১.৩. মিথ্যা প্রতিরোধে সাহাবীগণ
ওহীর জ্ঞানের নির্ভূল ও অবিমিশ্র সংরক্ষণের বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশ, ওহীর নামে মিথ্যা বা আন্দাজে কথা বলার ভয়াবহ পরিণতি, হাদীসের নির্ভূল ও অবিমিশ্র সংরক্ষণে রাসূলুল্লাহ(স) এর বিশেষ নির্দেশ ও হাদীসের নামে মিথ্যা বলার নিষেধাজ্ঞার আলোকে সাহাবীগণ হাদীসে রাসূল (স) কে সকল প্রকার অনিচ্ছাকৃত, অজ্ঞতাপ্রসূত বা ইচ্ছাকৃত ভুল, বিকৃতি বা মিথ্যা থেকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তাঁরা একদিকে নিজেরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। পরিপূর্ণ ও নির্ভূল মুখস্ত সম্পর্কে পূর্ণ নিশ্চিত না হলে তাঁরা হাদীস বলতেননা। অপরদিকে তাঁরা সবাইকে এভাবে পূর্ণরূপে হুবহু ও নির্ভূলভাবে মুখস্ত করে হাদীস বর্ণনা করতে উৎসাহ ও নির্দেশ প্রদান করতেন। তৃতীয়ত, তাঁরা সাহাবী ও তাবিয়ী যে কোনো হাদীস বর্ণনাকারীর হাদীসের নির্ভূলতা বিষয়ে সামান্যতম দ্বিধা হলে তা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করার পরে গ্রহণ করতেন।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, তাঁদের যুগে ইচ্ছাকৃত ভুলের কোনো সম্ভাবনা ছিলনা। মানুষের জাগতিক কথাবার্তা ও লেনদেনেও কেউ বলতেননা। সততা ও বিশ্বস্ততাই ছিল তাঁদের বৈশিষ্ট্য। তা সত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃত, অজ্ঞতাপ্রসূত বা আসাবধানতাজনিত সামান্যতম ভুল থেকে হাদীসে রাসূল(স) এর রক্ষায় তাঁদের কর্মধারা দেখলে হতবাক হয়ে যেতে হয়।
১.৩.১. অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলা থেকে আত্মরক্ষা
আমরা জানি যে, মিথ্যা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। অনিচ্ছাকৃত ভুলও মিথ্যা বলে গণ্য। সাহাবীগণ নিজে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ‘মিথ্যা’ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নির্ভূলভাবে ও আক্ষরিকভাবে হাদীস বলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁদের সতর্কতার অগণিত ঘটনা হাদীস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
তাবিয়ী আমর ইবনু মাইমূন আল আযদী(74 হি) বলেনঃ আরবী(*********)
-আমি প্রতি বৃহস্পতিবার আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ(রা)এর নিকট আগমন করতাম। তিনি তাঁর কথাবার্তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, এ কথাটা কখনো বলতেননা। এক বিকেলে তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন’, এরপর তিনি মাথা নিচু করে ফেলেন। আমি তাঁর দিকে তাঁকিয়ে দেখি তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর জামার বোতামগুলি খোলা। তাঁর চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছে এবং গলার শিরাগুলি ফুলে উঠেছে। তিনি বললেনঃ অথবা এর কম, অথবা এর বেশি, অথবা এর মত, অথবা এর কাছাকাছি কথা রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন। (ইবনু মাজাহ, আস সুনান 1/10-11, আস-সুনান 1/88, আল মুসতাদরাক ১/194)।
তাবিয়ী মাসরূক ইবনুল আজদা আবু আইশা (৬১ হি) বলেনঃ আরবী(***)
-একদিন আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ(রা) রাসূলুল্লাহ(স) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তখন তিনি কেঁপে উঠেন এমনকি তাঁর পোশাকেও কম্পন পরিলক্ষিত হয়। এরপর তিনি বলেনঃ অথবা অনুরূপ কথা তিনি বলেছেন। (হাকিম, আল মুসতাদরাক 1/193)।
তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন(১১০ হি) বলেনঃ আরবী(****)
আনাস ইবনু মালিক(রা) যখন হাদীস বলতেন তখন হাদীস বর্ণনা শেষ করে বলতেন: অথবা রাসূলুল্লাহ(স) যা বলেছেন (আমার বর্ণনায় ভুল হতে পারে)। (ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১)।
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবীগণ জ্ঞাতসারে একটি শব্দেরও পরিবর্তন করতেননা। আক্ষরিকভাবে হুবহু বর্ণনা করতেন তাঁরা। তাবেয়ী সা’দ ইবনু উবাইদাহ সুলামী (১০৩ হি) বলেন: সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উমর(৭৩ হি) বলেন: রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(******)
-“পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বা তাওহীদ, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, রামাদানের সিয়াম পালন এবং হ্জ্জ।” তখন এক ব্যক্তি বলে: “হজ্জ ও রামাদানের সিয়াম”। তিনি বলেন: “না, রামাদানের সিয়াম ও হজ্জ।” এভাবেই আমি রাসূলুল্লাহ(স) হতে শুনেছি। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৫)।
ইয়াফুর ইবনু রূযী নামক তাবেয়ী বলেনঃ আমি শুনলাম, উবাইদ ইবনু উমাইর (৭২ হি) নামক প্রখ্যাত তাবিয়ী ও মক্কার সুপ্রসিদ্ধ ওয়ায়িয একদিন ওয়াযের মধ্যে বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-“মুনাফিকের উদাহরণ হলো দুইটি ছাগলের পালের মধ্যে অবস্থানরত ছাগীর ন্যায়।” একথা শুনে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উমার(৭৩ হি) বলেনঃ আরবী(****)
-দূর্ভোগ তোমাদের! তোমরা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলবেনা। রাসুলুল্লাহ(স) তো বলেছেন: “মুনাফিকের উদাহরণ হলো দুইটি ছাগলের পালের মধ্যে যাতায়াতরত (wandering, roaming) ছাগীর ন্যায়।” (মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৫)।
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা ও পরিপূর্ণ নির্ভূলতা নিশ্চিত করার জন্য অধিকাংশ সাহাবী রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। শুধুমাত্র যে কথাগুলি বা ঘটনাগুলি তাঁরা পরিপূর্ণ নির্ভূলভাবে মুখস্ত রেখেছেন বলে নিশ্চিত থাকতেন সেগুলিই বলতেন। অনেকে কখনোই রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কিছু বলতেননা। সাহাবীগণের সংখ্যা ও হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীগণের সংখ্যার মধ্যে তুলনা করলেই আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। রাসূলুল্লাহ(স) এর কম বেশি সাহচর্য্ লাভ করেছেন এমন সাহাবীর সংখ্যা লক্ষাধিক। নাম পরিচয় সহ প্রসিদ্ধ সাহাবীর সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক। অথচ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা মাত্র দেড় হাজার।
সাহাবীদের নামের ভিত্তিতে সংকলিত প্রসিদ্ধ সর্ববৃহৎ হাদীসগ্রন্থ মুসনাদ আহমদ। ইমাম আহমদ এতে মোটামুটি গ্রহণ করার মত সকল হাদীস ও যয়ীফ হাদীস সংকলিত করেছেন। এতে ৯০৪ জন সাহাবীর হাদীস সংকলিত হয়েছে। পরিচিত, অপরিচিত, নির্ভরযোগ্য, অনির্ভরযোগ্য সকল হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা একত্রিত করলে ১৫৬৫ হয়।
এখানে আরো লক্ষ্যণীয় যে, হাদীস বর্ণনাকারী সহস্রাধিক সাহাবীর মধ্যে অধিকাংশ সাহাবী মাত্র ১ টি থেকে ২০/৩০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ১০০ টির বেশি হাদীস বর্ণনা করেছেন এমন সাহাবীর সংখ্যা মাত্র ৩৮ জন। এঁদের মধ্যে মাত্র ৭ জন সাহাবী থেকে ১০০০ এর বেশি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বাকী ৩১ জন সাহাবী থেকে ১০০ হতে কয়েকশত হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকার অনেক ঘটনা সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে।
সাইদ ইবনু ইয়াযীদ(৯১ হি) একজন সাহাবী ছিলেন। ছোট বয়সে তিনি বিদায় হজ্জে রাসুলুল্লাহ(স) এর সাহচর্য্ লাভ করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি সাহাবীগণের সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি বলেনঃ আরবী(******)
-আমি আবদুর রাহমান ইবনু আউফ(রা), তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ(রা), সাদ ইবনু আবী ওয়াক্কাস(রা) ও মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ(রা) প্রমূখ সাহাবীর সাহচর্যে সময় কাটিয়েছি। তাঁদের কাউকে রাসূলুল্লাহ(স) হতে হাদীস বলতে শুনিনি। তবে শুধুমাত্র তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহকে আমি ওহুদ যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে শুনেছি। (ইবনু আদী, আল কামিল ফী দুআফাইর রিজাইল ১/৯৩)।
তিনি আরো বলেনঃ “আমি সা’দ ইবনু মালিক(রা) এর সাহচর্যে মদীনা থেকে মক্কা পর্য্ন্ত গিয়েছি। এই দীর্ঘ পথে দীর্ঘ সময়ে তাঁকে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে একটি হাদীসও বলতে শুনিনি।”
হিজরী প্রথম শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী শা’বী(২০৪ হি) বলেনঃ “আমি আবুদল্লাহ ইবনে উমারের(রা) সাথে একটি বৎসর থেকেছি, অথচ তাঁকে রাসূলুল্লাহ(স) হতে কিছুই বলতে শুনিনি।”
অন্যত্র তিনি বলেনঃ “আমি দুই বৎসর বা দেড় বৎসর আবদুল্লাহ ইবনে উমার(রা) এর কাছে বসেছি। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁকে মাত্র একটি হাদীস বলতে শুনেছি…….।” (বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৫২; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/২৪৩)।
সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর(রা) বলেন, আমি আমার পিতা যুবাইর ইবনুল আওয়াম(রা) কে বললাম, অন্যান্য কোনো কোনো সাহাবী যেমন হাদীস বর্ণনা করেন আপনাকে তদ্রুপ হাদীস বলতে শুনিনা কেন? তিনি বলেনঃ “শুনে রাখ, ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমি কখনো তাঁর সাহচর্য্ থেকে দূরে যাইনি। কিন্তু আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, আমার নামে (ইচ্ছাকৃতভাবে) যে ব্যক্তি মিথ্যা বলবে তাকে অবশ্যই জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।(বুখারী, আস-সহীহ ১/৫২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৪)।
তাহলে যুবাইর ইবনু আওয়াম(৩৬ হি) এর হাদীস না বলার কারণ অজ্ঞতা নয়। তিনি নব্যূয়তের প্রথম কিশোর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এরপর দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর ইন্তিকালের পরে তিনি প্রায় ২৫ বৎসর বেঁচে ছিলেন। অথচ তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৪০ টিরও কম। মুসনাদে আহমদে তাঁর থেকে ৩৬টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ইবনু হাযাম উল্লেখ করেছেন যে, নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য সনদে তাঁর নামে বর্ণিত সকল হাদীসের সংখ্যা মাত্র ৩৮ টি।(ইবনু হাযাম, আসমাউস সাহাবাহ আর-রুওয়াত, পৃ.৯৫)।
আমরা দেখেচি যে, অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে তিনি হাদীস বলা থেকে বিরত ছিলেন। কারণ রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার শাস্তি জাহান্নাম। আর অনিচ্ছাকৃত ভুল বা শব্দগত পরিবর্তন ও তাঁর নামে মিথ্যা বলা হতে পারে। এজন্য তিনি হাদীস বর্ণনা থেকে অধিকাংশ সময় বিরত থাকতেন।
অন্যান্য সাহাবীও অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে এভাবে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। তাবিয়ী আবদুর রহমান ইবনু আবী লাইলা(৮৩ হি) বলেনঃ “আমরা সাহাবী যাইদ ইবনু আরকাম(৬৮ হি) কে বললাম, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস বর্ণনা করুন। তিনি বলেনঃ আমরা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি এবং বিস্মৃতি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে হাদীস বলা খুবই কঠিন দায়িত্ব।”
সাহাবী সুহাইব ইবনু সিনান(রা) বলতেনঃ “তোমরা এস, আমি তোমাদেরকে যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী বর্ণনা করবো। তবে কোনো অবস্থাতেই আমি ‘রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন’ একথা বলবনা। (আনসারুল আশরাফ ১/১৮৩)।
তাবিয়ী হাশিম হুরমুযী বলেন, আনাস ইবনু মালিক(রা) বলতেন, “ আমার ভয় হয় যে আমি অনিচ্ছাকৃত ভুল করে ফেলব। এই ভয় না থাকলে আমি অনেক কিছু তোমাদেরকে বলতাম যা আমি তাঁকে বলতে শুনেছি। কিন্তু তিনি বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতেই হবে। (আহমদ, আল মুসনাদ ৩/১৭২)।
এভাবে সাহাবীগণ অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। এখানে লক্ষণীয় যে, আনাস ইবনু মালিক ও আবু কাতাদাহ দুজনেই বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(স)‘ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর নামে হাদীস বলার শাস্তি বর্ণনা করেছেন।’ কিন্তু তাঁরা অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে তাঁর নামে হাদীস বর্ণনা পরিহার করেছেন। কারণ ভুল হতে পারে জেনেও সাবধান না হওয়ার অর্থ ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অনিচ্ছাকৃত ভুলের সুযোগ দেওয়া।’ অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে সর্বাত্মক সতর্ক না হওয়ার অর্থ ইচ্ছাকৃত বিকৃতিকে প্রশ্রয় দেওয়া। কাজেই যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে সতর্ক না হওয়ার কারণে ভুল করল, সে ইচ্ছাকৃতভাবেই রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলল। কোনো মুমিন রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের বিষয়ে অসতর্ক হতে পারেননা।
১.৩.২. অন্যের বলা হাদীস যাচাই পূর্বক গ্রহণ করা
এভাবে আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ নিজেরা হাদীস বর্ণনার সময় আক্ষরিকভাবে নির্ভূল বলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন এবং কোনো প্রকারের দ্বিধা বা সন্দেহ হলে হাদীস বলতেননা। হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তাঁদের দ্বিতীয় কর্মধারা ছিল অন্যের হাদীস বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও অনুরূপ সতর্কতা অবলম্বন করা। অন্য কোনো সাহাবী বা তাঁদের সমকালীন তাবিয়ীর বর্ণিত হাদীসের আক্ষরিক নির্ভূলতা বা যথার্থতা(Accuracy) সম্বন্ধে সামান্যতম সন্দেহ হলে তাঁরা তা যাচাই না করে গ্রহণ করতেননা।
অর্থাৎ তাঁরা নিজে হাদীস বলার সময় যেমন ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’ থেকে আত্মরক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন, তদ্রুপভাবে অন্যের বর্ণিত হাদীস সঠিক বলে গণ্য করার পূর্বে তাতে কোনো মিথ্যা বা ভুল আছে কিনা তা যাছাই করতেন। এই সূক্ষ্ম যাচাই ও নিরীক্ষাকে তাঁরা হাদীসের বিশুদ্ধতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূলুল্লাহ(স)এর নির্দেশিত অন্যতম দায়িত্ব বলে মনে করতেন। এজন্য এতে কেউ কখনো আপত্তি করেননি বা অসম্মানবোধ করেননি।
১.৩.২.১. নির্ভূলতা নির্ণয়ে তুলনামূলক পরীক্ষা
পূর্বের আলোচনা হতে আমরা জেনেছি যে, মিথ্যা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত উভয় প্রকারের হতে পারে। উভয় ধরনের মিথ্যা বা ভুল থেকে হাদীসকে রক্ষার জন্য সাহাবায়ে কেরাম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তাঁদের যুগে কোনো সাহাবী মিথ্যা বলতেননা এবং নির্ভূলভাবে হাদীস বলার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করতেননা। তবুও তাঁরা হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর কোনো ভুল হতে পারে সন্দেহ হলেই তাঁর বর্ণনাকে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে তা গ্রহণ করতেন।
তুলনামূলক নিরীক্ষার প্রক্রিয়া ছিল বিভিন্ন ধরনের।
১. বর্ণিত হাদীস অর্থাৎ বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনাকে মূল নির্দেশদাতার নিকট পেশ করে তার যথার্থতা ও নির্ভূলতা(Accuracy) নির্ণয় করা।
২. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনা(হাদীস) কে অন্য কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তির বর্ণনার সাথে মিলিয়ে তার যথার্থতা ও নির্ভূলতা নির্ণয় করা।
৩. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনা(হাদীস) কে বর্ণনাকারীর বিভিন্ন সময়ের বর্ণনার সাথে মিলিয়ে তার যথার্থতা ও নির্ভূলতা নির্ণয় করা।
৪. বর্ণিত হাদীসটির বিষয়ে বর্ণনাকারীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বা শপথ করিয়ে বর্ণনাটির যথার্থতা বা নির্ভূলতা নির্ধারণ করা।
৫. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা হাদীসটির অর্থ কুরআন ও হাদীসের প্রসিদ্ধ অর্থ ও নির্দেশের সাথে মিলিয়ে দেখা।
এ সকল নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা হাদীস বর্ণনাকারী হাদীসটি সঠিকভাবে মুখস্ত রাখতে ও বর্ণনা করতে পেরেছে কিনা যাচাই করতেন।
সাহাবীগণের যুগ থেকে পরবর্তী সকল যুগে হাদীসের বর্ণনার নির্ভূলতা ও বিশুদ্ধতা নির্ধারণে এ সকল পদ্ধতিতে নিরীক্ষাই ছিল মুহাদ্দিসগণের মূল পদ্ধতি। আমরা জানি যে, বিশ্বের সকল দেশের সকল বিচারালয়ে প্রদত্ত সাক্ষ্যের যথার্থতা ও নির্ভূলতা নির্ণয়ের জন্য ও এই পদ্ধতিই অনুসরণ করা হয়। কোনো বর্ণনা বা সাক্ষ্যের বিশুদ্ধতা ও নির্ভূলতা নির্ণয়ের জন্য এটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আমরা এখানে সাহাবীগণের যুগের কিছু উদাহরণ আলোচনা করব।
১.৩.২.২. মূল বক্তব্যদাতাকে প্রশ্ন করা
কোনো সাক্ষ্য বা বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের সর্বোত্তম উপায় বক্তব্যদাতাকে প্রশ্ন করা। রাসূলুল্লাহ(স) এর জীবদ্দশায় কোনো সাহাবী অন্য কোনো সাহাবীর বর্ণিত হাদীসের নির্ভূলতা বিষয়ে সন্দীহান হলে রাসূলুল্লাহ(স) কে প্রশ্ন করে নির্ভূলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। বিভিন্ন হাদীসে এ সংক্রান্ত অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
১. জাবির ইবনু আবদুল্লাহ(রা) বিদায় হজ্জের বর্ণনার মধ্যে বলেনঃ আরবী(*******)
-[(বিদায় হজ্জের পূর্বে রাসূলুল্লাহ(স) আলী(রা) কে ইয়ামেন এর প্রশাসক রূপে প্রেরণ করেন। ফলে) আলী(রা) ইয়ামান থেকে মক্কায় হজ্জে আগমন করেন। তিনি মক্কায় এসে দেখেন যে, ফাতিমা(রা) উমরা পালন করে ‘হালাল’ হয়ে গিয়েছেন। তিনি রঙিন সুগন্ধময় কাপড় পরিধান করেছেন এবং সুরমা ব্যবহার করেছেন। আলী এতে আপত্তি করলে তিনি বলেনঃ আমার আব্বা আমাকে এভাবে করত নির্দেশ দিয়েছেন। আলী বলেনঃ আমি ফাতিমার বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ(স) এর কাছে অভিযোগ করলাম, সে যে রাসূলুল্লাহ(স) এর নির্দেশের কথা বলছে তাও বললাম এবং আমার আপত্তির কথাও বললাম। ….তখন রাসূলুল্লাহ(স) বলেনঃ ‘সে ঠিকই বলেছে, সে সত্যই বলেছে।(মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৮৬-৮৯২)।
এখানে আমরা দেখতে পাই যে, আলী(রা) ফাতেমার(রা) বর্ণনার যথার্থতা সম্পর্কে সন্দীহান হন। তিনি তাঁর সত্যবাদিতায় সন্দেহ করেননি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ(স) এর বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝা ও বর্ণনা করার বিষয়ে তাঁর সন্দেহ হয়। অর্থাৎ তিনি অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে সন্দীহান হন। এজন্য তিনি রাসূলুল্লাহ(স) কে প্রশ্ন করে নির্ভূলতা যাচাই করেন।
২. উবাই ইবনু কা’ব বলেনঃ আরবী(*******)
-একদিন রাসূলুল্লাহ(স) জুমু’আর দিনে খুতবায় দাঁড়িয়ে সূরা তাবারাকা(সূরা আল ফুরকান)পাঠ করেন এবং আমাদেরকে আল্লাহ নেয়ামত ও শান্তি সম্পর্কে ওয়ায করেন। এমতাবস্থায় আবু দারদা বা আবু যার আমার দেহে মৃদু চাপ দিয়ে বলেনঃ এই সূরা কবে নাযিল হলো, আমি তো এখনই প্রথম সূরাটি শুনছি। তখন উবাই তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলেন। সালাত শেষ হলে তিনি(আবু যার বা আবু দারদা) বলেনঃ আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, সূরাটি কখন নাযিল হয়েছে, অথচ আপনি আমাকে কিছুই বললেননা! তখন উবাই বলেনঃ আপনি আজ আপনার সালাতের কোনোই সাওয়াব লাভ করেননি, শুধুমাত্র যে কথাটুকু বলেছেন সেটুকুই আপনার(কারণ খুতবার সময় কথা বললে সালাতের সাওয়াব নষ্ট হয়।) তখন তিনি রাসূলুল্লাহ(স) এর নিকট যেয়ে বিষয়টি বললেনঃ তিনি বলেন ‘উবাই সত্য বলেছে।।’(ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৩৫২-৩৫৩)
৩. আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস(রা) বলেনঃ আরবী(*******)
-আমাকে বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে তা অর্ধেক সালাত হবে। তখন আমি তাঁর নিকট গমন করলাম। আমি দেখলাম যে, তিনি বসে সালাত আদায় করছেন। তখন আমি তাঁর মাথার উপর আমার হাত রাখলাম। তিনি বললেনঃ হে আবদুল্লাহ ইবনু আমর, তোমার বিষয় কি? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে বলা হয়েছে যে, আপনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে তা অর্ধ সালাত হবে, আর আপনি বসে সালাত আদায় করছেন। তিনি বললেনঃ হ্যা, (আমি তা বলেছি), তবে আমি তোমাদের মত নই।(মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫০৭)।
এভাবে অনেক ঘটনায় আমরা হাদীসে দেখতে পাই যে, কারো বর্ণিত হাদীসের যথার্থতা বা নির্ভূলতার বিষয়ে সন্দেহ হলে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ(স) কে প্রশ্ন করে যথার্থতা যাচাই করতেন। তাঁরা বর্ণনাকারীর সততার বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেননা। মূলত তিনি বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝেছেন কিনা এবং নির্ভূলভাবে বর্ণনা করেছেন কিনা তা তাঁরা যাচাই করতেন। এভাবে তাঁরা হাদীসের নামে ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’ বা ভুলক্রমে বিকৃতি প্রতিরোধ করতেন।
১.৩.২.৩. অন্যদেরকে প্রশ্ন করা
সাক্ষ্য বা বক্তব্যের যথার্থতা নির্ণয়ের জন্য দ্বিতীয় পদ্ধতি বক্তব্যটি অন্য কেউ শুনেছেন কিনা এবং কিভাবে শুনেছেন তা খোঁজ করা। যে কোনো সাক্ষ্য বা বক্তব্যের নির্ভূলতা নির্ণয়ের জন্য তা সর্বজনীন পদ্ধতি। সকল বিচারালয়ে বিচারপতিগণ একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যের তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমেই রায় প্রদান করে থাকেন। একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যের মিল বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করে এবং অমিল প্রামাণ্যতা নষ্ট করে।
রাসূলুল্লাহ(স) এর ইন্তিকালের পর সাহাবীগণ এই পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। কোনো সাহাবীর বর্ণিত কোনো হাদীসের যথার্থতা বা নির্ভূলতা বিষয়ে তাঁদের কারো দ্বিধা হলে তাঁরা অনান্যা সাহাবীকে প্রশ্ন করতেন বা বর্ণনাকারীকে সাক্ষী আনতে বলতেন। যখন এক বা একাধিক ব্যক্তি বলতেন যে, তাঁরাও ঐ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) এর মুখ থেকে শুনেছেন, তখন তাঁরা হাদীসটি গ্রহণ করতেন। আবু বাকর সিদ্দীক(রা) এই পদ্ধতির শুরু করেন। পরবর্তী খলীফাগণ ও সকল যুগের মুহাদ্দিসগণ তা অনুসরণ করেন। এখানে সাহাবীগণের যুগের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
১. সাহাবী কাবীসাহ ইবনু যুআইব (৮৪ হি) বলেনঃ আরবী(*******)
-“এক দাদী আবু বাকর(রা) এর নিকট এসে মৃত পৌত্রের সম্পত্তিতে তার উত্তরাধিকার দাবী করেন। আবু বাকর(রা) তাকে বলেনঃ আল্লাহর কিতাবে আপনার জন্য(দাদীর উত্তরাধিকার বিষয়ে) কিছুই নেই। রাসূলুল্লাহ(স) এর সুন্নাতেও আপনার জন্য কিছু আছে বলে আমি জানিনা। আপনি পরে আসবেন, যেন আমি এ বিষয়ে অন্যদের প্রশ্ন করে জানতে পারি। তিনি এ বিষয়ে মানুষদের প্রশ্ন করেন। তখন সাহাবী মুগীরাহ ইবনু শু’বা(রা) বলেনঃ আমার উপস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ(স) দাদীকে (পরিত্যক্ত সম্পত্তির) এক ষষ্ঠাংশ প্রদান করেন। তখন আবু বাকর(রা) বলেনঃ আপনার সাথে কি অন্য কেউ আছেন? তখন অন্য সাহাবী মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ আনসারী(রা) উঠে দাঁড়ান এবং মুগীরার অনুরূপ কথা বলেন। তখন আবু বাকর সিদ্দীক(রা) দাদীর জন্য ১/৬ অংশ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।”[মালিক ইবনু আনাস (১৭৯ হি), আল মুআত্তা ২/৫১৩]।
এখানে আমরা দেখছি যে, আবু বাকর সিদ্দীক(রা)হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতার শিক্ষা দিলেন। মুগীরাহ ইবনে শু’বার একার বর্ণনার উপরই তিনি নির্ভর করতে পারতেন। কারণ তিনি প্রসিদ্ধ সাহাবী এবং কুরাইশ বংশের অত্যন্ত সম্মানিত নেতা ছিলেন। সমাজের যে কোনো পর্যায়ে তাঁর একার সাক্ষ্যই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবু বাকর(রা) সাবধানতা অবলম্বন করলেন। মুগীরার বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত হলেও তাঁর স্মৃতি বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে বা তাঁর অনুধাবনে ভুল হতে পারে। এজন্য তিনি দ্বিতীয় আর কেউ হাদীসটি জানেন কিনা প্রশ্ন করেন। দুজনের বিবরণের উপর নির্ভর করে তিনি হাদীসটি গ্রহণ করেন।
এজন্য মুহাদ্দিসগণ আবু বাকর(রা) কে হাদীস সমালোচনার জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লামা হাকিম নাইসাপূরী(৪০৫ হি) তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ “তিনিই সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। (মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল-আযামী, মানহাজুন নাকদ ইনদাল মুহাদ্দিসীন, পৃ ১০)।
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু তাহির ইবনুল কাইসুরানী(৫০৭ হি) সিদ্দীকে আকবারের জীবনী আলোচনাকালে বলেনঃ “তিনিই সর্বপ্রথম হাদীস গ্রহণ করার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করেন।”
২. দ্বিতীয় খলীফা উমার(রা) এ বিষয়ে তাঁর পূর্বসূরী সিদ্দীকে আকবরের অনুসরণ করেছেন। বিভিন্ন ঘটনায় তিনি সাহাবীগণকে বর্ণিত কোনো হাদীসের জন্য দ্বিতীয় কোনো সাহাবীকে সাক্ষী হিসেবে আনয়ন করতে বলতেন। এ জাতীয় কতিপয় ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।
আবু সাঈদ খুদরী(রা) বলেনঃ আরবী(*******)
-আমি আনসারদের এক মজলিসে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় আবু মূসা আশআরী(রা) সেখানে আগমন করেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি অস্থির বা উৎকন্ঠিত। তিনি বলেনঃ আমি উমার(রা) এর ঘরে প্রবেশের জন্য তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করি। অনুমতি না দেয়ায় আমি ফিরে আসছিলাম। উমার(রা) আমাকে ডেকে বলেনঃ আপনার ফিরে যাওয়ার কারণ কি? আমি বললামঃ আমি তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করি, কিন্তু অনুমতি জানানো হয়নি। আর রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যদি তোমরা তিনবার অনুমতি প্রার্থনা কর এবং অনুমতি না দেওয়া হয় তাহলে তোমরা ফিরে যাবে।” তখন উমার(রা) বলেনঃ আল্লাহর শপথ, এই বর্ণনার উপর আপনাকে অবশ্যই সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (আবু মূসা বলেন): আপনাদের মধ্যে কেউ কি এই হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) হতে শুনেছেন? তখন উবাই ইবনে কা’ব (রা) বলেনঃ আমাদের মধ্যে যার বয়স সবচেয়ে কম সেই আপনার সাথে যাবে। (আবু সাঈদ খুদরী বলেন) আমি উপস্থিতদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়স্ক ছিলাম। আমি আবু মুসার(রা) সাথে যেয়ে উমারকে(রা) বললাম যে, রাসূলুল্লাহ(সা) একথা বলেছেন।(বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩০৫; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৯৪)।
৩. তাবেয়ী উরওয়া ইবনুয যুবাইর(৯৪ হি) বলেনঃ আরবী(*****)
-উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) মানুষদের কাছে জানতে চান, আঘাতের ফলে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হলে তার দিয়াত বা ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ(স) কি বিধান দিয়েছেন তা কেউ জানে কিনা? তখন মুগীরাহ ইবনু শু’বা (রা) বলেন: আমি তাঁকে এ বিষয়ে একজন দাস বা দাসী প্রদানের বিধান প্রদান করতে শুনেছি। উমার(রা) বলেন: আপনার সাথে এ বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য কাউকে আনয়ন করুন। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ বলেন: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ(স) অনুরূপ বিধান দিয়েছেন।(বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৩১; মুসলিম, আস –সহীহ ৩/১৩১১)।
৪. সাহাবী আমর ইবনু উমাইয়াহ আদ-দামরী(রা) বলেনঃ আরবী(*****)
-তিনি একটি চাদর ক্রয়ের জন্য তা দাম করছিলেন। এমতাবস্থায় উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) তাঁর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। উমার বলেনঃ এটি কি? তিনি বলেনঃ আমি এই চাদরটি ক্রয় করে দান করতে চাই। এরপর তিনি তা ক্রয় করে তাঁর স্ত্রীকে প্রদান করেন এবং বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ(স) কে বলতে শুনেছিঃ ‘তোমরা স্ত্রীগণকে যা প্রদান করবে তাও দান বলে গণ্য হবে।’ তখন উমার বলেন: আপনার সাথে সাক্ষী কে আছে? তখন তিনি আয়েশা(রা) এর নিকট গমন করেন এবং দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। আয়েশা(রা) বলেনঃ কে? তিনি বলেনঃ আমি আমর। আপনি কি শুনেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ তোমরা স্ত্রীগণকে যা প্রদান করবে তাই দান? আয়েশা বলেনঃ হ্যাঁ। [বাইহাকী, আহমদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি)]
৫. ওয়ালীদ ইবনু আবদুর রাহমান আল-জুরাশী নামক তাবিয়ী বলেনঃ আরবী(*********)
“সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উমার(রা) অন্য সাহাবী আবু হুরায়রা(রা) এর নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। সে সময় আবু হুরায়রা(রা) রাসূলুল্লাহ(স) হতে হাদীস বর্ণনা করছিলেন। হাদীস বর্ণনার মধ্যে তিনি বলেনঃ ‘কেউ যদি কারো জানাযার অনুগমন করে এবং সালাতে অংশগ্রহণ করে তবে সে এক কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে। আর যদি সে তার দাফনে উপস্থিত থাকে তাহলে সে দুই কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে। এক কীরাত ওহুদ পাহাড়ের চেয়েও বড়।’ তখন আবদুল্লাহ ইবনু উমার বলেনঃ আবু হুরাইরা আপনি ভেবে দেখুনতো আপনি রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কি বলছেন। তখন আবু হুরাইরা(রা)তাকে সাথে নিয়ে আয়েশা(রা) এর নিকট গমন করেন এবং তাঁকে বলেনঃ হে উম্মুল মুমিনীন, আমি আপনাকে আল্লাহর নামে কসম করে জিজ্ঞাসা করছি, আপনি কি রাসূলুল্লাহ(স) কে বলতে শুনেছেন যে, ‘কেউ যদি কারো জানাযার অনুগমন করে ও সালাতে অংশগ্রহণ করে তবে সে এক কীরাত সাওয়াব অর্জন করে। আর যদি সে তার দাফনে উপস্থিত থাকে তাহলে দুই কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে।’ তিনি বলেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই শুনেছি।”(আহমদ, আল-মুসনাদ ২/২, আল মুসতাদরাক ৩/৫৮৪)।
১.৩.২.৪. বিভিন্ন সময়ের বর্ণনার মধ্যে তুলনা করা
কোনো সাক্ষ্য বা বক্তব্যের নির্ভূলতা নির্ণয়ের জন্য অন্য একটি পদ্ধতি হলো তাকে একই বিষয়ে একাধিক সময়ে প্রশ্ন করা। যদি দ্বিতীয়বারের উত্তর প্রথমবারের সাথে হুবহু মিলে যায় তাহলে তবে তার নির্ভূলতা প্রমাণিত হয়। আর উভয়ের বৈপরীত্য অগ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে। সাহাবীগণ হাদীসের নির্ভূলতা নির্ণয়ে এ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। একটি উদাহরণ দেখুন।
তাবিয়ী উরওয়া ইবনু যুবাইর বলেনঃ আরবী(******)
-“আমার খালাম্মা আয়েশা(রা) আমাকে বলেনঃ ভাগ্নে, শুনেছি সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস(রা) আমাদের এলাকা দিয়ে হজ্জে গমন করবেন। তমি তাঁর সাথে দেখা কর এবং তার থেকে প্রশ্ন করে শিখ। কারণ তিনি রাসূলুল্লাহ(স) হতে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন। উরওয়া বলেনঃ আমি তখন তাঁর সাথে সাক্ষাত করি এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করি। তিনি সে সব বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(স) থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি যে সকল কথা বলেন, তার মধ্যে তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ মানুষ থেকে জ্ঞান ছিনিয়ে নেবেননা। কিন্তু তিনি জ্ঞানীদের কব্জা করবেন(মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের গ্রহণ করবেন), ফলে তাদের সাথে জ্ঞানও উঠে যাবে। মানুষের মধ্যে মূর্খ নেতৃবৃন্দ অবশিষ্ট থাকবে, যারা ইলম ছাড়াই ফতওয়া প্রদান করবে এবং এভাবে নিজেরা বিভ্রান্ত হবে এবং অন্যদেরও বিভ্রান্ত করবে।” উরওয়া বলেনঃ আমি যখন আয়েশাকে(রা) একথা বললাম তখন তিনি তা গ্রহণ করতে আপত্তি করলেন। তিনি বলেন: তিনি কি তোমাকে একথা বলেছেন যে, একথা তিনি রাসূলুল্লাহ(স) হতে শুনেছেন? উরওয়া বলেনঃ পরের বছর আয়েশা(রা) আমাকে বলেন: আবদুল্লাহ ইবনু আমর আগমন করেছেন। তুমি তাঁর সাথে আগমন করে তাঁর সাথে কথাবার্তা বল। কথার ফাঁকে ইলম উঠে যাওয়ার হাদীসটির বিষয়েও কথাও বলবে। উরওয়া বলেনঃ আমি তখন তাঁর সাথে সাক্ষাত করি এবং তাঁকে প্রশ্ন করি। তিনি তখন আগেরবার যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই হাদীসটি বললেন। উরওয়া বলেনঃ আমি যখন আয়েশা(রা)কে বিষয়টি জানালাম তখন তিনি বলেনঃ আমি বুঝতে পারলাম যে, আবদুল্লাহ ইবনু আমর ঠিকই বলেছেন। আমি দেখেছি যে, তিনি একটুও বাড়িয়ে বলেননি বা কমিয়ে বলেননি।(মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৫৮-২০৫৯)।
এখানেও আমরা হাদীষ গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহাবীগণের অকল্পনীয় সাবধানতার নমুনা দেখতে পাই। আয়েশা(রা) আবদুল্লাহ ইবনু আমরের সততা বা সত্যবাদিতায় সন্দেহ করেননি। কিন্তু সৎ ও সত্যবাদী ব্যক্তিরও ভুল হতে পারে। কাজেই বিনা নিরীক্ষায় তাঁরা কিছুই গ্রহণ করতে চাইতেননা। রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত কোনো হাদীস তারা নিরীক্ষার আগেই ভক্তিভরে হৃদয়ে স্থান দিতেননা।
১.৩.২.৫. বর্ণনাকারীকে শপথ করানো
বর্ণনা বা সাক্ষ্যের নির্ভূলতা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনে বর্ণনাকারী বা সাক্ষীকে শপথ করানো হয়। সত্যপরায়ণ ও আল্লাহভীরু মানুষ ইচ্ছাকৃত মিথ্যা কথা বলেননা। তবে তাঁর স্মৃতি তাঁকে ধোঁকা দিতে পারে বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের মধ্যে তিনি নিপতিত হতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর নামে শপথ করতে হলে তিনি কখনো পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলবেননা। এজন্য সত্যপরায়ণ ব্যক্তির জন্য শপথ করানো সাক্ষ্য বা বক্তব্যের নির্ভূলতা যাচাইয়ের জন্য কার্য্কর পদ্ধতি। তবে মিথ্যাবাদীর জন্য শপথ যথেষ্ট নয়। তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশ্ন (cross interrogation) এর মাধ্যমে তার বক্তব্যের যথার্থতা যাচাই করতে হয়।
সাহাবীগণ সকলেই ছিলেন সত্যপরায়ণ অত্যন্ত আল্লাহভীরু মানুষ। তা সত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃত ভুলের সম্ভাবনা দূর করার জন্য সাহাবীগণ কখনো হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীকে শপথ করাতেন। আলী(রা) বলেনঃ আরবী(*****)
-আমি এমন একজন মানুষ ছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ(স)থেকে কোনো কথা নিজে শুনলে আল্লাহ আমাকে তা থেকে তাঁর মর্জিমত উপকৃত হতে তাওফীক প্রদান করতেন। আর যদি তাঁর কোনো সাহাবী আমাকে কোনো হাদীস শুনাতেন তবে আমি তাকে শপথ করাতাম। তিনি শপথ করলে আমি তার বর্ণিত হাদীস সত্য বলে গ্রহণ করতাম।(তিরমিযী, আস-সুনান ১/৪৪৬)।
১.৩.২.৬. অর্থ ও তথ্যগত নিরীক্ষা
‘ওহী’র জ্ঞান মানবীয় জ্ঞানের অতিরিক্ত, কিন্তু কখনোই মানবীয় জ্ঞানের বিপরীত বা বিরুদ্ধ নয়। অনুরূপভাবে হাদীসের মাধ্যমে প্রাপ্ত ‘ওহী’ কুরআনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ‘ওহী’র ব্যাখ্যা, সম্পূরণ বা অতিরিক্ত সংযোজন হতে পারে, কিন্তু কখনোই তা কুরআনের বিপরীত বা বিরুদ্ধ হতে পারেনা।
সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা এই মূলনীতির ভিত্তিতে বর্ণিত হাদীসের অর্থগত নিরীক্ষা করতেন। আমরা দেখেছি যে, সাধারণভাবে তাঁরা কুরআনের অতিরিক্ত ও সম্পূরক অর্থের জন্যেই হাদীসের সন্ধান করতেন। কুরআন কারীমে যে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই তা হাদীসে আছে কিনা তা জানতে চাইতেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রদত্ত তথ্যের অর্থগত নিরীক্ষা করতেন। তাঁদের অর্থ নিরীক্ষা পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপঃ
(১) হাদীসের ক্ষেত্রে প্র্রথম বিবেচ্য বিষয় হলো, তা রাসূলুল্লাহ(স) এ কথা বলে প্রমাণিত কিনা। যদি বর্ণনাকারীর বর্ণনা, শপথ বা অন্যান্য সাক্ষ্যের মাধ্যমে নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, তবে সেক্ষেত্রে তাঁদের নীতি ছিল তাকে কুরআনের সম্পূরক নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করা এবং তারই আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। ইতোপূর্বে দাদীর উত্তরাধিকার ও গৃহে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা বিষয়ে আমরা তা দেখতে পেয়েছি। দাদীর বিষয়ে কুরআনে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে হাদীসের বিবরণটি অতিরিক্ত সংযোজন। অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে কুরআনে বলা হয়েছে যে, অনুমতি চাওয়ার পরে “যদি তোমাদেরকে বলা হয় যে, ‘তোমরা ফিরে যাও’ তবে তোমরা ফিরে যাবে।”(সূরা নূরঃ২৮)।
এক্ষেত্রে হাদীসের নির্দেশনাটি বাহ্যত এই কুরআনী নির্দেশনার ‘বিরুদ্ধ’। কারণ তা কুরআনী নির্দেশনাকে আংশিক পরিবর্তন করে বলছে যে, তিন বার অনুমতি প্রার্থনার পরে ‘তোমরা ফিরে যাও’ বলা না হলেও ফিরে যেতে হবে।
সাহাবীগণ উভয় হাদীসকে কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
(২) কোনো কথা রাসূলুল্লাহ(স) বলেননি বলে প্রমাণিত হলে বা গভীর সন্দেহ হলে, কোনোরূপ অর্থ বিবেচনা না করেই তা প্রত্যাখ্যান করতেন। আমরা দেখেছি যে, বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততায় ও নির্ভরযোগ্যতায় সন্দেহ হলে তাঁরা কোনোরূপ অর্থ বিবেচনা ছাড়াই সেই বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করতেন।
(৩) কখনো কখনো দেখা গিয়েছে যে, বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততার কারণে বর্ণিত হাদীস বাহ্যত গ্রহণযোগ্য। তবে বর্ণনাকারীর অনিচ্ছাকৃত ভুলের জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে তাঁরা সেই হাদীসের অর্থ কুরআনে কারীম ও তাঁদের জানা হাদীসের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন এবং হাদীসটির অর্থ কুরআনে কারীম ও প্রসিদ্ধ সুন্নাতের সুস্পষ্ট বিপরীত হলে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এইরূপ অর্থ বিচার ও নিরীক্ষার কয়েকটি উদাহরণ দেখুনঃ
১. আবু আসসান আল আরাজ নামক তাবিয়ী বলেনঃ আরবী(****)
-দুই ব্যক্তি আয়েশা(রা) এর নিকট গমন করে বলেনঃ আবু হুরাইরা(রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন: নারী, পশু বা বাহন ও বাড়ি ঘরের মধ্যে অযাত্রা ও অশুভত্ব আছে। একথা শুনে আয়েশা(রা) এত বেশি রাগাণ্বিত হন যে, মনে হলো তাঁর দেহ ক্রোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বলেনঃ যিনি কুরআন নাযিল করেছেন তাঁর কসম, তিনি এভাবে বলতেননা। রাসূলুল্লাহ(স)বলতেনঃ “জাহিলিয়্যাতের যুগের মানুষেরা বলতঃ নারী, বাড়ি ও পশু বা বাহনে অশুভত্ব আছে।” এরপর আয়েশা(রা) কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করেনঃ (সূরা আল হাদীসঃ ২২)।“পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্য্য় আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বেই তা লিপিবদ্ধ থাকে।” (আহমদ, আল মুসনাদ ৬/১৫০, ২৪৬)।
এখানে আয়েশা(রা) আবু হুরাইরা(রা) এর বর্ণনা গ্রহণ করেননি। তিনি রাসূলুল্লাহ(স) হতে যা শুনেছেন এবং কুরআনের যে আয়াত পাঠ করেছেন তার আলোকে এই বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
২. উমরাহ বিনতে আবদুর রাহমান বলেনঃ আরবী(*******)
-‘আয়েশা(রা) এর নিকট উল্লেখ করা হয় যে, আবদুল্লাহ ইবনু উমার(রা) রাসূলুল্লাহ(স) হতে বর্ণনা করেছেন যে, ‘জীবিতের ক্রন্দনে মৃতব্যক্তি শাস্তি পায়।’ তখন আয়েশা(রা) বলেনঃ আল্লাহ ইবনু উমারকে ক্ষমা করুন। তিনি মিথ্যা বলেননি। তবে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন বা ভুল করেছেন(দ্বিতীয় বর্ণনায়ঃ শুনতে অনেক সময় ভুল হয়)। প্রকৃত কথা হলো, রাসূলুল্লাহ(স) এক ইহুদী মহিলার(কবরের) নিকট দিয়ে গমন করেন, যার জন্য তার পরিজনেরা ক্রন্দন করছিল। তিনি তখন বলেনঃ‘এরা তার জন্য ক্রন্দন করছে এবং সে তার কবরে শাস্তি পাচ্ছে।’ আল্লাহ বলেছেনঃ (সূরা আল আনআমঃ ১৬৪, সূরা ফাতির ১৮)। ‘এক আত্মা অন্য আত্মার পাপের বোঝা বহন করবেনা।’’’(মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৪০-৬৪৩)।
৩. ফাতিমা বিনতে কাইস(রা) নামক একজন মহিলা সাহাবী বলেন, তাঁর স্বামী তাঁকে তিন তালাক প্রদান করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ(স) বলেন যে, তিনি(ঐ মহিলা) ইদ্দতকালীন আবাসন ও ভরণপোষণের খরচ পাবেননা। তাঁর এই কথা শুনে খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) বলেনঃ আমরা আল্লাহর গ্রন্থ ও রাসূলে কারীম(স) এর সুন্নাত একজন মহিলার কথায় ছেড়ে দিতে পারিনা। কারণ আমরা বুঝতে পারছিনা যে, তিনি বিষয়টি মুখস্ত রেখেছেন না ভুলে গিয়েছেন। তিন তালাক প্রাপ্তা মহিলাও ইদ্দতকালীন আবাসন ও খোরপোশ পাবেন। মহিমাময় পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেনঃ(সূরা আত তালাকঃ১) তোমরা তাদেরকে তাদের বাসগৃহ হতে বহিষ্কার করোনা এবং তারাও যেন বের না হয়, যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়।”(মুসলিম, আস-সহীহ ২/১১১৮, আস-সুনান ২/২৯৭)।
১.৩.৩. ইচ্ছাকৃত মিথ্যার সম্ভাবনা রোধ করা
সাহাবীগণের যুগের প্রথম দিকে সাহাবীগণই হাদীস বর্ণনা করতেন। এক সাহাবী অন্য সাহাবীকে অথবা পরবর্তী প্রজন্ম তাবিয়ীগণকে হাদীস শুনাতেন ও শিক্ষা দিতেন। রাসূলুল্লাহ(স) এর ইন্তেকালের ২০/২৫ বছরের মধ্যে একদিকে যেমন অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেন, তেমনি অনেক সাহাবী হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষাদান শুরু করেন। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, এ সময় থেকে কোনো কোনো নও মুসলিম তাবেয়ীর মধ্যে ইচ্ছাকৃত মিথ্যার প্রবণতা দেখা দেয়। তখন সাহাবীগণ হাদীস গ্রহণের বিষয়ে আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে থাকেন।
এক সাহাবী অন্য সাহাবী হতে হাদীস বর্ণনা করলে শ্রোতা বা শিক্ষার্থী সাহাবী বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সততা ও সত্যপরায়ণতায় কোনোরূপ সন্দেহ করতেননা বা তিনি নিজ কর্ণে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) হতে শুনেছেন বা অন্য কেউ তাকে বলেছেন সে বিষয়েও প্রশ্ন করতেননা। রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহচর্য্ প্রাপ্ত সকল মানুষই ছিলেন তাঁরই আলোয় আলোকিত মহান মানুষ ও সত্যবাদিতায় আপোষহীন। তবে বিস্মৃতি, অনিচ্ছাকৃত ভুল বা হৃদয়ঙ্গমের অপূর্ণতা জনিত ভুল হতে পারে বিধায় উপরোক্ত বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাঁরা বর্ণিত হাদীসের নির্ভূলতা যাচাই করতেন।
তাবিয়ী বর্ণনাকারীদের হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা উপরোক্ত নিরীক্ষার পাশাপাশি দুইটি অতিরিক্ত বিষয় যোগ করেন। প্রথমত, তাঁরা বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সত্যপরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার বিষয়ে অনুসন্ধান করতেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁরা বর্ণনাকারী কার নিকট হতে হাদীসটি শুনেছেন তা(Reference)জানতে চাইতেন।
তৃতীয় খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওসমানের(রা)খেলাফত যুগে(২৩-৩৫ হি) মদীনার কেন্দ্র হতে দূরে অবস্থিত নও-মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভ্রান্তি ও হানাহানি ঘটে এবং নও-মুসলিমদের মধ্যে সত্যপরায়ণতার কমতি দেখা দেয়। তখন হতেই সাহাবীগণ উপরোক্ত দুইটি পদ্ধতি গ্রহণ করেন। প্রথম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন(১১০ হি) বলেনঃ “তাঁরা(সাহাবীগণ) সনদ বা তথ্যসূত্র সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতেননা। যখন(উসমানের খেলাফতের শেষ দিকে,৩০-৩৫ হি) ফিতনা-ফাসাদ ঘটে গেল তখন তাঁরা বললেনঃ তোমাদেরকে যারা হাদীস বলেছেন তাঁদের নাম উল্লেখ কর। কারণ দেখতে হবে, তারা যদি আহলুস সুন্নাত বা সুন্নাত পন্থীগণের অন্তর্ভূক্ত হন তাহলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে। আর তারা যদি আহলুল বিদ‘আত বা বিদ‘আত পন্থী গণের অন্তর্ভূক্ত হন তাহলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবেনা। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫)।
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস(রা) (৬৮ হি) বলেনঃ “আমরা তো হাদীস মুখস্ত করতাম এবং রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস (যে কোনো বর্ণনাকারী হতে) মুখস্ত করা হতো। কিন্তু তোমরা যেহেতু খানা খন্দক ও ভাল মন্দ সব পথেই চলে গেলে সেহেতু এখন(বর্ণনাকারীর বিচার নিরীক্ষা ছাড়া) কোনো কিছু গ্রহণ করার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।
তাবিয়ী মুজাহিদ (১০৪ হি) বলেনঃ “বাশীর ইবনু কা’ব আল-আদাবী নামক একজন প্রাচীন তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাসের(রা) নিকট আগমন করেন এবং হাদীস বলতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন। কিন্তু ইবনু আব্বাস তার দিকে কর্ণপাত ও দৃষ্টিপাত করলেননা। তখন বাশীর বলেনঃ হে ইবনু আববাস, আমার কি হলো! আপনি আমার হাদীস শুনেছেন কি? আমি আপনাকে রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস বর্ণনা করছি অথচ আপনি কর্ণপাত করছেননা। তখন ইবনু আব্বাস(রা) বলেনঃ একসময় ছিল যখন আমরা কাউকে বলতে শুনতাম ‘রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন’ তখনই আমাদের দৃষ্টিগুলি তার প্রতি আবদ্ধ হয়ে যেত এবং আমরা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার প্রতি কর্ণপাত করতাম। কিন্তু যখন মানুষ খানাখন্দক ভাল মন্দ সব পথেই চলে গেল তখন থেকে আমরা আর মানুষদের থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করিনা, শুধুমাত্র সুপরিচিত ও পরিজ্ঞাত বিষয় ব্যতিরেকে। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩)।
১.৩.৪. হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণে সতর্কতার নির্দেশ
এভাবে সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। পাশাপাশি তাঁরা অন্য সবাইকে এমন সতর্কতা অবলম্বন করতে উৎসাহ ও নির্দেশ প্রদান করতেন। এক্ষেত্রে কোনোরূপ অবহেলা বা ঢিলেমি তাঁরা সহ্য করতেননা। তাঁরা বিনা যাচাইয়ে হাদীস গ্রহণ করতে নিষেধ করতেন। অনেক সময় কারো হাদীস বর্ণনায় অনিচ্ছাকৃত ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে বা শ্রোতাদের মধ্যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তাঁকে হাদীস বলতে নিষেধ করতেন। এখানে কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করছি।
১. আবু উসমান আন-নাহদী বলেন, উমর ইবনুল খাত্তাব(রা) বলেনঃ ‘‘একজন মানুষের মিথ্যা বলার জন্য এই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে সবই বর্ণনা করবে।’’ (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১১)।
২. আবুল আহওয়াস বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ(রা) বলেনঃ ‘‘একজন মানুষের মিথ্যা বলার জন্য এই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে সবই বর্ণনা করবে।’’ (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১১)।
৩. সাহাবী আবদুর রাহমান ইবনু আউফ(রা) এর পুত্র মদীনার প্রখ্যাত আলিম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবরাহীম ইবনু আবদুর রাহমান(৯৫ হি) বলেনঃ “উমার ইবনুল খাত্তাব(রা), আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ(রা), আবু দারদা(রা), আবু মাসঊদ(রা) কে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁদেরকে বলেনঃ আপনারা রাসূলুল্লাহ(স) থেকে এত বেশি হাদীস বলছেন কেন? এরপর তিনি তাঁদেরকে মদীনাতেই অবস্থানের নির্দেশ দেন। তাঁর শাহাদাত পর্য্ন্ত তাঁরা মদীনাতেই ছিলেন।(তাবারানী, আল-মুজা’মুল আউসাত ৪/৮৬, নং ৩৪৪৯)।
এই তিনজন সাহাবী হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। উমার ইবনে খাত্তাব(রা) তাঁদের নির্ভূল হাদীস বলার ক্ষমতা বা যোগ্যতার বিষয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ করেননি। কিন্তু বেশি হাদীস বললে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে পারে। বিশেষত, কূফা বা সিরিয়ার মত প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে ইসলামী বিজয়ের সেই প্রথম দিনগুলিতে অধিকাংশ নও মুসলিম অনারব বসবাস করতেন, তাদের মধ্যে বেশি হাদীস বর্ণনা করলে অনেক শ্রোতা তা সঠিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম ও মুখস্ত করতে পারবেননা বলে আশঙ্কা থাকে। এজন্য হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য উমার ইবনুল খাত্তাব তাঁদেরকে মদীনায় অবস্থানের নির্দেশ প্রদান করেন।
অন্য ঘটনায় আমরা দেখতে পাই যে, উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) নিজে কুরআন ও হাদীসের কিছু বিষয় হজ্জ মওসূমে মক্কায় জনসম্মুখে আলোচনা করতে চান। কিন্তু সাহাবী আবদুর রাহমান ইবনু আউফ(রা) তাঁকে বলেন যে, মক্কায় উপস্থিত অগণিত অনারব ও নও মুসলিম হজ্জ পালনকারী হয়ত আপনার কথা ঠিকমত বুঝতে পারবেননা। এতে ভুল বুঝা ও অপব্যাখ্যার সুযোগ এসে যাবে। কাজেই আপনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার পর বিষয়গুলি আলোচনা করবেন। উমার(রা) এই পরামর্শ অনুসারে মক্কায় বিষয়গুলি আলোচনার সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেন।(বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫০৩-২৫০৪)।