হাদিসের নামে জালিয়াতীঃ প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন কথা
ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পিএইচডি (রিয়াদ), এমএ(রিয়াদ), এম.এম(ঢাকা)
সহযোগী অধ্যাপক, আল হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
ভূমিকা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লী আলা রাসলিহীল কারীম, আম্মাবাদ
কুরআনে কারীমের পরে রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস ইসলামী জ্ঞানের দ্বিতীয় উৎস ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ভিত্তি। মুমিনের জীবন আবর্তিত হয় রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসকে কেন্দ্র করে। হাদীস ছাড়া কুরআন বুঝা ও বাস্তবায়ন করাও সহজ নয়। হাদীসের প্রতি এই স্বভাবজাত ভালবাসা ও নির্ভরতার সুযোগে অনেক জালিয়াত বিভিন্ন প্রকার বানোয়াট কথা ‘হাদীস’ নামে সমাজে প্রচার করছে। সকল যুগে আলিমগণ এসকল জাল ও বানোয়াট কথা নিরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করে মুসলমানদেরকে সচেতন করেছেন।
আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে হাদীসের পঠন, পাঠন ও চর্চা থাকলেও সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসের বাছাইয়ের বিষয়ে বিশেষ অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। যুগ যুগ ধরে অগণিত বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা কথা আমাদের সমাজে হাদীস নামে প্রচারিত হয়েছে ও হচ্ছে। এতে আমরা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার কঠিন পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছি। এছাড়াও দুইভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রথমত, এ সকল বানোয়াট হাদীস আমাদেরকে সহীহ হাদীসের শিক্ষা, চর্চা ও আমল থেকে বিরত রেখেছে। দ্বিতীয়ত, এগূলোর উপর আমল করে আমরা আল্লাহর কাছে পুরস্কার বদলে শাস্তি পাওনা করে নিচ্ছি।
১৯৯৮ সাল থেকে আমার মুহতারাম শ্বশুর ফুরফুরার পীর হযরত মাওলানা আবুল আনসার সিদ্দীকী আল-কুরাইশী সাহেব(হাফিজাহুল্লাহ) আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন সমাজে প্রচলিত বানোয়াট ও জাল হাদীস সম্পর্কে বই লিখতে। তাঁর নির্দেশ অনুসারে কিছু বিষয় লিখে জমা করেছিলাম। ২০০২-২০০৩ সালে নেদায়ে ইসলামের কয়েক সংখ্যায় এ বিষয়ে কিছূ লিখেছিলাম। কিন্তু যোগ্যতার সীমাবদ্ধতা, সময়ের অভাব ইত্যাদি কারণে বিষয়টি পুস্তকাকারে প্রকাশ করা আর হয়ে উঠছিলনা। অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে পুস্তকটি প্রকাশ করতে পেরে তাঁর দরবারে অগণিত শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
জাল হাদীসের বিষয়ে দুই প্রকারের বিভ্রান্তি বিরাজমান। অনেকেই মনে করেন ‘হাদীস’ মানেই রাসূল(স) এর বাণী। কাজেই কোনো হাদীসকে দূর্বল বলে মনে করার অর্থ, রাসূল(স) এর কথা বা বাণীকে অবজ্ঞা করা। কেউবা মনে করেন যত দূর্বল বা যয়ীফই হোক, যেহেতু রাসূল(স) এর কথা, কাজেই তাকে গ্রহণ ও পালন করতে হবে।
এই ধারণা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। তবে এর বিপরীতে এরচেয়েও মারাত্মক বিভ্রান্তি অনেকের মাঝে বিদ্যমান। অনেক ‘অজ্ঞ’ পন্ডিত মনে করেন, হাদীস যেহেতু মৌখিকভাবে সনদ বা বর্ণনাকারীদের পরম্পরার মাধ্যমে বর্ণিত এবং রাসূল(স) এর কয়েকশত বৎসর পরে পরে লিখিত ও সংকলিত, কাজেই তার মধ্যে ভুলভ্রান্তি ব্যাপক। এজন্য হাদীসের উপর নির্ভর করা যাবেনা। কেউবা ভাবেন, হাদীসের মধ্যে অনেক জাল কথা আছে, কাজেই আমরা বিবেক বুদ্ধি অনুসারে কোনোটি মানবো আর কোনোটি মানবোনা।
এ সকল বিভ্রান্তির কারণ হলো, হাদীসের সনদ বিচারে ও হাদীসের নির্ভরযোগ্যতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগের মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণের সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞতা। এজন্য এই পুস্তকের প্রথম পর্বে হাদীসের পরিচয়, হাদীসের নামে মিথ্যার বিধান, ইতিহাস, হাদীসের নির্ভূলতা নির্ণয়ে সাহাবীগণ ও পরবর্তী মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতি, নিরীক্ষার ফলাফল, মিথ্যার প্রকারভেদ, মিথ্যাবাদী রাবীগণের শ্রেণীবিভাগ, জাল হাদীস নির্ধারণের পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করছি। আশা করি এই আলোচনা পাঠক মনের দ্বিধা ও অস্পষ্টতা দূর করবে এবং হাদীসের নির্ভূলতা রক্ষায় মুসলিম উম্মাহর অলৌকিক বৈশিষ্ট্য পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে।
দ্বিতীয় পর্বে আমাদের সমাজে প্রচলিত কতগুলো ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও জাল হাদীসের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেছি। উল্লেখ্য যে, জাল হাদীসের বিষয়ে আমি মূলত নিজের কোনো মতামত উল্লেখ করিনি। দ্বিতীয় হিজরীর তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী ইমামগণ থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগের অগণিত মুহাদ্দিস রাসূলুল্লাহ(স)এর নামে প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করে, গভীর নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের মাধ্যমে যে সকল হাদীস ও রাবীদের বিষয়ে যে সকল মতামত প্রদান করেছেন আমি মূলত সেগুলির উপরই নির্ভর করেছি এবং তাঁদের মতামতই উল্লেখ করেছি। যে সকল হাদীস বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন সেগুলির ক্ষেত্রে তাঁদের মতভেদ উল্লেখ করেছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি।
দুই একটি ক্ষেত্রে দেখেছি যে, আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছূ গ্রন্থে এমন কিছূ হাদীস রয়েছে যা সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ কোনো প্রকারের সনদেই কোনো গ্রন্থে পাওয়া যাচ্ছেনা। এগুলি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এই প্রকারের হাদীসের ক্ষেত্রে আমি নিজের মতামত প্রকাশ করেছি। পরবর্তী খন্ডগুলোতে এই প্রকারের হাদীস সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ।
এখানে উল্লেখ্য যে, এ ধরনের অনেক কথা সরাসরি হাদীস নামে বলা হয়। আবার অনেক কথা সওয়াব, ফযীলত, বরকত বা ক্ষতির কারণ হিসেবে সাধারণভাবে বলা হয়, কিন্তু পাঠক বা শ্রোতা কথাটিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের(স) এর কথা বলেই বোঝেন। এই জাতীয় অনেক কথা আমাদের দেশে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়। সেগুলি সম্পর্কেও মাঝে মাঝে আলোচনা করেছি।
প্রচলন বুঝাতে মাঝে মাঝে প্রচলিত বুই-পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেছি। এ সকল ক্ষেত্রে আমার উদ্দেশ্য কথাটির প্রচলন বোঝানো। লেখক বা বইয়ের সমালোচনা বা অবমূল্যায়ন আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং তাঁদের খেদমতের স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে হাদীসের নামে প্রচলিত বানোয়াট কথাগুলোর পাঠকদের সতর্ক করাই আমার উদ্দেশ্য। সকল লেখকই তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টার জন্য আল্লাহর কাছে পুরস্কার পাবেন। আমরা এ সকল লেখকের জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, তিনি এদের মহান খেদমত কবুল করুন, এদেরকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন এবং আমাদের ও তাঁদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন।
বইয়ের কলেবল বৃদ্ধির একটি কারণ হলো, প্রায় সকল বিষয়ে বানোয়াট হাদীসগুলো আলোচনার সময় সে বিষয়ে বর্ণিত সহীহ হাদীসগুলির বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হয়েছে। দুইটি কারণে তা করতে হয়েছে।
প্রথমত, অনেক সময় জালিয়াতগণ জাল হাদীস তৈরি করার সময় সহীহ হাদীসের কিছু শব্দ ও বাক্য তার সাথে জুড়ে দেয়। এছাড়া অনুবাদের কারণে অনেক সময় জাল ও সহীহ হাদীসের অর্থ কাছাকাছি মনে হয়। এজন্য শুধু জাল হাদীসটি উল্লেখ করলে সাধারণ পাঠকের মনে হতে পারে যে, এ বিষয়ের সকল হাদীসই বুঝি জাল। অথবা এই অর্থের একটি হাদীস অমুক গ্রন্থে রয়েছে, কাজেই তা জাল হয় কিভাবে।
দ্বিতীয়ত, শুধু জাল হাদীস চিহ্নিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বাস ও কর্মে জাল হাদীস বর্জন করে সহীহ হাদীসের উপর আমল করে নিজেদের নাজাতের জন্য চেষ্টা করা। এজন্য জাল হাদীস উল্লেখের সময় সে বিষয়ক সহীহ হাদীসগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে হলেও কিছু বলেছি।
সম্মানিত পাঠককে একটি বিষয়ে সাবধান করতে চাই। আমরা জানি যে, নিজে কর্ম করার চেয়ে অন্যের সমালোচনা করা অনেক বেশি সহজ ও মানবীয় প্রবৃত্তির কাছে আনন্দদায়ক। এজন্য অনেক সময় আমরা একটি নতুন বিষয় জানতে পারলে সেই নতুন জ্ঞানকে অন্যের দোষ ধরার কাজে ব্যবহার করি।
আমাকে একজন বললেন, “অমুকেরা যয়ীফ বা জাল হাদীস নিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে। কত বলি যে, আপনারা সহীহ হাদীসের কিতাব পড়ুন, কিন্তু তাঁরা শুনেননা।” আমি বললাম, “তাঁরা তো যয়ীফ হাদীস নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে যেয়ে ডাকছেন, আপনি সহীহ হাদীসের গ্রন্থগুলি নিয়ে কয়জনের দ্বারে গিয়েছন?” শুধু সমালোচনা কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনা।
এই বই থেকে আমরা অনেক জাল হাদীসের কথা জানতে পারব। এ জ্ঞান আমাদেরকে সহজেই শয়তানের খপ্পরে ফেলে দিতে পারে। আমরা চায়ের দোকানে, মসজিদে, ওয়াযে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা দলকে সমালোচনা করে বলতে পারব যে, তারা অমুক জাল হাদীসটি বলেন বা পালন করেন। এই কর্মের দ্বারা আমরা সওয়াবের পরিবর্তে গোনাহ অর্জন করব।
এই বইটি লেখার উদ্দেশ্য তা নয়। এই বইটি লেখার উদ্দেশ্য আমরা অনির্ভরযোগ্য, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীসের পরিবর্তে সহীহ হাদীসগুলির উপর নির্ভর করে নিজেদের কর্ম ও বিশ্বাসকে আরো উন্নত করব। যে সকল সহীহ হাদীস আমরা জানতে পারব সেগুলো ব্যক্তিগতভাবে পালন করব এবং অন্যদেরকে পালন করতে উৎসাহ দেব। যে সকল জাল হাদীসের বিষয়ে জানতে পারব সেগুলি কখনোই আর হাদীস হিসেবে বলবনা বা পালন করবনা। কেউ তা করলে সম্ভব হলে ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের সাথে সংশোধনের চেষ্টা করব। সর্বাবস্থায় মহিমাময় ও করুণাময় আল্লাহর কাছে তার ও আমাদের নিজের ক্ষমা ও কবুলিয়তের জন্য দোআ করব।
সম্মানিত পাঠক, আমার যোগ্যতার কমতি বিষয়ে আমি সচেতন। আমি জানি এ বিষয়ে লেখালেখি করার যোগ্যতা মূলত আমার নেই। যা কিছু লিখেছি সবই মূলত ধার করা বিদ্যা। আর এতে ভুল ভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক। কাজেই যে কোনো বিষয়ে আপনি যদি আমার ভুল ধরিয়ে দেন তবে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব এবং আপনাকে ওস্তাদের সম্মান প্রদান করব।
আগেই বলেছি, এই পুস্তকটি লিখতে আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন আমার শ্রদ্ধাভাজন শ্বশুর ফুরফুরার পীর মাওলানা আবুল আনসার সিদ্দিকী। মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন তাকে সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করেন, তাঁকে, তাঁর সন্তান সন্ততি, আত্মীয় স্বজন ও ভক্তবৃন্দকে হেফাজত করেন। এছাড়া অনেক বন্ধু বান্ধব, সহকর্মী, ছাত্র ও শুভান্যুধ্যায়ী আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। বন্ধুবর ড. মো. আবু সিনা, ড. মো. অলি উল্যাহ, জনাব আ.শ.ম. শুআইব আহমদ ও জনাব মো. আব্দুল মালেক বইটির পান্ডুলিপি দেখে অনেক গঠনমূলক পরামর্শ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ সবাইকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।
বানানের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে বাংলা একাডেমী মতামত অনুসরণ করা হয়েছে। তবে আরবী-ফারসী শব্দের ক্ষেত্রে মূল উচ্চারণের কাছাকাছি বর্ণ ব্যবহারের চেষ্টা করেছি। বিষয়টি কঠিন। অগণিত আরবী শব্দ ফারসী-উর্দূর প্রভাবে ভুল উচ্চারণে ও ভুল প্রতিবর্ণে বাংলা ভাষার সম্পদে পরিণত হয়েছে। এগুলি অনেক ক্ষেত্রে সেভাবেই রাখা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের খেদমতে একটি অতি নগন্য প্রচেষ্টা এই গ্রন্থ। আমার কর্মের মধ্যে অনেক ত্রুটি রয়েছে। মহান আল্লাহর দরবারে সকাতরে প্রার্থনা করি, তিনি দয়া করে ভুলত্রুটি ক্ষমা করে এই নগন্য খেদমতটুকু কবুল করেন এবং একে আমার, আমার পিতামাতা, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়, বন্ধূগণ ও সকল পাঠকের নাজাতের ওসীলা বানিয়ে দেন। আমীন!
আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর