২.২. মহান স্রষ্টা কেন্দ্রিক জাল হাদীস
১. আল্লাহকে কোনো আকৃতিতে দেখা চক্ষু আল্লাহকে দেখতে পারেনা বলে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ
لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ ۖ
-তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত।(সূরা ৬ঃ আনআম, আয়াত ১০৩)।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছেঃ “কোনো মানুষের জন্যই সম্ভব নয় যে, আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে বা পর্দার আড়াল থেকে ছাড়া তাঁর সাথে কথা বলবেন।”(সূরা ৪২, শূরাঃ আয়াত ৫১)।
অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছেঃ “মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলো এবং তার প্রতিপালক তার সাথে কথা বললেন, তখন সে বলল, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে দর্শন দাও, আমি তোমাকে দেখব। তিনি বলেনঃ তুমি কখনই আমাকে দেখতে পাবেনা। তুমি বরং পাহাড়ের প্রতি লক্ষ্য কর, তা স্বস্থানে স্থির থাকলে তুমি আমাকে দেখবে। যখন তার প্রতিপালক পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন, তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল…..।”(সূরা ৭ঃ আরাফ, আয়াত ১৪৩)।
কুরআন কারীমের এ সকল সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে মুসলিম জাতি একমত যে, পৃথিবীতে কেউ আল্লাহকে দেখতে পারেনা। রাসূলুল্লাহ(সা) হতে একটি সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয়নি যাতে বলা হয়েছে, “আমি জাগ্রত অবস্থায় পৃথিবীতে বা মি‘রাজে চর্মচক্ষে বা অন্তরের চক্ষে আল্লাহকে দেখেছি।” স্বপ্নের ব্যাপারে কোনো মতভেদ নাই। তবে রাসূলুল্লাহ(সা) জাগ্রত অবস্থায় অন্তরের দৃষ্টিতে আল্লাহকে দেখেছেন কিনা সে বিষয়ে সাহাবীগণ মতভেদ করেছেন। আয়েশা (রা) বলেন, “যে ব্যক্তি বলে যে, মুহাম্মাদ (সা) তাঁর প্রতিপালককে দেখেছেন, সে ব্যক্তি আল্লাহর নামে জঘন্য মিথ্যা কথা বলে।”(বুখারী, আস-সহীহ ৩/১১৮১, মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫৯)। ইবনু মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবীগণও এই মত পোষণ করেছেন। পক্ষান্তরে ইবনু আব্বাস(রা) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, “মি’রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ(সা) অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে আল্লাহকে দেখেছিলেন। আল্লাহ যেমন মূসা(আ)কে ‘কথা বলার’ মুজিযা প্রদান করেছিলেন, তেমনি তিনি মুহাম্মাদ(সা) কে অন্তরের দৃষ্টিতে দর্শনের মুজিযা দান করেছিলেন।”(ইবনু খুযাইমা, কিতাবুত তাওহীদ ২/৪৭৭-৫৬৩)।
যারা রাসূলুল্লাহ(সা) এর দর্শন দাবি করেছেন, তাঁরা একমত যে-এই দর্শন রাসূলুল্লাহ(সা) এর জন্য একটি বিশেষ মুযিজা, যা আর কারো জন্য নয় এবং এই দর্শন হৃদয়ের অনুভব, যেখানে কোনো আকৃতির উল্লেখ নেই। রাসূলুল্লাহ(সা) আল্লাহকে কোনো আকৃতিতে দেখেছেন, অথবা তিনি ছাড়া কোনো সাহাবী আল্লাহকে দেখেছেন মর্মে যা কিছু বর্ণিত সবই জাল ও মিথ্যা।
মি’রাজের রাত্রিতে বা আরাফার দিনে, বা মিনার দিনে বা অন্য কোনো সময়ে বা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ(সা) তাঁর মহান প্রভু মহিমাময় আল্লাহকে বিশেষ কোনো আকৃতিতে দেখেছেন অর্থে সকল হাদীস বানোয়াট। যেমন, তাকে যুবক অবস্থায় দেখেছেন, তাজ পরিচিত অবস্থায় দেখেছেন, উটের বা খচ্চরের পিঠে দেখেছেন বা অনুরূপ সকল কথা মিথ্যা ও বানোয়াট।(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/১৩৭-১৩৯)।
এ জাতীয় ভিত্তিহীন একটি বাক্য হলোঃ “আমি আমার প্রভুকে একজন দাঁড়ি গোফ উঠেনি এমন যুবকরূপে দেখেছি।”- এ জঘন্য কথাটিকে মুহাদ্দিসগণ জাল বলে ঘোষণা করেছেন। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওযূ’আত ১/৮০-৮১, সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৮-৩১, মুল্লা আলী কারী, আল আসরার ১২৬ পৃ.)।
অনুরূপভাবে উমরের(রা) নামে জালিয়াতগণ বানিয়েছে, “আমার প্রভুর নূর দ্বারা আমার অন্তর আমার প্রভুকে দেখেছে।” আলী(রা) এর নামে জালিয়াতগণ আরো জঘন্য কথা বানিয়েছে, “যে প্রভুকে আমি দেখিনা, সে প্রভুর ইবাদত আমি করিনা।”(সিররুল আসরার, পৃ. ৫৭-৫৮)।
২. ৭, ৭০ বা ৭০ হাজার পর্দা
সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “মহান আল্লাহর নূরের পর্দা রয়েছে।”(মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬১)। কিন্তু পর্দার সংখ্যা, প্রকৃতি ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়না। কিছু হাদীসে মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর পর্দার সংখ্যার কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন ওয়াযে ৭০ হাজার নূরের পর্দা, ৭০ টি পর্দা, ৭টি পর্দা ইত্যাদি কথা বলা হয়। মুহাদ্দিসগণ বিস্তারিত আলোচনা ও নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, এই অর্থের হাদীসগুলি কিছু সন্দেহাতীতভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট কথা আর কিছু যয়ীফ, দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য কথা।
৩. আরশের নিচে বিশাল মোরগ বিষয়ে
আমাদের সমাজে ওয়াযে আলোচনায় অনেক সময় আরশের নিচের বিশাল মোরগ, এর আকৃতি, এর ডাক ইত্যাদি সম্পর্কে বলা হয়। এ সংক্রান্ত হাদীসগুলি ভিত্তিহীন, বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল।(সুয়ূতী, লাআলী ১/৬০; ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/১৫৫, ১৮৯)।
৪. যে নিজেকে চিনল সে আল্লাহকে চিনল
আমাদের সমাজে ধার্মিক মানুষের মাঝে অতি প্রচলিত একটি বাক্য হলো- “যে নিজেকে জানল, সে তার প্রভুকে জানল।” অনেক আলেম তাঁদের বইয়ে এই বাক্যটিকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা বলে সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে বলেছেন যে, এই বাক্যটি রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা নয়, কোনো সনদেরই তাঁর থেকে বর্ণিত হয়নি। কোনো কোনো মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, বাক্যটি তৃতীয় হিজরী শতকের একজন সূফী ওয়ায়েয ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ায আল-রাযী(২৫৮ হি)-র নিজের বাক্য। তিনি ওয়াজ নসীহতের সময় কথাটি বলতেন, তার নিজের কথা হিসেবে, হাদীস হিসেবে নয়। পরবর্তীতে অসতর্কতাবশত কোনো কোনো আলিম কথাটিকে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
৫. মুমিনের কালব আল্লাহর আরশ
আমাদের সমাজে ধার্মিক মানুষের মাঝে বহুল প্রচারিত একটি বাক্যঃ“মুমিনের হৃদয় আল্লাহর আরশ।” এ বিষয়ে বিভিন্ন বাক্য প্রচলিতঃ “হৃদয় প্রভুর বাড়ি।” “মুমিনের হৃদয় আল্লাহ আরশ।” “আমার যমিন এবং আমার আসমান আমাকে ধারণ করতে পারেনি, কিন্তু আমার মুমিন বান্দার কলব বা হৃদয় আমাকে ধারণ করেছে।”- এগুলি সবই বানোয়াট বা জাল হাদীস। কোনো কোনো লেখক এই বাক্যগুলিকে তাঁদের গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের হাফেয যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণ অনেক গবেষণা করেও এগুলোর কোনো সনদ পাননি, বা কোনো হাদীসের গ্রন্থে এগুলোর উল্লেখ পাওয়া পাননি।রাসূলুল্লাহ(সা)হতে কোনো সনদেই এ সকল কথা বর্ণিত হয়নি। এজন্য তাঁরা এগুলিকে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীসের মধ্যে গণ্য করেছেন। (মুল্লা আলী কারী, আল আসরার, ১৭০ ও ২০৬ পৃ., আল-মাসনূয়, ১০০ ও ১৩০ পৃ.)।
৬. আমি গুপ্তভান্ডার ছিলাম
প্রচলিত একটি বানোয়াট কথা যা হাদীস নামে পরিচিতঃ “আমি অজ্ঞাত গুপ্তভান্ডার ছিলাম। আমি পরিচিত হতে পছন্দ করলাম।তখন আমি সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করলাম; যেন আমি পরিচিত হই।”
ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, সমাজে প্রচলিত জাল হাদীসগুলি দুই প্রকারের। এক প্রকারের জাল হাদীস যেগুলির সনদ আছে এবং কোনো গ্রন্থে সনদসহ তা সংকলিত আছে। সনদ নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ সেগুলির জালিয়াতি ধরে ফেলেছেন। দ্বিতীয় প্রকারের জাল হাদীস যেগুলি কোনো গ্রন্থেই সনদসহ বর্ণিত হয়নি। অথচ লোকমুখে প্রচলিত হয়ে গিয়েছে এবং তার সূত্র ধরেই কোনো কোনো আলিম তাঁর গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন। এই প্রকারের সম্পূর্ণ অস্তিত্ববিহীন ও সনদবিহীন বানোয়াট একটি কথা হলো এই বাক্যটি।(ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুসসাস, পৃ.৫৫; মোল্লা আলী কারী, আল আসরার পৃ. ১৭৯)।
৭. কিয়ামাতে আল্লাহ মানুষদেরকে মায়ের নামে ডাকবেন
আরেকটি বানোয়াট ও মিথ্যা কথা হলোঃ কিয়ামাতের দিন আল্লাহ মানুষদেরকে মায়ের নামে ডাকবেন। এই বাক্যটি একদিকে বানোয়াট বাতিল কথা, অন্যদিকে সহীহ হাদীসের বিপরীত। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলিত বিভিন্ন সহীহ হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, কিয়ামতের দিন মানুষদের পরিচয় পিতার নামের সাথে প্রদান করা হবে। বলা হবে, অমুক, পিতা অমুক বা অমুক ব্যক্তির পুত্র অমুক।(সাখাবী, আল মাগাদীস, পৃ. ১৩৯; সুয়ূতী আল লাআলী ২/৪৪৯)।
৮. জান্নাতের অধিবাসীদের দাড়ি থাকবেনা
জান্নাতের অধিবাসীদের দাড়ি থাকবেনা, সবাই দাড়িবিহীন যুবক থাকবে। শুধুামাত্র আদম(আ) এর দাড়ি থাকবে। কেউ বলছে শুধু মূসা(আ) বা হারূন(আ) এর দাড়ি থাকবে বা ইবরাহীম(আ) ও আবু বকর(রা) এর দাড়ি থাকবে। এগুলি সবই মিথ্যা ও বানোয়াট কথা।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৩/৩৯৩; মুল্লা কারী, আল আসরার, পৃ. ৭৫)।
৯. আল্লাহ ও জান্নাত জাহান্নাম নিয়ে চিন্তা ফিকির করা
প্রচলিত একটি মিথ্যা হাদীস হলোঃ “মহান আল্লাহর মহত্ত্ব, জান্নাত ও জাহান্নাম নিয়ে এক মুহুর্ত চিন্তা ফিকির করা সারা রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ার চেয়ে উত্তম।”(ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/১৪৮)।