২.১১. বার চাঁদের সালাত ও ফযীলত বিষয়ক
বৎসরের বার মসে ও বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতির সালাত ও সেগুলির আজগুবি ও উদ্ভট সব ফযীলতের বর্ণনা দিয়ে হাদীস বানিয়েছে জালিয়াতগণ।প্রচলিত ‘বার চাঁদের ফযিলত’জাতীয় গ্রন্থগুলি এই সব বাতিল কথায় ভরা।পাঠকদের সুবিধার্থে আমি আরবী মাসগুলির উল্লেখ করে,সে বিষয়ক সহীহ ও বানোয়াট কথাগুলি উল্লেখ করেছি।যদিও আমরা সালাত অধ্যায়ে রয়েছি,তবুও আমি সালাতের পাশাপাশি এ সকল মাসের সিয়াম ও অন্যান্য ফযীলত বিষয়ক কথাগুলি উল্লেখ করব;যাতে পাঠক একই স্থানে সংশ্লিষ্ঠ সকল বিষয় জানতে পারেন।
২.১১.১. মুহারাম মাস
ক. সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের আলোকে মুহার্রাম মাস
আরবী পণ্জ্ঞিকার প্রথম মাস মুহার্রাম মাস। সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা এই মাসের ফযীলত বা মর্যদা সম্পর্কে নিম্নের বিষয়গুলি জানতে পারি:
প্রথমত, এই মাসটি বৎসরের চারটি ‘হারাম’ মাসের অন্যতম। এই মাসগুলি ইসলামী শরিয়তে বিশেষভাবে সম্মানিত। এগুলিতে সধারণ ঝগরাঝাটি বা যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন: “আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটি সুপ্রতিষ্টিত বিধান।সুতরাং এই নিষিদ্ধ মাসগুলির মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না….।”(সূরা ৯:তাওবা,আয়াত,৩৬।)
এই মাসগুলি হলো:মুহার্রাম,রজব,যিলকাদ ও যিলহাজ্জ মাস।
দ্বিতীয়ত, এই মাসকে সহীহ হাদীসে্ ‘আল্লাহর মাস’বলে আখ্যায়িতকরা হয়েছে আবং এই মাসের নফল সিয়াম সর্বোত্তম নফল সিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ(সা) বলেন:
আরবী(*****)
– “রামাদানের পরে সর্বোত্তম সিয়াম হল আল্লহর মুহার্রাম মাস।”
তৃতীয়ত, এই মাসের ১০ তারিখ ‘আশুরা’র দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ ফযীলত রয়েছে।‘আশুরা’র সিয়াম সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ(সা) বলেন: “এই দিনের সিয়াম গত এক বৎসরের পাপ মার্জনা করে।”(মুসলিম,আস-সহীহ ২/৮২১)।
এই দিনে রাসুলুল্লাহ(সা) নিজে সিয়াম পালন করতেন উম্মতকে সিয়াম পালনের উৎসাহ দিয়েছেন এবং ১০ তারিখের সাথে সাথে ৯ বা ১১ তারিখে ও সিয়াম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন। (ইবনু রাজাব, লাতাইফ১/৬৮-৭৬;আব্দুল হাই লাখনবী পৃ৯১-৯৪)।
চতুর্থত,সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত হয়েছে যে, এই দিনে মহান আল্লাহ তার রাসুল মূসা (আ) ও তার সঙ্ঘী বনী ইসরাঈলকে ফির’আউনের হাত থেকে উদ্ধার করেন এবং ফির’আউনও তার সঙ্গি কে ডুবিয়ে মারেন। (বুখারী,আস-সহীহ২/৭০৪,৩/১২৪৪,মুসলিম,আস-সহীহ২/৭৯৬)।
সহীহ হাদীস থেকে মুহর্রাম মাস ও আশুরার সম্পর্কে শুধু এতটাকুই জানা যায়।পরবর্তীকালেঅনেক বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী এক্ষেত্রে প্রচলিত হয়েছে। এখানে দুইটা বিষয় লক্ষনীয়:
প্রথম বিষয়: এই দিনটিকে ইহুদীগণ সম্মন করত। এ কারনে ইহুদীদের মধ্যে এই দিনটির কল্প কাহীনি প্রচলিত ছিল। পরবর্তী যুগে ইসরাঈল রেওয়োয়াত হিসেবে সেগুলি মাসলিম সমাজে প্রবেশ করছে। প্রথম যুগে মাসলিমগণ এগুলি সত্য ব মিথ্যা বলে বিস্বাস না করে ইসরাঈলী কাহিনী হিসাবেই বলেছেন।পরবর্তী যুগে তা হাদীসে পরিণত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়,রাসুলুল্লাহ(সা)-এর ইন্তিকালের অর্ধ শতাব্দী পরে ৬১ হিজরীর মুহর্রাম মাসের ১০তরিখে আশুরার দিনে তাঁর প্রিয়তম নাতি হযরত হুসাইন(রা) করবালার প্রান্তরে শহীদ হন। এই ঘটনা মাসলিম উম্মাহর মধ্যে চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। হুসাইন(রা)পক্ষের ও বিপক্ষের অনেক বিবেকহীন দার্বল ।ঈমান মানূষ‘আশুরার’ বিষয়ে অনেক হাদীস বানিয়েছে।কেউ দিনটিকে ‘শোক দিবস’হিসেবে এবং কেউ দিনটিকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন এর জন্য নানা প্রকারের কথা বানিয়েছেন।তবে মুহাদ্দীসগণের নিরীক্ষার পদ্ধতিতে এ সকল জালিযাতি ধরা খুবই সহজ ছিল।
মুহর্রাম ও আশুরার সম্পর্কে প্রচলিত অন্যান্য কথাবার্তাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি:প্রথমমত,যে সকল ‘হাদিস’ কোনো কোনো মুহাদ্দীস জাল বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করলেও, কেউ কেউ তা দূর্বল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এবং যে সকল হাদীস অত্যন্ত দূর্বল সনদে কোনো কোনো সাহাবী তাবেয়ীগণ থেকে তাঁরা নিজের বক্তব্য হিসাবে বণীত হয়েছে। বাহ্যাত ইসরাঈলী বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁরা এগুলো বলেছেন। দ্বিদিদ দিতদ্বিতীয়ত,সকল মুহাদ্দিস যে সকল হাদীসকে জাল ও ভিত্তিহীন বলে একমত পোষণ করেছেন।
জাল বা দূর্বল হাদীস ও সাহাবী-তাবেয়ীগণের মতামত
১. অত্যন্ত দুর্বল সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবেয়ী থেকে বর্ণীত হয়েছে যে, এই দিনে আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-এর তাওবা কবুল করেন।
২. অনুরূপভাবে অনির্ভরযোগ্য সুত্রে বর্ণীত হয়েছে যে, এই দিনে নূহ(আ)এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামে।
৩. অনুরূপ অনির্ভরযোগ্য সুত্রে বর্ণীত হয়েছে যে, এই দিনে ঈসা(আ) জন্মগ্রহণ করেন।
৪. মুহর্রাম মাস ও আশুরার দিনে দান-সদকার বিষয়ে যা কিছুই বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেছেন আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে যেহেতু এক বৎসরের সওয়াব পাওয়া যায়, সেহতু এই দিনে দান করলেও এক বৎসরের দানের সওয়াব পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া এই দিনে দানের বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে সবকিছুই বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা। (ইবনু রাজাব,লাতাইফ ১/৭৮; আব্দুল হাই লাখনবী,আল-আসার পৃ ৯৫/৯৬)।
৫. একটি হাদিসে বলা হয়েছে:
“যে ব্যাক্তি আশুরার দিনে তার পরিবারের জন্য প্রশস্তভাবে খরচ করবে আল্লাহ সারা বৎসরই প্রশস্ত রিয্ক প্রদান করবেন।” হাদীসটি কযেকটা সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটা সনদই অত্যন্ত দূর্বল। বিভিন্ন সনদের কারণে বাইহাকী, ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দীস এই হাদীসকে জাল বলে গণ্য না করে ‘দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনু হজার হাদিসটিকে অত্যন্ত আপত্তিকর ও খুবই দূর্বল বলেছেন। অপরদিকে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনু তাহমিয়া প্রমুখ মুহাদ্দিস একে জাল বলে গণ্য করেছেন। তারা বলেন যে প্রত্যেক সনদই অত্যন্ত দূর্বল হওয়ার ফলে একাধিক সনদে এর গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় না। এছাড়া হাদীসটি সহীহ হাদীসের বিরোধী। সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে উৎসব বা আনন্দ করবে, তোমরা তাদের বিরোধিতা করবে; এই দিনে সিয়াম পালন করবে এবং উৎসব বা আনন্দ করবে না। (ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস,পৃ.৭৯, ইবনুল জাওযী,আল-মাওদু’আত২/১১৩-১১৭; সুয়ূতী,আল-লাআলী ২/১০৯-২১৩; সাখাবী,আল-মাকাসিদ,পৃ ৪২৭;্আল-যারকশী,আত-তাযকিরা৩৪,১১৮;ইবনু ইরাক,তানযীহ ২/১৫০-১৫৭;ইবনু রাজাব,লাতাইফ১/৭৯;মোল্লা কারী,আল-আসরার.,পৃ২৪৪-২৪৫;শাওকানী,আল ফাওয়াইদ ১/১৩২-১৩৩;আব্দুল হাই লাখনবী,আল-আসার পৃ১০০/১০২)।
৬.অন্য হাদীসে বলা হয়েছে:
“যে ব্যক্তি আশুরার দিনে চোখে ‘ইসমিদ’ বা সুরমা ব্যবহার করবে কখনোই চোখ উঠবে না।’’ উপরের হাদীসটির মতই এই হাদীসটি একাদিক সনদে বর্ণীত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেই অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে।কোনো কোনো মুহাদ্দীস একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে দূর্বল হিসাবে গণ্য করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দীস হাদীসটিকে জাল বা বানোয়াট হিসাবে গণ্য করেছেন। তারা বলেন,ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীগণ আশুরার দিনে সুরমা মাখার বিদ’আতটি চালু করেন। এই কথাটি তাদেরই বানানো। কোনো দুর্বল রাবী বেখেয়ালে তা বর্ণনা করেছেন। (ইবনুল জাওযী,আল-মাওদু’আত২/১১৬;আত২/১১৩-১১৭; সুয়ূতী,আল-লাআলী ২/২১১;সাখাবী,আল-মাকাসিদ, পৃ ৪০১; ইবনু ইরাক,তানযীহ ২/১৫৭;ইবনু রাজাব,লাতাইফ১/৭৯; মোল্লা কারী,আল-আসরার.,পৃ২২২;মাসনূ,পৃ১৪১; শাওকানী,আল ফাওয়াইদ ১/১৩১-১৩২;আব্দুল হাই লাখনবী,আল-আসার পৃ১০০/১০২)।
খ.মুহর্রাম মাস বিষয়ক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা
উপরের কথাগুলো কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বলে গণ্য করলেও কেউ কেউ তা দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। নিচের কথাগুলি সকল মাহাদ্দিস একবাক্যে জাল বলে স্বীকার করেছেন। এগুলিকে আমরা তিন ভগে ভাগ করতে পারি:প্রথমত,মুহর্রাম বা আশুরার সিয়ামের ফজিলতের বিষয়ে জাল কথা, দ্বিতীয়ত,আশুরার দিনের বা রাতের জন্য বা মুহর্রাম মাসের জন্য বিশেষ সালাত ও তার ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা এবং তৃতীয়ত, আশুরার দিনে অতীত ও ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে বলে জাল কথা।
১.মুহর্রাম বা আশুরার সিয়াম
আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে পূর্ববর্তী এক বৎসরের গোনাহের কাফফারা হবে বলে সহীহ হাদীসে আমরা দেখতে পেয়েছি। জালিয়াতগণ আরো অনেক কথা এ সম্পর্কে বানিয়েছে। প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি করছি: “হাদীসে আছে-যে ব্যক্তি মহর্রমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তা’আলা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন।আরও হাদীসে আছে-যে ব্যাক্তি আশুরার দিনে একটি রোযা রাখিবে সে দশ শাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে “
আরও হাদীসে আছে –যে ব্যাক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হইয়া কোনো এতিমের মাথায় হাত ঘুরাইবে,আল্লাহতাআলা ঐ এতিমের মাথার পৃত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটি ‘দরজা’প্রদান করিবেন।আর যে ব্যাক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াইবে বা ইফতার করাইবে, সে ব্যাক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওইবার ও ইফতার করাইবার ন্যায় ছওয়াব পাইবে।
হযরত(সা) আরও বলিলেন, যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে,সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি ঐ তারিখে বিমার পোরছী করিবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।….তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হইবে। ৪০ বৎসর গুনাহর কাফ্ফারা হইয়া যাইবে।…(হাদীস)” (মাও.গোলাম রহমান, মকছুল মো’মেনীন,পৃ.৪৩০-৪৩১, পুনশ্চ:মুফতি হাবীব ছামদানী,বার চান্দের ফজীলত,পৃ১৩; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল পৃ.২৯৮-৩০০)।
অনুরূপ আরেকটি মিথ্যা কথা হলো: “ হযরত রাসুলুল্লাহ(সা)এরশাদ করিয়াছেন,যে ব্যক্তি মহর্রম মাসের ১০ দিন রোযা রাখিবে,সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবৎ রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল।….মহর্রম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল।…তোমরা আল্লাহ তাআলার৫ পছন্দনীয় মাস মহর্রম মাসের সম্মান করিবে,আল্লাহ তাআলা তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মআনিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাচাঁইয়া রাকিবেন…. মহর্রমের ১-০ তারিখে রোজা রাখা আদম (আ) ও অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল।এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহন করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে…..।(মুফতি হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফজীলত, পৃ.১৩)।
মুহাদ্দীসগণ একমত যে, এগুলি সবই বানোয়াট কথা ও জাল হাদীস। (ইবনুল জাওযী,আল-মাওদু’আত ২/১১২-১১৭;সুয়ূতী,আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯;ইবনু ইরাক,তানযীহ ২/১৪৯-১৫১;মোল্লা কারী,আল-আসরার.,পৃ ২৯৪; শাওকানী আল ফাওয়াইদ ১/১২৯-১৩০;১/১৩২-১৩৩; আব্দুল হাই লাখনবী,আল-আসার পৃ৯৪-৯৫)।
২. মুহর্রাম মাসের সালাত
মুহর্রাম মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে এবং আশুরার দিবসে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদাযের কোনো প্রকার নির্দেশনা বা উৎসাহ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ক সকল কথাই বানোয়াট। আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো পুস্তকে মুহর্রাম মাসের ১ম তারিখে দুই রাকা’আত সালাত আদায় করে বিশেষ ফযীলতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এগুলি সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। (মুফতি হাবীব ছামদানী,বার চান্দের ফজীলত,পৃ.১১-১২;অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল পৃ.২৯৮)।
৩.আশুরার দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত
আশুরার দিনে সিয়াম পালনের উৎসাহ দেওয়া হলেও,হাদীস শরীফে আশুরার দিবসে বা রাতে বিশেষ সালাত আদায়ের বিধান দেওয়া হয় নি।তবে জালিয়াতগণ অনেক কথা বানিয়েছে।যেমন,যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে… অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকাত সালাত অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে… সে এত এত পুরস্কার লাভ করবে। সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য জালিয়াতগণ এ সকল কথা বানিয়েছে,যা অনেক সময় সরলপ্রণ আলিম ও বুযুর্গকে ধোকাগ্রস্ত করেছে। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওদু’আত ২/৪৫-৪৬; সুয়ূতী,আল-লাআলী ২/৫৪; ইবনু ইরাক,তানযীহ ২/৮৯; শাওকানী আল ফাওয়াইদ ১/৭৩; আব্দুল হাই লাখনবী,আল-আসার পৃ.৯০, ১১০-১১১)।
৪.আশুরায় অতীত ও ভবিষ্যত ঘটনাবলির বানোয়াট ফিরিস্তি
মিথ্যাবাদীরা রাসূলুল্লাহ (সা) এর নামে জালিয়াতি করে বলেছে:
আশুরার দিনে আল্লাহ আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন।
এই দিনে তিনি পাহাড় পর্বত, নদ নদী… সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি লাওহে মাহফুজ সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন। এই দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি জিবরাঈল(আ)সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি আদম(আ)সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তিনি আদম(আ)জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। এই দিনে তিনি ইদরীস (আ) কে আসমানে উঠিয়ে নেন। এই দিনে তিনি নূহ (আ)-কে নৌকা থেকে বের করেনে। এই দিনে তিনি দায়ূদের (আ) এর তওবা কবুল করেছেন। এই দিনে তিনি সুলাইমান(আ)-কে রাজত্ব প্রদান করেছেন। এই দিনে তিনি আইঊব(আ)-এর বিপদ-মসিবত দূর করেন। এই দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন। এই দিনে ইবরাহীম(আ) জন্মগ্রহণ করেন…খলীল উপাধি লাভ করেন। এই দিনে ইবরাহীম(আ) নমরূদের অগ্নিকুন্ডু থেকে রক্ষা পান। এই দিনে ইসমাঈল(আ) কে কুরবানী করা হয়েছিল। এই দিনে ইওনুস (আ) কে মাছের পেট থেকে বাহির হন। এই দিনে আল্লাহ ইউসূফকে(আ) জেলখানা থেকে বের হন। এই দিনে ইয়াকুব (আ)দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান্। এই দিনে ইয়াকুব (আ)ইউসূফ(আ) এর সাথে সম্মিলিত হন। এই দিনে হযরত মুহাম্মদ(সা) জন্মগ্রহণ করেছেন।
কেউ কেউ বানিয়েছে:মুহর্রাম এর দুই তারিখে নূহ(আ)প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন,৩ তারিখে ইদরীস(আ) আসমানে উঠানো হয়েছে ৪ তারিখে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে…..ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইরূপ অগণিত ঘটনা এই মাসে বা এই দিনে ঘটেছে বা ঘটবে বলে উল্লেখ করেছে জালিয়াতরা তাদের এ কল্প কাহিনীতে। মোট কথা হলো,আশুরার দিনে মূসা (আ) ও তাঁর সাথীদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়। আদমের(আ)তাওবা কবুল,নূহ (আ) এর নৌকা জূদি পর্বতের উপর থামাও । ঈসা(আ)জন্মগ্রহণ করার কথা অনির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী-তাবেয়ী থেকে বর্ণিত। আশুরা বা মুহর্রাম সম্পর্কে আর যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা ও বাতিল কথা। দূঃখজনক হলো,আমাদের দেশে মুহর্রাম বা আশুরা বিষয়ক বই পুস্তকে,আলোচনা ও ওয়াযে এই সমস্ত ভিত্তিহীন কথা বার্তা উল্লেখ করা হয়। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওদু’আত ২/১১২-১১৭; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার পৃ.৫২; যাহাবী,মীযানুল ই’তিদাল ২/১৯০; ইবনু হাজার,লিসানুল মীযান ২/১৬৯; সুয়ূতী,আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯; ইবনু ইরাক,তানযীহ ২/১৪৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার,পৃ.৩০০; আব্দুল হাই লাখনবী,আল আসরার,পৃ.৯৪-৯৭; দরবেশ হূত,আসনাল মাতালিব,পৃ.২৭৭-২৭৮;আজলূনী,কাশফুল খাফা ২/৫৫৭)।
২.১১.২ সফর মাস
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে মুহর্রাম মাসের জন্য কোনো বিশেষ কোনো সালাত নেই,তবে এই মাসের বিশেষ সিয়ামের কথা হাদীস শরীফে বর্ণীত হয়েছে এবং এ জন্য বিশষ সওয়াব রয়েছে। পক্ষান্তরে সফর মাসের জন্য কোনো বিশেষ সালাত ও নেই,সিয়াম ও নেই।
এই মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে কোনো প্রকারের সালাত আদাযের বিশেষ সওযাব বা ফযীলত কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। অনুরূপভাবে এই মাসের কোনো দিনে সিয়াম পালনেরও কোনো বিশেষ ফযীলত কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। এই মাসকে কেন্দ্র করেও অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে। এগুলো কে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত,সফর মাসের ‘অশুভত্ব’ ও ‘বালা-মুসিবত’ বিষয়ক,দ্বীতিয়ত,সফর মাসের প্রথম তারিখে বা অন্য সময়ে বিশেষ সালাত ও তৃতীয়ত,আখেরি চাহার শোম্বা বা শেষ বুধবার বিষয়ক।
প্রথমত,সফর মাসের অশুভত্ব বা এ মাসের বালা-মুসিবত
কোনো স্থান,সময়,বস্তু বা কর্মকে অশুভ,অযাত্রা বা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামী বিস্বাসে ঘোর পরিপন্থি একটি কুসংস্কার। এ বিষয়ে আমরা পরিবর্তীকালে আলোচনা করব,ইনশা আল্লহ। এখনে লক্ষনীয় যে,আরবের মানুষেরা জাহেলী যুগ থেকে ‘সফর’ মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করত।রাসূল্লাহ(সা) তাদের এই কুসংস্কারের প্রতিবাদ করে বলেন,
আরবী(*****)
“…কোনো অশুভ –অযাত্রা নেই ।…(বুখারী,আস-সহীহ ৫/২১৫৮,২১৬১,২১৭১,২১৭৭; মুসলিম,আস-সহীহ৪/১৭৪২-১৭৮৫)।
অথচ এর পরেও মুসলিম সমাজে প্রচার করেছে যে জালিয়াতগণ। তারা জালিয়াতি করে রাসূলুল্লাহ(সা)এর নামে বলেছে, এই মাস বালা মুসিবতের মাস। এই মাসে এত লক্ষ এত হাজার….বালা নাজিল হয়।…এ মাসে আদম ফল খেয়েছিলেন। এ মাসে হাবিল নিহত হন। এ মাসে নূহের কউম ধংস হয়। এ মাসে ইবরাহীমকে আগুনে ফেলা হয়।….এই মাসের আগমনে রাসূলুল্লাহ ব্যাথিত হতেন। এ্ই মাস চলে গেলে খুশি হতেন। তিনি বলতেন: “ যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করার সুসংবাদ প্রদান করব।”….ইত্যাদি আনেক কথা বানিয়েছে। আর অনেক সরলপ্রাণ বুযুর্গও তাদের সকল জালিয়াতি বিশ্বাস করে ফেলেছেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে সফর মাসের সকল কথা ভিত্তিহীন মিথ্যা। (সাগানী আল মাউদু’আত পৃ.৬১;মোল্লা কারী,আল-আসরার.,পৃ ২২৫;তাহের ফাতানী,তযকীরা,পৃ১১৬;আজলূনী,কাশফুল খাফা ২/৩০৯;শাওকনী,আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯ নিযামুদ্দীন আউলিয়া,রাহাতুল মুহিব্বীন,পৃ.১০১ রাহাতুল কুলুব,পৃ.১৩৮)।
দ্বিতীয়ত,সফর মাসের ১ম রাতের সালাত
উপরুক্ত মিথ্যা কথাগুলির ভিত্তিতেই একটি ভিত্তিহীন ‘সালাতের’উদ্বাভন করা হয়েছে।কেউ যদি সফর মাসের ১ম রাত্রিতে মাগরিবের পরে…বা ইশার পরে..চার রাকা’আত সালাত আদায় করে,অমুক অমুক সূরা বা আয়াত পাঠ করে…তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে,এত পুরুষ্কার চাবে..ইত্যাদি।এগুলি সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা,যদিও অনেক আলেম এগুলি বিস্বাস করেছেন বা তাদের বইয়ে বিওযায়ে উল্লেখ করেছেন। (খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া,রাহাতুল কুলুব,পৃ.১৩৮-১৩৯;মুফতি হাবীব ছামদানী,বার চান্দের ফজীলত,পৃ.১৪)।
তৃতীয়ত, সফর মাসের শেষ বুধবার
বিভিন্ন জাল হাদীসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবছেয়ে অুশুভ দিন।আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবছেয়ে বেশি অুশুভ দিন্ এবং এই দিন সবছেয়ে বশেি বালা মুসিবত নাযিল হয়। এই সবই ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রান বুযুর্গ বিস্বাস করেছেন। একজন লিখেছেন:সফর মাসে এক লাখ বিশ হাজার ‘বালা নাজিল হয়। এবং সবদিনের চেয়ে ‘আখেরী চাহার শুম্বা’-তে(সফর মাসে শেষ বুধবার)নাজিল হয় সবছেয়ে বেশি সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যাক্তি নিম্নোক্ত নিয়মে চার রাকা’আত নামাজ পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ঐ বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজতে রাকবেন। (খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া,রাহাতুল কুলুব,পৃ.১৩৯)।
এগুলি সবই ভিত্তিহীন কথা।তবে আমাদের দেশে বর্তমানে ‘আখেরী চাহার শুম্বা’-র প্রশিদ্ধ এই কারনে নয়,অন্য কারনে।প্রশিদ্ধ আছে,রাসুল্লাহ(সা) সফর মাসের শেষের দিকে অশুস্ত হয়ে পরেন। তিনি ষফর মাসের শেষ দিকে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুশস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তিকাল করেন। এজন্য মাসলমানেরা এই দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন।
এ বিষয়ক প্রচলিত কাহীনির সার সংক্ষেপ প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি করছি: “হযরত নবী করিম(সা) দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষনভাবে রোগআক্রান্ত হইয়া ছিলেন।অথঃপর তিনবি এই মাসের শেষ বুধবার সুস্থ হইয়া গোসল করত: কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববী তে হায়ীর হইয়া নামাযের ইমামতি করিয়াছিলেন।ইহাতে উপস্তিত সাহাবীগণ অত্যাধিক আনন্দিত হইয়াছিলেন।আর খুশির কারণে অনেক অনেক দান খয়রাত করেছিলেন।বর্নিত আছে হযরত আবু বকর(রা) খুশিতে ৭ সশস্র দীনার এবং হযরত উমর ইবনে খত্তাব(রা)৫ সহস্র দীনার,হযরত ওসমান(রা)১০সশস্র দীনার,হযরত আলী (রা)৩সহস্র দীনার,হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ(রা)১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছিলেন।তৎপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরন ও অনুসরন করিয়া আসিতেছে ।” হযরত নবী করিম(সা)এর এই দিনের গোসল ইজীবনের শেষ গোসল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতদকালে গোসর করেন নাই। তাই সকল মাসলমানের এই দিনে ওযু গোসল করতঃ ইবাদৎ বন্দেগী করা উচিৎ এবং নবী করিম(সা)এর পৃতি দরূদ শরীফ পাঠ করতঃসাওযাব রেছানী করা কর্তব্য….। (মুফতি হাবীব ছামদানী,বার চান্দের ফজীলত,পৃ.১৫)।
উপরের এই কাহীনিটিই কমবেশি সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা রয়েছ। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেও কোনো সহীহ বা যয়ীফ শাদীসে এই ঘটনার কোনো প্রকারের উল্লেখ পা্ইনি। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিন সমাজে সফর মাসের শেষ বুধবার পালনের রেওয়াজ বা কাহীনি প্রচলিত আছে বলে আমার জানা নেই।
ক. রাসুল্লাহ(সা)-এর সর্বশেষ অসুস্থতা
রাসুল্লাহ(সা)সফর ব রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখে অসুস্থ হয়ে পরেন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হদীস শরীফে কোনো ইঙ্গিত নেই অগনিত হদীসে তাঁর অসুস্থত,অসুস্থত-কালীন অবস্থা,কর্ম,উপদেশ,তাঁর ইন্তিকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত
হয়েছে।কিন্তু কোথাও কোনো ভাবে কোনো দিন,তারিখ বা সময় বলা হয়নি।কবে তাঁর অসুস্ততার শুরু হয়,কতদিন অসুস্ত ছিলেন,কত তারিখে ইন্তিকাল করেনে সে বিষয়ে কোনো াদীসেই কিছা উল্লেখ করা হয় নাই।
২য় হিজরী শতক থেকে তাবি ও তাবিয়ী আলিমগণ রাসুল্লাহ(সা) এর জিবনে ঘটনাবী ঐতিহাসিক দিন তারিক সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন।তখন থেকে মুসলিম আলিমগণ এ বিষয়ে অনেখ মত পেশ করেছেন।
তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে অনেক মত রযেছে। কোউ বলেছেন সফর মাসের শেষ দিকে তাঁর অসুস্থতা শুরু।কেউ বলেছেন রবিজউল আউয়াল মাস থেকে তার অসুস্থতা শুরু। দ্বীতিয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবেয়ী ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক(১৫ হি/৭৬৮খৃ)বলেন:
রাসুল্লাহ(সা) যে অসুস্থায় ইন্তিকাল করেন, সেই অসুস্থার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষ কযেক রাত থেকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে। (ইবনু হিশাম,আস-সীরাহ আন নববিয়্যাহ৪/২৮৯)।
কি বার থেকে তাঁর অসুস্থতা শুরু হয়েছিলি, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার,কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তাঁর অসুস্থতা শুরু হয়। (কাসতালানী,আহমদ ইবনু মাহাম্মদ,আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া৩/৩৭৩;যারকানী,শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩)।
কয়েকদিন অসুস্থার পর তিনি ইন্তিকাল করেন , সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ১০ দিন, কেউ বলেছেন ১২ দিন, কেউ বলেছেন ১৩ দিন, কেউ বলেছেন ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পর তিনি ইন্তিকাল করেন। (কাসতালানী,আহমদ ইবনু মাহাম্মদ,আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া৩/৩৭৩;আল-লাদুন্নিয়া৩/৩৭৩;যারকানী,শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩)।
সর্বাবস্থায়, কেউ কোনোভাবে বলছেন নাযে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোন দিন তিনি সুস্থ ছিলেন।অসুস্থ অবস্থাতেই,ইন্তিকালের
কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণীত হয়েছে। বুখারী সংকলীত হাদীসে আয়েশা (রা) বলেন:
…………………………………………………………………………………………………………………রাসুল্লাহ(সা) যখন আমার গৃহে প্রবেশ করলেন এবং তার অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন,তোমরা আমার উপরে ৭ মশক পানি ঢাল….,যেন আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশেনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাব তাঁর দেহে পানি ঢাললাম…। এরপর তিনি মানুষদের নিকট বেরিয়ে যেয়ে তাদরেকে নিয়ে সালাত আদায় করলেনে এবং তাদেরকে খুতবা প্রদান করলেন বা ওয়াজ করলেন। (বুখারি আস-সহীহ ১/৮৩,৪/২৬২৪,৫/২১৬০;হাকীম,আল-মুসতাদরাক ১/২৪৩;ইবনু শিব্বান,আস-সহীহ১৪/৫৬৬)।
এখানে স্পষ্ট যে রাসুল্লাহ(সা) তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা ও জরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন,যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মসজিদে যেয়ে সবাইকে নসীহত করতে পারেন।
এই গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদিসে কোনো বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নী।তবে আল্লামা ইবনু হজার আসকালানী সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম অন্যান্য হাদীসের সাথে এই হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে,এই গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ইন্তিকালের ৫ দিন আগে। (ইবনু শাজার,ফাতাহুল বারী ৮/১৪২)। ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল হলে তা ঘটেছিল ৮ ই রবিউল আউয়াল।
উপরের আলোচনা থেকে আমাদের নিকট প্রতিয়মান হয় যে সফর মাসের শেষ বুধবার রাসুল্লাহ(সা) এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এজন্য সাহাবীগণের আনন্দিত হওযা ও দান সদকা করার এ সকল কাহিনীর কোনোরুপ ভিত্তি নেই। আল্লাহই ভাল জানেন। সেহেতু মূল ঘটনাটিই প্রমানিত নয়, সেহেতু সেই ঘটনা উদযাপন করা বা পালন করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এরপরেও আমাদের বুঝতে হবে যে,কোন্আনন্দ বা দঃখের ঘটনা আনন্দিত বা দঃখিত হওযা এক কথা, আর প্রতি বৎসর সেই দিনে আনন্দ বা দঃখ করা বা “আনন্দ দিবস” বা “শোক দিবস”উদযাপন করা সম্পূর্ন অন্য কথা। উভয়ের মধ্যে আসমান জমিন পার্থক্য।
রাসুল্লাহ(সা)-এর জিবনে অনেক আনন্দের দিন বা মূহর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হযেছেন,শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সাজদাবনত হয়েছেন। কোনো কোনো ঘটনায় তার পরিবারবর্গ ও সাহাবীগনেরও আনন্দিত হয়েছেন বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময় সেই দিন বা মূহুর্তকে তারা বাৎসরিক আনন্দ দিবস হিসাবে উৎযাপন করেন নি। এজন্য রাসুল্লাহ(সা) ওর নির্দেশ বা সাহাবীদের কর্ম ছাড়া এইরূপ কোনোদিন বা মুহুর্ত পালন করা বা এগুলিতে বিশেষ ইবাদতকে বিশেষ সওয়াবের কারণ বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই।
খ.আখেরী চাহারা শোম্বার নামায
উপরের আলোচনা থেকে জানতে পারেছি য়ে,সফর মাসের শেষ বুধবার কোনো প্রকার বিশেষশত্ব হাদীস দ্বারা প্রমানিত হয়নি। এই দিনে কোনোরূপ ইবাদত, বন্দেগি, সালাত , যিকির, দোয়া,দান,সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য কোনো দিনের চেয়ে বেশি বা বিশেষ কোনো স্ওয়াব বা বরকতলাভ করা যাবে বলে ধারনা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।এজকন্য আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী লিখেছেন য়ে,সফর মাসের শেষ বুধবারে যে বিশেষ নফল সালাত বিশেষ কিছু সুরা বা আয়াত ও দোয়া পাঠের মাধ্যমে আদায় করা হয় তা বানোয়াট ও ভিত্তহীন। (আব্দুল হাই লখনবী,আল-আসার,পৃ১১১)।
২.১১.৩. রবিউল আউয়াল মাস
মহা নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ও ইন্তিকালের মাস হিসাবে রবিউল আউয়াল মাস মুসলিমে মানষে বিশেষ মর্যদার আসনে অধিষ্টিত।এই মাসের ফযীলত,ও আমল বিষয়ক হাদসে আলোচনা করারয ্আগে আমরা রাসুল্লাহ(সা) এর জন্ম ও ইন্তিকাল সম্পর্কে হাদীস ও ইতিহাসের আলোকে আলোচনা করব।মহান আল্লার কাছে তাওফিক চাই।
প্রথমত,রাসুল্লাহ(সা) এর জন্ম তারিখ
রাসুল্লাহ(সা) এর জন্ম বার,জন্মজ দিন,জন্ম মাস ও জন্ম তারিখ বিষয়ক হাদীসে ও ঐতিহাসিক তথ্যাদি বিস্তারিত আলোড়চনা করেছি ‘এহইযাউস সুনান গ্রন্থে।এখানে সংক্ষেপে কিছু বিষয়ক আলোচনা করছি।
সহীহ হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে,রাসুল্লাহ(সা) সোমবার জন্মগ্রহন করেছেন । (সহীহ মুসলিম ২/৮১৯; মুসনাদে আহমদ ৪/১৭২-১৭৩, নং২৫০৬)। হাদীসে নববী থেকে তার জন্ম মাস ও জন্ম তারিখ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।সাহাবীগণের মাঝেও এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ঠ মত প্রচলিত ছিল না। এ কারনে পরবর্তী যুগের আলিম ঐতিহাসিকগণ তার জন্মতারিখ সম্পর্কে মতভেদ করেছেন। এ বিষয়ে ১২ টির ও বেশি মত রযেছে। ইবনে হিশাম,ইবনে সা’দ,ইবনে কাসীর,কাসতালানী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক এ বিষয়ে নিম্নলিখিত মতামত উল্লেখ করেছেন:
(১).কারো মতে তাঁর জন্ম তারিখ অজ্ঞাত,তা জানা য়ায় নি এবং তা জানা সম্বব নয়। তিনি সোমবার জন্মগ্রহন করেছেন এতটুকুই জানা যায়,জন্ম মাস বা তারিখ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা তারা অবান্তর মনে করেন।
(২)কারো কারো মতে তিনি মুহররাম মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
(৩)অন্য মতে তিনি সফর মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
(৪)কারো মতে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্মগ্রহন করেন। দ্বীতিয় হিজরি শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক মুহাদ্দিস আবু মা’শার নাজীহ বিন আব্দুর রহমান আস- সিনদী (১৭০হি)এই মত গ্রহণ করেছেন।
(৫)অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ। আল্লামা কাসতালানী ও যারকানীর বর্ণনায় এই মতটি ই অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহন করেছেন। এই মতটি দুজন সাহাবী ইবনু আব্বাস ও জুবাইর বিন মুতয়িম(রা) তেকে বর্ণিত। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সিরাতের বিশেষজ্ঞ এই মতটি গ্রহন করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমইবনে শিহাব যুহরি (১২৫হি)তার উস্তাদ প্রথম শতাব্দির প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও নসববিদ ঐতিহাসিক তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনে মুতায়িম৯১০০হি) থেকে এই মতটি বর্ণনা করছেন।কাসতালানী বলেন:মুহাম্মদ ইবনে জুবাইর আরবদের বংশ পরিচয় ও আরবদের ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন।রাসুল্লাহ(সা) এর জন্মতারিক সম্পর্কিত এই মতটি তিনি তাঁর পিতা সাহাবী হযরত জুবাইর বিন মুতয়িম(রা) তেকে গ্রহন করেথেন।স্পেনের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ আলী ইবনে আহমদ ইবনে হাযম(৪৫৬হি) ও মুহাম্মদ ইবনে ফাতুহ আল-হুমাইদী(৪৮৮হি) এই মতটি কে গ্রহনযোঘ্য বলে মনে করেচেন।স্পেনের মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসূফ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল বার(৪৬৩হি) উল্লেখ করেছেন যে ঐতিহাসিকগণ এই মতটি কে সঠিক বলে মনে করেন।মিলাদের উপর প্রথম গ্রন্থ রচনা কারি আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনে দেহিয়া (৬৩৩ হি) ঈদে মিলাদুন্নবীর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ “আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বশির আন নাযীর”-এ এই মতটিকেই গ্রহন করেছেন।
৬.অন্য মতে তাঁর জন্মতারিক ১০ই রবিউল আউয়াল।এই মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মদ বিন আলী আল বাকের(১১৪হি) থেকে বর্ণিত।১ম-২য় শতাব্দির প্রখ্যাত মাহাদ্দিস আমির বিন শারাহিল আশ শাবী(১০৪হি)থেকেও এই মতটি বর্ণিত।ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন উমর আল-ওয়াকিদী(২০৭হি) এই মত গ্রহন করেছেন।ইবনে সা’দ “আত তাবাকাতুল কুবরা”-য়শুধু দুইটা মত উল্লেখ করেছেন,২ তারিখ ও ১০ তারিখ।৬৮৪
(৭) কারো মতে রাসুলুল্লাহ(সা) এর জন্ম তারিখ ১২ই রবিউল আউয়াল।এই মতটি দ্বীতিয় হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক(১৫১হি)গ্রহন করেছেন।তিনি বলেছেন:রাসুল্লাহ(সা) হাতির বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ১১ তারিখে জন্মগ্রহন করেছেন।৬৮৫ এখানে লক্ষনিয় যে ইবনে ইসহাক সীরাতুন্নবীর সকল তথ্য সাধারনত সনদসহ বর্ননা করেছেন,কিন্তু এই তথ্যটির জন্য কোনো সনদ উল্লে করেননি।কোথা থেকে তিনি এই তথ্যটি গ্রহন করেছেন তাও জানাননি বা সনদ সহ প্রথম শতাব্দির কোনো সাহাবি বা তাবেয়ী থেকে বর্ণনা করেন নি।এ জন্য অনেক গবেষক এই মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।৬৮৬ তা সত্তেও পরবর্তী যুগে এই মতটিই প্রসিদ্ধি লাষ করেছেন যে ২জন সাহাবি হযরত জাবির ও হযরত ইবনে আব্বাস থেকে এই মতটি বর্ণিত।
(৮).অন্য মতে রাসুল্লাহ(সা) এর জন্মতারিখ১৭ই রবিউ্রল আউযাল।
(৯).অন্য মতে তাঁর জন্ম তারিখ ২২-শে রবিউ্রল আউযাল।
(১০).অন্য মতে তিনি রবিউ্রস সানী মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
(১১)অন্য মতে তিনি রজব মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
(১২)(১১)অন্য মতে তিনি রমজান মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
তৃতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যুবাইর ইবনে বক্কার (২৫৬হি) থেকে এই মতটিবর্ণিত জুবাইর বিন মুতয়িম(রা) তেকে গ্রহন করেথেন।স্পেনের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ আলী ইবনে আহমদ ইবনে হাযম(৪৫৬হি) ও মুহাম্মদ ইবনে ফাতুহ আল-হুমাইদী(৪৮৮হি) এই মতটি কে গ্রহনযোঘ্য বলে মনে করেচেন।স্পেনের মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসূফ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল বার(৪৬৩হি) উল্লেখ করেছেন যে ঐতিহাসিকগণ এই মতটি কে সঠিক বলে মনে করেন।মিলাদের উপর প্রথম গ্রন্থ রচনা কারি আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনে দেহিয়া (৬৩৩ হি) ঈদে মিলাদুন্নবীর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ “আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বশির আন নাযীর”-এ এই মতটিকেই গ্রহন করেছেন।
৬.অন্য মতে তাঁর জন্মতারিক ১০ই রবিউল আউয়াল।এই মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মদ বিন আলী আল বাকের(১১৪হি) থেকে বর্ণিত।১ম-২য় শতাব্দির প্রখ্যাত মাহাদ্দিস আমির বিন শারাহিল আশ শাবী(১০৪হি)থেকেও এই মতটি বর্ণিত।ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন উমর আল-ওয়াকিদী(২০৭হি) এই মত গ্রহন করেছেন।ইবনে সা’দ “আত তাবাকাতুল কুবরা”-য়শুধু দুইটা মত উল্লেখ করেছেন,২ তারিখ ও ১০ তারিখ। (ইবনে সাদ,আত-ত্বাকাতুল কুবরা১/৮০-৮১)।
(৭) কারো মতে রাসুলুল্লাহ(সা) এর জন্ম তারিখ ১২ই রবিউল আউয়াল।এই মতটি দ্বীতিয় হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক(১৫১হি)গ্রহন করেছেন।তিনি বলেছেন:রাসুল্লাহ(সা) হাতির বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ১১ তারিখে জন্মগ্রহন করেছেন। (ইবনে হিসাম,.আস সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ,১/১৮৩)।
এখানে লক্ষনিয় যে ইবনে ইসহাক সীরাতুন্নবীর সকল তথ্য সাধারনত সনদসহ বর্ননা করেছেন,কিন্তু এই তথ্যটির জন্য কোনো সনদ উল্লে করেননি।কোথা থেকে তিনি এই তথ্যটি গ্রহন করেছেন তাও জানাননি বা সনদ সহ প্রথম শতাব্দির কোনো সাহাবি বা তাবেয়ী থেকে বর্ণনা করেন নি।এ জন্য অনেক গবেষক এই মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। (মাহদী রেজাকুল্লাহ আহমদ,আস সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ,১০৯পৃ.)। তা সত্তেও পরবর্তী যুগে এই মতটিই প্রসিদ্ধি লাষ করেছেন যে ২জন সাহাবি হযরত জাবির ও হযরত ইবনে আব্বাস থেকে এই মতটি বর্ণিত।
(৮).অন্য মতে রাসুল্লাহ(সা) এর জন্মতারিখ ১৭ই রবিউ্রল আউযাল।
(৯).অন্য মতে তাঁর জন্ম তারিখ ২২-শে রবিউ্রল আউযাল।
(১০).অন্য মতে তিনি রবিউ্রস সানী মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
(১১)অন্য মতে তিনি রজব মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
(১২) অন্য মতে তিনি রমজান মাসে জন্মগ্রহন করেছেন।
তৃতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যুবাইর ইবনে বক্কার (২৫৬হি) থেকে এই মতটিবর্ণিত।তার মতের পক্ষে যুক্তি হলো যে,রাসুল্লাহ(সা)সর্বসম্মতভাবে রমজান মাসে নবুয্যাত পেয়েছেন।তিনি ।তিনি ৪০ বৎসর পূর্তিতে নবুয়্যাত পেয়েছেন।তাহলে তার জন্ম অবশ্যই রমজান মাসে।এছাড়া কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত আছে যে,রাসুলল্লাহ(সা) হজ্বের পবিত্র দিনগুলোতে মাতৃগর্ভে আসেন।সেক্ষেত্রে ও তার জন্ম রমজানে ই হওয়া উচিত।এ মতের সমর্তনে হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমর(রা)থেকে একটি বর্ণনা আছে বলে উল্লেখ করেন। (ইবনে সাদ,আত-ত্বাকাতুল কুবরা১/১০০-১০১,ইবনে কাসীর,আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২১৫,.আল কাসতালানী,আহমদ বিন ,মুহাম্মদ,আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা ১/৭৪-৭৫,আল-যারকানী ,শারহূল মাওয়াহীব আল-লাদুন্নীয়া১/২৪৫/২৪৮,ইবনে রাজাব,লাতায়েফূল মায়ারেফ,প্রগুক্ত ১/১৫০)।
দ্বীতিয়ত,রাসুলুল্লাহ(সা) এর ওফাত দিবস
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে , রাসুলল্লাহ(সা) সোমবার ইন্তিকালের করেন। (বুখারী আস সহীহ ১/২৬২,৪/১৬১৬;মুসলিম,আস-সহীহ১/৩১৫;আবূ নুআইম ইসপাহানি,আল মুসনাদ আল-মুসতাখরাজ আলা সহীহ মুসলিম ২/৪৩-৪৪)।
কিন্তু এই সোমবারটি কোন মাসের কোন তারিখ ছিল তা কোনো হাদীসে নাই। রামাদান মাসের ১১ তারিখে ইন্তিকাল করেন। (ইবনু হাজার,ফাতাহতুল বারী ৮/১২৯০)।
এই একক বর্ননাটি ছালা মুসলিম উম্মহর সকল। ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিস একমত যে রাসুলল্লাহ(সা) রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু কোন তারিখে ইন্তিকাল করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে ।
বুখারী ও মুসলিম সংকলিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে,রাসুলুল্লাহ(সা) এর বদদায় হজ্জের ৯ই যিলহাজ্জ আরাফায় অবস্থানের দিনটি ছিল শুক্রবার। (বুখারী১/২৫,৪/১৬০০,১৬৮৩,৬/২৬৫৩;মুসলিম,৪/২৩১২-২৩১৩)। এ থেকে আমরা জানতে পারি যে সে বছর ছিল যিলহাজ্জ মাসের ১ তারিখ ছিল বৃহস্পতিবার। আমরা জানি যে,বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে তিনি যিলহাজ্জ মাসের বাকি দিনগুলি এবং মুহর্রাম ও সফর মাস মদিনায় অবস্থান করেন এবং রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন । কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেন যে তিনি বিদায় হজ্জের এই দিনের পরে ৮০ বা ৮১ দিন জীবিত ছিলেন। এরপর রবিউল আউয়াল মাসের শুরুতে তিনি ইন্তিকাল করেন। (ইবনু হাজার,ফাতাহতুল বারী ৮/১৩০)।
ইন্তিকালের তারিখ সম্পর্কে দ্বিতিয় হিজরীর তাবেয়ী ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তী ঐতিহাসিকগণের ৪টি মত রয়েছে:১লা রবিউ্ল আউয়াল,২রা রবিউল আউয়াল,১২ইরবিউ্ল আউয়াল ও ১৩রবিউ্ল আউয়াল। (ইবনু হাজার,ফাতাহতুল বারী ৮/১২৯)।
সাধারন ভাবে পরবর্তীকালে ১২ তারিখের মতটিই প্রসিদ্ধ রাভ করে। কিন্তু এখন একটি কঠিন সমস্যা রয়েছে। আমরা জানি যে,আরবি মাস ৩০ বা ২৯ দিনে হয় এবং সাধারণত পরপর ৩টি মাস ২৯ বা ৩০ দিন হয না। উপরের হাদিস থেকে লক্ষ আমরা জেনেছি য়ে,যিলহজ্জ মাস শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার। আর বৃহস্পতিবার ১লা যিলহজ্জ কোনো ভাবেই হতে পারে না। যিলহজ্জ,মহর্রম,সফর তিনটি মাসই ৩০ দিনে ধরলে ১ লা রবিউল আউয়াল হয় বুধবার।দুইটা ৩০ একটি ২৯ ধরলে ১লা রবিউল আউয়াল হয় মঙ্গলবার।দুইটা ২৯ একটি ৩০ ধরলে ১লা রবিউল আউয়াল হয় সোমবার আর তিন মাসই ২৯ দিনে ধরলে ১লা রবিউল আউয়াল হয় রবিবার। আর কোনো হিসাবেই ১২ তারিখ সোমবার হয় না।এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য কেউ কেউ ১৩ তারিখের কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন তিনটি মাস ই ৩০ দিনে ছিল এবং মদিনার একদিন পরে চাঁদ দেখা গিয়েছিল। দুটিই ব্যাখ্যাই দূরবর্তী।(ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯-১৩০)।
দ্বিতিয় হিজরীর শতকের প্রখ্যাত তাবেয়ী ঐতিহাসিক আল্লামা সুলাইমান ইবনে তারখান আত-তাইমী(৪৬-১৪৩হি) বলেন রাসুল্লাহ(সা) এর অসুস্ততা শুরু হয় ২২ সফর শনিবার।১০ দিন অসুস্ততা থাকার পর ২রা রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি ইন্তিকাল করেন।(ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯)।
তাঁর এই মত অনুসারে সে বৎসরের যিলহাজ্জ,মুহর্রাম ও সফর তিনটি মাস ই ২৯ দিনে ছিল,যা সাধারনত খুব কম ঘটে।এ জন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ও গবেষক ১ লা রবিউল আউয়ালের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে আল্লামা সুহাইলী, ইবনু হাজার প্রমুখ গবেষক, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ২ তারিখের মতটিকেই গ্রহন করেছেন। তিনটি কারণে তাঁরা এই মতটি গ্রহণ করেছেন। প্রথমত, তাবেয়ীগণের যুগ হতে সহীহ সনদে কথাটি পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই মতটি বিদায় হজ্জের পরে তাঁর ৮০ দিন বা ৮১ দিন জীবিত থাকার বর্ণনাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তৃতীয়ত, যারা ১২ বলেছেন তাদের কথার একটি দুরবর্তী ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যে, আরবীতে ‘মাসের দুইকে’ ‘দশের দুই’ পড়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। কেউ হয়তো ২ কে ১৩ পড়েছিলেন ও লিখেছিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসরণ করেছে।(ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯-১৩০)।
তৃতীয়ত, হাদীসের আলোকে রবিউল আউয়াল মাসের ফযীলত
উপরের আলোচনা হতে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ(সা) এর জন্ম বা ওফাতের মাস হিসেবে রবিউল আউয়াল মাসের কোনো উল্লেখ হাদীস শরীফে নেই। এই মাসের কোনো বিশেষ ফযীলত বা বিশেষ আমল কোনো কিছুই হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
এ বিষয়ক মিথ্যা গল্প কাহিনীর মধ্যে রয়েছে, “এই মাসের ১২ তারিখ বুযুর্গ তাবেয়ীগণ হযরত মুহাম্মাদ(সা) এর রূহের মাগফিরাতের জন্য ২০ রাকা’য়াত নফল নামায পড়িতেন। এই নামায দুই রাকা’য়াতের নিয়মে আদায় করিতেন এবং প্রত্যেক রাকা’য়াতে সূরা ফাতিহার পরে ১১ বার করিয়া সূরা ইখলাস পড়িতেন। নামায শেষে আল্লাহর হাবীবের প্রতি সাওয়াব রেছানী করিতেন। তাহারা ইহার বরকতে খাবের মাধ্যমে হযরত রাসূলুল্লাহ(সা)কে দর্শন লাভ করিতেন এবং দোজাহানের খায়ের ও বরকত লাভ করিতেন। অন্য রেওয়ায়াতে বর্ণিত আছে যে, কোনো মু’মিন ব্যক্তি নিম্নের দুরূদ শরীফ এই মাসের যে কোনো তারিখে এশার নামাযের পরে ১১২৫ বার পাঠ করিলে আল্লাহর রহমতে সে ব্যক্তি হযরত নবী করীম(সা)কে স্বপ্নে দর্শন লাভ করিবে।…….”(মুফতী হাবিব ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ১৬-১৭)।
এইরূপ আরো অনেক ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে দেখা যায়।(অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ৩০১, ৩০২)। এগুলি সবই বানোয়াট কথা। রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের পরবর্তী তিন যুগ, সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের মধ্যে এই মাসটির কোনো পরিচিতিই ছিল না। এ্ই মাসটি যে রাসূলুল্লাহ(সা) এর জন্ম মাস সেই কথাটিই তখনো প্রসিদ্ধি লাভ করে নি।
৪০০ হিজরীর দিকে সর্বপ্রথম মিশরের ফাতেমীয় শিয়া শাসকগণ এই মাসে ‘মিলাদ’ বা রাসূলুল্লাহ(সা) এর জন্ম দিবস পালন করে। ৬০০ হিজরীতে ইরাকের ইরবিল শহরে ৮ ও ১২ ই রবিউল আউয়াল মীলাদ বা মীলাদুন্নবী বা রাসূলুল্লাহ(সা) এর জন্ম উদযাপন শুরু হয়। অপরদিকে ভারত ও অন্যান্য দেশে ১২ই রবিউল আউয়ালে রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকাল উপলক্ষ্যে ‘ফাতেহা’ বা ‘ফাতেহায়ে দোয়াজদহম’ উদযাপন শুরু হয়। এ বিষয়ক সকল তথ্য বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে।
২.১১.৪. রবিউস সানী মাস
রবিউস সানী বা রবিউল আউয়াল মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা এই মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিকর বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি।
রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের প্রায় সাড়ে পাঁচশত বৎসর পরে, ৫৬১ হিজরীর রবিউস সানী মাসের ১০ তারিখে হযরত আব্দুল কাদের জীলানী(রাহ) ইন্তিকাল করেন। আমাদের দেশে অনেকে এই উপলক্ষ্যে ১১ই রবিউস সানী গেয়ারভী শরীফ বা ফাতেয়াহে ইয়াজদহম পালন করেন।
স্বভাবতই এর সাথে হাদীসের কোন সম্পর্কই নেই। এমনকি জন্ম বা মৃত্যু উদযাপন করা বা জন্ম তারিখ বা মৃত্যু তারিখ উপলক্ষ্যে দোয়া খায়ের বা সাওয়াব রেসানী করার কোন নির্দেশনা, প্রচলন বা উৎসাহ কোন হাদীসে নেই। রাসূলুল্লাহ(সা) এর জীবদ্দশায় তাঁর অনেক মেয়ে, ছেলে, চাচা, চাচাতো ভাই, দুধ ভাই ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম ওলী সাহাবীগণ ইন্তিকাল করেছেন। তিনি কখনো কারো মৃত্যুর পরের বৎসরে, বা পরবর্তী কোন সময়ে মৃত্যুর দিনে বা অন্য কোন সময়ে কোন ফাতেহা বা কোন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন নি।
রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের পরে তাঁর কন্যা ফাতিমা, জামাতা আলী, দৌহিত্র হাসান-হুসাইন, উম্মুল মোমিনীনগণ, খলিফায়ে রাশীদগণ, অন্যান্য সাহাবীগণ, তাবেয়ী-তাবি-তাবেয়ীগণ কেউ কখনো তাঁর ইন্তিকালের দিনে বা অন্য কোন সময়ে কোনরূপ ফাতিহা, দোয়া বা কোন অনুষ্ঠান করেন নি।
রবিউস সানী মাসের ফযীলত, আমল ইত্যাদি নামে যা কিছু প্রচলিত রয়েছে সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। যেমনঃ রবিউস সানী মাসের প্রথম তারিখে রাত্রিবেলা চার রাকা’য়াত নফল নামায আদায় করিতে হয়। উহার প্রতি রাকা’য়াতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইখলাছ পড়িতে হয়। এই নামায আদায়কারীর আমলনামায় ৯০ হাজার বৎসরের সাওয়াব লিখা হইবে এবং ৯০ হাজার বৎসরের গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইবে।(মুফতী হাবিব ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ১৭-১৮)। এইরূপ আরো অনেক আজগুবী মিথ্যা কথা প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে দেখা যায়। (মুফতী হাবিব ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ১৭-১৮, অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, পৃ. ৩০২)।
২.১১.৫. জমাদিউল আউয়াল মাস
জমাদিউল আউয়াল মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা এই মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিকর বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। যেমনঃ “রাসূলে করীম(সা) এর সাহাবীগণ এই মাসের প্রথম তারিখে দুই রাকায়াতের নিয়্যতে মোট বিশ রাকায়াত নামায আদায় করিতেন এবং ইহার প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পরে একবার করিয়া সূরা ইখলাস পাঠ করিতেন। নামাযের পরে নিম্নের দুরূদ শরীফ ১০০ বার পাঠ করিতেন। এই নামাযীর আমলনামায় অসংখ্য নেকী লিখা হইবে এবং তাহার সমস্ত নেক নিয়ত পূর্ণ করা হইবে।….কোনো ব্যক্তি এই মাসের প্রথম তারিখে দিনের বেলা দুই রাকায়াতের নিয়্যতে মোট ৮ রাকায়াত নামায আদায় করিলে এবং প্রতি রাকায়াতে সূরা ইখলাস ১১ বার পাঠ করিলে……।”(মুফতী হাবিব ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ১৮, অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, পৃ. ৩০৩)। এই জাতীয় অনেক আজগুবি, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা আমাদের দেশে প্রচলিত ‘বার চাঁদের ফযীলত’ ও এই ধরনের পুস্তকাদিতে পাওয়া যায়।
২.১১.৬. জমাদিউস সানী মাস
জমাদিউস সানী বা জমাদিউল আখের (জুমাদা আল আখেরা)মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা এই মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিকর বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। যেমনঃ জমাদিউস সানী মাসের পহেলা তারিখে হযরত আবূ বকর সিদ্দিক(রা) ও অন্যান্য সাহাবীগণ দুই রাকায়াতের নিয়্যতে মোট ১২ রাকায়াত নামায আদায় করিতেন। ইহার প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পরে ১১ বার করিয়া সূরা ইখলাস পড়িতেন। আবার কেহ কেহ সূরা ইখলাসের পরে তিনবার করিয়া আয়াতুল কুরসী পাঠ করিতেন। এই নামাযে অসংখ্য নেকী লাভ হয়।………(মুফতী হাবিব ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ১৮-১৯, অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, পৃ. ৩০৩)। এ সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা।
২.১১.৭. রজব মাস
রজব মাসকে নিয়ে যত বেশি মিথ্যা হাদীস তৈরি করা হয়েছে, তত বেশি আর কোন মাসকে নিয়ে করা হয় নি। সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউল সানী, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানী এই ৫ মাসের ফযীলত বা খাস ইবাদত বিষয়ক যা কিছু বানোয়াট কথাবার্তা তা মূলত গত কয়েক শত বৎসর যাবত ভারতীয় উপমহাদেশেই প্রচলিত হয়েছে। ৫ম/৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত মাউযূ হাদীস বা ফযীলতের বইগুলিতেও এ সকল মাসের উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ সকল যুগে যে সকল নেককার সরলপ্রাণ বুযুর্গ ফযীলত ও আমলের বিষয়ে সত্য-মিথ্যা সকল কথাই জমা করে লিখতেন তাদের বই পুস্তকেও এই মাসগুলির কোনো প্রকারের উল্লেখ নেই। তাঁরা মূলত রজব মাস দিয়েই তাদের আলোচনা শুরু করতেন এবং মুহাররাম মাস দিয়ে শেষ করতেন।
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, রজব মাস ইসলামী শরীয়তের ‘হারাম’ অর্থাৎ নিষিদ্ধ বা সম্মানিত মাসগুলির অন্যতম। জাহিলী যুগ থেকেই আরবরা ‘ইবরাহীম(আ) এর শরীয়ত’ অনুসারে এই মাসগুলির সম্মান করত। তবে ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার ও রসম রেওয়াজ প্রবেশ করে। জাহিলী যুগে আরবরা এই মাসকে বিশেষভাবে সম্মান করত। এই মাসে তারা আতীরাহ নামক এক প্রকার কুরবানী করতো এবং উৎসব করতো। হাদীস শরীফে তা নিষেধ করা হয়েছে।(বুখারী, আস-সহীহ ৫/২০৮৩; মুসলিম আস সহীহ, ৩/১৫৬৪)।
‘হারাম’ মাস হিসেবে সাধারণ মর্যাদা ছাড়া ‘রজব’ মাসের মর্যাদায় কোনো সহীহ হাদীসে কিছু উল্লেখ করা হয় নি। এই মাসের কোনোরূপ মর্যাদা, এই মাসের কোনো দিনে বা রাতে কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, যিকর, দোয়া, তিলাওয়াত বা কোনো বিশেষ ইবাদতের কোনো বিশেষ ফযীলত আছে এই মর্মে রাসূলুল্লাহ(সা) থেকে কোনোরূপ কোনো হাদীস সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। পরবর্তী যুগের তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণ হতে কিছু কথা পাওয়া যায়। কিন্তু এ বিষযে অনেক জাল ও বানোয়াট কথা প্রচলিত রয়েছে। যেহেতু আমাদের দেশে সাধারণভাবে ২৭শে রজব ছাড়া অন্য কোনো দিবস বা রাত্রিকেন্দ্রিক জাল হাদীসগুলি তেমন প্রসিদ্ধ নয়, সেহেতু ২৭শে রজবের বিষয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা এবং বাকি বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনার ইচ্ছা করছি। মহান আল্লাহর দরবারে তাওফীক প্রার্থনা করছি।
প্রথমত, সাধারণভাবে রজব মাসের মর্যাদা
সাধারণভাবে রজব মাসের মর্যাদা, এই মাসে কী কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এবং এই মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে কোনো সময়ে বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের সালাত, সিয়াম, দান, দোয়া ইত্যাদি ইবাদত করলে কী অকল্পনীয় সাওয়াব বা পুরস্কার পাওয়া যাবে তার বর্ণনায় অনেক জাল হাদীস বানানো হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিত ‘বার চাঁদের ফযীলত’ ও আমল-ওযীফা বিষয়ক বইগুলিতে এগুলির সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়।
যেমন, অন্য মাসের উপর রজবের মর্যাদা তেমনি, যেমন সাধারণ মানুষের কথার উপরে কুরআনের মর্যাদা……..। এই মাসে নূহ(আ) ও তাঁর সহযাত্রীগণ নৌকায় আরোহন করেন….। এই মাসেই নৌকা পানিতে ভেসেছিল….। এ মাসেই রক্ষা পেয়েছিল। এ মাসেই আদমের তাওবা কবুল হয়। এ মাসেই ইবরাহীম(আ) ও ঈসা(আ) এর জন্ম। এ মাসেই মূসার জন্য সমুদ্র দ্বিখন্ডিত হয়। ……এই মাসের প্রথম তারিখে রাসূলুল্লাহ(সা) এর জন্ম। এই মাসের ২৭ তারিখে তিনি নব্যুয়ত প্রাপ্ত হন। …এই মাসের ২৭ তারিখে তিনি মেরাজ গমন করেন। …..এই মাসে সালাত, সিয়াম, দান, সদকা, যিকর, দুরূদ, দোয়া ইত্যাদি নেক আমল করলে তার সাওয়াব বৃদ্ধি পায় বা বহুগুণ বেড়ে যায়….।ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা ও জাল হাদীস। পূর্ববর্তী অনেক বুযুর্গের আমল ওযীফা ও ফাযাইল বিষয়ক গ্রন্থে এগুলির সমাবেশ ঘটেছে। তবে আমাদের সমাজের সাধারণ ধার্মিক মুসলমানদের মাঝে এগুলির প্রচলন কম। এ জন্য এগুলির বিস্তারিত আলোচনা বর্জন করছি।
দ্বিতীয়ত, রজব মাসের সালাত
রজব মাসে সাধারণভাবে এবং রজব মাসের ১ তারিখ, ১ম শুক্রবার, ৩, ৪, ৫ তারিখ, ১৫ তারিখ, ২৭ তারিখ, শেষ দিনে বা অন্যান্য বিশেষ দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি ও সেগুলির অভাবনীয় পুরস্কারের ফিরিস্তি দিয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচারিত হয়েছে।পূর্ববর্তী অনেক বুযুর্গের আমল ওযীফা ও ফাযাইল বিষয়ক পুস্তাকাদিতে এবং আমাদের দেশে বার চাঁদের ফযীলত, আমল-ওযীফা ও অন্যান্য পুস্তকে এগুলির কিছু কথা পাওয়া যায়। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এগুলির প্রচলন কম। এজন্য এগুলির বিস্তারিত আলোচনা করছি না। মুহাদ্দিসগণ এক্ষেত্রে যে মূলনীতি উল্লেখ করেছেন তা বলেই শেষ করছি।
আল্লামা ইবনু রাজাব, ইবনু হাজার আসকালানী, সুয়ূতী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে বলেছেন, রজব মাসে বিশেষ কোন সালাত বা রজব মাসের কোন দিনে বা রাতে কোন সময়ে কোন সালাত আদায় করলে বিশেষ সাওয়াব পাওয়া যাবে এই মর্মে একটি হাদীসও কোন গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও বানোয়াট। (ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৪; ইবনু হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৯-৮০; আব্দুল হাই লাখনাবী, আল আসার, পৃ. ৫৮-৯০)।
তৃতীয়ত, রজব মাসের দান, যিকর ইত্যাদি
রজব মাসের যিকর, দান, দোয়া, দুরূদ ইত্যাদি নেক আমলের বিষয়েও একই কথা। রজব মাসে এ সকল নেক আমল করলে বিশেষ কোন সাওয়াব হবে বা সাধারণ সাওয়াব বৃদ্ধি পাবে এই মর্মে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন। (ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৭; ইবনু হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৯-৮০; আব্দুল হাই লাখনাবী, আল আসার, পৃ. ৫৮-৯০)।
চতুর্থত, রজব মাসের সিয়াম
সবচেয়ে বেশি জাল হাদীস প্রচার হয়েছে রজব মাসের সিয়াম পালন বিষয়ে। বিভিন্নভাবে এই মাসে সিয়াম পালনের উৎসাহ দিয়ে জালিয়াতগণ হাদীস জাল করেছে। কোন কোন জাল হাদীসে সাধারণভাবে রজব মাসে সিয়াম পালন করলে কত অভাবনীয় সাওয়াব তা বলা হয়েছে। কোনটিতে রজব মাসের নির্ধারিত কিছু দিনের সিয়াম পালনের বিভিন্ন বানোয়াট সাওয়াব পালনের কথা বলা হয়েছে। কোনটিতে রজব মাসের ১ টি সিয়াম পালনের কি সাওয়াব, ২ টি সিয়ামের কি সাওয়াব, ৩টির কি সাওয়াব….৩০ টি সিয়ামের কত সাওয়াব তা বলা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, রজব মাসের সিয়াম পালনের বিশেষ সাওয়াব বা রজব মাসের বিশেষ কোন দিনে সিয়াম পালনের উৎসাহ জ্ঞাপক সকল হাদীসই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে কোন কথাই নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি।
পঞ্জমত, লাইলাতুল রাগাইব
রজব মাস বিষয়ক জাল হাদীসের অন্যতম হলো লাইলাতুল রাগাইব ও সেই রাত্রির বিশেষ সালাত বিষয়ক জাল হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই রাত্রির নামকরণ, ফযীলত, এই রাত্রির সালাতের ফযীলত, রাক’আত সংখ্যা, সূরা কিারয়াত , পদ্ধতি সবকিছুই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা। কিন্তু বিষয়টি অনেক মুসলিম দেশে ব্যাপক প্রচার লাভ করেছে।
প্রথমত কিছু জালিয়াত এ রাত্রির নামকরণ ও এ বিষয়ক কিছু আজগুবি গল্প বানায়। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি আকর্ষণীয় ওয়াযে পরিণত হয়। জাল হাদীসের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তা সাধারণ মানুষের চিত্তাকর্ষক হয় এবং কোন একটি জাল হাদীস একবার বাজার পেলে তখন অন্যান্য জালিয়াতও বিভিন্ন সনদে তা বানিয়ে বলতে থাকে। এভাবে অনেক জাল হাদীস সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সালাতুল রাগাইব বিষয়ক হাদীসগুলিও সেইরূপ। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরে এই জাল হাদীসগুলি প্রচার ও প্রসিদ্ধি লাভ করলে সাধারণ মুসল্লীগণ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অনেক দেশে ঘটা করে লাইলাতুল রাগাইব পালন করতে শুরু করেন। এ সকল সমাজে ‘লাইলাতুল রাগাইব’ আমাদের দেশের ‘লাইলাতুল বরাত’ এর মতই উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়।
এ বানোয়াট সালাতটি আমাদের দেশে অতটা প্রসিদ্ধি লাভ করে নি। এজন্য এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি না। এর সার সংক্ষেপ হলো, রজব মাসের প্রথম শুক্রবারের রাত্রি হলো ‘লাইলাতুল রাগাইব’ বা আশা আকাঙ্খা পূরণের রাত। রজবের প্রথম বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করে, বৃহস্পতিবারের দিবাগত শুক্রবারের রাত্রিতে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে ১২ রাক’য়াত সালাত নির্ধারিত সূরা, আয়াত ও দোয়া দুরূদ দিয়ে আদায় করবে। …..তাহলে এই ব্যক্তি এত এত……পুরস্কার লাভ করবে।…….এর সাথে আরো অনেক কল্প কাহিনী যোগ করা হয়েছে এ সকল জাল হাদীসে।
এ সকল হাদীসের প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে মুহাদ্দিসগণ সেগুলির সূত্র ও উৎস নিরীক্ষা করে এর জালিয়াতির বিষয় নিশ্চিত করেছেন। মুসলিম উম্মাহর সকল মুহাদ্দিস একমত যে, ‘লাইলাতুল রাগাইব’ ও ‘সালাতুল রাগাইব’ বিষয়ক সকল কথা মিথ্যা, জাল ও বানোয়াট।
ষষ্ঠত, রজব মাসের ২৭ তারিখ
বর্তমানে আমাদের সমাজে ২৭ শে রজব মিরাজের রাত বলেই প্রসিদ্ধ। সেই হিসেবেই আমাদের দেশের মুসলিমগণ এই রাতটি পালন করে থাকেন। কিন্তু এই প্রসিদ্ধির আগেও রজব মাসের ২৭ তারিখ বিষয়ক আরো অনেক কথা প্রচলিত হয়েছিল এবং এই তারিখের দিবসে ও রাতে ইবাদত বন্দেগীর বিষয়ে অনেক জাল কথা প্রচলিত হয়েছিল। প্রথমে আমরা ‘লাইলাতুল মিরাজ’ সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। এরপর এই দিন সম্পর্কে প্রচলিত জাল ও বানোয়াট হাদীসগুলি আলোচনা করব, ইনশাল্লাহ।
ক. লাইলাতুল মিরাজ
ইসরা ও মিরাজের ঘটনা বিভিন্নভাবে কুরআন কারীমে ও অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধশহ সাহাবী থেকে মিরাজের ঘটনার বিভিন্ন দিক ছোট বা বড় আকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে মিরাজের তারিখ সম্পর্কে একটি কথাও বর্ণিত হয় নি। সাহাবীগণ তাঁকে কখনো তারিখ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন বলেও জানা যায় না। পরবর্তী যুগের তাবেয়ীদেরও একই অবস্থা; তাঁরা এ সকল হাদীস সাহাবাদের কাছে শিখেছেন, কিন্তু তাঁরা তারিখ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না। কারণ, তাঁদের কাছে তারিখের বিষয়টির কোনো মূল্য ছিল না, এ সকল হাদীসের শিক্ষা গ্রহণই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। ফলে তারিখের বিষয়ে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। মি‘রাজ একবার না একাধিকবার হয়েছে, কোন বৎসর হয়েছে, কোন মাসে হয়েছে, কোন তারিখে হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে এবং প্রায় ২০টি মত রয়েছে।
মাসের ক্ষেত্রে অনেকেই বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের ২৭ তারিখ। কেউ বলছেন রবউস সানী মাসে, কেউ বলছেন রজব মাসে, কেউ বলছেন রমজান মাসে, কেউ বলছেন শাওয়াল মাসে, কেউ বলেছেন যিলকদ মাসে, কেউ বলেছেন যিলহাজ্জ্ব মাসে। তারিখের বিষয়ে আরো অনেক মতবিরোধ আছে।
দ্বিতীয় হিজরী শতক হতে তাবেয়ী ঐতিহাসিকগণ মিরাজের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করতে পারেন নি। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ মি‘রাজের তারিখ বিষয়ক মতভেদ ও কারণ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবনু কাসীর(৭৭৪ হি), ইবনু হাজার আসকালানী(৮৫২ হি), আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল কাসতালানী(৯২৩ হি), মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আশ শামী(৯৪২ হি), আব্দুল হাই লাখনাবী(১৩০৪ হি) ও অন্যান্যরা এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
এত মতবিরোধের কারণ হলো হাদীস শরীফে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয় নি এবং সাহাবীগণও কিছু বলেন নি। তাবে-তাবেয়ীদের যুগে তারিখ নিয়ে কথা শুরু হয়, কিন্তু কেউই সঠিক সমাধান দিতে না পারায় তাঁদের যুগ ও পরবর্তী যুগে এত মতবিরোধ হয়। এই মতবিরোধ হতে আমরা বুঝতে পারি যে, কয়েক শতক আগেও শবে মেরাজ বলতে কোনো নির্দিষ্ট রাত ছিল না।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, রজব মাসের ২৭ তারিখে মি‘রাজ হয়েছিল, বা এই তারিখটি ‘লাইলাতুল মি‘রাজ’, এ্ই কথাটি তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের ঐতিহাসিকদের অনেক মতের একটি মত মাত্র। এই কথাটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। রাসূলুল্লাহ(সা) হতে এই তারিখে মি‘রাজ হওয়া সম্পর্কে কোনো কিছুই সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই ঐতিহাসিকদের মতামত বা বানোয়াট কথাবার্তা।
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করছি যে, কোনো কোনো জাল হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, রজব মাসের ২৭ তারিখে রাসূলুল্লাহ(সা) জন্মগ্রহণ করেন, নবুয়ত লাভ করেন……….ইত্যাদি। এগুলিও বাতিল ও মিথ্যা কথা।
খ. ২৭শে রজবের ইবাদত
মি‘রাজের রাত্রিতে ইবাদত বন্দেগী করলে বিশেষ কোনো সাওয়াব হবে এই বিষয়ে একটি সহীহ ও যয়ীফ হাদীসও নেই। মি‘রাজের রাত কোনটি তাই হাদীসে বলা হয় নি, সেখানে রাত পালনের কথা কিভাবে আসে। তবে ২৭ শে রজবের দিনে এবং রাতে ইবাদত বন্দেগীর ফযীলতের বিষযে কিছু জাল হাদীস প্রচলিত আছে। এ সকল জাল হাদীসে মি‘রাজের রাত হিসেবে নয় বরং রাসূলুল্লাহ(সা) এর নবুয়্যত প্রাপ্তির দিন হিসেবে বা একটি ফযীলতের দিন হিসেবে ‘২৭শে রজব’-কে বিশেষ মর্যাদাময় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এইরূপ একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছেঃ “রজব মাসের মধ্যে একটি দিন আছে, কেউ যদি এই দিনে সিয়াম পালন করে এবং সেই দিনের রাতে দাঁড়িয়ে (সালাতে ইবাদত রত) থাকে তাহলে সে ১০০ বৎসর সিয়াম পালন করার ও রাত জেগে সালাত আদায়ের সাওয়াব লাভ করবে। সেই দিনটি হলো রজব মাসের ২৭ তারিখ। এই দিনেই মুহাম্মাদ(সা) নুবয়ত লাভ করেন, এই দিনেই সর্বপ্রথম জিবরাঈল মুহাম্মাদ (সা) এর উপর অবতরণ করেন।”(জোযকোনী, আল আবাতিল, ২/৭১৪; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১১৭)।
অন্য একটি জাল হাদীসের ভাষা নিম্নরূপঃ যদি কেউ রজব মাসের ২৭ তারিখে ১২ রাকায়াত সালাত আদায় করে, প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পাঠ করে, সালাত শেষ হলে সে বসা অবস্থাতেই ৭ বার সূরা ফাতিহা পাঠ করে এবং এরপর ৪ বার ‘সুবহানাল্লাহ, ওয়ালহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা হাওলা ওয়ালা কুওআতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যূল আজিম’ বলে, অতঃপর সকালে সিয়াম শুরু করে, তবে আল্লাহ তার ৬০ বৎসরের পাপরাশি মাফ করে দিবেন। এই রাতেই মুহাম্মাদ(সা)নবুয়ত পেয়েছিলেন।” (ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৫২)।
“রজব মাসের ২৭ তারিখ আমি নবুয়ত পেয়েছি। কাজেই যে ব্যক্তি এই দিনে সিয়াম পালন করবে তার ৬০ মাসের গোনাহের কাফফারা হবে।”(ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৪)।
আরেকটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, ইবনু আব্বাস ২৭ শে রজবের সকাল হতে ইতিকাফ শুরু করতেন। যোহর পর্যন্ত সালাতে রত থাকতেন। যোহরের পরে অমুক অমুক সূরা দিয়ে চার রাকায়াত সালাত আদায় করতেন…… এবং আসর পর্যন্ত দোয়ায় রত থাকতেন…..। তিনি বলতেন, রাসূলুল্লাহ(সা) এরূপ করতেন।”(আব্দুল হাই লাখনাবী, আল আসার, পৃ. ৭৮)। এগুলি সবই জঘন্য মিথ্যা কথা।
২৭ শে রজবের ফযীলতে এবং এই দিনে ও রাতে সালাত, সিয়াম, দোয়া ইত্যাদি ইবাদতের ফযীলতে অনুরূপ আরো অনেক মিথ্যা কথা জালিয়াতগণ রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে প্রচার করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, ২৭ শে রজব সম্পর্কে হাদীস নামে যা কিছু প্রচলিত সবই ভিত্তিহীন, বাতিল ও জাল। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি, মুহাদ্দিসগণ একমত যে, রজব মাস এবং এই মাসের কোনো দিন বা রাতের বিশেষ ফযীলতের বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীসই ভিত্তিহীন। ২৭ শে রজব বিষয়ক হাদীসগুলিও এ সকল বাতিলের অন্তর্ভুক্ত। ইবনু হাজার আসকালানী, মোল্লা আলী কারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আজলূনী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হুত প্রমুখ মুহাদ্দিস বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ২৭শে রজবের ফযীলত, এই তারিখের রাত্রে ইবাদত বা দিনের সিয়াম পালনের বিষয়ে বর্ণিত সকল কথাই জাল, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
২.১১.৮. শাবান মাস
প্রথমত, সহীহ হাদীসের আলোকে শাবান মাস
পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, সফর হতে রজব পর্যন্ত ৬ মাসের বিশেষ কোনো ফযীলত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। শাবান মাস তদ্রুপ নয়। সহীহ হাদীসে শাবান মাসের নিম্নলিখিত ফযীলতগুলি প্রমাণিতঃ
১. এই মাসে রাসূলুল্লাহ(সা) বেশি বেশি সিয়াম পালন করতে ভালবাসতেন। তিনি সাধারণত এই মাসের অধিকাংশ দিন একটানা সিয়াম পালন করতেন বলে বুখারী ও মুসলিম সংকলিত সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি বুখারী ও মুসলিমের কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি শাবান মাস পুরোটাই নফল সিয়ামে কাটাতেন। তিনি এই মাসে কিছু সিয়াম পালন করতে সাহাবীগণকে উৎসাহ প্রদান করতেন।(বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৯৫, ৭০০; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮১০-৮১১,৮২০)।
২. আহমাদ, নাসাঈ প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলিত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বা হাসান পর্যায়ের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই শাবান মাসে বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়; এইজন্য এইমাসে বেশি বেশি নফল সিয়াম পালন করা উচিত।(নাসাঈ, আস সুনান ৪/২০১; আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/২০১)।
৩. শাবান মাসের মধ্যরজনী বা ১৫ ই শাবানের রাতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
এ সকল সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি এই মাসের ফযীলত ও ইবাদতের বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচলিত রয়েছে। এ জাল হাদীসগুলিকে আমার দু’ভাগে ভাগ করতে পারিঃ ১. সাধারণভাবে শাবান মাস বিষয়ক ও ২. শাবান মাসের মধ্য রজনী বা শবেবরাত বিষয়ক। আমাদের দেশে দ্বিতীয়টিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এজন্য প্রথম বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আমরা দ্বিতীয় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশাল্লাহ।
দ্বিতীয়ত, শাবান মাস বিষয়ক জাল ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা
‘বার চাঁন্দের ফযীলত’ জাতীয় কোনো কোনো পুস্তকে শাবান মাসের প্রথম রজনীতে বিশেষ সূরা বা আয়াত দিয়ে কয়েক রাকায়াত সালাত আদায়ের কথা, হযরত ফাতিমার(রা) জন্য বখশিস করার কথা, শাবান মাসে নির্ধারিত পরিমাণ দুরূদ শরীফ পাঠের বিশেষ ফযীলতের কথা, শাবান মাসের যে কোনো জুমুআর দিবসে বিশেষ সূরা দ্বারা বিশেষ পদ্ধতিতে কয়েক রাকায়াত সালাত আদায়ের কথা এবং সেগুলির কাল্পনিক সাওয়াবের কথা লেখা হয়েছে। (মুফতী হাবিব ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ১৮-১৯)। এগুলি সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। শাবান মাসে নফল সিয়াম পালন ব্যতীত অন্য কোনো প্রকারের বিশেষ ইবাদতের কথা কোনো হাদীসে বলা হয় নি।
তৃতীয়ত, শবে বরাত বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস
শাবান মাসের মধ্যম রজনী বা শবেবরাত মুসলিম সমাজে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এ বিষয়ক সকল সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস সনদসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি “কুরআন সুন্নাহর আলোকে শবে বরাতঃ ফযীলত ও আমল” নামক গ্রন্থে। এখানে আমি এ বিষয়ক জাল হাদীসগুলি আলোচনা করতে চাই। তবে প্রসঙ্গত এ বিষয়ক সহীহ ও যয়ীফ হাদীসগুলির বিষয়েও কিছু আলোকপাত করতে চাই।
১. মধ্য শাবানের রাত্রির বিশেষ মাগফেরাত
এ বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস শরীফে বলা হয়েছেঃ আরবী(*****)
“আল্লাহ তায়ালা মধ্য শাবানের রাত্রিতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং অংশীবাদী(মুশরিক) ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।”
এই অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী: আবূ মুসা আশআরী, আউফ ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, মুয়ায ইবনু জাবাল, আবু সালাবা আল খুশানী, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও আবূ বাকর সিদ্দিক(রা) হতে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। (ইবনু মাজাহ, আস সুনান ১/৪৪৫; আহমদ ইবনু হাম্বল, আল মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; বায়হাকী, শু’আবুল ঈমান, ৩/৩৮১)। এ সকল হাদীসের সনদ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা উপর্যুক্ত গ্রন্থে করেছি। এগুলির মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল ও কিছু সনদ হাসান পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদীসটি সহীহ। শাইখ আলবানী বলেন, “হাদীসটি সহীহ। তা অনেক সাহাবী হতে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।………(আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীস আসসাহীহা ৩/১৩৫)।
এ হাদীস হতে প্রমাণিত হয় যে, এই রাতটি একটি বরকতময় রাত এবং এই রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এই ক্ষমা অর্জনের জন্য শিরক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোনো আমল করার প্রয়োজন আছে কিনা তা এই হাদীসে উল্লেখ নেই।
২. মধ্য শাবানের রাত্রিতে ভাগ্য লিখন
কিছু কিছু হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয় বা পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত মওত ও রিযক ইত্যাদির অনুলিপি করা হয়। হাদীসগুলির সনদ বিস্তারিত আলোচনা করেছি উপর্যুক্ত পুস্তকটিতে। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, এই অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলি অত্যন্ত দুর্বল অথবা বানোয়াট। এই অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয় নি।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছেঃ
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ [٤٤:٣]
فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ [٤٤:٤]
আমিতো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এই রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (সূরা ৪৪ দুখানঃ আয়াত ৩-৪)।
এই বাণীর ব্যাখ্যায় তাবিয়ী ইকরিমাহ, বলেন, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে মধ্য শাবানের রাতকে বুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ বলেন, এই রাতে গোটা বছরের সকল বিষয় ফায়সালা করা হয়। (তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯)।
মুফাসসিরগণ ইকরামার এই মত গ্রহণ করেন নি। ইমাম তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরামার এই ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পরে তার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ইকরামার এই মত ভিত্তিহীন। তিনি বলেন যে, সঠিক মত হলো, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ কে বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ যে রাত্রিতে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন সেই রাত্রিকে এক স্থানে লাইলাতুল ক্বাদর বা মহিমান্বিত রজনী বলে অভিহিত করেছেন। (সূরা ৯৭, কাদর: আয়াত ১)। অন্যত্র এই রজনীকেই ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে উল্লেখ করেছেন। এবং এই রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। (সূরা ২, বাকারা: আয়াত ১৮৫)। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুবারক রজনী রামাদান মাসে, শাবান মাসে নয়।(নাহহাস, মা’আনিল কুরআন ৬/৩৯৫; ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৬৯০; কুরতুবী, তাফসীর ১৬/১২৬; ইবনু কাছীর, তাফসীর ৪/১৪০; শাওকানী, ফাতহুল ক্বাদীর, ৪/৫৭০-৫৭২)।
৩. মধ্য শাবানের রাত্রিতে দোয়া মুনাজাত
মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত তৃতীয় প্রকারের হাদীসগুলিতে এই রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ রাতে দোয়া করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমালাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এই অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস নেই। এই অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলির মধ্যে কিছু হাদীস দুর্বল এবং কিছু হাদীস জাল।
৪. অনির্ধারিত সালাত ও দোয়া
মধ্য শাবানের রাত্রি সম্পর্কে বর্ণিত কিছু হাদীসে এই রাত্রিতে সালাত আদায় ও দোয়া করার কথা বলা হয়েছে। এই সকল হাদীস এই রাত্রের সালাতের জন্য কোনো নির্ধারিত রাকা’য়াত, নির্ধারিত সূরা বা নির্ধারিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হয় নি। শুধুমাত্র সাধারণভাবে এই রাত্রিতে তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া করার বিষয়টি এ সকল হাদীস থেকে জানা যায়। এই অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলি সবই বানোয়াট পর্যায়ের। দুই একটি হাদীস বানোয়াট না বলে যয়ীফ বা দুর্বল বলে গণ্য করা যায়।
৫. নির্ধারিত রাকায়াত, সূরা ও পদ্ধতিতে সালাত
শবে বরাত বিষয়ক অন্য কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ সূরা পাঠের মাধ্যমে, নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকায়াত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী এই অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট। হিজরী চতুর্থ শতকের পরে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বানিয়ে এগুলি প্রচার করা হয়েছে। এখানে এই জাতীয় কয়েকটি জাল ও বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করছি।
১. ৩০০ রাকায়াত, প্রতি রাকায়াতে ৩০ বার সূরা ইখলাস
“যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে প্রত্যেক রাকায়াতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাকায়াত সালাত আদায় করবে জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।” হাদীসটি আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়্যিম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন।(ইবনুল ক্বাইয়্যেম নাক্বদুল মানকুল ১/৮৫)।
২. ২০০ রাকায়াত, প্রতি রাকায়াতে ১০ বার সূরা ইখলাস
মধ্য শাবানের রাত্রিতে এই পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী চতুর্থ শতকের পরে মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হিজরী সনে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম এই রাত্রিতে এই পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু হয়।(মোল্লা আলী কারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ৩/৩৮৮)। এ সময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী গল্পকার ওয়ায়েয এই অর্থে কিছু হাদীস বানিয়ে বলেন। এই অর্থে ৪ টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
এর প্রথমটি হযরত আলী ইবনু আবি তালিব(রা) এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে প্রচারিতঃ যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাত্রে ১০০ রাকায়াত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহা একবার ও সূরা ইখলাস ১০ বার পাঠ করবে, সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তায়ালা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন। লাওহে মাহফুজে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে, আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপরাশি মুছে দিবে, বছরের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবে। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা ‘আদন’ জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লক্ষ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা বেহেশতের মধ্যে তার জন্য শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপণ করবে…..। যে ব্যক্তি এ নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য তার অংশ দান করবেন।”
হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে জাল ও বানোয়াট। এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত। (ইবনুল জাউযী, আল মাউদূ’আত, ২/৫০-৫১; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ৫/২৭১; সুয়ূতী, আল লাআলী, ২/৫৯)।
এ বিষয়ক দ্বিতীয় জাল হাদীসটিতে বানোয়াটকারী রাবীগণ ইবনু উমার(রা) এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বর্ণনা করেছেঃ “যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাত্রিতে একশত রাকায়াত ৎসালাতে এক হাজার বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ১০০ জন ফেরেশতা প্রেরণ করবেন, তন্মধ্যে ত্রিশজন তাকে বেহেশতের সুসংবাদ দিবে, ত্রিশজন তাকে দোযখের আগুন হতে নিরাপত্তার সুসংবাদ প্রদান করবে, ত্রিশজন তাকে ভুলের মধ্য হতে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং দশজন তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রের জবাব দিবে।” এ হাদীসটিও বানোয়াট। সনদের অধিকাংশ রাবী অজ্ঞাত পরিচয়। বাকীরা মিথ্যাবাদী হিসেবে সুপরিচিত।(ইবনুল জাউযী, আল মাউ’দূআত, ২/৫০-৫১; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ৫/২৭১)।
এ বিষয়ক তৃতীয় জাল হাদীসটিতে জালিয়াতগণ বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ আল বাকের(১১৫ হি) হতে রাসূলুল্লাহ(সা)এর বরাতে বর্ণনা করেছেঃ “যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাত্রিতে একশত রাকায়াত সালাতে এক হাজার বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ১০০ জন ফেরেশতা প্রেরণ করবেন, তন্মধ্যে ত্রিশজন তাকে বেহেশতের সুসংবাদ দিবে, ত্রিশজন তাকে দোযখের আগুন হতে মুক্তি দিবে, ত্রিশজন তার ভুল সংশোধন করবে এবং ১০ জন তার শত্রুদের নাম লিপিবদ্ধ করবে।”
এ হাদীসটিও বানোয়াট। সনদের কিছু রাবী অজ্ঞাত পরিচয় এবং কিছু রাবী মিথ্যাবাদী হিসেবে সুপরিচিত।(ইবনুল জাউযী, আল মাউদূ’আত, ২/৫১; সুয়ূতী, আল লাআলী, ২/৫৯)।
১০০ রাকায়াত সংক্রান্ত এই বিশেষ পদ্ধতিটি বিভিন্ন গল্পকার ওয়ায়েযীনদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং যুগে যুগে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে ভারতীয় ওয়ায়েযগণ এই সালাতের পদ্ধতির মধ্যে প্রত্যেক দুই রাকায়াতের পর “তাসবীহুত তারাবীহর” প্রচলন করেন এবং ১০০ রাকায়াত পূর্ণ হওয়ার পর কতিপয় সাজদা, সাজদার ভিতরে ও বাহিরে কতিপয় দোয়া সংযুক্ত করেছেন।
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনাবী(১৩০৬ হি) বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হাদীসের মধ্যে এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। যার সারমর্ম হলো, মধ্য শাবানের রাতে পঞ্চাশ সালামে ১০০ রাকায়াত সালাত আদায় করতে হবে। প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পরে ১০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। প্রত্যেক দুই রাকায়াত পর তাসবীহুত তারাবীহ পাঠ করবে, এরপর সাজদা করবে। সাজদার মধ্যে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর সাজদা হতে মাথা তুলবে এবং নবী(সা) এর উপর দুরূদ পাঠ করবে ও কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর দ্বিতীয় সাজদা করবে এবং তাতে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে।(আব্দুল হাই লাখনাবী, আল আসার আল মারফুআ, পৃ. ১১৩-১১৪)।
৩. ৫০ রাকায়াত
ইমাম যাহাবী এ হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আলমীলী আত তাবারীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মাদ বিন সাঈদ এ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মাদ বিন আমর আল বাজালী এর সনদে হযরত আনাস(রা) হতে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেনঃ যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ৫০ রাকায়াত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার কাছে যত প্রকার প্রয়োজনের কথা বলবে তার সবটুকুই পূরণ করে দেয়া হবে। এমনকি লাওহে মাহফুজে তাকে দুর্ভাগ্যবান হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে তাকে সৌভাগ্যবান করা হবে। এবং আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ৭ লক্ষ ফেরেশতা প্রদান করবেন যারা তার নেকী লিপিবদ্ধ করবে, অপর ৭ লক্ষ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার জন্য বেহেশতে প্রাসাদ নির্মাণ করবে……এবং ৭০ হাজার একত্ববাদীর জন্য তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে………। ইমাম যাহাবী এই মিথ্যা হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, যে ব্যক্তি এ হাদীসটি বানোয়াট করেছে আল্লাহ তায়ালা তাকে লাঞ্চিত করুন।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ৬/১৬৮-১৬৯)।
৪. ১৪ রাকায়াত
ইমাম বায়হাকী তাঁর সনদে হযরত আলী(রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ(সা) কে মধ্য শাবানের রাতে ১৪ রাকায়াত সালাত আদায় করতে দেখেছি। সালাত শেষে বসে তিনি ১৪ বার সূরা ফাতিহা, ১৪ বার সূরা ইখলাস, ১৪ বার সূরা ফালাক, ১৪ বার সূরা নাস, ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং সূরা তাওবার শেষ দুই আয়াত তিলাওয়াত করেছেন, এ সব কাজের সমাপ্তির পর আমি তাঁকে এগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তুমি আমাকে যেভাবে করতে দেখেছ এভাবে যে করবে তার আমলনামায় ২০টি কবুল হজ্জের সাওয়াব লিখা হবে এবং ১০ বছরের কবুল সিয়ামের সাওয়াব লিখা হবে। পরদিন যদি সে সিয়াম পালন করে তবে দুই বছরের সিয়ামের সাওয়াব তার আমলনামায় লিখা হবে।”
হাদীসটি উল্লেখ করার পর ইমাম বায়হাক্বী বলেনঃ ইমাম আহমদ বলেছেন যে, এই হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যক্ত, জাল ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান হয়। হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে। (বায়হাক্বী, শুআব আল-ঈমান, ৩/৩৮৬-৩৮৭, হাদীস নং-৩৮৪১)।
অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করার বিষয়ে ইমাম বাইহাকীর সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। আল্লামা ইবনুল জাওযী ও ইমাম সুয়ূতী বলেন, হাদীসটি বানোয়াট, এর সনদ অন্ধকারাচ্ছন্ন।…..সনদের মধ্যে মুহাম্মাদ বিন মুহাজির রয়েছেন। ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল বলেনঃ মুহাম্মাদ বিন মুহাজির হাদীস বানোয়াটকারী।(ইবনুল জাওযী, আল মাউদূআত, ২/৫২; সুয়ূতী, আল লাআলী, ২/৫৯-৬০)।
৫. ১২ রাকায়াত, প্রত্যেক রাকায়াতে ৩০ বার সূরা ইখলাস
জালিয়াতগণ হযরত আবূ হুরায়রা(রা) পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরি করে তাঁর সূত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) থেকে বর্ণনা করেছেঃ “যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১২ রাকায়াত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকায়াতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, সালাত শেষ হওয়ার পূর্বেই বেহেশতের মধ্যে তার অবস্থান সে অবলোকন করবে। এবং তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জাহান্নামের আগুন নির্ধারিত হয়েছে এমন দশ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।” এ হাদীসের সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। এছাড়াও সনদের মধ্যে কতিপয় দুর্বল ও পরিত্যাজ্য বর্ণনাকারী রয়েছে। (ইবনুল জাউযী, আল মাউদূআত, ২/৫২; সুয়ূতী, আল লাআলী ২/৫৯)।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, মধ্য শাবানের রাতে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সূরার মাধ্যমে নির্দিষ্ট রাকায়াত সালাত আদায় করা সংক্রান্ত হাদীসসমূহ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। মুহাদ্দিসগণ এ ব্যাপারে সকলেই একমত। কিন্তু কতিপয় নেককার ও সরলপ্রাণ ফকীহ ও মুফাসসির তাঁদের রচনাবলিতে এগুলির জালিয়াতি ও অসারতা উল্লেখ ব্যতীতই এ সকল ভিত্তিহীন হাদীস স্থান দিয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ এগুলির উপর ভিত্তি করে ফতোয়া প্রদান করেছেন ও তদনুযায়ী আমল করেছেন, যা পরবর্তীতে এই রীতি প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।
মোল্লা আলী কারী(১০১৪ হি) মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলির অসারতা উল্লেখপূর্বক বলেন, সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো যে, যারা সুন্নাতের ইলমের সন্ধান পেয়েছেন তারা এগুলির দ্বারা প্রতারিত হন কি করে! এ সালাত চতুর্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থাকে। এ ব্যাপারে অসংখ্য জাল হাদীস তৈরি করা হয়েছে যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযোগ্য নয়।(মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, পৃ. ৩৩০-৩৩১; ইবনুল কাইয়্যেম, আল মানার আল মুনীফ পৃ. ৮৯-৯৯)। তিনি বলেন, হে পাঠক, এ সকল ভিত্তিহীন মিথ্যা হাদীস ‘কুতুল কুলুব’, ‘ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন’ ও ইমাম সালাবীর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ থাকার কারণে আপনারা প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হবেন না। (মোল্লা আলী কারী, আল মাসনূ, পৃ.২০৮-২০৯)। ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ আজলুনীও (১১৬২ হি) অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।(আজলুনী, কাশফুল খাফা, ২/৫৫৪-৫৫৫)।
আল্লামা শাওকানী(১২৫০ হি) শবে বরাতের রাত্রিতে আদায়কৃত এই সালাত সংক্রান্ত হাদীসের ভিত্তিহীনতা উল্লেখপূর্বক বলেন, এ সকল হাদীস দ্বারা একদল ফকীহ প্রতারিত হয়েছেন। যেমন ‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থকার ইমাম গাযালী ও অন্যান্যরা। এমনিভাবে কতিপয় মুফাসসিরও প্রতারিত হয়েছেন। এ সালাতের বিষয়ে বিভিন্ন প্রকার জাল হাদীস রচিত হয়েছে। এ সকল হাদীস মাঊযূ বা বানোয়াট হওয়ার অর্থ হলো, এই রাত্রিতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত রাকায়াত সালাত আদায়ের প্রচলন বাতিল ও ভিত্তিহীন। তবে কোনো নির্ধারিত রাকায়াত, সূরা বা পদ্ধতি ব্যতিরেকে সাধারণভাবে এই রাত্রিতে ইবাদত বা দোয়া করার বিষয়ে দুই একটি যয়ীফ হাদীস রয়েছে।(শাওকানী, আল ফাওয়ায়েদ ১/৭৬)।
তৃতীয়ত, আরো কিছু জাল বা অনির্ভরযোগ্য হাদীস
১. মধ্য শাবানের রাতে কিয়াম ও দিনে সিয়াম
ইমাম ইবনু মাজাহ তাঁর সুনান গ্রন্থে নিম্নলিখিত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। “আলী(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাতে(সালাতে দোয়ায়) দন্ডায়মান থাক এবং দিবসে সিয়াম পালন কর। কারণ, ঐদিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিযক অনুসন্ধানকারী আছে কি? আমি তাকে রিযক প্রদান করব। কোন দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।”
এ হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ তাঁর উস্তাদ হাসান বিন আলী আল খাল্লাল থেকে, তিনি আব্দুর রাজ্জাক থেকে, তিনি ইবনু আবি সাবরাহ থেকে, তিনি ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ থেকে, তিনি মুয়াবিয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন জাফর থেকে, তিনি তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ বিন জাফর থেকে, তিনি হযরত আলী ইবনু আবী তালিব(রা)থেকে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণনা করেছেন। (ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪৪৪)।
ইবনু মাজাহ কর্তৃক সংকলিত হওয়ার কারণে হাদীসটি আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত, প্রচারিত ও আলোচিত। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে অত্যন্ত দুর্বল ও বানোয়াট পর্যায়ের বলে চিহ্নিত করেছেন।
এ হাদীসটি একমাত্র ইবনু আবি সাবরাহ বর্ণনা করেছেন। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এ হাদীস বর্ণনা করেন নি। এ হাদীস আলী ইবনু আবী তালিব থেকে তাঁর কোনো ছাত্র বর্ণনা করেন নি। আব্দুল্লাহ বিন জাফর বিন আবী তালিব থেকেও তাঁর কোনো ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। এমনকি মুয়াবিয়া ও ইবরাহিম বিন মুহাম্মাদ থেকেও তাঁদের কোনো ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। শুধুমাত্র ইবনু আবি সাবরাহ দাবি করেছেন যে, তিনি ইবরাহীম থেকে উক্ত সনদে হাদীসটি শ্রবণ করেছেন। তাঁর কাছ হতে আব্দুর রাজ্জাক ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন।
ইবনু আবী সাবরাহ(১৬২ হি) এর পূর্ণনাম আবু বকর বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আবী সাবরাহ। তিনি মদীনার একজন বড় আলিম ও ফকীহ ছিলেন। কিন্তু তুলনামূলক নিরীক্ষা ও বিচারের মাধ্যমে হাদীসের ইমামগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতেন। অসংখ্য ইমাম তাঁকে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তন্মধ্যে ইমাম আহমদ, ইয়াহইয়া বিন মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, বুখারী, ইবনু আদী, ইবনু হিব্বান ও হাকিম নাইসাপুরী অন্যতম।(ইবনু হাজার, তাক্বরীব, পৃ. ৬৩২; তাহযীব, ১২/২৫-২৬)।
এরই আলোকে আল্লামা শিহাব উদ্দীন আহমদ বিন আবি বকর আল বুসীরী(৮৪০ হি) এ হাদীসের টীকায় বলেছেন, ইবনু আবি সাবরাহর দুর্বলতার কারণে এ সনদটি দুর্বল। ইমাম আহমদ ও ইবনু মাঈন তাঁকে হাদীস বানোয়াটকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।(আল বুছীরী, যাওয়ায়েদ ইবনু মাজাহ, পৃ. ২০৩)। শাইখ নাসির উদ্দীন আলবানী বলেছেন, অত্যন্ত দুর্বল বা বানোয়াট। তিনি আরো বলেন, সনদটি বানোয়াট।(আলবানী, দাঈফু সুনানি ইবনি মাজাহ, পৃ. ১০৬; যাঈফাহ, ৫/১৫৪)।
২. দুই ঈদ ও মধ্য শাবানের রাত্রিভর ইবাদত
একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাত ও দুই ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবে না যেদিন সকল অন্তর মরে যাবে।”(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ৫/৩৮১-৩৮২; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান, ৪/৩৯১)।
এই হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী উপর্যুক্ত ঈসা ইবনু ইবরাহীম ইবনু তাহমান বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে সুপরিচিত। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়া্হইয়া ইবনু মাঈন ও আবু হাতিম রাযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ঈসা ইবনু ইবরাহীম নামক এই ব্যক্তি তার ওস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন সেই ‘সালামা বিন সুলাইমান’ দুর্বল রাবী বলে পরিচিত। আর তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেই ‘মারওয়ান বিন সালিম’ মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত। (ইবনুল জাওযী, আল ইলাল আল মুতানাহিয়া ২/৫৬২; তালখীস আল হাবীর, ২/৬০৬)।
এভাবে আমরা দেখছি যে, এই হাদীসটির সনদের রাবীগণ অধিকাংশই মিথ্যাবাদী বা অত্যন্ত দুর্বল। এরা ছাড়া কেউ এই হাদীস বর্ণনা করেন নি। কাজেই হাদীসটি বানোয়াট পর্যায়ের।
এখানে উল্লেখ্য যে, আবূ উমামা(রা) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে একাধিক দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবে না যেদিন সকল অন্তর মরে যাবে।’ এ সকল বর্ণনায় দুই ঈদের রাতের সাথে মধ্য শাবানের রাতকে কেউ যুক্ত করেন নি।(ইবনু মাজাহ, আস সুনান ১/৫৬৭)।
৩. পাঁচ রাত্রি ইবাদতে জাগ্রত থাকা
মুয়ায ইবনু জাবাল(রা) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি পাঁচ রাত জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য্য হবে: জিলহ্জ্জ্ব মাসের ৮ তারিখ রাত্রি, ৯ তারিখের(আরাফা) রাত্রি, ১০ তারিখের (ঈদুল আযহা) রাত্রি, ঈদুল ফিতরের রাত্রি ও মধ্য শাবানের রাত্রি।”
হাদীসটি ইস্পাহানী তাঁর ‘তারগীব’ গ্রন্থে সুওয়াইদ ইবনু সাঈদ এর সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন। সুওয়াইদ, আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল‘আম্মী থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি ওয়াহব ইবনু মুনাব্বিহ থেকে, তিনি মুয়ায ইবনু জাবাল থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ(সা) হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল আম্মী(১৮৪ হি) নামক ব্যক্তি মিথ্যা ও জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়া্হইয়া ইবনু মাঈন, আহমদ ইবনু হাম্বাল, আবু হাতিম রাযী, আবু দাউদ ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এই ব্যক্তির বা মিথ্যাবাদীতার বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য এ হাদীসটি মাউযূ বা জাল হাদীস বলে গণ্য। ইবনুল জাওযী, ইবনু হাজার আসকালানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৪/৩৩৬; আলবানী, যায়ীফাহ ২/১২)।
৪. এই রাত্রিতে রহমতের দরজাগুলি খোলা হয়
আবুল হাসান আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ইরাক(৯৬৩ হি) তাঁর মাঊযূ বা জাল বা বানোয়াট হাদীস সংকলনের গ্রন্থে ইবনু আসাকির বরাত দিয়ে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হাদীস হিসেবে নিম্নের হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। উবাই ইবনু কাব(রা) এর সূত্রে কথিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন, “মধ্য শাবানের রাতে জিবরাঈল(আ) আমার নিকট আগমন করে বলেন, আপনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ুন এবং আপনার মাথা ও হস্তদ্বয় উপরে উঠান। আমি বললাম, হে জিবরাঈল, এটি কোন রাত? তিনি বলেন, হে মুহাম্মাদ, এই রাতে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং রহমতের ৩০০ দরজা খুলে দেওয়া হয়।……তখন রাসূলুল্লাহ(সা) বাকী গোরস্থানে গমন করেন। তিনি যখন সেখানে সাজদারত অবস্থায় দোয়া করেছিলেন, তখন জিবরাঈল সেখানে অবতরণ করে বলেন, হে মুহাম্মাদ, আপনি আকাশের দিকে মাথা তুলুন। তিনি তখন তাঁর মস্তক উত্তোলন করে দেখেন যে, রহমতের দরজাগুলি খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক দরজায় একজন ফিরিশতা ডেকে বলেছেন, এই রাত্রিতে যে সাজদা করে তার জন্য মহা সুসংবাদ…….. ।”
হাদীসটি উদ্ধৃত করে ইবনু ইরাক উল্লেখ করেছেন যে, এ হাদীস একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যে সূত্রের রাবীগণ সকলেই অজ্ঞাত পরিচয় এবং হাদীসটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হিসেবে বিবেচিত।(ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১২৬)।
৫. পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না
আবূ উমামা বাহিলীর(রা) সূত্রে, রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে কথিত আছে, “পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না। রজব মাসের প্রথম রাত, মধ্য শাবানের রাত, জুমআর রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত।”
এ হাদীসটি হাফিয আব্দুল কাসিম ইবনু আসাকির(৫৭১ হি) তাঁর ‘তারীখ দিমাশক’ গ্রন্থে আবু সাঈদ বুনদার বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ রূইহানীর সূত্রে, তিনি ইবরাহীম বিন আবি ইয়াহইয়া থেকে, তিনি আবু কা’নাব হতে, তিনি আবু উমামা বাহেলী(রা) হতে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম সুয়ূতী তাঁর “আল জামে আল সাগীর” গ্রন্থে হাদীসটি যয়ীফ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (সুয়ূতী, আল জামে আল সাগীর. ১/৬১০)। নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটি বানোয়াট হিসেবে উল্লেখ করেছেন।(আলবানী, দাঈফুল জামে, পৃ. ৪২০; যায়ীফাহ, ৩/৬৪৯-৬৫০)। কারণ এ হাদীসের মূল ভিত্তি হলো ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবী ইয়াহইয়া (১৮৪ হি) নামক একজন মুহাদ্দিস। ইমাম মালিক, আহমাদ, বুখারী, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইয়াহইয়া আল কাত্তান, নাসাঈ, দারাকুতনী, যাহাবী, ইবনু হিব্বান ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে রাফেয়ী, শিয়া, মুতাযিলী ও ক্বাদেরীয়া আক্বীদায় বিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত করেছেন এবং মিথ্যাবাদী ও অপবিত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম শাফেয়ী প্রথম বয়সে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন বিধায় কোনো কোনো শাফেয়ী মুহাদ্দিস তার দুর্বলতা কিছুটা হাল্কা করার চেষ্টা্ করেন। তবে শাফেয়ী মাযহাবের অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাকে এক কথায় পরিত্যক্ত ও মিথ্যাবাদী বলে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
ইমাম শাফেয়ী নিজেও তাঁর শিক্ষকের দুর্বলতা ও অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি পরবর্তী জীবনে তার সূত্রে কোনো হাদীস বললে তার নাম উল্লেখ না করে বলতেন, আমাকে বলা হয়েছে, বা শুনেছি বা অনুরূপ কোনো বাক্য ব্যবহার করতেন।(ইবনু আদী, আল কামিল, ১/৩৫৩-৩৬৭; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ১/১৮২-১৮৫; ইবনু হাজার, তাহযীব ১/১৩৭-১৩৯)। এই হাদীসটির ক্ষেত্রেও ইমাম শাফেয়ী বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, আগের যুগে বলা হতো, পাঁচ রাতে দোয়া করা মুস্তাহাব…..। ইমাম শাফেয়ী বলেন, এ সকল রাতে যে সব আমলের কথা বলা হয়েছে সেগুলিকে আমি মুসতাহাব মনে করি।
এছাড়া সনদের অন্য রাবী আবু সাঈদ বুনদার বিন উমরও মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালকারী বলে পরিচিত।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ২/৭০; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান, ২/৬৪)।
এখানে উল্লেখ্য যে, হাফিয আব্দুর রাজ্জাক সান’আনী এই হাদীসটি অন্য একটি সনদে হযরত ইবনু উমারের(রা) নিজস্ব বক্তব্য হিসেবে উদ্বৃত্ত করেছেন। (আব্দুর রাজ্জাক, আল মুসান্নাফ, ৪/৩১৭)।
আব্দুর রাজ্জাক সান’আনী বলেন, আমাকে এক ব্যক্তি বলেছেন, তিনি বায়লামানীকে বলতে শুনেছেন, তার পিতা বলেছেন, ইবনু উমার বলেছেন, পাঁচ রাতে দোয়া বিফল হয় না।…..”
এই সনদে আবদুর রাজ্জাককে যিনি হাদীসটি বলেছেন, তিনি অজ্ঞাত পরিচয়। পরবর্তী রাবী মুহাম্মাদ বিন আবদুর রাহমান বিন বায়লামানী হাদীস জালিয়াত হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন।(বুখারী, আততারীখুল কাবীর, ১/১৬৩; ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা ৩/৭৫)। উক্ত মুহাম্মাদের পিতা, সনদের পরবর্তী রাবী আব্দুর রাহমান বিন বায়লানামীও দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য রাবী।(ইবনু হাজার, তাহযীব, ৬/১৩৫; তাক্বরীব, পৃ. ৩৩৭)।
৬. শবে বরাতের গোসল
শবে বরাত বিষয়ক কতিপয় মিথ্যা কথাগুলির অন্যতম হলো এই রাতে গোসল করার ফযীলত। বিষয়টি যদিও সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও জঘন্য বানোয়াট কথা, তবুও আমাদের সমাজে তা অত্যন্ত প্রচলিত। আমাদের দেশের প্রচলিত প্রায় সকল পুস্তকেই এই জাল কথাটি লিখা হয় এবং ওয়াযে আলোচনায় বলা হয়। প্রচলিত একটি বই হতে উদ্ধৃত করছিঃ “একটি হাদীসে আছে যে, যে ব্যক্তি উক্ত রাত্রিতে এবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করিবে, সেই গোসলের প্রতিটি বিন্দু পানির পরিবর্তে তাহার আমল নামায় ৭০০(সাতশত) রাকায়াত নফল নামাযের ছওয়াব লিখা হইবে। গোসল করিয়া দুই রাকায়াত তাহিয়্যাতুল অজুর নামায পড়িবে।……..(মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমিনীন, পৃ. ২৪০; মুফতী হাবীব ছামদানি, বার চাঁদের ফযীলত, পৃ. ২৬; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ৩০৯)।
এই মিথ্যা কথাটি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কঠিন শীতের দিনেও অনেকে গোসল করেন। উপরন্তু ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার আশায় শরীর ও মাথা ভাল করে মোছেন না। এর ফলে অনেকে বিশেষত, মহিলারা ঠান্ডা-সর্দিতে আক্রান্ত হন। আর এই সকল কষ্ট শরীয়তের দৃষ্টিতে বেকার পরিশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, সুন্নাতের আলোকে এই রাতে গোসল করে ইবাদত করা আর ওযু করে ইবাদত করার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। অনুরূপভাবে এই রাতে গোসল করা এবং অন্য কোনো রাতে গোসল করার মাঝেও কোনো পার্থক্য নেই।
৭. এই রাত্রিতে নেক আমলের সুসংবাদ
এ বিষয়ে আমাদের দেশের প্রচলিত একটি কথাঃ “মহা সুসংবাদ তার জন্য যে শাবান মাসের মধ্যম রজনীতে নেক আমল করে……।” এই কথাটি উপরে উল্লেখিত উবাই ইবনু কার(রা) এর নামে প্রচারিত জাল হাদীসটি হতে গ্রহণ করা হয়।
৮. এই রাত্রিতে হালুয়া রুটি বা মিষ্টান্ন বিতরণ
এই রাত্রিতে হালুয়া রুটি তৈরি করা, খাওয়া, বিতরণ করা, মিষ্টান্ন বিতরণ করা ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কর্ম। এই রাত্রিতে এই সকল ইবাদত করলে কোনো বিশেষ সাওয়াব বা অতিরিক্ত সাওয়াব পাওয়া যাবে এই মর্মে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি।
৯. ১৫ ই শাবানের দিনে সিয়াম পালন
আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ(সা) শাবান মাসে বেশি বেশি সিয়াম পালন করতেন, এমনকি প্রায় সারামাসই সিয়ামরত থাকতেন। আমরা আরো দেখেছি যে, শা’বান মাসের মধ্যম রজনীর ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া ইসতিগফার বা সালাত আদায়ের উৎসাহজ্ঞাপক কিছু যয়ীফ বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস রয়েছে। কিন্তু পরদিন সিয়াম পালনের বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য হাদীস পাওয়া যায় না। ইবনু মাজাহ সংকলিত আলী(রা) এর নামে বর্ণিত হাদীসটিতে সিয়াম পালনের কথা বলা হয়েছে। তবে হাদীসটির সনদ নির্ভরযোগ্য নয়। এ রাতে ১৪ রাকায়াত সালাত আদায় বিষয়ক হাদীসেও পরদিন সিয়াম পালনের ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হাদীসটি জাল। এ বিষয়ক আরেকটি জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিতঃ “যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করবে, জাহান্নামের আগুন কখনোই তাকে স্পর্শ করবে না।”(মোকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ২৩৫; মুফতী ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ২৫)।
১০. প্রচলিত কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তার নমুনা
আমাদের দেশে প্রচলিত পুস্তকে অনেক সময় লেখকগণ বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধকে একসাথে মিশ্রিত করেন। অনেক সময় সহীহ হাদীসেরও অনুবাদে এমন বিষয় প্রবেশ করান যা হাদীসের নামে মিথ্যায় পরিণত হয়। অনেক সময় নিজেদের খেয়াল খুশি মত বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি গ্রন্থের নাম ব্যবহার করেন। এগুলির বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ দয়া করে আামাদের লেখকগণের পরিশ্রম কবুল করুন, তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন এবং আমাদের সকলকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করুন। শবে বরাত বিষয়ক কিছু ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত একটি পুস্তক হতে উদ্ধৃত করছি। প্রায় সকল পুস্তকেই এই কথাগুলি কম বেশি লেখা হয়েছে।
“হাদীসে আছে, যাহারা এই রাত্রিতে এবাদত করিবে আল্লাহ তাআলা আপন খাছ রহমত ও স্বীয় অনুগ্রহের দ্বারা তাহাদের শরীরকে দোযখের অগ্নির উপর হারাম করিয়া দিবেন। অর্থাৎ তাহাদিগকে কখনও দোযখে নিক্ষেপ করিবেন না। হযরত(সা) আরো বলেন-আমি জিবরাঈল(আ) এর নিকট শুনিয়াছি, যাহারা শাবানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহারা শবে ক্বদরের এবাদতের সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।
আরও একটি হাদীসে আছে, হযরত(সা) বলিয়াছেন, শাবানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে এবাদতকারী আলেম, ফাজেল, অলী, গাউছ, কুতুব, ফকীর, দরবেশ ছিদ্দীক, শহীদ, পাপী ও নিষ্পাপ সমস্তকে আল্লাহ তা‘আলা মার্জনা করিবেন। কিন্তু যাদুকর, গণক, বখীল, শরাবখোর, যেনাকার, নেশাখোর, ও পিতা-মাতাকে কষ্টদাতা-এই কয়জনকে আল্লাহ তা‘আলা মাফ করিবেন না।
আরও একটি হাদীসে আছে, আল্লাহ তা‘আলা শাবানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে ৩০০ খাছ রহমতের দরজা খুলিয়া দেন ও তাঁহার বান্দাদের উপর বে-শুমার রহমত বর্ষণ করিতে থাকেন।
কালইউবী কিতাবে লিখিত আছে,-একদিন হযরত ঈসা(আ) জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন হে খোদাতাআলা! এ যামানায় আমার চেয়ে বুযুর্গ আর কেহ আছে কি? তদুত্তরে আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। সম্মুখে একটু গিয়াই দেখ। ইহা শুনিয়া হযরত ঈসা(আ) সম্মুখের দিকে চলিতে লাগিলেন………তখন বৃদ্ধ বলিলেন, আমি এতদ্দেশীয় একজন লোক ছিলাম। আমার মাতার দোওয়ায় আল্লাহ তাআলা আমাকে এ বুযুর্গী দিয়াছেন। সুতরাং আজ ৪০০ বৎসর ধরিয়া আমি এই পাথরের ভিতর বসিয়া খোদা তাআলার এবাদত করিতেছি এবং প্রত্যহ আমার আহারের জন্য খোদাতাআলা বেহেশত হতে একটি ফল পাঠাইয়া থাকেন। ইহা শুনিয়া হযরত ঈসা(আ) ছেজদায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন। …….তখন আল্লাহ তা‘আলা বলিলেন, হে ঈসা(আ)! জানিয়া রাখ যে, শেষ যামানায় নবীর উম্মতদের মধ্যে যে ব্যক্তি শাবানের চাঁদের পনেরই তারিখের রাত্রে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে ও সেদিন রোযা রাখিবে নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি আমার নিকট এই বৃদ্ধের চেয়েও বেশি বুযুর্গ ও প্রিয় হইতে পারিবে। তখন ঈসা(আ) কাঁদিয়া বলিলেন, হে খোদা তাআলা! তুমি আমাকে যদি নবী না করিয়া আখেরী যামানার নবীর উম্মত করিতে তাহা হইলে আমার কতই না সৌভাগ্য হইত! যেহেতু তাঁহার উম্মত হইয়া এক রাত্রিতে এত ছওয়াব কামাই করিতে পারিতাম। …….
হাদীসে আছে, শাবানের রাতে ১৪ই তারিখে সূর্য অস্ত যাইবার সময় নিম্নলিখিত দোওয়া ৪০ বার পাঠ করিলে ৪০ বৎসরের সগীরা গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে।
-লা হাওলা ওয়ালা কুআতা ইল্লাবিল্লাহি।
…..দুই দুই রাকায়াত করিয়া চারি রাকাত নামায পড়িবে…..সূরা ফাতিহার পর প্রত্যেক রাকাতেই সূরা এখলাছ দশবার পড়িয়া পাঠ করিবে ও এই নিয়মেই নামায শেষ করিবে। হাদীস শরীফে আছে,-যাহারা এই নামায পড়িবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাহাদের চারিটি হাজত পুরা করিয়া দিবেন ও তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন।
তৎপর ঐ রাত্রিতে দুই দুই করিয়া আরো চারি রাকাত নামায পড়িবে।….প্রত্যেক রাকাতে সূরা ক্বদর একবার ও সূরা এখলাছ পঁচিশবার পাঠ করিবে এবং এই নিয়মে নামায শেষ করিবে।
হাদীস শরীফে আছে,-মাতৃগর্ভ হইতে লোক যেরূপ নিষ্পাপ হইয়া ভূমিষ্ঠ হয়, উল্লেখিত ৪ রাকাত নামায পড়িলেও সেইরূপ নিষ্পাপ হইয়া যাইবে। (মেশকাত)
হাদীস শরীফে আছে,-যাহারা এই নামায পাঠ করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদের পঞ্চশ বৎসরের গুনাহ মার্জনা করিয়া দিবেন।
আরও হাদীসে আছে, -যাহারা উক্ত রাত্রে বা দিনে ১০০ হইতে ৩০০ মরতবা দুরূদ শরীফ হযরত(সা) এর উপর পাঠ করিবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাহাদের উপর দোজখ হারাম করিবেন। হযরত(দঃ)ও সুপারিশ করিয়া তাহাদিগকে বেহেশতে লইবেন।(সহীহ বুখারী)।
আর যাহারা উক্ত রাত্রিতে সূরা দোখান সাতবার ও সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করিবে, আল্লাহ তাহাদের তিনটি মকছুদ পুরা করিবেন। যথাঃ (১) হায়াত বৃদ্ধি করিবেন, (২) রুজি-রেজক বৃদ্ধি করিবেন, (৩) সমস্ত পাপ মার্জনা করিবেন। (মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো‘মেনীন, পৃ. ২৩৬-২৪১)।
উপরের কথাগুলি সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হলো. গ্রন্থকার এখানে মেশকাত, তিরমিযী ও বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন ভিত্তিহীন কিছু কথার জন্য, যে কথাগুলি এই গ্রন্থগুলিতো দূরের কথা কোনো হাদীসের গ্রন্থেই নেই। এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন সরলপ্রাণ বাঙালি পাঠক। বস্তুত এই পুস্তকটি এবং এই জাতীয় প্রচলিত পুস্তকগুলি জাল ও মিথ্যা কথায় ভরা। আমাদের সমাজে জাল হাদীসের প্রচলনের জন্য এরাই সবচেয়ে বেশি দামী।
২.১১.৯. রামাদান মাস
রামাদান মাসের ফযীলত, গুরুত্ব, ইবাদত, লাইলাতুল কাদর এর গুরুত্ব, ইবাদত ইত্যাদি কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে এক্ষেত্রেও জালিয়াতগণ তাদের মেধা ও শ্রম ব্যয় করেছেন। অগণিত সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক জাল হাদীস তারা বানিয়েছেন। অনেক সময় তারা প্রসিদ্ধ সহীহ হাদীসের মধ্যে কিছু জাল কথা ঢুকিয়ে প্রচার করে। যেহেতু মূল ফযীলত প্রমাণিত, সেহেতু এ সকল জাল হাদীসের বিস্তারিত আলোচনা করছি না। প্রচলিত কয়েকটি জাল ও ভিত্তিহীন কথার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেষ করতে চাই। মহান আল্লাহর দরবারে তাওফীক প্রার্থনা করছি।
১. আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি ও আযাব-মুক্তি
রামাদান, সিয়াম, সেহরী খাওয়া, ইফতার করা ইত্যাদির গুরুত্ব, মর্যাদা, সাওয়াব ও বরকতের বিষয়ে অগণিত সহীহ হাদীস রয়েছে। তা সত্ত্বেও এগুলির বদলে অনেক আজগুবি বাতিল, ভিত্তিহীন ও জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত। একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, “যখন রমজান মাসের প্রথম রাত্রি উপস্থিত হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকাতের (তাঁর সিয়াম পালনকারী সৃষ্টির) প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করেন, আর আল্লাহ তা‘আলার রহমতের দৃষ্টি যাহার উপর পতিত হয়, সে কোন সময় শাস্তি ভোগ করিবে না।”(মুফতী হাবীব ছামদানি, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ২৯-৩০)।
মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি জাল ও বানোয়াট। (ইবনুল জাওযী, আল মাউদূআত, ২/১০৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০০-১০১; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৪৬)।
২. সাহরীর ফযীলত ও সাহরী ত্যাগের পরিণাম
সাহরী খাওয়ার উৎসাহ প্রদান করে একাধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অন্তত এক চুমুক পানি পান করে হলেও সাহরী খেতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সাহরীকে বরকতময় আহার বলা হয়েছে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, ইহুদী ও খৃস্টানদের সাথে আমাদের সাহরীর পার্থক্য সাহরী খাওয়া।
কিন্তু এ সকল সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি কিছু অতিরঞ্জিত বানোয়াট হাদীসও প্রচলিত হয়েছে। যেমনঃ রাসূলুল্লাহ(সা) ফরমাইয়াছেন…..ছেহরীর আহারের প্রতি লোকমার পরিবর্তে আল্লাহ তা‘আলা এক বৎসরের ইবাদতের সাওয়াব দান করিবেন।……..যে সেহরী খাইয়া রোজা রাখিবে সে ইহুদীদের সংখ্যানুপাতে সাওয়াব লাভ করিবে। ……তোমাদের মধ্য হইতে যে ব্যক্তি সেহরী খাওয়া হইতে বিরত থাকিবে, তাহার স্বভাব চরিত্র ইহুদীদের ন্যায় হইয়া যাইবে।……”(মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ৩৩-৩৪)। এ সকল কথাই সবই জাল ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান হয়।
৩. লাইলাতুল কাদর বনাম ২৭ শে রামাদান
কুরআন হাদীসে ‘লাইলাতুল কাদরের’ মর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ(সা) লাইলাতুল কাদরকে নির্দিষ্ট করে দেন নি। রামাদান মা্সের শেষ দশ রাত এবং বিশেষ করে শেষ দশ রাতের মাঝে বিজোড় রাতগুলিতে লাইলাতুল কাদর সন্ধান করার নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবী-তাবেয়ীগণের কেউ কেউ ২৭ শে রামাদান লাইলাতুল কাদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ(সা) হতে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছুই বর্ণিত হয় নি। কাজেই ‘২৭শে রামাদান’ এর ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট।
এই জাতীয় কিছু বাতিল কথা-“হাদীসে আছে-যে ব্যক্তি রামাদানের ২৭ তারিখের রাত্রিতে জাগিয়া ইবাদত বন্দেগী করিবে। আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় এক হাজার বৎসরের এবাদতের ছওয়াব লিখিয়া দিবেন। আর বেহেশতে তাহার জন্য অসংখ্য ঘর নির্মাণ করাইবেন।…..আবূ বাকর ছিদ্দিকের প্রশ্নের উত্তরে রাছূল(সা) বলিয়াছিলেনঃ রমযানের ২৭ তারিখেই শবে কদর জানিও।…..রমযান মাসের ২৭ তারিখে সূর্যাস্ত যাওয়ার সময় নিম্নলিখিত দোওয়া ৪০ বার পাঠ করিলে ৪০ বৎসরের ছগীরা গুনাহ মার্জিত হইবে।(মাও. গোলাম রহমান, মোকছুদোল মো‘মেনীন, পৃ. ২৪৫-২৪৮)।
অনুরূপ বানোয়াট কথাঃ “হযরত রাসূলুল্লাহ(সা) এরশাদ করিয়াছেন, যেই ব্যক্তি রমজান মাসের ২৭ তারিখের রজনীকে জীবিত রাখিবে, তাহার আমলনামায় আল্লাহ ২৭ হাজার বৎসরের ইবাদতের তুল্য সাওয়াব প্রদান করিবেন এবং বেহেশতের মধ্যে অসংখ্য মনোরম বালাখানা নির্মাণ করিবেন যাহার সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউই অবগত নন। (মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, পৃ. ৩৯; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, নেক কানুন, পৃ. ৩১৫)।
৪. লাইলাতুল কাদরের গোসল
শবে বরাতের ন্যায় কাদরের রাত্রিতেও গোসল করার বিষয়ে জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত। যেমনঃ “যাহারা শবে-ক্বদরের এবাদতের নিয়্যতে গোসল করিবে তাহাদের পা ধৌত করা শেষ না হইতেই পূর্বের পাপ মার্জিত হইয়া যাইবে।”(গোলাম রহমান, মোকছুদুল মো‘মেনীন, পৃ. ২৪৮; দুলাল, নেক কানুন, পৃ. ৩১৬)।
লাইলাতুল কাদরে গোসলের ফযীলতে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। তবে যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ(সা) রামাদান মাসের শেষ ১০ রাতের প্রত্যেক রাতে মাগরিব ও ইশার সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে গোসল করতেন। এইরূপ গোসলের ফযীলতে আর কিছু জানা যায় না। (ইবনু রাজাইব, লাতাইফ ২/৩০৯; ৩১৩-৩১৫)।
৫. লাইলাতুল ক্বাদরের সালাতের নিয়্যাত
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, ‘নাওয়াইতু আন…..’ বলে যত প্রকারের নিয়্যত আছে সবই বানোয়াট। এখানে আরো লক্ষ্যণীয় যে, শবে বরাত, শবে কদর ইত্যাদি রাতে বা মর্যাদাময় দিনে নফল সালাত আদায়ের জন্য বিভিন্ন বানোয়াট নিয়্যাত প্রচলিত আছে। কোনো নফল সালাতের জন্যই কোনো পৃথক নিয়্যাত নেই। লাইলাতুল কাদর বা যে কোনো রাতের সালাতের নিয়্যাত হবে ‘সালাতুল লাইল’ বা ‘কিয়ামুল লাইল’ এর। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মুমিন দুই দুই রাকাত করে নফল সালাতের নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য মনে নিয়ে যত রাকাত পারেন সালাত আদায় করবেন। যদি রাতটি সত্যই আল্লাহর নিকট ‘লাইলাতুল কদর’ বলে গণ্য হয় তাহলে বান্দা লাইলাতুল কাদরের সাওয়াব লাভ করবে। মুখে ‘আমি লাইলাতুল কাদরের নামায পড়ছি…..’ ইত্যাদি কথা বলা অর্থহীন ও ভিত্তিহীন।
৬. লাইলাতুল কাদরের সালাতের পরিমাণ ও পদ্ধতি
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে ‘লাইলাতুল কাদর’ বা ‘কিয়ামুল্লাইল’ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কিয়ামুল্লাইল মানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নফল সালাত আদায় করা। এর জন্য কোনো বিশেষ রাকাত সংখ্যা, সূরা, আয়াত, দোয়া বা পদ্ধতি নেই। রাসূলুল্লাহ(সা) নিজে সুদীর্ঘ কিরআতে এবং সুদীর্ঘ রুকু ও সিজদার মাধ্যমে কিয়ামুল্লাইল করতেন। এজন্য সম্ভব হলে দীর্ঘ কিরআত বা দীর্ঘ রুকু সাজদা সহকারে সালাত আদায় করা উত্তম। না পারলে ছোট কিরআত সহকারে রাকাত সংখ্যা বাড়াবেন। মুমিন তার নিজের সাধ্য অনুসারে সূরা, তাসবীহ, দোয়া ইত্যাদি পাঠ করবেন। প্রত্যেকে তার কর্ম অনুসারে সাওয়াব পাবেন।
কাজেই লাইলাতুল ক্বাদরের সালাতের রাকাআত সংখ্যা, সূরার নাম, সালাতের পদ্ধতি, সালাতের মধ্যে বা পরে বিশেষ দোয়া ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও মনগড়া কথা। (আব্দুল হাই লাখনাবী, আল আসার, পৃ. ১১৫)। অনেক প্রকারের মনগড়া কথা বাজারে প্রচলিত। একটি মনগড়া পদ্ধতি ও তৎসংশ্লিষ্ট কিছু জাল হাদীস একটি প্রসিদ্ধ পুস্তক হতে উদ্ধৃত করছি।
“শবে ক্বদরের নামায পড়িবার নিয়ম: এই রাত্রে পড়িবার জন্য নির্দিষ্ট ১২ রাকাত নফল নামায আছে। ঐ রাত্রিতে দুই রাকাত নফল নামায পড়িবে প্রথমে নিয়্যত করিবে, যথাঃ আমি আল্লাহরওয়াস্তে ক্বেবলারোখ দাঁড়াইয়া শবে-ক্বদরের দুই রাকাত নামায পড়িতেছি।” নিয়্যত ও তাকবীরে তাহরীমা অন্তে সুবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ ও ‘ছূরা ফাতেহার’ পর প্রত্যেক রাকাতে ‘ছূরা ক্বদর’ একবার, ‘ছূরা এখলাছ’ তিনবার পাঠ করিবে এবং এইরূপে নামায শেষ করিবে।
হাদীছে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে সমস্ত শবে-ক্বদরের ছওয়াব বখশিশ করিবেন এবং হযরত ইদরীস, হযরত শোয়াইব, হযরত আইয়ুব, হযরত ইউছুফ, হযরত দাউদ ও হযরত নূহ আলাইহিচ্ছালাম এর সমস্ত পূণ্যের ছওয়াব তাহাদের আমলনামায় লিখিয়া দিবেন ও তাহাদের দোওয়া মকবুল হইবে এবং তাহাদিগকে বেহেশতের মধ্যে এই পৃথিবীর সমতুল্য একটি শহর দান করিবেন।
অতঃপর দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নফল নামায পড়িবে। প্রথমতঃ নিয়্যত করিবে। নিয়্যত ও তাকবীরে তাহরীমা পাঠান্তে প্রত্যেক রাকাতে ‘ছূরা ফাতেহার’ পর ‘ছূরা ক্বদর’ একবার ও ‘ছূরা এখলাছ’ ২৭ বার পড়িবে। ইহাও খেয়াল রাখিবে যে, প্রথমতঃ নিয়্যত করিয়া প্রথম রাকাতে ছূরা ফাতিহার পূর্বে ছূবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পড়িতে হয়। কিন্তু তৎপর যত রাকাতই হউকনা কেন প্রত্যেক রাকাতে ছূরা ফাতেহার পূর্বে কেবলমাত্র বিছমিল্লাহ পড়িতে হইবে এবং উল্লেখিত নিয়মেই পড়িয়া নামায শেষ করিবে।
হাদীসে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে এইরূপ নিষ্পাপ করিয়া দিবেন, যেমন অদ্যই মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াছে। আর বেহেশতে তাহাদের জন্য হাজার বালাখানা তৈয়ার হইবে। –(মেশকাত)।
তৎপর দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নামায পড়িবে। অতঃপর দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নফল নামায পড়িবে। প্রথমতঃ নিয়্যত করিবে। নিয়্যত ও তাকবীরে তাহরীমা পাঠান্তে ছোবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ ও ‘ছূরা ফাতেহার’ পর প্রত্যেক রাকাতে ‘ছূরা ক্বদর’ তিনবার ও ‘ছূরা এখলাছ’ ৫০ বার পাঠ করিবে এবং এইরূপে নামায শেষ করিয়া ছেজদায় গিয়া ঐ দোওয়া একবার পড়িবে-যাহা সূর্যাস্ত যাইবার কালে পড়িবার জন্য লিখা হইয়াছে।
হাদীছে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন ও তাহাদের দোওয়া খোদা তাআলার দরবারে মকবুল হইবে।”(মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ২৪৮)।
এগুলি সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। ‘মেশকাত’ তো দূরের কথা কোনো হাদীসের গ্রন্থেই এ সকল কথা পাওয়া যায় না।
৭. লাইলাতুল কাদরের কারণে কদর বৃদ্ধি
আমাদের দেশে প্রচলিত একটি পুস্তকে নিম্নোক্ত হাদীসটি লিখা হয়েছে।
“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কাদর পাবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার কদর বা মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন।”(মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ. ২৪৩)।
এই হাদীসটি জাল ও ভিত্তিহীন বলেই প্রতীয়মান হয়।
৮. জুমু‘আতুল বিদা বিষয়ক জাল কথা
সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, জুমু‘আর দিন ‘সাইয়েদুল আইয়াম’ বা সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। সূর্যের নিচে এর চেয়ে উত্তম দিবস আর নেই।(মুসলিম, আস সহীহ, ২/৫৮৯; ইবনু হিব্বান, ৩/১৯১)। অনুরূপভাবে রামাদান শ্রেষ্ঠ ও বরকতময় মাস।(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৩১৪-৩৫৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৪০)। কাজেই রামাদান মাসের জুমু‘আর দিনটির মর্যাদা সহজেই অনুমেয়। মুমিন স্বভাবতই প্রত্যেক জুমুআর দিনে নেক আমলগুলি বেশি বেশি করার চেষ্টা করেন। একইভাবে রামাদানের প্রত্যেক দিনই মুমিন সাধ্যমত নেক কর্মের চেষ্টা করেন। আর রামাদানে জুমু‘আর দিনে উভয় প্রকার চেষ্টা একত্রিত হয়। রামাদান মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফযীলত পূর্ণ দিন হলো শেষ দশ দিন। এ ছাড়া রামাদানের শেষে রামাদান চলে যাচ্ছে বলে মুমিনের কিছু অতিরিক্ত আগ্রহ বাড়া্ই স্বাভাবিক।
এ ছাড়া রামাদান মাসের শেষ জুমু’আ বা অন্য কোনো জুমু‘আর দিনের কোনো বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস বর্ণিত হয় নি। তবে জালিয়াতগণ রামাদানের শেষ জুমু‘আর দিনের বা ‘বিদায়ী জুমু‘আর’ বিশেষ কিছু ফযীলত বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে এই দিনে কাযা সালাত ও উমরী কাযা আদায়ের ফযীলত ও এই দিনের বিশেষ দোয়া বিষয়ক কিছু জাল ও বানোয়াট কথা। যেমনঃ “যদি কোনো ব্যক্তি রামাদান মাসের শেষ জুমু‘আর দিনে এক ওয়াক্ত(অন্য জাল বর্ণনায় ৫ ওয়াক্ত) কাযা সালাত আদায় করে তবে ৭০ বৎসর পর্যন্ত তার সকল কাযা সালাতের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই কথাটি জাল ও মিথ্যা কথা।(মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ২৪২; দরবেশ হুত, আসানুল মাতালিব, পৃ. ২২৫)।
বাহ্যত এই জাল হাদীসটির প্রচলন ঘটছে বেশ দেরী করে। ফলে ৬ষ্ঠ-৭ম শতাব্দীতে যারা জাল হাদীস সংকলন করেছেন তারা তা উল্লেখ করেন নি। ১০ হিজরী শতক হতে মোল্লা আলী কারী(১০১৪ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এর জালিয়াতির বিষয়ে আলোকপাত করেন। আল্লামা শাওকানী(১২৫০) বলেন, “এই কথাটি যে বাতিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি কোনো মাউদূ হাদীসের গ্রন্থেও এই হাদীসটি পাইনি। কিন্তু আমাদের যুগে আমাদের সানআ(ইয়ামানের রাজধানী) শহরে অনেক ফকীহ ও ফিকহ অধ্যয়নকারীদের মধ্যে তা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এদের অনেকেই এর উপর আমল করে। জানি না কে এই জাল কথাটি বানিয়েছে। আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপমান করুন।(শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৭৯)।
কোনো কোনো আলিম জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে এই জাল ও ভিত্তিহীন কথাটি তাদের গ্রন্থে লিখেছেন। ৭ম-৮ম শতকের প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা হুসাইমুদ্দীন হুসাইন ইবনু আলী সাগনাকী(৭১০ হি) হেদায়া’র ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আন-নিহায়া’ নামক গ্রন্থে এই কথাটিকে ‘হাদীস’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ‘আন-নিহায়া’ হিদায়ার অন্যতম ব্যাখ্যা গ্রন্থ। পরবর্তী ব্যাখ্যাকারগণ এই গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছেন। ফলে হেদায়ার পরবর্তী অনেক ব্যাখ্যাকার এই জাল কথাটি ‘হাদীস’ হিসেবে লিখেছেন। অনেক সময় বড় আলিমদের প্রতি মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা তাদের সকল কথা নির্বিচারে গ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি করে। তাঁদের গ্রন্থে এই হাদীস উদ্ধৃত থাকাতে অনেক সাধারণ মানুষ এ্ই জাল কথাটিকে সঠিক বলে মনে করতে পারেন। এজন্য মোল্লা আলী কারী বলেনঃ “এই কথাটি নিঃসন্দেহে বাতিল। কারণ এই কথাটি এজমা বা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমতের বিরোধী। মুসলিম উম্মাহ একমত যে, কোনো একটি ইবাদত কখনোই অনেক বৎসরের পরিত্যক্ত ইবাদতের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না বা ক্ষতিপূরণ করতে পারে না। এরপর নেহায়া-র রচয়িতা এবং হেদায়ার অন্যান্য ব্যাখ্যাকার এর উদ্ধৃতির কোনো মূল্য নেই; কারণ তাঁরা মুহাদ্দিস ছিলেন না এবং তাঁরা কোনো হাদীস গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েও এই হাদীসটি উল্লেখ করেন নি।”(মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ২৪২; আব্দুল হাই লাখনাবী, আল আসার, পৃ. ৮৫)।
আল্লামা আলী কারীর এই কথার টীকায় বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও হানাফী ফকীহ আল্লামা আব্দুল গুদ্দাহ বলেনঃ “অত্যন্ত ভাল কথা বলেছেন! অত্যন্ত ভাল কথা বলেছেন!! রাসূলুল্লাহ(সা) এর হাদীসে পক্ষ হতে আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।”(আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ, মোল্লা আলী কারীর আল-মাসনূ গ্রন্থের টীকা, ১৫৭ পৃ.)।
৯. প্রচলিত কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তার নুমনা
ইতোপূর্বে উল্লেখ করছি যে, আমাদের দেশে প্রচলিত পুস্তাকাদিতে অনেক সময় লেখকগণ সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে যয়ীফ ও জাল হাদীসের উপর নির্ভর করা ছাড়াও বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধকে এমনভাবে সংমিশ্রণ করেন যে, পূরা কথাটি রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে মিথ্যায় পরিণত হয়। হাদীস গ্রন্থের উদ্ধৃতিও অনেক সময় মনগড়াভাবে দেওয়া হয়। একটি পুস্তকে বলা হয়েছেঃ “হযরত (সা) বলিয়াছেন, যাহারা শবে ক্বদরে বন্দেগী করিবে তাহারা শত বৎসরের নেকীর ছওয়াব পাইবে। হযরত(সা) আরো বলিয়াছেন, যাহারা শবে-ক্বদরে এবাদত করিয়াছে দোযখের আগুন তাহাদের উপর হারাম হইবে। আর একটি হাদীসে আছে, যদি তোমরা তোমাদের গোরকে আলোকময় পাইতে চাও, তবে শবে-ক্বদরে জাগরিত থাকিয়া এবাদত কর। আরও হাদীসে আছে-যাহারা শবে-ক্বদরে জাগিয়া এবাদত করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদের ছগীরা, কবীরা সমস্ত পাপই মার্জনা করিবেন ও কিয়ামতের দিন তাহাদিগকে কিছুতেই নিরাশ করিবেন না। আর একটি হাদীসে আছে, -যে ব্যক্তি শবে-ক্বদর পাইবে নিশ্চয়ই আমি তাকে বেহেশতে লইবার জন্য জামিন হইব।…..”
“হাদীসে আছে, একদিন মূছা(আ) আল্লাহ তায়ালাকে প্রশ্ন করিলেন, হে আল্লাহ তায়ালা তুমি উম্মতে মোহাম্মদীকে উৎকৃষ্ট কোন জিনিস দান করিয়াছ? তদুত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলিলেন, আমি হযরত মোহাম্মাদ(সা) এর উম্মাতকে উৎকৃষ্ট রমজান মাস দান করিয়াছি। মুছা(আ) বলিলেন, প্রভু সেই মাসের কি ফযীলত ও মরতবা তাহা আমাকে শুনাও। তখন আল্লাহ তায়ালা বলিলেন, হে মূছা! রমযান মাসের ফযীলত ও মরতবার কথা কতই শুনাইব তবে সামান্য এতটুকুতেই বুঝিতে পারিবে যে, উহার মর্যাদা কি পরিমাণ! তোমাদের সাধারণের মধ্যে আমার মর্যাদা ও সম্মান যেরূপ অতুলনীয়, অন্যান্য মাস হইতে রমযান মাসের মর্যাদাও তেমনি অতুলনীয় জানিবে। (তিরমিযী)”……..
হযরত(সা) বলেছেন, যাহারা নিজের পরিবার পরিজনসহ সন্তোষের সহিত রমজান মাসের ৩০টি রোজা রাখিয়াছে, হালাল জিনিস দ্বারা ইফতার করিয়াছে, আল্লাহ তায়ালা তাহাদিগকে ঐ প্রকার ছওয়াব দিবেন, যেমন তারা মক্কা শরীফে ও মদীনা শরীফে রোযা রাখিয়াছে। হাদীসে আছে, যাহারা উক্ত স্থানসমূহে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তায়ালা তাহাদের ৭০ হাজার হজ্জ্বের, ৭০ হাজার ওমরার ও ৭০ হাজার রমযান মাসের ছওয়াব দিবেন ও পৃথিবীতে যত ঈমানদার বান্দা আছেন, সমস্তের নেকীর ছওয়াব দিবেন আর ঐ পরিমাণ পাপও তাহাদের আমলনামা হইতে কাটিয়া দিবেন। আর সপ্ত আকাশে যত ফেরেশতা আছে, তাহাদের সমস্ত পূণ্যের ছওয়াব তাহাদের আমলনামায় লিখিয়া দিবেন। (তিরমিজী)।(মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো‘মেনীন, পৃ. ২৭৪-২৭৫)।
এ সকল কথা এভাবে সুনানে তিরমিযী তো দূরের কথা, অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থে সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে জানতে পারিনি। শুধুমাত্র মক্কা মোকাররমায় রামাদান পালনের বিষয়ে দুই একটি যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবত গ্রন্থকার এখানে ইবনু মাজাহ সংকলিত নিম্নের হাদীসটির ‘ইচ্ছামত’ অনুবাদ করেছেনঃ
ইবনু মাজাহ বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু আবী উমার বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল আম্মী বলেছেন, তার পিতা থেকে, সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেনঃ “যে ব্যক্তি মক্কায় রামাদান মাস পাবে, সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার জন্য অন্যত্র এক লক্ষ রামাদান মাসের সাওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। এবং আল্লাহ তার জন্য প্রতি দিবসের পরিবর্তে একটি দাসমুক্তি এবং প্রতি রাতের পরিবর্তে একটি দাসমুক্তি, এবং প্রতিদিনের জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য ঘোড়সাওয়ার পাঠানো এবং প্রতি দিনের জন্য একটি নেকি ও প্রতি রাতের জন্য একটি নেকি লিপিবদ্ধ করেন।”(ইবনু মাজাহ, আস সুনান ২/১০৪১)।
এই হাদীসটি একমাত্র আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল আম্মী(১৮৪ হি) নামক এই ব্যক্তি ছাড়া কেউই বর্ণনা করে নি। এই আব্দুর রহীম একজন মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত রাবী বলে প্রসিদ্ধ। ইমাম বুখারী, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী, জালিয়াত ও পরিত্যক্ত বলে গণ্য করেছেন। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।(ইবনু মাজাহ, আস সুনান ২/১০৪১; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, ৩/৩৪৭, ৩৮৭)।
২.১১.১০. শাওয়াল মাস
প্রথমত, সহীহ হাদীসের আলোকে শাওয়াল মাস
শাওয়াল মাস হজ্জের মাসগুলির প্রথম মাস। এই মাস হতে হজ্জ্বের কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়া সহীহ হাদীস দ্বারা এই মাসের একটি ফযীলত প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) এরশাদ করেছেনঃ “যে ব্যক্তি রামাদান মাসের সিয়াম পালন করবে। এরপর সে শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়াম পালন করবে, তার সারা বৎসর সিয়াম পালনের মত হবে। (মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২২)।
কোনো কোনো যয়ীফ হাদীসে পুরো শাওয়াল মাস সিয়াম পালনের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। একটি যয়ীফ হাদীসে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি রামাদান এবং শাওয়াল মাস এবং (সপ্তাহে) বুধবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”(আহমদ, আল মুসনদা ৩/৪১৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৯০; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ২/৩৬০-৩৬১)।
এছাড়া শাওয়াল মাসের আর কোনো ফযীলত প্রমাণিত নয়। মুমিন এ মাসে তার তাহাজ্জুদ, চাশত, যিকর ওযীফা ইত্যাদি সাধারণ ইবাদত নিয়মিত পালন করবেন। সাপ্তাহিক ও মাসিক নফল সিয়াম নিয়মিত পালন করবেন। অতিরিক্ত এই ছয়টি সিয়াম পালন করবেন। এছাড়া এই মাসের জন্য বিশেষ সালাত, সিয়াম, যিকর, দোয়া, দান বা অন্য কোনো নেক আমল, অথবা এই মাসে কোনো নেক আমল করলে বিশেষ সওয়াবের বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত বা কথিত সবই ভিত্তিহীন বা বানোয়াট কথা। এগুলির অনেক কথা সাধারণভাবে শাওয়াল মাসের ফযীলত ও ছয় রোযার বিষয়ে বানানো হয়েছে। আর কিছু কথা শাওয়াল মাসের প্রথম দিন বা ঈদুল ফিতরের দিনের বিশেষ নামায বা আমলের বিষয়ে বানানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, শাওয়াল মাস বিষয়ক কিছু জাল হাদীস
১.৬. রোযা ও অন্যান্য ফযীলত
এ সকল বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছেঃ “হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ(সা) ফরমাইয়াছেনঃ যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসে নিজেকে গুনাহের কর্ম হইতে বিরত রাখিতে সক্ষম হইবে আল্লাহ তায়ালা তাকে বেহেশতের মধ্যে মনোরম বালাখানা দান করিবেন। অন্য এক হাদীসে আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসের প্রথম রাত্রিতে বা দিনে দুই রাকয়াতের নিয়্যতে চার রাকয়াত নামায আদায় করিবে এবং উহার প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ২১ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিবে; করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তাহার জন্য জাহান্নামের ৭টি দরজা বন্ধ করিয়া দিবেন এবং জান্নাতের ৮টি দরজা উন্মুক্ত করিয়া দিবেন। আর মৃত্যুর পূর্বে সে তাহার বেহেশতের নির্দিষ্ট স্থান দর্শন করিয়া লইবে।…….অন্য আর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূলুল্লাহ(সা) ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে মৃত্যুবরণ করিবে সে ব্যক্তি শহীদানের মর্যাদায় ভূষিত হইবে।….”(মুফতী ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, ৩৯; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, ৩১৯-৩২০)।
এগুলি সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা হাদীসের নামে বলা হয়েছে। শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়ামের ফযীলত সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা জেনেছি। এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত অনেক জাল কথাও প্রচলন করা হয়েছে। যেমনঃ হযরত রাসূলুল্লাহ(সা) ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে ৬টি রোযা রাখিবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে শাস্তির শৃঙ্খল ও কঠোর জিজ্ঞিরের আবেষ্টনী হইতে নাজাত দিবেন…অন্য হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলুল্লাহ(সা) ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসের ৬টি রোযা রাখিবে, তাহার আমলনামায় প্রত্যেকটি রোযার পরিবর্তে সহস্র রোজার সওয়াব লেখা হইবে।”……“রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন,…যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে রোযা রাখেন আল্লাহ পাক তার জন্য দোযখের আগুন হারাম করে দেন। ……যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসের ৬টি রোযা রাখিবে, তাহার আমলনামায় সমস্ত মোহাম্মদী নেককার লোকের সাওয়াব লিখেণ এবং সে হযরত সিদ্দিক আকবার(রা) এর সাথে বেহেশতে স্থান পাইবে। …..যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে রোযা রাখে আল্লাহ তায়ালা তাকে লাল ইয়াকুত পাথরের বাড়ী দান করবেন এবং প্রত্যেক বাড়ীর সম্মুখে দুধ ও মধুর নহর প্রবাহিত হতে থাকবে। ফেরেশতারা তাকে আসমান হতে ডেকে বলবেন, হে আল্লাহর খাস বান্দা, আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন। শাওয়াল মাসে লূতের(আ)কওম ধ্বংস হয়েছিল, নূহের(আ) কওম ডুবেছিল, হুদের(আ) কওম ধ্বংস হয়েছিল…….”(মুফতী ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, ৪২-৪৩; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, ৩২০)।
ইত্যাদি অসংখ্য মিথ্যা কথা দুঃসাহসের সাথে নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলা হয়েছে। আমাদের সম্মানিত লেখকগণ একটুখানিও চিন্তা ও যাচাই না করেই সেগুলি তাঁদের পুস্তকে লিখেন। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
২. ঈদুল ফিতরের দিনের বা রাতের বিশেষ সালাত
শাওয়ালের ১ম তারিখ ঈদুল ফিতর। একাধিক যয়ীফ হাদীসে ঈদুল ফিতরের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ইবাদতের কোনো নির্ধারিত পদ্ধতি, রাক‘আত সংখ্যা, সূরা ইত্যাদি বলা হয় নি।
ঈদের দিনে সালাতুল ঈদ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ নফল সালাতের নির্দেশনা কোনো সহীহ হাদীসে নেই। তবে জালিয়াতগণ এ বিষয়ে কিছু হাদীস রচনা করেছে। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখের দিনে বা রাতের ৪ রাকা’আত সালাত বিষয়ক একটি জাল হাদীস পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। এ বিষয়ক আরো একটি প্রচলিত জাল হাদীস উল্লেখ করছিঃ “যিনি আমাকে নবীরূপে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, জিবরাঈল আমাকে ঈসরাফীলের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের রাতে ১০০ রাকা‘আত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাক‘আতে একবার করে সূরা ফাতিহা এবং ১১ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, এরপর রূকুতে এবং সাজদায় ……..অমুক দোয়া ১০ বার পাঠ করবে, এরপর সালাত শেষে ১০০ বার এসতেগফার পাঠ করবে। এরপর সেজদায় গিয়ে বলবে……। যদি কেউ এরূপ করে তাহলে সেজদা হতে উঠার আগেই তার পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, রামাদানের সিয়াম কবুল করা হবে ……ইত্যাদি ইত্যাদি।(ইবনুল জাওযী, আল মাউদূ‘আত, ২/৫২; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৬৩; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৬০-৬১)।
৩. ঈদুল ফিতরের পরে ৪ রাক‘আত সালাত
ঈদুল ফিতরের দিনে কোনো বিশেষ সালাতের বিশেষ সাওয়াব বা বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু জালিয়াতগণ সালাতুল ঈদ আদায়ের পরে ৪ রাক‘আত সালাতের বিশেষ ফযীলতের কাল্পনিক কাহিনী বানিয়েছে। একটি জাল হাদীস নিম্নরূপঃ
“যদি কেউ সালাতুল ঈদ আদায় করার পরে ৪ রাক‘আত সালাত আদায় করে, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক অমুক সূরা পাঠ করে, তবে সে যেন আল্লাহর নাযিল করা সকল কিতাব পাঠ করল, সকল এতিমকে পেটভরে খাওয়াল, তেল মাখালো, পরিষ্কার করলো। তার ৫০ বছরের পাপ ক্ষমা করা হবে। তাকে এত এত পুরস্কার দেওয়া হবে……।(ইবনুল জাওযী, আল মাউদূ‘আত, ২/৫৩-৫৪; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৬৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৬১)।
২.১১.১১. যিলকাদ মাস
যুলকা’দা বা যিলকাদ মাসের সাধারণ দুটি মর্যাদা রয়েছেঃ প্রথমত, তা ৪ টি হারাম মাসের একটি। দ্বিতীয়ত, তা হজ্জ্বের মাসগুলির দ্বিতীয় মাস। এ ছাড়া এই মাসের বিশেষ কোনো ফযীলত হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তবে জালিয়াতগণ এ বিষয়ে কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট কথা প্রচার করেছে। এগুলির মধ্যে রয়েছেঃ “রাসূলুল্লাহ(সা) ফরমান, তোমরা যিলক্বদ মাসকে সম্মান করিবে, যেহেতু ইহা মর্যাদাবান মাসসমূহের মধ্যে প্রথম মাস। ….যে ব্যক্তি যিলক্বদ মাসের ভিতরে একদিন রোযা রাখিবে, আল্লাহ তা‘আলা উহার প্রতি ঘন্টার পরিবর্তে একটি হজ্জের সাওয়াব তাহাকে দান করিবেন।….যে ব্যক্তি এই মাসের কোনো জুমুয়ার দিবসে দুই দুই রাকায়াতের নিয়তে চার রাকায়াত নামায আদায় করিবে, যাহার প্রতি রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পরে ১০ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাহাকে একটি হজ্জ ও একটি ওমরার সওয়াব দান করিবেন। …..যে ব্যক্তি যিলক্বদ মাসের প্রত্যেক রজনীতে দুই রাক‘আত করিয়া নামায আদায় করিবে এবং ইহার প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইখলাছ তিনবার পাঠ করিবে আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তির আমলনামায় একজন হাজী ও একজন শহীদের পূণ্যের তুল্য সাওয়াব দান করিবেন এবং রোজ কিয়ামতে সেই ব্যক্তি আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করিবে।….” “এই মাসের রোজাদারের প্রত্যেক নিঃশ্বাসে একটি গোলাম আজাদ করার সাওয়াব প্রদান করেন। …এই মাসকে গনীমত মনে করবে। যেহেতু যে ব্যক্তি এ মাসে একদিন এবাদত করে উহা হাজার বছর হতেও উৎকৃষ্ট। …যিলক্বদ মাসের সোমবারের রোজা হাজার বৎসরের এবাদত হতেও উৎকৃষ্ট। …..এই চাঁদে যে একদিন রোজা রাখবে, আল্লাহ পাক তার জন্য প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসে এক একটি মকবুল হজ্জ্বের সাওয়াব দান করবেন।…….ইত্যাদি ইত্যাদি …।”(মুফতী ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত, ৪৪-৪৫; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, ৩২১-৩২২)।
এগুলি সবই দুঃসাহসী নির্লজ্জ জালিয়াতগণের কথা, যা তারা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বানিয়ে প্রচার করছে এবং জাহান্নামে নিজেদের আবাসস্থল বানিয়েছে। দুঃখজনক হলো, অনেক আলিম বা লেখক যাচাই বাছাই না করেই এই সমস্ত আজগুবি মিথ্যা কথাকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। অন্তত কোন্ গ্রন্থে হাদীসটি সংকলিত তা যাছাই করলেও জালিয়াতি ধরা পড়ত। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।
২.১১.১২. যিলহাজ্জ মাস
যুলহাজ্জ বা যিলহাজ্জ মাস ৪টি হারাম মাসের অন্যতম। এ মাসেই হজ্জ আদায় করা হয় এবং এই মাসেই ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়। এই মাসের প্রথম দশ দিনে বেশি বেশি নেক কর্ম করতে সহীহ হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ(সা) এরশাদ করেন, “যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশদিন নেক আমল করা আল্লাহর নিকট যত বেশি প্রিয় আর কোনো দিনের আমল তাঁর নিকট তত প্রিয় নয়।”(বুখারী, আস-সহীহ ১/৩২৯; তিরমিযী, আস সুনান, ৩/১৩০-১৩১)।
যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এই দশদিনের প্রতি দিনের সিয়াম এক বৎসরের সিয়ামের তুল্য এবং প্রত্যেক রাত লাইলাতুল ক্বদরের তুল্য। (তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৩১৩)।
অন্য একটি দুর্বল হাদীসে বলা হয়েছে, “এই দশদিনের নেক আমলে ৭০০ গুণ সাওয়াব প্রদান করা হয়।”(বাইহাকী, শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৬; মুনযিরী, আত তারগীব ২/১২৮)। অন্য একটি যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আনাস ইবনু মালিক(রা) বলেছেন, কথিত আছে যে, যিলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন এক হাজার দিনের সমান এবং বিশেষত আরাফার দিন ১০ হাজার দিনের সমান।”(বাইহাকী, শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৮; মুনযিরী, আত তারগীব ২/১২৮)।
যুলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখে হাজীগণ আরাফার মাঠে অবস্থানের মাধ্যমে হজ্জের মূল দায়িত্ব পালন করেন। যারা হজ্জ করছেন না তাদের জন্য এই দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এই দিনের সিয়ামের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন, “তা বিগত বৎসর এবং পরবর্তী বৎসরের পাপ মার্জনা করে।”(মুসলিম, আস সহীহ ২/৮১৯)।
দ্বিতীয়ত, জিলহজ্জ মাস বিষয়ক কিছু বানোয়াট কথা
এ সকল সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের পাশাপাশি এ মাসের ফযীলতে অনেক জাল হাদীস সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এ সকল জাল হাদীসে এ মাসের জন্য বিশেষ বিশেষ সালাত ও সিয়ামের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া এ মাসের প্রথম ১০ দিনের ফযীলতের বিষয়েও অনেক জাল কথা তারা বানিয়েছে।
১. যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দিন
যিলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের অংশ হিসেবে এই দিনটির ফযীলত রয়েছে। কিন্তু জালিয়াতগণ অন্য ফযীলত বর্ণনা করেছে। “যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দিন হযরত ইবরাহীম(আ) জন্মগ্রহণ করেন। কাজেই যে ব্যক্তি এই দিনে সিয়াম পালন করবে সে ৭০ বৎসর সিয়াম পালনের সাওয়াব পাবে….তার ৮০ বৎসরের পাপের মার্জনা হবে…..।”(সুয়ূতী, যাইল আল লাআলী, পৃ. ১১৯; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৬৫; তাহের ফাতানী, তাযকিরা, পৃ. ১১৯)।
২. যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ, ইয়াওমুত তারবিয়া
যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখকে ‘ইয়াওমুত তারবিয়া’ বলা হয়। এই দিনে হজ্জের কার্য্যক্রম শুরু হয়। হাজীগণ এইদিনে হজ্জের জন্য মক্কা হতে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। হাজী ছাড়া অন্যদের জন্য এই দিনের বিশেষ কোনো আমল নেই। যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশদিনের অংশ হিসেবে এর মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু জালিয়াতগণ এই তারিখের দিবসে ও রাতের জন্য বিশেষ সালাত ও সিয়ামের কাহিনী রচনা করেছে। ইতোপূর্বে শবে বরাত বিষয়ক জাল হাদীস আলোচনার সময় ‘তারবিয়ার’ রাত বা যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকার বিষয়ে কয়েকটি জাল বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীস আমরা দেখতে পেয়েছি। আরেকটি জাল হাদীসে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি তারবিয়ার দিনে সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তাকে সেই পরিমাণ সাওয়াব প্রদান করবেন, যে পরিমাণ সাওয়াব আইয়ূব(আ) বালা মুসিবতের কারণে লাভ করেছিলেন।”(সুয়ূতী, যাইল আল লাআলী, পৃ. ১২১; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৬৫; তাহের ফাতানী, তাযকিরা, পৃ. ১২১)।
৩. যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখ, আরাফার দিন
আরাফার দিনে সিয়াম পালনের ফযীলত আমরা জানতে পেরেছি। হাজীগণ ব্যতীত অন্য মুসলিমের জন্য এই তারিখের দিনে বা রাতে আর কোনো বিশেষ সালাত, দোয়া, যিকির বা অন্য কোনো নেক আমলের র্নিধারিত বিধান বা পদ্ধতি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। জালিয়াতগণ এ দিনের সালাত, যিকর, দোয়া ইত্যাদির বিষয়েও অনেক জাল হাদীস প্রচার করছে।
৪. যিলহাজ্জ মাসের বানোয়াট সালাত
আমরা দেখেছি যে, যিলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন ও রাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে নফল সালাত বা সিয়াম, যিকর, দোয়া, দান ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদত বন্দেগী যথাসাধ্য বেশি বেশি পালন করা দরকার। যে যতটুকু করতে পারবেন ততটুকুর সাওয়াব পাবেন। এ সকল দিনে বা জিলহাজ্জ মাসের কোনো দিন বা রাতের জন্য কোনোরূপ বিশেষ সালাত বা সালাতের বিশেষ পদ্ধতি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট। যেমনঃ ১. যিলহাজ্জ মাসের প্রথম রাত্রির সালাতঃ দুই রাকা‘আত বা বেশি রাক‘আত…… সালাত, অমুক অমুক সূরা দ্বারা….ইত্যাদি। যেমনঃ
১. যিলহাজ্জ মাসের প্রথম রাত্রির সালাত। ২ রাক‘আত বা বেশি রাক‘আত……সালাত, অমুক অমুক সূরা দ্বারা….ইত্যাদি।
২. যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ ‘ইয়াওমুত তারবিয়ার’ রাতের সালাত: ২/৪….ইত্যাদি রাক‘আত সালাত, অমুক অমুক সূরা দিয়ে…।
৩. যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ ‘ইয়াওমুত তারবিয়ার’ দিবসের সালাত: ৬/৮….ইত্যাদি রাক‘আত সালাত, অমুক অমুক সূরা দিয়ে…।
৪. আরাফার দিনের সালাত: ২/৪….ইত্যাদি রাক‘আত সালাত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা ……অতবার… ইত্যাদি।
৫. আরাফার রাতের সালাত: ১০০ রাক‘আত….ইত্যাদি রাক‘আত সালাত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা ……অতবার… ইত্যাদি।
৬. ঈদুল আযহার বা ‘ইয়ামূন নাহার’ এর(কুরবানীর দিনের)রাতের সালাত: ১২/….ইত্যাদি রাক‘আত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা ……অতবার… ইত্যাদি।
৭. কুরবানীর দিন বা ঈদুল আযহার দিনের সালাত, ঈদুল আযহার পরে ২ রাক‘আত সালাত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা, অতবার……।
৮. জিলহাজ্জ মাসের শেষ দিনের সালাত, দুই রাক‘আত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা, অমুক আয়াত অতবার…..।
এ সকল বানোয়াট সালাতের মধ্যে বা শেষে কিছু দোয়া বা যিকর এর উল্লেখও করছে জালিয়াতগণ।তারা এ সকল সালাতের জন্য আকর্ষণীয় ও আজগুবি অনেক সাওয়াব ও ফলাফলের কথা উল্লেখ করেছে।(আব্দুল হাই লাখনাবী, আল আসার, পৃ. ৮৭-৮৯, ১১৫-১১৭)।
৬. যিলহাজ্জের শেষ দিন ও মুহাররামের প্রথম দিনের সিয়াম
একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি জিলহাজ্জ মাসের শেষ দিন এবং মুহাররাম মাসের প্রথম দিন সিয়াম পালন করল, সেই ব্যক্তি তার বিগত বছরকে সিয়াম দ্বারা সমাপ্ত করলো এবং আগত বছরকে সিয়াম দ্বারা স্বাগত জানালো। কাজেই আল্লাহ তার ৫০ বৎসরের কাফফারা বা পাপ মার্জনা করবেন। (ইবনুল জাওযী, আল মাঊদূ‘আত ২/১১২; সুয়ূতী, আল লাআলী ২/১৯৯, ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৪৮; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ ১/১২৯)।
এরূপ আরো আজগুবি সনদহীন বানোয়াট ও মিথ্যা কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়।(মুফতী ছামদানী, বার চাঁন্দের ফযীলত ৪৬-৫০)।
উপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, জালিয়াতদের মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি দেখানোর একটি বড় ক্ষেত্র হলো সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক বিভিন্ন নেক আমলের ফযীলতের বিষয়ে জাল হাদীস তৈরি করা। এর বড় কারণ হলো, এই ধরনের জাল কথা সহজেই সরলপ্রাণ মুসলমানদের মন আকৃষ্ট করে। এবং এগুলি দিয়ে সহজেই সরলপ্রাণ বুযুর্গ ও লেখকগণকে ধোঁকা দেওয়া যায়। তারা আমল ভালবাসেন এবং আমলের ফযীলত বিষয়ক হাদীসগুলি সরলমনে গ্রহণ করেন।
এই জাতীয় জাল কথা প্রচলন হওয়ার কারণও এই। অন্যান্য জাল কথার চেয়ে আমাদের ফযীলত বিষয়ক জাল কথার প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণ হলো, অনেক বুযুর্গ ওয়ায়েয, দরবেশ বা লেখক এগুলির মধ্যে ফযীলতের আধিক্য দেখে সরল মনে এগুলিকে গ্রহণ করেছেন এবং সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য এগুলি মুখে বলেছেন বা বইয়ে লিখেছেন। আর, একবার সাধারণত একবার একজন লিখলে পরবর্তী লেখকগণ সেগুলি থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করে থাকেন। অনেকেই যাচাই বাছাই করার সময় পান না। অনেকে ভাবেন, যাই হোক এর দ্বারা কিছু মানুষতো আমল করছে। ভালই তো!!
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অনেক নেককার বুযুর্গ এগুলির উপর আমল করেছেন, অনেক ফল ও প্রভাব লাভ করেছেন। অনেকে এগুলি তাদের ওয়াযে বলেছেন বা বইয়ে লিখেছেন-তাঁরা কি সবাই গোনাহগার হবেন?
এখানে আমাদের বুঝতে হবে যে, এ সকল জাল হাদীসে সাধারণত, সালাত, সিয়াম, যিকর, দোয়া, দান ইত্যাদি শরীয়তসম্মত নেক আমলের উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। মুমিনের দায়িত্ব হলো নফল সালাত, সিয়াম, যিকর, দোয়া ইত্যাদি সকল প্রকার দৈনন্দিন, সাপ্তাহিক, বাৎসরিক ও নেক আমল নিয়মিত পালন করা। এই হলো রাসূলুল্লাহ(সা) ও তাঁর সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসারী সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ও বুযুর্গগণের রীতি ও তরিকা। এরপর সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত মর্যাদাময় রাত ও দিনগুলিতে অতিরিক্ত ইবাদতের চেষ্টা করা। এ সকল মিথ্যা ও জাল হাদীস সাধারণত মুমিনকে সহীহ সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত ইবাদত থেকে দূরে নিয়ে যায়, অকারণ পরিশ্রম ও কষ্টের মধ্যে নিপতিত করে এবং সুন্নাত বিরোধী বিভিন্ন রীতি পদ্ধতির মধ্যে নিমজ্জিত করে। এ ছাড়া যে কোনো কথা শুনে বা পড়েই তাকে হাদীস বলে মেনে নেওয়া, হাদীসের কোন্ গ্রন্থে সংকলিত আছে তা অন্তত যাছাই করার চেষ্টা না করা রাসূলুল্লাহর(সা) সুন্নাতের বিরোধী এবং দীনের বিষয়ে অবহেলার শামিল। এরপরও যারা অসাবধানতা, সরলতা বা অজ্ঞতাবশত এগুলিকে সঠিক মনে করে এগুলির উপর আমল করেছেন, তারা এ সকল জাল হাদীসে বর্ণিত জাল ও বানোয়াট সাওয়াব পাবেন না, তবে মূল নেক আমলের সাধারণ সাওয়াব পাবেন বলে আশা করা যায়।
কিন্তু কেউ যদি এগুলিকে জাল বলে জানার বা শোনার পরও এগুলি বলেন, লিখেন বা পালন করেন, এ বিষয়ে কোনো তাহকীক বা যাচাই করতে আগ্রহী না হন, তবে অবশ্যই তিনি রাসূলুল্লাহর(সা) নামে মিথ্যা বলার অপরাধে অপরাধী হবেন।