের কথা অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলা হয়েছে এবং কেবলমাত্র এক আল্লাহর দাসত্ব কবুল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনের হুকুম অনেকটা বিস্তারিত করে পেশ করেছেন।
সূরা আল-আন’আম-এ বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************)
আল্লাহর সাথে কোনো কিছুই শরীক বানাবে না এবং পিতামাতার সাথে অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে।
এ আয়াতেও পূর্বোল্লিখিত আয়াতের মতোই প্রথমে আল্লাহর সাথে শিরক করতে নিষেধ –এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁরই আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তার সঙ্গে পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করার হুকুম দেয়া হয়েছে।
সূরা আল-বাকারায় বলা হয়েছেঃ
(আরবী*********************************************************************)
তোমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব কবুল করবে না এবং পিতামাতার সাথে অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে।
কুরআন মজীদের এসব আয়াতের বর্ণনাভঙ্গী থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মানুষের ওপর সর্বপ্রথম হক হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার এবং তার পর পরই ও সেই সঙ্গে সঙ্গেই হক হচ্ছে পিতামাতার। অনুরূপভাবে মানুষের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর প্রতি এবং তার পরই কর্তব্য হচ্ছে পিতামাতার প্রতি। আরো অগ্রসর হয়ে বলা যায়, প্রত্যেকটি মানুষের সর্বাধিক কর্তব্য রয়েছে আল্লাহ তা’আলা এবং পিতামাতার প্রতি। এ দুয়ের মাঝে যদি কখনও বিরোধ বাধে, একটি ছেড়ে অপরটি গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে আল্লাহর হক –আল্লাহর প্রতি কর্তব্য অগ্রাধিকার পাবে। তার পরে হবে পিতামাতার হক –পিতামাতার প্রতি কর্তব্য।
বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়, এসব আয়াতেই আল্লাহর হক ও আল্লাহর প্রতি কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে খুবই সংক্ষিপ্ত –একটি মাত্র শব্দে আর পিতামাতার প্রতি কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে অনেকটা বিস্তারিতভাবে। এ থেকে একদিকে যেমন একথা প্রমাণিত হয় যে, যে লোকই আল্লাহর বন্দেগী কবুল করবে, সে অবশ্যই পিতামাতার প্রতি তার কর্তব্য আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ীই পালন করবে। অনুরূপভাবে একথাও প্রমাণিত হয় যে, পিতামাতার প্রতি সঠিক কল্যাণমূলক ব্যবহার করা কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব –তারাই তা করে ও করতে পারে –যারা একমাত্র আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ দাসত্ব কবুল করেছে, যারা শপথ নিয়েছে সমগ্র জীবন ভরে এক আল্লাহর বন্দেগী করার।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পিতামাতার প্রতি কর্তবের ওপর এখানে এতখানি গুরুত্ব আরোপ করা হলো কেন? আল্লাহর বন্দেগী কবুল করার নির্দেশ দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কেন পিতামাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করার হুকুম দেয়া হলো এবং কেনই বা তা অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত করে বলা হলো?
এ প্রশ্নের জবাব এই যে, আল্লাহ তা’আলার দেয়া জীবন-ব্যবস্থায় আকীদার দিক দিয়ে প্রথম ভিত্তি তওহীদ –আল্লাহর একত্ব; এবং সমাজ জীবনের ক্ষেত্রে প্রথম ইউনিট হচ্ছে পরিবার। আর এ পরিবার গড়ে ওঠে পিতামাতার দ্বারা। একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোকের বিবাহিত হয়ে একত্র বসবাস শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে স্থাপিত হয় একটি পরিবারের প্রথম ভিত্তি-প্রস্তর। এ আয়াতের বিশেষ বর্ণনাভঙ্গী ও পরস্পরা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের মূল লক্ষ্য এক আল্লাহর প্রভুত্ব ও তাঁর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বাস্তবায়িত করা, তার জন্যে পরিবার গঠন ও পারিবারিক জীবন যাপন না করলে এক আল্লাহর বন্দেগী কবুল করা ও তদনুরূপ বাস্তব জীবনধারা পরিচালিত করা সম্ভব নয়। ৱ
দ্বিতীয়ত, এ পারিবারিক জীবনকে সুষ্ঠু, সুন্দর, স্বচ্ছন্দ ও শান্তিপূর্ণ করে গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনে সতত প্রস্তুত ও তৎপর হয়ে থাকা। সন্তান-সন্ততি যদি পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনে প্রস্তুত না হয়, বিশেষ করে তাদের কর্তব্য ও অক্ষমতার অসহায় অবস্থায়ও যদি তাদের বোঝা বহনকারী পৃষ্ঠপোষক আশ্রয়দাতা ও প্রয়োজন পূরণকারী হয়ে না দাঁড়ায় –বরং যৌবনের শক্তি-সামর্থ্যের অহমিকায় অন্ধ হয়ে যদি তারা পিতামাতার প্রতি কোনো রূপ খারাপ ব্যবহার করে, জ্বালা-যন্ত্রণা দেয়, তাদের খেদমত না করে, তাদের সাথে বিনয় ও নম্রতাসূচক ব্যবহার না করে, যদি তাদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাভক্তি ও অন্তরের অকৃত্রিম দরদ পোষণ না করে, তাহলে সে অবস্থা পিতামাতার পক্ষে চরম দুঃখ, অপমান ও লাঞ্ছনার ব্যাপার হয় দাঁড়ায়। তার ফলে পরিবার ও পারিবারিক জীবনের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে জাগে চিরন্তন অশ্রদ্ধা। এরপর অপর কোনো পুরুষ ও স্ত্রী পারিবারিক জীবন যাপবে –তথা সন্তান জন্মদান করে পিতামাতা হতে এবং সন্তানের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম ও দুঃসহ কষ্ট স্বীকার করতে আর কেউ রাজি নাও হতে পারে। তাহলে আল্লাহর একত্ববাদের বাস্তব রূপায়ণের প্রথম ভিত্তি এবং ইসলামী সমাজ-জীবনের প্রথম ঐকিক পরিবার গড়ে উঠতে পারবে না। আর তাই যদি না হয় তাহলে সেটা যে বড় মারাত্মক অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমান কর যায়।
পরিবার ও পারিবারিক জীবনের এ অপরিসীম গুরুত্বের কারণেই ইসলামে সেইসব বিধি-ব্যবস্তা ইতিবাচকভাবে দেয়া হয়েছে, যার ফলে পরিবার দৃঢ়মূল হতে পারে, হতে পারে সুখ-শান্তি ও মাধুর্যপূর্ণ এবং সেসব কাজ ও ব্যাপার-ব্যবহারকে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করে দেয়া হয়েছে যা পরিবারকে ধ্বংস করে, পারিবারিক জীবনকে তিক্ত ও বিষময় করে তোলে। আর তারই বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে বর্তমান গ্রন্থে।