২.১৮. বিবাহ, পরিবার, সমাজ ইত্যাদি বিষয়ক
২.১৮.১. বিবাহ, পরিবার ও দাম্পত্য জীবন
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিবার। পরিবার গঠন, পরিবারের সদস্যগণের পারস্পরিক দায়িত্ব, কর্তব্য, সহমর্মিতা, স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক দায়িত্ব, দাম্পত্য জীবনের আনন্দ ও তৃপ্তির ফযীলত ইত্যাদি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অনেক নির্দেশনা বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলির পাশাপাশি অগণিত বানোয়াট, ভিত্তিহীন, জাল বা যয়ীফ কথা হাদীস নামে সমাজে প্রচলিত। সবচেয়ে বেশি অবাক হতে হয় যে, প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থগুলির সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে অগণিত সূত্র বিহীন বানোয়াট কথা আমরা বিভিন্ন গ্রন্থে লিখছি বা মুখে বলছি।
বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিভিন্ন বিষয়ে সহীহ হাদীসের উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু সংক্ষেপে কিছু বানোয়াট কথা উল্লেখ করছি।
১. বিবাহিতের দুই রাক‘আত অবিবাহিতের ৭০ রাক‘আত
প্রচলিত একটি জাল হাদীসঃ “অবিবাহিতের ৭০ রাক‘আত অপেক্ষা বিবাহিতের দুই রাক‘আত উত্তম।”
২. বিবাহিতের দুই রাক‘আত অবিবাহিতের ৮২ রাক‘আত
আরেকটি প্রচলিত জাল হাদীসঃ “অবিবাহিতের ৭০ রাক‘আত অপেক্ষা বিবাহিতের দুই রাক‘আত উত্তম।”
কুরআন ও হাদীসে বিবাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বিবাহের ফযীলতও বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই হাদীস দুটি জাল ও বানোয়াট।(ইবনুল জাওযী, আল মাঊদূ‘আত ২/১৬৪; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/২১; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ৫/১৫)।
৩. বিবাহ অনুষ্ঠানে খেজুর ছিটানো, কুড়ানো বা কাড়াকাড়ি করা
এ বিষয়ে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে কোনো সহীহ হাদীস নেই। হাদীসগুলির সনদ অত্যন্ত যয়ীফ এবং সনদে মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। এজন্য মুহাদ্দিসগণ সেগুলিকে জাল বলে গণ্য করেছন।(তাবারানী, আল-আউসাত ১/৪৪; ইবনুল জাওযী, আল মাউদূ‘আত ২/১৭০-১৭২; যাহাবী, মীযানুল ইতদাল ২/২৩; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ২/১৯)।
৪. দাম্পত্য মিলনের বিধিনিষেধ
ইসলাম যেমন বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক কঠোরভাবে নিষেধ করে, তেমনি বিবাহিত দম্পতিকে তাদের জীবন ও যৌবনের আনন্দ, উল্লাস, ফূর্তি, আবেগ সবকিছু উপভোগ করতে উৎসাহ দেয়। দম্পতির স্বাভাবিক আনন্দলাভের কোনো দিন, তারিখ, বার, তিথি, সময়, উপকরণ বা পদ্ধতি ইসলাম নিষিদ্ধ বা হারাম করে নি। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কোনোরূপ পর্দা নেই বা কোনো কিছু দর্শন বা স্পর্শ করার নিষেধাজ্ঞা নেই।
প্রচলিত অনেক জাল, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীসে দাম্পত্য মিলন বিষয়ক বিভিন্ন মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। অমুক সময়ে, অমুক দিনে, অমুক বারে, অমুক রাতে, অমুক তিথিতে দাম্পত্য সম্পর্ক করবে না, তাতে অমুক প্রকারের ক্ষতি হবে, অথবা সন্তানের অমুক রোগ হবে….ইত্যাদি। অথবা অমুক পদ্ধতিতে বা অমুক আসনে দাম্পত্য মিলন করবে না, তাহলে অমুক ক্ষতি হবে বা সন্তানের অমুক খুত হবে…. ইত্যাদি। অথবা দাম্পত্য মিলনের সময় কথা বলবে না, দৃষ্টিপাত করবে না……স্পর্শ করবে না……তাহলে অমুক রোগ হবে, বা অমুক ক্ষতি হবে…ইত্যাদি। অথবা অমুক সময়ে, বারে, তিথিতে দাম্পত্য মিলনে সন্তান সৌভাগ্যবান বা দুর্ভাগ্যবান হয়…..। এগুলি সবই মিথ্যা, বানোয়াট ও জাল কথা।
সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মদীনার ইহুদীগণের মধ্যে এরূপ কিছু কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। তখন মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে সূরা বাকারা ২২৩ নং আয়াত নাযিল করে সেসকল কুসংস্কার খন্ডন করেন।(মুসলিম, আস-সহীহ ২/১০৫৯; ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/২৬২; ইবনুল জাওযী, আল-মাঊদূ‘আত ২/১৭৫-১৭৬; আলবানী, যায়ীফাহ ১/৩৫১-৩৫৬)।
৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
বহুল প্রচলিত একটি পুস্তকে রয়েছেঃ “হযরত (ﷺ) বলিয়াছেন, স্ত্রীগণের বেহেশত স্বামীর পায়ের নীচে।”(মাও. গোলাম রহমান, মোকছুদুল মোমেনীন, পৃ. ৩২৮)।
এই কথাটি একটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাঊযূ সনদেও এই কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা হতে বুঝা যায় যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জান্নাত উভয়ের হাতে। উভয়ের প্রতি উভয়ের দায়িত্ব পালন ও অধিকার আদায়ের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব।
৬. গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের পুরস্কার
কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে মাতৃগর্ভের মর্যাদার বিষয়ে বিশেষভাবে সন্তানধারণ, দুগ্ধপান ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে সাধারণভাবে সংসার পালন, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদির সাধারণ সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জালিয়াতগণ তাদের অভ্যাস মত প্রত্যেক কর্ম বা অবস্থার জন্য পৃথক পৃথক আজগুবি ফযীলত ও সাওয়াবের বর্ণনা দিয়ে অনেক হাদীস বানিয়েছে। আমাদের সমাজে এগুলি প্রচলিত। এমনকি এ সকল ভিত্তিহীন কথা দিয়ে বিভিন্ন ছাপানো পোস্টার, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি ছাপা হয়।
প্রচলিত একটি পুস্তকে রয়েছেঃ “হুযুর(ﷺ) একদিন স্ত্রীলোকদের লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছিলেন, যখন কোনো স্ত্রীলোক তাহার স্বামী কর্তৃক হামেলা(গর্ভবতী) হইয়া থাকে, তখন হইতে প্রসব বেদনা উপস্থিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সর্বদা সে স্ত্রীলোকটি দিনে রোযা রাখার ও রাত্রি বেলা নফল নামায পড়ার ছওয়াব পাইবে। আর যখন প্রসব বেদনা উপস্থিত হয় তখন খোদা তায়ালা তাহার জন্য বেহেশতের মধ্যে এমন বস্তুসমূহ গচ্ছিত রাখিয়া দেন যে, তাহার সন্ধান পৃথিবী আকাশ বেহেশত, দোজখবাসী কেহই অবগত নহেন। আর যখন সন্তান প্রসব করেন তখন হইতে দুগ্ধ ছাড়ান পর্যন্ত প্রতি ঢোক দুগ্ধের পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা তাহাকে একটি করিয়া নেকী দান করেন। এবং সেই সময়ের মধ্যে তাহার মৃত্যু হইলে শহীদের দরওয়াজা প্রাপ্ত হইবে। আর যদি তাহাকে তাহার সন্তানের জন্য কোনো রাত্রি জাগিয়া থাকিতে হয় তবে আল্লাহ তায়ালা তাহাকে ঐ রাত্রি জাগরণের পরিবর্তে ৭০টি গোলাম আজাদ করার ছওয়াব দিয়া থাকেন। তৎপর তিনি ইহাও বলিয়া ছিলেন যে, এই ছওয়াব সমূহ কেবল মাত্র ঐ সমস্ত স্ত্রী লোকদেরকে দেওয়া হইবে যাহারা সর্বদাই খোদার হুকুম ও আপন স্বামীর হুকুম পালন করিয়া আওরাতে হাছীনার অন্তর্ভূক্ত হইতে পারিয়াছে। আল্লাহ ও স্বামীর নাফরমান স্ত্রীলোকদিগকে কখনও ঐ সমস্ত ছওয়াব দেওয়া হইবে না।”(মাও. গোলাম রহমান, মকছুদুল মোমেনীন পৃ. ৩৩১-৩৩২)।
এই কথাটি একটি জাল হাদীসের ইচ্ছামাফিক অনুবাদ।(ইবনুল জাওযী, আল মাউদূ‘আত ২/১৭৮; সুয়ূতী, আল লাআলী ২/১৭৪-১৭৫; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/২০৩-২০৪, ২১১)।
এছাড়া আরো অনেক আজগুবি, মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা হাদীসের নামে লিখে এ সকল পুস্তকের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মসীলিপ্ত করা হয়েছে। এ সকল পুস্তকে হাদীস নামে লেখা অধিকাংশ কথাই বানোয়াট ও জাল।
২.১৮.২. বয়সের ফযীলত ও বয়স্কের সম্মান
কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন সামাজিক শিষ্ঠাচারের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো, বয়স্কদের সম্মান করা। বিভিন্ন হাদীসে যার বয়স বেশি তাকে আগে কথা বলার সুযোগ দেওয়া, কোনো দ্রব্য তার হাতে আগে দেওয়া বা অনুরূপ সামাজিক কর্মে ও সম্মানে অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বয়স্ক ও বৃদ্ধদেরকে সম্মান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সহীহ হাদীসের মধ্যে রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি আমাদের মধ্যকার ছোটদের মমতা না করবে এবং বড়দের অধিকার না জানবে(বড়দের সম্মান না করবে) সে আমাদের দলভুক্ত নয়।(হাকিম, আল মুসতাদরাক ১/১৩১; তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৩২১-৩২২)।
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ “আল্লাহকে মর্যাদা প্রদর্শনের অংশ হলো শুভ্রতাময় (সাদা চুল দাড়িওয়ালা) বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা…..।”(আবু দাউদ, আস সুনান ৪/২৬১; আলবানী, সহীহুল জামি ১/৪৩৮)।
১. বৃদ্ধের সম্মান আল্লাহর সম্মান
কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের মত এ বিষয়েও জালিয়াতগণ জাল হাদীস তৈরি করেছে। এ বিষয়ক জাল ও অত্যন্ত দুর্বল হাদীসগুলির মধ্যে রয়েছেঃ “তোমরা শাইখ বা বৃদ্ধ মানুষদেরকে সম্মান করবে; কারণ বৃদ্ধদের সম্মান করা আল্লাহর সম্মানের অংশ।”
এই হাদীসটির অর্থ উপরের নির্ভরযোগ্য হাদীসগুলির কাছাকাছি। তবে এই শব্দে কোনো হাদীস রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে বর্ণিত হয় নি। এজন্য মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই শব্দে হাদীসটি জাল।(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ২০৭)।
২. বংশের মধ্যে বৃদ্ধ উম্মতের মধ্যে নবীর মত
এ বিষয়ে অন্য একটি জাল হাদীসঃ “কোনো কওম বা গোত্রের মধ্যে শাইখ বা বয়স্ক মুরুব্বী ব্যক্তি উম্মাতের মধ্যে নবীর মতই।” (ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ২০৭-২০৮)।
শাইখ বলতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর যুগে বা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত দুটি অর্থ বুঝানো হতো। প্রথম অর্থ হলো ‘বৃদ্ধ বক্তি’। এ হলো এই শব্দে মূল শাব্দিক বা ব্যবহারিক অর্থ। দ্বিতীয় অর্থ হলোঃ গোত্রপতি। পরবর্তী যুগে সুফী বুযুর্গগণকেও শাইখ বলা হতো। ফার্সী ‘পীর’ শব্দটিও এই অর্থের।
‘শাইখ’ শব্দটি তৃতীয় অর্থে ব্যবহার করা শুরু হওয়ার পরে এই হাদীসটির জালিয়াতি সম্পর্কে অসচেতন কেউ কেউ এই জাল হাদীসটিকে তরীকতের শাইখ বা পীর মাশাইখদের মর্যাদার দলীল হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। আমরা জানি যে, পীর মাশাইখদের মর্যাদা রয়েছে নেককার বান্দা হিসেবে এবং আল্লাহর পথের উস্তাদ বা মুরশিদ হিসেবে। তবে এই জাল হাদীসটির সাথে তাদের মর্যাদার কোনো সম্পর্ক নেই।
৩. পাকাচুল বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার শাস্তি মাফ
এই জাতীয় অন্য একটি বানোয়াট কথা। আল্লাহ বলেনঃ “আমি লজ্জা পাই যে, ইসলামের মধ্যে আমার বান্দার চুল দাড়ি পেকে যাওয়ার পরও আমি তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দেব।”(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ২০৪-২০৫)।
এই ধরনের অন্য একটি বানোয়াট কথাঃ “ইসলামের মধ্যে যার বয়স ৬০ বৎসর হলো, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামকে হারাম করে দিলেন।”(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ২২৭)।
৪. ৪০ বৎসর বয়সেও ভাল না হলে জাহান্নামের প্রস্তুতি
আরেকটি বানোয়াট কথাঃ “যার বয়স চল্লিশ হলো, অথচ তার মধ্যে খারাপের চেয়ে ভাল বেশি হলো না; সে জাহান্নামের জন্য প্রস্তুত হোক।”(ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/২০৫-২০৬)।