১.৮. মিথ্যা হাদীস বিষয়ক কিছু বিভ্রান্তি
১.৮.১. হাদীস গ্রন্থ বনাম জাল হাদীস
অজ্ঞতা বশত অনেকে মনে করেন যে, কোনো হাদীস কোনো হাদীস গ্রন্থে সংকলিত থাকার অর্থ হলো হাদীসটি সহীহ, অথবা অন্তত উক্ত গ্রন্থের সংকলকের মতে হাদীসটি সহীহ। যেমন কোনো হাদীস যদি সুনাসু ইবনু মাজাহ বা মুসান্নুফূ আবদুর রাযযাক গ্রন্থে সংকলিত থাকে তার অর্থ হলো, হাদীসটি নিশ্চয় সহীহ, নইলে ইবনু মাজাহ বা আব্দুর রাযযাকের মত অত বড় মুহাদ্দিস তা গ্রহণ করলেন কেন? অন্তত, ইবনু মাজাহ বা আবদুর রাযযাকের মতে হাদীসটি সহীহ, নইলে তিনি তাঁর গ্রন্থে হাদীসটির স্থান দিতেননা।
আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, এই ধারণাটির উভয় দিকই ভিত্তিহীন। অধিকাংশ মুহাদ্দিসই তাঁদের গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ সকল প্রকার হাদীসই সংকলন করেছেন। তাঁরা কখনোই দাবি করেননি বা পরিকল্পনাও করেননি যে, তাঁদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলন করবেন। কাজেই কোনো হাদীস সুনানে ইবনু মাজাহ বা মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক-এ সংকলিত থাকাতে কখনোই বুঝা যায়না যে, হাদীসটি সহীহ বা ইবনু মাজাহ বা আবদুর রাযযাক এর মতে সহীহ।
ইবনু হিব্বান, ইবনু খুযাইমা, ইবনুস সাকান, হাকিম ও অন্যান্য যে সকল মুহাদ্দিস তাঁদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেছেন, তাঁদের গ্রন্থে কোনো হাদীস সংকলিত হলে আমরা মনে করব যে, হাদীসটি উক্ত মুহাদ্দিসের মতে সহীহ। তবে এতে প্রমাণিত হয়না যে, হাদীসটি প্রকৃতপক্ষে সহীহ। আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি যে, কোনো মুহাদ্দিসের দাবিই উম্মাহর অন্যান্য মুহাদ্দিস নিরীক্ষা ছাড়া গ্রহণ করেননি। এজন্য আমরা অন্যান্য মুহাদ্দিসের নিরীক্ষার আলোকে হাদীসটির বিধান বর্ণনা করব।
আমাদের সমাজে ‘সিহাহ সিত্তাহ’(সিহাহ সিত্তাহ পরিভাষাটি ভারতীয় ব্যবহার।এই ছয়টি গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা সুপরিচিত। তবে গ্রন্থগুলি ‘সহীহ’ নয়। বরং ২টি গ্রন্থ সহীহ এবং বাকিগুলি সুনান। এজন্য মুহাদ্দিসগণের মধ্যে সুপরিচিত পরিভাষা হলো ‘আল কুতুবুস সিত্তা’ ‘পুস্তক ছয়টি’। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও সিহাহ সিত্তা পরিভাষাটি প্রচলিত নয়) নামে প্রসিদ্ধ ৬ টি গ্রন্থের মধ্যে ২টি সহীহ গ্রন্থঃ ‘‘সহীহ বুখারী’’ ও “সহীহ মুসলিম” ছাড়া বাকি ৪টির সংকলক ও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস বর্ণনা করবেন বলে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁরা তাঁদের গ্রন্থগুলিতে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক দুর্বল ও বানোয়াট হাদীসও সংকলন করেছেন। তবে তাঁদের গ্রন্থগুলির অধিকাংশ হাদীস নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারণে পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ সাধারণভাবে তাঁদের গ্রন্থগুলির উপর নির্ভর করেছেন, সাথে সাথে তাঁরা এসকল গ্রন্থে সংকলিত দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছেন। আল্লামা আবদুল হাই লাখনবী(১৩০৪ হি)এক প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেনঃ ‘এই চার গ্রন্থে সংকলিত সকল হাদীস সহীহ নয়। বরং এ সকল গ্রন্থে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও বানোয়াট সকল প্রকারের হাদীস রয়েছে। (আল আজইবাতুল ফাযিলা লিল আসইলাহ আল আশারাতিল কামিলা পৃ. ৬৬)।
ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহর (রহ) বিবরণ দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, তিনি সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী: এই তিনটি গ্রন্থকে তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত করেছেন, যে সকল গ্রন্থের হাদীসসমূহ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলিতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। কিন্তু তিনি ‘সুনান ইবনি মাজাহ’কে এই পর্যায়ে উল্লেখ করেননি। এর কারণ হলো, ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইয়াজীদ ইবনু মাজাহ আল কাযবীনী(২৭৫ হি) সংকলিত ‘সুনান’ গ্রন্থটিকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত করেননি। হিজরী ৭ম শতক পর্য্ন্ত মুহাদ্দিসগণ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অতিরিক্ত এই তিনটি সুনান গ্রন্থকেই মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং হাদীস শিক্ষা ও শিক্ষাদানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন। ৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু তাহির মাকসিদী, আবুল ফাদল ইবনুল কাইসুরানী(৫০৭ হি) এগুলির সাথে সুনান ইবনু মাজাহ যোগ করেন।
তাঁর এই মত পরবর্তী দুই শতাব্দী পর্য্ন্ত মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেননি। ৭ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আবদুর রাহমান(৬৪৩ হি), আল্লামা আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-না্বাবী(৬৭৬ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের মূল উৎস হিসেবে উপরের ৫টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। সুনানে ইবুন মাজাহ কে তাঁরা এর মাঝে গণ্য করেননি। পরবর্তী যুগের অনেক মুহাক্কিক আলিম এদের অনুসরণ করেছেন। অপরদিকে ইমাম ইবনুল আসীর মুবারাক ইবনু মুহাম্মাদ (৬০৬ হি)ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস ৬ষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে ইমাম মালিকের মুআত্তাকে গ্রহণ করেছেন।
সুনান ইবনি মাজাহকে উপরের তিনটি সুনানের পর্যায়ভুক্ত করতে আপত্তির কারণ হলো ইমাম ইবনু মাজাহর সংকলন পদ্ধতি এই তিন গ্রন্থের মত নয়। উপরে তিন গ্রন্থের সংকলক মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছেন। বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে কিছু যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলির দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম ইবনু মাজাহ তৎকালীন সাধারণ সংকলন পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, এ সকল যুগের অধিকাংশ সংকলক সনদসহ প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করতেন। এতে সহীহ, যয়ীফ, মাউদূ সব প্রকারের হাদীসই তাঁদের গ্রন্থে স্থান পেত। সনদ বিচার ছাড়া হাদীসের নির্ভরতা যাচাই করা সম্ভব হতোনা। ইমাম ইবনু মাজাহও মূলত এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি সহীহ বা হাদীস সংকলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ ও কিছু মাউযূ বা বানোয়াট হাদীসও সংকলন করেছেন। তিনি এসকল যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসের ক্ষেত্রে কোনো মন্তব্য করেননি।
৮ম হিজরী শতক থেকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস সুনানে ইবনি মাজাহকে ৪র্থ সুনান গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। মুআত্তা ও সুনান ইবনি মাজাহ এর মধ্যে পার্থক্য হলো, মুআত্তা গ্রন্থের হাদীস সংখ্যা কম এবং এই গ্রন্থের সকল সহীহ হাদীস উপরের ৫টি গ্রন্থের মধ্যে সংকলিত। ফলে এই গ্রন্থটিকে পৃথকভাবে অধ্যয়ন করলে অতিরিক্ত হাদীস জানা যাচ্ছেনা। পক্ষান্তরে সুনান ইবনি মাজাহ এর মধ্যে উপরের ৫টি গ্রন্থের অতিরিক্ত সহস্রাধিক হাদীস রয়েছে। এজন্যই পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ এই গ্রন্থটিকে ৪র্থ সুনান হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
ইমাম ইবনু মাজাহ এর সুনান গ্রন্থে মোট ৪৩৪১টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। তন্মধ্যে প্রায় তিন হাজার হাদীস উপরের পাঁচটি গ্রন্থে সংকলিত। বাকী প্রায় দেড় হাজার হাদীস অতিরিক্ত। ৯ম হিজরী শতকের মুহাদ্দিস আল্লামা আহমদ ইবনু আবী বাকর আল-বূসীরী(৮৪০ হি) ইবনু মাজাহর এ সকল অতিরিক্ত হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন। আল্লামা বূসীরী ১৪৭৬ টি হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন, যেগুলি উপরের ৫টি গ্রন্থে সংকলিত হয়নি, শুধুমাত্র ইবনু মাজাহ সংকলন করেছেন। এগুলির মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সহীহ বা হাসান হাদীস এবং প্রায় এক তৃতীয়াংশ হাদীস যয়ীফ। এগুলির মধ্যে প্রায় অর্ধশত হাদীস মাউযূ বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন মুহাদ্দিসগণ।(ইবনুল কাউসূরানী, শুরুতুল আইম্মাহ আস-সিত্তাহ পৃ. ১৩, ২৪-২৬)।
১.৮.২. আলিমগণের গ্রন্থ বনাম জাল হাদীস
হাদীসের গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে হাদীস উল্লেখ করা হয়। তাফসীর, ফিকহ, ওয়ায, আখলাক, ফযীলত, তাসাউফ, দর্শন, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকাদিতে আরো অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়। সাধারণত এ সকল গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস উল্লেখ করা হয়। অনেকেই অজ্ঞতাবশত ধারণা করেন যে, এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ নিশ্চয় যাচাই বাছাই করেই হাদীসগুলি উল্লেখ করেছেন। সহীহ না হলে কি আর তিনি হাদীসটি লিখতেন?
এই ধারণাটিও ভুল, ভিত্তিহীন এবং উপরের ধারণাটির চেয়েও বেশি বিভ্রান্তিকর। সাধারণত প্রত্যেক ইলমের জন্য পৃথক ক্ষেত্র রয়েছে। এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বিষয়ের আলিম অন্য বিষয়ে অত সময় দিতে পারেননা। মুফাসসির, ফকীহ, ঐতিহাসিক, সূফী, ওয়ায়িয ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মরত আলিম ও বুযুর্গ স্বভাবতই হাদীসের নিরীক্ষা, যাছাই বাছাই ও পর্যালোচনার গভীরতায় যেতে পারেননা। সাধারণভাবে তাঁরা হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচলিত গ্রন্থ, জনশ্রুতি ও প্রচলনের উপরে নির্ভর করেন। এজন্য তাঁদের গ্রন্থে অনেক ভিত্তিহীন, সনদহীন ও জাল কথা পাওয়া যায়।
আল্লামা নবাবী তাঁর “তাকরীব” গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ূতী তাঁর “তাদরীবুর রাবী” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে অনেক মিথ্যা কথাকে কিছু বুযুর্গ দরবেশ হাদীসে বলে সমাজে চালিয়েছেন। কোনো কোনো মুফাসসির, যেমন- আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আস সালাবী নিশাপূরী(৪২৭ হি) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে, তাঁর ছাত্র আল্লামা আলী ইবনে আহমাদ আল ওয়াহিদী নিশাপূরী(৪৬৮ হি) তাঁর “বাসীত”, “ওয়াসিত”, “ওয়াজীয” ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে, আল্লামা আবুল কাশেম মাহমূদ ইবনে উমর আয-যামাখশারী (৫৩৮ হি) তাঁর কাশশাফ গ্রন্থে, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আল বাইযাবী(৬৮৫ হি) তাঁর “আনওয়ারুত তানযীল” বা “তাফসীরে বাইযাবী” গ্রন্থে এসকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এই কাজটি করে ভুল করেছেন। সুয়ূতী বলেনঃ “ইরাকী(৮০৬ হি)বলেছেন যে, প্রথম দুইজন-সা’লাবী ও ওয়াহিদী সনদ উল্লেখপূর্বক এসকল বানোয়াট বা জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।” ফলে তাঁদের ওজর কিছুটা গ্রহণ করা যায়, কারণ তাঁরা সনদ বলে দিয়ে পাঠককে সনদ বিচারের দিকে ধাবিত করেছেন, যদিও মাউযূ বা মিথ্যা হাদীস সনদসহ উল্লেখ করলেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে মাউযূ না বলে চুপ করে যাওয়া জায়েয নয়। কিন্তু পরবর্তী দুইজন-যামাখশারী ও বাইযাবী –এর ভুল খুবই মারাত্মক। কারণ, তাঁরা সনদ উল্লেখ করেননি, বরং রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে সরাসরি ও স্পষ্টভাবে এ সকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। (জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৩৪১)।
মোল্লা আলী কারী কোনো কোনো বানোয়াট হাদীস উল্লেখপূর্বক লিখেছেনঃ “কুতুল কুলুব”, “এহইয়াউ উলূমুদ্দীন”, “তাফসীরে সা’লাবী” ইত্যাদি গ্রন্থে হাদীসটির উল্লেখ আছে দেখে ধোঁকা খাবেননা।(মুল্লা আলী কারী, আল-আসরারুল মারফুয়া, পৃ. ২৮৯)।
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর নাম ও পর্যায় বিন্যাস উল্লেখ করে বলেনঃ “আমরা ফিকহী গ্রন্থাবলির নির্ভরযোগ্যতার যে পর্যায় উল্লেখ করলাম তা সবই ফিকহী মাসায়েলের ব্যাপারে। এ সকল পুস্তকের মধ্যে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির বিশুদ্ধতা বা নির্ভরযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস মোটেও প্রযোজ্য নয়। এরূপ অনেক নির্ভরযোগ্য ফিকহী গ্রন্থ রয়েছে যেগুলির উপর মহান ফকীহগণ নির্ভর করেছেন, কিন্তু সেগুলি জাল ও মিথ্যা হাদীসে ভরপুর। বিশেষত ‘ফাতওয়া’ বিষয়ক পুস্তকাদি। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে আমাদের নিকট প্রমাণিত হয়েছে যে, এসকল পুস্তকের লেখকগণ যদিও ‘কামিল’ ছিলেন, তবে হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অসতর্ক ছিলেন।(আবদুল হাই লাখনবী, আন-নাফি আল কাবীর, পৃ. ১২-১৩)।
এজন্য মুহাদ্দিসগণ ফিকহ, তাফসীর, তাসাঊফ, আখলাক ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসগুলি বিশেষভাবে নিরীক্ষা করে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবু বকর আল মারগীনানী (৫৯৩ হি) তাঁর লেখা ফিকহ শাস্ত্রের প্রখ্যাত গ্রন্থ “হেদায়া”য় অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি ফকীহ হিসাবে ফিকহ মাসায়েল নির্ধারণ ও বর্ণনার প্রতিই তাঁর মনোযোগ ও সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন বা পড়েছেন তা বাছবিচার না করেই লিখেছেন। তিনি কোনো হাদীসের সহীহ বা যয়ীফ বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করতে যাননি। পরবর্তী যুগে আল্লামা জামালুদ্দীন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসূফ যাইলায়ী হানাফী(৭৬২ হি), আল্লামা আহমাদ ইবনে আলী ইবনে হাজার আসকালানী(৮৫২ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস এসকল হাদীস নিয়ে সনদভিত্তিক গবেষণা করে এর মধ্য থেকে সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস নির্ধারণ করেছেন।
অনুরূপভাবে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী(৫০৫ হি) তাঁর প্রসিদ্ধ “এহইয়াউ উলুমিদ্দীন” গ্রন্থে ফিকহ ও তাসাউফ আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি দার্শনিক ও ফকীহ ছিলেন, মুহাদ্দিস ছিলেননা। এজন্য হাদীসের সনদ বাছবিচার না করেই যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে আল্লামা যাইনুদ্দীন আবুল ফাদল আব্দুল রহীম ইবনে হুসাইন আল-ইরাকী(৮০৬ হি) ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তাঁর উল্লিখিত হাদীসসমূহের সনদ ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষণ করে সহীহ, জাল ও বানোয়াট হাদীসুগলি নির্ধারণ করেছেন। এছাড়া ৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা ওয়াহাব ইবনু আলী আস-সুবকী (৭৭১ হি) ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে উল্লিখিত কয়েকশত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস একটি পৃথক পুস্তকে সংকলিত করেছেন। পুস্তকটির নাম ‘আল আহাদীস আল্লাতী লা আসলা লাহা ফী কিতাবিল এহইয়া’, অর্থাৎ ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে সংকলিত হাদীসসমূহ’।
১.৮.৩. কাশফ ইলহাম বনাম জাল হাদীস
সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় সুপ্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আল্লাহর প্রিয় ওলী-রূপে প্রসিদ্ধ আলিমগণের বিষয়ে। যেহেতু তাঁরা ‘সাহেবে কাশফ’ বা কাশফ সম্পন্ন ওলী ছিলেন, সেহেতু আমরা ধারণা করি যে, কাশফের মাধ্যমে প্রদত্ত তথ্যের বিশুদ্ধতা যাচাই না করে তো তাঁরা আর লিখেননি। কাজেই তাঁরা যা লিখেছেন বা যা বলেছেন তা বিশুদ্ধ বলে গণ্য হবে।
আল্লামা সুয়ূতী(৯১১ হি), আব্দুল হাই লাখনবী(১৩০৪ হি)প্রমুখ আলিম এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁরা ইমাম গাযযালীর ‘‘এহইয়াউ এলুমিদ্দীন” ও অন্যান্য গ্রন্থে, হযরত আবদুল কাদির জিলানী লিখিত কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখিত অনেক মাউযূ বা বানোয়াট হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, কেউ হয়তো প্রশ্ন করবেনঃ এত বড় আলেম ও এত বড় সাহেবে কাশফ ওলী, তিনি কি বুঝতে পারলেন না যে, এই হাদীসটি বানোয়াট? তাঁর মত একজন ওলী কিভাবে নিজ গ্রন্থে মাউদূ হাদীস উল্লেখ করলেন? তাঁর উল্লেখের দ্বারা কি বুঝা যায়না যে, হাদীসটি সহীহ? এই সন্দেহের জবাবে তাঁরা যে ব্যাখ্যাগুলি উল্লেখ করেছেন সেগুলির ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ
১.৮.৩.১. বুযুর্গগণ যা শুনেন তাই লেখেন
বস্তুত সরলপ্রাণ বুযুর্গগণ যা শুনেন তাই লিখেন।এজন্য কোনো বুযুর্গের গ্রন্থে তাঁর সুস্পষ্ট মন্তব্য ছাড়া কোনো হাদীস উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলে নিশ্চিত হয়েছেন। মূলত তাঁরা যা পড়েছেন বা শুনেছেন তা উল্লেখ করেছেন মাত্র। তাঁরা আশা করেছেন হয়তো এর কোনো সনদ থাকবে, হাদীসের বিশেষজ্ঞগণ তা খুঁজে দিবেন।
১.৮.৩.২. হাদীস বিচারে কাশফের কোনো ভূমিকা নেই
হাদীস বিচারের ক্ষেত্রে কাশফের কোনোই অবদান নেই। কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ হতে দেয়া নেয়ামত মাত্র, আনন্দ ও শুকরিয়ার উৎস। ইচ্ছামতো প্রয়োগের কোনো বিষয় নয়। আল্লাহ তা’য়ালা কাশফের মাধ্যমে হযরত উমারকে (রা) শত শত মাইল দূরে অবস্থিত সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখিয়েছিলেন, অথচ তাঁকে হত্যা করার জন্য তাঁরই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আবু লু’লুর কথা টের পেলেননা হযরত উমার(রা)।
এছাড়া কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি দ্বারা কখনোই হক বাতিলের বা ঠিক বেঠিকের ফায়সালা হয়না। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ ও সমস্যা ঘটেছে, কখনোই একটি ঘটনাতেও তাঁরা কাশফ, ইলহাম, স্বপ্ন ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁরা হক বা বাতিল জানার চেষ্টা করেননি। খুলাফায়ে রাশেদীন-আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর দরবারে অনেক সাহাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারীর ভুলভ্রান্তি সন্দেহ হলে তাঁরা সাক্ষী চেয়েছেন অথবা বর্ণনাকারীকে কসম করিয়েছেন। কখনো কখনো তাঁরা বর্ণনাকারীর ভুলের বিষয়ে বেশি সন্দিহান হলে তাঁর বর্ণিত হাদীসকে গ্রহণ করেননি।কিন্তু কখনোই তাঁরা কাশফের মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য বিচার করেননি। পরবর্তী প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন, শুনেছেন ও হাদীসের সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট নির্ধারণের জন্য সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা নিয়েছেন। বর্ণনাকারীর অবস্থা অনুসারে হাদীস গ্রহণ করেছেন বা যয়ীফ হিসেবে বর্জন করেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা কাশফের উপর নির্ভর করেননি।
হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের জন্য সনদের উপর নির্ভর করা সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সুন্নাতে সাহাবা। আর এ বিষয়ে কাশফ, ইলহাম বা স্বপ্নের উপর নির্ভর করা খেলাফে সুন্নাত, বিদয়াত ও ধ্বংসাত্মক প্রবণতা।
১.৮.৩.৩. কাশফ, ইলহাম সঠিকত্ব জানার মাধ্যম নয়
ইসলামী আকীদার গ্রন্থে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, কাশফ বা ইলম কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার মাপকাঠি নয়। ৬ষ্ঠ শতকের অন্যতম হানাফী আলিম উমার ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী(৫৩৭ হি) তাঁর “আল আকাইদ আল নাসাফিয়্যাহ” ও ৮ম শতকের প্রখ্যাত শাফেয়ী আলিম সা’দ উদ্দীন মাসউদ ইবনু উমার আত-তাফতাযানী (৭৯১ হি) তাঁর “শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ”তে লিখেছেনঃ “হকপন্থীদের নিকট ‘ইলহাম’ যা ‘ফয়েযরূপে প্রদত্ত ইলকা’ নামে পরিচিত তা কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার মাধ্যম হতে পারেনা।”(মুজাদ্দিদে আলফেসানী, মাকতুরাত শরীফ ১/১, পৃ. ৮৮, ১৭৮, ১৯৫, ১৯৬…..)।
কোনো কোনো অনভিজ্ঞ বুযুর্গ স্বপ্ন, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির ভিত্তিতে ‘হাদীসের’ বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের দাবি করলেও অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ বুযুর্গগণ এর কঠিন বিরোধিতা করেছেন। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ ও সংস্কারক মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রাহ) হক্ক-বাতিল বা বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা জানার ক্ষেত্রে কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির উপর নির্ভর করার কঠিন আপত্তি ও প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বারংবার উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন-হাদীসই কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির সঠিক বা বেঠিক হওয়ার মানদন্ড। কাশফ কখনোই হাদীস বা কোনো মতামতের সঠিকত্ব জানার মাধ্যম নয়।
১.৮.৩.৪. সাহেবে কাশফ ওলীগণের ভুলত্রুটি
বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, অনেক প্রখ্যাত সাধক, যাদেরকে আমরা সাহেবে কাশফ বলে জানি, তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে এমন অনেক কথা লিখেছেন যা নিঃসন্দেহে ভুল বা অন্যায়।হযরত আবদুল কাদের জিলানী(৫৬১ হি) লিখেছেন যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি স্বীকার করাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ও ফেরকায়ে নাজীয়ার আলামত বলে গণ্য করেছেন এবং ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি না মানাকে বাতিলদের আলামত বলে গণ্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, কোনো মুসলমানের উচিত নয় যে সে বলবেঃ “নিশ্চয় আমি মুমিন”, বরং তাঁকে বলতে হবে যে, “ইনশা আল্লাহ আমি মুমিন।” ইমাম আবু হানীফা(রাহ) ও তাঁর অনুসারীগণ যেহেতু ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি স্বীকার করেননা, আমলকে ঈমানের অংশ মনে করেননা এবং ‘ইনশা আল্লাহ আমি মুমিন’ বলাকে আপত্তিকর মনে করেন, সেজন্য তিনি তাঁকে ও তাঁর অনুসারীগণকে বাতিল ও জাহান্নামী ফিরকা বলে উল্লেখ করেছেন। [আব্দুল কাদের জিলানী, গুনিয়াতুত তালিবীন(অনুবাদ-নুরুল আলম রঈসী), পৃ. ৬, ৭, ১৪৯, ১৫১,১৫২, ১৫৫, ২১১, ২২৭]।
ইমাম গাযযালী লিখেছেন যে, গান বাজনা ও নর্তন কুর্দন ইত্যাদি আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার পথে সহায়ক ও বিদ‘আতে হাসানা। তিনি গান বাজনার পক্ষে অনেক দুর্বল ও জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।(আবু হামিদ গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/২৯২-৩৩২)
এরূপ অগণিত উদাহরণ তাঁদের গ্রন্থে পাওয়া যায়। কাজেই, তাঁরা যদি কোনো হাদীসকে সহীহ বলেও ঘোষণা দেন তারপরও তার সনদ বিচার ব্যতিরেকে তা গ্রহণ করা যাবেনা। কারণ রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা, সকল বানোয়াট কথাকে চিহ্নিত করা দ্বীনের অন্যতম ফরজ। কেউ সন্দেহযুক্ত হাদীস রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে বর্ণনা করলেও তাঁকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কাজেই, এক্ষেত্রে কোনো শিথিলতার অবকাশ নেই।
১.৮.৪. বুযুর্গগণের নামে জালিয়াতি
এখানে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার। তা হলো, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় নেককার বুযুর্গ ও ওলী-আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি হয়েছে প্রচুর। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়ঃ
(১) জালিয়াতগণ ধর্মের ক্ষতি করার জন্য অথবা ধর্মের ‘উপকার’ করার জন্য জালিয়াতি করত। বিশেষ করে যারা ধর্মের অপূর্ণতাকে(!) দূর করে আরো আকর্ষণীয় ও জননন্দিত করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদের জালিয়াতিই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। আর উভয় দলের জন্য বিশেষ করে দ্বিতীয় দলের জন্য রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে জালিয়াতি করার চেয়ে ওলী-আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি করা অধিক সহজ ও অধিক সুবিধাজনক ছিল।
(২) বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি অধিকতর সুবিধাজনক এজন্য যে, সাধারণ মানুষদের মাঝে তাঁদের নামের প্রভাব ‘হাদীসের’ চেয়েও বেশি। অনেক সাধারণ মুসলমানকে ‘হাদীস’ বলে বুঝানো কষ্টকর। তাকে যদি বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ(স) অমুক কাজ করেছেন, করতে বলেছেন……তবে তিনি তা গ্রহণ করতেও পারেন আবার নাও পারেন। কিন্তু যদি তাকে বলা হয় যে, আব্দুল কাদের জিলানী বা খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বা……অমুক ওলী এই কাজটি করেছেন বা করতে বলেছেন তবে অনেক বেশি সহজে তাকে ‘প্রত্যায়িত’ (Convinced) করা যাবে এবং তিনি খুব তাড়াতাড়ি তা মেনে নিবেন। ইসলামের প্রথম কয়েক শতাব্দীর সোনালী দিনগুলির পরে যুগে যুগে সাধারণ মুসলিমদের এ অবস্থা। কাজেই বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি বেশি কার্য্কর ছিল।
(৩) ওলী-আল্লাহদের নামে জালিয়াতি সহজতর ছিল এজন্য যে, হাদীসের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর নিবেদিত মুহাদ্দিসগণ যেভাবে সতর্ক প্রহরা ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছিলেন, এক্ষেত্রে তা কিছুই ছিলনা বা নেই। কোনো নিরীক্ষা নেই, পরীক্ষা নেই, সনদ নেই, মতন নেই, ঐতিহাসিক বা অর্থগত নিরীক্ষা নেই- যার যা ইচ্ছা বলছেন। কাজেই অতি সহজে জালিয়াতগণ নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পারতেন।
(৪) হাদীস জালিয়াতির জন্যও এ সকল বুযুর্গের নাম ব্যবহার ছিল অত্যন্ত কার্য্কর। এ সকল বুযুর্গের নামে বানোয়াট কথার মধ্যে অনেক জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা। এ সকল বুযুর্গের প্রতি ‘ভক্তির প্রাবল্য’-র কারণে অতি সহজেই ভক্তিভরে এ সকল বিষ ‘গলাধঃকরণ’ করেছেন মুসলমানরা। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পেরেছে জালিয়াতগণ।
১.৮.৪.১. কাদেরীয়া তরীকা
আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ) হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের(দ্বাদশ খ্রিস্টীয় শতকের) প্রসিদ্ধতম ব্যক্তিত্ব। একদিকে তিনি হাম্বলী মাযহাবের বড় ফকীহ ছিলেন। অন্যদিকে তিনি প্রসিদ্ধ সাধক ও সূফী ছিলেন। তাঁর নামে অনেক তরীকা, কথা ও পুস্তক মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত। এ সকল তরীকা, কথা ও পুস্তক অধিকাংশ বানোয়াট। কিছু কিছু পুস্তক তাঁর নিজের রচিত হলেও পরবর্তীকালে এগুলির মধ্যে অনেক বানোয়াট কথা ঢুকানো হয়েছে। এখানে আমরা তাঁর নামে প্রচলিত কাদেরীয়া তরীকা ও ‘সিররুল আসরার’ পুস্তিকটির পর্যালোচনা করব।
প্রচলিক কাদেরীয়া তরীকার আমল, ওযীফা, মুরাকাবা ইত্যাদি পদ্ধতির বিবরণ আব্দুল কাদির জিলানী(রাহ) এর পুস্তকে পাওয়া যায়না। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন যে, আব্দুল কাদির জিলানীর(রাহ) এর ওফাতের প্রায় দুইশত বছর পরে তাঁর এক বংশধর ‘গাওসে জিলানী” ৮৮৭ হিজরী সালে (১৪৮২ খ্রিস্টাব্দ) ‘কাদেরিয়া তরিকা’-র প্রচলন করেন। বিভিন্ন দেশে ‘কাদেরিয়া তরিকা’-র নামে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত। হযরত আব্দুল কাদির জিলানীর নিজের লেখা প্রচলিত বইগুলিতে যে সকল আমল, ওযীফা ইত্যাদি লিখিত আছে প্রচলিত ‘কাদেরিয়া তরিকা’র মধ্যে সেগুলি নেই।
আমাদের দেশে প্রচলিত কাদেরিয়া তরিকার সূত্র বা ‘শাজারা’ থেকে আমরা দেখি যে, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী(১১৭৬ হি/১৭৬২ খ্রিস্টাব্দ)থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘আল কাওলুল জামীল’ গ্রন্থে কাদেরীয়া তরীকার যে বিবরণ দিয়েছেন তার সাথে সাইয়্যেদ আহমেদ বেলব্রীর(১২৪৬ হি) ‘সিরাতে মুস্তাকিমের’ বিবরণে পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাঁদের দুইজনের শিখানো পদ্ধতির সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত কাদেরিয়া তরিকার ওযীফা ও আশগালের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলির কোনটি তাঁর নিজের প্রবর্তিত ও কোনটি তাঁর নামে পরবর্তীকালে প্রবর্তিত তা জানার কোনো উপায় নেই।
১.৮.৪.২. সিররুল আসরার
হযরত আব্দুল কাদির জিলানীর(রাহ) নামে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ একটি পুস্তক ‘সিররুল আসরার’। পুস্তকটিতে কুরআন-হাদীসের আলোকে অনেক ভালো কথা বলা রয়েছে। পাশাপাশি অনেক জাল হাদীস ও বানোয়াট কথা পুস্তকটিতে বিদ্যমান। অবস্থাদৃষ্টি দেখা যায়, পরবর্তীকালের কেউ এ বইটি লিখে তাঁর নামে চালিয়েছে। কয়েকটি বিষয় এ জালিয়াতি প্রমাণ করেঃ
১. এ পুস্তকের বিভিন্ন স্থানে লেখক ‘ফরিদ উদ্দীন আত্তার’ এর বিভিন্ন বাণী ও কবিতার উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। যেমন এক স্থানে বলেছেনঃ “হযরত শাইখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার(রহঃ) বলেন…..”(আব্দুল কাদের জিলানী, সিররুল আসরার, পৃ.২৭)। এখানে লক্ষণীয় যে, ফরিদ উদ্দীন আত্তার(রহঃ) ৫১২ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬২৬ হিজরীত ইন্তিকাল করেন। আর আব্দুল কাদির জিলানীর জন্ম ও মৃত্যু যথাক্রমে ৪৭১ হিজরী ও ৫৬১ হিজরীতে। ফরীদ উদ্দীন আত্তার বয়সে তাঁর ৪০ বছরের ছোট এবং তাঁর ইন্তিকালের সময় ফরিদউদ্দীন আত্তারের তেমন কোনো প্রসিদ্ধি ছিলনা। কাজেই ‘হযরত শাইখ……’ ইত্যাদি বলে তিনি আত্তারের উদ্ধৃতি প্রদান করবেন এ কথা কল্পনা করা যায়না।
২. এই পুস্তকে শামস তাবরীয- এর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। লেখক বলেনঃ “হযরত শাস তাবরীয(রঃ) বলেছেন……….………..(আব্দুল কাদের জিলানী, সিররুল আসরার, পৃ.২৭)।
উল্লেখ্য যে, শামস তাবরীয ৬৪৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্ম সঠিকভাবে জানা হয়নি। তবে ৫৬০ হিজরী এর পরে তাঁর জন্ম বলে মনে হয়। অর্থাৎ আব্দুল কাদির জিলানী(রাহঃ) এর মৃত্যুর সময় শামস তাবরীয এর জন্মও হয়নি। অথচ তিনি তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন।
৩. এই পুস্তকে বারংবার জালালুদ্দীন রুমীর উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে। যেমন লেখক বলেছেনঃ আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী তাঁর অমর কাব্য মসনবীতে বলেছেন………..(আব্দুল কাদের জিলানী, সিররুল আসরার, পৃ. ২৫, ২৯)। লক্ষ্যণীয় যে, জালালুদ্দীন রুমী (৬০৪-৬৭৬ হি) আব্দুল কাদির জিলানীর ইন্তিকালের পরে প্রায় অর্ধশত বৎসর পরে জন্মগ্রহণ করেন! রুমীর জন্মের অর্ধশত বৎসর পূর্বে তাঁর মসনবীর উদ্ধৃতি প্রদান করা হচ্ছে!!
এভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, এই পুস্তকটি পুরোটাই জাল, অথবা এর মধ্যে অনেক জাল কথা পরবর্তীতে ঢুকানো হয়েছে। এই পুস্তকটির মধ্যে অগণিত জাল হাদীস ও জঘন্য মিথ্যা কথা লিখিত রয়েছে। আর আব্দুল কাদির জিলানী(রাহঃ) এর নামে এগুলো খুব সহজেই বাজার পেয়েছে।
১.৮.৪.৩. চিশতীয়া তরীকা
আমাদের দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী(৬৩৩ হি), কুতুব উদ্দীন বখতীয়ার কা’কী (৬৫৩ হি), ফরীদ উদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শক্কর(৬৬৩ হি) ও নিযাম উদ্দীন আউলিয়া(৭২৫ হি) রাহিমাহুমুল্লাহ। এদের নামেই চিশতীয়া তরীকা প্রচলিত। এছাড়া এদের নামে অনেক কথা, কর্ম ও বই পুস্তকও প্রচলিত। এগুলির মধ্যে এমন অনেক কথা রয়েছে যা স্পষ্টতই মিথ্যা ও বানোয়াট। এখানে চিশতীয়া তরীকা ও এঁদের নামে প্রচলিত দু একটি বইয়ের বিষয়ে আলোচনা করব।
ভারতের বিভিন্ন দরবারের চিশতীয়া তরীকার আমল, ওযীফা ইত্যাদির মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। উপযুক্ত বুযুর্গগণের নামে প্রচলিত পুস্তকাদিতে এ সকল ‘তরীকা’ বা পদ্ধতির কিছুই দেখা যায়না। আবার এ সকল পুস্তকে যে সকল যিকর-ওযীফার বিবরণ রয়েছে সেগুলিও প্রচলিত চিশতীয়া তরীকার মধ্যে নেই। চিশতীয়া তরীকার ক্ষেত্রেও শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বিবরণের সাথে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর বিবরণের পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাঁদের দুইজনের শেখানোর পদ্ধতির সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত চিশতীয়া তরীকার ওযীফা ও আশগালের পার্থক্য দেখা যায়। এগুলির কোনটি অরিজিনাল আর কোনটি বানোয়াট তা জানার কোনো উপায় নেই।
১.৮.৪.৪. আনিসুল আরওয়াহ, রাহাতিল কুলুব……….ইত্যাদি
এ সকল মহান মাশাইখ রচিত বলে কিছু পুস্তক প্রচলিত। এগুলি ‘উস্তাদ বা পীরের সাহচর্য্যের স্মৃতি ও আলোচনা’ হিসেবে রচিত। খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী তাঁর উস্তাদ উসমান হারুনীর সাথে তাঁর দীর্ঘ সাহচর্য্যের বিবরণ ‘আনিসুল আরওয়াহ’ নামক পুস্তকে। খাজা কুতুব উদ্দীন বখতীয়ার কাকী তাঁর উস্তাদ মঈন উদ্দীন চিশতীর সাথে তার সাহচর্য্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘দলিলুল আরেফীন’ পুস্তকে। খাজা ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শক্কর তাঁর উস্তাদ কুতুব উদ্দীন এর সাহচর্য্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘ফাওয়ায়েদুস সালেকীন’ পুস্তকে। খাজা নিজাম উদ্দীন আউলিয়া তাঁর উস্তাদ ফরীদ উদ্দীন এর সাহচর্য্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘রাহাতিল কুলব’ পুস্তকে। প্রসিদ্ধ গায়ক আমীর খসরু তাঁর উস্তাদ নিজাম উদ্দীনের সাহচর্য্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘রাহাতুল মুহিব্বীন’ পুস্তকে।
এ সকল পুস্তক পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে, এগুলি পরবর্তী যুগের মানুষদের রচিত জাল পুস্তক। অথবা তাঁরা কিছু লিখেছিলেন সেগুলির মধ্যে পরবর্তী যুগের জালিয়াতগণ ইচ্ছামত অনেক কিছু ঢুকিয়েছে। এই পুস্তক গুলিতে কুরআন হাদীস ভিত্তিক অনেক ভালো কথা আছে। পাশাপাশি অগণিত জাল হাদীস ও মিথ্যা কথায় সেগুলি ভরা। এ ছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যাবলী উল্টাপাল্টা লেখা হয়েছে। এমন সব ভুল রয়েছে যা প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে।
প্রত্যেক বুযুর্গ তাঁর মাজালিসগুলির তারিখ লিখেছেন। সন তারিখগুলি উল্টাপাল্টা লেখা। যাতে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, পরবর্তীকালে এঁদের নামে এগুলি জালিয়াতি করা হয়েছে। শাওয়ার মাসের ৪ তারিখ বৃহস্পতিবার ও ৭ তারিখ রবিবার লেখা হয়েছে। অর্থাৎ শাওয়ালের শুরু সোমবারে। কিন্তু ১৫ই জিলক্বদ সোমবার লেখা হয়েছে। অর্থাৎ জিলক্বদ এর শুরুও সোমবারে। শাওয়াল মাস ২৮ দিনে হলেই শুধু তা সম্ভব।(খাজা মঈন উদ্দীন, আনিসুল আরওয়াহ(ফাওয়ায়েদুস সালেকীন) পৃ. ১৩৫, ১৪৩, ১৪৪)।
আবার পরের মাজলিশ হয়েছে ৫ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার। জিলক্বাদ এর শুরু সোম, মঙ্গল, বুধবার যেদিনই হোক, কোনোভাবেই ৫ই জিলহ্জ্জ বৃহস্পতিবার হয়না। আবার পরের মাজলিশ ২০শে জিলহ্জ্জ শনিবার! ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার হলে ২০ তারিখ শনিবার হয় কি করে? (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৭, ১৪৯)।
২০ শে রজব সোমবার এবং ২৭ শে রজব রবিবার লেখা হয়েছে। ৫ই শাওয়াল শনিবার অথচ ২০ শে শাওয়াল বৃহস্পতিবার(নিযাম উদ্দীন আওলিয়া, রাহাতুল মুহিব্বীন, পৃ. ২৪, ৪৩, ৮৩, ৮৮), এইরূপ অগণিত অসঙ্গতি যা প্রথম নজরেই ধরা পড়ে।
কাকী(রাহ) উল্লেখ করেছেন যে, ৬১৩ হিজরীতে তিনি বাগদাদে তাঁর পীর মঈন উদ্দীন চিশতীর নিকট মুরীদ হন। এরপর কয়েক মাজলিশ তিনি বাগদাদেই থাকেন। এরপর তিনি তাঁর সহচরদের নিয়ে আজমীরে আগমন করেন। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারছি যে, ৬১৩ হিজরী এর পরে হযরত মঈন উদ্দীন চিশতী ভারতে আগমন করেন। হযরত বখতীয়ার কাকী আরো উল্লেখ করেছেন যে, আজমীরে অবস্থানকালে আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমি পৃথ্বিরাজকে মুসলমানদের হাতে জীবিত বন্দী অবস্থায় অর্পণ করলাম। এর কয়েকদিন পরেই সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরীর সৈন্যগণ পৃথ্বিরাজকে পরাজিত ও বন্দী করে। [আনিসুল আরওয়াহ(দলিলুন আরেফীন ও ফাওয়ায়েদুস সালেকীনসহ পৃ. ৬২, ১১৯, ১৩৮]।
অথচ ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৬১৩ হিজরীর প্রায় ২৫ বছর পূর্বে ৫৮৮ হিজরীতে তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে আজমীর দখল করেন। আর ৬১৩ হিজরীতে খাজা মঈন উদ্দীন এর আজমীর আগমনের ১০ বৎসর পূর্বে ৬০৩ হিজরীতে শাহাবুদ্দীন ঘোরী মৃত্যুবরণ করেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, এ সকল কাহিনী সবই বানোয়াট। অথবা মঈন উদ্দীন(রাহঃ) অনেক আগে ভারতে আগমন করেন। এক্ষেত্রে আনিসুল আরওয়াহ,দলিলুন আরেফীন, ফাওয়ায়েদুস সালেকীন ইত্যাদি পুস্তকে লেখা সন-তারিখ ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি বানোয়াট।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় বুযুর্গদের নামেও জালিয়াতি হয়েছে ব্যাপক। হাদীসের ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, বুযুর্গদের ক্ষেত্রে তা না থাকাতে এদের নামে জালিয়াতি ধরার কোনো পথ নেই। জালিয়াতগণ বুযুর্গদের নামে জালিয়াত পুস্তক লিখে সেগুলির মধ্যে জাল হাদীস উল্লেখ করেছে, এবং তাঁদের লেখা বইয়ের মধ্যে জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন এ সকল জাল হাদীসের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সাধারণ মুসলিম বলবেন, অমুক বুযুর্গের পুস্তকে এই হাদীস রয়েছে, তা জাল হয় কিভাবে?! এভাবে জালিয়াতগণ একঢিলে দুই পাখি মেরেছে।
১.৮.৫. জাল হাদীস বনাম যয়ীফ হাদীস
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, জাল হাদীস যয়ীফ বা দুর্বল হাদীসের একটি প্রকার। জাল হাদীসের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ যেরূপ কঠোরতা অবলম্বন করেছেন, যয়ীফ হাদীসের বিষয়ে অনেক মুহাদ্দিস তদ্রুপ কঠোরতা অবলম্বন করেননি। দুইটি ক্ষেত্রে তাঁরা যয়ীফ হাদীসের ব্যবহার বা উল্লেখ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেনঃ (১) আকীদা বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এবং (২) শরীয়াতের আহকাম বা বিধানাবলীর ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে একমাত্র সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। শুধু তাই নয়, আকীদা বা বিশ্বাস প্রমাণের ক্ষেত্রে মূলত ‘মুতাওয়াতির’ বা বহু সাহাবী ও তাবিয়ী বর্ণিত হাদীস, যা সাহাবীগণের মধ্যেই বহুল প্রচারিত ছিল বলে প্রমাণিত এরূপ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ শুধু কুরআন কারীম ও এইরূপ ‘মুতাওয়াতির হাদীস’ দ্বারাই ‘একীন’ বা ‘দৃঢ়বিশ্বাস’ প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সহীহ বা হাসান হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। (সুযূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৩২; ইবনু জামায়াহ, আল মানহালু রাবী, পৃ. ৩২)।
১.৮.৫.১. যয়ীফ হাদীসের ক্ষেত্র ও শর্ত
পক্ষান্তরে তিনটি বিষয়ে ‘অল্প যয়ীফ’ হাদীস বলা অনেকে অনুমোদন করেছেন।
(১) কুরআন কারীমের ‘তাফসীর’ বা শাব্দিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, (২) ইতিহাস বা ঐতিহাসিক বর্ণনার ক্ষেত্রে, (৩) বিভিন্ন নেক আমলের ফযীলত বা সাওয়াব বর্ণনার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে তাঁরা নিম্নরূপ শর্তগুলি উল্লেখ করেছেনঃ
(১) যয়ীফ হাদীসটি অল্প দুর্বল হবে, বেশি দুর্বল হবেনা।
(২) যয়ীফ হাদীসটি এমন নেক আমলের ফযীলত বর্ণনা করবে যা সহীহ হাদীসের আলোকে ভালো ও জায়েয।
(৩) যয়ীফ হাদীসের উপর আমল করার ক্ষেত্রে একথা মনে করা যাবেনা যে, রাসূলুল্লাহ(স) সত্যি এ কথা বলেছেন। সাবধানতামূলকভাবে আমল করতে হবে। অর্থাৎ মনে রাখতে হবে যে, হাদীসটি নবী(স) এর কথা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তবে যদি সত্য হয় তাহলে এই সাওয়াবটা পাওয়া যাবে, কাজেই আমল করে রাখি। আর সত্য না হলেও মূল কাজটি যেহেতু সহীহ হাদীসের আলোকে মুস্তাহাব সেহেতু কিছু সাওয়াবতো পাওয়া যাবে। (বিস্তারিত দেখুনঃ আব্দুল হাই লাখনবী, যাফরুল আমানী, পৃ. ২০৯-২২৪)।
যয়ীফ হাদীসের ক্ষেত্রে কোনো কোনো মুহাদ্দিসের এই মতটি ভুল বুঝে অনেক সময় এর মাধ্যমে সমাজে জাল হাদীসের প্রচলন ঘটেছে। বস্তুত, বিভিন্ন মুসলিম সমাজে প্রচলিত অধিকাংশ জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস এই পথ দিয়ে মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে। সমাজে অগণিত জাল হাদীসের প্রচলনের পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছেঃ
(১) অযোগ্য ও ইলমহীন মানুষদের ওয়ায, নসীহত ও বিভিন্ন দ্বীনি দায়িত্ব পালন,
(২) সাধারণ আলিমদের অবহেলা ও অলসতা,
(৩) প্রসিদ্ধ ও যোগ্য আলিমদের ঢিলেমি,
(৪) হেদায়াতের আগ্রহ এবং
(৫) ইতিহাস, সীরাত ও রাসূলুল্লাহ(স) এর মুযিজা বর্ণনার আগ্রহ।
১.৮.৫.২. হেদায়াত ও ফযীলতে যয়ীফের নামে জাল হাদীস
জাল হাদীস প্রচলনের ক্ষেত্রে শেষের কারণদ্বয় সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। হেদায়াতের আগ্রহে অনেক যোগ্য আলেম ওয়ায, ফাজায়েল, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করেছেন। এ সকল যয়ীফ হাদীসের মধ্যে অনেক জাল হাদীস তাঁদের পুস্তকে স্থান পেয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা এগুলির জালিয়াতি বা দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেননি। ফলে সাধারণ পাঠকগণ এগুলিকে ‘সহীহ হাদীস’ বলেই গণ্য করেছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কুরআনের এত আয়াত, এত সহীহ হাদীস সবকিছু উল্লেখ করার পরও বোধ হয় মানুষের মনে হেদায়াতের কথাটি ঢুকানো গেলনা। কিছু যয়ীফ বা অনির্ভরযোগ্য কথা না বললে বোধ হয় মানুষের মনে আসর করা যাবেনা। কুরআনে ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত শাস্তির কথা এবং কুরআনে ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত পুরস্কার, সাওয়াব ও ফযীলতের কথা বোধ হয় মানুষের মনে সত্যিকার আখেরাতমুখিতা, আল্লাহ ভীতি ও আমলের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। এজন্যই তাঁরা বোধ হয় আয়াতে কুরআনী ও সহীহ হাদীসের পরে এ সকল যয়ীফ বা ভিত্তিহীন কথাগুলি উল্লেখ করেন।
১.৮.৫.৩. ইতিহাস ও সীরাতে যয়ীফের নামে জাল হাদীস
ইতিহাস, সীরাত ও যয়ীফ বর্ণনার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। সকল বিষয়ের লেখকই সেই বিষযে সর্বাধিক তথ্য সংগ্রহ করতে চান। তথ্য সংগ্রহের এই আগ্রহের ফলে প্রথম যুগ হতেই অনেক আলিম কিছুটা দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরবর্তী যুগে এই আগ্রহের ফলে সীরাতুন্নবী গ্রন্থগুলির মধ্যে অগণিত ভিত্তিহীন জাল হাদীস অনু্প্রবেশ করেছে।
ইতোপূর্বে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আলোচনা থেকে জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে প্রচলিত সকল হাদীসই ৪র্থ-৫ম শতাব্দীর মধ্যে সংকলিত হয়ে গিয়েছিল। এর পরবর্তী যুগে অতিরিক্ত যা কিছু সংকলিত হয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগে বানানো জাল ও ভিত্তিহীন কথা। এই প্রকারের গ্রন্থগুলিকে তিনি ৪র্থ ও ৫ম পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাস, সীরাত ও মুযিজা বিষয়ক গ্রন্থগুলির অবস্থাও আমরা এ থেকে বুঝতে পারবো। প্রথম ছয়শত বৎসরে সংকলিত এই জাতীয় গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হলোঃ ইবনু ইসহাকের(১৫০হি) ‘সীরাহ’, ওয়াকেদীর(২০৭ হি) মাগাযী, ইবনু হিশামের(২১৮ হি)সীরাহ, ইবনু সা’দ (২৩০ হি)এর তাবাকাত, খালীফা ইবনু খাইয়াতের(২৪০হি) তারিখ, বালাযুরির(২৭৯ হি) ফুতুহুল বুলদান, ফিরইয়াবীর(৩০১ হি) দালাইলুন নবু্ওয়াত, তাবারীর(৩১০ হি) তারীখ, মাসঊদীর(৩৪৫ হি) তারীখ, বাইহাকীর(৪৫৮ হি) দালাইলুন নবুওয়াত ইত্যাদি। এ সকল পুস্তকে প্রচুর ‘অত্যন্ত যয়ীফ’ হাদীস ও কিছু জাল হাদীস গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমারা দেখতে পাই যে, পরবর্তী যুগের লেখকগণ আরো অনেক কথা সংগ্রহ করেছেন যা এ সকল গ্রন্থে মোটেও পাওয়া যাচ্ছেনা।
পরবর্তীযুগের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলির অন্যতম হলো সুয়ূতীর(৯১১ হি) আল খাসাইসুল কুবরা, কাসতালানীর(৯২৩ হি) আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামীর(৯৪২ হি) সুবুলুল হুদা বা সীরাহ শামিয়াহ। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ দাবি করেছেন যে, তাঁরা তাঁদের গ্রন্থে যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করবেন কিন্তু জাল হাদীস উল্লেখ করবেননা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাঁরা এমন অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন, যেগুলিকে তাঁরা নিজেরাই অন্যত্র জাল ও মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন।
এর পরবর্তী পর্যায়ের গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হলো আলী ইবনু বুরহান উদ্দীন হালাবীর(১০৪৪ হি) সীরাহ হালাবিয়াহ, যারকানীর(১১২২ হি) শারহুল মাওয়াহিব ইত্যাদি গ্রন্থ। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ কোনো বাছবিচারই রাখেননি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল যত বেশি পারা যায় তথ্যাদি সংকলন ও বিন্যাস করা। এজন্য কোনোরূপ বিচার ও যাচাই ছাড়াই সকল প্রকার সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ ও সনদবিহীন বিবরণ একত্রিত সংমিশ্রিত করে বিন্যাস করেছেন। ফলে অগণিত জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা এগুলিতে স্থান পেয়েছে। আর জাল হাদীসের মধ্যে নতুনত্ব ও আজগুবিত্ব বেশি। এজন্য এ সকল পুস্তকে সহীহ হাদীসের পরিবর্তে জাল হাদীসের উপরেই বেশি নির্ভর করা হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, কুরআন কারীম ও অসংখ্য সহীহ হাদীস দিয়ে রাসূলুল্লাহ(স) এর নুবুওয়াত, মুজিযা ও মর্যাদা প্রমাণ করা বোধহয় সম্ভব হচ্ছেনা, অথবা এ সকল মিথ্যা ও জাল বর্ণনাগুলি ছাড়া বোধহয় তাঁর মর্যাদার বর্ণনা পূর্ণতা পাচ্ছেনা!!
এ পর্যায়ের গ্রন্থগুলির লেখকগণ অধিকাংশ বর্ণনারই সূত্র উল্লেখ করেননি। যেখানে সূত্র উল্লেখ করেছেন, সেখানেও তাঁদের অবহেলা অকল্পনীয়। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। সীরাহ হালাবিয়ার লেখক বলেনঃ “আমি ‘তাশরীফাত ফিল খাসাইস ওয়াল মুজিযাত’ নামক একটি বই পড়েছি। এই বইটির লেখকের নাম আমি জানতে পারিনি। এই বইয়ে দেখেছি, আবু হুরাইরা(রা) হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলে কারীম(স) হযরত জিব্রাঈল(আ)কে জিজ্ঞেস করেন, হে জিব্রাঈল, আপনার বয়স কত? ……হাদীসটি বুখারী সংকলন করেছেন। (হালাবী, আলী ইবনু বুরহান উদ্দীন, সীরাহ হালাবীয়া ১/৪৯)।
এই হাদীসটি বুখারী তো দূরের কথা কোনো হাদীস গ্রন্থেই নেই। এই অজ্ঞাত নামা লেখকের বর্ণনার উপর নির্ভর করে গ্রন্থকার হাদীসটি উদ্ধৃত করলেন। একটু কষ্ট করে সহীহ বুখারী বা ইমাম বুখারীর লেখা অন্যান্য গ্রন্থ খুঁজে দেখলেননা। এভাবে তিনি পরবর্তী যুগের মুসলমানদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে একটি জঘন্য মিথ্যা কথা প্রচলনের স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমাদের দেশের আলিমগণ “সীরাহ হালাবিয়া” জাতীয় পুস্তকের উপরই নির্ভর করেন, ফলে অগণিত জাল কথা তাদের লেখনীতে বা বক্তব্যে স্থান পায়। প্রসিদ্ধ আলেম ও বুযুর্গ আব্দুল খালেক(রাহ) তাঁর ‘সাইয়েদুল মুরসালীন’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মূলত এই ‘সীরাহ হালাবিয়া’(সীরাত-ই-হালাবী) গ্রন্থটির উপরেই নির্ভর করেছেন। স্বভাবতই তিনি গ্রন্থাকারের প্রতি শ্রদ্ধাবশত কোনো তথ্যই যাচাই করেননি। ফলে এই মূল্যবান গ্রন্থটির মধ্যে আমরা অগণিত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস দেখতে পাই।
আমরা দেখেছি যে, যয়ীফ হাদীসের উপর আমল জায়েয হওয়ার শর্ত হলো, বিষয়টি বিশ্বাস করা যাবেনা, শুধু কর্মের ক্ষেত্রে সাবধানতামূলক কর্ম করা যাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, বিশ্বাস ও কর্ম বিচ্ছিন্ন করা মুশকিল। কারণ যয়ীফ হাদীসের উপর যিনি আমল করেছেন তিনি অন্তত বিশ্বাস করেছেন যে, এই আমলের জন্য এই ধরনের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। বিশেষত রাসূলুল্লাহ(স) এর জীবনী ও মুজিযা বিষয়ক বর্ণনার ক্ষেত্রে একজন মুমিন কিছু শুনলে তা বিশ্বাস করেন। শুধু তাই নয়, এ সকল ‘যয়ীফ’ বা ‘জাল’ কথাগুলি তাঁর ঈমানের অংশে পরিণত হয়। এভাবে তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তি হয় যয়ীফ বা জাল হাদীসের উপর।
১.৮.৬. নিরীক্ষা বনাম ঢালাও ও আন্দাযী কথা
জাল হাদীসের ক্ষেত্রে জঘন্যতম ও সবচেয়ে মারাত্মক বিভ্রান্তি হলো, নিরীক্ষা ব্যতিরেকে ঢালাও মন্তব্য। আমরা ইতোপূর্বে বারংবার উল্লেখ করেছি এবং পূর্বের সকল আলোচনা থেকে নিশ্চিতরূপে বুঝতে পেরেছি যে, ওহী বা ধর্মীয় শিক্ষার বিশুদ্ধতা রক্ষা ও সূত্র সংরক্ষণ মুসলিম উম্মাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় তাঁদের ধর্মগ্রন্থ, ধর্ম প্রচারক বা প্রবর্তকের শিক্ষা ও নির্দেশাবলীর বিশুদ্ধতা রক্ষায় এইরূপ সচেষ্ট হয়নি।
সাহাবীগণের যুগ থেকে সকল যুগের মুসলিম আলিম ও মুহাদ্দিসগণ রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে প্রচারিত প্রতিটি কথা চুলচেরা নিরীক্ষা, পর্য্যবেক্ষণ ও যাচাই করে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অনেক ‘প্রাচ্যবিদ’, তাঁদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত অনেক মুসলিম ও অনেক অনভিজ্ঞ বা অজ্ঞ মুসলিম চিন্তাবিদ বা গবেষক হাদীসের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য ও মতামত ব্যক্ত করেন। হাদীস যেহেতু জাল হয়েছে, কাজেই কোনো হাদীসই নির্ভরযোগ্য নয়, অথবা অমুক হাদীসের অর্থ সঠিক নয় কাজেই তা জাল বলে গণ্য হবে……ইত্যাদি। কেউ কেউ মনে করেন, মুহাদ্দিসগণ সম্ভবত শুধু সনদই বিচার করেছেন, অর্থ, শব্দ, বাক্য, ভাব ইত্যাদি বিচার ও নিরীক্ষা করেননি। এগুলি সবই ভিত্তিহীন ধারণা ও উর্বর মস্তিষ্কের বর্বর কল্পনা মাত্র। মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতির সাথে পরিচয়হীনতা এর মূল কারণ। এর চেয়েও বড় কারণ ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও ইসলাম থেকে মানুষদের বিচ্যূত করার উদগ্র বাসনা।
ইহুদী খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদ পন্ডিতগণ, কাদিয়ানী, বাহাঈ ইত্যাদি অমুসলিম সম্প্রদায় ও শিয়া সম্প্রদায় ছাড়াও কিছু ‘জ্ঞানপাপী’ পন্ডিত হাদীসের বিরুদ্ধে এরূপ ঢালাও মন্তব্য করেন অথবা মর্জিমাফিক অর্থ বিচার করে হাদীস ‘জাল’ বলে ঘোষণা করেন। তারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করতে চান, কিন্তু ইসলাম পালন করতে চাননা। এরা সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ, হালাল ভক্ষণ, পবিত্রতা অর্জন ইত্যাদি কোনো কর্মই করতে রাজি নন। কুরআনে উল্লেখিত এসব বিষয়কে ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দিতে চান। কিন্তু ভয় হলো হাদীস নিয়ে। হাদীস থাকলে তো ইচ্ছামত ব্যাখ্যা অচল। রাসূলুল্লাহ(স) এর ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। এজন্য তারা নির্বিচারে হাদীসকে জাল বলে বাতিল করে দিতে চান।
আশা করি, এ গ্রন্থের আলোচনা থেকে পাঠক এ সকল মানুষের মতামতের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক। তাঁরা সনদ, শ্রুতি, পান্ডুলিপি, ভাষা, অর্থ, ও প্রাসঙ্গিক সকল প্রমাণের আলোকে যে সকল হাদীসকে সহীহ বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলির বিশুদ্ধতা ও যথার্থতা সম্পর্কে তথ্য প্রমাণবিহীন ঢালাও সন্দেহ একমাত্র জ্ঞানহীন মুর্খ বা বিদ্বেষী জ্ঞানপাপী ছাড়া কেউই করতে পারেনা। আর এই নিরীক্ষার ভিত্তিতে যে সকল হাদীসকে তাঁরা জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলিকে গায়ের জোরে হাদীস বলে দাবি করাও রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার ভয়ঙ্কর দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে তথ্য ভিত্তিক নিরীক্ষার দরজা সর্বদা উন্মুক্ত।
১.৮.৭. জাল হাদীস বিষয়ক কিছু প্রশ্ন
আমরা প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ করেছি। দ্বিতীয় পর্বে আমরা আমাদের সমাজে প্রচলিত অনেক জাল হাদীস ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করব। এ সকল জাল ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা পাঠের সময় পাঠকের মনে বারংবার কয়েকটি প্রশ্ন জাগতে পারে। প্রশ্নগুলির উত্তর পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি। তবুও এখানে প্রশ্নগুলি আলোচনা করতে চাই।
আমরা দেখতে পাব যে, মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীসের মধ্যে এমন অনেক কথা আছে যা অত্যন্ত সুন্দর, অর্থবহ, মূল্যবান ও হৃদয়স্পর্শী। তখন আমাদের কাছে মনে হবে, কথাটি তো খুব সুন্দর, একে বানোয়াট বলার দরকার কি? অথবা এত সুন্দর ও মর্মস্পর্শী কথা হাদীস না হয়ে পারেনা। অথবা এই কথার মধ্যে তো দোষ নেই, এর বিরুদ্ধে লাগার প্রয়োজন কি? ইত্যাদি।
এর উত্তরে আমাদের বুঝতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ (স) এর শিক্ষা ও বাণীকে অবিকল নির্ভেজালভাবে হেফাজত করা উম্মাতের প্রথম দায়িত্ব। তিনি বলেননি, এমন কোনো কথা তাঁর নামে বলাই জাহান্নামের নিশ্চিত পথ বলে তিনি বারবার বলেছেন। কাজেই কোনো বাণীর ভাব বা মর্ম কখনোই আমাদের কাছে প্রথমে বিবেচ্য নয়। প্রথম বিবেচ্য হলো, তিনি এই বাক্যটি বলেছেন কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা। কোনো কথার অর্থ যত সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী হোক সে কথাটিকে আমরা রাসূল(স) এর কথা বা হাদীষ বলতে পারিনা যতক্ষণ না বিশুদ্ধ সনদে তাঁর থেকে বর্ণিত না হয়। রাসূলুল্লাহ(স) যে কথা বলেছেন বলে আমরা নিশ্চিতরূপে জানি না সে তাঁর নামে বর্ণনা করার কঠিনতম অপরাধ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, আমরা প্রায়ই দেখব যে, আমরা যে সকল হাদীসকে বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছি, এ সকল হাদীসকে অনেক বুযুর্গ তার গ্রন্থে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে কেউ হয়তো বলতে পারেন, অমুক আলেম বা বুযুর্গ এই হাদীস বলেছেন, তিনি কি তাহলে জাহান্নামী?
আমরা দেখেছি যে, বুযুর্গগণের নামে জালিয়াতি হয়েছে অনেক। এ সকল হাদীস বুযুর্গগণ সত্যিই বলেছেন নাকি জালিয়াতগণ তাঁদের নামে চালিয়েছে তা আমরা জানিনা। যদি তাঁরা বলেও থাকেন, তবে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, একজন বুযুর্গের অসংখ্য কর্মের মধ্যে কিছু ভুল থাকতে পারে। তাঁদের অসংখ্য ভাল কাজর মধ্যে এ সকল ভুল ভ্রান্তি কিছুই নয়। মূলতঃ তাঁরা মুজতাহিদ ছিলেন। মুজতাহিদ তাঁর সঠিক কর্মের জন্য আল্লাহর কাছে দ্বিগুণ পুরস্কার পান। আর তিনি তার ভুলের জন্য একটি পুরস্কার পান। (সহীহ বুখারী)। এছাড়া আল্লাহ বলেছেনঃ “পূণ্য কাজ অবশ্যই পাপকে দূর করে দেয়।”(সূরা হুদঃ ১১৪ আয়াত)। তাই যিনি অনেক পূণ্য করেছেন তাঁর সামান্য ভূল পূণ্যের কারণে দূরীভূত হয়ে যাবে।
কোনো বুযুর্গ বা সত্যিকারের আল্লাহ ওয়ালা মানুষ কখনোই জেনে শুনে কোনো জাল বা মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে বলতে পারেননা। না জেনে হয়তো কেউ বলে ফেলেছেন। কিন্তু তাই বলে আমরা জেনেশুনে কোনো জাল হাদীস বলতে পারিনা। আমাদের দায়িত্ব হলো, কোনো হাদীসের বিষয়ে যদি আমরা শুনি বা জানি যে, হাদীসটি জাল তবে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তা বলা ও পালন করা বর্জন করব। যদি এ বিষয়ে আমাদের সন্দেহ হয় তবে আমরা মুহাদ্দিসগণের তথ্যাদির আলোকে ‘তাহকীক’ বা গবেষণা করে প্রকৃত বিষয় জানতে চেষ্টা করব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের কর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন, অন্য কারো কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেননা। কাজেই আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বা সন্দেহজনক কিছু বলা থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন যা আমাদের মনে আসবে তা হলো, এতসব বুযুর্গ কিছূ বুঝলেননা, এখন আমরা কি তাঁদের চেয়েও বেশি বুঝলাম? এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, এই গ্রন্থে আলোচিত জাল হাদীসগুলিকে জাল বলার ক্ষেত্রে আমার মত অধমের কোনো ভূমিকা নেই। এখানে আমি মূলত পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের মতামত বর্ণনা করেছি। পাঠক তা বিস্তারিত দেখতে পাবেন।
দ্বিতীয় পর্বঃ
প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন কথা
২.১. অশুদ্ধ হাদীসের বিষয়ভিত্তিক মূলনীতি
জাল ও নির্ভরযোগ্য হাদীস সংকলনের একটি বিশেষ পদ্ধতি হল, যে সকল বিষয়ে সকল হাদীস বা অধিকাংশ হাদীস বানোয়াট বা অনির্ভরযোগ্য সে সকল বিষয়কে একত্রিত করে সংকলিত করা। বানোয়াট হাদীস চিহ্নিত করনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে আগ্রহী মুসলিম বিভিন্ন গ্রন্থের সহায়তা ছাড়াই সহজে বুঝতে পারবেন যে, এই হাদীসটি বানোয়াট; কারণ এই হাদীসটি যে বিষয়ে বর্ণিত সেই বিষয়ে কোন সহীহ হাদীস নেই। এই পদ্ধতিতে রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে অন্যমত গ্রন্থ ৭ম হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও হানাফী ফকীহ উমার ইবনু বাদর আল মাউসিলী(৫৫৭-৬২২ হি) রচিত ‘আল মুগনী’ গ্রন্থ। এছাড়া হিজরী একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি), ত্রয়োদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফেয়ী ফকীহ, মুহাদ্দিস ও সূফী সাধক মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়েদ দরবেশ হুত(১২৭৬ হি) এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসও এ বিষয়ক কিছু মূলনীতি উল্লেখ করেন।
২.১.১. উমার ইবনু বাদর মাউসিলী হানাফী
যিয়াউদ্দীন আবু হাফস উমার ইবনু বাদর ইবনু সাঈদ ইবনু মুহাম্মাদ আল মাউসিলী হানাফী হাদীস, তাফসীর, ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম “আল মুগনী আনিল হিফযি ওয়াল কিতাব বি কাউলিহিম লাম ইয়াসিহ শাইউন ফী হাযাল বাব” নামক গ্রন্থটি। এই দীর্ঘ নামের প্রতিপাদ্য হলোঃ ‘মুহাদ্দিসগণ যে বিষয়ে বলেছেন যে, এই বিষয়ে কোন হাদীসই সহীহ নয় সেইগুলির বিবরণ। এইগুলির জন্য অন্য কোনো গ্রন্থ পাঠ বা মুখস্ত করার প্রয়োজনীয়তা থাকবেনা।’ এ গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তিনি ১০১ টি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, যে সকল বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীসই অশুদ্ধ বলে মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন। কোনো বিষয়ে কিছু হাদীস বিশুদ্ধ হলে তা উল্লেখ করে বাকি সকল হাদীস অশুদ্ধ বলে জানিয়েছেন।
২.১.২. যে সকল বিষয়ে সকল হাদীস অশুদ্ধ
আল্লামা মাউসিলী পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা ও বিস্তারিত গবেষণার আলোকে উল্লেখ করেছেন যে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে বর্ণিত সকল হাদীসই অশুদ্ধ। এগুলি হয় বানোয়াট অথবা অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য।
১. ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি্
ঈমান বাড়ে কমে, অথবা বাড়ে না ও কমে না এবং কথা ও কর্মও ঈমানের অন্তর্ভুক্ত অথবা অন্তর্ভুক্ত নয়, এই অর্থে রাসূলুল্লাহ(স) হতে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। এ বিষয়ে কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনার আলোকে মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ মতভেদ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সরাসরি কোনো সহীস হাদীস বর্ণিত হয়নি।
২. মুরজিয়া, জাহমিয়্যা, কাদারিয়্যাহ ও আশ‘আরিয়্যাহ সম্প্রদায়
এ সকল সম্প্রদায় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী মূলক কোনো সহীহ হাদীস রাসূলুল্লাহ(স) থেকে বর্ণিত হয়নি। এদের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলি বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ ও ইমামগণ কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনার আলোকে এ সকল সম্প্রদায়ের বিষয়ে কথা বলেছেন।
৩. আল্লাহর বাণী সৃষ্ট নয়
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(স) হতে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত সকল হাদীসই বানোয়াট।
কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত, বিভিন্ন হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনা ও সাহাবীগণের মতামতের আলোকে তাবিয়ীগণ, তাবে-তাবিয়ীগণ ও পরবর্তী ইমামগণ একমত যে, কুরআন আল্লাহর বাণী, তা তাঁর মহান গুণাবলীর অংশ ও তা সৃষ্ট নয়। বিভ্রান্ত মু’তাযিলা সম্প্রদায় কুরআনকে সৃষ্ট বস্তু বলে বিশ্বাস করতো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকে এই বিষয়টি মুসলিম সমাজের অন্যতম বিতর্কের বিষয় ছিল। এজন্য অনেক জালিয়াত এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে হাদীস বানিয়ে প্রসিদ্ধি লাভের চেষ্টা করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত পোষণ করেছেন যে, কুরআন সৃষ্ট নয়। তবে এই অর্থে হাদীস জালিয়াতির সকল প্রচেষ্টা তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
৪. নূরের সমুদ্রে ফিরিশতাগণের সৃষ্টি
জিবরাঈল(আ) প্রতিদিন নূরের সমূদ্রে ডুব দিয়ে উঠে শরীর ঝাড়া দেন এবং প্রতি ফোটা নূর হতে ৭০ হাজার ফেরেশতা সৃষ্টি করা হয়। এই অর্থে ও এই জাতীয় সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
৫. মুহাম্মাদ বা আহমদ নাম রাখার ফযীলত
মুহাম্মাদ বা আহমদ নাম রাখার ফযীলতে প্রচারিত সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এ বিষয়ে অনেক বানোয়াট হাদীস প্রচারিত হয়েছে। মুহাম্মাদ বা আহমদ নামধারীদের আল্লাহ শাস্তি দিবেননা, যাদের পরিবারে কয়েক ব্যক্তির নাম মুহাম্মাদ হবে, তাদের ক্ষমা করা হবে, বরকত দেওয়া হবে ইত্যাদি বিভিন্ন কথা বানিয়ে হাদীসের নামে প্রচার করা হয়েছে। এই নাম দুটি নিঃসন্দেহে উত্তম নাম। রাসূলুল্লাহ(স) এর মহব্বতে সন্তানদের এই নাম রাখা ভাল। তবে এই বিষয়ক বিশেষ ফযীলত জ্ঞাপক হাদীসগুলি বানোয়াট।
৬. আকল অর্থাৎ বুদ্ধি বা জ্ঞানেন্দ্রিয়
বুদ্ধি বা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রশংসা বা ফযীলতে বর্ণিত সকল হাদীস ভিত্তিহীন। কুরআন ও হাদীসে জ্ঞান শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং জ্ঞানীগণের প্রশংসা করা হয়েছে। তবে ইন্দ্রিয়ের প্রশংসায় রাসূলুল্লাহ(স) থেকে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। জালিয়াতগণ বুদ্ধি বা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রশংসায় অনেক হাদীস বানিয়েছে। যেগুলিতে বুদ্ধির প্রশংসা করা হয়েছে, মানুষের কর্ম নয় বরং বুদ্ধি অনুসারে পুরস্কার লাভ করবে; বুদ্ধিহীন বা নির্বোধের সালাতের চেয়ে বুদ্ধিমানের সালাতের সাওয়াব বেশি…ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে। এগুলি সবই বানোয়াট। কোনো জন্মগত বা বংশগত বিষয়ই আখিরাতের মুক্তি বা মর্যাদার বিষয় নয়। মানুষের ইচ্ছাকৃত কর্মই মূলত তার মুক্তির মাধ্যম। যার বুদ্ধি বেশি ও বুদ্ধি সৎকর্মে ব্যবহার করেন তিনি তার কর্মের জন্য প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হবেন। কিন্তু জন্মগত বা প্রকৃতিগত বুদ্ধি কোনো মুক্তি বা সাওয়াবের বিষয় নয়।
৭. খিযির(আ) ও ইলিয়াস(আ) এর দীর্ঘ জীবন
সূরা কাহাফের মধ্যে মহান আল্লাহ তায়ালা মূসা(আ) এর সাথে আল্লাহর একজন বান্দার কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে এই বান্দার নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই বান্দার নাম ‘খাযির’(প্রচলিত বাংলায়ঃ খিযির)। এই একটি ঘটনা ছাড়া অন্য কোনো ঘটনায় খিযির(আ) এর বিষয়ে কোনো সহীহ বর্ণনা জানা যায়না। তাঁর জন্ম, বাল্যকাল, নব্যুয়ত, কর্ম, কর্মক্ষেত্র, এই ঘটনার পরবর্তীকালে তাঁর জীবন ও তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কোনো প্রকারের কোনো বর্ণনা কোনো সহীহ হাদীসে জানা যায়না। তিনি আবে হায়াতের পানি পান করেছিলেন ইত্যাদি কথা সবই ইহূদী-খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত কথা মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে।
আল্লামা মাউসিলী বলেন, খিযির(আ) ও ইলিয়াস (আ) দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন, তাঁরা রাসূলুল্লাহ(স) কে দেখেছেন বা কথা বলেছেন, তাঁর পরে বেঁচে আছেন, ইত্যাদি অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বালকে খিযির(আ) ও ইলিয়াস(আ) এর দীর্ঘ জীবন ও জীবিত থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন-………শয়তানই এই বিষয়টি মানুষের মধ্যে প্রচার করেছে।
ইমাম বুখারীকে প্রশ্ন করা হয়, খিযির(আ) ও ইলিয়াস (আ) কি এখনো জীবিত আছেন? ইমাম বুখারী বলেন, তা অসম্ভব; কারণ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আজকের দুনিয়ায় যারা জীবিত আছেন তাদের সকলেই ১০০ বৎসরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করবেন।
ইবনুল জাউযী খিযির(আ) ও ইলিয়াস(আ) এর দীর্ঘ জীবনের বিষয়ে বলেন, এই কথাটি কুরআনের আয়াতের পরিপন্থী। আল্লাহ তায়ালা কুরআন কারীমে উল্লেখ করেছেনঃ “আপনার পূর্বে কোনো মানুষকেই আমি অনন্ত জীবন দান করিনি; সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরজীবি হয়ে থাকবে?” (সূরা ২১, আম্বিয়া; আয়াত ৩৪)।
উল্লেখ্য যে, কোনো কোনো আলিম খিযিরের(আ) জীবিত থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তাঁরা বিভিন্ন বুযুর্গের কথার উপর নির্ভর করেছেন। তবে এ বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য হাদীস রাসূলুল্লাহ(স) হতে বর্ণিত হয়নি।
৮. কুরআনের বিভিন্ন সূরার ফযীলত
আল্লামা মাউসিলী বলেন, কুরআনের ফযীলতের বিষয়ে কিছু হাদীস সহীহ, তবে এ বিষয়ে অনেক বানোয়াট হাদীস সমাজে প্রচার করা হয়েছে। নিম্নলিখিত সূরা বা আয়াতের বিষয়ে বিশেষ মর্যাদা বা ফযীলত জ্ঞাপক সহীহ বা হাসান হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সূরা ফাতিহা, সূরা বাকারাহ, সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, আয়াতুল কুরসী, সূরা আল ইমরান, সূরা কাহাফ, সূরা কাহাফের প্রথম বা শেষ দশ আয়াত, সূরা মূলক, সূরা যিলযাল, সূরা কাফিরূন, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস। এছাড়া অন্যান্য সূরার ফযীলতে বর্ণিত হাদীসগুলি বানোয়াট বা অত্যন্ত দূর্বল। এছাড়া উপরের সূরাগুলির ফযীলতেও অনেক বানোয়াট কথা হাদীস নামে প্রচার করা হয়েছে।
৯. আবু হানীফা(রাহ) ও শাফিয়ীর(রাহ) প্রশংসা বা নিন্দা
এ বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস মিথ্যা বা বানোয়াট।
১০. রোদে পানি গরম করাঃ রোদে গরম করা পানি ব্যবহার করলে অসুস্থতা বা অমঙ্গল হতে পারে অর্থে রাসূলুল্লাহ(স) হতে বর্ণিত সকল হাদীস মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
১১. ওযূর পরে রুমাল ব্যবহারঃ ওযূর পরে রাসূলুল্লাহ(সা) আর্দ্র আঙ্গুলগুলি মুছতেন বা মোছার জন্য রুমাল ব্যবহার করতেন বলে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি।
১২. সালাতের মধ্যে সশব্দে বিসমিল্লাহ পাঠঃ আল্লামা মাউসিলী বলেন, ইমাম দারাকুতনী বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) সালাতের মধ্যে সশব্দে‘ বিসমিল্লাহ…’ পাঠ করেছেন অর্থে বর্ণিত কোনো হাদীসই সহীহ নয়।
১৩. যার দায়িত্বে সালাত (কাযা) রয়েছে তার সালাত হবেনাঃ ইমাম মাউসিলী বলেন, এই অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস ভিত্তিহীন।
১৪. মসজিদের মধ্যে জানাযার সালাত আদায়ে নিষেধাজ্ঞাঃ ইমাম মাউসিলী বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা)থেকে এ বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি।
১৫. জানাযার তাকবীরগুলিতে হাত উঠানোঃ রাসূলুল্লাহ(সা) জানাযার প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্য কোনো তাকবীরের সময় হাত উঠিয়েছেন বলে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি।
১৬. সালাতুল রাগাইবঃ সালাতুল রাগাইব বা রজব মাসের প্রথম জুম’আর দিনে বিশেষ নফল সালাতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
১৭. সালাতু লাইলাতুল মি‘রাজঃ মি’রাজের রাত্রিতে বিশেষ নফল সালাত আদায়ের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
১৮. সালাতু লাইলাতু নিসফি বিন শাবানঃ শবে বরাতের রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ কিছু রাকা‘আত নফল সালাতের বিশেষ ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
১৯. সপ্তাহের প্রত্যেক দিন ও রাত্রের জন্য বিশেষ নফল সালাতঃ আল্লামা মাউসিলী বলেন, এ বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। তিনি আরো বলেনঃ নফল সালাতের বিষয়ে শুধুমাত্র নিম্নের সালাতগুলির বিষয়ে সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছেঃ ফরয সালাতের আগে পরে সুন্নাত সালাত, তারাবীহ, দোআ বা চাশত, রাতের সালাত বা তাহাজ্জুদ, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ, তাহিয়্যাতুল ওযূ, ইসতিখারার সালাত, কুসূফের(চন্দ্র বা সূর্য্ গ্রহণের) সালাত, ইসতিসকার সালাত।(সালাতুত তাসবীহও সহীহ হাদীসে বর্ণিত)।
২০. ঈদের তাকবীরের সংখ্যাঃ আল্লামা মাউসিলী বলেন, ইমাম আহমদ বলেছেন, ঈদের তাকবীরের সংখ্যার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণিত সকল হাদীসই যয়ীফ। (সাহাবীগণ থেকে তাঁদের কর্ম হিসাবে এ বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুনঃ লেখকের অন্য বই –“হাদীসের সনদ বিচার পদ্ধতি ও সহীহ হাদীসের আলোকে সালাতুল ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর”।
২১. সুন্দর চেহারার অধিকারীদের প্রশংসাঃ এ অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
২২. আশুরার ফযীলতঃ আশুরার দিনে সিয়াম সাধনার ফযীলত সহীহ হাদীসে প্রমাণিত। এছাড়া এই দিনে দান করা, খেযাব মাখা, তেল ব্যবহার, সুরমা মাখা, বিশেষ পানাহার ইত্যাদি বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
২৩. রজব মাসে সিয়ামের ফযীলতঃ রজব মাসে বা এই মাসের কোনো তারিখে নফল সিয়ামের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
২৪. ঋণ থেকে উপকার নেওয়াই সুদঃ আল্লামা মাউসিলী বলেন, একটি কথা প্রচলিত আছেঃ “ যে কোনো কর্জ বা ঋণ হতে উপকার নেওয়াই সুদ।” এ অর্থে বর্ণিত হাদীসের সনদ সহীহ নয়। সূদের জন্য হাদীসে সুনির্ধারিত সংজ্ঞা ও পরিচিতি রয়েছে।
২৫. অবিবাহিতদের প্রশংসায় কথিত সকল কথা ভিত্তিহীন।
২৬. ছুরি দিয়ে মাংস কেটে খাওয়ার নিষেধাজ্ঞাঃ একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, খাওয়ার সময় ছুরি ব্যবহার করা বা ছুরি দিয়ে মাংস কেটে খাওয়া আ’জামীদের আচরণ, মুসলমানদের তা পরিহার করতে হবে। এই হাদীসটি বানোয়াট পর্যায়ের। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ(স) ছুরি দিয়ে ছাগলের গোশত কেটে খেয়েছেন।
২৭. আখরোট, বেগুন, বেদানা, কিশমিশ, মাংস, তরমুয, গোলাপ ইত্যাদির উপকার বা ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট বা ভিত্তিহীন।
২৮. মোরগ বা সাদা মোরগের প্রশংসা বিষয়ক সকল কথা বানোয়াট।
২৯. আকীক পাথর ব্যবহার, বা অন্য কোনো পাথরের গুণাগুণ বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
৩০. স্বপ্নের কথা মহিলাদেরকে বলা যাবেনা মর্মে সকল হাদীস ভিত্তিহীন।
৩১. রাসূলুল্লাহ(সা) ফার্সী ভাষায় কথা বলেছেন বা ফার্সী ভাষার নিন্দা করেছেন মর্মে সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
৩২. জারজ সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবেনা মর্মে বর্ণিত সকল কথা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
৩৩. ফাসেক ব্যক্তির গীবত করার বৈধতাঃ প্রচলিত বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে “ফাসেক ব্যক্তির গীবত নেই।” অর্থাৎ ফাসিক ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার মধ্যে বিরাজমান সত্য ও বাস্তব দোষের কথা উল্লেখ করলে তাতে গীবত হবেনা বা গোনাহ হবেনা। এই অর্থে বর্ণিত সকল কথা বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও বাতিল। এই প্রকার বানোয়াট কথা অগণিত মুমিনকে ‘গীবতের’ মত ভয়ংকর পাপের মধ্যে নিপতিত করে।
৩৪. অমুক মাসে, অমুক সালে অমুক কিছু ঘটবে এইরূপ সন, তারিখ ও স্থানভিত্তিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বানোয়াট।
৩৫. দাবা খেলার উপর নিষেধাজ্ঞা বিষয়কঃ হাদীস শরীফে শরীরচর্চা মূলক খেলাধুলার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ভাগ্যনির্ভর খেলাধুলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুদ্ধিনির্ভর কিন্তু শরীরচর্চা বিহীন দাবা খেলার বৈধতার বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ থেকেই আলিমগণ মতভেদ করেছেন। অনেক সাহাবী এই খেলা কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। তবে এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে কিছু বর্ণিত হয়নি। আল্লামা মাউসিলী বলেন, এই অর্থে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়ক হাদীসগুলি দুর্বল বা বানোয়াট পর্যায়ের।
২.১.৩. মোল্লা আলী কারী ও দরবেশ হুত
১০ম-১১শ হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ও হানাফী ফকীহ মোল্লা আলী ইবনু সুলতান মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন আল হারাবী আল কারী(১০১৪ হি) রচিত বিভিন্ন মূল্যবান পুস্তকের মধ্যে দুইটি পুস্তক জাল হাদীস বিষয়ক। একটির নাম ‘আল আসরারুল মারফূয়া’ বা ‘আল মাউদূ’আত আল কুবরা’ ও অন্যটির নাম ‘আল মাসনূ ফিল হাদীসিল মাউদূ’ বা ‘আল মাউদূ‘আত আস-সুগরা’। উভয় গ্রন্থের শেষে জাল হাদীস বিষয়ক কিছু মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে।
ত্রয়োদশ হিজরী শতকের সুপ্রসিদ্ধ সিরীয় আলেম ও সূফী মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়েদ দরবেশ হুত(১২০৯-১২৭৬ হি)। তাঁর রচিত মূল্যবান গ্রন্থগুলির একটি ‘আসনাল মাতালিব’। এই গ্রন্থে তিনি সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন সহীহ, যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসের আলোচনা করেছেন। গ্রন্থের শেষে তিনি জাল হাদীস বিষয়ক কিছু মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। এই দুই আলিমের উল্লেখিত মূলনীতির আলোকে আমি এখানে সংক্ষেপে কিছু বিষয় উল্লেখ করছি (বিস্তারিত দেখুন, আল আসরার পৃ ২৭৭-২৫৯; আল-মাসনূ, পৃ. ১৭৮-২২০; আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৬৯-৩০০)।
২.১.৪. জাল হাদীস বিষয়ক কতিপয় মূলনীতি
১. ভবিষ্যতের যুদ্ধ বিগ্রহ বিষয়ক বর্ণনাসমূহ প্রায় সবই অনির্ভরযোগ্য ও গল্পকারদের বিবরণ। ভবিষ্যদ্বাণী ও ভবিষ্যৎ ঘটনাবলীর বিষয়ে অতি অল্প সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যেগুলি সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতের যুদ্ধ-বিগ্রহ, ফিতনা-ফাসাদ ইত্যাদি বিষয়ে বর্ণিত ও প্রচলিত অধিকাংশ হাদীসই অনির্ভরযোগ্য বা ভিত্তিহীন।
২. রাসূলুল্লাহ(সা) এর যুদ্ধবিগ্রহের বা জীবনের বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত ইতিহাস বা মাগাযী বিষয়ক অধিকাংশ হাদীসের কোনো সনদ বা গ্রহণযোগ্য সূত্র পাওয়া যায়না। এ সকল বিষয়ে অল্প কিছু সহীহ হাদীস রয়েছে। বাকি সবই গল্পকারদের বৃদ্ধি। ইতিহাসের ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাকের ইতিহাস প্রসিদ্ধ। তিনিও ইহুদী খৃস্টানদের তথ্য সংগ্রহ করতেন।
৩. তাফসীরের ক্ষেত্রে সহীহ সনদের তাফসীর ও শানে নুযূল খুবই কম। এ বিষয়ক অধিকাংশ হাদীস ই নির্ভরযোগ্য সনদ বা সূত্রবিহীন। বিশেষত, মুহাম্মাদ ইবনু সাইব ‘আল কালবী’(১৪৬ হি) বর্ণিত সকল তাফসীরই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এছাড়া মুকাতিল ইবনু সুলাইমান(১৫০ হি) এর বর্ণিত তাফসীরও অনুরূপ। এরা জনশ্রুতি, ইহুদী-খৃস্টানদের ইসরাঈলীয় বর্ণনা ইত্যাদির সাথে অগণিত মিথ্যা মিশ্রিত করেছেন।
৪. নবীগণের কবর সম্পর্কে যা কিছু প্রচলিত সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। রাসূলুল্লাহ(সা) ছাড়া অন্য কোনো নবীর কবর সম্পর্কে কিছু জানা যায়না।
৫. মক্কা শরীফে অনেক সাহাবীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু তাঁদের কবরের স্থান সম্পর্কে কিছুই জানা যায়না। ‘মু‘য়াল্লা’ গোরস্থানে খাদীজাতুল কুবরা(রা) এর কবর বলে পরিচিত স্থানটিও কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়নি। এক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে বলেন যে, এই স্থানটি খাদীজা(রা) এর কবর। পরে ক্রমান্বয়ে তা মক্কাবাসীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়।
৬. মক্কার ঠিক কোন স্থানটিতে রাসূলুল্লাহ(সা) জন্মগ্রহণ করেছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়না। এ নিয়ে মতভেদ আছে।
৭. কুদায়ীর ‘আশ-শিহাব’ গ্রন্থের অতিরিক্ত হাদীসসমূহ।
৪র্থ হিজরী শতকের পরে কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীস সংকলন গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ সকল হাদীস গ্রন্থের মধ্যে কিছু গ্রন্থে সংকলিত প্রায় সকল হাদীসই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এগুলির অন্যতম হলো ৫ম হিজরী শতকের মিশরীয় আলিম কাযি আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু সালামাহ আল কুদায়ী(৪৫৪ হি) প্রণীত ‘আশ-শিহাব’ নামক গ্রন্থটি। এই গ্রন্থটিতে তিনি প্রায় ১৫০০ হাদীস সংকলন করেছেন। এর মধ্যে কিছু হাদীস পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোতে সংকলিত ‘সিহাহ সিত্তা’ বা অন্যান্য প্রসিদ্ধ গ্রন্থে সংকলিত। অবশিষ্ট হাদীসগুলি তিনি নিজের সনদের সংকলন করেছেন। এই ধরনের হাদীসগুলি প্রায় সবগুলি বানোয়াট, ভিত্তিহীন বা অত্যন্ত দূর্বল সনদে সংকলিত।
৮. ইবনু ওয়াদ’আনের ‘চল্লিশ হাদীস’ গ্রন্থের সকল হাদীস
৫ম হিজরী শতকের অন্য একজন আলিম ছিলেন ইরাকের মাউসিলের কাযি আবূ নাসর মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াদ’আন(৪৯৪ হি)। তিনি ‘আল আরবাঈন’ বা ‘চল্লিশ হাদীস’ নামে হাদীসের একটি সংকলন রচনা করেন। এই সংকলনের সকল হাদীসই জাল বা বানোয়াট কথা। ইমাম সুয়ূতী বলেন, এই ‘চল্লিশ হাদীস’ নামক গ্রন্থের হাদীস নামক জাল কথাগুলির বক্তব্য খুবই সুন্দর। এগুলির মধ্যে হৃদয়গলানো ওয়ায রয়েছে। কিন্তু কথা সুন্দর হলেইতো তা রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা বলে গণ্য হবেনা। বিশুদ্ধ সনদে তাঁর থেকে বর্ণিত হতে হবে। এই গ্রন্থের সকল হাদীসই জাল। তবে জালিয়াতগণ কোনো কোনো জাল হাদীসের মাঝে সহীহ হাদীসের কিছু বাক্য ঢুকিয়ে দিয়েছে।
৯. শারাফ বালখী রচিত ‘ফাযালুল উলামা’ নামক বইয়ের সকল হাদীস।
১০. ‘কিতাবুল আরূস’ নামক একটি প্রচলিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে নব দম্পতি ও বিবাহিতদের বিষয়ে অনেক জাল কথা সংকলন করা হয়েছে। জালিয়াত বইটি ইমাম জাফর সাদিকের নামে প্রচার করেছে।
১১. তৃতীয়-চতূর্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম ‘হাকিম তিরমিযী’ মুহাম্মাদ ইবনু আলী (মৃত্যু. আনু. ৩২০ হি)। তিনি ‘নাওয়াদিরুল উসূল’ ও অন্যান্য অনেক প্রসিদ্ধ পুস্তক রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থগুলিতে অনেক জাল হাদীস রয়েছে। এমনকি মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, তিনি তাঁর গ্রন্থগুলিকে জাল হাদীস দিয়ে ভরে ফেলেছেন। ফলে তাঁর গ্রন্থের কোনো হাদীস নিরীক্ষা ছাড়া গ্রহণ করা যাবেনা।
১২. ইমাম গাযযালী রচিত ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে উল্লেখিত কোনো হাদীস নিরীক্ষা ছাড়া গ্রহণ করা যাবেনা। ইমাম গাযযালীর মহান মর্যাদা অনস্বীকার্য্য। তবে তিনি হাদীস উল্লেখের ব্যাপারে কোনো যাচাই বাছাই করেননি। প্রচলিত কিছু গ্রন্থ ও জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে অনেক জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
১৩. আল্লামা ইমাম আবুল লাইস সামারকান্দি নাসর ইবনু মুহাম্মাদ (৩৭৩ হি) রচিত ‘তানবীহুল গাফিলীন’ গ্রন্থের অবস্থাও অনুরূপ। এই গ্রন্থে অনেক মাউযূ বা জাল ও বানোয়াট হাদীস রয়েছে।
১৪. ৬ষ্ঠ শতকের প্রসিদ্ধ আলিম শু’আইব ইবনু আব্দুল আযীয খুরাইফীশ(৫৯৭ হি)। তিনি ওয়ায উপদেশ ও ফযীলত বিষয়ে ‘আর-রাওদুল ফাইক’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই গ্রন্থটিতেও অনেক জাল হাদীস স্থান পেয়েছে।
১৫. তাসাউফের গ্রন্থগুলিতে সূফী বুযুর্গগণের সরলতার কারণে অনেক জাল হাদীস স্থান পেয়েছে।
১৬. ইমাম হাকিম(৪০৫ হি) তাঁর ‘আল মুসতাদরাক’ গ্রন্থে অনেক যয়ীফ, বাতিল ও মাউযূ হাদীসকে ‘সহীহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে তিনি খুবই দুর্বলতা দেখিয়েছেন। এজন্য তাঁর মতামতের উপর নির্ভর করা যায়না।
১৭. কুদা‘য়ীর ‘আস-শিহাব’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন ৬ষ্ঠ শতকের একজন মুহাদ্দিস ‘মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু আহমাদ ইবনু হাবীব আল আমিরী’(৫৩০ হি)। তিনিও হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের বিষয়ে বিশেষ ঢিলেমি ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন। এই গ্রন্থের অনেক দুর্বল, জাল ও ভিত্তিহীন হাদীসকে সহীহ বা হাসান বলে উল্লেখ করেছেন। আব্দুল রাউফ মুনাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর এ সকল ভুল উল্লেখ করেছেন। এজন্য নিরীক্ষা ছাড়া তাঁর মতামত অগ্রহণযোগ্য।
১৮. আলীর(রা) এর প্রতি রাসূলুল্লাহ(সা) এর অসীয়ত নামে প্রচলিত অসীয়ত
আলী(রা) এর নামে একাধিক জাল অসীয়ত প্রচলিত আছে। প্রসিদ্ধ জাল অসীয়ত এর শুরুতে একটি বাক্য সহীহ হাদীস হতে নেওয়া হয়েছে। পরের সকল বাক্য জাল ও মিথ্যা। এই অসীয়তের শুরুতে বলা হয়েছেঃ ‘হে আলী মূসা(আ) এর কাছে হারূন(আ) এর মর্যাদা যেরূপ, আমার কাছেও তোমার মর্যাদা সেরূপ। তবে আমার পরে কোনো নবী নেই।’ জালিয়াত এই বাক্যটি সহীহ হাদীস হতে নিয়েছে। এরপর বিভিন্ন ভিত্তিহীন কথা উল্লেখ করেছে। যেমনঃ হে আলী, মুমিনের আলামত তিনটি-……মুনাফিকের আলামত………..হিংসুকের আলামত……..পুরো অসীয়তটিই বাতিল, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা কথায় ভরা। মাঝে মধ্যে দুই একটি সহীহ হাদীসের বাক্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। [এই জাল অসীয়তটি পুরোটাই বাংলায় ছাপা হয়েছে। দেখুন, আল্লামা সুয়ূতী, নবী কারীম(সা) এর অসীয়ত, অনুবাদ মাওলানা মুহাম্মাদ রিজাউল করীম ইসলামাবাদী (ঢাকা,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ ২০০৩), পৃ. ১১-২৪]
এছাড়া আলী(রা) এর নামে আরো একাধিক অসীয়ত জালিয়াতগণ তৈরি করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, ‘আলীর প্রতি রাসূলুল্লাহ(সা) এর অসীয়ত’ নামে প্রচারিত সবই জাল। তবে এগুলির মধ্যে জালিয়াতগণ দুই একটি সহীহ হাদীসের বাক্য ঢুকিয়ে দিয়েছে, যেগুলি অন্য সনদে বর্ণিত হয়েছে।
১৯. আবূ হুরাইরার(রা) এর প্রতি রাসূলুল্লাহ(সা) এর অসীয়ত
আবূ হুরাইরা(রা) এর প্রতি রাসূলুল্লাহ(সা) এর অসীয়ত নামে আরেকটি জাল ও বানোয়াট হাদীস প্রচলিত আছে। এই অসীয়তটিও আগাগোড়া জাল ও মিথ্যা। তবে জালিয়াতগণ তাদের অভ্যাসমত এর মধ্যে অন্য সনদে বর্ণিত দুই চারটি সহীহ হাদীসের বাক্য জোড়াতালি দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। (এই জাল অসীয়তটিও পূর্বের অসীয়তটির সাথে বাংলায় ছাপা হয়েছে। দেখুন- আল্লামা সুয়ূতী, নবী করীম(সা) এর অসীয়ত, পৃ. ২৭-৩৮)।
২০. বিলালের মদীনা পরিত্যাগ ও স্বপ্ন দেখে মদীনায় আগমনের কাহিনী
রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের পরে বিলাল(রা) জিহাদের উদ্দেশ্যে মদীনা ছেড়ে সিরিয়া এলাকায় গমন করেন এবং সিরিয়াতেই বসবাস করতেন। কথিত আছে যে, একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) তাঁকে যিয়ারতের উৎসাহ দিচ্ছেন। তখন তিনি মদীনায় আগমন করেন…..ইত্যাদি। আল্লামা কারী বলেন, সুয়ূতী উল্লেখ করেছেন যে, এই কাহিনীটি বানোয়াট। সম্ভবত ইবনু হাজার মাক্কী ইমাম সুয়ূতীর এই আলোচনা দেখতে পাননি; এইজন্য তিনি এই জাল কাহিনীটিকে তার যিয়ারত বিষয়ক পুস্তকটিতে উল্লেখ করেছেন।
২১. সপ্তাহের বিশেষ দিন বা রাতের জন্য বিশেষ নামাজের বিষয়ে বর্ণিত সবকিছু বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।অনুরূপভাবে আশুরার দিনের বা রাতের নামায, রজব মাসের প্রথম রাতের নামায, রজব মাসের অন্যান্য দিন বা রাতের নামায, রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতের নামায ইত্যাদি সকল কথাই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
আল্লামা আলী কারী বলেন, কূতুল কুলুব, এহইয়াউ ঊলূমিদ্দীন, তাফসীরে সা’আলাবী ইত্যাদি গ্রন্থে এ সকল হাদীস রয়েছে দেখে পাঠক ধোঁকা খাবেননা। এগুলি সবই বানোয়াট।
২২. হাসান বসরী হযরত আলী(রা) হতে খিরকা বা সূফী তরীকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বলে যা কিছু প্রচলিত আছে সবই ভিত্তিহীন বাতিল কথা।
২৩. রাসূলুল্লাহ(সা) উমার(রা)ও আলী(রা) কে তাঁর জামা বা খিরকা দিয়েছিলেন উয়াইস কারণীকে পৌছে দেয়ার জন্য এবং তাঁরা তাঁকে তা পৌছে দিয়েছিলেন মর্মে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন।
২৪. কুতুব-আকতাব, গওস, নকীব-নকাবা, নাজীব-নুজাবা, আওতাদ ইত্যাদি বিষয়ক সকল হাদীস বাতিল ও ভিত্তিহীন।
২৫. মেহেদি বা মেন্দির বিশেষ ফযীলত বা প্রশংসায় বর্ণিত সকল হাদীস ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। শুধুমাত্র মেহেদী দিয়ে খেযাব দেওয়ার উৎসাহজ্ঞাপক হাদীসগুলি নির্ভরযোগ্য।
২৬. আজগুবি সাওয়াব বা শাস্তি
মুহাদ্দিসগণ সনদ বিচার ছাড়াও যে সমস্ত আনুষঙ্গিক অর্থ ও তথ্যগত বিষয়কে জাল হাদীসের চিহ্ন হিসাবে উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো আজগুবি সাওয়াব ও শাস্তির বিবরণ।
বিভিন্ন প্রকারের সামান্য নফল ইবাদত বা অত্যন্ত সাধারণ ইবাদত, যিকির, দোয়া, কথা, কর্ম বা চিন্তার জন্য অগণিত আজগুবি সাওয়াবের বর্ণনা। এক্ষেত্রে জালিয়াতগণ কখনো সহীহ হাদীসে প্রমাণিত যিকির, সালাত, দোয়া বা ইবাদতের এইরূপ আজগুবি সাওয়াব বলেছে। কখনো বা বানোয়াট যিকির, সালাত, দোয়া, সিয়াম ইবাদত তৈরি করে তার বানোয়াট আজগুবি সাওয়াব বর্ণনা করেছে। এ সকল জাল হাদীসের ভাষা নিম্নরূপঃ যে ব্যক্তি অমুক যিকির করবে, অমুক বা অমুক কাজটি করবে তার জন্য এক লক্ষ নেকী, এক লক্ষ পাপ মোচন……। অথবা তার জন্য জান্নাতে এক লক্ষ বৃক্ষ রোপন, প্রত্যেক গাছের……….গোড়া স্বর্ণের……….ডালপালা………পাতা……….ইত্যাদি কাল্পনিক বর্ণনা। অথবা তার জন্য একলক্ষ শহীদের সাওয়াব, সিদ্দীকের সাওয়াব………। অথবা তার জন্য একটি ফিরিশতা/পাখি বানানো হবে, তার এত হাজার বা এত লক্ষ মুখ থাকবে…….ইত্যাদি। অথবা অমুক দোয়া পাঠ করলে লোহা গলে যাবে, প্রবাহিত পানি থেমে যাবে….প্রত্যেক অক্ষরের জন্য এত লক্ষ ফেরেশতা ইত্যাদি।
২৭. স্বাভাবিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিপরীত কথা
এই জাতীয় বানোয়াট কথাগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
১. ‘বেগুন সকল রোগের ঔষধ’ বা ‘বেগুন যে নিয়্যাতে খাওয়া হবে, সেই নিয়্যাত পূরণ হবে’।
২. ‘যদি কেউ কোনো কথা বলে এবং সে সময়ে কেউ হাঁচি দেয় তাহলে সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করে।’
৩. তোমরা ডাল খাবে; কারণ ডাল বরকতময়। ডাল কলব নরম করে এবং চোখের পানি বাড়ায়। ৭০ জন নবী ডালের মর্যাদা বর্ণনা করেছেন।
৪. স্বর্ণকার, কর্মকার ও তাঁতীগণ সবচেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী।
২৮. অবান্তর, অপ্রয়োজনীয় ও ফালতু বিষয়ের আলোচনা
যে সকল কথা সাধারণ জ্ঞানী মানুষেরা আলোচনা করতে ইচ্ছুক নয়, সকল জ্ঞানীর সরদার সাইয়িদুল বাশার রাসূলুল্লাহ(সা) সে বিষয়ে কথা বলতে পারেননা। এই জাতীয় কথাবার্তার মধ্যে রয়েছেঃ
১. চাউল যদি মানুষ হতো তবে ধৈর্য্যশীল হতো, কোনো ক্ষুধার্ত তা খেলেই পেট ভরে যেত।
২. আখরোট ঔষধ ও পনির রোগ। দুটি একত্রে পেটে গেলে রোগমুক্তি।
৩. তোমরা লবণ খাবে। লবণ ৭০ প্রকার রোগের ঔষধ।
৪. তারকাপুঞ্জ আরশের নিচে একটি সাপের ঘাম….
৫. আল্লাহ ক্রোধান্বিত হলে ফার্সী ভাষায় ওহী নাযিল করেন।
৬. সুন্দর চেহারার দিকে তাকালে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়। সুন্দর চেহারাকে আল্লাহ জাহান্নামে শাস্তি দিবেননা।
৭. চোখের নীল রং শুভ।
৮. আল্লাহ মাথার টাকের মাধ্যমে কিছু মানুষকে পবিত্র করেছেন, যাদের মধ্যে প্রথম হযরত আলী(রা)।
৯. নাকের মধ্যে পশম গজানো কুষ্ঠরোগ হতে নিরাপত্তা দেয়।
১০. কান ঝিঁঝিঁ করা বা কান ডাকা বিষয়ক হাদীসগুলি বানোয়াট।
এই জাতীয় বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন গাছ, সবজি, ঔষধি ইত্যাদির উপকার বর্ণনায় প্রচারিত হাদীস। অনুরূপভাবে মোরগ, সাদা মোরগ ইত্যাদির ফযীলতে বানোয়াট হাদীসও এই পর্যায়ভুক্ত।
২৯. চিকিৎসা, টোটকা বা খাদ্য বিষয়ক অধিকাংশ কথাই বানোয়াট
এই জাতীয় ফালতু কথার মধ্যে রয়েছে
১. অমুক অমুক কাজে স্মৃতিশক্তি কমে বা লোপ পায়। অমুক কাজে অমুক রোগ হয়। অমুক কাজ করলে অমুক রোগ দূর হয়……..ইত্যাদি।
২. অমুক খাদ্যে কোমর মজবুত হয়, অমুক খাদ্যে সন্তান বেশি হয়। মুমিন মিষ্ট এবং সে মিষ্টি পছন্দ করে। ঝুটা মুখে খেজুর খেলে কৃমি মরে।
৩০. উজ পালোয়ান, কোহে কাফ ইত্যাদি বাস্তবতা বর্জিত কথাবার্তা
এই জাতীয় ভিত্তিহীন বাতিল কথাবার্তার মধ্যে রয়েছেঃ
১. উজ ইবনু উনুক বা ওজ পালোয়ানের কাল্পনিক দৈর্ঘ্য….‘উজ পালোয়ান’ বিষয়ক সকল কথাই মিথ্যা ও বানোয়াট।
২. কোহে কাফ বা কাফ পাহাড়ের বর্ণনায় প্রচারিত ও বর্ণিত হাদীসসমূহ। এ বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন, জাল ও মিথ্যা।
৩. পৃথিবী পাথরের উপর পাথর একটি ষাঁড়ের শিঙ এর উপর।…….একটি মাছের উপর…./ষাঁড়টি নড়লে শিঙ নড়ে আর ভূমিকম্প হয়……..। এ জাতীয় সকল কথাই মিথ্যা ও বানোয়াট যা অসৎউৎসাহী ও নির্লজ্জ্ জালিয়াতগণ হাদীসের নামে প্রচার করেছে।
৩১. বিশুদ্ধ হাদীসের স্পষ্ট বিরোধী কথাবার্তা কুরআনের অনেক আয়াত ও অগণিত সহীহ হাদীসের শিক্ষা হলো, আখিরাতের মুক্তি নির্ভর করে কর্মের উপর, নাম কিংবা বংশের উপর নয়। অনুরূপভাবে কর্মের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হলো ফরয, যা করা অত্যাবশ্যক ও হারাম যা বর্জন করা অত্যাবশ্যক। এরপর ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব ইত্যাদি কর্ম রয়েছে। সমাজে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে যা এই ইসলামী শিক্ষার স্পষ্ট বিরোধী। সনদ বিচারে সেগুলি দুর্বল বা জাল বলে প্রমাণিত। তবে সনদ বিচার ছাড়া শুধু অর্থ বিচার করলেও এর জালিয়াতি ধরা পড়ে।
যেমন, অনেক হাদীসের সামান্য মুস্তাহাব কর্মের পুরস্কার বা সাওয়াব হিসেবে বলা হয়েছে, এই কর্ম করলে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা বা তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে….ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মুহাম্মাদ বা আহমাদ নাম হওয়ার কারণে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেওয়া হবে। এই প্রকারের সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।