২.৩. পূর্ববর্তী সৃষ্টি ও নবীগণ ও তাফসীর বিষয়ক
পূর্ববর্তী সৃষ্টি, পূর্ববর্তী নবীগণ ও ঘটনা কাহিনীর বিষয়ে কুরআন কারীম সংক্ষেপে আলোচনা এসেছে। শুধুমাত্র যে বিষয়গুলিতে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শিক্ষা রয়েছে সেগুলিই আলোচনা করা হয়েছে। এ সকল সৃষ্টি ও নবীগণের ঘটনা ইহুদীদের মধ্যে অনেক বিস্তারিতভাবে প্রচলিত।
কুরআন কারীমে যেহেতু এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা নেই, সেহেতু সাহাবী তাবেয়ীগণের যুগ হতেই অনেক মুফাসসির এ সকল বিষয়ে ইহুদীদের বর্ণনা কৌতুহলের সাথে শুনতেন। পাশাপাশি তাবিয়ী পর্যায়ে অনেক ইহুদী আলেম ইসলাম গ্রহণ করার পরে এ সকল বিষয়ে তাদের সমাজে প্রচলিত অনেক গল্প কাহিনী মুসলমানদের মধ্যে বলেছেন।
এ সকল গল্প কাহিনী গল্প হিসেবে শুনতে বা বলতে ইসলামে নিষেধ করা হয়নি। তবে এগুলিকে সত্য বলে মনে করতে ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। কোনো কোনো মুফাসসির ও ঐতিহাসিক পূর্ববর্তী নবীগণ বিষয়ক বিভিন্ন আয়াতের তাফসীরে ও তাদের জীবন কেন্দ্রিক ইতিহাস বর্ণনায় ইহুদী খৃস্টানগণের বিকৃত বাইবেল ও অন্যান্য সত্য-মিথ্যা গল্পকাহিনীর উপর নির্ভর করেছেন। প্রথম যুগগুলিতে মুসলিমগণ গল্প হিসেবেই এগুলি শুনতেন। তবে পরবর্তী যুগে এ সকল কাহিনীকে মানুষ সত্যি মনে করেছেন। কেউ কউ এগুলিকে হাদীস হিসেবে প্রচার করেছেন।
কুরআনে বারংবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, ইহুদী ও খৃস্টানগণ তাদের উপর অবতীর্ণ আল্লাহর কালাম তাওরাত, যাবুর ও ইঞ্জিলকে বিকৃত করেছে। অনেক কথা তারা নিজেরা রচনা করে আল্লাহর কালাম বলে চালিয়েছে। এজন্য হাদীস শরীফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তাদের কথা বর্ণনা করা যাবে, তবে শর্ত হলো, কুরআনের সত্যায়ন ছাড়া কোনো কিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করা যাবেনা। সাহাবীগণ ইহুদী খৃস্টানদের তথ্যের উপর নির্ভর করাকে নিন্দা করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, “ কিভাবে তোমরা ইহুদী খৃস্টানদেরকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা কর? অথচ তোমাদের পুস্তক যা রাসূলুল্লাহ(সা) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে যা নবীনতর, তোমরা তা বিশুদ্ধ অবস্থায় পাঠ করেছ, যার মধ্যে কোনোরূপ বিকৃতি প্রবেশ করতে পারেনি। এই কুরআন তোমাদেরকে বলে দিয়েছে যে, পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের অনুসারীগণ আল্লাহর পুস্তককে পরিবর্তন করেছে এবং বিকৃত করেছে। তারা স্বহস্তে পুস্তক রচনা করে বলেছে যে তা আল্লাহর পক্ষ হতে প্রাপ্ত। পার্থিব সামান্য স্বার্থ লাভের জন্য তারা এরূপ করছে। তোমাদের নিকট যে জ্ঞান আগমন করেছে(কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান) তা কি তোমাদেরকে তাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করা থেকে নিবৃত করতে পারেনা।”(বুখারী, আস সহীহ, ৬/২৬৭৯)।
এতকিছু সত্ত্বেও ক্রমান্বয়ে মুসলিম সমাজে ইসরাঈলী রেওয়ায়াত প্রবেশ করতে থাকে। পরবর্তী যুগে মুসলিমগণ এগুলিকে কুরআন বা হাদীসের কথা বলেই বিশ্বাস করতে থাকেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই বইয়ের পরিসরে সম্ভব নয়। এজন্য সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের জন্য ইঙ্গিত করছি।
১. বিশ্ব সৃষ্টির তারিখ বা বিশ্বের বয়স বিষয়ক
বিশ্ব সৃষ্টির তারিখ, সময়, বিশ্বের বয়স, আদম(আ) হতে ঈসা(আ) পর্য্যন্ত সময়ের হিসাব, আর কতদিন বিশ্ব থাকবে তার হিসাব ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা। জালিয়াতগণ এ বিষয়ে অনেক কথা বানিয়েছে।
ইহুদী ও খৃস্টানগণের বাইবেলে বিশ্ব সৃষ্টির বয়স উল্লেখ করা হয়েছে। মানব সৃষ্টির সময় বলা হয়েছে। বাইবেল এর হিসেব অনুসারে বর্তমান বিশ্বের বয়স মাত্র ৭০০০(সাত হাজার) বছর মাত্র। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে ও বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল বলে প্রমাণিত। এ সকল মিথ্যা ও ভুল তথ্যের উপর নির্ভর করে মুসলিম ঐতিহাসিকগণও অনেক কথা লিখেছেন। আর জালিয়াতগণ এই মর্মে অনেক জাল হাদীসও বানিয়েছে।
২. মানুষের পূর্বে অন্যান্য সৃষ্টির বিবরণ
মানব জাতির পূর্বে জিন ভিন্ন অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এই বিশ্বে ছিল কিনা সে বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। তবে মানুষের পূর্বে মহান আল্লাহ জিন জাতিকে মানুষের মতই বুদ্ধি, ইচ্ছাশক্তি ও ইবাদতের দায়িত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন বলে কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। জিন জাতির সৃষ্টির বিস্তারিত বিবরণ কুরআন কারীমে নেই। কোনো সহীহ হাদীসেও এ বিষয়ক কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়না।
জিন জাতির সৃষ্টি রহস্য, জিন জাতির আদি পিতা, জিন জাতির কর্মকান্ড, জিন জাতির নবী পয়গাম্বর, তাদের আযাব-গযব, তাদের বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ, নবী-রাসূলের নাম ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই ইহুদী খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার, লোককথা ও অনির্ভরযোগ্য কল্প-কাহিনী।
কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবলীস জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত। আদমকে সেজদা করার নির্দেশ অমান্য করে সে অভিশপ্ত হয়। এই ঘটনার পূর্বে তার জীবনের কোনো ইতিহাস সম্পর্কে কোনো সহীহ বর্ণনা নেই। ইবলিসের জন্ম-বৃত্তান্ত, বংশ ও কর্ম তালিকা, জ্ঞান-গরিমা, ইবাদত-বন্দেগী ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বিভিন্ন মানুষের কথা, ইসরায়েলী রেওয়ায়াত ও অনির্ভরযোগ্য বিবরণ। ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ জাতীয় পুস্তকগুলি এ সকল মিথ্যা কাহিনীতে পরিপূর্ণ।
৩. সৃষ্টির সংখ্যাঃ ১৮ হাজার মাখলুকাত
একটি বহুল প্রচলিত কথা হলোঃ ১৮ হাজার মাখলুকাত। অর্থাৎ এই মহাবিশ্বে সৃষ্ট প্রাণীর জাতি-প্রজাতির সংখ্যা হলো ১৮,০০০ মাত্র। এই কথাটি একান্তই লোকশ্রুতি ও কোনো কোনো আলিমের মতামত। আল্লাহর অগণিত সৃষ্টির সংখ্যা কত লক্ষ বা কত কোটি সে বিষযে কোনো তথ্য কোনো সহীহ এমনকি যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয়নি।
৪. নবী-রাসূলগণের সংখ্যা
কুরআন কারীম থেকে জানা যায় যে, মহান আল্লাহ সকল যুগে সকল জাতি ও সমাজেই নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এরশাদ করা হয়েছেঃ (আরবী*********)
-“প্রত্যেক জাতিতেই সতর্ককারী প্রেরণ করা হয়েছে।”(সূরা ৩৫, ফাতির, আয়াত ২৪। আরো দেখুন সূরা ১০, ইউনূস, আয়াত ৪৭)।
এ সকল নবী রাসূলের মোট সংখ্যা কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। বরং কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যে, এই নবী-রাসূলগণের কারো কথা আল্লাহ তাঁর রাসূলকে(সা) জানিয়েছেন এবং কারো কথা তিনি তাঁকে জানাননি। এরশাদ করা হয়েছেঃ
وَرُسُلًا قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِن قَبْلُ وَرُسُلًا لَّمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ ۚ
-“অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা ইতোপূর্বে আপনাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে যাদের কথা আপনাকে বলিনি।” (সূরা ৪: নিসা, আয়াত ১৬৪। আরো দেখুন সূরা ৪০, গাফির/মুমিন, আয়াত ৭৮)।
আমাদের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ কথা যে, নবী রাসূলগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার বা ২ লক্ষ ২৪ হাজার। এখানে লক্ষণীয় যে, নবী-রাসূলগণের সংখ্যার বিষয়ে একটি সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়নি। একাধিক যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসে এ বিষয়ে কিছু কথা বর্ণিত হয়েছে। ২ লক্ষ ২৪ হাজারের স্পষ্ট বর্ণনা সম্বলিত কোনো সনদ সহ হাদীস আমি কোথাও দেখতে পাইনি। তবে ১ লক্ষ ২৪ হাজার বা অন্য কিছু সংখ্যা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলি নিম্নরূপঃ
ক. ১ লক্ষ ২৪ হাজারঃ একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে- নবী রাসূলগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার। কিন্তু সবগুলি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। কোনো কোনো মুহাদ্দিস এই অর্থের হাদীসকে জাল বলে গণ্য করেছেন।
ইবনু হিব্বান প্রমুখ মুহাদ্দিস তাঁদের সনদে ইবরাহীন ইবনু হিশাম ইবনু ইয়াহইয়া আল গাশশানী(২৩৮ হি) নামক তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবীর সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এই ইবরাহীম বলেন, আমাকে আমার পিতা, আমার দাদা থেকে, তিনি আবূ ইদরীস খাওলানী থেকে, তিনি আবূ যার গিফারী থেকে বলেছেনঃ “আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! নবীগণের সংখ্যা কত? তিনি বলেন, এক লক্ষ ২৪ হাজার।আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, এদের মধ্যে রাসূল কত জন? তিনি বলেন, তিন শত তের জন, অনেক বড় সংখ্যা।”(ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১/৭৬-৭৯)।
এই হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী ইবরাহীম ইবনু হিশাম নামক রাবীর বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তাবারানী ও ইবনু হিব্বান তাকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী রাবী বলে চিহ্নিত করেছেন। আবূ যুরআ বলেনঃ লোকটি কাযযাব বা অত্যধিক মিথ্যাবাদী। আবূ হাতিম রাযী তার নিকট হাদীস গ্রহণ করতে গমন করেন। তিনি তার নিকট হতে তার পান্ডুলিপি নিয়ে তার মৌখিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে অগণিত বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্য দেখতে পান। ফলে তিনি বলেনঃ বুঝা যাচ্ছে যে, লোকটি কখনো হাদীস শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয় করেনি। লোকটি মিথ্যাবাদী বলে মনে হয়। যাহাবী তাকে মাতরূক বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/২০১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/১২২)।
যেহেতু হাদীসটি একমাত্র ইবরাহীম ইবনু হিশাম ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করেননি, সেহেতু ইবনুল জাউযী ও অন্যান্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন।(ইবনু কাসীর, আত-তাফসীর ১/৫৮৬-৫৮৭)।
ইমাম আহমাদ এই অর্থে অন্য একটি হাদীস সংকলন করেছেন। এই হাদীসে মু’আন ইবনু রিফা’আহ নামক একজন রাবী বলেন, আমাকে আলী ইবনু ইয়াযীদ বলেছেন, কাসিম আবূ আব্দুর রাহমান থেকে, তিনি আবূ উমামা(রা) থেকে…নবীগণের সংখ্যা কত? তিনি বলেন, ১ লক্ষ ২৪ হাজার…….। (আহমাদ, আল মুসনাদ ৫/২৬৫)।
এই হাদীসের রাবী মু‘আন ইবনু রিফা‘আহ আস-সুলামী কিছুটা দুর্বল রাবী ছিলেন।(ইবনুল জাউযী, আদ-দু‘আফা ৩/১২৬; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৪৫৫)। তার ওস্তাদ আলী ইবনু ইয়াযিদ আরো বেশি দুর্বল ছিলেন। ইমাম বুখারী তাকে মুনকার বা আপত্তিকর বলেছেন। ইমাম নাসাঈ, দারাকুতনী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। (নাসাঈ, আদ-দু‘আফা পৃ.৭৭)। তার ওস্তাদ কাসিম আবূ আব্দুর রাহমানও (১১২ হি) দুর্বল ছিলেন। এমনকি ইমাম আহমদ, ইবনু হিব্বান প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেছেন যে, কাসিম সাহাবীগণের নামে এমন অনেক কথা বর্ণনা করেন যে, মনে হয় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এই ভুলগুলি বলছেন। তিনি দাবী করতেন যে, তিনি ৪০ জন বদরী সাহাবীকে দেখেছেন, অথচ তার জন্মই হয়েছে প্রথম শতকের মাঝামাঝি। (ইবনুল জাউযী, আদ দু‘আফা ৩/১৪)।
এ থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এই হাদীসটিও অত্যন্ত দুর্বল। আরো দুই একটি এইরূপ অত্যন্ত দুর্বল সনদে এই সংখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে। সামগ্রিক বিচারে এই সংখ্যাটি মাউযূ বা জাল না হলেও অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য। মহান আল্লাহই ভাল জানেন।(ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৭-৫৮৮)।
খ. ৮ হাজার পয়গম্বর
আবূ ইয়ালা মাউসিলী মূসা ইবনু আবীদাহ আর রাবাযী থেকে, তিনি ইয়াযিদ ইবনু আবান আর-রাকাশী থেকে বর্ণনা করেছেন, আনাস ইবনু মালিক(রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “মহান আল্লাহ ৮ হাজার নবী প্রেরণ করেছেন। ৪ হাজার বনী ইসরাঈলের মধ্যে এবং বাকী চার হাজার অবশিষ্ট মানব জাতির মধ্যে। (ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮)।
এই হাদীসটিও দুর্বল। ইমাম ইবনু কাসীর বলেন, “এই সনদটিও দুর্বল। আর-রাবাযী দুর্বল। তার উস্তাদ রাকাশী তার চেয়েও দুর্বল।” ইবনু কাসীর বলেছেন যে, আরো একটি সনদে এই সংখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে। সনদটি বাহ্যত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। (ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮)।
গ. এক হাজার বা তারও বেশি পয়গাম্বর
ইমাম আহমাদ প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, “আমি এক হাজার বা তারও বেশি নবীর শেষ নবী।” ইবনু কাসীর, হাইসামী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, সংখ্যার বর্ণনায় অন্যান্য হাদীসের চেয়ে এই হাদীস কিছুটা গ্রহণযোগ্য, যদিও এর সনদেও দুর্বলতা রয়েছে। (ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮)।
৫. নবী-রাসূলগণের নাম
কুরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছেঃ
আদম(২৫ বার তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। দেখুন সূরা বাকারাহ, আয়াত ৩১……), ইদরিস (২ বার, দেখুন সূরা মারিয়াম, আয়াত ৫৬……), নূহ(৪৩ বার, দেখুন সূরা আল-ইমরান, আয়াত৩৩….), হুদ(৮ বার, দেখুন সূরা বাকারাহ, আয়াত ১২৪……), সালিহ(৯ বার, দেখুন সূরা আল আরাফ, আয়াত ৭৩…..), ইবরাহীম(৬৯ বার, দেখুন সূরা বাকারাহ, আয়াত ১২৪…….), লূত(১৭ বার, দেখুন সূরা হুদ ৭০ আয়াত…), ইসমাঈল(১২ বার, দেখুন সূরা বাকারা ১২৫ আয়াত……), ইসহাক(১৭ বার, দেখুন সূরা বাকারা ১৩৩ আয়াত….), ইয়াকূব(১৬ বার, সূরা বাকারা ১৩২ আয়াত…….), ইউসূফ(২৭ বার সূরা আনয়াত ৮৪ আয়াত…….), আইয়ূব(৪ বার, সূরা নিসা ১৬৩ আয়াত……), শুয়াইব(১১ বার, দেখুন সূরা আল আরাফ ৮৫ আয়াত…..), মূসা(১৩৬ বার, দেখুন সূরা বাকারা ৫১ আয়াত…..), হারূন(২০ বার, দেখুন সূরা বাকারা ২৪৮ আয়াত…..), ইউনূস(৪ বার, দেখুন সূরা নিসা ১৬৩ আয়াত…..), দাউদ(১৬ বার, দেখুন সূরা বাকারা ২৫১ আয়াত…….), সুলাইমান(১৭ বার, সূরা বাকারা ১০২ আয়াত…….), ইলইয়াস(৩ বার, সূরা আনআম ৮৫ আয়াত……), ইলইয়াসা(২ বা)র, সূরা আনআম ৮৬ ও সূরা সাদ ৪৮ আয়াত), যুলকিফল(২ বার, সূরা আম্বিয়া ৮৫ ও সূরা সাদ ৪৮ আয়াত), যাকারিয়া(৭ বার, দেখুন সূরা আল ইমরান ৩৭ আয়াত……), ইয়াহইয়া(৫ বার, দেখুন সূরা আল ইমরান ৩৯ আয়াত…..), ঈসা(২৫ বার, দেখুন সূরা বাকারা ৮৭ আয়াত….), মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)[৪ বার তাঁর নাম উল্লেখিত হয়েছে। সূরা আল ইমরান ১৪৪, সূরা আহযাব ৪০, সূরা মুহাম্মাদ ২ ও সূরা আল ফাতহ ২৯ আয়াত। আল্লাহ কুরআনে সকল নবী রাসূলের ক্ষেত্রে তাঁদের নাম ধরে সম্বোধন করেছেন এবং তাঁদের ঘটনা বর্ণনার সময় তাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুহাম্মাদ(সা) এর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তাঁকে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে কুরআন মাজীদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘হে নবী’, ‘হে রাসূল’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আর তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে তাঁর সম্মানিত উপাধি নবী, রাসূল বা আবদ বলা হয়েছে। এজন্য কুরআনে শুধুমাত্র ৪ টি স্থান ছাড়া কোথাও তাঁর নাম উল্লেখিত হয়নি।] (ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৬; কুরতুবী, তাফসীর ৩/৩১)।
কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উযাইরকে ইহুদীগণ আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করত।(সূরা ৯ তাওবা, আয়াত ৩০)। কিন্তু তাঁর নবুয়্যত সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। আবূ হুরাইরা(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, “আমি জানিনা যে, উযাইর নবী ছিলেন কিনা।”(আবূ দাউদ, আস সুনান ৪/২১৮; আযীম আবাদী, আউনুল মা’বুদ ১২/২৮০।)
মূসার খাদেম হিসেবে ইউশা ইবনু নূন এর নাম হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণিত কোনো সহীহ হাদীসে অন্য কোনো নবীর নাম উল্লেখ করা হয়নি। কোনো কোনো অত্যন্ত যয়ীফ বা জাল হাদীসে আদমের পূত্র শীষ(আ) এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কালুত, হাযকীল, হাযালা, শামূয়েল, জারজীস, শামঊন, ইরমিয়, দানিয়েল প্রমুখ নবীগণের নাম, জীবনবৃত্তান্ত ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই মূলত ইসরাঈলীয় বর্ণনা ও সেগুলির ভিত্তিতে মুফাসসির ও ঐতিহাসিকদের মতামত।
৬. আসমানী সহীফার সংখ্যা
মহান আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বারংবার এরশাদ করেছেন যে, তিনি নবী ও রাসূলগণকে গ্রন্থাদি প্রদান করেছেন। কিন্তু এ সকল কিতাব ও সহীফার কোনো সংখ্যা কুরআন কারীমের বা কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়নি। ‘১০৪’ কিতাব ও সহীফার কথাটি আমাদের দেশে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীসে কথাটি পাওয়া যায়না। উপরে ১ লক্ষ ২৪ হাজার পয়গম্বর বিষয়ক যে হাদীসটি আবূ যার(রা) হতে বর্ণিত হয়েছে, সেই হাদীসের মধ্যে এই ১০৪ সহীফা ও কিতাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, এই হাদীসটি জাল অথবা অত্যন্ত দুর্বল।
৭. নবী রাসূলগণের বয়স বিষয়ক বর্ণনা
কুরআন কারীমে নূহ(আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি ৯৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন। এছাড়া অন্য কোনো নবীর আয়ুষ্কাল কুরআন কারীমে বর্ণনা করা হয়নি। আদম(আ) এর আয়ুষ্কাল এক হাজার বৎসর বলে একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ক আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। নবীগণের আয়ুষ্কাল বিষয়ক যা কিছু প্রচলিত বই পুস্তকে লিখিত রয়েছে সবই ইহুদী খৃস্টানগণের বিকৃত গ্রন্থাবলি হতে গৃহীত।
৮. নবী-রাসূলগণের জীবন বৃত্তান্ত
উল্লেখিত নবী রাসূলগণের জীবনবৃত্তান্ত কুরআন কারীমে বা হাদীস শরীফে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। ইলইয়াস, ইলইয়াসা ও যুলকিফল(আ) সম্পর্কে শুধুমাত্র নাম উল্লেখ ছাড়া কিছুই বলা হয়নি। ইদরিস(আ) এর বিষয়টিও প্রায় অনুরূপ। অন্যান্য নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে তাঁদের জীবনের শিক্ষণীয় কিছু দিক শুধু আলোচনা করা হয়েছে। তাঁদের বিস্তারিত জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় তা অধিকাংশই ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত ও জনশ্রুতি। আমাদের দেশের প্রচলিত ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ ও বিভিন্ন নবীর জীবনী বিষয়ক পুস্তকাদিতে যা কিছু লেখা হয়েছে তার অধিকাংশই এ সকল জাল, ভিত্তিহীন ও ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত এর সমষ্টি। এই গ্রন্থের সীমিত পরিসরে এ সকল দিক বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। এছাড়া সকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনার যোগ্যতাও আমার নেই। এখানে সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের উল্লেখ করছি।
৯. আদম(আ) ও হাওয়া(আ)
৯.১. গন্দম ফল
আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত কথা যে, আদম(আ)গন্দম গাছের ফল খেয়েছিলেন। কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও কুরআন হাদীসে কোথাও তা নেই। আদম ও হাওয়া(আ) কে আল্লাহ তাআলা একটি বিশেষ বৃক্ষের নিকট গমন করতে নিষেধ করেন। পরবর্তীতে তাঁরা শয়তানের প্ররোচণায় এই বৃক্ষ হতে ভক্ষণ করেন। কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টি বলা হয়েছে। কিন্তু বৃক্ষ বা ফলের নাম কোথাও বর্ণিত হয়নি। পরবর্তীযুগে মুফাসসিরগণ বিভিন্ন গাছের নাম বলেছেন। ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল যে, আদম(আ) গন্দম, অর্থাৎ গম গাছের ফল ভক্ষণ করেন! কেউ বলেছেন আঙ্গুর, কেউ বলেছেন খেজুর….ইত্যাদি। এগুলি সবই আন্দায কথা। হাদীসে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। মুমিনের দায়িত্ব হলো, এই ঘটনা হতে শিক্ষা গ্রহণ করা, গাছের বা ফলের নাম জানা নয়। সর্বাবস্থায় এ সকল মানবীয় মতামতকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের(সা) কথা বলে মনে করা যাবেনা।(ইবনু কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া ১/১৯)।
এই গন্দম ফল নিয়ে আরো অনেক বানোয়াট কথা আমাদের দেশে প্রচলিত কাসাসূল আম্বিয়া ও এই জাতীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়।আদমের মনে কূটতর্ক জন্মে, জিবরাঈল(আ) তা বের করে পুঁতে রাখেন, সেখান থেকে গন্দম গাছ হয়…….ইত্যাদি…..। সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।
৯.২. আদম(আ) ও হাওয়া(আ) এর বিবাহ ও মোহরানা
কুরআনের বাহ্যিক বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, আদম(আ) এর জান্নাতে প্রবেশের পূর্বেই হাওয়া(আ) কে সৃষ্টি করা হয় এবং উভয়কে একত্রে জান্নাতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সাহাবীগণের যুগ থেকে কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন যে, আদম জান্নাতে অবস্থানের কিছুদিন পরে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদম হতে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ কুরআন কারীম বা হাদীস শরীফে দেওয়া হয়নি। মুফাসসিরগণ বিভিন্ন কথা বলেছেন। প্রচলিত আছে যে, আদম ও হাওয়ার মধ্যে বিবাহের মোহরানা ছিল দুরুদ শরীফ পাঠ……ইত্যাদি। এ সকল কথার কোনো সনদ বা ভিত্তি আছে বলে জানা যায়না।
৯.৩. ইবলীস কর্তৃক ময়ূর ও সাপের সাহায্য গ্রহণ
ইবলিস সাপ ও ময়ূরের সাহায্যে আদম ও হাওয়া(আ) কে প্ররোচনা প্রদানের চেষ্টা করে বলে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। এগুলি ইহুদী খৃস্টানদের হতে গ্রহণ করা হয়েছে বলে গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন।(মুহাম্মাদ আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৭৮-১৮০)।
৯.৪. পৃথিবীতে অবতরণের পরে
পৃথিবীতে অবতরণের পরে আদম ও হাওয়া(আ) সম্পর্কে কুরআন কারীমে কোনো কিছু বলা হয়নি। সহীহ হাদীসেও এ বিষয়ক বিশেষ কিছু পাওয়া যায়না। তাঁরা কোথায় অবতরণ করেছিলেন, কোথায় বসবাস করেছিলেন, কি কর্ম করতেন, কোন ভাষায় কথা বলতেন, কিভাবে ইবাদত বন্দেগী করতেন, সংসার ও সমাজ জীবন কিভাবে যাপন করতেন ইত্যাদি বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। এ সকল বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত প্রায় সবই মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণের মতামত বা বিভিন্ন গল্পকারদের গল্প। দুই একটি দুর্বল সনদের হাদীসও এ সকল বিষয়ে বর্ণিত আছে। আল্লাহই ভাল জানেন।
৯.৫. আদম(আ) কর্তৃক কাবা ঘর নির্মাণ
আদম(আ) পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণ করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে। মূলত বিভিন্ন ঐতিহাসিক, মুফাসসির বা আলিমের কথা এগুলি। এ বিষয়ক হাদীসগুলি দুর্বল সনদে বর্ণিত। কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ বিষয়ক সকল বর্ণনাই অত্যন্ত যয়ীফ ও বাতিল বলে গণ্য করেছেন। আল্লামা ইবনু কাসীর বাইতুল্লাহ বিষয়ক আয়াতগুলি উল্লেখ করে বলেন, এ সকল আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য বিশ্বের সকল মানুষের জন্য নির্মিত সর্বপ্রথম বরকতময় ঘর ‘বাইতুল্লাহ’ কে ইবরাহীম(আ) নির্মাণ করেন। এই স্থানটি সৃষ্টির শুরু হতেই মহা সম্মানিত ছিল। আল্লাহ সেই স্থান ওহীর মাধ্যমে তাঁর খলীলকে দেখিয়ে দেন। তিনি আরো বলেন, “রাসূলুল্লাহ(সা) হতে একটি সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়নি যে, ইবরাহীম(আ) এর পূর্বে কাবাঘর নির্মাণ করা হয়েছিল….এ বিষয়ক সকল বর্ণনা ইসরায়েলী রেওয়ায়াত। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এগুলিকে সত্যও মনে করা যাবেনা, মিথ্যাও মনে করা যাবেনা। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/১৭৩-১৭৪)।
১০. নূহ(আ) এর নৌকায় মলত্যাগ করা ও পরিষ্কার করা
এ বিষয়ে অনেক মুখরোচক গল্প প্রচলিত রয়েছে। এগুলির কোনো ভিত্তি কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে আছে বলে জানতে পারিনি। বাহ্যত এগুলি বানোয়াট গল্প যা গল্পকাররা বানিয়েছে। নূহ(আ) এর নৌকার বিবরণ, কোন্ কাঠে তৈরি, তাতে কোন্ প্রাণী কোথায় ছিল, শয়তান কিভাবে প্রবেশ করল ইত্যাদি বিষয়েও অগণিত বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কাহিনী প্রচলিত। এ সকল বিষয়ে সহীহ হাদীসে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।
১১. ইদরীস(আ) এর শশরীরে আসমানে গমন
কুরআন কারীমে দুই স্থানে ইদরীস(আ)এর উল্লেখ রয়েছে। একস্থানে এরশাদ করা হয়েছেঃ “ এবং ইসমাঈল, এবং ইদরীস এবং যুলকিফল সকলেই ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত।(সূরা ২১ আম্বিয়াঃ আয়াত ৮৫)। অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছেঃ আরবী(*****)
-“এবং আপনি স্মরণ করুন এই কিতাবের মধ্যে ইদরীসের কথা, সে ছিল সত্যনিষ্ঠ, নবী এবং আমি তাকে উন্নীত করেছিলাম উচ্চস্থানে(মর্যাদায়)।”(সূরা ১৯ঃ মারইয়াম, ৫৬-৫৭ আয়াত)।
হাদীস শরীফেও ইদরীস(আ) সম্পর্কে তেমন কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তাঁর জন্ম, বংশপরিচয়, কর্মস্থল, ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই ইসরাঈলীয় বর্ণনা বা গল্পকারদের বানোয়াট কাহিনী। বিশেষ করে আমাদের সমাজে প্রসিদ্ধ আছে যে, চারজন নবী চিরজীবিঃ খিযির ও ইলিয়াস(আ) পৃথিবীতে এবং ইদরীস ও ঈসা(আ) আসমানে। প্রচলিত আছে যে, ইদরীস(আ) কে জীবিত অবস্থায় সশরীরে ৪র্থ বা ৬ষ্ঠ আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সেখানে জীবিত আছেন। অথবা সেখানে তাঁর মৃত্যু হয় এবং এরপর আবার জীবিত হন…….। এ সকল কথা সবই ভিত্তিহীন ইসরায়েলীয় রেওয়ায়াত। ঈসা(আ) ছাড়া অন্য কোনো নবীর জীবিত থাকা, জীবিত অবস্থায় আসমানে গমন ইত্যাদি কোনো কথা রাসূলুল্লাহ(সা) হতে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয়নি।
আল্লাহ তাঁকে উচ্চস্থানে উন্নীত করেছেন অর্থ তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। যে মর্যাদার একটি বিশেষ দিক হলো আল্লাহ তাঁকে ইন্তেকালের পরে অন্য কয়েকজন মহান নবী রাসূলের সাথে রূহানীভাবে আসমানে স্থান দান করেছেন। সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মি’রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ(সা) আসমানে ৮ জন নবীর সাথে সাক্ষাত করেন। ১ম আসমানে আদম, ২য় আসমানে ইয়াহইয়া, ৩য় আসমানে ইউসূফ, ৪র্থ আসমানে ইদরীস, পঞ্চম আসমানে হারূন, ৬ষ্ঠ আসমানে মূসা, ৭ম আসমানে ইবরাহীম(আ) এর সাথে সাক্ষাত হয়।(বুখারী, আস-সহীহ ১/১৩৬, ৩/১১৭৩,১২১৬-১২১৭,১৪১০-১৪১১; মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৪৮-১৫০)। শুধু ঈসা(আ) ব্যতীত অন্য সকল নবীকে এই মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল স্বাভাবিক মৃত্যুর পরে।(ইবনু কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া ১/৬১-৬২; দরবেশ হুত, আসনাল মাতালিব , পৃ. ২৫)।
১২. হুদ(আ) ও শাদ্দাদের বেহেশত
শাদ্দাদের জন্মকাহিনী, জীবনকাহিনী, শাদ্দাদের বেহেশতের লাগামহীন বিবরণ, বেহেশতে প্রবেশের পূর্বে তাঁর মৃত্যু ইত্যাদি যা কিছু কাহিনী বলা হয় সবই বানোয়াট, ভিত্তিহীন কথা। কিছু ইহুদীদের বর্ণনা ও কিছু জালিয়াতগণের কাল্পনিক গল্প কাহিনী। এ বিষয়ক কোনো কিছুই রাসূলুল্লাহ(সা) থেকে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়নি।
অনেকে আবার এই মিথ্যাকে আল্লাহর নামেও চালিয়েছেন। এক লেখক লিখেছেন, “সে বেহেশতের কথা স্বয়ং আল্লাহ তাআলাও কোরআন পাকে উল্লেখ করেছেন যে, হে মুহাম্মাদ! শাদ্দাদ পৃথিবীতে এমন বেহেশত নির্মাণ করেছিল, দুনিয়ার কোনো মানুষ কোনোদিনই ঐরূপ প্রাসাদ বানাতে পারেনাই…।”(মাও. মো. আশরাফুজ্জামান, ছহী কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ২৩৫; এম.এন.এম. ইমদাদুল্লাহ, আদি ও আসল কাছাছুল আম্বিয়া ১/৯৮)।
কি জঘন্য মিথ্যা কথা! আল্লাহর কালামের কি জঘন্য বিকৃতি!! এখানে কুরআন কারীমের সূরা ফাজরের ৬-৭ আয়াতের অর্থকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলত অনেক মুফাসসির এ আয়াতের তাফসীরে সনদবিহীনভাবে এ সকল বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী উদ্ধৃত করেছেন। আবার ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে এগুলি উল্লেখ করা হয়েছে। সবই মিথ্যা কথা।
এ বিষয়ে ইমাম ইবনু কাসীর বলেনঃ “অনেক মুফাসসির এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইরাম শহর সম্পর্কে এ সকল কথা বলেছেন। এদের কথায় পাঠক ধোঁকাগ্রস্থ হবেননা। ….এ সকল কথা সবই ইসরায়েলীয়দের কুসংস্কার ও তাদের কোনো কোনো যিনদীকের বানোয়াট কল্প কাহিনী। এগুলি দিয়ে তারা মূর্খ সাধারণ জনগণের বুদ্ধি যাচাই করে, যারা যা শোনে তাই বিশ্বাস করে।”(ইবনু কাসীর, তাফসীর ৪/৫০৯)।
১৩. ইবরাহীম(আ)
১৩.১. ইবরাহীম(আ) এর পিতা যেখানে আল্লাহ কুরআনকে তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিল এর বিশুদ্ধতা বিচারের মানদন্ড বলে ঘোষণা করেছেন, সেখানে কোনো কোনো তাফসীরকারক বা আলেম বাইবেল এর বর্ণনাকে বিশুদ্ধতার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করে তার ভিত্তিতে কুরআনের বর্ণনাকে ব্যাখ্যা করেন। এর একটি জঘন্য উদাহরণ হলো ইবরাহীম(আ)এর পিতার নাম। মহান আল্লাহ বলেনঃ (*******)
-“এবং যখন ইবরাহীম তাঁর পিতা আযরকে বললেন।”(সূরা আনআমঃ আয়াত ৭৪)।
এখানে সুস্পষ্টভাবে ইবরাহীম এর পিতার নাম আযর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাইবেলে বলা হয়েছে যে, ইবরাহীম(আ) এর পিতার নাম ছিল ‘তেরহ’।(বাইবেল, আদি পুস্তক ১১/২৪-৩২)। কুরআন কারীমে সাধারণত নব্যূয়ত, দাওয়াত ও মু’জিযা বিষয়ক তথ্য ছাড়া নবীগণের পিতা, মাতা, জন্মস্থান, জীবনকাল ইত্যাদি বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্য আলোচনা করা হয়না। কখনো কখনো ইহুদীদের মিথ্যাচারের প্রতিবাদের জন্য কিছু তথ্য প্রদান করা হয়। যেমন ইহুদীরা তাদের বাইবেল বিকৃত করে লিখেছে যে, আল্লাহ ৬ দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং ৭ম দিনে বিশ্রাম করেন। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে আল্লাহর কোন শ্রম হয়নি বা বিশ্রামের প্রয়োজন হয়নি।
এখানে ইবরাহীমের পিতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ সম্ভবত ইব্রাহীমের পিতার নামের ক্ষেত্রে ইহুদীদের ভুলটি তুলে ধরা। সর্বাবস্থায় মুমিনের জন্য কুরআন হাদীসের বর্ণনার পরে আর কোনো বর্ণনার প্রয়োজন হয়না। এ জন্য অধিকাংশ প্রাজ্ঞ মুফাসসির বলেছেন যে, ইবরাহীম(আ) এর পিতার নাম ‘আযর’ ছিল। কুরআনের এই তথ্যই চূড়ান্ত। ইহুদী-খৃস্টানদের তথ্যের দিকে দৃষ্টি দেয়ার কোনোই প্র্রয়োজন মুসলিম উম্মাহর নেই। বাইবেলের বর্ণনায় প্রভাবিত হয়ে কোনো কোন মুফাসসির সমন্বয় করতে চেয়েছেন। কেউ বলেছেন যে, ‘আযর’ ও ‘তেরেহ’ দুইটিই ইবরাহীম(আ) এর পিতার নাম ছিল। যেমন ইয়াকূব(আ) এর আরেকটি নাম ছিল ইস্রাঈল। কেউ বলেছেন, একটি ছিল তাঁর উপাধি, অপরটি নাম। অনুরূপ আরো কিছু মতামত আছে। এ সকল ব্যাখ্যায় কুরআনের বর্ণনাকে বিকৃত করা হয়নি। সকলেই একমত যে, এখানে ‘তাহার পিতা’ বলতে ইব্রাহীমের জন্মদাতা পিতাকে বুঝানো হয়েছে এবং ‘আযর’ তারই নাম অথবা উপাধি……।(ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/১৫০-১৫১, তাবারী, তাফসীর ৭/২৪২-২৪৯)।
তবে সবচেয়ে জঘন্য ও মিথ্যা একটি মত প্রচলিত আছে যে, বাইবেলের বর্ণনাই ঠিক। ইবরাহীমের পিতার নাম তেরহ ছিল, তার নাম কখনোই আযর ছিলনা। তারা কুরআনের বর্ণনাকে সরাসরি মিথ্যা না বলে এর একটি উদ্ভট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, ইবরাহীমের এক চাচার নাম ছিল আযর। কুরআনে চাচাকেই পিতা বলা হয়েছে। এভাবে তারা বাইবেলের বর্ণনাকে বিশুদ্ধতার মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করে কুরআনে কারীমের স্পষ্ট অর্থকে বিকৃত করেছেন।
পিতা অর্থ চাচা বলা মূলত কুরআনের অর্থ বিকৃতি করা এবং কোনো প্রকার প্রয়োজনীয়তা ছাড়া স্পষ্ট অর্থকে অস্বীকার করা। কোনো কোনো ব্যতিক্রম স্থানে চাচাকে পিতা বলার দূরবর্তী সম্ভাবনা থাকলেও আমাদেরকে দুটি বিষয় মনে রাখতে হবেঃ প্রথমত, নিজের জন্মদাতা পিতা ছাড়া কাউকে নিজের পিতা বলা বা নিজেকে তার সন্তান বলে দাবি করা হাদীস শরীফে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কুরআনের স্পষ্ট অর্থ অন্যান্য আয়াত বা হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ ছাড়া রূপক বা ঘোরালো ভাবে ব্যাখ্যা করা বিকৃতির নামান্তর। সহীহ বুখারীতে সংকলিত হাদীস থেকেও আমরা জানতে পারি যে, আযরই ইবরাহীমের জন্মদাতা পিতা এবং এই আযরকেই ইবরাহীম হাশরের ময়দান ভৎসর্ণা করবেন এবং একটি জন্তুর আকৃতিতে তাকে জাহান্নামে ফেলা হবে। (বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২২৩; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/৫০০)।
এই বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা সমর্থন করার জন্য কেউ কেউ দাবি করেন যে, ইবরাহীমের জন্মদাতা পিতা কাফির ছিলেননা; কারণ আদম(আ) হতে রাসূলুল্লাহ(সা) পর্য্ন্ত তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কাফির মুশরিক ছিলেননা। এই কথাটি ভিত্তিহীন এবং কুরআন কারীম, সহীহ হাদীস ও ঐতিহাসিক তথ্যাদির সুস্পষ্ট বিপরীত। কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীসে বারংবার ইবরাহীমের পিতাকে কাফির বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ(সা) এর দাদা আবদুল মুত্তালিব কুফরী ধর্মের উপর ছিলেন বলে বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ(সা) তাঁর চাচা আবূ তালিবকে মৃত্যুর সময়ে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করে বলেন-আমি আব্দুল মুত্তালিব এর ধর্মের উপরই থাকব।(বুখারী, আস-সহীহ ১/৪৫৭, মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫৪)। স্বভাবতই আমর ইবনু লুহাই এর যুগ হতে আব্দুল মুত্তালিব এর যুগ পর্য্যন্ত পূর্বপুরুষগণও শিরকের মধ্যে লিপ্ত ছিলেন, যদিও তাঁরা সততা, নৈতিকতা, জনসেবা ইত্যাদির জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।(ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন নববিয়্যাহ ১/৯৩-৯৪)। রাসূলুল্লাহ(সা) এর পূর্বপুরুষগণ সকলেই অনৈতিকতা, ব্যভিচার ও অশ্লীলতা মুক্ত ছিলেন।(তাবারী, আত তাফসীর ১১/৭৬, ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৪০৪)।
১৩.২. ইবরাহীম(আ) এর তাওয়াক্কুল
ইবরাহীম(আ) এর নামে বানোয়াট একটি গল্প আমাদের মধ্যে প্রচলিত। এই ঘটনায় বলা হয়েছে, তাঁকে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তখন জিবরাঈল(আ) এসে তাঁকে বলেনঃ আপনার কোনো প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলুন। তিনি বলেনঃ আপনার কাছে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। জিবরাঈল(আ) বলেন, তাহলে আপনার প্রভুর কাছে আপনি প্রার্থনা করুন। তখন তিনি বলেনঃ “তিনি আমার অবস্থা জানেন, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। অতএব আমার আর কোনো প্রার্থনার প্রয়োজন নেই।”
এই কাহিনীটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী, সনদহীনভাবে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। মুহাদ্দিসগণ একে জাল বলে গণ্য করেছেন। কুরআন কারীমে হযরত ইবরাহীম(আ) এর অনেক দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি কখনো কোনো প্রয়োজনে দোয়া করেননি এরূপ কোনো ঘটনা কুরআন বা হাদীসে বর্ণিত হয়নি।(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৫০, আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/১৩৬)।
‘তাওয়াক্কুল’ এর নামে দোয়া পরিত্যাগ করা কুরআন ও হাদীস শিক্ষার বিপরীত। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সকল বিষয় আল্লাহর কাছে চাইতে হাদীস শরীফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সকল বিষয় বিস্তারিত জানতে পড়ুন ‘রাহে বেলায়েত’ বইটি।
১৩.৩. পুত্রের গলায় ছুরি চালানো
কুরআন কারীমে সূরা ‘সাফফাত’ এ মহিমাময় আল্লাহ ইবরাহীম(আ) কর্তৃক পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। এরশাদ করা হয়েছেঃ“(ইবরাহীম বলল)হে আমার প্রতিপালক, আমাকে এক সৎকর্ম পরায়ণ সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাকে এক স্থির বুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তাঁর পিতার সঙ্গে কাজ করবার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহীম বলল, বৎস আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবাই করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল? সে বলল, হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করল, তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, হে ইবরাহীম, তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করে থাকি।(সূরা ৩৭: সাফফাত, ১০০-১০৫ আয়াত)।
এখানে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক মিথ্যা ও কুরআন হাদীসের বিপরীত কথা আমাদের সমাজে হাদীস ও তাফসীর হিসেবে প্রচলিত। কয়েকটি বিষয়ের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
প্রথমত, কুরআন কারীমে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম তাঁর পুত্রকে যবাই করতে স্বপ্নে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম স্বপ্নে দেখেন যে, ‘তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কুরবানী কর।’ এই কথাটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে এই প্রকারের কোনো বিবরণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়না।
দ্বিতীয়ত, কুরআন কারীমে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম তাঁর পুত্রকে জানান যে, তিনি তাকে জবাই করার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে দাওয়াত খাওয়া…..ইত্যাদি মিথ্যা কথা বলে ঘর হতে বের করে নিয়ে যান।…..সর্বশেষ তিনি পুত্রকে সত্য কথা জানান। এ সকল কথা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) কর্তৃক বর্ণিত হয়নি। এ ছাড়া এই কথাগুলি নবীগণের মর্যাদার খেলাফ। আল্লাহর খলীল তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে কেন মিথ্যা কথা বলবেন?
তৃতীয়ত, প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম(আ) পুত্র ইসমাঈলকে দড়ি দিয়ে ভাল করে বাঁধেন। এরপর শুইয়ে তাঁর গলায় বারংবার ছুরি চালান………। এগুলি সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। কুরআনে তো স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে যে, জবাই করার প্রস্তুতি নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহর পক্ষ হতে আহবান এসে যায়। কোনো ছুরি চালানোর ঘটনা ঘটেনি। হাদীস শরীফেও বর্ণিত হয়েছে যে, জবাইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়েই আল্লাহর পক্ষ হতে বিকল্প জানোয়ার প্রদান করা হয়।(ইবনু কাসীর, তাফসীর ৪/১৬)।
এ বিষয়ে ত্রয়োদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ সিরীয় মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হুত(১২৭৬ হি) বলেন, হযরত ইবরাহীম(আ) এর বিষয়ে যে গল্প প্রচলিত আছে যে, তিনি তাঁর পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন, কিন্তু কাটেনি……এই গল্পটি জাল, মিথ্যা এবং যিন্দীকদের বানানো…।(দরবেশ হুত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৮৩-২৮৪)।
১৪. আইউব (আ) এর বালা মুসীবত
কুরআনে বলা হয়েছে যে, আইঊব(আ) বিপদগ্রস্ত হয়ে সবর করেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং তাকে বিপদাপদ থেকে উদ্ধার করেন। তাঁকে তাঁর সম্পদ ও সন্তান ফিরিয়ে দেন।(সূরা আম্বিয়া, ৮৩-৮৪ আয়াত;সূলা সাদ, ৪১-৪৪ আয়াত)।
আইঊব(আ) এর বালা মুসিবত বা বিপদাপদের ধরণ, প্রকৃতি, বিবরণ, সময়কাল, তাঁর স্ত্রীর নাম, আত্মীয় স্বজনের নাম ইত্যাদি সম্পর্কিত কোনো বর্ণনা কুরআন কারীম বা সহীহ হাদীসে নেই। এ বিষয়ক যা কিছু বলা হয় সবই মূলত ইসরায়েলীয় রেওয়ায়াত। অধিকাংশ বিবরণের মধ্যে লাগামহীন কাল্পনিক বর্ণনা রয়েছে। বিভিন্ন মুফাসসির এ বিষয়ে বিভিন্ন কথা বলেছেন। বিশেষত, ওয়াহব ইবনু মুনাব্বিহ, কা’ব আল-আহবার প্রমুখ তাবিয়ী আলিম, যারা ইহুদী ধর্ম হতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ ও তাঁদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন তাঁরাই এ সকল গল্প ‘গল্প’ হিসেবে বলেছেন।(ইবনু কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া ১/২৩০-২৩৬; আবূ শুহবাহ, আল ইসরাইলিয়্যাত, পৃ. ২৭৫-২৮২)।
এগুলিকে গল্প হিসেবে বলা যেতে পারে। কিন্তু কখনোই সত্য মনে করা যাবেনা। বিশেষত এ সকল গল্পে আইয়ূব(আ) এর রোগব্যাধির এমন কাল্পনিক বিবরণ দেওয়া হয়েছে যা একজন নবীর মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোনো সহীহ হাদীসে বর্ণিত হলে আমরা তা গ্রহণ করতাম ও ব্যাখ্যা করতাম। কিন্তু যেহেতু সহীহ হাদীসে এ বিষয়ে কিছুই বর্ণিত হয়নি এবং এগুলি ইসরায়েলী বর্ণনা ও রেওয়ায়াতদের গল্প, সেহেতু এগুলি পরিত্যাজ্য। এ বিষয়ে দরবেশ হুত(১২৭৬ হি) বলেন, “আইঊব(আ) এর গল্পে বলা হয় যে, আল্লাহ তাঁর উপরে ইবলীসকে ক্ষমতাবান করে দেন। তখন ইবলীস তাঁর দেহের মধ্যে ফুঁক দেয়। এতে তাঁর দেহ কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি তার শরীরের মাংস পচে যায় এবং পোকা পড়তে থাকে……ইত্যাদি। এগুলি গল্পকাররা বলেন এবং কোনো কোনো মুফাসসির উল্লেখ করেছেন।…..এ সকল কথা সবই নির্ভেজাল জাল, মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। যেই এ কথা বলুন বা উদ্ধৃত করুননা কেন, তাঁর মর্যাদা যতই বেশি হোকনা কেন, তাতে কিছু যায় আসেনা। এ সকল কথা আল্লাহর কিতাবে বলা হয়নি এবং তাঁর রাসূলের(সা) কোনো হাদীসেও বর্ণিত হয়নি। এমনকি কোনো যয়ীফ বা বাতিল সনদের হাদীসেও তা বর্ণিত হয়নি। এ সবই সনদবিহীন বর্ণনা….।”(দরবেশ হুত, আসনাল মাতাবিল, পৃ. ২৮৪)।
১৫. দায়ূদ (আ) এর প্রেম
নবী দায়ূদ(আ) এর সম্পর্কে একটি অত্যন্ত নোংরা গল্প বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ ও পরবর্তী যুগের দুই একটি হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায়। গল্পটি মূলত ইহুদীদের বাইবেল থেকে ও তাবিয়ীগণের যুগে বিদ্যমান ইহুদী আলেমদের মুখ থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো গ্রন্থে এই ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামেও প্রচার করা হয়েছে।
ইহুদীদের নোংরামির একটি অন্যতম দিক হলো তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও যাবূর এর মধ্যে তাদেরই নবী-রাসূলগণের নামে ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য অশ্লীল গল্প কাহিনী লিখে রেখেছে। এ সকল গল্প রামায়ণ মহাভারতের দেবদেবীর পাপাচারের কাহিনীকেও হার মানায়। সেগুলির মধ্যে একটি হলো দায়ূদ(আ) এর নামে প্রেম, ব্যভিচার ও হত্যার কাহিনী। এই গল্পটিই মুসলিম সমাজে কিছুটা সংশোধিতরূপে প্রচারিত। গল্পরি সার সংক্ষেপ নিম্নরূপঃ একদিন দায়ূদ(আ) হঠাৎ করে একজন গোসলরত মহিলাকে একনজর দেখে ফেলেন। এতে তিনি মহিলাটির উপর অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পড়েন।মহিলাটির স্বামীর নাম ছিল উরিয়া যিনি একজন যোদ্ধা ছিলেন। দায়ূদ প্রধান সেনাপতির সাথে ষড়যন্ত্র করেন উরিয়াকে যুদ্ধের মাঠে হত্যা করার জন্য। এক পর্যায়ে উরিয়া নিহত হলে দায়ূদ উক্ত মহিলাকে বিবাহ করেন। (নাউজুবিল্লাহ)।(তাবারী, আত-তাফসীর ২৩/১৪; আল কুরতুবী, তাফসীর ১৫/১৬৬-১৮৫)। বাইবেলে এই ঘটনাটি আরো অনেক নোংরাভাবে লেখা হয়েছে।(বাইবেল, ২ শমূয়েল, ১১:১-২৭)।
এই ঘটনাটি শুধু মিথ্যা এবং নবীদের প্রকৃতি বিরোধীই নয়; উপরন্তু তা মানবীয় বুদ্ধিরও বিপরীত। একজন বিবেকবান বয়স্ক মানুষ যার অগণিত স্ত্রী রয়েছে এবং যিনি একজন জনপ্রিয় শাসক তিনি একটিবার মাত্র দৃষ্টি পড়ার ফলে এমনভাবে প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়বেন এবং এইরূপ হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেবেন তা কল্পনা করা যায়না।(মুহাম্মাদ আবূ শাহবাহ, আল ইসরাঈলীয়্যাত, পৃ. ২৬৪-২৭০)।
১৬. হারূত মারূত
ইহুদীগণের মধ্যে যাদুর প্রচলন ছিল। তারা আরো দাবি করতো যে, সুলাইমান(আ) যাদু ব্যবহার করেই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তারা আরো দাবি করতো যে, স্বয়ং সুলাইমান(আ) এবং হারূত ও মারূত নামক দুই ফেরেশতা তাদেরকে যাদু শিক্ষা দিয়েছিলেন। এদের এই মিথ্যাচারের প্রতিবাদে কুরআন কারীমের সূরা বাকারার ১০২ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছেঃ
وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَىٰ مُلْكِ سُلَيْمَانَ ۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَٰكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ ۚ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ ۖ
“এবং সুলাইমানের রাজত্বে শয়তানগণ যা আবৃত্তি করত তারা(ইহুদীরা) তা অনুসরণ করতো। সুলাইমান কুফরী করেনি বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত। এবং যা বাবিলে হারূত ও মারূত এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। তারা কাউকে শিক্ষা দিতেননা, এই কথা না বলা পর্য্যন্ত যে, ‘আমরা পরীক্ষা স্বরূপ, সুতরাং তোমরা কুফরী করিওনা।…”
এই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যায় সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগ হতেই মুফাসসিরগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস(রা) ও অন্য কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন যে, হারূত ও মারূতের উপর ব্যবহৃত আরবী অর্থ (না)। অর্থাৎ হারূত মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপরও যাদু অবতীর্ণ করা হয়নি। সুলাইমান(আ) সম্পর্কে যেমন ইহুদীদের দাবি মিথ্যা তেমনি হারূত ও মারূত সম্পর্কেও তাদের দাবি মিথ্যা।
তবে সাধারণভাবে মুফাসসিরগণ বলেছেন যে, ইহুদীগণ যখন কারামত মুযিজা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য না করে সবকিছুকেই যাদু বলে দাবি করতে থাকে তখন আল্লাহ দুইজন ফিরিশতাকে দায়িত্ব প্রদান করেন যাদুর প্রকৃতি এবং যাদু ও মুজিযার মধ্যে পার্থক্য শিক্ষা দানের জন্য। তারা মানুষদের এই পার্থক্য শিক্ষা দিতেন এবং বলতেন, তোমরা এই জ্ঞানকে যাদুর জন্য ব্যবহার করে কুফরী করবেনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকেই যাদু ব্যবহারের কুফরীতে নিমগ্ন থাকতো।
কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, তাঁরা দুইজন মানুষ ছিলেন; বিশেষ জ্ঞান, পান্ডিত্য বা সৎকর্মশীলতার কারণে তাদেরকে মানুষ ফেরেশতা বলে অভিহিত করতো। তাঁরা এভাব মানুষকে যাদুর অপকারিতা শিক্ষা দিতেন।
হারূত ও মারূত সম্পর্কে কুরআনে আর কোনো কিছুই বলা হয়নি। সহীহ হাদীসেও এ বিষয়ে কিছু পাওয়া যায়না। কিন্তু এ বিষয়ক অনেক গল্প কাহিনী হাদীস নামে বা তাফসীর নামে তাফসীরের গ্রন্থগুলিতে বা সমাজে প্রচলিত। কাহিনীটির সারসংক্ষেপ হলো, মানবজাতির পাপের কারণে ফিরিশতাগণ আল্লাহকে বলেন, মানুষের এত অপরাধ আপনি ক্ষমা করেন কেন বা শাস্তি প্রদান করেননা কেন? আল্লাহ তাদেরকে বলেন, তোমরাও মানুষের প্রকৃতি পেলে এমন পাপ কাজ করতে। তারা বলেন, কক্ষনো না। তখন তারা পরীক্ষার জন্য হারূত ও মারূত নামক দুইজন ফিরিশতাকে নির্বাচিত করেন। তাদেরকে মানবীয় প্রকৃতি প্রদান করে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। তারা যোহরা নামক এক পরমা সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়ে মদপান, ব্যভিচার ও নরহত্যার পাপে জড়িত হন। পক্ষান্তরে যোহরা তাদের নিকট মন্ত্র শিখে আকাশে উড়ে যায়। তখন তাকে একটি তারকায় রূপান্তরিত করা হয়।………
এই গল্পগুলি মূলত ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীমালা। তবে কোনো কোনো তাফসীর গ্রন্থে এগুলি হাদীস হিসেবেও বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ক সকল হাদীসই অত্যন্ত দুর্বল ও জাল সনদে বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বিভিন্ন সনদের কারণে কয়েকটি বর্ণনাকে গ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। অনেক মুহাদ্দিস সবগুলিই জাল ও বানোয়াট বলে মত দিয়েছেন।
আল্লামা কুরতুবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস ও মুফাসসির উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল গল্প ফিরিশতাগণ সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বাসের বিপরীত। ইহুদী, খৃস্টান ও অন্যান্য অনেক ধর্মে ফিরিশতাগণকে মানবীয় প্রকৃতির বলে কল্পনা করা হয়। তাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্তশক্তি আছে বলেও বিশ্বাস করা হয়। ইসলামী বিশ্বাসে ফিরিশতাগণ সকল প্রকার মানবীয় প্রবৃত্তি, নিজস্ব চিন্তা বা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদের প্রবৃত্তি থেকে পবিত্র। তাঁরা মহান আল্লাহকে কিছু জানার জন্য প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা আল্লাহর কোনো কর্ম বা কথাকে চ্যালেঞ্জ করবেন এরূপ কোনো প্রকারের প্রকৃতি তাদের মধ্যে নেই। কাজেই এ সকল কাহিনী ইসলামী আকীদার বিরোধী।
এ বিষয়ে আল্লামা ইবনু কাসীর ও অন্যান্য কতিপয় মুহাদ্দিস সকল বর্ণনা একত্রিত করে তুলনামূলক নিরীক্ষার ভিত্তিতে বলেছেন যে, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে কোনো প্রকার সহীহ হাদীস বা নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়নি। তাঁর নামে বর্ণিত এ বিষয়ক হাদীসগুলি জাল। তবে সাহাবীগণ থেকে তাঁদের নিজস্ব কথা হিসেবে এ বিষয়ে কিছু কিছু বর্ণনার সনদ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। একথা খুবই প্রসিদ্ধ যে, এ সকল বিষয়ে কোনো কোনো সাহাবী (রা) ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন কাহিনী শুনতেন ও বলতেন। সম্ভবত এ সকল বর্ণনার ভিত্তিতেই তারা এগুলি বলেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।(তাবারী, ১/৪৫১-৪৬৪; ইবনু কাসীর, ১/১৩৫-১৪৪)।
পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের বিষয়ে আরো অনেক বানোয়াট গল্প এবং ইসরাঈলীয় বর্ণনা আমাদের সমাজে প্রচলিত। ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ জাতীয় বই পুস্তক এই সকল মিথ্যা কাহিনীতে ভরপুর। সেগুলির বিস্তারিত আলোচনার জন্য অনেক বৃহৎ পরিসরের প্রয়োজন। আপাতত এখানেই এই বিষয়ক আলোচনা শেষ করেছি।