২.৮. ইলম ও আলিমদের ফযীলত বিষয়ক
জ্ঞানার্জনের নির্দেশে এবং আলিম ও তালিব ইলম বা শিক্ষার্থীদের মর্যাদা বর্ণনায় অনেক আয়াতে কুরআনী ও সহীহ হাদীস রয়েছে। অপরদিকে ইলমের ফযীলত বর্ণনায় অনেক মিথ্যা হাদীস বানানো হয়েছে। অনেক নির্বোধ নেককার(!) মানুষ মানুষকে জ্ঞানার্জনের ফযীলত বর্ণনায় ও অনেক মিথ্যা হাদীস বানিয়েছেন। কি জঘন্য অপরাধ! তারা ভেবেছেন, কুরআন কারীমের আয়াত ও সহীহ হাদীস যথেষ্ট হচ্ছে না; সুতরাং আরো কিছু বানোয়াট ফযীলতের হাদীস না বললে হয়ত মানুষেরা ইলম শিখত আসবে না। যেহেতু আলিমরাই হাদীস প্রচার করেন, সেহেতু অনেক আলিম অনেক সময় সুন্দর অর্থবোধক এ সকল জাল হাদীসকে বিচার না করেই বর্ণনা করেছেন। এ কারণে ইলম ও আলিমদের ফযীলত বিষয়কে অনেক জাল হাদীস সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সকল মিথ্যা হাদীস জানা ও তা বলা হতে বিরত থাকা আমাদের সকলের কর্তব্য। কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীসই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
১. কিছু সময় চিন্তা হাজার বৎসর ইবাদত হতে উত্তম
এ সকল বানোয়াট হাদীসের মধ্যে রয়েছেঃ “এক মুহুর্ত বা কিছু সময় চিন্তা-মুরাকাবা করা এক বৎসর ইবাদত হতে উত্তম।” কেউ বাড়িয়ে বলছেন ৭০ হাজার বৎসর ইবাদত হতে উত্তম। মুহাদ্দিসগণ কথাটি জাল বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা হিসেবে তা মিথ্যা। কথাটি পূর্ববর্তী কোনো আলিমের উক্তিমাত্র।(মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ.৯৭; আলবানী, যয়ীফুল জামিয় ৫৮১ পৃ.)।
২. শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কালি উত্তম
ইলমের ফযীলতে বানানো অন্য একটি জাল হাদীস- “শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কালি উত্তম।” সাখাবী, যারকানী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস জানিয়েছেন যে, কথাটি খুব সুন্দর শুনালেও তা রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা নয়। যারকাশী বলেছেন, বাক্যটি আসলে হযরত হাসান বসরীর(রহ) উক্তি।
৩. আমার উম্মতের আলিমগণ বণী ইসরাঈলের নবীগণের মত
আলিম ও ধার্মিকগণের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি বাক্য। “আমার উম্মতের আলিমগণ বণী ইসরাঈলের নবীগণের মত”।
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই বাক্যটি নবীজী(সা) এর কথা নয়। বরং তাঁর নামে প্রচলিত একটি ভিত্তিহীন, সনদহীন মিথ্যা, জাল ও বানোয়াট কথা।(সাখাবী, আল মাকাদিস, ২৯৩ পৃ, মোল্লা কারী, আল আসরার ১৫৯ পৃ.)। অনেক ওয়ায়িয এ মিথ্যা হাদীসকে কেন্দ্র করে জাল গল্প বলেন যে, হযরত মূসা(আ) এর সাথে নাকি রাসূল মুহাম্মাদ(সা) এর এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল! নাউজুবিল্লাহ! কি জঘন্য বানোয়াট কথা!!
এখানে উল্লেখ্য যে, আলিমগণের ফযীলতে অন্য অনেক হাদীস রয়েছে যাতে আলিমগণকে নবীগণের কাছের মর্যাদার অধিকারী বলা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য(হাসান) একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ “আলিমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী।”
তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন। আমাদের উচিত বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলে গোনাহগার না হয়ে এ সকল গ্রহণযোগ্য হাদীস আলোচনা করা।
৪. আলিমগণের চেহারার দিকে তাকান
আলিমদের ফযীলতে বানানো অন্য একটি জাল হাদীস। “আলিমের চেহারার দিকে তাকান আল্লাহর কাছে ৬০ বৎসরের সিয়াম ও কিয়াম(তাহাজ্জুদের) ইবাদতের চেয়ে অধিক প্রিয়।”
অন্য শব্দে বলা হয়েছেঃ “আলিমের চেহারা দিকে তাকান ইবাদত।”
এ দুটি বাক্যের কোনোটিই হাদীস নয়। মুহাদ্দিসগণ বাক্য দুটিকে মিথ্যা বা বানোয়াট হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন।(সাখাবী, আল মাকাসিদ, ৪৪২ পৃ.; মুল্লা কারী,আল আসরার, ২৫৩ পৃ)।
৫. আলিমের ঘুম ইবাদত
এ ধরনের আরেকটি জাল হাদীস-“আলিমের ঘুম ইবাদত।” মোল্লা আলী কারী বলেন-“রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা হিসেবে(মারফূ হাদীস) এই বাক্যটির কোনো অস্তিত্ব নেই।”
৬. মূর্খের ইবাদতের চেয়ে আলিমের ঘুম উত্তম
অনুরূপ আরেকটি ভিত্তিহীন জাল কথাঃ
“মূর্খের ইবাদতের চেয়ে আলিমের ঘুম উত্তম।”
দুটি বাক্যই জাল। সহীহ, যয়ীফ বা মাঊযু কোনো সনদেই এই কথা দুটির অস্তিত্ব নেই। তবে কাছাকাছি অর্থে একটি জয়ীফ হাদীস রয়েছে- “ইলমসহ নিদ্রা যাওয়া মুর্খতাসহ সালাত আদায় করা হতে উত্তম।”(আবূ নুয়াইম ইসপাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৪/৩৮৫; মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, পৃ. ২৫৫; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৮৬১)।
৭. আলিমের সাহচর্য্য এক হাজার রাকাত সালাতের চেয়ে উত্তম
এ বিষয়ে অন্য একটি বানোয়াট হাদীসঃ “একজন আলিমের মজলিসে উপস্থিত হওয়া এক হাজার রাকা’য়াত নামায পড়ার চেয়ে উত্তম।” মুহাদ্দিসগণ বাক্যটিকে মিথ্যা হাদীস বলে গণ্য করেছেন।(মুল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১১৩)। এই জাল হাদীসটির উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে আরো একটি কথা বলা হয়েছেঃ “ওলীদের সাহচর্য্যে এক মুহুর্ত থাকা একশত বৎসর রিয়াহীন নামাজ পড়ার চেয়েও উত্তম।” সৎ ও নেককার মানুষের সাহচর্য্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কুরআন ও হাদীসে এর বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সাহচর্য্যের এই ফযীলত বানোয়াট।
৮. আসরের পর লেখাপড়া না করা
আমাদের দেশে অনেক আলিম ও মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, আসরের পরে লেখাপড়া করলে চোখের ক্ষতি হয়। একটি বানোয়াট হাদীস হতে এই কথাটির উৎপত্তি। উক্ত বানোয়াট হাদীসে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি তার চক্ষুদ্বয়কে ভালবাসে সে যেন আসরের পরে না লেখে।” কথাটি হাদীস নয়। এর কোনো ভিত্তি নেই। কম আলোতে, অন্ধকারে বা আলো আঁধারিতে লেখাপড়া করলে চোখের ক্ষতি হতে পারে। ডাক্তারগণ এ বিষয়ে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো হাদীস নেই।(সাখাবী, আল মাকাদিস, পৃ. ৩৯৭; মুল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ২১৬)।
৯. চীনদেশে হলেও জ্ঞানের সন্ধান কর
আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি কথাঃ “চীন দেশে হলেও জ্ঞানের সন্ধান কর।” অধিকাংশ মুহাদ্দিস একে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ একে অত্যন্ত দুর্বল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। দুইজন অত্যন্ত দুর্বল রাবী, যারা মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করতেন শুধুমাত্র তারাই রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা হিসেবে প্রচার করেছেন।(ইবনু আদী, আল কামিল ১/২৯২; ইবনুল জাউযী, আল মাউদুআত ১/১৫৪; সুয়ূতী, আল লাআলী ১/১৯৩)।
১০. রাতের কিছু সময় ইলম চর্চা সারারাত জেগে ইবাদতের চেয়ে উত্তম
আমাদের দেশের প্রসিদ্ধ একটি গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ “বোখারী শরীফের আরো একটি হাদীসে আছে-হযরত(দ) বলেছেন, রাত্রির এক ঘন্টা পরিমাণ(দ্বীনি) এলম শিক্ষা করা সমস্ত রাত্রি জাগরিত থাকিয়া ইবাদত করার চেয়েও ভাল।”(মোঃ গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ২৫)।
এই কথাটি সহীহ বুখারীতো দূরের কথা অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থেই রাসূলুল্লাহ(সা) এর বাণী হিসেবে সংকলিত হয় নি। ইমাম দারিমী তার সুনান গ্রন্থে অত্যন্ত দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন সনদে সাহাবী ইবনু আব্বাসের(রা) বাণী হিসেবে কথাটি সংকলিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে এ অর্থে যা কিছু বলা হয়েছে সবই জাল ও বানোয়াট।[দারিমী, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান(২৫৫ হি), আস সুনান ১/৯৪, ১৫৭)।
১১. ইলম, আমল ও ইখলাসের ফযীলত
ইলম, আমল ও ইখলাসের গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআন হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলির পাশাপাশি কিছু জাল হাদীস সমাজে প্রচলিত। যেমনঃ “সকল মানুষ মৃত/ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত, শুধু আলিমগণ ছাড়া। সকল আলিমগণই ধ্বংসপ্রাপ্ত শুধু আমলকারীগণ ছাড়া। আমলকারীগণ সকলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত/ডুবন্ত শুধু মুখলিসগণ ছাড়া। মুখলিসগণ কঠিন ভয়ের মধ্যে।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই কথাগুলি জাল। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাঊযূ সনদেও তা রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণিত হয় নি। দরবেশ হুত বলেনঃ “সামারকান্দী তার ‘তানবীহুল গাফিলীন’ পুস্তকে এই ‘হাদীসটি’ উল্লেখ করেছে। আর ওয়ায়েজগণ তা নিয়ে মাতামাতি করেন। এই পুস্তকটিতে অনেক মিথ্যা ও মাউযূ হাদীস রয়েছে। এজন্য পুস্তকটির উপর নির্ভর করা যায় না।”(দরবেশ হুত, আসানুল মাতালিব, পৃ. ২৪৬, আলবানী, যায়ীফাহ ১/১৭৪)।
১২. ইলম সন্ধান করা পূর্বের পাপের মার্জনা
ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনান গ্রন্থে নিম্নের হাদীসটি সংকলন করেছেনঃ “যদি কোনো ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করে, তবে তা তার পূর্ববর্তী পাপের জন্য ক্ষতিপূরণ(পাপমোচনকারী) হবে।”(তিরিমিযী, আস সুনান ৫/২৯)।
ইমাম তিরমিযী ছাড়াও দারিমী, তাবারানী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। সকলেই ‘অন্ধ আবূ দাঊদ’ নুফাই ইবনুল হারিস এর মাধ্যমে হাদীসটি সংকলন করেছেন। তিনি ১৫০ হিজরীর দিকে ইন্তিকাল করেন। সমসাময়িক ও পরবর্তীযুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, এই ব্যক্তি হাদীসের নামে মিথ্যা বলতেন।
সমসাময়িক প্রসিদ্ধ তাবেয়ী কাতাদা ইবনু দি‘আমা(১১৭ হি) তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, প্রসিদ্ধ তাবে-তাবেয়ী হাম্মাম ইবনু ইয়াহইয়া(১৬৫হি) বলেন, ‘অন্ধ আবূ দাউদ’ আমাদের নিকট এসে হাদীস বলতে থাকেন। তিনি সাহাবী বারা ইবনু আযিব(৭৩ হি), সাহাবী যাইদ ইবনু আকরাম(৬৮ হি) প্রমুখ সাহাবী থেকে হাদীস শুনেছেন বলে দাবি করেন। তিনি দাবি করেন যে, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১৮ জন সাহাবী হতে তিনি হাদীস শিক্ষা করেছেন। তখন আমরা প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুহাদ্দিস কাতাদার নিকট তার বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি বলেন লোকটি মিথ্যা বলছে। সে এ সকল সাহাবীকে দেখেনি বা তাদের থেকে কোনো কিছু শুনে নি। কারণ কয়েক বছর আগে মহামারীর সময়েও আমরা তাকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে দেখেছি।(মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১-২২)।
ইমাম বুখারী, আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আবু হাতিম রাযি প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন, নাসাঈ, ইবনু হিব্বান প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন। এই ব্যক্তিটি ছাড়া অন্য কেউ কোনো সনদে এই হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। এই ব্যক্তি দাবি করেন যে, তাকে আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ নামক এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে তার পিতা সাখবারাহ বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) এই কথাটি বলেছেন। এই আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ নামক ব্যক্তিটিও অপরিচিত। অন্ধ আবূ দাউদ ছাড়া আর কেউ তার নাম উল্লেখ করেন নি বা তাকে চিনেন বলে উল্লেখ করেননি। অনুরূপভাবে এই ‘সাখবারাহ’ নামক সাহাবার কথাও এই অন্ধ আব্দুল্লাহ ছাড়া আর কেউ উল্লেখ করেন নি। এই নামে কোনো সাহাবী ছিলেন বলে অন্য কোনো সূত্র হতে জানা যায় না।(ইবনু হাজার, তাহযীব ১০/৪১৯; তাকরীব, পৃ. ৪৬৫; আস ইসাবা ৩/৩৫)।
হাদীসটি উল্লেখ করার পরে উপরের বিষয়গুলির দিকে ইঙ্গিত করে ইমাম তিরমিযী বলেনঃ “এই হাদীসটির সনদ দুর্বল। আবূ দাঊদ দুর্বল। আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ এবং তার পিতার বিশেষ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। এই অন্ধ আবূ দাঊদের বিষয়ে কাতাদা ও অন্যান্য আলিম কথা বলেছেন।”(তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৯)।
ইমাম তিরমিযী এখানে হাদীসটির সনদ দুর্বল বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন। দুর্বলতার পর্যায় উল্লেখ করেন নি। আমরা জানি যে, দুর্বল বা যয়ীফ হাদীসের এক প্রকার জাল হাদীস। যে দুর্বল হাদীসের বর্ণনাকারী মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত সেই দুর্বল হাদীসকে জাল হাদীস বলা হয়। এ কারণে পরবর্তী কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘জাল’ হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা নূরুদ্দীন হাইসামী এই হাদীস উল্লেখ করে বলেনঃ “এর সনদে অন্ধ আবূ দাউদ রয়েছেন যিনি একজন প্রসিদ্ধ মিথ্যাবাদী ছিলেন।”(হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১২৩; আলবানী, যাঈফুল জামি, পৃ. ৮১৯)।
১৩. খালি পায়ে ভাল কাজে বা ইলম শিখতে যাওয়া
ইলম শিক্ষার জন্য বা কোনো ভাল কাজে পথ চলার জন্য খালি পায়ে চললে বেশে সওয়াব হবে বলে কিছু কথা প্রচলিত আছে। এগুলি সবই বাতিল কথা ও জাল হাদীস।(ইবনুল জাউযী, আল- মাঊদু’আত ১/১৫৫-১৫৭; সুয়ূতী, লাআলী ১/১৯৪-১৯৬; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/২৫১-২৫২)।
১৪. ইলম যাহির ও ইলম বাতিন
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী, সুয়ূতী, মুল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, ইলমুল বাতিন বা বাতিনী ইলমকে যাহেরী ইলম হতে পৃথক বা গোপন কোনো বিষয় হিসেবে বর্ণনা করে যে সকল হাদীস প্রচলিত সবই বানোয়াট ও মিথ্যা।(সুয়ূতী, যাইুলুল মাউযূআত, পৃ. ৪৪; মুল্লা আলী কারী, আল-মাসনূয়, পৃ. ৯৩)।
আমাদের সমাজে এ বিষয়ে সত্য ও মিথ্যা অনেক সময় মিশ্রিত হয়েছে এবং অনেক হাসান ও সহীহ হাদীসকে বিকৃত অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা জানি যে, মানুষের জ্ঞানের দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় হলো-কোনো কিছু জানা। দ্বিতীয় পর্যায় হলো, এই জানা মনের গভীরে বা অবচেতনে বিশ্বাসে পরিণত হওয়া। যেমনঃ একজন মানুষ জানেন যে, ‘ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, অথবা ‘ধুমপান বিষপান’। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ধুমপান করেন। কিন্তু তিনি কখনোই বিষপান করেন না। কারণ তার এই জ্ঞান সুগভীর বিশ্বাসে পরিণত হয় নি। যখন তা বিশ্বাসে পরিণত হবে তখন তিনি আর ধুমপান করতে পারবেন না, যেমন তিনি বিষপান করতে পারেন না।
ধর্মীয় বিধিবিধানের ক্ষেত্রেও জ্ঞানের এইরূপ দুটি পর্যায় রয়েছে। একজন মানুষ জানেন যে, প্রজ্জ্বলিত আগুনের মাঝে ঝাপ দিলে তিনি আগুনে পুড়ে যাবেন। এ কারণে তিনি কখনোই আগুনের মধ্যে ঝাপ দিবেন না। তাকে ধাক্কা দিয়ে আগুনের মধ্যে ফেলতে গেলেও প্রাণপণে বাধা দিবেন। আবার এই মানুষটিই জানেন এবং বিশ্বাস করেন যে, ‘নামায কাযা করলে জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত আগুনে পুড়তে হবে’, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নামায কাযা করেন। কারণ তার এই ‘জ্ঞান’ ও ‘বিশ্বাস’ প্রকৃতপক্ষে মনের গভীরে বা অবচেতন মনের গভীর বিশ্বাসের জ্ঞানে পরিণত হয় নি। যখন এই জ্ঞানটি তার গভীর বিশ্বাসের জ্ঞানে পরিণত হবে তখন তিনি কোনো অবস্থাতেই নামায কাযা করতে পারবেন না, যেমনভাবে তিনি কোনভাবেই আগুনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন না। তিনি জাহান্নামের আগুন হৃদয় দিয়ে অবলোকন ও অনুভব করতে পারবেন।
এজন্য আমরা জানি যে, একজন সাধারণ ধার্মিক মুসলিম, যিনি সাধারণভাবে ফজরের নামায জামাতে আদায় করেন, তিনি যদি রাতে দেরি করে ঘুমাতে যান, তাহলে হয়ত ফজরের জামাতের জন্য তার ঘুম ভাঙবে না। কিন্তু এই ব্যক্তিরই যদি রাত ৪ টায় ট্রেন বা গাড়ি থাকে তাহলে রাতে কয়েকবার ঘুম ভেঙ্গে যাবে। কারণ গাড়ি ফেল করলে তার কিছু অসুবিধা হবে বা ক্ষতি হবে এই জ্ঞানটি তার অবচেতন মনের বা ‘কালবের জ্ঞানে’ পরিণত হয়েছে। কিন্তু নামাযের জামাত ফেল করলে কিছু ক্ষতি হবে এই জ্ঞানটি সেই প্রকারের গভীর জ্ঞানে পরিণত হয় নি। যখন তা এরূপ গভীর জ্ঞান বা কলবের জ্ঞানে পরিণত হবে তখন ফজরের জামাতের জন্যও তার বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
প্রথম পর্যায়ের জ্ঞানের পালন ও আচরণই জ্ঞানকে দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়। সকল ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। ‘ধুমপানে বিষপান’ এই জ্ঞানটিকে যদি কারো মনে বারংবার উপস্থাপিত করা হয়, সে তা পালন করে, ধুমপানের অপকারিতার দিকগুলি বিস্তারিত পাঠ করে, এ বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা ইত্যাদিতে উপস্থিত হয়, তবে এক পর্যায়ে এই জ্ঞান তার গভীর জ্ঞানে পরিণত হবে এবং তিনি ধূমপান পরিত্যাগ করবেন। অনুরূপভাবে ‘গীবত জাহান্নামের পথ’ এই জ্ঞানটি যদি কেউ বারংবার আলোচনা করেন, এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলি বারংবার পাঠ করেন, আখিরাতের গভীর বিশ্বাসে তিনি এর শাস্তি মন দিয়ে অনুভব করেন…..তবে এক পর্যায়ে তিনি গীবত পরিত্যাগ করবেন। তার মনই তাকে গীবত করতে বাধা দিবে।
আমরা জানি যে, দুই পর্যায়ের জ্ঞানই জ্ঞান। প্রথম পর্যায়ের জ্ঞানের আলোকে আল্লাহ বান্দাদের হিসাব নিবেন। যে ব্যক্তি জেনেছে যে, নামায কাযা করা হারাম, কিন্তু তারপরও সে তা কাযা করেছে, তার জন্য তার কর্মের শাস্তি পাওনা হবে। আর জ্ঞান যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হয় তখন তা মানুষের জন্য আল্লাহর পথে চলাকে অতি সহজ ও আনন্দদায়ক করে তোলে। হাদীস শরীফে জ্ঞানকে এই দিক হতে দুই পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ(রা) বলেনঃ “অনেক মানুষ কুরআন পাঠ করে, কিন্তু তা তাদের গলার নিচে নামে না(হৃদয়ে গভীর জ্ঞানে পরিণত হয় না)। কিন্তু যখন তা অন্তরে পৌছে যায় এবং গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন তা তার কল্যাণ করে।”(ইবনু রাজাব, জামউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ৩৪৩)।
প্রখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী(রহ)(১১০ হি) বলেছেনঃ “ইলম বা জ্ঞান দুই প্রকারেরঃ ১. জিহবার জ্ঞান, যা আদম সন্তানের বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রমাণও ২. অন্তরের জ্ঞান। এই জ্ঞানই উপকারী জ্ঞান।(দারিমী, আস-সুনান ১/১১৪)।
হাসান বসরীর এই উক্তিটির সনদ নির্ভরযোগ্য। তবে অন্য সনদে এই উক্তিটি হাসান বসরীর সূত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বর্ণিত হয়েছে। এক সনদে পরবর্তী এক রাবী দাবি করেছেন, হাসান বসরী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(সা) উপরের বাক্যটি বলেছেন। অন্য সনদে পরবর্তী রাবী দাবি করেছেন, হাসান বসরী বলেছেন, সাহাবী জাবির(রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাজ(সা)উপরের বাক্যটি বলেছেন। এই দুটি সনদকে কোন কোন আলিম দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আল্লামা মুনযিরী হাদীসটির সনদ হাসান বলে উল্লেখ করেছেন।(দারিমী, আস-সুনান ১/১১৪; ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ ১/৪০৭; আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ১/৫৮)।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইমাম বুখারী সংকলিত একটি হাদীসে আবূ হুরাইরা(রা) বলেছেন, “ আমি রাসূলুল্লাহ(সা) হতে ইলম এর দুটি পাত্র সংরক্ষণ করেছি। একটি পাত্র প্রচার করেছি। অন্য পাত্রটি যদি প্রচার করি তবে আমার গলা কাটা যাবে।”(বুখারী,আস-সহীহ ১/৫৬)।
এই হাদীসটিকে কেউ কেউ ইলমুল বাতিন এর প্রতি ইঙ্গিত বলে বুঝাতে চেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এখানে আবূ হুরাইরা(রা) উমাইয়া যুগের যালিম শাসকদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। খিলাফতে রাশিদার পরে যালিম শাসকদের আগমন, দ্বীনি বিষয়ে অবহেলো ইত্যাদি বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং ইয়াযীদ ও অন্যান্য যালিম শাসকদের নামও বলেছিলেন। আবূ হুরাইরা ও অন্যান্য অনেক সাহাবী উমাইয়া যুগে এ বিষয়ক হাদীসগুলি বলার ক্ষেত্রে এ ধরনের কথা বলতেন। (ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/২১৬-২১৭)।
এভাবে মুহাদ্দিসগণ একমত হয়েছেন যে, ‘ইলমুল বাতিন’ শব্দ এর কথা কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি। তবে উপরের হাদীসে উল্লেখিত দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্ঞানকে অনেকে ‘ইলমুল ক্বালব’(অন্তরের জ্ঞান) বা ‘ইলমুল বাতিন’(অবচেতনের জ্ঞান) বলে অভিহিত করেছেন। এই জ্ঞান কুরআন হাদীসের জ্ঞান বা শরীয়তের জ্ঞান হতে ভিন্ন কিছু নয়। বরং এই জ্ঞান হলো কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানের প্রকৃত ও কাঙ্খিত পর্যায়। কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়তের জ্ঞান অবিরত চর্চা, পালন ও অনুশীলনের মাধ্যমে যখন অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে এবং অবচেতন মন থেকে মানুষের কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে তখন তাকে ‘ইলমুল ক্বালব’ বা ‘ইলমুল বাতিন’ বলা হয়।
কিন্তু পরবর্তীকালে ইলম যাহির ও ইলম বাতিন নামে অনেক প্রকারের ইসলাম বিরোধী কুসংস্কার মুসলিম সমাজে ছড়ানো হয়েছে। ইলম বাতিনকে গোপন কিছু বিষয় বা কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানের বাইরে অর্জনীয় কোনো বিষয় বলে দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ক কিছু হাদীস ও জালিয়াতগণ তৈরি করেছে। ‘ইলমু বাতিন ইলমু যাহির হতে পৃথক বা গোপন কোনো ইলম’ এই অর্থে প্রচলিত সকল কথাই জাল। এই জাতীয় কয়েকটি জাল হাদীস উল্লেখ করছি।
১৫. বাতিনী ইলম গুপ্ত রহস্য নবী-ফিরিশতাগণও জানেন না!
জালিয়াতগণ হাসান বসরী পর্যন্ত জাল হাদীস তৈরি করে বলেছে, হাসান বসরী(২২-১০৯ হি) বলেছেন, আমি সাহাবী হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে(৩৬ হি) জিজ্ঞাসা করলাম, ইলম বাতিন কী? তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ(সা)কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইলম বাতিন কী? তিনি বলেন, আমি জিবরীলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইলম বাতিন কী? তিনি বলেন, আমি আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইলম বাতিন কী? আল্লাহ বলেণ, “হে জীবরীল, তা হলো আমি ও আমার প্রিয়পাত্র অলীগণের মধ্যকার গোপন বিষয়। আমি তা তাদের অন্তরের মধ্যে প্রদান করি। কোনো নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা বা কোনো নবী-রাসূলও তা জানতে পারেন না।”
৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের আলিম শীরাওয়াইহি ইবনু শাহরদার দাইলামী(৫০৯ হি) তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আল ফিরদাউস’ এ এ কথাটিকে হাদীস হিসেবে সংকলিত করেছেন। কিন্তু আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী, জালালউদ্দীন সুয়ূতী, ইবনু ইরাক কিনানী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস হাদীসটির জালিয়াতি উদঘাটন করেছেন। হাদীসটির বর্ণনাকারীগণ মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালিয়াতি করতেন বলে প্রমাণিত। শুধু তাই নয়। জালিয়াতগণের কাছে কিছু ভুল থেকে যায়। এখানে তারা বলেছে, হাসান বসরী(রহ) হুজাইফাকে(রা) প্রশ্ন করেছিলেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে হাসান বসরী জীবনে হুযাইফাকে দেখেনও নি, তাঁর নিকট হতে কিছু জিজ্ঞাসা করাতো দূরের কথা। (দাইলামী, আল ফিরদাউস ২/৩১২; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/২৮০, মোল্লা কারী, আল-আসনূ, পৃ. ৯২-৯৩)।
১৬. বাতিনী ইলম গুপ্ত রহস্য, আল্লাহ ইচ্ছেমত নিক্ষেপ করেন
এই জাতীয় আরেকটি জাল ও বাতিল কথা হলোঃ “বাতিনী ইলম মহান আল্লাহর গুপ্ত রহস্যগুলির একটি এবং আল্লাহর বিধানাবলির একটি। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার অন্তরে চান তা নিক্ষেপ করেন।” হাদীসটির একটি সনদ আছে। সনদটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অজ্ঞাত পরিচয় রাবীগণের সমষ্টি। আল্লামা যাহাবী, সুয়ূতী, ইবনু ইরাক প্রমুখ হাদীসটিকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, আল্লামা সুয়ূতী নিজে হাদীসটিকে জাল হিসেবে চিহ্নিত করে তার ‘যাইলুল লাআলী’ নামক জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থে তা সংকলন করেছেন। কিন্তু তিনি আবার তাঁর ‘আল জামি আস সগীর’ নামক পুস্তকে হাদীসটি যয়ীফ হিসেবে উল্লেখ করেছন। অথচ তিনি দাবি করেছেন যে, ‘আল-জামি আস-সগীর’ পুস্তকে তিনি কোনো জাল হাদীস উল্লেখ করবেন না। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, সকল প্রাজ্ঞ আলেমেরই ভল হতে পারে এবং কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করা যাবে না।”
এই বাতিল কথাটি কেউ কেউ অন্যভাবে বলেছেন। “বাতিনী ইলম আমার গুপ্ত রহস্যসমূহের একটি আমি আমার বান্দাদের অন্তরে স্থাপন করি। আর আমি ছাড়া কেউ তা জানে না।”(সিররুল আসরার, পৃ. ২৩)।
১৭. মানুষই আল্লাহর গুপ্ত রহস্য
একটি জাল ‘হাদীসে কুদসী’-তে বলা হয়েছে-“মানুষ আমার গুপ্তরহস্য এবং আমি মানুষের গুপ্তরহস্য।”(সিররুল আসরার, পৃ. ২৩, ৩১)।
১৮. বাতিনী ইলম লুক্কায়িত রহস্য শুধু আল্লাহওয়ালারাই জানেন
এই অর্থে আরেকটি অত্যন্ত দুর্বল, অনির্ভরযোগ্য বা জাল কথাঃ “ইলমের মধ্যে এমন এক প্রকার ইলম রয়েছে যা গোপনীয় বস্তুর মত। যে ইলম আল্লাহওয়ালা আলেমগণ ছাড়া কেউ জানেন না। তাঁরা যখন তা উচ্চারণ করেন তখন আল্লাহর সম্পর্কে ধোঁকাগ্রস্থ ছাড়া কেউ তা অস্বীকার করে না।”
দাইলামী ও অন্যান্য আলিম এই হাদীসটি সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে নাসর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু হারিস নামক এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সূত্রে বলেছেন, এই ব্যক্তি বলেছেন, তাকে আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ আবুস সালত হারাবী বলেছেন, সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা থেকে, ইবনু জুরাইজ থেকে, আতা থেকে, আবূ হুরাইরা থেকে রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন…।
হাদীসটির রাবী নাসর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু হারিস অজ্ঞাত পরিচয়। তার উস্তাদ হিসেব আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। মিথ্যার প্রকারভেদ অনুচ্ছেদে আমরা তার বিষয়ে আলোচনা করেছি। একমাত্র এই মিথ্যাবাদী ছাড়া অন্য কারো সূত্রে এই হাদীসটি বর্ণিত হয় নি।”(দাইলামী, আল ফিরদাউস ১/২১০; আলবানী, যায়ীফাহ ২/২৬২)।
১৯. মিরাজের রাতে ত্রিশ হাজার বাতিনী ইলম গ্রহণ
বাতিনী ইলম বিষয়ক একটি জঘন্য মিথ্যা কথা হযরত আব্দুল কাদির জিলানী(রাহ) এর নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ নামক পুস্তকে নিম্নরূপে লেখা হয়েছেঃ “এই একান্ত গুপ্ত ত্রিশ হাজার এলম মেরাজ শরীফের রাতে আল্লাহ তাআলা হুযুর(সা) এর কলব মোবারকে আমানত রাখেন। হুযুর(সা) তাঁর অত্যন্ত প্রিয় সাহাবা এবং আসহাবে সুফফাগণ ব্যতীত অন্য কোনো সাধারণ ব্যক্তির নিকট সেই পবিত্র আমানত ব্যক্ত করেন নি।…..”(সিররুল আসরার, পৃ. ৪৫)।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের(সা) নামে কী জঘন্য ডাহা মিথ্যা কথা! রাসূলুল্লাহ(সা) এর একজন প্রিয় সাহাবী বা একজন সুফফাবাসী থেকেও এইরূপ কোনো কথা সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি।
২০. রাসূলুল্লাহ(সা) এর বিশেষ বাতিনী ইলম
জালিয়াতদের বানানো একটি কথা যা হাদীস বলে প্রচলিত – “আল্লাহর সাথে আমার এমন একটি সময় আছে, যেখানে কোনো নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা বা প্রেরিত নবীর স্থান সংকুলান হয় না।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি ভিত্তিহীন সনদহীন একটি জাল কথা, যদিও সুফিয়ায়ে কেরামের মধ্যে তা প্রচলন পেয়েছে। সূফী-দরবেশগণ সরলমনে যা শুনতেন তাই বিশ্বাস করতেন। ফলে জালিয়াতগণ তাঁদের মাঝে জাল কথা ছড়াতে বেশি সক্ষম হতো।(সাখাবী, আল মাকাদিস, পৃ. ৩৫৮; মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১৯৭)।
২১. আলিমগণ বা তালিব ইলম গ্রামে গেল ৪০ দিন কবর আযাব মাফঃ
প্রচলিত একটি মিথ্যা কথাঃ “কোনো আলিম বা তালিব-ইলম(শিক্ষার্থী) কোনো গ্রামের মধ্য দিয়ে গমন করলে মহান আল্লাহ ৪০ দিনের জন্য সেই গ্রামের গোরস্থানের আযাব উঠিয়ে নেন।” কথাটি বানোয়াট ও মিথ্যা।(মুল্লা আলী কারী, আল আসরার, পৃ. ৭৪, নং ২৬১)।
২২. আলিমের সাক্ষাত/মুসাফাহা রাসূলুল্লাহর(সা) সাক্ষাত/মুসাফাহার মতঃ
প্রচলিত একটি জাল হাদীস-“ যে ব্যক্তি কোনো একজন আলিম/আলিমগণের সাথে সাক্ষাৎ করল, সে যেন আমার সাথেই সাক্ষাৎ করল, যে ব্যক্তি কোনো একজন আলিম/আলিমগণের সাথে মুসাফাহা করল, সে যেন আমার সাথেই মুসাফাহা করল, যে ব্যক্তি কোনো একজন মহআলিম/আলিমগণের মাজলিসে বসল, সে যেন আমার মাজলিসেই বসল। আর যে দুনিয়াতে আমার মাজলিসে বসেছে মহান আল্লাহ তাকে আগামীকাল (কিয়ামতের দিন) আমার সাথে জান্নাতে বসাবেন।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি জাল ও মিথ্যা।(সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৩৫; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/২৭২-২৭৩; মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ২৩২)।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন ও হাদীসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১. ইলম শিক্ষা করা, ২. নেককার মানুষের সাহচর্য্যে থাকা এবং ৩. নেককার মানুষদের আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা ও তাঁদের সাথে দেখা সাক্ষাত করা। এই তিনটি ইবাদত মুমিনের নাজাতের অন্যতম ভিত্তি। আলিমগনের সাহচর্য থেকেই এই তিনটি ইবাদত পালন করা যায়।
আলিমের নিজস্ব কোন ফযিলত নেই ।তার ফজিলত নির্ভর করবে তিনি কুরআন ও হাদীস থেকে যতটুকু ইলম ও আমল গ্রহন করবেন তার উপর ।অর্থাৎ আমলের ফযীলত দুইটি : ইলম ও আমল। নেককার আলেমের সাহচর্যের গুরুত্ব তিনটি:নেককার মানুষের সাহচর্যের সাধারন মর্যাদা ,নেককার মানুষের মহব্বতের সাধারন মর্যাদা ও ইলম শিক্ষার সুযোগ …..। এছাড়া আলেমের পিছনে সালাত আদায়,মসলিসে বসা,সাক্ষাত করা,মুসাফাহা করা ইত্যাদির বিষেশ ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই ভিত্তিহীন ও জাল কথা।
২৩. য়ে দিন আমি নতুন কিছু শিখিনি সে দিন বরকতহীন
প্রচলিত একটি বাতিল কথা যা হাদীস নামে প্রচলিত :
“যদি আমার জীবনের এমন একটি দিন আসে যে দিন আমি আল্লাহর নৈকট্য প্রদানকারী কোন ঈমান বৃদ্ধি করতে পারি না, সেই দিনের সূর্যোদয়ে আমার জন্য কোনো বরকত না হোক।”
হাদীসটি আবূ নুআইম ইসপাহানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাকাম ইবনু আব্দুল্লাহ নামক দ্বিতীয় শতকের এক ব্যক্তির সূত্রে বর্ণনা করছেন ।হাকাম বলেন ইবনু শিহাব যুহরী তাকে এই হাদীস বলেছনে,সাঈদ ইবনুল মূসাইযিব থেকে, আয়েশা থেকে রাসূলুল্লাহ(সা:)থেকে।আবু নু’নআইম বলেন’’এই হাদীস একমাত্র হাকাম ছাড়া কেউ বর্ণনা করেন নি। (আবু ন’আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৮/১৮৮)।
হাকাম নামক এই ব্যক্তি সম্পর্কে মুহাদ্দিসগন একমত যে,লোকটি একজন জালিয়াত ও জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিল।ইমাম আবু হাতিম রাযী বলেন,লোকটি জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিল ।ইমাম দারাকুতনী,ইবনু আদী প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেন,লোকটি একজন জঘন্য জালিয়াত ছিল।সে একটি জাল পান্ডুলিপি বানিয়ে তাতে ৫০ টির ও অধিক জাল হাদীস লিখে সেগুলো ইমাম যুহরীর নামে সঈদ ইবনু মুসাইয়িবের সুত্র প্রচার করে ।এগুলো সবই জাল ও ভিিত্তহীন।এছাড়া আরো অনেক জাল হদীস প্রচার করেছে।সকল মুহাদ্দিসই একমত যে লোকটি পরিত্যক্ত,মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত(আল কামিল ২/৭৯.২০২-২০১৪;ইবনুল জাওয়ী, আদ-দুআফা ১/২২৭; যাহাবি,মীযানূল ই’তিদাল ২/৩৩৭)।
এই বাক্যটি অন্যভাবেও বর্ণিত:
“যদি আমার জীবনে এমন একটি দিন আসে যে দিন আমি কোনো একটি ভাল কর্ম বৃদ্ধি করতে পারি নি,সেই দিনে কোনো বরকত না হোক।”
এই বাক্যটিও উপরের জালিয়াত হাকাম ইবনু আব্দুল্লাহ সূত্রে বর্ণিত এর সনদে হাকাম পরে আরো জালিয়াত ও রাবী রয়েছে। সম্ভবত পরবর্তী কোনো দুর্বল রাবী ব্যাক্যটিকে একটু পরিবর্তীত করে ফেলেছে।
২৪. কুরআন্ দিয়ে হাদীস বীচার
ইসলামী ইলম-এর মূল উৎস দুইটি:কুরআন ও হাদিস্।আমারা দেখেছি য, হাদীসের জ্ঞানরে অতিরিক্ত তা কুরআনরে ব্যখ্যা হতে পারে বা কুরআানের সংযোজন হতে পারে্।প্রথম পর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে,এই মূলননীতিব ভীত্তিতে্ই সাহাবীগণের যুগ থেকে সকল যুগে মুসলিম উম্মাহর আলিমগন বুশুদ্ধতা,সূত্র, উৎস,অর্থ ইত্যাদি বিচার করেছেন।এ ক্ষেত্রেও জালিয়াতগণ বিভিন্ন রকমের জালিয়াতি করেছে।এ সকল জালিয়াতির উদ্দেশ্য হলো ‘ডকুমেন্টারী’নিরীক্ষা না করে ‘মনমর্জিত’ অর্থ বিচার করে হাদীস ‘গ্রহণ’করা। কেউ কুরআন দিয়ে হাদীস বিচার করার জন্য জাল হাদীস বানিয়েছে। কে্উ ‘ভাল-মন্দ’ অর্থ দেখে হাদীস বিচারের জন্য জাল হাদীস বানিয়েছে। কেউ নির্বিচারে‘ভক্তিভরে’ হাদীস গ্রহন করার জন্য জাল হাদীস বানিয়েছে। এই জাতীয় একটি হাদীস বলা হয়েছে:
“যখন তোমাদেরকে আমার থেকে কোন হাদীস বলা হবে, তখন তোমরা তা আল্লাহর কিতাবেরউপরে পেশ করবে (কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখবে।)যদি তা আল্লাহর কিতাবের সাথে সামন্জ্ঞস্যপূর্ণ হয় তবে তা গ্রহণ করবে।আর যদি তা তার বিরোধী হয় তবে তা প্রত্যাখ্যান করবে।”
এই হাদীসটি এবং এই অর্থে বর্ণিত বিভিন্ন বাক্য সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এই অর্থের অধিকাংশ বক্তব্যই সনদবিহীন মিথ্যা কথা।দুই একটি বাক্য এই অর্থে্ সনদসহও বর্ণিত হয়েছে, যেণ্ডলির সনদে মাতরূক, মুনকার বা পরিত্যক্ত ও মিথ্যায় অভিযুক্ত রাবী বিদ্যমান। মুহাদ্দিসগন উল্লেখ করেছেন যে ইসলামের গোপন শত্রু যিনদীকগন এসকল হাদিস তৈরি করে প্রচার করে।স্বভাবতই আমরা বুঝতে পারি যে,কোনো হাদীসই কোরআন ‘বিরোধী’ হয় না।তবে ‘ড়কুমেন্টারী’ প্রমান ছারা যদি ‘কোরআন’ হাদীস বিচার হয় তবে প্রত্যকেই তার নিজ ‘বুদ্ধি’ বা “মর্জি’ দিয়ে হাদীস বিচার করবে।একজন সহজেই বলতে পারবে যে, কুরআনে পাচঁ ওয়াক্ত সালাতের কথা নেই, বা তিন ওয়াক্তের কথা আছে। কাজেই পাচঁ ওয়াক্ত সালতের হাদীস গুলো কুরআন বিরোধী কাজেই তা প্রত্যাখান করতে হবে। অন্য জন বলবে বৎসরপূর্তির পরে যাকাত প্রধানের বিধান কুরআন বিরোধী।আরেকজন সহজেই বলতে পারবে,উকাশার প্রতিশোধ গ্রহনের কহিনী’ কুরআনের ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশের সাথে সামণ্জ্ঞস্যপূর্ণ,কাজেই তা সহীহ।অথবা কুরআনে রাসুলুল্লাহ(সা)-কে রাহমাতুল্লল আলামীন বলা হয়েছে,কজেই’ ‘আপনি না হলে বিশ্ব সৃষ্টি করতাম না হদীসটি সহীহ। অথবা কুরআনে সাহাবীদের প্রশংসা করা হযেছে,কজেই আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য’হাদীসটি সহীহ। এভাবে প্রত্যেকেই নিজের মর্জি মত দাবী দাওয়া করতে থাকত এবং মুসলিম উম্মাহ অন্তহীন বিভ্রান্তির আবর্তে পড়তেন । এই উদ্দেশ্যই যিন্দীকগণ এই হাদীসগুলো বানিয়েছিল।তবে মুহাদ্দিসগণের সনদ নীরীক্ষার ফলে তাদের জালিয়াতি ধরা পড়েছে।
২৫. ‘ভাল’ অর্থ দেখে হাদীস বিচার
দ্বিতীয় পর্যয়ে হাদীসগুলীর মধ্যে রয়েছে: “আমার পক্ষ থেকে কোনো ‘কল্যাণ’বা ‘ভালো’ তোমাদের কাছে পোঁছালে আমি বলি অথবা নাই বলি তোমরা তা গ্রহন করবে,কারণ আমি তা বলি।আর তোমাদের নিকট কোন ‘খরাপ’বা ‘অকল্যানণ’ পৌছলে(তা গ্রহণ করবে না);কারণ আমি ‘খারাপ বলি না।”
এই অর্থের অন্য একটা হাদীস নিম্নরূপ:
‘“যখন আমার পক্ষ থেকে কোনো হাদিস তোমাদের বলা হবে যা ‘হক্ক’ বা সত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূ্র্ণ, তখন তোমরা গ্রহণ করিবে-আমি তা বলি অথবা নাই বলি।”/ এইরুপ ‘ভালমন্দ’ অর্থ্বিচার কের হাদিস গ্রহণের বিষয়ে কয়েকটি ‘হাদিস’ বর্ণিত হয়েছে। এই অর্থে বর্ণিত কিছু হাদিস সন্দেহাতীতভাবে জাল ও মিথ্যা বলে প্রামানিত। এণ্ডলির সনদে সুপরিচিত মিথ্যাবাদী রাবী বিদ্যমান। আর কিছু হাদীস অত্যন্ত দুর্বল সনদে বর্ণিত, যেণ্ডলির কেউ ‘যরীফ’ বলেছেন এবং কেউ মাউযূ বলছেন।
আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণের যুগ থেকেই হাদীস যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ‘অর্থ বিচার করা হয়। তবে যে কোনো হাদীসের ক্ষেত্রে সর্ব-প্রথম বিচার্য হলো , কথাটি রসূলুল্লাহ … বলেছেন বলে প্রমনিত কিনাতিনি বলুন অথবা না বলুন, হক্ক, সত্য বা ভালর সাথে মিল হলেই তা ‘নির্বিচারে’ ‘হাদীস’ বলে গ্রহণ করার অর্থই হলো তিনি যা বলেন নি তা তাঁর নামে বলার পথ প্রশস্ত করা। আর অগনিত হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। এজন্য মুহাদ্দসগন এ বিষয়ক ‘দুর্বল’ হাদিসণ্ডলিকেও অর্থগতভাবে বাতিল বলে গণ্য করেছেন । অনেক দুর্বল রাবী ভুল বশত এক হাদীসের সনদ অন্য হাদীসে জুড়ে দেন, মতন পাল্টে ফেলেন। জন্যকখনো কখনো দুর্বল বা অজ্ঞাত পরিচয় রাবীর হাদীসও অর্থ বিচারে মাউযূ বা বাতিল বলে গণ্য করা হয়।
২৬.ভক্তিতেই মুক্তি
সাধারণ মানুষ যাতে ‘নির্বিচারে’ জাল হাদীসণ্ডলিগ্রহণ করে, জালিয়াতগণ ‘ভক্তিতেই মুক্তি; মর্মে অনেক হাদীস বানিয়েছে। যেমনঃ ‘যদি কারো নিকট কোনো ‘ফযীলতের’ বা সাওয়াবের কথা পৌছে এবং সে তা বিশ্বাস করে, তবে আল্লাহ তাকে সে সাওয়াব দান করবেন;যদিও প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক না হয়। অথবা তাকে যে কথাটি বলেছে সে যদিও মিথ্যাবাদী হয়।”
অনুরূপ আারেকটি মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস: “যদি কারো কাছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ফজিলত বা সাওয়াবের কথা পৌছে কিন্তু সে তা সত্য বলে মেনে না নেয়,তবে সে সেই ফজীলতটি লাভ করবে না।”
দাজ্জালের বানানো আরেকটি বানোয়াট কথা:
“যদি তোমাদের কেউ কোনো পাথরেরে ব্যাপারও ভাল ধারণা পোষণ করে,তবে সেই পাথরও তার উপাকার করবে।”
এই কথা গুলো এবং এই অর্থে বণিত সকল কথা্ই জঘন্য মিথ্যা, যা মিথ্যাবাদী দাজ্জালগণ বানিযেছে এবং এগুলোর জন্য সনদও বানীয়েছে। তবে সাহাবীগণ হদীস বর্ণনার জন্য সনদ বলার অপরিহার্য্যতার রীতি প্রচলনের ফলে মুসলিম উম্মাহ এদের জালীয়াতি থেকে আত্মরক্ষার পথ পেয়েছেন। মুহ্হাদ্দীসগণ দেখেছেন যে, এই সকল হাদীস প্রত্যেকটির সনদে মিথ্যাবাদী ও জালীয়াত বিদ্যমান। এজন্য তারা এ সকল হাদীস জাল বলে চিহ্নিত করেছেন। আর একধিক সনদের কারনে কোনো মুহাদ্দীস এগুলোকে ‘অত্যন্ত দূর্বল’ বলে উল্লেখ করে এগুলির সহীহ হাদীস সম্মত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।