২.১৩. যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ বিষয়ক
২.১৩.১. যাকাত বিষয়ক
১. মুমিনের জমিতে খারাজ ও উশর একত্রিত হয় না
একজন মুসলমানকে তার ভূ-সম্পদের উৎপাদনের ৫% বা ১০% অংশ যাকাত প্রদান করতে হয়। ফল ও ফসলের যাকাতকে ‘উশর’ বলা হয়। অমুসলিমদেরকে ‘যাকাত’ দিতে হয় না। অমুসলিমদেরকে যাকাত দিতে হয় না। এজন্য মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে তার ভূ-সম্পত্তির ‘খারাজ’ প্রদান করতে হয়। ‘খারাজ’ সাধারণত উশরের দ্বিগুণ হয়। কোনো অমুসলিমের জমি যদি কোনো মুসলিম ক্রয় করেন তবে তাকে উশর ও খারাজ উভয়ই প্রদান করতে হবে, নাকি শুধু খারাজ প্রদান করতে হবে সে বিষয়ে তাবেয়ীগণের যুগ থেকে ফকীহগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশ তাবেয়ী ও ইমাম বলেছেন, তাকে খারাজ ও উশর উভয়েই প্রদান করতে হবে। তাবিয়ী ইকরিমাহ, ইবরাহীম নাখায়ী ও ইমাম আবূ হানীফা(রা)বলেছেন, তাকে শুধুমাত্র খারাজ প্রদান করতে হবে। (পড়ুন লেখকের অন্য বইঃ বাংলাদেশে উশর বা ফসলের যাকাতঃ গুরুত্ব ও প্রয়োগ)।
এ বিষয়ে একটি হাদীস আলেমদের মধ্যে প্রচলিত। ৫ম হিজরী শতক ও তার পরের কিছু ফকীহ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এই হাদীসটিকে ইবনু মাসঊদ(রা) এর সূত্রে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ “একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর ও খারাজ একত্রিত হবে না।”(ইবনু আদী, আল কামিল ৯/১২৭, বাইহাকী, আস সুনানুল কুবরা ৪/২২২)।
কিন্তু ইমাম যাইলায়ী ও হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ-সহ সকল মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই হাদীসটি বানোয়াট। রাসূলুল্লাহ(সা) বা ইবনু মাসঊদের বাণী বা কথা হিসেবে এই বাক্যটি বানোয়াট। প্রকৃতপক্ষে এই বাক্যটি হযরত ইবরাহীম নাখয়ীল(রাহ) কথা ও তাঁর মতামত। ইবরাহীম নাখয়ী ছাড়া আরো অন্যান্য তাবিয়ী হতেও এই মতটি বর্ণিত হয়েছে। (বিস্তারিতঃ বাংলাদেশে উশর বা ফসলের যাকাতঃ গুরুত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ৮৬-৮৭)।
ইমাম আবূ হানীফা(রাহ) এই কথাটি ইব্রাহীম নাখয়ী(রাহ) থেকে নাখয়ী’র নিজের মতামত হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং তা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেনঃ আমাকে হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান বলেছেন, ইব্রাহীম নাখয়ী বলেছেনঃ “একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর ও খারাজ একত্রিত হবে না।” এই পর্যন্ত কথাটি সহীহ। অর্থাৎ কথাটি ‘মাকতুয়’ হাদীস বা তাবেয়ীর কথা হিসেবে সহীহ।
কিন্তু পরবর্তী যুগের একজন রাবী ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ ইমাম আবূ হানীফার নামে বানোয়াটভাবে এই কথাটিকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা হিসেবে বর্ণনা করে। ইয়াহইয়া ইবুন আনবাসাহ বলেনঃ “আবূ হানীফা আমাদেরকে বলেছেনঃ হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান ইব্রাহীম নাখয়ী হতে, তিনি ‘আলকামাহ’ হতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবুন মাসঊদ হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন যে, “একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর ও খারাজ একত্রিত হবে না।”
এভাবে ইয়াহইয়া ইবুন আনবাসাহ একজন তাবেয়ীর বর্ণনাকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর বাণী বলেবর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ খুব সহজেই তার এই জালিয়াতি বা ভুল ধরে ফেলেন।
তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, ইমাম আবূ হানীফার(রাহ) অগণিত ছাত্রের কেউই এই হাদীসটি তাঁর নিকট হতে বর্ণনা করেন নি। তাঁর অন্যতম ছাত্র ইমাম আবু ইউসূফ ও মুহাম্মাদ(রাহ) তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে এই মাসআলাটির উপরে অনেক আলোচনা করেছেন, কিন্তু কোথাও উল্লেখ করেন নি যে, ইমাম আবূ হানীফা তাঁদেরকে এই হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(সা) হতে বর্ণনা করেছেন অথবা তিনি এই বিষয়ে কোনো হাদীসে নববীর উপরে নির্ভর করেছেন।
এখানেই মুহাদ্দিসগণের সন্দেহের শুরু। যদি একজন হাদীস বর্ণনাকারী কোনো প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস বা ফকীহ হতে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করেন যা তাঁর অন্য কোনো ছাত্র, বিশেষত যারা আজীবন তাঁর সাথে থেকেছেন তাঁরা কেউ বর্ণনা না করেন, তাহলে হাদীসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে সন্দিহান হন। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে তাঁরা দেখেন, যে বর্ণনাকারী একাই এই হাদীসটি বলেছেন তাঁর বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের ও তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের অবস্থান কি? এখানে তাঁরা দেখতে পেলেন যে, ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ জীবনে যতগুলি হাদীস বর্ণনা করেছেন সবই ভুল বা বানোয়াট। তিনি বিভিন্ন প্রখ্যাত ও বিশ্বস্ত আলিম ও মুহাদ্দিসের নামে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন যা অন্য কেউ করেন নি। তিনি অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস এভাবে বিভিন্ন বানোয়াট সনদে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত সকল হাদীসকে মুহাদ্দিসগণের বর্ণিত হাদীসের সাথে তুলনামূলক নিরীক্ষা করে এবং তাঁর ব্যক্তিজীবন পর্যালোচনা করে মুহাদ্দিসগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, এই হাদীসটিও তিনি ইমাম আবূ হানীফার নামে বানিয়েছেন। এজন্যই ৩য় ও ৪র্থ হিজরী শতকের কোনো হানাফী ইমাম বা ফকীহ এই হাদীসটিকে দলীল হিসেবে পেশ করেন নি। (ইবনু আদী, কামিল ৯/১২৭; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৪/২২২; ইবনুল জাওযী, আল-মাঊদূ‘আত ২/৬৯-৭০; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১১৮; সুয়ূতী আল লাআলী ২/৭০)।
২. অলঙ্কারের যাকাত নেই
ব্যবহৃত অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে কি না সে বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ হতে ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হযরত জাবির ও অন্য কয়েকজন সাহাবী বলতেন যে, অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে না। অপরদিকে অন্য অনেক সাহাবী বলতেন যে, অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে।
এক্ষেত্রে যারা অলঙ্কারের যাকাত ফরয নয় বলে মত প্রকাশ করেন তাদের পক্ষে একটি হাদীস বর্ণিত ও প্রচলিত। জাবির(রা) এর নামে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, “অলঙ্কারের যাকাত নেই।”
হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা নয়। একে হাদীসে নববী হিসেবে বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন বাইহাকী, ইবনু হাজার, আলবানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস। এই বাক্যটি মূলত জাবির(রা) এর নিজের কথা। একজন অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী ভুলবশত একে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন। (ইবনু হাজার, আদ দিরাইয়াতু ১/২৬০; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৩/২৯৪-২৯৬)।
২.১৩.২. সিয়াম বিষয়ক
সিয়াম বিষয়ক অনেক জাল হাদীস ও মনগড়া কথা ইতোপূর্বে সালাত অধ্যায়ে ‘বার চাঁন্দের ফযীলত’ বিষয়ক আলোচনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। সিয়ামের বিষয়ে আরো দুই একটি বানোয়াট বা ভিত্তিহীন কথা এখানে উল্লেখ করছি।
১. সিয়ামের নিয়্যত
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ‘নাওয়াইতু আন….’ বলে যত প্রকার নিয়্যত বলা হয় সবই বানোয়াট কথা। কোনো ইবাদতের এরূপ নিয়্যত পাঠ করার কথা কোনো হাদীসে বলা হয় নি।
২. ৩০ দিন সিয়াম ফরয হওয়ার কারণ
বিভিন্ন ইবাদতের কারণ নির্ণয় করা একটি বিশেষ বাতুল আগ্রহ। ফলে জালিয়াতগণ এ বিষয়ে অনেক কথা বানিয়েছে। রামাদানের ফরয সিয়াম বিষয়ে জালিয়াতগণ বানিয়েছেঃ “আমার উম্মাতের উপর ৩০ দিনের সিয়াম ফরয করা হয়েছে। কারণ আদম যখন ফল খেয়েছিলেন তখন তা তাঁর পেটের মধ্যে ৩০ দিন বিদ্যমান থাকে। যখন আল্লাহ আদমের তাওবা কবুল করলেন তখন ৩০ দিন ও ৩০ রাত একটানা সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন। আমার উম্মাতের উপর শুধু দিবসে সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন।…….(ইবনুল জাওযী, আল মাঊদূ‘আত ২/১০১; সুয়ূতী, আল লাআলী ২/৯৭; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৪৫; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ ১/১১৯)।
৩. ইফতার সাহরী ইত্যাদি খানা খাওয়ার হিসাব না হওয়া
সমাজে প্রচলিত আছে যে, ইফতার, সাহরী ইত্যাদি খানা খাওয়ার হিসাব নেই। এই অর্থের বানোয়াট হাদীসগুলির মধ্যে রয়েছেঃ “তিনব্যক্তির পানাহারের নেয়ামতের হিসাব গ্রহণ করা হবে না: ইফতারকারী, সাহরীর খাদ্য গ্রহণকারী ও মেহমান সহ খাদ্য গ্রহণকারী।”(সুয়ূতী, যািইলুল লাআলী পৃ. ১২১; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৬৬; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ ১/১২৪)।
এ সকল ভিত্তিহীন কথাবার্তার কারণে রামাদান মাসকে আমরা নিজে খাওয়ার মাসে পরিণত করেছি। অথচ রামাদান হলো অন্যকে খাওয়ানো ও সহমর্মিতার মাস। এছাড়া আমাদের ‘হিসাব হবে কিনা’ তা বিবেচনা না করে সাওয়াব বেশি হবে কিনা তা বিবেচনা করা উচিত।
৪. আইয়াম বীযের নামকরণ
চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে ‘আইয়ামুল বিদ’ বা ‘শুভ্র রাতের দিনগুলি’ বলা হয়। কারণ এই তারিখগুলিতে পূর্ণ চাঁদের কারণে প্রায় সারারাতই শুভ্রতা বা আলো বিরাজমান থাকে।(ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৪/২২৬; আব্দুর রাঊফ মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/২২৯)। কিন্তু জালিয়াতগণ ‘আইয়াম বিয’ এর নামকরণে অনেক জাল হাদীস প্রচলন করেছে। যেমনঃ “নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের ফলে যখন আদম(আ) পৃথিবীতে আগমন করেন তখন তাঁর দেহ কাল হয়ে গিয়েছিল। ফলে ফেরেশতাগণ তাঁর জন্য কাঁদতে থাকেন। …তখন আল্লাহ আদমকে বলেন, তুমি আমার জন্য ১৩ তারিখ সিয়াম পালন কর। তিনি ১৩ তারিখ সিয়াম পালন করেন এবং এতে তাঁর এক তৃতীয়াংশ শুভ্র হয়ে যায়। অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁকে বলেন, তুমি আজকের দিন ১৪ তারিখও সিয়াম পালন কর। তখন তিনি ১৪ তারিখও সিয়াম পালন করেন এবং তাঁর দুই তৃতীয়াংশ শুভ্র হয়ে যায়। অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁকে বলেন, তুমি আজকের দিন ১৫ তারিখও সিয়াম পালন কর। তখন তিনি ১৫ তারিখ সিয়াম পালন করেন এবং তাঁর পুরো দেহ শুভ্র হয়ে যায়। এজন্য এই দিনগুলিকে ‘আইয়ামুল বীয’ বা ‘শুভ্রতার দিনগুলি’ নাম রাখা হয়।(ইবনুল জাওযী, আল-মাঊদূ‘আত ১/৩৭৫; সুয়ূতী, আল লাআলী ১/৪৮৩-৪৮৪; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/৫৪-৫৫)।
৫. আইয়াম বীযের সিয়াম পালনের ফযীলত
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সা) মুমিনগণকে সকল নফল ইবাদত অল্প হলেও নিয়মিত পালন করার উৎসাহ দিয়েছেন। নফল সিয়ামের ক্ষেত্রে প্রতি চান্দ্র বা আরবী মাসে অন্তত তিনদিন সিয়াম পালনের উৎসাহ দিয়েছেন। কোনো কোনো হাদীসে বিশেষ করে প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ নফল সিয়াম পালনের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। (বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৪)।
এই দিনগুলিতে সিয়াম পালনের বিশেষত্ব তিনটিঃ প্রথমত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন হাদীসে এই তিনদিন সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।(বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৪)।
দ্বিতীয়ত, তিনি নিজে সর্বদা এই তিন দিন সিয়াম পালন করতেন।(আলবানী, সহীহুল জামি ২/৮৭৬)। তৃতীয়ত, এই তিনদিন সিয়াম পালন করলে বা প্রতি মাসে অন্তত তিন দিন সিয়াম পালন করলে সারা বৎসর সিয়াম পালনের সাওয়াব হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।(বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৪)।
মুমিনের জন্য এগুলিই যথেষ্ট। কিন্তু জালিয়াতগণ ‘আইয়ামে বিয’ এর ফযীলতের বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচার করেছে। যেমনঃ “যদি কেউ আইয়ামে বিযের সিয়াম পালন করে তবে ১ম দিনে(তের তারিখে) তাকে ১০ হাজার বৎসরের পুরস্কার প্রদান করা হবে, দ্বিতীয় দিনে(১৪ তারিখে) তাকে এক লক্ষ বৎসরের পুরস্কার প্রদান করা হবে এবং তৃতীয় দিনে(১৫ তারিখে) তাকে তিন লক্ষ্য বৎসরের সাওয়াব প্রদান করা হবে।” কোনো কোনো জালিয়াত একটু কমিয়ে বলেছেঃ “১ম দিনে তিন হাজার বৎসরের সাওয়াব, দ্বিতীয় দিনে ১০ হাজার বৎসরের এবং তৃতীয় দিনে ২০ হাজার বৎসরের সাওয়াব পাবে……।”(সুয়ূতী, আল লাআলী ২/১০৬-১০৭; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৪৮; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ ১/১২৮)।
এইরূপ আরো অনেক বানোয়াট কথা তারা প্রচার করেছে।
২.১১.৩. হজ্জ বিষয়ক
১. সাধ্য হলেও হজ্জ না করলে ইহুদী বা খৃস্টান হয়ে মরা
আমাদের সমাজে অতি পরিচিত একটি হাদীস, হজ্জ বিষয়ক যে কোনো ওয়ায, আলোচনা বা লেখালেখিতে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়ঃ “যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ পৌছার মত পাথেয় ও বাহনের মালিক হলো, অথচ হজ্জ করলো না, সে ইহুদী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে অথবা খৃস্টান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার কোনো অসুবিধা হবে না।”
হাদীসটির প্রসিদ্ধির অন্যতম কারণ হলো, প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থের অন্যতম গ্রন্থ সুনানুত তিরমিযীতে এই হাদীসটি সংকলিত। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ আমাকে মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া বলেন, আমাদেরকে মুসলিম ইবনু ইবরাহীম বলেছেন, আমাদেরকে হেলাল ইবনু আব্দুল্লাহ বলেছেন, আমাদেরকে আবূ ইসহাক হামদানী বলেছেন, হারিস থেকে, তিনি আলী থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন………। হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর ইমাম তিরমিযী বলেনঃ “এটি একটি গরীব হাদীস। হাদীসটি একমাত্র এই সনদ ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে আমি পাই নি। এর সনদে আপত্তি রয়েছে। হেলাল ইবনু আব্দুল্লাহ একজন অজ্ঞাত পরিচয়। আর হারিস হাদীস বর্ণনায় দুর্বল।”(তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৭৬)।
এছাড়াও এ হাদীসটির সনদে আরো দুটি কঠিন দুর্বলতা রয়েছে।
প্রথমত, আবূ ইসহাক মুদাল্লিস ছিলেন। এখানে তিনি বলেন নি যে, হারিস তাকে হাদীসটি বলেছেন বা তিনি তার নিকট হতে হাদীস শুনেছেন। তার বর্ণনাভঙ্গি হতে বুঝা যায় তিনি সরাসরি হারিস হতে শুনেন নি।
দ্বিতীয়ত, হাদীসের পরবর্তী বর্ণনাকারী হিলাল ইবনু আব্দুল্লাহ অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। হাদীসটি আদৌ আবূ ইসহাক বলেছেন, নাকি এই লোকটি বানিয়ে বলেছে, তা কিছুই জানার উপায় নেই।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই অর্থে আরো কয়েকটি সনদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সে সকল সনদের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। এ সকল কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে কেউ কেউ একে যয়ীফ বলে গণ্য করেছেন। আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী সকল সনদ পর্যালোচনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) থেকে এই কথাটি কোনো গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। সবগুলি সনদই অত্যন্ত দুর্বল বা বাতিল। তবে সহীহ সনদে তা উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) হতে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসাবে বর্ণিতে হয়েছে। (ইবনুল জাওযী, আল মাঊদূ‘আত ২/১২১-১২২; সুয়ূতী আল লাআলী ২/১১৮-১১৯)।
২. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কবর যিয়ারত বিষয়ক হাদীসসমূহ
যিয়ারত শব্দের অর্থ সাক্ষাত করা, দেখা করা, বেড়ান(visit, call)ইত্যাদি। জীবিত মানুষদের, বিশেষত আত্মীয় স্বজন ও নেককার মানুষদের যিয়ারত করা বা সাক্ষাত করা একটি হাদীস নির্দেশিত নেক কাজ। বিভিন্ন হাদীসে মুমিনদেরকে ‘তাযাউর ফিল্লাহ’( لًلهافروازالت) বা আল্লাহর ওয়াস্তে একে অপরের যিয়ারত বা দেখা সাক্ষাত করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। (মুনযিরী, আত-তারগীব ৩/২৪৭-২৪৯)।
অনুরূপভাবে মৃত মানুষদের কবর যিয়ারত করা, অর্থাৎ সাক্ষাত করা বা বেড়ানোও হাদীস সম্মত একটি মুস্তাহাব ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাওযা শরীফ যিয়ারত নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যিয়ারত। এছাড়া তাঁকে ভালবাসা ঈমানের অংশ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আর সুন্নাত সম্মত যিয়ারতের মাধ্যমে এই মহব্বত বৃদ্ধি পায়। এছাড়া তাঁর পবিত্র কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দুরুদ-সালাম প্রদানের মর্যাদা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, রাওযা শরীফ যিয়ারত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
তবে এই ইবাদতের জন্য বিশেষ কোনো হাদীস আছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কউ এ বিষয়ক সকল হাদীস জাল ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ সেগুলিকে দুর্বল বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে সে বিষয়ে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই।
এ বিষয়ক হাদীসগুলিকে অর্থের দিক দিয়ে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর যিয়ারতকারী অথবা তাঁর বরকতময় কবর যিয়ারতের জন্য শাফায়াত বা রাহমাতের সুসংবাদ। দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর ইন্তিকালের পরে তাঁর পবিত্র কবর যিয়ারতকারীকে তার জীবদ্দশাতেই তার সাথে সাক্ষাতকারীর মর্যাদার সুসংবাদ দান। তৃতীয়ত, যিয়ারত পরিত্যাগকারীর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ।
ক. যিয়ারতকারীর জন্য সুসংবাদ
১ম হাদীসঃ “যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারত করবে, আমার শাফা‘আত তার প্রাপ্য হবে।”
হাদীসটি ইবনু খুযাইমা, বাযযার, দারাকুতনী, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। হাদীসটির ২টি সনদ রয়েছেঃ
১ম সনদঃ ইমাম বাযযার বলেনঃ আমাকে কুতাইবা বলেছেন, আমাকে আব্দুল্লাহ ইবনু ইবরাহীম বলেছেন, আমাকে আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম বলেছেন, তার পিতা থেকে, ইবনু উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন……।(হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২)।
আমরা অন্যত্র আব্দুর রামান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, মুহাদ্দিসগণ তাকে অত্যন্ত দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ তাকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। এই সনদে তার ছাত্র আব্দুল্লাহ ইবনু ইবরাহীম নামক এই ব্যক্তিও অত্যন্ত দুর্বল। তিনি আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিসের নামে এমন অনেক হাদীস বর্ণনা করেছন, যেগুলি সে সকল মুহাদ্দিসের অন্য কোনো ছাত্র বর্ণনা করেন না বা অন্য কোনো সূত্রে পাওয়া যায় না। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী। ইবুন হিব্বান তাকে হাদীস জালয়াতকারী বলে উল্লেখ করেছেন।(ইবনু আদী, আল কামিল ৪/১৯০-১৯১; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৪/৫৫-৫৬)।
আমরা দেখেছি যে, আব্দুর রাহমান বর্ণিত হাদীসই অত্যন্ত দুর্বল বা জাল বলে গণ্য। এই সনদে তার ছাত্রের অবস্থা এর চেয়ে আরও খারাপ।
দ্বিতীয় সনদঃ ইমাম দারাকুতনী বলেন, আমাদেরকে কাযী মুহামিলী বলেন, আমাদেরকে উবাইদুল্লাহ ইবুন মুহাম্মাদ আল-ওয়াররাক বলেছেন, আমাদেরকে মূসা ইবনু হিলাল বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ(অথবা উবাইদুল্লাহ) ইবনু উমার আল উমারী বলেছেন, তিনি নাফী থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে, রাসূলু্ল্লাহ(ﷺ) বলেছেন…”(দারাকুতনী, আস সুনান ২/২৭৮)।
ইমাম বাইহাকীও একই সনদে মূসা ইবনু হিলাল থেকে, আবদুল্লাহ ইবনু উমার আল উমারি থেকে নাফি থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে এই হাদীসটি সংকলিত করেছেন। হাদীসটি উদ্ধৃত করে বাইহাকী বলেনঃ হাদীসটি নাফী থেকে ইবনু উমার থেকে একটি মুনকার বা অত্যন্ত আপত্তিকর হাদীস। এই ব্যক্তি(মূসা ইবনু হিলাল) ছাড়া অন্য কেউই হাদীসটি বর্ণনা করেন নি।”(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৯০)।
ইমাম ইবনু খুযাইমাও একই সনদে হাদীসটি সংকলন করেছেন এবং বলেছেন, “হাদীসটি সনদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। …..হাদীসটি মুনকার, অর্থাৎ আপত্তিকর বা অত্যন্ত দুর্বল।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/৫৬৬-৫৬৭; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩২৮-৩২৯)।
এই সনদেও দুজন বর্ণনাকারী দুর্বল। মূসা ইবনু হিলাল নামক একজন অজ্ঞাত পরিচয় বা স্বল্প পরিচিত রাবী। আবূ হাতিম রাযী তাকে অজ্ঞাত পরিচয় বলেছেন। ইবনু আদী বলেছেন, আশা করি তার হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। যাহাবী বলেন, এ ব্যক্তির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। …..তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলির মধ্যে সবচেয়ে আপত্তিকর বা দুর্বল হলো এই হাদীসটি। (উকাইলী, আদ-দু‘আফা ৪/১৭০; ইবনু আদী, আল কামিল ৬/৩৫১)।
মূসা নামক এই রাবীর উস্তাদ আব্দুল্লাহ ইবুন উমার ইবনু হাফস আল উমারী (১৭১ হি) দ্বিতীয় শতকের একজন তাবে-তাবেয়ী রাবী। তিনি হাদীস বর্ণনায় দুর্বল হলেও পরিত্যক্ত ছিলেন না। তাঁর ভাই ‘উবাইদুল্লাহ ইবনু উমার’ খুবই নির্ভরযোগ্য ছিলেন। আর তিনি দুর্বল ছিলেন। ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন তাকে দুর্বল বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলেছেন। আহমাদ ইবনু হাম্বল, ইবনু আদী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলেছেন। নাসাঈ ও অন্য কেউ কেউ তাকে দুর্বল বলেছেন। ইবনু হাজার আসকালানী সকল মতের সমন্বয় করে বলেন, “তিনি দুর্বল রাবী। ইমাম মুসলিম তাঁর বর্ণনাকে সহায়ক বর্ণনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দায়ূদ ও ইবনু মাজাহ তার বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। (ইবনু আদী, আল কামিল ৪/১৪১; যাহাবী, আল মুগনী ১/৩৪৮-৩৪৯; মীযানুল ইতিদাল ৪/১৫১-১৫৩)।
কোনো কোনো বর্ণনায় মূসা ইবনু হিলাল তার উস্তাদ হিসেবে ‘উবাইদুল্লাহ ইবনু উমার’ এর নাম উল্লেখ করেছেন। তবে ইবনু খুযাইমা, বাইহাকী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেছেন, এখানে উবাইদুল্লাহর উল্লেখ ভুল। হাদীসটি আব্দুল্লাহর বর্ণনা।(দারাকুতনী, আস-সুনান ২/২৭৮; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৯০)।
সর্বাবস্থায় এই সনদটি দুর্বল হলেও এতে কোনো মিথ্যাবাদী রাবী বা মিথ্যা বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত বা পরিত্যক্ত রাবী নেই।
২য় হাদীসঃ “ যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারত করবে, অথবা তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আমার যিয়ারত করবে, কেয়ামতের দিন আমি তার জন্য শাফায়াতকারী অথবা সাক্ষ্যদানকারী হব।” হাদীসটি আবূ দাউদ তায়ালিসী ও বাইহাকী সংকলন করেছেন। তাঁরা সিওয়ার ইবনু মাইমূন নামক এক ব্যক্তির সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এই সিওয়ার ইবনু মাইমূন বলেন, তাকে উমার ইবনুল খাত্তাব বংশের এক ব্যক্তি বলেছেন, উমার থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন……।(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৮-৪৮৯; আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৫)।
এই হাদীসের বর্ণনাকারী সিওয়ার ইবনু মাইমূন অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী। রিজাল শাস্ত্রের কোনো গ্রন্থে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তার উস্তাদ ‘উমরের বংশের এক ব্যক্তি’ সম্পূর্ণ পরিচয়হীন। এজন্য ইমাম বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, “এই সনদটি অজ্ঞাত”।(বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৫)।
৩য় হাদীসঃ “ যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার যিয়ারত করবে; কিয়ামতের দিন সে আমার প্রতিবেশী হয়ে বা আমার আশ্রয়ে থাকবে।”(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৪/৪৮৮; যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল ৭/৬৩; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ৬/১৮০)।
হাদীসটি বাইহাকী, যাহাবী, ইবনু হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিস উদ্ধৃত করেছেন। তারা হাদীসটি ৩য় শতকের মুহাদ্দিস আব্দল মালিক ইবনু ইবরাহীম আল জুদ্দী(২০৫ হি) সূত্রে বর্ণনা করেন। আব্দুল মালিক বলেন, আমাদেরকে শু‘বা ইবনুল হাজ্জাজ(১৬২ হি) বলেছেন, সিওয়ার ইবনু মাইমুন থেকে, তিনি বলেন, আমাদেরকে হারূন ইবনু কুযা‘আহ বলেছেন, খাত্তাবের বংশের জনৈক ব্যক্তি থেকে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) থেকে, তিনি বলেছেন……।
এই হাদীসটির সনদ পূর্বের সনদের চেয়েও দুর্বল। উপরের সনদের দুটি দুর্বলতা ছাড়াও এই সনদে আরো দুটি দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, এই সনদে সিওয়ার এর উস্তাদ হারূন আবূ কুযা‘আহ এর সঠিক পরিচয় জানা যায় না। একে হারূন আবূ কুযা‘আহ বা হারূন ইবনু কুযা‘আহ বলা হয়। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেন, এই ব্যক্তির হাদীস ভিত্তিহীন, অন্য কেউ তা বলে না। আযদী বলেন, এই ব্যক্তি পরিত্যক্ত।(ইবনু আদী, আল কামিল ৭/১২৮, যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৭/৬৩,৬৭; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ৬/১৮০, ১৮৩)। দ্বিতীয়ত, এই সনদে সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হয় নি, ফলে সনদটি মুরসাল বা বিচ্ছিন্ন।
৪র্থ হাদীসঃ “যে ব্যক্তি আমার কাছে যিয়ারতকারী হিসেবে আগমন করবে, আমার যিয়ারত ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজন তাকে ধাবিত করবে না, তার জন্য আমার দায়িত্ব হবে যে, আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য শাফা‘আত করব।”
হাদীসটি দারাকুতনী, তাবারানী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আল আব্বাদীর সূত্রে বলেন, তিনি বলেছেন, আমাদেরকে মুসলিম(মাসলামা) ইবনু সালিম আল জুহানী বলেছেন, আমাকে আবদুল্লাহ (অথবা উবাইদুল্লাহ) ইবনু উমার বলেছেন, তিনি নাফি থেকে, তিনি সালিম থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন……(তাবারানী, আল মু’জামুল কবীর ১২/২৯১)। এই হাদীসের বর্ণনাকারী মুসলিম ইবনু সালিম আল জুহানী দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য রাবী ছিলেন। কেউ কেউ তার নাম ‘মাসলামা’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবূ দাউদ সিজিসতানী বলেন, এই লোকটি সিকাহ বা বিশ্বস্ত নয়। ইমাম হাইসামী বলেন, এই ব্যক্তি দুর্বল।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/৪১৫; ইবুন হাজার, লীসানুল মীযান ৬/২৯)।
৫ম হাদীসঃ “যে ব্যক্তি একান্ত নেক নিয়্যতে বা সাওয়াবের উদ্দেশ্যে মদীনায় আমার সাথে সাক্ষাত করবে, কেয়ামতের দিন আমি তার সাক্ষী ও শাফায়াতকারী হব।”
হাদীসটি ইবনু আবী দুনিয়া, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তারা একাধিক সনদে মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল ইবনু আবী ফুদাইক এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদেরকে আবুল মুসাইন্না সুলাইমান ইবনু ইয়াযিদ আল কাবী বলেছেন, আনাস ইবনু মালিক(রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন…..(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৯-৪৯০; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৭)।
এই সনদে আবুল মুসাইন্না সুলাইমান ইবনু ইয়াযিদ নামক এই রাবীকে মুহাদ্দিসগণ দুর্বল বলেছেন। আবূ হাতিম রাযী বলেন, লোকটি শক্তিশালী রাবী ছিল না, আপত্তিকর হাদীস বর্ণনা করতেন। দারাকুতনীও তাকে দুর্বল বলেছেন। তবে ইবনু হিব্বান তাকে ‘সিকাহ’ বা বিশ্বস্ত রাবীদের তালিকাভুক্ত করছেন। ইমাম তিরমিযীও তাকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। মুহাদ্দিসগণের মতামত সমন্বয় করে ইবনু হাজার তাকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আবুল মুসান্না তাবেয়ী ছিলেন না, তাবে-তাবেয়ী ছিলেন। ইবনু হিব্বান, ইবনু হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কোনো সাহাবী হতে হাদীস শিক্ষা করেন নি। বরং তাবেয়ীগণ হতে হাদীস শুনেছেন। এজন্য হাদীসটি সনদ বিচ্ছিন্ন বা মুনকাতী।(ইবনু হিব্বান, আস সিকাত ৬/৩৯৫; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৩/৩২১; ইবনু হাজার লিসানুল মীযান ৭/৪৮১; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৮০৮)।
৬ষ্ঠ হাদীসঃ “আল্লাহ রহমত করুন সেই ব্যক্তিকে, যে তার উটের রশি তার হাতে নিয়ে আমার যিয়ারত করেছে।”
এই বাক্যটির বিষয়ে ইবুন হাজার আসকালানী, সাখাবী, সুয়ূতী, ইবুন ইরাক, মোল্লা আলী কারী, শাওকানী, দরবেশ হুত প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেছেন যে, বাক্যটি ভিত্তিহীন বানোয়াট। (ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৭৬; সাখাবি, আল মাকাদিস পৃ. ২৩৫; মোল্লা আলী কারী, আল আসরার পৃ. ১২৮; দরবেশে হুত, আসানুল মাতালিব, পৃ. ১১৪)।
উপরের ৬টি হাদীসের মধ্যে ৬ষ্ঠ হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে ভিত্তিহীন বানোয়াট বাক্য। বাকী পাঁচটি হাদীস হতে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর যিয়ারত করা বা তাঁর সাথে সাক্ষাত করার ফযীলত অবগত হওয়া যায়। প্রথম হাদীসে কবর যিয়ারতের কথা স্পষ্ট বলা হয়েছে। তৃতীয়, চতূর্থ ও পঞ্চম হাদীসে রাসূলুল্লাহ(ﷺ)কে যিয়ারতের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় হাদীসে উভয়ের যে কোনো একটির কথা বলা হয়েছে। আর রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর ইন্তিকালের পরে তাঁর পবিত্র কবর যিয়ারতও তাঁরই যিয়ারত বলে গণ্য হতে পারে।
আমরা দেখছি যে, এই অর্থের হাদীসগুলির সবগুলোর সনদই বেশ দুর্বল। ইবনু তাইমিয়া, ইবুন আব্দুল হাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ অর্থের হাদীসগুলিকে একেবারেই ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। আলবানী একে যয়ীফ বা দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। (ইবুন আব্দুল হাদী, আস-সারিম আল-মানকী পৃ. ২৯-২৪৬; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩৩-৩৩৫)। তবে আমরা দেখতে পাই যে, প্রথম হাদীসটির দ্বিতীয় সনদ, ৪র্থ হাদীস ও পঞ্চম হাদীসের সনদে কোনো মিথ্যাবাদী বা একেবারে ‘মাজহূল’ বা অজ্ঞাতনামা কউ নেই। কাজেই এই সনদগুলি পরস্পরের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং একাধিক সনদের কারণে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
খ. ওফাত পরবর্তী যিয়ারতকে জীবদ্দশায় যিয়ারতের মর্যাদা দান
৭ম হাদীসঃ “যে ব্যক্তি হজ্জ করে আমার মৃত্যুর পর আমার কবর যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশাতেই আমার যিয়ারত করল।”
হাদীসটি দারাকুতনী, তাবারানী, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তাঁরা সকলেই হাদীসটি হাফস ইবুন সুলাইমান নামক রাবীর মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। হাফস বলেন, তাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইম বলেছেন, তাকে মুজাহিদ বলেছেন, আব্দুল্লাহ ইবুন উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন…….(দারাকুতনী, আস-সুনান ২/২৭৮; শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৯, তাবারানী, আল-মুজামুল আউসাত ১/৯৪)। বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, “একমাত্র হাফসই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি দুর্বল।(বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৬; শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৯)।
এই হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী হাফস ইবুন সুলাইমান(১৮০ হি) প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কারী ছিলেন। তবে তিনি হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। কুরআনের কিরআত ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে তিনি এত ব্যস্ত থাকতেন যে, হাদীস মুখস্ত, পুনরালোচনা ও বিশুদ্ধ বর্ণনায় তিনি মোটেও সময় দিতেন না। ফলে তাঁর বর্ণিত হাদীসে এত বেশি ভুল পাওয়া যায় যে, ইমাম আহমদ ছাড়া অন্য সকল মুহাদ্দিস তাকে অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত বলে গণ্য করেছেন। ইমাম আহমদ তাকে মোটামুটি চলনসই বলে মনে করতেন। যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, তিনি নিজে সত্যবাদী ছিলেন, তবে হাদীস বলতে অত্যন্ত বেশি ভুল করতেন, সনদ উল্টে ফেলতেন, রাবীর নাম বদলে দিতেন, মতন পাল্টে দিতেন, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করতে পারতেন না। এজন্য তিনি পরিত্যক্ত রাবী হিসেবে গণ্য। ইমাম বুখারী তাকে পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। আর তিনি মিথ্যায় অভিযুক্তদেরই পরিত্যক্ত বলতেন। আবূ হাতিম রাযী, ইবনু আদী, ইবনু হিব্বান ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও তাকে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। ইবনু খিরাশ তাকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছন। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ২/৩১৯-৩২১; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ১৭২)।
এই সনদের হাফসের উস্তাদ লাইস ইবুন আবী সুলাইমও কিছুটা দুর্বল রাবী ছিলেন। তিনি একজন বড় আলিম, আবিদ ও সত্যপরায়ণ রাবী ছিলেন। তবে শেষ জীবনে তার স্মৃতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ইমাম মুসলিম তার বর্ণনা সহায়ক বর্ণনা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সুনান চতুষ্টয়ের সংকলকগণ: তিরমিযী, নাসাঈ, আবূ দায়ূদ ও ইবনু মাজাহ তার বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৫/৫০৯; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪৬৪)।
৮ম হাদীসঃ “আমার মৃত্যুর পর আমার কবর যে ব্যক্তি যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত করল।”(তাবারানী, আল-মুজা‘মুল কাবীর ১২/৪০৬; আল-মুজামুল আউসাত ১/৯৪)।
ইমাম তাবারানী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, আমাকে আহমাদ ইবনু রিশদীন বলেছেন, আমাদেরকে আলী ইবনুল হাসান ইবনু হারূন আনসারী বলেছেন, আমাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইমের মেয়ের পুত্র লাইস বলেছেন, আমাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইমের স্ত্রী আয়েশা বিনতু ইউনুস বলেছেন, তাকে মুজাহিদ বলেছেন, ইবুন উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন…..। এই সনদের প্রায় সকল রাবীই অজ্ঞাত পরিচয় বা দুর্বল। তাবারানীর উস্তাদ আহমদ ইবনু রিশদীন(২৯২ হি) দুর্বল ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। (ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ১/২৫৭)। তাঁর উস্তাদ আলী ইবনুল হাসান নামক এই ব্যক্তির কোনোরূপ পরিচয় জানা যায় না। অনুরূপভাবে তাঁর উস্তাদ লাইস নামক এই ব্যক্তি, তার উস্তাদ আয়েশা নামক এই মহিলা এরাও একেবারেই অপরিচিত। এজন্য সনদটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। (হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১২৩-১২৪)।
৯ম হাদীসঃ “ যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশাতেই আমার যিয়ারত করল।”
হাদীসটি ইমাম দারাকুতনী, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। এই হাদীসের সনদ বর্ণনায় মুহাদ্দিসগণ বৈপরীত্য ও বিক্ষিপ্ততা দেখতে পেয়েছেন। দুইভাবে এই হাদীসটির সনদ ও মতন বলা হয়েছে।
প্রথম সনদঃ ২য় হিজরী শতকের মুহাদ্দিস ওকী ইবনুল জাররাহ(১৯৭ হি) বলেছেন, আমাদেরকে বলেছেন, খালীদ ইবুন আবূ খালীদ ও আবূ আউন উভয়ে শাবী ও আসওয়াদ ইবনু মাইমুন থেকে, তিনি হারূন আবূ কুযা‘আহ থেকে, তিনি হাতিব এর বংশের জনৈক ব্যক্তি হতে, তিনি হাতিব(রা) হতে, হাতিব(রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন……(দারাকুতনী, আস-সুনান ২/২৭৮; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৫; শু‘আবুল ঈমান ৪/৪৮৮)।
ইতোপূর্বে ৩ নং হাদীসের সনদ আলোচনার সময় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, হারূন আবূ কুযা‘আহ অপরিচিত, অগ্রহণযোগ্য ও পরিত্যক্ত রাবী। এই সনদে হারূন এর উস্তাদ ‘হাতিব এর বংশের জনৈক ব্যক্তি’ শুধু অজ্ঞাত পরিচয়ই নয়, তিনি অজ্ঞাতনামাও বটে। ২য১
দ্বিতীয় সনদঃ ৩য় শতকের মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবনু মূসা বলেন, আমাদেরকে ওকী ইবনুল জাররাহ বলেছেন, আমাদেরকে মাইমূন ইবনু সিওয়ার (সিওয়ার ইবনু মাইমূন)বলেছেন, আমাকে হারূন আবূ কুযা‘আহ..(বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৪/৪৮৮; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ৬/১৮০)।
এই সনদটি প্রথম সনদের চেয়েও দুর্বল। কারণ উপরে ৩ নং হাদীসের আলোচনা হতে আমরা দেখেছি যে, সিওয়ার ইবনু মাইমূন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি।
উপরের তিনটি হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর ওফাতের পরেও যে মুমিন তাঁর কবর যিয়ারত করবে, সে জীবদ্দশায় তাঁর সাথে সাক্ষাতের মর্যাদা লাভ করবে। আমরা দেখেছি যে, তিনটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। প্রথম ও দ্বিতীয় সনদে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত রাবী রয়েছেন। তৃতীয় সনদের পরিত্যক্ত রাবী রয়েছেন। এছাড়া সনদগুলিতে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতনামা ও অজ্ঞাতপরিচয় রাবী রয়েছে। এ কারণে ইবনু তাইমিয়া, ইবুন আব্দুল হাদী, আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এই হাদীসগুলিকে ‘মাঊদূ’ বা জাল বলে গণ্য করেছেন।
সনদগত অগ্রহণযোগ্যতা ছাড়াও অর্থগতভাবেও হাদীসগুলি ইসলামের মূল চেতনার বিরোধী বলে তাঁরা দাবি করেছেন। ইবুন তাইমিয়া বলেন, এ কথা যে মিথ্যা তা স্পষ্ট। এ কথা মুসলিমদের ধর্ম বিরোধী। কারণ যে মুমিন ব্যক্তি জীবদ্দশায় রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর যিয়ারত বা সাক্ষাত করবেন তিনি তাঁর সাহাবী বলে গণ্য হবেন। …..পরবর্তী যুগের একজন মুমিন বড় বড় ফরয ওয়াজিবগুলি বেশি বেশি পালন করেও কখনোই একজন সাহাবীর সম মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারবেন না। তাহলে একটি মুস্তাহাব ইবাদত পালনের মাধ্যমে কিভাবে তিনি একজন সাহাবীর সমমর্যাদা লাভ করবেন?!(আলবানী, যায়ীফাহ ১/১২০-১২৪; ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩৫-৩৪১)।
গ. যিয়ারত পরিত্যাগকারীর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ
১০ম হাদীসঃ “যে ব্যক্তি আমার হজ্জ করল, কিন্তু আমার যিয়ারত করল না, সে আমার সাথে অসদাচরণ করল বা বেয়াদবী করল।” অন্য ভাষায় “যে ব্যক্তি আমার যিয়ারত বা সাক্ষাত করল না সে আমার সাথে অসদাচরণ বা বেয়াদবী করল।”
হাদীসটি কোনো হাদীস সংকলক কোনো হাদীস গ্রন্থে সংকলন করেন নি। দুর্বল ও মিথ্যাবাদী রাবীদের জীবনীগ্রন্থসমূহে কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। তারা হাদীসটি একটিমাত্র সনদে সংকলিত করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আন-নু‘মান নামক এক ব্যক্তি বলেন, আমাকে আমার দাদা আন-নুমান ইবনু শিবল বলেছেন, মালিক ইবনু আনাস আমাকে বলেছেন, তিনি নাফি থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার(রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন……..।”
এই সনদের দুইজন রাবী অত্যন্ত দুর্বল ও মিথ্যা হাদীস বর্ণনায় অভিযুক্ত। প্রথমত ইমাম মালিক থেকে বর্ণনাকারী আন-নু‘মান ইবনু শিবল নামক এই ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল রাবী ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়ত তার পৌত্র মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদও মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ইমাম দারাকুতনী, ইবনু হিব্বান, ইবনুল জাওযী, সাগানী, যাহাবী, ইবনু হাজার, দরবেশ হুত, শাওকানী, আলবানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। দারাকুতনী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এর জালিয়াতির জন্য দায়ী মুহাম্মাদ ইবুন মুহাম্মাদ ইবুন আন নু‘মান, তার দাদা নুমান ইবনু শিবল নন।(ইবনু হিব্বান, আল মাজরূহীন ৪/৭৪; ইবনু আদী, আল কামিল ৭/১৪, দরবেশ হুত, আসানুল মাতালিব, পৃ. ২২৯; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১১৯)।
১১ শ হাদীসঃ “আমার উম্মাতের কোনো ব্যক্তির যদি স্বচ্ছলতা বা সুযোগ থাকে, তা সত্ত্বেও সে আমার সাথে সাক্ষাত বা যিয়ারত না করে তাহলে তার কোনো ওযর থাকে না।”
হাদীসটি ইবনু নাজ্জার তার ‘তারীখুল মদীনা’ নামক গ্রন্থে সংকলিত করেছেন। (ইরাকী, আল মুগনী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন সহ ১/৩০৬; সাখাবী, আল মাকাদিস পৃ. ৪২৪)। তাঁর সনদটি নিম্নরূপ। “মুহাম্মাদ ইবুন মুকাতিল থেকে, তিনি জাফর ইবনু হারূন থেকে, তিনি সাম‘আন ইবনু মাহদী থেকে, তিনি আনাস(রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন……।”(ইবনু আব্দুল হাদী, আস সারিম, পৃ. ২৩৪; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৪০)।
এই সনদটি মাঊদূ সনদ হিসেবে প্রসিদ্ধ। মুহাম্মাদ ইবনু মুকাতিল রাযী(২৪৮ হি) কিছুটা দুর্বল হলেও পরিত্যক্ত ছিলেন না। এই সনদে তিনি যার নিকট হতে হাদীসটি শুনেছেন, জাফর ইবনু হারূন নামক এ ব্যক্তি মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী ও জাল হাদীস প্রচারকারী হিসেবে পরিচিত। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ২/১৫১; ইবনু হাজার, লীসানুল মীযান ২/১৩১)। তাততারতজাকাকতার উস্তাদ হিসেবে পরিচিত ‘সামআন ইবনু মাহদী’ সম্পর্কে ইবনু হাজার আসকালানী ও যাহাবী বলেছেনঃ এই লোকটি সম্পর্কে কিছু জানা যায় না বললে চলে। তার নামে আনাস ইবনু মালিক(রা) থেকে একটি বানোয়াট পান্ডুলিপি প্রচারিত। এতে প্রায় ৩০০ হাদীস আছে। মুহাম্মাদ ইবনু মুকাতিল রাযী, জাফর ইবনু হারূন আল আল-ওয়াসিতীর মাধ্যমে এই সাম‘আন থেকে সেই হাদীসগুলি বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসগুলির জালিয়াতকে আল্লা্হ লাঞ্চিত করুন।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৩/৩২৮; ইবুন হাজার, লীসানুল মীযান ৩/১১৪)।
বাহ্যত এই হাদীসটিও উপর্যুক্ত জাল পান্ডুলিপির অংশ। সর্বাবস্থায় হাদীসটির সনদে একাধিক মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে।
১২শ হাদীসঃ “যে ব্যক্তি প্রশস্ততা বা স্বচ্ছলতা পেল, কিন্তু আমার নিকট আগমন করল না, সে আমার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ বা বেয়াদবী করল।”
হাদীসটি ইমাম গাযালী তাঁর ‘এহইয়া্উ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন। কোথাও কোনো গ্রন্থেই তা সনদসহ পাওয়া যায় না। আল্লামা সুবকী, ইরাকী, সাখাবী, আজলূনী, শাওকানী প্রমুখ মুহাদ্দিস নিশ্চিত করেছেন যে, এই বাক্যটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। (আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৬৬; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ ১/১৫৩)।
উপরের তিনটি হাদীস থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে-তাঁর জীবদ্দশায় বা ইন্তিকালের পরে-যিয়ারত বা সাক্ষাত না করার অপরাধ বুঝা যায়। তবে আমরা দেখছি যে, তৃতীয় হাদীসটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসের সনদের একাধিক মিথ্যাবাদী রয়েছে।
উপরের আলোচনা হতে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর বরকতময় কবর যিয়ারত এর ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীসই দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই প্রসিদ্ধ ছয়টি গ্রন্থের লেখকগণ, অন্যান্য সহীহ গ্রন্থের সংকলকগণ, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ প্রমুখ মুহাদ্দিস এ সকল হাদীস তাঁদের গ্রন্থসমূহে সংকলন করেন নি। এ সকল হাদীসের সনদগত দুর্বলতার কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস ঢালাওভাবে এ সকল হাদীসকে জাল বা অত্যন্ত দুর্বল বা একেবারে অগ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এগুলির সবগুলিকে একত্রিত ভাবে সহীহ বা হাসান বলে গ্রহণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ইবনু তাইমিয়্যা, ইবুনল জাওযী, ইবুন আব্দুল হাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পবিত্র কবর যিয়ারত বিষয়ক সকল হাদীসকেই জাল অথবা একেবারেই দুর্বল ও অগ্রহণযো্গ্য বলে উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লামা আবূ আলী ইবনুস সাকান, আব্দুল হক ইশবিলী, সুবকী, সাখাবী, ইবনু হাজার মাক্কী প্রমুখ মুহাদ্দিস এই অর্থের হাদীসগুলিকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।(ইবনু তাইমিয়া, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ২৭/২৯-৩৬, ১১৪-২৮৮; সাখাবী, আল মাকাদিস পৃ. ৪১০, ৪২৪)।
তবে উপরের আলোচনার মত অর্থগত মতপার্থক্য করে কেউ সনদগুলি আলোচনা করেছেন বলে জানতে পারি নি। একজন নগণ্য তালিব ইলম হিসেবে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তৃতীয় অর্থে অর্থাৎ যিয়ারত পরিত্যাগকারীর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশের অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই জাল ও ভিত্তিহীন। দ্বিতীয় অর্থে, অর্থাৎ ওফাতের পরে কবর যিয়ারতকারীকে জীবদ্দশায় যিয়ারতকারীর মর্যাদা প্রদান বিষয়ক হাদীসগুলি অত্যন্ত দুর্বল বা জাল।
প্রথম অর্থে, অর্থাৎ যিয়ারতকারীর জন্য শাফায়াতের সুসংবাদ প্রদানমূলক হাদীসগুলি হাসান পর্যায়ের বলে গণ্য করা উচিত। কারণ একই অর্থে ৫টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে তিনটি সনদের দুর্বলতা সম্পূরকযোগ্য। ১ম হাদীসের ২য় সনদ, ৪র্থ হাদীস এবং ৫ম হাদীসের সনদে কোনো মিথ্যায় অভিযুক্ত বা পরিত্যক্ত রাবী নেই। কাজেই একাধিক সনদের কারণে তা ‘হাসান লি গাইরিহী’ বলে গণ্য হবে। মহান আল্লাহই ভাল জানেন।
৩. বিবাহের আগে হজ্জ আদায়ের প্রয়োজনীয়তা
আমাদের দেশে ‘হজ্জ রাখতে পারবে কিনা’, ‘হজ্জের আগে ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে হবে’, ‘হজ্জের আগে পিতামাতার হজ্জ করাতে হবে’, বা পিতামাতার অনুমতি লাগবে….. ইত্যাদি কিছু ভিত্তিহীন ধারণা ও কুসংস্কারের কারণে সাধারণত মুসলমানরা বার্ধক্যের আগে হজ্জ করেন না, যদিও হজ্জ ফরয হওয়ার পর দেরি করা মোটেও উচিত নয়। ইন্দোনেশিয়ায় বিষয়টি উল্টো। যৌবনের শুরুতে, বিবাহের আগে হ্জ্জ না করলে মনে হয় হজ্জ হলো না। একটি জাল হাদীস এর কারণ। এই জাল হাদীসটিতে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি হজ্জ পালনের আগে বিবাহ করল, সে পাপ দিয়ে শুরু করল।” মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল। (ইবনু আদী, আল কামিল ১/৩৬৪; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৪৫৮; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১২০; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৬৭; শাওকানী, আল ফাওয়াইদ ১/১৩৮)।
৪. হজ্জের কারণে বান্দার হক্কও ক্ষমা হওয়া
হজ্জ বিষয়ক প্রচলিত কিছু হাদীসে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জের সময় হাজীদের সকল পাপের মার্জনার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ প্রথমে জানান যে বান্দার হক ছাড়া হাজীর সকল পাপ ক্ষমা করা হবে। বারংবার দোয়ার পর আল্লাহ জানান যে, হাজীর সকল পাপ এমনকি বান্দার হক্ক বিষয়ক পাপও ক্ষমা করা হবে…..।
এই মর্মে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি হাদীসের সনদই অত্যন্ত দুর্বল। প্রত্যেক সনদেই মিথ্যাবাদী অথবা অত্যন্ত দুর্বল রাবী অথবা অজ্ঞাতনামা ও অজ্ঞাতপরিচয় রাবী রয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে সেগুলিকে ‘দুর্বল’ হলেও সরাসরি জাল নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। পক্ষান্তরে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এই অর্থের সকল হাদীসই জাল ও ভিত্তিহীন বলে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ প্রত্যেক হাদীসেই মিথ্যাবাদী ও পরিত্যক্ত রাবী রয়েছেন। এছাড়া তা বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বার প্রমাণিত অর্থের বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে। বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার বা প্রাপ্য সংশ্লিষ্ট বান্দা ক্ষমা না করলে ক্ষমা করেন না। এমনকি জিহাদ ও শাহাদাতের দ্বারাও তা ক্ষমা হয় না। (ইবনুল জাওযী, আল মাঊদূ‘আত ২/১২৪-১২৭; যাহাবী, তারতীবুল মাঊদূ‘আত পৃ. ১৮৫; সুয়ূতী, আল লাআলী ২/১২০-১২৪; আল মুনযিরী, আত তারগীব ২/১২৯-১৩১)।