২.১৭. পানাহার বিষয়ক
১. খাদ্য গ্রহণের সময় কথা না বলা
খাদ্য গ্রহণের সময় কথা বলা নিষেধ বা কথা না বলা উচিত অর্থে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট। শুধু বানোয়াটই নয়, সহীহ হাদীসের বিপরীত। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিতে হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ খাদ্য গ্রহণের সময় বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলতেন ও গল্প করতেন।(সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ৪৬০; মুল্লা আলী কারী, আল আসরার পৃ. ২৬৫; আল-আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৪৮৮; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ. ২০৩)।
২. খাওয়ার সময়ে সালাম না দেওয়া
প্রচলিত ধারণা হলো খাওয়ার সময় সালাম দেওয়া ঠিক না। বলা হয়ঃ “খাদ্য গ্রহণকারীকে সালাম দেওয়া হবে না।”
সাখাবী, মুল্লা কারী ও আজলূনী বলেন, হাদীসের মধ্যে এই কথার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে যদি কারো মুখের মধ্যে খাবার থাকে, তাহলে তাকে সালাম না দেওয়া ভাল। এই অবস্থায় কেউ তাকে সালাম দিলে তার জন্য উত্তর প্রদান ওয়াজিব হবে না।(সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ৪৬০; মুল্লা আলী কারী, আল আসরার পৃ. ২৬৫)।
৩. মুমিনের ঝুটায় রোগমুক্তি
আরেকটি প্রচলিত বানোয়াট কথা হলোঃ “মুমিনের ঝুটায় রোগমুক্তি বা মুমিনের মুখের লালাতে রোগমুক্তি।” কথাটি কখনো হাদীস নয় বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কথা নয়। (সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ২৪১; মুল্লা আলী কারী, আল আসরার পৃ. ১২৯)।
মুমিনের ঝুটা খাওয়া রোগমুক্তি নয় তবে ইসলামী আদবের অংশ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) , তাঁর সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগের মুসলিমগণ একত্রে একই পাত্রে বসে খাওযা দাওয়া করেছেন এবং একই পাত্রে পানি পান করেছেন। এখনো এই অভ্যাস আরবে ও ইউরোপে প্রচলিত আছে। আমাদের দেশে ভারতীয় বর্ণপ্রথা ও অচ্ছূত প্রথার কারণে একে অপরের ঝুটা খাওয়াকে ঘৃণা করা হয়। এগুলি ইসলাম বিরোধী মানসিকতা।
৪. খাওয়ার আগে পরে লবণ খাওয়ায় রোগমুক্তি
আমাদের সমাজে প্রচলিত আরেকটি জাল হাদীস। “তুমি যখন খাদ্য গ্রহণ করবে, তখন লবণ দিয়ে শুরু করবে এবং লবণ দিয়ে শেষ করবে; কারণ লবণ ৭০ প্রকার রোগের প্রতিষেধক….।” মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই কথাটি মিথ্যা ও বানোয়াট।(হাইসামী, যাওয়াইদ মুসনাদুল হারিস ১/৫২৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৩৩; ইবনুল জাওযী, আল মাউদূ‘আত ২/১৯২)।
৫. লাল দস্তরখানের ফযীলত
আমাদের দেশের ধার্মিক মানুষদের মধ্যে প্রসিদ্ধ একটি ‘সুন্নাত’ হলো লাল দস্তারখানে খানা খাওয়া। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো লাল দস্তরখান ব্যবহার করেছেন, অথবা এইরূপ দস্তরখান ব্যবহার করতে উৎসাহ দিয়েছেন বলে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস দেখা যায় না। এ বিষয়ে অনেক বানোয়াট কথা প্রচলিত। এইরূপ একটি বানোয়াট কথা নিম্নরূপঃ “হযরত রাসূলে মকবুল (ﷺ) ….লাল দস্তরখান ব্যবহার করা হতো। …..যে ব্যক্তি লাল দস্তরখানে আহার করে তার প্রতি লোকমার প্রতিদানে একশ করে ছাওয়াব পাবে এবং বেহেস্তের ১০০টি দরজা তার জন্য নির্ধারিত হবে। সে ব্যক্তি বেহেশতের মধ্যে সব সময়ই ঈসা(আ) ও অন্য নবীদের হাজার হাজার সালাম ও আশীর্বাদ লাভ করবে….। এরপর হযরত কসম খেয়ে বর্ণনা করলেন, কসম সেই খোদার যার হাতে নিহিত রয়েছে আমার প্রাণ; যে ব্যক্তি লাল দস্তরখানে রুটি খাবে সে এক ওমরা হজ্জের সাওয়াব পাবে এবং এক হাজার ক্ষুধার্তকে পেট ভরে আহার করানোর সাওয়াব পাবে। সে ব্যক্তি এত বেশি সাওয়াব লাভ করবে যেন আমার উম্মাতের মধ্যে হাজার বন্দীকে মুক্ত করালেন…….।” এভাবে আরো অনেক আজগুবি, উদ্ভট ও বানোয়াট কাহিনী ও সাওয়াবের ফর্দ দেওয়া হয়েছে। (শায়খ মাঈন উদ্দীন চিশতী, আনিসুল আরওয়াহ পৃ. ৩০-৩১)।
এখানে উল্লেখ্য যে, দস্তরখান সম্পর্কে আরো অনেক ভুল বা ভিত্তিহীন ধারণা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দস্তরখান ব্যবহার করতেন। তবে তা ব্যবহার করার নির্দেশ বা উৎসাহ তাঁর থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয় নি। দস্তরখান ছাড়া খাদ্যগ্রহণের বিষয়ে তিনি কোনো আপত্তিও করেন নি। কিন্তু আমরা সাধারণত দস্তরখানের বিষয়ে যতটুকু গুরুত্ব প্রদান করি, কুরআন ও হাদীসে নির্দেশিত অনেক ফরয, বা নিষিদ্ধ অনেক হারামের বিষয়ে সেইরূপ গুরুত্ব প্রদান করি না। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দস্তরখান ব্যবহার করতেন বলে আমরা বুঝি যে, তিনি আমাদের মত দস্তরখানের উপর থালা, বাটি ইত্যাদি রেখে খাবার খেতেন। ধারণাটি সঠিক নয়। তাঁর সময়ে চামড়ার দস্তরখান বা ‘সুফরা’ ব্যবহার করা হতো এবং তার উপরেই সরাসরি-কোনোরূপ থালা, বাটি, গামলা ইত্যাদি ছাড়াই-খেজুর, পনির, ঘি ইত্যাদি খাদ্য রাখা হতো। দস্তরখানের উপরেই প্রয়োজনে এগুলি মিশ্রিত করা হতো এবং সেখান হতে খাদ্য গ্রহণ করা হতো।(বুখারী, আস-সহীহ ৫/২০৫৯)।