প্রথম পর্ব
হাদীস ও হাদীসের নামে জালিয়াতি
১.১. ওহী ও হাদীস
১.১.১. ওহী এবং মানবতার সংরক্ষণে তার গুরুত্ব
মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি মানবজাতিকে অত্যন্ত ভালবাসেন। মানুষকে তিনি সৃষ্টির সেরা হিসেবে তৈরি করেছেন। তাকে দান করেছেন জ্ঞান, বিবেক, যুক্তি ও বিবেচনা শক্তি যা তাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। মানুষের এই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষ তার জ্ঞান, বিবেক ও বিবেচনা দিয়ে তার পার্থিব জগতের বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারে এবং নিজেকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে পারে, কিন্তু তার ইন্দ্রিয়ের বাইরের কিছু সে জানতে পারেনা। এজন্য ইন্দ্রিয়ের অতীত কোনো বিষয়ে মানুষের জ্ঞান, বিবেক বা যুক্তি দিয়ে সঠিক সমাধানে পৌছাতে অনুরূপভাবে সক্ষম হয়না। আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালেই তা বুঝতে পারি।
জাগতিক বিষয়গুলি মানূষ অভিজ্ঞতা ও গবেষণার মাধ্যমে জানতে পারে। কিভাবে চাষ করলে বেশি ফল ফসল হবে, কিভাবে বাড়ি বানালে বেশি টেকসই হবে, কিভাবে গাড়ি চালালে দ্রুত চলবে, কিভাবে রান্না করলে খাদ্যমানের বেশি সাশ্রয় হবে, কিভাবে ব্যবসা করলে লাভ বেশি হবে বা পুঁজির নিরাপত্তা বাড়বে, কিভাবে চিকিৎসা করলে আরোগ্যের সম্ভাবনা, নিশ্চয়তা বা হার বাড়বে ইত্যাদি বিষয় মানবীয় অভিজ্ঞতা, গবেষণা, যুক্তি ও চিন্তার মাধ্যমে জানা যায়।
কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাস, কর্ম ও আচার আচরণ বিষয়ক জ্ঞান কখনো অভিজ্ঞতা বা ঐন্দ্রিক জ্ঞানের মাধ্যমে জানা যায়না। আল্লাহর সম্পর্কে বিশ্বাস কিরূপ হতে হবে, কিভাবে নবী রাসূলগণের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে, পরকালের সঠিক বিশ্বাস কি, কিভাবে আল্লাহকে ডাকতে হবে, কোন্ কর্ম করলে তাঁর রহমত ও বরকত বেশি পাওয়া যাবে, কিভাবে চললে আখিরাতে মুক্তির সম্ভাবনা বাড়বে, কোন্ পদ্ধতিতে চললে দ্রুত আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জন করা যাবে, কোন্ কাজ করলে বেশি সওয়াব অর্জন করা যাবে, কোন্ কর্মে পাপের ক্ষমালাভ হয় ইত্যাদি অধিকাংশ ধর্মীয় ও বিশ্বাসীয় বিষয় কখনোই অভিজ্ঞতা বা গবেষণার মাধ্যমে চূড়ান্তরূপে জানা যায়না বা এ বিষয়ক কোনো সমস্যা গবেষনা বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে চূড়ান্ত সমাধান করা যায়না।
এজন্য আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে সৃষ্টির সেরা রূপে সৃষ্টি করার পরও তার পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে নবী রাসূলগণ প্রেরণ করেছেন। তিনি যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কিছু মহান মানুষকে বেছে নিয়ে তাদের কাছে তাঁর বাণী, ওহী বা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন। মানুষ যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেক, গবেষণা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে যেসব বিষয় জানতে পারেনা বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা সে সকল বিষয় ওহীর মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন। এছাড়া মানুষ বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে যে সকল বিষয় ভাল বা মন্দ বলে বুঝতে পারে সে সকল বিষয়েও ভাল-মন্দের পর্যায়, গুরুত্ব, পালনের উপায় ইত্যাদি তিনি ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন।
ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের সংরক্ষণ ও তার অনুসরণ ব্যতীত মানব জাতি ও মানব সভ্যতার সংরক্ষণ সম্ভব নয়। স্বার্থের সংঘাত, হানাহানি ও স্বার্থপরতা দূর করে প্রকৃত ভালবাসা, সেবা ও মানবীয় মূল্যবোধগুলির বিকাশ করতে ওহীর জ্ঞানের উপরই নির্ভর করতে হবে। বিশ্বাস, সততা, পাপ, পূণ্য, স্রষ্টা, পরকাল ইত্যাদি বিষয়ে ওহীর বাইরে মানবীয় বিবেক, অভিজ্ঞতা বা গবেষণার আলোকে যা কিছু বলা হয় সবই বিতর্ক, সংঘাত ও বিভক্তি বৃদ্ধি করে। কারণ এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সত্য কখনোই ওহী ছাড়া মানবীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে জানা যায়না। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের বিকৃতি বা বিলুপ্তির কারণেই বিভিন্ন জাতি বিভ্রান্ত হয়েছে।
১.১.২. ওহীর বিকৃতি বা বিলুপ্তির কারণ
কুরআন হাদীসের বর্ণনা ও বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান বিলুপ্ত হওয়ার প্রধান কারণ দুটিঃ
১. অবহেলা, মুখস্ত না রাখা বা অসংরক্ষণের ফলে ওহীলব্ধ জ্ঞান বা গ্রন্থ হারিয়ে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া।
২. মানবীয় কথাকে ওহীর নামে চালানো বা ওহীর সাথে মানবীয় কথা বা জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটানো।(খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ ১১-১৫)।
প্রথম পর্যায়ে ওহীর জ্ঞান একেবারে হারিয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ওহী নামে কিছু জ্ঞান সংরক্ষিত থাকে, যার মধ্যে মানবীয় জ্ঞান ভিত্তিক কথাও সংরক্ষিত থাকে। কোন কথাটি ওহী বা কোন কথাটি মানবীয় তা জানার ব পৃথক করার কোনো উপায় থাকেনা। ফলে ‘ওহী’ নামে সংরক্ষিত গ্রন্থ বা জ্ঞান মূল্যহীন হয়ে যায়। পূর্ববর্তী অধিকাংশ জাতি দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ওহীর জ্ঞানকে বিকৃত করেছে। ইহুদী, খ্রীস্টান ও অন্যান্য অধিকাংশ ধর্মাবলম্বীদের নিকট ‘ধর্মগ্রন্থ’, Divine Scripture ইত্যাদি নামে কিছু গ্রন্থ সংরক্ষিত রয়েছে। যেগুলির মধ্যে অগণিত মানবীয় কথা, বর্ণনা ও মতামত সংমিশ্রিত রয়েছে। ওহী ও মানবীয় কথাকে পৃথক করার কোনো পথ নেই এবং সেগুলো থেকে ওহীর শিক্ষা নির্ভেজালভাবে উদ্ধার করার কোনো পথ নেই।
১.১.৩. দুই প্রকার ওহীঃ কুরআন ও হাদীস
কুরআন করীমে বারংবার এরশাদ করা হয়েছে যে, মহিমাময় আল্লাহ তাঁর মহান রাসূলকে দুইটি জিনিস প্রদান করেছেনঃ একটি ‘কিতাব’ বা ‘পুস্তক’ এবং দ্বিতীয়টি ‘হিকমাহ’ বা ‘প্রজ্ঞা’।(সূরা বাকারা ১২৯, ১৫১, ২৩১; সূরা আল ইমরান ১৬৪; সূরা নিসা ১১৩; সূরা আহযাব ৩৪; সূরা জুমুআহ ২)।
এই পুস্তক বা কিতাব হলো কুরআন করীম, যা হুবহু ওহীর শব্দে ও বাক্যে সংকলিত হয়েছে। আর হিকমাহ বা প্রজ্ঞা হলো ওহীর মাধ্যমে প্রদত্ত অতিরিক্ত প্রায়োগিক জ্ঞান যা হাদীস নামে সংকলিত হয়েছে। কাজেই ইসলামে ওহী দুই প্রকারঃ কুরআন ও হাদীস। ইসলামের এই দুই মূল উৎসকে রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ওহীর জ্ঞানকে হুবহু নির্ভেজালভাবে সংরক্ষণের জন্য একদিকে কুরআন ও হাদীসকে হুবহু শাব্দিকভাবে মুখস্ত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অপরদিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয় এমন কোনো কথাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
১.১.৪. হাদীসের ব্যবহারিক সংজ্ঞা
হাদীস বলতে রাসূল(স) এর কথা, কর্ম বা অনুমোদনকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোকে রাসূলুল্লাহ(স) যা বলেছেন, করেছেন বা অনুমোদন করেছেন তাকে হাদীস বলা হয়।
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় “যে কথা, কর্ম, অনুমোদন বা বিবরণকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বলে প্রচার করা হয়েছে বা দাবি করা হয়েছে” তাই “হাদীস” বলে পরিচিত। এছাড়া সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ এর কথা, কর্ম বা অনুমোদনকেও হাদীস বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্ম, কথা বা অনুমোদনকে “মারফূ হাদীস” বলা হয়। কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে “মাউকূফ হাদীস” বলা হয় আর তাবেয়ীগণের কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে “মাকতূ হাদীস” বলা হয়। [ইরাকী, যাইনুদ্দীন আব্দুর রাহীম ইবনুল হুসাইন(৮০৬হি), আত-তাকয়ীদ ওয়াল ঈদাহ, পৃ ৬৬-৭০; ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৫২-৬৩; সাখাবী, মুহাম্মদ ইবনু আবদুর রাহমান(৯০২ হি), ফাতহুল মুগীস ১/৮-৯, ১৭৭-১৫৫; সুয়ূতী, জালালুদ্দীন আবদুর রাহমান ইবনু আবী বকর(৯১১ হি), তাদরীবুর রাবী ১/১৮৩-১৯৪।]
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, যে কর্ম, কথা, অনুমোদন বা বর্ণনা রাসূলুল্লাহ(স) এর বলে দাবী করা হয়েছে বা বলা হয়েছে তাকেই মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলে গণ্য করা হয়। তা সত্যই রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা কিনা তা যাচাই করে নির্ভরতার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের বিভিন্ন প্রকার ও পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। আমরা পরবর্তী আলোচনায় সেগুলি ব্যাখ্যা করব।
১.১.৫. ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্বের বিষয়টি আলোচনা বাহ্যত নিষ্প্রয়োজনীয়। কুরআন করীমের অনেক নির্দেশ, রাসূলুল্লাহ(স) এর অগণিত নির্দেশ ও সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, ‘হাদীস’ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় উৎস ও ভিত্তি। বস্তুত মুসলিম উম্মাহর সকল যুগের সকল মানুষ এ বিষয়ে একমত। সাহাবীদের যুগ হতে শুরু করে সকল যুগে হাদীস শিক্ষা, সংকলন, ব্যাখ্যা ও হাদীসের আলোকে মানবজীবন পরিচালিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এভাবে গড়ে উঠেছে হাদীস বিষয়ক সুবিশাল জ্ঞান ভান্ডার। তবে কতিপয় ইহুদী, খৃস্টান প্রাচ্যবিদ ও মুসলিম উম্মাহর কোনো কোনো পন্ডিত বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্নভাবে হাদীসের গুরুত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বক্তব্যে পক্ষে উপস্থাপিত দলীলসমূহকে আমরা চারভাগে ভাগ করতে পারিঃ
(১) কুরআন করীমের কিছু আয়াতের আলোকে দাবি করা হয় যে, ‘কুরআনেই সব কিছুর বর্ণনা’ রয়েছে। কাজেই হাদীস নিষ্প্রয়োজনীয়।
(২) হাদীসের বর্ণনা ও সংকলন বিষয়ক কিছু আপত্তি উথ্থাপন করে দাবি করা হয় যে, হাদীসের মধ্যে অনেক জালিয়াতি প্রবেশ করেছে। কাজেই তার উপর নির্ভর করা যায়না।
(৩) কিছু হাদীস উল্লেখ করে হাদীসের মধ্যে বিজ্ঞান বা জ্ঞানবিরোধী কথাবার্তা বা বৈপরীত্য আছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা।
(৪) কিছু হাদীস থেকে তাঁরা প্রমাণ(!) পেশ করেন যে, রাসূলুল্লাহ ও সাহাবীগণ হাদীসের উপর গুরুত্ব প্রদান করতে নিষেধ করেছেন।
এ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা আমাদের গ্রন্থের পরিসরে সম্ভব নয়। তবে আমরা আমাদের এই গ্রন্থে হাদীসের জালিয়াতি ও সহীহ হাদীস থেকে জাল হাদীসকে পৃথক করার বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের সকল আলোচনা এবং সাহাবীদের যুগ থেকে আজ পর্য্ন্ত মুসলিম উম্মাহর সকল শ্রমের মূল ভিত্তিটিই হলো এই যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের অনুসরণ ছাড়া কুরআন পালন, ইসলাম পালন বা মুসলমান হওয়া যায়না। আমাদের জীবন চলার অন্যতম পাথেয় রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস। তবে আমাদের অবশ্যই বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
হাদীস বাদ দিলে আর কোনোভাবেই কুরআন মানা বা ইসলাম পালন করা যায়না। হাদীসের বিরুদ্ধে এ সকল মানুষের উথ্থাপিত যুক্তিগুলোর মধ্যে প্রথম যুক্তিটি আমরা আলোচনা করতে পারি। আমরা দেখতে পাব যে, কুরআন মানতে হলে হাদীস মানা আবশ্যক। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুনঃ
(১) ‘ওহী’র মাধ্যমে যে নির্দেশনা মানব জাতি লাভ করে তার বাস্তব প্রয়োগ ও পালনের সর্বোচ্চ আদর্শ হন ‘ওহী প্রাপ্ত নবীগণ ও তাঁদের সাহচর্য্ প্রাপ্ত শিষ্য ও সঙ্গীগণ। তাঁদের জীবনাদর্শই মূলত অন্যদের জন্য ওহীর অুনসরণ ও পালনের একমাত্র চালিকা শক্তি। এজন্য সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরা ধর্ম প্রচারক ও তাঁর শিষ্য, প্রেরিত ও সহচরদের জীবন, কর্ম ও আদর্শকে ধর্ম পালনের মূল উৎসরূপে সংরক্ষণ ও শিক্ষাদান করেন। আর রাসূলুল্লাহ(স) এর জীবন, কর্ম, ত্যাগ, ধৈর্য্, মানবপ্রেম, আল্লাহর ভয়, সত্যের পথে আপোষহীনত ….. ইত্যাদি হাদীস ছাড়া জানা সম্ভব নয়। একজন মুসলমানকে হাদীস থেকে বিচ্ছিন্ন করার অর্থই হলো তাঁকে রাসূলুল্লাহ(স) এর বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। একে অতি সহজেই তাঁকে কুরআন থেকে এবং ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব হয়।
(২) হাদীসের উপর নির্ভর না করলে কুরআন এর পরিচয় লাভ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মুহাম্মদ(স) এর জীবন, পরিচয়, বিশ্বস্ততা, সততা, নব্যুয়ত ইত্যাদি কোনো তথ্যই হাদীসের মাধ্যম ছাড়া জানা সম্ভব নয়। তিনি কিভাবে কুরআন লাভ করলেন, শিক্ষা দিলেন, সংকলন করলেন…….ইত্যাদি কোনো কিছুই হাদীসের তথ্যাদি ছাড়া জানা সম্ভব নয়।
(৩) হাদীসের উপর নির্ভর না করলে কুরআন মানাও সম্ভব নয়।
কুরআন করীমে সকল কিছুর বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু তা সবই শুধুমাত্র ‘মূলনীতি’ বা ‘প্রাথমিক নির্দেশনা’ রূপে। কুরআন করীমের অধিকাংশ নির্দেশই ‘প্রাথমিক নির্দেশ’, ব্যাখ্যা ছাড়া যেগুলি পালন করা অসম্ভব। ইসলামের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম সালাত বা নামায। কুরআন করীমে শতাধিক স্থানে সালাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সালাতের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। বিভিন্ন স্থানে রুকু করার বা সেজদা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ‘যেভাবে তোমাদের সালাত শিখিয়েছি সেভাবে সালাত আদায় করা।’ কিন্তু কুরআন করীমের কোথাও সালাতের এই পদ্ধতিটি শেখানো হয়নি। ‘সালাত’ বা ‘নামায’ কী, কথন তা আদায় করতে হবে, কখন কত রাকায়াত আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাক‘আত কী পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাক‘আতে কুরআন পাঠ কিভাবে হবে, রুকু কয়টি হবে, সিজদা কয়টি হবে, কিভাবে রুকু ও সেজদা আদায় করতে হবে…ইত্যাদি কোনো কিছুই কুরআনে শিক্ষা দেওয়া হয়নি। কুরআনের সর্বশ্রেষ্ট নির্দেশকে আমরা কোনোভাবেই হাদীসের উপর নির্ভর না করে আদায় করতে পারছিনা। এভাবে কুরআন হাদীসের অধিকাংশ নির্দেশই হাদীসের ব্যাখ্যা ছাড়া পালন সম্ভব নয়।
(৪) কুরআন করীমে কিছু নির্দেশ বাহ্যত পরস্পর বিরোধী। যেমন কোথাও মদ, জুয়া ইত্যাদিকে বৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কোথাও তা অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কাফির ও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কোথাও সকল প্রকার বিরোধিতা এবং যুদ্ধ হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদীসের নির্দেশনা ছাড়া এ সকল নির্দেশের কোনটি আগে, কোনটি পরে এবং কিভাবে সেগুলি পালন করতে হবে তা জানা যায়না। এজন্য হাদীস বাদ দিলে এসকল আয়াতের ইচ্ছামত ও মনগড়া ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হয়ে যায়।
মূলত এজন্যই ইহুদী, খৃষ্টান, কাদিয়ানী, বাহাঈ প্রমুখ সম্প্রদায় হাদীসের বিরুদ্ধে ঢালাও অপপ্রচার চালান। তাদের উদ্দেশ্য হলো মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া। তারাও জানেন যে, হাদীসের সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই কুরআন মানা যায়না। শুধুমাত্র সরলপ্রাণ মুসলমানদের ধোঁকা দেয়ার জন্যই তারা মূলত ‘কুরআনের’ নাম নেন।
(৫) আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ তাঁর রাসূল(স) কে দুইটি বিষয় প্রদান করেছেনঃ কিতাব(পুস্তক) ও হিকমাহ(প্রজ্ঞা)। স্বভাবতই কুরআনও প্রজ্ঞা ও হিকমাহ। তবে বারংবার পৃথকভাবে উল্লেখ করা থেকে আমার জানতে পারি যে, কুরআনের অতিরিক্ত প্রজ্ঞা বা জ্ঞান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূল (স) কে প্রদান করেছিলেন এবং তিনি কুরআন ছাড়াও অতিরিক্ত অনেক শিক্ষা মানব জাতিকে প্রদান করেছেন এই প্রজ্ঞা থেকে। আমরা জানি যে, কুরআনের যে অতিরিক্ত শিক্ষা তিনি প্রদান করেছিলেন, তাই ‘হাদীস’ রূপে সংকলিত। ‘হাদীস’ ছাড়া তাঁর প্রজ্ঞা জানার ও মানার আর কোনো উপায় নেই। কাজেই কুরআনের নির্দেশ অনুসারেই আমাদেরকে কুরআন ও হাদীসের অনুসরণে জীবন পরিচালিত করতে হবে।
(৬) কুরআনে রাসূলুল্লাহ(স) এর আনুগত্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আনুগত্য ছাড়াও তাঁকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ
-“বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, এতে আল্লাহ তোমাদিগকে ভালবাসবেন, এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করবেন।” (সূরা আল ইমরানঃ৩১)।
আমরা জানি যে, আনুগত্য অর্থ আদেশ নিষেধ পালন করা। আর কারো অনুসরণ করার অর্থ হলো হুবহু তাঁর কর্মের মত কর্ম করা। হাদীসের উপর নির্ভর না করলে কোনোভাবেই রাসূলুল্লাহ(স) এর অনুসরণ করা সম্ভব নয়। কুরআন কারীমে আদেশ নিষেধ উল্লেখ করা হলেও কোথাও রাসূলুল্লাহ(স) কর্ম ও জীবনরীতি আলোচিত হয়নি। এজন্য শুধুমাত্র কুরআন দেখে রাসূলুল্লাহ(স) এর অনুসরণ করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। কাজেই কুরআনের নির্দেশ অনুসারে আল্লাহর প্রেম ও ক্ষমা লাভ করতে হলে অবশ্যই হাদীসের বর্ণনা অনুসারে রাসূলুল্লাহ(স)এর অনুসরণ করতে হবে।
(৭) কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছেঃ
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
-নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সূরা আল আহযাবঃ২১)।
ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ(স) এর বাস্তব জীবননীতি কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কুরআনের নির্দেশে রাসূলুল্লাহ(স) এর আদর্শ অনুসরণ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
(৮) কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যেঃ
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا
-“রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক।”(সূরা হাশরঃ৭)।
আমরা জানি যে, রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর সুদীর্ঘ নব্যুয়তী জীবনে অনেক অনেক শিক্ষা প্রদান করেছেন তাঁর সাহাবীগণকে। জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক দিকনির্দেশনা তিনি প্রদান করেছেন। এ সকল শিক্ষা ও নির্দেশনাও ‘রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন’ এর অন্তর্ভূক্ত। কাজেই ‘রাসূল যা দিয়েছেন’ সবকিছু গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে কুরআনের পাশাপাশি হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
হাদীস সংকলন, লিখন, বর্ণনা ও জালিয়াতি বিষয়ক তাঁদের অন্যান্য আপত্তির বিষয় আমরা এই পুস্তকের অন্যান্য আলোচনা থেকে জানতে পারব। তবে এখানে আমরা বুঝতে পারছি যে, কুরআনের নির্দেশনা অনুসারেই আমাদেরকে হাদীসের আলোকে জীবন গঠন করতে হবে, হাদীসের আলোকে রাসূলুল্লাহ(স) এর হুবহু অনুসরণ করতে হবে, হাদীসের আলোকে রাসূলুল্লাহ(স) এর আদর্শে জীবন গড়তে হবে এবং হাদীসের ভিত্তিতেই আমাদেরকে কুরআনের নির্দেশাবলী পালন করতে হবে। আমরা আরো দেখছি যে, হাদীস ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কুরআন পালন বা ইসলামী জীবন গঠন সম্ভব নয়।
হাদীসের এই গুরুত্বের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ মূলত একমত। আর এজন্যই হাদীসের নামে জালিয়াতি ও মিথ্যা প্রতিরোধের সর্বোত্তম নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তাঁরা। তাঁদের নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতির আলোচনার আগে আমরা মিথ্যার পরিচয় ও ওহীর নামে মিথ্যার বিধান আলোচনা করব। মহান আল্লাহর নিকট তাওফীক প্রার্থনা করছি।