২.৯ ঈমান বিষয়ক
স্বদেশ প্রেম ঈমানের অংশ:
এটি অতি প্রচলিত একটি বাক্য “দেশপ্রেম ঈমানের অংশ।”
হাদীস হিসেবে কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এছাড়া কথাটির অর্থও ইসলামী দৃষ্টীভঙ্গীর সাথে ততটা সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কাজেই একে আলীমগণের কথা বা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিরি কথা বলে চালানোরও যৌক্তিকতা নেই। ঈমান ও ইসলাম ঐ সব কর্মের সমষ্টি যা মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে স্বেচ্ছায করতে পারে বা অর্জন করতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে বা জন্মগতভাবে সে সকল বিষয় অর্জিত হয় তাকে ঈমানের বা ইসলামের অংশ বলা হয় না। কারণ এগুলো ঐচ্ছিক বা ইচ্ছাধীন কর্ম নয়। জন্মস্থুান,আবাসষ্থল,বন্ধুবান্ধব,স্ত্রী,সন্তান,পরিজন ও পিতামাতার প্রতি ভালবাসা একটি প্রকৃতিগত বিষয়। মানুষ সৃষ্টিগত ভাবে এদের প্রতি ভালবাসা অনুভব করে।এগুলী কোনটিই ঈমানের অংশ নয়। এজন্য পিতামাতার আনুগত্য ও সেবাকে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা হয়েছে,পিতামাতার ভালবাসা কে নয়। অনূরূপভাবে দেশের প্রতি আবাসস্থলের প্রতি,পাড়া প্রতিবেশীর প্রতি মুসলিমের অনেক দায়িত্ব রয়েছে, যা তিনি ইচ্ছধীন কর্মের মাধ্যমে পালন করবেন।কিন্তু প্রকৃতিক ভালবাসাকে ঈমানের অংশ বলা ইসলামিক ধারনার সাথে পুরোপুরি মেলে না্।
কেউ প্রকৃতিক নিয়ম লঙ্গন করে,নীজ সন্তান, স্ত্রী, পিতামাতা, আবাসস্থল বা দেশকে ভাল না বাসে তাহলে আমরা তাকে অপ্রকৃতিস্হ,ম্যানিয়াক,পাগল ইত্যদি বলব।আর যদি এই অবস্থা তাকে তাকে উপর্যুক্ত দায়িত্বাদি পালন থেকে বিরত রাখে তাহলে আমরা তাকে পাপ ও আল্লাহর অবাধ্য বলব।
২. প্রচলিত ‘পাঁচ’ কালিমা
আমাদের দেশে ইসলামী ঈমান-আকীদার বিবরণের ক্ষেত্রে ‘পাচটি কালিমা’র কথা প্রচলিত আছে। এছাড়া ঈমানে মুজমাল ও ঈমানে মুফাসসাল নামে দুইটি ঈমানের কথা আছে। কায়েদা, আমপারা দ্বীনিয়াত ও বিভিন্ন প্রচলিত বই পুস্তকে এই কলিমাগুলি রয়েচে। এগুলিকে অত্যন্ত জরূরী মনে করা হয় এবং বিশেষভবাভে মুখস্থ করা হয়। এই বাক্যগুলির অর্থ সুন্দর। তবে সবগুলি বুাক্য এভাবে হাদীস শরীফে বর্ণীত হয় নি। এগুলিকে সব কুরআনের কথা হদীসের কথা মনে করলে ভুল হবে
(১)কালীমায়ে শাহাদত
কুরআন ও হদীসের ইসলামী ঈমান বা বিশ্বসের মূল হিসাবে দুইটি সাক্ষ্য প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,যা আমদের দেশে ‘কালীমায়ে শাহাদত’হিসাবে পরিচিত। এই কালীমায়ে আল্লাহর তোওহীদ এবং মুহাম্মদ(সা)এর রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা হয়। প্রকৃতপক্ষে একমাত্র‘কালীমায়ে শাহাদতই’হাদীস শরীফের মূল বাক্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সালাতের (নামাজের) ‘তাশাহুদের’মধ্যে বাক্যদ্বয় এভাবে একত্রে বলা হয়ছে:
“আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই”
“আমি আরো সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহ্হাম্মদ(সা)আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।”
প্রথম বাক্য: “আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই”
এই প্রথম বাক্যটির ক্ষেত্রে কোনো কোনো হাদীসে বলা হয়েছে:
“আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই,তিনি একক,তার কোনো শরীক নাই।”
দ্বীতিয় বাক্য: “আমি আরো সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহ্হাম্মদ(সা)আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।”
আযানের মধ্যে এই বাক্য দুইটিকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
(২) কলিমায়ে তাইয়েবা
আমদের দেশে ‘কালীমায়ে তাইয়েবা বা “পবিত্র বাক্য” বলতে বুঝানো হয় তাওহীদ ও রিসালাতের একত্রিত ঘোষণা:
কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:
“আপনি কি দেখেন নি, কিভাবে আল্লাহ একটি উদাহারন পেশ করেছেন একটি ‘কালীমায়ে তাইয়েবা বা “পবিত্র বাক্য” একটি পবিত্র বৃক্ষের মত, তার শাখা প্রশাখা আকাশে প্রসারিত।”
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা) ও অন্যন্য মুফ্ফা থেকে বর্ণীত হয়েছে যে এখনে ‘কালীমায়ে তাইয়েবা বলতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ এই বাক্যটি বুঝানো হয়েছে। কিন্তু (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) দুইটি বাক্য একত্রিতভাবে কোনো হাদীসে ‘কালীমায়ে তাইয়েবা’ হিসাব উল্লেখ করা হয়নি।
উপরের কালীমায়ে শাহাদতের দুইটা অংশের মূলই হলো কালিমা তাইয়েবায় তওহীদ ও রিসালাতের মূল বাক্যদুইটিকে একত্রে বলা হয়। আমরা দেখেছি যে, কালীমায়ে শাহাদতকে অনেক সময়’ “শাহাদাত” শব্দ উহ্য রেখে বলা হয়ছে।
এভাবে ‘কালিমা’ হিসাবে কোথও উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা য়ায না। একটা হাদীসে বর্ণীত হয়ছে যে,এভাবে এই বাক্যদ্বয় একত্রে আরশের গায়ে লিখা ছিল। আমরা্ এই পুস্তকের অন্য স্থানে উল্লেখ করেছি এই হাদীস অত্যন্ত দূর্বল ও বানোয়াট।
এখানে উল্লেখ্য যে, কালিমা তাইযেবার দুইটা অংশ পৃথকভাবে কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। উভয় বাক্যই্ কুরআনের অংশ এবং ঈমানের মূল সাক্ষ্যের প্রকাশ। উভয় বাক্যকে একত্রে বলার মধ্যে কোনো প্রকারের অসুবিধা নেই। তাবেয়ীগনের যুগ থেকেই কালিমা শাহাদতের মূল ঘোষণা হিসাবে এই বাক্যটির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। কুরআন কারীমে কালিমাতু তাকওযা’’ তাকওয়ার বাক্য’ বলা হয়ছে। এর ব্যাখ্যায় তাবিয়ী আতা আল-খুরাসানী(১৩৫হি) বলেন: কালিমায়ে তাকওয়া হলো (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ)
(৩)(কালিমায়ে তাওহীদ)
কালিমায়ে তাওহীদ নামে আমাদের দেশে নিম্নের বাক্যটি প্রচলিত:
আরবী(******)
এই বাক্যটির অর্থ সুন্দর। তবে এই বাক্যটির কোনোরূপ গুরুত্ব এমনকি এ্রর কোনো প্রকারের উল্লেখ বা অস্তিত্ব কুরআন বা হাদীসেও পাওয়া যায় না।
৪.(কালিমায়ে তামজীদ)
কালিমায়ে তামজীদ হিসাবে নিম্নেরে বাক্যটি প্রচলিত:
আরবী(******)
এই বাক্যটির অর্থ ও সুন্দর। কিন্তু এভাবে এই বাক্যটি বলার কোনো নির্দেশনা, এর গুরুত্ব বা অস্তিত্ব কুরআন বা অস্তিত্ব কুরআন বা হাদীসে পাওয়া যায় না ।
৫. কালিমায়ে রাদ্দে কুফর
কালিমায়ে রাদ্দে কুফর নামে কয়েকটি বাক্য আমাদের দেশের বিভিন্ন বইয়ে দেখা য়ায।
আরবী(******)
বাক্যগুলোর অর্থ ভাল। কিন্তু বাক্যগুলি এভাবে কোনো হাদীসে পাওয়া যায় না এবং এই বাক্যের কোনো বিশেষ গুরূত্বও হাদীস দ্বারা প্রমানীত নয়।
৬. ঈমানে মুজমাল
আরবী(******)
ঈমানে মুজমাল নামে প্রচলিত এই বাক্যটির অর্থ সুন্দর।তবে এই বাক্যটির পরবর্তী আলীমদের বানানো্ একটা সাধারন বাক্য।এরূপ কোনো বাক্য কোনোভাবে কোনো হাদীসে উল্লখ করা হয়নি।
৭.ঈমানে মুফাস্সাল
এক হাদীসে হযরত জিবরাঈল(আ) রাসূলুল্লাহ(সা)কে জিজ্ঞাসা করেন ঈমান কী? তিনি উত্তরে বলেন
আরবী(******)
“তুমি ঈমান আনবে আল্লাহর উপরে,তাঁর ফেরিশতাগণের উপরে, তাঁর কেতাবগুলির উপরে,তাঁর রাসূলগণের উপরে,শেষ দিবসের উপরে আনবে,এবং তুমি ঈমান আনবে তকদীরের উপরে:তার ভাল এবং তার মন্দের উপরে।”
ঈমানের এই ছয়টি রূকন বা স্তম্বের কথা কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে।এ ছাড়া এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস রয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষনীয় যে , ঈমানে মুফাস্সালের মধ্যে আখিরাতের বিস্বাস কে পৃথক দুইটা বাক্যে প্রকাশ করা হয়েছে (ইয়ওমিল আখির)ও(বা’সি বা’দাল মাউত): শেষ দিবস(আখিরাত) ও মৃত্যুর পরে উত্থান। উভয় বিষয় একই।