১.৭. মিথ্যার পরিচয় ও চিহ্নিতকরণ
১.৭.১. মিথ্যা চিহ্নিতকরণের প্রধান উপায়
১.৭.১.১. জালিয়াতের স্বীকৃতি
মিথ্যা হাদীসের পরিচিতি ও চিহ্নিত করনের পদ্ধতি উল্লেখ করে আল্লামা ইবনুস সালাহ(৬৪৩ হি) বলেনঃ হাদীস মাঊদূ বা জাল কিনা তা জানা যায় জালিয়াতের স্বীকৃতির মাধ্যমে অথবা স্বীকৃতির পর্যায়ের কোনো কিছুর মাধ্যমে। মুহাদ্দিসগণ অনেক সময় বর্ণনাকারীর অবস্থার প্রেক্ষিতে তার জালিয়াতি ধরতে পারেন। কখনো বা বর্ণিত হাদীসের অবস্থা দেখে জালিয়াতি ধরেন। অনেক বড় বড় হাদীস বানানো হয়েছে যেগুলির ভাষা ও অর্থের দুর্বলতা সেগুলির জালিয়াতির সাক্ষ্য দেয়। (ইরাকী, আত-তাকঈদ, পৃ. ১২৮)।
আল্লামা নববী, ইরাকী, সাখাবী, সুয়ূতী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও মিথ্যা বা জাল হাদীস চিহ্নিত করার পদ্ধতিগুলো উল্লেখ করেছেন।
১.৭.১.২. সনদবিহীন বর্ণনা
সাধারণভাবে জালিয়াতের স্বীকৃতি পাওয়া যায়না। এজন্য মুহাদ্দিসগণ এর উপর নির্ভর করেননা। তারা সনদ বিচার বা তুলনামূলক নিরীক্ষা ও নিরীক্ষামূলক প্রশ্নাবলীর মাধ্যমে ‘স্বীকৃতির পর্যায়ের তথ্যাদি’ সংগ্রহ করে সেগুলির ভিত্তিতে জালিয়াতি নির্ণয় করেন। এজন্য নিরীক্ষাই হলো জালিয়াতি নির্ণয়ের প্রধান পন্থা। প্রধানত দুইটি কারণে মুহাদ্দিসগণ হাদীসকে বানোয়াট, ভিত্তিহীন, জাল বা মিথ্যা বলে গণ্য করেন। প্রথমত, হাদীসের সনদে মিথ্যাবাদীর অস্তিত্ব ও দ্বিতীয়ত, হাদীসের কোনো সনদ না থাকা।
মূলত, প্রথম কারণটিই জালিয়াতি নির্ধারণের মূল উপায়। দ্বিতীয় পর্যায়টি ইসলামের প্রথম অর্ধ সহস্র বৎসরে দেখা যায়নি। হিজরী ৪র্থ/৫ম শতক পর্য্ন্ত কোনো মানুষই সনদ ছাড়া কোনো হাদীস বলতেননা বা বললে কেউ তাতে কর্ণপাত করতেননা। এজন্য জঘন্য জালিয়াতকেও তার মিথ্যার জন্য কোনো সনদ তৈরি করতে হতো। পরবর্তী যুগগুলোতে ক্রমান্বয়ে মুসলিম সমাজে কিছু কিছু কথা হাদীস নামে প্রচারিত হয় যেগুলো লোকমুখে প্রচারিত হলেও কোনো গ্রন্থ বা পুস্তিকায় সনদসহ পাওয়া যায়না। স্বভাবতই মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ একবাক্যে সেগুলিকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও জাল বলে গণ্য করেছেন।
রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে প্রচারিত সকল প্রকারের মিথ্যা বা ভিত্তিহীন কথাকে প্রতিহত করা এবং তাঁর নামে প্রচলিত কথার উৎস ও সূত্র নির্ণয় করার বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ ছিলেন আপোষহীন। এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, ৭ম/৮ম হিজরী শতাব্দী থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্য্ন্ত অগণিত জানবাজ মুহাদ্দিস তাঁদের জীবনপাত করেছেন এ সকল প্রচলিত কথার সূত্র বা উৎস সন্ধান করতে। দ্বিতীয় শতাব্দী হতে শুরু করে পরবর্তী প্রায় অর্ধসহস্র বৎসর ধরে লেখা অগণিত হাদীস, ফিকহ, তাফসীর, ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, জীবনী ইত্যাদি সকল প্রকার পুস্তক পুস্তিকার মধ্যে তাঁরা এগুলো সন্ধান করেছেন। এই সন্ধানের পরেও যে সকল হাদীস নামে প্রচলিত কথার কোনো সনদ তাঁরা পাননি সেগুলিকে তাঁরা ভিত্তিহীন, সূত্রবিহীন, বানোয়াট বা মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন।
১.৭.১.৩. মিথ্যাবাদীর বর্ণনা
জাল বা মিথ্যা হাদীস চেনার অন্যতম উপায় হলো যে, হাদীসটির সনদে এমন একজন রাবী রয়েছেন, যাকে মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে মিথ্যাবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন এবং একমাত্র তার মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়নি। এজন্য জাল বা মিথ্যা হাদীসের সংজ্ঞায় মুহাদ্দিসগণ বলেছেনঃ “ যে হাদীস শুধুমাত্র কোনো মিথ্যাবাদী রাবী বর্ণনা করেছে তা মাঊদূ হাদীস।”
এই মিথ্যাবাদী রাবীর উস্তাদ বা পূর্ববর্তী রাবীগণ এবং তার ছাত্র বা পূর্ববর্তী রাবীগণ বিশ্বস্ত, সত্যবাদী ও নির্ভরযোগ্য হলেও কিছু যায় আসেনা। মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি দেখতে পান যে, এই ব্যক্তি উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছে তাঁর অন্য কোনো ছাত্রই হাদীসটি বর্ণনা করছেননা বা অন্য কোনো সূত্রে ও হাদীসটি বর্ণিত হয়নি, তাহলে তাঁরা নিশ্চিত হন যে, এই মিথ্যাবাদী তার উস্তাদের নামে সনদটি বানিয়ে মিথ্যা হাদীসটি প্রচার করেছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মুহাদ্দিস এই মিথ্যাবাদীর নিকট হতে হাদীসটি সংগ্রহ করেছেন নিরীক্ষা, পর্যালোচনা বা সংকলনের জন্য।
১.৭.১.৩.১. মিথ্যাবাদীর পরিচয়
যে সকল রাবী মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করেন বলে মুহাদ্দিসগণ বুঝতে পেরেছেন তাদেরকে তাঁরা বিভিন্ন প্রকার বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। কখনো তাদেরকে স্পষ্টত মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন। কখনো বা তাদেরকে মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত না বলে অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, প্রথম তিন শতাব্দীর মুহাদ্দিসগণ সাধারণত সহজে কাউকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলতে চাইতেননা। বিশেষত, যে ব্যক্তির বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেছেন বলে ধারণা করেছেন তার বিষয়ে কিছু নরম শব্দ ব্যবহার করতেন। মিথ্যাবাদী রাবীগণের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষাকে আমরা সংক্ষেপে নিম্নোক্ত কয়েক ভাগে ভাগ করতে পারিঃ
১. সরাসরি মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত বলে উল্লেখ করাঃ রাবীর মিথ্যাচারিতা বোঝাতে মুহাদ্দিসগণ বলে থাকেন মিথ্যাবাদী, জঘন্য মিথ্যাবাদী, মিথ্যা বলে, দাজ্জাল, জঘন্য জালিয়াত, জাল করে, অভিযুক্ত, একটি হাদীস জাল করেছে, সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী, মিথ্যার একটি স্তম্ভ, অমুক মুহাদ্দিস তাকে জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন, অমুক তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন………ইত্যাদি।
২. বাতিল হাদীস বা বালা মুসিবত বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করাঃ রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর অন্যতম- বাতিল হাদীস বর্ণনা করে, তার কিছু বাতিল হাদীস রয়েছে, তার কিছু বালা মুসিবত আছে, তার বর্ণিত বালা মুসিবতের মধ্যে অমুক হাদীসটি…….,…এই হাদীসের বিপদ অনেক……খবীস হাদীস বর্ণনা করে…….হাদীস চুরি করে…….
৩. মুনকার(আপত্তিকর) বা মাতরূক(পরিত্যক্ত) বলে উল্লেখ করাঃ ‘মুনকার’ অর্থ অস্বীকারকৃত, আপত্তিকৃত, অন্যায়, গর্হিত ইত্যাদি। মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন অর্থে রাবীকে এবং হাদীসকে মুনকার বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে দুর্বল হাদীস বা দুর্বল রাবীকে মুনকার বলেছেন। কেউ কেউ মিথ্যাবাদী রাবীকে মুনকার বলেছেন। বিশেষত, ইমাম বুখারী রাবীগণের ত্রুটি উল্লেখের বিষয়ে অত্যন্ত নরম শব্দ ব্যবহার করতেন। তিনি সরাসরি কাউকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেননি। বরং অন্য মুহাদ্দিস যাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, তিনি তাকে ‘মুনকার’ বলেছন, অথবা ‘মাতরূক’ বা ‘মাসকূত আনহু’, ‘মানযূর ফীহ’ অর্থাৎ ‘পরিত্যক্ত’, ‘তাঁর বিষয়ে আপত্তি রয়েছে’ বলেছেন।
মুহাদ্দিসগণের মধ্যে প্রচলিত আরেকটি পরিভাষা ‘মাতরূক’, অর্থাৎ ‘পরিত্যক্ত’ বা ‘পরিত্যাজ্য’। সাধারণত মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত দুর্বল রাবীকে ‘পরিত্যক্ত’ বলেন। তবে ইমাম বুখারী, নাসাঈ, দারাকুতনী ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস মিথ্যাবাদী রাবীকে ‘মাতরূক’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষত ইমাম বুখারী ও ইমাম নাসাঈ কাউকে মাতরূক বা পরিত্যক্ত বলার অর্থই হলো যে, তাঁরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করেছেন।
অনুরূপভাবে মুহাদ্দিসগণ যদি বলেন যে, অমুকের হাদীস বর্ণনা করা বৈধ নয়-তাহলেও তার মিথ্যাচারিতা বুঝা যায়।
৪. তার হাদীস কিছুই নয়, মূল্যহীন—বলে উল্লেখ করা
কেউ কেউ রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝাতে রাবীকে বা তার বর্ণিত হাদীসকে মূল্যহীন, কিছুই নয়, এক পয়সাতেও নেওয়া যায়না বা অনুরূপ কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ীর কথা প্রনিদান যোগ্য। ইমাম ইসমাঈল ইবনু ইয়াহইয়া মুযানী(২৬৪ হি) বলেনঃ একদিন এক ব্যক্তি সম্পর্কে আমি বলি যে, লোকটি মিথ্যাবাদী। ইমাম শাফেয়ী(২০৪ হি) আমাকে বলেন, তুমি তোমার কথাবার্তা পরিশিলীত কর। তুমি ‘মিথ্যাবাদী’ না বলে বল ‘তার হাদীস কিছুই নয়’।
৫. পতিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত, অত্যন্ত দুর্বল………ইত্যাদি বলে উল্লেখ করাঃ কিছু শব্দ দ্বারা মুহাদ্দিসগণ রাবীর কঠিন দুর্বলতা ব্যক্ত করেছেন। যেমন: পতিত, অত্যন্ত দুর্বল, একেবারেই বাতিল, ধ্বংসপ্রাপ্ত, তার হাদীস চলে গেছে, উড়ে গেছে……ইত্যাদি। এ সকল রাবীর হাদীস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না হলেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ের। অনেক মুহাদ্দিস এই পর্যায়ের রাবীর হাদীসকেও জাল বা মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন।
১.৭.১.৩.২. মিথ্যা হাদীসের বিভিন্ন নাম
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, জাল বা মিথ্যা হাদীসকে মাঊযূ বলা হলেও, জাল হাদীস বুঝানোর জন্য মুহাদ্দিসগণের আরো কিছু প্রচলিত পরিভাষা রয়েছে। সেগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
১. বাতিলঃ আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, মুহাদ্দিসগণ অনেক সময় মিথ্যা হাদীসকে ‘মাউযূ’ বা ‘জাল’ না বলে বাতিল বলেন। বিশেষত, অনেক মুহাদ্দিস রাবীর ইচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে নিশ্চিত না হলে হাদীসকে ‘মাউযূ’ বলতে চাননা। এক্ষেত্রে তাঁরা ‘বাতিল’ শব্দটি ব্যবহার করেন। অর্থাৎ হাদীসটি মিথ্যা ও বাতিল তবে রাবী তা ইচ্ছেকৃতভাবে জাল করেছে কিনা নিশ্চিত নয়।
২. সহীহ নয়ঃ জাল হাদীস বুঝানোর জন্য মুহাদ্দিসগণের অন্যতম পরিভাষা হলো ‘হাদীসটি সহীহ নয়’। এই কথাটি কেউ কেউ ভুল বোঝেন। তাঁরা ভাবেন, হাদীসটি সহীহ না হলে হয়তো হাসান বা যয়ীফ হবে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। জাল হাদীস আলোচনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ যখন বলেন যে, হাদীসটি সহীহ বা বিশুদ্ধ নয়, তখন তাঁরা বুঝান যে, হাদীসটি অশুদ্ধ, বাতিল ও ভিত্তিহীন। তবে ফিকহী আলোচনায় কখনো কখনো তাঁরা ‘সহীহ নয়’ বলতে ‘যয়ীফ’ বুঝিয়ে থাকেন।
৩. কোনো ভিত্তি নেই, কোনো সূত্র নেইঃ মুহাদ্দিসগণ জাল ও মিথ্যা হাদীস বুঝাতে অনেক সময় বলেন, হাদীসটির কোনো ভিত্তি নেই, সূত্র নেই। এদ্বারা তাঁরা সাধারণভাবে বুঝান যে, হাদীসটি জনমুখে প্রচলিত একটি সনদবিহীন বাক্য মাত্র, এর সহীহ, যয়ীফ বা মাঊদূ কোনো প্রকারের কোনো সনদ বা সূত্র নেই এবং কোনো গ্রন্থে তা সনদ সহ পাওয়া যায়না। কখনো কখনো জাল বা বাতিল সনদের হাদীসকেও তাঁরা এভাবে ‘এর কোনো ভিত্তি নেই’ বলে আখ্যায়িত করেন।
৪. জানিনা, কোথাও দেখিনি, পাইনিঃ মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীস সংকলিত হয়ে যাওয়ার পরে, কোনো প্রচলিত বাক্য যদি সকল প্রকারের অনুসন্ধানের পরও কোনো গ্রন্থে সনদসহ পাওয়া না যায় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে, কথাটি বাতিল ও ভিত্তিহীন। যে সকল মুহাদ্দিস তাঁদের জীবন হাদীস সংগ্রহ, অনুসন্ধান, যাচাই ও নিরীক্ষার মাধ্যমে অতিবাহিত করেছেন, তাঁদের কেউ যদি বলেন, এই হাদীসটি আমি কোথাও দেখিনি, কোথাও পাইনি, আমি চিনিনা, জানিনা, পরিচিত নয়……….তবে তাঁর কথাটি প্রমাণ করবে যে, এই হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
৫. গরীব(অপরিচিত), অত্যন্ত গরীবঃ গরীব শব্দের অর্থ প্রবাসী, অপরিচিত বা অনাত্মীয়। যে হাদীসটি সকল পর্যায়ে শুধুমাত্র একজন রাবী বর্ণনা করেছেন মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে সাধারণত ‘গরীব’ হাদীস বলা হয়। এই পরিভাষা অনুসারে গরীব হাদীস সহীহ হতে পারে, যয়ীফও হতে পারে।
কিন্তু কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল হাদীস বোঝাতে এই পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ যে হাদীসের বিষয়ে বলেছেন ‘জানিনা, ভিত্তিহীন……..’, সেগুলির বিষয়ে তাঁরা বলেছেন ‘গরীব’ বা ‘গরীবুন জিদ্দান’ অর্থাৎ অপরিচিত বা অত্যন্ত অপরিচিত। ইমাম দারাকুতনী, খতীব বাগদাদী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস এভাবে এই পরিভাষাটি কখনো কখনো ব্যবহার করেছেন। এই পরিভাষাটি বেশি ব্যবহার করেছেন ৮ম শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফাকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ যাইলায়ী (৭৬২ হি)।
১.৭.২. ভাষা, অর্থ ও বুদ্ধিবৃত্তিক নিরীক্ষা
বর্ণনাকারীর বর্ণনার নির্ভুলতা যাচাইয়ের পাশাপাশি মুহাদ্দিসগণ বর্ণনার অর্থও যাচাই করেছেন। কুরআন কারীম, সুপ্রসিদ্ধ সুন্নাত, বুদ্ধি-বিবেক, ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠিত সত্য বা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্যে সুস্পষ্ট বিরুদ্ধ কোনো বক্তব্য তাঁরা হাদীস হিসেবে গ্রহণ করেননি।
হাদীসের বিষয়বস্তু, ভাব ও ভাষাও অভিজ্ঞ নাকিদ মুহাদ্দিসগণকে হাদীসের বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা বুঝতে সাহায্য করে।আজীবন হাদীস চর্চার আলোকে তাঁরা কোনো হাদীসের ভাষা, অর্থ বা বিষয়বস্তু দেখেই অনুভব করতে পারেন যে, হাদীসটি বানোয়াট। বিষয়টি খুব কঠিন নয়। যে কোনো বিষয়ের গবেষক সেই বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। একজন নজরুল বিশেষজ্ঞকে পরবর্তী যুগের কোনো কবির কবিতা নিয়ে নজরুলের বলে চালালে তা ধরে ফেলবেন। কবিতার ভাব ও ভাষা দেখে তিনি প্রথমে বলে উঠবেন, এ তো নজরুলের কবিতা হতে পারেনা! কোথায় পেয়েছেন এই কবিতা? কিভাবে??
অনুরূপভাবে যে কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট গবেষক সেই বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা ও অনুভুতি লাভ করেন, যা দিয়ে তিনি সেই বিষয়ক তথ্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক বিচারের যোগ্যতা লাভ করেন।
হাদীস শাস্ত্রের প্রাজ্ঞ ইমামগণ, যাঁরা তাঁদের পুরো জীবন হাদীস, শিক্ষা, মুখস্ত, তুলনা, নিরীক্ষা ও শিক্ষাদান করে কাটিয়েছেন তাঁরাও রাসূলুল্লাহ(স) এর আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, পুরস্কার বর্ণনা, শাস্তি বর্ণনা, শব্দ চয়ন, বিষয়বস্তু, ভাব, অর্থ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি লাভ করেন। এর আলোকে তাঁরা তাঁর নামে প্রচারিত কোনো বাক্য বা হাদীস শুনলে সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করতে পারেন যে, এই বিষয়, এই ভাষা, এই শব্দ বা এই অর্থ রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস হতে পারে বা পারেনা। এর পাশাপাশি তাঁরা অন্যান্য নিরীক্ষার মাধ্যমে এর জালিয়াতি নিশ্চিত করেন।
মুহাদ্দিসগণের হাদীস সমালোচনা সাহিত্যের সুবিশাল ভান্ডারে আমরা অগণিত উদাহরণ দেখতে পাই যে, হাদীসের বর্ণনাকারী মিথ্যাবাদী গণ্য না হওয়া সত্ত্বেও হাদীসের ভাষা, ভাব ও অর্থের কারণে মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে ‘পরিত্যক্ত’, জাল বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।
মুহাদ্দিসগণের এ বিষয়ক কর্মধারা আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, এক্ষেত্রে তাঁরা সাহাবীগণের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, কোনো হাদীসের বিচারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বিবেচ্য বিষয় হলো, কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে প্রমাণিত কিনা তা যাচাই করা। প্রমাণিত হলে তা গ্রহণ করতে হবে, অপ্রমাণিত হলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং কোনোরূপ দ্বিধা থাকলে তা অতিরিক্ত নিরীক্ষা করতে হবে। এভাবে ভাষা ও অর্থগত নিরীক্ষায় হাদীসের তিনটি পর্যায় রয়েছে।
১.৭.২.১. মূল নিরীক্ষায় সহীহ বলে প্রমাণিত
যদি বর্ণনাকারীগণের সাক্ষ্য ও সকল প্রাসঙ্গিক নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) এর কর্ম, বাণী বা অনুমোদন, তবে তা ‘ওহী’র নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এখানেও ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ এর বিচার করতে হবে, যেখানে ভাষা ও অর্থগত নিরীক্ষার প্রক্রিয়া বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্যণীয়ঃ
প্রথমত, এই পর্যায়ের প্রমাণিত কোনো হাদীসের মধ্যে ভাষাগত বা অর্থগত দুর্বলতা বা অসংলগ্নতা পাওয়া যায়না। কারণ শব্দগত বা অর্থগতভাবে অসংলগ্ন হাদীস বর্ণনা করা, অথবা বুদ্ধি, বিবেক, বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক তথ্যের বিপরীতে কোনো হাদীস বর্ণনা করাকেই রাবীর দুর্বলতা বলে বিবেচনা করা হয়েছে। অনেক সৎ ও প্রসিদ্ধ রাবী এইরূপ হাদীস বর্ণনা করার ফলে দুর্বল বলে বিবেচিত হয়েছেন এবং তাঁদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এজন্য সনদ ও সাধারণ অর্থ নিরীক্ষায় (৫টি শর্ত পূরণকারী) ‘সহীহ’ বলে প্রমাণিত কোনো হাদীসের মধ্যে ভাষাগত ও অর্থগত দুর্বলতা পাওয়া যায়না।
দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবেক, বুদ্ধি বা আকল এর নির্দেশনা আপেক্ষিক। একজন মানুষ যাকে বিবেক বিরোধী বলে গণ্য করেছেন, অন্যজন তাকে বিবেক বা বুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করতে পারেন। এজন্য মুসলিম উম্মাহর মূলনীতি হলো, কোনো কিছু ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত হলে তা মেনে নেওয়া। যেমন কুরআন কারীমে চুরির শাস্তি হিসেবে হস্তকর্তনের বিধান রয়েছে। বিষয়টি কারো কাছে বিবেকবিরুদ্ধ মনে হতে পারে। কিন্তু মুমিন কখনোই এই যুক্তিতে এই বিধানটি প্রত্যাখ্যান করেননা। বরং বুদ্ধি, বিবেক ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এই বিধানের যৌক্তিকতা বুঝতে চেষ্টা করেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও মুমিনগণ একইরূপ মূলনীতি অনুসরণ করেন।
তৃতীয়ত, বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক তথ্যের ক্ষেত্রেও মুমিনগণ একইরূপ মূলনীতি অনুসরণ করেন। স্বভাবতই কুরআন ও হাদীসে বিজ্ঞান বা ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হয়নি। তবে প্রাসঙ্গিকক্রমে এ জাতীয় কিছু কথা আলোচিত হয়েছে। ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত কোনো বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ যদি কোনো ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিপরীত হয়, তবে তাঁরা কখনোই সেই বক্তব্যকে ভুল বা মিথ্যা মনে করেননা। যেমন কুরআন কারীমের কোনো আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দ্বারা মনে হতে পারে যে, পৃথিবী সমতল বা সূর্য্ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত। এক্ষেত্রে মুমিনগণ এসকল বক্তব্যের সঠিক অর্থ বুঝার চেষ্টা করেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও একই নীতি তাঁরা অনুসরণ করেন।
চতুর্থত, নিরীক্ষায় প্রমাণিত কোনো ‘সহীহ হাদীস’ এর সাথে অন্য কোনো ‘সহীহ হাদীস’ বা কুরআনের আয়াতের মূলত কোনো বৈপরীত্য ঘটেনা। বাহ্যত কোনো বৈপরীত্য দেখা দিলে মুহাদ্দিসগণ ঐতিহাসিক ও পারিপার্শ্বিক তথ্যাদির বিপরীতে ‘ডকুমেন্টারি’ প্রমাণের মাধ্যমে সেই বৈপরীত্য সমাধান করেছেন। কিন্তু কখনোই ঢালাওভাবে শুধু বাহ্যিক বৈপরীত্যের কারণে কোনো প্রমাণিত তথ্যকে অগ্রাহ্য করেননি। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ(স) কোন স্থান হতে হজ্জের ‘তালবিয়া’ পাঠ শুরু করেন সে বিষয়ে একাধিক ‘সহীহ’ বর্ণনা রয়েছে, যেগুলি বাহ্যত পরস্পর বিরোধী। মুহাদ্দিসগণ এই বাহ্যিক বৈপরীত্যের সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক ও পারিপার্শিক তথ্যাদি বিবেচনা করেছেন, যা আমরা এই পুস্তকের প্রথমে আলোচনা করেছি।
এভাবে কোনো হাদীস ডকুমেন্টারি পরীক্ষায় ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত হওয়ার পরেও যদি বাহ্যত অন্য কোনো হাদীস বা আয়াতের সাথে তার বৈপরীত্য দেখা যায়, তবে মুহাদ্দিসগণ সেই বৈপরীত্যের ইতিহাস, কারণ ও সমাধান অনুসন্ধান করেছেন ও লিপিবদ্ধ করেছেন।
১.৭.২.২. মূল নিরীক্ষায় মিথ্যা বলে প্রমাণিত
যদি কোনো কথা বা বক্তব্যের বিষয়ে প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) এর বাণী নয়, বরং বর্ণনাকারী ভুলে বা ইচ্ছায় তাঁর নামে মিথ্যা বলেছেন, তবে সেক্ষেত্রে সেই বক্তব্যটির ভাষা বা অর্থ বিবেচনা করা হয়না। কোনোরূপ বিবেচনা ছাড়াই তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। অধিকাংশ জাল হাদীসই এই পর্যায়ের। জালিয়াতগণ সাধ্যমত সুন্দর অর্থেই হাদীস বানাতে চেষ্টা করেন।
১.৭.২.৩. মূল পরীক্ষায় দুর্বল বলে পরিলক্ষিত
যদি প্রমাণিত হয় যে, বর্ণনাকারী ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও সত্যপরায়ণ, তবে তিনি তাঁর বর্ণনায় কিছু ভুল করতেন, তবে সেক্ষেত্রে তাঁর দুর্বলতার মাত্রা অনুসারে বর্ণিত হাদীসটিকে হাসান বা যয়ীফ বলে গণ্য করা হয়। এছাড়া কোনো বর্ণনাকারীর পরিচয় জানা না গেলেও হাদীসটি সাধারণভাবে দুর্বল বলে গণ্য করা হয়। এই পর্যায়ের অনেক হাদীসকে মুহাদ্দিসগণ শব্দ ও অর্থগত নিরীক্ষার মাধ্যমে ‘জাল’ বলে গণ্য করেছেন। জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থাবলীতে এরূপ অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলির সনদে কোনো মিথ্যায় অভিযুক্ত না থাকলেও সেগুলিকে জাল বলা হয়েছে। আবার এই জাতীয় কিছু হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন। বাহ্যিক সনদের কারণে কেউ কেউ তা দুর্বল বা ‘হাসান’ বললেও, অর্থের কারণে অন্যরা তা জাল বলে গণ্য করেছেন। এখানে দুইটি উদাহরণ উল্লেখ করছিঃ
(১) আনাস(রা) এর সূত্রে ‘আরশ’ এর বর্ণনায় একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আনাস বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ(স) কে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি জিবরাঈলকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি মীকাঈলকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি ইসরাফীলকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি রাফীকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি লাওহে মাহফূযকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি কলমকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আরশের ৩ লক্ষ ৬০ হাজার খুঁটি আছে,…. ইত্যাদি……।
হাদীসটির সনদে ‘মুহাম্মদ ইবনু নাসার’ নামক একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন, যাকে স্পষ্টত মিথ্যাবাদী বলা হয়নি। তবে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল। ইবনু হাজার বলেনঃ “এই হাদীসটির মিথ্যাচার সুস্পষ্ট। হাদীস সাহিত্যে যার দখল আছে তিনি কখনোই এই বিষয়ে দ্বিমত করবেননা।”(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২১১)।
(২) তাবি-তাবিয়ী ফুদাইল ইবনু মারযূক (১৬০ হি) বলেছেন, ইবরাহীম ইবনু হাসান থেকে, ফাতিমা বিনতুল হুসাইন ইবনু আলী(১০০ হি) থেকে, আসমা বিনতু উমাইস(রা) থেকে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) এর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিল। এ সময়ে তাঁর মস্তক ছিল আলী(রা) এর কোলে। এজন্য আলী আসরের সালাত আদায় করতে পারেননি। এমতাবস্থায় সূর্য্ ডুবে যায়। তিনি আলীকে বলেনঃ তুমি কি সালাত আদায় করেছ? তিনি বলেনঃ না। তখন তিনি বলেনঃ হে আল্লাহ, আলী যদি আপনার এবং আপনার রাসূলের আনুগত্যে থেকে থাকেন তবে তাঁর জন্য আপনি সূর্য্ ফিরিয়ে দিন। আসমা বলেনঃ আমি দেখলাম, সূর্য্ ডুবে গেল। এরপর ডুবে যাওয়ার পরে তা আবার উদিত হলো।”
এই সনদে আসমা বিনতু উমাইস প্রসিদ্ধ মহিলা সাহাবী। ফাতিমা বিনতুল হুসাইন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। ফূযাইল ইবনুল মারযূক সত্যপরায়ণ রাবী, তবে তিনি ভুল করতেন। ইবরাহীম ইবনু হাসান কিছুটা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়না। তবে যেহেতু কেউ তাকে অগ্রহণযোগ্য বলে স্পষ্টত কিছু বলেননি, এজন্য ইবনু হিব্বান তাকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, সনদ বিচারে হাদীসটি ‘হাসান’ বলে গণ্য হতে পারে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বাহ্যিক সনদের দিকে তাকিয়ে এইরূপ মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইবনু তাইমিয়া, ইবনু কাসীর, যাহাবী ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস হাদীসটির ‘মতন’ বা ‘মূলপাঠ’কে জাল বলে গণ্য করেছেন।
তাঁদের বিস্তারিত আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো, সূর্য্ অস্তমিত হওয়ার পরে উদিত হওয়া একটি অত্যাশ্চর্য্ ঘটনা। আর মানবীয় প্রকৃতি অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনা বর্ণনায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহ বোধ করে। এজন্য স্বভাবতই আশা করা যায় যে, অন্তত বেশ কয়েকজন সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হবে। কিন্তু একমাত্র আসমা বিনতে উমাইস(রা) ছাড়া অন্য কোনো সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হয়নি। এইরূপ ঘটনা সূর্য্গ্রহণের চেয়ে অধিক আশ্চর্য্জনক বিষয়। আমরা দেখি যে সূর্য্ গ্রহণের ঘটনা অনেক সাহাবী হতে বর্ণিত, অথচ এই ঘটনাটি এই একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত।
এরপর আসমা(রা) এর ২০ জনেরও অধিক প্রসিদ্ধ ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন। এইরূপ একটি অত্যাশ্চর্য্ ঘটনা তাঁর অধিকাংশ ছাত্রই বর্ণনা করবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু বস্তুত তা ঘটেনি। শুধুমাত্র ফাতেমার সনদে তা বর্ণিত হচ্ছে। ফাতেমার ছাত্র বলে উল্লেখিত ‘ইবরাহীম ইবনু হাসান’ অনেকটা অজ্ঞাত পরিচয় তিনি ফাতেমার নিকট হতে আদৌ শুনেছেন কিনা তা জানা যায়না। অনুরূপ আরেকটি সনদেও ঘটনাটি আসমা বিনতে উমাইস(রা) হতে বর্ণিত। সেই সনদেও দুইজন অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী ও একজন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। এতবড় একটি ঘটনা এভাবে দুই একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ বলবেননা তা ধারণা করা কষ্টকর।
অন্যদিকে ঘটনাটি কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য বর্ণনার সাথে বাহ্যত সাংঘর্ষিক। খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ(স) নিজে ও আলী(রা) সহ অন্যান্য সকল সাহাবী আসরের সালাত আদায় করতে ব্যর্থ হন। সূর্যাস্তের পরে তাঁরা কাযা সালাত আদায় করেন। অন্যদিন ঘুমের কারণে রাসূলুল্লাহ(স) সহ সাহাবীগণের ফজরের সালাত এভাবে কাযা হয়। এই দুইদিনে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(স) ও আলী(রা)সহ সাহাবীগণের জন্য সূর্য্ কে ফেরত আনা বা নেওয়া হলোনা, অথচ এই ঘটনায় শুধু আলীর জন্য তা করা হবে কেন? আর ওযরের কারণে সালাতের সময় নষ্ট হলে তো কোনো অসুবিধা হয়না। এছাড়া আলী(রা) রাসূলুল্লাহ(স) এর সাথে জামাতে সালাত আদায় করবেননা, আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্য্ন্ত এক/দেড় ঘন্টা যাবত ওহী নাযিল হবে ইত্যাদি বিষয় স্বাভাবিক মনে হয়না।
এই জাতীয় আরো অন্যান্য বিষয়ের ভিত্তিতে তাঁরা বলেন যে, এই ‘মতন’টি ভুল বা বানোয়াট। এ সকল অজ্ঞাত পরিচয় রাবীগণ কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল করেছেন।(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/৩৭৮-৩৮২; আলবানী, যায়ীফাহ ২/৩৯৫-৪০১)।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ভাষা, অর্থ ও বুদ্ধিভিত্তিক নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের পদ্ধতি অত্যন্ত যৌক্তিক ও সুক্ষ্ম। যে কোনো বিচারালয়ে বিচারক বুদ্ধিভিত্তিক ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণকে ডকুমেন্টারি প্রমাণের পরে বিবেচনা করেন। কোনো অভিযুক্তের বিষয়ে অপরাধীর মোটিভ ও যৌক্তিকতা স্পষ্টভাবে দেখতে পারলেও পাশাপাশি প্রমাণাদি না থাকলে তিনি শুধুমাত্র মোটিভ বিবেচনায় শাস্তি দেননা। অনুরূপভাবে কোনো অভিযুক্তের বিষয়ে যদি তিনি অনুভব করেন যে, তার জন্য অপরাধ করার কোনো যৌক্তিক বা বিবেকসংগত কারণ নেই, কিন্তু সকল ডকুমেন্ট ও সাক্ষ্য প্রমাণাদি সুস্পষ্টরূপে তাকে অপরাধী বলে নির্দেশ করছে, তখন তিনি তাকে অপরাধী বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। মুহাদ্দিসগণও এভাবে সর্বপ্রথম ‘ডকুমেন্টারি’ প্রমাণগুলির নিরীক্ষা করেছেন এবং তারপর ভাষা, অর্থ ও তথ্য বিবেচনা করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে শব্দ ও অর্থগত নিরীক্ষার কিছু মূলনীতি আমরা দেখতে পাব, ইনশাল্লাহ।
১.৭.৩. মিথ্যা হাদীস চিহ্নিতকরণে মতভেদ
জাল হাদীস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কখনো কখনো মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এই মতভেদ সীমিত ও খুবই স্বাভাবিক। আমরা দেখতে পেয়েছি যে, হাদীসের নির্ভূলতা যাচাই করা অবিকল বিচারালয়ে প্রদত্ত সাক্ষ্য প্রমাণের নির্ভুলতা প্রমাণ করার মতই একটি কর্ম। বিভিন্ন কেসে আমার বিচারকগণের মতভেদ দেখতে পাই। এর অর্থ এই নয় যে, বিচারকার্য্ একটি অনিয়ন্ত্রিত কর্ম এবং বিচারকগণ ইচ্ছামাফিক মানুষদের ফাঁসি দেন বা একজনের সম্পত্তি অন্যজনকে প্রদান করেন। প্রকৃত বিষয় হলো, সাক্ষ্য প্রমাণের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কখনো কখনো বিচারকগণ মতভেদ করতে পারেন। হাদীসের নির্ভুলতা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কিছু সংখ্যক হাদীসের বিষয়ে তাঁদের মতভেদ রয়েছে। এই মতভেদকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি। ১. পরিভাষাগত মতভেদ ও ২. প্রকৃত মতভেদ।
১.৭.৩.১. মতভেদ কিন্তু মতভেদ নয়
অনেক সময় মুহাদ্দিসগণের মতভেদ একান্তই পরিভাষাগত। উপরে আমরা দেখেছি যে, মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত রাবীর পরিচয় জ্ঞাপনে এবং জাল হাদীস চিহ্নিতকরণে মুহাদ্দিসগণ একই পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। এতে কখনো কখনো দেখা যায় যে, একটি হাদীসকে একজন মুহাদ্দিস ‘মুনকার’ বা ‘বাতিল’ বলেছেন এবং অন্যজন তাকে ‘মাঊদূ’ বলেছেন।
এইরূপ একটি পরিভাষাগত বিষয় ‘যয়ীফ’ শব্দের ব্যবহার। ইলমু হাদীসের পরিভাষায় সকল প্রকার অগ্রহণযোগ্য হাদীসকেই ‘যয়ীফ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। যয়ীফ হাদীসের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে এক প্রকারের হলো জাল বা মাউদূ হাদীস। কোনো হাদীসকে যয়ীফ বলে আখ্যায়িত করার অর্থ হাদীসটি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। তা জাল হতে পারে নাও হতে পারে।
আমরা দেখতে পাই যে, অনেক মুহাদ্দিস হাদীস সংকলন ও নিরীক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষত বৃহদাকার গ্রন্থাদির ক্ষেত্রে অনেক হাদীস দুর্বল বা জয়ীফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সকল দুর্বল হাদীসের কোনো কোনো হাদীসকে অন্যান্য মুহাদ্দিস ‘মাউযূ’ বা জাল বলে উল্লেখ করেছেন। বিষয়টি বাহ্যত মতভেদ হলেও তা প্রকৃত মতভেদ নয়। কোনো মুহাদ্দিস যদি বলেন যে, হাদীসটি যয়ীফ তবে মাউযূ নয় এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেন যে, হাদীসটি মাউযূ, তবে তা মতভেদ বলে গণ্য হবে। কিন্তু যে সকল মুহাদ্দিস সাধারণত ‘মাউযূ’ পরিভাষা ব্যবহার করেননি, বরং সকল ‘অনির্ভরযোগ্য’ হাদীসকে সংক্ষেপে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি মতভেদ বলে গণ্য নয়।
১.৭.৩.২. প্রকৃত মতভেদ
কিছু হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের প্রকৃত মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। এই জাতীয় অধিকাংশ হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের মতভেদ ‘যয়ীফ বনাম মাউযূ’। কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন, হাদীসটি মাউযূ নয় বরং যয়ীফ বলে গণ্য। পক্ষান্তরে কেউ কেউ তাকে মাউযূ বলে গণ্য করেছেন। অল্প কিছু হাদীসের ক্ষেত্রে ‘সহীহ বনাম মাউযূ’ মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোনো কোনো মুহাদ্দিস একটি হাদীসকে মাউযূ বলে গণ্য করেছেন, কিন্তু অন্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলে গণ্য করেছেন। এ সকল মতভেদের ক্ষেত্রে পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন নিরীক্ষার মাধ্যমে কোনো একজন এর মতকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন। বিষয়টি অনেকটা বিচারের রায়ের ক্ষেত্রে মতভেদ ও আপীলের মত।
১.৭.৩.৩. মতভেদের কারণঃ
কয়েকটি কারণে এই জাতীয় মতভেদ হয়ে থাকে।
১.৭.৩.৩.১. সনদের বিভিন্নতা
অনেক সময় একজন মুহাদ্দিস এক বা একাধিক সনদের ভিত্তিতে একটি হাদীসকে জাল বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি জানতে পারেননি যে, হাদীসটি অন্য কোনো সনদে বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে অন্য একজন মুহাদ্দিস অন্য এক বা একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেন।
১.৭.৩.৩.২. রাবীর মান নির্ধারণে মতভেদ
‘রাবী’র বর্ণিত হাদীসগুলির তুলনামূলক নিরীক্ষা হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের মূল মাপকাঠি। আর এ কারণেই রাবীর বর্ণনা বিচারে কিছু মতভেদ হয়। এদিক থেকে আমরা রাবীগণকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি। (১) পূর্ণ গ্রহণযোগ্য রাবীগণ, যাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে সকল মুহাদ্দিসগণ একমত, (২)পূর্ণ অনির্ভরযোগ্য রাবীগণ, যাদের দুর্বলতা বা জালিয়াতির বিষয়ে নিরীক্ষক মুহাদ্দিসগণ একমত এবং (৩) মতভেদীয় রাবীগণ, যাদের গ্রহণযোগ্যতার মান নির্ধারণে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন।
যে সকল রাবী কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ দেখেছেন যে, তাঁদের বর্ণিত হাদীসে বেশ কিছু উল্টাপাল্টা ও ভুল বর্ণনা রয়েছে এবং কিছু সহীহ বর্ণনাও রয়েছে এদের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো মতভেদ করেছেন। তাদের বর্ণিত হাদীসের মধ্যে শুদ্ধ ও ভুল বর্ণনার হার, কারণ ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বা অনিচ্ছাকৃত ভুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ মাঝে মাঝে মতভেদ করেছেন।
এছাড়া অনেক সময় কোনো কোনো মুহাদ্দিস আংশিক তথ্যের উপর নির্ভর করে রায় দিয়েছেন, যা অন্য কোনো মুহাদ্দিস সামগ্রিক তথ্যের উপর নির্ভর করে বাতিল করেছেন। যেমন একজন বর্ণনাকারীর কিছু হাদীস বিশুদ্ধ বা ভুল দেখে একজন মুহাদ্দিস তাকে গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। অন্য মুহাদ্দিস তাঁর সকল বর্ণিত হাদীস তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে অন্য বিধান প্রদান করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, এ সকল মতভেদের ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ পর্যালোচনা করেছেন এবং মতামত প্রদানকারীদের বিভিন্ন মতামতের ভারসাম্য, বিচক্ষণতা, গভীরতা ইত্যাদির ভিত্তিতে মতবিরোধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিমালা নির্ণয় করেছেন। (ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ১৫১-১৭০)।
১.৭.৩.৩.৩. মুহাদ্দিসের নীতিগত বা পদ্ধতিগত মতভেদ
কখনো কখনো রাবী বা হাদীসের বিধান প্রদানে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে পদ্ধতিগত কিছু পার্থক্য দেখা যায়। কেউ কেউ বেশি ঢিলেমি ও কেউ বেশি কড়াকড়ি করেছেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ এ সকল বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে তাদের মতভেদ নিরসন করেছেন। যেমন, চতুর্থ শতকের মুহাদ্দিস ইবনু হিব্বান আবু হাতিম মুহাম্মাদ আল বুসতী(৩৫৪ হি), ৬ষ্ঠ শতকের মুহাদ্দিস ইবনুল জাওযী আবুল ফারাজ আব্দুর রাহমান ইবনু আলী(৫৯৭ হি) ভিত্তিহীন কঠোরতার জন্য অভিযুক্ত। পক্ষান্তরে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযী ইবনু ঈসা(২৭৯ হি), ৪র্থ-৫ম শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ হাকিম নাইসাপুরী (৪০৫ হি), ১০ম শতকের মুহাদ্দিস জালালুদ্দিন সুয়ূতী(৯১১ হি) প্রমুখ ঢিলেমির জন্য পরিচিত ছিলেন। এখানে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
(১) ইবনু হিব্বান ও ইবনুল জাওযীর কড়াকড়ি জাত ভুলের উদাহরণ। দ্বিতীয় হিজরী শতকের রাবী আফলাহ ইবনু সাঈদ আনসারী(১৫৬ হি) বলেন, আমাদেরকে উম্মু সালামার গোলাম আব্দুল্লাহ ইবনু রাফি বলেছেন, আমি আবু হুরাইরা(রা) কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “তোমার জীবন যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে খুব সম্ভব তুমি এমন কিছু মানুষ দেখতে পাবে যাদের হাতে গরুর লেজের মত(ছড়ি বা বেত) থাকবে। (নিরীহ মানুষদের সন্ত্রস্ত করবে বা আঘাত করবে।) তারা সকালেও আল্লাহর ক্রোধের মধ্যে থাকবে, বিকেলেও আল্লাহর ক্রোধের মধ্যেই থাকবে।
এই হাদীসটিকে ইবনু হিব্বান ও ইবনুল জাওযী বানোয়াট ও জাল বলে গণ্য করেছেন। তাদের দাবি, এই হাদীসের বর্ণনাকারী আফলাহ ইবনু সাঈদ হাদীস উল্টাপাল্টা বলতেন, জাল হাদীস বর্ণনা করতেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের মতামতের আলোকে দেখেছেন যে, ইবনু হিব্বান ও ইবনুল জাওযীর এই মত সম্পূর্ণ ভুল। কোনো মুহাদ্দিসই কখনো বলেননি যে, আফলাহ জাল হাদীস বর্ণনা করেন। এমনকি কেউ বলেননি যে, আফলাহ দুর্বল বা অনির্ভরযোগ্য। মুহাম্মদ ইবনু সাদ(২৩০ হি), ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন(২৩৩ হি), আবূ হাতিম রাযী(২৭৭ হি), নাসাঈ (৩০৪ হি)ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে নির্ভরযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ইবনু হিব্বান বা ইবনুল জাওযী কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেননি যে, আফলাহ অন্য রাবীদের বিপরীত উল্টাপাল্টা কোনো হাদীস বর্ণনা করেছেন। সর্বোপরি এই হাদীসটি আফলাহ ছাড়াও অন্য নির্ভরযোগ্য রাবী আবু হুরাইরার সূত্রে বর্ণিত করেছন। কাজেই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ এবং ইবনু হিব্বান ও ইবনুল জাওযী ভুল বলে প্রমাণিত।(মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৮০)।
(২)ইমাম তিরমিযীর ঢিলেমিজাত ভুলের উদাহরণ। তিনি বলেনঃ “আমাদেরকে মুসলিম ইবনু আমর আবু আমর আল হাযযা মাদানী বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ ইবনু নাফী আস সাইগ বলেন, তিনি কাসীর ইবনু আব্দুল্লাহ থেকে তার পিতা থেকে তার দাদা(আমর ইবনু আউফ) থেকে বলেন, “নবী আকরাম দুই ঈদে প্রথম রাকায়াতে কুরআন পাঠের পূর্বে ৭ এবং দ্বিতীয় রাকায়াতে কুরআন পাঠের পূর্বে ৫ তাকবীর বলেছেন। (তিরিমিযী, আস-সুনান ২/৪১৬)।
হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম তিরমিযীর বলেনঃ কাসীরের দাদার হাদীসটি হাসান। এই বিষয়ে যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে এই হাদীসটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। (তিরিমিযী, আস-সুনান ২/৪১৬)।
এভাবে তিনি এই হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, তার মতে এই বিষয়ে এটিই হলো সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হাদীস।
মুহাদ্দিসগণ ইমাম তিরমিযীর এই প্রবল মতের বিরোধিতা করেছেন। কারণ, মুহাদ্দিসগণ এই হাদীসের বর্ণনাকারী কাসীর ইবনু আব্দুল্লাহকে অত্যন্ত দুর্বল রাবী বলে গণ্য করেছেন। উপরন্তু অনেকেই তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম ইবনু হাম্বাল বলেনঃ সে অত্যন্ত দুর্বল ও একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বলেনঃ সে দুর্বল। ইমাম আবু দাউদ বলেনঃ লোকটি জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিল। ইমাম শাফেয়ী বলেনঃ সে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদীদের একজন। ইমাম নাসাঈ ও দারাকুতনী বলেনঃ সে পরিত্যক্ত, অর্থাৎ মিথ্যা হাদীস বলার অভিযোগে অভিযুক্ত। ইবনু হিব্বান বলেনঃ সে তার পিতা থেকে দাদা থেকে একটি মিথ্যা হাদীসের পুস্তিকা বর্ণনা করেছে। শুধুমাত্র সমালোচনার প্রয়োজন ছাড়া কোনো গ্রন্থে সে সকল হাদীস উল্লেখ করাও জায়েয নয়। ইবনু আব্দুল বারর বলেনঃ এই ব্যক্তি যে দুর্বল সে বিষয়ে ইজমা বা ঐকমত্য হয়েছে।(ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৮/৩৭৭)।
এজন্য আবুল খাত্তাব উমর ইবনু হাসান ইবনু দাহিয়া(৬৩৩ হি) বলেনঃ “ইমাম তিরমিযী তাঁর গ্রন্থে কত যে মাউযূ বা বানোয়াট ও অত্যন্ত দুর্বল সনদকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এই হাদীসটিও সেগুলির একটি।[যাইলায়ী, আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ(৭৬২ হি)]।
(৩) ইমাম হাকীম এর মুসতাদরাক এর উদাহরণ। হাদীসকে সহীহ বলার ক্ষেত্রে হাকীমের দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। তিনি তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থে অনেক জাল হাদীসকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।
একটি উদাহরণ দেখুনঃ হাকিম বলেন, আমাদেরকে আবুল হাসান আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু উকবা শাইবানী কুফায় অবস্থানকালে বলেছেন, আমাদেরকে কাযী ইবরাহীম ইবনু আবিল আনবাস বলেছেন, আমাদেরকে সাঈদ ইবনু উসমান আল খাররায বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুর রাহমান ইবনু সাঈদ আল মুয়াযযিন বলেছেন, আমাদেরকে কাতার ইবনু খালীফাহ বলেছেন, আবুত তুফাইল থেকে, তিনি আলী ও আম্মার(রা) থেকে: তাঁরা উভয়ে বলেনঃ “নবী ফরয সালাতসমূহে জোরে জোরে (সশব্দে) ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করতেন এবং তিনি সালাতুল ফযরে কুনুত পাঠ করতেন……।”
ইমাম হাকিম হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, “এই হাদীসটির সনদ সহীহ। এর রাবীদের মধ্যে কেউ দুর্বল বলে গণ্য হয়েছেন বলে জানিনা।”(হাকিম, আল মুসতাদরাক ১/৪৩৯)।
ইমাম যাহাবী, যাইলায়ী, ইবনু হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিস হাকিমের এই সিদ্ধান্ত ভুল বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী বলেন, এই হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল, মাউযূ বা জাল বলেই প্রতীয়মান হয়। সনদের দুইজন রাবী অত্যন্ত দুর্বলঃ (১)সাঈদ ইবনু উসমান আল খাররায এবং (২) তার উস্তাদ আব্দুর রাহমান ইবনু সাঈদ আল মুয়াযযিন। (হাকিম, আল মুসতাদরাক ১/৪৩৯)।
এইরূপ আরো উদাহরণ আমরা দ্বিতীয় পর্বে দেখতে পাব ইনশাআল্লাহ।
(৪)দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী। ইলম হাদীসের বিভিন্ন ময়দানে তাঁর খেদমত রয়েছে। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ বিভিন্নভাবে তাঁর গ্রন্থাবলীর উপর নির্ভর করেন। তিনি তাঁর প্রণীত ও সংকলিত ‘আল জামি’ আস-সগীর’, ‘আল জামি’ আল-কাবীর’ ‘আল খুসাইসুল কুবরা’ বিভিন্ন গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি এ সকল গ্রন্থে সহীহ ও যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করবেন তবে কোনো জাল হাদীস নয়। কিন্তু পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তাঁর এ সকল গ্রন্থে কিছু জাল হাদীসও দেখতে পেয়েছেন। বিশেষত, ইমাম সুয়ূতী নিজেই জাল হাদীসের বিষয়ে অনেকগুলো বই লিখেছেন। বেশ কিছু হাদীস ইমাম সুয়ূতী জাল বলে চিহ্নিত করে জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থে সংকলন করেছেন। আবার তিনি নিজেই সেগুলিকে ‘আল জামি’ আস-সগীর’, ‘আল জামি’ আল-কাবীর’ ‘আল খুসাইসুল কুবরা’ গ্রন্থাদিতে সংকলিত করেছেন।
একটি উদাহরণ দেখুন। পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী(৪২৭ হি) ও আহমদ ইবনু আলী খাতীব বাগদাদী (৪৬৩ হি) একটি হাদীস সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে তৃতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী ইসহাক ইবনুস সালত হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এই ইসহাক ইবনুস সালত বলেন, আমাদেরকে ইমাম মালিক ইবনু আনাস বলেছেন, আমাদেরকে আবুয যুবাইর মাক্কী বলেছেন, আমাদেরকে জাবিন ইবনু আব্দুল্লাহ(রা) বলেছেন, “আমি রাসূলুল্লাহ(স) হতে এমনি তিনটি (অলৌকিক) বিষয় দেখেছি যে, তিনি কুরআন আনয়ন না করলেও আমি তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করতাম। (একবার) আমরা এক দূরবর্তী মরূভূমিতে গমন করি। তখন নবী(স) ইসতিনজার পানি হাতে নিলেন। তিনি দুইটি খেজুরগাছ দেখে আমাকে বললেন, হে জাবির, তুমি গাছ দুটির নিকট যেয়ে তাদেরকে বল, তোমরা একত্রিত হও। এতে গাছ দুইটি এমনভাবে একত্রিত হয়ে গেল যেন তার একই মূল হতে উৎপন্ন। তখন রাসূলুল্লাহ(স) ইসতিনজা সম্পন্ন করলেন। আমি তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে তাকে দিলাম। আর আমি বললাম, তাঁর পেট থেকে যা বের হয়েছে তা হয়ত আল্লাহ আমাকে দেখাবেন এবং আমি তা ভক্ষণ করব। কিন্তু আমি দেখলাম যে, মাটি পরিস্কার সাদা। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি ইসতিনজা করেননি? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তবে আমাদের নবীগণের বিষয়ে যমীনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আমাদের থেকে মলমূত্র যা নির্গত হবে তা আবৃত করে ফেলতে……।”
ইমাম মালিক ছিলেন দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস। অগণিত মুহাদ্দিস তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা করেছেন। মূলত, সেই সময়ের সকল মুহাদ্দিসই তাঁর নিকট হতে হাদীস শিখেছেন। অনেকেই বছরের পর বছর তাঁর সান্যিধ্যে থেকে হাদীস শিখেছেন। এ সকল অগণিত ছাত্রের কেউই এই হাদীসটি বর্ণনা করেননি। অনুরূপভাবে তাবিয়ী আবুয যুবাইর বা সাহাবী জাবির (রা) থেকেও অন্য কোনো সূত্রে তা বর্ণিত হয়নি। একমাত্র ইসহাক ইবনুস সালত নামক এই ব্যক্তি দাবি করেছেন যে, ইমাম মালিক তাকে হাদীসটি বলেছেন। এই ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল ও বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী বলে চিহ্নিত হয়েছেন। আরো লক্ষণীয় হলো, এই ইসহাকের বর্ণনাও তৃতীয় বা চতুর্থ শতকে কোনোরূপ প্রসিদ্ধি বা পরিচিতি লাভ করেনি। ৫ম শতকে কেউ কেউ হাদীসটি বর্ণনা করেননি। জুরজানী ও খতীব হতে ইসহাক পর্য্ন্ত সনদও অন্ধকারাচ্ছন্ন। এজন্য খতীব বাগদাদী, হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী, যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিসের মতামতের আলোকে ইমাম সুয়ূতী নিজেই হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন এবং জাল বিষয়ক ‘যাইলুল লাআলী’ নামক গ্রন্থে তিনি তা উল্লেখ করেছেন।
আবার তিনি নিজেই রাসূলুল্লাহ(স) এর মুযিজা, অলৌকিকত্ব ও বৈশিষ্ট্যাবলী বিষয়ক ‘আল-খুসাইসুল কুবরা’ নামক গ্রন্থে এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি দাবী করেছেন যে, এই গ্রন্থে তিনি কোনো মাউযূ বা জাল হাদীস উল্লেখ করবেননা। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তাঁর এই স্ববিরোধিতা ও হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে তাঁর ঢিলেমেরি কথা উল্লেখ করেছেন।(হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী, তারীখ জুরজান, পৃ. ৫২৬, সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৫০)।