২.৫. আহলু বাইত, সাহাবী ও উম্মাত সম্পর্কে
রাসূলুল্লাহ(সা) এর সুমহান মর্যাদার স্বাভাবিক দাবী যে, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাথী সহচরগণের মর্যাদা ও সম্মান হবে নবীগণের পরে বিশ্বের সকল যুগের সকল মানুষের উর্ধে্ব। কুরআন ও হাদীসে যদি তাঁদের বিষয়ে উল্লেখ নাও থাকত, তবুও তাঁদের মহোত্তম মর্যাদার বিষয়ে যেকোনো জ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষ সহজেই অনুধাবন করতে পারতেন।
এই স্বাভাবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে এবং তাঁদের মহিমা, মর্যাদা ও সম্মান বর্ণনা করেছেন কুরআন কারীমের অনেক আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ(সা) এর অগণিত বাণী। এসকল আয়াত ও হাদীসের বিস্তারিত আলোচনার জন্য পৃথক পুস্তক প্রয়োজন। এসবের সারকথা হলো, রাসুলুল্লাহ(সা) এর পরিজনকে এবং সাহাবীগণকে ভালবাসা ও সম্মান করা মানে তাঁকে ভালবাসা ও সম্মান করা এবং ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কুরআন ও হাদীসের এসকল মহান বাণী, সহজ ও হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা অনেক মুর্খ ভক্তের হৃদয়কে তৃপ্ত করতে পারেন নি। তৃপ্ত করতে পারে নি অতিভক্তির ভন্ডামিতে লিপ্ত অগণিত মানুষকে। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আজগুবি ও অবাস্তব কথা বানিয়েছে তাঁরা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে। এভাবে তারা তাঁর নামে মিথ্যা বলার জঘন্যতম পাপ করার সাথে সাথে ইসলামের বুদ্ধিভিত্তিক আবেদনকে কলুষিত করেছে। মুমিনের ঈমান ও জ্ঞানীর অনুভবকে অপবিত্র করেছে। নিচে এই জাতীয় মিথ্যা, বানোয়াট ও অনির্ভরযোগ্য কিছু কথা উল্লেখ করছি।
১. পাক পাঞ্জাতন
আহলু বাইতের মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর সাথে আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন(রা) কে একত্রিত করে পাঁচজনের বিশেষ মর্যাদা জ্ঞাপক অনেক বানোয়াট ও মিথ্যা কথা “পাক পাঞ্জাতন” নামে প্রচলিত আছে। “পাক পাঞ্জাতন” বিষয়ক সকল কথা বানোয়াট ও জঘন্য মিথ্যা কথা।
হযরত আলী ও ফাতিমা(রা) এর কথাকে কেন্দ্র করে মূর্খরা অনেক বানোয়াট, আজগুবি ও মিথ্যা কথা রটনা করেছে। যেমনঃ হযরত ফাতিমা (রা) একদিন একটি পাখির গোশত খেতে চান। হযরত আলী(রা) অনেক চেষ্টা করেও পাখিটি ধরতে পারেন নি।.……। জঘন্য মিথ্যা কথা এসব।
২. বিষাদ সিন্ধু ও অন্যান্য প্রচলিত পুঁথি ও বই
বিষাদ সিন্ধু বইয়ের ৯৫% কথা মিথ্যা। বিষাদ সিন্ধু একটি উপন্যাস, কোনো ইতিহাস বা ধর্মীয় পুস্তক নয়। উপন্যাস হিসেবে এর মূল্যায়ন হবে। কিন্তু দুঃখজনক কথা হলো, সমাজের সাধারণ মানুষেরা এই ধরনের বইয়ের কথা সত্য বলে বিশ্বাস করে। বিশেষত রাসূলুল্লাহ(সা) কে জড়িয়ে যে সকল মিথ্যা কথা বলা হয়েছে সে বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা দরকার। হযরত মুআবিয়াকে(রা) ভবিষ্যদ্বাণী করা, মুহাম্মাদ হানুফার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা, হযরত হুসাইনের গলায় বারংবার ছুরির আঘাতে ক্ষত না হওয়া……..তাঁর হত্যাকারীর বেহেশতে নেওয়া ইত্যাদি সকল কথা বানোয়াট। মুহাম্মাদ হানুফা(মুহাম্মাদ ইবনু আলী, ইবনুল হানাফিয়্যাহ) বিষয়ক, ইয়াযিদের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ, তাঁর পাহাড়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকা ইত্যাদি কথা সবই মিথ্যা।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, বিষাদ সিন্ধু জাতীয় পুস্তাকাদি, পুঁথি সাহিত্য ও খাইরুল হাশর জাতীয় পুস্তকগুলিই আমাদের সমাজে মিথ্যা ও জাল হাদীস প্রচারের অন্যতম কারণ। এর পাশাপাশি রয়েছে ‘বার চাঁদের ফযীলত’, ‘নেক আমল’, ‘মকছুদুল মুমিনীন’, ‘নিয়ামুল কুরআন’, ‘নাফউল খালায়েক জাতীয় পুস্তক। সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ইসলামী শিক্ষার প্রসারে এ সকল পুঁথি পুস্তকের অবদান অনস্বীকার্য্। এ সকল পুস্তকের সম্মানিত লেখকগণ তাঁদের যুগের ও সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকে সাধ্যমত দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কল্যাণময় খেদমতের পাশাপাশি জাল হাদীস, ভিত্তিহীন কথাবার্তা, বিভিন্ন প্রকারের কুসংস্কার ও ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণার প্রসারেও এগুলি অবদান রেখেছে।
একসময় বাংলার যোগ্য আলিমগণ বাংলা ভাষায় পুস্তকাদি রচনা ‘দূষণীয়’ বলে গণ্য করতেন। এই ধ্বংসাত্মক বিভ্রান্তিই অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য আলিমদের ভুলভ্রান্তিপূর্ণ পুস্তক রচনার সুযোগ করে দেয়।
৩. ফাতিমা(রা) এর শরীর টেপার জন্য বাঁদী চাওয়া
এখানে অনুবাদের বিকৃতি ও মিথ্যার একটি নুমনা উল্লেখ করছি। প্রচলিত একটি পুস্তকে উল্লেখ লিখিত হয়েছে, “হাদীস শরীফে উল্লেখ আছেঃ একদিন বিবি ফাতিমা(রা) রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট আসিয়া আরজ করিলেন, হে পিতা! আমাকে সমস্ত দিনই আটা পিষায় ও গৃহস্থালী কাজে নিয়োগ থাকিতে হয়। তাই আমার শরীরটা বেদনা ও দরদযুক্ত হইয়া যায়। অতএব আমাকে একটি বাঁদী ক্রয় করিয়া দিন যাতে সে আমার শরীরটা টিপিয়া দিতে ও গৃহকার্যে্ আমাকে সহায়তা করিতে পারে। তদুত্তরে হুজুর(সা) বলিলেন, হে মাতা! স্ত্রী লোকের পক্ষে আপন স্বামীর ও পরিবার পোষনের জন্য আটা পিষা গৃহ কার্যে্ আঞ্জাম করার ন্যায় পূণ্য কাজ আর কিছু্ই নাই। কিন্তু বাদী বা চাকরানীর সাহায্য নিলে ততদূর সাওয়াবের ভাগী হইতে পারিবে না। অতএব আমার উপদেশ মানিয়া সর্বদা নিম্নলিখিত দোয়া পাঠ করিতে থাক, নিশ্চয়ই তোমার শরীরের বেদনা দূর হইয়া যাইবে এবং শরীর সর্বদা সবল ও সুস্থ থাকিবে। আর অতিরিক্ত সাওয়াবও পাইবে। তখন হইতে বিবি ফাতিমা তাহাই করিতেন। দোওয়াঃ….. সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।”(মো. গোলাম রহমান, কাজী মাওলানা, মকছুদুল মো’মিনীন পৃ. ৫৫-৫৬)।
একটি সহীহ হাদীসের মনগড়া অনুবাদ করে এখানে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে অনেক মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু ফাতিমা(রা) এর জন্য অবমাননাকর কথাবার্তা বলা হয়েছে। মূল হাদীসটি বুখারী, মুসলিম ও অন্য সকল মুহাদ্দিস কাছাকাছি শব্দে সংকলন করেছেন। হাদীসটি নিম্নরূপঃ
“আলী (রা) বলেন যাঁতা চালানোর কারণে তাঁর হাতে কি কষ্ট হয় তা জানাতে ফাতিমা(আ) নবীজী(সা) এর নিকট গমন করেন। ফাতিমা শুনেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট কিছু যুদ্ধবন্দী দাস-দাসী এসেছে। তিনি রাসূলুল্লাহ(সা) এর বাড়িতে যেয়ে তাঁকে পান নি। তখন তিনি আয়েশা(রা)কে বিষয়টি জানান। যখন রাসূলুল্লাহ(সা) ঘরে আসেন তখন আয়েশা(রা) তাঁকে বিষয়টি জানান। আলী বলেন, আমরা রাতে বিছানায় শুয়ে পড়ার পর তিনি আমাদের নিকট আগমন করলেন। তখন আমরা উঠতে গেলাম। তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের জায়গাতেই থাক। তিনি এসে আমার ও ফাতিমার মধ্যখানে বসলেন। এমনকি আমি আমার পেটের উপর তাঁর পদযুগলের শীতলতা অনুভব করলাম। তিনি আমাদেরকে বললেন, তোমরা যা চাচ্ছ তার চেয়েও উত্তম বিষয় কি তোমাদের শিখিয়ে দেব না? তোমরা যখন তোমাদের বিছানায় শুয়ে পড়বে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। এই আমলটি তোমাদের জন্য দাসীর চেয়েও উত্তম। আলী বলেন, এরপর আমি কখনোই এই আমলটি ত্যাগ করি নি।”
এই হলো মূল ঘটনা, যা বুখারী ও মুসলিম সহ সকল মুহাদ্দিস বিভিন্ন সহীহ সনদে সংকলিত করেছেন। অথচ উপরের অনুবাদে সব কিছু বিকৃত করা হয়েছে এবং অনেক মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলা হয়েছে।(সহীহ বুখারী ৩/১১৩৩, ৩/১৩৫৮, ৫/২০৫১, সহীহ মুসলিম ৪/২০৯১, ফাতহুল বারী ১১/১২০)।
৪. আবূ বাকর(রা) এর খেজুর পাতা পরিধান
প্রচলিত একটি পুস্তক হতে একটি ভিত্তিহীন কাহিনী উল্লেখ করছি। “ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে হযরত আবু বাকর(রা)একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। যেদিন হযরত মুহাম্মাদ(সা) এর খেদমতে আসিয়া ইসলামে দীক্ষিত হইলেন সেইদিন হইতেই তাঁহার যাবতীয় সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করিতে লাগিলেন। ……একদিন পরনের কাপড়ের অভাবে মসজিদে নামায পড়িতে যাইতে কিঞ্চিত দেরী হইয়াছিল। দেখিয়া হযরত মুহাম্মাদ(সা) বলিলেন, আবূ বাকর(রা), আমি জীবিত থাকিতেই ইসলামের প্রতি আপনাদের এত অবহেলা হইতেছে, আমি অভাবে আরও কত কি হয় বলা যায় না।…..তিনি বলিলেন, হুযুর আমার অবহেলার কিছুই নহে। বাস্তবিক আমার পরনে কাপড় ছিল না, সেই হেতু আমি ছোট একখানা কাপড়ের সহিত বালিশের কাপড় ছিঁড়িয়া খেজুর পাতা ও কাঁটা দ্বারা সেলাই করতঃ ধুইয়া ও শুকাইয়া পরিয়া আসিতে এত গৌণ হইয়াছে……..। ইহার কিছুক্ষণ পরে জীব্রাঈল সম্পূর্ণ খেজুর পাতার পোষাক পরিয়া হযরতের সম্মুখে হাজির হইলেন……। হযরত মুহাম্মাদ(সা)তাহাকে জিজ্ঞেস করিলেন, …….আজকে খেজুর পাতার পোষাক দেখিতেছি কেন? তদুত্তরে জীব্রাঈল(আ) বলিলেন, হযরত আবূ বাকর(রা) খেজুর পাতার সেলাই করা কাপড়ে নামায পড়িতে আসিয়াছিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা সমস্ত ফেরেশতাগণকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ হে ফেরেশতাগণ, আবূ বাকর আমার সন্তোষ লাভের জন্য কতইনা কষ্ট স্বীকার করিতেছেন। অতএব তোমরা যদি আজ অমার সন্তোষ চাও তবে এখনই আবূ বাকরের সম্মানার্থে সকলেই খেজুর পত্রের পোষাক পরিধান কর। নচেৎ আজই আমার দপ্তর হতে সমস্ত ফেরেশতার নাম কাটিয়া দিব।” এই কঠোর বাক্য শুনিয়া আমরা সকলেই তাঁহার সম্মানার্থে খেজুর পাতার পোশাক পরিধান করতে বাধ্য হইয়াছি।”(মো. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, ১৪৯-১৫১)।
৫. আবূ বাকরের সাথে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা উমার বুঝতেন না
জালিয়াতদের বানানো একটা কথা। উমার (রা) বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ(সা) যখন আবূ বাকর(রা) এর সাথে কথা বলতেন, তখন আমি তাঁদের মাঝে অনারব হাবশীর মত হয়ে যেতাম, যে কিছুই বুঝতে পারে না।”
জালিয়াত দাজ্জালরা বলতে চায় যে, রাসূলুল্লাহ(সা) আবূ বাকর(রা) এর সাথে এমন মারেফতী ভাষায়(!)কথা বলতেন যে, উমার(রা) ও তাঁদের কথা বুঝতে পারতেন না। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই কথাটি সনদবিহীন ভিত্তিহীন একটি মিথ্যা কথা।(ইবনুল কাইয়েম, আল মানার পৃ.১১৫, সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ.২০৩, ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৪০৭, মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ৩৪২)।
৬. উমার(রা) কর্তৃক নিজ পুত্র আবু শাহমাকে দোররা মারা
প্রচলিত আছে যে, উমার(রা) তাঁর নিজ পুত্র আবু শাহমাকে ব্যভিচারের অপরাধে ১০০ বেত্রাঘাত করেন। এতে সেই পুত্রের মৃত্যু হয়। এই ব্যভিচার উদঘাটন, স্বীকারোক্তি, শাস্তি, পিতা-পুত্রের কথাবার্তা ইত্যাদি নিয়ে লম্বা চওড়া কাহিনী বলা হয়, যা শুনলে সাধারণ শ্রোতাগণের চোখে পানি আসে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলি ভিত্তিহীন মিথ্যা গল্প। ইবনুল জাওযী বলেন, “সাধারণ শ্রোতাগণকে কাঁদানোর জন্য জাহিল ওয়ায়িজগণ এগুলি বানিয়েছে।”(ইবনুল জাওযী, আল মাউদূআত ২/৪৪২)।
ইতিহাসে পাওয়া যায়, উমারের (রা) পুত্র আব্দুর রাহমান আবূ শাহমা মিশরের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধরত ছিলেন। একদিন তিনি নাবীয বা খেজুর ভিজিয়ে তৈরি করা শরবত পান করেন। কিন্তু এই খেজুরের শরবতে মাদকতা এসে গিয়েছিল, ফলে আবূ শাহমার মধ্যে মাতলামি আসে। তিনি মিশরের প্রশাসক আমর ইবনুল আস(রা) এর নিকটে আগমন করে বলেন, আমি মাদকদ্রব্য পান করেছি, কাজেই আমাকে আপনি মাদক পানের শরীয়তী শাস্তি(বেত্রাঘাত) প্রদান করুন। আমর(রা) তাকে গৃহাভ্যন্তরে বেত্রাঘাত করেন। উমার(রা) তা জানতে পেরে আমরকে(রা) তিরস্কার করেন এবং বলেন সাধারণ মুসলিম নাগরিককে যেভাবে জনসমক্ষে শাস্তি প্রদান করা হয়, আমার পুত্রকেও সেভাবে শাস্তি প্রদান করা উচিত ছিল। আবূ শাহমা মদীনায় ফিরে গেলে তিনি নিজে তাকে পুনরায় শাস্তি প্রদান করেন। এর কিছুদিন পরে আবূ শাহমা ইন্তিকাল করেন। (ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ২/৪৩৮-৪৪৩, ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/২২০)।
৭. উমার(রা) এর ইসলাম গ্রহণের দিনে কাবাঘরে আযান শুরু
প্রচলিত আছে যে, উমার(রা) যেদিন ইসলাম গ্রহণ করেন, সেই দিন হতে কাবাঘরে প্রথম আযান শুরু হয়। কথাটি ভুল। উমার(রা) হিজরতের পাঁচ বৎসর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর আযানের প্রচলন হয় হিজরতের পরে মদীনায়। উমারের(রা) ইসলাম গ্রহণের সময় এবং পরবর্তী প্রায় ৬ বৎসর যাবত আযানের কোনো প্রচলন ছিল না। প্রকৃত কথা হলো, উমারের(রা) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মক্কায় মুসলিমগণ কাবা ঘরের পাশে নামায আদায় করতে পারতেন না। মক্কার কাফিরগণ তাতে বাধা দিত। উমারের(রা) ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি কাফিরদের বাধা প্রতিহত করে নিজে কাবা ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করেন এবং তাঁর সাথে অন্যান্য মুসলমানও সেখানে নামায আদায় করেন।(ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ)।
এই তথ্যটি কিভাবে ক্রমান্বয়ে বিকৃত হয়েছে তার একটি নমুনা দেখুন। খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া(রাহ) নামে প্রচলিত ‘রাহাতিল কুলুব’ গ্রন্থে রয়েছে তাঁর মুর্শিদ হযরত ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ গঞ্জে শক্কর বলেন, “যতদিন পর্যন্ত হযরত আমিরুল মোমেনীন ওমর এবনে খাত্তাব(রা) ইসলামে ঈমান আনেন নি ততদিন পর্যন্ত নামাযের আযান গুহা গহবরে দেওয়া হতো। কিন্তু যে দিন আমিরুল মোমেনীন হযরত উমর ফারূক(রা) ঈমান আনলেন সেদিন তিনি তলোয়ার মুক্ত করে দাঁড়িয়ে হযরত বেলাল(রা) কে বললেন, কা’বা ঘরের মিম্মারে উঠে আযান দাও। হযরত বেলাল তাঁর নির্দেশ মতো কাজ করলেন।[রাহাতুল কুলুব, পৃ. ৭১(১২ মজলিশ)]।
আমরা জানি যে, এই কথাগুলি কোনোটিই সঠিক নয়। উমারের(রা) ইসলাম গ্রহণের আগে বা পরে কখনোই মক্কায় গুহায়, গহবরে বা কাবাঘরে কোথাও আজান দেওয়া হয় নি। এছাড়া কাবাঘরের মিম্বার ছিল না বা নেই। আমরা বলতে পারি, এই পুস্তকটি সম্ভবত খাজা নিজামুদ্দীনের নামে জাল করে লেখা। অথবা সরলতার কারণে তাঁরা যা শুনেছেন সহজেই বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন।
৮. রাসূলুল্লাহ(সা) ইলমের শহর এবং আলী(রা) তাঁর দরজা
আমাদের সমাজে বহুল প্রচারিত হাদীস-“আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী(রা) তাঁর দরজা।” এই হাদীসটিকে অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে মিথ্যা না বলে যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী এই অর্থে একটি হাদীস বর্ণনা করে নিজেই হাদীসটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। (তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৯৬)।
ইমাম বুখারী, আবূ হাতিম, ইয়াহইয়া বিন সায়ীদ, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে ভিত্তিহীন মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন। (ইবনুল জাওযী, আল মাউদূআত ১/২৬১-২৬৫, সুয়ূতী, আল লাআলী ১/৩২৮-৩৩৬, মুল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ৭১-৭২)।
৯. আলীকে(রা)দরবেশী খিরকা প্রদানঃ
প্রচলিত একটি গল্পে বলা হয়েছেঃ “রাসূলুল্লাহ(সা) মিরাজ হতে ফিরে আসার পরে নিজের সাহাবা(রা) দেরকে ডেকে এরশাদ করলেন যে, আমার দরবেশী খিরকা ঐ ব্যক্তিকে প্রদান করবো যে আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে…….আবূ বাকর(রা)কে বললেন, যদি আমি তোমাকেই এই দরবেশি খিরকা দান করি তাহলে তুমি এর হক কিভাবে আদায় করবে?……এভাবে উমার(রা)কে জিজ্ঞেস করলেন……..উসমান(রা)কে জিজ্ঞেস করলেন………।এরপর আলী(রা)কে প্রশ্ন করলেন। আলী(রা) উত্তরে বললেন, আমি আল্লাহর বান্দাদের গোপনীয়তা রক্ষা করব। তখন তিনি আলীকেই খিরকা প্রদান করেন……” ইত্যাদি। পুরো কাহিনীটিই ভিত্তিহীন বানোয়াট।”(হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলূব, পৃ. ৮-৯)।
১০. আলীকে ডাক, বিপদে তোমাকে সাহায্য করবে
মোল্লা কারী বলেন, শিয়াদের বানানো একটি জঘন্য জাল মিথ্যা কথাঃ “আলীকে ডাক, সে আশ্চর্য্য কর্মাদি প্রকাশ করে, তাকে তুমি বিপদে আপদে তোমার সহায়ক পাবে। হে মুহাম্মাদ, আপনার নব্যুয়ত দ্বারা, হে আলী, আপনার বেলায়াত দ্বারা।”(মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৬৫-২৬৬; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৪৮৯)।
বস্তুত, আমাদের সমাজে প্রচলিত সকল কুসংস্কার, শিরক ও বিদআতের উৎস হচ্ছে শিয়া মতবাদ ও শিয়া সম্প্রদায়। কুরআন কারীম ও সুস্পষ্ট সুন্নাতকে পরিত্যাগ করে তারা রাসূলুল্লাহ(সা) এর বংশের ১২ বা ৭ ইমামের নামে ভক্তিতে বাড়াবাড়ি করেন। ফলে এসকল নেককার মানুষের নামে বিভিন্ন প্রকার মিথ্যা ও ঈমান বিধ্বংসী কথা তাদের মধ্যে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের শত্রুদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়। তাদের হৃদয়গুলি কুরআন কারীম ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(সা) এর সুন্নাতের বাঁধন হতে মুক্ত হয়ে গিয়েছে। হৃদয়ের মনিকোঠায় বসেছেন আলী ও তাঁর বংশের ইমামগণ। তাঁদের নামে জালিয়াতগণ যা বলেছে সবই তারা ভক্তিভরে মেনে নিয়েছেন এবং এই মিথ্যাগুলির ভিত্তিতে কুরআন কারীমের স্পষ্ট নির্দেশনার বিকৃত ব্যাখ্যা করেছেন।
এই সম্প্রদায়ের কঠিনতম অপরাধগুলির মধ্যে অন্যতম হলো, এরা আলী(রা)ও তাঁর বংশের ইমামদেরকে ঈশ্বর বানিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ‘ঈশ্বরত্ব’ বা ‘ঐশ্বরিক শক্তি’ কল্পনা করেছে। এই কথাটি তাদের মধ্যে প্রচলিত একটি শিরক। যেখানে কুরআন ও সুন্নাহ বারংবার শিখাচ্ছে সকল বিপদে আপদে শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার, সেখানে এরা বানিয়েছে আলীর কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা। বিপদে আপদে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে অলৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করাই হলো সকল শিরকের মূল। এ বিষয়ে আমি ‘রাহে বেলায়াত’ নামক পুস্তকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
এই জঘন্য মিথ্যা কথাটির ভিত্তিতে শিয়াগণ একটি দোয়া বানিয়েছে, যা দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজে অনেক সুন্নী মুসলিমের মধ্যেও প্রচলিত। এই শিরক-পূর্ণ দো’আটি প্রচলিত একটি পুস্তক হতে উদ্ধৃত করছিঃ “দোয়ায়ে নাদে আলী। তাহাজ্জুদ নামাজের পর আগে পরে দুরূদ শরীফ পড়ে এই দোয়া যত বেশি পারা যায় পড়ে দোয়া করিলে মনের বাসনা পূর্ণ হয় এবং কঠিন বিপদ দূর হয়ে থাকে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। নাদে আলিয়ান মাজহারাল আজায়েবে তাজেদহু আউনাল্লাকা ফিন্নাওয়ায়েবে ওয়াকুল্লি হাম্মিন ওয়া গাম্মিন সাইয়ানজালি বি-আজমা-তিকা ইয়া আল্লাহু বিনুবুওয়াতিকা ইয়া মুহাম্মাদ বি-বিলায়িতিকা ইয়া আলী, ইয়া আলী, ইয়া আলী, লা ফাতা ইল্লা আলী, লা সাইফা ইল্লা জুল ফাক্কারে, নাছরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারীব, ওয়া বাশশেরিশ মোমিনীন, ফাল্লাহু খাইরুন হাফিজাও ওয়া হুয়া আরহামার রাহিমিন।”(মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৮৬)।
১১. আলী(রা) কে দাফন না করে উটের পিঠে ছেড়ে দেওয়া
৪০ হিজরীর রামাদান মাসের ২৩ তারিখে হযরত আলী ইবনু আবূ তালিব(রা) তাঁর খেলাফতের রাজধানী কূফায় এক গুপ্তঘাতক খারিজীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ্য পুত্র হাসান ইবনু আলী(রা) তাঁর জানাযার সালাতে ইমামতি করেন। জানাযা শেষে কুফাতেই তাঁর বাড়ির অভ্যন্তরে তাঁকে দাফন করা হয়। কারণ ইমাম হাসান ও অন্যরা ভয় পাচ্ছিলেন যে, সাধারণ গোরস্তানের তাঁকে দাফন করলে খারিযীগণ তাঁর মৃতদেহ চুরি করবে এবং অপমানিত করবে। এ বিষয়টি প্রথম যুগের মুসলিমদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল।
পরবর্তীকালে শিয়াগণ এ বিষয়ে একটি বানোয়াট ও মিথ্যা গল্প প্রচার করেছে। গল্পটির সারসংক্ষেপ হলো আলী(রা) কে দাফন না করে উটের পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। উটটি হারিয়ে যায়।……পরবর্তীকালে ‘নাজাফ’ এ তাঁর কবরের খোঁজ পাওয়া যায়।
এ সকল কথা শুধু মিথ্যাই নয়, উপরন্তু তা আলী(রা), হাসান(রা), হুসাইন (রা) ও আলীর পরিবারের সকলের জন্যই কঠিন অবমাননাকর। ইন্তিকালের পর মৃতদেহ দাফন করা জীবিতদের উপর ফরয। এই ফরয দায়িত্বে অবহেলা করে তাঁরা আমিরুল মোমিনীন এর মৃতদেহ উটের পিঠে ছেড়ে দিবেন একথা একান্ত কান্ডজ্ঞানহীন মূর্খ ছাড়া কেউই বিশ্বাস করবে না। হাসান-হুসাইন(রা) তো দূরের কথা, একজন অতি সাধারণ মানুষও তার পিতার মৃতদেহ এভাবে ছেড়ে দিতে রাজি হবে না। সেও চাইবে যে, তার পিতার কবরটি পরিচিতি থাক, যেন সে ও তার বংশধররা তা জিয়ারত করতে পারে…..। কিন্তু সমস্যা হলো কুরআন সুন্নাহকে পরিত্যাগ করে অতিভক্তির অন্ধকারে হৃদয়কে নিমজ্জিত করার পরে ইমামগণের নামে যা কিছু বাতিল, শরীয়তবিরুদ্ধ, বুদ্ধি ও বিবেক বিরুদ্ধ কথা বলা হয়েছে, সবই শিয়ারা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বিশ্বাস করে নিয়েছে।
এই মিথ্যাচারের ভিত্তিতে নাজাফ শহরে একটি কবরকে শিয়াগণ আলীর কবর বলে বিশ্বাস ও প্রচার করেন। আলী(রা) এর শাহাদাতে তিনশত বছর পর্য্ন্ত কেউ বলেনি যে, আলীর কবর নাজাফে। প্রায় তিনশত বৎসর পরে বিভিন্ন জনশ্রুতি ও কুসংস্কারের ভিত্তিতে এই কবরটি আলীর(রা) কবর বলে পরিচিতি পেতে শুরু করে। কবরটির অবস্থা অবিকল বাবরী মসজিদের স্থলে রাম জন্ম-মন্দিরের কাহিনীর মত। সকল হিন্দু গবেষক ও ঐতিহাসিক একমত যে, অযোধ্যার বাবরী মসজিদের স্থানে কোনো কালেই রামমন্দির ছিল না। কিন্তু এই মিথ্যা কথাটি উগ্রপন্থী হিন্দুদের প্রচারে এখন প্রায় স্বতঃসিদ্ধ সত্যে পরিণত হয়েছে। হয়ত এক সময় এখানে রাম-মন্দির নির্মিত হবে। ভারতের কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করবে যে, এখানেই রামের জন্ম হয়েছিল। যেমন ভাবে কোটি কোটি শিয়া বিশ্বাস করে যে নাজাফের এই কবরটিই আলীর কবর। এজন্য তারা নাজাফ শহরকে বলে নাজাফ আল আশরাফ। মক্কা শরীফ, মদীনা শরীফ ও নাজাফ আশরাফ অর্থাৎ পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদীনা ও মহাপবিত্র নাজাফ!!!(ইবনু তাইমিয়া, মাজমূউ ফতওয়া ২৭/৪৪৬; ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ৭/৩৩০; মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ২৮০)।
১২. আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্যঃ
মুসলিম সমাজে প্রচলিত একটি হাদীস: “আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য, তাঁদের যে কাউকে অনুসরণ করলেই তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হবে।”
হাদীসটি আমাদের মধ্যে এত প্রসিদ্ধ যে, সাধারণ একজন মুসলিম স্বভাবতই চিন্তা করেন যে, হাদীসটি বুখারী, মুসলিমসহ সিহাহ সিত্তা ও সকল হাদীসগ্রন্থেই সংকলিত। অথচ প্রকৃত বিষয় হলো, সিহাহ সিত্তাহ তো দূরের কথা অন্য কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি নেই। যয়ীফ ও জালিয়াত রাবীগণের জীবনীগ্রন্থে, কয়েকটি ফিকহ গ্রন্থে ও অপ্রসিদ্ধ দুই একটি হাদীসের গ্রন্থে এই বাক্যটি এবং এ অর্থের একাধিক বাক্য একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেরই একাধিক রাবী জালিয়াত হিসেবে প্রসিদ্ধ অথবা অত্যন্ত দুর্বল ও মিথ্যা বলায় অভিযুক্ত। এজন্য আবূ বাকর বাযযার আহমদ ইবনু আমর(২৯২ হি), ইবনু হাযম জাহিরী আলী ইবনু আহমদ(৪৫৬ হি), যাহাবী মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ(৭৪৮ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এই হাদীসটিকে জাল ও ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। (আবদ ইবনু হুমাইদ, আল মুসনাদ, পৃ. ২৫০; ইবনু হাযম, আল ইহকাম ৬/২৪৪; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ২/১৪১-১৪২; সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ৪৯-৫০)।
আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, সাহাবীগণের মর্যাদা প্রমাণের জন্য আমরা এই ধরনের অনির্ভরযোগ্য হাদীসের উপর নির্ভর করি, অথচ কুরআনে অনেক স্থানে সুস্পষ্টভাবে তাঁদের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের মর্যাদার বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস প্রসিদ্ধ হাদীসের গ্রন্থসমূহে সংকলিত রয়েছে।
১৩. আমার আহলু বাইত নক্ষত্রতুল্য
উপরের হাদীসের ভাষাতেই আরেকটি হাদীসঃ “আমার আহলু বাইত অর্থাৎ বাড়ির মানুষেরা বা বংশধরেরা নক্ষত্রতুল্য, তাঁদের যে কাউকে অনুসরণ করলেই তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হবে।”
নুবাইত ইবনু শারীত(রা) একজন সাহাবী ছিলেন। একাধিক তাবেয়ী তাঁর হতে হাদীস শিক্ষা ও ও বর্ণনা করেছেন। তাঁরই এক অধস্তন পুরুষ আহমদ ইবনু ইসহাক ইবনু ইবরাহীম ইবনু নুবাইত তৃতীয়-চতূর্থ হিজরী শতকে দাবি করেন যে, নুবাইতের লিখিত একটি পান্ডুলিপি তার নিকটে আছে। তিনি দাবী করেন, তিনি তার পিতা পিতামহের নিকট হতে এ পান্ডুলিপি পেয়েছেন। এতে লিখিত হাদীসগুলির একটি হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ লোকটি একজন জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিলেন। তিনি নিজে জালিয়াতি করে এই পান্ডুলিপিটি লিখে তার উর্ধ্বতন দাদার নামে চালান। এই হাদীসটি এবং পান্ডুলিপিটির সকল হাদীস জাল। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ১/২১৬; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ১/১৩৬)।
১৪. আমার সাহাবীগণের বা আমার উম্মতের মতভেদ রহমত
একটি অতি প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ হাদীসঃ “আমার উম্মতের ইখতিলাফ(মতভেদ) রহমত বা করুণা স্বরূপ।” কখনো কখনো বলা হয়ঃ “আলেমদের এখতেলাফ বা মতবিরোধ রহমত।” এবং কেউ বলেন, “আমার সাহাবীগণের এখতেলাফ রহমত।”
মুহাদ্দিসগণ ঘোষণা করছেন যে, এই বাক্যটি রহমত হিসেবে সমাজে বহুমুখে প্রচলিত হলেও কোনো হাদীসের গ্রন্থে এই হাদীসটি সনদসহ পাওয়া যায় না। কোনো সহীহ, যয়ীফ এমনকি জাল সনদেও তা বর্ণিত হয় নি। সনদবিহীনভাবে অনেকেই বিভিন্ন গ্রন্থে এই বাক্যটি হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা সুবকী বলেছেনঃ “মুহাদ্দিসগণের নিকট এটি হাদীস বলে পরিচিত নয়। আমি এই হাদীসের কোনো সনদই পাই নি, সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট কোনো রকম সনদই এই হাদীসের নেই।”(মোল্লা কারী, আল আসরার, ৫১পৃ.; সুয়ূতী, আল-জামি আস সগীর ১/১৩, আলবানী, যায়ীফাহ ১/১৪১)।
ইখতিলাফ বা মতভেদ মূলত নিন্দনীয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অনুমোদিত বা প্রশংসিতও হতে পারে। আমরা ইখতিলাফের প্রশংসায় বা নিন্দায় অনেক কিছুই বলতে পারি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে এই কথাটি বলতে পারি না, কারণ তা সনদবিহীন ভিত্তিহীন কথা।
১৫. মু’আবীয়ার কাঁধে ইয়াযীদঃ বেহেশতীর কাঁধে দোযখী
খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নামে প্রচলিত ‘রাহাতুল কুলুব’ নামক পুস্তকে রয়েছে, হযরত ফরীদউদ্দীন গঞ্জে শক্কর বলেনঃ “হযরত রাসূলে মাকবুল(সা) একদিন সাহাবাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বসেছিলেন, এমন সময় মু’আবীয়া তাঁর পুত্র এজিদকে কাঁধে নিয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো, তাঁকে দেখে হুজুর পাক(সা) মুচকি হেসে বললেন, ‘দেখ-দেখ, বেহেস্তীর কাঁধে দোযখী যাচ্ছে।’…..”(রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৩০)।
এই কথাটি যে ভিত্তিহীন বানোয়াট তা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে যার সাধারণ জ্ঞান আছে তিনিও জানেন যে, ইয়াযিদের জন্ম হয়েছে রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের প্রায় ১৪ বৎসর পরে।
১৬. সাহাবীগণের যুগে ‘যমিনবুসি’
খাযা নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রাহ) এর নামে প্রচলিত ‘রাহাতুল কুলুব’ পুস্তকে রয়েছে, “একদিন রাসূলুল্লাহ(সা) সাহাবাগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন…….এমন সময় একজন আরবী এসে জমিনে আদব চুমু খেয়ে আরজ করলেন………।”(রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৩০)।
কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। আমরা আগেই বলেছি যে, এই বইটি পুরোই জালিয়াতদের রচিত বলে প্রতীয়মাণ হয়। যমিন-বুসি তো দূরের কথা কদম বুসীর রীতিও রাসূলুল্লাহ(সা) এর যুগে প্রচলিত ছিল না। রাসূলুল্লাহ(সা) এর দরবারে তাঁর ২৩ বৎসরের নব্যুয়তের জিন্দেগীতে তাঁর লক্ষাধিক সাহাবীর কেউ কেউ দুই একবার এসেছেন। কেউ কেউ সহস্রাধিকবার এসেছেন। এ সকল ক্ষেত্রে তাঁদের সুন্নাত ছিল সালাম প্রদান। কখনো কখনো দেখা হলে তাঁরা সালামের পর হাত মিলিয়েছেন, বা মুসাফাহা করেছেন। দু’একটি ক্ষেত্রে তাঁরা একজন আরেকজনের কপালে চুমু খেয়েছেন বা কোলাকুলি করেছেন। কয়েকটি যয়ীফ বর্ণনায় দেখা যায়, কেউ কেউ রাসূল(সা) এর পায়ে চুমু খেয়েছেন। রাসূলুল্লাহ(সা) এর ২৩ বছরের নব্যুয়তী জিন্দেগীতে লক্ষ মানুষের অগণিত আগমনের ঘটনার মধ্যে মাত্র ৪/৫টি পদচুম্বনের ঘটনা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ সকল ঘটনায় কোনো সুপরিচিত সাহাবী তাঁর পদচুম্বন করেন নি, করেছেন নতুন ইসলাম গ্রহণ করতে আসা বেদুঈন বা ইহুদী, যারা দরবারে থাকেনি বা দরবারের আদব জানত না। (আবূ বাকর মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম, আর রুখসাতু ফী তাকবীলীল ইয়াদ, ৫৫-৮০ পৃ.)।
আবু বাকর, উমার, উসমান, আলী, ফাতিমা, বিলাল(রা) ও তাঁদের মত প্রথম কাতারের শত শত সাহাবী প্রত্যেকে ২৩ বৎসরে কমপক্ষে ১০ হাজার বার তাঁর দরবারে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু কেউ কখনো একবারও তাঁর কদম মুবারকে চুমু খান নি বা সেখানে হাত রেখে সেই হাতে চুমু খান নি, তাঁর সামনে মাটিতে চুমু খাওয়া তো অনেক দূরের কথা।
ভারতের হিন্দুরা মানুষকে সেজদা, গড় বা প্রণাম করতে অভ্যস্ত ছিল। ইসলামের আগমনের পরে ভারতের মুসলমানদের মধ্যেও পীর, মুরুব্বী বা রাজা-বাদশাহকে সাজদা করা, তাদের পায়ে মুখ দিয়ে চুমু খাওয়া বা তাদের সামনে মাটিতে চুমু খাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। এই রীতিটি নিঃসন্দেহে ইসলামবিরোধী। আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, একে হাদীস বলে চালানো।
১৭. আখেরী জামানার উম্মাতের জন্য চিন্তা
আব্দুল কাদের জীলানীর(রাহ) নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ নামক গ্রন্থের মধ্যে ঢুকানো অগণিত ভিত্তিহীন জাল হাদীসের একটি নিম্নরূপঃ “আমার শেষ যামানার উম্মাতের জন্য আমার খুবই চিন্তা।”(সিররুল আসরার, পৃ. ১৫)।
সহীহ, যয়ীফ বা মাঊযূ কোনো সনদেই কোনো গ্রন্থে একথা পাওয়া যায় না। আমরা আগেই বলেছি এই বইটি পুরোই জাল বলে প্রতীয়মান হয়।