১.৪. জালিয়াতি প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহ
উপরের আলোচনা হতে আমরা স্পষ্টরূপে দেখতে পাই যে, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, অনুধাবনগত বা অসাবধানতাজনিত সকল প্রকার মিথ্যা হতে বিশুদ্ধ হাদীসকে নির্ভেজালভাবে সংরক্ষণের জন্য সাহাবীগণ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তা একদিকে যেমন যৌক্তিক, প্রায়গিক, বৈজ্ঞানিক ও সূক্ষ্ম, অন্যদিকে তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একক ও অনন্য। অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীগণ তাঁদের ধর্মের মূল শিক্ষা বা ওহী সংরক্ষণের জন্য এরূপ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যা প্রচারিত হয়েছে তাই সংকলিত করা হয়েছে। অবশেষে ওহীর সাথে মানবীয় জ্ঞানের মিশ্রণের মাধ্যমে ওহীর বিকৃতি ও অবলুপ্তি ঘটেছে।
তাবিয়ীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ সাহাবীগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আপোষহীন ছিলেন। তাঁরা হাদীস এর সংরক্ষণ ও বানোয়াট কথা থেকে বিশুদ্ধ হাদীসের বাছাই এর জন্য তাঁদের জীবনের সকল আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করেছেন।
এই পরিচ্ছেদে আমরা সংক্ষেপে তাঁদের মূলনীতিগুলো আলোচনা করবে।
১.৪.১. হাদীস শিক্ষা ও সংরক্ষণ
মহান আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদীর প্রথম যুগের মানুষদেরকে তাঁর মহান রাসূল(স) এর হাদীস সংরক্ষণের বিষয়ে একটি সঠিক ও সময়োপযোগী কর্মের তাওফীক প্রদান করেন। প্রথম হিজরী শতক থেকে সাহাবী, তাবিয়ী ও তৎপরবর্তী যুগের আলিমগণ মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি গ্রামগঞ্জ, শহর ও জনপদ ঘুরে ঘুরে সকল হাদীস ও বর্ণনাকারীদের তথ্য সংগ্রহ করতেন। হাদীস শিক্ষা, লিখে রাখা, শিখানো ও হাদীস কেন্দ্রিক আলোচনাই ছিল ইসলামের প্রথম তিন চার শতকের মানুষদের অন্যতম কর্ম, নেশা, পেশা ও আনন্দ।
তাবেয়ীগণের যুগ থেকে বা হিজরী প্রথম শতকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী প্রায় তিন শতাব্দী পর্য্ন্ত সময়কালে আমরা দেখতে পাই যে, হাদীস বর্ণনাকারীগণ দুই প্রকারের। অনেক হাদীস বর্ণনাকারী বা ‘রাবী’ নিজ এলাকার ‘রাবী’ বা মুহাদ্দিসগণের নিকট হতে এবং সম্ভব হলে অন্যান্য দেশের কিছু মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন। এরপর তিনি হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষায় রত থেকেছেন। তাঁর নিকট হতে যে শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েছে তাকে সেই হাদীসগুলি শিক্ষা দিয়েছেন। এরা সাধারণভাবে ‘রাবী’ বা বর্ণনাকারী নামে পরিচিত।
অপরদিকে এই যুগগুলিতে অনেক মুহাদ্দিস নিজ এলাকার সকল ‘রাবী’র নিকট হতে হাদীস শিক্ষা ও লিপিবদ্ধ করার পরে বেড়িয়ে পড়েছেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি জনপদ সফর করতে। তাঁরা প্রত্যেকে দীর্ঘ কয়েক বছর বা কয়েক যুগ এভাবে প্রতিটি জনপদে গমন করে সকল জনপদের সকল ‘রাবী’ বা মুহাদ্দিসের নিকট হতে হাদীস শুনেছেন ও লিপিবদ্ধ করেছেন। একজন সাহাবীর বা একজন তাবেয়ীর একটিমাত্র হাদীস বিভিন্ন ‘রাবী’র মুখ হতে শুনতে ও সংগ্রহ করতে তাঁরা মক্কা, মদীনা, খোরাসান, সমরখন্দ, মারভ, ওয়াসিত, বাসরা, কূফা, বাগদাদ, দামেস্ক, হালাব, কায়রো, সান‘আ ইত্যাদি অগণিত শহরে সফর করেছেন। একটি হাদীসই তাঁরা শত শত সনদে সংগ্রহ করে তুলনার মাধ্যমে নির্ভুল ও ভুল বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন।
একটি নমুনা দেখুন। তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবরাহীম ইবনু সাঈদ আল জাওহারী আল বাগদাদী(২৪৭ হি)। তার সমসাময়িক মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনু জাফার ইবনু খাকান বলেনঃ আমি ইবরাহীম ইবনু সাঈদকে আবু বাকর সিদ্দীক(রা) হতে বর্ণিত একটি হাদীসের বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি তার খাদেমকে বললেনঃ গ্রন্থাগারে ঢুকে আবু বাকর সিদ্দীক(রা) এর হাদীস সংকলনের ২৩ তম খন্ডটি নিয়ে এস। আমি বললামঃ আবু বাকর(রা) থেকে ২০ টি হাদীসও সহীহ সনদে পাওয়া যায়না, আপনি কিভাবে তাঁর হাদীস ২৩ টি খন্ডে সংকলন করলেন? তিনি উত্তরে বললেনঃ কোনো একটি হাদীস যদি আমি কমপক্ষে ১০০ টি সনদে সংগ্রহ করতে না পারি তাহলে আমি সেই হাদীসের ক্ষেত্রে নিজেকে এতিম বলে মনে করি। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/১৫৪-১৫৫)।
হাদীস গ্রহণের সময় তাঁরা সংশ্লিষ্ট ‘রাবী’ কে বিভিন্ন প্রশ্ন করে তার বর্ণনার যথার্থতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেছেন। সাথে সাথে তার ব্যক্তিগত সততা, তার শিক্ষকগণ ও এলাকার অন্যান্য রাবীগণের বিষয়ে সেই এলাকার প্রসিদ্ধ আলেম, মুহাদ্দিস ও শিক্ষার্থীগণকে প্রশ্ন করেছেন। এভাবে সংগৃহীত সকল তথ্য তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা সকল রাবী ও তাদের বর্ণিত সকল হাদীসের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছেন। এ সকল নিরীক্ষক ও সমালোচক হাদীস বিশেষজ্ঞগণ একদিকে রাবী বা হাদীস বর্ণনাকারী এবং সাথে সাথে ‘নাকিদ’ বা হাদীস সমালোচক ও হাদীসের ইমাম বলে পরিচিত। ইসলামের প্রথম চার শতাব্দীতে এই ধরনের শতাধিক ইমাম ও নাকিদ আমরা দেখতে পাই। হাদীসে রাসূলের খেদমতে এদের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। জ্ঞান ও সভ্যতার ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। অন্য কোনো জাতির ইতিহাসে এর সামান্যতম নজির নেই। এদের কর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণের জন্যও শত শত পৃষ্ঠার গ্রণ্থ প্রণয়ণের প্রয়োজন।
এ সকল নাকিদ মুহাদ্দিস বা ইমাম এভাবে সকল হাদীস ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা চিহ্নিত করেছেন, মিথ্যাবাদীকে চিহ্নিত করেছেন, বিশুদ্ধ হাদীসকে মিথ্যা ও সন্দেহজনক বর্ণনা থেকে পৃথক করেছেন। তাঁরা নিম্নের পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছেন।
১. সকল হাদীসের সনদ, সূত্র বা Reference সংরক্ষণ।
২. সনদের সকল রাবীর ব্যক্তিগত পরিচয়, জন্ম, মৃত্যু, শিক্ষা, উস্তাদ, ছাত্র, কর্ম, সফর ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ।
৩. রাবীগণের ব্যক্তিগত সততা, বিশ্বস্ততা ও সত্যপরায়ণতা যাচাই করা।
৪. বর্ণিত হাদীসের অর্থগত নিরীক্ষা ও যাচাই করা।
৫. সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবী তার উর্ধ্বতন রাবীর নিকট হতে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন কিনা তা যাচাই করা।
৬. সংগৃহীত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা থেকে নির্ভুল বর্ণনাগুলি পৃথক করা।
৭. সংগৃহীত তথ্যাদি ও তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে যে সকল রাবীর মিথ্যাচার ধরা পড়েছে তাদের মিথ্যাচার উম্মাহর সামনে তুলে ধরা।
৮. সংগৃহীত সকল হাদীস সনদসহ গ্রন্থায়িত করা।
৯. রাবীদের নির্ভুলতা বা মিথ্যাচার বিষয়ক তথ্যাদি গ্রন্থায়িত করা।
১০. পৃথক গ্রন্থে বিশুদ্ধ হাদীস সংকলিত করা।
১১. পৃথক গ্রন্থে মিথ্যা ও জাল হাদীসগুলি সংকলিত করা।
১২. জাল বা মিথ্যা হাদীস সহজে চেনার নিয়মাবলি বের করা।
নিম্নে আমরা এ সকল বিষয়ে আলোচনা করব।
১.৪.২. সনদ সংরক্ষণ
আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সনদ বা তথ্য সূত্র বলার রীতি চালু করেন। যেন সূত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য যাচাই করা যায়। পরবর্তী যুগগুলোতে সনদ সংরক্ষণের বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়। হাদীস বর্ণনাকারী ব্যক্তির প্রসিদ্ধি, সততা, মহত্ব, পান্ডিত্য ইত্যাদি যত বেশিই হোকনা কেন, তিনি কার নিকট হতে হাদীসটি শুনেছেন এবং তিনি কোন সূত্রে হাদীসটি বলেছেন তা উল্লেখ না করলে মুহাদ্দিসগণ কখনোই তার বর্ণিত হাদীসকে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেননি। উপরন্তু তিনি এবং তার সনদে বর্ণিত প্রত্যেক রাবী পরবর্তী রাবী থেকে হাদীসটি নিজে শুনেছেন কিনা তা যাচাই করেছেন। সনদের গুরুত্ব বুঝাতে অনেক কথা তাঁরা বলেছেন।
প্রথম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেনঃ “এই জ্ঞান হলো দ্বীন(ধর্ম)। কাজেই কার নিকট হতে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছ তা দেখে নেবে।” (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৪)।
সুফিয়ান ইবনু উ‘আইনাহ(১৯৮ হি) বলেনঃ “একদিন ইবনু শিহাব যুহরী (১২৫ হি) হাদীস বলছিলেন। আমি বললামঃ আপনি সনদ ছাড়াই হাদীসটি বলুন। তিনি বলেনঃ তুমি কি সিঁড়ি ছাড়াই ছাদে আরোহন করতে চাও?” (সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ২/১৬০)।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস সুফিয়ান ইবনু সাঈদ আস সাউরী(১৬১ হি) বলেনঃ “সনদ মুমিনের অস্ত্র স্বরূপ।” (সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ২/১৬০)।
উতবাহ ইবনু আবু হাকীম (১৪০ হি) বলেন, একদিন আমি ইসহাক ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু আবী ফারওয়া(১৪৪ হি) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। সেখানে ইবনু শিহাব যুহুরী(১২৫ হি)উপস্থিত ছিলেন। ইবনু আবী ফারওয়া হাদীস বর্ণনা করে বলতে থাকেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, …..। তখন ইবনু শিহাব যুহুরী তাকে বলেন, হে ইবনু আবী ফারওয়া, আল্লাহ আপনাকে ধ্বংস করুন! আল্লাহর নামে কথা বলতে আপনার কত্ত বড় দুঃসাহস! আপনি হাদীস বলছেন অথচ হাদীসের সনদ বলছেননা। আপনি আমাদেরকে লাগামহীন হাদীস বলছেন।(যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/৩৪৪)।
প্রসিদ্ধ তাবি তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক(১৮১ হি) বলেনঃ “সনদ বর্ণনা ও সংরক্ষণ দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা না থাকলে যে যা চাইত তাই বলত।”(মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫)।
তৃতীয় হিজরী শতকের মুহাদ্দিস আবু ইসহাক ইবরাহীম ইবনু ইসহাক ইবনু ঈসা(২১৫ হি) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক(১৮১ হি) কে বললাম, একটি হাদীসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সালাতের সাথে পিতামাতার জন্য সালাত আদায় করা এবং তোমার সিয়ামের সাথে পিতামাতার জন্য সিয়াম পালন করা নেককর্মের অন্তর্ভুক্ত।’ তিনি বলেনঃ হাদীসটি আপনি কার নিকট হতে শুনেছেন? আমি বললামঃ শিহাব ইবনু খিরাশ থেকে। তিনি বলেনঃ শিহাব নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, তিনি কার নিকট হতে শুনেছেন? আমি বললামঃ তিনি হাজ্জাজ ইবনু দীনার থেকে। তিনি বলেনঃ হাজ্জাজ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, তিনি কার নিকট হতে শুনেছেন? আমি বললামঃ তিনি বলেছেন-রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন। ইবনুল মুবারক বললেনঃ হে আবু ইসহাক, হাজ্জাজ ইবনু দীনার ও রাসূলুল্লাহ(স) এর মাঝে বিশাল দূরত্ব রয়েছে, যে দূরত্ব অতিক্রম করতে অনেক বাহনের প্রয়োজন। অর্থাৎ হাজ্জাজ দ্বিতীয় হিজরীর শেষের দিকের একজন তাবে-তাবেয়ী। অন্তত ২/৩ জন ব্যক্তির মাধ্যম ছাড়া তিনি রাসূলুল্লাহ(স) এর নিকট পৌঁছাতে পারেননা। তিনি যেহেতু বাকী সনদ বলেননি, সেহেতু হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬)।
এভাবে প্রথম হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সনদ (uninterrupted chain of authorities) উল্লেখ অপরিহার্য্ বলে গণ্য করেছেন। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলতে দুইটি অংশের সমন্বিত রূপকে বুঝায়। প্রথম অংশঃ হাদীসের সূত্র বা সনদ ও দ্বিতীয় অংশঃ হাদীসের মূল বক্তব্য বা মতন।
একটি উদাহরণ দেখুন। ইমাম মালিক ইবনু আনাস(১৭৯ হি) ২য় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলক। তিনি তাঁর মুয়াত্তা গ্রন্থে বলেনঃ আরবী(*****)
-“মালিক, আবুয যিনাদ(১৩০ হি) থেকে, তিনি আ’রাজ(১১৭ হি) থেকে, তিনি আবু হুরাইরা(৫৯ হি) থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেনঃ এই দিনের মধ্যে একটি সময় আছে কোনো মুসলিম যদি সেই সময় দাঁড়িয়ে সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ তাকে তা প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ(স) হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন যে, এই সুযোগটি স্বল্প সময়ের জন্য।[মালিক ইবনু আনাস (১৭৮), আল মুআত্তা ১/১০৮]।
উপরের হাদীসের প্রথম অংশ “মালিক, আবযু যিনাদ থেকে…. আবু হুরাইরা থেকে” হাদীসের সনদ বা সূত্র। শেষে উল্লেখিত রাসূলুল্লাহ(স) এর বাণীটুকু হাদীসের ‘মতন’ বা বক্তব্য। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলতে শুধু শেষের বক্তব্যটুকুই নয়, বরং সনদ ও মতন এর সম্মিলিত রূপকেই হাদীস বলা হয়। একই বক্তব্য দুইটি পৃথক সনদে বর্ণিত হলে তাকে দুইটি হাদীস বলে গণ্য করা হয়। অনেক সময় শুধু সনদকেই হাদীস বলা হয়।(ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৩/২৫৩)।
১.৪.৩. সনদ বনাম লিখিত পান্ডুলিপি
উপরের হাদীস ও হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত অনুরূপ অগণিত হাদীস হতে কেউ ধারণা করতে পারেন যে, সাহাবী, তাবেয়ী বা তাবে-তাবেয়ীগণ সম্ভবত হাদীস লিপিবদ্ধ বা সংকলিত করে রাখতেননা, শুধুমাত্র মুখস্ত ও মৌখিক বর্ণনা করতেন। এজন্য বোধহয় মুহাদ্দিসগণ এভাবে সনদ উল্লেখ করে হাদীস সংকলিত করেছেন। অনেকেই ধারণা করেন যে, হাদীস তৃতীয় বা চতূর্থ হিজরী শতকেই লিপিবদ্ধ বা সংকলিত হয়েছে, এর পূর্বে তা মৌখিকভাবে প্রচলিত ছিল।
বিষয়টি কখনো তা নয়। হাদীস বর্ণনা বা সংকলনের পদ্ধতির সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অগভীর ভাসাভাসা জ্ঞানই এই কঠিন বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। বস্তুত হাদীস বর্ণনা বা সংকলনের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ সূক্ষ্মতম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তাঁরা মৌখিক বর্ণনা ও লিখিত পান্ডুলিপির সমন্বয়ের মাধ্যমে হাদীস বর্ণনায় ভুলভ্রান্তি অনুপ্রবেশের পথ রোধ করেছেন। হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও সনদ বর্ণনায় সর্বদা মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির পাশাপাশি লিখনি ও পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করা হতো। অনুরূপভাবে হাদীস নিরীক্ষা ও জালিয়াতি নির্ধারণেও পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করা হতো।
১.৪.৩.১. হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও সনদ বর্ণনায় পান্ডুলিপি
সাহাবীগণ সাধারণত হাদীস মুখস্ত করতেন এবং কখনো কখনো লিখেও রাখতেন। সাহাবীগণের হাদীস লিখে রাখার প্রয়োজনও তেমন ছিলনা। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, অধিকাংশ সাহাবীর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ২০/৩০ টির বেশি নয়। রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহচর্যে কাটানোর দিনগুলির স্মৃতি থেকে ২০/৩০ টি বা ১০০ টি, এমনকি হাজারটা ঘটনা বা কথা বলার জন্য লিখে রাখার প্রয়োজন হতোনা। তাছাড়া তাঁদের জীবনে আর কোনো বড় বিষয় ছিলনা। রাসূলুল্লাহ(স) এর স্মৃতি আলোচনা, তাঁর নির্দেশাবলী হুবহু পালন, তাঁর হুবহু অনুকরণ ও তাঁর কথা মানুষদের শোনানোই ছিল তাঁদের জীবনের অন্যতম কাজ। অন্য কোনো জাগতিক ব্যস্ততা তাঁদের মন মগজকে ব্যস্ত রাখতে পারতনা। আর যে স্মৃতি ও যে কথা সর্বদা মনে জাগরুক ও কর্মে বিদ্যমান তা তো আর পৃথক কাগজে লিখার দরকার হয়না। তা সত্ত্বেও অনেক সাহাবী তাঁদের মুখস্ত হাদীস লিখে রাখতেন এবং লিখিত পান্ডুলিপির সংরক্ষণ করতেন। (মুহাম্মাদ আজ্জাজ আল খাতীব, আস-সুন্নাত কাবলাত তাদবীন, পৃ. ৩০৩-৩২১)।
সাহাবীগণের ছাত্রগণ বা তাবেয়ীগণের যুগে থেকে হাদীস শিক্ষা প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল লিখিত পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করা। অধিকাংশ তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীস শুনতেন, লিখতেন ও মুখস্ত করতেন। পান্ডুলিপি সামনে রেখে বা পান্ডুলিপি থেকে মুখস্ত করে তা ছাত্রদের শোনাতেন। তাঁদের ছাত্ররা শোনার সাথে সাথে তা নিজেদের পান্ডুলিপিতে লিখে নিতেন এবং শিক্ষকের পান্ডুলিপির সাথে মিলাতেন। তাবেয়ীগণের যুগ, অর্থাৎ প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষাংশ থেকে এভাবে সকল পঠিত হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখা হাদীস শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এ বিষয়ক অগণিত বিবরণ হাদীস বিষয়ক গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। দু একটি উদাহরণ দেখুন।
তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আকীল(১৪০ হি) বলেনঃ “আমি এবং আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ আল বাকির(১১৪ হি) সাহাবী জাবির ইবনু আবদুল্লাহ(৭০ হি) এর নিকট গমন করতাম। আমরা সাথে ছোট ছোট বোর্ড বা স্লেট নিয়ে যেতাম যেগুলিতে আমরা হাদীস লিপিবদ্ধ করতাম।” [রামহুরমুযী, হাসান ইবনে আবদুর রহমান(৩৬০ হি)]
তাবিয়ী আমির ইবনু শারাহীল শা’বী (১০২ হি) বলেনঃ “তোমরা যা কিছু আমার নিকট হতে শুনবে সব লিপিবদ্ধ করবে। প্রয়োজনে দেয়ালের গায়ে লিখতে হলেও তা লিখে রাখবে।”(প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৬)।
তাবিয়ী আবু কিলাবাহ আবদুল্লাহ ইবনু যাইদ(১০৪ হি) বলেনঃ “ভুলে যাওয়ার চেয়ে লিখে রাখা আমার কাছে অনেক প্রিয়।” (ইবনু রাজার, শারহু ইলালিত তিরমিযী, পৃ. ৫৭)।
তাবিয়ী হাসান বসরী(১১০ হি) বলেনঃ“আমাদের নিকট পান্ডুলিপিসমূহ রয়েছে, যেগুলি আমরা নিয়মিত দেখি ও সংরক্ষণ করি।”(রামহুরমুযী, আল মুহাদ্দিস আল ফাসিল, ৩৭০-৩৭১)।
প্রসিদ্ধ তাবি তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক(১৮১ হি) বলেনঃ “হাদীস শিক্ষার সময় পান্ডুলিপি আকারে লিখে না রাখলে আমরা মুখস্তই করতে পারতামনা।”(ইবনু রাজার,শারহু ইলালিত তিরমিযী, পৃ. ৫৭)।
এ বিষয়ক অগণিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে পৃথক গ্রন্থের প্রয়োজন।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, তাবেয়ীগণের যুগ থেকে মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষার সাথে সাথে তা লিখে রাখতেন। হাদীস শিক্ষা দানের সময় তাবিয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণ সাধারণত পান্ডুলিপি দেখে হাদীস পড়ে শেখাতেন। কখনো বা মুখস্ত পড়ে হাদীস শেখাতেন তবে পান্ডুলিপি নিজের হেফাজতে রাখতেন যাতে প্রয়োজনের সময় তা দেখে নেয়া যায়।
তাবিয়ীগণের যুগে বা তৎপরবর্তীযুগে কতিপয় মুহাদ্দিস ছিলেন যারা পান্ডুলিপি ছাড়াই হাদীস মুখস্ত করতেন ও বর্ণনা করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা হাদীস বর্ণনায় দূর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, এরা পান্ডুলিপির উপর নির্ভর না করায় মাঝে মাঝে বর্ণনায় ভুল করতেন। বস্তুত মৌখিক শ্রবণ ও পান্ডুলিপির সংরক্ষণের মাধ্যমেই নির্ভরযোগ্য বর্ণনা করা সম্ভব। এজন্য যে সকল ‘রাবী’ শুধুমাত্র পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করে বা শুধুমাত্র মুখস্তশক্তির উপর নির্ভর করে হাদীস বর্ণনা করতেন তাঁদের হাদীস মুহাদ্দিসগণ দূর্বল বা অনির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। কারণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের বর্ণনায় ভুল ও বিক্ষিপ্ততা ধরা পড়ে। এই জাতীয় অগণিত বিবরণ আমরা রিজাল ও জারহু ওয়াত তা’দীল বিষয়ক গ্রন্থগুলিতে দেখতে পাই। দুই একটি উদাহরণ দেখুনঃ
আবু আম্মার ইকরিমাহ ইবনু আম্মার আল ইজলী(১৬০ হি) দ্বিতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি হাদীস মুখস্তকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর মুখস্ত হাদীসগুলিকে লিপিবদ্ধ করে পান্ডুলিপি আকারে সংরক্ষণ করতেননা, ফলে প্রয়োজনে তা দেখতে পারতেননা। এজন্য তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু ভুল পাওয়া যেত। ইমাম বুখারী(১৫৬ হি) বলেনঃ “তাঁর কোনো পান্ডুলিপি ছিলনা, এজন্য তাঁর হাদীসে বিক্ষিপ্ততা পাওয়া যায়।(যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/১১৪)।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিস জারীর ইবনু হাযিম ইবনু যাইদ(১৭০ হি)। তাঁর বিষয়ে ইবনু হাজার বলেনঃ “তিনি নির্ভরযোগ্য।….. তবে তিনি যখন পান্ডুলিপি না দেখে শুধুমাত্র মুখস্ত স্মৃতির উপর নির্ভর করে হাদীস বলতেন তখন তাঁর ভুল হতো।” (ইবনু হাজার, তারকীবুত তাহযীব, পৃ. ১৩৮)।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী আব্দুল আযীয় ইবনু ইমরান ইবনু আব্দুল আযীয(১৭০ হি)। তিনি মদীনার অধিবাসী ছিলেন এবং সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনু আউফের বংশধর ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁকে দূ্র্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। কারণ তাঁর বর্ণিত হাদীসের মাঝে ভুল ভ্রান্তি ব্যাপক। আর এই ভুলভ্রান্তির কারণ হলো পান্ডুলিপি ব্যতিরেকে মুখস্ত বর্ণনা করা। তৃতীয় হিজরী শতকের মদীনার মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক উমার ইবনু শাব্বাহ(২৬২ হি) তাঁর ‘মদীনার ইতিহাস’ গ্রন্থে এই ব্যক্তির সম্পর্কে বলেনঃ “তিনি হাদীস বর্ণনায় অনেক ভুল করতেন; কারণ তাঁর পান্ডুলিপিগুলো পুড়ে যাওয়ার ফলে তিনি স্মৃতির উপর নির্ভর করে মুখস্ত হাদীস বলতেন।”(ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৬/৩১২)।
ইবনু হাজার আসকালানীর ভাষায়ঃ “তিনি একজন পরিত্যক্ত রাবী। তাঁর পান্ডুলিপিগুলো পুড়ে যায়। এজন্য তিনি স্মৃতির উপর নির্ভর করে হাদীস বলতেন। এতে তাঁর ভুল হতো খুব বেশি।” (ইবনু হাজার, তাকরীবুত তাহযীব পৃ. ৩৫৮)।
তৃতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাজিব ইবনু সুলাইমান আল মানবিজী(২৬৫ হি)। তিনি ইমাম নাসাঈর উস্তাদ ছিলেন। তিনি হাদীস বর্ণনায় নির্ভরযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পান্ডুলিপি না থাকার কারণে ভুল হতো। ইমাম দারাকুতনী(৩৮৫ হি) বলেনঃ “তিনি হাদীস মুখস্ত বলতেন এবং স্মৃতির উপরেই নির্ভর করতেন। তাঁর কোনো পান্ডুলিপি ছিলনা। এজন্য তাঁর হাদীসে ভুল দেখা দেয়।” (যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৬৪)।
তৃতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম ইবনু মুসলিম, আবু উমাইয়া(২৭৩ হি)। তাঁর সম্পর্কে তাঁর ছাত্র মুহাম্মাদ ইবনু হিব্বান(৩৫৪ হি) বলেনঃ “তিনি তুরতুসের অধিবাসী ছিলেন এবং নির্ভরযোগ্য ছিলেন। তিনি মিশরে আগমন করেন এবং কোনো পান্ডুলিপি ছাড়া মুখস্ত কিছু হাদীস বর্ণনা করেন; যে সকল হাদীস বর্ণনায় তিনি ভুল করেন। এজন্য তাঁর বর্ণিত কোনো হাদীস আমি দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নই। শুধুমাত্র যে হাদীসগুলি তিনি পান্ডুলিপি দেখে বর্ণনা করেছেন সেগুলিই গ্রহণ করা যায়। (ইবনু হিব্বান, মুহাম্মাদ(৩৫৪ হি), আস-সিকাত ৯/১৩৭)।
ইমাম শাফেয়ী(২০৪ হি) দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম আলিম। তিনি লিখেছেনঃ “যে মুহাদ্দিস এর ভুল বেশি হয় এবং তার কোনো বিশুদ্ধ লিখিত পান্ডুলিপি নেই তার হাদীস গ্রহণ করা যাবেনা।”
(শাফেয়ী, আল রিসালাহ, পৃ. ৩৮২)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক হতে হাদীস শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য শিক্ষকের নিকট হতে মৌখিক শ্রবণ ও লিখিত পান্ডুলিপি সংরক্ষণ উভয়ের সমন্বয়ের উপর নির্ভর করা হতো। সুপ্রসিদ্ধ ‘হাফিজ-হাদীসগণ’, যারা আজীবন হাদীস শিক্ষা করেছেন ও শিক্ষা দিয়েছেন এবং লক্ষ লক্ষ হাদীস মুখস্ত রেখেছেন, তাঁরাও পান্ডুলিপি না দেখে হাদীস শিক্ষা দিতেননা বা বর্ণনা করতেননা।
৩য় শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আলী ইবনুল মাদীনী(২৩৪ হি) বলেনঃ “হাদীস মুখস্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের সাথীদের মাঝে আহমাদ ইবনু হাম্বল(২৪১ হি) এর চেয়ে বড় বা বেশি যোগ্য আর কেউই ছিলেননা। তা সত্ত্বেও তিনি পান্ডুলিপি সামনে না রেখে হাদীস বর্ণনা করতেননা। আর তাঁর মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।” (যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১/২১৩)।
অপরদিকে ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি) বলেনঃ “অনেকে আমাদেরকে স্মৃতি থেকে হাদীস শুনিয়েছেন এবং অনেকে আমাদেরকে পান্ডুলিপি থেকে হাদীস শুনিয়েছেন। যারা পান্ডুলিপি দেখে হাদীস শুনিয়েছেন তাঁদের বর্ণনা ছিল বেশি নির্ভুল।”(ইবনু রাজাব, শারহু ইলালিত তিরমিযী, পৃ. ৫৭)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের সমন্বয়কে অত্যন্ত জরুরী মনে করতেন: প্রথমত হাদীসটি উস্তাদের মুখ থেকে শাব্দিকভাবে শোনা বা তাকে মুখে পড়ে শোনানো ও দ্বিতীয়ত পঠিত হাদীসটি নিজে হাতে লিখে নেওয়া ও তৃতীয়ত উস্তাদের পান্ডুলিপির সাথে নিজের লেখা পান্ডুলিপি মিলিয়ে সংশোধন করে নেওয়া। কোনো মুহাদ্দিস স্বকর্ণে শ্রবণ ব্যতীত শুধু পান্ডুলিপি দেখে হাদীস শেখালে বা পান্ডুলিপি ছাড়া শুধু মুখস্ত হাদীস শেখালে তা গ্রহণ করতে তাঁরা আপত্তি করতেন। ইমাম আহমদ হাম্বলের পুত্র আবদুল্লাহ (২৯০ হি) বলেনঃ
“ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন(২৩৩ হি) বলেনঃ ইমাম আব্দুল রাজ্জাক সান‘আনী (২১১ হি) আমাকে বলেন: তুমি আমার নিকট হতে অন্তত একটি একটি হাদীস লিখিত পান্ডুলিপি ছাড়া গ্রহণ কর। আমি বললাম: কখনোইনা, আমি লিখিত পান্ডুলিপির প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র মৌখিক বর্ণনার উপর নির্ভর করে একটি অক্ষরও গ্রহণ করতে রাজী নই।”(আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/২৯৭)।
আব্দুর রাযযাক সান’আনীর মত সুপ্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসের নিকট থেকেও লিখিত ও সংরক্ষিত পান্ডুলিপির সমন্বয় ব্যতিরেকে একটি হাদীস গ্রহণ করতেও রাজী হননি ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন!
এ বিষয়ে তাঁদের মূলনীতি দেখুন। তৃতীয় শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও হাদীস বিচারক ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বলেনঃ “যদি কোনো ‘রাবী’র হাদীস তিনি সঠিকভাবে মুখস্ত ও বর্ণনা করতে পেরেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হয় তাহলে তার কাছে তার পুরাতন পান্ডুলিপি চাইতে হবে। তিনি যদি পুরাতন পান্ডুলিপি দেখাতে পারেন তবে তাকে ইচ্ছাকৃত ভুলকারী বলে গণ্য করা যাবেনা। আর যদি তিনি বলেন যে, আমার মূল প্রাচীন পান্ডুলিপি নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আমার কাছে তার একটি অনুলিপি আছে তাহলে তার কথা গ্রহণ করা যাবেনা। অথবা যদি বলেন যে, আমার পান্ডুলিপিটি আমি পাচ্ছিনা তাহলেও তাঁর কথা গ্রহণ করা যাবেনা। বরং তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে বুঝতে হবে। (খতীব বাগদাদী, আল-কিফাইয়াতু ফী ইলমির রিওয়াইয়া পৃ. ১১৭)।
১.৪.৩.২. সনদে শ্রুতি বর্ণনার অর্থ ও প্রেক্ষাপট
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই হাদীস লিখে মুখস্ত রাখা হতো। মুহাদ্দিসগণ লিখিত পান্ডুলিপি দেখে হাদীস বর্ণনা করতেন, নিরীক্ষা করতেন, বিশুদ্ধতা যাচাই করতেন এবং প্রত্যেকেই তাঁর শ্রুত হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এখন প্রশ্ন হলো, তাঁরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে লিখিত পুস্তকের রেফারেন্স প্রদান না করে শুধুমাত্র মৌখিক বর্ণনার উপর কেন নির্ভর করতেন? তাঁরা কেন ‘আমাকে বলেছেন’, ‘আমাকে সংবাদ দিয়েছেন’ ইত্যাদি বলতেন? তাঁরা কেন বললেননা, অমুক পুস্তকে এই কথাটি লিখিত আছে…… ইত্যাদি?
প্রকৃত বিষয় হলো সাহাবীগণের যুগ হতেই ‘পুস্তক’ এর চেয়ে ‘ব্যক্তির’ গুরুত্ব বেশি দেয়া হয়েছে। পান্ডুলিপির নির্ভরতা ও এতদসংক্রান্ত ভুল ভ্রান্তির সম্ভাবনা দূর করার জন্য মুহাদ্দিসগণ পান্ডুলিপির পাশাপাশি বর্ণিত হাদীসটি বর্ণনাকারী উস্তাদ থেকে স্বকর্ণে শ্রবণের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। এজন্য হাদীস শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে গ্রন্থ বা পান্ডুলিপির রেফারেন্স প্রদানের নিয়ম ছিলনা। বরং বর্ণনাকারী শিক্ষকের নাম উল্লেখ করার নিয়ম ছিল। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘হাদ্দাসানা আখবারানা’ অর্থাৎ ‘আমাকে বলেছেন’ কথাটির অর্থ হলো আমি তাঁর পুস্তক তাঁর নিজের কাছে বা তাঁর অমুক ছাত্রের কাছে পড়ে স্বকর্ণে শুনে তা থেকে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছি। কেউ কেউ ‘আমি তাঁকে পড়তে শুনেছি’, বা ‘আমি পড়েছি’ এরূপ বললেও , সাধারণত ‘হাদ্দাসানা’ বা ‘আখবারানা’ বা ‘আমাদেরকে বলেছেন’ বলেই তাঁরা এক বাক্যে বিষয়টি উপস্থাপন করতেন।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, উপরে উল্লেখিত মুয়াত্ত গ্রন্থের সনদটির অর্থ এই নয় যে, মালিক আবুয যিনাদ থেকে শুধুমাত্র মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন এবং তিনি আ’রাজ থেকে মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন এবং তিনি আবু হুরাইরা থেকে মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন। বরং এখানে সনদ বলার উদ্দেশ্য হলো এই সনদের রাবীগণ প্রত্যেকে তাঁর ওস্তাদের কাছ হতে হাদীসটি শুনেছেন, লিখেছেন এবং লিখিত পান্ডুলিপি মৌখিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন।
তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল বুখারী (২৫৬ হি) এই হাদীসটি মুয়াত্তা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
তিনি বলেনঃ আমাদেরকে আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা বলেছেন, মালিক থেকে আবু যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) শুক্রবারের কথা বলেনঃ এই দিনের মধ্যে একটি সময় আছে কোনো মুসলিম যদি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ তাকে তা প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ(স) হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন যে, এই সুযোগটি স্বল্প সময়ের জন্য। (বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস-সহীহ ১/৩১৬)।
এখানে ইমাম বুখারী মুয়াত্তা গ্রন্থের হাদীসটি হুবহু উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তিনি এখানে মুয়াত্তা গ্রন্থের উদ্ধৃত দেননি। বরং তিনি ইমাম মালিকের একজন ছাত্র থেকে হাদীসটি শুনেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। বাহ্যত পাঠকের কাছে মনে হতে পারে যে, ইমাম বুখারী মূলত শ্রুতির উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু প্রকৃত বিষয় কখনোই তা নয়। ইমাম মালিকের নিকট হতে শতাধিক ছাত্র মুয়াত্তা গ্রন্থটি পূর্ণরূপে শুনে ও লিখে নেন। তাঁদের বর্ণিত লিখিত মুয়াত্তা গ্রন্থ তৎকালীন বাজারে ‘ওয়াররাক’ বা ‘হস্তলিখিত পুস্তক’ ব্যবসায়ীদের দোকানে পাওয়া যেত। ইমাম বুখারী যদি এইরূপ কোনো পান্ডুলিপি কিনে তার বরাত দিয়ে হাদীসটি উল্লেখ করতেন তবে মুহাদ্দিসগণের বিচারে বুখারীর উদ্ধৃতিটি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হতো। কারণ পান্ডুলিপি নির্ভরতার মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ভুলের সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থটি তাঁর মুখ থেকে আগাগোড়া শুনে ও পান্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে বিশুদ্ধ পান্ডুলিপি বর্ণনা করতেন যে সকল মুহাদ্দিস ইমাম বুখারী সে সকল মুহাদ্দিসের নিকট যেয়ে মুয়াত্তা গ্রন্থটি প্রথম থেকে শেষ পর্য্ন্ত স্বকর্ণে শুনেছেন। ইমাম বুখারী তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে মুয়াত্তা গ্রন্থের হাদীসগুলি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু কখনোই গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদান করেননি। বরং যাদের কাছে তিনি গ্রন্থটি পড়েছেন তাদের সূত্র প্রদান করেছেন। যেমন এখানে তিনি আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামার সূত্র উল্লেখ করেছেন। এখানে তাঁর কথার অর্থ হলো ‘আমি আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামার’ নিকট ইমাম মালিকের গ্রন্থটির মধ্যে এই হাদীসটি আমি স্বকর্ণে পঠিত শুনেছি।
৩য় শতাব্দীর অন্যতম মুহাদ্দিস ইমাম মুসলিমও (২৬২ হি) এই হাদীসটি মুয়াত্তা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
তিনি বলেনঃ “আমাদেরকে কুতাইবা ইবনু সাঈদ বলেন, মালিক থেকে, আবযু যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবু হুরাইরা থেকে , রাসূলুল্লাহ(স) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেন……………..।”(মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ ২/৫৮৩)।
এখানে ইমাম মুসলিমও একইভাবে পুস্তকের উদ্ধৃতি না দিয়ে পুস্তকটির বর্ণনাকারীর উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। ৫ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম বাইহাকী আহমদ ইবনুল হুসাইন(৪৫৮ হি) তাঁর ‘আস-সুনানুল কুবরা’ নামক হাদীস গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।
তিনি বলেনঃ “আমাদেরকে আলী ইবনু আহমদ ইবনু আবদান বলেন, আমাদেরকে আহমদ ইবনু উবাইদ সাফফার বলেন, আমাদেরকে ইসমাঈল কাযী বলেন, আমাদেরকে আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা কা’নাবী বলেন, তিনি মালিক থেকে, তিনি আবুয যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেন……..।”(বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৯)।
সনদটি দেখে কেউ ভাবতে পারেন যে, ৫ম শতাব্দী পর্য্ন্ত মুহাদ্দিসগণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে শুধু মৌখিক বর্ণনার উপর নির্ভর করতেন। রাসূলুল্লাহ(স) হতে গ্রন্থাগার পর্য্ন্ত মাঝে ৮ জন বর্ণনাকারী। সকলেই শুধু মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির উপর নির্ভর করেছেন! কাজেই ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা খুবই বেশি!!
কিন্তু প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইমাম বাইহাকীর এই সনদের অর্থ হলোঃ ইমাম মালিকের লেখা মুয়াত্তা গ্রন্থটি আমি আলি ইবনু আহমদ ইবনু আবদান এর নিকট পঠিত শুনেছি। তিনি তা আহমদ ইবনু উবাইদ সাফফার নিকট পড়েছেন। তিনি পুস্তকটি ইসমাঈল কাযীর নিকট পাঠ করেছেন। তিনি পুস্তকটি আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা কা’নবীর নিকট পাঠ করেছেন। তিনি মালিক থেকে….। এর দ্বারা তিনি প্রমাণ করলেন যে, তিনি মুয়াত্তা গ্রন্থটি বাজার থেকে ক্রয় করে নিজে পাঠ করে তার থেকে হাদীস সংগ্রহ করেননি। বরং তিনি মুয়াত্তার পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে এমন এক ব্যক্তির নিকট তা পাঠ করে শুনেছেন যিনি নিজে গ্রন্থটি বিশুদ্ধ পাঠের মাধ্যমে আয়ত্ত করেছেন…..এভাবে শেষ পর্য্ন্ত। বাইহাকী এই সনদটি আরো অনেকগুলি সনদে উল্লেখ করেছেন। সকল সনদেই তিনি মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মূলত বলেছেন যে, ইমাম মালিকের মুয়াত্তা গ্রন্থটি বিভিন্ন উস্তাদের নিকট বিভিন্ন সনদে বিশুদ্ধরূপে পড়ে শ্রবণ করেছেন।(বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৯)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, লিখিত পান্ডুলিপির সাথে মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির সমন্বয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ পান্ডুলিপি বা পুস্তকের বরাত প্রদানের পরিবর্তে শ্রবণের বরাত প্রদানের নিয়ম প্রচলন করেন। তাঁদের এই পদ্ধতিটি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক। বর্তমান যুগে প্রচলিত গ্রন্থের নাম, পৃষ্ঠা সংখ্যা ইত্যাদি উল্লেখ করে ‘Reference’ বা তথ্যসূত্র দেওয়ার চেয়ে এভাবে শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে ‘Reference’ দেওয়া অনেক নিরাপদ ও যৌক্তিক। তৎকালীন হস্তলিখিত গ্রন্থের যুগে শুধুমাত্র গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রন্থ পাঠে ভুলের সম্ভাবনা, গ্রন্থের মধ্যে অন্যের সংযোজনের সম্ভাবনা ও অনুলিপিকারের ভুলের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু গ্রন্থাকারে মুখ থেকে গ্রন্থটি পঠিতরূপে গ্রহণ করলে এ সকল ভুল বা বিকৃতির সম্ভাবনা থাকেনা।
ইহুদী খৃস্টানগণ তাঁদের ধর্মগ্রন্থ লিখতেন পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করে। এতে বাইবেলের বিকৃতি সহজ হয়েছিল। ইহুদী খৃস্টান পন্ডিতগণ একযোগে স্বীকার করেন যে, প্রচলিত বাইবেলের মধ্যে লক্ষ্য লক্ষ্য বিকৃতি বিদ্যমান। যেগুলিকে তাঁরা ভুল(erratum) বা পাঠের বিভিন্নতা(various readings)বলে উল্লেখ করেন।(T.H. Horne, An Introduction to the Critical Study and Knowledge of the Holy Scriptures 2/325.; রাহমাতুল্লাহ কিরানবী, ইযহারুল হক ২/৫৪২)।
এই বিকৃতি ও ভুলের প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে পেরেছিলেন মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির বিষয়ে গুরুত্বারোপের মাধ্যমে।
আমরা আরো বুঝতে পারছি যে, হাদীস তৃতীয় শতাব্দীতে বা পরবর্তীকালে সংকলিত হয়েছে মনে করাও ভুল। মূলত প্রথম শতাব্দী থেকেই হাদীস সংকলন করা হয়েছে।পরবর্তী সংকলকগণ তাঁদের গ্রন্থ পূর্ববর্তী সংকলকদের সংকলিত পুস্তকগুলি সংকলিত করেছেন। তবে মুহাদ্দিসগণ কখনোই হাদীস বর্ণনার তথ্য সূত্র হিসেবে পান্ডুলিপির উল্লেখ করেননি। বরং পান্ডুলিপির পাশাপাশি মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির উপর তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
১.৪.৪. ব্যক্তিগত সততা যাচাই
বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীসকে হাদীসের নামে কথিত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল বা মিথ্যা থেকে পৃথক করার জন্য মুহাদ্দিসগণের দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল সনদে উল্লেখিত সকল ‘রাবী’র ব্যক্তিগত তথ্যাদি সংগ্রহ করা এবং ব্যক্তিগত সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও ধার্মিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এ বিষয়ে তাঁরা নিজেরা ‘রাবী’র কর্ম পর্যবেক্ষণ করতেন এবং প্রয়োজনে সমকালীন আলিম, মুহাদ্দিস ও শিক্ষার্থীগণকে প্রশ্ন করতেন।
সাহাবীগণের সমকালীন ১ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী আবুল আলিফী রুফাই ইবনু মিহরান(৯০ হি) বলেনঃ কোনো স্থানে কোনো ব্যক্তি হাদীস বলেন বা শিক্ষাদান করেন জানলে আমি হাদীস সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার নিকট গমন করতাম। সেখানে যেয়ে আমি তার সালাত পর্যবেক্ষণ করতাম। যদি দেখতাম, তিনি সুন্দর ও পূর্ণরূপে সালাত প্রতিষ্ঠা করছেন তবে আমি তার নিকট অবস্থান করতাম এবং তার নিকট হতে হাদীস লিখতাম। আর যদি তার সালাতের বিষয়ে অবহেলা দেখতাম তবে আমি তার নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা না করেই ফিরে আসতাম। আমি বলতামঃ যে সালাতে অবহেলা করতে পারে সে অন্য বিষয়ে বেশি অবহেলা করবে।(ইবনু হাদী, আল-কামিল ১/১৩২)।
তাঁরা শুধু হাদীস বর্ণনাকারীর বাহ্যিক কর্মই দেখতেননা, তার আচরণ, আখলাক, সততা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদিও জানার চেষ্টা করতেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ তাবিয়ী আসিম ইবনু সুলাইমান আল আহওয়াল(১৪০ হি) বলেন, আমি আবুল আলিয়া(৯০ হি) কে বলতে শুনেছি, তোমরা (দ্বিতীয় শতকের তাবিয়ীগণ) তোমাদের পূর্ববর্তীদের চেয়ে সালাম সিয়াম বেশি পালন কর বটে, কিন্তু মিথ্যা তোমাদের জিহবায় প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে। (ইবনু আদী, আল কামিল ১/১৩৩)।
এছাড়া উক্ত রাবীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং তার পান্ডুলিপির সাথে মুখের বর্ণনা মিলিয়ে তাঁর সততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। নিজেদেরকে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি মূলত সমকালীন আলিমদের মতামতের মাধ্যমে তারা রাবীর সত্যতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন। ইয়াহইয়া ইবনু মুগীরাহ(২৫৩ হি) বলেনঃ আমি প্রখ্যাত তাবি তাবিয়ী জারীর ইবনুল আবদুল হামিদ(১৮৮ হি)কে তার ভাই আনাস ইবনুল আবদুল হামিদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেনঃ তার হাদীস লিখবেনা; কারণ সে মানুষের সাথে কথাবার্তায় মিথ্যা কথা বলে। সে হিশাম ইবনু উরওয়াহ, উবাইদুল্লাহ ইবনু উমার প্রমুখ মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শিখেছে। কিন্তু যেহেতু মানুষের সাথে কথাবার্তায় তার মিথ্যা বলার অভ্যাস আছে সেহেতু তার হাদীস গ্রহণ করবেনা।(ইবনু আবু হাতিম, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ২/২৮৯)।
তবে সর্বাবস্থায় তাঁদের মূল সিদ্ধান্তের ভিত্তি হতো ব্যক্তির প্রদত্ত তথ্যের তুলনামূলক নিরীক্ষা। এজন্য অগণিত ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, একজন মুহাদ্দিস কোনো একজন রাবী সম্পর্কে অনেক প্রশংসা শুনে কেবল ভক্তি ও আগ্রহ সহকারে তার নিকট হাদীস শিখতে গিয়েছেন। কিন্তু যখনই তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা ও ভুল দেখতে পেয়েছেন তখনই সে ব্যক্তির বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত পাল্টে গিয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনুল মুহাররির আল জাযারী ২য় শতকের একজন আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন। খলীফা মানসূরের শাসনামলে(১৩৬-১৫৮ হি) তিনি বিচারকের দায়িত্বও পালন করেন। তবে তিনি হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত দূর্বল ছিলেন। তিনি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলতেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনু মুবারক(১৮১ হি)বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবনু মুহাররিকের নেক আমল, বুজুর্গী ও প্রসিদ্ধির কথা শুনে আমার মনে তার প্রতি এত ভক্তি জন্মেছিল যে, আমাকে যদি এখতিয়ার দেয়া হতো যে, তুমি জান্নাতে যাবে অথবা আবদুল্লাহ ইবনুল মুহাররিকের সাথে সাক্ষাত করবে, তাহলে আমি তার সাথে সাক্ষাতের পর জান্নাতে যেতে চেতাম। কিন্তু যখন আমি তার সাথে সাক্ষাত করলাম তখন তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে মিথ্যার ছড়াছড়ি দেখে আমার মনের সব ভক্তি উবে গেল। ছাগলের শুকনা লাদিও আমার কাছে তার চেয়ে বেশি প্রিয়।(ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/১৩২)।
১.৪.৫. সাহাবীগণের সততা
এভাবে প্রতিটি হাদীস বর্ণনাকারীর ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ ব্যক্তিগত সততা ও বর্ণনার যথার্থতা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে নিরীক্ষা ও যাচাই করেছেন। ‘রাবী’র ব্যক্তিগত প্রসিদ্ধি, যশ, খ্যাতি ইত্যাদি কোনো কিছুই তাঁদেরকে এই যাচাই ও নিরীক্ষা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখতে পাব যে, যাচাই ও নিরীক্ষার ভিত্তিতে অনেক দেশবরেণ্য সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিকেও তাঁরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন সাহাবীগণ। একমাত্র সাহাবীগণের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ ব্যক্তিগত সততা ও বিশ্বস্ততা নিরীক্ষা করেননি। তাঁরা সকল সাহাবীকে ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও সত্যপরায়ণ বলে মেনে নিয়েছেন।
ইহুদী খৃস্টান পন্ডিতগণ ও শিয়াগণ মুহাদ্দিসগণের এ মূলনীতির সমালোচনা করেন। তাঁরা সাহাবীগণের সততায় বিশ্বাস করতেননা। বরং তারা সাহাবীগণকেই জালিয়াত বলে অভিযুক্ত করেন।
সাহাবীগণের সততা ও বিশ্বস্ততা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। তাঁদের সততার বিষয়ে হাদীসের নির্দেশনাও আমি এখানে আলোচনা করব না। আমি এখানে যুক্তি, বিবেক ও কুরআনের আলোকে সাহাবীগণের সততার বিষয়টি আলোচনা করব।
(১) মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ সাহাবীগণের বিষয়ে মূলত ‘বিশ্বজনীন’ মানবীয় মূলনীতির ভিত্তিতে কাজ করেছেন। বিশ্বের সর্বত্র স্বীকৃত মূলনীতি হলো, যতক্ষণ না কোনো মানুষের বিষয়ে মিথ্যাচার প্রমাণিত হবে, ততক্ষণ তাকে ‘সত্যবাদী’ বলে গণ্য করতে হবে এবং তার সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। ‘তার সাথে তার ভাইয়ের মামলা বা শত্রুতা আছে’ এই অভিযোগে অন্যান্য ক্ষেত্রে তার বর্ণিত সংবাদ বা তথ্য বাতিল করা যায়না। মুসলিম উম্মাহ এই নীতির ভিত্তিতেই সাহাবীগণের বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। সাহাবীগণ পরস্পরে যুদ্ধ করেছেন, বিভিন্ন বিরোধিতা ও জাগতিক সমস্যায় পড়েছেন, কিন্তু কখনো কোনোভাবে প্রমাণিত হয়নি যে, তাঁদের মধ্য থেকে কেউ কোনো অবস্থাতে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলেছেন। সাহাবীদের বিরুদ্ধে যারা বিষোদগার করেন, তাঁরা একটিও প্রমাণ পেশ করতে পারেননি যে, অমুক ঘটনায় অমুক সাহাবী হাদীসের নামে মিথ্যা বলেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ইতিহাসে সাহাবীদের বিরুদ্ধে অনেক কথা লিখিত রয়েছে। কিন্তু তাঁরা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলেছেন বলে কোনো তথ্য প্রমাণিত হয়নি। কাজেই তাঁদের দেওয়া তথ্য গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কোনো সাধারণ সন্দেহের ভিত্তিতে, হয়ত তিনি মিথ্যা বলেছেন এই ধারণার উপরে কারো সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করা যায়না।
(২) আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ হাদীস গ্রহণ ও বিচারের সময় তা নিরীক্ষা করতেন। অন্যান্য সাহাবীর বর্ণনা তাঁরা অনেক সময় যাচাই করেছেন। একটি ঘটনাতেও কারো ক্ষেত্রে কোনো মিথ্যা বা জালিয়াতি ধরা পড়েনি। বরং সাহাবীগণের সত্যবাদিতা, সততা ও এক্ষেত্রে তাঁদের আপোসহীনতা ইতিহাসখ্যাত। হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের সতর্কতা ছিল অতুলনীয়।
(৩) যে কোনো ধর্ম প্রচারক বা মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতার মত ও পরিচয় তাঁর সহচরদের মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব। এজন্য সকল ধর্মেই নবী, রাসূল বা ধর্ম প্রবর্তকদের সহচরদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। এদের উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনোভাবেই নবী বা রাসূলের বাণী, বাক্য ও আদর্শ জানা সম্ভব নয়। সাহাবীগণের প্রতি সন্দেহ ও অনাস্থার অর্থই হলো রাসূলুল্লাহ(স)কে অস্বীকার করা এবং ইসলামকে ব্যবহারিক জীবন থেকে মুছে দেয়া। কারণ কুরআন, হাদীস বা ইসলাম সবই আমরা এ সকল সাহাবীর মাধ্যমে লাভ করেছি।
(৪) সাহাবীগণের সততায় অবিশ্বাস করার অর্থ রাসূলুল্লাহ(স) এর নব্যুয়ত অস্বীকার করা। যারা মনে করেন যে, অধিকাংশ সাহাবীই স্বার্থপর, অবিশ্বাসী বা ধর্মত্যাগী ছিলেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে মনে করেন যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(স) একজন ব্যর্থ নবী ছিলেন(নাউজুবিল্লাহ)। লক্ষ মানুষের সমাজে অজ্ঞাত অখ্যাত দুই চারজন মুনাফিক থাকা কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহচর্যে থেকেছেন এবং সাহাবী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন, তাঁদেরকেও যদি কেউ প্রবঞ্চক বলে দাবি করেন, তবে তিনি মূলত রাসূলুল্লাহ(স)এর ব্যর্থতার দাবি করেছেন।
একজন ধর্মপ্রচারক যদি নিজের সহচরদের হৃদয়গুলিকে ধার্মিক বানাতে না পারেন, তবে তিনি কিভাবে অন্যদেরকে ধার্মিক বানাবেন! তাঁর আদর্শ শুনে, ব্যবহারিকভাবে বাস্তবায়িত দেখে ও তাঁর সাহচর্য্ থেকেও যদি মানুষ ‘সততা’ অর্জন করতে না পারে, তবে শুধু সেই আদর্শ শুনে পরবর্তী মানুষদের সততা অর্জনের কল্পনা বাতুলতা মাত্র।
আজ যিনি মনে করেন যে, কুরআন পড়ে তিনি সততা শিখেছেন, অথচ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) এর কাছে কুরআন পড়ে, জীবন্ত কুরআনের সাহচর্যে থেকেও আবু হুরাইরা সততা শিখতে পারেননি, তিনি মূলত নবী মুহাম্মাদ(স)এর নব্যুয়তকেই অস্বীকার করেন। মানবীয় দুর্বলতা, ক্রোধ, দলাদলি ইত্যাদি এক বিষয় আর প্রবঞ্চনা বা জালিয়াতি অন্য বিষয়। ধর্মের নামে জালিয়াতি আরো অনেক কঠিন বিষয়। কোনো ধর্ম প্রবর্তক যদি তাঁর অনুসারীদের এই কঠিনতম পাপের পঙ্কিলতা থেকে বের করতে না পারেন, তবে তাকে কোনোভাবেই সফল বলা যায়না। কোনো স্কুলের সফলতা যেমন স্কুলের ছাত্রদের পাশের হারের উপর নির্ভর করে, তেমনি ধর্মপ্রচারকের সফলতা নির্ভর করে তার সাহচর্য্ প্রাপ্তদের ধার্মিকতার উপর।
(৫) সর্বোপরি কুরআনে বিশ্বাসী কোনো মুসলমান কখনোই সাহাবীদের সততায় সন্দেহ করতে পারেননা। কুরআনে বারংবার সাহাবীদের ধার্মিকতার সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ক অল্প কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করছি।
মহিমাময় আল্লাহ এরশাদ করেছেনঃ আরবী(*********)
-“মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছেন, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। এ মহাসাফল্য।(সূরা ৯ তাওবাঃ ১০০)।
এখানে সাহাবীগণকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত, প্রথম অগ্রগামী মুহাজিরগণ, দ্বিতীয়ত, প্রথম অগ্রগামী আনসারগণ এবং তৃতীয়ত তাঁদেরকে যারা নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন। প্রথম দুই পর্যায়ের সাহাবীগণকে সফলতার মাপকাঠি ও অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকাংশ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী এই দুইভাগের অন্তর্ভুক্ত।
কুরআন কারীমে অন্যান্য অনেক স্থানে সকল মুহাজির ও সকল আনসারকে ‘প্রকৃত মুমিন’ ও জান্নাতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।(সূরা আনফাল:৭২,৭৪ আয়াত, সূরা হাশর: ৮,৯,১০ আয়াত)।
হুদাইবিয়ার প্রান্তরে ‘বাইয়াতে রেদওয়ান’ সম্পর্কে এরশাদ করা হয়েছেঃ
لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا [٤٨:١٨]
“মুমিনগণ যখন বৃক্ষতলে আপনার নিকট ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করল, তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন।”(সূরা ৪৮ ফাতহঃ১৮)।
হাদীস বর্ণনাকারী প্রসিদ্ধ সকল সাহাবীই এই ‘বাইয়াতে’ অংশগ্রহণ করেছিলেন। একজন মুনাফিকও এতে অংশ নেয়নি।
তাবূকের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সাহাবীর প্রশংসায় এরশাদ হচ্ছেঃ
لَٰكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۚ وَأُولَٰئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ [٩:٨٨]
“কিন্তু রাসূল এবং যারা তার সঙ্গে ঈমান এনেছে, তারা নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে; তাদের জন্যই কল্যাণ আছে এবং তারাই সফলকাম।”(সূরা ৯ তাওবাঃ৮৮)।
হাদীস বর্ণনাকারী প্রসিদ্ধ সকল সাহাবীই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একজন মুনাফিকও এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি। রাসূলুল্লাহ(স)এর সকল সাহাবীর ঢালাও প্রশংসা করে ও তাঁদের ধার্মিকতা, সততা ও বিশ্বস্ততার ‘ঢালাও’ ঘোষণা দিয়ে এরশাদ করা হয়েছেঃ
وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ ۚ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِّنَ الْأَمْرِ لَعَنِتُّمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ [٤٩:٧]
“কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তাকে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন। তিনি কুফরী, পাপ ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী।”(সূরা: ৪৯ হুজুরাতঃ ৭)।
অন্যত্র মক্কা বিজয়ের পূর্বে ও পরে ইসলামগ্রহণকারী উভয় প্রকারের সাহাবীগণকে ‘ঢালাওভাবে’ কল্যাণ বা জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
وَمَا لَكُمْ أَلَّا تُنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا يَسْتَوِي مِنكُم مَّنْ أَنفَقَ مِن قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ ۚ أُولَٰئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِينَ أَنفَقُوا مِن بَعْدُ وَقَاتَلُوا ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ [٥٧:١٠]
“তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং সংগ্রাম করেছে, তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়; তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের চেয়ে, যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে এবং সংগ্রাম করেছে। তবে আল্লাহ উভয়েরই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”(সূরা ৫৭ হাদীসঃ ১০)।
এখানে উল্লেখ্য যে, হাদীস বর্ণনাকারী প্রসিদ্ধ সাহাবীগণ সকলেই মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং সংগ্রাম করেছেন।
সাহাবীগণের প্রশংসায়, তাঁদের সততা, বিশ্বস্ততা, ঈমান ও জান্নাতের সাক্ষ্য সম্বলিত আরো অনেক আয়াত কুরআন কারীমে রয়েছে।
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ সাহাবীগণের মধ্যে রয়েছেন আবু হুরাইরা, আবদুল্লাহ ইবনু উমার, আনাস ইবনু মালিক, আয়েশা, আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস, জাবির ইবনু আবদুল্লাহ, আবু সাঈদ খুদরী, আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আবদুল্লাহ ইবনু আমর, আলী ইবনু আবু তালিব, উমার ইবনুল খাত্তাব, উম্মু সালামাহ, আবূ মূসা আশ‘আরী, বারা ইবনু আযিব, আবূ যার গিফারী, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস, আবূ উমামা বাহিলী, হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান, সাহল ইবনু সাদ, উবাদা ইবনুস সামিত, ইমরান ইবনুল হুসাইয়িন, আবূ দারদা, আবূ কাতাদা, আবূ বকর সিদ্দীক, উবাই ইবনু কা’ব মু‘আয ইবনু জাবাল, উসমান ইবনু আফফান প্রমুখ প্রসিদ্ধ সাহাবী।
তাঁরা সকলেই ছিলেন রাসূলুল্লাহ(স) এর প্রসিদ্ধ সহচর, মক্কা বিজয়ের আগে ইসলাম গ্রহণকারী, তাবূক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, বাইয়াতে রেদোয়ানে অংশগ্রহণকারী বা প্রথম অগ্রগামী মুহাজির ও আনসার।
কুরআন যাকে সৎ, ঈমানদার ও সফলকাম বলে সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং কুরআন যার জন্য কল্যাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করছে তার সততার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করার অর্থ কুরআনের সাক্ষ্য অস্বীকার করা।
১.৪.৬. তুলনামূলক নিরীক্ষা
হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয় কিংবা বিশুদ্ধ হাদীসকে অশুদ্ধ হাদীস থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের অন্যতম পদ্ধতি ছিল সার্বিক নিরীক্ষা(Cross Examine)। এক্ষেত্রে মূলত তাঁরা সাহাবীগণের কর্মধারার অনুসরণ করেছেন।
১.৪.৬.১. তুলনামূলক নিরীক্ষার মূল প্রক্রিয়া
হযরত আবু হুরাইরা(রা)একজন সাহাবী। অনেক তাবিয়ী তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা করেছেন। এদের মধ্যে অনেক তাবিয়ী দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে থেকেছেন এবং অনেকে অল্প দিন থেকেছেন। কোনো সাহাবী বা মুহাদ্দিস একেক ছাত্রকে একেকটি হাদীস শিখাতেননা। তাঁরা তাঁদের নিকট সংগৃহীত হাদীসগুলি সকল ছাত্রকেই শিক্ষা দিতেন। ফলে সাধারণভাবে আবূ হুরাইরা(রা)বর্ণিত সকল হাদীসই তাঁর অধিকাংশ ছাত্র শুনেছেন। তাঁরা একই হাদীস আবু হুরাইরার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ আবু হুরাইরার(রা)সকল ছাত্রের বর্ণিত হাদীস সংগ্রহ ও সংকলিত করে সেগুলি পরস্পরের সাথে মিলিয়ে নিরীক্ষা করেছেন।
যদি দেখা যায় যে, ৩০ জন তাবেয়ী একটি হাদীস আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন, তন্মধ্যে ২০/২৫ জন হাদীসটি আবু হুরাইরা যে শব্দে বলেছেন হুবহু সেই শব্দে মুখস্ত ও লিপিবদ্ধ করেছেন। আর বাকী কয়জন হাদীসটি ঠিকভাবে মুখস্ত রাখতে পারেননি। এতে তাদের মুখস্ত ও ধারণ শক্তির দূর্বলতা প্রমাণিত হল।
যদি আবু হুরাইরার কোনো ছাত্র তাঁর নিকট হতে ১০০টি হাদীস শিক্ষা করে বর্ণনা করেন এবং তন্মধ্যে সবকয়টি বা অধিকাংশ হাদীসই তিনি এভাবে হুবহু মুখস্ত রেখে বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করতে পারেন তাহলে তা তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। অপরদিকে যদি এরূপ কোন তাবেয়ী ১০০টি হাদীসের মধ্যে অধিকাংশ হাদীসই এরূপভাবে বর্ণনা করেন যে, তার বর্ণনা অন্যান্য তাবেয়ীর বর্ণনার সাথে মেলেনা তাহলে বুঝা যাবে যে তিনি হাদীস ঠিকমত লিখতেননা ও মুখস্ত রাখতে পারতেননা। এই বর্ণনাকারী তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। তিনি ‘যয়ীফ’ বা দুর্বল রাবী বলে চিহ্নিত হন।
ভুলের পরিমাণ ও মাত্রার উপর নির্ভর করে দুর্বলতার মাত্রা বুঝা যায়। যদি তার কর্মজীবন ও তার বর্ণিত এ সকল উল্টা পাল্টা হাদীসের কারণে প্রমাণিত হতো যে তিনি ইচ্ছাপূর্বক রাসূলুল্লাহ(স)থেকে বর্ণিত হাদীসের মধ্যে বেশি কম করেছেন অথবা ইচ্ছাপূর্বক হাদীসের নামে বানোয়াট কথা বলেছেন তাহলে তাকে ‘মিথ্যাবাদী’ রাবী বলে চিহ্নিত করা হতো। যে হাদীস শুধুমাত্র এই ধরণের মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারী একাই বর্ণনা করেছেন সেই হাদীসকে কোনো অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা হিসেবে গ্রহণ করা হতোনা। বরং তাকে মিথ্যা বা ‘মাউযূ’ হাদীস বলে চিহ্নিত করা হতো।
অনেক সময় দেখা যায় যে, আবু হুরাইরার(রা) কোনো ছাত্র এমন একটি বা একাধিক হাদীস বলছেন যা অন্য কোনো ছাত্র বলছেননা। এক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ উপরের নিয়মে নিরীক্ষা করেছেন। যদি দেখা যায় যে, উক্ত তাবিয়ী ছাত্র আবূ হুরাইরার সাহচর্যে অন্যদের চেয়ে বেশি ছিলেন, তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ হাদীস তিনি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ ও মুখস্ত রাখতেন বলে নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁর সততা ও ধার্মিকতা সবাই স্বীকার করেছেন, সে ক্ষেত্রে তার বর্ণিত অতিরিক্ত হাদীসগুলিকে সহীহ(বিশুদ্ধ) বা হাসান(সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য) হাদীস হিসেবে গ্রহণ করা হতো।
আর যদি উপরোক্ত তুলনামূলক নিরীক্ষায় প্রমাণিত হতো যে তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলির মধ্যে অধিকাংশ হাদীস বা অনেক হাদীস গ্রহণযোগ্য রাবীদের সাথে কম বেশি অসামঞ্জস্যপূর্ণ তবে তার বর্ণিত এই অতিরিক্ত হাদীসটিও উপরের নিয়মে দুর্বল ও মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
সাধারণত একজন তাবেয়ী একজন সাহাবী থেকেই হাদীস শিখেতেননা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেক তাবেয়ী চেষ্টা করতেন যথাসম্ভব বেশি সংখ্যক সাহাবীর নিকট হতে হাদীস শিখতে। এজন্য তাঁরা তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের যে শহরেই কোনো সাহাবী বাস করতেন সেখানেই গমন করতেন। মুহাদ্দিসগণ উপরের নিয়মে সকল সাহাবীর হাদীস, তাদের থেকে সকল তাবেয়ীর হাদীস, তাঁদের থেকে বর্ণিত তাবে তাবেয়ীগণের হাদীস একত্রিত করে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে ও বর্ণনাকারীগণের ব্যক্তিগত জীবন, সততা, ধার্মিকতা ইত্যাদির আলোকে হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপন করতেন।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকে। একদিকে মুহাদ্দিসগণ সনদসহ রাসূলুল্লাহ(স)এর নামে কথিত সকল হাদীস সংকলিত করেছেন। অপরদিকে ‘রাবী’গণের বর্ণনার তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তাদের বর্ণনার সত্যাসত্য নির্ধারণ করে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। (জারহ তাদীল বিষয়ক সকল গ্রন্থেই এ বিষয়ক বিবরণাদি সংকলিত রয়েছে। বিশেষভাবে দেখুন: মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, কিতাবুত তাময়ীয, ইবনু আদী, আল কামিল ফী দু’আফাইর রিজাল, ড. মুহাম্মাদ মুসতাফা আ’যামী, মানহাজুন নাকদ ইনদাল মুহাদ্দিসীন।)
ইমাম তিরমিযী আবু ইসা মুহাম্মাদ ইবনু ইসা(২৭৫ হি) বলেন, আমাদেরকে আলী ইবনু হুজর বলেছেন, আমাদেরকে হাফস ইবনু সুলাইমান বলেছেন, তিনি কাসীর ইবনু যাযান থেকে, তিনি আসীর ইবনু দামুরাহ থেকে, তিনি আলী ইবনু আবু তালিব থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, মুখস্ত করবে, কুরআনের হালালকে হালাল হিসেবে পালন করবে ও হারামকে হারাম হিসেবে বর্জন করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার পরিবারের দশ ব্যক্তির বিষয়ে তার সুপারিশ কবুল করবেন, যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।”
হাদীসটি এভাবে সংকলিত করার পর ইমাম তিরমিযী হাদীসটির দুর্বলতা ও অগ্রহণযোগ্যতার কথা উল্লেখ করে বলেনঃ এই হাদীসটি গরীব(দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য)। এই একটিমাত্র সূত্র ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে হাদীসটি জানা যায়না। এর সনদ সহীহ নয়। হাফস ইবনু সুলাইমান(১৮০ হি) হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল।
ইমাম তিরমিযীর এই মতামত তাঁর ও দীর্ঘ তিন শতকের অগণিত মুহাদ্দিসের নিরীক্ষার ভিত্তিতে প্রদত্ত। তাঁদের নিরীক্ষার সংক্ষিপ্ত পর্যায়গুলি নিম্নরূপঃ
১. তাঁরা হাফস ইবনু সুলাইমান বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করেছেন।
২. হাফস যে সকল শিক্ষকের সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের অন্যান্য ছাত্র বা হাফসের ‘সহপাঠী’ রাবীদের বর্ণনা সংগ্রহ করে তাঁদের বর্ণনার সাথে তার বর্ণনার তুলনা করেছেন।
৩. এই হাদীসে হাফসের উস্তাদ কাসীর ইবনু যাযানের সূত্রে বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করে হাফসের বর্ণনার সাথে তুলনা করেছেন।
৪. কাসীরের ওস্তাদ আসিম ইবনু দামিরাহ বর্ণিত সকল হাদীস তার অন্যান্য ছাত্রদের সূত্রে সংগ্রহ করে হাফসের এই বর্ণনার সাথে তুলনা করেছেন।
৫. আলী(রা) এর অন্যান্য ছাত্রদের সূত্রে বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করে তুলনা করেছেন।
৬. আলী(রা) ছাড়া অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীসের সাথে এই বর্ণনার তুলনা করেছেন।
এই নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা দেখেছেনঃ
ক. এই হাদীসটি এই একটিমাত্র সূ্ত্র ছাড়া কোনো সূত্রে বর্ণিত হয়নি। অন্য কোনো সাহাবী থেকে কেউ বর্ণনা করেননি। আলীর অন্য কোনো ছাত্র হাদীসটি আলী থেকে বর্ণনা করেননি। আসিমের অন্য কোনো ছাত্র তা তার থেকে বর্ণনা করেননি। কাসীরের অন্য কোনো ছাত্র তা বর্ণনা করেননি।
এভাবে তাঁরা দেখেছেন যে দ্বিতীয় হিজরীর শেষ প্রান্তে এসে হাফস ইবনু সুলাইমান দাবী করেছেন যে, এই হাদীসটি তিনি এই সূত্রে শুনেছেন। তাঁর দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য কোনো সাক্ষী পাওয়া গেলনা।
খ. এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাদীসটি গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। কারণ সাধারণভাবে এরূপ ঘটেনা যে, আলী(রা) বর্ণিত একটি হাদীস তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আসীম ছাড়া কেউ জানবেননা। আবার আসিম একটি হাদীস শেখাবেন তা একমাত্র যাযান ছাড়া কেউ জানবেননা। আবার যাযান একটি হাদীস শেখাবেন তা হাফস ছাড়া কেউ জানবেননা।
গ. এখন দেখতে হবে যে, হাফস বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের অবস্থা কি? মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, হাফস তার ওস্তাদ যাযান ও অন্যান্য সকল উস্তাদের সূত্রে যত হাদীস বর্ণনা করেছেন প্রায় সবই ভুলে ভরা। এজন্য তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, হাফস যদিও কুরআনের বড় কারী ও আলিম ছিলেন, কিন্তু তিনি হাদীস বর্ণনায় দূর্বল ছিলেন। তিনি ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না বললেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বা ভুল বলতেন খুব বেশি। এজন্য তাঁরা তাকে দুর্বল ও পরিত্যক্ত গণ্য করেছেন। (মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, আত-তাময়ীয পৃ. ১৬৯)।
হাদীস বর্ণনাকারী বা ‘রাবী’র বর্ণনার যথার্থতা নির্ণয়ের এই সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনেকেই বুঝতে পারেননা।ফলে মুহাদ্দিস যখন কোনো ‘রাবী’ বা হাদীসের বিষয়ে বিধান প্রদান করেন তখন তারা অবাক হয়েছেন বা আপত্তি করেছেন। কেউ বলেছেন, এ হলো রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বিচারের ধৃষ্টতা। কেউ বলেছেনঃ এ হলো অকারণে, না জেনে বা আন্দাজে নেককার মানুষদের সমালোচনা। বর্তমান যুগেই নয়, ইসলামের প্রথম যুগগুলিতেও অনেক মানুষ এই ধারণা পোষণ করতেন। (মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, আত-তাময়ীয, ১৬৯)।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, ‘রাবী’ ও ‘হাদীসের’ সমালোচনায় হাদীসের ইমামগণের সকল বিধান ও হাদীস বিষয়ক মতামত এই নিরীক্ষার ভিত্তিতে। কোনো মুহাদ্দিস যখন কোনো রাবী বা হাদীস বর্ণনাকারী সম্পর্কে বলেন যে, তিনিঃ নির্ভরযোগ্য, পরিপূর্ণ মুখস্তকারী, মুখস্তকারী, সত্যপরায়ণ, চলনসই, দুর্বল, অনেক ভুল করেন, আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী, পরিত্যক্ত, মিথ্যাবাদী, হাদীস বানোয়াটকারী ইত্যাদি তখন বুঝতে হবে যে, তার এই ‘সংক্ষিপ্ত মতামতটি’ তার আজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম, হাদীস সংগ্রহ ও তুলনামূলক নিরীক্ষার ফল।
অনুরূপভাবে যখন তিনি কোনো হাদীসের বিষয়ে বলেনঃ হাদীসটি সহীহ, যয়ীফ, আপত্তিকর, বানোয়াট, মুরলাস, সহীহ হলো যে হাদীসটি সাহাবীর বাণী………..ইত্যাদি তাহলেও আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি তাঁর আজীবনের সাধনার নির্যাস আমাদেরকে দান করলেন।
এভাবে আমরা মুহাদ্দিসগণের কর্মধারা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এবার আমরা এই কর্মধারার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি আলোচনা করব।
১.৪.৬.২. নিরীক্ষামূলক প্রশ্নাবলী
মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষামূলক প্রশ্নের মাধ্যমে রাবীর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা যাচাই করার চেষ্টা করতেন। এ বিষয়ক ২/১টি ঘটনা দেখুনঃ
১. দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন তাবেয়ী উফাইর ইবনু মা’দান বলেনঃ “উমর ইবনু মুসা আল ওয়াজিহী আমাদের নিকট হিমস শহরে আগমন করেন। আমরা হিমসের মসজিদে তার নিকট(হাদীস শিক্ষার্থে) সমবেত হই। তিনি বলতে থাকেনঃ আপনাদের নেককার শাইখ আমাদেরকে হাদীস বলেছেন। আমরা বললামঃ নেককার শাইখ বলতে কাকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেনঃ খালিদ ইবনু মাদান। আমি বললামঃ আপনি কত সনে তাঁর নিকট হাদীস শুনেছেন। তিনি বললেনঃ আমি ১০৮ হিজরীতে তাঁর নিকট হাদীস শিক্ষা করি। আমি বললামঃ কোথায় আপনার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়েছিল। তিনি বলেনঃ আরমিনিয়ায় যুদ্ধের সময়। আমি বললামঃ আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং মিথ্যা বলা হতে বিরত থাকুন। খালিদ ইবনু মা’দান ১০৪ হিজরী সনে মৃত্যু বরণ করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, তাঁর মৃত্যুর ৪ বছর পরে আপনি তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা করেছেন। অপরদিকে তিনি কখনোই আরমিনিয়ায় যুদ্ধে যাননি। তিনি শুধুমাত্র বাইযান্টাইন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।(ইবনু আবু হাতীম, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ৬/১৩৩, যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৫/২১৭)।
এভাবে এই রাবীর মিথ্যাবাদিতা প্রমাণিত হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসগণ তাকে পরিত্যক্ত ও মিথ্যাবাদী ‘রাবী’রূপে চিহ্নিত করেছেন। আবু হাতেম রাযী বলেনঃ উমর ইবনু মূসা পরিত্যক্ত, সে মিথ্যা হাদীস তৈরি করত। বুখারী বলেনঃ তার বর্ণিত হাদীস আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য। ইবনু মাঈন বলেনঃ লোকটি নির্ভরযোগ্য নয়। ইবনু আদী বলেনঃ লোকটি বানোয়াটভাবে হাদীসের সনদ ও মতন তৈরি করত। দারাকুতনী, নাসাঈ প্রমূখ মুহাদ্দিস বলেনঃ সে পরিত্যক্ত। (প্রাগুক্ত)।
২. আবুল ওয়ালীদ তাইয়ালিসী হিশাম ইবনু আবদুল মালিক(২২৭ হি) বলেনঃ “আমি আমির ইবনু আবী আমের আল খাযযায এর নিকট থেকে হাদীস লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেছিলাম। একদিন হাদীসের সনদে তিনি বললেনঃ ‘আমাদেরকে আতা ইবনু আবু রাবাহ(১১৪ হি) বলেছেন’। আমি প্রশ্ন করলাম, আপনি কত সালে আতা থেকে হাদীস শুনেছেন? তিনি বললেনঃ ১২৪ হিজরী সালে। আমি বললামঃ আতা তো ১১৩/১১৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেছেন।”
এভাবে তাঁর বর্ণনায় মিথ্যা ধরা পড়ে। এই মিথ্যা ইচ্ছাকৃত হতে পারে আবার অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। ইমাম যাহাবী(৭৪৮ হি) বলেনঃ যদি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে একথা বলে থাকেন তাহলে তিনি একজন মিথ্যাবাদী ও বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী। আর যদি তিনি ভুলক্রমে আতা ইবনুস সাইব(১৩৬ হি) নামের অন্য তাবিয়ীকে আতা ইবনু আবু রাবাহ বলে ভুল করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে যে, তিনি একজন অত্যন্ত অসতর্ক, জাহিল ও পরিত্যাজ্জ রাবী।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৪/১৮)।
৩. প্রথম হিজরী শতকের একজন রাবী সুহাইল ইবনু যাকওয়ান আবু সিনদী ওয়াসিতী। তিনি আয়েশা(রা) হতে হাদীস শুনেছেন বলে দাবি করতেন। মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষামূলক প্রশ্নের মাধ্যমে তার মিথ্যাচার ধরা পড়েছে। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বলেন, আমাদেরকে আব্বাদ বলেছেনঃ সুহাইল ইবনু যাকওয়ানকে আমরা বললামঃ আপনি কি আয়েশা(রা)কে দেখেছেন? তিনি বললেনঃ হ্যা, দেখেছি। আমরা বললাম, বলুনতো তিনি দেখতে কেমন ছিলেন? তিনি বলেনঃ তাঁর গায়ের রং কালো ছিল। সুহাইল আরো দাবি করেন যে, তিনি ইবরাহীম নাখেয়ীকে দেখেছেন, তাঁর চোখ দুটি ছিল বড় বড়।
সু্হাইলের এই বক্তব্য তাঁর মিথ্যাচার ধরিয়ে দিয়েছে। কারণ আয়েশা(রা) ফর্সা ছিলেন। আর ইবরাহীম নাখয়ীর চোখ নষ্ট ছিল।(ইবনউ আদী, আল কামিল ৪/৫২১-৫২২)।
১.৪.৬.৩. শব্দগত ও অর্থগত নিরীক্ষা
হাদীসের সংগ্রহ ও নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের শব্দ, বাক্য বিন্যাস ও অর্থের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। বর্ণিত হাদীসটির মধ্যে ব্যবহৃত শব্দাবলী, বাক্যের ব্যবহার ইত্যাদি রাসূলুল্লাহ(স) এর ভাষা ও ভাবের সাখে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা লক্ষ্য রাখতেন। বর্ণিত হাদীসটির অর্থ মানবীয় যুক্তি, জ্ঞান, বিবেক বিরোধী কিনা, অথবা কুরআন ও হাদীসের সুপরিচিত বক্তব্যের স্পষ্ট বিরোধী কিনা তা বিবেচনা করতেন। ফলে অনেক সময় বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সততা প্রমাণিত হওয়া সত্বেও তাঁর বর্ণিত হাদীসকে তাঁরা মিথ্যা বা বানোয়াট বলে প্রত্যাখ্যান করতেন। পরবর্তী আলোচনায় পাঠক এ বিষয়ক অনেক উদাহরণ দেখতে পাবেন।
১.৪.৬.৪. ‘রাবী’র ওস্তাদকে প্রশ্ন করা
মুহাদ্দিসগণ কোনো রাবীর নিকট হতে হাদীস সংগ্রহের পর চেষ্টা করতেন তিনি যে ওস্তাদের সূত্রে হাদীসটি বলেছেন তাঁর কাছে যেয়ে সরাসরি তাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে বর্ণনাটি যাচাই করার। এজন্য প্রয়োজনে তাঁরা হাজার মাইল পরিভ্রমণের কষ্ট স্বীকার করতেন। উক্ত শিক্ষকের মৃত্যুর কারণে তার নিকট প্রশ্ন করা সম্ভব না হলে তাঁরা তার অন্যান্য ছাত্রের বর্ণনা সংগ্রহ করে তুলনা করতেন। এই জাতীয় একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন তাবেয়ী হাদীস বর্ণনাকারী ‘রাবী’ হাসান ইবনু উমারাহ আল বাজালী(১৫৩ হি)। তিনি বড় আলিম ও ফকীহ ছিলেন এবং কিছুদিন বাগদাদ এর বিচারপতি ছিলেন। কিন্তু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। সমকালীন নাকীদ বা সমালোচক হাদীসের ইমামগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তার দুর্বলতা প্রমাণ করেন। এ বিষয়ে দ্বিতীয় হিজরীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, নাকিদ ও ইমাম আল্লামা শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ(১৬০ হি) বলেনঃ “হাসান ইবনু উমারাহ আমাকে ৭ টি হাদীস বলেন। তিনি বলেন যে, তিনি হাদীসগুলি হাকাম ইবনু উতাইবাহ(১১৩ হি) এর নিকট হতে শুনেছেন, তিনি ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার থেকে শুনেছেন। আমি হাকাম ইবনু উতাইবাহ এর সাথে সাক্ষাত করে সেগুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেনঃ এগুলির মধ্যে একটি হাদীসও আমি বলিনি। (ইবনু আদী, আল কামিল ফী দুআফাইর রিজাল ২/২৮৩)।
আবু দাউদ তায়ালিসী সুলাইমান ইবনু দাউদ(২০৪ হি) বলেনঃ শু’বা আমাকে বলেনঃ আমাকে হাসান ইবনু উমারাহ বলেন, আমাকে হাকাম ইবনু উতাইবাহ বলেছেন, আবদুর রহমান ইবনু আবু লাইলা বলেছেন, আলী(রা) বলেছেনঃ “উহুদের শহীদগণকে গোসল দেওয়া হয়, কাফন পরানো হয় এবং জানাযার সালাত আদায় করা হয়।” এরপর আমি হাকামের নিকট গমন করে উহুদের শহীদগণের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেনঃ তাঁদের গোসল করানো হয়নি এবং কাফন পরানো হয়নি। আমি বললামঃ তাহলে হাসান ইবনু উমারাহ যে আপনার সূত্রে এইসব কথা বর্ণনা করেছে? তিনি বলেনঃ আমি কখনোই তাকে এই হাদীস বলিনি।”(প্রাগুক্ত ২/২৮৪)।
আবু দাউদ তায়ালিসী আরো বলেনঃ আমাকে শু’বা বললেনঃ তুমি জারীর ইবনু হাযিম(১৭০ হি) এর নিকট গমন করে তাকে বলঃ আপনার জন্য হাসান ইবনু উমারাহ হতে হাদীস বর্ণনা জায়েয নয়; কারণ সে মিথ্যা বলে। তায়ালিসী বলেনঃ আপনি কিভাবে তা জানলেন? তিনি বলেনঃ তিনি আমাকে হাকাম ইবনু উতাইবাহর সূত্রে অনেক হাদীস শুনিয়েছেন যেগুলোর কোনো ভিত্তি আমি পাইনি।
তায়ালিসী বলেনঃ আমি বললামঃ সেগুলি কি? শু’বা বলেনঃ আমি হাকামকে বললামঃ জারজ সন্তানের বিষয়ে আপনার মত কি? তিনি বলেনঃ তাদের জানাযা পড়া হবে। আমি বললামঃ এই হাদীস কার হতে বর্ণিত? হাকাম বলেনঃ হাসান বসরী থেকে বর্ণিত। অথচ হাসান ইবনু উমারাহ বলছেনঃ তাকে হাকাম হাদীসটি ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার থেকে আলীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।(মুসলিম, আস-সহীহ ১/২৩-২৪)।
এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শু’বা হাসান ইবুন উমারাহ এর বর্ণিত হাদীসগুলি তার উস্তাদের নিকট পেশ করে হাসানের বর্ণনার অযথার্থতা ও তার ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ভুল বা মিথ্যা প্রমাণ করলেন। এইরূপ অগণিত ঘটনা আমরা রিজাল গ্রন্থসমূহে দেখতে পাই। মূলত মুহাদ্দিসগণের সফরের একটি বড় অংশ ব্যয় করতেন সংকলিত হাদীসসমূহ ‘রাবী’র ওস্তাদের নিকট পেশ করে সেগুলোর যথার্থতার কাজে।
১.৪.৬.৫. বিভিন্ন বর্ণনাকারীর বর্ণনার তুলনা
মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষার অন্যতম দিক ছিল রাবীর সতীর্থ বা সহপাঠিগণের বর্ণনা সংগ্রহ ও তুলনা করে তার যথার্থতা নির্ণয় করা। তুলনা ও নিরীক্ষার এই প্রক্রিয়া ছিল তাঁদের সার্বক্ষণিক হাদীস চর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্য। হাদীস শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সেই হাদীসকে স্মৃতিতে সংরক্ষিত অন্যদের বর্ণিত হাদীসগুলির সাথে তুলনা করতেন। এরপর প্রয়োজন ও সুযোগ অনুসারে অন্যান্য রাবীগণকে প্রশ্ন করতেন, তাঁদের বর্ণনার সাথে এই বর্ণনার তুলনা করতেন এবং প্রয়োজন মত পান্ডুলিপির সাথে মেলাতেন।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবু দাউদ তায়ালিসী(২০৪ হি) বলেন, আমরা একদিন আমাদের উস্তাদ শু’বা ইবনুল হাজ্জাজের(১৬০ হি) নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় সমসাময়িক রাবী হাসান ইবনু দীনার সেখানে আগমন করেন। শু’বা তাকে বলেনঃ আপনি এখানে বসুন। তিনি বসেন এবং হাদীস থেকে বলেনঃ আমাদেরকে হামীদ ইবনু হিলাল বলেছেন, তিনি মুজাহিদ(২১-১০৪ হি) থেকে, তিনি উমার ইবনুল খাত্তাবকে(২১ হি) বলতে শুনেছেন……। হাদীসটি শুনে শু’বা অবাক হয়ে বলেনঃ মুজাহিদ উমার থেকে কোনো হাদীস শুনেছেন? এ কিভাবে সম্ভব?এ সময় হাসান ইবনু দীনার উঠে চলে যান। অন্য একজন রাবী আবুল ফাদল বাহর ইবনু কুনাইয আস সাক্কা(১৬০ হি) সেখানে আগমন করেন। শু’বা তাকে বলেনঃ আবুল ফাদল, আপনি হামীদ ইবনু হিলাল থেকে কোনো হাদীস শুনেছেন? তিনি বলেন, হ্যা, শুনেছি। আমাদেরকে হামীদ ইবনু হিলাল বলেছেন, আমদেরকে বনু আদী গোত্রের আবু মুজাহিদ নামের একজন আলিম বলেছেন, তিনি উমার ইবনুল খাত্তাবকে বলতে শুনেছেন…….। তখন শু’বা বলেনঃ তাহলে এই হলো আসল বিষয়।(ইবনু আদী, আল কামিল৩/১১৭)।
হাসান ইবনু দীনার তার হাদীস বর্ণনায় ভুল করেছেন। প্রসিদ্ধ রাবী মুজাহিদের জন্ম উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) এর শাহাদাতের দুই এক বছর পূর্বে। তিনি উমরের নিকট হতে কোনো হাদীস শুনেননি। তিনি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে রাবীর নামে ভুল করেছেন। বাহার আস সাক্কা এর বর্ণনার সাথে তুলনা করে শু’বা বুঝতে পারলেন হাসান ইবনু দীনারের ভুল কোথায়। তিনি হামীদ ইবনু হিলালের উস্তাদের নাম ঠিকমত মনে রাখতে পারেননি। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না বললেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেন। তিনি হাদীস নির্ভুলরূপে মুখস্ত রাখতে বা বর্ণনা করতে পারেননা।
তৃতীয় শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন(২৩৩ হি) মূসা ইবনু ইসমাঈল(২২৩ হি) এর নিকট গমন করে হাম্মাদ ইবনু সালামাহ ইবনু দীনারের(১৬৭ হি)বর্ণিত হাদীসগুলির পান্ডুলিপি পাঠ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। মূসা বলেনঃ আপনি এই পান্ডুলিপিগুলি আর কারো কাছে শুনেননি? ইয়াহইয়া বলেনঃ আমি ইতোপূর্বে হাম্মাদের ১৭ জন ছাত্রের কাছে তাদের নিকট সংকলিত হাম্মাদের বর্ণিত হাদীসগুলির পান্ডুলিপি পড়ে শুনেছি। আপনি ১৮ তম ব্যক্তি যার কাছে আমি হাম্মাদের বর্ণিত হাদীসগুলি পড়তে চাই। মূসা বলেনঃ কেন? ইয়াহইয়া বলেনঃ কারণ হাম্মাদ ইবনু সালামাহ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুই/এক স্থানে ভুল করতেন; এজন্য আমি তার ভুল ও তার ছাত্রদের ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে চাই। যদি দেখি যে, হাম্মাদের সকল ছাত্রই একইভাবে বর্ণনা করেছেন তাহলে বুঝতে পারব যে, হাম্মাদ এভাবেই বলেছেন এবং এক্ষেত্রে ভুল হলে তা হাম্মাদেরই ভুল। আর যদি দেখি যে, ছাত্রদের বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে তাহলে বুঝতে পারব যে, এক্ষেত্রে ভুল ছাত্রের নিজের।এভাবে আমি হাম্মাদের নিজের ভুল এবং তাঁর ছাত্রদের ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারব।(যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৪৫৬)।
মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষার অগণিত উদাহরণ ও ব্যাখ্যা ইমাম মুসলিম বিস্তারিতভাবে তার ‘আত-তাময়ীয’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাষায় একটি উদাহরণ এখানে পেশ করছি। তিনি বলেনঃ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ভুল হাদীসের সনদে বা মতনে হতে পারে। মতনে ভুলের একটি উদাহরণ। আমাকে হাসান হুলওয়ানী ও আবদুল্লাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ দারিমী বলেছেন, আমাদেরকে কাসীর ইবনু যায়ীদ বলেছেন, আমাদেরকে ইয়াযীদ ইবুন আবী যিয়াদ বলেছেন, কুরাইব ইবনু আবী মুসলিম(৯৮ হি)থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস থেকে, তিনি বলেনঃ আমি আমার খালা(নবী পত্নী)মাইমুনার ঘরে রাত্রি যাপন করি। …রাসূলুল্লাহ(স) রাত্রে উঠে ওযূ করে (তাহাজ্জুদের) সালাতে দাঁড়ান। তখন আমি তাঁর ডান পার্শ্বে দাঁড়াই। তিনি আমাকে ধরে তাঁর বাম পার্শে দাঁড় করিয়ে দেন।……”
ইমাম মুসলিম বলেনঃ এই হাদীসটি ভুল। কারণ নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীগণ সহীহ বর্ণনায় এর বিপরীত কথা বর্ণনা করেছেন। তারা উল্লেখ করেছেন যে, ইবনু আব্বাস রাসূলুল্লাহ(স) এর বামে দাঁড়িয়েছিলেন এরপর তিনি তাকে তাঁর ডানদিকে দাঁড় করিয়ে দেন। …..আমি এখানে কুরাইব ইবনু আবু মুসলিম থেকে তাঁর অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনা এবং এরপর ইবনু আব্বাস থেকে ইবনু আব্বাসের অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনা উল্লেখ করব, যারা কুরাইবের সতীর্থ ছিলেন এবং তাঁরই অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
১. আমাদেরকে ইবনু আবী উমর বলেন, আমাদেরকে সুফিয়ান সাওরী বলেছেন, আমর ইবনু দীনার থেকে, কুরাইব থেকে ইবনু আব্বাস থেকে, তিনি মাইমূনার গৃহে রাত্রি যাপন করেন। রাসূলুল্লাহ(স) রাত্রে উঠে ওযু করে সালাতে দাঁড়ান। ইবনু আব্বাস বলেনঃ আমি তখন উঠে রাসূলুল্লাহ(স) যেভাবে নামায পড়েন সেভাবে ওযু করে তাঁর নিকট আগমন করি এবং তাঁর বামে দাঁড়াই। তিনি তখন আমাকে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করিয়ে দেন।
২. মাখরাহ ইবনু সুলাইমান কুরাইব থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে অনুরূপভাবে বর্ণনা করেছেন।
৩. সালামা ইবনু কুহাইল কুরাইব থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে অনুরূপভাবে।
৪. সালিস ইবনু আবীল জা’দ কুরাইব থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে অনুরূপভাবে।
৫. হুশাইম আবু বিশর থেকে সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে ইবনু আব্বাস থেকে।
৬. আইয়ুব সাখতিয়ানী, আবদুল্লাহ ইবনু সাঈদ জুবাইর থেকে, তার পিতা সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে।
৭. হাকাম ইবনু উতাইবাহ সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে।
৮. ইবনু জুরাইজ আতা ইবনু আবী রাবাহ থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে।
৯. কাইস ইবনু সাঈদ আতা ইবনু আবী রাবাহ থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে।
১০. আবু নাদরাহ(মুনযির ইবনু মালিক)ইবনু আব্বাস থেকে।
১১. শা’বী ইবনু আব্বাস থেকে।
১২. তাঊস ইকারামাহ থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে।
ইমাম মুসলিম বলেনঃ এভাবে কুরাইব থেকে এবং ইবনু আব্বাসের অন্যান্য ছাত্রদের থেকে সহীহ বর্ণনায় প্রমাণিত হলো যে, রাসূলুল্লাহ(স) ইবনু আব্বাসকে তাঁর বামে দাঁড় করিয়েছিলেন বলে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে ভুল। (মুসলিম, আত-তাময়ীয, পৃ. ৬২-৬৩)।
পাঠক, এখানে ইমাম মুসলিমের নিরীক্ষার গভীরতা ও প্রামাণ্যতা লক্ষ্য করুন। তিনি এই একটি হাদীস ইবনু আব্বাস থেকে ১৩ টি সূত্রে সংকলিত করে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক বর্ণনাকে ভুল বা মিথ্যা বর্ণনা থেকে পৃথক করলেন।
তিনি প্রথমে উল্লেখ করেছেন যে, ইয়াযিদ ইবনু আবী যিয়াদ নামক ‘রাবী’র সূত্রে বর্ণনা করলেন যে, কুরাইব তাকে বলেছেন, ইবনু আব্বাস তাকে বলেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ(স) এর ডানে দাঁড়ান এবং তিনি তাকে বামে দাঁড় করিয়ে দেন। এরপর তিনি ইয়াযিদের ওস্তাদ ‘কুরাইবের’ অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনার সাথে তা মেলালেন। কুরাইবের অন্য তিনজন প্রসিদ্ধ ছাত্র মাখরামাহ, সালামা ও সালিমের বর্ণনা ইয়াযিদের বর্ণনার বিপরীত। তাঁরা তিনজনই বলেছিলেন যে, কুরাইব বলেছেন, ইবনু আব্বাস বামে দাঁড়িয়েছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ(স) তাকে ডানে দাঁড় করান। এতে প্রমাণিত হলো যে, ইয়াযিদ ইবনু আবী যিয়াদ হাদীসটি মুখস্ত রাখতে পারেননি।
ইমাম মুসলিম এখানেই থামেননি। তিনি এরপর কুরাইব ছাড়াও ইবনু আব্বাসের অন্য ৫ জন ছাত্র: সাঈদ ইবনু জুবাইর, আতা ইবনু আবী রাবাহ, আবু নুদরাহ, শা’বী ও ইকরামাহ থেকে হাদীসটির বিবরণ সংকলিত করে তার সাথে উপরের বর্ণনাটির তুলনা করেছেন। এই ৫ জনের বর্ণনাও প্রমাণ করে যে, ইয়াযিদ ইবনু আবী যিয়াদ হাদীসটির ভুল বর্ণনা দিয়েছেন। এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হলো যে, ইবনু আব্বাস তাঁর সকল ছাত্রকে বলেছেন যে, তিনি প্রথমে বামে দাঁড়িয়েছিলেন, পরে রাসূলুল্লাহ(স) তাকে ডানে দাঁড় করিয়ে দেন। ইবনু আব্বাসের সকল ছাত্রের ন্যায় কুরাইবও তাঁর ছাত্রদের এই কথায় বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ইয়াযিদ তাঁর স্মৃতির দুর্বলতার কারণে হাদীসটি ভুলভাবে বর্ণনা করেছেন।
এইরূপ ব্যাপক তুলনা ও নিরীক্ষা মুহাদ্দিসগণ প্রতিটি হাদীসের ক্ষেত্রে করতেন। হাদীস ও রাবীর বিধান বর্ণনায় তাঁদের প্রতিটি মতামতই এইরূপ গভীর ও ব্যাপক তুলনা ও নিরীক্ষার ভিত্তিতে প্রদত্ত।
আরেকটি উদাহরণ দেখুন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের মিশরের একজন প্রসিদ্ধ আলিম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন আবু আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনু লাহী’য়া উক্ববা আল হাদরামী আল গাফিকী(১৭৪ হি)। তিনি একজন প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন এবং অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত সকল হাদীস তুলনামুলক নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে দেখতে পেয়েছেন যে, তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ভুলের পরিমাণ খুবই বেশি। নাকিদ মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলি তাঁর নিকট থেকে বা তাঁর ছাত্রদের নিকট হতে সংকলিত করেছেন। এরপর তিনি যেসকল ওস্তাদের সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের অন্যান্য ছাত্রদের থেকে হাদীসগুলি সংগ্রহ ও সংকলন করেছেন। এরপর এ সকল বর্ণনার সনদ ও মতনের তারতম্য দেখতে পেয়ে ‘ইবনু লাহীয়াহ’ কে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল বলে চিহ্নিত করেছেন।
ইবনু লাহীয়াহ এর মারাত্মক ভুলের উদাহরণ হিসেবে ইমাম মুসলিম বলেনঃ আমাদেরকে যুহাইর ইবনু আরব বলেছেন, আমাদেরকে ইসহাক ইবনু ঈসা বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ ইবনু লাহীয়াহ বলেছেন, মূসা ইবনু উকবাহ(১৪১ হি) আমার কাছে লিখে পাঠিয়েছেন, আমাকে বসুর ইবনু সাঈদ বলেছেন, যাইদ ইবনু সাবিত(রা) থেকে, তিনি বলেছেনঃ “রাসূলুল্লাহ(স) মসজিদের মধ্যে হাজামত করেন বা সিংগার মাধ্যমে দেহ থেকে রক্ত বের করেন।” ইবনু লাহীয়াহ এর ছাত্র ইসহাক ইবনু ঈসা বলেনঃ আমি ইবনু লাহীআকে বললামঃ তাঁর বাড়ির মধ্যে কোনো নামাজের স্থানে? তিনি বললেনঃ মসজিদে নববীর মধ্যে।”
ইমাম মুসলিম বলেনঃ হাদীসটির বর্ণনা সকল দিক হতে বিকৃত। এর সনদ ও মতন উভয় ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল রয়েছে। ইবনু লাহীয়াহ এর মতনের শব্দ বিকৃত করেছেন এবং সনদে ভুল করেছেন। এই হাদীসের সহীহ বিবরণ আমি উল্লেখ করছি।
আমাকে মুহাম্মাদ ইবনু হাতিম বলেন,আমাদেরকে বাহায ইবনু আসাদ বলেন, আমাদেরকে উহাইব ইবনু খালিদ ইবনু আজলান(১৬৫ হি) বলেন, আমাকে মূসা ইবনু উকবাহ বলেন, আমি আবুন নাদর সালিম ইবনু আবু উমাইয়াহ(১২৯ হি) কে বলতে শুনেছি, তিনি বুসর ইবনু সাইদ থেকে, তিনি যাইদ ইবনু সাবিত থেকে বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ(স)মসজিদের মধ্যে চাটাই দিয়ে একটি ছোট ঘর বানিয়ে তার মধ্যে কয়েক রাত সালাত আদায় করেন…..।”
ইমাম মুসলিম বলেনঃ “আমাকে মুহাম্মাদ ইবনুল মাসাল্লা বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফর বলেছেন, আমাদেরকে আবদুল্লাহ ইবনু সাঈদ ইবনু আবী হিনদ আল ফারাযী (১৪৫ হি) বলেছেন, আমাদেরকে আবুন নাদর সালিম বলেছেন, তিনি বুসর ইবনু সাঈদ থেকে, তিনি যাইদ ইবনু সাবিত থেকে, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ(স) চাটাই দিয়ে মসজিদের মধ্যে একটি ঘর বানিয়ে নেন…।”
ইমাম মুসলিম বলেনঃ এভাবে আমরা সঠিক বর্ণনা পাচ্ছি উহাইব ইবনু খালিদ(১৬৫ হি) থেকে মূসা ইবনু উকবাহ থেকে, আবুন নাদর থেকে। এছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনু সাঈদ ইবনু আবী হিনদ আল ফারাযী(১৪৫ হি) দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আবুন নাদর থেকে যে বর্ণনা করেছেন তাও উল্লেখ করলাম। ইবনু লাহীয়া এখানে হাদীসের মতন বর্ণনায় ভুল করেছেন তার কারণ তিনি হাদীসটি মূসার নিকট হতে স্বকর্ণে শুনেননি। শুধুমাত্র লিখে পাঠানো পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করেছেন যা তিনি উল্লেখ করেছেন। (এজন্য তিনি বা ঘর বানিয়েছেন শব্দটিকে বা রক্ত বাহির করেছেন বলে পড়েছেন।) যারা মুহাদ্দিসের নিজের মুখ হতে স্বকর্ণে না শুনে বা মুহাদ্দিসকে নিজে পড়ে না শুনিয়ে শুধুমাত্র লিখিত পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করে হাদীস বর্ণনা করেন তাদের সকলের ক্ষেত্রেই আমরা এই বিকৃতির ভয় পাই।
আর সনদের ভুল হলো, মূসা ইবনু উকবাহ হাদীসটি আবুন নাদর সালিম এর নিকট হতে গ্রহণ করেছেন। আবুন নাদর হাদীসটি বুসর ইবনু সাঈদ থেকে শিখেছেন। কিন্তু ইবনু লাহিয়াহ সনদ বর্ণনায় আবুন নাদর এর নাম উল্লেখ না করে বলেছেনঃ মূসা হাদীসটি বুশর থেকে শুনেছেন। (মুসলিম, আত-তাময়ীয, পৃ. ১৮৭-১৮৮)।
এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম মুসলিম দুই পর্যায়ে তুলনা করেছেন। প্রথমত ইবনু লাহীয়াহর উস্তাদ মূসার অন্য ছাত্র উহাইবের বর্ণনার সাথে ইবনু লাহীয়াহর বর্ণনা তুলনা করেছেন। উভয় বর্ণনা প্রমাণ করেছে যে, ইবনু লাহিয়াহ সনদ বর্ণনায় ও মতন উল্লেখে মারাত্মক ভুল করেছেন।
১.৪.৬.৬. বিভিন্ন সময়ের বর্ণনার মধ্যে তুলনা করা
সাক্ষ্য বা বর্ণনার নির্ভুলতা যাচাইয়ের অন্যতম পদ্ধতি বর্ণনাকারীকে বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ে প্রশ্ন করা। এই পদ্ধতি সাহাবীগণ ব্যবহার করতেন হাদীস বর্ণনাকারীর বর্ণনার নির্ভুলতা যাচাইয়ের জন্য। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণও এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এখানে ২ টি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
১. উমাইয়া শাসক মারওয়ান ইবনুল হাকাম(৬৫ হি) এর সেক্রেটারী আবুয যুআইযাহ বলেন, একদিন মারওয়ান আমাকে বলেনঃ আবু হুরাইরা(রা) কে ডেকে আনাও। আবু হুরাইরা উপস্থিত হলে তিনি আবু হুরাইরাকে বিভিন্ন বিষয়ে হাদীস জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। আর আমাকে পর্দার আড়ালে বসে সেগুলি লিখতে নির্দেশ দিলেন। এরপর একবৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে মারওয়ান পুনরায় আবু হুরাইরাকে ডেকে পাঠান এবং আমাকে পর্দার আড়ালে আগের বছরে লেখা পান্ডুলিপি নিয়ে বসতে বলেন। তিনি আবু হুরাইরাকে সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে আবার প্রশ্ন করেন এবং আবু হুরাইরা গত বছরে বলা হাদীসগুলি পুনরায় বলেন। আমি মিলিয়ে দেখলাম যে, তিনি একটুও কম বেশি করেননি বা কোনো শব্দ আগে পিছেও করেননি।”(হাকিম, আল মুসতাদরাক ৩/৫৮৩)।
২. উমারাহ ইবনুল কা’কা বলেনঃ আমাকে ইবরাহীম নাখয়ী (৯৬ হি)বলেনঃ তুমি আমাকে আবু যুর’আ ইবনু আমর ইবনু জারীব থেকে হাদীস বর্ণনা কর। আবু যুর’আর নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ হলো, আমি তাকে একটি হাদীস সম্পর্কে প্রশ্ন করি। এরপর দুই বৎসর পরে আমি তাকে হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। দ্বিতীয়বার তিনি হুবহু প্রথমবারের মতই বর্ণনা করেন, একটি অক্ষরও বেশি কম করেননি। (ইবনু হাজার আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব ১২/১০৯)।
১.৪.৬.৭. স্মৃতি ও শ্রুতির সাথে পান্ডুলিপির তুলনা
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, তাবেয়ীগণের যুগ থেকে ‘রাবী’ ও মুহাদ্দিসগণ সাধারণভাবে প্রত্যেক শিক্ষকের নিকট হতে শিক্ষা করা হাদীসগুলি পৃথকভাবে পান্ডুলিপি আকারে লিপিব্ধ করে সংরক্ষণ করতেন। তাঁরা পান্ডুলিপির সাথে মুখস্ত বর্ণনার তুলনা করে নির্ভুলতা যাচাই করতেন। প্রয়োজনে তাঁরা পান্ডুলিপির হস্তাক্ষর, কালি ইত্যাদি পরীক্ষা করতেন। এখানে বর্ণিত হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে পান্ডুলিপির সাহায্য গ্রহণের কয়েকটি নযির উল্লেখ করছি।
(১) দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন মুহাদ্দিস খলীফা ইবনু মূসা বলেন, আমি গালিব ইবনু উবাইদুল্লাহ আল জাযারী নামে একজন মুহাদ্দিসের নিকটে হাদীস শিক্ষা করতে গমন করি। তিনি আমাদেরকে হাদীস লেখাতে শুরু করে তার পান্ডুলিপি দেখে বলতে থাকেনঃ আমাকে মাকহুল(১১৫ হি) বলেছেন…, আমাকে মাকহুল বলেছেন…., এভাবে তিনি মাকহুলের সূত্রে হাদীস লেখাতে থাকেন। এমন সময় তাঁর প্রশ্রাবের বেগ হয়, তিনি উঠে যান। তখন আমি তার পান্ডুলিপির উপর নযর করে দেখি সেখানে লেখা রয়েছেঃ আমাকে আবান ইবনু আবী আইয়াশ(১৪০ হি) বলেছেন, আনাস থেকে, আবান বলেছেন, অমুক থেকে….। তখন আমি তাকে পরিত্যাগ করে সেখান হতে উঠে আসলাম। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৮)।
অর্থাৎ, এই রাবী তার হাদীসগুলি আবানের নিকট হতে শুনেছেন ও লিখেছেন। তবে আবান মুহাদ্দিসগণের নিকট দুর্বল বলে ও অনির্ভরযোগ্য বলে পরিচিত। এজন্য তিনি হাদীস পড়ার সময় তার নাম বাদ দিয়ে প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাকহুলের নামে হাদীসগুলি বলেছিলেন। খলীফা সুযোগ পেয়ে তার মুখের বর্ণনার সাথে লিখিত পান্ডুলিপির তুলনা করে তার জালিয়াতি ধরে ফেলেন।
(২) দ্বিতীয় শতকের নাকিদ ইমাম, আবদুর রহমান ইবনু মাহদী (১৯৮ হি) বলেন, একদিন সুফিয়ান সাওরী (১৬১ হি) একটি হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ হাদীসটি আমাকে বলেছেন হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান(১২০ হি), তিনি আমর ইবনু আতিয়্যাহ আত তাইমী(মৃত্যু ১০০ হিজরীর কাছাকাছি) নামক তাবিয়ী থেকে তিনি সালমান ফারসী(৩৪ হি) থেকে।
আবদুর রহমান বলেনঃ আমি বললামঃ হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান তো এই হাদীস রিবয়ী ইবনু হিরাশ(১০০ হি) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি সালমান ফারসী থেকে। (অর্থাৎ, আপনার সনদ বর্ণনায় ভুল হয়েছে, হাম্মাদের উস্তাদ আমর ইবনু আতিয়্যাহ নয়, বরং রিবয়ী ইবনু হিরাশ।) সুফিয়ান সাওরী বলেছেনঃ এই সনদ কে বলেছেন? আমি বললামঃ আমাকে হাম্মাদ ইবনু সালামাহ(১৬৭ হি) বলেছেন, তিনি হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান হতে এই সনদ উল্লেখ করেছেন। সুফিয়ান বললেনঃ আমি যা বলছি, তাই লেখ। আমি বললামঃ শু’বা ইবনুল হাজ্জাজও (১৬০ হি) আমাকে এই সনদ বলেছেন। তিনি বললেনঃ আমি যা বলছি তাই লিখ। আমি বললামঃ হিশাম দাসতুআয়ীও (১৫৪ হি) আমাকে এই সনদ বলেছেন। তিনি বললেনঃ হিশাম? আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বললেন, আমি যা বলছি তাই লিখ। আমি হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমানকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ আমি আমর ইবনু আতিয়্যাহ থেকে হাদীসটি শুনেছেন।
আব্দুর রাহমান বলেনঃ আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস এসে গেল যে, এখানে সুফিয়ান সাওরী ভুল করলেন। অনেকদিন যাবত আমি এই ধারণা পোষণ করে থাকলাম যে, এই হাদীস বলতে সুফিয়ান সাওরী ভুল করলেন। এরপর একদিন আমি আমার ওস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফার গুনদার (১৯৩ হি) এর মাধ্যমে শু’বা ইবনুল হাজ্জাজের যে হাদীসগুলি শুনেছিলাম সেগুলির লিখিত পান্ডুলিপির মধ্যে দেখলাম যে, শু’বা বলেছেন, আমাকে হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান বলেছেন, তাকে রিবয়ী ইবনু হিরাশ বলেছেন, সালমান ফারসী থেকে। শু’বা বলেছেনঃ হাম্মাদ একবার বলেন যে, তিনি আমর ইবনু আতিয়্যাহ হতে হাদীসটি শুনেছেন।
আবদুর রহমান বলেনঃ পান্ডুলিপি দেখার পর আমি বুঝতে পারলাম যে, সুফিয়ান সাওরী ঠিকই বলেছিলেন। তাঁর নিজের মুখস্তের বিষয়ে তাঁর গভীর আস্থা থাকার কারণে অন্যান্যদের বিরোধিতাকে তিনি পাত্তা দেননি। (ইবনু আবী হাতিম, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৬৪-৬৫)।
(৩) দ্বিতীয় শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক(১৮১ হি) বলেন, যদি মুহাদ্দিসগণ শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ(১৬০ হি) থেকে বর্ণিত হাদীসের সঠিক বর্ণনার বিষয়ে মতভেদ করেন তাহলে মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফর গুনদার(১৯৩ হি) এর পান্ডুলিপিই তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করবে। গুণদার এর পান্ডুলিপির বর্ণনাই সঠিক ও নির্ভুল বলে গৃহীত হবে।(ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/২৭১)।
(৪) তৃতীয় শতকের তিনজন মুহাদ্দিস, মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম ইবনু উসমান আর রাযী(২৭০ হি), ফাদল ইবনু আব্বাস ও আবু যুরু’আ রাযী উবাইদুল্লাহ ইবনু আব্দুল করিম(২৬৪ হি) একত্রে বসে হাদীস আলোচনা করছিলেন। মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম একটি হাদীস বলে যাতে ফাদল আপত্তি উঠান। তিনি অন্য একটি বর্ণনা বলেন। দুজনের মধ্যে হাদীসটি নিয়ে বচসা হয়। তাঁরা তখন আবু যুরআকে সালিস মানেন। আবু যুরআ মতামত প্রকাশে অনীহা করেন। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম চাপাচাপি করতে থাকেন। তিনি বলেনঃ আপনার নীরবতার কোন অর্থ নেই। আমার ভুল হলে তাও বলেন। আর তাঁর ভুল হলে তাও বলেন। আবু যুর’আ তখন তাঁর পান্ডুলিপি আনতে নির্দেশ দেন। তিনি ছাত্র আবুল কাসিমকে বলেন, তুমি গ্রন্থাগারে ঢুকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারি বাদ দিবে। এরপরের সারির বই গুণে প্রথম থেকে ১৬ খন্ড পান্ডুলিপি রেখে ১৭ তম খন্ডটি নিয়ে এস। তিনি যেয়ে বর্ণনা অনুসারে পান্ডুলিপিটি নিয়ে এসে আবু জুরআকে প্রদান করেন। আবু যুরআ পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে হাদীসটি বের করেন। এরপর তিনি পান্ডুলিপিটি মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিমের হাতে দেন। মুহাম্মাদ পান্ডুলিপিতে সংকলিত হাদীসটি পড়ে বলেনঃ হ্যাঁ, তাহলে আমারই ভুল হয়েছে। আর ভুল তো হতেই পারে।”(ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/৩৩৭: ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৭/৩০)।
(৫) তৃতীয় হিজরীর একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল রাহমান ইবনু উমর আল ইসপাহানী রুস্তাহ(২৫০ হি)। তিনি একদিন হাদীসের আলোচনা কালে আবু জুরআ রাযী(২৬৪ হি) ও আবু হাতিম রাযী মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস(২৭৭ হি) উভয়ের উপস্থিতিতে একটি হাদীস বর্ণনা করে বলেনঃ আমাদেরকে আব্দুর রাহমান ইবনু মাদী বলেছিলেন, তিনি সুফিয়ান সাওরী থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সালিহ থেকে তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যোহরের সালাত ঠান্ডা করে আদায় করবে; কারণ উত্তাপের কাঠিণ্য জাহান্নামের প্রশ্বাস থেকে।” একথা শুনেই প্রতিবাদ করেন আবু যুর’আ রাযী। তিনি বলেনঃ আপনি(তাবিয়ী আবু সালিহ এর উস্তাদ সাহাবীর নাম আবু হুরাইরা উল্লেখ করে) ভুল বললেন। সকলেইতো হাদীসটি আবু সাঈদ খুদরীর সূত্রে বর্ণনা করেন। কথাটি আব্দুর রাহমান এর মনে খুবই লাগে। তিনি বাড়ি ফিরে নিজের নিকট রক্ষিত পান্ডুলিপি পরীক্ষা করে আবু যুরআর কাছে চিঠি লিখে বলেনঃ “আমি আপনাদের উপস্থিতিতে একটি হাদীস আবু হুরাইরার সূত্রে বর্ণনা করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন যে, আমার বর্ণনা ভুল, সবাই হাদীসটি আবু সাঈদের সূত্রে বর্ণনা করেন। কথাটি আমার মনে খুবই আঘাত করেছিল। আমি বিষয়টি ভুলতে পারিনি। আমি বাড়িতে ফিরে আমার নিকট সংরক্ষিত পান্ডুলিপি পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখানে দেখলাম যে, হাদীসটি আবু সাঈদের সূত্রেই বর্ণিত। যদি আপনার কষ্ট না হয় তাহলে আবু হাতীম ও অন্যান্য সকল বন্ধুদের জানিয়ে দিবেন যে, আমার ভুল হয়েছিল। আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করুন। ভুল স্বীকার করে লজ্জিত বা অপমানিত হওয়া(ভুল গোপন করে) জাহান্নামের আগুনে পোড়ার চেয়ে উত্তম।(ইবনু আবী হাতিম, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৩৩৬)।
(৬) তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস সুলাইমান ইবুন হারাব(২২৪ হি) বলেনঃ আমি যখন আমার সমসাময়িক প্রসিদ্ধ ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনু মা‘য়ীন(২৩৩ হি) এর সাথে বিভিন্ন হাদীস আলোচনা করতাম, তখন তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, এই হাদীসটি ভুল। আমি বলতামঃ এর সঠিক রূপ কি হবে? তিনি বলতেন তা জানিনা। তখন আমি আমার পান্ডুলিপি দেখতাম। আমি দেখতে পেতাম যে, তাঁর কথাই ঠিক। পান্ডুলিপিতে হাদীসটি অন্যভাবে লিখা হয়েছে।(ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/৩১৪)।
(৭) ইমাম আহমদ হাম্বল(২৪১) কে প্রশ্ন করা হয়ঃ আবুল ওয়ালিদ কি পরিপূর্ণ নির্ভরযোগ্য? তিনি বলেনঃ না। তাঁর পান্ডুলিপিতে নোকতা দেওয়া ছিলনা এবং হরকত দেওয়া ছিলনা। তবে তিনি শু’বা ইবনুল হাজ্জাজের নিকট থেকে যে হাদীসগুলি শুনেছিলেন ও লিখেছিলেন সেগুলি তিনি বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করেছেন।(আহমদ ইবনু হাম্মাল, আল ইলাল ওয়া মা’রিফাতুর রিজাল ২/৩৬৯)।
(৮) তৃতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী ইয়াকূব ইবনু হুমাইদ ইবনু কাসিব(২৪০ হি)। ইমাম আবু দাউদ(২৭৫ হি) বলেন, ইয়াকূব এর বর্ণিত হাদীসগুলির মধ্যে অনেক হাদীস দেখতে পেলাম যেগুলি অন্য কেউ এভাবে বর্ণনা করেননা। এজন্য আমরা তাকে তার মূল পান্ডুলিপি দেখাতে অনুরোধ করি। তিনি কিছুদিন যাবত আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেন। এরপর তিনি তার পান্ডুলিপি বের করে আমাদেরকে দেখান। আমরা দেখলাম তার পান্ডুলিপিতে অনেক হাদীস নুতন তাজা কালি দিয়ে লেখা। পুরাতন লেখা ও নতুন লেখার মধ্যে পার্থক্য ধরা পড়ে। আমরা দেখলাম অনেক হাদীসের সনদের মধ্যে রাবীর নাম ছিলনা, তিনি সেখানে নতুন করে রাবীর নাম বসিয়েছেন। কোনো কোনো হাদীসের ভাষার মধ্যে অতিরিক্ত শব্দ বা বাক্য যোগ করেছেন। এজন্য আমরা তার হাদীস গ্রহণ করা হতে বিরত থাকি। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৭/২৭৬-২৭৭; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১/১৫৯)।
(৯) চতূর্থ হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আবু আহমদ আব্দুল্লাহ ইবনু আদী(৩৬৫ হি) বলেনঃ মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল আশ‘আশ নামক এক ব্যক্তি মিশরে বসবাস করতেন এবং হাদীস বর্ণনা করতেন। আমি হাদীস সংগ্রহের সফরকালে মিশরে তার নিকট গমন করি। তিনি আমাদেরকে একটি পান্ডুলিপি বের করে দেন। পান্ডুলিপিটির কালি তাজা এবং কাগজও নতুন। এতে প্রায় এক হাজার হাদীস ছিল, যেগুলি তিনি হযরত আলীর বংশধর মূসা ইবনু ইসমাঈল ইবনু মূসা ইবনু জা’ফর সাদিক ইবনু মুহাম্মাদ বাকির ইবনু যাইনুল আবিদীন ইবনু হুসাইন ইবনু আলী থেকে তাঁর পিতা পিতামহদের সূত্রে রাসূলুল্লাহ(স) থেকে শুনেছেন বলে দাবি করেন। এর প্রায় সকল হাদীসই অজ্ঞাত, অন্য কেউ এই সনদে বা অন্য কোনো সনদে তা বর্ণনা করেনি। কিছু হাদীসের বা মতন অন্যান্য সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়, তবে এই সনদে নয়। তখন আমি সনদে উল্লেখিত মূসা ইবনু ইসমাঈল সম্পর্কে আলী বংশের সমকালীন অন্যতম নেতা হুসাইন ইবনু আলীকে প্রশ্ন করি ।তিনি বলেনঃ এই মূসা ৪০ বছর যাবত মদীনায় আমার প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি কখনোই কোনোদিন বলেননি যে, তিনি তাঁর পিতা পিতামহদের সূত্রে বা অন্য কোনো সূত্রে কোনো হাদীস তিনি শুনেছেন বা বর্ণনা করেছেন। ইবনু আদী বলেনঃ এই পান্ডুলিপির হাদীসগুলির মধ্যে আমরা কোনো ভিত্তি খুঁজে পাইনি। এগুলি তিনি বানিয়েছিলেন বলে বুঝা যায়। (ইবনু আদী, আল কামিল ৬/৩০১-৩০২; ইবনুল জাউযী, আদ দুআফা ৩/৪৩, ৯৭)।
১.৪.৭. নিরীক্ষার ভিত্তিতে হাদীসের প্রকারভেদ
নিরীক্ষার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ হাদীসকে মূলত তিনভাগে ভাগ করেছেনঃ সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীস, হাসান বা ভাল অর্থাৎ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ও যয়ীফ বা দুর্বল। যয়ীফ হাদীস দুর্বলতার কারণ ও দুর্বলতার পর্যায়ের ভিত্তিতে বিভিন্নভাবে বিভক্ত।
এখানে সাধারণ পাঠকের অনুধাবনের জন্য এগুলি সহজ ব্যাখ্যার চেষ্টা করব। মনে করুন একজন বিচারক একজন হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত সাক্ষ্য প্রমাণাদি নিরীক্ষা করে দেখেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো সে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় এক ব্যক্তিকে খুন করেছে। প্রদত্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে তিনি সম্ভাব্য চার প্রকার রায় প্রদান করতে পারেনঃ ১. মৃত্যুদন্ড, ২. যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৩. কয়েক বছরের কারাদন্ড বা ৪. বেকসুর খালাস। মোটামুটিভাবে হাদীসের নির্ভরতার ক্ষেত্রেও এই পর্যায়গুলি রয়েছে।
১.৪.৭.১. সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীস
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহীহ হাদীস বলা হয়। ১. ‘আদালত’: হাদীসের সকল রাবী পরিপূর্ণ সৎ ও বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত,
২. ‘যাবত’: সকল রাবীর ‘নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা’ পূর্ণরূপে বিদ্যমান বলে প্রমাণিত,
৩. ‘ইত্তিসাল’: সনদের প্রত্যেক রাবী তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন বলে প্রমাণিত,
৪. ‘শুযূয মুক্তি’: হাদীসটি অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত এবং
৫. ‘ইল্লাত মুক্তি’: হাদীসটির মধ্যে সূক্ষ্ম কোনো সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত। (ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ. ২৩-২৫; ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৭-৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/২৫-৩১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৬৩-৭৪; মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৪-৩৬)।
প্রথম তিনটি শর্ত সনদ কেন্দ্রিক এবং শেষোক্ত দুইটি শর্ত মূলত অর্থকেন্দ্রিক। এগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক। তবে সাধারণ পাঠকের জন্য আমরা বলতে পারি যে, প্রদত্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদির বিষয়ে যতটুকু নিশ্চয়তা অনুভব করলে একজন বিচারক মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিতে পারেন, বর্ণিত হাদীসটি সত্যিই রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন বলে অনুরূপভাবে নিশ্চিত হতে পারলে মুহাদ্দিসগণ তাকে ‘সহীহ’ বা বিশুদ্ধ হাদীস বলে গণ্য করেন। নিরীক্ষার মাধ্যমে যে সকল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস এই মানের নির্ভুল বা সহীহ বলে গণ্য করা হয় তাদের নির্ভরযোগ্যতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ আরবীতে নির্ভরযোগ্য, প্রামাণ্য ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন।
১.৪.৭.২. ‘হাসান’ বা সুন্দর বা গ্রহণযোগ্য হাদীস
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাসান হাদীসেও উপরোক্ত ৫টি শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য্। তবে দ্বিতীয় শর্তের মধ্যে যদি সামান্যতম দূর্বলতা দেখা যায় তবে হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলা হয়। অর্থাৎ হাদীসের সনদের রাবীগণ ব্যক্তিগতভাবে সৎ, প্রত্যেকে হাদীসটি উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ নেই। তবে সনদের কোনো রাবীর নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা বা ‘যাবত’ কিছুটা দুর্বল বলে বুঝা যায়। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। এইরূপ ‘রাবী’র বর্ণিত হাদীস ‘হাসান’ বলে গণ্য।(ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ. ৪৫-৬১; ফাতহুল মুগীস, পৃ.৩২-৪৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/৭৬-১১০; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৫৩-১৭৮; মাহমূদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৪৫-৫০)।
পরিভাষার বিস্তারিত ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক। তবে আমরা সাধারণ পাঠকদের জন্য বলতে পারি যে, যে পর্যায়ের প্রমাণাদির ভিত্তিতে একজন বিচারক খুনের অভিযোগে অভিযুক্তকে বিস্তারিত শাস্তি দেন, কিন্তু মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন শাস্তি প্রদান করেননা, সেই পর্যায়ের প্রমাণাদির ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ একটি হাদীসকে ‘হাসান’ বলে গণ্য করেন। যে সকল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ আরবীতে সত্যপরায়ণ, অসুবিধা নেই, চলনসই ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন।
১.৪.৭.৩. ‘যয়ীফ’ বা দুর্বল হাদীস
যে ‘হাদীসের’ মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলির মধ্যে কোনো একটি অবিদ্যমান থাকে, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে ‘যয়ীফ’ হাদীস বলা হয়। অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি, সনদের মধ্যে কোনো একজন রাবী বা তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে থেকে সরাসরি বা স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেননি বলে প্রমাণিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ বিদ্যমান থাকা…..ইত্যাদি যে কোনো একটি বিষয় কোনো হাদীসে বিদ্যমান থাকলে হাদীসটি ‘যয়ীফ’ বলে গণ্য।(ইরাকী, আত তাকয়ীদ, পৃ.৬২; ফাতহুর মুগীস পৃ.৪৯; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/১১১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৭৯; মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহ, পৃ. ৬২-৬৩)।
শর্ত পাঁচটির ভিত্তিতে যয়ীফ হাদীসকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন মুহাদ্দিসগণ। সেগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক। তবে আমরা বুঝতে পারি যে, কোনো হাদীসকে যয়ীফ বলে গণ্য করার অর্থ হলো, হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। বর্ণনাকারীদের দুর্বলতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমনঃ দুর্বল, কিছুই নয়, মূল্যহীন, অজ্ঞাত পরিচয়, জঘন্য উল্টাপাল্টা হাদীস বর্ণনাকারী, পরিত্যক্ত, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি।
‘যয়ীফ’ বা দুর্বল হাদীসের দুর্বলতার তিনটি পর্যায় রয়েছে।
১.৪.৭.৩.১. কিছুটা দুর্বল
বর্ণনাকারী ভুল বলেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়, কারণ তিনি যতগুলো হাদীস বলেছেন তার মধ্যে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। তবে তিনি ইচ্ছাকৃত ভুল বলতেননা বলেই প্রমাণিত। এরূপ ‘যয়ীফ’ হাদীস যদি অন্য এক বা একাধিক পর্যায়ের কিছুটা যয়ীফ সূত্রে প্রমাণিত হয় তাহলে তা হাসান বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বলে গণ্য হয়।
১.৪.৭.৩.২. অত্যন্ত দুর্বল(যায়ীফ জিদ্দান, ওয়াহী)
এইরূপ হাদীসের বর্ণনাকারীর সকল হাদীস তুলনামূলক নিরীক্ষা করে যদি প্রমাণিত হয় যে, তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ বা সকল হাদীসই অগণিত ভুলে ভরা, যে ধরনের ভুল সাধারণত অনিচ্ছাকৃতভাবে হয় তার চেয়েও মারাত্মক ভুল, তবে তার বর্ণিত হাদীস পরিত্যক্ত, একেবারে অগ্রহণযোগ্য বা অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করা হবে। এরূপ দুর্বল হাদীস অনুরূপ অন্য দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হলেও তা গ্রহণযোগ্য হয়না।
১.৪.৭.৩.৩. মাউযূ বা বানোয়াট হাদীস
যদি প্রমাণিত হয় যে, এরূপ দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে সমাজে প্রচার করতেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীসের সূত্র(সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কম বেশি করতেন, তবে তার বর্ণিত হাদীসকে ‘মাউযূ’ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য করা হয়। বানোয়াট হাদীস জঘন্যতম দুর্বল হাদীস।(বিস্তারিত দেখুনঃ হাকিম নাইসাপুরী(৪০৫ হি), মারি’ফাতু উলুমিল হাদীস, পৃ. ১৪-১৭. ৩৬-৪০, ৫২-৬২, ১১২-১৫১, আল ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৭-৫১, ১৩৮-১৭৮, আত তাকয়ীদ ওয়াল ইদাহ, পৃ.২৩-৬৩, ১৩৩-১৫৭, ৪২০-৪২১, ড. মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৩-১২৫, ১৪৪-১৫৫)।
১.৪.৮. গ্রন্থাকারে হাদীস সংকলন ও সংরক্ষণ
জালিয়াতি ও মিথ্যা থেকে হাদীসকে হেফাজতের জন্য মুহাদ্দিসগণের অন্যতম কর্ম ছিল গ্রন্থাকারে সনদসহ সকল হাদীস সংকলন করা। আমরা দেখেছি যে, তাবিয়ীগণের যুগ বা প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই শিক্ষা, মুখস্ত ও শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে হাদীস লিখে রাখার প্রচলন ছিল। তবে নির্দিষ্ট নিয়মে গ্রন্থাকারে হাদীস সংকলন শুরু হয় দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে। তৃতীয় হিজরী শতকে এই কর্ম পূর্ণতা লাভ করে। পরবর্তী দুই শতাব্দীতেও সনদসহ হাদীস সংকলনের ধারা চালু থাকে এবং কিছু গ্রন্থ সংকলিত হয়। প্রত্যেক যুগের মুহাদ্দিসগণ পূর্ববর্তীযুগের মুহাদ্দিসগণের সংকলিত হাদীসগুলি সনদসহ সংকলিত করেন। এছাড়া তাঁরা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সফর ও হাদীস সংগ্রহ অভিযান চালিয়ে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত সকল হাদীস সংগ্রহ ও সনদ সহ সংকলিত করেন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এসকল গ্রন্থ সংকলিত হয়ঃ
১. সনদসহ প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করা।
২. শুধুমাত্র বিশুদ্ধ বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস সংকলন করা।
৩. বর্ণনাকারীদের বিবরণসহ তাঁদের বর্ণিত হাদীস সংকলন করা।
৪. শুধুমাত্র অনির্ভরযোগ্য বা বানোয়াট হাদীস সংকলন করা।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় ৪ শতাব্দী পর্য্ন্ত হাদীস সংকলনের যে ধারা চালু থাকে এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত ও প্রচারিত সকল হাদীস সংকলিত করা। যাতে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষাভিত্তিক বিধানের আলোকে এগুলির মধ্য থেকে বিশুদ্ধ ও নির্ভুল হাদীস বেছে নিতে পারেন। অনেকে বর্ণনাকারী রাবী বা বর্ণনাকারী সাহাবীর নামের ভিত্তিতে হাদীস সংকলিত করতেন। সবারই মূল উদ্দেশ্য ছিল হাদীস নামে প্রচলিত সব কিছু সংকলিত করা।
এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ হাদীস গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ সকল প্রকারের হাদীস সংকলিত হয়েছে। এখানে অজ্ঞতার কারণে অনেকে ভুল ধারণায় পড়েন। উপরের পরিচ্ছেদগুলিতে আলোচিত সাহাবী ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসদের হাদীস বিচার, সনদ যাচাই, নিরীক্ষা ইত্যাদি থেকে অনেকে মনে করেন যে, মুহাদ্দিসদের এসকল বিচার ও নিরীক্ষার মাধ্যমে যাদের ভুল বা মিথ্যা ধরা পড়েছে তাদের হাদীসতো তারা গ্রহণ করেনন এবং সংকলনও করেননি। কাজেই কোনো হাদীসের গ্রন্থে হাদীস সংকলনের অর্থই হলো এসকল হাদীস নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে বলেই উক্ত মুহাদ্দিস হাদীসগুলিকে তাঁর গ্রন্থে সংকলিত করেছেন।
এই ধারণাটি একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত এবং প্রকৃত অবস্থার একেবারেই বিপরীত। কয়েকজন সংকলক বাদে কোনো সংকলকই শুধুমাত্র বিশুদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ রচনা করেননি। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, আলিম ও ইমাম হাদীস সংকলন করেছেন সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট সকল প্রকার হাদীস সনদসহ একত্রিত করার উদ্দেশ্যে; যেন রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত বা প্রচারিত সবকিছুই সংরক্ষিত হয়। তাঁরা কোনো হাদীসই রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বা কাজ হিসেবে সরাসরি বর্ণনা করেননি। বরং সনদসহ, কে তাদেরকে হাদীসটি কার সূত্রে বর্ণনা করেছেন তা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা মূলত বলেছেন, “অমুক ব্যক্তি বলেছেন যে, ‘এই কথাটি হাদীস’, আমি তা সনদসহ সংকলিত করলাম।” হাদীস প্রেমিক পাঠকগণ এবার সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস বেছে নিন। এ সকল সংকলকের কেউ কেউ আবার হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে তার সনদের আলোচনা করেছেন। এ সকল সংকলকের কেউ কেউ আবার হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে তা সনদের আলোচনা করেছেন এবং দুর্বলতা বা সবলতা বর্ণনা করেছেন।
অল্প কয়েকজন সংকলক শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল বুখারী(২৫৬ হি) ও ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল কুশাইরী(২৬১ হি)অন্যতম। তাঁদের পরে আবদুল্লাহ ইবনু আলী ইবনুল জারূদ(৩০৭ হি), মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক ইবনু খুযাইমা(৩১১ হি), আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ, ইবনুশ শারকী(৩২৫ হি), কাসিম ইবনু ইউসুফ আল বাইয়ানী(৩৪০ হি), সাঈদ ইবনু উসমান, ইবনুস সাকান(৩৫৩ হি), আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনু হিব্বান আল বুসতি(৩৫৪ হি), আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ হাকিম নাইসাপূরী(৪০৫হি), যিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহিদ আল মাকদিসী(৬৪৩ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস শুধুমাত্র সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করে ‘সহীহ’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। (কাত্তানী, আর-রিসালাতুল মুসতাতরাফা, পৃ.২০-২৬)।
কিন্তু পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্থদ্বয়ের সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাকী কোনো গ্রন্থেরই সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হয়নি। বরং কোনো কোনো গ্রন্থে যয়ীফ, বাতিল ও মিথ্যা হাদীস সংকলিত হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বাদশ হিজরী শতকের অন্যতম আলিম হযরত ইমাম শাহ ওয়ালীওল্লাহ দেহলভী(১১৭৬ হি/১৭৬২ খ্রী.) হাদীসের গ্রন্থগুলিকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে তিনখানা গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক। এই তিনখানা গ্রন্থের সকল সনদসহ বর্ণিত হাদীসই গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে সে সকল গ্রন্থ যেগুলির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলোতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। মোটামুটিভাবে মুসলিম উম্মাহ এ সকল গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন এবং তাদের মধ্যে এগুলি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই পর্যায়ে রয়েছে তিনটি গ্রন্থঃ সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী। ইমামা আহমাদ এর মুসনাদ ও প্রায় একই পর্যায়ের।
তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিস এর আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে বিশুদ্ধ, দুর্বল, মিথ্যা, ভুল সব ধরনের হাদীসই রয়েছে, যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিস ভিন্ন এ সকল গ্রন্থ হতে লাভবান হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দিসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এই পর্যায়ে রয়েছেঃ মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফে ইবনু আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবনু হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বাইহাকীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ(সুনানে কুবরা, দালাইলুন নবুওয়্যাত, শুয়াবুল ঈমান, …………ইত্যাদি), ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ(শারহ মায়ানাল আসার, শারহ মুশকিলিল আসার,….ইত্যাদি), তাবারানীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ(আল মু’জামুল কবীর, আল মু’জামুল আওসাত, আল মু’জামুস সাগীর,……..ইত্যাদি)। এ সকল গ্রন্থের সংকলকদের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তাঁরা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেননি।
চতূর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলি হলো ঐ সকল গ্রন্থ যা কয়েক যুগ পরে সংকলিত হয়। এ সকল গ্রণ্থের সংকলকরা মূলত নিম্ন পর্যায়ের হাদীস সংকলন করেছেনঃ (১) যে সকল হাদীস পূর্ব যুগে অপরিচিত বা অজানা থাকার কারণে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়নি, (২) যে সকল হাদীস কোনো অপরিচিত গ্রন্থে সংকলিত ছিল, (৩)লোকমুখে প্রচলিত বা ওয়াযেদের ওয়াযে প্রচারিত বিভিন্ন কথা, যা কোনো হাদীসের গ্রন্থে স্থান দেয়নি, (৪) বিভিন্ন দুর্বল ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কথাবার্তা, (৫)যে সকল ‘হাদীস’ মূলত সাহাবী বা তাবেয়ীদের কথা, ইহুদীদের গল্প বা পূর্ববর্তী যামানার জ্ঞানী ব্যক্তিদের কথা, সেগুলিকে ভুলক্রমে বা ইচ্ছাপূর্বক কোনো বর্ণনাকারী হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, (৬)কুরআন বা হাদীসের ব্যাখ্যা জাতীয় কথা যা ভুলক্রমে কোনো সৎ বা দরবেশ মানুষ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, (৭) হাদীস থেকে উপলব্ধিকৃত অর্থকে কেউ কেউ ইচ্ছাপূর্বক হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন, অথবা (৮) বিভিন্ন সনদে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের বাক্যকে একটি হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন। এ ধরনের হাদীসের সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ইবনে হিব্বানের আদ দুয়াফা, ইবনে আদীর আল কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নুয়াইম আল আসফাহানী, ইবনে আসাকের, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ। খাওয়ারিজমী কর্তৃক সংকলিত মুসনাদ ইমাম আবু হানীফাও প্রায় এই পর্যায়ে পড়ে। এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় দুর্বল বা বানোয়াট।
পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্থসমূহে ঐ সকল হাদীস রয়েছে যা ফকীহগণ, সূফীগণ বা ঐতিহাসিকগণের মধ্যে প্রচলিত ও তাঁদের লেখা বইয়ে পাওয়া যায়। যে সকল হাদীসের কোনো অস্তিত্ব পূর্বের চার পর্যায়ের গ্রন্থে পাওয়া যায়না। এসব হাদীসের মধ্যে এমন হাদীসও রয়েছে যা কোনো ধর্মচ্যূত ভাষাজ্ঞানী পন্ডিত পাপাচারী মানুষ তৈরি করেছেন। তিনি তার বানোয়াট হাদীসের জন্য এমন সনদ তৈরি করেছেন যার ত্রুটি ধরা দুঃসাধ্য, আর তার বানোয়াট হাদীসের কথাও এমন সুন্দর যে রাসূলুল্লাহ(স)এর কথা বলে সহজেই বিশ্বাস হবে। এ সকল বানোয়াট হাদীস ইসলামের মধ্যে সুদূরপ্রসারী বিপদ ও ফিতনা সৃষ্টি করেছে। তবে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ হাদীসের ভাষা ও সূত্রের(সনদের) তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তার ত্রুটি খুঁজে বের করতে সক্ষম হন।
শাহ ওয়ালউল্লাহ(রাহ) বলেনঃ প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্থের উপরই শুধু মুহাদ্দিসগণ নির্ভর করেছেন। তৃতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্থসমূহ থেকে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ইলমুর রিজাল ও ইলাল শাস্ত্রে পন্ডিত বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ ছাড়া কেউ উপকৃত হতে পারেননা, কারণ এ সকল গ্রন্থে সংকলিত হাদীসসমূহের মধ্য হতে মিথ্যা হাদীস ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের পার্থক্য শুধু তাঁরাই করতে পারেন। আর চতুর্থ পর্যায়ের হাদীসগ্রন্থসমূহ সংকলন করা বা পাঠ করা এক ধরনের জ্ঞান বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। সত্য বলতে, রাফেযী, মুতাযিলী ও অন্যান্য সকল বিদ’আতী ও বাতিল মতের মানুষেরা খুব সহজেই এ সকল গ্রন্থ থেকে তাদের মতের পক্ষে বিভিন্ন হাদীস বের করে নিতে পারবেন। কাজেই, এ সকল গ্রন্থের হাদীস দিয়ে কোনো মত প্রতিষ্ঠা করা বা কোনো মতের পক্ষে দলীল দেওয়া আলেমদের নিকট বাতুলতা ও অগ্রহণযোগ্য। (শাহ ওয়ালীওল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১/৩৮৫-৩৯১)।
এখানে উল্লেখ্য যে, হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় এবং সহীহ হাদীসকে দুর্বল ও মাউযূ হাদীস থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণের দৃঢ়তা ছিল আপোষহীন ও অনমনীয়। দুনিয়ার বুকে কোনো যুগে কোনো ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ বা আলিম কখনো বলেননি যে, কোনো হাদীসের গ্রন্থে একটি হাদীস বর্ণিত থাকলেই হাদীসকে সহীহ বলা যাবে। অমুক আলিম যেহেতু হাদীসটি সংকলন করেছেন, কাজেই হাদীসটি হয়তো সহীহ হবে।
তেমনিভাবে সংকলক যত মর্যাদাসম্পন্নই হোক, তাঁর সংকলিত কোনো হাদীসের মধ্যে দুর্বলতা বা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার সম্ভাবনা থাকলে তা স্পষ্টরূপে বলতে কোনো দ্বিধাই তাঁরা কখনোই করেননি। হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষাকে তাঁরা সকল ব্যক্তিগত ভালবাসা ও শ্রদ্ধার উপরে স্থান দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের নামে সকল মিথ্যা ও ভুল চিহ্নিত করে বিশুদ্ধ হাদীসকে ভুল ও মিথ্যা ‘হাদীস’ থেকে পৃথক রাখার এই প্রবল দৃঢ়তার কারণেই মুহাদ্দিসগণ কখনোই কারো দাবী বিনা যাচাইয়ে মেনে নেননি। তাঁরা কখনোই মনে করেননি যে, অমুক মহান ব্যক্তিত্ব যেহেতু হাদীসটিকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন, সেহেতু তাঁর মতামত বিনা যাচাইয়ে মেনে নেওয়া উচিত।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সহ উপরের সকল ‘সহীহ’ হাদীসের গ্রন্থে সংকলিত প্রতিটি হাদীসের সনদ পরবর্তী কয়েক শতাব্দী যাবৎ মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিরীক্ষা পদ্ধতিতে বিচার ও যাচাই করেছেন। এই বিচারের মাধ্যমেই তাঁরা ঘোষণা দিয়েছেন যে, বুখারী ও মুসলিম তাঁদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে সংকলিত সকল হাদীস ‘সহীহ’ বলে মেনে নেওয়ার কারণ এই নয় যে, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদীসগুলিকে সহীহ বলেছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত মর্যাদা এখানে একেবারেই মূল্যহীন। প্রকৃত বিষয় হলো, তাঁরা হাদীসগুলিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে মুহাদ্দিসগণ তাঁদের সংকলিত হাদীসগুলির সনদ যাচাই করেছেন এবং তাঁদের দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
অন্য আরো লেখক শুধুমাত্র সহীহ বা সহীহ ও হাসান হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ রচনা করেছেন। কেউ কেউ সহীহ ও যয়ীফ হাদীস সংকলন করবেন ও জাল ও মাঊদু হাদীস বাদ দিবেন বলে ঘোষণা করেছেন। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ তাঁদের দাবি কখনোই বিনা যাচাইয়ে মেনে নেননি। বরং তাঁদের সংকলিত সকল হাদীস যাচাই করে তাঁদের গ্রন্থাবলীর বিষয়ে বিধান প্রদান করেছেন। এ সকল যাচাইয় দেখা গিয়েছে যে, অধিকাংশ লেখক ও সংকলকই তাঁদের ঘোষণা ও সংকল্প পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারো দাবিই মুহাদ্দিসগণ বিনা যাচাইয়ে গ্রহণ করেননি।
১.৪.৯. গ্রন্থাকারে রাবীগণের পরিচয় সংরক্ষণ
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী হতে মুহাদ্দিসগণ সনদসহ সকল হাদীস সংকলন করেন, যেন সনদ পর্যালোচনা করে বিশুদ্ধ হাদীসকে মিথ্যা বা ভুল থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায়।
দ্বিতীয় হিজরী শতক হতে মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংকলনের পাশাপাশি রাবীগণের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক তথ্যাবলী গ্রন্থাকারে সংকলন করতে থাকেন; যেন এ সকল তথ্যের আলোকে হাদীসগ্রন্থগুলিতে সংকলিত হাদীসগুলির সনদ বিচার করা যায়। এই জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়নেও ক্রম বিবর্তন ঘটে।
২য় হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে মুহাদ্দিসগণে প্রথমে নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য সকল বর্ণনাকারীর বিবরণ একত্রে সংকলন করতে শুরু করেন। ইমাম লাইস ইবুন সা’দ(১৭৫ হি), আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক(১৮১ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস দ্বিতীয় হিজরীর মাঝামাঝি হতে এই জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়ন শুরু করেন। এ সকল গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য, অনির্ভরযোগ্য সকল রাবীর জীবনী, তাদের বর্ণিত কিছু হাদীস ও তাদের বর্ণিত হাদীসের নিরীক্ষার ভিত্তিতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক বিধান সংকলিত হয়েছে। পরবর্তী শতকগুলোতে এ জাতীয় গ্রন্থ রচনার ধারা অব্যাহত থাকে। তৃতীয় হিজরী শতকে আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আলী ইবনুল মাদানী, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ও পরবর্তী যুগের অগণিত মুহাদ্দিস এই জাতীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ শুধুমাত্র মুহাদ্দিসগণ ও মিথ্যাবাদী রাবীদের বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। দ্বিতীয় শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল কাত্তান(১৯৮ হি) সর্বপ্রথম ‘আদ-দুআফা’ নামে এই জাতীয় গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। পরবর্তী শতকগুলোতে এ জাতীয় গ্রন্থ রচনার ধারা অব্যাহত থাকে। এ সকল গ্রন্থে দুর্বল ও মিথ্যাবাদী রাবীগণ, তাদের বর্ণিত কিছু হাদীস ও তাদের বিষয়ে ইমামদের মতামত সংকলন করা হয়েছে। এগুলির পাশাপাশি তৃতীয় হিজরী শতক থেকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত রাবীদের বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা শুরু করেন।
বস্তুত, রাবীগণের বিবরণ সংগ্রহ ও সংকলন মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণের একটি অতুলনীয় কর্ম। প্রথম হিজরী শতাব্দী থেকে পরবর্তী ৬০০ বৎসর যাবত মুহাদ্দিসগণ মুসলিম দেশের প্রতিটি জনপদ ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক রাবীর নাম, বংশ, জন্ম, মৃত্যু, শিক্ষা, কর্ম, শিক্ষক, ছাত্র ইত্যাদি ব্যক্তিগত সকল তথ্যসহ তাঁর বর্ণিত হাদীসের নিরীক্ষা ও নিরীক্ষার ভিত্তিতে তার সম্পর্কে তার সমসাময়িক ও পরবর্তী মুহাদ্দিসগণের মতামত ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে সংরক্ষণ করেছেন। হাদীসে রাসূলকে বিকৃতি ও জালিয়াতি থেকে সংরক্ষণ করার জন্য তাঁরা এভাবে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের তথ্য সংরক্ষণ করছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এর কোনো নযির নেই। এ সকল তথ্যের ভিত্তিতে যে কোনো যুগে যে কোনো গবেষক যে কোনো হাদীসের সনদ বিচার ও নিরীক্ষা করতে সক্ষম হন।
১.৪.১০. জাল হাদীস গ্রন্থাকারে সংরক্ষণ
১.৪.১০.১. মিথ্যাবাদী রাবীদের পরিচয় ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা
হাদীসের নামে মিথ্যা চিহ্নিত করার জন্য অন্যতম পদক্ষেপ ছিল মিথ্যাবাদীদের জালিয়াতি পৃথকভাবে সংকলন করা।এক্ষেত্রে প্রথম পদ্ধতি ছিল দুর্বল ও মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারীদের বিষয়ে সংকলিত গ্রন্থগুলি।
ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলো ছিল ইসলামী জ্ঞান ও বিশেষত হাদীস চর্চার স্বর্ণযুগ। হাজার হাজার শিক্ষার্থী হাদীস শিক্ষা করতেন। শত শত মহাদ্দিস, ইমাম সমাজে বিদ্যমান। সবাই সনদসহ হাদীস শুনতেন ও শেখাতেন। সনদের মধ্যে উল্লেখিত কোনো ব্যক্তির পরিচয় জানা না থাকলে জেনে নিতেন। সেই যুগে মিথ্যাবাদী রাবীদের নাম ও পরিচয় জানা থাকলেই তাদের মিথ্যা ও জালিয়াতি থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব ছিল। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে সংকলিত অনেক হাদীস গ্রন্থই বিষয়ভিত্তিক না সাজিয়ে বর্ণনাকারী রাবী বা সাহাবীগণের নামের ভিত্তিতে সাজানো হতো। কারণ রাবীর ভিত্তিতেই হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা। এছাড়া সবাই সকল হাদীস পড়তেন। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বিষয়ের হাদীস পড়ার প্রবণতা তখন ছিলনা।
এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, দ্বিতীয় হিজরী ৬ষ্ঠ হিজরী পর্য্ন্ত ৪ শতাব্দী যাবৎ হাদীসের নামে প্রচারিত ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে অন্যতম কর্ম ছিল দুর্বল ও মিথ্যাবাদী রাবীদের বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা করা। এ সকল গ্রন্থে এ সকল রাবীদের নাম, পরিচয়, তাদের বর্ণিত কিছু ভুল বা মিথ্যা হাদীস, তাদের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষার ফলাফল ও মতামত সংকলিত করা হতো।
১.৪.১০.২. মিথ্যা বা জাল হাদীস সংকলন
৬ষ্ঠ হিজরী শতক পর্য্ন্ত এই জাতীয় গ্রন্থগুলিই ছিল হাদীসের নামে, মিথ্যাচারী ও তাদের মিথ্যাচার সম্পর্কে জানার প্রধান উৎস। ৬ষ্ঠ শতকের পরও এই জাতীয় গ্রন্থ রচনা অব্যাহত থাকে। তবে জাল হাদীস চিহ্নিত করণ প্রক্রিয়ায় নতুন ধারার সৃষ্টি হয়।
কালের আবর্তনে হাদীস চর্চাসহ জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মুসলিস উম্মাহর মধ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়। বর্ণনাকারীদের পরিচয় জানার আগ্রহ কমতে থাকে। স্বল্প সময়ে ও স্বল্প চেষ্টায় যে কোনো জিনিস শিখে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। রাবীদের নামের ভিত্তিতে সংকলিত গ্রন্থ থেকে মিথ্যা হাদীস জেনে নেওয়ার সময় ও আগ্রহ হ্রাস পায়। এজন্য মুহাদ্দিসগণ বিষয়ভিত্তিক জাল ও বানোয়াট হাদীস সংকলন শুরু করেন যেন পাঠক সহজেই কোনো বিষয়ে কোনো হাদীস জাল কিনা তা জেনে নিতে পারেন। ৫ম হিজরী শতক থেকে এই জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়ন শুরু হয়। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ইবনুল জাউযীর কর্মের মাধ্যমে এই ধারা বিশেষভাবে গতিলাভ করে। বর্তমান যুগ পর্য্ন্ত তা অব্যাহত আছে। প্রথম দিকে মুহাদ্দিসগণ এ সকল মাঊদূ হাদীস সনদ সহকারে উল্লেখ করে সনদ আলোচনার মাধ্যমে এগুলির মিথ্যাচার প্রমাণ করতেন। পরবর্তী সময়ে সনদ উল্লেখ ব্যতিরেকে শুধুমাত্র বানোয়াট হাদীসগুলি একত্রে সংকলন করা হয়।
এ সকল গ্রন্থের মধ্যে কিছু বিষয়ভিত্তিক বিন্যস্ত। কিছু গ্রন্থে হাদীসের প্রথম অক্ষর অনুসারে(Alphabetacilly) সাজানো হয়। অধিকাংশ মুহাদ্দিস শুধুমাত্র মাঊযূ হাদীস একত্রিত করেন।কোনো কোনো মুহাদ্দিস সমাজে প্রচলিত হাদীস সমূহ একত্রিত করে সেগুলোর মধ্যে কোনটি সহীহ ও কোনটি বানোয়াট তা বর্ণনা করেন। কেউ কেউ বানোয়াট হাদীস ছাড়াও দুর্বল হাদীস ও সংকলিত করেছেন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই বিষয়ে গত ৯ শতাব্দীতে অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এখানে এই জাতীয় প্রধান গ্রন্থগুলি ও লেখকদের নাম উল্লেখ করছি।
১. আল মাউদূআত, আবু সাঈদ মুহাম্মাদ ইবুন আলী আন-নাক্কাশ(৪১৪ হি)।
২. যাখীরাতুল হুফফায, মুহাম্মাদ ইবনু তাহির ইবনুল কাইসুরানী(৫০৭ হি)।
৩. আল-আবাতীল ওয়াল মানাকীর, হুসাইন ইবনু ইবরাহীম আল-জূযকানী(৫৪৩ হি)।
৪. কিতাবুল কুসসাল ওয়াল মুযাককিরীন, আবুল ফারাজ আব্দুর রাহমান ইবনু আলী, ইবনুল জাউযী(৫৯৭ হি)।
৫. আল-মাউদূআত, আবুল ফারাজ, ইবনুল জাউযী(৫৯৭ হি)।
৬. আল ইলালুল মুতানাহিয়া, আবুল ফারাজ ইবনুল জাউযী(৫৯৭ হি)।
৭. আল আহাদীসুল মাউদূআহ ফীল আহকামিল মাশরূআ, আবু হাফস উমার ইবনু বাদর আল মাউসিলী(৬২২ হি)।
৮. আল মুগনী আন হিফযিল কিতাব, উমার আল মাউসিলী(৬২২ হি)।
৯. আল উকূফ আলাল মাউকূফ, উমার আল মাউসিলী(৬২২ হি)।
১০. আল-মাঊদূআত, হাসান ইবনু মুহাম্মাদ আস-সাগানী(৬৫০ হি)।
১১. আদ-দুররুল মুলতাকিত, আস-সাগানী(৬৫০ হি)।
১২. আহাদীসুল কুসসাস, আহমাদ ইবুন আব্দুল হালীম, ইবনু তাইমিয়া(৭২৮ হি)।
১৩. মুখতারাসুল আবাতীল, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ যাহাবী(৭৪৮ হি)।
১৪. তারতীবু মাউদূআতি ইবনিল যাওযী, যাহাবী(৭৪৮ হি)।
১৫. আল মাঊদূআত ফিল মাসাবীহ, উমার ইবনু আলী আল কাযবীনী(৭৫০ হি)।
১৬. আল-মানারুল মুনীফ, ইবনু কাইয়িম আল জাউযিয়্যাহ(৭৫১ হি)।
১৭. আল আহাদীস আল্লাতী লা আসলা লাহা ফিল এহইয়া, আব্দুল ওয়াহাব ইবনু আলী আস-সুবকী(৭৭১ হি)।
১৮. আত-তাযকিরা ফিল আহাদীসিল মুশতাহিরা, মুহাম্মাদ ইবনু বাহাদুর আয-যারকাশী(৭৯৪ হি)।
১৯. তাবঈনুল আজাব ফী মা ওরাদা ফী শাহরী রাজাব, ইবনু হাজর আসকালানী আহমাদ ইবনু আলী(৮৫২ হি)।
২০. আল-মাকাসিদুল হাসানাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান সাখাবী(৯০২ হি)।
২১. আল-লাআলী আল-মাসনূআহ, জালালুদ্দীন আব্দুর রাহমান সুয়ূতী(৯১১ হি)।
২২. আত-তাআক্কুবাত আলাল মাউদূআত, সুয়ূতী(৯১১ হি)।
২৩. আদ-দুরারুল মুনতাশিরাহ, সুয়ূতী(৯১১ হি)।
২৪. তাহযীরুল খাওয়াস মিন আহাদীসিল কুসসাস, সুয়ূতী(৯১১ হি)।
২৫. আল গাম্মায আলাল লাম্মায, আলী ইবনু আব্দুল্লাহ আস-সামহুদী(৯১১ হি)।
২৬. তাময়ীযূত তাইয়ীবি মিনাল খাবিস, আব্দুর রাহমান আয যাবীদী(৯৪৪ হি)।
২৭. আশ-শাযারাহ ফীল আহাদীসিল, মুশতাহিরাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আলী আদ-দিমাশকী(৯৫৩ হি)।
২৮. তানযীহুশ শারীয়াহ, আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ইরাক(৯৬৩ হি)।
২৯. তাযকিরাতুল মাউদূআত, মুহাম্মাদ তাহির ফাতানী(৯৮৬ হি)।
৩০. আল আসরারুল মারফূআহ, মুল্লা আলী কারী(১০১৪ হি)।
৩১. আল মাসনূ ফী মা’রিফাতুল মাঊদী, মুল্লা আলী কারী(১০১৪ হি)।
৩২. মুখতাসারুল মাকাসিদ, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী(১১২২ হি)।
৩৩. আল জাদ্দুল হিসসীস ফী বায়ানি মা লাইসা বিহাদীস, আহমদ ইবনু আব্দুল কারীম আমিরী(১১৪৩ হি)।
৩৪. কাশফুল খাফা ওয়া মুযিলুল ইলবাস, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আল আজলূনী(১১৬২ হি)।
৩৫. আল কাশফুল ইলাহী আন শাদীদিদ দা’ফি ওয়াল মাউদূ ওয়াল ওয়াহী, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ আত-তারাবলুসী(১১৭৭ হি)।
৩৬. আন-নাওয়াফিহুল আতিরাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আস-সান‘আনী(১১৮১ হি)।
৩৭. আন-নুখবাতুল বাহিয়্যাহ, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ আস-সাবনাবী(১২৩২ হি)।
৩৮. আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ, মুহাম্মাদ ইবনু আলী শাওকানী(১২৫০ হি)।
৩৯. আসনাল মাতালিব, মুহাম্মাদ ইবনু সাইয়িদ দারবীশ(১২৭৬ হি)।
৪০. হুসনুল আশার, মুহাম্মাদ দারবীশ(১২৭৫ হি)।
৪১. আল আশারুল মারফূআহ, আব্দুল হাই লাখনাবী(১৩০৪ হি)।
৪২. আল লু’লু আল মারসূ, মুহাম্মাদ ইবনু খালীল আল মাশীশী(১৩০৫ হি)।
৪৩. তাহযীরুল মুসলিমীন, মুহাম্মাদ ইবনুল বাশীর আল মাদানী(১৩২৯ হি)।
বর্তমান শতকেও এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। প্রিয় পাঠক, এখন আমাদের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, একই বিষয়ে এত গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা কি?
আসল বিষয় হলো দ্বিতীয় হিজরী শতক শুরু হওয়ার পর হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রচেষ্টা কখনো থামেনি। পরবর্তী অনুচ্ছেদে জালিয়াত ও জালিয়াতির পরিচিতির আলোচনায় আমরা এসকল বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারব। ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা যেমন অব্যাহত থেকেছে, তেমনি সে সকল মিথ্যাকে চিহ্নিত করা ও বিশুদ্ধ হাদীস থেকে তা পৃথক করার প্রচেষ্টাও অব্যাহত থেকেছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে নতুন নতুন কথা হাদীসের নামে প্রচারিত হয়েছে। তখন সেই দেশের প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ গবেষণার মাধ্যমে সেগুলির সত্যতা ও অসত্যতা নির্ণয় করেছেন। এ সকল কথা কোনো হাদীসের গ্রন্থে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে কিনা, সনদের গ্রহণযোগ্যতা কিরূপ, এই অর্থে অন্য কোনো হাদীস বর্ণিত হয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয় তাঁরা নির্ণয় করেছেন। এছাড়া পূর্ববর্তী গবেষকদের সিদ্ধান্তে কোনো ভুল থাকলে তা পরবর্তী লেখকগণ আলোচনা করেছেন। এভাবে এ বিষয়ে লেখনী ও গবেষণার ধারা অব্যাহত থেকেছে।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, গত দেড় হাজার বছরে সকল যুগে ও সকল শতকে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ হাদীসে রাসূলের হেফাযতে জাগ্রত প্রহরায় সদা সতর্ক থেকেছেন। তাঁরা সদা সর্বদা চেষ্টা করেছেন রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের নামে মিথ্যাচারের সকল প্রচেষ্টা চিহ্নিত করে হাদীস নামের মিথ্যা কথার খপ্পর থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করার। মহান আল্লাহ এ সকল মানুষদেরকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।