২.৭. আউলিয়া কেরাম ও বেলায়াত বিষয়ক
আল্লাহর ওলীগণের পরিচয়, কর্ম ও মর্যাদার বিষয়ে কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। এহইয়াউস সুনান ও রাহে বেলায়াত পুস্তকদ্বয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে অনেক মিথ্যা কথা মুসলিম সমাজে প্রচার করছে জালিয়াতগণ। অনেক সরলপ্রাণ নেককার বুযুর্গ এগুলি সরলপ্রাণে বিশ্বাস করেছেন। এখানে এ বিষয়ক কিছু কথা উল্লেখ করছি।
১. ওলীগণের কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা সত্য
প্রচলিত একটি গ্রন্থে লেখা হয়েছে: “আল্লাহ তাআলার বন্ধুদের শানে কোরান শরীফ ও হাদীস শরীফের কয়েকটি বাণী:………..কারামাতুন আউলিয়া হাক্কুন-আল হাদীস। অর্থ আউলিয়া এর অলৌকিক ক্ষমতা সত্য। [খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া(রাহ), রাহাতুল মুহিব্বীন, শেষ প্রচ্ছদ]। এখানে এই বাক্যটি আল হাদীস বলে বা রাসূলুল্লাহ(সা) এর বাণী বলে উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে জালিয়াতি করা হয়েছে। এখানে আমরা দুইটি বিষয় আলোচনা করবঃ (১) এই বাক্যটির উৎস ও (২) এই বাক্যটির অর্থ।
প্রথমত, বাক্যটির উৎস। “ওলীগণের কারামত সত্য”-এই বাক্যটি মুসলিম আলিমগণের বাক্য। এটি কোনো হাদীস নয়। রাসূলুল্লাহ(সা) কখনোই এই বাক্যটি বলেন নি বা তাঁর হতে কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে তা বর্ণিত হয় নি। শুধু তাই নয়, ‘কারামত’ শব্দটিই কুরআন বা হাদীসের শব্দ নয়। নবী ও ওলীগণের অলৌকিক কর্মকে কুরআন ও হাদীসে ‘আয়াত’ বা চিহ্ন বলা হয়েছে। দ্বিতীয় তৃতীয় শতাব্দী হতে মুসলিম আলিমগণের পরিভাষায় নবী রাসূলগণের আয়াতকে ‘মুজিযা’ এবং ওলীগণের আয়াতকে ‘কারামত’ বলা হয়।
দ্বিতীয় হিজরী শতক হতে মুতাযিলা ও অন্যান্য কিছু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ওলীগণের দ্বারা অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করেন। তাদের এই মতটি কুরআন সুন্নাহ বিরোধী। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস প্রমাণ করে যে, নবীগণ ছাড়া্ও আল্লাহর নেককার মানুষদেরকে আল্লাহ কখনো কখনো অলৌকিক চিহ্ন বা ‘আয়াত’ প্রদান করেন। এজন্য সুন্নাতপন্থী আলিমগণ বলেনঃ “কারামাতুল আউলিয়া হাক্ক।”
দ্বিতীয়ত, বাক্যটির অর্থঃ
এভাবে আমরা দেখেছি যে, এই বাক্যটি রাসূলুল্লাহ(সা) এর বাণী নয়; বরং আলিমগণের বক্তব্য। কাজেই বাক্যটিকে হাদীস বলে জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়া উপরের উদ্ধৃতিতে বাক্যটিকে ভুল অনুবাদ করা হয়েছে। ফলে অনুবাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জালিয়াতি ঘটেছে।
ক. কারামত বনাম অলৌকিক ক্ষমতাঃ
এই বাক্যে তিনটি শব্দ রয়েছেঃ কারামত, আউলিয়া, হক্ক। উপরের উদ্ধৃতিতে প্রথম শব্দ কারামতের অনুবাদ করা হয়েছে অলৌকিক ক্ষমতা। এই অনুবাদটি শুধু ভুলই নয়, বরং ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কারামত অর্থ অলৌকিক আয়াত বা চিহ্ন, অলৌকিক ক্ষমতা নয়। মহিমাময় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক।
কারামত শব্দটির মূল অর্থ সম্মাননা। ইসলামী পরিভাষায় কারামত অর্থ ‘নবী-রাসূলগণ ব্যতীত অন্যান্য নেককার মানুষের দ্বারা সংঘটিত অলৌকিক কর্ম।’ অলৌকিক চিহ্নকে অলৌকিক ক্ষমতা মনে করা শিরকের অন্যতম কারণ। খৃস্টানগণ দাবি করেন, ‘মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা ঈশ্বর ছাড়া আর কারো নেই। যীশু মৃতকে জীবিত করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, যীশু ঈশ্বর বা তাঁর মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল।’
কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে, কোনো অলৌকিক কর্ম বা চিহ্ন কোনো নবী-রাসূল বা কউ নিজের ইচ্ছায় ঘটাতে বা দেখাতে পারেন না; শুধুমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটতে পারে। কোনো ওলী বা নেককার ব্যক্তি কর্তৃক অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, এই কর্মটি সম্পাদন করা ঐ ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা তার নিজের ক্ষমতা। এর অর্থ হলো একটি বিশেষ ঘটনায় আল্লাহ তাকে সম্মান করে একটি অলৌকিক চিহ্ন তাকে প্রদান করেছেন। অন্য কোনো সময়ে তা নাও দিতে পারেন।
একটিমাত্র উদাহরণ উল্লেখ করছি। নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, ২৩ হিজরীর প্রথম দিকে এক শুক্রবারে উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) মসজিদে নববীতে খুতবা প্রদান কালে উচ্চস্বরে বলে উঠেনঃ “হে সারিয়া, পাহাড়ে যাও।” সে সময়ে একজন মুসলিম সেনাপতি সারিয়া ইবনু যুরাইম পারস্যের এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার উপক্রম করছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি উমারের এই বাক্যটি শুনতে পান এবং পাহাড়ের আশ্রয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন। (তাবারী, তারীখ ২/৫৫৩-৫৫৪; ইবনু হাজার, আল ইসাবা ৩/৫-৬; আল মাকাদিস, পৃ. ৪৬৮)।
এই ঘটনায় আমরা উমার(রা) এর একটি বিশেষ কারামত দেখতে পাই। তিনি হাজার মাইল দূরের যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা অবলোকন করেছেন, মুখে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে নির্দেশনা সারিয়া শুনতে পেয়েছেন।
এই কারামতের অর্থ হলো, মহান আল্লাহ তাঁর এই মহান ওলীকে এই দিনের এই মুহুর্তে এই বিশেষ ‘সম্মাননা’ প্রদান করেন, তিনি দূরের দৃশ্যটি হৃদয়ে অনুভব করেন, নির্দেশনা দেন এবং তাঁর নির্দেশনা আল্লাহ সারিয়ার নিকট পৌছে দেন। এর অর্থ এই নয় যে, উমার (রা) এর হাজার মাইল দূরের সবকিছু অবলোকন করার ক্ষমতা ছিল, অথবা তিনি ইচ্ছা করলেই এভাবে দূরের কিছু দেখতে পেতেন বা নিজের কথা দূরে প্রেরণ করতে পারতেন।
এই বছরেরই শেষে ২৩ হিজরীর জিলহজ্জ মাসের ২৭ তারিখে ফজরের সালাত আদায়ের জন্য যখন উমার(রা) তাকবীরে তাহরীমা বলেন, তখন তাঁরই পিছনে চাদর গাঁয়ে মুসল্লীরূপে দাঁড়ানো আল্লাহর শত্রু আবু লু’লু লুকানো ছুরি দিয়ে তাঁকে বারংবার আঘাত করে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। চেতনা ফিরে পেলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কে আঘাত করল? তাঁকে বলা হয়, আবূ লু’লু। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, আমাকে কোনো মুসলিমের রহাতে শহীদ হতে হলো না। এর কয়েকদিন পর তিনি ইন্তিকাল করেন। (ইবনু কাসীর, আল বিদায়া ৭/১৩০-১৩৮)।
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মহান আল্লাহ প্রথম ঘটনায় হাজার মাইল দূরের অবস্থা উমারকে(রা) দেখিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় পাশে দাঁড়ানো শত্রুর বিষয়ে তাঁকে জানতে দেন নি। কারণ ‘কারামত’ কখনোই ক্ষমতা নয়, কারামত আল্লাহর পক্ষ হতে দেওয়া সম্মাননা মাত্র।
খ. ওলী ও আউলিয়াঃ
‘বেলায়াত’ শব্দের অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। “বেলায়াত” অর্জনকারীকে ওলী অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ওলীদের পরিচয় প্রদান করে কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছেঃ “জেনে রাখ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা চিন্তাগ্রস্তও হবেন না- যারা ঈমান এনেছেন এবং যারা আল্লাহর অসন্তুষ্টি হতে আত্মরক্ষা করে চলেন বা তাকওয়ার পথ অনুসরণ করেন।”(সূরা ইউনূসঃ ৬২-৬৩)।
ঈমান অর্থ তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি বিশুদ্ধ, শিরক ও কুফর মুক্ত বিশ্বাস। ‘তাকওয়া’ শব্দের অর্থ আত্মরক্ষা করা। যে কর্ম বা চিন্তা করলে মহিমাময় আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন সেই কর্ম বা চিন্তা বর্জনের নাম তাকওয়া। মূলত সকল হারাম, নিষিদ্ধ ও পাপ বর্জনকে তাকওয়া বলা হয়।
এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানছি যে, দুটি গুণের মধ্যে ওলীর পরিচয় সীমাবদ্ধ। ঈমান ও তাকওয়া। এই দুটি গুণ যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি বেলায়াতের পথে তত বেশি অগ্রসর ও আল্লাহর তত বেশি প্রিয় বা ওলী বলে বিবেচিত হবেন। রাসূলুল্লাহ(সা) ওলী বা বেলায়াতের পথের কর্মকে দুইভাগে ভাগ করেছেনঃ ফরয ও নফল। সকল ফরয পালনের পরে অনবরত বেশি বেশি নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্যের পথে বেশি বেশি অগ্রসর হতে থাকে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়ার গুণ যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বেশি ওলী। হানাফী মাযহাবের অন্যতম ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী(৩২১ হি) ইমাম আবু হানীফা, মুহাম্মাদ, আবু ইউসূফ রাহিমাহুমুল্লাহ ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা বা বিশ্বাস বর্ণনা করে বলেনঃ “সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর নিকট সম্মানিত(তত বেশি ওলী)।(ইমাম তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ৩৫৭-৩৬২)।
তাহলে ওলী ও বেলায়াতের মানদন্ড হচ্ছেঃ ঈমান ও তাকওয়া-সকল ফরয কাজ আদায় করা এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করা। যদি কোনো মুসলিম পরিপূর্ণ সুন্নাহ অনুসারে সঠিক ঈমান সংরক্ষণ করেন, সকল প্রকারের হারাম ও নিষেধ বর্জনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করেন, তাঁর উপর ফরয যাবতীয় দায়িত্ব তিনিই পালন করেন এবং সর্বশেষ যথাসম্ভব নফল ইবাদত আদায় করেন তিনিই আল্লাহর ওলী বা প্রিয় মানুষ। এ সকল বিষয়ে যিনি যতটুকু অগ্রসর হবেন তিনি ততটুকু আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াত অর্জন করবেন।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ‘বেলায়াত’ কোনো পদ-পদবী নয় এবং ইসলামের ‘ওলী’ বলে কোনো বিশেষ পদ বা পর্যায় নেই। প্রত্যেক মুমিনই ওলী। যে যত বেশি ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করবেন তিনি তত বেশি ওলী।
গ. হক্কঃ
‘কারামাতুল আউলিয়া হক্ক’ বা ‘ওলীগণের অলৌকিক কর্ম সত্য’ অর্থ ‘ওলীগণ হতে অলৌকিক কর্ম প্রকাশ পাওয়া সম্ভব’। যদি কোনো বাহ্যত নেককার মুমিন মুত্তাকী মানুষ থেকে কোনো অলৌকিক কার্য্য প্রকাশ পায় তাহলে তাকে আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত সম্মাননা বলে বুঝতে হবে। অনুরূপভাবে যদি কোনো নেককার বুযুর্গ মানুষ থেকে কোনো অলৌকিক কার্য্য প্রকাশিত হয়েছে বলে বিশুদ্ধ সূত্রে জানা যায় তবে তা সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। তা অস্বীকার করা বা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়া মু‘তাযিলীদের আকীদা।
‘ওলীদের কারামত সত্য’ বলে দুই প্রকারে ভুল অর্থ করা হয়।
প্রথমত, কেউ মনে করেন-ওলীদের নামে যা কিছু কারামত বা অলৌকিক কথা বলা হবে সবই সত্য মনে করতে হবে। কথাটি জঘন্য ভুল। বিশুদ্ধ সনদ ছাড়া কোনো বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। জাল হাদীসের মত অগণিত জাল কারামতির ঘটনা ওলীদের নামে সমাজে ছড়ানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, কেউ মনে করেন যে, ‘ওলীগণের কারামত সত্য’ অর্থ ‘ওলীগণের কারামত থাকতেই হবে বা কারামতই ওলীগণের আলামত বা চিহ্ন। এই ধারণাটি কঠিন ভুল। বাহ্যিক আমল ছাড়া ওলীর পরিচয়ের জন্য কোনো চিহ্ন, মার্কা বা সার্টিফিকেট নেই। কোনো ‘কারামত’ বা অলৌকিকত্ব কখনোই বেলায়াতের মাপকাঠি নয়। আল্লাহর প্রিয়তম ওলীর কোনোপ্রকার কারামত নাও থাকতে পারে। আমরা জানি আল্লাহর প্রিয়তম ওলী সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশেরই কোনো কারামত বর্ণিত হয় নি। আবার পাপী বা কাফির মুশরিকের নিকট হতেও অলৌকিক কার্য্য প্রকাশিত হতে পারে। সর্বোপরি কারামতের অধিকারী ব্যক্তিও কোনো বিশেষ পদমর্যাদার ব্যক্তি নন বা পদস্খলন থেকে সংরক্ষিত নন। কর্মে ত্রুটি হলে তিনি শাস্তিভোগ করবেন। কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি যে, অনেক সময় কারামতের অধিকারী ওলীও গোমরাহ ও বিভ্রান্ত হয়েছেন। (সূরা আরাফঃ আয়াত ১৭৫-১৭৭; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/২৬৫-২৬৮)।
২. ওলীগণ মরেন নাঃ
প্রচলিত একটি পুস্তকে লেখা হয়েছেঃ “নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোনো মৃত্যু নেই বরং তাঁরা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহজগত হতে স্থায়ী পরজগতে।”-আল হাদীস।(খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া, রাহাতুল মুহিব্বীন, শেষ প্রচ্ছদ)।
এখানে উল্লেখ্য যে, আব্দুল কাদির জিলানীর(রাহ) নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ পুস্তকে এই হাদীসটি অন্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছেঃ “মুমিনগণের কোনো মৃত্যু নেই বরং তাঁরা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহজগত হতে স্থায়ী পরজগতে।”
দুটি কথাই রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে মিথ্যা, জঘন্য ও বানোয়াট কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট সনদেও তা বর্ণিত হয় নি।
আমরা জানি যে, প্রতিটি মানুষই মৃত্যুর মাধ্যমে “ধ্বংসশীল ইহজগত হতে স্থায়ী পরজগতে স্থানান্তরিত হয়।” এখানে কারো কোনো বিশেষত্ব নেই। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বারা শহীদগণের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত। সহীহ হাদীসের আলোকে নবীগণের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত। এছাড়া অন্য কোনো নেককার মানুষের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত নয়। আলিমগণ, ওলীগণ, মুআযযিনগণ……..ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার নেককার মানুষের মৃত্যু পরবর্তী হায়াত বা জীবন সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই সনদবিহীন, ভিত্তিহীন বাতুল কথা।(দরবেশ হুত, আসানুল মাতালিব, পৃ. ২৯৫-২৯৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৩৫)।
৩. ওলীগণ কবরে সালাত আদায়ে রত
ওলীগণের পারলৌকিক জীবন বিষয়ক আরেকটি জাল কথা, “নবীগণ ও ওলীগণ তাঁদের কবরের মধ্যে সালাত আদায় করেন, যেমন তাঁরা তাঁদের বাড়িতে সালাত আদায় করেন।”(সিররুল আসরার, পৃ. ৫৫)।
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, নবীগণের ক্ষেত্রে হাদীসটি সহীহ। তবে এখানে ‘ওলীগণ’ শব্দটির সংযোগ বানোয়াট।
৪. ওলীগণ আল্লাহর সুবাস
প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছেঃ “আল আউলিয়াও রায়হানুল্লাহ-আল হাদীস। অর্থ আউলিয়া আল্লাহর সুবাস।” [খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া(রাহ), রাহাতুল মুহিব্বীন, শেষ প্রচ্ছদ]।
এই কথাটিও আল্লাহর রাসুল(সা) এর নামে বানোয়াট কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদেও এই বাক্যটি রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় নি। ওলীগণকে আল্লাহর সুবাস বলায় কোনো অসুবিধা নেই। আল্লাহর রিযককে আল্লাহর সুবাস বলা হয়েছে, সন্তানকেও আল্লাহর সুবাস বলা হয়েছে।(তাবারী, তাফসীর ২৭/১২৩, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/৬২১)। কিন্তু এই কথাটিকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলতে হলে সহীহ সনদে তা বর্ণিত হতে হবে।
৫. ওলীগণ আল্লাহর জুব্বার অন্তরালে
প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছেঃ “ইন্না আউলিয়াই তাহতা কাবাই লা ইয়ারিফুহুম গাইরী ইল্লা আউলিয়াই।–হাদীসে কুদসী। অর্থঃ নিশ্চয়ই আমার বন্ধুগণ আমার জুব্বার অন্তরালে অবস্থান করেন, আমি ভিন্ন তাঁদের পরিচিতি সম্বন্ধে কেহই অবগত নহে, আমার আউলিয়াগণ ব্যতীত।”[খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া(রাহ), রাহাতুল মুহিব্বীন, শেষ প্রচ্ছদ]।
এই কথাটিও একটি ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও জাল কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদে ও এই কথাটি বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না। বিভিন্ন সনদবিহীন ভিত্তিহীন কথার মত এই কথাটিও পরবর্তী যুগে সমাজের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। আর নবম দশম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম ভিত্তিহীন জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে সনদবিহীনভাবে এই কথাটি তাদের পুস্তকে উল্লেখ করেছেন। (জুরজানী, আলী ইবনু মুহাম্মাদ (৮১৬ হি), তা’রীফাত, পৃ. ২৯৫)।
৬. ওলীদের খাস জান্নাতঃ শুধুই দীদার
আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যে, আল্লাহর খাস ওলীগণ জান্নাতের নেয়ামতের জন্য ইবাদত করেন না, বরং শুধুই ‘মহব্বত’ বা ‘দীদারের’ জন্য। এই অবস্থাকে সর্বোচ্চ অবস্থা বলে মনে করা হয়। এই মর্মে একটি জাল হাদীসঃ “আল্লাহর এমন একটি জান্নাত আছে যেখানে হুর, অট্টালিকা, মধু এবং দুগ্ধ নেই।(বরং দীদারে ইলাহী মাওলার দর্শন)।” কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সনদবিহীন একটি জাল কথা।(সিররুল আসরার, পৃ. ১৯-২০)।
৭. ওলী আল্লাহদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারাম
উপরের অর্থেই আরেকটি বানোয়াট কথাঃ “আখিরাত ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া হারাম আর দুনিয়া-ওয়ালাদের জন্য আখিরাত হারাম। আর আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই হারাম।”(অর্থাৎ যে পর্যন্ত কেউ ইহকাল ও পরকালের সুখ শান্তি এবং আশা-আকাঙ্খা বিসর্জন দিতে না পারবে, সে পর্যন্ত সে আল্লাহর নৈকট্য পাবে না)।
৬ষ্ঠ শতকের আলিম শীরাওয়াইহি ইবনু শাহরদার দাইলামী(৫০৯ হি) তার ‘আল ফিরদাউস’ এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তাঁর পুত্র শাহরদার ইবনু শীরওয়াহী আবূ মানসূর দাইলামী তার ‘মুসনাদুল ফিরদাউস’ গ্রন্থে হাদীসের একটি সনদ উল্লেখ করেছেন। সনদের অধিকাংশ রাবীই একেবারে অজ্ঞাত পরিচয়। অন্যরা দুর্বল। এজন্য হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করা হয়েছে।(দাইলামী, আল ফিরদাউস ২/২৩০; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১০৫-১০৬)।
এই হাদীসে বলা হয়েছে যে, (১) আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া হারাম এবং (২) আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া,আখিরাত-উভয়ই হারাম। এই কথা দুটি কুরআন কারীম ও অগণিত সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহ ঠিক এর বিপরীত কথা বলেছেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম রাসূল(সা) ও শ্রেষ্ঠতম আল্লাহ-ওয়ালা সাহাবীগণসহ সকল আল্লাহওয়ালা ও আখিরাতওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌন্দর্য ও আনন্দ হারাম করেন নি বলে ঘোষণা করেছেনঃ “আপনি বলুন: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সৌন্দর্য ও পবিত্র আনন্দ ও মজার বস্তুগুলি বের(উদ্ভাবন) করেছেন তা হারাম বা নিষিদ্ধ করলো কে? আপনি বলুন: সেগুলি মুমিনদের জন্য পার্থিব জীবনে এবং কিয়ামতে শুধুমাত্র তাদের জন্যই।”(সূরা আরাফঃ আয়াত ৩১-৩২)।
কুরআন কারীমে আল্লাহওয়ালা ও আখিরাতওয়ালাদিগকে দুনিয়া ও আখিরাতের নেয়ামত প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(সা) সর্বদা এভাবে দোয়া করতেন। আর আখেরাতের নেয়ামত তো আল্লাহওয়ালা ও আখেরাতওয়ালাদের মূল কাম্য।
মূল কথা হলো, আল্লাহওয়ালা হতে হলে, জান্নাতের নিয়ামতের আশা আকাঙ্খা বর্জন করতে হবে, এই ধারণাটিই কুরআন হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধী। কোনো কোনো নেককার মানুষের মনে এই ধারণা আসতে পারে। তবে রাসূলুল্লাহ(সা) ও সাহাবীগণ সর্বদা জান্নাতের নিয়ামত চেয়েছেন, সাহাবীগণকে বিভিন্ন নিয়ামতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে সর্বোচ্চ মর্যাদার নবী-ওলীগণ এবং সাধারণ ওলীগণ সকলের জন্য জান্নাতের নিয়ামতের বর্ননা দিয়েছেন।
৮. শরীয়ত, তরীকত, মারেফত ও হাকীকত
এগুলি আমাদের মধ্যে অতি পরিচিত চারটি পরিভাষা। কুরআন-হাদীসে শরীয়ত শব্দটিই মূলত ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামের চারিটি পর্যায়, স্তর বা বিভাজন অর্থে তরীকত, মারিফাত ও হাকীকত পরিভাষাগুলি কুরআন হাদীসে কোথাও ব্যবহৃত হয় নি। কুরআন ও হাদীসের আলোকে পরবর্তী যুগের আলিমগণ এ সকল পরিভাষা বিভাজন করেছেন। জালিয়াতগণ এ বিষয়ে হাদীসও বানিয়েছে। মিথ্যাবাদীরা বলেছে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “শরীয়ত একটি বৃক্ষ, তরীকত তার শাখা-প্রশাখা, মারিফাত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল।”(সিররুল আসরার, পৃ. ৩৩)।
মিথ্যাবাদীদের আল্লাহ লাঞ্চিত করুন। তাদের বানানো আরেকটি কথা। “শরীয়ত আমার কথাবার্তা, তরীকত আমার কাজকর্মে, হাকীকত আমার অবস্থা এবং মারিফাত আমার মূলধন।”(আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৬)।
৯. ছোট জিহাদ এবং বড় জিহাদ
কথিত আছে, রাসূলুল্লাহ(সা) এক যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন করে বললেনঃ “আমরা ছোট জিহাদ হতে বড় জিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম।………বড় জিহাদ হলো মনের সাথে জিহাদ বা নিজের প্রবৃত্তির সাথে সংগ্রাম।” ইবনু তাইমিয়া হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বাতিল বলে গণ্য করেছেন। ইরাকী, সুয়ূতী প্রমূখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি দুর্বল সনদে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণিতে হয়েছে। পক্ষান্তরে সহীহ সনদে কথাটি ইবরাহীম ইবনু আবী আবলা(১৫২ হি) নামক প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হতে নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এজন্য ইবনু হাজার আসকালানী বলেছেন যে, হাদীসটি মূলত এই তাবেয়ীর বক্তব্য। অনেক সময় দুর্বল রাবীগণ সাহাবী বা তাবিয়ীর কথাকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। (মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, পৃ. ১২৭; দরবেশ হুত, আসানিল মাতালিব, পৃ. ১৫৩; আলবানী, যায়ীফাহ ৫/৪৭৮-৪৮১)।
১০. প্রবৃত্তির জিহাদিই কঠিনতম জিহাদ
আমাদের সমাজে এই অর্থে আরেকটি হাদীস প্রচলিত। “সবচেয়ে কঠিন জিহাদ প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ।” কথাটি রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা নয়। তাঁর কথা হিসেবে কোনো সনদেই তা বর্ণিত হয় নি। প্রসিদ্ধ তাবে তাবেয়ী ইবরাহীম ইবনু আদহাম(১৬১ হি) থেকে তাঁর নিজ বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত। (বাইহাকী, কিতাবুয যুহদ ২/১৫২)।
উল্লেখ্য যে, এই অর্থের কাছাকাছি সহীহ হাদীস রয়েছে। ফুদালাহ ইবনু উবাইদ(রা) বলেন, বিদায় হজ্জের ওয়াযের মধ্যে রাসূলুল্লাহ(সা) বলেনঃ “আর মুজাহিদতো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ করে।”(তিরমিযী, আস-সুনান ৪/১৬৫; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১১/২০৪)।
দুঃখজনক হলো, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থে সংকলিত সহীহ বাদ দিয়ে ভিত্তিহীন বানোয়াট কথাগুলি আমরা রাসূলুল্লাহ(সা)এর নামে বলি।
১১. আলিম বনাম আরিফ
কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় ইসলামী ইলমের অধিকারীকে ‘আলিম’ বলা হয়। ‘মারিফাত’ অর্থে তত্ত্বজ্ঞান, গুপ্তজ্ঞান বা বিশেষ জ্ঞান বুঝানো. ‘আরিফ’ বলতে তত্ত্বজ্ঞান বুঝানো এবং আলিম ও আরিফ এর মাঝে পার্থক্য বুঝানোর বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে কিছু বলা হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় তা সবই বানোয়াট কথা। এইরূপ একটি জাল হাদীসঃ “আলিম নকশা অঙ্কিত করে এবং আরিফ(খোদাতত্ত্ব জ্ঞানে জ্ঞানী) তা পরিষ্কার করে।”(সিররুল আসরার, পৃ. ৪৯)।
১২. আল্লাহর স্বভাব গ্রহণ কর
সূফীগণের মধ্যে প্রচলিত একটি ভিত্তিহীন সনদবিহীন জাল হাদীস। “তোমরা আল্লাহর স্বভাব গ্রহণ কর বা আল্লাহর গুণাবলিতে গুণান্বিত হও।”(সিররুল আসরার, পৃ. ৫০)।
১৩. একা হও আমার নিকটে পৌছ
“একা হও আমার নিকটে পৌছাবে।”(সিররুল আসরার, পৃ. ৭৮)। উপরের কথাগুলি সবই সনদহীন, ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ সনদেও এই কথাগুলি বর্ণিত হয় নি।
১৪. সামা বা প্রেম-সঙ্গীত শ্রবণ করা কারো জন্য জায়েয….
‘সামা’ (সেমা) অর্থ ‘শ্রবণ’। সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগে সামা বলতে কুরআন শ্রবণ ও রাসূলে আকরামের জীবনী, কর্ম ও বাণী শ্রবণকেই বোঝান হতো। এগুলিই তাঁদের মনে আল্লাহ-প্রেমের ও নবী-প্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করত। কোনো মুসলিম কখনোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য বা হৃদয়ে আল্লাহর প্রেম সৃষ্টি করার জন্য গান শুনতেন না। সমাজের বিলাসী ও অধার্মিক মানুষের মাঝে বিনোদন হিসেবে গান বাজনার সীমিত প্রচলন ছিল, কিন্তু আলেমগণ তা হারাম জানতেন। ২/১ জন বিনোদন হিসেবে একে জায়েয বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কখনোই এসকল কর্ম আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বলে গণ্য হয় নি।
ক্রমান্বয়ে সামা বলতে গান-বাজনা বুঝানো হতে থাকে। আর গানের আবেশে উদ্বেলিত হওয়া ও নাচানাচি করাকে ‘ওয়াজদ’ অর্থাৎ আবেগ, উত্তেজনা, উন্মত্ততা বলা হতো। এই সামা বা সঙ্গীত ও ওয়াজদ অর্থাৎ গানের আবেশে তন্ময় হয়ে নাচানাচি বা উন্মত্ততা ৫ম হিজরী শতাব্দী থেকে সূফী সাধকদের কর্মকান্ডের অন্যতম অংশ হয়ে যায়। সামা ব্যতিরেকে কোনো সূফী খানকা বা সূফী দরবার কল্পনা করা যেত না। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী(৫০৫ হি)ও অন্য কোনো আলিম সূফীগণের প্রতি ভক্তির কারণে এইরূপ গান বাজনা ও নর্তন কুর্দনকে জায়েয বা শরীয়ত সঙ্গত ও বিদআতে হাসানা বলে দাবি করেছেন।(আবু হামিদ আল গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/২৯২-৩৩২)।
এদিকে যখন সামা সঙ্গীতের ব্যাপক প্রচলন হয়ে গেল নেককার মানুষদের মাঝে তখন জালিয়াতগণ তাদের মেধা খরচের একটি বড় ক্ষেত্র পেয়ে গেল। তারা সামা, ওয়াজদ প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হাদীস বানিয়ে প্রচার করে।
‘সিররুল আসরার’ পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে, হুযুর (সা) এরশাদ করেছেনঃ “সামা হলো কারো জন্য ফরয, কারো জন্য সুন্নাত এবং কারো জন্য বিদআত। ফরয হলো খাস লোকদের জন্য, সুন্নাত হলো প্রেমিকদের এবং বিদআত হলো গাফিল বা অমনোযোগীদের জন্য।”(সিররুল আসরার, পৃ. ৮৮-৮৯)।
এটি রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বানানো একটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা, যা কোনো যয়ীফ বা মাউযূ সনদেও কোথাও বর্ণিত হয় নি।
১৫. যার ওয়াজদ বা উন্মত্ততা নেই তার ধর্মও নেই, জীবনও নেই
গানের মজলিসে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে অচেতন হওয়া বা নাচানাচি করাকে ইশকের বড় নিদর্শন বলে গণ্য করা হতো। জালিয়াতরা এ বিষয়ে কিছু হাদীস বানিয়েছে। সিররুল আসরার পুস্তকে এইরূপ একটি ‘হাদীস’ উল্লেখ করা হয়েছেঃ “যার ওয়াজদ বা উত্তেজনা-উন্মত্ততা নেই তার জীবন নেই/ধর্ম নেই।”(সিররুল আসরার, পৃ. ৮৬, ৮৯)।
এ কথাটিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন সনদহীন বানোয়াট কথা।
১৬. যে গান শুনে আন্দোলিত না হয় সে মর্যাদাশীল নয়
এ বিষয়ে অন্য একটি জাল হাদীস প্রসিদ্ধ। এই হাদীসটির একটি সনদও আছে। সনেদের মূল রাবী মিথ্যাবাদী জালিয়াত। এই হাদীসে বলা হয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট একটি প্রেমের কবিতা পাঠ করা হয়। গানে বলা হয়ঃ ‘প্রেমের সর্প আমার কলিজায় দংশন করেছে। এর কোনো চিকিৎসক নেই, ঔষধও নেই। শুধু আমার প্রিয়তম ছাড়া। সেই আমার অসুস্থতা এবং সেই আমার ঔষধ।’ এই কবিতা শুনে তিনি উত্তেজিত উদ্বেলিত হয়ে নাচতে বা দুলতে থাকেন। এমনকি তাঁর চাদরটি গা থেকে পড়ে যায়। তাঁর সাথে সাহাবীগণও এভাবে নাচতে বা দুলতে থাকেন……। এরপর রাসূলুল্লাহ(সা) বলেনঃ “শ্রবণের সময় যে আন্দোলিত হয় না সে মর্যাদাশীল নয়।” মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই হাদীসটি জঘন্য মিথ্যা ও জাল কথা।(ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুসসাস, পৃ. ৬০-৬১; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৫/১৯৮)।
১৭. গওস, কুতুব, আওতাদ, আকতাব, আবদাল, নুজাবা
আমাদের সমাজে ধার্মিক মানুষের মাঝে বহুল প্রচলিত পরিভাষা রয়েছে গওস, কুতুব, আওতাদ, আকতাব ইত্যাদি শব্দ। আমরা সাধারণভাবে আওলিয়া কেরামকে বুঝতে এ সকল শব্দ ব্যবহার করে থাকি। এছাড়া এসকল পরিভাষার বিশেষ অর্থ ও বিশেষ বিশেষ পদবীর কথাও প্রচলিত। আরো প্রচলিত আছে যে, দুনিয়াতে এতজন আওতাদ, এতজন আবদাল, এতজন গাওস, এতজন কুতুব ইত্যাদি সর্বদা বিরাজমান……….। এগুলি সবই ভিত্তিহীন কথা এবং আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূলের(সা) নামে বানোয়াট কথা। একমাত্র আবদাল ছাড়া অন্য কোনো কথা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
গাওস, কুতুব, আওতাদ….ইত্যাদি সকল পরিভাষা, পদ-পদবী ও সংখ্যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে কোনো কিছুই সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। শুধুমাত্র ‘আবদাল’ শব্দটি একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
আবদাল শব্দটি বদল শব্দের বহুবচন। আবদাল অর্থ বদলগণ। একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক নেককার মানুষ আছেন যাদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর বদলে অন্য কাউকে আল্লাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এজন্য তাঁদেরকে আবদাল বা বদলগণ বলা হয়।
এ বিষয়ে বর্ণিত প্রতিটি হাদীসেরই সনদ দুর্বল। কোনো সনদে মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো সনদ বিচ্ছিন্ন। কোনো সনদে দুর্বল রাবী রয়েছেন। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস আবদাল বিষয়ক সকল হাদীসকে এক কথায় ও ঢালাওভাবে মুনকার, বাতিল বা মাঊযূ বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্য অনেক মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে এগুলিকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন মুহাদ্দিসের বিস্তারিত আলোচনা ও বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদীসগুলি পর্যালোচনা করে আমার কাছে দ্বিতীয় মতটিই সঠিক বলে প্রতয়িমান হয়েছে। দুইটি বিষয় ‘আবদাল’ শব্দটির ভিত্তি প্রমাণ করে। প্রথমত, এ বিষয়ক বিভিন্ন হাদীস। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের অনেক তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী, মুহাদ্দিস, ইমাম ও ফকীহ এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, এই শব্দটির ভিত্তি ও উৎস রয়েছে।
অন্যান্য সকল বিষয়ের মত ‘আবদাল’ বিষয়েও অনেক মিথ্যা কথা হাদীস বলে প্রচারিত হয়েছে। এগুলির পাশাপাশি এ বিষয়ক নিম্নের তিনটি হাদীসকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।
প্রথম হাদীসঃ শুরাইহ ইবনু উবাইদ(১০১ হি)নামক একজন তাবেয়ী বলেন, আলী(রা) এর সাথে যখন মুআবিয়া(রা) এর যুদ্ধ চলছিল, তখন আলী(রা) এর অনুসারী ইরাকবাসীগণ বলেন, হে আমিরুল মোমেনীন, আপনি মুয়াবিয়ার অনুসারী সিরিয়াবাসীগণের জন্য লানত বা অভিশাপ করুন। তখন তিনি বলেন, না। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ(সা) কে বলতে শুনেছি-“আবদাল(বদলগণ) সিরিয়ায় থাকবেন। তাঁরা ৪০ ব্যক্তি। যখনই তাঁদের কউ মৃত্যুবরণ করবেন তখনই আল্লাহ তাঁর বদলে অন্য ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করেন। তাঁদের কারণে আল্লাহ বৃষ্টি প্রদান করেন। তাঁদের কারণে শত্রুর উপরে বিজয় দান করেন। তাদের কারণে সিরিয়বাসীদের নিকট হতে আযাব দূরীভূত করবেন।”
এই হাদীসের সনদের সকল রাবীই নির্ভরযোগ্য এবং বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক গৃহীত। শুধুমাত্র শুরাইহ ইবনু উবাইদ ব্যতিক্রম। তাঁর হাদীস বুখারী ও মুসলিমে নেই। তবে তিনিও বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী হিসেবে স্বীকৃত। কাজেই হাদীসটির সনদ সহীহ। কোনো কোনো মুহাদ্দিস সনদটি বিচ্ছিন্ন বলে মনে করছেন। তাঁরা বলেন, শুরাইহ বলেন নি যে, আলীর মুখ হতে তিনি কথাটি শুনেছেন। বরং তিনি শুধু ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। এতে মনে হয়, শুরাইহ সম্ভবত অন্য কারো মাধ্যমে ঘটনাটি শুনেছেন, যার নাম তিনি উল্লেখ করেন নি। তবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। সিফফীনের যুদ্ধের সময় শুরাইহ কমবেশি ৩০ বৎসর বয়সী ছিলেন। কাজেই তাঁর পক্ষে আলী(রা) থেকে হাদীস শ্রবণ করা বা এই ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা অসম্ভব ছিল না। এজন্য বাহ্যত হাদীসটির সনদ অবিচ্ছিন্ন বলেই মনে হয়।
যিয়া মাকদিসী উল্লেখ করেছেন যে, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সনদে এই হাদীসটি আলীর(রা) নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কাজেই এই হাদীসটি আলীর(রা) বক্তব্য বা মাউকূফ হাদীস হিসেবে সহীহ।(আহমাদ, আল মুসনাদ ১/১১২; সাখাবী, আল-মাকাদিস, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৩৩০-৩৩২; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/৩০৬-৩০৭)।
দ্বিতীয় হাদীসঃ তাবেয়ী আব্দুল ওয়াহিদ ইবনু কাইস বলেন, উবাদা ইবনুস সামিত(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “এই উম্মাতের মধ্যে আবদাল(বদলগণ) ত্রিশ ব্যক্তি। এরা মহিমাময় দয়াময় আল্লাহর খলীল ইবরাহীম(আ) এর মত। যখন এদের কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তখন মহিমাময় বরকতময় আল্লাহ তার বদলে অন্য ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করেন।”
এই হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুল ওয়াহিদ ইবনু কাইস এর বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের মতভেদ রয়েছে। ইজলী ও আবূ যূর’আ তাকে গ্রহণযোগ্য বলে মত দিয়েছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। ইমাম আহমাদ হাদীসটিকে মুনকার, অর্থাৎ আপত্তিকর বা দুর্বল বলেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান পর্যায়ের বলে গণ্য করেছেন।
তৃতীয় হাদীসঃ আনাস(রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “যমীন কখনো ৪০ ব্যক্তি হতে শুণ্য হবে না, যারা দয়াময় আল্লাহর খলীল ইবরাহীমের মত হবেন। তাঁদের কারণেই তোমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হও, এবং তাঁদের কারণেই তোমরা বিজয়লাভ করো। তাঁদের মধ্য হতে কেউ মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাঁর বদলে অন্য ব্যক্তিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন।”
হাদীসটি তাবারানী সংকলন করেছেন। সনদের একাধিক বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। তবে আল্লামা হাইসালামী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলে গণ্য করেছেন।(তাবারানী, আল মু’জামুল আউসাত ৪/২৪৭; আলবানী, যায়ীফাহ ৯/৩২৫-৩২৭; যায়ীফুল জামি, পৃ. ৬৮৯)।
উপরের তিনটি হাদীস ছাড়াও আবদাল বিষয়ে আরো কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রতিটি হাদীস পৃথকভাবে যয়ীফ বা অত্যন্ত যয়ীফ হলেও সামগ্রিকভাবে আবদালের অস্তিত্ব প্রমাণিত। স্বভাবতই এই প্রমাণিত বিষয়কে কেন্দ্র করে অনেক জাল ও বানোয়াট কথা বর্ণিত হয়েছে। আবদাল বা বদলগণের দায়িত্ব, পদমর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক জাল ও বানোয়াট কথা বর্ণিত হয়েছে।
আবদাল বা বদলগণের নিচের পদে ও উপরে অনেক বানোয়াট পদ-পদবীর নাম বলা হয়েছে। যেমন ৩০০ জন নকীব/নুকাবা, ৭০ জন নাজীব/নুজাবা, ৪০ জন বদল/আবদাল, ৪ জন আমীদ/উমুদ, ১ জন কুতুব বা গাউস…….ইত্যাদি। ‘আবদাল’ ছাড়া বাকি সকল পদ-পদবী ও সংখ্যা সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণিত কোনো একটি সহীহ বা যয়ীফ সনদেও কুতুব, গাউস, নজীব, নকীব ইত্যাদির কথা কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। এছাড়া এদের দেশ, পদমর্যাদা, দায়িত্ব, কর্ম ইত্যাদি যা কিছু বলা হয়েছে সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে সহীহ বা যয়ীফ সনদে কিছু্ই বর্ণিত হয় নি, যদিও গত কয়েক শতাব্দীতে কোনো কোনো আলিম এ সকল বিষয়ে অনেক কিছুই লিখেছেন।(হাকিম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ১/২৬১-২৬৩; সাখাবী, আল মাকাদিস, পৃ. ৩২-৩৪; দরবেশ হুত, আসানুল মাতালিব, পৃ. ৬৩; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ২০৩, ৩৩৪,৩৬৭)।
এখানে এ সম্পর্কিত দুটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ আবদালের পরিচয় ও আবদালের দায়িত্ব।
ক. আবদালের পরিচয়
আবদালের পরিচয় সম্পর্কে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। আবদাল বা বদলগণ নিজেদেরকে বদল বলে চিনতে বা বুঝতে পারেন বলেও কোনো হাদীসে কোনোভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে বাহ্যিক নেক আমল দেখে দ্বিতীয় শতক থেকে নেককার মানুষকে আবদালের অন্তর্ভূক্ত বলে মনে করা হতো। কোনো কোনো যয়ীফ হাদীসে এ বিষয়ক কিছু বাহ্যিক আমলের কথা বলা হয়েছে। একটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছেঃ
“তাঁরা এই মর্যাদা বেশি বেশি (নফল) সালাত, সিয়াম বা দান-সদকা করে লাভ করেন নি…..বরং বদান্যতা, হৃদয়ের প্রশস্ততা ও সকল মুসলিমের প্রতি দয়া, ভালবাসা ও নসীহতের দ্বারা তা লাভ করেছেন।” হাদীসটির সনদ দুর্বল।(হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ, ১০/৬৩; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/২৪-২৫)।
বিভিন্ন যয়ীফ হাদীস এবং তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের বক্তব্যের আলোকে আল্লামা সাখাবী, সুয়ূতী, আজলুনী প্রমুখ আলিম বদলগণের কিছু আলামত উল্লেখ করেছেনঃ অন্তরের প্রশস্ততা, ভাগ্যের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, হারাম হতে বিরত থাকা, আল্লাহর দ্বীনের জন্য ক্রোধান্বিত হওয়া, কাউকে আঘাত না করা, কেউ ক্ষতি করলে তার উপকার করা, কেউ কষ্ট দিলে তাকে ক্ষমা করা, উম্মাতে মুহাম্মদীর জন্য প্রতিদিন দোয়া করা, নিঃসন্তান হওয়া বা কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ না করা, কাউকে অভিশাপ না দেওয়া…..ইত্যাদি।(ইবনুল জাউযী, আল মাঊদূয়াত, ২/৩৩৫-৩৩৭; সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল লাআলী ২/৩৩০-৩৩২, ইবনু ইরাক, তানযীহ ৩০৬-৩০৭; তাহের ফাতানী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৩-১৯৫)।
খ. আবদালের দায়িত্বঃ
আমাদের মধ্যে আরো প্রচলিত যে, গাওসের অমুক দায়িত্ব, কুতুবের অমুক দায়িত্ব,….ইত্যাদি। এগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। অগণিত বুযুর্গ ও নেককার মানুষ সরল বিশ্বাসে এ সকল ভিত্তিহীন শোনা কথা সঠিক মনে করেন এবং বলেন। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, আবদাল ব্যতীত বাকী সকল পদ-পদবী ও পরিভাষাই ভিত্তিহীন। আর আবদালের ক্ষেত্রে কোনো কোনো হাদীসে বলা হয়েছে ‘তাঁদের কারণে বা তাদের জন্য আল্লাহ বৃষ্টি দেন ইত্যাদি।” এই কথাটির দুটি অর্থ রয়েছে।
প্রথমতঃ নেক আমলের বরকত লাভ-
নেককার মানুষের নেক আমলের কারণে আল্লাহ জাগতিক বরকত প্রদান করেন। সহীহ হাদীসে আনাস(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) এর যুগে দুই ভাই ছিলেন। এক ভাই রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট আগমন করতেন, অপর ভাই অর্থ উপার্জনের কর্মে নিয়োজিত থাকতেন। পেশাজীবি ভাই রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট আগমন করে অন্য ভাই সম্পর্কে অভিযোগ করেন যে, সে তাকে কর্মে সাহায্য করে না। তখন তিনি বলেনঃ “হতে পারে যে, তুমি তার কারণেই রিযকপ্রাপ্ত হচ্ছ।”(তিরমিযী, আস সুনান, ৪/৫৭৪, হাকিম, আল মুসতাদরাক ১/১৭২)।
দ্বিতীয়তঃ তাঁদের দোয়া লাভ
দ্বিতীয় অর্থ হলো, তাঁদের দোয়ার কারণে আল্লাহ রহমত ও বরকত প্রদান করবেন। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের দোয়া কবুল করেন বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। আবদাল বিষয়ক একাধিক যয়ীফ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এদের দোয়ার বরকত মানুষ লাভ করবে। নেককার মানুষদের প্রকৃতিই হলো যে, তাঁরা সদা সর্বদা সকল মুসলমানের ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। এই দোয়ার বরকত মুসলিম উম্মাহ লাভ করে। এখানে তিনটি ভুল ও বিকৃত অর্থ সমাজে প্রচলিতঃ
প্রথমত, দোয়া কবুলের বাধ্যবাধকতা
অনেকে দোয়া করেন ‘আবদাল’ বা এই প্রকারের কোনো নেককার মানুষ দোয়া করলে আল্লাহ শুনবেনই। কাজেই মহিমাময় আল্লাহ খুশি থাকুন আর বেজার থাকুন, আমি কোনো প্রকারে অমুক ব্যক্তির নিকট থেকে দোয়া আদায় করে নিতে পারলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে। এই ধারণা শুধু ভুলই নয়, উপরন্তু ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ও শিরকমূলক।
প্রথমত, কে বদল বা আবদাল তা আমরা কেউই জানি না। এ বিষয়ে সবই ধারণা ও কল্পনা। দ্বিতীয়ত, কারো দোয়া কবুল করা না করা সবই আল্লাহর ইচ্ছা। কুরআন কারীম হতে আমরা জানতে পারি মহিমাময় আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব ও খালীল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর(সা) মনের অব্যক্ত আশাটিও পূর্ণ করেছেন। আবার তিনি তাঁর মুখের দোয়াও কবুল করেন নি। তিনি একজন মুনাফিকের জন্য ক্ষমার দোয়া করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ কবুল করেন নি। উপরন্তু বলেছেন, ৭০ বার এভাবে দোয়া করলেও কবুল হবে না। একজন কারামত প্রাপ্ত ওলী, আল্লাহর মর্জির বাইরে দোয়া করেছিলেন বলে তাকে কঠিনভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। (সূরা ৯, তাওবাঃ আয়াত ৮০; সূরা ৭, আরাফঃ ১৭৫-১৭৭; তাফসীর ইবনু কাসীর ২/২৬৫-২৬৯)।
দ্বিতীয়ত, দোয়া কবুলের মাধ্যম বা ওসীলা
‘তাঁর কারণে বা মাধ্যমে তুমি রিযিক পাও’, ‘তাঁদের কারণে বা মাধ্যমে তুমি বৃষ্টি পাও…..’ ইত্যাদি কথার একটি বিকৃত ও ইসলামী আকীদা বিরোধী ব্যাখ্যা হলো এই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের দোয়া বা সুপারিশ ছাড়া বোধহয় আল্লাহ এগুলি দিবেন না। এরা বোধহয় রাজা-বাদশাহের মন্ত্রীদের মত, তাঁদের সুপারিশ ছাড়া চলবে না। পৃথিবীতে রাজা, শাসক ও মন্ত্রীদের কাছে কোনো আবেদন পেশ করতে হলে তাদের একান্ত আপনজনদের মাধ্যমে তা পেশ করলে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে আল্লাহর কাছে সরাসরি চাওয়ার চেয়ে এদের মাধ্যমে চাওয়া হলে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এই ধারণাগুলি সুস্পষ্ট শিরক। পৃথিবীর বাদশা আমাকে চেনেন না, আমার সততা ও আন্তরিকতার কথা তাঁর জানা নেই। কিন্তু তাঁর কোনো প্রিয়পাত্র হয়তো বা আমাকে চিনেন। তার সুপারিশ পেলে বাদশাহর মনে নিশ্চয়তা আসবে যে, আমি তাঁর দয়া পাওয়ার উপযুক্ত মানুষ। আল্লাহ তা’আলার বিষয় কি তদ্রুপ? তিনি কি আমাকে চেনেন না? আল্লাহর কোনো ওলী, কোনো প্রিয় বান্দা কি আমাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি চেনেন? নাকি বেশি ভালবাসেন? অথবা বেশি করুণা করতে চান? এছাড়া পৃথিবীর বাদশাহ বা বিচারকের মানবীয় দুর্বলতার কারণে পক্ষপাতিত্বের বা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভয় আছে, সুপারিশের মাধ্যমে যা দূরীভূত হয়। আল্লাহর ক্ষেত্রে কি এমন কোনো ভয় আছে?
কে আল্লাহর কাছে মাকবূল ও প্রিয় তা কেউই বলতে পারে না। আমরা আগেই দেখেছি, নেককার মানুষদের প্রকৃতিই হলো যে, তাঁরা সর্বদা সকল মুসলমানের ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। এই দোয়ার বরকত মুসলিমগণ লাভ করেন। এছাড়া কোনো মুসলিমকে ব্যক্তিগতভাবে, অথবা মুসলিম সমাজকে সমষ্টিগতভাবে কোনো নির্ধারিত নেককার ব্যক্তির কাছে যেয়ে দোয়া চাইতে হবে, এ কথা কখনোই এ সকল হাদীসের নির্দেশনা নয়। ইসলামের বরকতময় যুগগুলিতে সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা তৎকালীন মানুষের কখনোই এরূপ করেন নি।
তৃতীয়ত, দায়িত্ব বা ক্ষমতা
অনেকে মনে করেন, আবদাল বা আউলিয়ায়ে কেরামকে আল্লাহ বৃষ্টি, বিজয় ইত্যাদির দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছেন। এরা নিজেদের সুবিধামতো তা প্রদান করেন। এই ধারণাটি হিন্দু ও মুশরিকদের দেব দেবতায় বিশ্বাসেরই মত শিরক। এই বিশ্ব পরিচালনায় আল্লাহ জীবিত বা মৃত কোনো নবী, ওলী বা কোনো মানুষকেই কোনো দায়িত্ব বা অধিকার প্রদান করেন নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় বা মনে করা হয় সবই জঘন্য মিথ্যা কথা ও কুরআন ও হাদীসের অগণিত স্পষ্ট কথার বিপরীত কথা।
আল্লাহ ফিরিশতাগণকে বিশ্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন, কিন্তু কোনো ক্ষমতা দেন নি। কোনো জীবিত বা মৃত মানুষকে কোনোরূপ দায়িত্ব প্রদান করেন নি।
মুসলিম সমাজেরই অনেকেই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে মনের আন্দাযে ধারণা করেন যে, অমুক ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বান্দা। এরপর মনের আন্দাযে ধারণা করেন যে, আল্লাহ তাকে হয়তো কোনো ক্ষমতা দিয়েছেন। এরপর মনগড়াভাবে এদের কাছে চাইতে থাকেন। আর এ সকল জঘন্য শিরককে সমর্থন করার জন্য কোনো কোনো জ্ঞানপাপী উপরের ‘আবদাল’ বিষয়ক হাদীসগুলি বিকৃত করে থাকেন।
১৮. আব্দুল কাদের জিলানী(রাহ) কেন্দ্রিক
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের অবক্ষয়, বিচ্ছিন্নতা, অবক্ষয় ও বর্হিশত্রুর আক্রমণের যুগের, হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের অন্যতম আলেম, ফকীহ ও সূফী ছিলেন হযরত আব্দুল কাদের জীলানি। তিনি ৪৭১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯০ বছর বয়সে ৫৬১ হিজরীতে(১১৬৬ খৃ)মৃত্যুবরণ করেন। তিনি হাম্বলী মাযহাবের একজন বড় ফকীহ ছিলেন। এছাড়া তাসাউফের বড় সাধক ও ওয়ায়িজ ছিলেন। তাঁর ওয়াযের প্রভাবে অগণিত মানুষ সেই অন্ধকার যুগে দ্বীনের পথে ফিরে আসে। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর অনেক কারামত প্রসিদ্ধ লাভ করে। তাঁর ছাত্রগণ বা নিকটবর্তীগণ, যেমন যাহাবী, সামআনী ও অন্যান্যরা তাঁর বিশুদ্ধ জীবনী রচনা করেছেন। এছাড়া তিনি নিজে অনেক গ্রন্থ লিখে হাম্বলী মাযহাব অনুসারে মুসলিমগণের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের শিক্ষা প্রদান করেন। যদিও তিনি তৎকালীন মাযহাবী কোন্দলের প্রভাবে ইমাম আবূ হানীফা(রাহ) ও তাঁকে অনুসারীদেরকে জাহান্নামী ফিরকা হিসেবে উল্লেখ করেছেন(আব্দুল কাদের জীলানী, গুনিয়াতুত তালেবীন, পৃ. ৬, ৭, ১৪৯, ১৫১, ১৫২, ১৫৫, ২১১, ২২৭), তবুও হানাফীগণ সহ সকল মাযহাবের মানুষেই তাঁকে ভক্তি করেন।
পরবর্তী যুগে তাঁর নামে অগণিত আজগুবি ও মিথ্যা কথা কারামতের নামে বানানো হয়। এ সকল কথা যেমন ভিত্তিহীন ও মিথ্যা, তেমনি তা ইসলামী ধ্যানধারণার পরিপন্থী। তবে এখানে আমাদের আলোচ্য হলো রাসূলুল্লাহ(সা) কেন্দ্রিক মিথ্যা কথা। আব্দুল কাদির জিলানীকে(রাহ) কেন্দ্র করে মিথ্যাবাদীদের বানোয়াট কথার একটি হলো, মি’রাজের রাত্রিতে নাকি রাসূলুল্লাহ(সা) আব্দুল কাদের জিলানীর(রাহ) কাঁধে পা রেখে আরশে উঠেছিলেন। কথাটি রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বানোয়াট জঘন্য মিথ্যা কথা। কোনো হাদীসের গ্রন্থেই এর অস্তিত্ব নেই। আর যে কথা রাসূলুল্লাহ(সা) বলেননি, কোনো হাদীসের গ্রন্থে নেই বা সনদ নেই, সে সকল আজগুবি বানোয়াট কথা একজন মুমিন কিভাবে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বলতে পারেন সে কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। যেখানে সাহাবীগণ তাঁদের মুখস্ত ও জানা কথা সামান্য কমবেশি হওয়ার ভয়ে বলতে সাহস পেতেন না, সেখানে নির্বিচারে যা শুনছি তাই তাঁর নামে বলে কিভাবে কিয়ামতের দিন তাঁর সামনে মুখ দেখাব!