যেসব মেয়ে-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে হারাম
মানব বংশের স্থিতি ও বৃদ্ধি এবং মনের প্রশান্তি ও স্বস্তি একান্তভাবে নির্ভর করে স্ত্রী-পুরুষের যৌন মিলনের ওপর। কুরআন মজীদ এ মিলনকে সমর্থন করেছে এবং তাকে জরুরী বলে ঘোষণা করেছেন। এ মিলন স্পৃহাকে অস্বীকার করা, উপেক্ষা করা কিংবা নির্মূল করে দেয়া কুরআনের দৃষ্টিতে মানবতার প্রতি এক চ্যালেঞ্জ, এক অমার্জনীয় অপরাধ সন্দেহ নেই।
কিন্তু যৌন মিলন সংস্থাপনের ব্যাপারে ইসলাম নারী-পুরুষকে স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী ও বল্গাহারা করে ছেড়ে দেয়নি। বরং এজন্যে জরুরী সীমা নির্দেশ করে দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে এবং নির্ধারিত করে দিয়েছে কতকটা বিধি-নিষেধ। কিছু কিছু নারী-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে এজন্যেই হারাম করে দিয়েছে ইসলাম। এ সীমা নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ বংশ, আত্মীয়তা-সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ীত্ব ও পবিত্রতা, পারস্পরিক ঐক্য ও সহযোগিতা এবং সর্বোপরি নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এক উন্নত ও পবিত্র সমাজ পরিবেশ গঠন করার জন্যে একান্তই জরুরী। নারী-পুরুষের যৌন মিলনের সম্ভ্রম ও পবিত্রতা রক্ষার জন্যে সর্ব প্রথম শর্ত হচ্ছে বিয়ে। কিন্তু সেই বিয়েকেও যথেচ্ছা হতে দেয়া যায় না কোনোক্রমেই। সমাজ-পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতির জন্যে যেমন দরকার হচ্ছে নারী-পুরুষের পারস্পরিক যৌন-মিলনের, তেমনি জরুরী হচ্ছে ইসলাম আরোপিত এই সীমা, বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণকে পূর্ণ মাত্রায় ও বাধ্যতামূলকভাবে রক্ষা করে চলে।
কুরআন মজীদ যেসব মেয়ে-পুরুষের মাঝে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপন হারাম করে দিয়েছে, তার ভিত্তি হচ্ছে তিনটিঃ বংশ-সম্পর্ক, দুগ্ধপানের সম্পর্ক এবং বৈবাহিক সম্পর্ক।
১. বংশ-সম্পর্কের কারণে মা-বাপের দিক দিয়ে যেসব আত্মীয়তার উদ্ভব হয় তা মোটামুটি সাতটিঃ মা, ঔরসজাত কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি, বোনঝি। যে-কোনো পুরুষের পক্ষেই তার এ ধরনের আত্মীয় মহিলাকে বিয়ে করা চিরদিনের তবে হারাম। আর এ হারামের কারণ হচ্ছে এই বংশ-সম্পর্ক (আরবী*******)। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************************)
বিয়ে করা হারাম করে দেয়া হয়েছে তোমাদের প্রতি তোমাদের মা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, তোমাদের ভাইয়ের কন্যা এবং বোনের কন্যা।
মা বলতে এখানে এমন সব মেয়েলোককে বুঝায়, যার সাথে প্রকৃত মা এবং বাবার দিক দিয়ে জন্ম ও রক্তের সম্পর্ক রয়েছে আর এ সম্পর্কের সূচনা হয় দাদি ও নানি থেকে। অতএব তাদের বিয়ে করাও হারাম।
কন্যা বলতে এমন সব মেয়েও বোঝাবে, যাদের সাথে স্বীয় ঔরসজাত কন্যা বা পুত্রের দিক দিয়ে সম্পর্ক রয়েছে। আর বোনের মধ্যে শামিল সেসব মেয়েও, যার সাথে বাপ কিংবা মা অথবা উভয়ের সমন্বয়ে বোনের সম্পর্ক হতে পারে। ফুফু বলতে এমন মেয়ে লোকও বোঝায়, যে বাবার কি তার বাবার –মানে দাদার বোন। আর ‘খালা’র মধ্যে এমন সব মেয়েলোকও শামিল, যার সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে মা কিংবা দাদার দিক দিয়ে। বোনঝি বলতে এমন সব মেয়েই বোঝায়, যাদের মায়ের সাথে রক্তের দিক দিয়ে বোনের সম্পর্ক হতে পারে। এ মোট সাত পর্যায়ের মেয়েলোক ও পুরুষ লোক পরস্পরের জন্যে মুহাররম। এদের পারস্পরিক বিয়ে হারাম। একথা সর্বজনসমর্থিত –কোনো মতভেদ নেই এতে। কেননা কুরআন (আরবী******************) বলে এদেরকেই স্পষ্ট হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
২. দুধ পানের সম্পর্কেও কিছু সংখ্যক মেয়ে-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে হারাম। ছেলে বা মেয়ে দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় যদি অপর কোনো মহিলার দুধ পান করে, তবে সে মহিলা হবে তার দুধ-মা, তার স্বামী হবে এর দুধ-বাপ। এ দুধ-মা ও বাপের সাথে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপন দুধ পানকারী পুরুষ বা নারীর জন্য হারাম, যেমন হারাম প্রকৃত মা বোনের সাথে বিয়ে। (আরবী******************)
অনুরূপভাবে দুধ-বোনও হারাম। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে দুধ-মা ও দুধ-বোন উভয় সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************)
এবং তোমাদের স্তনদায়িনী মা-দের এবং তোমাদের দুধ-বোনদেরকে বিয়ে করা তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে।
আল্লামা ইবনে রুশদ আল-কুরতুবী এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
মোটামুটিভাবে বংশ সম্পর্কের কারণে যাকে বিয়ে করা হারাম, দুধ পানের কারণেও তাকে বিয়ে করা হারাম হওয়া সম্পর্কে সব ফিকাহবিদই সম্পূর্ণ একমত অর্থাৎ স্তনদায়িনী আপন মায়ের সমান পর্যায়ে গণ্য হবে। অতএব বংশের দিক দিয়ে ছেলের প্রতি হারাম যাকে যাকে বিয়ে করা, দুগ্ধদায়িনীর পক্ষেও সে সে হারাম।
দুধ বোন সম্পর্কে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী********************************************************************)
মোটামুটিভাবে বংশ সম্পর্কের কারণে যাকে বিয়ে করা হারাম, দুধ পানের কারণেও তাকে বিয়ে করা হরাম হওয়া সম্পর্কে সব ফিকাহবিদই সম্পূর্ণ একমত অর্থাৎ স্তনদায়িনী আপন মায়ের সমান পর্যায়ে গণ্য হবে। অতএব বংশের দিক দিয়ে ছেলের প্রতি হারাম যাকে যাকে বিয়ে করা, দুগ্ধদায়িনীর পক্ষেও সে সে হারাম।
দুধ বোন সম্পকে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
দুধ-বোন সে, যাকে তোমার মা তোমার বাবার কাছে থেকে পাওয়া দুধ সেবন করিয়েছে, তা তোমার সাথে এক সঙ্গেই সেবন করুক, কি তোমার পূর্বে তোমার পরে –ছেলে হোক আর মেয়ে হোক। (আরবী**********)
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন –হযরত রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী********************************************)
দুধ পানে সে সে হারাম হয়ে যায়, যে যে হারাম হয় জন্মগত সম্পর্কের কারণে।
এজন্যে হযরত আয়েশা (রা) সব সময় বলতেনঃ
(আরবী************************************************************)
তোমরা দুধ পানের কারণে তাকে তাকে হারাম মনে করবে, যাকে যাকে হারাম মনে করো বংশের কারণে।
নবী করীম (স)-এর আর একটি কথা হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী**********************************)
রেহমী সম্পর্কের কারণে যে যে হারাম হয়, দুধ পানের দরুনও সে সে হারাম হয়।
বৈবাহিক সম্পর্কের দিক দিয়েও কোনো কোনো আত্মীয়ের সাথে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপন হারাম হয়ে যায়। এ হারাম দু’প্রকারের। এক, স্থায়ী –যেমন স্ত্রীর মা, পুত্রের স্ত্রী, যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এমন স্ত্রীর কন্যা এবং পিতার স্ত্রী।
পিতার স্ত্রী সম্পর্কে কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************************)
তোমাদের পিতারা যাকে বিয়ে করেছে, তাকে তাকে তোমরা বিয়ে করো না।
এর কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বয়ং কুরআনেই বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************)
পিতার বিয়ে করা স্ত্রীকে বিয়ে করা অত্যন্ত লজ্জাকর ও জঘন্য কাজ, গুনাহের ব্যাপার এবং বিয়ের খুবই খারাপ পথ।
আল্লামা শওকানী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
(আরবী***********************************************************)
(পিতার বিয়ে করা স্ত্রীকে পুত্রের বিয়ে করা সম্পর্কে) নিষেধ বাণীর যে তিনটি কারণ উদ্ধৃত হয়েছে, তা প্রমাণ করে যে, এ কাজ অত্যন্ত সাংঘাতিক রকমের হারাম ও ঘৃণিত কাজ।
আর পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে কুরআনের নিষেধবাণী হচ্ছেঃ
(আরবী************************************************)
তোমাদের আপন ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদেরও হারাম করা হয়েছে।
স্ত্রীদের মা হারাম হওয়ার আয়াত হচ্ছেঃ
(আরবী***********************************)
তোমাদের স্ত্রীদের মা’দের হারাম করা হয়েছে।
আর স্ত্রীর গর্ভজাত মেয়েকে বিয়ে করা হারাম হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতের ভিত্তিতেঃ
(আরবী***********************************************)
এবং তোমাদের সেসব স্ত্রীদের –যাদের সাথে তোমাদের যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে –গর্ভজাত মেয়েরাও হারাম।
যৌন সম্পর্ক স্থাপিত না হলে তাদের কন্যাকে বিয়ে করা হারাম নয়।
(আরবী*****************************************)
যদি বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত না করে থাকে, তবে তার কন্যাকে বিয়ে করায় কোনো দোষ নেই।
এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে রুশদ আল-কুরতুবী লিখেছেনঃ
(আরবী*********************************************)
এ চারজনের মধ্যে দুজন হারাম হয়ে যায় বিয়ের আকদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে –তারা হচ্ছে পিতার স্ত্রী পুত্রের জন্যে ও পুত্রের স্ত্রী পিতার জন্যে, আর একজন হারাম হয় স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে পরে –সে হচ্ছে স্ত্রীর অপর এক স্বামীর নিকট থেকে নিয়ে আসা কন্যা।
আর দ্বিতীয় অস্থায়ী ও সাময়িক। যেমন স্ত্রীর বোন, স্ত্রীর ফুফু, খালা, ভাইঝি-বোনঝি ইত্যাদি। স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় স্ত্রীর এসব নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করা ও একত্রে এক স্থায়ী স্ত্রীত্বে বরণ করা ইসলামে হারাম। এ কথার ভিত্তি হচ্ছে নিম্নোক্ত আয়াতাংশঃ
(আরবী************************************************)
এবং দু’জন সহোদর বোনকে একত্রে স্ত্রীরূপে বরণ করা তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ।
এ আয়াতের ভিত্তিতে ফিকাহবিদগণ নিম্নোক্ত মূলনীতি নির্ধারণ করেছেনঃ
(আরবী**********************************************************)
যে দু’জন স্ত্রীলোকের পারস্পরিক আত্মীয়তার কারণে বিয়ে হারাম, তাদের দু’জনকে একজন স্বামীর স্ত্রীত্ব একত্রে বরণ করা হারাম।
এভাবে যেসব মেয়েলোককে বিয়ে করা একজন পুরুষের পক্ষে হারাম তাদের সংখ্যা দাঁড়াল নিম্নরূপঃ
(ক) বৈবাহিক ও রক্তের সম্পর্কের কারণে সাতজন। আর তারা হচ্ছেঃ মা, কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি ও বোনঝি।
(খ) বৈবাহিক ও দুগ্ধপানের কারণে মোট সাতজন। তারা হচ্ছেঃ দুধ-মা, দুধ-বোন, স্ত্রীর মা, স্ত্রীর পূর্বপক্ষের কন্যা ও দুবোনকে একত্রের বিয়ে করা। এতদ্ব্যতীত পিতার স্ত্রী এবং ফুফু-ভাইঝিকে একত্রে বিয়ে করা। ইমাম তাহাভী বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************)
এ কয়জনকে বিয়ে করা যে-কোনো পুরুষের পক্ষে স্থায়ী ও সর্ববাদীসম্মতভাবে হারাম। এ বিষয়ে কারো কোন মতভেদ নেই।
এরপর আল্লাহ তা’আলা সেসব স্ত্রীলোককে হারাম করে দিয়েছেন, যারা বিবাহিতা –যাদের স্বামী জীবিত ও বর্তমান। বলেছেনঃ
(আরবী************************************************************)
এবং স্বামীওয়ালী সুরক্ষিতা মহিলাদের বিয়ে করাও হারাম।
আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী************************************)
এখানে ‘মুহসানাত’ মানে সেসব মেয়েলোক, যাদের স্বামী বর্তমান –যারা বিবাহিতা।
যেসব মেয়েলোককে বিয়ে করা হারাম, তাদের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করছেনঃ
(আরবী**************************************************)
এ হারাম –মুহাররম-স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্যান্য সব মেয়েলোকই বিয়ে করার জন্যে তোমাদের পক্ষে হালাল করে দেয়া হয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তাদেরকে তোমাদের মাল-মোহরানা দিয়ে সুরক্ষিত বিবাহিত জীবন যাপনের লক্ষ্যে গ্রহণ করবে, উচ্ছৃঙ্খল যৌন লালসা পূরণের কাজে নয়।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
উপরে উল্লিখিত মহিলাদের ছাড়া অন্যান্য সব মেয়েলোক বিয়ে করা জায়েয –সম্পূর্ণ হালাল, তা এ আয়াতাংশ স্পষ্ট প্রমাণ করছে।
অন্য কথায়, আল্লাহ তা’আলা চান যে, মুহাররম স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্যান্য মেয়েলোকদের যাকেই গ্রহণ করা হোক বিয়ের জন্যে –বিয়ের মাধ্যমে রীতিমতো মোহরানা দিয়ে তাদের বিয়ে করা হোক। কেবল উচ্ছৃঙ্খল যৌন পরিতৃপ্তি লাভ ও লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে যেন কেউ বিয়ে বন্ধনের বাইরে কোনো নারীকে স্পর্শ পর্যন্তও না করে।
কাফের ও আহলে কিতাব মেয়ে
কিন্তু এ ছাড়া আরো দু’শ্রেণীর মেয়ে বিয়ে করা সম্পর্কে কথা বলা এখনো বাকী রয়ে গেছে। এক কাফের মেয়ে, আর দ্বিতীয় মুশরেক ও আহলে কিতাব মেয়ে। কাফের মেয়ে যেমন মুসলমানদের জন্যে বিয়ে করা জায়েয নয়, তেমনি কাফের পুরুষের নিকট মুসলিম মেয়ে বিয়ে দেয়। দ্বীনের পার্থক্যের কারণে এ ধরনের বিয়ে স্থায়ীভাবে হারাম করে দেয়া হয়েছে।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*******************************************************)
তোমরা মুসলামনরা কাফের মেয়েকে বিয়ের বন্ধনে বেধে রেখো না।
এ আয়াতের ভিত্তিতে ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ
(আরবী****************************************************)
এ আয়াতে সমস্ত কাফের মুশরেক মেয়ে বিয়ে করতে স্পষ্ট নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
তিনি আরো লিখেছেন, পূর্বে কাফেররা মুসলিম মেয়ে বিয়ে করত আর মুসলিমরা করত কাফের মেয়ে। এ আয়াত দ্বারা এ উভয় বিয়েকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছেঃ
এ আয়াতের পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***********************************)
মুসলিম মেয়েরা কাফেরদের জন্যে হালাল নয় এবং মুসলিম পুরুষরাও অনুরূপভাবে হালাল নয় কাফের মেয়েদের জন্য।
আর এর কারণ হচ্ছে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য।
আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ
(আরবী*****************************************)
এ আয়াতে প্রমাণ করছে যে, মু’মিন-মুসলিম মেয়ে কাফের পুরুষের জন্যে হালাল নয়।
আর প্রথমোক্ত আয়াদের তাফসীরে লিখেছেনঃ
(আরবী******************************************************)
এর অর্থ এই যে, যে মুসলমানের স্ত্রী কাফের সে আর তার স্ত্রী থাকেনি। কেননা দ্বীন দুই হওয়ার কারণে এ দুয়ের বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে।
আহলে কিতাব –ইহুদী ও নাসারা বা খ্রিষ্টান-মেয়ে বিয়ে করার ব্যাপারটি বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ। এখানে তা পেশ করা যাচ্ছে।
আল্লামা আবূ বকর আল-জাসসাস লিখেছেনঃ
আহরে কিতাব মেয়ে বিয়ে করার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটি মত হচ্ছে এই যে, আহলে কিতাবের আযাদ বংশজাত বা জিম্মী মেয়ে হলে তাদের বিয়ে করা মুসলিম পুরুষদের জন্যে জায়েয, এতে কোনো মতভেদ নেই। যদিও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) তা পছন্দ করেন না, মকরুহ মনে করেন। তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************)
তিনি আহলে কিতাবের খানা খাওয়ায় কোনো দোষ মনে করতেন না, তবে তাদের মেয়ে বিয়ে করাকে মকরুহ মনে করতেন।
তাঁর সম্পর্কে অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ ইহুদী ও খ্রীষ্টান মেয়ে বিয়ে করা সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ
(আরবী*************************************************************)
আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের জন্যে মুশরেক মেয়ে বিয়ে করাকে স্পষ্ট ভাষায় হারাম করে দিয়েছেন। আর মরিয়ম পুত্র ঈসা কিংবা অপর কোনো আল্লাহর বান্দাকে রব্ব বলে মনে করা অপেক্ষা বড় কোনো শিরক হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
আর ইহুদী-নাসারাদের বিশ্বাস ও আকীদা এমনিই, তাই তারাও মুশরিকদের মধ্যে গণ্য। অতএব তাদের মেয়ে বিয়ে করাও জায়েয নয়।
(আরবী***************************************************)
কেননা আহলে কিতাবও মুশরেক। এজন্যে ইহুদীরা বলেছেঃ উজাইর আল্লাহর পুত্র, আর খ্রিষ্টানরা বলেছেঃ ঈসা আল্লাহর পুত্র। যদিও বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেন যে, এ আয়াত মনসুখ হয়ে গেছে।
মায়মুন ইবনে মাহরান হযরত ইবনে উমর (রা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আমরা এমন জায়গায় থাকি, যেখানে আহলে কিতাবের সাথে খুবই খোলা-মেলা হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় আমরা কি তাদের মেয়ে বিয়ে করতে পারি?
এর জবাবে তিনি নিম্নোক্ত দু’টি আয়াত পাঠ করেনঃ
(আরবী**************************************************)
এবং আহলে কিতাব বংশের সেসব চরিত্র-সতীত্বসম্পন্না মেয়ে (বিয়ে করা তোমাদের জন্যে জায়েয)।
এবং
(আরবী********************************************)
এবং মুশরেক মেয়ে যতক্ষণ না ইসলাম কবুল করছে, ততক্ষণ তোমরা তাদের বিয়ে করো না।
প্রথম আয়াতে আহলে কিতাব মেয়ে বিয়ে করা জায়েয বলা হয়েছে, আর দ্বিতীয় আয়াতে মুশরেক মেয়ে বিয়ে করতে সুস্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। অন্য কথায়, তিনি এ ব্যাপারে নিজস্ব কোনো ফয়সালা শোনালেন না। শুধু আয়াত পড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়ে থাকলেন।
আল্লামা আবূ বকর লিখেছেন যে, একমাত্র হযতর ইবনে উমর ছাড়া সাহাবীগণের এক বিরাট জামা’আত যিম্মী আহলে কিতাবের মেয়ে বিয়ে করা জায়েয মনে করতেন। তাঁদের মতে দ্বিতীয় আয়াতটি কেবলমাত্র মুশরেকদের সম্পর্কেই প্রযোজ্য, সাধারণ আহলে কিতাবদের সম্পর্কে নয়।
হাম্মাদ বলেনঃ আমি হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর (রা)-কে ইহুদী নাসারা মেয়ে বিয়ে করা জায়েয কিনা জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেনঃ (আরবী************) –তাতে কোনো দোষ নেই। তাঁকে উপরিউক্ত দ্বিতীয় আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে মূর্তিপূজক মেয়েদের সম্পর্কে নির্দেশ, তারা নিশ্চয়ই হারাম।
হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা) ফায়েলা বিনতে ফেরারা নাম্নী এক খ্রিষ্টান মহিলা বিয়ে করেছিলেন। হযরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা)-ও সিরীয় ইহুদী মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। হাসান, ইবরাহী, নখয়ী ও শাবী প্রমুখ তাবেয়ী হাদীস-ফিকাহবিদও এ বিয়ে জায়েয বলে মনে করতেন।
কিন্তু এ পর্যায়ে হযরত উমর ফারূক (রা)-এর একটি নির্দেশ চমক লাগিয়ে দেয়। হযরত হুযায়ফা (রা) এক ইহুদী মেয়ে বিয়ে করলে তাকে নির্দেশ পাঠালেনঃ (আরবী************) ‘তাঁর পথ ছেড়ে দাও, তাকে ত্যাগ করো’।
তখন হুযায়ফা(রা) প্রশ্ন করে পাঠালেনঃ (আরবী****************) ‘ইহুদী মেয়ে বিয়ে করা কি হারাম?’
তার জবাবে হযত উমর (রা) লিখলেনঃ
(আরবী******************************************************)
হারাম নয় বটে, কিন্ত আমি ভয় করছি –আহলে কিতাব বলে তোমরা যদি তাদের বিয়ে করো তাহলে তোমরা তাদের মধ্য থেকে বদকার ও চরিত্র-সতীত্বহীনা মেয়েই বিয়ে করে বসবে।
হযরত উমরের উপরোক্ত নির্দেষ তাৎপর্যপূর্ণ এজন্যে যে, কুরআন মজীদে আহলে কিতাবের মধ্যে কেবলমাত্র (আরবী********************************)-দেরই বিয়ে করা জায়েয করা হয়েছে। আর তার জন্যে দুটি শর্ত অপরিহার্য। একটি হচ্ছে নাপাকীর জন্যে গোসল করা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে যৌন অঙ্গকে পূর্ণরূপে সংরক্ষিত রাখা। কিন্তু আহলে কিতাবের কোনো মেয়ে বিয়ের পূর্বে তার যৌন অঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করেছে, তা বাছাই করে নেয়া খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। আর দ্বিতীয়ত বিয়ের পর যৌন অঙ্গকে স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে ব্যবহার করতে না দেয়ার প্রতি কোনো মেয়ের মনে দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে, তা জানবার কি উপায় হতে পারে? বিশেষত এ কারণে যে, আহলে কিতাব সমাজের লোকেরা এ ব্যাপারে কড়াকড়ি করার খুব বেশী পক্ষপাতী নয়। বরং তাদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়ার কারণে যৌন সংরক্ষণশীলতা নেই বললেই চলে।
এ দুটি দিক সম্পর্কে যদি নিশ্চয়তা লাভ করা সম্ভব নয়, তাহলেই একজন ঈমানদার মুসলিমের পক্ষে একজন আহলে কিতাব মেয়েকে বিয়ে করা জায়েয হতে পারে। অন্যথায় তা সাধারণ কাফের মুশরেক মেয়েদের মতোই মুসলিমদের জন্যে চিরতরে হারাম। তিন আল্লাহতে বিশ্বাসী আহলে কিতাবরা মুশরেকদের মধ্যে গণ্য। তাই তাদের মেয়ে বিয়ে করাও হারাম।
বদল বিয়ে জায়েয নয়
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেছেনঃ
(আরবী***************************************************)
নবী করীম (স) ‘শেগার’ বিয়ে নিষেধ করে দিয়েছেন।
‘শেগার’ বিয়ে কাকে বলে –তার ব্যাখ্যা করে হাদীসের বর্ণনাকারী বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
‘শেগার’ বিয়ে হয় এভাবে যে, একজন অপরজনের নিকট নিজের মেয়ে বিয়ে দেবে এ শর্তে যে, সে তার মেয়ে তার নিকট বিয়ে দেবে, আর এ দুটি বিয়েতে কোনো মোহরানা দেয়া নেয়া হবে না।
আল্লামা ‘বেন্দার’ বলেছেনঃ শেগার বিয়ের কথাবার্তা হয় এভাবে যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলবেঃ
(আরবী****************************************************************************)
তোমার মেয়েকে আমার নিকট বিয়ে দাও, আমি আমার মেয়েকে তোমার নিকট বিয়ে দেবো।
বাংলা ভাষায় আমরা এ ধরনের বিয়েকে বলে থাকি ‘বদল বিয়ে’
‘বদল বিয়ে’র নিষিদ্ধ ধরন হচ্ছে এই যে, একজন তার বোন কিংবা মেয়েকে অপর ব্যক্তির নিকট বিয়ে দেবে এ শর্তে যে, সেই অপর ব্যক্তি তার নিজের বোন কিংবা মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দেবে এবং একজনের যৌন অঙ্গ অপর জনের বিয়ের মোহরানাস্বরূপ হবে। দুটি বিয়ের কোনোটিতেই আলাদাভাবে কোনো মোহরানাই ধার্য করা হবে না।
ইমাম রাফেয়ী বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************)
এ ধরনের বিয়েতে একটি বিয়েকে অপর একটি বিয়ের সাথে সম্পর্কিত করা হয়, একটির জন্যে অপরটি শর্ত স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। আর যৌন অঙ্গে পরস্পরকে শরীক করা হয়। এ কারণে এ বিয়ে জায়েয নয়।
কিন্তু হানাফী মাযহাব অনুযায়ী একজনের মেয়ে কিংবা বোনকে অপর জনের নিকট বিয়ে দেয়া এবং শর্তে যে, সে তার মেয়ে কিংবা বোনকে তার নিকট বিয়ে দেবে –যেন একটি বিয়ে অপর বিয়ের বদল হয় –এ বিয়ে জায়েয এবং তাতে মহরে মিসল –সম-মানের মোহরানা দেয়া ওয়াজিব।
এ সম্পর্কে হানাফী মাযহাবের ফিকাহবিদদের মত হচ্ছেঃ
(আরবী*******************************************************************************)
‘শেগার’ বিয়ে নিষিদ্ধ শুধু এজন্যে যে, কেননা তাতে মোহরানা ধার্য করা হয় না। এ কারণে আমরা তাতে মহরে মিসল ওয়াজিব মনে করেছি। তাহলে তা আর ‘শেগার’ থাকবে না অর্থাৎ তখন তা নিষিদ্ধ নয়।