২.১৬. পোশাক ও সাজগোজ বিষয়ক
‘রাসূলুল্লাহর (ﷺ) পোশাক ও ইসলামে পোশাকের বিধান’ পুস্তকে আমি পোশাক বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও মাউদূ হাদীসগুলি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে এ বিষয়ক কিছু মাউযূ বা জাল হাদীস উল্লেখ করেছি।
২.১৬.১. জামা-পাজামা বিষয়ক
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর একটিমাত্র জামা ছিলঃ
আবু দারদা(রা) হতে বর্ণিত হয়েছেঃ “রাসূলু্ল্লাহর (ﷺ) একটি কামিসই ছিল। একাধিক কামিস তাঁর ছিল না।”(তাবারানী, আল মু’জামুল আউসাত ৬/৩১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১২১)। হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনু মাইসারাহ মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলতেন বলে ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৩/২৩৩)।
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে মনে হয়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন প্রকারের জামা পরিধান করতেন। কোনোটির ঝুল ছিল টাখনু পর্যন্ত। কোনোটি কিছুটা খাট হাটুর নিম্ন পর্যন্ত। কোনোটির হাতা ছিল হাতের আঙ্গুলগুলির মাথা পর্যন্ত। কোনোটির হাতা কিছুটা ছোট এবং কব্জি পর্যন্ত ছিল।
২. জামার বোতাম ছিল না বা ঘুন্টি ছিল
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহর (ﷺ) জামার বোতাম ছিল, তবে তিনি সাধারণত বোতাম লাগাতেন না। বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছ যে, ‘তাঁর জামার বোতামগুলি’ খোলা ছিল। এ থেকে মনে হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জামার তিন বা ততোধিক বোতাম ছিল। তিনি সাধারণত, এ সকল বোতামের কোনো বোতামই লাগাতেন না।
কেউ কেউ বলেছেন যে, তাঁর জামার বোতাম ছিল না বা বোতামের স্থলে কাপড়ের তৈরি ঘুন্টি ছিল। এ বিষয়ক কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ইমাম গাযালী(৫০৫ হি) লিখেছেনঃ “তাঁর কামিস ও জামার বোতামগুলি লাগানো থাকত। কখনো কখনো তিনি সালাত ও সালাতের বাইরে বোতামগুলি খুলে রাখতেন।”(গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/৪০৫)।
৩. দাঁড়িয়ে বা বসে পাজামা পরিধান
কোনো কোনো গ্রন্থে বসে পাজামা পরিধান করা সুন্নাত বা আদাব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমার নজরে পড়ে নি। বিষয়টি পরবর্তী যুগের আলিমদের মতামত বলেই মনে হয়।
২.১৬.২. টুপি বিষয়ক
৪. টুপির উপর পাগড়ী মুসলিমের চিহ্ন
ইমাম আবু দাউদ ও তিরমিযী উভয়ে তাঁদের উস্তাদ কুতাইবা ইবনু সাঈদের সুত্রে একটি হাদীস সংকলিত করেছেন। তাঁরা উভয়ই বলেনঃ কুতাইবা আমাদেরকে বলেছেন, তাকে মুহাম্মাদ ইবনু রাবীয়াহ হাদীসটি আবুল হাসান আসকালানী নামক এক ব্যক্তি থেকে, তিনি জাফর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু রুকানাহ নামক এক ব্যক্তি থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে বলেছেন, রুকানার সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুস্তি লড়েন এবং তিনি রুকানাকে পরাস্ত করেন। রুকানা আরো বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি-“আমাদের ও মুশরিকেদের মধ্যে পার্থক্য হলো টুপির উপরে পাগড়ী।”(তিরমিযী, আস-সুনান ৪/২৪৭; আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/৫৫)।
ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উল্লেখ করে এর সনদটি যে মোটেও নির্ভরযোগ্য নয় তা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী আবুল হাসান আসকালানী। এই ব্যক্তিটির পরিচয় কেউ জানেন না। শুধু তাই নয়, তিনি দাবি করেছেন যে, তিনি রুকানার পুত্র হতে হাদীসটি শুনেছেন। রুকানার কোনো পুত্র ছিল কিনা, থাকলে তিনি কে, কিরূপ মানুষ ছিলেন তা কিছুই জানা যায় না। এজন্য হাদীসটির সনদ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
ইমাম তিরমিযীর উস্তাদ, ইমামুল মুহাদ্দিসীন ইমাম বুখারীও তার ‘‘আত-তারীখুল কাবীর” গ্রন্থে এই হাদীসটির দুর্বলতা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, হাদীসটির সনদ অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষদের সমন্বয়। এছাড়া এদের কেউ কারো কাছ হতে হাদীস শুনেছেন বলেও জানা যায় না।(বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ১/৮২)। ইমাম যাহাবী, আজলূনী প্রমুখ একে মাউযূ বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।(হাকিম, আল মুসতাদরাক ৩/৫১১; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৫; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/১৪৫; আজলূনী, কাশাফুল খাফা ২/৯৫)।
এছাড়া আব্দুর রাঊফ মুনাবী, মুল্লা আলী কারী, আব্দুর রাহমান মুবারকপুরী, শামছুল হক আযীমাবাদী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আলোচনা করেছেন যে, এই হাদীসের অর্থ বাস্তবতার বিপরীত। হাদীসটির দুটি অর্থ হতে পারেঃ ১. মুশরিকগণ শুধু টুপি পরিধান করে আর আমরা পাগড়ীসহ টুপি পরিধান করি। ২. মুশরিকগণ শুধু পাগড়ী পরিধান করে আর আমরা টুপির উপর পাগড়ী পরিধান করি। উভয় অর্থই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণের কর্মের বিপরীত। কারণ বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাঁরা কখনো শুধু টুপি পরিধান করতেন এবং কখনো শুধু পাগড়ী পরতেন।
ইমাম গাযালী (৫০৫ হি) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো পাগড়ীর নিচে টুপি পরিধান করতেন। কখনো পাগড়ী ছাড়া শুধু টুপি পরতেন। তিনি পাগড়ী ছাড়া শুধু টুপিও পরতেন। আবার টুপি ছাড়া শুধু পাগড়ীও পরতেন।”(ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা’আদ ১/১৩০)।
৫. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পাঁচকল্লী টুপি
হযরত আবু হুরাইরা(রা) হতে বর্ণিতঃ “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথায় একটি লম্বা (উঁচু) পাঁচভাগে বিভক্ত টুপি দেখেছি।”
হাদীসটি আল্লামা আবু নুআইম ইসপাহানী তাঁর সংকলন ‘মুসনাদুল ইমাম আবী হানীফা’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। তিনি বলেছেনঃ আমাকে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনু জাফর ও আবু আহমদ জুরজানী বলেছেন, আমাদেরকে আহমদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসুফ বলেছেন, আমাদেরকে আবু উসামাহ বলেছেন, আমাদেরকে দাহহাক ইবনু হাজার বলেছেন, আমাদেরকে আবু কাতাদাহ হাররানী বলেছেন যে, অমাদেরকে আবু হানীফা বলেছেন, তাঁকে আতা’ আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি এই হাদীস বলেছেন।(আবু নু‘আইম ইসপাহানী, মুসনাদুল ইমাম আবী হানীফা, পৃ. ১৩৭)।
এই হাদীসটি জাল। ইমাম আবু হানীফা থেকে শুধুমাত্র কাতাদাহ হাররানী(মৃ. ২০৭ হি) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এই হাররানী ছাড়া অন্য কেহ এই শব্দ বলেন নি। ইমাম আবু হানীফার(রা) অগণিত ছাত্রে কেউ এই হাদীসটি এই শব্দে বলেন নি। বরং তাঁরা এর বিপরীত শব্দ বলেছেন। অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনা অনুসারে ইমাম আবু হানীফা বলেছেন, তাঁকে আতা’ আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাদা শামি টুপি ছিল।(মুল্লা আলী কারী, শারহু মুসনাদি আবী হানীফাহ, পৃ. ১৪২)।
তাহলে আমরা দেখেছি যে, অন্যান্যদের বর্ণনা মতে হাদীসটি ‘শামী টুপি’ এবং আবু কাতাদাহ হাররানীর বর্ণনায় বা ‘খুমাসী টুপি’। এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আবু হানীফা বলেছিলেন শামী টুপি, যা তাঁর সকল ছাত্র বলেছেন, আবু কাতাদাহ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ভুল বলেছে। অথবা সে শব্দটিকে বিকৃতভাবে রূপে পড়েছে।
সর্বোপরি এই আবূ কাতাদা পরিত্যক্ত রাবী। ইমাম বুখারী বলেছেন, আবূ কাতাদাহ হাররানী ‘মুনকারুল হাদীস’। ইমাম বুখারী কাউকে ‘মুনকারুল হাদীস’ বা ‘আপত্তিকর বর্ণনাকারী’ বলার অর্থ হলো যে, সেই লোকটি মিথ্যা হাদীস বলে বলে তিনি জেনেছেন। তবে তিনি সরাসরি কাউকে মিথ্যাবাদী না বলে ‘মুনকারুল হাদীস’ বা অনুরূপ শব্দাবলী ব্যবহার করতেন।
এছাড়া হাদীসটি আবু কাতাদাহ হাররানীর থেকে শুধুমাত্র দাহহাক ইবনু হুজুর বর্ণনা করেছেন। এই দাহহাক ইবনু হুজুর এর কুনিয়াত হলো আবু আব্দুল্লাহ মানিবিজী। তিনিও অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী ছিলেন। তিনি মিথ্যা হাদীস বানাতেন বলে ইমাম দারাকুতনী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন।(ইমাম বুখারী, আত তারীখুল কাবীর ৫/২১৯; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৪/৩১৯; ইবুন হাজার আসকালানী, লীসানুল মীযান ৭/৭২)।
এজন্য আল্লামা আবু নু’আইম ইসপাহানী হাদীসটি উল্লেখ করে বলেনঃ “এই হাদীসটি শুধুমাত্র দাহহাক আবু কাতাদা হতে বর্ণনা করেছেন। আর কেউই আবু হানীফা থেকে বা আবু কাতাদাহ হতে তা বর্ণনা করেন নি।”(আবু নু’আইম, মুসনাদুল ইমাম আবু হানীফা, পৃ. ১৩৭)।
২.১৬.৩. পাগড়ী বিষয়ক
৬. পাগড়ীর দৈর্ঘ্য
পাগড়ী কত হাত লম্বা হবে বা পাগড়ীর দৈর্ঘ্যের বিষয়ে সুন্নাত কী? এ বিষয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে। সবই ভিত্তিহীন বা আন্দায কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পাগড়ীর দৈর্ঘ্য কত ছিল তা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।(আযীমাবাদী, আউনুল মা’বুদ ১১/৮৯)।
৭. দাঁড়িয়ে পাগড়ী পরিধান করা
কোনো কোনো গ্রন্থে ‘দাঁড়িয়ে পাগড়ী পরিধান করা’ সুন্নাত বা আদব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমার নজরে পড়ে নি। এ বিষয়টিও পরবর্তী যুগের আলিমদের মতামত বলেই মনে হয়। (মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৪/৩৬২)।
৮. পাগড়ীর রঙ: সাদা ও সবুজ পাগড়ী
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অধিকাংশ সময় কাল রঙের পাগড়ী পরেছেন। হাদীস হতে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি মদীনায়, সফরে, যুদ্ধে সর্বত্র কাল পাগড়ী ব্যবহার করতেন।
৮/৯ম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় থাকা অবস্থায় কাল পাগড়ী ব্যবহার করতেন। এই দাবীর পক্ষে কোনো প্রমাণ বা হাদীস তারা পেশ করেন নি। এজন্য হিজরী ৯ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম সাখাবী(৯০২ হি) এই কথাকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।(মুহাম্মাদ ইবুন ইউসুফ শামী, সীরাহ শামিয়াহ ৭/২৭৬)।
আমরা জানি, পাগড়ী পোশাক বা জাগতিক বিষয়। এজন্য হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা ব্যতিরেকে কোনো রঙকে আমরা নাজায়েয বলতে পারব না। তবে কোনো রঙ সুন্নাত কিনা তা বলতে প্রমাণ প্রয়োজন। বিভিন্ন হাদীসে সাধারণ ভাবে সবুজ পোশাক পরিধানে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো পাগড়ীর ক্ষেত্রে সবুজ রঙ ব্যবহার করেছেন বলে জানতে পারি নি। ফিরিশতাগণের পাগড়ী বিষয়েও তাঁরা কখনো সবুজ পাগড়ী পরিধান করেছেন বলে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমরা দেখতে পাই নি। অনুরূপভাবে তিনি কখনো সাদা রঙের পাগড়ী পরিধান করেছেন বলে জানতে পারি নি। কোনো কোনো সনদহীন ইসরায়েলীয় বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তাবেয়ী কা’ব আহবার বলেছেনঃ হযরত ঈসা(আ) যখন পৃথিবীতে নেমে আসবেন তখন তাঁর মাথায় সবুজ পাগড়ী থাকবে।(মুনাবী, ফযযুল কাদীর ২/৫৩৮)।
৯. পাগড়ীর ফযীলত
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ পাগড়ী ব্যবহার করতেন। কিন্তু পাগড়ী ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান মূলক কোনো সহীহ হাদীস নেই। এ বিষয়ে যা কিছু বর্ণিত ও প্রচারিত সবই ভিত্তিহীন, বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। এ বিষয়ক হাদীসগুলি দুই ভাগে ভাগ করা যায়ঃ প্রথমত, সাধারণ পোশাক হিসেবে পাগড়ী পরিধানের উৎসাহ প্রদান বিষয়ক হাদীস। দ্বিতীয়ত, পাগড়ী পরিধান করে নামায আদায়ের উৎসাহ প্রদান বিষয়ক হাদীস। উভয় অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই অত্যন্ত দুর্বল ও বানোয়াট পর্যায়ের।
বিশেষত দ্বিতীয় অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস সন্দেহাতীতভাবে জাল ও বানোয়াট।
এখানে উল্লেখ্য যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পোশাক’ গ্রন্থে এ সকল হাদীসের সনদের বিস্তারিত আলোচনা করেছি। প্রত্যেক সনদের মিথ্যাবাদী জালিয়াতের পরিচয়ও তুলে ধরেছি। এখানে সংক্ষেপে হাদীসগুলি উল্লেখ করেছি। আগ্রহী পাঠক পোশাকের বইটি থেকে বাকি আলোচনা জানতে পারবেন।
প্রথমত, সৌন্দর্য্য ও মর্যাদার জন্য পাগড়ী
সৌন্দর্য্য ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে পাগড়ী পরিধানের উৎসাহ দিয়ে বর্ণিত জাল বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীসগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
৯.১. পাগড়ীতে ধৈর্য্যশীলতা বৃদ্ধি ও পাগড়ী আরবদের তাজ
একটি বানোয়াট হাদীসে বলা হয়েছেঃ “তোমরা পাগড়ী পরিধান করবে, এতে তোমাদের ধৈয্যশীলত বৃদ্ধি পাবে। আর পাগড়ী হলো আরবদের তাজ বা রাজকীয় মুকুট।” (হাকিম, আল মুসতাদরাক ৪/২১৪; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৫; সাখাবী, আল মাকাদিস ২৯৭)।
৯.২. পাগড়ী আরবদের তাজ, পাগড়ী খুললেই পরাজয়
অন্য একটি বানোয়াট হাদীসে বলা হয়েছেঃ “পাগড়ী আরব জাতির মুকুট। তারা যখন পাগড়ী ফেলে দিবে তখন তাদের মর্যাদাও চলে যাবে বা আল্লাহ তাদের মর্যাদা নষ্ট করে দিবেন।”(প্রাগুক্ত)।
৯.৩. পাগড়ী মুসলিমের মুকুট, মসজিদে যাও পাগড়ী পড়ে ও খালি মাথায়
আরেকটি বানোয়াট হাদীসে বলা হয়েছেঃ “তোমরা মসজিদে একেবারে খালি মাথায় আসবে এবং পাগড়ী, পট্টি বা রুমাল মাথায় আসবে(অর্থাৎ সুযোগ ও সুবিধা থাকলে খালি মাথায় না এসে পাগড়ী মাথায় মসজিদে আসবে); কারণ পাগড়ী মুসলিমের মুকুট।”(ইবুন আদী, আল কামিল ৬/৪১৭-৪১৯; আলবানী, যয়ীফুল জামিয়, পৃ. ৬; যায়ীফাহ ৩/৪৫৯)।
৯.৪. পাগড়ী মুমিনের গাম্ভীর্য ও আরবের মর্যাদা
অন্য একটি অত্যন্ত দুর্বল ও জাল হাদীসে বলা হয়েছেঃ “পাগড়ী মুমিনের গাম্ভীর্য ও আরবের মর্যাদা। যখন আরবগণ পাগড়ী ছেড়ে দিবে তখন তাদের মর্যাদা নষ্ট হবে।”(আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৪; আলবানী, মাকালাত পৃ. ১৩৪)।
৯.৫. পাগড়ী আরবদের তাজ ও জাড়িয়ে বসা তাদের প্রাচীর
অন্য একটি বানোয়াট হাদীসঃ “পাগড়ী আরবদের মুকুট, দুই পা ও পিঠ একটি কাপড় দ্বারা পেচিয়ে বসা তাদের প্রাচীর।”(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৬; সাখাবী, আল মাকাদিস , পৃ. ২৯৭)।
৯.৬. পাগড়ীর প্রতি প্যাচে কেয়ামতে নূর
আরেকটি বানোয়াট হাদীসঃ “মুশরিকগণ ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য হলো টুপির উপরে পাগড়ী। কেয়ামতের দিন মাথার উপর পাগড়ীর প্রতিটি আবর্তনের বা প্যাচের জন্য নূর প্রদান করা হবে।” (মুনাবী, ফাইযুল কাদির ৪/৩৯২; আলবানী, মাকালাত পৃ. ১৩১)।
৯.৭. পাগড়ী পরে পূর্ববর্তী উম্মাতের বিরোধিতা কর
আরেকটি যয়ীফ বা বানোয়াট হাদীসঃ “তোমরা পাগড়ী পরিধান করবে, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিদের বিরোধিতা করবে।”(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৬)।
৯.৮. পাগড়ী আর পতাকায় সম্মান
আরেকটি যয়ীফ বা বানোয়াট হাদীসঃ “আল্লাহ তায়ালা এই উম্মাতকে পাগড়ী ও পতাকা বা ঝান্ডা দিয়ে সম্মানিত করেছেন।”(সাঈদ ইবনু মানসুর, আস-সুনান ২/২৪৬)।
৯.৯. পাগড়ী ফিরিশতাদের বেশ
আরেকটি বানোয়াট হাদীসঃ “তোমরা পাগড়ী পরবে; কারণ পাগড়ী ফিরিশতাদের চিহ্ন বা বেশ। আর তোমরা পিছন থেকে পাগড়ীর প্রান্ত নামিয়ে দিবে।”(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৫/১৭৬; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৩১৫, ৬/২৯৪, ৭/২০৪; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৪)।
৯.১০. পাগড়ী কুফর ও ঈমানের মাঝে বাঁধা
আলীর(রা) নামে প্রচারিত একটি বানোয়াট হাদীসঃ “গাদীর খুমের দিনে রাসূলু্ল্লাহ (ﷺ) আমাকে পাগড়ী পরিয়ে দেন এবং পাগড়ীর প্রান্ত পিছন দিকে ঝুলিয়ে দেন। এরপর বলেনঃ বদর ও হুনাইনের দিনে আল্লাহ আমাকে এভাবে পাগড়ী পরা ফিরিশতাদের দিয়ে সাহায্য করেছেন। আরো বলেনঃ পাগড়ী কুফর ও ঈমানের মাঝে বেড়া বা বাঁধা।”(বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ১০/১৪; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৪২৬, ৪/৬৭; আল মুগনী ১/৯১, ১/৩৩৩, ২/৭৮৪)।
এ সকল হাদীসে অধিকাংশ হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, তা মিথ্যাবাদীদের বানোয়াট কথা। দুই একটি হাদীসের বিষয়ে সামান্য মতভেদ আছে। কেউ সেগুলিকে মিথ্যা হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন। কেউ সরাসরি মিথ্যা না বলে সেগুলিকে অত্যন্ত দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।(সাখাবী, আল মাকাদিস পৃ. ২৯৭-২৯৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৪)।
দ্বিতীয়ত, পাগড়ী সহ সালাতের ফযীলত
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা তাঁর সাহাবীগণ কখনো শুধু নামাযের জন্য পাগড়ী পরিধান করেছেন এরূপ কোনো কথা কোথাও দেখা যায় না। এখন প্রশ্ন হলো পাগড়ী পরে নামায আদায় করার অতিরিক্ত কোনো সাওয়াব আছে কি না?
এ বিষয়ে কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সেগুলি সবই বানোয়াট। সুপরিচিত মিথ্যাবাদী রাবীগণ এগুলি বানিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে আমি হাদীসগুলি উল্লেখ করছি। বিস্তারিত আলোচনার জন্য পোশাক বিষয়ক পুস্তকটি দ্রষ্টব্য।
৯.১১. জুমু‘আর দিনে সাদা পাগড়ী পরার ফযীলত
হযরত আনাস ইবনু মালিকের(রা)সূত্রে প্রচারিত একটি মিথ্যা কথাঃ “আল্লাহর কিছু ফিরিশতা আছেন, শুক্রবারের দিন জামে মসজিদের দরজায় তাঁদের নিয়োগ করা হয়, তারা সাদা পাগড়ী পরিধান কারীগণের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। (খাতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৪/২০৬; ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৬/২৬১)।
৯.১২. জুমু‘আর দিনে পাগড়ী পরার ফযীলত
হযরত আবু দারদার(রা) নামে বর্ণিত মিথ্যা কথা। “আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ শুক্রবারে পাগড়ী পরিহিতদের উপর সালাত(দয়া ও দরুদ) প্রেরণ করেন।”(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৪৬৩; ইবুন হাজার, লীসানুল মীযান ১/৪৮৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৫)।
৯.১৩. পাগড়ীর ২ রাকা‘আত বনাম পাগড়ী ছাড়া ৭০ রাকা‘আত
হযরত জাবিরের(রা) নামে বর্ণিত জাল হাদীসঃ “পাগড়ীসহ দুই রাকা‘আত নামায পাগড়ী ছাড়া বা খালি মাথায় ৭০ রাক‘আত নামাযের চেয়ে উত্তম।”(সাখাবী, আল মাকাদিস পৃ. ২৯৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৩, ৯৫)।
৯.১৪. পাগড়ীর নামায ২৫ গুণ ও পাগড়ীর জুমু‘আ ৭০ গুণ
ইবনু উমরের(রা)সূত্রে প্রচারিত একটি জাল কথাঃ “পাগড়ীসহ একটি নামায পঁচিশ নামাযের সমান এবং পাগড়ীসহ একটি জুমু‘আ ৭০টি জুমু‘আর সমতুল্য”।(সাখাবী, আল মাকাসিদ পৃ. ২৯৮; মুল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১৪৭; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৩, ৯৫)।
৯.১৫. পাগড়ীর নামাযে ১০,০০০ নেকী
আনাস ইবনু মালিকের সূত্রে প্রচার করেছ মিথ্যাবাদীরা।“পাগড়ীসহ নামাযে ১০,০০০ নেকী রয়েছে।”(সাখাবী, আল মাকাসিদ পৃ. ২৯৮; মুল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১৪৭; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৩, ৯৫)।
এভাবে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, ‘পাগড়ী পরে নামায আদায়ের ফযীলতে’ যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই জাল ও বানোয়াট কথা।
২.১৬.৪. সাজগোজ ও পরিচ্ছন্নতা
১০. নুতন পোশাক পরিধানের সময়
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নতুন পোশাক পরিধানের জন্য কোনো সময়কে পছন্দ করতেন বলে কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে নিম্নের হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যাকে মুহাদ্দিসগণ জাল বলে গণ্য করেছেনঃ “রাসূলুল্লাহ(ﷺ) যখন নতুন পোশাক পরিধান করতেন তখন শুক্রবারে তা পরিধান করতেন।”(খাতীব বাগদাদী, তারিখ বাগদাদ ৪/১৩৬; ইবনু হাজার, তাহজীব ৯/২২৮; আলবানী, যায়ীফুল জামিয়, পৃ. ৬২৯)।
১১. দাড়ি ছাঁটা
ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনান গ্রন্থে বলেনঃ আমাদেরকে হান্নাদ বলেছেন, আমাদেরকে উমার ইবনু হারূন বলেছেন, তিনি উসামা ইবনু যাইদ থেকে, তিনি আমর ইবনু শু‘আইব থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর দাড়ির দৈর্ঘ্যও প্রস্থ হতে গ্রহণ করতেন(কাটতেন)।”
ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেনঃ “এই হাদীসটি গরীব(দুর্বল)। আমি মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈলকে (ইমাম বুখারী) বলতে শুনেছি, উমার ইবনু হারূন কোনোরকম চলনসই রাবী। তার বর্ণিত যত হাদীস আমি শুনেছি সবগুলিরই কোনো না কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়। কিন্তু এই হাদীসটিরই কোনোরূপ ভিত্তি পাওয়া যায় না। আর এই হাদীসটি উমার ইবনু হারূন ছাড়া আর কারো সূত্রে জানা যায় না।(তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৯৪)।
ইমাম তিরমিযীর আলোচনা থেকে আমরা তিনটি বিষয় জানতে পারি।
(১) এ্ই হাদীসটি একমাত্র উমার ইবনু হারূন ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে বর্ণিত হয় নি। একামাত্র তিনিই দাবি করছেন যে, উসামা ইবুন যাইদ আল-লাইসী তাকে এই হাদীসটি বলেছেন।
(২) ইমাম বুখারীর মতে উমার ইবনু হারূন একেবারে পরিত্যক্ত রাবী নন।
(৩) উমার ইবনু হারূন এর অন্যান্য হাদীসের ভিত্তি পাওয়া গেলেও এ হাদীসটি একেবারেই ভিত্তিহীন।
অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস দ্বিতীয় বিষয়ে ইমাম বুখারীর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। বিষয়টির সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমাদেরকে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতি এবং এ বিষয়ক মতভেদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণালাভ করতে সাহায্য করবে।
উমার ইবুন হারূন ইবনু ইয়াযিদ বালখী(১৯৪ হি) দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন বেশ নামকরা মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁর আরো একটি বিশেষ পরিচয় ছিল যে, তিনি মুহাদ্দিসগণের ও আহলূস সুন্নাতের আকীদার পক্ষে মুরজিয়াগণের বিপক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখতেন। ফলে অনেক মুহাদ্দিসই তাঁকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, তিনি তাঁর কোনো কোনো উস্তাদের নামে এমন অনেক হাদীস বলেন, যেগুলি সে সকল উস্তাদের অন্য কোনো ছাত্র বলেন না। মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষায় এগুলি ধরা পড়ে।
এর কারণ নির্ণয়ে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তাঁর প্রসিদ্ধি ও বিদ‘আত বিরোধী ভূমিকার ফলে অনেক মুহাদ্দিস তাঁর বিষয়ে ভাল ধারণা রাখতেন। তাঁরা তাঁর এই একক বর্ণনাগুলির ব্যাখ্যায় বলেন যে, সম্ভবত তিনি অনেক হাদীস মুখস্ত করার ফলে কিছু হাদীসে অনিচ্ছাকৃত ভুল করতেন। এদের মতে তিনি ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলতেন না। এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম বুখারী ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস।
অপরদিকে অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের নিরীক্ষায় তাঁর মিথ্যা ধরা পড়েছে। এদের অন্যতম হলেন সমসাময়িক প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক(১৮১ হি)। তিনি বলেন, আমি ইমাম জাফর সাদিকের(১৪৮ হি) নিকট হতে হাদীস শিক্ষা করার জন্য মক্কায় গমন করি। কিন্তু আমার পৌছানোর আগেই তিনি ইন্তিকাল করেন। ফলে আমি তাঁর নিকট হতে কিছু শিখতে পারি নি। আর উমার ইবুন হারূন আমার পরে মক্কায় আগমন করেন। এরপরও সে দাবি করে যে, সে ইমাম জাফর সাদিক হতে অনেক হাদীস শিখেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, সে মিথ্যাবাদী।
আবদুর রাহমান্ ইবনু মাহদী(১৯৪ হি) বলেন, উমার ইবনু হারূন আমাদের নিকট এসে জাফর ইবনু মুহাম্মাদ(ইমাম জাফর সাদিক) এর সূত্রে অনেক হাদীস বলেন। তখন আমরা উমার ইবনু হারূনের জন্ম এবং তার হাদীস শিক্ষার জন্য মক্কার তারিখ হিসাব করলাম। এতে আমরা দেখলাম যে, উমারের মক্কায় গমনের আগেই জা’ফর ইন্তিকাল করেন।(উমার ১২৫/১৩০ হিজরীর দিকে জন্মগ্রহণ করেন। জাফর সাদিক ১৪৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। এ সময়ে উমার হাদীস শিক্ষার জন্য বের হন নি।)
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল বলেন, উমার ইবুন হারূন একবার কিছু হাদীস বলেন। পরবর্তী সময়ে সে হাদীসগুলিই তিনি অন্য উস্তাদের নামে এবং অন্য সনদে বলেন। ফলে আমরা তার হাদীস পরিত্যাগ করি।
এ ধরনের বিভিন্ন নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে যে, উমার ইবনু হারূন হাদীস বর্ণনায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলেন। অন্যান্য যে সকল মুহাদ্দিস উমার ইবুন হারূনকে মিথ্যাবাদী বা পরিত্যক্ত বলেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল কাত্তান, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, নাসাঈ, সালিহ জাযরাহ, আবূ নু‘আইম, ইবুন হিব্বান ও ইবনু হাজার।(ইবুন হাজার, তাহযীব ৭/৪৪১-৪৪৩; তাকরীব, পৃ. ৪১৭)। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।(আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৬৫৩; যায়ীফাহ ১/৪৫৬-৪৫৭)।
এখানে উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার(রা), আবু হুরাইরা(রা) প্রমুখ সাহাবী হতে গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিতে হয়েছে যে, তাঁরা হজ্জ বা উমরার পর যখন মাথা টাক করতেন, তখন দাড়িকে মুষ্টি করে ধরে মুষ্টির বাইরের দাড়ি কেটে ফেলতেন।(বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২০৯; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১০৪; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১০/৩৫০)।
এজন্য কোনো কোনো ফকীহ বলেছেন যে, এক মুষ্টি পরিমাণের বেশি দাড়ি কেটে ফেলা যাবে। অন্যান্য ফকীহ বলেছেন যে, দাড়ি যত বড়ই হোক ছাঁটা যাবে না, শুধুমাত্র অগোছালো দাড়িগুলো ছাঁটা যাবে।
১২. আংটি ও পাথরের গুণাগুণ
সমাজে প্রচলিত অসংখ্য মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীসের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পাথরের গুণাগুণ বর্ণনার হাদীস্। মুসলমানের ঈমান নষ্টকারী বিভিন্ন শয়তানী ওসীলার মধ্যে অন্যতম হল জ্যোতিষ শাস্ত্র ও সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়া ভন্ড জ্যোতিষীর দল। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে, কোনো জ্যোতিষী বা ভাগ্য গণনাকারীর কাছে গেলে বা তার কথা বিশ্বাস করলে মুসলমান কাফির হয়ে যায় এবং তার ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়ে এখানে আলোচনা সম্ভব নয়। জ্যোতিষীদের অনেক ভন্ডামির মধ্যে রয়েছে পাথর নির্ধারণ। তারা বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন ধরণের পাথরের আংটি পরতে পরামর্শ দেন। কেউ কেউ আবার এ বিষয়ে হাদীসও উল্লেখ করেন। পাথরের মধ্যে কল্যাণ অকল্যাণের শক্তি থাকার বিশ্বাস ঈমান বিরোধী বিশ্বাস। বিভিন্ন অমুসলিম সমাজ থেকে এই বিশ্বাস মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, পাথরের গুণাগুণ সম্পর্কিত সকল হাদীসই বানোয়াট। বিভিন্ন ধরনের পাথর, যেমন: যবরজদ পাথর, ইয়াকুত পাথর, যমররদ পাথর, আকীক পাথর ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণিত কোনো হাদীসই নির্ভরযোগ্য নয়। (মোল্লা কারী, আল আসরার ৯৩-৯৪ পৃ.; আল মাসনূ, ৫১ পৃ.)।
১৩. আঙটি পরে নামাযে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব
আঙটির ফযীলতে বানোয়াট একটি হাদীস। “আঙটি পরে নামায আদায় করলে আঙটি ছাড়া নামায আদায়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব হয়।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আঙটি ব্যবহার করেছেন বলে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত। তবে আঙটি পরতে উৎসাহ দিয়েছেন বলে কোনো সহীহ হাদীস নেই।(সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ২৭১; মুল্লা কারী, আল আসরার পৃ. ১৪৬; মাসনূ’য়, পৃ. ৮৭; যারকানী, মুখতারাসুল মাকাসিদ, পৃ. ১২৫)।
১৪. নখ কাটার নিয়মকানুন
নিয়মিত নখ কাটা ইসলামের বিধান ও সুন্নাত। নখ কাটার জন্য কোনো নির্ধারিত দিবস রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিক্ষা দেন নি। বিভিন্ন গ্রন্থে নখ কাটার বিভিন্ন নিয়ম, উল্টোভাবে নখ কাটা, অমুক নখ থেকে শুরু করা ও অমুক নখে শেষ করা, অমুক দিনে নখ কাটা বা না কাটা ইত্যাদির ফযীলত বা ফলাফল বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলি সবই পরবর্তী যুগের প্রবর্তিত নিয়ম। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত সবই বাতিল, বানোয়াট ও মিথ্যা।
নখ কাটার জন্য এসকল নিয়ম পালন করাও সুন্নাত বিরোধী কাজ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নখ কাটতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো বিশেষ নিয়ম বা দিন শিক্ষা দেন নি। কাজেই যে কোনো দিন যে কোনোভাবে নখ কাটলেই এই নির্দেশ পালিত হবে। কোনো বিশেষ দিনে বা কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে নখ কাটার কোনো বিশেষ ফযীলত কল্পনা করার অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শিক্ষাকে অপূর্ণ মনে করা এবং তার শিক্ষাকে পূর্ণতা দানের দুঃসাহস দেখানো। আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ সুন্নাতের মাধ্যমে জীবন যাপনের তাওফীক প্রদান করুন।(সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ৩১৩, ৪২১; মুল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৭০, ২৪১)।