২.১২. মৃত্যু, জানাযা ইত্যাদি বিষয়ক
১. প্রতিদিন ২০ বার মৃত্যুর স্মরণে শাহাদাতে মর্যাদা
আমাদের দেশে ওয়াযে ও বিভিন্ন পুস্তকে বহুল প্রচলিত একটি কথাঃ “যে ব্যক্তি মৃত্যুকে দৈনিক বিশবার স্মরণ করবে সে শহীদগণের সঙ্গী হবে বা শহীদের মর্যাদা পাবে।”
মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, কথাটি সনদবিহীন বানোয়াট কথা।(তাহের ফাতানী, তাযকিরা পৃ. ২১৩; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ ১/৩৩৬)।
২. মৃত্যু কষ্টের বিস্তারিত বিবরণ
মৃত্যুর যন্ত্রণা বা কষ্ট বা সাতরাতুল মাওত বিষয়ক কিছু কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মৃত্যু যন্ত্রণার বিস্তারিত বিবরণ, তুলনা, উদাহরণ, প্রত্যেক অঙ্গের সাথে আত্মার কথাবার্তা ইত্যাদি বিষয়ক প্রচলিত হাদীসগুলি কিছু বানোয়াট ও কিছু অত্যন্ত দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। (তাহের ফাতানী, তাযকিরা, পৃ. ২১৩-২১৪)।
৩. ইবরাহীম (আ) এর মৃত্যুযন্ত্রণা
একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, ইবরাহীম(আ) যখন তাঁর প্রভুর সাথে সাক্ষাত করেন তখন তিনি বলেন, হে ইবরাহীম, মৃত্যুকে কেমন বোধ করলে? তিনি বলেন, আমার অনুভব হলো যে, আমার চামড়া টেনে তুলে নেওয়া হচ্ছে। তখন আল্লাহ বলেন, তোমার জন্য মৃত্যু যন্ত্রণাকে সহজ করা হয়েছিল, তারপরেও এরূপ….।
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি মিথ্যা ও জাল।(ইবনুল জাউযী, আল মাঊদূআত ২/৩৯৬; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/৩৬২)।
৪. চারিদিক থেকে জানাযা বহন বা মৃতের অনুগমন
আমাদের মধ্যে অতি প্রচলিত রেওয়াজ হলো, মৃতদেহ দাফনের জন্য বহন করার সময় একই ব্যক্তি ঘুরে ঘুরে চারিদিক থেকে বহন করেন। এ বিষয়ে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, “যদি কেউ চারিদিক হতে মৃতের অনুগমন করেন বা চারিদিক থেকে মৃতের খাটিয়া বহন করেন তাহলে আল্লাহ তার চল্লিশটি কবীরা গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন।”
ইবনুল জাওযী, আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এই অর্থের হাদীসকে মাউযূ বা মুনকার ও অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে সুয়ূতী, ইবনু ইরাক প্রমুখ মুহাদ্দিস এই অর্থের হাদীসকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। (ইবনুল জা্ওযী, আল মাঊদূআত ২/৩৮৩; সুয়ূতী, আল লাআলী ২/৪০৫)।
৫. নেককার মানুষদের পাশে কবর দেওয়া
একটি প্রচলিত জাল হাদীসে বলা হয়েছেঃ “তোমরা মৃতদেরকে নেককার মানুষদের মাঝে দাফন করবে; কারণ জীবিত মানুষ যেমন খারাপ প্রতিবেশি দ্বারা কষ্ট পায়, মৃত মানুষও তেমনি খারাপ প্রতিবেশি দ্বারা কষ্ট পায়।” হাদীসটির সনদে মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। (ইবনুল জাওযী, আল মাঊদূআত ২/৪১১-৪১২; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/৩৭৩; আলবানী, যয়ীফাহ ২/৩৮-৩৯, ৭৯-৮২)।
৬. কবর যিয়ারতের ফযীলত
কবর যিয়ারত করা একটি সুন্নাত নির্দেশিত নফল ইবাদত। রাসূলুল্লাহ(সা) নিজে মাঝে মাঝে কবর যিয়ারত করতেন। এছাড়া তিনি আখেরাতের স্মরণ, মৃত্যুর স্মরণ ও মৃতব্যক্তির সালাম ও দোয়ার জন্য কবর যিয়ারত করতে উম্মাতকে অনুমতি ও উৎসাহ দিয়েছেন।(বুখারী, আস সহীহ ১/৪৩০; মুসলিম আস সহীহ ১/২১৮, ৩/১৫৬৩)।
এই সাধারণ সাওয়াব ছাড়া যিয়ারতের বিশেষ সাওয়াবের বিষয়ে কিছু জাল হাদীস প্রচলিত রয়েছে। যেমনঃ “যদি কোনো ব্যক্তি তার পিতা, মাতা, ফুফু, খালা বা কোনো আত্মীয়ের কবর জিয়ারত করে তবে তার জন্য একটি মাবরূর হজ্জের সাওয়াব লিখা হবে……।”(ইবনুল জাওযী, আল মাঊদূ‘আত ২/৪১৩-৪১৪; সুয়ূতী, আল লাআলী ২/৪৪০)।
৮. শুক্রবারে কবর যিয়ারতের বিশেষ ফযীলত
কবর যিয়ারত যে কোনো দিনে বা যে কোনো সময়ে করা যেতে পারে। কোনো বিশেষ দিনে বা বিশেষ সময়ে কবর জিয়ারতের জন্য বিশেষ ফযীলতের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এ বিষয়ে একটি প্রচলিত হাদীসঃ “যদি কোনো ব্যক্তি প্রত্যেক শুক্রবারে তার পিতামাতার বা একজনের কবর যিয়ারত করে তবে তার পাপ ক্ষমা করা হবে এবং তাকে পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হবে।”
হাদীসটি ইমাম তাবারানী প্রমুখ মুহাদ্দিস লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁরা হাদীসটি মুহাম্মাদ ইবনু নু’মান ইবনু আবদুর রাহমান এর সূত্রে সংকলন করেছেন। মুহাম্মাদ ইবনু নু’মান ইয়াহইয়া ইবনুল আলা আল বাজালী থেকে, তিনি আবদুল কারীম ইবনু আবীল মাখারিক থেকে, তিনি মুজাহিদ থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা(রা) হতে হাদীসটি সংকলন করেছেন।
বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবনু নু’মান অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার উস্তাদ হিসেবে উল্লেখিত ইয়াহইয়া ইবনুল আলা আল বালাজী পরিত্যক্ত ও মিথ্যায় অভিযুক্ত রাবী। ইমাম আহমদ, ওকী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে স্পষ্টভাবে মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে অভিহিত করেছেন। তার উস্তাদ হিসেবে উল্লেখিত ‘আব্দুল কারীম’ ও অত্যন্ত দুর্বল রাবী হিসেবে পরিচিত। এভাবে আমরা দেখেছি যে, হাদীসটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল। বিশেষত ইয়াহইয়া নামক এই মিথ্যাবাদী রাবীর কারণে হাদীসটি জাল বলে গণ্য হয়। (তাবারানী, আল মাউসাত ৬/১৭৫; আস-সগীর ২/১৬০; সুয়ূতী আল লাআলী ২/৪৪০; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/৩৭৩; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ ১/৩৪৫)।
৭. কবর যিয়ারতের সময় সূরা ইয়াসীন পাঠ
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, কবর যিয়ারতের সময় রাসূলুল্লাহ(সা) “আস-সালামু আলাইকুম দারা কাওমিন মুমিনীন…..” বা অনুরূপ বাক্য দ্বারা কবরবাসীকে সালাম প্রদান করতেন। এবং সালামের সাথেই সংক্ষিপ্ত কয়েকটি শব্দে দোয়া পাঠ করতেন। তিনি সাহাবীগণকে এভাবে সালাম দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, একরাতে তিনি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে হাত তুলে মৃতদের জন্য দোয়া করেন।(এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৩৫৪-৩৫৫)।
এভাবে সালাম ও দোয়া ছাড়া কবর যিয়ারতের সময় কুরআন তিলাওয়াত ও কোনো সূরা পাঠের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। কোনো কোনো ফকীহ যিয়ারতের পূর্বে আয়াতুল কুরসী, সূরা ইখলাস ইত্যাদি পাঠ করার কথা বলেছেন। তবে এ বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ক জাল হাদীসগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
“যদি কেউ তার পিতামাতা বা উভয়ের একজনের কবর শুক্রবারে যিয়ারত করে এবং (তার কাছে)সূরা ইয়াসীন পাঠ করে, তবে তাকে ক্ষমা করা হবে।(পঠিত আয়াত বা অক্ষরের সংখ্যায় তাকে ক্ষমা করা হবে)।”
ইবুন আদী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। তাঁরা আমর ইবনু যিয়াদ নামক এক রাবীর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এই ব্যক্তি বলেন, আমাদেরকে ইয়াহইয়া ইবনু সুলাইম বলেন, আমাদেরকে হিশাম ইবনু উরওয়া বলেন, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি আয়েশা(রা) থেকে, তিনি আবূ বাকর(রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ(সা) থেকে…..।
এই হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী ‘আমর ইবনু যিয়াদ’ নামক এই ব্যক্তিকে মুহাদ্দিসগণ মিথ্যাবাদী, জালিয়াত ও হাদীস চোর বলে স্পষ্টত উল্লেখ করেছেন। এজন্য ইবুন আদী, যাহাবী, ইবনুল জাওযী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন। ইমাম সুয়ূতী এই হাদীসটিকে উপরে উল্লেখিত শুক্রবারে কবর যিয়ারত বিষয়ক হাদীসের সমার্থক বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আব্দুর রাউফ মুনাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর কথার প্রতিবাদ করে বলেন, প্রথমত, উভয় হাদীসের মধ্যে অর্থগত পার্থক্য রয়েছে। দ্বিতীয়ত, উভয় হাদীসের সনদেই জালিয়াত রাবী রয়েছে। জাল হাদীসের ক্ষেত্রে একাধিক হাদীসের সমন্বিত অর্থ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে না।(ইবনু আদী, আল কামিল ৫/১৫১; ইবনুল জাউযী, আল মাঊদূ‘আত ২/৪১৩)।
৮. কবর যিয়ারতের সময় সূরা ইখলাস পাঠ
প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে রয়েছেঃ “কবরস্থানে যেয়ে সূরা ইখলাস ১১ বার পাঠ করে মৃত ব্যক্তিগণের রূহের বখশিয়া দিলে সেই ব্যক্তি কবরস্থানের সমস্ত কবরবাসীর সমসংখ্যক নেকী লাভ করবে।” মূলত কথাটি একটি জাল হাদীসের প্রচলিত অনুবাদ। এই জাল হাদীসটিতে বলা হয়েছেঃ “যদি কেউ গোরস্থানের নিকট গমন করার সময় ২১ বার সূরা ইখলাস পাঠ করে তার সাওয়াব মৃতগণকে দান করে তবে মৃতগণের সংখ্যার সমপরিমাণ সওয়াব তাকে প্রদান করা হবে।” মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল ও বানোয়াট।(সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১৪৪; আলবানী, যায়ীফাহ ৩/৪৫২-৪৫৪)।
৯. মৃত্যুর সময় শয়তান পিতামাতার রূপ ধরে বিভ্রান্তির চেষ্টা করে
সাধারণের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, মৃত্যুপথযাত্রীর নিকট শয়তান তার পিতামাতার রূপ ধরে এবং তাকে বিভিন্ন ওয়াসওয়াসার মাধ্যমে বিপথগামী করার চেষ্টা করে। ইমাম সুয়ূতী, ইবনু হাজার মাক্কী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এ বিষয়ে কোনো কথা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।(আলবানী, আহকামুল জানাইয, পৃ. ২৪৩)।
১০. গায়েবানা জানাযা আদায় করা
যে মৃতব্যক্তির মৃত্যুর স্থানে একবার জানাযার সালাত আদায় করা হয়েছে তার জন্য পুণরায় ‘গায়েবী জানাযা’ আদায় করার পক্ষে কোনরূপ হাদীস বর্ণিত হয় নি। বরং এই কর্মটি সুন্নাত বিরোধী একটি কর্ম। এহইয়াউস সুনান গ্রন্থে এ বিষয়ক বিস্তারিত উল্লেখ করছি।(এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৩৩৫; আলবানী, আহকামুল জানাইয, পৃ. ২৫২)।
খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া রচিত ‘রাহাতুল কুলুব’ নামক পুস্তকে তিনি লিখেছেন যে, তাঁর মুর্শিদ খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জেশক্কর বলেনঃ “গায়েবানা জানাযা পড়ার বিধান রয়েছে। কেননা আমিরুল মোমেনীন হযরত হামযা ও অন্যান্যরা যখন শহীদ হলেন তখন হুজুর পাক(সা) তাঁদের জন্য গায়েবানার জানাযার নামাজ পাঠ করেছিলেন। এমনকি প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক ভাবে পড়েছিলেন। (খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল কুলুব, পৃ. ১২৬ (বিংশ মাজলিশ)।)।
এ সকল কথা কি সত্যই খাজা নিযামুদ্দীন(রাহ) লিখেছেন না তাঁর নামে জালিয়াতি করা হয়েছে তা আমরা জানি না। তবে সর্বাবস্থায় এগুলি একেবারে ভিত্তিহীন কথা। একজন সাধারণ মুসলিম জানেন যে, হামযা(রা) উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন এবং রাসূলুল্লাহ(সা) স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
১১. মৃত লাশকে সামনে রেখে উপস্থিতগণকে প্রশ্ন করা
আমাদের দেশে অনেক সময় সালাতুল জানাযা আদায়ের পূর্বে বা পরে মৃতদেহ সামনে রেখে উপস্থিত মুসল্লীগণকে প্রশ্ন করা হয়, লোকটি কেমন ছিল? সকলেই বলেনঃ ভাল ছিল……ইত্যাদি। এই কর্মটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। হাদীস শরীফে এরূপ কোনো কর্মের উল্লেখ নাই। হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে যদি মানুষেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশংসা করেন তবে তা সেই ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর বলে গণ্য হবে।(বুখারী, আস-সহীহ ১/৪৬০; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৫৫)।
১২. মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেওয়া
প্রচলিত আরেকটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কর্ম হলো মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেওয়া। কোনো সহীহ যয়ীফ বা মাঊযূ হাদীসেও এইরূপ কোনো কথা রাসূলুল্লাহ(সা) বা কোনো সাহাবী থেকে বর্ণিত হয় নি। এমনকি নামাযের ওয়াক্ত ছাড়া অন্য কোনো কারণে আযান দেওয়ার কোনো ফযীলতও কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
১৩. ভূত-প্রেতের ধারণা
আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও ইসলাম বিরোধী ধারণা হলো ভূত-প্রেতের ধারণা। মৃত মানুষের আত্মা ভূত বা প্রেত হয়ে বা অন্য কোনোভাবে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, অবস্থান করে, ভাল বা মন্দ করতে পারে……ইত্যাদি সকল কথাই জঘন্য মিথ্যা ও ইসলামী বিশ্বাসের বিপরীত কথা। এই জাতীয় বাতিল কথা হলো, মৃতের আত্মা তার মৃত্যুর স্থানের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়……ইত্যাদি।
১৪. মৃত্যুর পরে লাশের নিকট কুরআন তিলাওয়াত করা
মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ মুহুর্তগুলিতে সূরা ইয়াসীন পাঠ করে শুনানোর বিষয়ে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (আবূ দাউদ, আস সুনান ৩/১৯১)। কিন্তু মৃত্যুর পরে লাশের নিকট কুরআন তিলাওয়াত করার বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস বর্ণিত হয় নি।
১৫. লাশ বহনের সময় সশব্দে কালিমা, দোয়া বা কুরআন পাঠ
এটি একটি বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও সুন্নাতের বিপরীত কর্ম। লাশ বহনের সময় পরিপূর্ণ নীরবতাই সুন্নাত। মনের গভীরে শোক ও মৃত্যুচিন্তা নিয়ে পথ চলতে হবে। পরস্পরে কথাবার্তা বলাও সুন্নাত বিরোধী। ইমাম নববী বলেন, লাশ বহনের সময় সম্পূর্ণ নীরব থাকাই হলো সুন্নাত সম্মত সঠিক কর্ম যা সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগের মানুষদের রীতি ছিল। প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা কাসানী বলেনঃ “লাশের অনুগমনকারী তার নীরবতাকে প্রলম্বিত করে। এ সময় সশব্দে যিকর করা মাকরূহ। কাইস ইবনু উবাদাহ বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(সা) এর সাহাবীগণ তিন সময়ে শব্দ করতে অপছন্দ করতেন: যুদ্ধ, জানাযা এবং যিকর। এছাড়া লাশ বহনের সময় সশব্দে যিকর করা ইহুদী নাসারাগণের অনুকরণ; এজন্য তা মাকরূহ।(কাসানী, বাদাউস সানাই ১/৩১০)।
১৬. কবরের নিকট দান সাদকা করা
হাদীস শরীফে সন্তানকে তার পিতামাতার জন্য দান সাদকা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই দান কবরের নিকট করলে কোনো অতিরিক্ত সাওয়াব বা সুবিধা আছে বলে কোনো হাদীসে কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। বিশ্বের যে কোনো স্থান হতে দান করলে একই অবস্থা।
১৭. সন্তান ছাড়া অন্যদের দান সাদকা
এখানে আরো লক্ষ্যণীয় যে, সন্তান-সন্ততি বা পরিবারবর্গ ছাড়া অন্য কেউ দান করলে মৃত ব্যক্তি সাওয়াব পাবেন বলে কোনো হাদীসে কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় বা করা হয় সবই আলিমদের মতামতভিত্তিক, অথবা মনগড়া বা বানোয়াট।
কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুমিনগণের দায়িত্ব হলো মৃত মুমিনগণের জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করা। আর সন্তানদের দায়িত্ব হলো মৃত পিতামাতার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার ছাড়াও দান করা। সন্তান-সন্ততি ছাড়া অন্যান্য মানুষ দোয়া করলে মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন বলে আমরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিশ্চিত জানতে পারি। কিন্তু সন্তান ছাড়া কেউ দান করলে মৃত ব্যক্তি সাওয়াব পাবেন বলে কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি।
তবে অধিকাংশ আলিম মনে করেন যে, সন্তানের দানের সাওয়াব যেহেতু মৃত ব্যক্তি লাভ করবেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু আমরা আশা করতে পারি যে, অন্যান্য মানুষের দানের সাওয়াবও মৃত ব্যক্তি পেতে পারেন। কোনো কোনো আলিম বলেন যে, এক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসের বাইরে আশা পোষণের কোনো ভিত্তি বা যুক্তি নেই। কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে কোনো মুসলিম যে কোনো মৃত মুসলিমের জন্য দোয়া করবেন। আর সন্তান সন্ততি পিতামাতার জন্য দোয়া করা ছাড়াও দান করবে। আমাদের এর বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। (এ বিষয়ক আয়াত, হাদীস ও আলিমদের মতামত বিস্তারিত দেখুনঃ ইবনুল কাইয়িম, আর রূহ, পৃ. ৩৫৩-৪০৯; সুয়ূতী, শরাহুস সুদূর, পৃ. ৩০১-৩১৪)।
অধিকাংশ আলিমের ‘আশা’ মেনে নিলেও এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। যেহেতু কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারছি যে, দোয়া ও ইসতিগফার করলেই মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন এবং দোয়ার বিনিময়েই তাকে নেকী ও সাওয়াব দান করা হবে, সেহেতু কুরআন ও হাদীসের নির্দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কি? যেহেতু আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারছি যে, ‘হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তিকে আপনি ক্ষমা করুন, তাঁকে মর্যাদা দান করুন….ইত্যাদ ‘ বলে দোয়া করলেই সে ব্যক্তি উপকৃত হবেন, তখন আমাদের প্রয়োজন কি যে আমরা বলব-“হে আল্লাহ, আমাদের এই দানের সাওয়াব অমুককে প্রদান করুন এবং এর বিনিময়ে তাকে ক্ষমা করুন, মর্যাদা, নেকি দান করুন”?
সম্ভবত আমরা মনে করি যে, দান-সাদকাসহ দোয়া করলে মৃতব্যক্তি বেশি সাওয়াব লাভ করবে। ‘গাইবী’ বিষয়ে নিজেরা ‘মনে’ করার চেয়ে ‘ওহী’-র উপর নির্ভর করা উত্তম। কুরআন ও হাদীসে দোয়া ও ইসতিগফারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, রাসূলুল্লাহ(সা) নিজে আজীবন অগণিত মুমিন-মুমিনার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করেছেন, কিন্তু কখনোই শেখান নি যে, কবর যিয়ারত বা অন্য সময় মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া-ইসতিগফারের পূর্বে, পরে বা অন্য সময়ে কিছু দান-সাদকা বা খানা বিতরণ করা ভাল। তিনি নিজেও তা কখনো করেন নি এবং কাউকে তা শিক্ষাও দেন নি। সাহাবীগণও মৃতদের জন্য দোয়া-ইসতিগফার করেছেন এবং কবর যিয়ারত করেছেন কিন্তু কখনোই কবরের পাশে বা অন্য কোথাও মৃতদের ‘সাওয়াব রেসানী’-র জন্য দান খয়রাত করেছেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয় নি। আমাদের উচিত সুন্নাতের শিক্ষার মধ্যে থাকা। সকল মুমিনই নিজের সাওয়াব অর্জন, বিপদ মুক্তি ও বরকতের জন্য সর্বদা বেশি বেশি দান সাদকা করতে চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি সন্তান সন্ততি তাদের পূর্ব পুরুষদের জন্য দোয়া, ইসতিগফার ও দান করবে। আর অন্য সকল মুসলমান সকল মৃত মুমিন-মুমিনার জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করবে।
১৮. মৃতের জন্য জীবিতদের হাদিয়া
প্রচলিত ওয়ায আলোচনায় একটি হাদীসে বলা হয় যে, মৃতব্যক্তি হলো ডুবন্ত মানুষের মত, জীবিতদের পক্ষ হতে কুরআন, কালিমা, দান-খয়রাত ইত্যাদির সাওয়াব হাদিয়া পাঠালে সে উপকৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে হাদীসটিতে শুধু দোয়া-ইসতিগফারের কথা বলা হয়েছে, বাকি কথাগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। মূল হাদীসটিও অত্যন্ত দুর্বল। ইমাম বাইহাকী তৃতীয় শতকের একজন অজ্ঞাত পরিচয় রাবী মুহাম্মাদ ইবনু জাবির ইবনু আবী আইয়াশ আল মাসীসীর সূত্রে হাদীসটি সংকলন করেছেন। এই ব্যক্তি বলেন, তাকে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, তাকে ইয়াকূব ইবনু কা’কা বলেছেন, মুজাহিদ থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস থেকে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “ডুবন্ত ত্রাণপ্রার্থী ব্যক্তির যে অবস্থা, অবিকল সেই অবস্থা হলো কবরের মধ্যে মৃতব্যক্তির। সে দোয়ার অপেক্ষায় থাকে, যে দোয়া কোনো পিতা মাতা, ভাই বা বন্ধুর পক্ষ হতে তারা কাছে পৌঁছাবে। যখন এরূপ কোনো দোয়া তাঁর কাছে পৌছে তখন তা তার কাছে দুনিয়া ও তন্মধ্যস্থ সকল সম্পদের চেয়ে প্রিয়তর বলে গণ্য হয়। এবং মহিমাময় পরাক্রমশালী আল্লাহ পৃথিবীবাসীদের দোয়ার কারণে কবরবাসীদের পাহাড় পরিমাণ(সাওয়াব) দান করেন। আর মৃতদের জন্য জীবিতদের হাদিয়া হলো তাদের জন্য ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা।”
ইমাম বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, একমাত্র মুহাম্মাদ ইবনু জাবির ইবনু আবী আইয়াশ নামক এই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সূত্রে কোনোভাবে এই হাদীসটি বর্ণিত হয় নি।(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৬/২০৩, ৭/১৬)। ইমাম যাহাবী এই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেনঃ “এই ব্যক্তির কোনো পরিচয়ই আমি জানতে পারি নি। এই ব্যক্তি বর্ণিত হাদীসটি অত্যন্ত আপত্তিকর বা খুবই দুর্বল((منكر جد \ ।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/৮৬; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ৫/৯৯; আলবানী, যায়ীফাহ ২/২১১)।
১৯. মৃতের জন্য খানাপিনা দান বা দোয়ার অনুষ্ঠান
মৃত ব্যক্তির জন্য মৃত্যুর পরে ৩য় দিন, ৫ম দিন, ৭ম দিন, ৪০ তম দিন বা অন্য যে কোনো দিনে, মৃত্যু দিনে বা জন্মদিনে খানাপিনা, দান-সাদকা, দোয়া খাইর ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত রীতি। তবে রীতিটি একেবারেই বানোয়াট। এ সকল বিষয়ে মৃতের জন্য কোনো অনুষ্ঠান করার বিষয়ে কোনো প্রকার হাদীস বর্ণিত হয় নি। কোনো মানুষের মৃত্যুর পর কখনো কোনো প্রকার অনুষ্ঠান করার কোনো প্রকার নির্দেশনা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। সদা সর্বদা বা সুযোগমত মৃতদের জন্য দোয়া করতে হবে। সন্তানগণ দান করবেন। এবং সবই অনানুষ্ঠানিক। এ বিষয়ে ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।(পৃ. ৩৪৭-৩৫৯)।
২০. অসুস্থ ও মৃত ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন প্রকারের খতম
খতমে তাহলীল, খতমে তাসমীয়া, খতমে জালালী, খতমে খাজেগান, খতমে ইউনূস ইত্যাদি সকল প্রকার খতম-ই পরবর্তীকালে বানানো। এ বিষয়ে হাদীস নামে প্রচলিত বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছেঃ “হাদীস শরীফে আছে. হযরত(সা) ফরমাইয়াছেন, যখন কেহ নিম্নোক্ত কলেমা(লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়িয়া কোনো মৃত ব্যক্তির রূহের উপর বখশিশ করিয়া দিবে, তখন খোদাতাআলা নিশ্চয়ই উহার উছিলায় তাহাকে মার্জনা করিয়া দিবেন ও বেহেশতে স্থান দিবেন। (গোলাম রহমান, মোকছুদোল মো‘মেনীন পৃ. ৪০৭)। এগুলি সবই বানোয়াট কথা।
২১. মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন খতম
আমাদের দেশের অতি প্রচলিত কর্ম হলো কেউ ইন্তিকাল করলে তার জন্য কুরআন খতম করা। এই কর্মটি কোনো হাদীস ভিত্তিক কর্ম নয়। কোনো মৃত মানুষের জন্য রাসূলুল্লাহ(সা) ও সাহাবীগণ কখনোই কুরআন খতম করেন নি। এছাড়া কারো জন্য কুরআন খতম করলে তিনি সাওয়াব পাবেন এরূপ কোনো কথাও কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
আমরা আগেই উল্লেখ করছি যে, কুরআন ও হাদীসে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সন্তানগণকে মৃত পিতামাতার জন্য দান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে ঋণ পরিশোধ, সিয়াম পালন, হজ্জ ও উমরা পালনের কথাও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন খতম, তাসবীহ তাহলীল পাঠ ইত্যাদি ইবাদতের কোনো নির্দেশনা হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তবে অধিকাংশ আলিম বলেছেন যে, যেহেতু দান, সিয়াম, হজ্জ, উমরা ও দোয়ার দ্বারা মৃত ব্যক্তি উপকৃত হবেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে সেহেতু আশা করা যায় যে, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ তাহলীল ইত্যাদি ইবাদত দ্বারাও তারা উপকৃত হবেন। তবে এজন্য আনুষ্ঠানিকতা, খতম ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
২২. দশ প্রকার লোকের দেহ পচবে না
প্রচলিত একটি পুস্তকে রয়েছেঃ “হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে যে, নিম্নলিখিত দশ প্রকারের দেহ পঁচবে নাঃ ১. পয়গম্বর, ২. শহীদ, ৩. আলিম, ৪. গাজী, ৫. কুরআনের হাফেজ, ৬. মোয়াযযিন, ৭. সুবিচারক বাদশাহ বা সরদার, ৮. সূতিকা রোগে মৃত রমনী, ৯. বিনা অপরাধে যে নিহত হয়, ১০. শুক্রবারে যার মৃত্যু হয়।(মৌলভী শামছুল হুদা, নেয়ামুল কোরআন ২৪৫)।
এদের অনেককেই হাদীসে শহীদ বলা হয়েছে। তবে একমাত্র নবীগণ বা পয়গম্বরগণের দেহ মাটিতে পচবে না বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। অন্য নয় প্রকারের মৃতগণের মৃতদেহ না পচার বিষয়ে কোনো হাদীস আছে বলে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেও জানতে পারি নি। মহান আল্লাহই ভাল জানেন।