২.১৯. ভাষা, পেশা ইত্যাদি বিষয়ক
ইসলাম সকল যুগের, সকল ভাষার, সকল সমাজের মানুষদের জন্য আল্লাহর মনোনীত ধর্ম, দীন বা জীবন ব্যবস্থা। এখানে ভাষা, বর্ণ, দেশ, গোত্র, বংশ, যুগ ইত্যাদির কারণে কোনো মর্যাদার আধিক্য বা কমতি নেই। কুরআন ও হাদীসে একথা বারংবার বলা হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে জাতিগত, ভাষাগত, পেশাগত ইত্যাদি বিভেদের সুযোগ নিয়ে অনেক জালিয়াত কারো পক্ষে ও কারো বিপক্ষে বিভিন্ন হাদীস বানিয়েছে। আরবী ভাষার পক্ষে ও ফার্সী ভাষার বিপক্ষে কেউ কথা বানিয়েছে। কউ উল্টো করেছেন। অনুরূপভাবে আরব, ফার্সীয়ান, তুর্কী, নিগ্রো, রোমান, গ্রীক, আফ্রিকান……বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের পক্ষে ও বিপক্ষে হাদীস বানানো হয়েছে। স্বর্ণকার, তাতী, জেলে, নাপিত…..ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার পক্ষে ও বিপক্ষে হাদীস বানানো হয়েছে।
সনদ বিচার ও নিরীক্ষায় এগুলির জালিয়াতি ধরা পড়েছে। এছাড়া এগুলি ইসলামি মূল্যবোধের বিরোধী। মানুষের মর্যাদার একমাত্র মাপকাঠি ‘তাকওয়া’ বা সততা। পেশা, ভাষা, বর্ণ, গোত্র, বংশ ইত্যাদির ভিত্তিতে কাউকে নিন্দা করা বা কাউকে কারো থেকে ছোট বলা কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার বিরোধী। এ জাতীয় জাল হাদীসগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
১. আরবদেরকে তিনটি কারণে ভালবাসবে
আরবী কুরআনের ভাষা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ভাষা। এজন্য স্বভাবতই সকল মুমিন আরবী ভাষাকে ভালবাসেন। ভাষার প্রতি এই স্বাভাবিক ভালবাসাকে কেন্দ্র করে জালিয়াতগণ আরবগণকে ভালবাসার ফযীলতে অনেক হাদীস বানিয়েছে। একটি প্রচলিত হাদীসঃ “তিনটি কারণে আরবদেরকে ভালবাসবেঃ আমি আরবী, কুরআনের ভাষা আরবী এবং জান্নাতের ভাষা আরবী।” এই কথাকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস বানোয়াট ও মিথ্যা হাদীস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কউ কেউ যয়ীফ বা দুর্বল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সনদ বিচারে এ কথাটি বানোয়াট বলেই বুঝা যায়।(হাকিম, আল মুসতাদরাক ৪/৯৭-৯৮; সুয়ূতী, আল লাআলী ১/৪৪২; সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ৪৫-৪৬; আলবানী, যায়ীফাহ ১/২৯৩)।
২. ফার্সী ভাষায় কথা বলার কঠিন অপরাধ
হাকিম নাইসাপুরী তার আল মুসতাদরাক গ্রন্থে আনাস(রা)এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে নিম্নের হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেনঃ “যদি কেউ ফার্সী ভাষায় কথা বলে, তবে তা তার নোংরামি পাপ বৃদ্ধি করবে এবং তার মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্ব কমিয়ে দিবে।”
এই হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী তালহা ইবনু যাইদ রুক্কী। তিনি দাবি করেন যে, ইমাম আউযায়ী তাকে হাদীসটি ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাসির থেকে আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন। এই ব্যক্তিকে মুহাদ্দিসগণ পরিত্যক্ত ও অত্যন্ত আপত্তিকর বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য ইবনুল জাওযী, যাহাবী প্রমুখ ইমাম হাদীসটিকে বানোয়াট ও মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, সনদগত দুর্বলতার পাশাপাশি অর্থ ইসলামী মূল্যবোধের বিরোধী হওয়ায় হাদীসটি বাতিল বলেই গণ্য।(ইবনু আদী, আল কামিল ৪/১০৮-১১০; হাকিম, আল মুসতাদরাক ৪/৯৮; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৩/৪৬৩-৪৬৪; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/২৯১)।
৩. বিভিন্ন পেশার নিন্দা
যে সকল জাল হাদীস আমাদের সমাজে দীর্ঘস্থায়ী ঘৃণ্য প্রভাব রেখেছে সেগুলির অন্যতম হলো তাঁতী, দর্জি, কর্মকার, নাপিত ইত্যাদি পেশার মানুষদের বিরুদ্ধে বানানো বিভিন্ন জাল হাদীস। ইসলামে শ্রম, কর্ম ও পেশাকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। সকল প্রকার পেশা ও কর্মকে প্রশংসা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এ সকল জালিয়াত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে বিভিন্ন পেশার নিন্দায় হাদীস বানিয়েছে। যেমন, তাঁতীগণ বা নাপিতগণ অন্য মুসলমানদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের সমমর্যাদা সম্পন্ন নয়। কর্মকার বা স্বর্ণকারগণ সবচেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী। তাঁতিরাই দাজ্জালের অনুসারী হবে। পশু-ব্যবসায়ী, কসাই বা শিকারীর নিন্দা।(দাইলামী, আল ফিরদাউস ৩/৮৯; ইবনুল জাওযী, আল মাউদূ‘আত ১/১৬২-১৬৩; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৫/১৭৪-১৭৬; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/২৫৪-২৫৫; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৫৬২-৫৬৩)।
এ সকল জাল হাদীসের প্রচলন মুসলিম সমাজে বিভিন্ন পেশার প্রতি ঘৃণা, কর্মের প্রতি ঘৃণা ইত্যাদি ইসলাম বিরোধী মানসিকতা সৃষ্টি করেছে।
২.১৮. অন্যান্য কিছু বানোয়াট হাদীস
আমরা জানি যে, আখেরাতের জন্য দুনিয়াতেই কর্ম করতে হবে। তবে এই অর্থে একটি হাদীস প্রচলিত, যা ভিত্তিহীন। হাদীসটিতে বলা হয়েছেঃ “দুনিয়া হলো আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।” কথাটির অর্থ সঠিক হলেও তা হাদীস নয়। কোনো সহীহ,যয়ীফ বা মাঊদূ সনদেও কথাটি কোথাও বর্ণিত হয় নি। শুধু জনশ্রুতির ভিত্তিতে অনেকে তা হাদীস বলে লিখেছেন, বলেছেন ও বলছেন।(সাগানী, আল মাঊদূ‘আত, পৃ. ৬৪; সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ২২৭; মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১২৩; দরবেশ হুত, আসানুল মাতালিব, পৃ. ১১০)।
২. নেককারদের পূণ্য নিকটবর্তীদের পাপ
প্রচলিতি একটি বাক্য যা সাধারণত হাদীস হিসেবে উল্লেখ করা হয়ঃ “নেককার মানুষদের নেক-আমলসমূহ নিকটবর্তীগণের(আল্লাহর ওলীদের) জন্য পাপ বলে গণ্য।” মুহাদ্দিসগণ একমত যে, বাক্যটি হাদীস নয়, বরং তৃতীয় শতকের একজন বুযুর্গ আবূ সাঈদ আল খাররার(২৮৬ হি) এর কথা।(ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুসসাস, পৃ. ৮৪; সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ১৯৯; মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১১৩; আল-মাসনূ, পৃ. ৬৪)।
৩. মনোযোগ ছাড়া সালাত হবে না
‘হাদীস’ বলে প্রচলিত আরেকটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। “অন্তরের উপস্থিতি ছাড়া সালাত হবে না।” সালাতের মধ্যে মনোযোগের গুরুত্ব কুরআন ও বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে বুঝা যায়। তবে এই কথাটি হাদীস নয়; বরং সনদবিহীন বানোয়াট কথা।
৪. মৃত্যুর আগে মৃত্যুবরণ কর
হাদীস নামে প্রচলিত একটি বানোয়াট বাক্যঃ “তোমরা মৃত্যুর আগেই মৃত্যুবরণ কর।” ইবুন হাজার আসকালানী, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস একমত যে, এই কথাটি ভিত্তিহীন একটি বানোয়াট কথা।(সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ৪৩২; মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ২৪৬; দরবেশ হুত, আসানুল মাতালিব, পৃ. ২৩৫, আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৮৪)।
৫. ধুমপানের মহাপাপ
প্রচলিত একটি পত্রিকা(আঞ্জুমানে আহমাদিয়া রাহমানিয়া সুন্নিয়া, চট্টগ্রাম, মাসিক তরজুমান ২৫ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, মে-জুন ২০০৫, পৃ. ৫৭) থেকে জানা যায় যে, আমাদের দেশের কোনো কোনো এলাকায় ধুমপানের বিরুদ্ধে দুটি বানোয়াট হাদীস প্রচার করা হয়। “যে ব্যক্তি ধুমপান করল সে যেন নবীগণের রক্ত পান করল।” “যে ব্যক্তি ধুমপান করল, সে যেন কাবাঘরের মধ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করল।” এই প্রকারের জঘন্য নোংরা ও ফালতু কথা কেউ হাদীস হিসেবে বলতে পারে বলে বিশ্বাস করা কষ্ট। সর্বাবস্থায় এগুলি জঘন্য মিথ্যা ও বানোয়াট কথা।
৬. মাদ্রাসা নবীর ঘর
আমাদের দেশের অতি প্রচলিত ও ওয়ায়িযদের প্রিয় হাদীসঃ “মাসজিদ আল্লাহর বাড়ি এবং মাদ্রাসা আমার বাড়ি বা ঘর।”
এই কথাটি হাদীসের নামে বলা একটি জঘন্য মিথ্যা ও বানোয়াট কথা, যা কোনো সহীহ, যয়ীফ সনদ তো দূরের কথা, কোনো জাল বা মাউযূ সনদেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয় নি। ‘মাদ্রাসা’ শব্দটিরই কোনো ব্যবহার ইসলামের প্রথম দুই শতাব্দীতে ছিল না।
শেষ কথা
হাদীসের নামে জালিয়াতির এই আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আমাদের চারিপাশে অগণিত জাল হাদীসের ছড়াছড়ি। ওয়াযে, আলোচনায়, লেখনীতে, গবেষণায় সর্বত্রই এসকল মিথ্যা ও বানোয়াট কথার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। হাদীসের নামে বা রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে প্রচলিত ও প্রচারিত এ সকল অগণিত জাল কথার মধ্য থেকে কিছু বিষয় এ পুস্তকে আলোচনার চেষ্টা করেছি। মহিমাময় আল্লাহর দয়া ও তাওফীক হলে পরবর্তী খন্ডগুলিতে প্রচলিত অন্যান্য বানোয়াট, মিথ্যা ও অনির্ভরযোগ্য কথা আলোচনা করব।
সাইয়্যেদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লীল আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলু্ল্লাহ (ﷺ) এর সহীহ সুন্নাতকে জীবিত করা এবং মিথ্যা, জাল , ভিত্তিহীন বা অনির্ভরযোগ্য কথা আলোচনা, বর্ণনা, পালন বা বিশ্বাসের কঠিন পাপ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার আবেগে অযোগ্যতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম। স্বভাবতই এর মাঝে অনেক ভুলভ্রান্তি রয়েছে। আমি সকল ভুলভ্রান্তির জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করছি ও তাওবা করছি।
এই নগন্য প্রচেষ্টার মধ্যে যা কিছু কল্যাণকর রয়েছে সবই মহান আল্লাহর দয়া ও তাওফীক। তাঁর পবিত্র দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন দয়া করে তাঁর প্রিয়তম রাসূলের (ﷺ) সুন্নাতের খেদমতে এই নগন্য প্রচেষ্টাটুকু কবুল করে নেন এবং একে আমার, আমার পিতামাতা ও সকল পাঠকের নাজাতের ওসীলা বানিয়ে দেন। আমীন!
وصلى آللًه على محمد آلنبى آلأمى وآله وأصحبه أجمعين وآلحمد للًه رب آلع مين