২.১৪. যিকর, দোয়া, দুরূদ, সালাম ইত্যাদি
২.১৪.১. কুরআন তিলাওয়াত বিষয়ক
কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরা বা আয়াতের ফযীলত বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যেগুলির বিষয়ে ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার এ সকল বিষয়ে অনেক মিথ্যা কথাও হাদীস নামে চালানো হয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে এ জাতীয় অনেক অনির্ভরযোগ্য ও বানোয়াট কথা রয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরা বা আয়াত বিষয়ক দুই প্রকারের কথা প্রচলিত। এক প্রকারের কথা ফযীলত বা আখিরাতের মর্যাদা, সাওয়াব, আল্লাহর দয়া ইত্যাদি বিষয়ক। দ্বিতীয় প্রকারের কথা তদবীর বা দুনিয়ায় বিভিন্ন ফলাফল বিষয়ক।
উমার আল মাউসিলীর আলোচনা হতে দেখেছি যে, বিভিন্ন সূরা ও আয়াতের ফযীলতে কিছু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া প্রচলিত বাকি হাদীসগুলি অধিকাংশই যয়ীফ বা বানোয়াট। বিশেষত, তাফসীরে কাশশাফ ও তাফসীরে বায়যাবীর প্রতিটি সূরার শেষে সেই সূরার ফযীলত বিষয়ক যে সকল কথা বলা হয়েছে তা মূলত এ বিষয়ক দীর্ঘ জাল হাদীসটি হতে নেওয়া হয়েছে। আমাদের সমাজে পাঞ্জ সূরার ফযীলত বিষয়ক অধিকাংশ কথাই জাল অথবা যয়ীফ। এই বিষয়ক যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এগুলির বিস্তারিত আলোচনার জন্য পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। এই বইয়ের কলেবর ইতোমধ্যেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এজন্য আমরা এই বইয়ে ফযীলত বিষয়ক যয়ীফ ও জাল হাদীসগুলি আর আলোচনা করছি না। বরং এখানে আমল-তদবীর বিষয়ক কিছু কথা উল্লেখ করছি।
২.১৪.২. আমল তদবীর ও খতম বিষয়ক
কুরআনের আয়াত দ্বারা ঝাড় ফুঁক দেওয়া ও এগুলি পাঠ করে বিভিন্ন রোগব্যাধি বা বিপদাপদ থেকে মুক্তির জন্য আমল করা বৈধ। হাদীস শরীফে কুরআন দ্বারা রুকইয়া বা ঝাড় ফুঁক করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া হাদীসের দোয়া বা যে কোনো ভাল অর্থের বাক্য দ্বার ঝাড় ফুঁক করা বৈধ।
ঝাড়ফুঁক বা তদবীর দুই প্রকারের। কিছু ঝাড়ফুঁক বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এই প্রকারের ঝাড়ফুঁক ও আমল সীমিত। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ঝাড়ফুঁক আমল ইত্যাদি পরবর্তী যুগের বুযুর্গদের অভিজ্ঞতার আলোকে বানানো। যেমন, অমুক সূরা বা অমুক আয়াতটি এতবার বা এতদিন বা অমুক সময় পাঠ করলে অমুক ফল লাভ হয় বা অমুক রোগ হতে মুক্ত হওয়া যায়। এইরূপ বিভিন্ন আমল বা তদবীরই বিভিন্ন বুযুর্গের অভিজ্ঞতা প্রসূত।
কেউ ব্যক্তিগত আমল বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ‘তদবীর’ বা ‘রুকইয়্যা শরইয়্যা’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। তবে এগুলির কোনো খাস ফযীলত আছে বা এগুলি হাদীস সম্মত এরূপ ধারণা করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে মিথ্যা বলা হবে। এছাড়া তদবীর বা আমল হিসেবেও আমাদের উচিত সহীহ হাদীসে উল্লেখিত তদবীর, দোয়া ও আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।
হাদীসের নামে যে সকল বানোয়াট ‘আমল’ বা ‘তদবীর’ আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় সেগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
১. লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা……দারিদ্র্য বিমোচনের আমল
(লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) এই যিকরটির ফযীলতে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে এই বাক্যটিকে বেশি বেশি করে বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই বাক্যটি জান্নাতের অন্যতম ধনভান্ডার, গোনাহ মাফের ও অফুরন্ত সাওয়াব লাভের অসীলা বলে বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে। এ বিষয়ক কিছু সহীহ হাদীস আমি ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যহ এই বাক্যটি ১০০ বার পাঠ করবে সে কখনো দরিদ্র থাকবে না।’ কথাটি বানোয়াট বলেই প্রতীয়মান হয়।
২. ঋণমুক্তির আমল
আলী(রা) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, নিম্নের বাক্যটি বললে পাহাড় পরিমাণ ঋণ থাকলেও আল্লাহ তা পরিশোধ করাবেনঃ “হে আল্লাহ, আপনি আপনার হালাল প্রদান করে আমাকে হারাম হতে রক্ষা করুন এবং আপনার দয়া ও বরকত প্রদান করে আমাকে আপনি ছাড়া অন্য সকলের অনুগ্রহ হতে বিমুক্ত করে দিন।” হাদীসটি সহীহ।(সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৬০; মুসতাদরাক হাকিম ১/৭২১)।
কিন্তু কোনো বিশেষ দিনে বা বিশেষ সংখ্যায় দোয়াটি পাঠ করার বিষয়ে কোনো নির্দেশ কোনো হাদীসে দেওয়া হয় নি। প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি শুক্রবার দিনে ৭০ বার এই দোয়া পড়বে, অল্প দিনের মধ্যে আল্লাহ তাকে ধনী ও সৌভাগ্যশালী করে দিবেন। হযরত আলী(রা) বলেছেন, শুক্রবার দিন জুময়ার নামাযের পূর্বে ও পরে ১০০ বার করে দুরূদ পড়ে এই দোয়া ৫৭০ বার পাঠ করলে পাহাড় পরিমাণ ঋণ থাকলেও তাহা অল্প দিনের মধ্যে পরিশোধ হয়ে যাবে…..।” এই বর্ণনাগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান হয়।
৩. সূরা ফাতিহার আমল
সূরা ফাতিহার ফযীলতে বলা হয়ঃ “ফাতিহা যে নিয়্যতে পাঠ করা হবে তা পূরণ হবে।” এই কথাটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। আরেকটি কথা বলা হয়। “সূরা ফাতিহা সকল রোগের আরোগ্য বা শেফা।” এই কথাটি একটি যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।(সাখাবী, আল মাকাদিস পৃ. ৩০৫, নং ৭৩৪; মুল্লা আলী কারী, আল আসরার পৃ. ১৬৫)।
৪. বিভিন্ন প্রকারের খতম
বিভিন্ন প্রকারের খতম প্রচলিত আছে। সাধারণত, দুটি কারণে ‘খতম’ পাঠ করা হয়। (১) বিভিন্ন বিপদাপদ কাটানো বা জাগতিক ফল লাভ ও (২) মৃতের জন্য সাওয়াব পাঠানো। উভয় প্রকার খতমই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এ সকল খতমের জন্য পঠিত বাক্যগুলি অধিকাংশই খুবই ভাল বাক্য। এগুলি কুরআন কারীমের আয়াত বা সুন্নাত সম্মত দোয়া ও যিকর। কিন্তু এগুলি এক লক্ষ বা সোয়া লক্ষ বার পাঠের কোনো নির্ধারিত ফযীলত, গুরুত্ব বা নির্দেশনা কিছুই কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ সকল ‘খতম’ সবই বানোয়াট। উপরন্তু এগুলিকে কেন্দ্র করে কিছু হাদীসও বানানো হয়েছে।
‘বিসমিল্লাহ’ খতম, দোয়া ইউনুস খতম, কালেমা খতম ইত্যাদি সবই এই পর্যায়ের। বলা হয় ‘সোয়া লাখ বার বিসমিল্লাহ পড়লে অমুক ফল লাভ করা যায়’ বা ‘সোয়া লাখ বার দোয়া ইউনুস পাঠ করলে অমুক ফল পাওয়া যায়’ ইত্যাদি। এগুলি সবই বুযুর্গদের অভিজ্ঞতার আলোকে বানানো এবং কোনোটিই হাদীস নয়। তাসমিয়া বা (বিসমিল্লাহ), তাহলীল বা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও দোয়া ইউনুস এর ফযীলত ও সাওয়াবের বিষয়ে সহীহ হাদীস রয়েছে। (দেখুন, লেখকের অন্য বই: রাহে বেলায়াত, পৃ. ৮৯)। তবে এগুলি এক লক্ষ, সোয়া লক্ষ ইত্যাদি নির্ধারিত সংখ্যায় পাঠ করার বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। খতমে খাজেগানের মধ্যে পঠিত কিছু দোয়া সুন্নাত সম্মত ও কিছু দোয়া বানোয়াট। তবে পদ্ধতিটি পুরোটাই বানানো।
২.১৪.৩. যিকর, ওযীফা, দোয়া ইত্যাদি
১. মহান আল্লাহর বিভিন্ন পাক নামের ফযীলত বা আমল
মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে উল্লেখ করেছেনঃ
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا ۖ وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ [٧:١٨٠]
-“ এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামে ডাকবে। যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করবে। তাঁদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই তাদেরকে দেওয়া হবে।”(সূরা আরাফঃ আয়াত ১৮০)।
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত হাদীসে হযরত আবূ হুরাইরা(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে, ১০০’র একটি কম, যে ব্যক্তি এই নামগুলি সংরক্ষিত রাখবে বা হিসাব রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”(সহীহ বুখারী ২/৯৮১; নং ২৫৮৫; সহীহ মুসলিম ৪/২০৬৩, নং ২৬৭৭)।
এই হাদীসে নামগুলির বিবরণ দেওয়া হয় নি। ৯৯ টি নাম সম্বলিত একটি হাদীস ইমাম তিরমিযী, ইবনু মাজাহ ও অন্য কয়েকজন মুহাদ্দিস সংকলন করেছন।(সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৩০; নং ৩৫০৭; মুসতাদরাক হাকিম ১/৬২-৬৩)। কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিস উক্ত বিবরণকে যয়ীফ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী নিজেই হাদীসটি সংকলন করে তার দুর্বলতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কোনো মুহাদ্দিস বলেন, ৯৯টি নামের তালিকা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা আবূ হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত নয়। পরবর্তী রাবী এগুলি কুরআনের আলোকে বিভিন্ন আলিমের মুখ হতে সংকলিত করে হাদীসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। কুরআন কারীমে উল্লেখিত অনেক নামই এই তালিকায় নেই। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি নামে ডাকা হয়েছে ‘রাব্ব’ বা প্রভু নামে। এই নামটিও এ তালিকায় নেই। (ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১১/২১৭)।
এক্ষেত্রে আগ্রহী মুসলিম চিন্তা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ৯৯টি নাম দিলেন, কিন্তু তার তালিকা দিলেন না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে উলামায়ে কেরাম বলেন যে, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আংশিক গোপন রাখা হয়, মুমিনের কর্মোদ্দীপনা বৃদ্ধির জন্য। যেমন, লাইলাতুল কাদর, জুমু’আর দিনের দোয়া কবুলের সময় ইত্যাদি। অনুরূপভাবে নামের নির্ধারিত তালিকা না বলে আল্লাহর নাম সংরক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেন বান্দা আগ্রহের সাথে কুরআন কারীমে আল্লাহর যত নাম আছে সবই পাঠ করে, সংরক্ষণ করে এবং সে সকল নামে আল্লাহকে ডাকতে থাকে এবং সেগুলির অসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। (ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১১/২১৭-২১৮, ১১/২২১; নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম ১৭/৫)।
কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযী সংকলিত তালিকাটিকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন।(নাবাবী, আল আযকার পৃ. ১৫১; জামউল উসূল ৪/১৭৩-১৭৫)। সর্বাবস্থায় আগ্রহী যাকির এই নামগুলি মুখস্ত করতে পারেন। এছাড়া কুরআন কারীমে উল্লেখিত আল্লাহর মোবারক নাম নিয়মিত কুরআন পাঠের মাধ্যমে সংরক্ষিত রাখতে হবে।
আল্লাহ তায়ালার বরকতময় নামের অসীলা দিয়ে কিভাবে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে, মহিমাময় আল্লাহর ‘ইসমু আযম’ কি এবং এর মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে সে বিষয়ক সহীহ হাদীসগুলি আমি রাহে বেলায়াত গ্রন্থে সনদসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আমাদের দেশের প্রচলিত অনেক বইয়ে এ সকল নামের আরো অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন প্রত্যহ এগুলি পাঠ করলে অন্নকষ্ট হবে না, রোগব্যাধি দূর হবে, স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর যিয়ারত হবে, মনের আশা পূর্ণ হবে, দৈনিক এতবার অমুক নামটি এত দিন পর্যন্ত পড়লে, বা লিখলে অমুক ফল লাভ করা যাবে অথবা অমুক নাম প্রতিদিন এতবার এই পদ্ধতিতে করলে অমুক ফল পাওয়া যাবে, অথবা অমুক নাম এতবার পাঠ করতে হবে, ইত্যাদি। এই ধরনের কোনো কথাই কুরআন বা হাদীসের কথা নয়। কোনো কোনো বুযুর্গ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো কোনো আমল বা তদবীর করেছেন বা শিখিয়েছেন। তবে এগুলিকে আল্লাহর কথা বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কথা বলে মনে করলে বা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে মিথ্যা বলা হবে।
এ বিষয়ক প্রচলিত জাল হাদীসগুলির মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপঃ
২. “আল্লাহর যিকর সর্বোত্তম যিকর।”
বিভিন্ন পুস্তকে হাদীস হিসেবে নিম্নের বাক্যটি উল্লেখ দেখা যায়ঃ “আল্লাহর যিকর সর্বোত্তম যিকর।” অর্থের দিক থেকে কথাটি ঠিক। আল্লাহর যিকর তো সর্বোত্তম যিকর হবেই। আল্লাহর যিকর ছাড়া আর কার যিকর সর্বোত্তম হবে? তবে কথাটি হাদীস নয়। কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে তা বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না।
৩. “যে ব্যক্তি রাত্রিতে আল্লাহর নাম যিকর করে তাহার অন্তরে এবং মৃত্যু হইলে তাহার কবরে নূর চমকাইতে থাকিবে” (মৌলভী শামছূল হুদা, নেয়ামুল কুরআন পৃ. ১৭)।
৪. যে ব্যক্তি ফযরের সময় আল্লাহ নামটি ১০০ বার যিকর করে নিম্নোক্ত ৬টি নাম(জাল্লা জালালুহু, ওয়া আম্মা নাওয়ালুহু, ওয়া জাল্লা সানাউহু, ওয়া তাকাদ্দাসাত আসমাউহূ, ওয়া আ‘যামা শানুহু, ওয়া লা ইলাহা গাইরুহু) একবার করে পড়বে, সে ব্যক্তি গোনাহ হতে এমনভাবে মুক্ত হবে যেন সে এইমাত্র মাতৃগর্ভ হতে জন্মলাভ করল। তার আমলনামা পরিষ্কার থাকবে এবং সেই ব্যক্তি নিশ্চয়িই বেহেশতে প্রবেশ করবে।(মৌলভী শামছূল হুদা, নেয়ামুল কুরআন পৃ. ৩৬)।
এগুলি সবই ভিত্তিহীন কথা যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে বলা হয়েছে।
৫. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার খাস যিকর
আল্লাহর যিকর এর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্য হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ “সর্বোত্তম যিকর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”(তিরমিযী, আস সুনান ৫/৪৬২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৪৯; হাকিম, আল মুসতাদরাক ১/৬৭৬,৬৮১)। আরো বলেন, “তোমরা বেশি বেশি করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।(হাকিম, আল মুসতাদরাক ৪/২৮৫; হাইসামী, মাজমাওয যাওয়াইদ ১/৫২, ২/২১১, ১০/৮২)। অন্যত্র তিনি বলেনঃ “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় বাক্য চারটিঃ ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং ‘আল্লাহু আকবার’। তুমি ইচ্ছেমত এই বাক্য চারটির যে কোনো বাক্য আগে পিছে বলতে পার।”(সহীহ মুসলিম ৩/১৬৮৫, নং ২১৩৭)।
এ সকল যিকর এর গুরুত্ব, ফযীলত, সংখ্যা ও সময় বিষয়ক অনেক সহীহ ও হাসান হাদীস আমি ‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকে আলোচনা করেছি। আমরা সেখানে দেখেছি যে, এ সকল যিকর যপ করার বা উচ্চারণ করার কোনো বিশেষ পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শেখান নি। কোথাও কোনো একটি সহীহ বা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাউকে টেনে টেনে বা জোরে জোরে বা ধাক্কা দিয়ে বা কোনো লতীফার দিকে লক্ষ্য করে, বা অন্য কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে যিকর করতে শিক্ষা দিয়েছেন। মূল কথা হলো, মনোযোগের সাথে বিশুদ্ধ উচ্চারণে যিকর করতে হবে এবং প্রত্যেকে তার মনোযোগ ও আবেগ অনুসারে সাওয়াব পাবেন।
পরবর্তী যুগের বিভিন্ন আলেম, পীর ও মুরশিদ মুরীদগণের মনোযোগ ও আবেগ তৈরির জন্য কিছু বিশেষ পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। এগুলি তাঁদের উদ্ভাবন এবং মুরিদের মনোযোগের জন্য সাময়িক রিয়াযত বা অনুশীলন।
তবে জালিয়াতরা এ বিষয়েও কিছু কথা বানিয়েছে। এই জাতীয় একটি ভিত্তিহীন কথা ও জাল হাদীস নিম্নরূপঃ “একদা হযরত আলী(রা) হুযুর (ﷺ) কে বলিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের জন্য আমাকে সহজ সরল পন্থা বলিয়া দিন। হুযুর (ﷺ) বলিলেন-একটি যিকর করিতে থাক। হযরত আলী বলিলেন-কিভাবে করিব? এরশাদ করিলেন-চক্ষু বন্ধ কর এবং আমার সাথে তিনবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বল। হযরত আলী(রা) ইহা হযরত হাসান বসরীকে এবং হযরত হাসান বসরী হইতে মুরশিদ পরম্পরায় আমাদের নিকট পর্যন্ত পৌছিয়াছে।”
এই গল্পটির আরেকটি ভার্সন নিম্নরূপঃ “আলী(রা) বলেন, খোদা-প্রাপ্তির অতি সহজ ও সরল পথ অবগত হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওহীর অপেক্ষায় থাকেন। অতঃপর জিবরাঈল(আ) আগমন করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমা শরীফ তিনবার শিক্ষা দিলেন। জিবরাঈল(আ) যেভাবে উচ্চারণ করলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সেভাবে আবৃত্তি করলেন। অতঃপর তিনি আলী(রা)কে তা শিখিয়ে দিলেন। আলী(রা) অন্যান্য সাহাবীকে তা শিখিয়ে দিলেন।”
এই হাদীসটি লোকমুখে প্রচারিত ভিত্তিহীন কথা মাত্র। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাঊদূ সনদেও হাদীসটি কোনো গ্রন্থে সংকলিত হয় নি। এজন্য শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী উল্লেখ করেছেন যে, তরীকার বুযুর্গগণের মুখেই শুধু এই কথাটি শোনা যায়। এছাড়া এর কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না। (শাহ ওয়ালীউল্লাহ, আল-কাউলূল জামিল, পৃ. ৩৮-৩৯)।
৬. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে ওযীফা
অগণিত সহীহ হাদীসে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে বিভিন্ন প্রকারের যিকর, দোয়া বা ওযীফার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে পালন করতেন বা সাহাবীগণকে ও উম্মাতকে পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এগুলি ছাড়াও কিছু ওযীফা আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত, যা পরবর্তী যুগের মানুষদের বানানো, কোনো হাদীসে তা পাওয়া যায় না। নিম্নের ওযীফাটি খুবই প্রসিদ্ধঃ
ফজর নামাযের পরে ১০০ বার ‘হুয়াল হাইয়্যূল কাইয়্যূম’, যোহরের নামাযের পর ১০০ বার ‘হুয়্যাল আলীয়্যূল আজীম’, আসরের নামাযের পরে ১০০ বার ‘হুয়ার রাহমানির রাহিম’, মাগরিবের নামাযের পর ১০০ বার ‘হুয়াল গাফূরুর রাহিম’ এবং ঈশার নামাযের পরে ১০০ বার ‘হুয়াল লাতীফুল খাবীর’ পাঠ করা।
এই বাক্যগুলি সবই সুন্দর এবং এগুলির পাঠে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এগুলির কোনোরূপ ফযীলত হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এগুলিকে এত সংখ্যায় পড়তে হবে বা অমুক সময়ে পড়তে হবে এমন কোনো প্রকারের নির্দেশনা কুরআন বা হাদীসে নেই। আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শেখানো ওযীফাগুলি পালন করা।
৭. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত শেষে ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম…..’
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরয নামাযের সালাম ফিরিয়ে বলতেনঃ “হে আল্লাহ, আপনিই সালাম(শান্তি), আপনার থেকেই শান্তি, হে মহাসম্মানের অধিকারী ও মর্যাদা প্রদানের অধিকারী, আপনি বরকতময়।”(সহীহ মুসলিম ১/৪১৪, নং ৫৯১)।
৮. দোয়ায়ে গঞ্জল আরশ
প্রচলিত মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়াগুলির অন্যতম এই দোয়াটি। এর মধ্যে যে বাক্যগুলি বলা হয় তার অর্থ ভাল। তবে এভাবে এই বাক্যগুলি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এই বাক্যগুলির সম্মিলিতরূপ এভাবে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এই বাক্যগুলির ফযীলত ও সাওয়াবে যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা কথা।
৯. দোয়ায়ে আহাদ নামা
অনুরূপ একটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে আহাদ নামা’। প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে এই দোয়াটি বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দোয়ার মূল বাক্যগুলি একাধিক যয়ীফ সনদে বর্ণিত হাদীসে পাওয়া যায়। এ সকল হাদীসে এই দোয়াটি সকালে ও সন্ধ্যায় পাঠ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফযীলত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি কেউ এই দোয়াটি সকাল সন্ধ্যায় পাঠ করেন তবে কিয়ামতের দিন সে মুক্তি লাভ করবে…..।(আহমদ, আল মুসনাদ ১/৪১২; হাকিম, আল মুসতাদরাক ২/৪০৯; তাবারী, আত-তাফসীর ১১/১৫৪)।
এছাড়া এই দোয়ার আমল ও ফযীলত সম্পর্কে প্রচলিত কথাগুলি সবই বানোয়াট। এ সকল বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথাবার্তার একটি নমুনা দেখুনঃ “তিরমিযী, শামী ও নাফাউল খালায়েক কিতাবে ‘দোয়ায়ে আহাদনামা’ সম্পর্কে বহু ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন-যে ব্যক্তি ইসলামী যিন্দেগী যাপন করে জীবনে আহাদনামা ১০০ বার পাঠ করবে সে ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে এবং আমি তার জান্নাতের জামিন হব। ….হযরত জাবির(রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে শুনেছি, মানবদেহে আল্লাহ তায়ালা তিন হাজার রোগব্যাধি দিয়েছেন। এক হাজার হাকিম ডাক্তারগণ জানেন এবং চিকিৎসা করেন। দু‘হাজার রোগের ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কেহ জানেন না। যদি কেউ আহাদনামা লিখে সাথে রাখে অথবা দু‘বার পাঠ করে আল্লাহ তায়ালা তাকে দু‘হাজার ব্যাধি থেকে হিফাজত করবেন।……(মাও. মুহাম্মাদ আমজাদ হুসাইন; অজীফায়ে ছালেহীন পৃ. ১৪৪)।
এগুলি সবই ভিত্তিহীন কথা ও হাদীসের নামে জালিয়াতি। সুনানুত তিরমিযী তো দূরের কথা কোনো হাদীস গ্রন্থেই এ সকল কথা কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি।
১০. দোয়ায়ে কাদাহ
প্রচলিত আরেকটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে কাদাহ’। এই দোয়াটির ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।
১১. দোয়ায়ে জামিলা
দোয়ায়ে জামিলা ও এর ফযীলত বিষয়ক যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।
১২. হাফতে হাইকাল
হাফতে হাইকাল নামক এই দোয়াটির মধ্যে মূলত কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতগুলির এরূপ বিভক্তি, বন্টন ও ব্যবহার কোনো কোনো বুযুর্গের বানানো ও অভিজ্ঞতালব্ধ। এগুলির ব্যবহার ও ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বিভিন্ন মানুষের কথা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কথা বা হাদীস নয়।
১৩. দোয়ায়ে আমান
প্রচলিত আরেকটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে আমান’। এই দোয়ার বাক্যগুলির অর্থ ভাল। তবে এভাবে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি এবং এর ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট।
১৪. দোয়ায়ে হিযবুল বাহার
প্রচলিত একটি দোয়া ও আমল হলো ‘দোয়ায়ে হিযবুল বাহার’। এই দোয়াটির মধ্যে ব্যবহৃত অনেক বাক্য কুরআন ও হাদীস হতে নিয়ে জমা করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে এই দোয়াটি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এর কোনোরূপ গুরুত্ব, ফযীলত বা ফায়দাও হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
অনেক বুযুর্গ এগুলির উপর আমল করেছেন। অনেকে ফল পেয়েছেন। অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন যে, এ সকল দোয়াকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কথা বা হাদীস বলে মনে করলে অন্যায় হবে। কিন্তু বুযুর্গদের বানানো দোয়া হিসেবে আমল করতে দোষ কি?
এ কথা ঠিক যে, মুমিন যে কোনো ভাল বাক্য দিয়ে দোয়া করতে পারেন। তবে এ সকল দোয়ার মনগড়া কোনো সাওয়াব বা ফলাফল ঘোষণা করতে পারেন না। এছাড়া সহীহ হাদীসে অনেক সংক্ষিপ্ত ও সুন্দর দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলি পালন করলে এরূপ বা এর চেয়েও ভাল ফল পাওয়া যাবে বলে স্বয়ং রাসূলু্ল্লাহ (ﷺ) বলেছেন। এ সকল বানোয়াট সুন্দর সুন্দর দোয়ার প্রচলনের ফলে সে সকল ‘নববী’ দোয়া পরিত্যক্ত ও অচল হয়ে গিয়েছে। এ সকল দোয়ার বুযুর্গীর ছোঁয়া থাকলেও নবুওতের নূর নেই। আমাদের জন্য উত্তম হচ্ছে নবুওতের নূর হতে উৎসারিত দোয়াগুলি পালন করা। এতে দোয়া করা ও ফল লাভ ছাড়াও আমরা সুন্নাতকে জীবিত করার এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ভাষায় দোয়া করার অতিরিক্ত সাওয়াব ও বরকত লাভ করব। আমি আমার ‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকে সহীহ হাদীস থেকে অনেক দোয়া, মুনাজাত, যিকর ও ওযীফা উল্লেখ করেছি। আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।
২.১৪.৪. দরুদ-সালাম বিষয়ক
মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে মুমিনগণকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর মহান নবীর (ﷺ) উপর সালাত(দুরুদ) ও সালাম পাঠ করতে। হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলে আকরাম (ﷺ) এর উপর দুরুদ ও সালাম পাঠ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও অত্যন্ত বড় নেক কর্ম। সহীহ হাদীসের আলোকে দরুদ ও সালামের ফযীলতের বিষয়গুলি ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এ সকল ফযীলতের মধ্যে রয়েছেঃ (১) সালাত ও সালাম পাঠকারীর উপর আল্লাহ নিজে সালাত(রহমত) ও সালাম প্রেরণ করেন। একবার সালাত(দরুদ) পাঠ করলে আল্লাহ সালাত পাঠকারীকে ১০ বার সালাত(রহমত) প্রদান করবেন, তার ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন, ১০টি সাওয়াব লিখবেন এবং ১০টি গোনাহ ক্ষমা করবেন। একবার সালাম পাঠ করলে আল্লাহ তাকে ১০বার সালাম জানাবেন।
(২) সালাত বা দরুদ পাঠকারী যতক্ষণ দরুদ পাঠে রত থাকবেন ততক্ষণ ফিরিশতাগণ তার জন্য দোয়া করতে থাকবেন। একবার সালাত(দরুদ) পাঠ করলে আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ তাঁর উপর সত্তর বার সালাম(রহমত ও দোয়া) করবেন।
(৩) সালাত ও সালাম পাঠকারীর সালাত ও সালাম তার পরিচয়সহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে পৌছানো হবে।
(৪) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে সালাত পাঠকারীর জন্য দোয়া করবেন।
(৫) দরুদ পাঠ কিয়ামতে নবীজী (ﷺ) এর শাফায়াত লাভের অসীলা।
(৬) মহান আল্লাহ দরুদ পাঠকারীর দোয়া কবুল করবেন এবং সকল দুনিয়াবী ও পারলৌকিক সমস্যা মিটিয়ে দিবেন।
দরুদের এত সহীহ ফযীলত থাকা সত্ত্বেও কতিপয় আবেগী মানুষ দরুদের ফযীলতে আরো অনেক বানোয়াট কথা হাদীস নামে প্রচার করেছেন।
‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ’ এইটুকু কথা হলো দরুদের ন্যূনতম পর্যায়। এর সাথে ‘সালাম’ যোগ করলে সালামের ন্যূনতম পর্যায় পালিত হবে। যেমন, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও সাল্লিম’। অথবা ‘সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদিও ওয়া সাল্লামা।’ সহীহ হাদীসে দরুদ পাঠের জন্য দরুদে ইবরাহিমী ও ছোট বাক্যের দুই একটি দরুদ পাওয়া যায়। হাদীসে বর্ণিত দরুদের বাক্যগুলি ‘রাহে বেলায়াত’ ও ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থদ্বয়ে উল্লেখ করেছি। আমাদের সমাজে প্রচলিত দরুদে বিভিন্ন নির্ধারিত বাক্য সবই বানোয়াট।
দরুদ সালাম বিষয়ক কিছু প্রচলিত বানোয়াট বা অনির্ভরযোগ্য কথা
১. জুমু‘য়ার দিনে নির্দিষ্ট সংখ্যায় দরুদ পাঠের ফযীলত
জুমুআর দিনে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করতে সহীহ হাদীসে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এই দিনে নির্ধারিত সংখ্যক দরুদ পাঠের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এই দিনে বা রাতে ৪০ বার, ৫০ বার, ১০০ বার, ১০০০ বার বা অনুরূপ কোনো সংখ্যায় দরুদ পাঠ করলে ৪০, ৫০, ১০০ বছরের গোনাহ মাফ হবে, বা বিশেষ পুরস্কার বা ফযীলত অর্জন হবে অর্থে কোনো সহীহ হাদীস নেই। মুমিন যথাসাধ্য বেশি বেশি দরুদ ও সালাম এই দিনে পাঠ করবেন। নিজের সুবিধা ও সাধ্যমত ওযীফা তৈরি করতে পারেন। যেমন আমি শুক্রবারে অথবা প্রতিদিন ১০০, ৩০০ বা ৫০০ বার ওযীফা পাঠ করব।
২. দরুদে মাহি বা মাছের দরুদ
দরুদে মাহি ‘মাছের দরুদ’ এ বর্ণিত ঘটনাবলি সবই মিথ্যা ও বানোয়াট। অনুরূপভাবে এই দরুদের ফযীলতে বর্ণিত সকল কথাই মিথ্যা ও বানোয়াট। এই বানোয়াট কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহর (ﷺ) যুগে এক ব্যক্তি নদীর তীরে বসে দরুদ পাঠ করতেন। ঐ নদীর একটি রুগ্ন মাছ শুনে শুনে দরুদটি শিখে ফেলে এবং পড়তে থাকে। ফলে মাছটি সুস্থ হয়ে যায়। পরে এক ইয়াহুদীরে জালে মাছটি আটকা পড়ে। ইহুদীর স্ত্রী মাছটিকে কাটতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে মাছটিকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। মাছটি ফুটন্ত তেলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দরুদটি পাঠ করতে থাকে। এতে ঐ ইহুদী আশ্চার্যান্বিত হয়ে মাছটিকে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) দরবারে উপস্থিত হয়। তাঁর দোয়ায় মাছটি বাকশক্তি লাভ করে এবং সকল বিষয় বর্ণনা করে।…… পুরো ঘটনাটিই ভিত্তিহীন মিথ্যা।
৩. দরুদের তাজ, তুনাজ্জিনা, ফুতুহাত, শিফা ইত্যাদি
দরুদে তাজ, দরুদে তুনাজ্জিনা, দরুদে ফুতুহাত, দরুদে শিফা, দরুদে খাইর, দরুদে আকবার, দরুদে লাখী, দরুদে হাজারী, দরুদে রূহী, দরুদে বীর, দরুদে নারীয়া, দরুদে শাফেয়ী, দরুদে গাওসিয়া, দরুদে মোহম্মাদী…….।
এ সকল দরুদ সবই পরবর্তী যুগের মানুষদের বানানো। এগুলির ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও মিথ্যা।
এ সকল দরুদের বাক্যগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাল কথার সমন্বয়। তবে এভাবে রাসূলু্ল্লাহ (ﷺ) থেকে পড়ার জন্য বিশেষ কোনো নির্দেশনা নেই। এ সকল দরুদের বাক্যগুলি বিন্যাস পরবর্তী মানুষদের তৈরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলি পাঠ করলে দরুদ পাঠের সাধারণ ফযীলত লাভ হতে পারে। তবে এগুলির বিশেষ ফযীলতে বর্ণিত কথাগুলি বানোয়াট।
যেমন, (আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি) হাদীস সম্মত একটি দরুদ। আবার(আল্লাহুম্মা সাল্লিা ‘আলা মুহাম্মাদিন বি ‘আদাদি কুল্লি দায়িওঁ ওয়া বি ‘আদাদি কুল্লি ইল্লাতিওঁ ওয়া শিফা)কথাটির মধ্যে কোনো দোষ নেই। এই বাক্যের মাধ্যমে দরুদ পাঠ করলে দরুদ পাঠের সাধারণ সাওয়াব লাভের আশা করা যায়। তবে এগুলির জন্য কোনো বিশেষ ফযীলতের কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়। সকল বানানো দরুদেরই একই অবস্থা। কোনো কোনো বানানো দরুদের মধ্যে আপত্তিকর কথা রয়েছে।