২.৪. রাসূলুল্লাহ(সা) সম্পর্কে
রাসূলুল্লাহ(সা) এর সীমাহীন ও অতুলনীয় মর্যাদা, ফযীলত, মহত্ত্ব ও গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে কুরআন কারীমের অগণিত আয়াতে ও অনেক সহীহ হাদীসে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের ভাব গম্ভীর ভাষা, বুদ্ধিভিত্তিক আবেদন ও আত্মিক অনুপ্রেরণা অনেক মুমিনকে আকৃষ্ট করতে পারেনা। এজন্য অধিকাংশ সময় আমরা দেখতে পাই যে, এ সকল আয়াত ও সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে সাধারণত একেবারে ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও অত্যন্ত অনির্ভরযোগ্য হাদীসগুলি আমরা সর্বদা আলোচনা করি, লিখি ও ওয়ায নসীহতে উল্লেখ করি।
আমরা দেখেছি যে, মুসলিম সমাজে প্রচলিত জাল হাদীসের অন্যতম তিনটি ক্ষেত্র হলোঃ (১) ফাযায়েল বা বিভিন্ন নেক আমলের সাওয়াব বিষয়ক গ্রন্থাদি, (২) পূর্ববর্তী নবীগণ বা কাসাসুল আম্বিয়া জাতীয় গ্রন্থাদি এবং (৩) রাসূলুল্লাহ(সা) এর জন্ম, জীবনী, মুজিযা বা সীরাতুন্নবী বিষয়ক গ্রন্থাদি। যুগের আবর্তনে ক্রমান্বয়ে এ সকল বিষয়ে জাল ও ভিত্তিহীন কথার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ হিজরী শতকে সংকলিত সীরাত, দালাইল বা মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থাবলিতে অগণিত ভিত্তিহীন ও জাল বর্ণনা স্থান পেয়েছে, যেগুলি পূর্ববর্তী কোনো হাদীসের গ্রন্থতো দূরের কথা, কোনো সীরাত বা মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থাদিতেও পাওয়া যায়না।
আল্লামা আবূল কালাম আযাদ তাঁর ‘রাসূলে রাহমাত’ গ্রন্থে তুলনামূলক আলোচনা ও নিরীক্ষা করে এই জাতীয় কিছু বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্পের উল্লেখ করেছেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ(সা)এর জন্মের পূর্বে হযরত আসিয়া(আ) ও মরিয়ম(আ) এর শুভাগমন এবং হযরত আমিনাকে রাসূলুল্লাহ(সা)এর জন্মের সুসংবাদ প্রদান, রাসূলুল্লাহ(সা) এর গর্ভধারণের শুরু থেকে জন্মগ্রহণ পর্য্ন্ত সময়ে হযরত আমিনার কোনোরূপ কষ্টক্লেশ না হওয়া……ইত্যাদি।(মাওলানা আবূল কালাম আযাদ, রাসূলে রাহমত, বাংলা সংস্করণ, ই ফা বাংলাদেশ, পৃ. ৬৯-৮০)।
কেউ কেউ মনে করেন, রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে মিথ্যা দ্বারা আমরা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছি। কি জঘন্য চিন্তা! মনে হয় তাঁর সত্য মর্যাদায় ঘাটতি পড়েছে যে, মিথ্যা দিয়ে তা বাড়াতে হবে!! নাউজুবিল্লাহ। মহিমাময় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল খুবই অসন্তুষ্ট হন মিথ্যায় এবং সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যা হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল(সা) এর নামে মিথ্যা বলা।
লক্ষ্যণীয় যে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পূর্ববর্তী নবীগণকে(আ)মূর্ত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনেক মুজিযা বা অলৌকিক বিষয় প্রদান করেছিলেন। শেষ নবী ও বিশ্বনবীকেও তিনি অনেক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মুজিযা দিয়েছেন। তবে তাঁর মৌলিক বা অধিকাংশ মুজিযা বিমূর্ত বা বুদ্ধি ও জ্ঞানবৃত্তিক। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মানুষকে রাসূলুল্লাহ(সা)এর মুজিযা অনুধাবনে সক্ষম করে। অনেক সময় সাধারণ মূর্খ মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ, আনন্দ দান, উত্তেজিত করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে গল্পকার, ওয়ায়িয ও জালিয়াতগণ অনেক মিথ্যা গল্প কাহিনী বানিয়ে হাদীস নামে চালিয়েছে।
অনেক সময় এ বিষয়ক মিথ্যা হাদীসগুলিকে চিহ্নিত করাকে অনেকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর মর্যাদা ও শানের সাথে বেয়াদবী বলে ভাবতে পারেন। বস্তুত তাঁর নামে মিথ্যা বলাই হলো তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশি বেয়াদবী ও দুশমনী। যে মিথ্যাকে শয়তানের প্ররোচণায় মিথ্যাবাদী তার মর্যাদার পক্ষে ভাবছে সেই মিথ্যা মূলত তাঁর মর্যাদার হানিকর। মিথ্যার প্রতিরোধ করা, মিথ্যা নির্ণয় করা এবং মিথ্যা থেকে দূরে থাকা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নির্দেশ। এই নির্দেশ পালনই তাঁর প্রতি আনুগত্য, অনুসরণ, ভক্তি ও ভালবাসা। এখানে রাসূলুল্লাহ(সা) কেন্দ্রিক কিছু বানোয়াট কথা উল্লেখ করছিঃ
১. আমিই শেষ নবী, আমার পরে নবী নেই, তবে…..
জালিয়াতদের তৈরি একটি জঘন্য মিথ্যা কথা। “আমিই শেষ নবী, আমার পরে নবী নেই, তবে আল্লাহ যদি চান।” কুরআন কারীমে রাসূলুল্লাহ(সা) কে শেষ নবী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম সহ সকল হাদীস গ্রন্থে বিশুদ্ধতম সনদে সংকলিত অসংখ্য সাহাবী হতে বর্ণিত অগণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, তাঁর পরে আর কোনো নবী হবেনা। তিনিই নবীদের অট্টালিকার সর্বশেষ ইট। তিনিই নবীদের সর্বশেষ। তাঁর মাধ্যমে নবুওতের পরিসমাপ্তি।
কিন্তু এত কিছুর পরেও পথভ্রষ্টদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ নামক দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন যিনদীক বলে, তাকে হুমাইদ বলেছেন, তাকে আনাস ইবনু মালিক বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, “আমি শেষ নবী, আমার পরে নবী নেই, তবে আল্লাহ যদি চান।”(ইবনুল জাউযী, আল-মাউযূআত, ১/২০৬, ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীআহ ১/৩২১)।
এই যিনদীক ছাড়া কেউ এই অতিরিক্ত বাক্যটি “তবে আল্লাহ যদি চান” বলেননি। কোনো হাদীসের গ্রন্থেও বাক্যটি পাওয়া যায়না। শুধুমাত্র এই যিনদীকের জীবনীতে ও মিথ্যা হাদীসের গ্রন্থে মিথ্যাচারের উদাহরণ হিসেবে এই মিথ্যা কথাটি উল্লেখ করা হয়। তা সত্ত্বেও কাদিয়ানী বা অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায় এই মিথ্যা কথাটি তাদের বিভ্রান্তির প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চায়।
সুপথপ্রাপ্ত মুসলিমের চিহ্ন হলো তাঁর আত্মা, ইচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ ও অভিরুচি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের(সা) নির্দেশনার নিকট সমর্পিত। এরই নাম ইসলাম। মুসলিম যখন হাদীসের কথা শুনেন তখন তাঁর একটি মাত্র বিবেচ্য; হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে কিনা। হাদীসের অর্থ তাঁর মতের বিপরীত বা পক্ষে তা নিয়ে চিন্তা করেননা। বরং নিজের মতকে হাদীসের অনুগত করে নেন।
বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্টদের পরিচয়ের মূলনীতি হলো তারা নিজেদের অভিরুচি ও পছন্দ অনুসারে কোনো কথাকে গ্রহণ করে। এর বিপরীতে সকল কথা ব্যাখ্যা ও বিকৃত করে। এরা কোনো কথা শুনলে তার অর্থ নিজের পক্ষে কিনা তা দেখে। এরপর বিভিন্ন বাতিল যুক্তিতর্ক দিয়ে তা সমর্থন করে। কোনো কথা তার মতের বিপক্ষে হলে তা যত সহীহ বা কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশই হোক তারা তা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বিকৃত ও পরিত্যাগ করে।
২. আপনি না হলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতামনা
“এ ধরনের বানোয়াট কথাগুলির একটি হলোঃ“আপনি না হলে আমি আসমান যমিন বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতামনা।” আল্লামা সাগানী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুল হাই লাখনবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে কথাটিকে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এই শব্দে এই বাক্য কোনো হাদীসের গ্রন্থে কোনো প্রকার সনদে বর্ণিত হয়নি। (আল্লামা সাগানী, আল মাউদূ’আত, পৃ. ৫২; মোল্লা কারী, আল আসরার পৃ. ১৯৪; আব্দুল হাই লাখনবী, আল আসারুল মারফূয়া, পৃ. ৪৪)।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই শব্দে নয়, তবে এই অর্থে দুর্বল বা মাঊযূ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করছি।
৩. আরশের গায়ে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নাম
একটি যয়ীফ বা বানোয়াট হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন, “আদম (আ) যখন ভুল করে(নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করে) ফেলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেনঃ হে প্রভু, আমি মুহাম্মাদ এর হক(অধিকার) দিয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি কিভাবে মুহাম্মাদকে(সা) চিনলে, আমিতো এখনো তাকে সৃষ্টিই করিনি? তিনি বলেন, হে প্রভু, আপনি যখন নিজ হাতে আমাকে সৃষ্টি করেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করান, তখন আমি মাথা তুলে দেখলাম আরশের খুঁটিসমূহের গায়ে লিখা রয়েছেঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এতে আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় বলেই আপনি আপনার নামের সাথে তাঁর নামকে সংযুক্ত করেছেন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনিই আমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। তুমি আমার কাছে তার হক্ক(অধিকার) দিয়ে চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। মুহাম্মাদ(সা) না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতামনা।” (হাকিম, আল মুসতাদরাক ২/৬৭২)।
ইমাম হাকিম নাইসাপুরী হাদীসটি সংকলিত করে একে সহীহ বলেছেন। তবে সকল মুহাদ্দিস একমত যে, হাদীসটি যয়ীফ। তবে মাঊযূ কিনা মতভেদ করেছেন। ইমাম হাকিম নিজেই অন্যত্র এই হাদীসের বর্ণনাকারী রাবীকে মিথ্যাবাদী বলেছেন।
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ইমাম হাকিম অনেক যয়ীফ ও মাঊযূ হাদীসকে সহীহ বলেছেন এবং ইমাম ইবনূল জাউযী অনেক সহীহ বা হাসান হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন। এজন্য তাঁদের একক মতামত মুহাদ্দিসগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তাঁদের মতামত তাঁরা পুনর্বিচার ও নিরীক্ষা করেছেন।
এই হাদীসটির সনদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সনদটি খুবই দুর্বল, যে কারণে অনেক মুহাদ্দিস এক মাউযূ হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীসটির একটিই সনদ: আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনু মুসলিম আল ফিহরী নামক এক ব্যক্তি দাবি করেন, ইসমাঈল ইবনু মাসলামা নামক এক ব্যক্তি তাকে বলেছেন, আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতা,তার দাদা থেকে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব(রা) হতে বর্ণনা করেছেন।
বর্ণনাকারী আব্দুল হারিস একজন অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। এছাড়া আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম(১৮২ হি) খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি কোনো হাদীস ঠিকমতো বলতে পারতেননা, সব উল্টোপাল্টা বর্ণনা করতেন। ইমাম হাকিম নাইসাপুরী নিজেই তার ‘মাদখাল ইলা মারিফাতিস সহীহ’ গ্রন্থে বলেছেন: “আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতার সূত্রে কিছু মাঊযূ বা জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস শাস্ত্রে যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন যে, এ সকল হাদীসের জালিয়াতির অভিযোগ আব্দুর রাহমানের উপরেই বর্তায়।”(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াত ১/২৫০; আলবানী, সিলসিলাতুয যায়ীফাহ ১/৯০)।
এই হাদীসটি উমার(রা) হতে কোনো অন্য কোনো তাবেয়ী বলেননি, আসলাম থেকেও তাঁর কোনো ছাত্র বর্ণনা করেননি। যাইদ ইবনু আসলাম প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। তাঁর অনেক ছাত্র ছিল। তাঁর কোনো ছাত্র এই হাদীস বর্ণনা করেননি। শুধুমাত্র আব্দুর রাহমান দাবী করছেন যে, তিনি এই হাদীসটি তাঁর পিতার নিকট শুনেছেন। তার বর্ণিত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষা করে ইমামগণ দেখেছেন তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীসই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা পর্যায়ের। এজন্য ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে মাউযূ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইমাম বাইহাকী হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই কথাটি মূলত ইহুদী খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত শেষ নবী বিষয়ক কথা; যা কোনো কোনো সাহাবী বলেছেন। অন্য একটি দুর্বল সনদে এই কথাটি উমার(রা) এর নিজের কথা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আব্দুর রাহমান অন্যান্য অনেক হাদীসের মত এই হাদীসেও সাহাবীর কথাকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। (তাবারানী, আল মুজামুল আউসাত ৬/৩১৩-৩১৪; মুসতাদরাক হাকিম ২/৬৭২; তারিখ ইবনু কাসীর ২/৩২৩, মোল্লা আলী কারী, আল আসরার পৃ. ১৯৪)।
এই মর্মে আরেকটি যয়ীফ হাদীস আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসের কথা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীসটিও হাকিম নাইসাপুরী সংকলন করেছেন। তিনি জানদাল ইবনু ওয়ালিক এর সূত্রে বলেন, তাকে আমর ইবনু আউস আল আনসারী নামক দ্বিতীয় হিজরী শতকের এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে প্রখ্যাত তাবে তাবেয়ী সাঈদ ইবনু আবূ আরূবাহ (১৫৭ হি), তাকে প্রখ্যাত তাবেয়ী কাতাদা ইবনু দিআমাহ আস-সাদূসী (১১৫ হি) বলেছেন, তাকে প্রখ্যাত তাবেয়ী সাঈদ ইবনু মুসাইআব(৯১ হি) বলেছেন, তাকে ইবনু আব্বাস(রা) বলেছেন, “মহান আল্লাহ ঈসা(আ) এর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেন, তুমি মুহাম্মাদের উপর ঈমান আনয়ন কর এবং তোমার উম্মাতের যারা তাঁকে পারে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ প্রদান কর। মুহাম্মাদ(সা) না হলে আদমকে সৃষ্টি করতামনা, মুহাম্মাদ(সা) না হলে জান্নাত ও জাহান্নামও সৃষ্টি করতামনা। আমি পানির উপর আরশ সৃষ্টি করেছিলাম। তখন আরশ কাঁপতে শুরু করে। তখন আমি তার উপরে লিখলামঃ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’; ফলে তা শান্ত হয়ে যায়।” (হাকিম, আল মুসতাদরাক ২/৬৭১)।
ইমাম হাকিম হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। ইমাম যাহাবী তার প্রতিবাদ করে বলেন, “বরং হাদীসটি মাউযূ বলেই প্রতীয়মান হয়।” কারণ এই হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী এই ‘আমর ইবনু আউস আল আনসারী’ নামক ব্যক্তি। সে প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুহাদ্দিস এর নামে হাদীসটি বর্ণনা করেছে। অথচ এদের অন্য কোনো ছাত্র এই হাদীসটি তাদের থেকে বর্ণনা করেনি। এই লোকটি মূলত একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায়না। এই জানদাল ইবনু ওয়ালিক ছাড়া অন্য কোনো রাবী তার নাম বলেননি বা তার কোনো পরিচয়ও জানা যায়না। এজন্য ইমাম যাহাবী ও ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী বলেন যে, এই হাদীসটি ইবনু আব্বাসের নামে বানানো জাল বা মিথ্যা হাদীস। (যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/২৯৯; ইবনু হাজার, লীসানুল মীজান ৪/৩৫৪)। এই অর্থে আরো জাল হাদীস মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন।
নূরে মুহাম্মাদী বিষয়ক হাদীসসমূহ প্রথমত, আল কুরআন ও নূরে মোহাম্মদী আরবী ভাষায় নূর অর্থ আলো, আলোকচ্ছটা, উজ্বলতা(light, ray of light, brightness) ইত্যাদি। আরবী, বাংলা ও সকল ভাষাতেই নূর, আলো বা লাইট যেমন ‘জড়’ আলো অর্থে ব্যবহৃত হয়, তেমনি আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক আলো বা পথ-প্রদর্শকের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লামা কুরতুবী বলেন, “আরবী ভাষায় নূর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য আলো বা জ্যোতিকে বলা হয়। অনুরূপভাবে রূপকার্থে সকল সঠিক ও আলোকোজ্জ্বল অর্থকে ‘নূর’ বলা হয়। বলা হয়, অমূকের কথার মধ্যে নূর রয়েছে। অমুক ব্যক্তি দেশের নূর, যূগের সূর্য্ বা যূগের চাঁদ….।” (কুরতুবী, তাফসীর ১২/২৫৬)।
মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে নিজেকে নূর বলেছেন।
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ ۖ
“আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর(জ্যোতি)। তাঁর নূরের উপমা যেন একটি দীপাধার যার মধ্যে রয়েছে একটি প্রদীপ……।”(সূরা ২৪: নূর, আয়াত ৩৫)। ইমাম তাবারী বলেছেন, “আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী নূর” একথা বলতে মহিমাময় আল্লাহ বুঝাচ্ছেন যে, তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যকার সকলের হাদী বা পথপ্রদর্শক। তাঁরই নূরে তাঁরা সত্যের দিকে সুপথপ্রাপ্ত হয়।…..ইবনু আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর’ অর্থ তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অধিবাসীদের হাদী বা পথপ্রদর্শক।……আনাস থেকে বর্ণিত, আল্লাহ বলেছেন, আমার হেদায়াতই আমার নূর……।”(তাবারী, তাফসীর ১৮/১৩৫; আরো দেখুন, ইবনু কাসীর, তাফসীর ৩/২৯০)।
মহিমাময় আল্লাহ কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে ‘কুরআন’ কে আলো বা নূর বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ(সা) সম্পর্কে এরশাদ করা হয়েছেঃ
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ ۚ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنزِلَ مَعَهُ ۙ أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ [٧:١٥٧]
“যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক এই উম্মী নবীর……যারা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তাঁর সাথে যে নূর অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।”(সূরা ৭: আরাফ, ১৫৭ আয়াত)।
এখানে রাসূলুল্লাহ(সা) এর উপর অবতীর্ণ ‘আল কুরআন’ কে নূর বলা হয়েছে। অন্যত্র কুরআনকে ‘রূহ’ বা ‘আত্মা’ ও নূর বলা হয়েছেঃ
وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ أَمْرِنَا ۚ مَا كُنتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَٰكِن جَعَلْنَاهُ نُورًا نَّهْدِي بِهِ مَن نَّشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا ۚ وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ [٤٢:٥٢]
“এইভাবে আমি আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রূহ(আত্মা), আমার নির্দেশ থেকে, আপনি তো জানতেন না যে, কিতাব কি এবং ঈমান কি! কিন্তু আমি একে নূর বানিয়ে দিয়েছি, যা দিয়ে আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ নির্দেশ করি……।”(সূরা ৪২: শূরা, আয়াত ৫২)।
অন্যত্র মূসা(আ) এর উপর অবতীর্ণ তাওরাতকেও নূর বলা হয়েছে।নূর….।”(সূরা: ৬, আনআম, আয়াত ৯১)।
অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছে তাওরাত ও ইনজীল এর মধ্যে নূর ছিল।
আরবী(*********)
“নিশ্চয় আমি অবতীর্ণ করেছি তাওরাত, যার মধ্যে রয়েছে হেদায়াত ও নূর…….এবং আমি তাকে(ঈসাকে) প্রদান করেছি ইনজীল যার মধ্যে রয়েছে হেদায়াত ও নূর।(সূরা ৫ মায়েদা ৪৪ ও ৪৬ আয়াত)।
অন্য অনেক স্থানে মহান আল্লাহ সাধারণভাবে ‘নূর’ বা ‘আল্লাহর নূর’ বলেছেন। এর দ্বারা তিনি কি বুঝিয়েছেন সে বিষয়ে সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগ হতে মুফাসসিরগণ মতভেদ করেছেন। যেমন এক স্থানে বলেছেনঃ
يُرِيدُونَ أَن يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَن يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ [٩:٣٢]
“তারা আল্লাহর নূরকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়; কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণ করবেন, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।”(সূরা ৬১: সাফ, আয়াত ৮; সূরা ৯: তাওবা, আয়াত ৩২)। এখানে আল্লাহর নূর বলতে কি বোঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাসসিরগণের মতভেদ রয়েছে। আল্লামা কুরতুবী বলেনঃ এখানে আল্লাহর নূরের ব্যাখ্যায় পাঁচটি মত রয়েছে। (১) আল্লাহর নূর অর্থ আল কুরআন, কাফিররা কথার দ্বারা তা বাতিল করতে ও মিথ্যা প্রমাণ করতে চায়। ইবনু আব্বাস ও ইবনু যাইদ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। (২) আল্লাহর নূর অর্থ ইসলাম, কাফিররা কথাবার্তার মাধ্যমে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। সুদ্দী একথা বলেছেন।(৩) আল্লাহর নূর অর্থ মুহাম্মাদ(সা)। কাফিররা অপপ্রচার ও নিন্দাচারের মাধ্যমে তার ধ্বংস চায়। দাহহাক এ কথা বলেছেন। (৪) আল্লাহর নূর অর্থ আল্লাহর দলীল-প্রমাণাদি, কাফিররা সেগুলি অস্বীকার করে মিটিয়ে দিতে চায়। ইবনু বাহর এ কথা বলেছেন। (৫) আল্লাহর নূর অর্থ সূর্য্। অর্থাৎ ফুৎকারে সূর্য্ কে নেভানোর চেষ্টা করার মত বাতুল ও অসম্ভব কাজে তারা লিপ্ত। ইবনু ঈসা একথা বলেছেন।(কুরতুবী, তাফসীর ১৮/৮৫)।
الر ۚ كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَىٰ صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ [١٤:١]
“এই কিতাব। আমি তা আপনার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে আপনি মানবজাতিকে অন্ধকার হতে আলোতে বের করে আনেন….।” (সূরা ১৪: ইবরাহীম, আয়াত ১)।
এখানে স্বভাবতই অন্ধকার ও আলো বলতে জড় কিছুকে বুঝানো হয়নি। এখানে অন্ধকার বলতে অবিশ্বাসের অন্ধকার এবং আলো বলতে আল কুরআন অথবা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে।
অনুরূপভাবে অন্যান্য বিভিন্ন আয়াতে নূর বা আল্লাহর নূর বলা হয়েছে এবং সেখানে ‘নূর’ অর্থ কুরআন, ইসলাম, মুহাম্মাদ(সা) ইত্যাদি অর্থ গ্রহণ করেছেন মুফাসসিরগণ। এই ধরনের একটি আয়াতঃ
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ ۚ قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ [٥:١٥]
“হে কিতাবীগণ, আমার রাসূল তোমাদের নিকট এসেছেন, তোমরা কিতাবের যা কিছু গোপন করতে তিনি তার অনেক তোমাদের নিকট প্রকাশ করেন এবং অনেক উপেক্ষা করে থাকেন। আল্লাহর নিকট হতে এক নূর ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে।”(সূরা ৫: আল মায়েদা,আয়াত ১৫)
এই আয়াতে নূর বা জ্যোতি বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাসসিরগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, এখানে নূর অর্থ কুরআন, কেউ বলেছেন ইসলাম, কেউ বলেছেন মুহাম্মাদ(সা)।(তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১; কুরতুবী, তাফসীর ৬/১১৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫)।
এই তিন ব্যাখ্যার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। যারা ‘নূর’ অর্থ ইসলাম বা ইসলামী শরীয়ত বলেছেন, তাঁরা দেখেছেন যে, এই আয়াতে প্রথমে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা বলা হয়েছে এবং শেষে কিতাব বা কুরআনের কথা বলা হয়েছে। কাজেই মাঝে নূর বলতে ইসলামকে বুঝানোই স্বাভাবিক। এ ছাড়া কুরআন কারীমে অনেক স্থানে নূর বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে।
এরা বলেন যে, আরবীতে ‘আলো’ বুঝাতে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়-একটি ‘দিয়া’, অপরটি ‘নূর’। প্রথম আলোর মধ্যে উত্তাপ রয়েছে আর দ্বিতীয় আলো হলো স্নিগ্ধতাপূর্ণ আনন্দময় আলো। পূর্ববর্তী শরীয়তগুলির বিধিবিধানের মধ্যে কাঠিন্য ছিল। পক্ষান্তরে ইসলামী শরীয়তের সকল বিধিবিধান সহজ, সুন্দর ও জীবনমুখী। এজন্য ইসলামী শরীয়তকে নূর বলা হয়েছে।(ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/২১৯)।
যারা এখানে নূর অর্থ কুরআন বুঝিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন যে, এই আয়াতের প্রথমে যেহেতু রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা বলা হয়েছে, সেহেতু শেষে ‘নূর’ ও ‘স্পষ্ট কিতাব’ বলতে কুরআন কারীমকে বুঝানো হয়েছে। কাজেই ‘নূর’ বলতে মুহাম্মাদ(সা)কে বুঝানোই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে ইমাম তাবারী বলেনঃ “নূর বলতে এখানে মুহাম্মাদ(সা) কে বুঝানো হয়েছে, যার দ্বারা আল্লাহ হক্ক বা সত্যকে আলোকিত করেছেন, ইসলামকে বিজয়ী করেছেন এবং শিরককে মিটিয়ে দিয়েছেন। কাজেই যে ব্যক্তি তাঁর দ্বারা আলোকিত হতে চায়, তার জন্য তিনি আলো। তিনি হক্ক বা সত্য প্রকাশ করেন। তাঁর হক্ককে আলোকিত করার জন্য একটি দিক হলো যে, ইহুদীরা আল্লাহর কিতাবের যে সকল দিকগুলো গোপন করতো তার অনেক কিছু তিনি প্রকাশ করেছেন। (তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১)।
সর্বোপরি, কুরআন কারীমে রাসূলুল্লাহ(সা) কে ‘আলোকোজ্জ্বল প্রদীপ’ বা ‘নূর প্রদানকারী প্রদীপ’ বলা হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا [٣٣:٤٥] وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا [٣٣:٤٦]
“হে নবী! আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে এবং আলোকোজ্জ্বল(নূর প্রদানকারী)প্রদীপরূপে।” (সূরা ৩৩: আহযাব, আয়াত ৪৫-৪৬)।
উপরের আলোচনা হতে আমরা দেখতে পেলাম যে, কুরআন কারীমে সত্যের দিশারী, হেদায়াতের আলো ও সঠিক পথের নির্দেশক হিসেবে কুরআন কারীমকে ‘নূর’ বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে কোনো কোনো আয়াতে ‘নূর’ শব্দের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাসসির রাসূলুল্লাহ(সা) কে বা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন।
কুরআন কারীমের এ সকল বর্ণনা হতে বুঝা যায় না যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(সা), কুরআন বা ইসলাম নূরের তৈরি বা নূর হতে সৃষ্ট। আমরা বুঝতে পারি যে, এখানে কোনো সৃষ্ট, জড় বা মূর্ত নূর বা আলো বুঝানো হয়নি। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(সা), ইসলাম ও কুরআন কোনো জাগতিক, জড়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা মূর্ত আলো নয়। এ হলো বিমূর্ত, আত্মিক, আদর্শিক ও সত্যের আলোকবর্তিকা, যা মানুষের হৃদয়কে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের অন্ধকার হতে বিশ্বাস, সত্য ও সুপথের আলোয় জ্যোতির্ময় করে।
দ্বিতীয়ত, হাদীস শরীফে নূর মুহাম্মাদী কুরআন ও হাদীসে বারবার বলা হয়েছে যে মানুষকে মাটি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির উপাদান বলতে প্রথম সৃষ্টিকেই বুঝানো হয়। এরপর তার বংশধররা বংশ পরম্পরায় সেই উপাদান ধারণ করে। কুরআন কারীমে আদম(আ)কে মাটির উপাদান থেকে সৃষ্টি করার বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা হয়েছে।পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ জাগতিক প্রক্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করে। কাউকেই নতুন করে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়না। তবে সকল মানুষকেই মাটির মানুষ বা মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়।
কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে অনেক স্থানে রাসূলুল্লাহ(সা)কে (বাশার) বা মানুষ, মানুষ ভিন্ন কিছুই নন, তোমাদের মতই মানুষ ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, রাসূলুল্লাহ(সা) এর সৃষ্টির উপাদানে কি কোনো বিশেষত্ব নেই?
রাসূলুল্লাহ(সা) কে নূর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে মর্মে কিছু হাদীস প্রচলিত রয়েছে। এগুলির অর্থ আমাদের কাছে আকর্ষণীয় এবং মুমিনের কাছে এগুলি ভাল লাগে। একথা ঠিক যে, সৃষ্টির মর্যাদা তার কর্মের মধ্যে নিহিত, তার সৃষ্টির উপাদান, বংশ ইত্যাদিতে নয়। এজন্য আগুনের তৈরি জিন ও নূরের তৈর ফিরিশতার চেয়ে মাটির তৈরি মানুষ অনেক ক্ষেত্রে বেশি মর্যাদাবান। এরপরও যখন আমরা জানতে পারি যে, সৃষ্টির উপাদানেও আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ(ﷺ ) এর বৈশিষ্ট্য রয়েছে তখন আমাদের ভাল লাগে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, যে কোনো কথা যতই ভাল লাগুক, তা গ্রহণের আগে তার বিশুদ্ধতা যাচাই করা। কোনো কথাকে শুধুমাত্র তার অর্থের ভিত্তিতে নয়, বরং সাক্ষ্য প্রমাণের বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে প্রথমে বিচার করা হয়। এরপর তার অর্থ বিচার করা হয়। এখানে এই অর্থের কয়েকটি জাল হাদীস উল্লেখ করছি।
৪. রাসুলুল্লাহ(ﷺ ) ও আলী (রা) নূর হতে সৃষ্টি
“আমাকে ও আলীকে নূর হতে সৃষ্টি করা হয়। আদমের সৃষ্টির ২ হাজার বৎসর পূর্বে আমরা আরশের ডান পার্শ্বে ছিলাম। অতঃপর যখন আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন তখন আমরা মানুষদের ঔরসে ঘুরতে লাগলাম।” মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এটি একটি মিথ্যা ও জাল হাদীস। জা’ফর ইবনু আহমদ ইবনু আলী আল-গাফিকী নামক এক মিথ্যাবাদী জালিয়াত হাদীসটি বানিয়েছে এবং এর জন্য একটি সনদও সে বানিয়েছে।(ইবনুল জাউযী, আল মাউদূআত ১/২৫৪; সুয়ূতী, আল লাআলী ১/৩২০; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৩৫১; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ, ২/৪৩৪)।
৫. রাসুলুল্লাহ(ﷺ ) কে আল্লাহর নূর, আবূ বকরকে তাঁর নূর…..হতে সৃষ্টি
“আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বকরকে আমার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, উমারকে আবূ বকর এর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার উম্মাতকে উমরের নূর হতে সৃষ্টি করেছেন……।”- মুহাদ্দিসগণ একমত যে হাদীসটি মিথ্যা ও বানোয়াট। আহমদ ইবনু ইউসূফ আল মানবিযী নামক এক ব্যক্তি এ মিথ্যা কথাটির প্রচারক। সে এই মিথ্যা কথাটির একটি সুন্দর সনদও বানিয়েছে। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৩১৪; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/৩২৮; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৫০; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৩৩৭)।
এই অর্থে আরেকটি বানোয়াট কথাঃ “আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বকরকে আমার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, উমারকে আবূ বকর এর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন এবং নবী রাসূলগণ ব্যতীত মুমিনগণের সকলকেই উমারের নূর হতে সৃষ্টি করেছেন।”(দাইলামী, আল ফিরদাউস ১/১৭১)।
এই অর্থে আরেকটি ভিত্তিহীন কথা, “আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বকরকে আমার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, উমার ও আয়েশাকে আবূ বকর এর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন আর আমার উম্মতের মুমিন পুরুষগণকে উমারের নূর হতে এবং মুমিন নারীগণকে আয়েশার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন।” (কুরতুবী, তাফসীর ১২/২৮৬)।
৬. আল্লাহর মুখমন্ডলের নূরে রাসুলুল্লাহ(ﷺ ) এর সৃষ্টি
আব্দুল কাদের জিলানী(রাহ) এর নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ নামক জাল পুস্তকটির মধ্যে জালিয়াতগণ অনেক জঘন্য কথা হাদীস নামে ঢুকিয়েছে। এ সকল জাল কথার একটিতে বলা হয়েছে, আল্লাহ বলেছেন, “আমি মুহাম্মাদকে আমার মুখমন্ডলের নূর হতে সৃষ্টি করেছি।”- এ জঘন্য মিথ্যা কথাটি কোনো জাল সনদেও বর্ণিত হয়নি। (সিররুল আসরার, পৃ. ১০)।
৭. রাসুলুল্লাহ(ﷺ ) এর নূরে ধান চাউলের সৃষ্টি
জালিয়াতদের বানানো আরেকটি মিথ্যা কথাঃ “চাউল আমা হতে এবং আমি চাউল হতে। আমার অবশিষ্ট নূর হতে চাউলকে সৃষ্টি করা হয়।”(তাহের ফাতানী, তাযকিরা, পৃ. ১৪৭; শাওকানী, আল ফাওয়াদ ১/২১১)।
৮. ঈমানদার মুসলমান আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্ট
দায়লামী তার ‘আল ফিরদাউস’ নামক পুস্তকে ইবনু আব্বাস (রা) এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণনা করেছেন, “মুমিন আল্লাহর নূরের দ্বারা দৃষ্টিপাত করেন, যে নূর হতে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।”(দায়লামী, আল ফিরদাউস, ৪/১৭৮; সাখাবী, আল মাখাদিস, পৃ. ৪৩৬)। এই হাদীসটিও জাল। এর একমাত্র বর্ণনাকারী মাইসারাহ ইবনু আব্দুরাব্বিহ দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম প্রসিদ্ধ জালিয়াত ও মিথ্যাবাদী রাবী। ইমাম বুখারী, আবূ দাউদ, আবূ হাতিম, ইবনু হিব্বান সহ সকল মুহাদ্দিস এ বিষয়ে একমত। তাঁরা তার রচিত অনেক জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ৬/৫৭৪-৫৭৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৩৮-১৩৯)।
৯. নূরে মুহাম্মাদীই (ﷺ ) প্রথম সৃষ্টি
উপরের হাদীসগুলি আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত নয়, যদিও হাদীসগুলি বিভিন্ন গ্রন্থে সনদসহ বা সনদবিহীনভাবে এবং মুহাদ্দিসগণ এগুলির সনদ আলোচনা করে জাল ও মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন। বিশেষত, ‘মুমিন আল্লাহর নূরে সৃষ্টি’ এই হাদীসটি দাইলামীর গ্রন্থে রয়েছে। এই গ্রন্থের অনেক জাল হাদীসই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, কিন্তু এই হাদীসটি আমাদের সমাজে প্রসিদ্ধ নয়। পক্ষান্তরে একটি হাদীস, যা কোনো হাদীসের গ্রন্থে সংকলিত হয়নি, কোথাও কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না, সেই কথাটি আামদের সমাজে বহুল প্রচলিত। শুধু প্রচলিতই নয়, এই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সনদহীন কথাটি সর্ববাদীসম্মত মহাসত্যের রূপ গ্রহণ করেছে এবং তা ইসলামী বিশ্বাসের অংশরূপে স্বীকৃত। এমন কি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের স্বীকৃত ‘আকিদা ও ফিকহ’ গ্রন্থেও যা হাদীসরূপে উল্লেখিত। হাদীসটি হচ্ছেঃ “আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।” একটি সুদীর্ঘ হাদীসের অংশ হিসেবে হাদীসটি প্রচলিত। হাদীসটির সারসংক্ষেপ হলো, জাবির(রা) রাসুলুল্লাহ(ﷺ ) কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম কি সৃষ্টি করেন? উত্তরে তিনি বলেনঃ “সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেন।” এরপর এ লম্বা হাদীসে উল্লেখ করা হয়, উক্ত নূরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে তা হতে আরশ, কুরসী, লাওহ, কলম, ফিরিশতা, জিন, ইনসান এবং সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়।….
কথাগুলি শুনতে ভাল। যদি রাসুলুল্লাহ(ﷺ )এর নামে মিথ্যা কথা বলার বা যা শুনব তাই বলার অনুমতি থাকতো তাহলে আমরা নির্দ্বিধায় তা গ্রহণ করতাম ও বলতাম। কিন্তু যেহেতু তা নিষিদ্ধ তাই বাধ্য হয়েই আমাদের প্রতিবাদ করতে হয়। রাসুলুল্লাহ(ﷺ ) কে সর্বপ্রথম নূর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে, বা তাঁর নূর হতে বিশ্ব বা অন্যান্য সৃষ্টকে সৃষ্টি করা হয়েছে মর্মে যা কিছু প্রচলিত সবই ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মিথ্যা কথা।
কেউ কেউ দাবী করেছেন যে, হাদীসটি বাইহাকী বা আব্দুর রাযযাক সান‘আনী সংকলন করেছেন। এই দাবিটি ভিত্তিহীন। আব্দুর রাযযাক সান‘আনীর কোনো গ্রন্থে বা বাইহাকীর কোনো গ্রন্থে এই হাদীসটি নেই। কোনো হাদীসের গ্রন্থেই এই কথাটির অস্তিত্ব নেই। সহীহ, যয়ীফ এমনকি মাঊযূ বা মিথ্যা সনদেও এই হাদীসটি কোনো হাদীসের গ্রন্থে সংকলিত হয়নি। সাহাবীগণের যুগ হতে আজ পর্য্ন্ত শত শত হাদীসের গ্রন্থ লিপিবদ্ধ ও সংকলিত হয়েছে, যে সকল গ্রন্থে সনদসহ হাদীস সংকলিত হয়েছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত যে কোনো হাদীস(সহীহ/হাসান/যয়ীফ/মাঊযূ) এ সকল গ্রন্থের অধিকাংশে পাওয়া যাবে। যে কোনো হাদীস আপনি খুঁজে দেখুন, অন্তত ১০/১৫টি গ্রন্থে তা পাবেন। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বা প্রসিদ্ধ হাদীস আপনি প্রায় সকল গ্রন্থেই দেখতে পাবেন। অর্থাৎ, এ ধরনের যে কোনো একটি হাদীস আপনি ৩০/৩৫টি হাদীসের গ্রন্থে এক বা একাধিক সনদে সংকলিত দেখতে পাবেন। কিন্তু হাদীস নামের “আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন”-বাক্যটি খুঁজে দেখুন. একটি হাদীসগ্রন্থেও পাবেননা। রাসুলুল্লাহ(ﷺ )যুগ হতে হতে পরবর্তী শত শত বৎসর পর্য্ন্ত কেউ এ হাদীসটি জানতেননা। কোনো গ্রন্থেও লিখেননি। এমনকি সনদবিহীন সিরাতুন্নবী, ইতিহাস, ওয়ায বা অন্য কোনো গ্রন্থেও তা পাওয়া যায়না।
যতটুকু জানা যায়, ৭ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম মহিউদ্দীন ইবনু আরাবী আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনু আলী তাঈ হাতিমী(৫৬০-৬৩৮হি/১১৬৫-১২৪০খৃ.) সর্বপ্রথম এ কথাগুলিকে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইবনু আরাবী তাঁর পুস্তকাদিতে অগণিত জাল হাদীস ও বাহ্যত ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। পরবর্তী যুগে বুযুর্গগণ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত এ সকল কথার বিভিন্ন ওযর ও ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আবার অনেকে কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন। বিশেষত মুজাদ্দেদী আলফে সানী হযরত আহমদ ইবনু আব্দুল আহাদ সারহিন্দী(১০৩৪ হি) ইবনু আরাবীর এ সকল জাল ও ভিত্তিহীন কথার প্রতিবাদ করেছেন বারংবার। কখনো কখনো নরম ভাষায়, কখনো কঠিন ভাষায়।(উদাহরণ-মাকতুবাত শরীফ ১/১, মাকতুব ৩১, (পৃষ্ঠা ৬৭, ৬৮) মাকতুব ৪৩)।
এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “ আমাদের নসস বা কুরআন ও হাদীসের পরিষ্কার অকাট্য বাণীর সহিত কারবার, ইবনু আরাবীর কাশফ ভিত্তিক ফসস বা ফুসূসূল হিকামের সহিত নহে। ফুতূহাতে মাদানীয়া বা মাদানী নবী(ﷺ )এর হাদীস আমাদেরকে ইবনে আরাবীর ফতূহাতে মাক্কীয়া জাতীয় গ্রন্থাদি হতে বেপরওয়া করে দিয়েছেন।”(প্রাগুক্ত, ১/১, মাকতুব ১০০, পৃষ্ঠা ১৭৮)।
অন্যত্র প্রকৃত সূফীদের প্রশংসা করে লিখেছেন, “তাহারা নসস, কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বাণী, পরিত্যাগ করত ফসস বা মহিউদ্দীন ইবনে আরাবীর ফসস বা ফূসূসূল হিকাম পুস্তকে লিপ্ত হননা এবং ফতূহাতে মাদানীয়া, অর্থাৎ হাদীস শরীফ বর্জন করত ইবনে আরাবীর ফুতূহাতে মাক্কীয়া পুস্তকের প্রতি লক্ষ্য করেননা।”(প্রাগুক্তু, ১/২, মাকতুব ২৪৩, পৃ. ২১১)।
সর্বাবস্থায় ইবনু আরাবী এই বাক্যটির কোনো সূত্র বা সনদ উল্লেখ করেননি। কিন্তু তিনি এর উপরে তাঁর প্রসিদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের Theory of Logos এর আদলে তিনি নূরে মুহাম্মাদী তত্ত্ব প্রচার করেন। খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, ঈশ্বর সর্বপ্রথম তার নিজের ‘জাত’ বা সত্ত্বা হতে ‘কালেমা’ বা পুত্রকে সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে তিনি সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন। ইবনু আরাবী বলেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম নূরে মুহাম্মাদী সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন।
ক্রমাণ্বয়ে কথাটি ছড়াতে থাকে। বিশেষত ৯ম/১০ম হিজরী শতক হতে লেখকগণের মধ্যে যাচাই বাছাই ছাড়াই অন্যের কথা উদ্ধৃতির প্রবণতা বাড়তে থাকে। শ্রদ্ধাবশত বা ব্যস্ততাহেতু অথবা অন্যান্য বিভিন্ন কারণে নির্বিচারে একজন লেখক আরেকজন লেখকের নিকট হতে গ্রহণ করতে থাকেন। যে যা শুনেন বা পড়েন তাই লিখতে থাকেন, বিচার করার প্রবণতা কমতে থাকে।
দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল কাসতালানী(৯২৩ হি) তার রচিত প্রসিদ্ধ সীরাত গ্রন্থ ‘আল মাওয়াহিব আল লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থে এই হাদীসটি ‘মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে’ সংকলিত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আগেই বলেছি, হাদীসটি মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক বা অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থে বা অন্য কোথাও সনদসহ সংকলিত হয়নি। আল্লামা কাসতালানী যে কোনো কারণে ভুলটি করেছেন। তবে ভুলটি পরবর্তীকালে সাধারণ ভুলে পরিণত হয়। সকলেই লিখেছেন যে, হাদীসটি মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে সংকলিত। কেউ একটু কষ্ট করে গ্রন্থটি খুঁজে দেখতে চাচ্ছেননা। সারাবিশ্বে ‘মুসান্নাফ’, ‘দালাইলুন নুবুওয়াহ’ ও অন্যান্য গ্রন্থের অগণিত পান্ডুলিপি রয়েছে। এছাড়া গ্রন্থগুলি মুদ্রিত হয়েছে। যে কেউ একটু কষ্ট করে খুঁজে দেখলেই নিশ্চিত হতে পারেন। কিন্তু কেউই কষ্ট করতে রাজী নয়। ইমাম সুয়ূতী ও অন্যান্য যে সকল মুহাদ্দিস এই কষ্টটুকু করেছেন তাঁরা নিশ্চিত করেছেন যে, এই হাদীসটি ভিত্তিহীন ও অস্তিত্বহীন কথা। (সুয়ূতী, আল হাবী ১/৩৮৪-৩৮৬)।
গত কয়েকশত বৎসর যাবত এই ভিত্তিহীন কথাটি ব্যাপকভাবে মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। সকল সীরাত লেখক, ওয়ায়েয, আলেম এই বাক্যকে এবং এ সকল কথাকে হাদীস বলে উল্লেখ করে চলেছেন। এই ভিত্তিহীন হাদীসটি, ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরে যার কোনোরূপ অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়ন, তা বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজে ঈমানের অংশে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ হতে একটি কঠিন বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে। উপরে আমরা দেখেছি যে, এই ভিত্তিহীন জাল হাদীসটিতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ তাঁর নূর হতে নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” এ থেকে কেউ কেউ বুঝেছেন যে, তাহলে আল্লাহর ‘সত্তা’ বা যাত একটি নূর বা নূরানী বস্তু। এবং আল্লাহ স্বয়ং তাঁর যাত বা সত্তার অংশ হতে তাঁর নবীকে সৃষ্টি করেছেন। কী জঘন্য শিরক! এভাবেই খৃস্টানগণ বিভ্রান্ত হয়ে শিরকে লিপ্ত হয়।
প্রচলিত বাইবেলেও যীশু খ্রীস্ট বারংবার বলেছেন যে, আমি মানুষ, আমাকে ভাল বলবেনা, আমি কিছুই জানিনা, ঈশ্বরই ভাল, তিনিই সব জানেন, একমাত্র তাঁরই ইবাদত কর…..ইত্যাদি। তবে যীশু ঈশ্বরকে পিতা ডেকেছেন। হিব্রু ভাষায় সকল নেককার মানুষকেই ঈশ্বরের সন্তান, ঈশ্বরের পুত্র ইত্যাদি বলা হয় এবং ঈশ্বরকে পিতা ডাকা হয়। তিনি বলেছেন: ‘যে আমাকে দেখল, সে ঈশ্বরকে দেখল।’ এইরূপ কথা সকল নবীই বলেন। কিন্তু ভন্ড পৌল হতে শুরু করে অতিভক্তির ধারা শক্তিশালী হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে খ্রীস্টানগণ দাবি করতে থাকেন যীশু ঈশ্বরের ‘যাতের’ অংশ’। ঈশ্বর তাঁর সত্তা বা যাতের অংশ(Same substance) দিয়ে পুত্রকে সৃষ্টি করেন….। ৪র্থ-৫ম শতাব্দী পর্য্ন্ত আলেকজান্দ্রিয়ার প্রসিদ্ধ খৃস্টান ধর্মগুরু আরিয়াস ও তার অনুসারীগণ যীশুকে ঈশ্বরের সত্তার অংশ নয় বরং সৃষ্ট বা মাখলুক বলে প্রচার করেছেন। কিন্তু অতিভক্তির প্লাবনে তাওহীদ হেরে যায় ও শিরক বিজয়ী হয়।
এই মুশরিক অতিভক্তগণও সমস্যায় পড়ে গেল। বাইবেলেরই অগণিত আয়াতে যীশু স্পষ্ট করে বলেছেন যে, আমি মানুষ। তিনি মানুষ হিসেবে তাঁর অজ্ঞতা স্বীকার করেছেন। এখন সমাধান কী? তারা ‘দুই প্রকৃতি তত্ত্বের’ আবিষ্কার করলেন। তারা বললেন, খৃস্টের মধ্যে দুটি সত্তা বিদ্যমান ছিল। মানবীয় সত্তা অনুসারে তিনি এই কথা বলেছেন। তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি ঈশ্বর ছিলেন….।(বাইবেল: মথি ৪/১০; ১৯/১৭, মার্ক ১২/২৮, ২৯, ১৩/৩২, করিন্থীয় ৮/৬: গালাতীয়।)।
মুসলিম সমাজে আজ অনেকে এভাবে শিরকের মধ্যে নিপতিত হচ্ছেন। এই হাদীসটি যদি সহীহ বলে প্রমাণিত হতো তাহলেও এর দ্বারা একথা বুঝা যেতনা। আল্লাহ আদমের মধ্যে ‘তাঁর রূহ’ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ঈসা(আ) কে ‘আল্লাহর রূহ’ বলা হয়েছে। এতে কখনোই তাঁর নিজের রূহের অংশ বুঝানো হয়নি। বরং তাঁর তৈরি ও সৃষ্ট রূহকে বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে তাঁর নূর বলতেও একই কথা বুঝানো হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
আমাদের উচিত কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীসগুলির উপর নির্ভর করা এবং ভিত্তিহীন কথাগুলি রাসূলুল্লাহ(সা) এর উপর না বলা।
১০. নূরে মুহাম্মাদীর ময়ূররূপে থাকা
এ বিষয়ক প্রচলিত অন্যান্য কাহিনীর মধ্যে রয়েছে নূরে মুহাম্মাদীকে ময়ূর আকৃতিতে দেখা। এ বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাঊযূ হাদীসের গ্রন্থে এর কোনো প্রকার সনদ বা ভিত্তি উল্লেখ পাওয়া যায়না। বিভিন্নভাবে গল্পগুলি লেখা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা শাজারাতুল ইয়াকীন নামক একটি বৃক্ষ সৃষ্টি করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ(সা) এর নূর মোবারককে একটি ময়ূর আকৃতি দান করত স্বচ্ছ ও শুভ্র মতির পর্দার ভিতর রেখে তাকে সেই বৃক্ষে স্থাপন করলেন….ক্রমান্বয়ে সেই নূর হতে সবকিছু সৃষ্টি করলেন…….রূহদিগকে তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করতে নির্দেশ দিলেন…..ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সকল কথার কোনো সনদ কোথাও পাওয়া যায়না।
১১. রাসূলুল্লাহ(ﷺ ) তারকারূপে ছিলেন
আমাদের দেশে প্রচলিত ধারণা, রাসূলুল্লাহ(ﷺ ) আদম সৃষ্টির পূর্বে তারকারূপে বিদ্যমান ছিলেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন ভাষ্য প্রচলিত। যেমন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ ) ফাতিমা(রা) কে বলেন, জিবরাঈল তোমার ছোট চাচা……ইত্যাদি। এ বিষয়ে প্রচলিত সকল কথাই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। আমাদের দেশের সুপ্রসিদ্ধ একটি ইসলামী কেন্দ্র হতে প্রকাশিত খুতবার বইতে লেখা হয়েছেঃ “হযরত আবূ হুরাইরা(রা) হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলে কারীম(ﷺ ) হযরত জিবরাঈল(আ) কে জিজ্ঞেস করেন, হে জিব্রাঈল, আপনার বয়স কত? তিনি উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি এ সম্পর্কে কিছু জানিনা। তবে এটুকু বলতে পারি যে, চতূর্থ পর্দায়(আসমানে) একটি সিতারা আছে যা প্রতি ৭০ হাজার বছর পর সেখানে উদিত হয়। আমি উহা এ যাবত ৭০ হাজার বার শরীফ)”(অনুবাদে এভাবেই লেখা হয়েছে, যদিও মূল আরবীতে ৭২ বলা হয়েছে)উদিত হতে দেখেছি। এতদশ্রবণে হুজুর( ﷺ) বললেন, হে জিব্রাঈল, শপথ মহান আল্লাহর ইজ্জতের, আমি সেই সীতারা। (বুখারী)”(শাহ মুহাম্মাদ মোহেববুল্লাহ, পীর সাহেব ছারছীনা শরীফ, খুতবায়ে ছালেহীয়া, পৃ. ৪২)।
এ ধরনের সকল কথাই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা যা হাদীস নামে প্রচলন করা হয়েছে। (ইবনু তাইমিয়া, আল-ইসতিগাসাহ ফির রাদ্দী আলাল বাকরী ১/১৩৮; মাজমূউল ফাতাওয়া ১৮/৩৬৬-৩৬৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল আসার, পৃ. ৪২-৪৩)।
তবে সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হলো, এ ভিত্তিহীন কথাটিকে বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে চালানো হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, সীরাহ হালাবিয়া গ্রন্থের লেখক একজন অজ্ঞাতনামা লেখকের উপর নির্ভর করে এই জাল হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু আমরা কি একটু যাচাই করবো না? এ সকল ইসলামী কেন্দ্রে এমন অনেক আলিম রয়েছেন যারা যুগ যুগ ধরে বুখারী পড়াচ্ছেন। বুখারী শরীফের অনেক কপি সেখানে বিদ্যমান। কিন্তু কেউই একটু কষ্ট করে পুস্তকটি খুলে দেখার চেষ্টা করলেননা। শুধু সহীহ বুখারীই নয়, বুখারীর লেখা বা অন্য কারো লেখা কোনো হাদীসের গ্রন্থেই এই কথাটি সনদসহ বর্ণিত হয়নি। অথচ সেই জাল কথাটিকে বুখারীর নামে চালানো হলো।
কেউ কেউ এই ভিত্তিহীন কথাটিকে শুধু বুখারীর নামে চালানোর চেয়ে ‘বুখারী ও মুসলিম’ উভয়ের নামে চালানো উত্তম মনে করলেন। উক্ত প্রসিদ্ধ দ্বীনি কেন্দ্রের একজন সম্মানিত মুহাদ্দিস, যিনি বহু বৎসর যাবত ছাত্রদেরকে ‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম’ পড়িয়েছেন তিনি এই হাদীসটি উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘মুসলিম শরীফ ও বুখারী শরীফ।’[আল্লামা মুহা. মুস্তাফা হামিদী, মীলাদ ও কিয়াম(ছারছীনা দারূচ্ছুন্নাত লাইব্রেরী), পৃ. ১৮]।
আমরা মনে করি যে, এ সকল আলিম ও বুযুর্গ জেনেশুনে মিথ্যা বলেননি। তাঁরা অন্য আলিমদের উদ্ধৃতির উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু আলিমদের জন্য এটি কখনোই গ্রহণযোগ্য ওযর নয়। এখন আমরা যতই বলিনা কেন, যে এই হাদীসটি বুখারী শরীফ বা মুসলিম শরীফের কোথাও নেই, আপনারা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম খুলে অনুসন্ধান করুন….সাধারণ মুসলমান ও ভক্তগণ সে সকল কথায় কর্ণপাত করবেননা। তাঁরা কোনোরূপ অনুসন্ধান বা প্রমাণ ছাড়াই বলতে থাকবেন, এতবড় আলিম কি আর না জেনে লিখেছেন!!
রাসূলুল্লাহ( ﷺ) এর নূরত্ব বনাম মানবত্ব
নূরে মোহাম্মদীর বিষয়ে আরো অনেক জাল ও সনদবিহীন কথা ইবনু আরাবীর পুস্তকাদি, সীরাহ হালাবিয়া, শারহুল মাওয়াহিব ইত্যাদি পুস্তকে বিদ্যমান। এ সকল পুস্তকের উপর নির্ভর করে আমাদের দেশে ‘সাইয়াদুল মুরসালীন’ ও অন্যান্য সীরাতুন্নবী বিষয়ক পুস্তকে এগুলি উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলির বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছেনা। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ( ﷺ) কে নূর দ্বারা তৈরি করা হয়েছে অর্থে বর্ণিত ও প্রচলিত সকল হাদীসই বানোয়াট। পাঠক একটু খেয়াল করলেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতূর্থ হিজরী শতকে ‘সিহাহ সিত্তাহ’ সহ অনেক হাদীসের গ্রন্থ সংকলন করা হয়েছে। এ সকল গ্রন্থে অনেক সাধারণ বিষয়েও অনেক হাদীস সংকলন করা হয়েছে। সহীহ, হাসান, যয়ীফ হাদীসের পাশাপাশি অনেক জাল হাদীসও এ সকল গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। কিন্তু ‘রাসূলুল্লাহ( ﷺ) নূর দ্বারা তৈরি অর্থে একটি হাদীসও কোনো পুস্তকে পাওয়া যায়না।
মুহাদ্দিসগণ হাদীসের গ্রন্থসমূহে কত ছোটখাট বিষয়ে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ লিখেছেন। অথচ ‘নূরে মোহাম্মদী’ বিষয়ে কোনো মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রন্থে একটি অনুচ্ছেদও লিখেননি। অনেক তাফসীরের গ্রন্থে বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সূরা মায়েদার উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কোনো প্রাচীন মুফাসসিরই রাসূলুল্লাহর নূর হতে সৃষ্টি বিষয়ক কোনো হাদীস উল্লেখ করেননি।
ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক বইগুলোতে অগণিত যয়ীফ ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে অনেক অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ রচনা করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরে লেখা কোনো একটি ইতিহাস বা সীরাত গ্রন্থে ‘নূরে মুহাম্মাদী’ বিষয়টি কোনোভাবে আলোচনা করা হয়নি। আসলে রাসূলুল্লাহ(সা) এর যুগ হতে পরবর্তী ৫/৬শত বৎসর পর্য্ন্ত মুসলিম উম্মাহর কোনো ব্যক্তি বা দল ‘নূরে মুহাম্মাদী’ তত্ত্বের কিছুই জানতেননা।
এখন আমাদের সামনে শুধু থাকলো, সূরো মায়েদার উপরোক্ত আয়াতটি, যে আয়াতের তাফসীরে কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন যে, এখানে নূর বলতে রাসূলুল্লাহ( ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে। এখানে আমাদের করণীয় কি?
আমাদেরকে নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
(১) কুরআন হাদীসের নির্দেশনাকে নিজের পছন্দ অপছন্দের উর্ধে্ব সর্বান্তকরণে গ্রহণ করার নামই ইসলাম। সুপথপ্রাপ্ত মুসলিমের দায়িত্ব হলো, ওহীর মাধ্যমে যা জানা যাবে তা সর্বান্তকরণে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা এবং নিজের পছন্দ ও মতামতকে ওহীর অনুগত করা। পক্ষান্তরে বিভ্রান্তদের চিহ্ন হলো, নিজের পছন্দ বা অপছন্দ অনুসারে ওহীকে গ্রহণ করা বা বাদ দেওয়া।
(২) কুরআন হাদীসে বারংবার অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ(সা) বাশার বা মানুষ। এরশাদ করা হয়েছেঃ ‘আপনি বলুন, আমি মানুষ রাসূল ভিন্ন কিছুই নই’, ‘আপনি বলুন, আমি তোমাদের মতই মানুষ মাত্র’।(সূরা ১৭, ইসরা, ৯৩ আয়াত; সূরা ১৮, কাহাফ, ১১০ আয়াত; সূরা ৪১, ফুসসিলাত, ৬ আয়াত)। অনুরূপভাবে, অগণিত সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) বারংবার বলেছেন যে, ‘আমি মানুষ’, ‘আমি তোমাদের মতই মানুষ’। এর বিপরীতে কুরআন কারীমে বা হাদীস শরীফে একস্থানেও বলা হয়নি যে, ‘আপনি বলুন, আমি নূর’। কোথাও বলা হয়নি যে, ‘মুহাম্মাদ নূর’। শুধু কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন যে, তোমাদের কাছে ‘নূর’ এসেছে বলতে রাসূলুল্লাহ( ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে। এই ব্যাখ্যাও রাসূলুল্লাহ( ﷺ) বা কোনো সাহাবী থেকে প্রমাণিত নয়, বরং পরবর্তী কোনো কোনো মুফাসসির এমন কথা বলেছেন।
(৩) এখন আমরা যদি কুরআন ও হাদীসের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাই তবে আমাদের করণীয় কি পাঠক তা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছেন। আমরা কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন নির্দেশকেই গ্রহণ করব। আর মুফাসসিরদের কথা তার স্থানেই রাখব।
আমরা বলতে পারি, কুরআন ও হাদীসের কোথাও রাসূলুল্লাহ( ﷺ) কে স্পষ্টত নূর বলা হয়নি। কাজেই তাঁর বিষয়ে একথা বলা হতে বিরত থাকাই শ্রেয়।
অথবা আমরা বলতে পারি, কুরআন হাদীসের নির্দেশ অনুসারে নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ( ﷺ) মানুষ। তবে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মানব জাতির পথপ্রদর্শনের আলোক বর্তিকা হিসেবে তাঁকে নূর বলা যেতে পারে।
(৪) কিন্তু যদি কেউ বলেন যে, তিনি ‘হাকীকতে’ বা প্রকৃত অর্থে নূর ছিলেন, মানুষ ছিলেননা, শুধু মাজাযী বা রূপক অর্থেই তাঁকে মানুষ বলা যেতে পারে, তবে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি মন মর্জি অনুসারে কুরআন হাদীসের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা বাতিল করে এমন একটি মত গ্রহণ করলেন, যার পক্ষে কুরআন ও হাদীসের একটিও দ্ব্যর্থহীন বাণী নেই।
রাসূলুল্লাহ (সা) এর মর্যাদার প্রাচীনত্ব বিষয়ক সহীহ হাদীস
উপরোক্ত বাতিল ও ভিত্তিহীন কথার পরিবর্তে আমাদের সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের উপর নির্ভর করা উচিত। সহীহ হাদীসে ইরবাদ ইবনু সারিয়া(রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ(সা) কে বলতে শুনেছি, “যখন আদম তাঁর কাদার মধ্যে লুটিয়ে রয়েছেন(তাঁর দেহ তৈরি করা হয়েছে কিন্তু রূহ প্রদান করা হয়নি) সেই অবস্থাতেই আমি আল্লাহ তাআলার নিকট খাতামুন নাবিয়্যীন বা শেষ নবী রূপে লিখিত। আমি তোমাদেরকে এর শুরু সম্পর্কে জানাব। তা হলো আমার পিতা ইবরাহীম(রা) এর দোয়া, ঈসার(আ) সুসংবাদ এবং আমার আম্মার দর্শন। তিনি যখন আমাকে জন্মদান করেন তখন দেখেন যে, তাঁর মধ্য হতে একটি নূর(জ্যোতি) নির্গত হলো যার আলোয় তাঁর জন্য সিরিয়ার প্রাসাদগুলি আলোকিত হয়ে গেল।”(হাকিম, আল মুসতাদরাক ২/৬৫৬, ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১৪/৩১৩)।
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, “তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কখন আপনার জন্য নব্যূয়ত স্থিরকৃত হয়? তিনি বলেনঃ যখন আদম দেহ ও রূহের মধ্যে ছিলেন তখন।”
ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান, সহীহ গরীব বলেছেন। (তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৮৫)।
অন্য হাদীসে মাইসারা আল ফাজর(রা) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ(সা) কে বললাম, আপনি কখন নবী ছিলেন(অন্য বর্ণনায়, আপনি কখন নবী হিসেবে লিখিত হয়েছিলেন)? তিনি বললেন, যখন আদম দেহ ও রূহের মধ্যে ছিলেন।” হাদীসটি হাকিম সংকলন করেছেন ও সহীহ বলেছেন। যাহাবীও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। (হাকিম, আল মুসতাদরাক ২/৬৬৫)।
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা(রা) বলেনঃ “নবী(সা) কে বলা হলো, কখন আপনার জন্য নব্যূয়ত স্থিরকৃত হয়? তিনি বলেন, আদমের সৃষ্টি ও তাঁর মধ্যে রূহ ফুঁক দেওয়ার মাঝে।” (হাকিম, আল মুসতাদরাক ২/৬৬৫)।
এই অর্থে একটি যয়ীফ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ৫ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নূআইম ইসপাহানী(৪৩০ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী সাঈদ ইবনু বাশীর(১৬৯ হি) থেকে হাদীসটি গ্রহণ করেছেন। এই সাঈদ ইবনু বাশীর বলেন, আমাকে কাতাদা বলেছেন, তিনি হাসান থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেনঃ “আমি ছিলাম সৃষ্টিতে নবীগণের প্রথম এবং প্রেরণে নবীগণের শেষ।” (ইবনু কাসীর, তাফসীর ৩/৪৭০; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৩/১৯১; মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১৭৯)।
এই সনদে দুটি দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, হাসান বসরী মুদাল্লিস রাবী ছিলেন। তিনি এখানে ‘আন’ বা ‘থেকে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয়ত, এই হাদীসের বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনু বাশীর হাদীস বর্ণনায় দুর্বল ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে চলনসই বলে বর্ণনা করেছেন। অনেকে তাকে অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলি নিরীক্ষা করে এবং সকল মুহাদ্দিসের মতামত পর্যালোচনা করে তাকে ‘যয়ীফ’ বা দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।(নাসাঈ, আদ-দুআফা, পৃ. ৫২; ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা ১/৩১৪; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৩/১৯০-১৯২)।
এই হাদীসটিকে কেউ কেউ তাবিয়ী কাতাদার নিজের মতামত ও তাফসীর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইবনু কাসীর এই হাদীসের বিষয়ে বলেন, “ সাঈদ ইবনু বাশীরের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। সাঈদ ইবনু আবূ আরূবাও হাদীসটি কাতাদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি কাতাদার পরে হাসান বসরী ও আবূ হুরাইরার নাম বলেন নি, তিনি কাতাদা হতে বিচ্ছিন্ন সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আর কেউ কেউ হাদীসটিকে কাতাদার নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।”(ইবনু কাসীর, তাফসীর ৩/৪৭০)।
এই সর্বশেষ হাদীসটি ছাড়া উপরের ৪টি হাদীসেই সহীহ বা হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীস সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, আদম(আ) এর সৃষ্টি প্রক্রিয়া পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর শ্রেষ্ঠতম সন্তান, আল্লাহর প্রিয়তম হাবীব, খালীল ও রাসূল মুহাম্মাদ(সা) এর নব্যূয়ত, খতমে নব্যূয়ত ও মর্যাদা সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ভিত্তিহীন, সনদবিহীন কথাগুলোকে আন্দাযে, গায়ের জোরে বা বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলার প্রবণতা ত্যাগ করে এ সকল সহীহ হাদীসের উপর আমাদের নির্ভর করা উচিত।
১২. আদম যখন পানি ও মাটির মধ্যে
এখানে উল্লেখ্য যে, উপরের সহীহ বা হাসান হাদীসগুলির কাছাকাছি শব্দে জাল হাদীস প্রচারিত হয়েছে। একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছেঃ “আদম যখন পানি ও মাটির মধ্যে ছিলেন তখন আমি নবী ছিলাম।”
১৩. যখন মাটিও নেই, পানিও নেই
কোনো কোনো জালিয়াত এর সাথে একটু বাড়িয়ে বলেছেন, “আদম যখন পানি ও মাটির মধ্যে ছিলেন তখন আমি নবী ছিলাম। এবং যখন পানিও ছিল না এবং মাটিও ছিল না তখন আমি নবী ছিলাম।”
আল্লামা সাখাবী, সুয়ূতী, ইবনু ইরাক, মোল্লা আলী কারী, আজলূনী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে বলেছেন যে, এই কথাগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।(সাখাবী, আল মাকাদিস, পৃ. ৩৩১, সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ২০৩; মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ১৭৮)।
১৪. রাসূলুল্লাহ (সা), আবূ বাকর ও উমার(রা) একই মাটির সৃষ্ট
রাসূলুল্লাহ(সা) এর নূর নিয়ে যেমন অনেক বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা কথা প্রচলিত হয়েছে, তেমনি তাঁর সৃষ্ট মাটির বিষয়েও কিছু কথা বর্ণিত হয়েছে।
একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ “মহান আল্লাহ আমাকে, আবূ বাকরকে ও উমারকে একই মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই মাটিতেই আমাদের দাফন হবে।”
হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি সনদই দুর্বল। ইবনুল জাওযী একটি সনদকে জাল ও অপরটিকে ‘ওয়াহী’ বা অত্যন্ত দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। পক্ষান্তরে সুয়ূতী, ইবনু ইরাক, তাহের ফাতানী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এই দুটি সনদ ছাড়াও হাদীসটি আরো কয়েকটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ সকল সনদে দুর্বল রাবী থাকলেও মিথ্যায় অভিযুক্ত নেই। কাজেই সামগ্রিকভাবে হাদীসটি ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য। (ইবনু আদী, আল-কামিল ৭/১৫০; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ২/৩১৩; ইবনুল জাউযী, আল মাওদূআত ১/২৪৪)।
১৫. রাসূলুল্লাহ (সা), আলী (রা), হারূন(আ)…..একই মাটির সৃষ্ট
পঞ্চম শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আহমদ ইবনু আলী আবূ বাকর খতীব বাগদাদী তাঁর ‘তারীখ বাগদাদ’ গ্রন্থে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর সনদে তিনি বলেন, ….আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবনূল হুসাইন ইবনু দাউদ আল কাত্তান ৩১১ হিজরীতে তার ছাত্র মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈলকে বলেছেন। আবূ ইসহাক বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু খালাফ আল মারওয়াযী বলেছেন, আমাদেরকে মুসা ইবনু ইবরাহীম আল মারওয়াযী বলেছেন, আমাদেরকে ইমাম মূসা কাযিম বলেছেন, তিনি তাঁর পিতা জাফর সাদিক থেকে, তিনি তাঁর পিতামহদের সূত্রে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন, “ আমি, হারূন ইবনে ইমরান(আ), ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া(আ) ও আলী ইবনে আবূ তালিব একই কাদা হতে সৃষ্ট।”(খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ৬/৫৮)।
লক্ষ্য করুন, এই সনদে রাসূল বংশের বড় বড় ইমামদের নাম রয়েছে। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল ও মিথ্যা কথা। এই সনদের দুজন রাবী মুহাম্মাদ ইবনু খালাফ ও তার ওস্তাদ মূসা ইবনু ইবরাহীম উভয়ই মিথ্যাচার ও জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত। এই দুজনের একজন হাদীসটি বানিয়েছে। তবে জালিয়াতির ক্ষেত্রে বেশি প্রসিদ্ধ ছিল উস্তাদ মূসার। (ইবনুল জাউযী, আল-মাওদূআত ১/২৫৩-২৫৪; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/১৩৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৩২০)।
১৬. রাসূলুল্লাহ(সা), ফাতেমা, হাসান, হুসাইন (রা) একই মাটি হতে সৃষ্ট
পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নুআইম ইসপাহানী তার ‘ফাযাইলুস সাহাবাহ’ গ্রন্থে একটি হাদীস সংকলন করেছেন। এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) ফাতেমাকে(রা) সম্বোধন করে হাসান হুসাইন সম্পর্কে বলেছেন, “আমি এবং তোমরা একই মাটি হতে সৃষ্ট হয়েছি।” সুয়ূতী, ইবনে ইরাক প্রমূখ মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে জাল বলেছেন।(সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৬২; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৪০০)।
১৭. রাসূলুল্লাহ (সা) এর অস্বাভাবিক জন্মগ্রহণ
আমাদের সমাজের কিছু কিছু মানুষের মধ্যে প্রচলিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মাতৃগর্ভ হতে অস্বাভাবিকভাবে বা অলৌকিকভাবে বের হয়ে আসেন। এ সকল কথা সবই ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে আন্দাযে মিথ্যা বলা। রাসূলুল্লাহ(সা) এর জন্ম বিষয়ে সহীহ হাদীসের সংখ্যা কম। এগুলিতে বা এছাড়াও এ বিষয়ে সনদসহ যে সকল যয়ীফ বর্ণনা রয়েছে সেগুলিতে এ সব কথা কিছূই পাওয়া যায় না।
এখানে একটি কথা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমাদের মধ্যে অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে বা অজ্ঞতাবশত মনে করেন, অলৌকিকত্ব সম্ভবত মর্যাদার মাপকাঠি। যত বেশি অলৌকিকত্ব তত বেশি মর্যাদা। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। এই ভুল ধারণাকে পুঁজি করে আমাদের দেশে খৃস্টান মিশনারীগণ বিভিন্ন স্থানে অপপ্রচার চালান। তাদের একটি লিফলেটে বলা হয়েছেঃ কে বেশি বড়? হযরত মুহাম্মাদ (সা) নাকি ঈসা মসীহ? ঈসা মসীহ বিনা পিতায় জন্মলাভ করেছেন আর হযরত মুহাম্মাদের (সা) পিতা ছিল। ঈসা মসীহ মৃতকে জীবিত করতেন কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ(সা) করতেন না। ঈসা মসীহ মৃত্যুর স্দা গ্রহণ করেন নি, বরং সশরীরে আসমানে চলে গিয়েছেন, কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ(সা) মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন……..।
এভাবে মুসলিম আকীদার কিছু বিষয়কে বিকৃত করে এবং প্রচলিত ভুল ধারণাকে পূঁজি করে তারা মুসলিম জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
অলৌকিকত্ব কখনো মর্যাদার মাপকাঠি নয়। নবীদেরকে আল্লাহ অলৌকিকত্ব বা মুজিযা প্রদান করেন হেদায়াতের প্রয়োজন অনুসারে, মর্যাদা অনুসারে নয়। মর্যাদার মূল মানদন্ড হলো আল্লাহর ঘোষণা। এছাড়া দুনিয়ার ফলাফল আমরা পর্যালোচনা করতে পারি। বিস্তারিত আলোচনা এই বিষয়ে সম্ভব নয়। শুধুমাত্র খৃস্টানদের এই বিষয়টিই আমরা আলোচনা করি।
ঈসা(আ) এর জন্ম অলৌকিক। এছাড়া মৃতকে জীবিত করা, অন্ধকে বা কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করা ইত্যাদি বড় বড় অলৌকিক মুজিযা তাকে প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর মর্যাদা আল্লাহর কাছে বেশি নয়। কারণ প্রথমত আল্লাহর ঘোষণা। দ্বিতীয়ত জাগতিক ফলাফল ও তা প্রমাণ করে। খৃস্টানদের প্রচলিত বাইবেল হতে বিচার করলে বলতে হবে যে, মানুষকে সুপথে পরিচালিত করা ও হেদায়াতের ক্ষেত্রে ঈসা(আ) এর দাওয়াতের ফলাফল সবচেয়ে কম। আল্লাহর হুকুমে ঈসা অনেক রুগীকে সুস্থ করেছেন, মৃতকে জীবিত করেছেন। কিন্তু বাইবেল পড়লে মনে হয়, জীন ভূত তাড়ানো ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু তিনি অনেক অবিশ্বাসীকে বিশ্বাসী করতে পারেন নি। অনেক মৃত হৃদয়কে জীবিত করতে পারেন নি। আল্লাহর হুকুমে তিনি অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন, কিন্তু বিশ্বাসে অন্ধকে চক্ষু দান করতে পারেন নি। মাত্র ১২ জন বিশেষ শিষ্যের বিশ্বাসও এত দুর্বল ছিল যে, তার গ্রেফতারের সময় একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং একজন তাকে অস্বীকার করে…..।(পবিত্র বাইবেলঃ মথি ২৬/২০-৭৫; মার্ক ১৪/১৭-৭২; লূক ২২/১-৬২; যোহন ১৮/১-২৭)।
পক্ষান্তরে মহিমাময় আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(সা) কে অনেক অলৌকিকত্ব প্রদান করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অলৌকিকত্ব হলো লক্ষাধিক মানুষকে বিভ্রান্তির অন্ধত্ব থেকে বিশ্বাসের আলো প্রদান করা। লক্ষাধিক মৃত হৃদয়কে জীবন দান করা।
কাজেই অলৌকিকত্ব সম্পর্কে মিথ্যা, দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য কথাবার্তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা, সেগুলোকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর মর্যাদার মাপকাঠি বা নবুয়তের প্রমাণ মনে করা ইসলামের মূল চেতনার বিপরীত। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(সা) এর শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা ও নবুয়ত প্রমাণ করতে আল কুরআনই যথেষ্ঠ। এর পাশাপাশি সহীহ হাদীসগুলির আমরা নির্ভর করব। আমাদের মানবীয় বুদ্ধি, আবেগ বা যুক্তি দিয়ে কিছু বাড়ানো বা কমানোর কোনো প্রয়োজন আল্লাহর দ্বীনের নেই।
১৮. হিজরতের সময় সাওর গিরি গুহায় আবূ বাকরকে সাপে কামড়ানো
১৩শ শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়েদ দরবেশ হুত বলেন, “সীরাতুন্নবী লেখকগণ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) এর হিজরতের সময়ে গুহার মুখে গাছ জন্মেছিল, গুহার পিছনে দরজা প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেখানে একটি নদী দেখা গিয়েছিল, এবং গুহার মধ্যে আবূ বাকরকে(রা) সাপে কামড় দিয়েছিল-এগুলি সবই বাতিল কথা যার কোনো ভিত্তি নেই।(দরবেশ হুত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৮৬)।
১৯. মিরাজের রাত্রিতে পাদুকা পায়ে আরশে আরোহণ
আমাদের সমাজে অতি প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ কথা যে, মিরাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ(সা) জুতা পায়ে আরশে আরোহণ করেছিলেন। কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট একটি কথা।
মিরাজের ঘটনা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থ সহ সকল হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধশত সাহাবী হতে মিরাজের ঘটনা বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সিহাহ সিত্তার এ বিষয়ক হাদীসগুলি আমি ভালভাবে পড়ার চেষ্টা করেছি। এছাড়া মুসনাদ আহমাদ সহ প্রচলিত আরো ১৫/১৬টি হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলি পাঠ করার চেষ্টা করেছি। এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) এর সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমনের কথা বারবার বলা হয়েছে। কুরআন কারীমেও তাঁর সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমনের কথা বলা হয়েছে। তিনি সিদরাতুল মুনতাহার উর্ধে্ব বা আরশে গমন করেছেন বলে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি।
রাফরাফে চড়া, আরশে গমন করা ইত্যাদি কোন কথা সিহাহ সিত্তা, মুসনাদে আহমদ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে সংকলিত কোনো হাদীস নেই। ৫/৬শ শতাব্দী পর্যন্ত সংকলিত ইতিহাস ও সিরাত বিষয়ক পুস্তকগুলিতেও এ বিষয়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। দশম হিজরী শতাব্দী ও পরবর্তী যুগে সংকলিত সীরাতুন্নবী বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে মিরাজের বিষয়ে রাফরাফে আরোহণ, আরশে গমন ইত্যাদি ঘটনা বলা হয়েছে। শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবীর আলোচনা হতে আমরা দেখেছি, যে সকল হাদীস কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায় না, বরং ৫ম হিজরী শতকে বা তার পরে কোনো মুহাদ্দিস বা বিষয়ভিত্তিক লেখক তা সংকলন করেছেন, সেগুলি সাধারণত বাতিল বা অত্যন্ত দুর্বল সনদের হাদীস। বিশেষত ১১শ-১২শ শতাব্দীর গ্রন্থাদিতে সহীহ, যয়ীফ ও মাউদূ সবকিছু একত্রে মিশ্রিত করে সংকলন করা হয়েছে।
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী(১১২২ হি) ‘আল মাওয়্যাহিব আল লাদুন্যিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে আল্লামা রাযী কাযবিনীর একটি বক্তব্য উদ্বৃত্ত করেছেন। তিনি বলেন, “একটি সহীহ, হাসান বা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ(সা) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন। বরং বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তথায় এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌছেছিলেন যে, কলমের খসখস শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যিনি দাবি করবেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন, তাকে তার দাবির পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর কিভাবে তিনি তা করবেন। একটি সহীহ বা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি আরশে আরোহণ করেছিলেন। কারো কারো মিথ্যাচারের প্রতি দৃকপাত নিষ্প্রয়োজন।’’(যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩)।
সর্বাবস্থায় আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি জাল হাদীসঃ “মিরাজের রাত্রি যখন রাসূলুল্লাহ(সা)কে উর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া হলো এবং আরশে মুআল্লায় পৌঁছালেন, তখন তিনি তার পাদুকাদ্বয় খোলার ইচ্ছা করেন। কারণ আল্লাহ তাআলা মূসা(আ) কে বলেছিলেন, “তুমি তোমার পাদুকা খোল; তুমি পবিত্র ‘তুয়া’ প্রান্তরে রয়েছ।”(সূরা তাহা, আয়াত ১২)। তখন আল্লাহর পক্ষ হতে আহবান করে বলা হয়, হে মুহাম্মাদ, আপনি আপনার পাদুকাদ্বয় খুলবেন না। কারণ আপনার পাদুকাসহ আগমনে আরশ সৌভাগ্যমন্ডিত হবে এবং অন্যদের উপরে বরকতের অহংকার করবে। তখন রাসূলুল্লাহ(সা) পাদুকাদ্বয় পায়ে রেখেই আরশে আরোহণ করেন।”
এই কাহিনীর আগাগোড়া সম্পূর্ণটাই বানোয়াট। এ কাহিনীর উৎপত্তি ও প্রচারের পর থেকে মুহাদ্দিসগণ বারংবার বলেছেন যে, এ কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের দেশের অনেক প্রাজ্ঞ্য মুহাদ্দিসও এ সকল মিথ্যা কথা নির্বিচারে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলে থাকেন। এ সকল কথা তাঁরা কোন্ হাদীস গ্রন্থে পেয়েছেন তাও বলেন না, খুঁজেও দেখেন না, আবার যারা খুঁজে দেখে এগুলির জালিয়াতির কথা বলেছেন তাঁদের কথাও পড়েন না বা শুনতে চান না। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।
আল্লামা রাযীউদ্দীন কাযবীনী, আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল মাককারী, যারকানী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হুত প্রমুখ মুহাদ্দিস এই কাহিনীর জালিয়াতি ও মিথ্যাচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আব্দুল হাই লাখনবী এ প্রসঙ্গে বলেনঃ “এই ঘটনা যে জালিয়াত বানিয়েছে আল্লাহ তাকে লাঞ্চিত করুন। রাসূলুল্লাহ(সা) এর মিরাজের ঘটনায় বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি। এত হাদীসের মধ্যে একটি হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ(সা) মিরাজের সময় পাদুকা পরে ছিলেন। এমনকি একথাও প্রমাণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ(সা) আরশে আরোহণ করেছিলেন।” (আব্দুল হাই লাখনবী, আল আসার, পৃ. ৩৭)।
২০. মিরাজের রাত্রিকে আত্তাহিয়্যাতু লাভ
আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি কথা হলো, রাসূলুল্লাহ(সা) মিরাজের রাত্রিতে আত্তাহিয়্যাতু লাভ করেন। এ বিষয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটির সারসংক্ষেপ হলো, রাসূলুল্লাহ(সা) যখন মিরাজের রাত্রিতে আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্যে পৌছান তখন মহান আল্লাহকে সম্ভাষণ করে বলেনঃ আত-তাহিয়্যাতু লিল্লাহি…….। তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ আস-সালামু আলাইকা……….। তখন রাসূলুল্লাহ(সা) চান যে, তাঁর উম্মাতের জন্যও সালামের অংশ থাক। এজন্য তিনি বলেনঃ আসসালামু আলাইনা ওয়া…….। তখন জিবরাঈল ও সকল আকাশবাসী বলেনঃ আশহাদু…..। কোনো কোনো গল্পকার বলেনঃ আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা………বাক্যটি ফেরেশতাগণ বলেন……।
এই গল্পটির কোনো ভিত্তি আছে বলে জানা যায় না। কোথাও কোনো গ্রন্থে সনদ সহ এই কাহিনীটি বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় নি। মিরাজের ঘটনা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে ও সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কোনো সনদসহ বর্ণনায় মিরাজের ঘটনায় এই কাহিনীটি বলা হয়েছে বলে আমি দেখতে পাই নি। সনদবিহীনভাবে কেউ কেউ তা উল্লেখ করেছেন। (কুরতুবী, তাফসীর ৩/৪২৫)। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সহ অন্যান্য সকল হাদীসের গ্রন্থে ‘আত-তাহিয়্যাতু’ বা তাশাহহুদ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও একথা বলা হয় নি যে, মিরাজ হতে তা গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে, সাহাবীগণ সালাতের শেষ বৈঠকে সালাম পাঠ করতেন। আল্লাহকে সালাম, নবীকে সালাম, জিবরাঈলকে সালাম……। তখন তিনি তাঁদেরকে বললেন, এভাবে না বলে তোমরা ‘আত-তাহিয়্যাতু……’ বলবে।(বুখারী, আস-সহীহ ১/২৮৭; মুসলিম আস-সহীহ ১/৩০১)।
সকল হাদীসেই এরূপ বলা হয়েছে। কোথাও দেখতে পাই নি যে, ‘আত-তাহিয়্যাতু’ মিরাজ হতে গ্রহণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২১. মুহুর্তের মধ্যে মিরাজের সকল ঘটনা সংঘটিত হওয়া
প্রচলিত একটি কথা, রাসূলুল্লাহ(সা) এর মিরাজের সকল ঘটনা মুহুর্তের মধ্যে সংঘটিত হয়ে যায়। তিনি সকল ঘটনার পর ফিরে এসে দেখেন পানি পড়ছে, শিকল নড়ছে, বিছানা তখনো গরম রয়েছে ইত্যাদি। এ সকল কথার কোনো ভিত্তি আছে বলে জানতে পারি নি।
আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, সিহাহ সিত্তা সহ প্রায় ২০ খানা হাদীস গ্রন্থের মিরাজ বিষয়ক হাদীসগুলি আমি অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছি। অধিকাংশ হাদীসে মিরাজে ভ্রমণ, দর্শন ইত্যাদি সবকিছু সমাপ্ত হতে কত সময় লেগেছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ করা হয় নি। তাবারানী সংকলিত একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেনঃ “অতঃপর প্রভাতের পূর্বে আমি মক্কায় আমার সাহাবীদের নিকট ফিরে আসলাম। তখন আবূ বাকর আমার নিকট আগমন করে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি গত রাতে কোথায় ছিলেন? আমি আপনার স্থানে আপনাকে খুঁজেছিলাম, কিন্তু আপনাকে পাই নি।…….তখন তিনি মিরাজের ঘটনা বলেন।”(হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৭৩-৭৪। হাদীসটির সনদের একজন রাবীকে কেউ কেউ নির্ভরযোগ্য বলেছেন এবং কেউ কেউ দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন)।
এ হাদীস হতে বুঝা যায় যে, রাসূল(সা) প্রথম রাতে মিরাজে গমন করেন এবং শেষ রাতে তিনি ফিরে আসেন। সারা রাত তিনি মক্কায় অনুপস্থিত ছিলেন। এইরূপ আরো দুই একটি হাদীস হতে বুঝা যায় যে, মিরাজের ঘটনায় রাসূলুল্লাহ(সা) রাতের কয়েক ঘন্টা সময় কাটিয়েছিলেন।(হাইসামী, মাজমাউয যা্ওয়াইদ ১/৭৫-৭৬; ইবনু হাজার, আল মাতালিব ৪/৩৮৯-৩৮১)।
মিরাজের ঘটনায় কত সময় লেগেছিল তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এই মহান অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ সময় ছাড়া বা অল্প সময়ে যে কোনো ভাবে তাঁর মহান নবীর জন্য সম্পাদন করতে পারেন। কিন্তু আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, হাদীসে যা বর্ণিত হয় নি তা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে না বলা। আমাদের উচিত এ ধরনের ভিত্তিহীন কথা তাঁর নামে না বলা। তিনি ফিরে এসে দেখেন শিকল নড়ছে, পানি গড়ছে, বিছানা তখনো গরম রয়েছে ইত্যাদি কথা কোনো সহীহ এমনকি যয়ীফ হাদীসে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে বলে জানতে পারি নি।
মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়্যিদ দরবেশ হুত(১২৭৬হি) এ বিষয়ে বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ(সা) মিরাজের রাত্রিতে গমন করেন এবং ফিরে আসেন কিন্তু তখনো তার বিছানা ঠান্ডা হয় নি, এ কথাটি প্রমাণিত নয়।” (দরবেশ হুত, আসানিল মাতালিব, পৃ. ১১২)।
২২. মিরাজ অস্বীকারকারীর মহিলায় রূপান্তরিত হওয়া
আমাদের দেশে প্রচলিত একটি বানোয়াট কাহিনীতে বলা হয়েছে, মিরাজের রাত্রিতে মুহুর্তের মধ্যে এত ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে মানতে পারেনি এক ব্যক্তি। ঐ ব্যক্তি একটি মাছ ক্রয় করে তার স্ত্রীকে প্রদান করে নদীতে গোসল করতে যায়। পানিতে ডুব দেওয়ার পর সে মহিলায় রূপান্তরিত হয়। এক সওদাগর তাকে নৌকায় তুলে নিয়ে বিবাহ করেন…….অনেক বছর পর আবার ঐ মহিলা পুরুষে পরিণত হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে দেখেন যে, তার স্ত্রী তখনো মাছটি কাটছে…….। এগুলি সবই বানোয়াট কাহিনী।
২৩. হরিণীর কথা বলা বা সালাম দেওয়া
আমাদের দেশে প্রচলিত একটি গল্প যে, একটি হরিণী রাসূলুল্লাহ(সা) কে সালাম দেয়, তাঁর সাথে কথা বলে, অথবা শিকারীর নিকট হতে তাঁর নাম বলে ছুটি নেয়…….ইত্যাদি। এ সকল কথার কোনো নির্ভরযোগ্য ভিত্তি পাওয়া যায় না ।(মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ৯৫; দরবেশ হুত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ৮৬, ২৮৮)।
২৪. হাসান হুসাইনের ক্ষুধা ও রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রহৃত হওয়া
আমাদের দেশের অতি প্রচলিত ওয়ায ও গল্প, হাসান-হুসাইনের অভুক্ত থেকে ক্রন্দন, বিবি খাদিজা(রা)(!!)[হাসান-হুসাইনের জন্মের অনেক বছর আগে খাদীজা(রা) ইন্তিকাল করেন], ফাতেমা(রা) ও আলীর(রা) কষ্ট, রাসূলুল্লাহ(সা) কর্তৃক ইহুদীর বাড়িতে কাজ করা, ইহুদী কর্তৃক রাসূলুল্লাহ(সা) কে আঘাত করা…….ইত্যাদি। এ সকল কাহিনী সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এগুলির কোনো ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নেই।
২৫. জাবিরের (রা) সন্তানদের জীবিত করা
প্রচলিত একটি গল্পে বলা হয়, হযরত জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ(রা) রাসূলুল্লাহ(সা) কে দাওয়াত দেন। ইত্যবসরে জাবিরের এক পুত্র আরেক পুত্রকে জবাই করে। এরপর সে ভয়ে পালাতে গিয়ে চুলার মধ্যে পড়ে গিয়ে পুড়ে মারা যায়। জাবির(রা) এর স্ত্রী এ সকল বিষয় গোপন রেখে রাসূলুল্লাহ(সা) এর মেহমানদারি করেন। …….এরপর মৃত পুত্রদ্বয়কে তাঁর সামনে উপস্থিত করেন।…..রাসূলুল্লাহ(সা) এর দোয়ায় তারা জীবিত হয়ে উঠে। …….
পুরো কাহিনীটি আগাগোড়াই বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।(দরবেশ হুত, আসানাল মাতাদিল, পৃ. ২৮২)।
২৬. বিলালের জারি
প্রচলিত বিলালের জারির সকল কথাই বানোয়াট।
২৭. উসমান ও কুলসুমের (রা) দাওয়াত সংক্রান্ত জারি
এ বিষয়ক প্রচলিত জারিতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।
২৮. উকাশার প্রতিশোধ গ্রহণ
একটি অতি পরিচিত গল্প উকাশার প্রতিশোধ নেওয়ার গল্প। মূল মিথ্যা কাহিনীর উপর আরো শত রঙ চড়িয়ে এ সকল গল্প বলা হয়। মূল বানোয়াট কাহিনী হলো, রাসূলুল্লাহ(সা) ইন্তিকালের পূর্বে সাহাবীগণকে সমবেত করে বলেন, আমি যদি কাউকে যুলুম করে থাকি তবে আজ সে প্রতিশোধ বা বদলা গ্রহণ করুক। এক পর্যায়ে উকাশা নামক এক বৃদ্ধ উঠে বলেন, এক সফরে আপনার লাঠির খোঁচা আমার কোমরে লাগে। উকাশা রাসূলুল্লাহ(সা) এর কোমরে লাঠির খোঁচা মেরে প্রতিশোধ নিতে চান। হাসান, হুসাইন, আবূ বাকর, উমার(রা) প্রমূখ নিজেদের দেহ পেতে দেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, কিন্তু তিনি তাতে রাজি হন নি। উকাশার দাবি অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ(সা) নিজের গায়ের জামা খুলে দেন। উকাশা তাঁর পেটে চুমু দেন এবং তাঁকে ক্ষমা করে দেন।……….ইত্যাদি।
পুরো ঘটনাটিই বানোয়াট। তবে সনদবিহীন বানোয়াট নয়, সনদসহ বানোয়াট। পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নুআইম ইসপাহানী তার ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে এই হাদীসটি সংকলন করেছেন। তিনি বলেন, আমাদেরকে সুলাইমান ইবনু আহমাদ বলেছেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ আল-বারা বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল মুনয়িম ইবনু ইদরীস বলেছেন, তিনি তাঁর পিতা হতে, ওয়াহব ইবনু মুনাব্বিহ থেকে, তিনি জাবির ও ইবনু আব্বাস(রা) হতে…….এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
এই হাদীসের বর্ণনাকারী আব্দুল মুনয়িম ইবনু ইদরীস(২২৮ হি) তৃতীয় হিজরী শতকে বাগদাদের প্রসিদ্ধ গল্পকার ওয়ায়েয ছিলেন। ইমাম আহমদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই ব্যক্তি জালিয়াত ছিলেন। তার ওয়াযের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য এইরূপ বিভিন্ন গল্প তিনি সনদসহ বানিয়ে বলতেন। এই হাদীসটিও তার বানানো একটি হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল, বানোয়াট ও জঘন্য মিথ্যা কথা।(আবূ নুআইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৪/৭৩-৭৫; ইবনুল জাওযী ১/২১৯;সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৭৭-২৮২; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৩২৬-৩৩১)।
২৯. ইন্তিকালের সময় মালাকুল মাওতের আগমন ও কথাবার্তা
প্রসিদ্ধ একটি গল্প হলো, রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের সময় মালাকুল মওতের আগমন বিষয়ক। গল্পটির সার সংক্ষেপ হলো, রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের সময় মালাকুল মওত একজন বেদুঈনের বেশে আগমন করেন এবং গৃহের মধ্যে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এক পর্যায়ে ফাতিমা(রা) অনুমতি প্রদান করেন। তিনি গৃহে প্রবেশের পর অনেক কথাবার্তা আলাপ আলোচনার পরে তাঁর পবিত্র রূহকে গ্রহণ করেন……..। গল্পটি বানোয়াট। গল্পটি মূলত উপরের জাল হাদীসের অংশ। আরো অনেক গল্পকার এতে রঙ চড়িয়েছেন। (ইবনুল জাউযী ১/২১৯; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৩২৬-৩৩১)।
৩০. স্বয়ং আল্লাহ তাঁর জানাযার নামায পড়েছেন!
আরেকটি প্রচলিত ওয়ায ও গল্প হলো, রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের পরে তাঁর গোসল ও কাফন সম্পন্ন করা হয় এবং তাঁর মুবারক দেহকে মসজিদে রাখা হয়। প্রথমে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর জানাযার সালাত আদায় করেন! গল্পটি বানোয়াট। এই গল্পটিও উপর্যুক্ত আব্দুল মুনয়িম ইবনু ইদরিসের বানানো গল্পের অংশ।(ইবনুল জাউযী ১/২১৯; সুয়ূতী আল-লাআলী ১/২৭৭-২৮২; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৩২৬-৩৩১)।
৩১. ইন্তিকালের পরে ১০ দিন দেহ মুবারক রেখে দেওয়া!
খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার নামে প্রচারিত ‘রাহাতুল কুলুব’ নামক বইয়ের বিষয়ে ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। এই বইয়ের ২৪শ মজলিশে খাজা নিজামুদ্দিন লিখেছেন, ২রা রবিউল আউয়াল ৬৫৬ হিজরিতে (৮/৩/১২৫৮ খৃ.) তিনি তার পীর শাইখ ফরীদ উদ্দীন এর দরবারে আগমন করলে তিনি বলেন, “আজকের দিনটা এখানেই থেকে যাও, কেননা আজ হযরত রেসালাতে পানাহ [রাসূলুল্লাহ(সা)] এর উরস মোবারক। কালকে চলে যেও। এরপর বললেন, ইমাম সাবী(রহ) হতে রাওয়ায়েত আছে যে, হযরত রেছালাতে পানাহ এর বেছাল মোবারক রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখে। তাঁর দেহ মোবারক মোজেযার জন্য ১০ দিন রাখা হয়েছিল। দুনিয়ার জীবিত কালে তাঁর পছিনা(ঘাম) মোবারকের সুগন্ধ ছিল উৎকৃষ্ট সুগন্ধির চেয়েও উৎকৃষ্ট। সেই একই খুশবু একইভাবে বেরিয়েছে ঐ দশ দিন, একটুও কমেনি(সুবহানাল্লাহ)। হুজুর পাক(সা) এর মোজেযা দেখে কয়েক হাজার ইহুদী তখন মোসলমান হয়েছিল। এ দশদিনের প্রতিদিন গরীব মিসকিনদেরকে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে বিভিন্ন বিবিদের ঘর হতে। ঐ সময় হুজুর (সা) এর নয়টি হুজরা ছিল এবং নয়দিন তাঁদের সেখান হতে দান করা হয়েছে। এবং দশম দিন, অর্থাৎ ১২ই রবিউল আউয়াল দান করা হয়েছে হযরত সিদ্দিকে আকবার আবূ বাকর(রা) এর ঘর হতে। এদিন মদীনার সমস্ত লোককে পেটভরে পানাহার করানো হয়েছে এবং এ দিনই তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক দাফন করা হয়েছে। এজন্যই মোসলমানগণ ১২ই রবিউল আউয়াল উরস করে এবং ১২ ই রবিউল আউয়াল দিনটি উরস হিসেবে প্রসিদ্ধ।”(খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া, রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৫০)।
আমরা জানিনা, হযরত খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া(রাহ)এর গ্রন্থের মধ্যে পরবর্তীকালে কেউ এই কথাগুলি লিখেছে, নাকি কারো মুখ হতে গল্পটি শুনে হযরত ফরীদ উদ্দীন(রাহ) এই কথাগুলি সরলমনে বিশ্বাস করেছেন এবং বলেছেন। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এ সমস্ত বইয়ের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই। পুরো বইটিও জাল হতে পারে।
সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ(সা) এর মুবারক দেহ ১০ দিন দাফন বিহীন রাখা, হাজার হাজার ইহুদীর ইসলাম গ্রহণ, ১০ দিন খানা খাওয়ানো ইত্যাদি সকল কথাই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের দিন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাঠক সালাত অধ্যায়ে, রবিউল আওয়াল মাসের আমল বিষয়ক আলোচনার মধ্যে জানতে পারবেন, ইনশা আল্লাহ। তবে মুসলিম উম্মাহ একমত যে, রাসূলুল্লাহ(সা) সোমবার পূর্বাহ্নে ইন্তিকাল করেন। পরদিন মঙ্গলবার তাঁর গোসল ও জানাযার সালাত আদায় শেষে দিবাগত সন্ধ্যায় ও রাতে তাঁকে দাফন করা হয়।
৩২. রাসূলুল্লাহ (সা) জন্ম থেকেই কুরআন জানতেন
আব্দুল হাই লাখনাবী বলেন, প্রচলিত যে সকল মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ(সা) সম্পর্কে বলা হয় তার মধ্যে রয়েছেঃ “রাসূলুল্লাহ(সা) জন্মলগ্ন হতেই কুরআন জানতেন এবং পাঠ করতেন।”(আবদুল হাই লাখনাবী, আল আসার, পৃ. ৩৮)।
এ কথা শুধু মিথ্যাই নয়, কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতের স্পষ্ট বিরোধী। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে, “আপনি তো জানতেন না যে, কিতাব কি এবং ঈমান কি….”(সূরা শুরা, আয়াত ৫২)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, “আপনি তো আশা করেন নি যে, আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হবে। ইহা তো কেবল আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহ।(সূরা কাসাস, আয়াত ৮৬)।
৩৩. রাসূলুল্লাহ (সা) জন্ম হতেই লেখাপড়া জানতেন
আব্দুল হাই লাখনাবী বলেন, ওয়ায়েযদের মিথ্যাচারের একটি নমুনাঃ “রাসূলুল্লাহ(সা) উম্মী বা নিরক্ষর ছিলেন না। তিনি প্রকৃতিগতভাবে শুরু হতেই লিখতে ও পড়তে সক্ষম ছিলেন।”
এই কথাটিও সনদবিহীন ভিত্তিহীন কথা এবং এটি কুরআন কারীমের স্পষ্ট আয়াতের বিরোধী। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে, “আপনিতো এর পূর্বে কোনো পুস্তক পাঠ করেন নি এবং নিজ হাতে কোনো পুস্তক লিখেন নি যে, মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষন করবে।”(সূরা ২৯, আনকাবুত, আয়াত ৪৮)।
৩৪. রাসূলুল্লাহ (সা) এর পবিত্র দাঁতের নূর
আব্দুল হাই লাখনাবী বলেন, প্রচলিত আরেকটি মিথ্যা কাহিনী নিম্নরূপঃ “এক রাত্রিতে আয়েশা(রা) এর হাত হতে তাঁর সূঁচটি পড়ে যায়। তিনি তা হারিয়ে ফেলেন এবং খোঁজ করেও পান নি। তখন নবীজি(সা) হেসে উঠেন এবং তাঁর দাঁতের একটি আলোকরশ্মি বেরিয়ে পড়ে। এতে ঘর আলোকিত হয়ে যায় এবং সেই আলোয় আয়েশা(রা) তাঁর সূচটি দেখতে পান। (আবদুল হাই লাখনাবী, আল আসার, পৃ. ৪৫)।
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, অনেক লেখক ও আলেম তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে সহীহ কথার পাশাপাশি অনেক বাতিল কথাও সংযোজন করেছেন। এতে অনেক সময় সাধারণ মুসলমানগণ বিভ্রান্ত হন। যেমন দশম হিজরী শতকের একজন মোল্লা মিসকীন মোহাম্মাদ আল ফিরাহী(৯৫৪ হি) কর্তৃক ফার্সী ভাষায় লিখিত ‘মা’আরিজুন নব্যুয়ত’ নামক সিরাতুন্নবী বিষয়ক একটি পুস্তক এক সময় ভারতে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। এই গ্রন্থে উপরের ঐ মিথ্যা হাদীসটি সংকলিত হয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লামা লাখনবী বলেনঃ “এ কথা ঠিক যে, এই জাল ও মিথ্যা কথাটি ‘মা’আরিজুন নব্যুয়ত’ গ্রন্থে ও অন্যান্য সীরাতুন্নবী গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ শুকনো ভিজে(ভাল মন্দ) সব কিছুই জমা করতেন। কাজেই এ সকল বইয়ের সব কথার উপর শুধুমাত্র ঘুমন্ত বা ক্লান্ত(অজ্ঞ বা অসচেতন) মানুষরাই নির্ভর করতে পারে।……”(আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার. পৃ. ৪৫-৪৬)।
৩৫. খলীলুল্লাহ ও হাবীবুল্লাহ
প্রচলিত একটি ‘হাদীসে কুদসী’তে আবূ হুরাইরা(রা) এর সূত্রে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “আল্লাহ ইবরাহীমকে(আ) খলীল(অন্তরঙ্গ বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেছেন, মূসাকে(আ) নাজীই(একান্ত আলাপের বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং আমাকে হাবীব(প্রেমাস্পদ) হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অতঃপর আল্লাহ বলেছেন, আমার মর্যাদা ও মহিমার শপথ, আমি আমার হাবীবকে আমার খালীল ও নাজীই এর উপর অগ্রাধিকার প্রদান করব।”
হাদীসটি ইমাম বাইহাকী ‘শুআইবুল ঈমান’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। তিনি তাঁর সনদে বলেন, দ্বিতীয় হিজরী শতকের রাবী মাসলামা ইবনু আলী আল খুশানী(১৯০ হি) বলেন, আমাকে যাইদ ইবনু ওয়াকি, কাসিম ইবনু মুখাইরিমা হতে, আবূ হুরাইরা থেকে বলেন….।” হাদীসটি উদ্বৃত্ত করে বাইহাকী বলেন, “এই মাসলামা ইবনু আলী মুহাদ্দিসগণের নিকট দুর্বল।”(বাইহাকী, শুআইবুল ঈমান, ২/১৮৫)।
মাসলামা ইবনু আলী নামক এই রাবীকে মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। আবূ যুরআ, বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে ‘মুনকার’ ও একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। নাসাঈ, দারাকুতনী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে ‘মাতরূক’ বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা মিথ্যা অভিযুক্ত রাবীকেই মাতরূক বলেন। হাকিম তাকে জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। (নাসাঈ, আদ-দুআফা, পৃ. ৯৭; ইবনুল জাউযী, আদ-দুআফা ৩/১২০)।
এজন্য অনেক মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন; কারণ এই একমাত্র পরিত্যক্ত রাবী ছাড়া কেউ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। অপরপক্ষে কোনো কোনো মুহাদ্দিস মাসলামাকে অত্যন্ত দুর্বল রাবী হিসেবে গণ্য করে হাদীসটিকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।
পক্ষান্তরে বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলিত সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(সা)কেও খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেনঃ “তিনি আমাকে খলীল(অন্তরঙ্গ বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেছেন যেরূপ তিনি ইবরাহীমকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।”(বুখারী, আস সহীহ ৩/১৩৩৭; মুসলিম, আস সহীহ ১/৩৭৭)।
রাসূলুল্লাহ (সা) এর ইন্তিকাল পরবর্তী জীবন বা হায়াতুন্নবী
কুরআন কারীমের অনেক আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, শহীদগণ মৃত নন, তাঁরা জীবিত ও রিযকপ্রাপ্ত হন। নবীগণের বিষয়ে কুরআন মাজীদে কিছু বলা না হলেও সহীহ হাদীসে তাঁদের মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে। আনাস ইবনু মালিক(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেনঃ “নবীগণ তাঁদের কবরের মধ্যে জীবিত, তাঁরা সালাত আদায় করেন।” হাদীসটির সনদ সহীহ।(বাইহাকী, হায়াতুল আম্বিয়া, পৃ. ৬৯-৭৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/২১১)।
অন্য একটি যয়ীফ সনদের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “নবীগণকে ৪০ রাতের পর তাঁদের কবরের মধ্যে রাখা হয় না; কিন্তু তাঁরা মহান আল্লাহর সম্মুখে সালাত রত থাকেন; শিংগায় ফুঁক দেওয়া পর্য্ন্ত।” হাদীসটির বর্ণনাকারী আহমাদ ইবনু আলী আল হাসনবী মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে পরিচিত। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস একে মাউযূ বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস এ অর্থের অন্যান্য হাদীসের সমন্বয়ে একে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।(দাইলামী, আল ফিরদাউস ১/২২২; ৩/৩৫; সুয়ূতী, আল লাআলী ১/২৮৫)।
বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ(সা) মি’রাজের রাত্রিতে মূসা(আ) কে নিজ কবরে সালাত আদায় করতে দেখেছেন এবং ঈসা(আ) কেও দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে দেখেছেন। আল্লামা বাইহাকী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এই দর্শনকে উপরের হাদীসের সমর্থনকারী বলে গণ্য করেছেন।(বাইহাকী, হায়াতুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭-৮৫)।
কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি কোনো কোনো পূর্ববর্তী নবীকে হজ্জ পালনরত অবস্থায় দেখেছেন। এ সকল হাদীসকেও কোনো কোনো আলিম নবীগণের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের নিদর্শন বলে গণ্য করেছেন। ইবনু হাজার আসকালানী বলেন, এই দর্শনের বিষয়ে কাজী ইয়াজ বলেন, এই দর্শনের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। একটি ব্যাখ্যা হলো, নবীগণ শহীদদের চেয়েও মর্যাদাবান। কাজেই নবীগণের জন্য ইন্তিকালের পরেও এইরূপ ইবাদতের সুযোগ পাওয়া দূরবর্তী কিছু নয়। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো, তাঁরা জীবিত অবস্থায় যেভাবে হ্জ্জ করেছেন রাসূলুল্লাহ(সা) কে তার সূরাত দেখানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(সা) কে ওহীর মাধ্যমে যা জানানো হয়েছে তাকে তিনি দর্শনের সাথে তুলনা করেছেন……।(ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৪৮৭)।
রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকাল পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিশেষভাবে কিছু হাদীস বর্ণিত। আবূ হুরাইরা(রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, “কেউ আমার কবরের নিকট থেকে আমার উপর দুরুদ পাঠ করলে আমি শুনতে পাই। আর যদি কেউ দূর হতে আমার উপর দুরূদ পাঠ করে তাহলে আমাকে জানানো হয়।”(বাইহাকী, হায়াতুল আম্বিয়া ১০৩-১০৫ পৃ.; সাখাবী, আল কাউলুল বাদী ১৫৪ পৃ.)। হাদীসটির একটি সনদ খুবই দুর্বল হলেও অন্য আরেকটি গ্রহণযোগ্য সনদের কারণে ইবনু হাজার, সাখাবী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এই সনদটিকে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।(সুয়ূতী, আল লাআলী ১/২৮৩; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৩৫৫; দরবেশ হুত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২১৬)।
আউস(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “তোমাদের দিনগুলির মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো শুক্রবার।…কাজেই, এই দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে দুরূদ পাঠ করবে, কারণ তোমাদের দুরূদ আমার কাছে পেশ করা হবে।” সাহাবীগণ বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তো (কবরের মাটিতে) বিলুপ্ত হয়ে যাবেন, মিশে যাবেন, কিভাবে তখন আমাদের দুরূদ আপনার নিকট পেশ করা হবে?” তিনি বলেন, “মহান আল্লাহ মাটির জন্য নিষেধ করেছেন নবীদের দেহ ভক্ষণ করা।”(নাসাঈ, আস-সুনান ৩/৯১; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৩৪৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/২৭৫, ২/৮৮)।
আরো অনেক সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, মুমিন বিশ্বের যেখান থেকেই সালাম ও দুরূদ পাঠ করবেন, ফিরিশতাগণ সেই সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ(সা)এর রওযা মোবারকে পৌছিয়ে দিবেন। আম্মার বিন ইয়াসির(রা) এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণিতঃ “মহান আল্লাহ আমার কবরে একজন ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন, যাকে তিনি সকল সৃষ্টির শ্রবণশক্তি প্রদান করেছেন, কিয়ামত পর্য্ন্ত যখনই কোনো ব্যক্তি আমার উপর সালাত(দুরূদ)পাঠ করবে তখনই ঐ ফেরেশতা সালাত পাঠকারীর নাম ও তাঁর পিতার নাম উল্লেখ করে আমাকে তাঁর সালাত পৌছে দিয়ে বলবে: অমুকের ছেলে অমুক আপনার উপর সালাত প্রেরণ করেছে।” হাদীসটি বাযযার, তাবারানী ও আবুশ শাইখ সংকলন করেছেন। হাদীসের সনদে পরস্পর বর্ণনাকারী রাবীদের মধ্যে দুইজন রাবী দুর্বল। এজন্য হাদীসটি দুর্বল বা যয়ীফ। তবে এই অর্থে আরো কয়েকটি দুর্বল সনদের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলির সামগ্রিক বিচারে নাসিরুদ্দীন আলবানী ও অন্যান্য কিছু মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।(সাখাবী, আল কাওলুল বাদী, পৃ. ১৫৩-১৫৫; আলবানী, আস সহীহা ৪/৪৩-৪৫)।
উপরের হাদীসগুলি হতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ(সা)এর ইন্তিকালের পরে তাঁকে পুনরায় জীবন দান করা হয়েছে। এই জীবন বারযাখী জীবন, যা একটি বিশেষ সম্মান বা গায়েবী জগতের একটি অবস্থা। এ বিষয়ে হাদীসে যতটুকু বলা হয়েছে ততটুকুই বলতে হবে। হাদীসের আলোকে আমরা বলব, এই অপার্থিব ও অলৌকিক জীবনে তাঁর সালাত আদায়ের সুযোগ রয়েছে। কেউ সালাম দিলে আল্লাহ তাঁর রূহ মোবারককে ফিরিয়ে দেন সালামের জবাব দেয়ার জন্য। রাওযার পাশে কেউ সালাম দিলে তিনি তা শুনেন, আর দূর হতে সালাম দিলে তা তাঁর নিকট পৌছানো হয়। এর বেশি কিছুই বলা যাবে না। বাকি বিষয় আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে। বুঝতে হবে যে, উম্মাতের জানার প্রয়োজন নেই বিধায় রাসূলুল্লাহ(সা) বাকি বিষয়গুলি বলেন নি।
কিন্তু এ বিষয়ে অনেক মনগড়া কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলা হয়। এ সকল কথা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলা হয়। মুমিনের উচিত গায়েবী বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে কুরআন হাদীসের উপর নির্ভর করা এবং এর অতিরিক্ত কিছুই না বলা। গায়েবী জগত সম্পর্কে আমরা শুধুমাত্র ততটুকু কথা বলব, যতটুকু রাসূলুল্লাহ(সা) আমাদেরকে বলে গিয়েছেন। বাকি বিষয় আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে। এর বাইরে কিছু বলার অর্থই হলো: প্রথমত, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে আন্দাযে মিথ্যা কথা বলা। দ্বিতীয়ত, আমরা দাবি করবো যে, গায়েবী বিষয়ে আমাদের জানা জরুরী এমন কিছু বিষয় না শিখিয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) চলে গিয়েছেন, ফলে এখন আমাদেরকে যুক্তি ও গবেষণার মাধ্যমে তা জানতে হচ্ছে।
৩৬. তাঁর ইন্তিকাল পরবর্তী জীবন জাগতিক জীবনের মতই
এ সকল বানোয়াট কথার মধ্যে অন্যতম হলো, রাসূলুল্লাহ(সা) ও নবীগণের ইন্তিকাল পরবর্তী এই বারযাখী জীবনকে পার্থিব বা জাগতিক জীবনের মতই মনে করা। এই ধারণাটি ভুল এবং তা কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের রীতির পরিপন্থী। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও সূফী মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়্যিদ দরবেশ হুত ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের পরবর্তী ঘটনাগুলি বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থ পাঠ করলেই আমরা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ(সা) কে কখনোই জাগতিক জীবনের অধিকারী বলে মনে করেন নি। খলীফা নির্বাচনের বিষয়, গোসলের বিষয়, দাফনের বিষয়, পরবর্তী সকল ঘটনার মধ্যেই আমরা তা দেখতে পাই। রাসূলুল্লাহর(সা) জীবদ্দশায় তাঁর পরামর্শ, দোয়া ও অনুমতি ছাড়া তাঁরা কিছুই করতেন না। কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর কোনো সাহাবী কখনো তাঁর রাওযায় দোয়া, পরামর্শ বা অনুমতি গ্রহণের জন্য আসেন নি। সাহাবীগণ বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছেন, যুদ্ধ বিগ্রহ করেছেন এবং বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। কখনোই খোলাফায়ে রাশেদীন বা সাহাবীগণ দলবেঁধে বা একাকী রাসূলুল্লাহ(সা) এর রাওযা মোবারকে গিয়ে তাঁর কাছে দোয়া-পরামর্শ চান নি।
আবূ বকরের(রা)খিলাফত গ্রহণের পরই কঠিনতম বিপদে পতিত হয় মুসলিম উম্মাহ। একদিকে বাইরের শত্রু, অপরদিকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিদ্রোহ, সর্বোপরি প্রায় আধা ডজন ভন্ড নবী। মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্বের সংকট। কিন্তু একটি দিনের জন্যও আবূ বাকর(রা) সাহাবীদেরকে নিয়ে বা নিজে রাসূলুল্লাহ(সা) এর রাওজায় গিয়ে তাঁর নিকট দোয়া চান নি। এমনকি আল্লাহর নিকট দোয়া করার জন্য রাওযা শরীফে উপস্থিত হয়ে কোনো অনুষ্ঠান করেন নি।
রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইন্তিকালের পরে ফাতিমা, আলী ও আব্বাস(রা) খলীফা আবূ বাকর(রা) এর নিকট রাসূলুল্লাহ(সা) এর পরিত্যক্ত সম্পত্তির উত্তারিধাকার চেয়েছেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে অনেক মতভেদ ও মনোমালিন্য হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশার(রা)সাথে আমীরুল মুমিনীন আলীর(রা) কঠিন যুদ্ধ হয়েছে, আমীর মুয়াবিয়ার(রা) সাথেও তাঁর যুদ্ধ হয়েছে। এসকল যুদ্ধে অনেক সাহাবী সহ অসংখ্য মুসলিম নিহত হয়েছেন। কিন্তু এ সকল কঠিন সময়ে তাঁদের কেউ কখনো রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে পরামর্শ চান নি। তিনি নিজেও কখনো এ সকল কঠিন মুহুর্তে তাঁর কন্যা, চাচা, জামাতা, খলীফা কাউকে কোনো পরামর্শ দেন নি। এমনকি কারো কাছে রূহানীভাবেও প্রকাশিত হয়ে কিছু বলেন নি। আরো লক্ষণীয় যে, প্রথম শতাব্দীগুলির জালিয়াতগণ এ সকল মহান সাহাবীর পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক জাল হাদীস বানিয়েছে, কিন্তু কোনো জালিয়াতও প্রচার করে নি যে, রাসূলুল্লাহ(সা) ইন্তিকালের পর রাওযা শরীফ থেকে বা সাহাবীগণের মজলিসে এসে অমুক সাহাবীর পক্ষে বা বিপক্ষে যুদ্ধ করতে বা কর্ম করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (দরবেশ হুত, আসানিল মাতালিব, পৃ. ২৯৮-২৯৯)।
৩৭. তিনি আমাদের দরূদ সালাম শুনতে বা দেখতে পান আব্দুল হাই লাখনবী বলেন, প্রচলিত যে সকল বানোয়াট ও মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, “যদি কেউ রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে দুরূদ পাঠ করে, তবে সেই ব্যক্তি যত দূরেই থাক, তিনি কারো মাধ্যম ছাড়াই তা শুনতে পান।”(আব্দুল হাই লাখনাবী, আলআসার, পৃ. ৪৬)।
এই কথাটি শুধু সনদবিহীন, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মিথ্যা কথাই নয়; উপরন্তু তা উপরের সহীহ হাদীসগুলির বিরোধী।
৩৮. তিনি মীলাদের মাহফিলে উপস্থিত হন
আব্দুল হাই লাখনবী আরো বলেন, প্রচলিত যে সকল বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, “মাওলিদের ওয়াযের মজলিসে তাঁর মাওলিদ বা জন্মের কথা উল্লেখের সময় তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত হন। এ কথার উপরে তারা তাঁর মাওলিদের বা জন্মের কথার সময় সম্মান ও ভক্তি প্রদর্শনের জন্য কিয়াম বা দাঁড়ানোর প্রচলন করেছে।”(আব্দুল হাই লাখনাবী, আলআসার, পৃ. ৪৬)। একথাটিও সনদহীন, ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। উপরন্তু এ কথা উপরে উল্লেখিত সহীহ হাদীসগুলির সুস্পষ্ট বিরোধী।
৩৯. মিলাদ মাহফিলের ফযীলত
বর্তমান যুগে প্রচলিত মিলাদ মাহফিল সম্পর্কে আলিমদের মতভেদ সুপরিচিত। আমি আমার লেখা ‘এহইয়াউস সুন্নাহ’ ও ‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকদ্বয়ে কুরআন, সুন্নাহ ও ইতিহাসের আলোকে মীলাদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও এ বিষয়ে আলিমগণের মতামত বিস্তারিত আলোচনা করেছি।(দেখুন এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৪৬১-৪৯৫; রাহে বেলায়াত, পৃ. ২৯৬-২৯৭)। আমরা দেখেছি যে, মীলাদ মাহফিলের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ(সা) এর মীলাদ, সীরাত, শামাইল, সুন্নাত ইত্যাদি আলোচনা করা, দুরূদ সালাম পাঠ করা ইত্যাদি সবই সুন্নাত সম্মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নাম ও পদ্ধতিগত কারণে বিভিন্ন মতভেদ দেখা যায়। এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিভিন্ন মত পোষণ করার ও প্রমাণ পেশ করার অধিকার সকলেরই রয়েছে। কিন্তু জালিয়াতি করার অধিকার কারোই নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ বিষয়েও অনেক জালিয়াতি হয়েছে। আমাদের দেশের একজন প্রসিদ্ধ আলেম এ জাতীয় অনেক জাল ও মিথ্যা কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “হযরত আবূ বাকর(রা) এর বাণীঃ যে ব্যক্তি মীলাদ পাঠের নিমিত্ত এক দিরহাম(চারআনা) দান করবে ঐ ব্যক্তি আমার সাথে বেহেশতে সাথী হবে। হযরত ওমার ফারূক (রা) এর বাণীঃ যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তাযিম ও সম্মান প্রদর্শন করবে সে প্রকৃতপক্ষে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করবে। হযরত ওসমান গনী(রা) এর বাণীঃ যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর জন্য এক দিরহাম দান করলো, সে যেন বদর বা হোনাইনের যুদ্ধে যোগদান করলো। হযরত আলী(রা) এর বাণীঃ যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তাযীম করবে এবং মীলাদ পাঠের কারণ হবে, সে দুনিয়া হতে ঈমানের সাথে ইন্তেকাল করবে।(আল্লামা মুহাম্মাদ মোস্তফা হামিদী, মীলাদ ও কিয়াম, পৃ. ৭০)।
এভাবে আরো অনেক তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীর নামে অনেক জাল কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ(সা) ও সাহাবীগণের হাদীসের ভাষা, শব্দ ও পরিভাষা সম্পর্কে যার ন্যূনতম জ্ঞান আছে তিনিও বুঝতে পারবেন যে, এগুলি সবই জাল কথা। সর্বোপরি কোনো সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদেও এই কথাগুলি বর্ণিত হয় নি। ইসলামের প্রথম ৬/৭ শতাব্দীর মধ্যে লিখিত কোনো গ্রন্থে সনদ বিহীনভাবেও এই মিথ্যা কথাগুলি উল্লেখ করা হয় নি। গত কয়েক শতাব্দী ধরে দাজ্জাল জালিয়াতগণ এ সকল কথা বানিয়ে প্রচার করছে।
৪০. রাসূলুল্লাহ (সা) এর ইলমুল গায়েব এর অধিকারী হওয়া
আব্দুল হাই লাখনবী বলেন, প্রচলিত যে সকল মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে প্রচারিত হয় তার অন্যমত হলোঃ “রাসূলুল্লাহ(সা) সৃষ্টির শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সকলের ও সব কিছুর বিস্তারিত জ্ঞান প্রদত্ত হয়েছিলেন। যা কিছু অতীত হয়েছে এবং যা কিছু ভবিষ্যতে ঘটবে সবকিছুরই বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি জ্ঞান তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। ব্যাপকতায় ও গভীরতায় রাসূলুল্লাহ(সা) এর জ্ঞান ও তাঁর প্রতিপালক মহান আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য নেই(নাউজুবিল্লাহ)। শুধুমাত্র পার্থক্য হলো, আল্লাহর জ্ঞান অনাদি ও স্বয়ংজ্ঞাত, কেউ তাঁকে শেখান নি। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহর জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তাঁর প্রভুর শেখানোর মাধ্যমে।”
আল্লামা লাখনবী বলেন, এগুলি সবই সুন্দর করে সাজানো মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। ইবনু হাজার মাক্কী তার ‘আল মিনাহুল মাক্কিয়াহ’ গ্রন্থে ও অন্যান্য প্রাজ্ঞ আলিম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই কথাগুলি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, সামগ্রিক ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। একমাত্র তিনিই সকল অদৃশ্য জ্ঞানের একমাত্র অধিকারী বা আলিমুল গাইব। এই জ্ঞান একমাত্র তাঁরই বিশেষত্ব ও তাঁরই গুণ। আল্লাহর পক্ষ হতে অন্য কাউকে এই গুণ প্রদান করা হয় নি। হ্যাঁ, আমাদের নবী(সা) এর জ্ঞান অন্য সকল নবী রাসূলের(আ) জ্ঞানের চেয়ে বেশি। গাইবী বা অতিন্দ্রিয় বিষয় সম্পর্কে তাঁর প্রতিপালক অন্যান্য সবাইকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার চেয়ে অধিকতর ও পূর্ণতর শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে। তিনি জ্ঞান ও কর্মে পূর্ণতম এবং সম্মান ও মর্যাদায় সকল সৃষ্টির নেতা।(আব্দুল হাই লাখনবী, আল আসার, পৃ. ৩৮)।
মোল্লা আলী কারীও অনুরূপ কথা বলেছেন।(মোল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ৩২৩-৩২৫)।
৪১. রাসূল (সা) এর হাযির নাযির হওয়া
রাসূলুল্লাহ(সা) এর ইলমুল গায়েব ও মীলাদে উপস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত আরেকটি প্রচলিত বানোয়াট কথা যে, তিনি ‘হাযির নাযির’। হাযির-নাযির দুইটি আরবী শব্দ। হাযির অর্থ উপস্থিত; নাযির অর্থ দর্শক, পর্যবেক্ষক বা সংরক্ষক। ‘হাযির-নাযির’ বলতে বুঝানো হয় সদাবিরাজমান ও সর্বজ্ঞ বা সবকিছুর দর্শক। স্বভাবতই যিনি সদাসর্বত্র বিরাজমান ও সবকিছুর দর্শক তিনি সর্বজ্ঞ ও সকল যুগের সকল স্থানের গায়েবী জ্ঞানের অধিকারী। কাজেই যারা রাসূলুল্লাহ(সা) কে ‘হাযির-নাযির’ দাবি করেন, তাঁরা দাবি করেন যে, তিনি শুধু সর্বজ্ঞই নন, উপরন্তু তিনি সর্বত্র বিরাজমান।
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়ঃ
প্রথমত, এই গুণটি শুধুমাত্র আল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ আল্লাহ বারংবার এরশাদ করেছেন যে, বান্দা যেখানেই থাক, আল্লাহ তাঁর সাথে আছেন, তিনি তার নিকটে আছেন…… ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ(সা) সম্পর্কে কখনো ঘুণাক্ষরেও কুরআন ও হাদীসে বলা হয় নি যে, তিনি সর্বদা উম্মতের সাথে আছেন, অথবা সকল মানুষের সাথে আছেন, অথবা কাছে আছেন, অথবা সর্বত্র উপস্থিত আছেন, অথবা সবকিছু দেখছেন। কুরআনের আয়াত তো দূরের কথা, একটি যয়ীফ হাদীসও দ্বর্থহীনভাবে এই অর্থে কোথাও বর্ণিত হয় নি। কাজেই যারা এই কথা বলেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে মিথ্যা কথা বলেন। কেননা কোনো সহীহ, যয়ীফ এমন কি মাঊদূ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি বলেছেন, ‘আমি হাযির-নাযির’। অথচ তাঁর নামে এই মিথ্যা কথাটি বলা হচ্ছে। এমনকি কোনো সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী বা ইমাম কখনোই বলেন নি যে, ‘রাসূলুল্লাহ(সা) হাযির-নাযির’।
দ্বিতীয়ত, কুরআন হাদীসে বারংবার অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ও দ্বর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ(সা) ইলমুল গায়েব বা গোপন জ্ঞানের অধিকারী নন। রাসূলুল্লাহ(সা) কে হাযির নাযির বলে দাবি করা উক্ত সকল স্পষ্ট ও দ্বর্থহীন আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করা।
তৃতীয়ত, আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন হাদীসে তিনি বলেছেন, উম্মাতের দুরূদ-সালাম তাঁর কবরে উপস্থিত করা হয়। আর রাসূলুল্লাহ(সা)কে হাযির নাযির দাবি করার অর্থ হলো এ সমস্ত হাদীস সবই মিথ্যা।উম্মাতের দুরূদ সালাম তাঁর নিকট উপস্থিত হয় না বরং তিনিই উম্মাতের নিকট উপস্থিত হন!! কাজেই যারা এই দাবিটি করছেন তারা শুধু রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে মিথ্যা বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। উপরন্তু তারা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(সা) কে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করছেন, নাঊযুবিল্লাহ! নাঊযুবিল্লাহ!!
এ সকল মিথ্যার উৎস ও কারণ
এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন হতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ(সা) এইরূপ ইলমুল গাইবের অধিকারী, হাযির-নাযির, ইত্যাদি যখন কোনো হাদীসেই বর্ণিত হয় নি এবং কুরআনেও এভাবে বলা হয় নি, তখন কেন অনেক মানুষ এগুলি বলছেন? তাঁরা কি কিছুই বুঝেন না?
এই বইয়ের পরিসরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইলমুল গায়েব, হাযির-নাযির ও অন্যান্য বিষয়ে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলার পিছনে দুটি কারণ প্রধানঃ
প্রথম কারণঃ এ বিষয়ক কিছু বানোয়াট কথা বা বিভিন্ন আলিমের কথার উপর নির্ভর করা। পাশাপাশি দ্বর্থবোধক বিভিন্ন আয়াত বা হাদীসের উপর নির্ভর করে সেগুলিকে নিজের মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা। আর এ সকল দ্বর্থবোধক আয়াত ও হাদীসের বিশেষ ব্যাখ্যাকে বজায় রাখতে অগণিত আয়াত ও হাদীসের স্পষ্ট অর্থকে বিকৃত করা বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে সেগুলিকে বাতিল করে দেওয়া।
ইসলামের পূর্ববর্তী ধর্মগুলির বিভ্রান্তির যে চিত্র কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে আমরা দেখতে পাই যে, এই বিষয়টি ছিল বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। আল্লাহ ঈসাকে(আ)বিনা পিতায় জন্ম দিয়েছেন, তাকে আল্লাহর কালিমা ও আল্লাহর রূহ বলেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের সত্ত্বার(যাতের) অংশ বলেন নি। প্রচলিত বাইবেলেও নেই যে, যীশু নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করেছেন। কিন্তু খৃস্টানগণ দাবি করলেন, যেহেতু ‘আল্লাহর কালাম’ আল্লাহর গুণ ও তাঁর সত্ত্বার অংশ, সেহেতু যীশু ঈশ্বরের অংশ। আল্লাহর রূহ তাঁরই সত্ত্বা। যেহেতু যীশুকে ঈশ্বরের আত্মা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেহেতু তিনি ঈশ্বরের যাতের অংশ, ঈশ্বরের জাত ও ঈশ্বর….(God Incarnate)। এই অপব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে তাঁরা বাইবেলের অগণিত স্পষ্ট বাক্যের অপব্যাখ্যা করে এই আসমানী ধর্মটিকে বিকৃত করে। এজন্য আল্লাহ এরশাদ করেছেনঃ
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ ۚ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَىٰ مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِّنْهُ ۖ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۖ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ ۚ انتَهُوا خَيْرًا لَّكُمْ ۚ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۖ سُبْحَانَهُ أَن يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ ۘ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَكِيلًا [٤:١٧١]
“হে কিতাবীগণ! দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলো না। মরিয়ম তনয় ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল, এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মরীয়মের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর থেকে(আগত)আত্মা (আদেশ)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আন এবং বলিও না ‘তিন’…..।”(সূরা ৪, নিসাঃ আয়াত ১৭১)।
এভাবে আল্লাহ তাঁদেরকে বাড়িয়ে বলতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ যতটুকু বলেছেন ততটুকুই বল। তাকে আল্লাহর কালিমা ও আল্লাহর রূহ বল, কিন্তু এ থেকে বাড়িয়ে বা ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁকে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঈশ্বরের জাত’ বলো না এবং ত্রিত্ববাদের শিরকের মধ্যে নিপতিত হয়ো না।
ইসলামের প্রথম যুগ থেকে যারা বিভ্রান্ত হয়েছে তাদের মধ্যেও একই কারণ বিদ্যমান। খারিজী, শিয়া, কাদারিয়া, জাবারিয়া, মুরজিয়া, মু’তাযিলী ইত্যাদি সকল সম্প্রদায়ই কুরআন সুন্নাহ মানেন। একটি কারণেই তারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। কুরআন ও হাদীসে যা কিছু বলা হয়েছে সাহাবীগণ তা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতেন। এগুলির মধ্যে কোনো বৈপরীত্য দেখতেন না বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করতেন না। কুরআন-হাদীসে যা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁরা তাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। যেমন, কুরআন কারীমের বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো হুকুম নেই। আবার অন্যত্র বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে হাকিম বানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাহাবীগণ উভয় বিষয় সমানভাবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু খারিজীগণ একটিকে গ্রহণ করেছে এবং অন্য সকল নির্দেশকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বাতিল করে দিয়েছে।
অনুরূপভাবে কুরআন কারীমে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার কথা ও কর্মের কারণে বিপদাপদের কথা বলা হয়েছে। তেমনি সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয় তাও বলা হয়েছে। সাহাবীগণ উভয় কথা সমানভাবে বিশ্বাস করেছেন। এগুলির মধ্যে কোনো বৈপরীত্য খুঁজেন নি। কিন্তু কাদারিয়া, জাবারিয়া, মু’তাযিলা বিভিন্ন সম্প্রদায় একটি কথাকে মূল হিসেবে গ্রহণ করে বাকি কথাগুলিকে বিভিন্ন অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে দিয়েছেন।
কুরআন কারীমে পাপীদের অনন্ত জাহান্নাম বাসের কথা বলা হয়েছে। আবার শিরক ছাড়া সকল পাপ আল্লাহ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করতে পারেন বলেও বলা হয়েছে। অগণিত সহীহ হাদীসে পাপী মুমিনের শাস্তিভোগের পরে জান্নাতে গমনের কথা বলা হয়েছে। সাহাবীগণ সবগুলিই সমানভাবে মেনেছেন। কিন্তু বিভ্রান্ত সম্প্রদায়গুলি একটিকে মানতে অন্যটি বাতিল করেছেন।
‘ইলমুল গায়িব’ বা হাযির-নাযির কথাটি ইসলামের প্রথম কয়েকশত বৎসর ছিল না। পরবর্তীকালে এর উৎপত্তি। এ বিষয়েও একই বিষয় পরিলক্ষিত হয়।
কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া আসমান যমীনের কেউ গায়েব জানেন না। বিভিন্ন আয়াতে বারংবার বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ(সা) ‘গাইব’ বা অদৃশ্য বিষয় জানেন না। মক্কী সূরায়, মাদানী সূরায়, মদীনায় অবতীর্ণ একেবারে শেষের দিকের সূরারয় সকল স্থানেই তা বলা হয়েছে। (দেখুন সূরা: ৬, আনআম ৫০, ৫৯; সূরা: ৭, আরাফ, ১৮৮; সূরা: ৯, তাওবা ১০১; সূরা: ১০, ইউনূস, ২০; সূরা: ১১, হুদ, ৩১; সূরা ২১, আম্বিয়া, ১০৯, ১১১; সূরা: ২৭, নামল, ৬৫; সূরা: ৪৬, আহকাফ, ৯; সূরা: জিন, ২৫)।
এর বিপরীতে একটি আয়াতেও বলা হয় নি যে, তিনি ‘আলিমুল গাইব’। তিনি ‘গাইবের সবকিছু জানেন’ একথা তো দূরের কথা ‘তিনি গাইব জানেন’ এ ধরনের একটি কথাও কোথাও বলা হয়নি। তবে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, এগুলি গাইবের কথা আপনাকে ওহীর মাধ্যমে জানালাম………ইত্যাদি।
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি গাইব বা অদৃশ্য জ্ঞানের মালিক নন, তিনি মনের কথা জানেন না, তিনি গোপন কথা জানেন না এবং তিনি ভবিষ্যত জানেন না।
আয়েশা, উম্মু সালমা, আসমা বিনতে আবূ বাকর, আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আনাস ইবনু মালিক, আবূ সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনু সা’দ, আমর ইবনুল আস প্রমুখ প্রায় দশ জন সাহাবী(রাদিআল্লাহু আনহুম) থেকে অনেকগুলি সহীহ সনদে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন যে, কেয়ামতের দিন অনেক মানুষ আমার কাছে(হাউজে পানি পানের জন্য)আসবে, যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেওয়া হবে না, বাধা দেওয়া হবে। আমি বলব: এরাতো আমারই উম্মত। তখন বলা হবে: আপনার পরে তারা কি আমল করেছে তা আপনি জানেন না।(বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৯১, ১৭৬৬, ৫/২৩৯১; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩-১৭৯৪)।
এ সকল অগণিত সহীহ হাদীসের বিপরীতে একটি হাদীসও তিনি বলেন নি যে, আমি ‘আলিমুল গাইব’ বা আমি সকল গোপন জ্ঞানের অধিকারী, অথবা আমি তোমাদের সকল কথাবার্তা বা কাজকর্মের সময় উপস্থিত থাকি, অথবা আমি ঘরে বসেই তোমাদের সকল কাজকর্ম ও গোপন বিষয় দেখতে পাই……এরূপ কোনো কথাই তিনি বলেন নি।
তবে বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) অনেক ভবিষ্যতের সংবাদ প্রদান করেছেন, অনেক মানুষের গোপন বিষয় বলে দিয়েছেন, কোনো কোনো হাদীসে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, স্বপ্ন বা সালাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি জান্নাত, জাহান্নাম সবকিছু দেখেছেন। এসব ঘটনায় প্রমাণ হয় না যে, রাসূলুল্লাহ(সা) গায়েবের সব জ্ঞান জানতেন বরং মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয়তম রাসূলকে যতটুকু জানিয়েছেন তিনি ততটুকুই জানতেন। অর্থাৎ গায়েবের একমাত্র মালিক আল্লাহ তাআলা।
মনে রাখতে হবে, দ্বর্থবোধক কথার জন্য দ্বর্থহীন বা সুস্পষ্ট কথা বাতিল করা যাবে না। বরং দ্বর্থহীন কথাকে ভিত্তি ধরে অস্পষ্ট বা দ্বর্থবোধক কথার ব্যাখ্যা করতে হবে। কোনো একক হাদীসের জন্য কুরআনের স্পষ্ট বাণী বা মুতাওয়াতির ও মশহুর হাদীস বাতিল করা যাবে না। প্রয়োজনে কুরআন ও প্রসিদ্ধ হাদীসের জন্য একক ও দ্বর্থবোধক হাদীসের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা করতে হবে।
কিন্তু যারা ইলমুল গায়েবের দাবি করেন তাঁরা এসব দ্বর্থবোধক বা ফযীলত বোধক আয়াত ও হাদীসকে মূল ধরে এর ভিত্তিতে অগণিত সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীসকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে দেন। পাঠকের হৃদয়ঙ্গমের জন্য এখানে তাঁদের এইরূপ তিনটি দলীল আলোচনা করছি।
(১) কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহকে(সা) ‘শাহিদ’ বা ‘শাহীদ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।(সূরা ৩৩: আহযাব, ৪৫; সূরা ৪৮:ফাতহ, ৮; সূরা ৭৩: মুযাম্মিল, ১৫; সূরা ২: বাকারা ১৪৩; সূরা ৪: নিসা, ৪১; সূরা ১৬: নাহল, ৮৯; সূরা ২২: হাজ্জ, ৭৮)। এই শব্দ দুইটির অর্থ ‘সাক্ষী’, ‘প্রমাণ’, ‘উপস্থিত’(witness, evidence, present) ইত্যাদি। সাহাবীগণের যুগ থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মুফাসসিরগণ এই শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে ও সাক্ষীরূপে প্রেরণ করেছেন। যারা তাঁর প্রচারিত দ্বীন গ্রহণ করবেন, তিনি তাঁদের পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন। এছাড়া পূর্ববর্তী নবীগণ যে তাদের দীন প্রচার করেছেন সে বিষয়েও তিনি এবং তাঁর উম্মাত সাক্ষ্য দিবেন। অনেকে বলেছেন, তাঁকে আল্লাহ তাঁর একত্বের বা ওয়াহদান্যিয়াতের সাক্ষী ও প্রমাণ-রূপে প্রেরণ করেছেন।(তাবারী ২২/১৮, ২৬/৭৩; ইবনু কাসীস ৩/৪৯৮)।
এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক স্থানে মুমিনগণকেও মানবজাতির জন্য ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।(সূরা ২: বাকারা, ১৪৩; সূরা ২২: হাজ্জ, ৭৮)। অনেক স্থানে আল্লাহকে ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।(সূরা ৪: নিসা,৭৯, ১৬৬; সূরা ৫:মায়িদা, ১১৭; সূরা ১০:ইউনূস, ২৯; সূরা ১৩:রাদ, ৪৩; সূরা ১৭: ইসরা, ৯৬; সূরা ২৯:আনকাবুত, ৫২; সূরা ৩৩:আহযাব, ৫৫; সূরা ৪৬:আহকাফ, ৮; সূরা ৪৮:ফাতহ, ২৮)।
যারা রাসূলুল্লাহকে(সা) সকল অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বা হাযির-নাযির বলে দাবি করেন তাঁরা এই দ্বর্থবোধক শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ গ্রহণ করেন। এরপর সেই অর্থের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কুরআনের সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বাণী বাতিল করে দেন। তাঁরা বলেন, ‘শাহীদ’ অর্থ উপস্থিত। কাজেই তিনি সর্বত্র উপস্থিত। অথবা ‘শাহীদ’ অর্থ যদি সাক্ষী হয় তাহলেও তাঁকে সর্বত্র উপস্থিত থাকতে হবে। কারণ না দেখে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। আর এভাবে তিনি সদা সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান বা হাযির নাযির ও সকল স্থানের সকল গোপন ও গাইবী জ্ঞানের অধিকারী।
তাঁদের এই ব্যাখ্যা ও দাবির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়।
প্রথমত, তাঁরা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী, তাবেয়ী ও পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের মতামত নিজেদের মর্জিমাফিক বাতিল করে দিলেন।
দ্বিতীয়ত, তাঁরা একটি দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যাখ্যাকে মূল আকীদা হিসেবে গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা নিজেদের মর্জিমাফিক বাতিল করে দিলেন। তাঁরা এমন একটি অর্থ গ্রহণ করলেন, যে অর্থে একটি দ্বর্থহীন আয়াত বা হাদীসও নেই। সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী বা কোনো ইমামও কখনো এ কথা বলেন নি।
তৃতীয়ত, তাঁদের এই ব্যাখ্যা ও দাবি মূলতই বাতিল। তাদের ব্যাখ্যা অনুসারে প্রত্যেক মুসলমানকেই ‘সর্বজ্ঞ’, ‘ইলমে গাইবের অধিকারী’ ও ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করতে হবে। কারণ মুমিনগণকেও কুরআন মাজীদে ‘শাহীদ’ অর্থাৎ ‘সাক্ষী’ বা ‘উপস্থিত’ বলা হয়েছে এবং বারংবার বলা হয়েছে যে, তাঁরা পূর্ববর্তী সকল উম্মাত সহ পুরো মানব জাতির সম্পর্কে কেয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবেন। আর উপস্থিত না হলে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। কাজেই তাদের ব্যাখ্যা ও দাবি অনুসারে বলতে হবে যে, প্রত্যেক মুমিন সৃষ্টির শুরু থেকে বিশ্বের সর্বত্র সর্বদা বিরাজমান এবং সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। কারণ না দেখে তারা কিভাবে মানব জাতির পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবেন?
النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ ۖ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ ۗ وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَىٰ بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ
“নবী মুমিনগণের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর স্ত্রী তাদের মাতা। এবং আল্লাহর কিতাবে আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর।”(সূরা ৩৩: আহযাব, আয়াত ৬)। এখানে ‘আউলা’ শব্দটির মূল হলো ‘বেলায়েত’ অর্থাৎ বন্ধুত্ব, নৈকট্য, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। ‘বেলায়েত’ অর্জনকারীকে ‘ওলী’ অর্থাৎ বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ‘আউল’ অর্থ ‘অধিকতর ওলী’। অর্থাৎ ‘অধিক বন্ধু’, ‘অধিক নিকটবর্তী’, ‘অধিক যোগ্য’, বা ‘অধিক দায়িত্বশীল’।(more entitled, more deserving, worthier, closer)। এখানে স্বভাবতই ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর(closer) বলতে ভক্তি, ভালবাসা, দায়িত্ব, সম্পর্ক ও আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠতা বুঝানো হচ্ছে। মুমিনগণ রাসূলুল্লাহকে তাঁদের নিজেদের সত্ত্বার চেয়েও বেশি আপন, বেশি প্রিয় ও আনুগত্য ও অনুসরণের বেশি হক্কদার বলে জানেন। এই ‘আপনত্বের’ একটি দিক হলো যে, তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মাতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আবার উম্মাতের প্রতি রাসূলুল্লাহ(সা) এর দরদ ও প্রেম তার আপনজনদের চেয়েও বেশি। রাসূলুল্লাহ(সা) স্বয়ং এ আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথা বলেছেন। হযরত জাবির, আবূ হুরাইরা প্রমূখ সাহাবী(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “প্রত্যেক মুমিনের জন্যই দুনিয়া ও আখিরাতে আমি তার অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহর বাণী পাঠ করঃ “নবী মুমিনগণের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর”। কাজেই যে কোনো মুমিন যদি মৃত্যুবরণ করে এবং সে সম্পদ রেখে যায়, তবে তার উত্তরাধিকারীগণ যারা থাকবে তারা সেই সম্পদ গ্রহণ করবে। আর যদি সে ঋণ রেখে যায় বা অসহায় সন্তান সন্তুতি রেখে যায় তবে তারা যেন আমার নিকট আসে; সে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব আমার উপরেই থাকবে। কারণ আমিই তার আপনজন “(বুখারী, আস-সহীহ ২/৮০৫,৮৪৫; ৪/১৭৯৫; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৫৯২, ৩/১২৩৭,১২৩৮)।
কিন্তু ‘হাযির-নাযির’ এর দাবিদারগণ দাবি করেন যে, এখানে দৈহিক নৈকট্য বুঝানো হয়েছে। কাজেই তিনি সকল মুমিনের নিকট হাযির আছেন।
এখানেও আমরা দেখেছি যে, একটি বানোয়াট ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তারা কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশকে বাতিল করে দিচ্ছেন। তারা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(সা) এর ব্যাখ্যাকেও গ্রহণ করছেন না। সর্বোপরি তাদের এই ব্যাখ্যা সন্দেহাতীতভাবেই বাতিল।কারণ এই আয়াতেই বলা হয়েছে, “আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর”। অন্যত্র ও বলা হয়েছে যে, “আত্মীয়গণ একে অপরের ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর”।(সূরা ৮:আনফাল, ৭৫)। তাহলে এদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমাদের বলতে হবে যে, সকল মানুষই হাযির নাযির। কারণ সকল মানুষই কারো না কারো আত্মীয়। কাজেই তারা সদাসর্বদা তাদের কাছে উপস্থিত এবং তাদের সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন!
অন্য আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে, নবী ও মুমিনগণ মানুষদের মধ্যে ইবরাহীম(আ) সবচেয়ে নিকটতর বা ঘনিষ্ঠতর।(সূরা ৩:আল ইমরান, ৬৮)। এখানে দাবি করতে হবে যে, সকল মুমিন ইবরাহীমের নিকট উপস্থিত……!
অন্য হাদীসে ইবনু আব্বাস(রা) বলেন, “যখন রাসূলুল্লাহ(সা) মদীনায় আগমন করেন, তখন ইহুদীদের আশুরায় সিয়াম পালন করতে দেখেন। তিনি তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তারা বলে, এই দিনে আল্লাহ মূসা(আ) ও ইস্রায়েল সন্তানদেরকে ফেরাউনের উপর বিজয় দান করেন। এজন্য মূসা(আ) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই দিন সিয়াম পালন করেন। তখন তিনি বলেনঃ “তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা(আ) এর নিকটতর। একথা বলে তিনি এই দিনে সিয়াম পালনের নির্দেশ প্রদান করেন।”(বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৪৪; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৯৫)।
এখন এই ব্যাখ্যা অনুসারে আমাদের দাবি করতে হবে যে, আমরা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক সদস্য মূসার কাছে উপস্থিত ও বিরাজমান!!
(৩) আনাস ইবনু মালিক(রা) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ(সা) আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। সালাতের পরে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে(অন্য বর্ণনায়, মিম্বরে আরোহণ করে) তিনি বলেনঃ হে মানুষেরা! আমি তোমাদের ইমাম। কাজেই তোমরা আমার আগে রুকু করবে না, সেজদা করবে না, দাঁড়াবে না এবং সালাত শেষ করবে না।(অন্য বর্ণনায়, কাতারগুলি পূর্ণ করবে।) কারণ আমি তোমাদেরকে দেখতে পাই আমার সামনে এবং আমার পেছনে, যখন তোমরা রুকু কর এবং যখন তোমরা সেজদা কর।(অন্য বর্ণনায়, সালাতের মধ্যে এবং রুকুর মধ্যে আমি আমার পেছন থেকে তোমাদেরকে দেখি যেমন আমি সামনে থেকে তোমাদেরকে দেখি)।(বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬২, ২৫৩; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩২০, ৩২৪)।
এই হাদীস হতে আমরা রাসূলুল্লাহ(সা) এর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পারছি। হাদীসটি পাঠ করলে বা শুনলে যে কেউ অনুভব করবেন যে, বিষয়টি স্বাভাবিক দৃষ্টি ও দর্শনের বিষয়ে। মানুষ সামনে যেরূপ সামনের দিকে দেখতে পায়, রাসূলুল্লাহ(সা) সালাতের মধ্যে সেভাবেই পিছনে দেখতে পেতেন। হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবেই জানা যায় যে, এই দর্শন ছিল সালাতের মধ্যে ও রুকু সাজদার মধ্যে। অন্য সময়ে তিনি এইরূপ দেখতেন বলে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। ইবনু হাজার আসকালানী বলেনঃ “হাদীসের বাহ্যিক বা স্পষ্ট অর্থ হতে বুঝা যায় যে, পিছন হতে দেখতে পাওয়ার এই অবস্থাটি শুধুমাত্র সালাতের জন্য খাস। অর্থাৎ তিনি শুধু সালাতের মধ্যেই এইরূপ পিছন হতে দেখতে পেতেন। এমনও হতে পারে যে, সর্বাবস্থায় তিনি এইরূপ দেখতে পেতেন। (ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/৫১৫)।
এই দ্বিতীয় সম্ভাবনা হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীত। তা সত্ত্বেও যদি তা মেনে নেওয়া হয় এবং মনে করা হয় যে, তিনি এইরূপ সর্বদা সামনে ও পেছনে দেখতে পেতেন, তবুও এ হাদীস দ্বারা কখনো বুঝা যায় না যে, তিনি দৃষ্টির আড়ালে, ঘরের মধ্যে, পর্দার অন্তরালে, মনের মধ্যে বা অনেক দূরের সবকিছু দেখতে পেতেন। তা সত্ত্বেও যদি কুরআন ও হাদীসের বিপরীত ও বিরোধী না হতো, তবে আমরা এই হাদীস হতে দাবি করতে পারতাম যে, তিনি এভাবে সর্বদা সর্বস্থানের সর্বকিছু দেখতেন এবং দেখছেন। কিন্তু আমরা দেখছি যে, বিভিন্ন আয়াতে এবং অগণিত সহীহ হাদীসে সুস্পষ্টত এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বারংবার এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। মূলত মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূলুল্লাহ(সা) এইরূপ ঝামেলা ও বিড়ম্বনার দায়িত্ব হতে উর্ধে্ব রেখেছেন।
কিন্তু ইলমুল গাইব বা হাযির-নাযির দাবিদারগণ এখানে ‘তোমাদেরকে দেখতে পাই’ কথাটির ব্যাখ্যায় বলেন যে, তিনি সদা সর্বদা সর্বস্থানে সর্বজনকে দেখতে পান। আমরা দেখছি যে, এই ব্যাখ্যটি শুধু হাদীসের বিকৃতিই নয়, উপরন্তু অগণিত আয়াত ও সহীহ হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধী।
সর্বোপরি সামনে ও পেছনে দেখা বা গায়েবী দেখা দ্বারা ‘সদা সর্বদা সর্বত্র উপস্থিত’ বা সবকিছু দেখা প্রমাণিত হয় না। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যে, শয়তান ও তার দল মানুষকে গায়েবীভাবে দেখেঃ “সে(শয়তান)ও তার দল তোমাদিগকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না।”(সূরা ৭:আরাফ, আয়াত ২৭)।
এখানে কি কেউ দাবি করবেন যে, যেহেতু ‘তোমাদিগকে দেখে’ বর্তমানকালের ক্রিয়া, সেহেতু শয়তান ও তার দলের প্রত্যেকে সদা সর্বদা সকল স্থানের সকল মানুষকে একইভাবে দেখতে পাচ্ছে বা দেখেই চলছে?!
এভাবে আমরা আমরা দেখছি যে, রাসূলু্ল্লাহ(সা) এর নামে এ সকল বানোয়াট ও মিথ্যা কথা যারা বলেন, তারা তাদের কথাগুলির পক্ষে একটিও দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট আয়াত বা হাদীস পেশ করছেন না। তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক বা দ্ব্যর্থবোধক কিছু আয়াত বা হাদীসকে মনগড়াভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং এরপর এইরূপ ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে তাঁরা অগণিত আয়াত ও সহীহ হাদীস বাতিল করে দেন। যারা এইরূপ ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ(সা) এর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান তাঁদের নেক নিয়্যত ও ভক্তি ভালবাসার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাঁরা ভাল উদ্দেশ্যে ওহীর নামে মিথ্যা বলছেন এবং রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে এমন বলছেন যা তিনি কখনোই নিজের বিষয়ে বলেন নি।
দ্বিতীয় কারণ, এ সকল কথাকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর মর্যাদা বৃদ্ধিকর বলে মনে করা এবং এসকল কথা বললে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, ভক্তি বৃদ্ধি ও পূর্ণতা বলে মনে করা।
নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ(সা) এর প্রতি ভক্তি ভালবাসা এবং তাঁর প্রশংসা করা ঈমানের মূল ও মুমিনের অন্যতম সম্বল। তবে এজন্য কুরআন কারীমের অগণিত আয়াত ও সহীহ হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশের বাইরে আমাদের যয়ীফ, বানোয়াট ও মিথ্যা কথা বলতে হবে বা যুক্তি, তর্ক, ব্যাখ্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে কিছু কথা বানাতে হবে এই ধারণাটিই ইসলাম বিরোধী।
এ সকল ক্ষেত্রে মুমিনের জন্য নাজাতের একমাত্র উপায় হলো, সকল ক্ষেত্রে বিশেষত আকীদা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আক্ষরিকভাবে কুরআন ও সুন্নাহর উপর নির্ভর করা। আমাদের বুঝতে হবে যে, আকীদা ও ধর্মীয় বিশ্বাস এমন একটি বিষয় যা প্রত্যেক মুমিনকেই একইভাবে বিশ্বাস করতে হবে। আমলের ক্ষেত্রে কোনো আমল কারো ক্ষেত্রে জরুরী আর কারো জন্য কম জরুরী বা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসের বিষয় তা নয়। তা সকলের জন্য সমান। এজন্য আলিমগণ বলেছেন যে, বিশ্বাসের ভিত্তি হবে কুরআন কারীম বা মুতাওয়াতির হাদীসের উপর। অর্থাৎ যে বিষয়টি বিশ্বাস করা মুমিনের জন্য প্রয়োজন সেই বিষয়টি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ(সা) তাঁর সাহাবীদেরকে জানিয়েছেন এবং সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায়ই জানিয়েছেন। আর এইরূপ বিষয় অবশ্যই কুরআন কারীমে থাকবে এবং ব্যাপক প্রচারিত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসে থাকবে।
এছাড়া আরো বুঝতে হবে যে, বিশ্বাসের ভিত্তি গাইবী বিষয়ের উপর। এ সকল বিষয়ে ওহীর নির্দেশনা ছাড়া কোনো ফায়সালা দেওয়া যায় না। কর্ম বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট বিধান নেই এরূপ নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবিত হয়, এজন্য সেক্ষেত্রে কিয়াস ও ইজতিহাদের প্রয়োজন হয়। যেমন মাইক, ধুমপান ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু বিশ্বাস বা আকীদার বিষয় সেরূপ নয়। এগুলোতে নতুন সংযোজন সম্ভব নয়। এজন্য এ বিষয়ে কিয়াস বা ইজতিহাদ অর্থহীন। আল্লাহর গুণাবলী, নবীগণের সংখ্যা, মর্যাদা, ফিরিশতাগণের সংখ্যা, সৃষ্টি, কর্ম, দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ইজতিহাদের কোনো সুযোগ নেই। কুরআন ও হাদীসে যেভাবে যতটুকু বলা হয়েছে তাই বিশ্বাস করতে হবে। এ সকল কথাকে আমরা ওহীর কথাকে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করতে পারি, কিন্তু যুক্তি দিয়ে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারি না।
এজন্য মুমিনের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো, কুরআন কারীমের সকল কথাকে সমানভাবে গ্রহণ করা এবং কোনো কথাকে প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য কথাকে বাতিল বা ব্যাখ্যা না করা। অনুরূপভাবে সকল সহীহ হাদীসকে সহজভাবে মেনে নেওয়া। ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে সাহাবীগণের অনুসরণ করা। যে বিষয়ে সহীহ হাদীসে স্পষ্ট কিছু নেই এবং সাহাবীগণও কিছু বলেন নি, সে বিষয়ে চিন্তা না করা, কথা না বলা ও বিতর্কে না জড়ানো। মহান আল্লাহ আমাদের নফসগুলিকে কুরআন ও সুন্নাহর অনুগত করে দিন। আমিন।